বৃষ্টি থেমে গেছে অনেকক্ষন। নিন্মচাপের মেঘে ঢাকা আকাশ বেয়ে সন্ধে নেমেছে একটু আগেই। আমি বিছনায় বসে ল্যাপটপে লিখে চলেছি, সেই বিকেল থেকে। ঘরটা অন্ধকার হয়েছিল। আলো জ্বালাইনি। লেখার সময় আমার অন্ধকার দরকার হয়। ঘরে আলো থাকলে আমার বাক্য গঠন, শব্দ চয়ন, সব ঘেঁটে যায়।
লেখা বলতে ওই টুকটাক গল্প লিখি ফেসবুকে। আগে বেশ কিছু জনপ্রিয় গ্রূপে লেখা দিতাম। সেখানেও কালে কালে দলবাজির আনাগোনা শুরু হ’ল দেখে সরে এসেছি। এখন নিজের ওয়ালেই লিখি। ওই আজকাল যেমন সবাই লেখে কমবেশী ; সেইরকম। প্রফেশনালি কিছু নয়। নিজের জন্যই লেখি মূলত। এছাড়া কয়েকজন নিয়মিত পাঠক আছেন। আমি যাই লিখি না কেন, তারা সাধু সাধু বলেন। সত্যি বলতে, আমার বেশ ভালোই লাগে ব্যাপারটা। উপভোগ করি।
একটানা লিখে মাথাটা ধরে গিয়েছিল। চশমাটা খুলে চোখটা বন্ধ করে বসে রইলাম মিনিট খানেক। লেখা ব্যাপারটা বড্ড স্ট্রেসফুল। অন্তত আমার তো তাই মনে হয়। কোনো একটা প্লট মাথায় এলে, যতক্ষণ না সেটা লিখে সম্পূর্ন করতে পারছি, কেমন যেন একটা অস্বস্তি ঘিরে থাকে আমায়। বাকি কোনো কাজেই মন বসে না।
আবার কখনও এমনটাও হয় যে, লিখতে মন চাইছে অথচ প্লট পাচ্ছিনা। তখন অবসাদ ভর করে।
প্রচন্ড ক্লান্তির কারনে শরীর জুড়ে ঘুম নামছিল। একটা সিগারেট দরকার। চোখ খুলে বিছনায় রাখা সিগারেটের প্যাকেটটা তুলে দেখলাম। ফাঁকা। কিনতে যেতে হবে।
কিন্তু ল্যাপটপের উজ্জ্বল স্ক্রিনটার দিকে চোখ পড়তেই সেই ইচ্ছেটা মরে গেল। লেখাটা এখনও মাঝপথেই থেমে আছে। ওটা শেষ করা দরকার।
ফোনটা হাতে নিয়ে, নীলার নম্বরে একটা কল করলাম। নীলা মানে নীলাশা ; আমার গার্লফ্রেন্ড, সেই কলেজের সেকেন্ড ইয়ার থেকে। আসলে আমার সেকেন্ড ইয়ার ছিল, আর নীলা ছিল ফাইনাল ইয়ারে। কলেজ সোশ্যালে আলাপ হয়। আমি নিজের লেখা একটা কবিতা আবৃত্তি করতে স্টেজে উঠেছিলাম। কবিতার প্রথম তিন-চার লাইন পাঠ করার পরেই লোকজন বিভিন্ন রকম আওয়াজ দিতে শুরু করে। তবুও আমি শেষ অবধি পাঠ করে, ধন্যবাদ জানিয়ে নেমে আসি। আমার বন্ধুরা অবধি খ্যাক খ্যাক করে হাসছিল। খারাপ যে একেবারেই লাগেনি সেটা বললে মিথ্যে বলা হবে। কিন্তু সব মন খারাপ এক লহমায় বাষ্পীভূত করে দিয়েছিল একটা মেয়ে। নীলাশা। ও নিজেই এসে আলাপ করেছিল।
বলেছিল, ” তোর কনফিডেন্সটা জিইয়ে রাখবি। গুড লাক। “
নীলাশার উচ্চারিত শব্দ গুলো হাওয়ায় ভেসে আমাদের চারপাশে একটা অদৃশ্য বৃত্ত তৈরী করে দিয়েছিল, যে বৃত্তের ভিতরে ছিলাম শুধু আমি আর নীলাশা। বাকি সব কিছুই কুয়াশায় ঢেকে গিয়েছিলো ওই মুহূর্তটায়। সময়ও হয়তো থেমে গিয়েছিল হঠাৎ। তারপর না জানি কিভাবে প্রেম, প্রেম থেকে সম্পর্ক, আর সম্পর্কের হাত ধরেই লিভ-ইন অবধি। হ্যাঁ, নীলা আর আমি বিগত প্রায় দু বছর হ’ল লিভ-ইন রিলেশনে রয়েছি।
নীলার ফোনটা বেজে গেল। ধরলো না। আমি একটা মেসেজ করে দিলাম, “আসার সময় এক প্যাকেট গোল্ড ফ্লেক এনো। আমার স্টক ফুরিয়ে গেছে।” হোয়াটস- অ্যাপে সিন দেখালো টেক্সটটা। নীলা রিপ্লাই করলো না। ক্লান্ত লাগছিল ভীষন। ল্যাপটপটা অন রেখেই আমি গা এলিয়ে দিলাম বিছনায়। একটা হাই উঠলো। আমি চোখ বুঁজে শুয়ে থাকলাম। কত পুরোনো কথা মনে ভিড় করে আসে এই সময়টায়। ফেলে আসা জীবন, বন্ধুত্ব, প্রেম, সম্পর্ক সব যেন মিলে মিশে গিয়ে একটা ফাস্ট ফরোয়ার্ড করা ভিডিওর মত চোখের সামনে চলতে থাকে।
কলেজ শেষেই নীলা চাকরি জয়েন করে নিয়েছিল। ও বরাবরই ভীষন প্র্যাকটিকাল। যেটা ওর চাই, সেটা চাইই। আমার তখন সবে ফাইনাল ইয়ারের রেসাল্ট বেরিয়েছে। নীলার অনেক সোর্স ছিল। ওর রেফারেন্সেই একটা ঠিকঠাক চাকরী জুটে গেল আমার, খুব তাড়াতাড়ি। আমাদের প্রেম বেশ ভালোই চলছিল। তবে চাকরি ব্যাপারটা আমার ঠিক পোষাচ্ছিল না। এমন নয় যে, চাকরিটা খারাপ ছিল। একদমই তা নয়। তবে আমি ঠিক, চাকরি বাকরি করে জীবন-যৌবন কাটিয়ে দেয়ার লোক কোনোকালেই ছিলাম না। এখনও নই। লেখালেখির শখ সেই ছোট থেকেই। সেটাই প্রফেশন করার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু….
দরজায় লক খোলার আওয়াজ পেলাম। নীলা এসেছে। একটা অদ্ভুত সুন্দর গন্ধ ওর সাথেই প্রবেশ করলো ঘরে। নীলার ঘামে ভেজা শরীরে মিশে থাকা পারফিউমের গন্ধ। এই গন্ধটার জন্যই আগামী জন্মেও আমি ওকে চিনে নিতে পারবো।
ঘরের ভিতরের অন্ধকার, দরজার বাইরের প্যাসেজের আলোয় সামান্য লঘু হ’ল ক্ষনিকের জন্য। নীলা দেয়ালের উপর লাইটের সুইচ গুলো অন করে দিয়ে, দরজা বন্ধ করে দিল। আমি বিছানায় শুয়েই রইলাম। বললাম, ” সিগারেট এনেছো ?” নীলা কিছু বললো না। চুপচাপ পাশের ঘরে ঢুকে গেল, চেঞ্জ করতে।
আমি বিছনা থেকে উঠে, দরজার পাশের ছোট্ট টেবিলটার দিকে এগিয়ে গেলাম। নীলার ব্যাগটা রাখাছিল ওখানেই। ছোট্ট একটি ভ্যানিটি ব্যাগ। নীলার নিত্য প্রয়জনীয় টুকিটাকি জিনিসগুলো থাকে ওটার ভিতর। কারোর ব্যক্তিগত জিনিসে হাত দেয়া আমার স্বভাব নয়। কিন্তু নীলা তো আমারই।
আমি ব্যাগটা হাতড়ে দেখলাম। সিগারেটের প্যাকেট নেই। নীলা কেনেনি। তবে যেটা পেলাম, তাতে বেশ অবাক হলাম। বলা ভালো আশাহত হলাম। একটা কন্ডোমের বক্স। বক্সটা ছেঁড়া। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমি যথা স্থানে কন্ডমের বক্সটা রেখে দিয়ে, ব্যাগের চেন আটকে, আবার বিছনায় এসে শুয়ে পড়লাম।
খিঁচ ধরা একটা মৃদু যন্ত্রনা অনুভব করলাম বুকের কাছটায়, যেটা ক্রমশই উঠে আসতে চাইছে গলা বেয়ে।
নীলার চেঞ্জ করা হয়ে গিয়েছিল। ও পাশের ঘর থেকে বেড়িয়ে এসে, সোফায় বসে টিভিটা অন করে দিল। আমি ল্যাপটপটা বন্ধ করে দিয়ে, বিছনা ছেড়ে উঠে গায়ে জামা গলিয়ে নিলাম। সিগারেট আনতে যেতে হবে। নীলা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো আমায়। বললো, ” কোথায় যাচ্ছিস ?”
আমি বললাম, “ঘরে বসে আছি সেই দুপুর থেকে। মাথাটা ধরে আছে। সিগারেট ও কিনতে হবে।”
হঠাৎ করেই নীলা চিৎকার করে উঠলো।
বললো, ” আমার খিদে পেয়েছে। রান্না বান্না কি করেছিস ! “
আমি বললাম, ” এসে রান্না বসাবো। আজ শরীরটা ভালো নেই। আলু ভাতে ভাত আর ডিম ভাজা বানাচ্ছি ফিরে এসে।”
নীলা তড়াক করে লাফিয়ে উঠলো সোফা থেকে। রাগলে ওর গলা কাঁপতে থাকে। বুঝতে পারছিলাম, কোনো একটা কারণে ও প্রচন্ড রেগে রয়েছে। নীলা আবারও চিৎকার করে বললো, ” সারাদিন অফিসে যমের খাটনি খেটে, রাত্রে বেলায় আলু ভাতে ভাত !
সেটুকুও ঠিক সময় রান্না করতে পারিস না তুই ?”
মেয়েটা রেগে থাকলে আমি ওর সাথে তর্কে যাই না। যা বলে, চুপচাপ শুনে যাই। নীলার গলার আওয়াজ বাড়ছিল ক্রমশ।
বললো, ” সারাদিন ঘরে বসে বসে, কোন ঘোড়ার ঘাস কাটিস তুই ! যে এই এটুকু কাজ তোর দ্বারা হয় না ? অফিস করবো আমি, সংসার চালাবো আমি, এখন কি রান্নাবান্না টুকুও আমাকেই করতে হবে !? “
আমার মনে হ’ল নীলার মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে জমতে থাকা বারুদে আগুন লেগে গিয়েছে হঠাৎ করেই। নীলার বিষোদ্গার বন্ধ হওয়ার নাম নিচ্ছিল না।
-” ভালো একটা চাকরি, জানি না কি কারনে ছেড়ে দিলি। সংসারে একটা টাকা কন্ট্রিবিউট করতে পারিস না। ঘরটুকু সামলাবি সে যোগ্যতাও তোর নেই। সারাদিন ফেসবুকে আট-ভাট লিখে কি পেট চলবে ! “
এই কথাটা নীলা ভুল বললো। চাকরি ছেড়ে দেয়ার পরও আমি সংসারে কন্ট্রিবিউট করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু নীলা বলেছিল, সেভিংস ভেঙে লাভ নেই। আমি তো আছিই। যতদিন না অন্য জবে জয়েন করছিস, ততদিন আমি চালিয়ে নেব। আর লেখালেখি নিয়ে যে খোঁটা দিল নীলা ; একটা সময় আমার সব লেখা গোগ্রাসে গিলত এই মেয়েটাই।
আসলে পুরষ মানুষের ঘরে বসে থাকার সাথে, তার অর্জিত সম্মান, ভালোবাসা এবং অবশ্যই তার আত্মসম্মান বোধের মধ্যে একটি ব্যস্তানুপাতিক সম্পর্ক রয়েছে। অর্থাৎ একজন পুরুষের, ঘরে নিষ্কর্মা হয়ে বসে থাকার দিন সংখ্যা যত বাড়তে থাকে, বাকি লোকজন এমনকি তার নিজের সবচেয়ে কাছের মানুষের কাছেও তার প্রতি সম্মান ততই কমতে থাকে। স্বাভাবিক। কারন আমরা এমনই এক সমাজের অংশ যেখানে, ছোট থেকেই আমাদের কয়েকটা বিষয়ে মগজ ধোলাই হয়ে গিয়ে থাকে। কোন কাজটা ছেলেদের, আর কোন কাজটা শুধু মেয়েরাই করবে ; মেয়েরা ঘর সামলাবে, ছেলেরা বাইরে বেড়িয়ে উপার্জন করবে এই ধরনের কথাবার্তা অপরিণত বয়স থেকেই এতবার করে আমাদের শোনানো হয় যে, একটা সময় এগুলোই ধ্রুব সত্য হিসেবে মনে হতে শুরু করে। এই ধরনের সংকীর্ণ চিন্তাধারা অজান্তেই আমাদের মস্তিষ্কে প্রোথিত হয়ে যায়। আর কেউ এই বস্তা পচা ধ্যানধারণার বাইরে গিয়ে অন্যরকম কিছু করলেই আমাদের চোখ টাটিয়ে যায়।
ঝাল লাগলো কথাগুলো শুনে ! সত্যিটা কমবেশি আমরা সব্বাই জানি। শুধু উপর উপর আধুনিকতার ভেক ধরে থাকি।
মনে মনে বেশ একটা প্রসন্ন ভাব জন্মালো। কি দারুন একটা মনোলগ রচনা করে ফেললাম এই মানসিক অবস্থাতেও। বাহ ! এই কথা গুলোই তো একটু গুছিয়ে, পরের লেখাটায় চালিয়ে দেওয়া যায়। আমার হাসি পেল।
নীলার বাক্যবন কখন যেন থেমে গেছে বুঝতে পারিনি।
আমি মিনিট খানেক দাঁড়িয়ে থেকে, রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম। নীলা সোফায় বসে পড়েছিল। সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে ও বললো, ” শোন আদৃত, কিছু কথা বলার আছে তোকে।”
আমি বললাম, রান্না করে নিই আগে। একটু অপেক্ষা কর। আধ ঘন্টার মধ্যেই হয়ে যাবে। তারপর তোর সব কথা শুনবো।”
নীলা উঠে এলো সোফা ছেড়ে। এখন ভীষন ক্লান্ত আর অবসন্ন লাগছিল ও কে। বললো, ” আদৃত, আমাদের এই রিলেশনটা ; ইটস নট ওয়ার্কিং এনি মোর।”
আমি রিয়্যাক্ট করলাম না। নীলা মাঝে মাঝেই এরকম কথা বলে। বললাম, ” তুই স্নান করে আয়। তরপর কথা বলছি।”
নীলা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। নখ দিয়ে ডান হাতের অনামিকার আংটিটা খুঁটছিল। প্রথম মাইনে পেয়ে কিনে দিয়েছিলাম নীলাকে এই আংটিটা। যখন ভীষন নার্ভাস ফিল করে, তখনই এমনটা করে ও। আমি আর চোখে ওকে দেখে নিয়ে, চাল ধুয়ে নিচ্ছিলাম। নীলা কিছুক্ষন ওভাবেই দাঁড়িয়ে থাকার পর বললো, ” আই স্লেপ্ট উইথ রোহিত। একবার নয়। বেশ কয়েকবার।”
আমি বুঝতে পারছিলাম না, ঠিক কি ভাবে রিয়্যাক্ট করবো কথাটায়। ভীষন যে অবাক হয়েছি তা নয়। বিগত বেশ কিছুদিন যাবৎ, নীলার সাথে আমার ফিজিক্যাল কন্ট্যাক্ট একদম নেই এর পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। একটু আগেই ওর ব্যাগে কন্ডম দেখেই আমি কিছুটা আঁচ করে নিয়েছিলাম ব্যাপারটা। এখন তো নীলা নিজেই স্বীকার করে নিল। রোহিত নীলার অফিস কলিগ। আমাদের মানে নীলার ফ্ল্যাটে এসেছে দুবার। ওর চোখ দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম, ব্যাটার নজর আছে নীলার উপর। তবে আমি কোনো কালেই ওভার পসেসিভ ছিলাম না নীলাকে নিয়ে। বিশ্বাস ছিল ওর প্রতি। শুনেছি শরীর চেনা হয়ে গেলে আগ্রহ কমে যায়। কথাটা আমি বিশ্বাস করি। কিন্তু তাই বলে, বিশ্বাস টুকুও কি চলে যায় ?
যাইহোক আফটার অল ওর নিজের জীবন। যা খুশী করতে পারে। সেই অর্থে আমরা আইনত কোনো বন্ধনেও আবদ্ধ নই , তাই আরগ্যুমেন্টের ও কোনো অবকাশ নেই।
আমি বললাম, “কতদিন চলছে এসব !?”
নীলা আমার দিকে তাকাচ্ছিল না। মাথা নিচু রেখেই বললো, “লাস্ট সিক্স মান্থ”।
বুঝতে পারলাম আমাদের সম্পর্কের ভীত নড়ে গিয়েছে। আসলে লিভ-ইন রিলেশন ব্যাপারটা মূলত যে দুটি স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে থাকে, সেই দুটি হল ভালোবাসা আর স্বনির্ভরতা। ভালোবাসা ছিল একসময়। এখনও আছে হয়তো। তবে আমি সেই অর্থে আর স্বনির্ভর ছিলাম না। ঘরেই বসে আছি শেষ একবছর, চাকরী ছেড়ে। প্রথম প্রথম নীলার চোখে নিজের জন্য ভালোবাসা দেখতে পেতাম। সেটাই কখন যেন বদলে গেল, করুনায়। আর আসতে আসতে করুনার জায়গায়, স্থান পেতে শুরু করলো ভর্ৎসনা, অসম্মান হয়তো ঘৃণাও। তবে আমি নীলার দোষ দেখি না। আসলে আমি নিজেকে তো হাড়েহাড়ে চিনে গেছি এই এতদিনে।
আমি কথা বাড়ালাম না আর। বলার মত বাকি নেই কিছুই। খাটের নিচে রাখা ট্রলিব্যাগ দুটি বের করে, আধ ঘন্টার মধ্যেই গুছিয়ে নিলাম নিজের যাবতীয় জিনিসপত্র। গোছানোর সময়টুকু নীলা চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছিল আমায়। ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিয়ে, আমি আরো একবার দুটো ঘর আর বাথরুমটা চেক করে দেখে নিলাম, কিছু রয়ে গেল কিনা। নাহ, কিছুই আর নেই।
ট্রলি ব্যাগ দুটো টেনে ঘরের দরজার অবধি নিয়ে গেলাম। নীলা দাঁড়িয়েছিল তখনও, মাথা নামিয়ে। আমি বললাম, “ভালো থেকো। রোহিত ছেলেটা সুবিধের নয় খুব একটা। সম্পর্কে জড়ানোর আগে, আর একবার ভেবে নিয়ো সম্ভব হলে। আমি আসি।”
নীলার শরীরটা অল্প একটু কেঁপে উঠলো মনে হ’ল।
ফ্ল্যাট থেকে নেমে, বাইরে রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম। যাওয়ার জায়গা নেই। ঘর ছেড়েছি বহুকাল। দুহাতে দুটো ট্রলি ব্যাগ নিয়ে বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যের ফাঁকা রাস্তা ধরে হাটতে লাগলাম। কোথায় যাবো ! জানিনা আপাতত।
******
ফোনটা বাজছিল। বেশ অনেকক্ষন থেকেই পুরোটা রিং হয়ে কেটে যাচ্ছিল। ঘুমের মধ্যে, একটানা হয়ে চলা কোনো শব্দ যেমন খুব ক্ষীণ ভাবে অনূভব করা যায় ; ফোনের রিংটোনটা ঠিক একইরকম ভাবে, বহু দূরের কোনো উৎস থেকে যেন ভেসে আসছিল। শব্দ তরঙ্গ কাছে এসে আমায় ছুঁয়ে দিয়েই আবার সরে যাচ্ছিল দূরে। চেনা সুরটা মৃদু থেকে ক্রমশ জোড়ালো হয়ে পৌঁছে যাচ্ছিল আমার কান অবধি।
আমার ঘুম ভেঙে গেল। বুক পকেটে রাখা ছিল ফোনটা। সতেরো টা মিসড কল। সবকটাই নীলার।
আমি কলব্যাক করলাম। একবার রিং হতেই ফোনটা ধরলো নীলা। কান্না ভেজা অস্পষ্ট কিছু কথা শুনতে পেলাম।
-” কোথায় তুমি ! এভাবে আমায় একা ফেলে যেতে পারলে ! এতটাই কি ফেলনা আমি ?”
নীলার এই ভার্সনটা আমার চেনা। যখন প্রচন্ড কষ্টে, দুঃখে একদম ভেঙে চুরে, দুমড়ে মুচড়ে যায় ওর ভিতরটা, তখন ও আমায় তুমি বলে। আমি কোনো উত্তর না দিয়েই চুপ করে শুনছিলাম। নীলা রীতিমত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। থেমে থেমে বললো, ” আর কখনও এমনটা করবো না। আমায় ক্ষমা করো আদৃত। প্লিস, যেখানেই থাকো একটিবার ফিরে এসো। নাহলে আমি মরেই যাবো।
কথা বলার মাঝে মাঝে ও থেমে যাচ্ছিল। বুঝতে পারলাম, স্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছে।
-“আমার ভিতর টা জ্বলে যাচ্ছে আদি। প্লিস কাম ব্যাক। আর কোনোদিন এমন হবে না। প্লিস আদি, প্লিস কাম ব্যাক।”
নীলার কথা গুলো ক্রমশই গোঙানিতে বদলে যাচ্ছিল। আমি টের পেলাম, এখন রীতিমত হাঁ করে স্বাস প্রশ্বাস চালাতেও ওর কষ্ট হচ্ছে।
আমি বললাম, ” লক্ষী মেয়ের মত আগে চোখটা মোছো। একটু ঘাড়ে মাথায় জল দাও। আমি আসছি।
আর ডু দি ব্রিদিং এক্সারসাইজ। ব্রিদ ইন…হোল্ড ইট….নাও এক্সহেইল। “
আমি যে জায়গাটায় বসে আছি, সেটা নীলার অ্যাপার্টমেন্ট থেকে হেঁটে বড়জোর মিনিট পঁচিশের রাস্তা। আরো কিছুক্ষণ পার্কের বেঞ্চেটায় বসে রইলাম। বৃষ্টি ভেজা মাটির, মন উদাস করা গন্ধ চারপাশ থেকে ঘিরে আছে আমায়। বসে থাকতে ভালো লাগছে।
ফোনের স্ক্রিনটা আনলক করতেই দেখলাম, নীলা হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কলেজের শেষ দিনের ছবি। অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
পার্কের এই লোকেশন থেকে একটা ক্যাব বুক করে, ফ্ল্যাট অবধি ড্রপ লোকেশন সেট করলাম। তিন মিনিটের ওয়েটিং দেখাচ্ছে অ্যাপ ক্যাব। ফ্ল্যাট থেকে বেড়িয়ে বেশিদূর যাইনি। যাওয়ার দরকার ও ছি’লনা। কারন নীলাকে আমার চেয়ে ভালো আর কেউ চেনে না। ও পারবেনা আমায় ছেড়ে থাকতে।
অকারনেই মানুষ রাগ, দুঃখ, ঘৃণা, অবহেলার বিলাসিতায় বেঁচে থাকে। জীবনটা যে আসলে, ভালোবাসার মানুষের ভালোবাসায় বাঁচতে হয় ; সেটা প্রায়শই ভুলে যাই আমরা। একটা গোটা জীবন, সত্যিই কি যথেষ্ট এই অকৃত্রিম ভালোবাসায় কাটিয়ে দেয়ার জন্য ! জানা নেই !
ক্যাব এসে গিয়েছিল। ট্রলি দুটো গাড়ির ভিতর তুলে নিয়ে আমি উঠে বসলাম। রাস্তা ফাঁকাই ছিল। দশ মিনিটও লাগলোনা ফ্ল্যাটে পৌঁছতে।
ফ্ল্যাটের দরজা খোলাই ছিল। লাইটগুলো সব জ্বালানো রয়েছে। নীলার অন্ধকার পছন্দ নয় একদমই। আমি বিছনার কাছে এগিয়ে গেলাম। নীলা উপুড় হয়ে শুয়ে রয়েছে। ওর পিঠটা ফুলে ফুলে উঠছে। আমি ওর মাথার চুল গুলো আলতো হাতে সরিয়ে দিলাম। চোখদুটো ফুলে লাল হয়ে গিয়েছিল নীলার। শুয়ে থাকা অবস্থাতেই আমায় জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে। মেয়েটা তখনও কাঁদছিল। আর গোঙানির সুরে কত কি যে বলছিল, সবটা আমি বুঝতে পারছিলাম না। বোঝার দরকার ও ছিল না।
কারন আমার চেয়ে ভালো আর কেউ চেনে না ওকে।
*****
ড্রাগটার অভ্যেস হয়ে গেছে নীলার। আজকাল সময় মত ওটা না পেলে পাগলের মত আচরণ করতে শুরু করে ও। সমস্ত শরীরে যেন আগুন জ্বলে। সাইড এফেক্টও আছে কিছু। একটু একটু করে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। স্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা শুরু হয়। মোদ্দা কথা, মৃত্যু ক্রমশ এগিয়ে আসে তার ভয়াল, ভয়ঙ্কর দাঁত, নখ উঁচিয়ে।
কিন্তু ওসবে পাত্তা দিইনি আমি। গত একবছর ধরে নিয়মিত একটু একটু করে ড্রাগের নেশা ধরিয়েছি নীলাকে। আর সবচেয়ে ভালো যে জিনিসটা, সেটা হ’ল নীলা নিজেও জানে না যে, ও ড্রাগ অ্যডিক্টেড। যে কোনো লিকুইড বা সলিড খাবারের সাথেই মিশিয়ে দেওয়া যায় ড্রাগটা। প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ে, ওটা ওর লাগবেই। নাহলে শরীর জুড়ে যে জ্বালাপোড়া শুরু হয়, তা অসহনীয়। এসব আমি জেনেছি, যার থেকে ড্রাগটা কিনি, তাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে। আর বাকিটা আমার রিসার্চ।
প্ল্যানটা একবছর আগের। ফেসবুকেই এক ভদ্রলোক ড্রাগ অ্যাডিসকশন নিয়ে একটি গল্প লিখেছিলেন। সৌভাগ্যবশত গল্পটা আমার নজরে আসে। গল্পের বিষয় বস্তু ছিল এই যে, একটি লোক তার খাবারের দোকানের আইটেম গুলোয় খুব লিমিটেড মাত্রায় ড্রাগ ব্যবহার করতেন। প্রথমদিকে বেশ কিছুদিন ভদ্রলোক ফ্রি অফ কস্ট খাবার দাবার বিলি করতে লাগলেন। ফ্রিতে খাবার কেন, বিষ পাওয়া গেলেও মানুষ আকর্ষিত হবেই। এক্ষেত্রেও তাই হয়। লোকজন নিয়মিত আসতে শুরু করে দোকানে। এইভাবে একটা সময় পর, লোকটার ব্যবসা ফুঁলে ফেঁপে ওঠতে শুরু করে। কাস্টমার বাড়তে থাকে। খাদ্য গুনে নয়, বরং যারা ডেইলি কাস্টমার, তারা ক্রমশ অ্যাডিক্টেড হয়ে পরে, সেই কারনে। যাইহোক, আইডিয়াটা সেখান থেকেই মাথায় ঢোকে।
ড্রাগটার নাম ?….
নাহ। ওটা বলা যাবে না।
কোথা থেকে কিনলাম জানতে চাইছেন ?
নাহ। সেটাও বলা যাবে না।
আরে লেখক হিসেবে আমার একটা সামাজিক দায়িত্ব, কর্তব্য আছে তো নাকি ! এভাবে এরকম একটা বিপদজনক আর ক্ষতিকর দ্রব্যের সোর্স বলে বেড়াবো নাকি !
কি বললেন !
তাহলে আমি কেন ব্যবহার করছি ?
আহা, কি মুশকিল !
আমি তো আর নিজের উপর ব্যবহার করছিনা মশাই। তাহলে আসল কথাটা শুনে যান বরং।
নীলাকে আমি বড্ড ভালোবাসি। হ্যাঁ, সত্যিই ভালোবাসি। তবে ভালোবাসার চেয়েও যেটা আরো গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হ’ল আমি নীলার উপর নির্ভরশীল। বিশেষত আর্থিক ভাবে। চাকরি বাকরি আমার দ্বারা হওয়ার নয়। আগেও বলেছি। তাই নীলাকে যদি সম্পূর্ণ ভাবে আমার উপর নির্ভরশীল হতে বাধ্য করা যায়, তাহলে ওর পক্ষে আমায় ছাড়া থাকা সম্ভব হবে না। তাই না ?
বুঝলেন তো ব্যাপারটা ?
হ্যাঁ..হ্যাঁ। একদম ঠিক ধরেছেন। আমি জানোয়ারই বটে। কিন্তু আপনারা আমার কিস্যুটি করতে পারবেন না। বুঝতেই পারছেন। তাই যেমন চুপচাপ গল্প পড়তে এসেছেন, পড়ুন। তারপর ভুলে যান।
আর পড়তে ইচ্ছে না করলে, ফুটে যান।
ড্রাগের লোকাল সোর্স, দাম, ড্রাগ কেনা, তার ব্যবহার, ক্রমশ সেটা নেশায় পরিণত করা, সেটার সাইড এফেক্ট ঠিক কতটা, নিয়মিত ড্রাগ সেবন করলে বেঁচে থাকার মেয়াদ কমবে কিনা ; এ সব বিষয়েও রীতিমত রিসার্চ ওয়ার্ক করতে হয়েছে আমায়। বিস্তর খাটা খাটনি গেছে ওই সময়ে। কিন্তু আজ আমি সফল। নীলা চাইলেও আমায় ছাড়া থাকতে পারবে না আর। আমি ঘর সামলাই। আর নীলা বাইরেটা সামলায়।
লোকে ভাবছেন ড্রাগ কেনার পয়সা কোথা থেকে আসে ! খুব সহজ। নীলা আছে তো।
আবার খিস্তি করছেন ? করুন করুন।
তবে হ্যাঁ, নীলার ও সময় শেষ হবে একটা সময়ে। তখন কি করবো ভাবছেন তো ?
কেন সোশ্যাল সাইটে নীলাদের কমতি আছে নাকি !
রিসেন্টলি একজনের সাথে আলাপ হয়েছে। সেও আবার আমার লেখার দারুণ ভক্ত। আমি যদিও পাত্তা দিচ্ছিনা এখনই।
প্রচুর রিসার্চ ওয়ার্ক বাকি। মেয়েটা কি করে ; মানে চাকরি বাকরি আরকি। মাইনে পত্তর কেমন পায়, বাড়িতে কেউ আছে কিনা, লিভ-ইনে বিলিভ করে কিনা ; এইসব খুঁটিনাটি আরো অনেক কিছু জানার বাকি। ততদিন নীলা তো রইলো।
নীলা ঘুমাচ্ছিল নিশ্চিন্তে। আমার কোলে মাথা রেখেই ঘুমোচ্ছে মেয়েটা। কষ্ট হয় মাঝে মাঝে। যখন ভাবি ওর নরম ঠোঁট দুটোর স্বাদ আর পাবোনা কিছুদিন পর, মনটা হু হু করে ওঠে। কান্না পায়। খুব ইচ্ছে করে, নীলার শরীরটাকে হিংস্র আদরে আদরে রক্তাত্ব করে ফেলি। কিন্তু সেই ইচ্ছে দমন করতে হয় নিজেকেই। আজকাল ওকে ছুঁয়েও দেখিনা। নীলাকে কল্পনা করেই শান্ত হই কখনও কখনও। যাতে করে, ওর অনুপস্থিতিটা আমার অভ্যেস হয়ে যায়।
দয়া করে ভুল বুঝবেন না আমায়। নীলাকে সত্যিই ভালোবাসি আমি। বড্ড ভালোবাসি। কিন্তু কি করবো বলুন, নীলার চেয়েও বেশী আরো একজনকে যে ভালোবেসেছি সেই ছোট্ট থেকে।
ওই আপনারা যাকে পশু ভাবছেন ; অমানুষ, জানোয়ার প্রভৃতি নানা রকমের বিশেষণে ভূষিত করছেন, সেই নিজেকে। নিজের চেয়ে বেশী, আর কাউকে ভালোবাসিনি আমি কখনই। ভালোবাসতে পারবোও না হয়তো।
আমি জানি, সব্বাই আমার মত নয়।
আমার গল্প প্রায় শেষের পথে, বুঝলেন !
না,না মশাই। সিমপ্যাথি চাইনি। আমি জানি আপনারা অনেকেই বুঝবেন না আমায়। অযথা নিজেকে জাস্টিফাই ও করবো না তাই।
তবে এটুকু আপনারা জেনে রাখুন, কেউ কেউ কিন্তু ঠিক বুঝতে পেরেছে আমায়। আমার মত পরজীবী হয়ে বেঁচে থাকে যারা, তারা ঠিক বুঝতে পারবে আমায়। ওই দেখুন না, কেমন কুটিল হাসি খেলা করছে ওদের ঠোঁটে।
এই বেলা চুপি চুপি বলে রাখি, একটু বেশী সাবধান থাকবেন এবার থেকে। বলা তো যায়না, আপনার আসে পাশেই, হয়তো আপনার সবচেয়ে কাছের মানুষটাই….
সমঝদার কে লিয়ে ইশারা কাফি হ্যায়।
রাত্রে আর কিছু রান্না করা সম্ভব হয়নি। ফ্রিজে দুধ রাখা ছিলো। ওটাই গরম করে, কর্নফ্লেক্সের সাথে খাইয়ে দিয়েছি নীলাকে। বাচ্ছা মেয়ের মত চামচে করে খাইয়ে দিতে হয়েছে। এই সময়টা একদম শিশু হয়ে যায় নীলা। ডোজ টা নেয়ার পর আর বেশিক্ষন জেগে থাকতে পারেনা। গভীর ঘুম নেমে আসে ওর শরীর জুরে। আসলে ক্লান্ত হয়ে যায় তো, তাই।
অজান্তেই এক বিন্দু নোনতা তরল গড়িয়ে পড়লো আমার চোখ থেকে, নীলার কপালে। মায়া ! হবে হয়তো।
ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়েছিলাম। একটা নাইট বাল্ব তার অল্প আলো নিয়ে, স্থির হয়ে জ্বলে আছে মাথার উপর। বিষের মতই নীল রঙের আলোয় মায়াবী লাগছিল নীলার নিষ্পাপ মুখটা। প্রবল ঝড়ের শেষে প্রকৃতি যেমন ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরে ; নীলাও ঠিক তেমনই ঘুমিয়েছিল। গভীরতর ঘুমে।
শেষ।