হাসপাতালের ওয়েটিং রুমে মশার কামড় খেয়ে খেয়ে গোকুলের ঘুম চটকে গেল। নাক ফস্কে পড়ে ভেঙে যাওয়ার ভয়ে, তার পুরোনো চশমাটি সাবধানে বাক্সে ঢুকিয়ে রাখল। জন্মানোর পরে মায়ের বুকের দুধে টান দেওয়ার আগে, বাবার চোখের চশমাটি সে কিছু না বুঝেই টান দিয়েছিল। পরে উত্তরাধিকারসূত্রে ওই চশমাটিই শুধু অর্জন করেছিল। গোকুল জন্মানোর কিছুদিনের মধ্যেই বউ মারা যাওয়ার পরে, চরিত্রবান নকুল, মৃত স্ত্রীর আত্মার শান্তির জন্যে আর বিয়ে করেনি। নিজের শরীরের শিহরনকে বাইপাস করতে ঈশ্বরের চরণে নিজেকে সঁপে দিয়েছে। ভাড়াবাড়ির ছোটঘরে এককথায় একা একা বড় হতে লাগল গোকুল। বাবার তো ছেলের দিকে তাকানোর সময়ই নেই। গোপালের ঘুম ভাঙানো, তিনবেলা ভোগ, সন্ধ্যারতি,শয়ন প্রভৃতি নিত্যকর্ম শেষ করে রাতের বেলায় বিছানায় গড়াতে যাওয়ার সময় মনে পড়ে ছেলের জন্যে খাতা কেনা হয়নি। ছেলেটির মন কিন্তু খাতা চাইছে না হয়তো বা লজেঞ্চুস। উপায় নেই। উত্তরাধিকারসূত্রে অকর্মণ্য নকুলের মূলধন ছিল শ্বশুরবাড়ির পয়সা। তাই বউ মরে একদিকে সুবিধাই হয়েছে। তিনটে পেটের জায়গায় এখন দুটো। মরা বৌয়ের বাপের বাড়ির কিছু সম্পত্তি পেয়ে সেই টাকায় ঠেলে গুতিয়ে কোনরকমে সংসার চালিয়ে যাচ্ছে, সকালে ভগবানের প্রসাদ খেয়ে কাটিয়ে দেন। প্রসাদ মানে সামান্য জল,বাতাসা ; দুপুরে শাকান্ন ; রাতে ছাতুমুড়ি। ছেলের ইচ্ছে করে একটু কাটলেট খেয়ে আসি বা মাংসের ঝোল। কাজেই বাপটি যেন দুচোখের বিষ। তার ভাবতে ভাল লাগে বন্ধুদের মত স্কুলের সামনের ঠ্যালাওয়ালার দোকান থেকে চটপটি খেতে বা আচার চাটতে বা পুজোতে পরতে নতুন কাপড় বা মাসে অন্তত একটা বচ্চনের ছবি দেখতে। দীর্ঘদিন বাপের কিপটেমি সহ্য করতে করতে ছেলেটি একদিন বাবার সিন্দুকের চাবি চুরি করে। সিন্দুক খুলে দেখে ভেতরে একটি টাকাও নেই,তবে যত্ন করে রাখা একটি বই, ‘হরিদাসের গুপ্তকথা ‘। তাহলে মানুষের দুটো হাতের সাথে অজুহাতও থাকে। পড়াশোনায় চিরকালই তার অনীহা। বইটির মর্ম বুঝতে না পারা নকুল, পুরনো বইয়ের দোকানে বইটিকে বিক্রি করে হাতে পায় কিছু টাকা। দেখে সিনেমা হলে চলছে গুরুর ছবি ‘শোলে ‘। হলের সামনে বিশাল লাইন, ব্ল্যাকে টিকিটের চড়া দাম। পরপর চীনাবাদামভাজা সহযোগে তিন তিনটে শো দেখে বচ্চনময় চোখে বাড়ি যখন ফিরছিল, পকেটে পড়ে রয়েছে শুধু নোনতা ছেঁড়া টিকিটের কাউন্টারপার্ট। পকেট খালি হয়ে যাওয়ার পর মনে পড়ল, বাবা বলেছিল ‘রেখে খাবি ‘। বাবার কিপটেমির প্রতি গোকুলের শ্রদ্ধায় মন ভরে যায়। সে ঘরে ঢুকে দেখে চৌকির ওপরে বাবা মুখ খুলে ঘুমাচ্ছে। ছেলে এসে বাবার পদসেবা করতে থাকে আলতো করে,ঠিক যেন বাবাকে বলছে, ” তুমি ঠিকই সাবধান করেছিলে, এত খরচ করা উচিত হয়নি। ” এদিকে বাপের চোখে ঘুম নেই। সিন্দুকরহস্যের কথা ছেলে জানতে পেরেছে জেনে নকুলের ঘুম অনেক আগেই ছুটে গেছে।
একবার পয়সার গন্ধ পেয়ে ছেলেটা রোজগারের কথা ভাবতে থাকে। তাকে বড় হতে হবে। সে এই ভাড়া বাড়িতে থাকবে না। অনেক টাকা ভাড়াতেই বেরিয়ে যায়। সে টাকা জমাবে। একদিন বড় বাড়ি করবে। অর্থচিন্তায় অনর্থ চলে আসে। সেদিনের সিনেমাহলে পরিচয় পাওয়া ব্ল্যাকারদের সাথে তার নিবিড় বন্ধুত্ব স্থাপিত হয়। নতুন বন্ধুরা নিয়ে গেল জুয়োর আড্ডায়। ধীরে ধীরে ছেলেটা স্কুল ফাঁকি দিয়ে জুয়োখেলাতেই মনোনিবেশ করে। একাগ্রতা আর অধ্যবসায়ের গুণে অল্প বয়েসেই এলাকার সুদক্ষ জুয়ারিতে পরিণত হয়। ঈশ্বরপ্রাণ বাপের কানে কথাটা উঠলে, চিন্তায় পড়ে ছেলের মধ্যে তার কৈশোরের সমস্ত গুণ ফুটে উঠেছে। রোজগার করা ভাল কিন্তু একবার শ্রীঘরে ঢুকলে পুলিশে তো কম টাকা খিঁচবে না। দিনরাত গোপালের কাছে কান্নাকাটি করলেন,” ঠাকুর ছেলের একটা ব্যবস্থা করো। ” নকুলের এতদিনের সাধনায় আর ইদানীং ঘ্যানর ঘ্যানরে তিতিবিরক্ত হয়ে ঘনশ্যামের কৃপায় ছেলেটা খানিক দৌড়ঝাঁপ আর জুয়োতে জমানো কষ্টের টাকা ঘুষ দিয়ে সেই পুলিশের চাকরিতেই ঢুকল। পোস্টিং কিন্তু বাইরের রাজ্যে। ছেলেটা যেদিন চাকরি করতে গেল, বাপের চোখে আনন্দাশ্রু। পেটের ভাতের জন্যে ছেলেকে ঘরের ভাত ত্যাগ করতে হল !” কী খাবে, কী পড়বে? ” বাপের চোখের জল দেখে, প্রতিবেশীর দুচোখ ভেসে গেল। ছেলের পাঠানো প্রথম মাইনার টাকায় নকুল আবার কিনে আনলেন গুপ্তকথা। এবারের বইটি ঝকঝক, নতুন। অবশ্য পাড়া প্রতিবেশী জানতে পারল ছেলে চাকরি পাওয়ায় বাপে দিনরাত কীর্তন, ভজন,হরির লুটে পয়সা উড়িয়ে যাচ্ছে। সাধনসঙ্গীর দল জুটেছে। যদিও দলে সঙ্গিনীই বেশী। তবে আনন্দ বেশিদিন স্থায়ী হল না। সাধন সঙ্গিনীর অত্যাচারে নকুল একদিন চৌকি ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়ল। বুকে, কোমরে পেল ভীষণ চোট। নকুলের মর্ত্যধামের সময় প্রায় শেষ। তার নিষ্ঠায় নিশ্চয় কোন ফাঁকি ছিল। জীবনের শেষ সময়ে গুপ্তকথা হারিয়ে ফেলল। অগত্যা বুকে গীতা চেপে নকুল চন্দ্রবিন্দুর পথে পাড়ি দিচ্ছে।
ছেলে এদিকে ট্রাফিক পুলিশে ভরদুপুরে মালবোঝাই ট্রাকের থেকে টাকা কাচিয়েই চলেছে। চাকরি পাওয়ার পরেই নকুল ছেলেকে দীক্ষা দিয়ে দেন। সবসময় মন যেন ঈশ্বরে লীন থাকে। ছেলেও বাপের কথা মেনে, ডানহাতে সৎভাবে কামিনী আর কাঞ্চন গ্রহণ করে। অগ্রপশ্চাৎ পায়ুসংক্রান্ত কাজ বাদ দিয়ে, ছোট থেকে ডানহাতে সব কাজ করা গোকুলের চাকরিসূত্রে দুহাত সমানে চলে। বাপের কাছে ডানহাতের রোজগার চলে যায় আর বাঁ-হাতের টাকা জমতে থাকে। একদিন সে তার স্বপ্নের বাড়ি নিশ্চয় বানাবে। বাপের চোখে নিজের যৌবনের স্মৃতি এখনো বিস্মৃতি হয়নি। ছেলেকে নিয়ে তাই একটু চিন্তা। অচেনা জায়গায় গিয়ে ছেলে কোনও মেয়েমানুষের খপ্পরে না পরে। তাই চাকরি পাওয়ার বছরখানেকের মধ্যেই ছেলের বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। ছেলের শ্বশুরবাড়ির যৌতুকের টাকা ছেলেকে না দিয়ে নিজেই আত্মসাৎ করেছে। সাধনসঙ্গিনীর পেছনে কম খরচ ! ছেলের, বৌটাকে একদম পছন্দ হয়নি। গলায় গলকম্বল, পেটের চামড়া ঝুলে গেছে, সারাদিন খসর খসর করে গা চুলকাতে থাকে। বাইরের রাজ্যে একটা লোকের পেটখরচ অনেক বেশি আর হাতখরচের কথা বাদই দিল তাছাড়া মেয়েমানুষের নানারকম খরচ লেগেই থাকে। বৌটাকে বাড়িতে রেখে আসতে পারত। বাবাই বারণ করেছিলেন। ছেলেকে কি করে বলবেন তার চৌকিসঙ্গিনীদের কথা। যদিও ব্যাটা সবই জানে। শেষমেষ বিয়ে করা বৌকে শ্বশুরবাড়িতে রেখে অজুহাত দিল, ” আপনার মেয়ের বয়েস কম,এখন না হয় বাড়িতে থেকে কিছুদিন ঘরের কাজ শিখুক। তাছাড়া বিদেশ বিভুঁইয়ে মেয়েমানুষের সেফটি, সিকিউরিটি খুব কম। ” হাবাগোবা শ্বশুরমশায়ের মাথায় আসল না পুলিশের বৌয়ের সিকিউরিটির প্রশ্ন। শ্বশুরের ঘরে আপদকে গছিয়ে গোকুল হাফ ছেড়ে বাঁচল। চাকরির জায়গায় মনেপ্রাণে টাকা গোছাতে লাগল কিন্তু সারাদিনে জমানো টাকার ভাগবাটোয়ারা হতেই ছেলের মন চায় একটু নছলা ( ফুর্তি )। তবুও নিজের বাড়ি বানানোর সংকল্পে টাকা জমাতে থাকে সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ধীরে ধীরে মুদ্রাসঞ্চয় তার জীবনে মানসিক সুখ আর অসুখ দুটোরই কারণ হয়ে দাঁড়ায়। রান্না করে যৎসামান্য। শেষ সিনেমা দেখেছিল ‘লাওয়ারিশ ‘। কী সব দিন ছিল ! সব কিছু ছিল কত সস্তা। জুয়োখেলার বন্ধুদের ঘাড় ভেঙে কত ছবিই না দেখেছিল। যেদিন ওর বরাত আসতে, কোনো কারণ দেখিয়ে ঘরের বাইরে বেরোত না। ইচ্ছে করে ওই দিনগুলোতে ফিরে যেতে। সেই পুরোনো বন্ধুগুলো কোথায় হারিয়ে গেল ! ওর কান্ঠামোর (কিপটেমি ) কথা জানতে পেরে সবাই ওকে সাইড করে যে যার জীবনে এগিয়ে গেছে। বাড়িতে যখন ফেরে রাস্তায় দেখা হলে, সবাই শুকনো মুখে উষ্ণতা দেখিয়ে কেটে পরে। উষ্ণতার ধর্ম আদানপ্রদানে। ভীষণ কষ্ট হলে, বেরিয়ে পরে পুলিশ কোয়ার্টারের বাইরে। চারপাশের প্রকৃতি বড্ড দমবন্ধ করা। মঝে মাঝে মনে হয়, ” কেন সে এইরকম? ” তখন আবার নিজের স্বপ্নের কথা ভাবতে থাকে। সে এই নোনা ধরা কোয়ার্টারের ছাদের নীচে থাকবে না, একটা প্রকাণ্ড বাড়ি হবে। তার পরের শব্দগুলো সে ভাবতে পারে না। হয়ত চায় না। গাড়ি কিনে কি হবে? তেল কিনতে কিনতে পয়সা শেষ হয়ে যাবে। আর নারীর কথা বাদই দিলাম। বাবা যেটিকে গছিয়েছে, সেটিকে নিয়েই চলতে হবে। তবুও মাঝে মাঝে পাশ দিয়ে যখন কোন সুন্দর গড়ন চলে যায়, মন বলে ওঠে ” চুম্মা চুম্মা দে দে … ” সেদিন প্রয়োজন হয় বাঁ-হাতের। চোখ চলে যায়, তোষকের নীচে রাখা ফুটপাত থেকে কেনা কামসূত্র চটিবইটির উপরে। লেখাপড়ার থেকে ছবি দেখা অনেক বেশি স্বাস্থ্যসম্মত তাছাড়া গুপ্তর থেকে সূত্র অনেক সস্তাও বটে !
বড়বাবুর সাথে টাকাপয়সা নিয়ে ঝামেলা হওয়ায় সন্তোষীমায়ের পুজোর দিনে গোকুলের ডিউটি পড়েছিল একটা মন্দিরে। রোজগার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মনটা বেশ খারাপ। দিনের আলো যত কমতে থাকে, বাড়তে থাকে জনতার চাপ। কুল কুল করে আসতে থাকা দড়ি দিয়ে ঘেরা অপেক্ষমান জনতা ভক্তিতে গদগদ হয়ে শক্তিসেলগুলো ভুলে গিয়েছিল। হঠাৎ সন্ধ্যারতির পরে মন্দিরের দরজা খুলতেই, পাটভাঙা কাপড়ের মত গড়িয়ে পড়ল জনতার দল। সৃষ্টি হল তীব্র বিশৃঙ্খলা। ভক্তিসুধায় বিগলিত মানুষের দল গোকুলকে পিষে এগিয়ে চলল। সেদিনই জনতার পায়ের ধুলোয় গোকুলের দু -কুল প্রায় ভেসে গিয়েছিল। বিপদে পড়ে হঠাৎ হরিকে মনে পড়ল। হোক না নেপোটিজম, রেগুলার ভক্তের সন্তানকে একটু তো অ্যাডভ্যান্টেজ দিতেই হবে। রাখালরাজের কৃপায় হঠাৎ মঞ্চে কোথা থেকে একপাল ছুটন্ত গরুর অভ্যুথান হল। প্রসারিত শিঙের দর্শনে ভক্তরা হল ছন্নছাড়া। আহত গোকুল, পুলিশ হাসপাতালে প্রাণে বেঁচে গেলেও ডাক্তারি পরামর্শে শুইয়ে কাটাতে হল বেশ কয়েকদিন। বহুদিন বাঁ-হাতের কাজ বন্ধ। হঠাৎ খবর আসল, নকুল পটল তুলল বলে। পাঁচমাস আগেই বাড়ি থেকে ঘুরে এসেছে। এই আধমরা শরীরে আবার বাড়ি যেতে হবে শুনে যাতায়াতের ধকলের থেকেও খরচের ভয়ে মানুষটি বেশ গুটিয়ে গেল। উপায় নেই। প্রতিবার সস্তার জেনারেল কামরায় যাতায়াতে অভ্যস্ত, মানুষটিকে এবার অবস্থার চাপে বিমানের টিকিট কাটতেই হল। প্রথমবার অলক্ষীর ভাণ্ডার থেকে খরচ হল। বিমানসেবিকাগুলো ঠিক সিনেমার মত সুন্দরী। যখনই কথা বলার জন্যে অজুহাত উত্থিত হয় তখনই পেটে বেল্টের চাপ পরে। এই গণ্ডি সে নিজে কখনই কাটতে পারবে না। মনমরা হয়ে বাড়িতে যখন পৌঁছল, শ্মশানযাত্রার জন্যে গাড়ি রেডি। দাহ করে, বাড়িতে ফিরে দেখে শ্বশুরবাড়ির থেকে বৌ এসে গেছে। শ্মশানফেরত ক্লান্ত চোখদুটো থেকে বিমানসেবিকার মোহ কেটে গেছে। তাকে প্রশ্ন করে, ”কেমন আছো?”
ভাড়াঘরে বাবার ব্যবহার্য খাটিয়াটা আগেই শ্মশানে চলে গেছে। সিন্দুকের চাবি পাওয়া যাচ্ছে না। শেষে মিস্ত্রি ডেকে ভেঙে দেখে, পুরো ফাঁকা ! প্রতি মাসে পাঠানো টাকা সব উড়িয়ে দিয়েছে। একটি কানাকড়িও ছেলের জন্যে রেখে যাননি। সমস্ত আক্রোশ গিয়ে পড়ল ঘরের দেয়ালে গজালে ঝোলা শ্রীখোলটির উপর। মাটির উপর সেটিকে আছাড় মারে। হঠাৎ দেখতে পেল বারান্দার জানলার পাশে রাখা বাবার চশমাটা। শেষ স্মৃতি ! সেটিকে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগল।
পাঁচটা ব্রাহ্মণ ধরে নমো নমো করে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান সম্পন্ন করতেও বেশ খানিকটা টাকা উড়ল। এর মধ্যে শ্বশুরমশায়ও দেহ রেখেছে। শালাবাবু এই সুযোগে বোনকে পাকাপাকিভাবে জামাইবাবুর হাতে গছিয়ে বিদায় নিল। বউ চলল বরের সঙ্গে। ট্রেনের কামরাটি সেই জেনারেল !
বৌউকে কাছে পেয়ে গোকুল একটু অবাকই হল। বাইরের খাবার খরচ নেই বললেই হয়। গৃহলক্ষীর আগমনে বাঁ- হাতের রোজগার আরো বাড়ল। মানুষটি মনপ্রাণ দিয়ে স্বামীর কিপ্টেমোকে আত্মস্থ করেছে। স্কুলের গণ্ডি না পার করলে ওর মাথাটা খুব পরিষ্কার। ব্যাংক, পোস্টঅফিসের কখনো চৌকাঠ মারায় না। গৃহকর্মে নিপুণা মানুষটির যদি কোথাও সাক্ষরতার পরিচয় দিতে হয় উনি সঙ্গে সঙ্গে বলে, ” ভাই, চশমাটা তো আনা হয়নি,একটু পড়ে দেবে। ” তবে একটাই দোষ, দুপুরে ভাত খায় বড্ড বেশি। এক ঠ্যাং ভাঁজ করে, আরেক ঠ্যাং ছড়িয়ে ভাতের হাড়ি নিয়ে খেতে বসে। পাহাড়ের মত ভাত থালায় জড়ো করে একটু একটু করে খেতে সময় লাগে প্রায় ঘন্টাখানেক। বাদবাকি খরচ নেই বললেই হয়। দুটো নাইটি, পুরোনো সুতির শাড়ীতে দিব্বি সংসারটি চালিয়ে নেয়। নিমের দাঁতনে দাঁত মাজে। একটা লাইফবয় সাবানে তার দুমাস চলে, মাথা ঘষতে ব্যবহার করে সস্তার সার্ফ। বর্ষাকালে নোনা ধরা ছাঁদ থেকে যখন জল টুপটুপ করে পড়ে, তখনও সে তার স্বামীর উপর বিরক্ত হয় না। বুদ্ধি করে আশ্রয় নেয় খাটের নীচে। ঘুমন্ত নাকদুটো বিউগলের মত বাজতে থাকে। নিজের শখ আহ্লাদের জন্যে স্বামীকে কখনও অত্যাচার করে না। ঘরের কাজ করতে কাজের লোকের দরকার পড়ে না। স্বামী চাকরি করতে যাওয়ায়, বাজার তাকেই করতে হয়। বাজারে দেরি করে যায়, অপেক্ষা করে সেই মাহেন্দ্রক্ষণের যখন সবজিওয়ালার দোকান বন্ধ করার সময় হয়। সস্তায় পোকা বেগুন, শুকিয়ে যাওয়া মুলো, দাগি আলু কিনে বাড়িতে ফেরে। কারেন্ট খরচের ভয়ে বাড়িতে টিভি নেই। বিনোদন বলতে শুধুমাত্র আমীন সাহানির বিনাকা গীতমালা। বাকিটা সময় রেডিও থাকে চুপটি করে, চ্যাঁচালেই যে ব্যাটারির খরচ বাড়বে ! গোকুল ডিউটি থেকে কোয়ার্টারে ফিরলে, নিঃশব্দ পরিবেশে ইচ্ছে করে বৌয়ের সাথে দুটো কথা বলি। তবে এতদিনের অনভ্যাসবসত কথাগুলো গলায় দলা পাকিয়ে যায়। হয়তো বলতে যাবে ‘ তুমি খেয়েছো ‘ তার জায়গায় বেরিয়ে গেল ‘ খিদে পেয়েছে ‘। গোকুল বাড়িতে এসে তৃপ্তি করে হাত চেটে খেতে খেতে, বৌয়ের চোখে নিজেকে হারিয়ে ফেলে। ভুলে যায় চোখের নীচে গলকম্বল আরো বেড়েছে। তবে আনন্দ বেশি দিন স্থায়ী হল না। হঠাৎ করে একদিন গোকুলের চোখে পড়ল,পেটটা একটু বেশিই ফোলা ফোলা লাগছে। মনে পড়ল বেশ কিছুদিন আগে মাসের শেষের দিকে ঘুমানোর সময় চোখে পড়েছিল, মালা-ডি ক্যাপসুলের স্ট্রিপ ফাঁকা। মন চাইল ওষুধের দোকান থেকে কিনে আনি, পকেট বলল না, শরীর অন্যকিছু। ফলাফল বেরিয়ে গেল। কন্যাসন্তান ! সহসংযোজন সিজার। কিছুদিন বৌয়ের সেবা করার জন্যে লোক রাখা হল। ঘরের কাজ করার জন্যে লোক জুটল। গোকুলের টাকা খরচ হতে থাকল প্রচুর পরিমানে। এই অবস্থায় খরচ বন্ধ করলে বৌটা মারা যাবে। নিরুপায় হয়ে পিতার দেখানো পথে ঈশ্বরের স্মরণাপন্ন হল। ভক্ত আবার বিপথগামী না হয়, তাই ঈশ্বর বহু ভক্তকুলকে বঞ্চিত করে আবার গোকুলকে সহায়তা করলেন। সুস্থ হয়ে উঠল বউ। কাজের লোক হল ছাঁটাই। গোকুলের মুখে আবার হাসি ফুটল। শুধু একটিই দুঃখ, মেয়ের বিয়েতে যৌতুকে অনেক টাকা যাবে। তাই রোজগার বাড়ানোর তাগিদে বড়বাবুকে তেল দেওয়া শুরু করল। ইনামও পেয়ে গেল হাতেনাতে। হাইওয়ে চেকপোস্টে ডিউটিতে পোস্টিং আসল এক সপ্তাহের মধ্যে। তবে একটাই অসুবিধে, বাড়ির মেয়ে বলে কথা, বাপের মত তাইরে নাইরে করে ঈশ্বরের নামে ছেড়ে দেওয়া যাবে না। তার বংশের রক্তটা সে ভাল করেই জানে ! অমানুষ হওয়াটা অস্বাভাবিক না। তবে ছোট থেকেই মেয়ের দুর্বার কৃচ্ছসাধনের চেষ্টা দেখে সে আশ্বস্ত হয়েছে। বংশের সংস্কৃতি এর হাতে সুরক্ষিত। অলক্ষী একে কখনই স্পর্শ করতে পারবে না। পাঁচ বছর অব্দি মায়ের দুধ হজম করে মেয়েটা শরীরে বেশ সবল। দুধের কৌটোর খরচ নেই বললেই হয়। সন্ধেবেলায় পঞ্চাশ গ্রাম মুড়িতে মা মেয়ের দিব্বি চলে যায়। চানাচুরের জন্যে বায়না নেই। এক চিরুনিতেই মেয়ের বয়েস এক দশক পেরিয়ে গেল। চুলোচুলি করে চুল ছিঁড়লেও গায়ের জামাকাপড়ের উপর কখনও আঁচড় পড়ে না। বাড়ির ছোট ছোট জিনিসের উপর মেয়ের নজর মাকেও হার মানায়। তাদের ঘর থেকে মাথার ক্লিপ, সেফটিপিন, নেলকাটারের হারিয়ে যাওয়ার স্বাধীনতা নেই। এই কিপটে সুখী পরিবারের গৃহকর্তার মনে একটাই দুঃখ। ট্রান্সফারেবল চাকরির জন্যে মেয়েকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করতে হয়েছে। এই অখাদ্য স্কুলগুলোতে খাজনার থেকে বাজনা বেশি। প্রতি বছর নতুন ক্লাসে ভর্তি করতে টাকার শ্রাদ্ধ হয়। স্কুল ছাড়া বাইরে পড়ার বই পাওয়া যায় না। ম্যাচিং ড্রেস, হাত ঘড়ি, চকচকে টিফিন বাক্স ছাড়া স্কুলে মেয়ে হালে পানি পায় না। মাঝেমাঝেই কোনও না কোনও বান্ধবীর জন্মদিনে মেয়েকে পাঠাতে হয়। খালি হাতে তো যাওয়া যায় না। সাথে লাগে একটা কিছু উপহার। আবার অনুষ্ঠানে না গেলে ক্লাসের বাকি মেয়েরা, গোকুলের মেয়ে বকুলকে এক ঘর করে দেয়। উপায় তবে একটা বেরল। এরপরে অনুষ্ঠান বাড়িতে মেয়ে নিমন্ত্রণ পেলে, গোকুল আর তার বউও হাসিমুখে চলে যায়। হয়তো গিফট দিল দশ টাকার প্লাস্টিকের ফুলের টব, সেই জায়গায় স্বামী, স্ত্রী, মেয়ে মিলে পেটচুক্তি খেয়ে নেয়। যেখানে সবাই এক,দু পিস্ মাছ খাচ্ছে, সেখানে গোকুল নিচ্ছে কমপক্ষে পাঁচ-ছটা কিন্তু খাবার সময় অনুভব করে শুধু চোখেই খিদে লেগে আছে। ছোটবেলার খাবার শক্তি নষ্ট হয়ে গেছে। তবে এইটুকু শান্তি যে মেয়েটা পেট ভরে, মন ভরে খেতে পারছে। মনে অতৃপ্তি নিয়ে বড় হচ্ছে না। নিমন্ত্রণ বাড়ির থেকে ফিরে এসে খেয়াল হয়, ঠাকুর এখনও অভুক্ত। ঢেকুর তুলতে তুলতে কোনোরকমে নকুলদানা আর জল দিয়ে ঠাকুরের শয়ন দিয়ে দেয়। আগে ঠাকুরের সেবায় মিছরি দেওয়া হত, মেয়ে বড় হয়েছে খরচ যে বাড়ছে !
দুহাতের রোজগারে অচিরেই কিছু বছরের মধ্যে বেশ বড় অংকের টাকা জমিয়ে ফেলল। তবে টাকা গুনতে আজকাল অসুবিধে শুরু হয়েছে। মাঝেমাঝেই ভাগ বাটোয়ারা করতে ভুল হয়ে যাচ্ছে। চোখের ডাক্তার দেখাল। চোখে নাকি চশমা লাগবে। তার মানে আবার খরচ। মনে পড়ল,বাপের ফেলে রাখা চশমার ফ্রেম। চশমাতে অভ্যেস করতে সময় লাগবে। ডিউটিতে প্রথমবার চশমাটা পরে যাওয়ার দিন চোখে পড়ল এক ছেলে ওর মেয়েকে বাইকের পেছনে বসিয়ে ফ্যাটফেটিয়ে চলে গেল। সামনেই তো পার্ক। চোখে ভুল দেখল না তো?
তবে মেয়েটার আজকাল খরচের হাত খুলছে। মাঝে মাঝেই ঠোঁট-পালিশ, নখ-পালিশ, সান্সক্রিম, মেকআপ কিট কিনেই চলেছে। সারাদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কী যেন দেখতে থাকে। পড়াশোনায় কোন কালেই ভাল না। তবে ইদানীং স্কুল থেকে গার্জেন কল আসছে। এদিকে গোকুলের মানিব্যাগ থেকে মাঝেমাঝেই পঞ্চাশ, একশো টাকার নোট হাওয়া হয়ে যাচ্ছে। লক্ষণ খুব একটা ভাল না। মেয়েটার ব্যবস্থা করতে হবে। খুব তাড়াতাড়ি !
অবশ্য মেয়ে নিজেই ব্যবস্থা করে আসল। পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে ফিরল। ছেলেটি দেখতে ঠিক গরুচোরের মত। নাম পাভেল। বড় বড় চোখ, কাঁধে উল্টো করে ঝোলানো গিটার, কানে হেডফোন, দেহের তুলনায় ধরটা বড়, এক মাথা চুল, দক্ষিণের ছবির হিরোদের মত বিশাল বিশাল ঝুলপি, পরণে বেলবটম প্যান্ট। এক কথায় অন্য গ্রহের জীব। ইচ্ছে করছে, অফিসের বুট পায়ে শালার পাছায় গিয়ে লাথি মারি। পরে যখন গোকুল জানতে পারল, বড়বাবুর একমাত্র শ্যালকের দ্বিতীয় পক্ষের আগের পক্ষের ছেলে তখন নিজেই বুট পায়ে দোকান থেকে মিষ্টি কিনতে গেল। জামাই বলে কথা, চাকরিটা বাঁচাতে হবে না।
গিটারের ঝ্যাঙর ঝ্যাঙরে মাঝরাতে ঘুম চটকে গেল। জামাই সেই যে আসল, যাবার নাম নেই, বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। বাবু এসে এসেই বাড়ির পরিবেশ নষ্ট করে দিয়েছে। বেলা বারোটার আগে কখনও ঘুম ভাঙে না। বাড়িতে সকলের সামনে হাফপ্যান্ট পরে ঘুরে বেড়ায়। ডিমে নাকি তার এলার্জি। মাছ, মাংস ছাড়া বাবুর মুখে কিছুই রোচে না। মাঝে মাঝেই মুখের স্বাদ বদলাতে সুইগিতে অর্ডার দিয়ে বেকন, মিটবল, বার্গারের মত বড়লোকি খাবার আনিয়ে নেয়। কুটুস কুটুস করে গোকুলের অ্যাকাউন্ট থেকে মাঝেমাঝেই টাকা কেটে যায়। লোকের বাড়িতে হাঘরের মত খাবার শাস্তি জামাইয়ের হাতে যে এমনভাবে পেতে হবে, তা কে জানত? বাবুর ঘুমানোর জন্য পালঙ্ক কিনতে হল। গোকুলের খাট চ্যাম্পিয়ন বাপে ছেলের কষ্টে সমান্তরাল দুনিয়া থেকে হাত পা তুলে নাচতে থাকে, ”বাপের সম্পত্তির দিকে খুব নজর ছিল। দ্যাখ কেমন লাগে!” ঘরে ঢুকল ফ্রিজ। তাও ডবলডোর। জামাইয়ের বক্তব্য তাতে নাকি আইসক্রিম ভাল জমে। নীচে মদ উপরে আইসক্রিম, একেবারে রয়েল কম্বিনেশন! ঘরে বসল এসি। উনি ঠিক অটোতে চড়তে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন না। একটাই মাত্র মেয়ে, তাই বাবাকে বাধ্য হয়ে গাড়ি কিনতেই হল। গোকুল ভেবেছিল একটা ছোট আটশো সিসির গাড়ি কিনবে। কিন্তু বাবুর কমফোর্টের কাছে ধাক্কা খেয়ে সেদান গাড়ি বাড়িতে ঢুকল। মেয়ে বড় হওয়ার পর থেকে দুটো পাখা, নিজেদের ঘরে একটা জিরো ওয়াটের আর মেয়ের ঘরে পঁচিশ ওয়াটের বাল্ব জ্বালিয়ে কেটে যেত। আর এখন প্রতিদিনই যেন ঘরে কার্নিভাল লেগেই আছে। বারান্দাটা এলইডিতে ভরিয়ে দিয়েছে। প্রতিঘরে দুটো, তিনটে লাইট অহরহ জ্বলছে। পেল্লায় এলইডি টিভিতে বাবু আই.পি.এল. দেখে। ইলেকট্রিক মিটারের কাঁটা সাঁই সাঁই করে দৌড়াচ্ছে। সারাদিন ঘরে হাহা হিহি লেগেই আছে। সাথে বাড়ছে গোকুলের মাথার যন্ত্রণা। টাকা আর জমবে কোথায়, সবই তো উড়ে যাচ্ছে। দশ বছরের খরচ, ছমাসের মধ্যে করিয়ে দিয়েছে। ছেলেটির আবার শরীরে রোগ আছে। পেটে কিছুই হজম হয় না। যে কোনও মুহূর্তে পায়খানা পেয়ে যায়। পায়খানাতে আবদ্ধ গাঁজার গন্ধ একজস্ট পাখা চালিয়েও যায় না। গোকুলের বাপের ভাগ্য, জামাই পুলিশ শ্বশুরের সামনে গাঁজায় টান দেয়নি। এদিকে গিন্নী জামাইয়ের প্রশংসায় অজ্ঞান। এখন তার আবার কাপড় কাচতে ওয়াশিং মেশিনের দরকার পড়ছে। ভ্যাকুয়াম ক্লিনার অর্ডার হয়ে গেছে। ‘ওগো’, ‘হ্যাঁ গো ‘ শব্দগুলো গোকুলের জীবন থেকে হঠাৎ করে গায়েব হয়ে গেছে। একজন স্কুলে না যাওয়া মানুষের থেকে সারাদিন ‘হানি’, ‘হানি’ শুনতে কার ভাল লাগে? পুরো সংসারের কৃষ্টি শেষ। সংসারে গোকুলের অবস্থান বেশ নড়বড়ে। এর থেকে যৌতুক দিয়ে একটি সৎপাত্রের হাতে মেয়েটাকে তুলে দিতে পারলে গোকুলের শান্তি হত। তবে সন্ধেবেলায় যখন গিটার বাজিয়ে এলভিস প্রেসলির গান করে তখন গোকুলের মনে হয় এই ছেলেটার মত তার জীবনটা যদি অন্য খাতে বইত খুব একটা কি খারাপ হত? কমপক্ষে একটা বাড়িতে যদি ঘরজামাই হিসেবে চান্স পেত। সেও খরচ করতে পারত অকাতরে। ওর তো নিজের মত ঘুরতে, খেতে, বেড়াতে ইচ্ছে করে। গুরুর ছবিগুলো একটাও মিস করতে হত না। ছোটবেলায় কিপটে বাপের চক্করে নিজের শখ, ফুর্তিকে জলাঞ্জলি দিতে হয়েছিল। বাপে টাকার জন্যে একটা ফালতু পরিবারের সাথে বিয়ে দিল। জামাইষষ্ঠীতে শ্বশুরবাড়ির আদর আপ্যায়ন এখনও অধরা। শালাবাবু বোনকে গলা ধরে বার করে দিয়ে একটিবার খোঁজ নেয়নি। সুযোগ বুঝে পুরো সম্পত্তিটা ঠিক বাগিয়ে নিয়েছে। পুলিশে চাকরি করা গোকুলের এর থেকে ভাল মেয়ে প্রাপ্য ছিল। ওর সহকর্মীরা ওর বৌয়ের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে ওর অনুপস্থিতিতে অফিসে হাসাহাসি করে। আজকাল হঠাৎ গোকুলের আবিষ্কার হয় যে তার বৌয়ের পুরোনো গা চুলকানোর রোগ ফিরে এসেছে। এত বয়েস হল ভাত খাওয়াটা তবু কমে না ! দিনের পর দিন প্রতি মাসে ওষুধের খরচ বেড়েই চলেছে। গা থেকে মোষের মত গন্ধ বেরোয়। একদিন রাতে বৌয়ের নাসিকাবন্দনায় তিতিবিরক্ত হয়ে গোকুল খাট থেকে নেমে মেঝেতে পাতা মাদুরে ঘুমিয়ে পড়ে। দেখতে থাকে রড বেরোনো সিলিঙের গায়ে পাখা ঘুরছে। ভাবতে থাকে সময়ের চাকাটাকে উল্টো করে ঘুরিয়ে চটিবইয়ের দিনগুলোতে যদি ফিরে যাওয়া যায়। হঠাৎ লক্ষ করে খাটের তলায় ধুলোয় মাখা ”Playboy” ম্যাগাজিন। কানে আসে জামাই এর বাজখাই গলায় গান
”Live each day, as if it were your last
It’s written in the stars, your destiny is cast…”
জামাইয়ের উৎপাতে গোকুলের উপার্জিত সম্পত্তি খরচ হচ্ছে জলের মত। সে আর বড় বাড়ি বানানোর স্বপ্ন দেখে না। শুধু একটাই আশঙ্কা রিটায়ার্মেন্টের আর পাঁচ বছর বাকি। এইভাবে চলতে থাকলে শেষজীবনে তো রাস্তায় দাঁড়াতে হবে। ঘনঘন নাইট ক্লাব, সিনেমা দেখা, মদ খাওয়ার টাকা জোগাড় করতে করতে হাফিয়ে উঠল। একদিন খবর পেল পাভেল একটি জালিয়াত। ওর মা, বাবা কারওর সাথে বড়বাবুর কোনও সম্পর্ক নেই। এতদিন ওর বংশপরিচয় সম্পর্কে যা শুনতে পেয়েছে সব মিথ্যে। শালাকে খতম করতে হবে। বহু টাকা খসিয়েছে। তবে নিজের হাতে এই পাপ করবে না। এতদিনের পুলিশি জীবনে এত বাঁ- হাতের কাজ করেও ওর উর্দিতে একটা দাগ পড়েনি। এদিকে ভাড়াটে গুন্ডাও অনেক টাকা খসিয়ে দেবে। পুলিশের চাকরিতে ঢুকে শেষ কবে গুলি চালিয়েছিল মনে নেই। পুলিশ ইউনিফর্মের সাথে স্ট্রাপে আটকানো খাপের মধ্যে থাকা বন্দুক দেখলেই লোকে ভরসা করে ফেলে। এদিকে দেখা গেল বহুদিন আনলোডেড। এই ছোকরাটাকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। তবে গোকুলের মত অহিংসপরায়ণ দুর্বলচিত্তের পুলিশ অফিসারের কাছে জামাইকে না বাঁচিয়ে রাখাটা লাখ টাকার প্রশ্ন! একবার এক থার্ড-ডিগ্রি টর্চার রুমে পুলিশি কায়দায় অপরাধীকে গরুপিটানো দেখে গোকুলেরই প্যান্টে হিসু হয়ে যায়। অহেতুক এড্রিনালিন টেনশনে হিসু করার থেকে ঘেমে নেয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে চেকিংয়ের কাজে সে বেশি স্বচ্ছন্দ। তবে জামাইকাণ্ডে অহিংসাপরায়ণতা আর কিপটেমোর দ্বন্দে গোকুলের রাতের ঘুম নষ্ট হল। মেয়েটা যদি বিধবা হয়ে যায়, সারাটা জীবন কিভাবে কাটবে? ছেলে অনেক আছে! বহু ভাবনাচিন্তা করেও যখন কোন উপায় মাথায় এল না হঠাৎ আবিষ্কার করে ধুলোয় মাখা গোপালের মূর্তি। শেষ কবে ঠাকুরের সেবা দিয়েছিল মনে পড়ছে না। কিপটেমি আর ফাঁকিবাজিতে ভগবানকে ভুলেই গিয়েছিল প্রায়। আবার শুরু হল জপতপ। মাঝখানের বহুবছর ফাঁকিবাজি মেরে কাটিয়ে দিয়েছে। এবারে তেল বেশি মারতে হবে। মাঝে মাঝেই নিরম্ব উপবাস করে ফেলল। সেদিনগুলোতে বাঁ-হাতের কাজ বন্ধ। কলিকালে এই ভয়ংকর কঠিন তপস্যায় ভীষণরকম অপুষ্টিতে আর অবহেলায় রোগাক্রান্ত পদ্মনাভর মনে পড়ল সত্যযুগের ভক্ত প্ৰহ্লাদের কথা। কলিযুগের গোকুলের তপস্যায় সাড়া দিতেই হবে না হলে মিডিয়াতে ছি ছি পরে যাবে। চিন্তা করে এমন কিছু করতে হবে যাতে ভক্তের বিপদ কাটে আবার একই সাথে তার ফ্যানফলোয়িংও বাড়ে। তার দশ অবতারের মধ্যে কোন এক অবতারকে আবার মার্কেটে আনতে পারলেই সভ্যতার চতুর্থস্তম্ভের ভিত নড়ে যাবে। কল্কি অবতারের এখনও সময় হয়নি। তবে নৃসিংহ অবতারের রিপিট টেলিকাস্ট করলে খেলা জমে যাবে। পরে মনে হয় ঐসব অবতারমার্কা এল .ই .ড. শোয়ের খরচ ভক্তের দল না জোগালে শেষে পথে বসতে হবে। তাছাড়া গোকুলের স্বার্থ ফুরালে ভুলে যায়। শালা বেইমানের জন্যে এত দূর প্লেন ভাড়ার দরকার নেই। একটা তো থামই ভাঙতে হবে। বিশ্বকর্মাকে ডাক দেয় ”গোকুলের অফিস কোয়াটারের বয়েস কত হয়েছে?
আজ্ঞে ! প্রভু, সেটা ব্রিটিশ আমলের।
উত্তম ! তাহলে দেরি করে লাভ নেই ”
সেদিন রাত্রিবেলায় জামাইয়ের পেট খারাপ হওয়ায় গোকুল যখন তার মেয়ে আর বৌউকে নিয়ে অফিসকলিগের বিয়েতে গিয়েছিল, জামাই পায়খানায় বসে হেডফোনে এলভিস প্রেসলীর শেষ গান শুনতে শুনতে গাঁজা টানছিল। লাইনগুলো ছিল
” Please stop it now ….
My head is spinning a spell on me now ”
গানের লাইনটি শুনতে শুনতে মাথাটি যখন তালে তালে দুলছিল হঠাৎ ছাঁদের চাই খসে পড়ল | স্পট ডেড ! পাভেলের পায়খানাতে যখন মৃত্যু হল স্বর্গ থেকে এলভিস পুস্পবর্ষণ করতে লাগল ‘ সাধু ‘, ‘সাধু ‘।
জামাইয়ের মৃত্যুর দিন গোকুল জানতে পারল মেয়ে সন্তানসম্ভবা। তবে জামাইয়ের মৃত্যুতে অনেক লাভ হল। ছাদ ভেঙে জামাইয়ের মৃত্যুর জন্যে অনেক টাকা কম্পেনসেশন পেল। মেয়ের এই অবস্থায় এই বিপদজনক কোয়ার্টারে থাকতে গোকুল একটু ভয়ই পেয়ে গেল। এই অবস্থায় টাকার কথা ভাবলে বিপদ বাড়বে। শেষে কিছুদিনের মধ্যেই গোকুল কম্পেনসেশনের টাকা আর নিজের জমানো অংশ দিয়ে একটা বাড়ি কিনে ফেলল। বাড়িটা খুব সুন্দর। ঘরগুলো বেশ বড় বড়। বাইরে সামনের দিকে একটা ছোট বাগান আছে। যেদিন বৌ আর বিধবা মেয়েকে নিয়ে নতুন বাড়িতে ঢুকল মনের মধ্যে একটি অদ্ভুত দোটানা অনুভব করল। শেষ অব্দি তার সারাজীবনের স্বপ্নপূরণ করতে পেরেছে। মন চাইছে লাফাতে, ঝাঁপাতে কিন্তু শান্তিটা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। আজকে তার আর কিপটেমি করার দরকার নেই। সে ভাল করে বাঁচতে পারবে। কিন্তু যে মানুষটা তাদের ভাল করে বাঁচতে শিখিয়েছিল, সেই আর নেই। পাভেল যে কদিন তাদের জীবনে ছিল খরচ -খরচা হত খুব বেশী কিন্তু পুরো সংসারটাকে বেঁধে রেখেছিল। সে সিনেমা যাক বা নাইট ক্লাবেই যাক না কেন বৌ, শ্বশুর, শাশুড়ি সবাইকে নিয়ে যেত। একলা বাঁচা জানত না বলেই হয়তো এই একলা পৃথিবীকে ছেড়ে তাকে চলে যেতে হয়েছে। মা, মেয়ে, বাবা প্রত্যেকে নিজের নিজের ঘরে বসে কী যেন ভাবতে থাকে। প্রত্যেকেই যেন একটা অদ্ভুত খাঁচাতে আটকে আছে। আগে সবাই মিলে ‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’ দেখার সময় গোকুল অন্য ঘরে চলে যেত। খুঁজতে থাকত তার ছোটবেলার একাকিত্বের যন্ত্রণা। আর আজকে যখন সবাই ভীষণ একা, গোকুল আজকেও হাতড়াতে থাকে অতীতের দিনগুলো। কারেন্টের মিটার বা ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করে না। ভাগবাটোয়ারার টাকার প্রতি বিতৃষ্না জন্মে গেছে। টেবিল খাবার ঢাকা থাকে, খিদে পায় না। তার কোন বন্ধু নেই, শত্রু নেই। কি অদ্ভুত জীবন। চোখের উপরে বসা বাপের চশমাটা পরলেই বাপকে মনে পড়ে, ”রেখে, খাবি।” ”আমার আর কিছুই নেই তখন রেখে আর কি লাভ” বলে কাঁদতে কাঁদতে শুনতে পায় মেয়ের প্রসবযন্ত্রনা। সারাজীবন কিপটেমি করে চালানো মানুষটার ইচ্ছে ছিল মেয়ের ডেলিভারি করবে কোন প্রাইভেট নার্সিংহোমে। কিন্তু প্রসব যন্ত্রণা এত তীব্র হল যে পাশের সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যেতে বাধ্য হল। বেঞ্চে বসে ঝিমাতে ঝিমাতে আরেকটু হলে কখন যেন চশমাটা পড়ে যেত। ঘড়িতে এখন প্রায় রাত দুটো। বারান্দার কাঁচের জানলার সার্সির ভেতর দিয়ে বাইরে তাকাল। দূরে রাস্তায় হাই – মাস এর আলো জ্বলছে। আজকে তার মেয়ে, মা হতে যাচ্ছে। জন্মানোর পর থেকে মাকে কখনো দেখেনি। আজকে যে নবজাতক পৃথিবীতে আসবে, সে জন্মলগ্ন থেকেই জানবে না বাপ কি জিনিস। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। তার নিজের শৈশবকে চোখের সামনে দেখতে পেল। মা, বাবার মধ্যে কোনও একজন না থাকলে বাচ্চার শৈশবের যে কি হয় তার থেকে ভাল কেই বা জানে? ঠাকুর মেয়েটা বাঁচবে তো? ওকে কেড়ে নিও না। ওর মায়ের সুগারের সমস্যা। আজ আছে তো কাল নেই। আর আমি কি ঠিকমত কোনো দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি? এরকম দাদুর সংস্পর্শে এলে সারাজীবন ডান হাত, বাঁ – হাত নিয়ে কাটাকুটি খেলতে খেলতে মানুষ আর হবে না। স্বর্গের থেকে মুরলীধর গোকুলের মুখে প্রথম ঈশ্বরের কাছে কামিনীকাঞ্চন বাদ দিয়ে অন্য কথা শুনে দেবী কমলাকে বললেন, ”শেষঅব্দি গোকুলের যখন সুমতি ফিরে এসেছে, তাহলে পরবর্তী অবতারের সময়ও চলে এসেছে।” হঠাৎ ওটির থেকে একটা বাচ্চার আওয়াজ আসল, ”ছেলে হয়েছে, আপনার মেয়ে সুস্থ আছে।” নাতির চোখ দুটো হয়েছে পুরো পাভেলের মত বড় বড়। কোলে যেই নিতে গেল, নাতি ওমনি চশমাটা টেনে ধরল। (শব্দ সংখ্যা ৪৪৮৫)