‘প্রিয়তমেষু,
কেমন আছ? কোন একদিন যদি দেখা হয়ে তোমার সাথে, তাহলে এই প্রশ্নটাই করব তোমাকে, বিস্ময়ভরা চোখে। যদি আবার একদিন হঠাৎ দেখা হয়েই যায়, কেমন হবে বলতে পারো? ভালোবাসি, শব্দটা যতবার বলেছিলাম, প্রতিবারই তা প্রতিধ্বনিত হয়েছিল অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে। তুমি কি শুনতে পেয়েছিলে সে আর্তনাদ, একবার, একটিবার এর জন্য?
জানো, পুরনো সেই দিনগুলোর কথা খুব বেশী মনে পড়ে। স্মৃতির পাতায় ঐ মুহূর্তগুলো শুকতারার মত জ্বলজ্বল করে। মনে পড়ে সেই প্রথম দিনগুলোর কথা, প্রথম দেখা? রোমান্টিক কোন গল্প-উপন্যাসের মত ছিল না মোটেও। সাধারণ দুইটি মানুষের সাধারণ একটি সকালে দেখা। কিন্তু কে জানত যে সেই সাধারণ পরিচয় সূচনা করবে অসাধারণ এক গল্পের। ভালই যাচ্ছিল আমাদের দিন কাল। প্রথমদিকে কাজের ফাঁকে ফাঁকে বাক্য বিনিময় আর ছোট ছোট কথা। তারপরে বাক্যগুলো বন্দি হল মুঠোফোনের ক্ষুদে বার্তার বাক্সটিতে। সঙ্গে যুক্ত হল, মধ্য রাতের আলাপচারিতা। আশায় থাকতাম, কখন রাত হবে আর তোমার নাম আমার মুঠোফোনের পর্দায় ভেসে উঠবে।
তোমার সাথে ছিলাম কতগুলো বছর কিন্তু সময়গুলো যেন চোখের পলকে চলে গিয়েছে। যে রকম করে সময়গুলো যেত আমাদের দেখা হলে। সময় আর ভালবাসার প্রতিযোগিতায় প্রতিবার ভালোবাসা জিতলেও শেষ বেলায় কি সময় জিতে গেল? আমাদের ছোট ছোট সাক্ষাৎ আর সুদীর্ঘ কথোপকথন। আমি যেন তোমার গাঢ় বাদামী চোখের গভীরতায় হারিয়ে যেতাম। প্রথমে সবার অগোচরে সাক্ষাৎ, প্রথম একসাথে পথ হাঁটা, প্রথম হাত ধরা, প্রথম আলিঙ্গন, প্রথম চুম্বন। সেই মুহূর্তগুলো মনে করলে এখনও শিহরণ জাগে, চোখ বন্ধ করলে সেই অনুভূতিগুলো আমাকে ছেয়ে ধরে। সময়ের সাথে সাথে একফোঁটাও ক্ষয় হয়নি।
তোমার কি মনে পড়ে আমাদের নববর্ষ উদযাপন? আমার পরনে কতথাকত আটপৌরে মোটা লাল পাড়ের সাদা শাড়ী, হাতে কাঁসার চুড়ি, গলায় পেঁচা লকেট, লাল ঠোঁট আর তার চেয়েও লাল টিপ, খালি রক্ত-লাল সিঁদুরটাই বাকি। তোমার জন্য অপেক্ষায় থাকতাম আমাদের মোড়ের দোকানের সামনে। আর তুমি সেই কাঠফাটা রোদ উপেক্ষা করে আসতে। নিজেকে মনে হত রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের নায়িকা, আর তুমি নায়ক। আমি তোমার লাবণ্য আর তুমি আমার অমিত। মনে আছে, আমরা দুই বর্ষা প্রেমিক কীভাবে বর্ষার প্রথম দিন উদযাপন করতাম, আমাদের বর্ষা বিলাস? নীল তোমার খুব পছন্দের একটি রং, তাই বর্ষা আর তোমাতে মিল রেখে নীল তাঁতের শাড়ী, মোটা করে আঁকা কাজল, তোমার সবচেয়ে প্রিয় নীল টিপ আর কানের পিছনে তাজা নীল অপরাজিতা। আর তোমার পরনে কতথাকত ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবী অথবা হাল্কা নীল একটা শার্ট। পুরনো ব্রিজটার ধারের যে কদম গাছটা রয়েছে তার নিচে দেখা হত আমাদের দুইজনার, বর্ষাস্নানের অপেক্ষায়। টিপ টিপ বৃষ্টিতে তোমার হাত ধরে হাঁটা আর তোমার কণ্ঠে মহাদেব সাহার কবিতা। মনে যেন পুরনো দিনের ফিল্মের শুটিং চলছে। বর্ষা, কবিতা, সোডিয়াম লাইট, সব মিলে মিশে হত একাকার, যেন জলরঙে আঁকা এক ছবি। বর্ষার প্রথম দিনে, তোমার প্রেমে সিক্ত হল আমার হৃদয়। প্রেমের মহাকাব্য পঙক্তিমালা রচনা হত প্রতিটা বৃষ্টির ফোঁটায় ফোঁটায়।
আমি কখনও সাগর দেখিনি বলে তুমি কথা দিয়েছিলে যে আমার প্রথম সাগর ভ্রমণ হবে তোমার সাথে। এরই মধ্যে একদিন প্লেনের টিকিট কেটে সোজা সাগরের পারে হাজির আমরা। বালুকাবেলায় পা দিয়ে অবাক নয়নে দেখলাম আমি সাগরের ঢেউ, আর অসীম জলরাশি। আর তুমি দেখলে আমার বিস্ময়ভরা চোখ, আবার সেইদিনই টিকিট কেটে সোজা ইট পাথরের চেনা শহরের ফেরত আসা। তোমার সাথে প্রতিটা মুহূর্ত যেন রোমাঞ্চকর অভিযান।
আমাদের পুরনো ব্রিজটায় সূর্যকে মাথার উপর রেখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প, তোমার হাতের একটু স্পর্শ পাওয়ার জন্য শহরের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় যাত্রা, আমাদের বিকালের নৌকাভ্রমণ, অলস দুপুরে আমদের এই ছোট্ট মহল্লার অলি-গলিতে তোমার পাশে হাঁটা, আরও কত শত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্মৃতি, সব লিখতে গেলে তো উপন্যাস হয়ে যাবে। এরই মাঝে কবে যে তোমার প্রেমে পড়ে গেলাম, জানা নেই। ঠিক যেভাবে তুমি এসেছিলে ঠিক সেভাবেই চলে গেলে। কিন্তু আমি এখনও অপেক্ষায় আছি সেই দোকানের সামনে, সেই কদম তলায়, আমাদের ব্রিজটার উপরে। চিরকাল তোমার অপেক্ষায় থাকব, তুমিও কি আছ? তোমার প্রিয় রবি ঠাকুরের কবিতা দিয়েই শেষ করি এই চিঠিখানি-
‘আমাদের গেছে যে দিন
একেবারেই কি গেছে,
কিছুই কি নেই বাকি।’
ভালো থেকো, প্রিয়। অনেক অনেক ভালো।
ইতি,
তোমারই ‘চারুলতা’। কাঁপা কাঁপা হাতে আর পুরু চশমার ভিতর দিয়ে চিঠিটা আরেকবার পড়ল প্রবীণ মানুষটি। কত হাজারবার যে পড়েছে এই পুরনো হলুদ হয়ে যাওয়া চিঠিটা, সে বলতে পারে না। সময়ের সাথে সাথে কাগজের ভাঁজগুলো দুর্বল হয়ে গেলেও, প্রতিটা শব্দ এখনও চিৎকার করে, ভালোবাসি, ভালোবাসি বলে। চারুলতার বিয়ে হয়েছে অন্যত্র, যেখানে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র মিলেছে। সে ভাল থাকতে পারল না বেশীদিন, মনঃকষ্টে, অভিমানে অন্য দুনিয়ায় পাড়ি দিল। আর ছেলেটি, এখন প্রবীণ, ঠিকানা নাম না জানা বৃদ্ধাশ্রমে। তাকিয়ে আছে জীবনের শেষ কয়টা দিনের দিকে। এই গোধূলি শেষ হলে ঐ পারেই যে আছে তার চারুলতা। অনেকদিন তো অপেক্ষা করল, আর কত? অন্য জীবনে সে কি পাবে না তার চারুলতাকে?