চোখের দীঘিতে ভিজাবে বলে এতো আয়ো জন| প্রেমে পড়া বারণ | কহিমুল হাসান| Bengali Love Story
0 (0)

এমনি মেঘ সন্ধ্যা মুখর দিনে এক চায়ের কাপে বৃষ্টির স্নিগ্ধতা মিশিয়ে চায়ে চুমুক দিচ্ছি। হালকা লিকারে চায়ের স্পর্শ ঠোঁটে পরতেই শরীরটাতে এক অজানা ভালো লাগার শিহরণ বয়ে গেল। এখন কয়টা বাজে?

এই সাড়ে ৭টার আশেপাশেই হবার কথা -আমার কথার সাথে তাল মিলিয়ে বলে উঠল এক অপরিচিত ভদ্রলোক।

আমি তার দিকে একপলক দৃষ্টি দিলাম। বেশ সুদর্শন চেহারার অধিকারী। এই অসময়ী বৃষ্টিতে আটকা পড়ে ভদ্রলোকের মুখটা গম্ভীর থাকার কথা, কিন্তু তাকে বেশ হাস্যোজ্জ্বলই দেখতে লাগল। যাক ভালোই হয়েছে এই সময়টা ভদ্রলোকের সাথে খানিকটা কথা বলে কাটানো যাবে। আমি এতসব ভাবতে ভাবতেই ভদ্রলোক বলে উঠলেন – আপনি কি গভীর চিন্তার মধ্যে আছেন, আপনার কপাল ভাঁজ হয়ে আছে তো তাই বললাম।

না তেমন কিছু না, আমি মোটামুটি সময় চিন্তা করেই কাটিয়ে দিই। ইনফ্যাক্ট আমরা সারাদিন যা যা কথা বলি তার অলমোস্ট ২-৩ গুণ আমরা চিন্তা করি। আচ্ছা বলুন তো আমরা মানুষ হয়ে এত ভাবি কেন যে এইটা বলব নাকি ওইটা বলব, আমরা আমাদের সমস্ত জীবনটাই অন্যের কথা ভেবে কাটিয়ে দিই কি আজব না!

ভেরি ইন্টারেস্টিং!

কিছু মনে করবেন না আপনার সাথে আরেকদিন কথা হবে আজকে আমার একটা মিটিং ধরতে হবে বলেই হন্তদন্ত হয়ে উঠে চলে যেতে লাগলেন। সামনেই একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল।

আমি হাঁটছি একা একা। কেন জানি ফুজির চিন্তা কয়েকদিন ধরে মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। নাহ এই চিন্তা বের করতে হবে নাহলে মস্তিষ্ক অক্সিটোসিন ক্ষরণ করা শুরু করে দিবে আর তাহলেই তো বিপদ!

মেস অন্ধকার করে ঘুমিয়ে আছি, মাথাটা ধরেছে। কতক্ষণ ঘুমেইছি মনে করতে পারছি না। আশেপাশে হাতড়াতে লাগলাম ফোনটা খুঁজে পেলাম না। আশ্চর্য এইখানেই তো ছিল। হঠাৎ ভাইব্রেশন মুড এ টেবিলে দেখলাম ফোনটা কাঁপছে। উঠতে ইচ্ছা করছে না। তাও কোনমতে চোখ খুলে অতি সন্তর্পণে সামনের দিকে এগোচ্ছি। ফুজির কল, ঠিক করলাম ধরব না। কিছুদিন না কথা বলাই শ্রেয়। যখন কোন আবেগ বাড়তে থাকে তখন নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে হয় নাহলে আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করব কীভাবে!

এক দিক দিয়ে ফুজির কলে ভালোই হয়েছে সময়টা জানা গেছে। সাড়ে ৪ টা বাজে। আর শুয়ে থাকতে ইচ্ছা করছে না। একটা টিউশনিও আছে তাও করাতে ইচ্ছা করছে না। মনটাকে খানিকটা স্বাভাবিক করতে গন্তব্য-হীন হন্টন প্রয়োজন। বের হয়ে গেলাম। বের হতেই নাহিদ এর সাথে দেখা। দেখে একপ্রকার বলে উঠল, আমাদের সাথে তো আর আড্ডা দিতে আসেনই না। সেইদিন পাড়ার সবাই মিলে জম্পেশ আড্ডা দিলাম। ও বলতে ভুলে গেছি সিদুদাও ছিল।

সিদু এখন কই আছে?

কই আর, সেই চাকরীর পরীক্ষা দিনভর আর রাত-জেগে পড়াশোনা এই চলছে দাদার। আপনার কথা খুব করে জিজ্ঞেস করল। আপনি তো অমাবস্যার চাঁদ, সে যাই হোক আজকে সন্ধ্যায় আসুন সবাই মিলে ফিস্ট করব। আমি অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে হাসি দিলাম তার অর্থ যে কি তা ভাবতে ভাবতেই কেটে পড়লাম।

বাবুর টং এ বসে চা খাচ্ছি। সিগারেট একটা নিলাম। মানসিক যন্ত্রণায় সিগারেট টান টনিক এর মতো কাজ করে। এক হাতে পত্রিকার পেজ উল্টাচ্ছি আরেক হাতে সিগারেট মাঝে মধ্যে চায়ের কাপে চুমুক চলছে। হঠাৎ করে এক পরিচিত কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো ঠিক চিনতে পারছি না। কিন্তু ঠোঁটের কোণে হাসি ধরে রেখে মাথার নিউরনগুলোকে কাজে লাগিয়ে দিলাম কে তা খুঁজে বের করতে।

সেই অপরিচিত মেয়েটা বলে উঠল, আমি কে তা আপনি চিনতে পারেননি তাই না?

আমি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম, সরাসরি সুন্দরী মেয়েদের মুখের উপর না বলা যায় না। তার উপর তাকে চিনতে পারি নি এত ঘোর পাপ কলিকাল এসে গেল নাকি! মেয়েটার চোখ দুটোতে একপ্রকার মায়া কাজ করছে। তার উপর হালকা করে কাজল চোখ দুটোকে হরিণীর মতো করে তুলেছে। মেয়েটা আমার চুপচাপ থাকা দেখে বলে উঠল, আমি তিসু।

তিসু তিসু ওহ আচ্ছা তিসু তা বলো কেমন আছ?

আপনি আমাকে এখনও চিনেন নাই তাই না?

সত্যি বলতে চিনি নাই।

আমি তো তেমন ইম্পর্ট্যান্ট কেউ না যে মনে রাখবেন। যাই হোক, চেয়ারটা টেনে নিয়ে আমার সামনে বসে নিজেই আরও দুইকাপ চা অর্ডার দিল। নিজের জন্য কড়া লিকারের চা আর আমার জন্য হালকা লিকারের চা।

আমি যে হালকা লিকারে চা খাই তা জানলা কীভাবে?

আপনাকে আমি সবসময় চা বানায় খাওয়াইতাম আমাদের বাসায় গেলে। এইবার ও চিনতে পারেন নাই তাই না?

আরেহ তুমি তো মিনু খালার মেয়ে। ওহ আচ্ছা এত্তো বড় হয়ে গেলা কেমনে?

অনেকটা অভিমানী সুরে বলে উঠল, আমি বড়ই ছিলাম, আমাকে কখনও বড় হওয়ার চোখে দেখেন নাই। সবসময় শুধু পিচ্চু পিচ্চুই করে গেলেন।

আরে রাখো সেই কথা, এখন বলো এইখানে কী করে! খালাও কি আসছে?

নাহ আমি এইখানে পড়ালেখা করছি হোস্টেলে থেকে। হঠাৎ করে আপনাকে দেখে এত্তো খুশি লাগল না ডেকে পারলাম না। ভাবছিলাম এই জীবনে আপনার সাথে আর কথা বলব না।

আমি কথার প্রসঙ্গ পাল্টাতে বললাম, তা বলো তুমি এখন কেমন স্টুডেন্ট আছ? আগের মতোই কি দিনরাত এক করে সব পড়ে ফেলছো?

মেয়েটা লজ্জিত বোধ করে বলল, আপনাকে তা বলব না। আজকে আমাকে উঠতে হবে নাহলে হোস্টেল এর গেট বন্ধ করে দিবে। কিছু না মনে করলে একটা অনুরোধ করি!

হ্যাঁ অবশ্যই, আমি আবার সুন্দরীদের অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারি না।

তিসু হো হো করে হেসে উঠল। মেয়েটা সুন্দরী হলেও হাসিটায় প্রাণ নেই। ফুজির হাসিটা শুনলে একপ্রকার ঝংকার লেগে যায় কানে। মনে হই এই মেয়েটার সব কথাই সঠিক এই মেয়ে কীভাবে ভুল বলবে! ভুল করব আমি, তাই তো ফুজি ঝগড়া করলে আমি অবাক হয়ে তার কথা শুনি। এক পর্যায়ে গিয়ে আর না পেরে বলে তুমি তো একটা গাছ বলা আর না বলা একি কথা। শেষে একটা প্রাণোচ্ছল হাসি দিত। উফ! আবার ফুজিকে নিয়ে কেন ভাবছি? আমার মস্তিষ্কে ফুজির ফাইলটা এখন অফ করে দিতে হবে।

তিসু বলল, আপনার কি হইছে? কতক্ষণ ধরে ডাকছি শুনছেনই না। শরীর খারাপ করল না তো, বলেই কপালে হাত রাখল। শরীর খারাপ এর সাথে মাথায় হাত দেওয়ার কি সম্পর্ক তা ঠিক বুঝলাম না।

আমি বলে উঠলাম, তোমার আদেশটা বলো।

তিসু মুখ খানিকটা বাকিয়ে বলল আমাকে একটু পৌছায় দিবেন। আসলে আপনার সাথে হাঁটার অনেক শখ আমার। এইটুকু পূরণ করলেই আমি খুশি।

আমি বললাম, চলো। তিসু মনে হয় বিশ্বাস করতে পারছে না। শিশুরা যেমন কৌতুহল দৃষ্টিতে তাকায় থাকে তিসুও তাকিয়ে আছে। তার হাত টান দিতেই তার হুশ ফিরল। তার হোস্টেলের কাছে আসতেই বলল আমার হাতটা আরেকবার ধরবেন।

আমি তার হাতটা ধরলাম। অশ্রুভরা চোখে আমাকে বিদায় দিল। বেশিক্ষণ দাঁড়ালাম না। কারণ অশ্রুর কাছাকাছি থাকলেই মায়ায় জড়িয়ে যাওয়ার প্রোবাবিলিটি থাকে। তাই যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব গণ্ডির বাইরে বের হইতে হবে। রাত ১০ টা নাগাদ মেসে ফিরলাম।

মেসে ফিরতেই রিসুইবাবুর সাথে দেখা যাকে বলে বিনা মেঘে বজ্রপাত। আমি সাধারণত একটু এড়িয়ে চলি এই লোকটিকে, বড্ড রাগী স্বভাবের। তার চেহারাটাই কালো মেঘের আভাসে ঢাকা। তার উপর আবার এই মাসের বকেয়াও বাকি। কি যে কই বুঝতে পারছি না। একটু হাসি দিয়ে ভদ্রলোকটিকে ভড়কে দিতে চাইলাম।

রিসুইবাবু বলে উঠলেন, আপনাদের জ্বালায় তো টিকা দায়। ফোন কি ব্যবহার করেন না? মেয়েছেলে কেন আমায় ফোন দিয়ে বিরক্ত করবে তাও আপনাকে চেয়ে! সে যাই হোক ফুজি মেয়েটা বড্ড অস্থির হয়ে আছে আপনি তাকে আজই ফোন দিবেন। আমি মাথা নাড়ালাম। এখন কেটে পড়তে পারলেই বাঁচা যায়। রুমে এসে লাইট দিতেই ভড়কে গেলাম। একি!

দেখি রুমে কাচুমাচু হয়ে ফুজি শুয়ে আছে। পিছনে তাকাতেই দেখি রিসুইবাবু দাড়িয়ে। ফুজি এখনও ঘুমিয়ে আছে। রিসুই বাবু বলে উঠলেন, এসে দেখি মেয়েটি বাইরে আপনাকে খুঁজছে কাঁদো-কাঁদো চোখে তাকিয়েছিল। কী করব বলুন আপনি নেই, আপনার ঘরের চাবি আমার কাছে থাকে তাই রুম খুলে দিলাম। এখন তাড়াতাড়ি বুঝিয়ে শুনিয়ে বাড়িতে দিয়ে আসুন এই বলে রিসুইবাবু প্রস্থান করলেন।

আমি ঘুমন্ত ফুজির দিকে তাকিয়ে আছি। একটা মানুষ এতটা নিখুঁত সৌন্দর্য নিয়ে আসবে কেন? ঘুমের মধ্যেও তাকে লাগছে অপ্সরার মতন তবে বাচ্চা অপ্সরা হবে।

তার মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ ফুজি চোখ মেলে লজ্জিত ভঙ্গিমায় উঠে বসল। বলল, কখন এলে কই ডাক দিলেই পারতে? উঠে গিয়ে টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে খেলো, এদিক সেদিক তাকাল যেন এই বাসাটা তার কত্তোদিনের পূর্বপরিচিত। সে এসে সহজভাবে বসে বলল ভয় পাবার দরকার নাই। আমি তোমাকে বিয়ে করার জন্য ফাঁসাবো না। তোমার আমাকে নাই পছন্দ হতে পারে এটা নিয়ে আমি মোটেই আপসেট না- ফুজি অন্যদিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলছে। তার চোখের দিকে তাকাতে একটা জলের স্রোত দেখা গেল যার মধ্যে আলো পড়ে চিকচিক করছে। এই জলে সমস্ত ভুবন ডুবিয়ে দেওয়া সম্ভব আর আমিই তো নিতান্তই মাংসে গড়া সাধারণ মানুষ।

তোমার সাথে কথা না বলে কোন গাছের সাথে কথা বলাও ভালো।

আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম, তাহলে এইখানে কেন? কোন কিছু কি হয়েছে?

নাহ কিছু হবে না। আমি তোর কে? আমি এখন চলে যাব যেই দিকে দুই চোখ যায়।

আমি ফুজির হাত ধরে থামিয়ে বললাম, এখন কয়টা বাজে বল তো? সে ফোন দেখে স্বাভাবিক ভাবে বলল ১২.৪০।

আমি বললাম, তোর বাসা থেকে এতক্ষণে থানা পুলিশ হয়ে গেছে যা দেখ। তাড়াতাড়ি চল তোকে দিয়ে আসি।

আমাকে নিয়ে তোর ভাবা লাগব না। আমার কথা তোকে না ভাবলেও চলবে। আর কেউ কিছু করবে না কারণ আমি আসার আগে চিঠি দিয়ে এসেছি- আমি আমার ভালোবাসার মানুষের কাছে যাচ্ছি যদি গ্রহণ না করে তাহলে যেদিকে চোখ যায় চলে যাব, অন্যদিকে মুখ দিয়ে এই কঠিন কথা বলা শেষ করল। ফুজির একটা ব্যাপার আমি বুঝি না। সে কোন কঠিন কথা চোখে চোখ রেখে বলতে পারে না। সম্ভবত মায়া কাটানোর চেষ্টা। তবে তাতেও লাভ হয় না। তার চোখের সমুদ্র ফুলে ফেঁপে উঠছে। মাঝেমধ্যে বর্ষণ ও হচ্ছে।

তবে তো চিন্তার বিষয় বলতেই ফুজি বাচ্চাদের মতো অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে থাকল।  বল তো এই মাঝরাতে কাজী পাব কই?

মেয়েটার চোখে সমুদ্রের বাধ খুলে গেছে। কাঁদছে সাথে হাসছে মাঝখানে খেল বিষম। শেষে পানি নিয়ে টানাটানি অবস্থা আমি হাসতে হাসতে শেষ।

মেয়েটা অভিমানী সুরে বলল, তুমি বুঝি কাউরে কাঁদতে দেখো নাই এত হাসির কি হল বুঝলাম না বাপু!

আমি রিসুইবাবুকে ডাক দিলাম। দেখি তিনি কিছু ব্যবস্থা করতে পারেন নাকি। রাগী মানুষের স্বভাব হচ্ছে আগুনে জ্বলা লোহার মতন। তাদের ভিতর এতটাই নরম বুঝা যায় না। লোকটা রীতিমতো হুলস্থুল কারবার শুরু করে দিল। সারা মেসের সবাইকে কাজে লাগিয়ে দিল আর জোরে জোরে বল্‌ এই শুভ কাজের সমস্ত টাকা আমি দিবো খোদ খোদাতায়ালা এই পবিত্র কাজের সুযোগ দিয়েছেন। রাত সোয়া ৩টা নাগাদ বিয়েটা হয়ে গেল। আমি বাসর ঘরে ঢুকতেই ফুজি সালাম করল। আমি বিচক্ষণ এর মতো বললাম বেঁচে থাকো মা একশ পুত্রের জননী হও। কথাটা বলতে না বলতেই রেগে-মেগে ফুজি বলল একশ পুত্র কি তুই জন্ম দিবি হারামজাদা! সব কিছুতে ফাজলামি করোস। বিয়ের আগে অনেক জ্বালাইছোস এখন বুঝবি কত ধানে কত চাল।

আমি অট্টঠাসিতে ফেটে পড়লাম। হঠাৎ করে বললাম ব্যাগটা গুছিয়ে নাও।

ফুজি বলল, কেন?

আমি বললাম, তোমাকে নিয়ে সিলেটে যাব। কেন জানি সিলেটে যেতে মন চাইছে। তাছাড়া কালকে জ্যোস্নারাত। একসাথে সিলেটে বসে জ্যোস্নাবিলাস করব। ফুজি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। সে তাড়াতাড়ি করার জায়গায় উল্টে সব গুবলেট করে ফেলল।

সাড়ে ৪টায় সুরমা মেইলে করে যাচ্ছি। ফুজি ঘুমিয়ে আছে আমার গায়ে তার মাথা এলিয়ে দিয়ে। এত নিষ্পাপ লাগছে তাকে। মনে পড়ে যেতো লাগল তার সাথে দেখা হওয়া প্রথম মুহূর্তের কথা।

সেইদিন অমাবস্যার রাত ছিল। আমি খেয়ে দেয়ে বের হয়েছি হাঁটবো বলে। একে তো ঘুটঘুটে অন্ধকার তার উপর স্ট্রিট লাইটগুলো নিষ্প্রাণ। কোনভাবে এগোচ্ছি এমন সময় ডাক এল শুনছেন। পিছনে ফিরে তাকাতেই দেখলাম একটা অবয়ব দাঁড়ানো। আমি অবয়ব এর সাথে কথা বলছি, জী বলুন।

কিছু মনে করবেন না আমি এই শহরে নতুন। কিছুই চিনছি না। একটু আগে বাস এসে পৌছালো। এখন কই যাব কিচ্ছু বুঝছি না, কোন গাড়ি-ঘোড়াও নেই। তার উপর মেয়েমানুষ। একটু যদি এগিয়ে দিতেন।

আমিও তো আপনার ক্ষতি করতে পারি কি দেখে ডাকলেন?

মেয়েটা থতমত খেয়ে গেল। এইরকম জবাব আশা করে নি বোধহয়। এইখানে কিছুটা সম্ভাবনা আছে এই মেয়ে কোন গ্যাং এর সদস্য। আড়ালে নিয়ে গিয়ে সব লুট করবে। তাকে আরেকটু ভ্যাবাচেকা খাইয়ে দিলাম এই বলে যদি আমাকে লুট করতে চান তাহলে বলি আমার মানিব্যাগ এ মোটে ২৩১ টাকা আছে আর ফোন ইউজ করি না।

মেয়েটা বিব্রতভাবে বলে উঠল, আপনার যদি হেল্প করতে না মন চায় কইরেন না কিন্তু উল্টাপাল্টা বলবেন না এই বলতেই তার চোখে অশ্রুর স্রোতের চিকচিক আভা দেখতে পেলাম। মনে হয় চোখ অন্ধকারে সয়ে গেছে তা না হলে এই স্রোতের আভা দেখা যেতো না।

আমি তার হাত থেকে ঠিকানা নিয়ে তাকে নিয়ে পৌছায় দিলাম মগবাজারে তার মামা বাসায়। এতক্ষন কোন কথা হয় নাই। বাসার নিচে এসেই সরে পরলাম সে মনে হই ধরতে পারে নাই। চেহারাটা ঠিক খেয়াল করা হই নাই।

একদিন রাস্তা দিয়ে হাটছি ভার্সিটিতে যাব। পড়ে গেলাম ড্রেনে কি বিচ্ছিরি অবস্থা! কি করব বুঝতে পারছিলাম না। সাধারণত অপ্রস্তুত মোমেন্টে আমরা কান্ডজ্ঞানহীন হয়ে পরি। আমারও হয়েছিলো তা। কোনকিছু মাথাই আসছিল না। একটা মেয়ে হঠাৎ আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল সামনের টি স্টলে। তাদের থেকে পানি নিয়ে দিল তা দিয়ে পা ধোয়া সম্পন্ন হল। আমি লজ্জা পেলাম সাধারণ বুদ্ধিটা মাথায় এল না। মেয়েটার দিকে তাকাতেই সব লজ্জা উধাও হয়ে গেল। ইন্দ্রাণীর উদাহরণ টেনে সৌন্দর্য্যের যেই সংজ্ঞা দেওয়া হয় তা মনে হল ভুল। হাত নেড়ে নেড়ে ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছিল। কথা শেষ হতেই দোকানিকে ইশারা দিল চা এর জন্য। চা হাতে দিয়ে বলল আমাকে মাফ করবেন আপনি কি চা খান তা তো জানি না তাই ২ কাপেই কড়া লিকারে দুধ আর চিনি বেশি দিয়ে চা বানাতে বলেছি আপনার সমস্যা নেই তো? তার চোখে যেন অপরাধবোধ কাজ করছে। আমি আছি ঘোরের মধ্যে তার সব কথা শুনতেই ভালো লাগছে। আমি মাথা নেড়ে বললাম কোন সমস্যা নেই। আসলে যে আমি কড়া লিকার চা খেতে পারি না সেটা তার অজানাই রয়ে গেল। চায়ে চুমুক দিয়ে দেখি শরবত কোনমতে শেষ করলাম সাথে আজকে রাতের ঘুমেরও দফারফা হয়ে গেল হাশ!

তার সাথে কোন কথা ছাড়াই হাঁটতে লাগলাম পাশাপাশি। হঠাৎ বলে উঠল বলুন তো আমি কে?

আমি ভেবাচেকা খেয়ে গেলাম আমি তাকে চিনব কি করে! আমি তো কোন রাজপুত্র না যে সাত সমুদ্র তেরো নদী পার করে তার কাছে এসেছি। বরং সেই আমাকে বিব্রত অবস্থা থেকে বের করল। আমি বললাম, চিনার কথা কি?

সে হাসি দিয়ে বলল অবশ্যই। একবার মনে করার চেষ্টা করুন।

আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম আমার স্মৃতিশক্তি খুবই নিম্নমানের।

মেয়েটা বোধহয় আশাহত হল। খানিকটা সময় নিয়ে বলল আমি সেই অপরিচিতা যাকে আপনি সেইদিন সন্ধ্যা নাগাদ মামার বাসায় পৌছে দিয়েছিলেন। আমি বললাম, ও আচ্ছা।

মেয়েটা বলল কিছু মনে করবেন না আপনাকে সেইদিন ভিতরে ডাকিনি। অসৌজন্যতার জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।

আমি বললাম অ্যাপোলাইজ গ্রান্টেড।

মেয়েটা এইবার উচ্চস্বরে হেসে উঠল। আমার কানে ঝংকার লেগে গেল। এই মেয়েটার এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে সে যে কাউকে বশ করতে পারবে তার চোখের দিকে তাকাতেই মনে হল। সাধারণত সবাই চোখের সাথে অনেক কিছুর তুলনা দিয়ে থাকে। আমার এক বন্ধুর মতে সবচেয়ে সুন্দর চোখ হচ্ছে গরুর চোখ। এই মেয়েটার চোখটা কার সাথে তুলনা দিব বুঝতে পারছি না তবে একটা জিনিস বুঝতে পারছি তার চোখের ভিতর একটা দীঘি আছে। সেই দীঘির জলে সবাই ডুবে যাবে আমি তো নিতান্তই মানুষ। তার চোখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম।

তার মামাবাড়িতে নিয়ে যাবার জন্য জোর করল বটে কিন্তু কাজ থাকায় যেতে পারলাম না। আমি চলে যাচ্ছি পিছন থেকে ডাক দিল এই যে শুনুন

আমি থেমে গেলাম, বলল আপনি তো ভারি আজব মানুষ! আমার নামটাই তো আপনার জানা হল না।

আমি বললাম ওহ আচ্ছা তোমার নামটা যেন কি?

ভ্রু কুচকে বলল ফুজি। আপনার নাম না বললেও চলবে। একটা কাগজ হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল কালকে দুপুর ২টা নাগাদ এই নাম্বারে ফোন দিবেন। আমি ভ্যাবলার মতো তার চলে যাওয়া দেখতে লাগলাম। এতক্ষণে ঘোর কাটল যাক মেয়েটা গণ্ডির বাইরে গেছে। এই মেয়ের থেকে একশ হাত দূরে থাকা বাঞ্ছনীয়। নাহলে মস্তিষ্ক মশাই অঘটন ঘটিয়ে ফেলবে।

পরের দিন এর কথা ভুলেই গেলাম। আর সবথেকে আশ্চর্যের বিষয় দিন সাতেক পরে যখন মনে হল তখন নাম্বার দেওয়া কাগজটা কই ফেলেছি তা শত চেষ্টাতেও পেলাম না। যদিও আমি চাচ্ছিলাম এই মেয়ে থেকে যেন দূরে থাকি তারপরেও অবচেতন মন চাচ্ছে যেন নাম্বারটা খুঁজে বের করে তার সাথে যোগাযোগ করি।

প্রায় এক মাস পরে এক লোকাল বাসে ফুজির সাথে আমার দেখা। তার চোখে সেদিন অগ্নিবিস্ফোরণ দেখেছিলাম। চুপচাপ শাহবাগের মোড়ে এসে আমার হাত টান দিয়ে ধরে নেমে গেল। আমি কোন কথা বলি নি।

আমাকে ধমকের মতন দিয়ে বলল আপনার সমস্যা কি হ্যাঁ!

কি মনে করেন নিজেকে। আপনাকে এত্তোবার বললাম আমাকে ২ টা নাগাদ ফোন দিবেন আপনার কোন হুশ-জ্ঞান নাই। জানেন ঐদিন আমি সারাদিন-রাত বসে ছিলাম কখন ফোন দিবেন। আমি চুপচাপ তার কথা শুনছি। হালকা বাতাসে তার চুল উড়ছে বার বার তার মুখের উপর এলোকেশ এসে পড়ছে। আমি মনের অজান্তেই এক হাত দিয়ে তার চুলগুলো ঠিক করে দিলাম। মেয়েটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল। আমার জ্ঞান আসতেই আমি অ্যাপোলজি স্বীকার করলাম।

মেয়েটা আমাকে চমকে দিয়ে বলে উঠল, অ্যাপোলজি গ্রান্টেড আর হাসিতে ফেটে পড়ল।

তখন আষাঢ় মাস চলছে আনুমানিক ৮ কি ৯ তারিখ। আমার তার সাথে দেখা হওয়ার কথা বেলা ৯ টায়। আমি ঘুমে বেঘোর ঘুম ভাঙল ১১টা নাগাদ। চোখ মেলে দেখি মুষলধারে বৃষ্টি হয়েই চলছে। কেন জানি খিচুড়ি খেতে ইচ্ছা করছে। মনে পড়ল ফুজির সাথে দেখা হওয়ার কথা। ভুলে মেরে দিয়েছি আজ আর রক্ষা নাই। তাই এই বর্ষার জল মাথায় নিয়ে হাজির হলাম তার হোস্টেলের সামনে। আমাকে দেখেই নিচে নেমে বকাবকি করে কী অবস্থা। আমাকে একটা গামছা এনে দিল সাথে একটা টিফিনবাটি আর ছাতা দিয়ে আমাকে পাঠিয়ে দিল। বাসায় পৌঁছাতেই বক্স খুলে দেখি ভিতরে খিচুড়ি আর ইলিশ ভাজা। যদিও আমি মাছের গন্ধ সহ্য করতে পারি না, তারপরেও এই বর্ষায় ইলিশ খেতে মানা নেই।

ফুজির সাথে মাঝেমধ্যেই দেখা করা লাগছে মেয়েটা বড্ড জ্বালিয়ে মারছে। একে তো সুন্দরী তাই না পারি কথা ফেলতে না পারি গিলতে আমার মস্তিষ্ক মশায় বিভ্রান্তের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে। অক্সিটোসিন ক্ষরণ করছে অন্যদিকে আমি আবার চাইছি যেন না ক্ষরণ করে। আমাকে বোকা বানিয়ে অবচেতন মন ভালোই খেলা দেখাচ্ছে। নাহ আর এই ইন্দ্রাণীর গন্ডির ভিতর যাওয়া যাবে না। তার চোখের দিকে তাকালেই আমি অতলে হারিয়ে যায় খুবই শোচনীয় অবস্থা আমার!

দিন বিশেক গায়েব ছিলাম। অবশেষে কাটাবনে দেখা হয়ে গেল। আমি আশা করছিলাম অগ্নিমূর্তি দেখার সৌভাগ্য হবে। কিন্তু সে গুড়েবালি একরাশ হাসি নিয়ে আমার হাত ধরে নিয়ে গেল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। এক প্যাকেট বাদাম কিনে আমাকে খোসা ছাড়িয়ে দিচ্ছে। আমি আবহাওয়ার সাথে মানায় নিতে পারছিলাম না বুঝতে পারছিলাম কিছুক্ষণের মধ্যে একটা সুনামী বয়ে যাবে তাই এত নিস্তব্ধতা। আমি ভাবতে ভাবতেই তার চোখে সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাস দেখা গেল আর যাই করি না কেন এই বর্ষণ দেখে আমার হাত তার মুখে চলে গেল তৃষ্ণার্ত হয়ে। তার চোখে সেদিন কী দেখেছিলাম জানি না তবে মস্তিষ্ককে বিভ্রান্তির হাত থেকে মুক্তি যে দিয়েছিলাম তা বলতে পারি।

সেদিন ছিলো শুক্রবার হঠাৎ করে চলে গেলাম আগারগাঁও। এক মুঠো গন্ধরাজ ফুল কিনে নিয়ে পায়ে হেঁটে গন্তব্যের দিকে চললাম। ঠিক জুম্মার আগে তার হোস্টেলের নিচে পৌছালাম। তাকে ফুল দিতেই বাচ্চাদের মতো খুশিতে গদগদ হয়ে যাবার যোগাড় তার দিক থেকে চোখ ফেলে মসজিদের দিকে পা বাড়ালাম।

তার ২ দিন পর ছিলো ঘোর পূর্ণিমা। স্বভাবতই হাটতে বের হয়েছি ফুজির ফোন পেয়ে কিছুটা চমকে গেছি। ফোনের ওইপাশ থেকে তাকে নিয়ে বের হওয়ার হুকুম পেলাম আমি শান্তশিষ্ট নিতান্তই গোবেচারা মানুষ তাই ঝামেলা এড়াতে ছুটে চললাম তার হুকুম পালন করতে।

দিন পনেরো তার সাথে যোগাযোগ নেই আমার আবার উধাও হওয়ার নেশা জেগেছে। কীভাবে যেন আমার মেসের ঠিকানা যোগাড় করে হাজির। আর পারলাম না সব কিছু ক্ষান্ত দিলাম এই জীবনে আমার আর সুখী থাকা হল না হাশ!

ওমা এইতো ট্রেনের হুইশেল দিল মেয়েটা বড্ড আরামে ঘুমিয়ে পড়েছে। তার চোখের নিচে কালি জমেছে কি আমার পাগলামীর জন্য!

যাক ভালোই হয়েছে ঘন করে কাজল লাগাতে বলব যাতে তাকে মায়াবন হরিণীর মতো দেখতে দেখতে জীবনটা কাটিয়ে ফেলতে পারি।

ট্রেন এসে থামল আরেক স্টেশনে। এই যে চাওয়ালা ভাই আজকে এক কাপ কড়া লিকারে দুধ-চিনি বেশি দিয়ে চা বানাও তো।

খেতে অতোটাও মন্দ না। নাকি আমার সবকিছুতেই ভালো লাগা শুরু করেছে, আমি কি তাহলে তার চোখের দীঘির জলে তলিয়ে যাচ্ছি?

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post অনুভূতির রঙ| প্রেমে পড়া বারণ | সরস্বতী ইরাবতী| Bengali Love Story
Next post ঐ শ্ব রি ক প্রে ম| প্রেমে পড়া বারণ | আশিস চক্রবর্তী| Bengali Love Story