অরণ্যর SUV গাড়িটা মুম্বাই এর এক পাঁচতারা হোটেলে ঢুকতেই শোরগোল পড়ে গেল চারিদিকে। জাতীয় দলের একজন জনপ্রিয় ক্রিকেটার অরণ্য চ্যাটার্জি। লোকারণ্য হোটেল লবি। এখন ICCR এ রাঙ্কিংএ অরণ্যর জায়গা বেশ ওপরের দিকে। নিজের রুমে এসে ব্যাগটা রেখেই ইন্টারকমে একটা জুস অর্ডার দিল। তারপর শাওয়ার এর নীচে এসে মগ্ন হয়ে দাঁড়াল অরণ্য। টানা সিরিজ খেলতে খেলতে ক্লান্ত। অরণ্য টুরে এলে বাড়িতে বেশি ফোন করে না, তিনবছরের মেয়ে রাইকে রাতে একবার করে ভিডিও কল বড় জোর। নিজের চাকরি ও রাইকে সামলে সংসার নিয়ে নাভিশ্বাস ওঠে সুকন্যার। অরণ্য জানায়“Reached safely. Love u, baby.” অরণ্য অনেকবার বলেছে সুকন্যাকে চাকরি ছাড়তে, কিন্তু সে রাজি হয়নি। রাই হওয়ার আগে সাউথ আফ্রিকা টুরে গিয়ে গগনচুম্বী হোটেলের ঘরে মখমলি বিছানায় গা ডুবিয়ে, অরণ্যর বুকে নাক ঘষতে ঘষতে সুকন্যা বলেছিল “এত দেশ বিদেশ ঘোরো– কোন সুন্দরীকে পেয়ে আমাকে যদি ভুলে যাও- খুব ভয় লাগে আমার, বল আমাকে ছেড়ে যাবে না তো কোনওদিন…” অরণ্য কোন উত্তর দেয়নি- শুধু তার ঠোঁট ডুবিয়ে দিয়েছিল সুকন্যার ঠোঁটে।
(২)
আজ রাইএর ক্লাস ফাইভের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়ে ছুটি পড়ল। সুকন্যার স্কুলেও তাই। অরণ্যও এখন বাড়িতে। ওরা এবার মরিশাস ঘুরতে যাবে ঠিক করেছে। এই ঘুরতে যাওয়ার আরও একটি কারণ আছে। অরণ্যর গত দু’বছর ধরে ঘুমের মধ্যে একটা panic attack হচ্ছে। খুব ভয় পেয়ে থাকে। ওর শুধু মনে হয় একটা আবছা মেয়ের মুখ ওকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। অরণ্যর কেরিয়ারে যদিও এর কোন ছায়া পড়েনি, কেরিয়ার গ্রাফ আপরাইসিং রেখেই সে এখন রিটায়ারমেন্টের কথা ভাবছে। সুকন্যা খুব কাছ থেকে এই ফেজে অরণ্যকে দেখছে। ওরই ডিসিশান এ এই ট্রিপ। খুব মজা করে ঘুরল ওরা, কিন্তু ফেরার দিন সমুদ্রের ধারে হঠাৎ করে অরণ্য আবার খুব রেস্টলেস হয়ে গিয়েছিল।
(৩)
আজ বেশ কয়েক বছর পর অরণ্য আবার মুম্বাই এসেছে। গত পরশুদিন রাই লন্ডন স্কুল অফ ইকনোমিক্স এ গ্র্যাজুয়েশন করতে চলে গেল। অরণ্য এসেছে মূলত নির্বাচক কমিটির একটি কাজে। এখন ওর panic attack টা আগের মত অতবার না হলেও হয় মাঝে মাঝে। সেই আবছা মেয়ের মুখটাকেই খুঁজে ফেরে সে। বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে অরণ্য চলে এসেছে মেরিন ড্রাইভে। চকিতে মনে ঝলসে ওঠে বহু বছর আগের কিছু খণ্ডচিত্র। তখন অরণ্য সবে সুযোগ পেয়েছে জাতীয় দলে। মুম্বাইতে এসেছিল একটি ঘরোয়া ম্যাচ খেলতে। প্রচন্ড মাথা ব্যথায় বেহুঁশ হয়ে রাস্তায় পড়ে গিয়েছিল সেবার। উদ্ধার করে বাড়ি নিয়ে আসেন এ অঞ্চলের নামকরা ব্যবসায়ী অমর্ত্য বসু। বিখ্যাত ডাক্তার বন্ধু কৃষ্ণেন্দুর চিকিৎসাতেই তখন মাথার টিউমারটা ডায়াগনোসিস হয়। ওঁওঁর মেয়ে ছিলেন সম্ভাবনাময়ী টেনিস খেলোয়াড় সুদেষ্ণা বসু। ঘরোয়া টুর্নামেন্টে বেশ পরিচিত নাম। অনেক ছোটতে মা মারা গিয়েছিলেন একটি দুর্ঘটনায়। তাই খেলার লাইনে গেলেও খুব বেশি বিদেশে যেতো না সুদেষ্ণা, বাবার কাছে থেকেই ওঁওঁর দেখাশোনা করত। অরণ্যকে যেদিন বাড়ি নিয়ে এলেন ওর বাবা, ওকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিল সুদেষ্ণা। খেলাধুলো, পড়াশুনো বাদ দিয়ে অরণ্যকে সুস্থ করে তোলাই ছিল ওর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। ওর আপ্রাণ চেষ্টায় দীর্ঘ তিনমাস পর স্বাভাবিক জীবনে ফেরে অরণ্য। পরে তার ব্রেন টিউমার রিমুভ হয়। কিন্তু মুম্বাই থেকে ফিরে অনেক কষ্টেও আর সুদেষ্ণাকে ধরতে পারেনি। উবে গেল হাওয়ায় সে….এত বছর তার কথা শত ব্যস্ততায় মনেও পড়েনি অরণ্যর। আজ বারবার মনে পড়ছে। ওর নাভিমূলে একটা তিল ছিল….সেখানে কতবার পরম আশ্লেষে…..
হাঁটতে হাঁটতে সমুদ্র থেকে অনেক দূরে চলে এল সে…এদিকেই কি ছিল সুদেষ্ণাদের বাড়িটা… একটা কফিশপে এসে বসল অরণ্য। সামনে একটা মেয়ে এসে দাঁড়াল “Anything, Sir?” সামনে মুখ তুলে তাকাতেই ধাক্কা– attack এর সময়ে দেখা মুখটা এক লহমায় পরিস্কার… এ যে একদম সুদেষ্ণার মুখের আদল৷ কাঁপা গলায় একটা ক্যাপুচিনোর অর্ডার দিয়ে মুখ ঢাকা সানগ্লাসটি পরে রিসেপশান ডেস্কে পৌঁছালো অরণ্য। নিজের পরিচয় দিয়ে মেয়েটির where abouts জানতে চাইলে ম্যানেজার খুব চাপা স্বরে জানালেন, “খুব ভালো মেয়ে স্যার, বাইরে পড়াশুনো করে, এখন বাড়ি এসেছে। মা ভাল টেনিস খেলত, প্লেন ক্র্যাশে মারা যায়। এখানে এলে মাঝে মাঝে আমাদের ক্যাফেতে কাজ করে পার্ট টাইম, যদিও দাদুর যা সম্পত্তি বসে শেষ করতে পারবে না।” এই বলে উনি অরণ্যকে একটি মেইল পাঠালেন গোপনে। লেখা ছিল —
Dayita Chatterjee
Mother’s Name: Sudeshna Basu Chatterjee
(Daughter of a single mother)
নত মস্তকে কফিশপের বাইরে এল তারকা অরণ্য চ্যাটার্জী। বছর কয়েক হল রিটায়ার করলেও তিনি এখনও ক্রিকেটমহলে বেশ পরিচিত মুখ। মেয়েটি ততক্ষণে কফি টেবিলে দিয়ে গেছে। অরণ্যর ভেজা চোখে তখন অস্তরাগের প্রতিফলন।