ডাইনি | ভয়ের দেশ |আরিত্র মজুমদার| Bengali Horror Story
0 (0)

অনেক রাত্রে আমার খাটের পাশের ফোন হঠাৎ বেজে উঠল। হাতের বইটা নামিয়ে রেখে ফোনটা ধরলাম। ওপাশ থেকে পরিচিত একটি গলা ভেসে এল।

“হ্যালো প্রবীরদা?”

“হ্যাঁ, কে তন্ময় নাকি?”

“ঠিক ধরেছ, তোমার সাথে একটু কথা আছে। তোমার অফিসে সময় হবে?”

“অফিসে? মানে তুই রোগী হয়ে আসতে চাস? নাকি অফিসে দেখা করা সুবিধা?”

একটু চুপ করে তন্ময় বলল, ” তা, রোগী হয়েই আসি। তোমার তো খুব বেশী পসার নেই।

“খোঁচাটা উপেক্ষা করে বললাম, ” এত রাতে ফোন করেছিস যখন, কিছু একটা হয়েছে বুঝি?”

আবার কিছুক্ষণ চুপ করল তন্ময়। তারপর বলল, “কাল এসেই বলব তোমাকে। আচ্ছা, গুডনাইট।” ফোন রেখে দেওয়ার আওয়াজ পেলাম। কিছুক্ষণ ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকলাম আমি। তন্ময় আমার কলেজের জুনিয়র। যতদূর জানি, ভাল ছেলে। কলেজে তার বিশেষ প্রতিপত্তি না থাকলেও, ফুটবল ভাল খেলার কারণে অনেকেই ওকে চিনত। পাস করার পর খুব একটা খবর ছিল না, কিন্তু অকস্মাৎ একদিন ওর সাথে রাস্তায়ে দেখা হয়ে গেছিল। তখনই মোবাইল নম্বর নিয়ে রাখে তন্ময়। জানিয়েছিল কলকাতারই একটি কোম্পানিতে চাকরি করছে সে। আমি যে মনোবিজ্ঞানী হয়ে প্র্যাকটিস শুরু করেছি, এটা জেনে অবাক হয়েছিল একটু। হবারই কথা। মনোবিজ্ঞান যে এক ধরনের বিজ্ঞান, সেটা অনেকেই মানতে অস্বীকার করে। এসব নাকি গুল, ভাঁওতা, এসবে পসার নেই, অনেকেই আমাকে বলার চেষ্টা করেছে বটে। কিন্তু সকলের কথায়ে কান দিলে নিজের কাজ আটকে যায়, তাই বিশেষ পাত্তা দিই নি। তন্ময়ও নিন্দুকের দলে ছিল। তার হঠাৎ এই মতবদল আমাকে একটু অবাক করল।

যাইহোক, কাল সকাল সকাল উঠতে হবে ভেবে বই রেখে শুয়ে পরলাম।

পরদিন সকালে সময় মত অফিসে তন্ময় এসে হাজির। ওকে দেখে আমি অনেকটা চমকালাম। ছেলেটার চোখের তলায়ে কালি, চেহারা বিধ্বস্ত, যেন কিসের অদৃশ্য ভারে কুঁজো হয়ে গেছে। দেখে মনে হল কিছুদিন হয়ত ঠিক করে ঘুময়ে নি তন্ময়।

“আয় বস। কি মনে করে?” আমি বললাম।

তন্ময় ইতস্তত করে বলল, “একটু সমস্যায়ে পরে এসেছি তোমার কাছে প্রবীরদা। তোমার তো এসব নিয়েই কারবার।”

ইতিমধ্যে লোকনাথ আমাদের চা দিয়ে গেছে। চা টা হাতে তুলে নিয়ে বললাম, “হু, তা কি সমস্যা হচ্ছে?”

“বেশ কিছুদিন ধরে আমি ঘুমতে পারছি না।”

“কিরকম? শরীরের অস্বস্তি?”

“না ঠিক তা নয়। আমি… ঘুমতে চাইছি না।”

কথাটা শুনে ভাল করে দেখলাম ওকে। তারপর হেসে বললাম, “এটা কি নতুন কোন হুজুগ নাকি?”

“না প্রবীরদা, আমি ঠিক বোঝাতে পারছি না। আমি ঘুমতে চাই না কারণ, আমি ঘুমলেই দুঃস্বপ্ন দেখি।”

এবার আমি একটু সোজা হয়ে বসলাম। “প্রত্যেক বার?”

“না প্রত্যেক বার নয়। আসলে, বেপারটা অত ঘন নয়। কিন্তু…”

“কিন্তু কি?”

“স্বপ্ন গুলো একই রকমের।”

“একই স্বপ্ন বার বার দেখছিস?”

“না, মানে, একদম এক নয়। কিন্তু…”

তন্ময়কে বিভ্রান্ত দেখাল। আমি ওর হাতে চা তুলে দিয়ে বললাম, “গুছিয়ে নে। সময় আছে অনেক। নে, চা খা।”

তন্ময় চায়ে চুমুক দিল। একটা কিছু ভেবে নিল সে। তারপর বলল, “এই ধরো দু বছর আগে, আমি একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম, যেখানে আমি একটা ফ্ল্যাটের দরজার সামনে দাড়িয়ে আছি। দরজাটার সামনে কি করে এলাম এগুলো জানি না, কিন্তু এইটুকু স্বপ্নে স্থির ছিল যে দরজাটা আমাকে খুলতে হবে। সেই ভেবে দরজাটা খুলতে যাব এমন সময়, দেখি দরজার ওপরে একটা কিসের চিহ্ন।”

“কিসের চিহ্ন?”

“সেটা আমার কিছুতেই মনে পড়েনি। কিন্তু আমার মনে আছে যে স্বপ্নে আমি চিহ্নটা দেখে ভেবেছিলাম যে এরম আজগুবি চিহ্ন কোন মানুষ ভাবতেই পারে না। আমার এটাও মনে হয়েছিল যে চিহ্নটা আমার অনেক দিনের চেনা। অনেক পুরনো এই চিহ্ন। আমার গা শিরশির করে উঠেছিল। আমার যেন মনে হয়েছিল যে দরজাটা খুললে বিপদ হবে। তাই আমি দরজা খুলি নি।”

“আচ্ছা। এটা ঠিক দুঃস্বপ্ন তো বলা চলে না। অবশ্যই স্বপ্নের কোন মানে থাকবে, ” আমি বললাম।

বাকি চা এক চুমুকে শেষ করে দিল তন্ময়। তারপর বলতে শুরু করলো, “এরপর কয়েক মাস কেটে যায়। আমার এই স্বপ্নটা মাথায়ে ছিল না। হঠাত একদিন রাতে আমি স্বপ্ন দেখলাম, যে আমি একটা ফ্ল্যাট বাড়ির সামনে দাড়িয়ে আছি। সামনে আমার একটা লোহার গেট। আমি গেটের বাইরে দাড়িয়ে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছি। আর কোথাও কিচ্ছু নেই। শুধু ওই বাড়িটা আর আমি। আমি স্বপ্নের ভেতরেই জানি যে বাড়িটা তে কেউ থাকে না। বহুদিন আগে ওই বাড়ি ত্যাগ করে লোকেরা চলে গেছে। ইলেক্ট্রিসিটিও নেই, কর্পোরেশন থেকে কেটে দিয়েছে। তাও আমি দেখলাম যে চারতলা ফ্ল্যাটের একদম চার নম্বর তলায়ে একটা জানলায় দপ করে আলো জ্বলে উঠল। আমি ভাবলাম এটা কি করে সম্ভব? ইলেক্ট্রিসিটি তো নেই! আমার খুব ইচ্ছে হল বাড়িটা তে গিয়ে ঢুকতে। গেট ঠেলে ঢুকতে যাব, এমন সময় ঘুম ভেঙে গেল। দেখি সকাল হয়ে গেছে।”

তন্ময় থামল। আমিও চুপ করে রইলাম। বেপারটা অনেকটাই ইন্টারেস্টিং। মনে মনে আমি স্বপ্নের মানে ভাবা শুরু করে দিয়েছিলাম। স্বপ্নের ভেতর অনেক কিছুই বলা থাকে। তবে সেগুলি বলা থাকে ইঙ্গিতে, সোজাসুজি নয়। যেমন স্বপ্নে অনেকেই দেখে সিঁড়ি দিয়ে উঠেই চলেছে, শেষ নেই। এটার মানে অনেকেই ভাববে যে কর্মস্থলে বা জীবনে উন্নতি না হবার আশঙ্কাই স্বপ্নরূপে প্রকাশ পাচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটা সত্যি হলেও, সকল ক্ষেত্রে হয় না। মানুষের মন যে কোন দুর্গম পথ ধরে চলেছে, সেটা সব সময় বোঝা যায় না। তবে অনুমান করা যায়।

“তারপর কিছুদিন আগে একটা ঘটনা ঘটে যেটাতে আমি খুব ভয় পাই” তন্ময় বলল।

“কি?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“আমি একদিন রাত্রি বেলা ঘুমোতে যাব, এমন সময় আমার বাড়ির কলিং বেল বেজে উঠল। আমি ভাবলাম এত রাতে কে? আমি দরজা খুলে কাউকে পেলাম না। ভাবলাম হয়ত পাড়ার ছেলেরা নেশা ভাঙ করে পেছনে লাগছে। দরজাটা বন্ধ করে দিতে যাচ্ছি এমন সময় আমার বাথরুম থেকে জল পরার আওয়াজ এল। আশ্চর্য হলাম। আমি ছাড়া বারিতে কেউ থাকেই না এটা তো তুমি জানোই। কিন্তু বাথরুমের কল কে খুলল? দরজা বন্ধ করে বাথরুমে গেলাম। দেখলাম কল বন্ধ। জল পরার কোন আওয়াজ নেই। ভাবলাম, হয়ত শোনার ভুল। বিশেষ না ভেবে ঘুমোতে চলে গেলাম। কিন্তু ঘরে ঢুকতেই মনে হল, কে যেন ছিল একটু আগে। আমি আসতেই অন্য দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। আমি ঘাবড়ে গেলাম। আমি যখন দরজা খুলেছিলাম, তখন হয়ত কেউ ঢুকে পরেছে? আমার একটা ভারি টর্চ আছে। সেটা হাতে করে সারা বাড়ি একবার ঘুরে দেখলাম। কেউ নেই। ভাবলাম, সত্যই মনের ভুল হয়েছে। সেদিনের মত শুয়ে পরলামডাঁড়ীয়েদুঃস্বপ্নও হল না। কিন্তু তার পরের রাতে আমার আবার দুঃস্বপ্ন আসে। এবারেও আমি দেখলাম যে আমি সেই ফ্ল্যাটবাড়ির গেটের সামনে দারিয়ে আছি। এবারেও দপ করে ঘরটা তে আলো জ্বলে উঠল। কিন্তু এবারে একটা নতুন জিনিস দেখলাম। দেখলাম জানালায় পরদা দেওয়া, আর পরদার পেছনে কে এক মহিলা দারিয়ে আছে। মনে হল যেন মহিলাটি আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। আচমকা খুব ভয় করতে লাগল। মনে হল দৌড়ে পালাই। কিন্তু আমার ঘুম ভেঙে গেল। আমি হাঁফ ছেরে বাঁচলাম।”

তন্ময় এতটা বলে চুপ করল। আমি দেখলাম তার মুখ শুকিয়ে গেছে। প্লাস্টিকের বোতলে জল ছিল, সেটা ওর দিকে এগিয়ে দিলাম। ও গলা ভিজিয়ে নিয়ে বলে চলল, “সেই থেকে আমার রাতের ঘুম উরে গেছে। মাঝে মধ্যেই আমার এই এক স্বপ্ন হয়। কখনও কখনও এমনও হয়েছে যে পরদার পেছনে দাঁড়ানো মহিলাটা আমাকে হাত নেড়ে ডেকেছে। কিন্তু আমি যাই নি। একটা প্রবল ইচ্ছে হয় যাওয়ার, কিন্তু তার সাথে প্রচণ্ড ভয়ও হতে থাকে। মনে হয় গেলেই বিপদ হবে। রাতে ঘুমোতে ভয় লাগে আজকাল। মনে হয়, যদি আবার দেখি, যদি এবারে মহিলার আহ্বান অগ্রাহ্য না করতে পারি।”

ততক্ষণে আমি কিছু কিছু বুঝেছি মনে হল, কিন্তু একটা খটকা থেকেই গেল। আমি বললাম, “আচ্ছা বুঝলাম। কিন্তু তন্ময়, তুই আমাকে স্বপ্নের কথাটা বললি, কিন্তু আমাকে দরজার বেল বাজানো, জল পরার শব্দ পাওয়া, এগুলো বললি কেন? তোর কি মনে হয় এটার মধ্যে যোগাযোগ আছে?”

“সেটা বুঝলে তো হয়েই যেত প্রবীরদা। যোগাযোগ যে একেবারে নেই তা তো জোর দিয়ে বলতে পারছি না।”

“কেন?”

“বললে বিশ্বাস করবে?”

“তুই বলে দেখ না। আমার কাজই তো শোনা।”

তন্ময় ইতস্তত করল তারপর বলল, “আমার আজকাল মনে হয় রাত হলেই আমার ঘরে আমি ছাড়া আরেকজন কেউ আছে।”

“কিভাবে মনে হয়?”

“কিভাবে বোঝাই বলো তো। কখনও আমার ঘরে অন্ধকারে ঢুকলেই যেন মনে হয় আমার খাটে কে একজন বসে আছে। আলো জাললেই দেখি কিছু না। মাঝে মাঝে নিজের থেকেই আমার বাথরুমের কল খুলে যায়। কখনও কখনও শুয়ে থাকলে মনে হয় কেউ যেন আমাকে দেখছে। অস্বস্তি হয়। মাঝে মধ্যে কাজ থেকে চোখ তুলে তাকালে মনে হয় দরজার বাইরে দিয়ে কে যেন হেঁটে চলে গেল। মাঝে মাঝে কেমন যেন পোড়া পোড়া গন্ধ পাই। প্রথম প্রথম ভেবেছিলাম মনের ভুল, কিন্তু এত বার দেখেছি যে আমার এখন বিশ্বাস হয়েছে যে কিছু একটা যেন আছে বাড়িটা তে।”

“বুঝলাম। দেখ এসব কিছুরই যুক্তি আছে, কিন্তু আমাকে তোকে আরও কয়েকদিন দেখতে হবে। আচ্ছা, একটা কথা বল তো। তোর কি এই বছর খানেকের মধ্যে কোন বড় বদল হয়েছে জীবনে? কিংবা হয়ত বদল হবে? তোকে কোন জরুরি সিদ্ধান্ত নিতে হবে? এমন কিছু আছে?”

“বদল বলতে তো আমার বাড়ি পাল্টানো ছাড়া সেরকম কিছু হয়নি। আর সিদ্ধান্ত নিতে হবে এরম কিছু তো মাথাতে আসছে না…”

“আচ্ছা। তুই এক কাজ কর। একটা সপ্তাহ তুই একটা ডায়েরি লেখ। যেই ঘুম ত্থেকে উঠবি, যদি কোন স্বপ্ন দেখিস, সব নোট করে রাখবি। পারবি?”

তন্ময় মাথা নেড়ে জানায়ে, পারবে।

“বেশ। আরেকটা কথা বল তো, তুই বাড়িটা তে কবে উঠেছিস?”

“এই ধরো মোটামুটি দুবছর হল।”

“আচ্ছা বুঝলাম। ঠিক আছে, তোকে যেমন বললাম সেরকম কর। আর কিছু দরকার হলে ফোন করবি। মনে রাখবি তুই একলা নয়।”

তন্ময় চলে যাওয়ার পরে অনেকক্ষণ বসে বসে ভাবলাম। যতদূর জানি, স্বপ্ন মানুষের অবচেতনের প্রকাশ। অবচেতনে তন্ময় নিশ্চয়ই কোন গুরুতর বেপার নিয়ে চিন্তিত আছে। ফ্ল্যাটবাড়ি কিসের প্রতীক হতে পারে? ফাঁকা বাড়ি এমনিতে মানুষের জীবনের একাকীত্ব কে তুলে ধরে। কিন্তু ফাঁকা বাড়িতে আলো জ্বলা, আর সেই মহিলাকে ভয় পাওয়া, তার মানে কি তন্ময়ের জীবনে এমন কারুর আবির্ভাব ঘটেছে যাকে সে পছন্দ করে না? বা, ভয় পায়? এদিকে আবার একটা চিহ্ন যেটা ওর চেনা, এবং সেটা দরজার ওপরে আঁকা। অনেকটা “প্রবেশ নিষেধ” সাইনের মত। এটার যে কি মানে হতে পারে ভেবে পেলাম না। তবে দরজা খোলার উদ্দেশ্য নিয়ে এসে চিহ্ন দেখে দরজা না খোলা, এটার একটি সহজ মানে হতে পারে যে, তন্ময় তার জীবনে কোন বদল আনার চেষ্টায়ে আছে, কিন্তু তার অবচেতন ওকে সাবধান করে দিচ্ছে। হয়ত যেমনটা ও ভাবছে হবে, তেমনটা হবে না, এটাই তার অবচেতন ওকে বোঝাচ্ছে ভয়ের মাধ্যমে। অথচ তার বাড়িতে জলের শব্দ পাওয়া, কাউকে যেন দেখা, এগুলো দৃষ্টিভ্রমের এলাকায়ে পরে। দীর্ঘদিন ধরে হতাশায়ে ভুগলে এমন হয়, এটা কে সাইকোসিস বলে। তন্ময়ের হতাশা বা সংলগ্ন কোন কারণ আছে কি না সেটা আমাকে খুঁটিয়ে দেখতে হবে।

ভাবতে ভাবতে মাথা গরম হয়ে গেল। তারপর এক সময় ভাবা ছেড়ে দিলাম। এখনই কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া আসলেই সম্ভব নয়। আমাকে ওকে আরও কয়েকবার দেখতে হবে। ওকে জানতে হবে।

দিন তিনেক পর হঠাত একদিন গভীর রাতে তন্ময় ফোন করলো আমাকে। ঘুম চোখে ফোন ধরে বললাম, “হ্যালো”

“প্রবীরদা তুমি এক্ষুণি আমার বাড়ি আসতে পারবে?” তন্ময়ের গলা শুনে মনে হল বেশ ভয় পেয়েছে।

“কি ব্যাপার? কি হয়েছে?”

“এই বাড়িতে আমি একলা থাকতে পারছি না। তুমি এলে বুঝতে পারবে।”

“আচ্ছা, তোর অ্যাড্রেস টা বল তো।”

অ্যাড্রেস লিখে নিয়ে আমি গাড়ি চালিয়ে চলে গেলাম তন্ময়ের বাড়ি। ও হয়ত জানলায়ে মুখ লাগিয়েই ছিল। আমি গাড়ি থামাতেই দেখলাম ও দুতলার জানালা থেকে মুখ সরিয়ে নিল। কিছুক্ষণ পরেই দরজা খুলে গেল। দেখলাম ভয়ে ওর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।

আমি বাড়ি ঢুকতেই ও বলা শুরু করে দিল, “আমি এক সাংঘাতিক স্বপ্ন দেখেছি।”

“কি দেখেছিস?” আমি বাইরের ঘরে বসলাম।

“এই তিনদিন কিছু দেখি নি। তাই ডাইরিও লিখি নি। কিন্তু আজ…”

“আমাকে সব বল।”

“বলছি, ” তন্ময় একটু দম নিল। আরেকজন বাড়িতে আসাতে ওকে অনেকটা ধাতস্থ দেখাচ্ছিল।

“আবার সেই আগের মত, আমি গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে, আর পরদার পেছনে মহিলাটি আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকল। আমি ভয় পেলাম, কিন্তু এবারে আমি ঢুকে গেলাম। ঘন অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে আমি উঠে চললাম। এক সময় আমি সেই ফ্ল্যাটের দরজার সামনে আসলাম, কিন্তু দেখলাম দরজার তলা দিয়ে কোন আলো আসছে না। আমি তখনও অত ভয় পাই নি। আমি ভাবলাম কোনও কারণে আলো নিভিয়ে দিয়েছে। আমি দরজাতে ঠকঠক করতে যাব, এমন সময় দেখি দরজার ওপরে সেই চিহ্নটা।”

আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, “চিহ্নটা কিরম দেখতে মনে আছে?”

“হ্যাঁ, দাঁড়াও এঁকে দেখাচ্ছি।”

তন্ময়ের হাতের কাছেই একটা পাতা আর পেন ছিল। সেটা নিয়ে আঁকিবুঁকি করে আমাকে দেখাল। আমি দেখলাম একটি গোলের ভেতর কয়েকটা বাঁকা লাইন, তাদের শেষে গোলাকার। চিহ্নটা আমি কোনদিন দেখি নি। মোবাইলটা বের করে ছবি তুলে নিলাম। তন্ময় বলে চলল, “আমি চিহ্নটা দেখে এবারে অত ঘাবড়ালাম না। দরজাতে কড়া নাড়লাম। ভেতর থেকে কোনও সাড়াশব্দ এল না। আমি তখন হাতল ঘোরাতেই দরজা খুলে গেল। দেখলাম, ভেতরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। এতটাই গাঢ় অন্ধকার, যে আমার মনে হল যেন আমি অন্ধ হয়ে গেছি। নিজের হাত পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমি ভেতরে না ঢুকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকলাম।”

এই পর্যন্ত বলে তন্ময় আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। আমি বললাম, “তারপর?”

আগের মতই স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে তন্ময় বলল, “আগে তুমি একটা কথা বল, তুমি ডাইনিতে বিশ্বাস কর?”

এই অদ্ভুত প্রশ্ন শুনে থতমত খেয়ে গেলাম। “মানে?”

“বল না। ডাইনি যে হয়, এটা তুমি বিশ্বাস কর?”

“এখন তো মধ্যযুগ নয়, তন্ময়। ডাইনিতে কেউই বিশ্বাস করে না।” আমার হালকা বিরক্তি লাগছিল। “তুই একথা কেন জিজ্ঞেস করছিস?”

“কারণ আছে, প্রবীরদা। তুমি যান, এই বাড়ি হওয়ার দুশ বছর আগে এখানে এক ডাইনির বাড়ি ছিল?”

আমি অবাক হয়ে গেলাম। বললাম, “তুই কিকরে জানলি?”

তন্ময় শুষ্ক হাসল। “আমি জানি। পশ্চিমের অপদেবতার আরাধনা করত এই ডাইনি। তারপর সে তার আরাধনার চূড়ান্ত মুহূর্তে নিজের গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করে।”

আমি অবাক হয়ে শুনছিলাম। বললাম, “তুই এত তথ্য জানলি কি করে?”

তন্ময় আবার একটু হাসল। বলে চলল, “যাই হোক, তারপর শোন। স্বপ্নে আমি যখন দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছি, তখন আমার মনে হল যে কেউ যেন অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে আমার দিকে আসছে। কিছুই আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি না, কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু আমার শরীরের লোম খাঁড়া হয়ে যাচ্ছে। খালি মনে হচ্ছে, ভয়ানক কিছু একটা আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। এই এসে পরল বলে। আমি ভয়তে থাকতে না পেরে চিৎকার করে উঠলাম। সেই চিৎকারে আমার ঘুম ভেঙে গেল।”

ওর কথা শুনে আমারও গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল। বুঝলাম, কোনও কারণে আমি বেশ ভয় পেয়েছি। সেটা ওকে বুঝতে না দিয়ে বললাম, “খুবই খারাপ স্বপ্ন তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তন্ময় এগুলো তোর অবচেতনের অমীমাংসিত ভাবনার রূপায়ন। এগুলো তো সত্যি না, শুধুই মনের চিন্তা। তুই ভয় পাস না। ভয়ের কোন কারণ নেই।”

এতক্ষণ তন্ময় নিচের দিকে তাকিয়ে ছিল। এবার ও আমার দিকে তাকাল। কিন্তু… তার চোখের চাহনি কেমন যেন বদলে গেছে মনে হচ্ছে না? আমার অস্বস্তি হতে লাগল। তন্ময় কেমন যেন কর্কশ গলায়ে আমাকে বলল, “শুধু চিন্তা না। এগুলোর মধ্যে সত্যি লুকিয়ে আছে। এস আমার সঙ্গে।” বলে উঠে দাঁড়ালো। আমিও দেখাদেখি উঠে দাঁড়ালাম। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল তন্ময়। “সেই জেগে থেকে আমি আর ওপরে যাওয়ার সাহস পাই নি। নিচের ঘরেই অপেক্ষা করছি।”

“কিন্তু…” বলেই আমি চুপ করে গেলাম। গাড়ি রাখার সময় আমি যেন স্পষ্ট দেখেছিলাম তন্ময়ের মুখ দুতলার জানলাতে? সেটা কি তাহলে মনের ভুল? তন্ময় কোনও কথা না বলে দুতলায়ে চলে গেল। আমি উঠে আসতেই বলল, “দেখো।”

তাকিয়ে দেখলাম, ওর দরজার ওপরে একটা চিহ্ন। তাড়াতাড়ি ফোন বের করে মিলিয়ে নিলাম। ঠিক সেই চিহ্ন! আমি তন্ময়ের দিকে তাকালাম। এটা কি তাহলে ও নিজেই এঁকেছে? ও কি আমার সাথে মশকরা করছে?

আমার মনের ভাব বুঝে নিয়ে তন্ময় বলল, “না আমি এটা আঁকি নি। আমি ঘুম ভেঙে ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় এটা লক্ষ করি। সেই থেকে আমি আর ওঘরে যাই নি। ওপরেও আসি নি।”

আমি চুপ করে রইলাম। আমার ওর কথা ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল সবটাই একটা বড় মিথ্যে। কেমন যেন অসংগতি ঠেকছিল। তন্ময় আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে বলল, “চলো ভেতরে এবার ঢোকা যাক।” আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম।

দরজা ঠেলে ও ঢুকতে আমি ওর পেছন পেছন ঢুকলাম। ঘরে ঢুকতেই যেন মনে হল অন্ধকারে কে যেন ওর খাটের ওপরে বসে আছে। সেই সঙ্গে একটা অদ্ভুত পোড়া গন্ধ নাকে ভেসে এল। তন্ময় ঘরের আলোটা জালাতেই সেই ঘোর টা কেটে গেল। কিন্তু একি? তন্ময়ের ঘরের এরকম হাল? দেওয়ালে বিভিন্ন রকমের বিচিত্র আঁকিবুঁকি, আর ঘরের ঠিক মাঝে একটা বড় বৃত্তাকার, তার মধ্যে অদ্ভুত সব চিহ্ন। একটা অজানা আতঙ্কে আমার মন শিউরে উঠল। আমি তন্ময়ের দিকে তাকাতেই দেখলাম ও আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। ওকে একটু অন্যরকম দেখতে লাগছে না? ওর চোখের দৃষ্টি আমার ভাল লাগল না। হঠাত মনে হল, এত রাতে একলা কাউকে না জানিয়ে এখানে হয়ত না আসলেই ভাল হত।

“তুমি জানো কেন আত্মহত্যা করেছিল সেই ডাইনি?” আচমকা বলে ওঠে তময়। তার গলা অনেকটা ভারি শোনায়ে। তন্ময়ের গলা আমি চিনি। এটা তার গলা হতেই পারে না। সাহসে ভর করে বললাম, “কেন?”

“মানুষের আত্মা চেয়েছিল সেই অপদেবতা। তার বদলে তার সকল রকমের শক্তি পাবে সেই ডাইনি। কিন্তু অপদেবতা তার আত্মা নিল না, কারণ তার মনুষ্যত্ব আগেই হারিয়ে গেছিল। কাজেই তার আরাধনা বৃথা হয়। এদিকে তার শরীর ধ্বংস হয়ে যায়ে। কি করবে বল তো এই ডাইনি?”

আমার হাত পা অসাড় হয়ে আসছে। আমার মাথায়ে যেই ভাবনাগুলো আসছে, সেটা আমার যুক্তি মানতে চাইছে না, কিন্তু…কিন্তু…

কখন জানিনা তন্ময়ের হাতে একটা মস্ত ছোরা উঠে এসেছে। তাকিয়ে দেখলাম আমি খেয়াল না করে একদম বৃত্তাকারের মধ্যিখানে এসে পরেছি। তন্ময় ছোরাটা হাতে নিয়ে হাসল। সে কি ভয়ানক হাসি। তার চোখের সাদা অংশটি দেখা যাচ্ছেনা। তার দাঁতগুলো চকচক করছে আলোয়ে। এত দীর্ঘ হাসি আমি কোনও মানুষের মুখে দেখিনি। সত্যিই যেন আকর্ণবিস্তৃত হাসি তার। তন্ময় লম্বা ছোরাটা হাতে নিয়ে এগিয়ে আসলো। “এবার তাহলে আমার আরাধনা পূর্ণ হবে।” বলে কিসব বিজবিজ করে মন্ত্র বলতে লাগল। শব্দগুলো শুনে আমার মন অবশ হয়ে যেতে লাগল। মনে হল, কে যেন আমার হাত পা আটকে রেখেছে। প্রচণ্ড ভয়ে আমি চিৎকার করে উঠলাম। সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে হল যেন আমার গা হালকা হয়ে গেল। গায়ে যত জোর আছে, জড় করে তন্ময়ের মুখে একটা ঘুসি মারলাম। সে পরে গেল, আর আমি দাঁড়ালাম না। এক লাফে দরজা দিয়ে বেরিয়ে দ্বিতীয় লাফে সিঁড়ি থেকে নিচের ঘরে এসে পরলাম। তারপর বাইরের দরজা খুলে গাড়িতে। ইঞ্জিন চালু করতে করতে দেখলাম তন্ময় আমাকে দুতলার জানলা থেকে দেখছে। তার ঠোঁট থেকে রক্ত পরছে, কিন্তু এখনো তার মুখে সেই রক্ত জল করা হাসি। ফুল স্পীডে গাড়ি ঘুরিয়ে চলে এলাম বাড়িতে। বাড়িতে ঢুকেই দরজা লক করে পুলিস কে ফোন করলাম।

মিনিট দশেকের মধ্যেই পুলিস এল। সব কথা খুলে বললাম। ডাইনির ব্যাপারটা চেপে গেলাম। বললাম যে তন্ময় পাগল হয়ে গেছে, আমাকে খুন করার চেষ্টা করেছে। পুলিসের গাড়ি করেই আবার গেলাম সেই বাড়িতে। দুতলার ঘরে পুলিস পেল ছুরির আঘাতে আত্মঘাতী হওয়া তন্ময়ের মৃতদেহ। রক্তে তখন সেই বৃত্তাকারের অস্তিত্ব প্রায় মুছে গেছে। তার ঘর খুঁজে সেরকম কিছুই পাওয়া গেল না। আমি তাকে যেই ডাইরি লিখতে বলেছিলাম, সেটা খাটের পাশের টেবিল থেকে পাওয়া গেল। সেখানে তার শেষ স্বপ্ন লেখা ছিল, যেটা ও আমাকে বলেছিল আজ। সেই লেখার তারিখ কালকের। তবে কি কাল থেকেই তন্ময়… না না। এসব ভেবে আর লাভ নেই।

ওর চিহ্নের ছবিটা পলিসকে দেখিয়েছিলাম। পুলিস ওটাকে পাগলের প্রলাপ বলে উড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমি তা করতে পারিনি। ইন্টারনেটে অনেক খোঁজাখুঁজি করে আমি সেই চিহ্নটার মানে পেয়েছি। ওটি একটি পশ্চিমী অপদেবতার চিহ্ন। তার নাম “বাএল।” নাম দিয়ে সার্চ করতেই রাশি রাশি ডাইনীবিদ্যা, জাদুবিদ্যা, ইত্যাদির লিংক দেখাল। আমি আর খুললাম না সেসব।

সবকিছু একসাথে ভেবে আমি যা বুঝলাম তা হল এই, তন্ময় নিশ্চয়ই ডাইনির বেপারে কারুর মুখ থেকে কথা শুনেছিল। তারপর সেসব নিয়ে অনেক পড়াশোনা করে। তার মনে নিশ্চয়ই ডাইনীদের বেপারে সহানুভূতি জেগেছিল। আগেকার দিনে ডাইনি বলে যাকে তাকে পুড়িয়ে মারত। সহানুভূতি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তারপর ক্রমে ক্রমে সে এতটাই এই ব্যাপারে মগ্ন হয়ে গেল, যে সে ভাবতে লাগল তার বাড়িতে ডাইনি আছে। স্বপ্নগুলি হয়ত তারই ইঙ্গিত ছিল। তারপর একসময় একটি অত্যন্ত ভয়ের স্বপ্ন দেখার ফলে তার মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে যায়ে। সে নিজেকে ডাইনি মনে করতে থাকে। এটা এক ধরনের আইডেন্টিটি সমস্যা, তার নাম ডিসোসিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিসঅর্ডার। এসব ক্ষেত্রে মানুষ তার নিজের পরিচয় ভুলে গিয়ে অন্য পরিচয় আঁকড়ে আচরণ করতে থাকে। এই যুক্তিটা আমার মনে হল সব ঘটনাকে ব্যাখ্যা করছে। তবে কষ্ট হল এই ভেবে যে, ছেলেটা কে বাঁচাতে পারলাম না। সে আত্মহত্যা করে ফেলল।

সেদিন আর আমি বাড়ির বাইরে গেলাম না। সন্ধ্যের দিকে একটু হাঁটতে যাওয়ার ইচ্ছে হল। ঘর থেকে বেরিয়ে দরজা বন্ধ করতে যাব, এমন সময় দেখলাম আমার দরজার ওপর… ওকি! এ যে সেই চিহ্ন! বাএল এর চিহ্ন!

সবকিছু কেমন অন্ধকার হয়ে আসতে লাগল। জ্ঞান হারানোর পূর্বে মনে হল যেন তন্ময়ের পৈশাচিক হাসি শুনতে পাচ্ছি।

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post দুর্যোগের একটি রাত| ভয়ের দেশ |সুব্রত মজুমদার| Bengali Horror Story
Next post কুহকাহন | ভয়ের দেশ |সাখাওয়াত হোসেন| Bengali Horror Story