এ গল্পের শেষ নেই| প্রেমে পড়া বারণ | সৌভিক ব্যানার্জি| Bengali Love Story
0 (0)

. শহরের বুকে এক রাক্ষস

লোকটার গলার কাছে চামড়ার ফাঁক দিয়ে গরম কালচে রক্ত বেড়িয়ে আসছে ফিনকি দিয়ে। হাঁটুর চাপটা কমিয়ে বুকের উপর থেকে নেমে বসল ছেলেটা। তারপর উন্মাদের মত এক হাতে ছুরি দিয়ে কোপ মারতে লাগল লোকটার পেটে, আর আরেক হাত সেই ক্ষতর মধ্যে ঢুকিয়ে বের করে আনতে লাগল এক এক করে ক্ষুদ্রান্ত্র, বৃহদন্ত্র আরও হাতের নাগালে যা যা পেতে লাগল, সেই সবই। সেই রক্ত সারা শরীরে, মুখে মেখে অন্ধকার ফুঁড়ে ছেলেটা উগড়ে দিল একটা চিৎকার। খুব পরিচিত একটা চিৎকার, এই চিৎকার প্রকৃতি আগেও শুনেছে, মাটি থেকে উপড়ে নেওয়া শিকড়ের চিৎকার এটা, এটা আহত পশুর যন্ত্রণার কান্না, এটা চেনা, পরিচিত, এটা এর আগেও শোনা।

-আবারও একটা স্যার, একই ভাবে।

– ভিকটিম এর বয়স?

– বয়স্ক, ষাট সত্তর এর মাঝেই হবে।

– হম।

একটা সিগারেট ধরিয়ে সামনের দেওয়ালে হেলান দিয়ে লাশটা দেখতে লাগল ইন্সপেক্টর বোস। যেভাবে পেট ছিঁড়ে নাড়িভুঁড়ি বের করেছে একঝলক দেখলে যেন মনে হয় কোন মানুষ নয়, রূপকথার রাক্ষসের হাতে প্রাণ যাচ্ছে অসহায় বৃদ্ধ মানুষগুলোর।

. রাত জাগা স্বভাব

– কত দিন ঘুমাওনি?

– জানি না, ঘুম আসে না আর।

– ওষুধগুলো খাচ্ছ না?

– কাজ দেয় না আর।

– দেখো এভাবে তোমার এই অসুখ সারবে না। তোমাকে নিয়মিত চোখে চোখে রাখতে হবে, তোমাকে নিয়মিত কাউন্সেলিং করতে হবে, না হলে আমি এর চিকিৎসা কীভাবে করব!

– দেখুন ম্যাম, আমি ভালো হতে চাই না, আমি ভুলে যেতে চাই না কিছু। শুধু কথা বলার মানুষ নেই আমার, যাকেই বলি সে হাসে, প্রলাপ ভাবে, এই কথাগুলো কেউ বোঝে না। কতটা কষ্ট হয়েছিল কেউ বোঝে না, আমাকে পাগল ভাবে সবাই, সব মিথ্যে ভাবে, কিন্তু ও মিথ্যে না, ও কিন্তু একেবারেই মিথ্যে নয়।

কথাগুলো বলতে বলতে ছেলেটার চোখের ধরণ বদলে যেতে দেখলেন মিসেস চ্যাটার্জি। চোয়াল শক্ত হয়ে এসেছে, দাড়ি গোঁফের ফাঁকে দাঁতগুলো ধারালো করাতের মত উঁকি দিচ্ছে। সামনের দিকে বড় বড় চুলের ফাঁকে চাউনিটা মোটেও ভাল লাগল না তার। নিজের গলার স্বর নরম করে পরিস্থিতি সামাল দিয়ে বললেন,

– আমি তো করি, আমি তোমার সব কথা বিশ্বাস করি।

ছেলেটা রুমালে মুখটা মুছে নিয়ে তাকাল মিসেস চ্যাটার্জির দিকে, ক্ষনিকের ব্যবধানে ওই হিংস্র চাউনি দুটোয় অসহায়তা ফুটে উঠেছে। চোখের কোণে জল জমছে।

– আমি আছি অভি, আমি সব শুনবো, বিশ্বাস করব, শুধু তোমাকে কথা দিতে হবে। তুমি নিয়মমত এই ওষুধগুলো খাবে, ঘুমনোর চেষ্টা করবে, আমাদের ক্লিনিকে এসে নিয়মিত কাউন্সেলিং করবে, করবে তো?

ছেলেটা চোখের জল মুছে মৃদু হেসে ঘাড় নাড়ল। তারপর উঠে গিয়ে দশ বাই বারোর ছোটো ঘরটার কোণের আলমারি থেকে একটা খাম এনে হাতে দিল, খামের গায়ে আঠা দিয়ে লাগানো একটা সূর্যমুখী ফুল।

– ম্যাম, আপনার ফিসটা।

মিসেস চ্যাটার্জি খামটার দিকে তাকিয়ে থাকায় ছেলেটা নিজেই বলল,

– নন্দিনী সূর্যমুখী খুব ভালোবাসতো।

দীর্ঘ পনেরো বছরের মনস্তত্ত্ববিদের কর্মজীবনে একটু নতুন স্বাদ জন্মেছে তার। এমনিতে একটা স্বাভাবিক চনমনে ছেলে, অথচ রাতে ঘুমায় না। ঘুমের ওষুধও কাজ করে না! তার থেকেও অদ্ভুত যে বিষয়টা, ছেলেটার মনের অন্ধকারে একটা গল্প দানা বাঁধছে, যার শিকড়ের হদিশ এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে কেবল মিসেস চ্যাটার্জিকেই দিয়েছে সে। এখন জানা বাকি যে সেটা কতটা সত্যি আর কতটা গল্প।

– স্যার, ফরেনসিক রিপোর্ট বলছে দু’টো খুনের একই খুনি। তাছাড়া দরজার হাতলে পাওয়া ফিঙ্গারপ্রিন্টও আগের খুনের ফিঙ্গারপ্রিন্টের সাথে মিলে গেছে।

– হম। আচ্ছা, কোনও ক্রিমিনাল রেকর্ড নেই?

– নাহ নেই। তবে আন্দাজ করা হচ্ছে, খুনির বয়স বেশি না।

– সবই বুঝছি, কিন্তু মোটিভটা কী সেটাই ক্লিয়ার হচ্ছে না এখনও।

– স্যার দেখে তো মনে হচ্ছে খুনির হয় ভীষণ আক্রোশ নয়তো খুনি উন্মাদ। নইলে এমন নৃশংসতা!

– হম, যা হোক, কাল রাতে ভালো ঘুম হয়নি, আমি বাড়ি যাচ্ছি। দরকার পড়লে ডেকে নিও একটু।

– হ্যাঁ স্যার নিশ্চই।

. আরও শিকারের খবর

-নন্দিনী, জানো আমার একটাই ভয় হয়। যদি কোনোদিন  আলাদা হয়ে যাই, তোমাকে আবার খুঁজে পাব তো?

-জানি না, শুধু এটুকু জানি যতদিন না খুঁজে পাবে এই গল্পের শেষ নেই।

জানালা দিয়ে রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল ছেলেটা। মেঘের আড়ালে ঢেকে যাওয়া আধ খাওয়া চাঁদটা আজও একই ভাবে তাকিয়ে। পুরনো স্মৃতি ভেঙে বেরিয়ে এল একটা দীর্ঘশ্বাস। ‘সে রাতে অশান্তি না করলেই হচ্ছিল না তোমার?’ অস্ফুটে বলে উঠল ছেলেটা। পিছনে একটা মৃতদেহ, বছর ষাটের কাছাকাছি বয়স। ভোরের আলো জানালা দিয়ে যখন প্রতিদিনের মত ঘরে ঢুকলো, মৃতদেহ আর ঘরের মেঝেতে রক্তের উপর কিছু বুটের ছাপ পড়ে রইল শুধু।

“শহরের বুকে একের পর এক নারকীয় হত্যালীলা। শিকার হচ্ছেন ষাটোর্ধ পুরুষ। ঘরে ঢুকে ছুরি দিয়ে কেটে দেওয়া হচ্ছে নলি, তার পর পেট ফেঁড়ে বের করে আনা হচ্ছে অন্ত্র। ঠিক যেন হলিউডি সিনেমার অনুকরণ! কী বলছে কলকাতা পুলিশ! আসুন শুনে নিই…”

– টিভিটা বন্ধ করো।

থানায় ইন্সপেক্টর বোস নিজের টেবিলে মাথা নিচু করে বসে রইলেন। কোনও ক্লু নেই, কোনও প্রোগ্রেস নেই। পুলিশ স্রেফ হাত গুটিয়ে বসে আছে। ঠিক তখনই সাব ইন্সপেক্টর এর ডাক,

– স্যার, একটা ক্লু পেয়েছি। এটা কোন র‍্যানডম কিলিং না। এর নিশ্চয়ই কোনও মোটিভ আছে।

– কেন?

– স্যার, এই দেখুন আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে তিনজন ভিকটিম একই কলেজে পড়ত, একে অন্যকে চিনত, আমি সেই কলেজের রেজিস্টার লিস্ট দেখেছি। তিনজনের নাম আছে।

– তার মানে এমন কেউ খুন করছে, যে এই তিনজনের শত্রু?

– তিনজন না চারজনের।

শেষ কথাটা হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন মিসেস চ্যাটার্জি। চোখে মুখে উদ্বিগ্নের ছায়া, কখন যে তিনিও ঘরে এসে দাঁড়িয়েছেন কেউ টের পায়নি।

. টাইম মেশিন, ফ্ল্যাশব্যাক অথবা পুনর্জন্ম

কাঁচের গ্লাসের সমস্ত জলটা গলায় ঢেলে শান্ত হয়ে বসলেন মিসেস চ্যাটার্জি। তারপর বলতে শুরু করলেন,

– আমি সুস্মিতা চ্যাটার্জি, একজন মনস্তত্ত্ববিদ। ঘুম হচ্ছে না বলে একটা ছেলে আমাকে প্রাইভেটে দেখায়। আমি কিছু ওষুধ দিই, স্ট্রেস কমাতে ওকে কাউন্সেলিং করি। ও ক্লিনিকে আসবে না জানিয়ে দেয়, ওর বাড়ি গিয়েই থেরাপি দিতাম। ওর সাথে কথা বলতে গিয়ে আস্তে আস্তে বুঝতাম, শুধু ঘুম এর সমস্যা না, আরও কিছু ওর মস্তিষ্কে দলা পাকাচ্ছে। প্রথমে বলত, চোখ বুঝলে একটা মেয়েকে দেখতে পায়, তারপর বলত একটা নাম মনে পড়ে খুব, নন্দিনী। তারপর বেশ ক’দিন খুব চুপচাপ কতথাকত ছেলেটা, শেষে একদিন একটা গল্প শোনায় আমাকে।

সময়টা ১৯৮৬, নন্দিনী আর ছেলেটা, দু’জন দু’জনকে ভালোবাসতো। বাড়িতেও জানত ওদের। মেনেও নিয়েছিলো সবটা। শুধু কলেজ শেষ করে দু’জনের চাকরি পাওয়ার অপেক্ষা, তারপর বিয়ে। শীতের সন্ধে, ডিসেম্বরে শ্যামনগরে তখন রাসের মেলা বসে। বাড়িতে জানিয়েই দু’জন সেই মেলায় যায়। ছেলেটির জেদাজেদীতেই ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায়। শীতের সন্ধ্যে তাড়াতাড়ি রাত হয়ে আসে। নন্দিনীকে বাড়িতে এই নিয়ে কথা শুনতে হবে বলে অভিমান করেছিল। আর ছেলেটা সেই জনশুন্য রাস্তায় কান ধরে বারবার ক্ষমা চাইছিল। যুগলের খুনসুটি যেমন হয় তেমনই। ঠিক হঠাৎই সেই সময় পিছন থেকে বাইকের হেডলাইটের তীব্র আলো এসে পড়ে। এলাকার নেতা রজত চৌধুরী আর তার কিছু বন্ধু বাইক নিয়ে ওদের পিছনে এসে দাঁড়ায়, রজত আর ওর বন্ধুরা যে কলেজে পড়ত, নন্দিনীও সেখানে পড়ত। ভেসে আসে কিছু টোন টিটকিরির শব্দ। ছেলেটাও ফিরে উত্তরে কিছু বাজে কথা বলে। ব্যস ঘটে যায় অঘটন। তিনটে বাইক থেকে চারজন নেমে আসে। ছেলেটাও এগিয়ে যায়, শুরু হয় হাতাহাতি। কিন্তু চারজোড়া হাতের কাছে সহজেই ধরাশায়ী হয়ে যায় ছেলেটা, শুধু একা ফাঁকা রাস্তায় দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদতে থাকে অসহায় নন্দিনী। চার জানোয়ারের জিভ লকলক করে ওঠে। ছেলেটাকে দু’জন মিলে চেপে ধরে, আর বাকি দু’জন ছেলেটার সামনে মেয়েটার জামা কাপড় টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেলে। তারপর কামড়ে আঁচড়ে শুরু হয় অকথ্য যৌন নির্যাতন। ছেলেটা চিৎকার করে, হাত পা ছোঁড়ে, ধস্তাধস্তি করে, শেষে অনুরোধে, কান্নায় ভেঙে পড়ে। একের পর এক পালা করে ধর্ষণের শেষে সামনের ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত ভালোবাসাকে একটু একটু করে নিস্তেজ হয়ে যেতে দেখেছিল ছেলেটা। ওরা ছেড়ে যায়নি মেয়েটাকে, দেহটা অবধি বাইকে করে তুলে নিয়ে যায়। ছেলেটা বাইকের পিছনে পাল্লা দিয়ে ছুটতে পারে না, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সারারাত শহরের এগলি ওগলি খুঁজে চলে নন্দিনীকে। শেষে হতাশ হয়ে ফিরে আসে ভোরবেলা বাড়ি।

এতক্ষনে ভিড় জমে গেছে বাড়ির সামনে। কিছু বলার আগেই একটা হাত ছেলেটার কলার ধরে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়,

-বল আমার মেয়েটাকে কোথায় রেখেছিস?

পুলিশ আসে, তুলে নিয়ে যায় ছেলেটাকে। থানায় সমস্ত ঘটনা খুলে বলে ছেলেটা। গরাদের ফাঁক দিয়ে দেখে কারা যেন বড়বাবুকে কিছু টাকা দিয়ে কেসটা মিটিয়ে নিতে বলে যায়। তারপর কেউ বিশ্বাস করেনি ছেলেটার কথা। শুরু হয় পুলিশের মার, লাঠির আঘাতে কালশিটে জমে শরীরে, শুধু ব্যথার উপর ব্যথা লাগে না আর। ছেলেটাকে কোর্টে চালান দেওয়া হয়, মেলার কিছু লোক সাক্ষী দেয়, যে হ্যাঁ, মেয়েটা বাড়ি যেতে চাইছিল, ছেলেটার সাথে সেই নিয়ে কথা কাটাকাটি হচ্ছিলো খুব। ছেলেটা জানতে পারে নন্দিনী আর নেই, লাশ পাওয়া গেছে জোড়াপুকুরের ধারে, যোনিপথে হামলা করে কেউ বা কারা যেন শরীরের বাইরে টেনে হিঁচড়ে বের করে ফেলে রেখেছিলো ডিম্বাশয়। ধর্ষণ আর খুনের মামলায় সাজা শোনায় কোর্ট, ঠিক তখনই ছেলেটার সামনের পুলিশের কোমর থেকে পিস্তল ছিনিয়ে নিয়ে গুলি করে নিজের মাথায়। রক্তাক্ত দেহটা লুটিয়ে পড়ে কাঠগড়ার পাশে।

এই সমস্ত গল্পটা ও, মানে আমার পেশেন্ট অভিক ব্যানার্জীর মুখে শুনি। ওর মনে হতে লাগে ১৯৮৬-র ছেলেটা ও নিজেই, অথচ যার জন্ম হয় ১৯৯৮ তে। আমি মনে করি এটা একটা মনের অসুখ, ও নিজেই একটা গল্প বানিয়ে সেটাকে সত্যি বলে ভাবতে শুরু করেছে। আমি সেই মত ওষুধ দিই, ট্রিটমেন্ট চালাই। তারপর কিছুদিন আগে আমাদের একটা কাউন্সেলিং সেশনের সময় আমি ওর বাড়ি যাই। একাই থাকে ছেলেটা, বাবা-মা কেউ নেই, এক মাসি আছে সে বর্ধমানে থাকে। তো সেখানে আমাকে আমার ফজ দিতে গিয়ে আলমারি খোলে ছেলেটা, আমি সেখানে একটা শার্ট দেখি, রক্তের দাগ ছিল তাতে। আমার সন্দেহ হয়, টিভিতে খুনগুলোর ব্যাপারে শুনেছিলাম আগেই। আমি শ্যামনগর থানাতে গিয়ে খোঁজ নিই, পুরনো ফাইল ঘেঁটে নন্দিনী মিত্রর রেপ কেস পাওয়া যায়। হুবহু এক গল্প, শুধু পুলিশের বয়ানে মৃন্ময় নামে ছেলেটি ছিল দোষী। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের এই গল্প অভির জানার কথা না, এটা কোন খবরের কাগজে বেরোয়নি, এক কথায় ধামাচাপা করে রাখা হয়েছিল। একমাত্র যার দলিল ছিল পুলিশের ফাইলে। অভিক সেটা দেখেনি কখনই। এখন প্রশ্ন ও এত কিছু জানল কীভাবে!

একটা জমাট নিস্তব্ধতা ছিল ঘরটায়। সাব ইন্সপেক্টর সেখানে আঘাত হেনে বলল,

– পুনর্জন্ম? সম্ভব?

– শান্তি দেবী, ব্রায়ান উইস, গ্রেডেস ম্যাকগ্রেগর, চাইলে এমন অনেক কেস আছে, কিন্তু সেটা প্রমাণের সময় এটা নয়। এমনটাও হতে পারে কোনভাবে এই গল্পটা অভিক শুনেছে, আবার হয়তো কোথাও শোনেনি। কিন্তু আগে আমাদের অভিকের ঘরটা ভাল করে দেখা উচিত।

ইন্সপেক্টর বোসের নির্দেশে, পুলিশের কালো জিপের চাকা জল কাদা ছিটিয়ে অভিকের বাড়ির দিকে ছুটতে শুরু করেছে। রাতের আকাশের রং লাল। হাওয়া ক্রমে ভারী হয়ে আসছে, হয়তো বৃষ্টি নামবে শীঘ্রই।

. আজ রাতে ঘুম নেমে আয় চোখে

বৃষ্টি শুরু হয়েছে ঝেঁপে। সঙ্গে চলছে মেঘের গুড়গুড়ানি। অভিকের বাড়ির সামনে জিপটা দাঁড়িয়ে। ভিতরের ঘরে তল্লাশি চলছে, অভিক নেই, ঘর ফাঁকা। বালিশের নীচে ইন্সপেক্টর বোস পেলেন একটা চিরকুট। তাতে চারটে ঠিকানা লেখা। তিনটে ঠিকানায় লাশ উদ্ধার করে এসেছেন তিনি, বাকি শুধু শেষ ঠিকানায়। আজ রাতেই কিছু অঘটন ঘটবে, হাতে সময় নেই, শেষ খুনটা আটকাতেই হবে তাকে। জিপ নিয়ে ছুটে চললেন সেই ঠিকানায়। উত্তর কলকাতার পুরনো বাড়িটায় যখন এসে দাঁড়ালেন, শিউরে উঠলেন দেওয়ালে ভেজা কাঠের লেটার বাক্সে নাম দেখে, ‘রজত চৌধুরী’। ভিতরে ঢুকে দেখলেন এক বয়স্কা মহিলা টিভি দেখছেন সঙ্গে কাজের মেয়েটিও বসে। এভাবে পুলিশ ঢুকতে দেখে চমকে গেলেন তারা।

– কি চাই? কি ব্যাপার?

– রজত বাবু কোথায়?

– উনি তো একজন এসেছেন তার সাথে কথা বলছেন  ওপরের ঘরে।

– ওহ শিট!

সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে উপরের ঘরে উঠতে উঠতে শুনলেন ছাদ থেকে আসছে সেই পাশবিক চিৎকার, ঠিক চিৎকার নয়, আর্তনাদ, যেন কেউ নিজের ভালোবাসাকে ধর্ষিতা হতে দেখছে চোখের সামনে। বুকের কাছে হিম হয়ে গেল সেই চিৎকারে। উপরের ঘরের লাগোয়া ছাদ। ছাদে গিয়ে দেখলেন বৃষ্টির জলে চিৎ হয়ে পড়ে আছে রজত চৌধুরীর দেহ, আর তার পেটের ভিতর হাত ঢুকিয়ে রক্ত মাংসের পিণ্ড বের করে আনছে ছেলেটা। একটু করে চামড়া কাটছে, হাত ঢুকাচ্ছে আর বের করে আনছে। ইন্সপেক্টর আর কনস্টেবলদের জুতোর শব্দে ফিরে তাকাল অভিক। এই উর্দির উপর ভীষণ ঘেন্না, ভীষণ রাগ তার। ছুরি উঁচিয়ে বুনো শুয়োরের মত শব্দ করে তেড়ে এল ইন্সপেক্টর বোসের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে একটা বাজ পড়ার মত শব্দ, বারুদের গন্ধ বৃষ্টির জলে মিশে গেছে, বন্দুকের নল গরম হয়ে উঠেছে, ছেলেটা লুটিয়ে পড়ল ভিজে ছাদে। রক্তে লাল হয়ে গেল ছাদে জমা বৃষ্টির জল। এখনও শরীরে নিভু নিভু প্রাণ আছে। মিসেস চ্যাটার্জি ইন্সপেক্টর বোসকে সরিয়ে, ‘এ কি করলেন! এ কি করলেন মিস্টার বোস? ও অসুস্থ’, বলতে বলতে অভিকের কাছে এসে বসল। অভিকের মাথায় হাত রেখে বললেন,

– এবার ঘুমাও অভিক, তোমার কাজ তো শেষ, এবার ঘুমাও।

অভিকের রক্ত ওঠা মুখে সফেদ দাঁতে হাসির ছাপ।

– ম্যাম, সব কাজ শেষ নয়, আমাকে আবার আসতে হবে।

– কেন অভিক? কী বাকি আছে?

– নন্দিনীকে খুঁজতে হবে ম্যাম, যতদিন না খুঁজে পাব, এই গল্পের শেষ নেই। আমি আবার আসব ম্যাম, আমাকে খুঁজতেই হবে ওকে।

শেষ কথাগুলো জড়িয়ে যেতে যেতে নিস্তেজ হয়ে পড়ল শরীরটা। দু’টো পাথরের মত ক্লান্ত দৃষ্টি চেয়ে রইল শুধু। মিসেস চ্যাটার্জি চোখে জল আর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বন্ধ করে দিল অভিকের দু’চোখের পাতা। ‘অভিক, ঘুমাও, এ রাতে অন্তত তুমি ঘুমাও।’

উপসংহার

হিসেব রাখিনি, বসন্ত কেটে গেছে অনেকগুলো। কোন এক দেশের, কোন এক প্রদেশের, কোন এক গ্রামে, এক সূর্যমুখীর বাগানে তখন ভোরের আলো পড়েছে। উজ্জ্বল সোনালী আলোয় মেয়েটার মুখের হাসি স্পষ্ট। সে মন দিয়ে সূর্যমুখী দেখছে। সত্যিই কি সুন্দর।

একটা ছেলের কণ্ঠস্বর শোনা গেল পিছনে,

– পছন্দ?

মেয়েটা মুখের হাসি ধরে রেখেই আড়চোখে তাকিয়ে জবাব দিল,

– সূর্যমুখী আমার ভীষণ পছন্দ।

ছেলেটা একটা সূর্যমুখী ফুল এগিয়ে দিল মেয়েটার হাতে, মেয়েটা হাত থেকে ফুলটা নিয়ে লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে হাঁটা লাগাল বাড়ির পথে। ছেলেটা জিজ্ঞেস করল,

– এই যে, হ্যালো, তোমার নামটা বললে না তো!

পিছন না ফিরেই মেয়েটা জবাব দিল,

– নন্দিনী।

~ আন-রোম্যান্টিক

16 Jan 2021

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post আজ সব হারিয়েছি আমি| প্রেমে পড়া বারণ | তানভীর স্বাধীন| Bengali Love Story
Next post নববসন্ত| প্রেমে পড়া বারণ | সমাদৃতা মিত্র| Bengali Love Story