শুভদীপ ব্যানার্জী, উচ্চমাধ্যমিক টপার হয়ে ভর্তি হয়েছে নামকরা সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। বাবা নামকরা কার্ডিওলজিস্ট, মা কোর্টের উকিল। বাবা মায়ের চাকরির সূত্রে জন্মের প্রায় ছয় মাস পর থেকেই মানুষ হয়েছে কাজের মাসির কাছে। মা-বাবাকে নিজের মতো করে কাছে পায়নি শুভদীপ, পায়নি বাবার স্নেহ, মায়ের ভালোবাসা। কোনদিন হয়তো অভাব হয়নি, চাওয়ার আগেই পেয়েছে সব কিছু কিন্তু তবুও জেনো একাকীত্বের মাঝে বড়ো হতে থাকে সে। পড়াশুনোতে খুব ভালো হলেও সবসময় চুপচাপ থাকে ক্লাসে, এমনকি এত বড়ো হওয়ার পরেও। স্কুল আর বাড়ির মাঝামাঝি কারুর সঙ্গে তেমন কোন কথা বলত না সে, তাই আড্ডাহীন জীবনে, নিঃসঙ্গতার আবরণে বন্ধুর সংখ্যাও খুবই নগণ্য। এইভাবে হতে হতে অবশেষে ভর্তি হয় এই সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। নতুন মুখ, নতুন বন্ধুর মাঝে নিজেকে আরও যেন হারিয়ে ফেলে নিজের থেকে। এইভাবে হতে হতে এক মাসের মধ্যে ক্লাসমেট আবিরের সঙ্গে একটু ঘনিষ্ঠতা বাড়ে, কিন্তু আবিরও ধীরে ধীরে বুঝতে পারে যে, শুভদীপ কোন কারণে খুব একা, নিঃসঙ্গ। আবির খুব ভালো ছেলে, তাই সে ভাবতে থাকে যে কী করে শুভদীপকে নিঃসঙ্গ জীবন থেকে ফিরিয়ে আনা যায়। ভাবতে ভাবতে মাথায় খেলে যায় এক আশ্চর্য রকমের উপায়, ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে আবিরের। মনে মনে ভাবে, ‘এই প্ল্যানটা যদি কাজে লাগে তবে এতদিনে হয়তো বন্ধুর একটা উপকার করতে পারব।’
(২)
একদিন কলেজের ক্যাম্পাসের দালানে গল্প করতে করতে আবির বলে,
– শুভ চল, আজ একটু নদীর পাড়ে ঘুরে আসি। কতদিন যাইনি, আর একটা সারপ্রাইজ আছে তোর জন্য।
– সারপ্রাইজ! কিন্তু…
– না না কোনও কিন্তু না চল।
আর না করতে পারল না শুভদীপ। বিকেল চারটার দিকে দু’জনে নদী ধার বরাবর হাঁটতে লাগল।
– আবির, দাঁড়া। কিরে কেমন আছিস, এই তোর নতুন বন্ধু নাকি! বাহ্ দারুন হ্যান্ডসাম তো।
দু’জনে পিছন ফিরে ঘুরে দেখল যে একজন মেয়ে। কাজল নয়না হরিণীর মতো চোখে মায়াবিনী দৃষ্টি যে কাউকে আকৃষ্ট করে সহজেই।
আবির শুভদীপকে নিয়ে গিয়ে পরিচয় করালো,
– শুভদীপ, এ হল আমার বেস্টফ্রেন্ড – নাম কমললতা। এখন বি.টেকএ ভর্তি হয়েছে। খুব ভালো মেয়ে। চল আমরা হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি।
তিনজনে গল্প করতে করতে যেতে থাকল নদীর পাড় বরাবর। নদীর স্বল্প স্বল্প ঢেউএর ওপর সূর্য কিরণের অপূর্ব দৃশ্যকে সাক্ষী রেখে এগোতে থাকে তারা। সামনে মেয়েটি আর তার পিছনে দুই বন্ধু। কিছুদূর চলতে চলতে দৃশ্যটা পাল্টে গেল, সামনে চলে গেল আবির আর পিছনে পাশাপাশি হাঁটতে লাগল শুভদীপ আর কমললতা। আস্তে আস্তে পড়াশুনোর কথা বলতে বলতে বিভিন্ন কথা বলতে শুরু করে তারা। শুভদীপ বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে মেয়েটার সঙ্গে কথা বলে। অনেক কথা বলতে বলতে অনেকটা পিছিয়ে গেল তারা। অবশেষে সামনে অনেকখানি দূর থেকে আবির ডাক দিল,
“শুভদীপ অনেকটা সন্ধে হয়ে গেছে, চলে আয় এবার। বাড়ি যেতে হবে।”
অবশেষে দুই বন্ধু কমললতাকে বিদায় জানিয়ে দুজনে বাড়ির পথ ধরল।
রাস্তার যেতে যেতে আবিরের কিছু বলার আগেই শুভদীপ বলল,
“জানিস আবির, মেয়েটা খুব ভালো রে। খুব মিশুকে, খুব মিষ্টি, কি সুন্দর কথা বলে জানিস। এই প্রথম কারুর সঙ্গে এতটা মন খুলে গল্প করলাম।”
আবির মনে মনে ভাবতে লাগল, যাই হোক আমার আর কমললতা এর প্ল্যানটা কাজে লেগেছে। ভাগ্যিস শুভদীপের কথা বলেছিলাম ফোনে। মেয়েটা সত্যি খুব ভালো। এত সহজে রাজি হবে ভাবিনি। এখন আমি যেটা ভাবছি সেটা যদি হয় তবে শুভদীপের একাকীত্বের গল্প খাতার শেষ পাতায় কমললতা হয়ে উঠবে এক নতুন অধ্যায়।
আবির বলল, – তবে! কার বান্ধবী দেখতে হবে তো তাই না।
– কিন্তু একটা ভুল হয়ে গেল আবির। এত গল্প করলাম কিন্তু ফোন নম্বরটা নেওয়া হল না।
– (মুচকি হেসে) ও ভাবিস না তুই। আমার কাছে তো আছে। ওটা নিয়ে চিন্তা নেই। এখন চল তাড়াতাড়ি পা চালা।
এরপর আস্তে আস্তে শুভদীপ আর কমললতার মধ্যে ফোনে কথা বলা বাড়তে লাগল। এক ঘন্টা, দু’ঘন্টা চলতে চলতে কখনও সারা রাত হয়ে যায়। আবির বেশ খুশি হল শুভর একাকীত্বের জীবনে একটা হাসির মানুষকে এনে দিতে পেরে। প্রিয় বন্ধুর প্ল্যানের কথা আর জানতেও পারল না শুভদীপ।
(৩)
“তুই কি করে রাজি হয়ে গেলি? আমি ভাবতে পারছি না তুই কি করে রাজি হলি?”- আবির শুভদীপের দিকে তাকিয়ে বিরক্তি সহকারে কথাগুলো বলল।
আবির রাগে লাল হয়ে গেছে। মনে মনে আপশোশ করল, কারণ সেই তো কমললতাকে ভালো বান্ধবী মনে করে শুভদীপ এর জীবনের নিঃসঙ্গ প্রদীপটা জ্বালাতে চেয়েছিল। কিন্তু মেয়েটা এমন করবে শুভদীপের সঙ্গে, ভাবতেই পারেনি আবির।
আবির রাগে গজগজ করে কিছুক্ষণ পর বলল – “ইউ আর এ কাওয়ার্ড, প্রেমে আবার কি কোনও শর্ত হয় নাকি? আমারই ভুল, তোর জীবনটা আমি নষ্ট করে দিচ্ছি শুভ। কমললতা খুব ভালো মেয়ে জানি, কিন্তু ও এটা করবে ভাবতে পারিনি।”
– ভুল তো কিছু বলেনি ও। ওরও তো কিছু চাওয়া পাওয়া থাকতে পারে। আমাকে ভালোবাসে খুব, তাই হয়তো…। এছাড়া আমি এখন কোন চাকরি পাইনি। তাই এটুকু চেয়েছে।
-এটা কি কোন চাকরি যে শর্ত চাপিয়ে দেবে? ও কি এমন সুন্দরী কমললতা নাকি, যে তোকে একজন ভারতীয় ক্রিকেটার দলের একজন হতে বলল। তোকে যদি ওর ভালো লাগত তবে সে এমনি রাজি হয়ে যেত।
– সত্যি তো ও কমললতা। আমার নিঃসঙ্গ জীবনের গল্পের শেষ পাতার কমললতা, যে শেষ পাতা থেকে শুরু করব আবার নতুন করে লেখা। ও আমার সব। এতদিনে এমন একজনকে পেয়েছি যে পারবে আমার জীবন আশার আলোতে ভরিয়ে দিতে।
– তুই ওর পিছনে ছুটিস না আর প্লিজ। আমি ওকে এত বছরেও চিনতে পারলাম না। আমার তো নিজেরই লজ্জা লাগছে তোর কথা ভেবে যে তুই এসব…
– ওকে না পেলে আমি পাগল হয়ে যাব আবির। অনেক সুন্দর কথা বলে, হাসতে থাকে, কথা বলতে জানে, মানুষকে আপন করে নিতে খুব ভালো পারে। গতকাল কমললতার সঙ্গে দেখা করে প্রথমে বলেছিলাম, – ‘আমি জানি তুমি ক্রিকেট পছন্দ করো। তাই তুমি বাড়ির দেওয়ালে সব ক্রিকেটারদের ছবি লাগিয়ে রেখেছ। আমি ওদের থেকে কম কি। আগে আমি খেলা কি জিনিস জানতাম না। তুমি আমাকে বাইরের জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছ। তুমি ক্রিকেট ভালোবাসো জানার পর আমি আস্তে আস্তে ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছি, মিশে গেছি তোমার পছন্দের সঙ্গে। আমিও তো আমাদের গ্রামের ক্লাবের সেরা ক্রিকেটার।’
– তখন তোকে কমললতা কি বলল?
– তখন ও বলল, ‘কোথায় তুমি আর কোথায় ইন্ডিয়ান ক্রিকেটার’
– তখন আমি বললাম, ‘ওদের মতো সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মাইনি আমি, জন্মালে হয়তো কলকাতার যে কোনও ক্লাবের ক্রিকেট টিমে চান্স পেতাম।’
এসব শুনে আবির বলল, “বাহ্ চমৎকার, ইন্টারেস্টিং। এসব কথা আমাকে তো আগে বলিসনি। যাই হোক এটা শুনে কমললতা কি বলল?”
শুভদীপ বলল,“তখনই আমাকে শর্ত ছুড়ে দিল, বলল- তুমি কি পারবে ওদের মতো পর পর সেঞ্চুরি করতে, টেস্ট খেলতে, ওদের মতো একজন হয়ে উঠতে? যদি কোনদিন সেরকম হয়ে, একটা বড়ো জায়গায় গিয়ে সেঞ্চুরি করে আমাকে দেখাতে পারো সেদিন আমাকে পাবে।
আমি চ্যালেঞ্জটা একসেপ্ট করলাম শুধুমাত্র তোর কথা ভেবে আবির। কারণ কমললতাকে নিজের জন্য ধরে রাখতে না পারলে তোকে যে অসম্মান করা হবে।”
আবির অশ্রুভরা চোখে দেখতে লাগল শুভদীপের দিকে। ভাবল কত ভাগ্য করে এমন একটা বন্ধু পাওয়া যায়।
আবির বলল, “বেশ আমি কাল থেকে তোর সব ব্যবস্থা করে দেব। তোর নিজের ইচ্ছেতে তোকেই করতে হবে সেঞ্চুরি আর তাও সেটা কোনও এক বড় জায়গাতে।”
এরপর মিলিটারি ট্রেনিং এর মত আবিরের ঠিক করা এক কোচ এর তত্ত্বাবধানে প্র্যাকটিস করতে লাগল শুভদীপ। সকাল-সন্ধ্যা শুধু প্র্যাকটিস এর উপর প্র্যাকটিস। দু’মাসের মধ্যে সে কলকাতার এক বিখ্যাত স্পোটিং ক্লাবে চান্স পেয়ে গেল। তখন শুভদীপের নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে কমললতা, হৃৎস্পন্দনে কমললতা কিন্তু স্বপ্নে ক্রিকেট। কিন্তু তবুও সে ভাবতে থাকে যে, সত্যি কি সে আমার জীবনের কমললতা হয়ে উঠতে পারবে!
(৪)
আজ প্রথম ম্যাচ, সারা গ্যালারিতে দর্শক ভর্তি। দেখতে এসেছে কমললতাও। শুভদীপ এর মনে একটাই লক্ষ্য – বন্ধুর সম্মান আর কমললতার ভালোবাসা। দুটোকেই রক্ষা করতে নিঃসঙ্গ, মনমরা মানুষটা আজ ক্রিকেট মাঠে। খেলা শুরু হল। দলের অসামান্য কৃতিত্ব ও শুভদীপের ব্যাটিং এর ক্ষিপ্রতায় বিপক্ষ ধরাশায়ী। বাউন্ডারি আর ওভার বাউন্ডারির চাপে প্রথম ম্যাচেই সেঞ্চুরি করে সবাইকে চমকে দিল শুভদীপ। এই সেঞ্চুরি তার কাছে শুধু সংখ্যা নয়, একটা গুরুত্বপূর্ণ স্বপ্ন।
গ্যালারির রাস্তায় উল্লাসের মিছিল জয়ের পথে দাঁড়ায় কমললতা। শুভদীপকে বলল – “আমি ভাবতে পারিনি যে তুমি আমার জন্য এতটা করতে পারো। তবে দেখলে তো জেদ থাকলে মানুষ কত কি করাতে পারে।”
অভিনন্দন জানাতে এল আবির। এই প্রথম আবিরকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো শুভদীপ আর বলল, “আমি পেরেছি”।
আসলে কমললতাও তার জেদটা দেখতে চেয়েছিল শুধু।
কমললতা তখন বলল, “আমি রাজি শুভদীপ, আমি রাজি।”
অনেক আশ্চর্য হয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে অনেক পরে শুভদীপ বলল,“আমিও রাজি কিন্তু একটা শর্ত আছে।”
– শর্ত? কি শর্ত আবার? (অবাক হয়ে বলল কমললতা)
– শর্তটা হল, তোমাকেও আমার গল্পের শেষ পাতার কমললতা হয়ে উঠতে হবে।
– (মুচকি হেসে) কথা দিলাম। আজ থেকে তোমার জীবনের ‘পুরনো গল্পের শেষ পাতায় আমি সেই কমললতা’ হয়ে থাকব সারাজীবন। দু’জনে শুরু করব আবার নতুন গল্প সেই শেষ পাতা থেকেই।
দর্শক ভর্তি গ্যালারিকে সাক্ষী রেখে ও বেস্টফ্রেন্ড আবিরের সামনে দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরল।