‘বাব্বাহ! কী রাগান্বিত ছবি ডিপিতে! রাগকুমারীর প্রোফাইলটা ঘুরে আসি তো।’ বলে শুভ ঢুঁ মারল জেবার প্রোফাইলে।
জেবা খুবই প্রাণবন্ত, চাঞ্চল্যকর একটা মেয়ে। প্রোফাইলের পোস্ট দেখলেই তা বুঝা যায়।
শুভ যেন তার প্রিয়া হিসেবে এমন একটা মানুষই খুঁজছিল।কিন্তু জেবার সিট খালি আছে কিনা কে জানে! মনে হয় না এই মেয়ে সিঙ্গেল আছে এখনও। ভার্সিটি পড়ুয়া এমন প্রাণবন্ত মেয়েরা সিঙ্গেল থাকে নাকি! শুভ মনে মনে এগুলোই ভাবছিল। এমন সময় শুভর বন্ধু রাহাত টেক্সট করল,
‘কিরে দোস্ত কি করছিস?’
‘মিঙ্গেল হওয়ার প্রচেষ্টা, হি হি হি।’
‘শালা, এসব তোর দ্বারা হবে না। মেয়ে দেখলে মিউমিউ করিস, গলায় ব্যাঙ লাগে, জলপ্রপাতের মতো চিকন ঘাম নেমে আসে। আর তুই করবি প্রেম? হাসাইলিরে দোস্ত।’
রাহাতের এই হাসিকে উপেক্ষা করে শুভ বলল, ‘আর কিছু বলব না, ডুবে ডুবে জল খাব। যা তুই শালা দূরে থাক। বুদ্ধি দিবি কয়, তা না করে মজা নিচ্ছিস।’
শুভ অপেক্ষা করছিল কখন জেবা অনলাইনে আসে। নাহ, মেয়েটা অনলাইনে আসলো না ওইদিন। তবুও শুভ কথা বলার লোভ সামলাতে না পেরে টেক্সট দিয়েই দিল,
‘আসসালামু আলাইকুম! কেমন আছেন?’
দু’দিন পর জেবা টেক্সট সিন করলেও রিপ্লাই না দেওয়াতে শুভ ধরেই নিল জেবার সিট ব্লকড।
রাগকুমারী চড়ুইপাখিটা মিঙ্গেল ভাবতেই শুভ’র মন খারাপ হয়ে গেল। প্রায় ৩-৪ দিন পর শুভ মেসেঞ্জারের নোটিফিকেশন দেখে মনে হচ্ছিল যেন সে আকাশে ইদের চাঁদ দেখেছে।
‘ওয়া আলাইকুমুসসালাম। কোন দরকার?’ জেবা রিপ্লাই দিল।
‘কেন দরকার ছাড়া কি কথা বলা যায় না?’
‘অবশ্যই না, শুধু শুধু কেন আপনার সাথে আমি বকবক করতে যাব।’
‘কথা বলাকে বকবক বানিয়ে দিলেন!’
‘কাজের কথা হলে কথা, অকাজের হলে তা বকবক।’
‘ওহ আচ্ছা! জানা ছিল না। আপনার ডিপিতে দেওয়া ছবিটা সুন্দর। বেশ ইউনিক।’
‘এইটা আমি না ভাইয়া, তামিল নায়িকা রাসি খান্না।’
‘এত সুন্দর করে ভাইয়া ডাকিয়েন না। কর্ণকুহরে প্রবেশ করতে কষ্ট হয়, শ্রুতিমধুর লাগে না।’
‘তো আংকেল ডাকি, কি বলেন! হি হি হি’
এভাবেই শুভ আর জেবার মধ্যে খুনসুটি হত। ধীরে ধীরে খুনসুটির পরিমাণ বেড়ে গেল। একদিন কথা না হলেই শুভর অস্থির লাগে। শুভ ভীষণ ভালোবাসে জেবার প্রাণচাঞ্চল্যকর কথাবার্তা। জেবার কথা, দুষ্টামিতে শুভর সকল দুঃখ, হতাশা, মনখারাপি কর্পূরের ন্যায় উবে যায়। শুভ সারাক্ষণ অপেক্ষায় থাকে কখন জেবা অনলাইনে আসবে।
২
পরিচয়ের প্রায় ৩-৪ মাস পর শুভ ভয়ে ভয়ে একদিন বলল তার পছন্দের কথা, জেবার প্রতি যে অনুভূতিগুলো মনগহিনে বাক্সবন্দি করে রেখেছিল তা মুক্ত করে দিল জেবার সামনে। এই ধরনের কথাবার্তা শোনে জেবা যেন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। বলল,
‘আপনাদের ছেলেদের এই এক স্বভাব। যে কারো প্রেমে পড়ে যান, যখন তখন প্রেমে পড়েন। যাকে তাকে প্রেম নিবেদন করেন। লজ্জা করে না আপনাদের এভাবে যে কাউকে প্রেম নিবেদন করতে। প্রেম তো এত সস্তা না, প্রেম হবে একজনের জন্য যে সোল-মেট। আপনার আবেগ আপনি ভিতরেই রাখেন, পরে কাজে লাগবে।’
জেবার কথায় একটুও মন খারাপ করেনি শুভ। জেবা যা বলেছে তার দিক থেকে ঠিকই বলেছে। হয়তো মেয়েটা প্রায়ই এমন পরিস্থিতিতে পড়ে। এজন্য রাগটা ঝেড়ে নিল। তবে জেবার চিন্তা ভাবনার সাথে শুভ’র চিন্তা ভাবনা একদম মিলে গেল। শুভও ভাবে সে একজনকেই ভালোবাসবে। একজনই হবে তার প্রেয়সী।
ওইদিনের পর প্রায় অনেকদিন জেবা অনলাইনে আসেনি। শুভ প্রায় পাগলপারা। অচেনা, অদেখা, অজানা এক পাখি কি পাগল করে দিল তাকে। মনের ব্যালকনিতে পাখিটা সারাক্ষণ উড়াউড়ি করে। শুভ দূর থেকে শুধু কল্পনা করতে পারে, ধরতে পারে না, দেখতে পারে না। পাখিটা কি হারিয়ে গেল! শুভর মন বিষণ্ণতায় ছেয়ে গেল। এক অতলান্ত পরিমাণ বিষণ্ণতা নিয়ে শুভ জেবাকে লিখল,
‘কেন এত বৈরিতা
উত্তাপে পোড়ে চারপাশ,
কেন এমন অবহেলা
জনজীবনে শুধু হাঁসফাঁস।
কোন সে অকালে
রক্তজবা ঝরে যায়,
কোন সে ক্ষণে
মাঝি পথ হারায়।
প্রাণ নেই কোথাও
আজ সজীবতা শূন্য,
গগন পানে চেয়ে
থাকে বৃষ্টির জন্য।
কোন বিরহে উন্মত্ততা
পথিকের ছাতি ফাটে,
দোলে না আর মন
ছুটে নদীর ভাটে।
বৃষ্টি বিহীন শ্রাবণ
মনে হয় না আপন,
বেঁধেছিলাম কত স্বপন
এখন শুধুই মরণ।
বেমানান শ্রাবণ বৃষ্টি ছাড়া
রৌদ্রতাপে সব নিষ্প্রাণ,
কোন অবহেলায় শ্রাবণ
হারাল যৌবনের গান।
অনেক চেনা শ্রাবণ
মুষল ধারের বৃষ্টি,
খুব করে হয় নাকো
নতুন সজীবতার সৃষ্টি।’
আমি আপনাকে খুব মিস করছি।
শুভ চাতক পাখির ন্যায় অপেক্ষায় থাকে কবে আসবে জেবা। কখন রাগান্বিত একটা টেক্সট করবে,’ন্যাকামো করেন। কবিতা সুন্দর হয়নি। এমন বাজে কবিতা আমাকে আর দিবেন না।’
কিন্তু না জেবা রিপ্লাই দিল,
‘বাহ! সুন্দর লিখেন তো। আপনি লিখেছেন?’
‘হু।’
‘জানেন একবার এক ছেলে আমাকে কবিতা দিল, পাগলী আমার ঘুমিয়ে পড়েছে মুঠোফোন তাই শান্ত,
আমি এদিকে দিচ্ছি পাহারা পাগলী যদি তা জানত।
আমি ভাবলাম ছেলেটা নিজে লিখেছে আমার জন্য। আমি তো বেশ ইম্প্রেসড। পরে শুনি এইটা নির্মলেন্দু গুণের কবিতা। হাহাহা।’
‘হায় ভাগ্য! আমি নিজে লিখলাম তবুও কেউ পটে না আজ বেকার বলে।’
‘হা হা হা, সবকিছুতে বেকার বেকার করেন কেন?’
‘বেকার বলেই তো প্রেম নিবেদন করলাম, সাকার হলে বিয়ের প্রস্তাব দিতাম। পাখিটাকে আমার করে নিতাম। মনের ব্যালকনিতে হত পাখিটার দাপাদাপি। আপনার অনুপস্থিতিতে আমার জীবন মরুভূমি হয়ে যায়। আপনি বিশ্বাস করুন, প্লিজ।’
‘আপনি আমাকে দেখেননি, জানেন না আমার ব্যাপারে কীভাবে এত ভালোবাসেন। এগুলো কি আষাঢ়ে গল্প নয়!’
‘দেখুন প্রেম হয় মন দেখে। আপনার সম্পর্কে যা জেনেছি তা যথেষ্ট। আমি আপনার ভবিষ্যৎ হতে চাই, আপনার অতীত নিয়ে আমার কোন প্রশ্ন নেই। আমি আপনার আপনিটাকে ভালোবাসি, রূপ, গুণ নয়। আপনার সরলতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন,
আমি যে তোমাকে ভালোবাসি তা তোমার রূপের জন্যও নয়, গুণের জন্যও নয়।
ভালো না বেসে থাকতে পারি না বলেই ভালোবাসি।
আমি আপনাকে উৎসর্গ করলাম।’
জেবা বলল, ‘আমি প্রেম করব না, ভালবাসবো। কথায় কথায় আই লাভিউ, বাবু, সোনা বলব না। মাঝে মাঝে বলব, ওগো আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোনে কথা বলব না। তবে চুপিচুপি রাত জেগে বাঁকা অক্ষরে হাতে লিখা পত্র দিব। রেস্টুরেন্ট পার্ক দাপিয়ে বেড়াবো না তবে কুয়াশাছন্ন ভোরে চাদর মুড়িয়ে কুয়াশা বিলাস করব। ঝুম বৃষ্টিতে রিকশায় করে গন্তব্য-হীন ভ্রমণে বের হব। আমি চাইব না অর্কিড, রজনীগন্ধা, গোলাপের স্টিক। কুড়ানো বকুল, শিউলি, কাঠগোলাপ, কিংবা কচুরিপানাতেই আমি সুখ খুঁজে পাই। আমি চাইব না দামী হীরা, কোহিনূর, সোনার চুড়ি, রেশমি চুড়ি, আমার তুমিটার পাঞ্জাবির রঙে মিলিয়ে আমার একটা তাঁতের শাড়ি বা জামদানি হলেই আমি খুশি। আমি চাই এক জোড়া হাত যা একান্তই আমার হবে, আর গোটা মানুষটা আমার আয়না হবে। আমি জ্বালাব, খুব জ্বালাব। মানুষটা সহ্য করবে। আর বলবে তুমি জ্বালালে অস্থির লাগে, না জ্বালালেও অস্থির লাগে। তুমি বরং আমাকে জ্বালিয়ে অস্থির করো।
আমি একটা তুমি চাই, একান্ত আপন একটা তুমি। আমি তার প্রেমিকা হতে চাই না প্রেয়সী হতে চাই। যাকে নিয়ে জান্নাতে থাকার স্বপ্ন দেখতে পারব। তুমিটা হবে আমার চিরস্থায়ী তুমি। আমার আপনার আপনজন।’
‘আপনি কি হবেন আমার এমন তুমি! হবেন না কেউই হবে না। কারণ আমি নিজেই যে আমি না। আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেনন না প্লিজ। আমার সেই যোগ্যতা নেই কাউকে আপন করার। আমি চাই না আমার জন্য কেউ কষ্ট পাক। আমি নিজেও দুর্বল হয়ে পড়ব আমি মায়া বাড়াতে চাই না। প্লিজ আপনি আমাকে আর এইসব বলবেন না। প্লিজ।’মেসেজ পড়ে শুভ থ হয়ে গেল। এমন বলছে কেন মেয়েটা। ওর যোগ্যতা নেই মানেকী!
শুভ বলল, ‘আমি সব কিছু মেনে নিব। আমি আপনাকে বিয়ে করব শুধু জবটা হোক। আমি কিছুই শুনতে চাই না। আর এইসব কি বলছেন আমাকে খুলে বলুন, কিছুই বুঝতেছি না।’
প্রায় অনেকদিন অনেক রিকুয়েস্টের পর জেবা যা বলল তা শুনে শুভর মনটা ভেঙে গুড়ো গুড়ো হয়ে গেলেও জেবাকে আরও তীব্রভাবে ভালোবেসে ফেলল শুভ। শুভ শুধু চায় ভালোবাসা অমর হোক, চিরস্থায়ী হোক।
৩
প্রায় ১ বছর পর তাদের দেখা হল। এক অন্যরকম অনুভূতি। আপনি তুমি বিভ্রাটের খেলা। লজ্জায় লাল হওয়া, মুচকি হাসি, আড়চোখে তাকানো। চারদিকে শত প্রজাপতির উড়া-উড়ি। মৃদুমন্দ হাওয়ায় ফুলেদের মাথা দোলানো। একটু পরপর পাখিদের কিচিরমিচির। আকাশের মেঘগুলোও যেন সাজিয়ে নিয়েছে নিজেকে। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর আজ প্রেমিক তার প্রেম প্রেয়সীর দেখা পেয়েছে।
দুজন দুজনের জন্য নিয়ে এসেছে আবেগে ঠাসা চিঠি। খুব সুন্দর একটা দিন কাটানোর পর এবার বিদায়ের পালা। আফটার অল, এভরি হাই এন্ড উইথ গুডবাই।
শুভর চিঠি:
‘প্রিয়া, কি বলে সম্বোধন করব তোমায়! তুমি আমার জন্যে কাঠগোলাপ। হাসনাহেনা, রজনীগন্ধা, গন্ধরাজের সুবাস তুমি দূর থেকেই পাবে কিন্তু কাঠগোলাপের সুবাস নিতে গেলে তার কাছে যেতে হবে। জেবা তুমি আমার কাঠগোলাপ। ভালোবাসার সংজ্ঞা আমার জানা নেই। ভালোবাসার সংজ্ঞা তুমি যা দিবে তাই। আমি শুধু তোমাকেই চাই।
অনেক দামে কেনা প্রথম রবির করে,
সোনালী এক ভোরে প্রথম হল জানা।
অনেক সুখে চেনা, বৃষ্টিস্নাত কদম ফুলে
মহুয়া-বনে মৌসন্ধ্যা দোলে, মায়াবী জাল বোনা।
অনেক আলোয় ভরা, দিনের প্রতিটি সময়
অথবা বর্ণিল গোধূলিময়, উচ্ছ্বসিত মন বাঁধনহারা।
অনেক পরশ মাখা, ভাবনায় বিভোর থেকে
রংধনুর সাত রং মেখে সন্ধ্যা লগ্নে চেয়ে থাকা।
অনেক আশায় বাঁধি, ছোট-খাটো কত চাওয়া
হোক পাওয়া না-পাওয়া, বইবে অচিন নদী।
অনেক কথার বুলি, শত গল্পের মাঝে
সকাল কিংবা সাঁঝে অনিকেত প্রান্তরে চলি।
অনেক আদরের তুমি, প্রানচঞ্চলতায় ডুবে থাকো
যাবে নাকো বেঁধে রেখে খুশির রাজ্যের খনি।
অনেক মনকাড়া হাসিমুখে, প্রণয়ে বিরহে পাশাপাশি।
দূরে তবুও কাছাকাছি ভাসব সুনীল সুখে।
শারদ জ্যোৎস্না রাতে মহুয়া বনের তটে,
পাশাপাশি বসে দুজন চেয়ে থাকব আঁখিপটে।
নিস্তব্ধ আমরা তখন ভাবব কত কথা,
এখনকার দিনগুলি সব প্রণয়ে বিরহে গাঁথা।
আমার বাহুডোরে তুমি, বাঁধবো প্রেমের বাঁধনে,
কেটে যাবে অনন্তকাল, থাকব তোমার সনে।
এইভাবে কেটে যাবে সকাল দুপুর রাত,
ছুটে চলব মোরা হাতে রেখে হাত।
আমি খুব করে চাই তুমিই হও আমার জীবনসঙ্গিনী, আমার অর্ধাঙ্গিনী।
প্রিয়ান্তে,
শুভ।’
শুভর চিঠি পড়ে জেবা খুব করে কেঁদে নিল যেমন কাঁদে আকাশ। কুয়াশা আকাশের গোপন কান্না, যা কেউ বুঝে না তবুও আকাশ কাঁদে। জানে কেউ জিজ্ঞাসা করবে না কেন কাঁদছে, তবুও সে কাঁদে প্রিয় জিনিসের জন্যে হয়তো বা।
মান অভিমান খুনসুটিতে কেটে গেল প্রায় তিন বছর। শুভর কোথাও কোন জব হয়নি। এদিকে জেবা প্রায়ই খুবই রাগারাগি করে, মেজাজটা কেমন খিটখিটে হয়ে গেল জেবার। শুভ বুঝতে পারে না কেন এই পরিবর্তন জেবার মধ্যে। দু’জন দুই এলাকার বলে ওদের মধ্যে দেখাও হয়েছে হাতে গোনা ৩-৪ বার। চিঠি-পাগলী এখন চিঠিও দিতে বলে না, হুট-হাট আবদার করে বলে না একটা কবিতা লিখেন তো। শুভর মন ছেয়ে থাকে বিষণ্ণতায়। কি হল জেবার! কিছু জিজ্ঞেস করলেও জেবা কিছু বলে না। অজানা কোন এক কারণে তীব্র অভিমান করে আছে অভিমানী মেয়েটা। কিন্তু কি সেই কারণ!
একদিন হুট করে তেমন কোন কিছু না বলেই জেবা জানিয়ে দিল ও আর শুভর সাথে যোগাযোগ রাখবে না। জেবা এক কথার মানুষ, সে তার সিদ্ধান্তে অটল। শুভকে কোন কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই জেবা যোগাযোগ বন্ধ করে দিল। শুভ জানে মেয়েটা ওকে বড্ড ভালোবাসে। শুভ রাগ করতে পারে না জেবার ওপর। প্রাণচাঞ্চল্যকর এই মেয়েটা ভেতরে ভেতরে খুবই দুঃখী। শুভ পরম আপন করে নিতে চাই এই দুঃখী মেয়েটাকে। সে প্রমাণ করতে চায় সত্যিকারের ভালোবাসা আজো পৃথিবীতে বেঁচে আছে।’হে নিষ্ঠুর সমাজ, কেন এত নিয়মকানুন তোমার! একটা চাকরির জন্যে আজ আমি আমার প্রেয়সীকে আপন করে নিতে পারছি না। বেকার ছেলেকে কেউ মেয়ে দিতে রাজি হয় না। ইনশাআল্লাহ! এ আঁধার একদিন ঘুচবে দেখা মিলবে সূর্যদ্যুতি, ততদিন আমার জেবা ফুল হয়ে ফুটে থাকুক।’ আকাশের দিকে তাকিয়ে শুভ আনমনে বিড়বিড় করে।
যোগাযোগ-বিহীন কেটে গেল প্রায় দেড় বছর। কিন্তু একটা দিন একটা মুহূর্তের জন্যেও কেউ কাউকে ভুলে যায়নি। দু’জন দু’জায়গায় থেকেও আশার আলোটাকে জিইয়ে রেখেছে পরম যত্নে। কবি বলেছিল, ‘আউট অফ সাইট আউট অফ মাইন্ড।’ এই বাক্য শুভ জেবার বেলায় মিথ্যে ঠেকল। দৃষ্টির আড়ালে থাকলেও ওরা একজন অন্যের হৃদ প্রকোষ্ঠে জায়গা করে নিয়েছিল।
৪
প্রায় দেড় বছর পর হুট করেই একদিন বিয়ে হয়ে গেল তাদের। যদিও শুভর ফ্যামিলির কেউই রাজি ছিল না এ বিয়েতে। জেবা নিজেও রাজি ছিল না। জেবা চেয়েছিল শুভ ভাল থাকুক, সুখে থাকুক। কিন্তু শুভর সুখ সব জেবাতেই বিদ্যমান। ভালোবাসার দামে ভালোবাসা কিনে নিল শুভ। বিয়ের দিন রাতে আলতো করে জেবার হাতটা নিজের কোলে টেনে নিয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুভ বলল, ‘জেবা আমি পাইলাম। আমার আপনার আপনকে আজ আপন করে নিলাম। তোমাতেই আমার সকল সুখ, আমি এখন সুখের রাজ্যের রাজা।’ জেবা ওইদিন কিছুই বলেনি, শুভকে জড়িয়ে ধরে মন ভরে কেঁদে নিয়েছে। শুভ মানা করেনি শুধু বলেছিল আজই শেষদিন কান্না করে নাও, আর কোনদিন এই সুযোগ তোমাকে দেওয়া হবে না।
রাতভর কান্না করে শুভর বুকেই মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল চড়ুই পাখিটা। আর শুভ সারারাত ধরে তাকিয়ে ছিল তার পাখিটার দিকে আর বলছিল, ‘একদিন সূর্য নিভে যাবে, আকাশ ভেঙে পড়বে, চাঁদ তারা খসে পড়বে, পৃথিবী জনশূন্য হবে সেইদিন ও রয়ে যাবে আমার ভালোবাসা। আমি হারাব না পাখি, তোমাকে আগলে রাখব অনন্তকাল ধরে। তুমি আমাকে ছেড়ে গেলেও আমি তোমাকে ছেড়ে যাব না। আই লাভ ইউ এ লট। এ লট টু দ্যা পাওয়ার ইনফিনিটি!’
শুভ ঠিক তেমন করে সব গুছিয়ে নিয়েছিল যেমন বলেছিল জেবা। জেবার মন মতো করে সাজিয়ে নিয়েছিল সংসার। দক্ষিণে বারান্দা পাশে কাঠগোলাপ গাছ। উঠোনের কোণে এক টুকরো বাগান। পুরো বাড়িতে ফুলের মেলা আর প্রজাপতির উড়া-উড়ি। পটে আঁকা ছবির মত ছোট্ট একটা পড়ার ঘর।
যতই দিন যাচ্ছিল জেবা তীব্রভাবে ভেঙে পড়ছিল। শুভকে একা করে ও কীভাবে চলে যাবে! প্রকৃতির নিয়ম পালটানোর সাধ্য কারও নেই। শুভকে একা করে দিয়ে যেতে চাই না জেবা। জেবা খুব করে চাই তাদের ঘরে একটা ফুল ফুটুক। যে ফুল শুভকে সঙ্গ দেবে।
জেবার স্বপ্ন পূরণ হয়েছিল। ঘর আলো করে শুভ জেবার যমজ মেয়ে হল। জেবা চলে যাবে বলেই হয়তো বিধাতা ওকে এই পুরস্কার দিলেন। শুভ মেয়েদের নাম রেখে দিল ‘নয়ন মণি’।
নয়ন মণির ছ’মাস বয়সে, প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী দুনিয়ার মায়া কাটিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানকে ব্যর্থ করে দিয়ে জেবা চলে গেল না ফেরার দেশে। জেবা থ্যালাসেমিয়া মেজর প্রবলেমে আক্রান্ত ছিল। যারা মেজর প্রবলেমে ভোগে ২২-৩০ বছর বয়সের মধ্যেই তাদের মৃত্যু-ঝুঁকি থাকে। জেবা এই শত্রুর সাথে যুদ্ধ করে পেরে ওঠেনি। চলে গেল সকল মায়া কাটিয়ে। বিধাতা যাকে খুব বেশি ভালোবাসেন তাকেই তিনি এই রোগটা দেন। যেন বিধাতার ভালোবাসার বান্দা অন্যদের তুলনায় আগেই বিধাতার প্রিয় হয়ে যান।
শুভ সব জেনেশুনেই ভালোবেসে ছিল জেবাকে। জেবা বোকা মেয়ে সে ভাবত এই প্রবলেমের জন্য কেউ কখনও ওকে ভালবাসবে না। কিন্তু তীব্রভাবে একটা তুমিকে খুঁজত। জেবা কি জানে জেবা যতটা ভালোবাসতো শুভকে, এমন ভালোবাসা কেউ কখনও কাউকে বাসতে পারবে না।
শুভ এখনও ভালোবাসে তার জেবাকে ঠিক আগের মতোই। মনে মনে কত কথা হয় তাদের। জেবা খুব করে বলেছিল, আমি চলে যাবার পর আপনি আবার বিয়ে করে নিয়েন। প্লিজ নিজেকে কষ্ট দিবেন না। কিন্তু জেবা কি জানে জেবা বিহীন এমন কিছু ভাবাই শুভর জন্যে অনেক কষ্টের।
দিন কেটে যায় অপেক্ষায়।
জেবার সাথে ফের দেখা হবে এই অপেক্ষা।
‘জেবা তুমি-বিহীন আমি বেঁচে আছি। তোমার স্মৃতি আমাকে বাঁচিয়ে রাখে। দিন চলে যাচ্ছে। আমি একটু একটু করে অগ্রসর হচ্ছি সেই দিনের জন্য। যেদিন তোমার আমার ফের দেখা হবে।
দেখা হলে জিজ্ঞেস করিও তুমি-বিহীন কেমন ছিলাম! অভিমানী নেকি সুরে ভীষণ কেঁদে বলব তুমি-বিহীন আমি ভালো ছিলাম না। ভালো থেকো বলে গেলেই ভালো থাকা হয় না। আমি আকাশের দিকে তাকাই, দেখি মেঘেদের উড়া-উড়ি। রাতের আকাশে দেখি তারার ঝিলিমিলি, পুকুরের টলটলে পানিতে জ্যোৎস্না রাতের চাঁদ দেখি, ফুলে ফুলে প্রজাপতির উড়া-উড়ি দেখি, ফুল কুড়াই, বৃষ্টি ছুঁই। মন এঁটো হয়ে আসে, মনে মেঘ জমে। আমি নিশ্চুপ কাঁদি কুয়াশার মতো। যেমন আকাশ কাঁদে।’
‘তুমি তখন হাসো। ছেলেরা কাঁদলে তোমার হাসি পায় যে। তুমি কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলো, পাগল ছেলে! এত্ত তীব্রভাবে কেউ আমাকে ভালোবাসবে তা কখনও বুঝিনি। আমি চলে এসেছি বলে মন খারাপের কি আছে! চলে যাওয়া মানে বিদায় নয়, চলে যাওয়া মানে অনন্তকালের জন্য একত্রে থাকার অপেক্ষা করা মাত্র। আমাদের প্রেম চিরস্থায়ী হবে। অনন্তকাল ধরে ভালোবেসে যাব একে অন্যকে। যা শেষ হবার নয়।’
শুভ মুচকি হাসে। মনে মনে ভাবে, হুমায়ূন আহমেদ তার ‘অপেক্ষা’ উপন্যাসে বলেছিল, মানুষ অপেক্ষা করে জীবিতদের জন্যে, মৃতদের জন্যে নয়।
হুমায়ূন আহমেদের হয়তো জানা ছিল না, যারা অনন্তকাল ধরে ভালোবাসতে চায় তারা অপেক্ষা করে মৃতদের জন্যেও। প্রিয়দের সাথে ফের দেখা হবে সেই আশায়।