জোনাকি| প্রেমে পড়া বারণ | মুকতাদির হাসান মাশুক| Bengali Love Story
0 (0)

-দোস্ত, ভূতে বিশ্বাস করিস?

-নোপ

আমি আমার বন্ধু শাহেদকে মজার একটা গল্প শোনাতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু ওর স্বভাবটাই এমন। শুরুর আগেই শেষ করে দেয়

-আচ্ছা, ১ মিনিটের জন্য কর।

-জাস্ট ১ মিনিট তো? এর বেশি কিন্তু পারব না।

-ওকে, ইনাফ। তোকে একটা গল্প বলব ভূতের মুখে শোনা। ভূতের মুখে রামনামের মত, ভূতের মুখে গল্পনাম।

-তো গল্পর নামটা কি?

-জোনাকি

-খারাপ না! ভালোই বানাইছিস।

-বানানো না,সত্যি। তাহলে শোন, আগে কীভাবে গল্পটা পেলাম সেটা বলি। আমাদের বাসার উত্তরের যে জানলা, ওটা দিয়ে প্রচুর মশা আসে। মাঝে মাঝে মনে হয় রুম থেকে বের হয়ে যাই, মশারাই এখানে সংসার করুক। বুঝলি?

-হুম

-তো মশা আটকাতে প্রতিদিন সন্ধ্যার আগেই জানালা বন্ধ করে দিতাম। একদিন হঠাৎ ভুলে গেলাম।

-তারপর?

-তারপর আর কী মশারা ঢুকে পড়ল, একদম ঝাঁকে ঝাঁকে। মশারি দিয়ে বসে থাকলাম। কিন্তু মজার ব্যাপার হল মশার সাথে সাথে একটু ভূতও ঢুকে পড়ল। আমি লাইট নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। আধো ঘুম আধো জাগরণের মাঝামাঝি একটা সময়ে ভূতটা এসে গল্পটা শুনিয়ে গেল।

-ওয়াও ইন্টারেস্টিং তো!

-হুম, ইভেন সে কত সাল সেটাশুদ্ধ বলেছিল। ফার্স্টের ২টা অঙ্ক ১৯। লাস্টেরটা ৭। মাঝের একটা অঙ্ক মনে নাই। অবশ্য ওটা অতটা ইম্পর্ট্যান্ট না।

-ওহ,আচ্ছা। ১ মিনিট শেষ। আর ভূতে বিশ্বাস করতে পারব না। ফাজলামো বাদ দে। এবার মূল গল্পে ঢোক।

-আচ্ছা, হাসলাম আমি।

ভূতের মুখে যা শুনেছিলাম, একদম হুবহু সেটাই ওর এবং আপনাদের সামনে তুলে ধরলাম…

ছোটকালে নাকি আমি ছিলাম পাজির পা ঝাড়া। আমি বুঝতাম না, শুধু পাজি বললে কি সমস্যা। পা ঝাড়া শব্দটা অপমানজনক। হাত ঝাড়া বা মাথা ঝাড়া বললে তাও মানা যায়। যা হোক এখন আমি অনেক বড় হয়ে গেছি, অনেক শান্ত আর বুদ্ধিমতী। তার প্রমাণ আজ রাতে আমি পালিয়ে বিয়ে করতে যাচ্ছি।

আমি যে ছেলেটার সাথে পালিয়ে বিয়ে করতে যাচ্ছি তার সাথে আমার পরিচয় ২ বছরের। ওর বিশেষত্ব হল ওর কোনও বিশেষত্ব নেই। মেধাবী, হাজার রকম কাজে পারদর্শী মানুষকে ভালোবাসা অনেক সহজ। সাধারণ, আটপৌরে মানুষকে ভালোবাসা কঠিন। ছোটবেলা থেকেই আমি কঠিন কঠিন কাজ করতে পছন্দ করি।

ছেলেটার সাথে আমার পরিচয় কোনও এক সকালে একটা বইয়ের দোকানে। তখন বর্ষাকাল। হোসে সারামাগোর কোন বইটা সবচেয়ে ভালো হবে সেটা নিয়ে পাশে আলোচনা করছিল ও।

-আমার মনে হয়, ব্লাইন্ডনেস।

অযাচিতভাবেই ঢুকে পড়েছিলাম আড্ডায়।ও অবাক চোখে তাকাল ছেলেটা।

-আপনি পড়েছেন?

-হুম,ওঁওঁর এটাই সবচেয়ে ভালো লেগেছে।

-ওহ, আমি আবার সাহিত্যপ্রেমি।”হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিচিউড পড়েছেন? গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের?

-নোপ

কথাটা শুনে ছেলেটা মনে হল যেন মানতেই পারল না। তার চেহারা দেখে মনে হল বইটা না পড়লে নিঃশ্বাস নেয়া উচিত না। অথচ আমি ২২ বছর ধরে নিঃশ্বাস নিয়ে যাচ্ছি।

-কি বলেন, এই বই পড়েননি! তাহলে এই শতাব্দীর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ বইটাই তো আপনি মিস করেছেন!

কী বলব বুঝতে পারলাম না।

-জ্বী পড়ব, তাড়াতাড়িই পড়ে ফেলব।

আমার শেষ কথাটা বলতে বলতেই ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। সকাল থেকেই মেঘ করেছিলো। ঠাণ্ডা বাতাসের সাথে কেমন একটা বিষন্নতা ভেসে বেড়াচ্ছিল সব জায়গায়। সময় যেতে যেতে মেঘ বাড়ল। আকাশ কালো হয়ে গেল। তারপর হঠাৎ বাতাস থেমে গেল আর শুরু হল এই তুমুল বৃষ্টি।

আমি ছাতা আনতে ভুলে গেছি। এমন পরিবেশে একটা বই কিনব বলে বেরিয়েছিলাম। তারপর জানালার পাশে, ধোঁয়া জমে থাকা চায়ের কাপে হালকা করে চুমুক দিতে দিতে আয়েশ করে পড়ব বলে ভেবেছিলাম। বইও কিনেছি। শীর্ষেন্দুর দূরবীন। কিন্তু বাসায় যাব কীভাবে! আমার মাথায় একটু বৃষ্টির পানি পড়লেই আমি বিছানায় পড়ে যাই। ১০৩ এর নিচে জ্বর আসে না আমার। ভুলভাল বকি ক’দিন। আর একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখি। প্রতিবার স্বপ্নে দেখি নরম আলো ছড়িয়ে একটা জোনাকি ক্রমাগত আমার থেকে ছুটে পালাচ্ছে, আমার হাত-পা বাঁধা। আমি গড়িয়ে গড়িয়ে জোনাকিটার পিছে ছুটছি। আমার শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে, রক্তে মাঝে মাঝেই পিছলে যাচ্ছি, তবুও ছাড়ছি না। ক্রমাগত গড়িয়ে গড়িয়ে জোনাকিটার পিছে ছুটে চলেছি।

আমি ভয়ে ভয়ে বৃষ্টির দিকে তাকাতে লাগলাম। ছেলেটা যেন আমার চোখের কথা পড়ে ফেললো। অবশ্য এই বয়সী ছেলেরা নিজের স্বার্থে মেয়েদের চোখের কথা পড়ে নেওয়ায় পারদর্শী হয়। ছেলেটা সুন্দর করে হাসল।

-আপনার ছাতা লাগবে?

-ইয়ে মানে পেলে ভালো হত। ছাতা আনতে ভুলে গেছি। আমার আবার বৃষ্টির পানি সহ্য হয় না।

-কোনদিকে যাবেন?

-ধানমন্ডি।

-ওহ, আমাকে তো একটু পলাশীর দিকে যেতে হবে। আচ্ছা সমস্যা নাই, আপনি ছাতাটা রাখুন। তবে সমস্যা আছে, ছাতাটায় অনেক ফুটো। আমি দিতে খুবই লজ্জা পাচ্ছি।

আমি হাসলাম।

-ওকে ফুটো ছাতাই চলবে। আচ্ছা ফেরত কীভাবে দেবো?

-আমার মাঝে মাঝে ধানমন্ডি যাওয়া লাগে, আপনার বাসার নম্বরটা দিলে আমি গিয়ে নিয়ে আসব। বা বাইরে কোথাও দিতে পারেন।

বাইরে কোথাও না দিয়ে আমি বাসার নম্বরটাই দিলাম। বৃষ্টি বাড়ছে। আকাশ থেকে পানির ফোটার বদলে পানির দলা পড়ছে মনে হচ্ছে, সাথে এলমেলো বাতাস। এমন বৃষ্টিতে গা বাঁচবে না। কোনমতে মাথা বাঁচলেই হল।

ছেলেটা আমাকে ছাতাটা দিয়ে ওই ঝুম বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে চলে গেল। তাকে দেখে মনে হল সে নিয়মিত বৃষ্টিতে ভেজে এবং ভিজতে পছন্দ করে। আমি ছাতা ফুটিয়ে বাড়ির দিকে রওঁ হলাম।

সেদিন বিকেলে আমার জ্বর আসলো। এলমেলো বাতাসে বৃষ্টির ছাঁট থেকে শরীর বাঁচেনি, আশাও করিনি। কিন্তু ছাতাটায় অনেকগুলো ফুটো। রওঁ দেয়ার মিনিট খানেকের ভেতরেই ছাতার ভেতর আরেক বৃষ্টি শুরু হল। মাথা গলা ভিজে পুরো জবজবে অবস্থা। যখন বাসায় পৌছালাম তখন আমার চোখ পুরো লাল, শরীর শালিকভেজা এবং আমি কিছুক্ষণ পরপর হাঁচি দিচ্ছি। বাসায় পৌঁছেই আগে ছাতাটায় ফুটোর সংখ্যা গুনলাম। মোট নয়টা ছোটবড় ফুটো। এই ছাতা ব্যবহারের কোনও কারণ খুঁজে পেলাম না। মা ছুটে আসলো।

-এ কি অবস্থা তোর! ছাতা নিস নি!

-নাহ, আরেকজনের ছাতা ধার করেছিলাম, ছাতাটা জঘন্য, ৯ টা ফুটো।

-ওখানে থেকে যেতি কিছুক্ষণ।

-এ বৃষ্টি তাড়াতাড়ি থেমে যাওয়া বৃষ্টি না, বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় থাকলে আমাকে ওখানে ৩ দিন বসে থাকা লাগত। যা হোক, ওসব কথা থাক। গরম পানি দাও, গোসল করব। আজ বিকেলে জ্বর আসবে, অনেকদিন গোসল করা হবে না।

আমার জ্বর আসলো দুপুরে। আর সেই বৃষ্টিটা ঘন্টাখানেক হয়েই থেমে গিয়েছিলো।

রাতের মধ্যেই জ্বর ১০৩ ডিগ্রি ছুঁয়ে ফেললো। আম্মু বারবার মাথায় পানি ঢালতে আর শরীর মুছে দিতে লাগল। ডাক্তার সাহেব আসলেন, জ্বর মাপলেন, একটা প্রেসক্রিপশন করে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে বলে গেলেন, নরমাল ভাইরাল জ্বর। ওষুধ না খেলে ৭ দিন, খেলে এক সপ্তাহ, হে হে।

এদিকে জ্বর বাড়ছে ক্রমাগত। আমি একের পর এক স্বপ্ন দেখে যাচ্ছি। ওই একই স্বপ্ন, জোনাকির পেছনে ছুটে চলা। তবে একই স্বপ্ন ভিন্ন ভিন্ন ভাবে দেখছি। একবার দেখলাম পুরো স্বপ্নটা লাল, সব কিছু লাল। আরেকবার দেখলাম পুরো স্বপ্নটা সাদাকালো, আরেকবার দেখলাম ঘষাখাওয়া স্বপ্ন। জ্বর যত বাড়তে লাগল স্বপ্ন তত থ্রিডি হতে লাগল। একসময় তীব্র জ্বরের ঘোরে আম্মুর হাত চেপে ধরে ছোটদের মত প্রলাপ বকা শুরু করলাম, আম্মু আম্মু আমার জোনাকিটা এনে দাও, উহুহুহু…জোনাকি দাও…উহুহুহু…জোনাকি।

আমার দুরাবস্থা দেখে অনেক কষ্টে আম্মু নিজের কান্না আটকে আমার মাথায় পানি দিতে লাগল। আমার মাথায় বৃষ্টির পানি পড়লেই আমার মাকে এভাবে চোখের পানি আটকাতে হয়।

দিন তিনেক পরেই আমার জ্বর কমতে শুরু করল। ছেলেটা ছাতা ফেরত নিতে এল চতুর্থ দিনে…

আমি তখনো পুরোপুরি সারিনি। শরীর দুর্বল। বিছানা থেকে মাথা তুললেই মনে হয় যে, হয় আমি স্থির আছি পৃথিবী ঘুরছে অথবা পৃথিবী স্থির আছে আমি ঘুরছি। অদ্ভুত একটা সমস্যা।

ছেলেটা যেদিন আসলো সেদিন চকচকে রোদ। এমন দারুণ রোদ দেখতে মরা মানুষও কবর থেকে উঠে আসে। তবে আমার ঘরটা অন্ধকার করে রাখা হয়েছে। আমার খুব রোদ দেখতে ইচ্ছে করছে। আম্মুকে বললাম জানালার পর্দাটা সরিয়ে দিতে। সরানোর সাথে সাথে ঘরে একগাদা রোদ ঢুকে পড়ল আর আমার মাথার যন্ত্রণা শুরু হল। আম্মুকে বললাম, পর্দা ফেলে দিয়ে লাইট জ্বালিয়ে দিতে। আম্মু তাই করল। জ্বর আসলে নিজেকে মিশরের সম্রাজ্ঞী মনে হয়। সবাই তখন আমার হুকুম তামিল করে।

হঠাৎ করে,দরজায় নক করল কেউ।

“ঠক ঠক, ঠক ঠক”

খুব আস্তে আস্তে। একটা নির্দিষ্ট ছন্দে। এমন ছন্দে দরজা নক করে ফকিরেরা।

আম্মু জোরে চিল্লিয়ে বলল, “মাফ করেন।”

নক করা থেমে গেল। মিনিট দুয়েক পরে আবার একই ভাবে, “ঠকঠকঠক…ঠক”

“মাফ করতে বললাম না! অন্য জায়গায় দেখেন”

লাজুক একটা ছেলেকণ্ঠ প্রতিধ্বনির মত শব্দ করে উঠল “আমি”… “ছাতা”

“ওহ, নাহ ছাতা নিব না। ছাতা লাগবে না।” আম্মু চেঁচিয়ে বলল।

আবার নক করা থেমে গেল। মিনিট দুয়েক পর আবার, “ঠকঠকঠক…ঠক”

আম্মুর মাথায় রক্ত উঠে গেল। দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে তুমুল একটা ঝাড়ি দেবেন বলে মনঃস্থির করলেন।

উনি দৌড়ে গিয়ে দরজা খুললেন কিন্তু ঝাড়ি দিতে পারলেন না, একটা ভদ্রমত ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। তার শার্টটা হাস্যকর রকমের বড় আর প্যান্টটা দুঃখজনক ভাবে ছোট। অনেক লম্বা কোনও বিল্ডিং থেকে লাফ দিলেও সে শার্টকে প্যারাসুট বানিয়ে নিরাপদে অবতরণ করতে পারবে।

আম্মু বললেন, “কি চাই?”

-জ্বী আন্টি আমি ছাতা নিতে এসেছি।

এত দ্রুত কথাটা বলল যেন মনে হল আসার আগে এই ৪ দিন ধরে কথাটা বলার প্রাক্টিস করেছে।

-কিসের ছাতা? তোমার ছাতা এখানে আসবে কেন?

আমি শোবার ঘর থেকে সবই শুনছিলাম আর আম্মুর এই কথাটা শোনার জন্য ওয়েট করছিলাম।

-আম্মু উনাকে ভেতরে আসতে বলো। উনার কাছ থেকেই ছাতাটা ধার করেছিলাম।

ছেলেটাকে তীব্র অনিচ্ছায় আম্মু ভেতরে ঢুকতে দিল। এই বয়সী ছেলেরা ড্যান্জারাস। এরা স্ট্রেঞ্জার হয়ে ঢুকে জামাই হয়ে বেরিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে।

উনাকে ড্রয়িং রুমে বসতে দিল। আমি অসুস্থ শরীর নিয়েই উঠে এলাম।

-কিরে তুই উঠে এলি কেন! আমিই দিয়ে দিতাম ছাতাটা।

-নাহ, এখন একটু ভালো লাগছে (মিথ্যা কথা) শুয়ে থাকতে থাকতে আর সহ্য হচ্ছিলো না (কথা সত্য)।

ছেলেটা সোফায় গুটিসুটি হয়ে বসে আছে। চেহারায় কেমন লাজুক একটা ভাব। পোশাক-পরিচ্ছদে মনে হচ্ছে অসচ্ছল অথবা উদাসীন। আমি আসতেই একটা বই এগিয়ে দিল।

-আপনার জন্য বইটা আনলাম, “হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিচিউড”। খুব ভালো।পড়ে দেখবেন।

আমি হাত বাড়িয়ে বইটা নিলাম।

-তবে বইটা আমার না, আমার ফ্রেন্ডের। ধার করে এনেছি। পড়ে ফেরত দিলে ভালো হয়।

-আর না দিলে?

ছেলেটা চুপ করে থাকল।

-আপনার ছাতাটা ভেঙে ফেলেছি।

ছেলেটা বজ্রাহত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল।

-নাহ, ইচ্ছে করে না। সেদিন বৃষ্টির মধ্যে আসতে গিয়ে দেখি একজায়গায় পানি জমে আছে। বুঝতে পারিনি গর্ত। যেই পা দিয়েছি, একদম দিড়িম করে পড়েছি। ছাতার একটা কোনা একটুর জন্য চোখে লাগেনি, নাহলে চোখটা যেত। যা হোক, তারপর একদম ভিজে গেলাম, জ্বর আসলো, ভুলভাল বকলাম, এই তো। তবে আপনার জন্য ছাতা কিনে এনেছি।

ছেলেটার চোখে সহানুভূতি উপচে পড়ল। আপনার কোথাও লাগেনি তো?

-লেগেছে, দেখানোর মত জায়গায় না।

ছেলেটা প্রচন্ড লজ্জায় কুঁকড়ে গেল।

-আচ্ছা সমস্যা নাই, ছাতা লাগবে না।

-না না, আমি কিনে এনেছি ছাতা।

আমার নতুন ছাতাটা বাড়িয়ে দিলাম ছেলেটার দিকে। কাঁপাকাঁপা হাতে নিল।

-আচ্ছা, আমি যাই।

-অবশ্যই যাবেন, তবে চা খেয়ে যাবেন। আমি অসুস্থ, নিজে চা বানাতে পারব না। আম্মুর হাতে চা খেয়ে যাবেন।

আম্মু ২ জনের জন্য ২ কাপ চা বানিয়ে আনল। আমি চায়ে চুমুক দিলাম, ছেলেটাও দিল। ভাব দেখে মনে হল জিভ পুড়িয়ে ফেলেছে।

-শুনুন, আপনার বই ফেরত দিয়ে দেব। কবে কোথায় দেব বলেন?

-না না, লাগবে না। থাক। সমস্যা নাই।

-নোপ, একবার মুখফুটে যখন বলে ফেলেছেন ফেরতের কথা, ফেরত আপনাকে নিতেই হবে। তবে একটু বড় বই তো, সময় লাগবে। ৫-৬ দিন হয়ত লাগবে। আচ্ছা একসপ্তাহ পর, নীলক্ষেত মোড়ে থাকব,সকাল ১০ টা। আপনার ঠিকানা দিয়ে যান, ওখানে না পেলে আপনার বাসায় চলে যাব। বাসায় আপনি না থাকলে দরজার সামনে রেখে আসবো। (এই গল্পের ঘটনাটা যখন ঘটে ঢাকা শহরে তখনো মোবাইল ফোন চালু হয়নি)

ছেলেটাকে খুবই অনুতপ্ত মনে হল। তার কপালে ঘাম চিকচিক করছে, আশেপাশে আমি না থাকলে হয়ত কেঁদে ফেলত। মেয়েলি স্বভাবের ছেলে। জানালা খোলা, রোদ ঢুকছে। হঠাৎ একটা বিষয় দেখে আমার দমবন্ধ হয়ে আসল!

ছেলেটার শরীর থেকে আমার স্বপ্নের সেই জোনাকির মত অদ্ভুত সবুজাভ আলো ঠিকরে বের হচ্ছে, অনেক নরম একটা আলো। তবে মোহনীয় আর হৃৎপিণ্ড কেটে ফেলার মত যথেষ্ট ধারালো।

চোখ মুছে আবার তাকালাম! তাই তো! জ্বর আর দুর্বল শরীর নিয়েও আমার নিজেকে অদ্ভুত সুখী মনে হল। ছেলেটা একটা কাগজে নিজের ঠিকানা লিখছে, আমি হা হয়ে বসে আছি! কীভাবে সম্ভব! কীভাবে সম্ভব!

“আজ যাই”বলে ছেলেটা চলে গেল আর আমি দুটো জিনিস বুঝলাম।

১. ছেলেটা সম্ভবত অসচ্ছল

২. কোন রকমের পূর্বসংকেত ও যুক্তিযুক্ত কারণ ছাড়াই আমি ভুল একটা মানুষের প্রেমে পড়েছি…

মেয়েদের প্রচণ্ড গোপন একটা সত্য কথা শুনবেন? অধিকাংশ মেয়েই হয় একেবারে নিরেট। আপনি যদি কাউকে মাত্রাহীন ভালোবাসায় অস্থির করে তুলতে চান তাহলে আপনাকে যেটা করতে হবে তা হল সেই নিরেট মনের ভেতর একটা শূন্যতা সৃষ্টি করতে হবে। আর সেই শূন্যতাটা হবে এমন এক শূন্যতা যা কেবল আপনার দ্বারাই পূরণ করা সম্ভব। জগতের কোনকিছুই শূন্যতা সহ্য করতে পারে না। এ বড় কঠিন যন্ত্রণা!

আমার শূন্যতার জন্য দায়ী মানুষটা এখন আমার বাসার সামনে যে লাইটপোস্ট তার অপজিটে দাঁড়িয়ে আছে। তার কাঁধে ব্যাগ। বার বার ইতিউতি তাকাচ্ছে। আশেপাশে কোনও পুলিশ থাকলে শুধু ভাবভঙ্গির কারণেই তাকে থানায় ধরে নিয়ে যেত। আমি গয়না আর টাকাপয়সা ভর্তি ব্যাগটা বাইরে ফেলে দিলাম। আম্মু ড্রইংরুমে বসে চা খাচ্ছেন। আমি স্বাভাবিক বাইরে যাওয়ার জামাকাপড় পরে বের হতে গেলাম।

-কি রে! এই সন্ধ্যায় কই যাচ্ছিস?

-একটু মিলিদের বাসায় যাচ্ছি। গতদিন ওর বাসায় একটা গুরুত্বপূর্ণ নোট অর্ধেক কমপ্লিট করে ফেলে এসেছি। এখন গিয়ে পুরোটা কমপ্লিট করে নিয়ে আসতে হবে।

-কাল গেলে হয় না? সকালে যাস! এই সন্ধ্যায় শুধু শুধু এভাবে যাওয়া…

-শুধু শুধু না, অনেক দরকারী। তুমি বুঝবা না। আর শোন, যদি কমপ্লিট করতে করতে খুব বেশি রাত হয়ে যায় তাহলে ওখানে আজ রাতটা থেকে যেতে পারি। টেনশন কইরো না।

আম্মু সম্মতিসূচক মৌনতাজ্ঞাপন করে চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। অবশ্য দেয়ারই কথা। মিলি আমার খুবই কাছের বান্ধবী। আজ যেন সন্দেহ না করে সেজন্য বিগত ৬ মাস যাবৎ আমি নিয়মিত মিলির বাসায় যাচ্ছি।

-আচ্ছা, সাবধানে যাস, কিন্তু তোকে কেমন যেন একটু অন্যরকম লাগছে। রাত জাগিস না,শরীর খারাপ করবে। আর মিলিকে আসতে বলিস বাসায়।

আচ্ছা, বলে দরজার নব ঘুরিয়ে বেরিয়ে গেলাম।

স্বাধীনতা জিনিসটা অস্বাভাবিক আনন্দময় একটা জিনিস। দরজার বাইরে পা দেয়ার সাথে সাথে সেটা টের পেলাম। নিজেকে সকল বন্ধন থেকে মুক্ত মনে হল। মনে হল আমি যা খুশি, তাই করতে পারি। বাইরে ঠাণ্ডা বাতাস! আজীবনই ঠাণ্ডা বাতাসে কেমন যেন প্রচণ্ড শূন্যতা অনুভূত হয়, আজকে সেই জিনিসটাতেই মাত্রাছাড়া আনন্দ হচ্ছে। একদম রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে বাস রিকশাগুলো থামিয়ে একটু নাচতে ইচ্ছে করছে। তাহলে হয়ত মনটা শান্ত হত। কিন্তু সেটা সম্ভব না। আমি গহনা আর টাকার ব্যাগটা কুড়িয়ে নিলাম। আর তারপর অশান্ত মন নিয়েই রাস্তায় গিয়ে ওর ভীতু হাতটাকে চেপে ধরলাম। জীবনে এতটা স্বস্তিদায়ক নির্ভরতা কখনও পাইনি আমি। আস্তে করে বললাম,”চলো”। ও একটু কেঁপে উঠল। আমরা একপা দুইপা করে আগাতে লাগলাম। এই যাত্রা নতুন এক জীবন আর নতুন এক পৃথিবীর পথে। আমার মনে হল আমরা বিশ্বজয় করতে যাচ্ছি আর আমি এই যুদ্ধের সেনাপতি।

মোড় থেকেই রিকশা নিলাম, লক্ষ্য পুরান ঢাকার কোনও এক কাজী অফিস। রিকশাওয়ালা লোকটা মিশমিশে কালো। ও ভয়ে সিঁটিয়ে আছে, আমিই রিকশা ঠিক করলাম। বললাম, “ওঠো”।

-সমস্যা নাই আগে তুমি ওঠো।

-নাহ, আগে তুমি উঠবা, তারপর আমাকে হাত ধরে তুলবা। দেখব কতটা শক্ত করে ধরো।

ও হাসতে হাসতে রিকশায় উঠল। তারপর আমাকেও টেনে তুলল।

মানুষ আনন্দে থাকলে মনে হয় সবকিছুই ভালো লাগে। এই মুহূর্তে আমারও ওমন লাগছে। রিকশাওয়ালাটা মিশমিশে কালো, তবে ভালো লাগছে; রিকশাটা রঙচটা, আর সিট ভাঙা, তাও মজা পাচ্ছি; ইভেন রিকশার চাকা থেকে যে ক্যাচক্যাচ আওয়াজ আসছে ওটাকেও সঙ্গীত মনে হচ্ছে। এই মুহূর্তে আমার মধ্যে কোন শূন্যতা নেই। আমি পরিপূর্ণ। স্রষ্টার ঠিকানা জানলে হয়ত আমি বিয়ে করা বাদ দিয়ে আগে সেখানে গিয়ে চিৎকার করে বলে আসতাম, “রক্তমাংসের মানুষকে এতটা সুখ দেয়া ঠিক না”।

রিকশা পুরান ঢাকার এক কাজী অফিসের সামনে এসে দাঁড়াল। সদরঘাট কাছেই। আমাদের প্লান, বিয়ে করে আজ রাতেই লঞ্চে করে বরিশাল চলে যাব। হাতে যথেষ্ট টাকা পয়সা আছে। চাকরি-বাকরি কিছু জুটিয়ে নেয়ার আগে অনায়াসে ৫-৬ মাস চলে যাবে। আর আমরা একেবারে অশিক্ষিত না, চাকরি-বাকরি জুটবে। তবে অশিক্ষিত হলেও পালাতাম। তখন বরিশাল গিয়ে ও লঞ্চঘাটে কুলির কাজ করত, আমি হয়ত মানুষের বাসায় থালা-বাসন ধুতাম আর ঘর মুছতাম। মানুষের ঘর মুছতে মুছতে ওর কথা ভাবতাম।

যেই মুহূর্তে আমরা কাজী অফিসে ঢুকলাম সাথে সাথে কাজী সাহেব পিচিক করে পানের পিক ফেললেন। উনাকে দেখে মনে হল জন্মের পরদিন থেকেই পান খাওয়া ধরেছেন। দাঁত লাল, ফাঁকে ফাঁকে একগাদা শুকনো পান জমে আছে। ঠোঁট ফাটা, তবে লাল। দাড়ি নিচের অর্ধেক সাদা, উপরের অর্ধেক লাল। সম্ভবত উনি মেহেদী দিতেন কিন্তু ক’দিন দিতে পারেননি। উনার পরনে সাদা আলখাল্লার আর তার সাথে হাজী রুমাল। গরম পড়েছে, টুপিটা এখন খুলে রেখেছেন। উনার চকচকে টাকটা এখন দুনিয়ায় আলোবাতাস খাচ্ছে। আমাদের দেখে উনার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

-আসেন মা-বাবাজীরা। বিবাহ করিতে আসিয়াছেন?

উনার কথাবার্তা সব সাধু ভাষায়। বেশিক্ষণ শুনলে মাথা ঘুরবে।

-জ্বী। কিন্তু সাক্ষী আনতে পারিনি। আপনার এখানে সাক্ষী পাওয়া যাবে?

-জ্বী জ্বী, সবই পাওয়া যাইবে শুধু সাক্ষীগণকে একটু খানি চা-নাস্তার টাকা দিয়া খুশি করিয়া দিতে হইবে। তবে এ ব্যাপারে একটু সমস্যা রহিয়াছে। তাহারা উন্নত চা নাস্তা ছাড়া খায় না, এজন্য একটু বেশি দিতে হইবে।

আমি ওর চোখের দিকে একবার তাকালাম, তারপর কাজী সাহবকে বললাম “দেব, সমস্যা নাই। আপনি সাক্ষী নিয়ে আসেন।”

উনি আবার খুশি হয়ে গেলেন। সম্ভবত উনার রোজগারপাতি কম হচ্ছে। আজ বড় একটা দাও মারবেন।

-জ্বী আচ্ছা, জ্বী আচ্ছা আম্মা। তা আম্মা একটা কথা কই?

-জ্বী বলেন।

-আপনারা কি পালাইয়া বিবাহ করিতেছেন। যদি করেন সমস্যা নাই। যা যুগ আসিতেছে মানুষ বিবাহই করে না। বিবাহ ব্যতিরেকেই তাহারা স্বামী-স্ত্রীর ন্যায় আচরণ করে, নাউজুবিল্লাহ। ইহা নিঃসন্দেহে কিয়ামতের আলামত। আমার কিয়ামত দেখিবার শখ নাই। তবে সূর্য পশ্চিমে উঠিবে ইহা দেখিবার অতীব খায়েশ, দোয়া করিবেন কালই যেন সূর্য পশ্চিমে উঠে এবং পরশুই আমি মরিয়া যাই, হে হে।

কাজী লোকটা প্রচণ্ড পরিমাণে অপ্রয়োজনীয় কথা বলে। এমনিতেই এক ধরণের ঘোরের মধ্যে আছি, সাথে হাজার রকমের অনিশ্চয়তা। উনার এসব গা জ্বালানো কথায় ঘোর কেটে যাচ্ছে। আমি ছেলে হলে আর উনার চেয়ে বয়সে বড় হলে টেবিলে দিড়িক করে একটা কিল বসিয়ে বলতাম, “খাজুরে আলাপ বাদ দে, সাক্ষী ডাক, বিয়ে পড়া।” কিন্তু সেটা বলা যাবে না।

-কাজী সাহেব আমাদের হাতে সময় নেই। সাড়ে নয়টায় লঞ্চ। একটু তাড়াতাড়ি করেন। সাক্ষী-সাবদ ডাকেন, রেজিস্ট্রি করেন।

উনি মনে হয় ঘন্টা খানেক গল্প করতে চেয়েছিলেন। কেমন যেন আশাহত হলেন। তারপর চিকন কণ্ঠে ডাকলেন, জামিল, এ জামিল। তাড়াতাড়ি এখানে চলিয়া আয়। সাক্ষী হওয়া লাগিবে।”

একটা রোগাপটকা লোক আরও ৩ জন লোকসহ রুমে ঢুকলো। সাক্ষী হওয়া তাদের পেশা। পারিবারিকভাবে বিয়ে হলে সবচেয়ে মন খারাপ করে এরা, কারণ সেখানে সাক্ষী হয় পরিবারের লোক। এরা দিনরাত দোয়া করতে থাকে, বাংলাদেশের সবাই যেন পালিয়ে বিয়ে করে আর এই কাজী অফিসেই আসে।

আমরা একজন অন্যজনের হাতে হাত রাখলাম, নিচে আমারটা, তারপরে ওরটা, তারপর আমারটা, তারপর আবার ওরটা। এই হাত কি কখনও ছাড়া সম্ভব!

কাজী সাহেব সুর করে মিহি গলায় দোয়া পড়ছেন। মনে হচ্ছে শব্দগুলো যেন আরশ থেকে ভেসে আসছে। আচ্ছা বিয়ের দোয়াগুলো এত্ত সুন্দর কেন!…

চাঁদের আলোতে কিন্তু সূর্যের মত ভিটামিন ডি উৎপন্ন হয় না। তবুও ছোটবেলায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে আমি আর আম্মু জ্যোৎস্না রাতে চাঁদের আলো মাখতাম। যখন অনেক ছোট ছিলাম, তখন রাতে হিসেব করে মাত্র ৩ ঘন্টা কারেন্ট কতথাকত। লোডশেডিং এর সময়টাতে ব্যলকনিতে আম্মু একটা দোলচেয়ারে আমাকে কোলে নিয়ে বসতেন। সম্ভবত তখন জ্যোৎস্নার পাওয়ার বেশি ছিলো। কেমন দারুণ মায়াবী আলোয় অপার্থিব একটা পরিবেশ সৃষ্টি হত!

আমি জীবনে যে জিনিসটা দেখে সর্বপ্রথম মুগ্ধ হয়েছিলাম সেটা হল এই চাঁদ। আমার জীবনের প্রথম লক্ষ্য ছিলো যেভাবেই হোক চাঁদে যাওয়া। অসম্ভব লাগত না সেটা। কিন্তু আমার কখনওই লক্ষ্য ছিল না পালিয়ে বিয়ে করা, সম্ভব -অসম্ভবের প্রশ্ন তো দূরের কথা। অথচ নিয়তির বাঁধাধরা চালে সেই অভব্য বিষয়টাই সম্ভব হয়ে উঠল। কোথাকার সেই চাঁদের প্রেমে পড়া আমি চাঁদকে ভালোবেসে জোনাকিকে বিয়ে করে ফেললাম।

আমাদের বিয়েটা হয়েই গেল শেষমেশ। সই-সাক্ষ্য, রেজিস্ট্রি সব শেষ। আমি মাথায় ঘোমটা দিয়ে বসে আছি। কেমন অদ্ভুত একটা পরিবর্তন টের পাচ্ছি। মনে হচ্ছে ওকে আর আমাকে কেউ সূক্ষ্ম একটা সূতা দিয়ে বেঁধে ফেলেছে। ওকে দূরে যেতে দেয়া যাবে না, সূতায় টান লাগবে। এই সূতার টানে মৃত্যুর মত যন্ত্রণা হয়।

ও জুবুথুবু হয়ে বসে আছে, ওর চোখে “এ আমি কি কোল্লাম” টাইপ ভাব ফুটে আছে। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে ও, মনে হচ্ছে পৃথিবীতে হুট করে বায়ুমণ্ডলের অক্সিজেন ২১% থেকে ১০% এ নেমে এসেছে। ওকে দেখে আমারও কেমন মায়া হচ্ছে। চোখের কোণা দিয়ে মায়া মায়া দৃষ্টিতে আমি ওকে দেখছি।

কাজী সাহেব আবার সেই সাধুভাষায় কথা বলে উঠলেন। অনেকটা ওয়াজের মত করে…

-তা বাবাজি হাদিয়ার ব্যাপারটা চুকাইয়া ফেলিলে ভালো হইতো না? আপনাদের রওঁ হইতে দেরি হইয়া যাইতেছে, আমিও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হইয়া পড়িতেছি। লঞ্চ ফেল করিতে পারেন। পালাইয়া বিবাহ করা দম্পতিদের মধ্যে লঞ্চ ফেল করিবার হার অনেক বেশি, আমি আপন চোখে দেখিয়াছি…

উনি সমর্থকের জন্য জামিল ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের দিকে তাকালেন। কিন্তু ওরা পাথরের মত বসে থাকল, একবারও মাথা নাড়াল না।

-জ্বী অবশ্যই, কত করে হাদিয়া নেন।

-জ্বী আম্মাজী, আমি অত্র এলাকার সবচাইতে পুরাতন কাজী। এমন যুবকও রহিয়াছে যাহাদের বাবা ও দাদার বিয়েও এই অধমই পড়াইছে। এখন জিনিসপত্রের দাম বাড়তির পথে, আমার জীবনে কোন বিলাসিতা নাই, সামান্য খাইয়া-পরিয়া বাঁচিতে যেটুকু লাগে সেটুকুই আমি হাদিয়া লইয়া থাকি। তবে সমস্যা হইলো ইদানিং মানুষ বিবাহ করা কমাইয়া দিয়াছে। যেনা ব্যভিচার সর্বত্রই, জীবনধারণ কঠিন হইয়া যাইতেছে। এদিকে আপনারাও নতুন জীবন শুরু করিতে যাইতেছেন। তাই আম্মাজী সব বিবেচনায় আমাকে পাঁচশত টাকা হাদিয়া প্রদান করিলেই মন থেকে খাস দিলে দোয়া বাহির হইতে থাকিবে।

পুরো কথাটা বলতে উনি তিনবার পানের পিক ফেললেন। আমি উনাকে ৫০০ টাকার একটা নোট বের করে দিলাম।

কাজী সাহেব বিষম খেলেন মনে হল। তার চেহারা চকচক করে উঠল। উনি ভাবতেও পারেননি যা চাবেন তাই পেয়ে যাবেন। এখন উনার আফসোস হচ্ছে কেন ৮০০ টাকা চাইলেন না। লোকে বিয়ে পড়ালে ১০০ ও দিতে চায় না। তবে প্রথমবার বিয়ে করতে আসা মানুষগুলো না জেনে না বুঝে আসে, কল্পনায় ভাসতে ভাসতে বিয়ে করে ফেলে। এদের কাছে যা চাওয়া যায় তাই দিয়ে দেয়। মাতাল আর সদ্য বিবাহিতের মধ্যে তেমন কোনও পার্থক্য নাই। উনি মনে মনে ভাবলেন কাজী অফিসের সাইনবোর্ডে একটা লাইন যুক্ত করবেন “শুধুমাত্র প্রথমবার বিবাহ করিতে আগমনকারী নর-নারীর বিবাহ পড়ানো হয়।”

জামিল বিরস বদনে বসে আছে। ওর সাঙ্গপাঙ্গরা ইতোমধ্যে কাজী সাহেবের দিকে তাকিয়ে টাকার জন্য কাশাকাশি শুরু করে দিয়েছে। কাজী সাহেব মুখ খুললেন।

-আর আম্মাজী, এই ভুখা মানুষগুলানরে চা-নাস্তার কিছু টাকা দেন। তাহারা চা-নাস্তার ওপরেই বাঁচিয়া থাকে।

ওদের প্রত্যেককে ৫০ টাকা করে দিলাম। ওরাও বিস্মিত হল। অন্যরা প্রথমে ২০ টাকা দেয়, হাতে পায়ে ধরলে দেয় ২৫। আমি একবারেই দিয়ে দিলাম দ্বিগুন। ওরে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। শুধু কাজী সাহেব দরাজ গলায় বলতে লাগলেন, মাশাআল্লাহ, মাআআআশআল্লাহ (এটা যখনকার কথা তখন চাল ১০ টাকা করে কেজি)।

আমরা কাজী সাহেবকে সালাম দিয়ে বের হয়ে যেতে উদ্যত হলাম। উনি ডাকলেন, “আম্মাজী”।

আমরা পেছনে ফিরে তাকালাম। উনাকে কেমন নিষ্পাপ নিষ্পাপ লাগছে, কারণটা কি!

-আম্মাজী, এখানে বিবাহ করিবার পরে তাহাদের নতুন জীবনের উদ্দেশ্যে আমি তাহাদিগকে কিছু উপহার দিয়া থাকি। তাই আপনাদেরও একটা বুখারী শরীফের খন্ড দিতে মনস্থির করিয়াছি। হাদীস কোরানের আলো ব্যতীত সুন্দর সংসার সম্ভব নহে। বইখানি পড়িবেন সময় পাইলে…

আসলে কথাটা কিছুটা মিথ্যা। যদি উনার মন ভালো থাকে আর কোন বই একাধিক থাকে তাহলে উনি এই কাজটা করেন। আর উনার মন ভালো থাকে তখনই যখন তার রোজগারপাতি ভালো হয়।

উনি একটা বই এগিয়ে দিলেন, বোখারী শরীফ, ২য় খন্ড। ও হাত বাড়িয়ে বইটা নিয়ে বলল, ধন্যবাদ কাজী সাহেব।

-আল্লাহ আপনাদের ভালো করুন। আল্লাহ হাফেজ। দ্রুত রওঁ হোন, লঞ্চ ছাড়িয়া দিতে পারে।

আমরা উনাকে সালাম দিয়ে বের হয়ে আসলাম আর উনি বসে বসে গুনগুন করে বলতে লাগলেন, “এ যুগের ছেলেমেয়ে তো, পায়ে হাত দিয়া সালাম করিতে শেখে নাই। যা হোক, খারাপ না। খাস দিলে দোয়া রহিলো। ফি আমানিল্লাহ”।

ঠাণ্ডা বাতাস আরও বেড়েছে। মনে হয় বৃষ্টি হবে। আমি প্রাণেপণে চাচ্ছি বৃষ্টি হোক। আজ আমরা ২ জনই ছাতা আনতে ভুলে গেছি। এখন বৃষ্টিতে ভিজলে নিশ্চিত ১০৩+ জ্বর আসবে। আবার আমি জোনাকির স্বপ্নটা দেখব। নরম আলো ছড়িয়ে একটা জোনাকি উড়ে উড়ে যাবে, আমার হাত পা বাঁধা থাকবে। তবে এবার আর আমি জোনাকির পিছে ছুটবো না। ও আমার মাথায় পরম যত্নে পানি পট্টি দিবে। আমি স্বপ্নের মধ্যেই অকুন্ঠ নির্ভরতায় ওর হাতটা চেপে ধরে উড়ে যাওয়া ওই জোনাকিটাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাব। আমি বেঁচে থাকব ওকে ঘিরে, জোনাকিরা উড়ে যাক। সব নরম মিষ্টি আলো এখন আমার দখলে।

আমরা সদরঘাট পৌছে গেলাম। ৪ টাকা দিয়ে ২ জন সদরঘাটে ঢোকার টিকিট কাটলাম। মোটামত একটা লোক লুঙ্গির গিট্টু খুলে, টুলে বসে টিকিট দিচ্ছে।ওঁওঁর পেটটা এতটাই মোটা যে লুঙ্গি খুলে পড়ে যাচ্ছে না। উনি যেই টুলটার ওপর বসে আছেন ওটা হয়ত চিৎকার করে বলছে, “বাঁচাও! বাঁচাও!” ভাগ্যিস বস্তুজগতের ভাষা বোঝার ক্ষমতা আমাদের নেই। ও লোকটাকে জিজ্ঞাসা করল, ভাই বরিশালের লঞ্চ কোনটা?

গমগমে গলায় লোকটা বলল, এমভি টাইগার। ওখানে যাইয়া টিকিট কাইট্টা নিবেন। ওই যে পঙ্খিরাজের লাহান ওই লঞ্চোডা দেহা যায় ওইডা, যান চইলা যান। একটু পরেই ছাড়ব।”

এই লোকের ঠোঁট দাত সব কালো। পান-সিগারেট একসাথে খেলে এমন হয়!

আমরা লঞ্চে উঠলাম। বাতাস বাড়ছে। লঞ্চ ছাড়বে কিনা কে জানে! তবুও টিকিট কিনলাম। ও ডাবল বেডের একটা কেবিন নিতে চাইল। আমি ওর কানে ফিসফিস করে বললাম, “এখনও ডাবল বেড!”

শেষমেশ সিঙ্গেল বেডের একটা কেবিন ভাড়া নিলাম। তবে ২ জন থাকব বলে দু’টো টিকিট। রুমের চাবি দিয়ে দিল। তিনতলায়। সিঁড়ি ভেঙে ৩ তলায় উঠলাম। দারুণ লঞ্চ, একদম চকচকে, জায়গায় জায়গায় অপ্রয়োজনীয় লাইটিং। তবে ভালো লাগল। এখন সবই ভালো লাগছে, এটা নৌকার ভেলা হলেও ভালো লাগত। ও হাত ধরে আছে, মাঝেমাঝে ছেড়ে দিচ্ছে, তখন খারাপ লাগছে। অদ্ভুত এবং ব্যাখ্যাতীত এক ধরণের খারাপ লাগা।

সিঙ্গেল রুমটা খুলে হতাশ হলাম। বিছানা এতই চিকন যে একজনও ঠিকমত শোয়া যাবে না। ২ জন পাশাপাশি শোয়া অসম্ভব। তবে একজনের ওপর আরেকজ…বাদ দিই। আজ রাতে ঘুম হবে না। কেমন শিহরণ জাগানিয়া একটা মুহূর্ত! আমার রুমে ঢুকে ব্যাগগুলো বেডের তলে ঢুকালাম। তারপর দরজা বন্ধ করে দিলাম। মনে হল আমরা পৃথিবীর বাইরে, ৬ ফিটবাই ৩ ফিটের নতুন একটা পৃথিবী। এই পৃথিবীর আবিষ্কর্তা আমরা দু’জন। একটা জানালা থাকলে ভালো হত, খুলে দিতাম। মেঘ করেছে, তবে চাঁদটা কষ্টেশিষ্টে মেঘের পরশ থেকে বাইরে বের হয়ে জ্যোৎস্না ঢেলে যাচ্ছে। খুব মন চাচ্ছে চাঁদ আমাদের আজকের প্রেম দেখে হিংসায় মরে যাক। তারপর রাগ করে উধাও হয়ে যাক অন্য কোনও সৌরজগতে। অনন্ত অন্ধকার সেই পৃথিবীতে আমরা একে অন্যকে ভালোবেসে যাই মহাকালের সেই বিপদসীমা পর্যন্ত, যার পর আর ভালোবাসা নিষিদ্ধ। আমরা কাছাকাছি বসলাম।

পোওওওওওও, বুক কাঁপিয়ে দেয়া একটা শব্দে চমকে উঠে ওর হাতটা জাপটে ধরলাম। মনে হল, কিয়ামত শুরু হয়ে গেছে। ইসরাফিল (আঃ) শিঙ্গায় ফুঁ দিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু আসলে তা না। লঞ্চের ভেঁপুর শব্দ, লঞ্চ ছাড়লো। এখন এই লঞ্চের কেবিনটা আমাদের পারমিশন ছাড়াই বেহেশতে নিয়ে যাবে।…

পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে জঘন্য যন্ত্রটা হল ঘড়ি। এর প্রধান কাজ মানুষজনকে টেনশনে রাখা, দ্বিতীয় কাজ সময় পরিমাপ। আমি বুঝি না, যে জিনিসটা আটকানোর ক্ষমতা মানুষের নেই, সেই জিনিসটা পরিমাপ করে কি লাভ। আলটিমেটলি, ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত আসামি বাদে মৃত্যুর তারিখ তো কেউই জানে না।

হঠাৎ করে স্রষ্টা যদি আমাকে একদিন ডেকে জিজ্ঞাসা করতেন, “যে কোন একটা সুপারপাওয়ার…দেব তোমাকে, বলো কি চাও?”

আমি চোখবন্ধ করে ১০ মিলিসেকেন্ডও না ভেবে বলে দিতাম “সময় আর ঘড়ি নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা।”

লঞ্চ ছেড়ে দিয়েছে। আমরা একটা সিঙ্গেল বেডের কেবিনে বন্দী। আমরা চুপচাপ একজন অন্যজনের হাত ধরে বসে আছি। আমাদের ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে কোনও একটা আদিম টুর্নামেন্ট জিতে ট্রফি হাতে বসে আছি। ওর ট্রফি আমি, আমার ট্রফি ও। ঠিক এই মুহূর্তটায় সময় থামিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। ঘড়ি আর না চলুক, স্থবির হয়ে যাক সবকিছু।

লঞ্চ ছাড়ার পর ওর কণ্ঠের জড়তা কাটতে শুরু করেছে। যতক্ষণ ঢাকা ছিলাম, হঠাৎ ধরা পড়া ওয়ান্টেড ক্রিমিনালের মত আচরণ করছিল। এখন সব ঠিকঠাক। ও স্বাভাবিক কণ্ঠে প্রশ্ন করল

-এর আগে কখনও লঞ্চে উঠেছ?

-উহু

-রাত্রি বেলা ওয়াটার সার্ফেসকে একটা চাদরের মত মনে হয় জানো। মিশমিশে কালো, কিন্তু মোলায়েম। চাঁদ থাকলে লাগে রূপালী। আজ মনে হয় রূপালী লাগবে। ঠাণ্ডা বাতাস আছে। ডেকে দাঁড়াল দারুণ লাগবে। যাবা?

মনে মনে ভাবলাম যাই, পুরাতন প্রেমিক চাঁদের সাথে শেষ দেখাটা করে আসি। আজকের পর আর কখনও চাঁদের দিকে প্রেমের আকুতি নিয়ে তাকাব না। এক বনে যেমন দুই বাঘ থাকা ঠিক, তেমনি এক মনে দুই প্রেমিক থাকা ঠিক না। মনে মনে হাসলাম।

-হাসছ কেন!

-কিছু না, এমনি। আমি এখন থেকে মাঝে মাঝে অকারণে হাসব। কিছু মনে করো না।

-আগে তো হাসতে না।

-আগে কিছু একটা ছি না, এখন সেটা আছে।

ও কিছু বলল না। মুচকি করে হাসল। বুঝছি না এখন আমারও কি জিজ্ঞাসা করা উচিত, হাসছ কেন?

-আচ্ছা, চলো। ছাদে যাই। ওখান থেকে চারপাশে খানিকটা দেখা যাবে। অনেক দূরের শহরগুলোকে তারার মত ছোট আর জ্বলজ্বলে মনে হবে। সাথে ঠাণ্ডা বাতাস…

-তোমার তো অনেক অভিজ্ঞতা

-অনেক না, কিছুটা

কেমন মরা মরা শোনালল ওর কণ্ঠ।

-খুব অস্থির লাগছে। আচ্ছা একটা কথা বলি। তুমি আমাকে ভালোবাসো তো?

-অবান্তর প্রশ্ন, কি হয়েছে তোমার!

কেমন আনমনা লাগল ওকে। গুনগুন করল,”

না না, কিছু না। আমি অনেক বাসি তো তাই বল্লাম আরকি”।

-সব কথা বলা লাগে না। এখন চলো। ছাদে যাব। নদী দেখব, চলো।

অন্যমনস্কের মত বলল, “চলো।”

ছাদে ঝোড়ো ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে হুহু করে। লঞ্চের দুলুনি ধীরে ধীরে আরামদায়ক থেকে শঙ্কাজনকে পরিণত হচ্ছে। আমরা যখন ছাদে গেলাম তখনও বাতাস মানুষের টেনশনের সীমা অতিক্রম করেনি। মেঘের এক ফুটো দিয়ে চাঁদের একটা অংশ বের হয়ে আছে। আবার মনে হচ্ছে মেঘের ওইপাশে স্বর্গ এপাশে পৃথিবী, মাঝখানে একটা ফুটো হয়ে গেছে। সামান্য জ্যোৎস্না। এই জ্যোৎস্নায় শুধু অবয়ব বোঝা যায়। খুব সহজ-সরল কোনও মানুষকেও খুব রহস্যজনক লাগে। ওকে ওমন অদ্ভুত রহস্যময় লাগছে। পরিবেশটা দারুণ, তবে কেন জানি না, ছাদে তেমন মানুষ নেই। যে ২-৪ জন আছে তারা অতিরিক্ত রোমান্টিক, অথবা সিগারেট খেতে এসেছে। সিগারেটখোরদের ঠোঁটের সামনে একটুকরো আলো জ্বলে আছে। ওই আলোই তাদের জীবনানন্দের খোরাক।

আমরা রেলিং ধরে দাঁড়ালাম। হুহু বাতাস, লঞ্চ পূর্ণ বেগে যাচ্ছে। জান্তব গোঁ গোঁ শব্দে পানি কেটে এগিয়ে যাচ্ছে লঞ্চটা। হালকা জ্যোৎস্নায় পানিটা ঠিক রূপালি হতে না পারলেও পুরোপুরি কালো নেই। তবে ওর কথা ঠিক, ওয়াটার সার্ফেসটাকে পেতে রাখা চাদরের মত লাগছে। সেই চাদর ছিঁড়েখুঁড়ে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের লঞ্চ।

অনেক দূরে তারার মত আলোও চোখে পড়ছে। আমি চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছি। মেঘ বাড়ছে। হয়ত বৃষ্টি আসবে, অথবা ঝড়ও। দুটো ডানা থাকলে উড়ে যেতাম। কিন্তু একটা ডানা থাকলে? একটা ডানা দিয়ে কি ওড়া সম্ভব?

জানি না, কেন যেন নিজেকে এখন প্রচণ্ড একা লাগছে। সদ্য বিবাহিত আমি, এই একাকীত্বটা কি ও পূরণ করতে পারবে?

আমি একদম প্রকৃতিতে মজে গেছি। ও নিজে থেকে কোনও কথা বলছে না, হয়ত উদাস হয়ে তাকিয়ে আছে দূরের কোনও নৌকা বা লঞ্চের দিকে। হঠাৎ করে মাথায় একটা প্রশ্ন আসলো…

-আচ্ছা, এখন যদি ধরো আমি হঠাৎ করে লঞ্চ থেকে লাফ দিই, কি করবা?

কোনও উত্তর আসলো না। আমি ও যেখানে রেলিং এ হাত রেখেছিল সেখানে হাত রাখলাম। আজব! ওর হাতটা নেই। ঠাণ্ডা হয়ে আছে লোহার রেলিংটা।

আমি ছট করে পাশে তাকালাম। তারপর পাথরের মত জমে গেলাম একদম। একটা জোনাকি উড়ে যাচ্ছে। অবিকল স্বপ্নে দেখা সেই জোনাকিটার মত! আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত জোনাকিটাকে নরম আলো পেছনে ফেলে অদৃশ্য হতে দেখলাম। এটা কি স্বপ্ন? নিজেকে প্রশ্ন করলাম। আমি কি জ্বরের ঘোরে আমার ড্রইংরুমে শুয়ে আছি? নাহ নাহ। এটাই বাস্তবতা।

কিন্তু ও যে আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো! ও কোথায়! আমি পুরো ছাদে চক্কর দিলাম, নাহ নেই! তাহলে কি কেবিনে চলে গেল! আমাকে না জানিয়ে তো যাওয়ার কথা না।

দৌড়ে গেলাম। হাঁফাতে হাঁফাতে দরজা খুললাম। ও নেই। মাথাটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। মনে হচ্ছে কেউ হঠাৎ করে ঘিলু ফেলে দিয়ে একগাদা বাতাস জোর করে উচ্চচাপে ঢুকিয়ে দিয়েছে মাথায়। অস্বাভাবিক অস্বস্তি, বুক ধড়ফড় করছে। মনে হচ্ছে যে কোন মুহূর্তে হৃৎপিণ্ড বাইরে বেরিয়ে এসে চারপাশে রক্ত ছিটানো শুরু করবে। মাথায় একটা ফুটো করে দিলে ভালো হত। আমি মাথা ঠাণ্ডাকরতে বিছানায় বসলাম। আচ্ছা কোথায় যেতে পারে ও? টয়লেটেও তো যেতে পারে! নিজেকে নিজেই বললাম, ও আসবে। শান্ত হও, শান্ত হও। বসে থাকলাম ওর অপেক্ষা। ১ঘন্টা পার হয়ে গেল। ও এলনা, বদলে হঠাৎ করে লঞ্চটা বিপদজনকভাবে দুলতে লাগল, আর মানুষের চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ ভেসে আসতে লাগল!

ঝড় উঠেছে। মাতাল হাওয়া হুহু করে বইছে। লঞ্চ বিপদজনকভাবে দুলছে। আমার কোনও ভাবান্তর নেই। আমি চুপচাপ বসে লঞ্চের সাথে দুলছি। মানুষজন ঝিঁঝিঁপোকার মত চিল্লিয়ে যাচ্ছে। কে যেন কেবিনের দরজায় নক করল। আমার বুকের ভেতরটা ধপাস করে উঠল। দ্রুত দরজা খুললাম। ও না। লম্বামত একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে, এখানকার স্টাফ হবে হয়ত।

-ম্যাডাম, ঝড় উঠেছে, অবস্থা খারাপ। লঞ্চ ডুবে যেতে পারে।

-এখনও ডুবছে না কেন, এত দেরি হচ্ছে কেন!

ছেলেটা হাঁ করি তাকিয়ে থাকল। সে প্রথমত আমাকে এমন চুপচাপ অবস্থায় আশা করে নি, দ্বিতীয়ত এমন কথা বলব সেটা ভাবতেও পারেনি। তার হাতে বেশ কয়েকটা লাইফ জ্যাকেট।

-আচ্ছা ম্যাডাম, এটা রাখেন। শুধু কেবিন যারা নিয়েছে তাদের জন্য।

আমি হাত বাড়িয়ে একটা লাইফ জ্যাকেট নিলাম। চকচকে,নতুন। কখনও কেউ ব্যবহার করেনি সম্ভবত। আমি দরজা খুলেই দাঁড়িয়ে থাকলাম। ছেলেটা অন্য একটা কেবিনে চলে গেল। আমার কেবিনের সামনেই রেলিং, ওপাশে ফাঁকা। লঞ্চের আলোতে নদীর তাণ্ডব দেখা যাচ্ছে। সেই লঞ্চের তলের শান্ত চাদরটা কেউ যেন জোরে জোরে ঝাঁকি দিয়ে লঞ্চটাকে উড়িয়ে দিতে চাচ্ছে। শোঁ শোঁ বাতাসের সাথে বাজ পড়ার কানফাটা আওয়াজ। আমি আলোকিত আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলাম খানিকক্ষণ। তারপর শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে জ্যাকেটটা ছুঁড়ে ফেললাম নদীতে।

আধাঘন্টা পর হইচই থিতিয়ে আসলো, পরিবেশও শান্ত হয়ে আসলো। ও আসলো না। আমিও শান্ত হয়ে এসেছি। হালকা খারাপ লাগছে যে লঞ্চটা ডুবে গেল না কেন! মাথার ভেতরটায় আর কিছুই ঢুকছে না। তবে বুকে ব্যথা। মনে হচ্ছে প্রতিবার হৃৎস্পন্দনের সময় চারজন দায়িত্ব নিয়ে হৃৎপিণ্ডের চারটা প্রকোষ্ঠে সূচ ফোটাচ্ছে। আমি উঠে দাঁড়ালাম। বাস্তবে ফেরার চেষ্টা করলাম ধীরে ধীরে। তারপর সিদ্ধান্ত নিলাম, সুপারভাইজারের কাছে যাব। ওকে খুঁজব।

লঞ্চের সুপারভাইজার মানুষটা মাঝারি গড়নের। কালো প্যান্ট, সাদা শার্ট। দেখে মনে হচ্ছে কোনও কোম্পানিতে চাকরির জন্য ভাইভা দিতে এসেছে। দাড়ি ক্লিনশেভড, কিন্তু মোচগুলো সজারুর কাঁটার মত। খুবই আনন্দিত লাগছে উনাকে। একটু আগেই একটা ফাঁড়া কাটল। নিশ্চিত ডুবে যেত লঞ্চটা। অথচ সেটাই এখন সুন্দরভাবে চলছে। কোনও ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।

-এক্সকিউজ মি?

-জ্বী বলুন।

-আমার হাজব্যান্ডকে খুঁজে পাচ্ছি না, গত দেড়-দুই ঘন্টা যাবৎ নিখোঁজ।

লোকটার মুখের হাসি মুছে গেল। উনি ভেবেছিলেন কোনও ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। কিন্তু ঝড়ে একজন মানুষ নিখোঁজ হয়ে গেছে!

-ওহ! ঝড়ের সময় হারিয়ে গেছেন?

-নাহ, তারও ঘন্টাখানেক আগে। একদম হঠাৎ করে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। অনেক খুঁজলাম, কোথাও পেলাম না।

লোকটাকে চিন্তিত লাগল। তাহলে ঝড়ের আগের ঘটনা। হঠাৎ কী ভেবে উনার চোখ বড় হয়ে গেল।

-ম্যাম, আপনাদের বিয়ে কবে হয়েছে?

-আজ।

-রুম থেকে কিছু চুরি গেছে?

উনি যা বলছেন আমি বুঝতে পারছি। উনি ভেবেছেন ও হয়ত চুরি করে পালিয়েছে। এমন ঘটনা অবশ্য হরহামেশাই ঘটে। ভাবা দোষের কিছু না।

-নাহ, শুধু দু’টো টিকিট। ওর পকেটে ছিল।

লোকটা হিসাব মেলাতে পারছেন না, ঘামছেন।

-আচ্ছা, উনার কোনও ছবি আছে আপনার কাছে? নাম কি উনার?

-নাহ ছবি নেই,ওর নাম…

ওর নামটা বললাম।

লোকটা সহানুভূতির কণ্ঠে বলল, “

সমস্যা নাই, আপনি চিন্তা করবেন না। লঞ্চ কোথাও থামেনি যে উনি নেমে যাবেন। উনি লঞ্চেই আছেন। আমি মাইকিং করে দিচ্ছি যেন যেখানেই থাকুক, এখানে এসে যোগাযোগ করেন। আর আপনার সাথে একজন স্টাফকে দিচ্ছি। ছবি যেহেতু নেই, আপনি একটু নিজের চোখে খুঁজে দেখুন উনাকে।”

সুপারভাইজার লোকটার কথা শুনে শান্তি লাগল। এমন পরিস্থিতিতে আশার বাণীর মত মূল্যবান আর কিছুই নেই।

মাইকে বারবার ওর নাম উচ্চারিত হতে লাগল। আরেকজনের সাথে আমি পুরো লঞ্চ চষে ফেললাম। ও নেই।

সুপারভাইজার লোকটা ধাঁধাঁ ধরে বসে আছেন। আমি কেমন যেন ক্লান্তিতে এলিয়ে পড়েছি। উনি তবুও আশা ছাড়লেন না।

-আচ্ছা, সমস্যা নেই। এমন হতেই পারে। লঞ্চ থামার পর সবাই যখন নামবে তখন আপনি ওখানে থাকবেন, একটু দেখবেন। তারপর আমরা পুরো লঞ্চ সার্চ করব। ইনশাআল্লাহ অবশ্যই পেয়ে যাবেন।

লঞ্চ বরিশাল পৌঁছালো ভোর সাড়ে ৬ টায়। ততক্ষণে সোনালী রোদ উঁকি দিতে শুরু করেছে। সবাই লাইন করে নামতে শুরু করল। একটা টুলের ওপর দাঁড়িয়ে আমি প্রতিটা মানুষের মুখে আমার আকুল দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে লাগলাম। ওকে পেলাম না।

ফাঁকা লঞ্চ সার্চ করা হল, ও নেই। ও নেই, নেই,একেবারেই নেই। এমন ধাঁধাঁধরা পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আমার কেমন পাগল পাগল লাগা শুরু হল।…

৬ (শেষ পর্ব)

লঞ্চঘাট, স্টেশন, বাসস্ট্যান্ড এই জায়গাগুলোর মধ্যে দারুণ একটা মিল আছে। সেটা হল এই জায়গাগুলোতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকলেও কেউ আপনাকে জিজ্ঞাসা করবে না, “কি হয়েছে?” এই জায়গাগুলোতে আসলে কেমন যেন অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার একটা অনুভূতি আসে। মনে হয় আমি পৃথিবীতে নেই, তবুও কত সুন্দরভাবে পৃথিবীটা চলছে। লঞ্চঘাট, বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশন এগুলো হল আমি-হীন পৃথিবীর রেপ্লিকা। কি দারুণভাবেই না বুঝিয়ে দেয় আমি না থাকলেও বাস, ট্রেনগুলোর কিচ্ছু যাবে আসবে না। পৃথিবী ঘুরবে পশ্চিম থেকে পুবে,সামান্য হেলে।

এখন সাড়ে নয় বা দশটা মত বাজবে। আমি লঞ্চঘাটের একটা বেঞ্চিতে বসে আছি। সেই ৭ টা থেকে আমি এখানে বসা। একদম পাথরের মত। একবারও নড়িনি। এমনকি চোখের মণিটাও নড়েনি আমার। একদম সোজা সামনে তাকিয়ে আছি। নিজকে খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। তবে একা একা লাগছে না। লঞ্চঘাটের এই জিনিসটা ভালো, হাজার হাজার মানুষ। কাউকে একা হতে দেয় না। আচ্ছা একা একা লাগলে সেটাকে বলে একাকীত্ব, তাহলে ফাঁকা ফাঁকা লাগলে সেটা কি? ফাঁকাকীত্ব?

বেঞ্চির ওপাশে একজন ফকির শুয়ে আছে। তার শরীরে মিশরের পিরামিড থেকে চুরি করা পোশাক, শতচ্ছিন্ন। এই ফকিরগুলো একেকজন হিউম্যান সাইকোলজির ওপর পিএইচডি। এরা চেহারা হাঁটাচলা, কথা বলা আর পরিবেশ দেখে ক্যালকুলেট করে ফেলতে পারে সে ভিক্ষা পাবে কিনা। আমি ৩ ঘন্টা যাবৎ এখানে বসে আছি। আমার শরীরে ভদ্দরলোকের পোশাক। এই ধরণের পোশাক পরা মেয়েরা ভিক্ষা দিলে আশাতীত ভিক্ষা দেয়, না দিলে দেয় না। ফকিরটি তার হিউম্যান সাইকোলজি রিলেটেড নিজের আবিষ্কৃত সমীকরণে আমাকে, আমার হাবভাব আর পরিস্থিতি বসিয়ে রেজাল্ট পেয়েছে সে ভিক্ষা পাবে না। তাই সে আমার প্রতি কোনও আগ্রহ দেখাচ্ছে না। সে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া প্রতিটা মানুষের দিকে হাত বাড়াচ্ছে আর অদ্ভুত ঘোঁৎ ঘোঁৎ শব্দ করছে।

আমার কেমন যেন শরীর খারাপ লাগছে। ও কোনরকম ওয়ার্নিং না দিয়েই অদৃশ্য হয়ে গেছে। এটা যতই আমি নিজেকে বিশ্বাস করাতে যাচ্ছি, ততই শরীর খারাপটা বাড়ছে। পুরোপুরি বিশ্বাস যখন করব তখন হয়ত আমি মরেই যাব।

জ্বর এসেছে, শীত শীত লাগছে। শরীর জুড়ে কেমন যেন এক ধরণের বার্ধক্যজনিত ক্লান্তি। মনে হচ্ছে, আমি বুড়ি হয়ে গিয়েছি। হুট করে খুব কান্না পাচ্ছে। কোনও ধরণের জড়তা বাদেই চিৎকার করে কাঁদা শুরু করলাম আমি। গলা বসে গেছে। ফ্যাসফ্যাসে একটা শব্দ বের হতে লাগল গলা থেকে। কান্নাটা আহাজারি না হয়ে হয়ে গেল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না। কেউ ফিরেও তাকাল না। আমি একমনে কেঁদে যেতে লাগলাম। ১০ মিনিট কাঁদলাম।

হয়ত আরও কাঁদতাম, কিন্তু হঠাৎ করে গায়ে একটা খোঁচা লাগল। দেখি লাল চোখ নিয়ে ফকিরটা জিজ্ঞাসু একটা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। উনার চোখের দিকে তাকাতেই উনি ঘোঁৎ করে একটা শব্দ করলেন। সম্ভবত উনি এই শব্দটা দিয়েই মনের ভাব বিনিময় করেন, এই মাত্র বলা ঘোঁৎ এর অর্থ, “

তুমি কাঁদছ কেন,মা!”

আমি কিছু বললাম না, তবে কান্না থামালাম। চোখের পানি মুছলাম। তারপর অন্য দিকে তাকালাম। উনি আবার খোঁচা দিলেন, আর তারপর আবার সেই ঘোঁৎ। এবারের ঘোঁৎ এর অর্থ, “

কথা বলছ না কেন!”

আমি আমার ব্যাগ থেকে ৫০০ টাকার একটা নোট বের করে উনার হাতে দিলাম। তারপর বললাম

-বেঁচে থেকে কোনও লাভ নাই, বুঝলেন। ৫০০ টাকা দিলাম। মরে যান।

আশ্চর্য! আমার গলাটা এতই বসে গেছে যে কথাটা প্রায় শোনাই গেল না। ফ্যাসফ্যাসে টায়ারের ঘর্ষণের মত লাগলে শব্দটা। আমি উঠে দাঁড়ালাম। আর বসে থেকে লাভ নেই। উঠে দাঁড়িয়েও অবশ্য লাভ নেই, তবুও মনে হল যাই কিছু একটা করি। মাথা ঘুরছে, হালকা হ্যালুসিনেশন হচ্ছে। মনে হয় পাগল হয়ে যাচ্ছি বা অলরেডি গেছি।

ফকির লোকটা টাকা হাতে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে বুঝতে পারছে না এটা কত টাকার নোট। সে আজীবন ১-২ টাকা পেয়ে অভ্যস্ত। নোটটা তার কাছে অনাবিষ্কৃত কোনও মহাদেশের মতই অপরিচিত লাগছে। আমি উনার সামনে দাঁড়ালাম।

-এটা ৫০০ টাকার নোট, অনেক টাকা। বুঝলেন। কিন্তু আমার কাছে আর এগুলোর দাম নেই। যার সাথে সুখ করব বলে এসেছিলাম সে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। হ্যাঁ হ্যাঁ, আমার স্বামী। বলতে পারবেন ও কোথায়? পারলে আপনাকে আমার এই ব্যাগটা দিয়ে দেব। এই ব্যাগে ১৮ ভরি সোনা আছে, নগদ ২০০০০ টাকা আছে। ওপস, ২০০০০ নেই, ১৯৫০০ টাকা আছে। আপনাকে ৫০০ দিয়ে দিয়েছি। অঙ্ক বুঝেন? ২০০০০ থেকে ৫০০ বাদ দিলে হয় ১৯৫০০। হা হা হা।

আমি উন্মাদের মত হাসছি, শরীর কাঁপছে। ওজনহীন লাগছে কেন যেন নিজেকে। ফকির মানুষটা সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

-কি হল, বলেন? ও কোথায় আছে? আপনাকে সব দিয়ে দেব। প্রমিস।

এবার আর ফকিরটা ঘোঁৎ করল না। করল ঘোঁৎ ঘোঁৎ।

আমি হা হা করে হাসতে হাসতে চলে আসলাম। পৃথিবীতে আসলে অনেক আনন্দ, তবে সব আনন্দই দুঃখে চোবানো নষ্ট আনন্দ।

রিকশা নিলাম। লক্ষ্য থানা, একটা ডায়রি করব। একটি নিখোঁজ সংবাদ। জ্বর বাড়ছে, হ্যালুসিনেশন হচ্ছে। আবার সেই স্বপ্নটা চোখের পাতায় স্লাইড শোর মত ভাসা শুরু হল। সেই জোনাকি, সেই আলো, সেই আমি,সেই ছুটে চলা,সেই ব্যর্থতা, অস্বস্তি, দুঃখ…সব কিছুর জঘন্য আর গোলমেলে এক জগাখিচুরি। আমার নিজের ওপর আর কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই, মাঝে মাঝে হেসে উঠছি। মাঝে মাঝে গুনগুন করছি, “দাঁড়াও দাঁড়াও, যাইয়ো না।”হঠাৎ হঠাৎ কাঁদছি।

রিকশাওয়ালা মাথা ঘুরিয়ে মাঝে মাঝে আমাকে দেখছে। সে ভাড়া নিয়ে চিন্তিত। তবে আমার পোশাক আর চেহারায় সে কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছে। এমন চেহারা আর পোশাকের কেউ ভাড়া দেয় নি, এমন রেকর্ড নেই।

পুলিশ স্টেশনে পৌঁছে গেলাম। আমার চোখ লাল হয়ে এসেছে। কেউ দেখলে বলবে মাতাল হয়ে আছি, আসলেও তাই। মাতাল হয়ে আছি। মাতাল কি শুধু মদেই হয়? দুঃখে হয় না? পৃথিবী ভর্তি হাজার হাজার মানুষ দুঃখের ওভারডোজে মাতলামি করে বেড়াচ্ছে। সেসবের খবর কি রাখেন?

থানায় পৌঁছে গেলাম।

-৭ টাকা ভাড়া হইছে আপা।

-আপনি বিয়ে করেছেন?

-হু।

-বৌ কোথায়?

-বাড়িত আছে আফা।

-কখনও ওকে ছেড়ে যাবেন না, বুঝলেন?

রিকশাওয়ালাকেও ৫০০ টাকা দিলাম। আমার কাছে এখন সব ৫০০ টাকার নোট। তখনও ১০০০ টাকার নোট বাজারে আসেনি। ১০০০ টাকার নোট থাকলে ১০০০ টাকা দিতাম।

-এতবড় নোট তো ভাঙতি নাই, আফা।

-উহু, পুরা টাকা আপনার। ৭ টাকা ভাড়া, ৪৯৩ টাকা আপনার, ওয়াইফকে কখনও ছেড়ে না যাওয়ার জন্য দিলাম বুঝেছেন। প্লিজ তাকে কখনও ছেড়ে যাবেন না।

রিকশাওয়ালাটার চোখে বিষ্ময়, আনন্দ, আর বেদনার মিশেল।

-আপনাকে একটা প্রশ্ন করব, উত্তর দিতে পারলে আমার কাছে যা আছে সব দিয়ে দেব। বলেন তো আমরা নিঃশ্বাসের সাথে নাক দিয়ে কি নিই?

-বাতাস নাকি আফা?

-উহু,হয়নি।

আমি হাহা করে হাসতে লাগলাম। তারপর কোনমতে হাসি থামিয়ে বললাম

-দুঃখ নিই, বুঝেছেন? নিঃশ্বাসের সাথে আমরা নাক দিয়ে কনসেনট্রেটেড দুঃখ নিই। সরি, টাকাটা আপনি পেলেন না। বাই বাই।

আমি চলে আসলাম। রিকশাওয়ালাটা মনে মনে বলল, “আহারে, আফাডা কত ভালো। কিন্তু প্রথমবার নেশাপানি করছে। বড় লোকদের ব্যাপার-স্যাপার বোঝা মুশকিল।”একবার ঠোঁট দিয়ে চুকচুক করে সে খুশিমনে বাড়ি চলে গেল। ৫০০ তার ১ সপ্তাহের রোজগার। আজ সে আর রিকশা চালাবে না।

মিঃওয়াহেদ একজন পুলিশ। তিনিই আজ ডাইরি নেয়ার দায়িত্বে আছেন। তার পরনের ইউনিফর্ম থেকে ডিটারজেন্টের গন্ধ আসছে। তার চেহারা সুন্দর এবং পুরুষালী। প্রথম দেখায় যে কেউ তাকে হ্যান্ডসাম বলে মত দেবে। কিন্তু তার কণ্ঠটা প্রচণ্ড মেয়েলি। এটা নিয়ে তিনি খুব লজ্জায় থাকেন। ঠাণ্ডা লাগলে তার কণ্ঠ কিছুটা মোটা হয় এবং ছেলেদের মত শোনায়। তাই তিনি চেষ্টায় থাকেন সারাবছর যেন তার ঠাণ্ডা লেগে থাকে।

মানুষ হিসেবে তিনি বেশ নীতিবান। আই রিপিট “বেশ নীতিবান” নট “পুরোপুরি” নীতিবান। তিনি পরিমিত পরিমাণে ঘুষ খান। মাসে ১-২ বারের বেশি ঘুষ তিনি মরে গেলেও খান না। এই ২-১ বারও খেতেন না। জাস্ট স্ট্যাটাস মেইনটেইন আর বৌয়ের চাহিদা মেটানোর জন্য তিনি কাজটা করেন।

বর্তমানে একজন সুন্দরী মেয়ে তার সামনে বসে আছে। সম্ভবত ড্রাঙ্ক। কথা শুরু করার আগেই সে এসে প্রথমে টেবিলে ৫০০ টাকার দু’টি নোট রেখেছে। ওয়াহেদ সাহেব এ মাসে ঘুষ খাননি, এই ঘুষটা তিনি খাবেন বলে মনস্থির করলেন।

-ওই দু’টো নোট আপনার, বুঝলেন?

-আজব! কেন। কি হয়েছে? কি সমস্যা আপনার?

-অনেক সমস্যা।

মেয়েটা বাচ্চাদের মত কাঁদা শুরু করল। কাঁদতে কাঁদতে বলল

-আমার একটা জিনিস হারিয়ে গেছে, খুঁজে দেন না,প্লিজ…

-ওহ, ডায়রি করতে এসেছেন? কি হারিয়েছেন বলুন, কোথায়? গহনাগাটি?

-উহু, ওগুলা তো আমার ব্যাগে।

-তাহলে।

-একটা জোনাকি হারিয়ে গেছে। জোনাকিটার নরম সবুজ আলো ছিল। দুটো ডানাও ছিল। উড়ে উড়ে পালিয়ে গেছে, ধরতে পারিনি। প্লিজ খুঁজে দিন। আমার ব্যাগে ১৮ ভরি সোনার গহনা আছে, নগদ ১৯০০০ টাকা আছে। আপনাকে সব দিয়ে দেব। প্লিজ দিন না খুঁজে।

মেয়েটার ফুলে থাকা লাল চোখ থেকে ঝর্ণার মত অঝোর ধারায় পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল।

ওয়াহেদ সাহেব প্রচণ্ড বিষ্ময়ে থ হয়ে মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তিনি চোখ দেখে সত্যি মিথ্যা ধরতে পারেন। তিনি অবাক হয়ে দেখলেন, মেয়েটার চোখ এক ফোঁটাও মিথ্যা বলছে না। এতটা সত্যি বলা কোনও মানব চোখের পক্ষে সম্ভব না।

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post যেই দিকে রোদ্দুর| প্রেমে পড়া বারণ | স্বর্ণালী শীল| Bengali Love Story
Next post অপ্রকাশিত| প্রেমে পড়া বারণ | চিরঞ্জিৎ সাহা| Bengali Love Story