চক্রব্যূহ| কঠোর ভাবে প্রাপ্তমনস্কদের জন্য | অমিত দত্ত| Bengali Story for Matured
0 (0)

“ দাদা, কাজটা হয়ে গেছে।’’

    “ শাবাশ! কোন সাক্ষী নেই তো?’’

    “ কেউ না দাদা। বাকি পেমেন্টটা…?’’

    “ পটাকে পাঠিয়ে দেব। ওর থেকেই নিয়ে নিস। আর শোন… ফোন করবি না আমাকে। এখন ফোন ট্যাপিং হচ্ছে। ঘরশ্ত্রু বিভীষণে সব ভরা।’’

     “ আচ্ছা দাদা। রাখলাম।’’

   সকাল সাতটা। রামকানাই নিয়োগীর বাড়িতে প্রাত্যহিক কাজকর্ম চলছে। গিন্নী রমাদেবী রান্নাঘরে রান্নার মাসিকে প্রতিদিনকার পদ বুঝিয়ে দিচ্ছেন। রামকানাইবাবু ব্যালকনিতে বসে চায়ের কাপ হাতে পেপারে চোখ বোলাচ্ছেন। মনের ভিতর একটা উত্তেজনা খেলা করলেও মুখে তার কোন  প্রকাশ নেই। রাজনীতির অলিগলিতে দীর্ঘদিন ঘুরতে ঘুরতে ও বহুঘাটের জল খেতে খেতে এই গুণ তিনি অর্জন করেছেন। ছেলে সমীর এখনও ঘুমাচ্ছে। কলেজে থার্ড ইয়ারে পড়ে। বিষয় জার্নালিজম। রাজনীতিতে আসার কোন ইচ্ছা নেই। বরং এই বয়সেই বেশ কিছু পত্রিকায় ফিচার লিখে ফেলেছে। ফিল্ম সম্বন্ধেও ভালই উৎসাহ আছে। মাঝেমধ্যে রিভিউ লেখে। বাপের সাথে দিনের মধ্যে খুব একটা কথাবার্তা হয় না। এইসব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে বিরক্তি নিয়েই একটু দূরে থাকে ও। রামকানাইবাবুও চান না যে সমীর সরাসরি রাজনীতির এই পাঁকে নামুক। তারপর ভবিষ্যৎ দেখা যাবে ভবিষ্যতে।

   রামকানাই নিয়োগী সূর্যনগরের তেরো নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। এছাড়া ওনার পৈতৃক হার্ডওয়ার্সের দোকানও আছে। দোকানটি ছোট ছিল, এখন যথেষ্ট বড় হয়েছে। বাড়িও একতলা থেকে দোতলা হয়েছে। ফ্লোরে ইতালিয়ান ব্ল্যাক মার্বেল । এই উন্নতি এমনি এমনি হয়নি। পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, সঠিক লোককে সঠিক সময়ে তৈলমর্দন ও প্রয়োজনে নিষ্ঠুর পদক্ষেপ নেওয়ার মানসিক দক্ষতা। দল বদলেছেন বেশ কয়েকবার। হাওয়া বুঝে, ক্ষমতায় থাকা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ ক’রে ধীরে ধীরে একজন সাধারণ কর্মী থেকে আজ তার উত্তরণ ঘটেছে একজন কাউন্সিলর হিসাবে। এখন তার পাখির চোখ সামনের বিধানসভা ইলেকশনে এম.এল.এ র টিকিট পাওয়া। কাজটা যদিও সহজ হবে না। প্রতিপক্ষ আছে। লড়াইটা এখানেই। কিন্তু রামকানাইবাবুও বছরের পর বছর ধ’রে লড়াই ক’রে ক’রে পায়ের নিচে মাটি শক্ত করেছেন। মিউনিসিপ্যালিটিতে তার বিশাল হোল্ড। কোন কনট্রাক্টারই তাকে দক্ষিণা না দিয়ে কোন টেন্ডার পাশ করাতে পারবে না। চেয়ারম্যানও তাকেই বিশ্বাস করেন। এর কারণও আছে। রামকানাই নিয়োগী একা সবকিছু গাপ করেন না। যথাযোগ্য স্থানে যথাযোগ্য দক্ষিণা পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে তার জুড়ি নেই। তবে বছরখানেক হল প্রতিদ্বন্দ্বীর আবির্ভাব ঘটেছে। দশ নম্বর ওয়ার্ডের  কাউন্সিলর কাজল সিংহ বাহুবলীর ভূমিকা ক্রমশ নিচ্ছে। বেশ কয়েকবার রামকানাইয়ের ছেলেদের সাথে কাজল সিংহ র ছেলেদের হাতাহাতি ঘটেছে। রামকানাইয়ের কাছে খবর আছে বেশ কয়েকজন কনট্রাক্টার গোপনে কাজলের সাথে যোগাযোগ রাখছে টেন্ডার পাশ করানোর জন্য। কাজল রামকানাইয়ের থেকে একটু কম কমিশন নিচ্ছেন। এ সবই বাজার ধরার কৌশল, রামকানাই তা ভালই বোঝেন। কাজল যে রামকানাইকে পথ থেকে সরিয়ে দেবার নীতি নিয়েছেন, রামকানাই তা বুঝতে পারছেন। তবে তিনিও দুদিনের কারবারী নন। রাজনীতিতে বিরোধী দলের নেতাদের থেকে নিজের দলের লোকেদের সাথেই যে লড়াইটা বেশি তা এতদিনে রামকানাই বুঝে ফেলেছেন। শাসক বিরোধী এসব লড়াই জনগণের জন্য। আইওয়াশ। তবে আজ সকালে তিনি চিন্তিত যে ঘটনাটা ঘটে গেছে তার পরবর্তী অভিঘাত নিয়ে। ব্যাপারটা নিয়ে যে যথেষ্ট জলঘোলা হবে তিনি নিশ্চিত। তবে তিনিও তৈরি আছেন।

        পকেটে মোবাইলটা বাজছে। তিনি এটারই অপেক্ষা করছিলেন। ফোনটা রিসিভ করলেন।

   “ বল।’’

   “ দাদা, অরবিন্দ স্পোর্টিং গ্রাউন্ডের পাশের হাইড্রেনে মদনের লাশ ভাসছে।’’

   “ বলিস কি! সকাল সকাল এসব কী খবর দিলি?”

   “ আমিও তো খুবই অবাক হয়ে গেছি দাদা। মদনের মতন গুন্ডাকে কে সাবাড় করলো? কাজল সিংহ র কাছেও খবর পৌঁছে গেছে। ওর পেয়ারের কুত্তার মার্ডারকে সহজে মেনে নেবে না। কী করব দাদা? সরে আসব?”

   “ এখন ওখান থেকে কেটে পড়। লোকজন জোগাড় কর। আমি আধঘন্টা পরে যাচ্ছি। গোটা কুড়ি ছেলে নিয়ে যা। হাজার হোক একটা ছেলে খুন হল। যেমনই হোক না কেন। অপরাধী কোন ছাড় পাবে না। থানায় খবর গেছে?’’

   “ গেছে দাদা।’’

   “ ঠিক আছে। পুলিশ আসুক। আমরাও পৌঁছাচ্ছি।’’

    ফোনটা রেখে রামকানাই নিয়োগী মনে মনে হাসলেন। তার রাজনৈতিক গুরু প্রাক্তন এম.এল.এ স্বর্গীয় রমাপদ বিশ্বাস বলতেন এমন ভাবে কাজ করবে যে ডানহাত জানতে পারবে না বাঁ হাত কী করেছে। রামকানাইবাবু দু-হাত তুলে প্রণাম জানালেন রমাপদ বিশ্বাসের উদ্দেশ্যে। পটার হাতে বাকি টাকাটা দেবার সময়ে অবশ্য তিনি বলে দিয়েছিলেন যে সিজার যেন এখন কিছুদিন বিহারের চম্পারণেই থাকে। অন্য কোন জায়গায় যেন না যায়। পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হলে তিনি নিজেই ডেকে পাঠাবেন।

   রামকানাইবাবু উঠলেন। এবার অ্যাকশনে নামতে হবে। নিচে একতলায় নামলেন। রমা আর সমীর ড্রইংরুমে ব’সে চা খাচ্ছে। সমীর তাহলে উঠেছে। ছেলে কী করছে, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী, এসব নিয়ে ভাববার বা কথা বলার সেরকম কোন সময়ই পান না রামকানাইবাবু। রমার বয়স পঁয়তাল্লিশ-ছেচল্লিশ। গৃহবধূ। সংসারের সব ঝক্কি ও রাজনৈতিক নেতা রামকানাইয়ের হাজার মতিগতি সামলেও এখনও শরীরের বাঁধুনিটুকু ঠিক রেখেছেন। মাঝারি উচ্চতা, ফর্সা ত্বক। মুখে মিষ্টতা আছে। মাঝে মাঝে রামকানাইবাবু ভাবেন রমা না থাকলে তিনি কি এতদূর এগোতে পারতেন? এই কারণেই কিনা জানেন না, এত ব্যস্ততা ও কূটকচালের মধ্যেও এখনও মাসে অন্তত দুবার তিনি রমার সাথে শারীরিক মিলন করেন। রমারও তাতে কোন আপত্তি থাকে না। দু-জনেরই কাছে এটা এখনও একটা উপভোগ্যের বিষয়।

   রামকানাইবাবু একটা পাঞ্জাবী গলিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বেরোচ্ছেন দেখতে পেয়ে রমাদেবী ডাকলেন-

“ কী গো, জলখাবার না খেয়েই বেরোচ্ছ?’’

সমীর মোবাইলে কিছু একটা দেখছিল। ও মুখ তুলে তাকাল।

রামকানাইবাবু উত্তর দিলেন-

“ হ্যাঁ, এখনই বেরোতে হবে। একটা জরুরী কাজ এসে পড়েছে।’’

“ না, না, জলখাবার না খেয়ে তুমি কোথাও বেরোবে না। একটু বোসো, কল্পনা লুচি ভেজে দিচ্ছে।’’

“ বললাম তো, বসার সময় নেই। আমাদের দলেরই একটা ছেলে খুন হয়েছে। ওখানে যেতে হবে।’’

“ সাতসকালেই খুন! আর ভাল লাগে না। ঠিক আছে, যাচ্ছ যাও কিন্তু একটা কিছু মুখে দিয়ে তবে ঘর থেকে বেরোবে।’’ রমাদেবী আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে রান্নাঘরের দিকে এগোলেন।

    পাঁচমিনিট পর রামকানাইবাবু যখন গপগপ ক’রে লুচি আর বেগুনভাজা মুখে ঢোকাচ্ছেন তখন সমীর বাবাকে প্রশ্নটা করল-

“ আচ্ছা বাবা, সারাক্ষণ এই খুন, মারামারি, হিংসা এসবের মাঝে কী আনন্দ পাও তুমি? দোকানে তো যাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছ। উজ্জ্বলকাকু আর রাতুলই সব সামলাচ্ছে।’’

   রামকানাইবাবু হাতটা মুখে তুলতে গিয়েও থামলেন। সমীরের দিকে তাকিয়ে বললেন-

“ এই রাজনীতির জন্যই তো সব উন্নতি। তুই তো পড়াশোনা আর নিজের জগতেই থাকিস। এই দিকে তো আর নজর দিলি না। রাজনীতি হল রাজার নীতি। এই রাজনীতিতেই সব আছে- জন্ম মৃত্যু, উত্থান পতন, নীতি দুর্নীতি, উদারতা নৃশংসতা। যে এটা বুঝেছে সে সব জয় করেছে।’’

   সমীর মোবাইলের দিকে দৃষ্টি ফেরাল। স্ক্রিনটা সোয়াইপ করতে করতে বলল-

“ জার্নালিজম পড়তে পড়তে আমিও কিছুটা জানতে পেরেছি। জানি না, পেশা হিসাবে সাংবাদিকতা আমি নেব কিনা, তবে রাজনীতিতে আমি কখনও আসব না। সে আমি যাই করি না কেন। অন্তত নিজের বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাকব যে নিজের স্বার্থের কারণে আমি কাউকে খুন করাইনি।’’

   সমীর উঠে চলে গেল। রামকানাইবাবু চমকে উঠলেন। খাওয়া থামিয়ে দিলেন। সমীর এটা কী বলে গেল? ও কি তবে কিছু শুনতে পেয়েছে? না কি এমনি একটা জেনারেল কথা বলে গেল? রামকানাইবাবু উঠে পড়লেন।

     অরবিন্দ স্পোর্টিং গ্রাউন্ডে যখন পৌঁছালেন, তখন সেখানে লোক থিকথিক করছে। নিজের গ্রুপের জনা কুড়ি ছেলেকে দেখতে পেলেন। একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। ওনাকে কাছে আসতে দেখে কমল এগিয়ে এল। ওই ফোনটা করেছিল।

   “ দাদা এসেছেন?”

   “ হুঁ। লাশ তোলা হয়েছে?”

   “ না দাদা, এখনও হয়নি। পুলিশ এসেছে। জিগ্যেস-টিগ্যেস করছে। কাজল সিংহ খুব তড়পাচ্ছে।’’

   “ সে তো তড়পাবেই। চল।’’

    রামকানাইবাবু এগোলেন। ভিড়টা একটু জায়গা ছেড়ে দিল। ও.সি নিজেই এসেছেন। রামকানাইবাবু ওনার দিকেই এগিয়ে গেলেন।

 “ এসব কি হচ্ছে বলুন তো মি.দাস? দুর্গানগর ত অপরাধীদের স্বর্গরাজ্য হয়ে যাচ্ছে। আজ একটা খুন তো কাল বোমাবাজি। ল এয়ান্ড অর্ডার তো ভেঙে পড়েছে দেখছি।’’

    ও.সি অরিন্দম দাস মুখ কাঁচুমাচু ক’রে বললেন-

“ আমরা তো চেষ্টা করছি স্যার। তবে থানায় ফোর্স কম। ফলে সবদিক সামলে উঠতে পারছি না। ভাববেন না, এই মার্ডার কেস সলভ ক’রে ফেলব। মনে হচ্ছে, মদনের রাইভ্যাল গ্রুপেরই কাজ এটা। একদম পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে ফায়ার করেছে। কাল রাতে খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। বাইরে খুব একটা কেউ ছিল না। আওয়াজও কেউ শোনেনি। ফলে সাক্ষী জোগাড় করা একটু কঠিন হবে। তবে এই কেস সলভ ক’রে দেব। চিন্তা করবেন না স্যার।’’ ও.সি সামনে এগোলেন কিছু লোককে জেরা করার উদ্দেশ্যে।

    কাজল সিংহ এগিয়ে এলেন রামকানাইয়ের দিকে। বয়স রামকানাইয়ের মতনই। কালো বলিষ্ঠ চেহারা। পাকানো মোচ আছে। তুই তোকারি সম্পর্ক দুজনের। কাজলের চোখে আগুন জ্বলছে।

   “ কাজটা ভাল করলি না রামকানাই।”

   “ কোন কাজের কথা বলছিস?”

   “ ন্যাকামো করিস না। ভাবছিস খুন খারাপি ক’রে তুই পার পেয়ে যাবি? এম.এল.এ হবি?”

   “ মুখ সামলে কথা বলবি কাজল। মদনকে আমি মারতে যাব কেন? কোন প্রমাণ আছে যে তুই এই কথা বলছিস? তুই নিজের লোককে সামলে রাখতে পারিস না, সেটা আমার দোষ? আর এম.এল.এ র ব্যাপারটা তো ডিস্ট্রিক্ট সেক্রেটারি গোপালদা ঠিক করেন। উনিই নাম রেকমেন্ড ক’রে সি.এম র কাছে পাঠান। এখনও তো ইলেকশনের ছ’মাস বাকি আছে। এতই যখন শখ তুই চেষ্টা করছিস না কেন?”

    কথাগুলো মুখের উপর ছুঁড়ে দিয়ে রামকানাইবাবু স্পট থেকে বেরিয়ে এলেন। এখন ওয়ার্ড অফিসে যাবেন। একবার গোপালদাকে ফোন করবেন। যদি সম্ভব হয় তাহলে বাড়িতে চায়ের নিমন্ত্রণ জানাবেন। নামেই চায়ের নিমন্ত্রণ, আসলে চলে বিদেশী পানীয়। রমার দক্ষ ব্যবস্থাপনাতে সবকিছু খুব সুন্দরভাবে উতরে যায়। গোপালদা অবশ্য এখনও তার বাড়িতে পায়ের ধুলো দেননি। লোকটার একটু চরিত্রের দোষও আছে। তবে এসব ভাবলে চলবে না। রেকমেন্ডেশনের চাবিকাঠি গোপাল পালের কাছেই। ডিস্ট্রিক্ট সেক্রেটারি হিসাবে সি.এম র একদম কাছের লোক। একে সন্তুষ্ট করতেই হবে। রামকানাইবাবু পা চালালেন।

     দুর্গানগরের শপিং কমপ্লেক্স থেকে আধকিলোমিটার দূরে ‘ ড্রিম এবোড ’ নামে নতুন একটি হাউজিং কমপ্লেক্স গড়ে উঠেছে। ওখানেই একটি টাওয়ারের ফিফথ ফ্লোরের একটি ফ্ল্যাটে সমীর এখন ব’সে আছে। এটি দীপার ফ্ল্যাট। সম্প্রতি ওরা শিফট করেছে। আগে দীপারা নতুন পাড়ায় থাকত। দীপার বাবা রিটায়ার করার পর পৈতৃক বাড়ি বেচে এই ফ্ল্যাটটি কিনেছে। বাড়িতে দীপা আর ওর বাবা। মা নেই। বছর পাঁচেক আগে ক্যান্সার দীপার মা’কে কেড়ে নেয়।

     ঘরে মুখোমুখি সমীর আর দীপা ব’সে আছে। দীপার বাবা কমপ্লেক্সেরই একটি ক্লাবে গেছেন। ঘন্টাদু’য়েকের আগে ফিরবেন না। দীপা একই কলেজে সোশিওলজি নিয়ে পড়ছে। সাবজেক্ট আলাদা  হলেও সমীর আর দীপার বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। আর সেই বন্ধুত্ব এখন গভীর প্রেমের আকার নিয়েছে। সম্প্রতি দীপা বামপন্থী আন্দোলনের দিকে ঝুঁকেছে। এই নিয়ে দীপা আর সমীরের মধ্যে কথা কাটাকাটি হচ্ছিল। দীপা বলে-

  “ তুই কি চাস না যে সম্পদের সমবন্টন হোক? ধনী দরিদ্র ভেদাভেদ মুছে গিয়ে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠুক?”

    সমীর হাসল।

   “ এইসব আইডিয়োলজি তিরিশ বছর আগেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ধনী দরিদ্র ভেদাভেদ কখনই মুছবে না। কারণ হল মানুষের মন। একে কোন একটা নীতি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। মানুষের মধ্যেই বিশ্বাসঘাতকতা লুকিয়ে আছে। ফলে কখনই সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠবে না। তুই ফালতু সময় নষ্ট করছিস দীপা।”

   “ আমি এটা বিশ্বাস করি না। সমাজ একদিন বদলাবেই। তাইতো আমি ঠিক করেছি এইবারের বিধানসভা ইলেকশনে আমি আমাদের ক্যান্ডিডেট রূপা গোস্বামীর হয়ে ক্যাম্পেনিং করব। পোস্টার, দেওয়াল লিখন, মিছিল সবেতেই থাকব।”

   সমীর বাধা না দিয়ে পারল না।

  “ তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে দীপা? একদম রাজনীতির মধ্যে ঢুকিস না। আমি হার্ডকোর রাজনীতির বাড়ির ছেলে হিসেবে বলছি, একবার এই পাঁকে নামলে আর উঠতে পারবি না। আর তোর ওই সমাজ পালটে দেওয়া নেতা নেত্রীরা তোর মাথার উপর পা দিয়েই আরও উপরে উঠে যাবে। আমার কথা শোন, এই অন্ধগলি থেকে বেরিয়ে আয়।”

    দীপা এবার সমীরের পাশে একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে বসল। চোখে ছলছল ভালবাসা নিয়ে সমীরের দিকে তাকিয়ে বলল-

  “ আমি যদি ডুবেও যাই, তুই আমাকে তুলবি না? বল, বল। আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিবি না? এই আমাকে ভালবাসিস?”

    সমীর দীপার হাত মুঠো ক’রে ধরল।

  “ এইজন্যই তো তোকে বলছি রাজনীতির মধ্যে ঢুকিস না। এটা খুব নোংরা একটা জায়গা। তুই জানিস না, আমি কি কি দেখেছি বা শুনেছি!”

  “ ওইজন্যই তো আরও বেশি ক’রে আমাদের মতন শিক্ষিত ছেলে মেয়েদের রাজনীতিতে আসা দরকার সমীর। তাহলেই এই কলঙ্ক দূর হবে। আর তুই ছাড়া আমি এই লড়াই একা লড়তে পারব না রে। বল, তুই আমার পাশে থাকবি, বল।” দীপা আরও এগিয়ে এসে সমীরের ঠোঁটের উপর নিজের ঠোঁট রাখল। অমৃতের সন্ধান পেয়ে সমীরের চোখ আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে গেল। কয়েক মিনিট পর দীপা উঠে গিয়ে ঘরের দরজাটা বন্ধ ক’রে দিল। সমীর অবাক হয়ে দীপার দিকে তাকাল। “কী করছিস, কাকু চলে আসবেন যে?”

   দীপা ঠোঁটে এক দুষ্টু হাসি মেখে উপরের টপটা খুলে ফেলল। ব্রায়ের একটা স্ট্র্যাপ নামাতে নামাতে বলল-

  “ বামপন্থার পথে এগোনো এত সহজ নয়। অনেক প্রলোভোন থাকে। আজকে আমি তোর পরীক্ষা নেব। আমি নিজেকে তোর কাছে সঁপে দেব। দেখব তুই নিজেকে কতটা কন্ট্রোল করতে পারিস? এটা আমারও পরীক্ষা হবে। আমি জীবনসঙ্গী হিসেবে ঠিক লোককে বেছে নিয়েছি কিনা জানতে পারব।”

   ব্রায়ের দ্বিতীয় স্ট্র্যাপটাও নামিয়ে দীপা সমীরের দিকে দু-হাত বাড়িয়ে দিল। সমীর এক দৃষ্টিতে দীপার উন্মুক্ত স্তনের দিকে তাকিয়ে আছে। আস্তে আস্তে একটা ঘোরের মধ্যে থেকে সমীর দীপার দুই স্তনের মধ্যবর্তী উপত্যকায় আশ্রয় নিল। একটা অজানা সুগন্ধ তাকে আচ্ছন্ন করল।

               আসর বেশ জমে উঠেছে। রামকানাইবাবুর বাড়ির একতলায় একটি ঘর এসব বিশেষ অনুষ্ঠানের জন্যই প্রস্তুত করা হয়েছে। সিক্রেট পলিটিক্যাল মিটিং, ড্রিঙ্কিং পার্টি, ক্যাশ লেনদেন ইত্যাদি যাতে নির্বিঘ্নে আর গোপনীয়ভাবে সম্পন্ন করা যায়, তার জন্য স্পেশাল এই ঘরটি তৈরি করিয়েছেন রামকানাইবাবু। ঘরের এক কোণে একটি মাঝারি মাপের ফ্রিজ আছে যার তাকগুলো ভর্তি দামী ওয়াইনের বোতল দিয়ে। হোস্ট হিসাবে রমা বরাবরই তুখোড়, আগেই বলা হয়েছে। অবশ্য শুরুর দিকে রামকানাইবাবুকে ট্রেনিং দিতে হয়েছিল। প্রথম প্রথম রমা এসব করতে মোটেও রাজী ছিল না। কিন্তু রামকানাইবাবু কিছুটা জোর করেই রমার হাতে ওয়াইনের গ্লাস তুলে দিয়েছিলেন।  কীভাবে ড্রিঙ্কস তৈরি করতে হয়, তাও হাতে ধরে শিখিয়েছিলেন। স্বামীর উন্নতি দেখে পরবর্তীকালে রমা আর আপত্তি করে নি।

    গোপাল পালের হাতে এখন ওল্ড মঙ্ক। অন দ্য রকস। স্পেশাল ডিজাইন করা কাচের গ্লাসে সোনালী তরল যেন সমস্ত পরিবেশটাকেই নেশাগ্রস্থ ক’রে তুলেছে। গোপাল পালের চোখ ঢুলুঢুলু। একটা চিকেন পকোড়া মুখে চালান ক’রে গ্লাসে আর একটা চুমুক দিল গোপাল।

    “ তারপর রামকানাই, নদের হাট রাস্তাটার টেন্ডার পাশ করিয়ে তোমার পকেটে কত ঢোকালে বাবা?”

   রামকানাইবাবু একহাত জিভ কেটে নিজের কান নিজে মুললেন।

   “ ওরকম বলবেন না দাদা। আমি কি আপনাদের প্রাপ্য দিই না?”

   “ না, তা দাও। আমি বলছি তুমি নিজের জন্য কত রাখ?”

   “ ওই আপনাদের প্রসাদ হিসাবে যা পড়ে থাকে, তাই নিই দাদা। আপনারা আমার উপর বিশ্বাস রাখেন বলেই তো কাজ করতে পারছি।”

   “ হুঁঃ! তবে কাজলের প্রপোজালও কিন্তু আমাদের কাছে আসছে। এবং পার্সেন্টেজ কিছুটা বেশিই। আমাদের তো সবাইকেই নিয়েই চলতে হয়। সবাই তো দলের লোক। জান নিশ্চয়ই, মিউনিসিপ্যালিটির লাস্ট মিটিং এ একটা কমিউনিটি হল আর একটা অডিটোরিয়াম বানানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যেই টেন্ডার কল করা হবে। এইবার ব্যাপারটা কিন্তু এতটা একতরফা হবে না। চেয়ারম্যানও আমার সাথে কথা বলেছিল কাজলের ব্যাপারে। তোমার পলিসি চেঞ্জ করতে হবে, নইলে…”

     রামকানাইবাবুর মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ পড়ল। গোপাল পালকে ডেকেছি্লেন অন্য এক কারণে। এখন তো দেখা যাচ্ছে যে হাতের পাঁচও বেরিয়ে যাচ্ছে। গদগদ হয়ে রামকানাইবাবু বললেন-

   “ আজ্ঞে দাদা, আপনার আশীর্বাদ যদি আমার মাথার উপর থাকে, তাহলে অন্য কাউকে নিয়ে আমার চিন্তার কিছু নেই।”

    “ হুঁ বুঝলাম।”

    “ আর একটা কথা দাদা…”

    “ কী কথা?”

    “ বলছিলাম…নির্বাচন তো প্রায় এসে গেল। আর মাসছয়েক বড়জোড়। এই অঞ্চলে সবকিছুই তো আপনার হাতে। সি.এম আপনাকে অন্ধের মতন বিশ্বাস করেন…”

    “ বিশ্বাসের মর্যাদা দিতে হয় বুঝেছ? গত তিনটি ইলেকশানে দুর্গানগরের ক্যান্ডিডেট রেকর্ড ভোটে জিতেছে। এই তো সুবোধ কর্মকার, বর্তমান বিধায়ক, গত বারের নির্বাচনে কত ভোটে জিতেছিল?”

    “ তা দাদা লাখের উপরে।”

    “ এক লাখ পনেরো হাজার! বুঝেছ? এমনি এমনি তো এসব হয়না। ভোট করাতে হয়। এই রেজাল্ট দিতে পারি বলেই তো উনি আমার উপর ভরসা রাখেন।” 

    “ সে তো বটেই দাদা, সে তো বটেই। তা বলছি এইবারেও কি সুবোধ কর্মকার ই টিকিট পাবে না অন্য কেউ…”

    “ কেন তোমার টিকিট লাগবে না কি?”

    “ তা দাদা… যদি যোগ্য মনে করেন… ওগো শুনছ ভেটকি ফ্রাইটা নিয়ে এস। দাদা… আপনার গ্লাসটা তো খালি হয়ে এসেছে। দিন, দিন আর একটা পেগ বানিয়ে দিই।”

      স্বামীর গলা শুনে রান্নাঘর থেকে তাড়াতাড়ি রমা বেরিয়ে এল। আজ সে পরেছে কালো স্লিভলেস ব্লাউজ, কাঞ্জিভরম শাড়ি আর গলায় নেকলেস। ঠোঁট গাঢ় লাল লিপস্টিকে রাঙানো। বুকের কাছে আঁচল একটু সরানো, যাতে নিচু হয়ে খাবার বা ড্রিঙ্ক সার্ভ করতে গেলে ক্লিভেজ বেরিয়ে আসে। বলা বাহুল্য, এসব ট্রেনিং রামকানাইবাবুরই দেওয়া। রমার কোন ইচ্ছাই নেই এইভাবে শরীর প্রদর্শন করার। কিন্তু স্বামীর ইচ্ছার মর্যাদা রাখার জন্য সে এইসব অপ্রিয় কাজও করছে।

     রমা ভেটকি ফ্রাইয়ের প্লেটটা সেন্টার টেবিলের উপর রাখল। গোপাল পাল ঢুলুঢুলু চোখে রমাকে জরিপ করছে। রমার বুকের খাঁজ তার নজর এড়িয়ে যায়নি। হাতটা বাড়িয়ে গোপাল রমার ডানহাত ধ’রে টান দিয়ে বসাল। রমা একটু হকচকিয়ে গেল। গোপাল জড়ানো গলায় বলল-

    “ কোথায় কোথায় পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বৌদি? আমাদের একটু কোম্পানিও তো দিতে পারেন। আপনি থাকলে রাতটা আরও রঙিন লাগবে।”

     রমা অপ্রস্তুত ভাবটা কাটিয়ে উঠে মুখে জোর ক’রে হাসি ফুটিয়ে তুলল। বুকের কাছে আঁচলটা টেনে নিয়ে বলল-

     “ কোথায় আর যাব দাদা? এইসব আয়োজনেই তো ব্যস্ত আছি। আপনি খান।”  কথাটা বলেই রমা উঠে পড়ল। লোকটাকে দেখে তার ঘেন্নায় বমি আসছে।

     রামকানাইবাবু লক্ষ্য করলেন গোপাল পালের নজর এখন রমার পেছন দিকে। রমা আবার রান্নাঘরের দিকেই যাচ্ছিল। বয়স হলেও রমার কোমর বা পেছনের অংশে সেরকম মেদ জমেনি। হাল্কা যা একটু মেদ রয়েছে তা রমাকে আরও আকর্ষণীয় ক’রে তুলেছে। রামকানাইবাবু বুঝলেন গোপাল পাল শিকারের সন্ধানে আছেন। তিনি একটু অস্বস্তির মধ্যে পড়লেন।

      “ রামকানাই”, গোপাল পাল জড়ানো গলায় কথা শুরু করেছে, “ তুমি তো জান অনেক বছর হল আমার বউ নেই। একা একা এত বড় একটা টেনশনের জীবন কাটানো কতটা কঠিন তুমি সেটা বুঝতে পারবে না। জীবনের মধু হল রমণী। তুমি খুব সুখী যে তোমার ঘরে রমার মতন বউ আছে। তা এই সুখ কি আমি একরাতের জন্যও পেতে পারি না?”

   রামকানাইবাবু চমকে উঠলেন। তিনি এইটা প্রত্যাশা করেননি।

   “ আজ্ঞে গোপালদা, এটা কী বলছেন!”

   “ রামকানাই, তোমার প্রত্যাশা তো অনেক কিছুই। তা এটা তো জান যে কিছু পেতে গেলে কিছু দিতে হয়। তোমার থেকে যোগ্য ক্যান্ডিডেট দলে অনেকেই আছে। তাদেরকে সরিয়ে তোমাকে প্রেফারেন্স দেব কী জন্য বলতে পারো?”   

     গোপাল পাল উঠে পড়ল। টলতে টলতে গেটের কাছে দাঁড়ানো সাদা বোলেরোর দিকে এগিয়ে চলল সে। একটা হাত ধরে আছেন রামকানাইবাবু। মনটা মেঘাচ্ছন্ন। গাড়িতে ওঠার আগে দরজায় হাত রেখে ঘুরে দাঁড়াল গোপাল।

    “ আজ বৃহস্পতিবার। রবিবার সন্ধ্যায় আমি ফাঁকা আছি। বাড়িতে আমি একাই থাকি। কেউ জানবে না। চাকরগুলোকেও বিদায় ক’রে দেব। ভেবে দেখতে পার। তোমার লোকসান হবে না। এমনিতে দেখতে গেলে নেতৃত্বর কাছে তোমার গ্রহণযোগ্যতা কিন্তু ততটা নেই যতটা তুমি ভাবছ। আচ্ছা, চলি।” বোলেরো বেরিয়ে গেল। 

      রামকানাইবাবু একবুক কুয়াশা নিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকলেন। কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। কিন্তু সিদ্ধান্ত তো একটা নিতেই হবে। রমা ড্রয়িং রুমে ঢুকল।

     “ ওই লোকটাকে আর কোনদিন বাড়িতে আনবে না। আমাকে যেন চোখ দিয়ে ধর্ষণ করছিল। নোংরা, জানোয়ার একটা।”

     রামকানাইবাবু সোফায় এসে চুপচাপ বসলেন। রমা পাশে এসে বসল।

     “ কী ব্যাপার? চুপ ক’রে আছ কেন? কিছু বললে না যে?”

    রামকানাইবাবু নীরবতা ভাঙলেন।

    “ রমা তুমি আমার জন্য অনেককিছু করেছ। আমি তার জন্য ঋণী। আমি জানি তোমার এইসব ড্রিঙ্ক সার্ভ করতে একদম ভাল লাগে না। তুমি শুধু আমার উন্নতির দিকে চোখ রেখে নিজেকে স্যাক্রিফাইস ক’রে যাও। শেষ একটা জিনিস এবার তোমার কাছে চাইছি। আর কিছু কখনও চাইব না। তুমি তো জান যে আমার লক্ষ্য হল এম.এল.এ হওয়া। কিন্তু টিকিট পাওয়া না পাওয়া নির্ভর করছে এই নোংরা লোকটার উপর। তাই যদি…”

    রমা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল। “ আমায় কী করতে হবে?”

    “ যদি একটা রাত…”

    সপাটে চড় নেমে এল রামকানাইবাবুর গালে। রমা উঠে দাঁড়িয়েছে। থরথর ক’রে কাঁপছে।

    “ নামতে নামতে তুমি কোথায় নেমেছ তুমি সেটা নিজেই জান না। নইলে আজ এই কথা তুমি আমাকে বলতে পারতে না। তোমার জন্য, শুধু তোমার উন্নতির জন্য আমি কি না করেছি? আজ তুমি তার প্রতিদানে আমাকে বেশ্যা বানাতে চাইছ? ছিঃ। তোমাকে স্বামী হিসাবে পরিচয় দিতে আমার ঘেন্না লাগে।” রমা চোখের জল মুছতে মুছতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। নির্বাক হয়ে ব’সে রইলেন রামকানাইবাবু।

              মাস পাঁচেক পর। ওয়ার্ড অফিসে ব’সে আছেন রামকানাইবাবু। সাথে গুটিপাঁচেক ছেলে ছোকরা। দেওয়ালে লাগানো এল.ই.ডি টিভিটা চলছে। ইলেকশন ডিক্লেয়ার হয়ে গেছে। আজ সি.এম প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করছেন। দুর্গানগর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে প্রার্থী হচ্ছেন কাজল সিংহ। অফিসে থমথমে আবহাওয়া। এরকম যে একটা কিছু হবে তার আঁচ টের পেয়েছিলেন রামকানাইবাবু। কিন্তু খবরটা শোনার পর এখন ভেতরে ভেতরে হতাশায় ভেঙে পড়েছেন। এমন সময় কমল ঢুকল ভেতরে। উত্তেজিত।

    “ দাদা খবরটা পেয়েছেন?”

    রামকানাইবাবু মুখ তুললেন। “ কী খবর? একটা খবর তো চ্যানেলেই দেখাচ্ছে।”

    “ একটু বাইরে আসবেন?”

    দু’জনে অফিসের বাইরে এল। কমল মুখটা রামকানাইবাবুর কানের পাশে নিয়ে এসে ফিসফিস ক’রে বলল-

    “ সিজার ধরা পড়েছে।”

    রামকানাইবাবু চমকে উঠলেন। ফ্যাকাশে হয়ে গেল তার মুখ।

    কমল বলে চলেছে-

    “ পটা ওই কাজলের গ্রুপে নাম লিখিয়েছে। ওই ফাঁস করেছে সবকিছু। এখন কী হবে দাদা?”

   রামকানাইবাবু মাথা নিচু ক’রে ভাবছেন। গুরুর নির্দেশ থাকলেও রাজনীতিতে সব কাজ একা করা যায় না। তাই ইচ্ছে না থাকলেও কিছু কিছু গোপন খবর অন্যরাও জানতে পারে। পটা সেরকমই একজন লোক। আজ সুযোগ বুঝে পিছনে ছুরিটা মারল। ওকে না হয় পরে দেখা যাবে, কিন্তু এখন কী করণীয়? আতঙ্কিত হলে চলবে না। প্রয়োজনে কাজলের সাথেও কথা বলতে হতে পারে। টাকা পয়সা দিয়ে একটা সেটলমেন্টে আসতে হবে। মুখে বললেন-

   “ তুই এসেছিস। এখন কিছুক্ষণ অফিসে বোস। আমি বাড়ি যাচ্ছি। শরীরটা ভাল ঠেকছে না। বাকি কথা কালকে হবে।”

     দরজাটা ঠেলে যখন ড্রয়িংরুমে ঢুকলেন রামকানাইবাবু, তখন তিনি চমকে উঠলেন। ড্রইংরুমের সেন্টার টেবিল, সোফা, চেয়ার সব একদিকে সরানো। মাঝখানের জায়গাটা ফাঁকা করা হয়েছে। সেখানে কার্পেটের উপরে সমীর এক গাদা আর্ট পেপার, রং, তুলি নিয়ে ব’সে ব’সে কীসব করছে। রামকানাইবাবু বলে উঠলেন-

    “ এসব কি হচ্ছে সমীর?”

    সমীর একমনে প্যালেটে তুলি দিয়ে উপযুক্ত রঙের কম্বিনেশনটা খুঁজছিল। ও মাথা তুলে তাকাল।

    “ পোস্টার তৈরি করছি বাবা। রূপা গোস্বামীর সাপোর্টে সব জায়গায় লাগাব। কয়েকটা স্লোগানও তৈরি করেছি। আজ বিকেলবেলায় দীপা, আমি আরও কয়েকজন দুর্গানগরের বেশ কয়েকটা ব্লকে ঘুরে ঘুরে এসব লাগাব।”

    রামকানাইবাবু আঁতকে উঠলেন।

   “ রূপা গোস্বামী মানে বামপন্থী বিরোধী যুব দলনেত্রী? যে এখানে আমাদের দলের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে?”

   “ হ্যাঁ বাবা।”

 “ তুই আমার ছেলে হয়ে আমারই দলের বিরুদ্ধে গিয়ে প্রচার করবি? আর তুই যে বলেছিলি যে কখনও রাজনীতিতে আসবি না, তার কি হল?”

  “ আমার চিন্তা পাল্টে গেছে বাবা। আর একই বাড়ির সদস্য আলাদা আলাদা দল করছে এমন তো অনেক দেখা যায় বাবা। এখন আর কথা বোলো না। অনেক কাজ বাকি আছে।” সমীর আবার কাজে মন দিল।

   রামকানাইবাবু ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলেন। ব্যালকনিতে নিজের প্রিয় বেতের চেয়ারটায় গিয়ে বসলেন। আজ তিনি একা। যে কূটনীতিতে তিনি নিজেকে চাণক্য ভাবতেন, সেই কূটনীতি আজ তাকে ত্যাগ করেছে। স্ত্রীর চোখে তিনি নেমে গেছেন, পুত্র বিরোধী দলের হয়ে প্রচার করছে, মাথার উপর কেসের ফাঁড়া ঝুলছে আর সহকর্মীদের কাছে আজ তিনি করুণা ও উপহাসের পাত্র। এই চক্রব্যূহ থেকে কি তিনি বেরোতে পারবেন? রামকানাইবাবু শূন্যদৃষ্টিতে বাইরে তাকালেন।

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post তোমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিষ| কঠোর ভাবে প্রাপ্তমনস্কদের জন্য | -| Bengali Story for Matured
Next post দৃষ্টিভ্রম | কঠোর ভাবে প্রাপ্তমনস্কদের জন্য | রিতেশ দাস| Bengali Story for Matured