বেশ কয়েক বছর আগের কথা। আমার বয়স তখন কম। সেলস ম্যানের চাকরি করি। আমার কোম্পানির ছিল নানা রকমের যন্ত্রপাতির আমদানি রপ্তানির ব্যবসা। স্বদেশী ও বিদেশী সবরকমের যন্ত্রপাতির ব্যাপারী ব্যবস্থা ছিল। আমার কাজ ছিল এইসব যন্ত্রপাতি বিভিন্ন কোম্পানিতে ঘুরে ঘুরে তাদের বড়কর্তা ও ছোট-কর্তাদের সাথে কথাবার্তা বলে কেনাবেচা করা। মাইনে ছাড়াও ছিল কমিশন। প্রথম প্রথম মাইনেটা ছিল লক্ষ্য আর কমিশনটা ছিল উপলক্ষ। কিন্তু যত দিন যেতে লাগল দেখলাম লক্ষ্যের থেকে উপলক্ষটা বড় হতে লাগল। পয়সা করার নেশা কার না ভাল লাগে। আমিও মেতে গেলাম এই নেশায়। এই নেশাটা ছাড়াও আমার আরও বড় একটা নেশা ছিল। সেটা ছিল দেশ ভ্রমণের নেশা। আমি ছিলাম তখন ভবঘুরে, যাযাবর, যাকে বলে বাউণ্ডুলে। আমার এই তৃষ্ণা মেটানোর জন্য তাই এই চাকরিটা আমার ভালই লাগত। এইসব অভিযানে অনেক সময়ে আমাকে মুখোমুখি হতে হয়েছিল নানা রকম বিপদের কিন্তু বিনিময়ে আমার সঞ্চয়ে উঠে এসেছিল বহু অপ্রত্যাশিত ও উত্তেজনাপূর্ণ অভিজ্ঞতা। সেইরকম একটি ঘটনার কথাই নিবেদন করব। ঘটনাটি ভৌতিক, না অলৌকিক বা কাকতালীয় আজও আমার অজানা।
দিল্লি শহরতলির থেকে কিছুদূরে একটি কারখানায় যন্ত্রপাতি জোগান দেওয়ার ব্যাপারে আমাকে যেতে হয়েছিল। দিল্লি শহরে নেমে আর একটা ছোট ট্রেন নিয়ে জায়গাটায় পৌঁছতে হয়। জায়গাটায় আমি আগেও এসেছি তাই লোকজনের সঙ্গে চেনা পরিচয় ছিল। কারখানাটি বেশ বড়, ব্রিটিশ আমলের তৈরি। বেশ সাজানো গোছানো পরিষ্কার আর কেতাদুরস্ত। গার্ডের কাছে পরিচয় পত্র দেখানোর পর কোম্পানির গাড়ির ড্রাইভার আমাকে নামিয়ে দিল মেন বিল্ডিঙের দোর গোঁড়ায়। বোঝা যায় যে বর্তমান মিলের মালিক পুরনো সাহেবিয়ানা এখনও বজায় রাখার চেষ্টা করেন। যদিও পৌঁছেছিলাম সকাল বেলায় কাজ শেষ হতে সময় নিলো প্রয়োজনের থেকে একটু বেশী। বেশী সময় নিলো এই কারণে যে আমরা দু’জন প্রতিদ্বন্দ্বী অর্থাৎ আমি আর মিস্টার মালহত্রা আমাদের কোম্পানির মাল গুলো অন্যদের তুলনায় কত ভালো তার প্রমাণ দেওয়ার জন্য লড়াই শুরু করে দিলাম।
লোক দেখে তার স্বভাব চরিত্র নির্ণয় করার ক্ষমতা আমার ছোটবেলার থেকেই। বড় হওয়ার সাথে সাথে এই নির্ণয় ক্ষমতা ক্রমশ বেড়েছে বই কমেনি বলেই আমার বিশ্বাস। সুভাষ মালহত্রা লোকটাকে প্রথমবার দেখলে মনে হবে ভাজা মাছ উনি উলটে খেতে জানেন না। যেমন নির্বোধ, জড়বুদ্ধি চেহারা তেমনি আলুথালু পোশাক আসক। উজ্জ্বল, দক্ষ, পটু বা বুদ্ধিমান এইসব বিশেষণ গুল একেবারেই মানায় না। তার ওপর বাঁ পাটা ডান পায়ের থেকে একটু ছোট। যার জন্য তাঁকে প্রথম দর্শনে পঙ্গু, দুর্বল ও অক্ষম বলে মনে করাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ওই গুনগুলো না থাকাটাই যে তাঁর মারনস্ত্র সেটা বুঝতে আমার সময় নিয়েছিল। যেটা আমি বুঝতে পারিনি সেটা হল ওনার যুক্তি তর্ক মিশিয়ে গুছিয়ে কথা বলা আর যন্ত্রপাতি সম্বন্ধে অগাধ জ্ঞান। যেভাবে উনি ভরাট গলায় দৃঢ় আস্থার সাথে আমার যন্ত্রপাতি গুলোর ভুলভ্রান্তি তুলে ধরছিলেন আর নিজের যন্ত্রপাতি গুলোর প্রশংসা করছিলেন তখন প্রতিবাদ না করে আমিও একজন দর্শকের মত মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম। বুঝতে যখন পারলাম দেখলাম খুব দেরী হয়ে গেছে। যাই হোক সব যখন শেষ হোল দেখা গেল বড় অর্ডার গেল মিস্টার মালহত্রার তরফে আর ছোট অর্ডার গুলো এলো আমার পকেটে। নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল বলে সবাইকার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে।
বেরিয়ে এসে দেখি মুষল ধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। চারিদিক অন্ধকার হয়ে এসেছে, ঘূর্ণি ঝড়ের মত শোঁ শোঁ আওয়াজ করে হওয়া দিচ্ছে এত জোরে, যে গাছপালা গুলো একবার করে নুয়ে পড়ছে আবার বিদ্রোহ করে উঠে পড়ছে মাথা উঁচু করে। শরীরটাকে প্রবল বৃষ্টির ছাঁট থেকে বাঁচিয়ে, প্ল্যান্টের প্রশাসনিক বিল্ডিঙের গাড়িবারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম কোম্পানির গাড়ির জন্য। কি করা উচিৎ এই পরিস্থিতিতে এই চিন্তায় আপন মনে মশগুল ছিলাম।
চমকে উঠলাম কানের পাশে একটা গলার আওয়াজ শুনে।
“দুর্যোগটা সহজে থামবে বলে মনে হয় না। অন্তত কয়েকদিন ধরে তো চলবেই। আপনার ছোট ট্রেনটা তো বটেই এমনকি কোলকাতা যাওয়ার ট্রেনটাও হয়ত ক্যান্সেল হয়ে গেছে এতক্ষণে। এইরকম দুর্যোগ অনেকদিন পরে দেখলাম। এই ধরনের দুর্যোগ ভাল নয়। দশ বছরে একবার কি দুবার হয় এখানে। আমি একবার খুব বিপদে পড়েছিলাম। খুব সাবধানে থাকবেন। বিদেশ বিভুয়ে এসেছেন তাই বললাম আর কি। আর হ্যাঁ যদি থাকার জায়গা না থাকে আমার বাংলোতে এসে থাকতে পারেন।”
ঘাড়টা ঘুরিয়ে সুভাষ মালহত্রাকে দেখে আমার গা পিত্তি শুধু জলে গেল। একটা খারাপ গালাগাল মুখ থেকে প্রায় বেরিয়ে গিয়েছিল, কোনরকমে নিজেকে সামলে নিলাম। আমার থেকে সব কিছু ছিনিয়ে নিয়ে আমাকেই সাহায্য করার জন্য হাত বাড়ানো। গরু মেরে জুতো দান। মনের ভাবটাকে ঢেকে রেখে হাসি মুখে বললাম “থ্যাঙ্কস, কিন্তু আমার অন্য প্ল্যান আছে।” মিস্টার মালহত্রা আমার দিকে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চলে গেলেন মুচকি হেসে ডান পায়ের ওপর ভর দিয়ে বাঁ পাটাকে টেনে টেনে। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম কোম্পানির গাড়ির অপেক্ষায়। অদৃষ্ট দূরে থেকে আমার ওপর লক্ষ্য রাখছিলেন আর তিনিও মুচকি মুচকি হাসছিলেন।
গার্ডের কাছে নামিয়ে দিয়ে গাড়িটা চলে গেল। ব্যাপারটা যে এইভাবে মোড় নেবে আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। গার্ডের কাছে জানলাম ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। অতএব আমাকে কাছেপিঠে কোথাও কয়েকটা দিনের মত থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। কোথায় আস্তানা পাওয়া যায় এইসব নিয়ে যখন খবরাখবর করছি হঠাৎ দেখি আমার কাঁধে একটি বলিষ্ঠ হাত পড়ল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি মিস্টার মালহত্রা দাঁড়িয়ে আছেন হাসি মুখে।
“কথা না বাড়িয়ে আসুন আমার সঙ্গে। রামধিন সাহেবের মালগুলো গাড়িতে তুলে দাও। আমরা বাংলোয় যাব।” আমাকে কোনরকম কথা বলার সুযোগ না দিয়ে প্রায় বগল দাবা করে গাড়িতে তুলে দিলেন মিস্টার মালহত্রা। গাড়িতে খুব একটা কথা হল না। উনি চোখটা বন্ধ করে শরীরটা সিটে এলিয়ে দিলেন।
আমি জানলায় চোখ রেখে বাইরেটা দেখার চেষ্টা করলাম। কাঁচের জানলা ঘোলাটে অস্বচ্ছ, কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। ঝড়, থেকে থেকে আকাশের বুক চিরে করা বিদ্যুৎ এর আলো, আর দূরে কোথাও বাজ পড়ার আওয়াজ। একটা অজানা ভয় আমাকে গ্রাস করল। প্রকৃতির কাছে আমরা কত ছোট। আমি চোখ বন্ধ করে এক কোনে বসে ইষ্টনাম জপ করতে লাগলাম। কখন কি ভাবে যে আমাদের গন্তব্য-স্থলে পৌঁছলাম জানিনা। ভগবানকে ধন্যবাদ জানালাম মনে মনে আর রামধিনকে জানলাম তার সামনে দাঁড়িয়ে। রামধিন আমাকে একটা সেলাম ঠুকে আমার মালপত্র নিয়ে ভিতরে চলে গেল।
বৃষ্টির ছাঁট বাঁচিয়ে কোনরকমে বাংলোয় ঢুকে পড়লাম। আমার পিছন পিছন মিস্টার মালহত্রাও ঢুকে পড়লেন। কয়েক মিনিট লাগল তাঁর ধাতস্থ হতে। তারপর একটু এগিয়ে গিয়ে রামধিনকে কিছু একটা বললেন আমার কানে এলো না।
“রামধিন আপনাকে আপনার ঘরটা দেখিয়ে দেবে। এটা এই কোম্পানির গেস্ট হাউস বা বাংলো। ওদের নিজেদের সাহেবরা যখন আসে তারাই ব্যবহার করে। আমার সঙ্গে অনেকদিনের জানাশোনা তাই আমি যখন আসি আমার জন্য এই বাংলোটা বলাই থাকে। যাক আপনি হাত মুখ ধুয়ে চলে আসুন ড্রয়িং রুমে। আমি রামধিনকে বলেছি বাবুর্চিকে বলে গরম গরম পাকোড়ার ব্যবস্থা করতে। এই বৃষ্টি বাদলের দিনে হুইস্কির সঙ্গে গরম পাকোড়া হলে বেশ ভালই হবে কি বলেন। হুইস্কি চলে তো? আমার কাছে বিলিতি মাল আছে, আপনার ভালো লাগবে। অনেক গল্প আছে আমার কাছে, সময় আপনার খারাপ কাটবে না, গ্যারান্টি দিতে পারি। ঠিক আছে, তাহলে পনের মিনিট বাদে আপনার সঙ্গে দেখা হবে?”
আমার ঘরে ঢুকে দেখলাম রামধিন মালপত্র আগেই রেখে দিয়েছে। মনে মনে হাসলাম। একটু আগেই মনে হচ্ছিল এই অজানা বিদেশ বিভূঁইয়ে এসে এই ঘুরনি ঝড়ের আক্রোশে পড়ে আমার প্রাণটা হয়তো বেঘোরেই চলে যাবে। আর এই মুহূর্তে আমার জন্য গরম গরম পাকোড়া আর বিলিতি হুইস্কি আমাকে স্বাগত জানাতে আমার জন্য অধির আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে। রাখে হরি মারে কে। মুখহাত ধুয়ে সুট বুট ছেড়ে হাল্কা পোশাক পরে ড্রয়িং রুমের দিকে পা বাড়ালাম খোশ মেজাজে। দেখলাম মিস্টার মালহত্রা আমার আগেই পৌঁছে গেছেন। বসে আছেন আয়েস করে চেয়ারে হেলান দিয়ে। সামনের টেবিলের ওপর রাখা দামি বিলিতি হুইস্কির বোতল, দুটো খালি গেলাস আর বরফ ভরা পাত্র। শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ। হঠাৎ চমকে উঠলাম। ওটা কি উঠে আসছে মালহত্রার চেয়ারের পিছন থেকে? আমার দিকেই তাকিয়ে আছে? আমি ভয় পেয়ে পিছন ফিরে দৌড় দেবার জন্য তৈরি হলাম।
একটা ভরাট গলা কানে এলো “টাইগার স্টপ, গো ব্যাক, সিট।”
কোষ্ঠী-পাথরের মত একটা কুকুর মনিবের আওয়াজ শুনে ধীরে ধীরে গিয়ে বসে পড়ল চেয়ারের পিছনে নিজের জায়গায়।
“সরি আপনাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম যে আমার একটা বুলডগ আছে। ওকে ছাড়া কোথাও যাই না। অনেক জায়গায় যেতে হয় কাজের ব্যাপারে। কাজের শেষে রাত্রিটাও কাটাতে হয় এইসব জায়গায়। সব জায়গা ভাল হয় না। সঙ্গে টাকাকড়িও থাকে। আমি পঙ্গু মানুষ আমাকে কাবু করে বা প্রাণে মেরে সব কিছু নিয়ে নেওয়া খুব বড় কোন ব্যাপার নয়। এই টাইগার আমার ভরসা। ওকে দেখলেই আমার ধারে কাছে আর কেউ ঘেঁষবে না। কোন ভয় নেই। ও এখন জানে যে আপনি আমার চেনা লোক।”
আমি ভয় পাচ্ছি দেখে মালহত্রা উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে এসে আমাকে অভ্যর্থনা করে একটা খালি চেয়ারে এনে বসালেন। আমি একটু অবাক হলাম। এই লোকটাই কিছুক্ষণ আগে আমাকে আপাদমস্তক আড়ং ধোলাই দিয়ে আমার কাছ থেকে বড় অর্ডারটা হাতিয়ে নিয়েছিল। এখন তার ব্যবহার দেখে সেকথা মনেই হচ্ছে না। লোকটা কি বহুরূপী নাকি? মনে মনে ভাবলাম সাবধানে থাকতে হবে। কে জানে কি মতলব আছে।
আমাকে বসতে বলে দুটো গেলাসে পানিও ভরে দিলেন। আমরা ধীরে ধীরে চুমুক দিতে শুরু করলাম। গল্প শুরু করলেন মালহত্রা। সত্যি তাঁর কথা বলার দক্ষতা তারিফ করার মত। লক্ষ্য করলাম তিনি তাঁর চাকরির জীবনের গল্পের মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখলেন। নিজের ব্যক্তিগত জীবনের ব্যাপারের ধারকাছ দিয়েও গেলেন না। আমার পারিবারিক জীবনের প্রতিও তিনি কোনরকম কৌতূহল প্রকাশ করলেন না। একবার মনে হল জিজ্ঞেস করি ওনার নাম সুভাষ কেন রাখা হয়েছিল। নামটা তো খাঁটি বাঙালি নাম। কিন্তু ওনার হাবভাব দেখে মনে হল, না করাটাই ভাল। রামদেও বাবুর্চি এসে ডিনার সাজিয়ে আমাদের জানিয়ে গেল। ডিনার থেকে ফিরে আরও অনেকক্ষণ গল্প করার পর আমরা যে যার ঘরে চলে গেলাম।
সারাদিনের ক্লান্তি, উৎকণ্ঠা, বাইরে ঝড়ের গর্জন আর জানলার কাঁচের ওপর পড়া বৃষ্টির ছাটের আওয়াজে কখন যে নিদ্রাদেবি আমার ওপর সদয় হয়ে আমায় ঘুম পাড়িয়ে দিলেন আমার মনে নেই। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে ব্রেকফাস্ট রুমে গিয়ে বসলাম। মালহত্রা এলেন একটু পরেই। বৃষ্টিটা ধরেছে, একটু রোদও উঠেছে। দেখে ভালো লাগলো। কিন্তু মালহত্রার কাছে শুনলাম যে এটা ক্ষণিকের জন্য। বিকেলের পর থেকে আবার বৃষ্টি শুরু হবে। ঝড়ে অনেক গাছপালা পড়ে গিয়ে রাস্তা দিয়ে চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। অতএব আমরা কয়েকদিনের জন্য এখানেই আটকা থাকব। আমরা গল্প করছিলাম। মালহত্রার কুকুরটাকে ধারে কাছে দেখলাম না। জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করলাম না।
হঠাৎ একটা আওয়াজ শুনতে পেলাম। আওয়াজটা ডুগডুগি বাজানোর। বাঁদর খেলা দেখানোর সময় যেরকম ডুগডুগি বাজিয়ে জানান দেওয়া হয় যে আমরা এসে গেছি, দর্শকেরা চলে এসো। খেলা দেখবে এস। মালহত্রার কানেও আওয়াজটা যে গেছে বুঝতে পারলাম তাঁর কথায়।
“বাঃ আপনার কপাল ভালো বলতে হবে। আপনার জন্য এন্টারটেইনমেন্ট বন্দবস্তও এসে গেছে।”
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি দেখে হেসে বললেন “বাঁদর খেলা দেখানোর লোক এসে গেছে। গিয়ে দেখে আসুন বাঁদর খেলা।
“আপনি যাবেন না খেলা দেখতে?”
“আমি সাধারণত এই সব খেলা দেখতে যাই না। পঙ্গু লোককে নিয়ে অনেকে হাসি ঠাট্টা করে। সব থকে বেশী করে বাচ্চারা। আর এই সব খেলা দেখতে উৎসাহী তো তারাই। তবে আপনাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য আজকে যেতে পারি।”
সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে খেলা দেখছিলাম, মালহত্রার এক হাতে ধরা ছিল টাইগার, চামড়া-দড়ির চেন দিয়ে বাঁধা ছিল সে। দেখলাম রামদেও আর রামধিনকে ভিড়ের মধ্যে। লক্ষ্য করলাম যে লোকটা খেলা দেখাচ্ছিল তাকে বাচ্চারা চেনে। মাঝে মাঝেই তারা জংলি জংলি বলে ডাকছিল। জংলির মতই চেহারা বটে। ছয় ফুটের কাছাকাছি লম্বা। একটা কালো আলখাল্লায় সারা দেহটা ঢাকা। মাথার জটাধারী চুল আর গায়ের চামড়াটা রোদে পোড়া, তামাটে, আর রুক্ষ। চোখ দুটো রক্ত জবার মতই লাল আর ভয়ঙ্কর। চোখের দৃষ্টি আশ্চর্য রকমের তীক্ষ্ণ আর অন্তর্ভেদী। দু-একবার চোখাচোখি হয়েছিল, অজ্ঞাত কারণে তাড়াতাড়ি চোখটা নামিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিলাম। চেহারাটায় এমন একটা কিছু আছে যেটা দেখলে মনে হয় লোকটার বাঁদর খেলাড়ি না হয়ে কাপালিক তান্ত্রিক বা ডাকাত হলে ভালো মানাত। অথচ বাচ্চারা তাকে ভয় না পেয়ে উৎসাহিত করছে দেখে একটু অবাক হলাম।
নিজের চিন্তায় মগ্ন ছিলাম। বলা নেই কওয়া নেই একটা চিল চিৎকার আর গর্জনে আমার সম্বিত ফিরে এলো। দেখলাম খেলা বন্ধ হয়ে গেছে। গোল হয়ে থাকা চক্রবুহ ভেঙ্গে গেছে। মালহত্রা আমার পাশে নেই। সবাই জটলা পাকিয়ে খেলা যেখানে চলছিল সেইখানে অর্থাৎ মাঝখানটায় হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। আমি কি হচ্ছে বুঝতে না পেরে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
গলা পেলাম মালহত্রার “টাইগার স্টপ, লিভ ইট, লেট গো, আই উইল শুট ইউ।”
দেখলাম ভিড়টা ভেঙ্গে যাচ্ছে কর্পূরের মত। যে যেদিকে পারছে ছুটছে। জায়গাটা খালি হয়ে গেল নিমেষের মধ্যে। ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেলাম। দেখলাম দাঁড়িয়ে আছে দুটি চরিত্র, একটি চরিত্র শুয়ে আর একটি চরিত্র বসে। আরও কয়েক পা এগিয়ে গেলাম। মালহত্রা তাঁর বুলডগকে টেনে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। বাঁদরটা মাটিতে পড়ে আছে রক্তে মাখামাখি, জংলি তার ওপর উপুড় হয়ে বসে কাঁদছে। নিমেষের মধ্যে ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম। মালহত্রার কাছে গিয়ে কাঁধে হাত রাখলাম। মালহত্রা আমাকে খুলে বললেন কি হয়েছে। টাইগার ওনার হাতে ধরা ছিল শক্ত করে। বাঁদরটা খেলা দেখাতে দেখাতে ওনার খুব কাছে এসে গিয়েছিল। টাইগারের সেটা পছন্দ হয় নি বোধহয়। সে তার সহজপ্রবৃত্তি অনুযায়ী তার প্রভুর আততায়ীকে আক্রমণ করেছিলো। মালহত্রার হাতে ধরা চামড়া-দড়ির চেন ছিঁড়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাঁদরটার গলাটাকে লক্ষ্য করে।
“আপনি টাইগারকে নিয়ে প্লিজ ভিতরে যান, আমি লোকটার সঙ্গে একটু কথা বলে আসি। যদি টাকাপয়সা দিয়ে মিটমাট করা যায়।”মালহত্রা এগিয়ে গিয়ে লোকটার পিঠে হাত রেখে নিচু হয়ে কিছু বলতে লাগলেন।
আমি পড়লাম মহা বিপদে। টাইগার এর মত বুলডগ সামলানো আমার কর্ম নয়। তার ওপর চেনের অর্ধেকটা ছেঁড়া। যাই হোক মালহত্রার বকা খেয়ে হোক বা যে কোন কারণেই হোক সে চুপচাপ ভালো ছেলের মত চলে এলো আমার সঙ্গে। টাকাপয়সা দিয়ে কি না হয়। কত পয়সায় রফা করতে পারবেন মালহত্রা কে জানে। লোকটাকে ধড়িবাজ বলে মনে হয়, খুব সহজে ছাড়বে বলে মনে হয় না। অপেক্ষা করতে লাগলাম।
মালহত্রা ফিরলেন কিছুক্ষণ পরেই। বসলেন আমার সামনের চেয়ারে কোন কথা না বলে, মুখটা থমথমে। বুঝলাম এখন কোন কথা না বলাই ভালো। সময় দিলাম ওনাকে। রামদেও নিজের থেকেই ঠাণ্ডা জলের গ্লাস এনে রাখল টেবিলের ওপর। মালহত্রা জলের গ্লাসটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন, তারপর শুরু করলেন “হেরে গেলাম বুঝলেন। নিজেকে খুব বড় সেলেস্ ম্যান মনে করতাম। কিন্তু হেরে গেলাম লোকটার কাছে। কিছুতেই টাকা নেবে না। আপনি যে অবধি দেখেছিলেন তারপর যা হল তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। লোকটা হঠাৎ তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। তার ছয় ফুট লম্বা চেহারাটা মনে হল যেন আকাশটাকে ছুঁয়ে ফেলবে। কি হিংস্র সেই চেহারা। লাল চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসছে কোটরের ভেতর থেকে। সে প্রথমে শুরু করল অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি। তারপর যা বলল তার সার মর্ম করলে দাঁড়ায় এই রকম। তুই ভাবিস পয়সা দিয়ে সব কিছু কেনা যায়। এই বাঁদরীটা ছিল আমার মেয়ের মতন। ছোটবেলার থেকে ওকে মানুষ করেছি আমি। তিল তিল করে ওকে শিখিয়েছি সব কিছু। ও ছিল আমার সব-কুছ। আমি ছিলাম ওর সব-কুছ। যা ওয়াপাস যা তোর বাংলোয়। আজকের দিনটা খুব আয়েস কর। কাল থেকে তুই আমার কেনা গোলাম হয়ে থাকবি। তোকে এর উসুল দিতে হবে তোর জীবন দিয়ে, পয়সা দিয়ে নয়। তোর জীবন আমি তোর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেব। বলে জোরে জোরে হাসতে লাগল পাগলের মত। বুঝতে পারলাম লোকটা নেশা ভাং খেয়ে ভুল বকছে। আবার বোঝতে শুরু করলাম টাকা পয়সার বিনিময়ে মিটমাট করার জন্য। যতবার টাকা পয়সার কথা তুলি ততই লোকটা ক্ষেপে আগুন হয়ে যায়। অবশেষে হাল ছেড়ে দিয়ে চলে এলাম। পাগলের সঙ্গে কতক্ষণ কথা বলা যায়। কিছু যদি মনে না করেন তাহলে আমি এখন একটু একলা থাকতে চাই। আমার একটা ড্রিংকের খুব দরকার এই মুহূর্তে।” মালহত্রা পা বাড়ালেন নিজের ঘরের দিকে। তখন জানতাম না যে ওই দেখাটাই আমাদের শেষ দেখা হবে।
আমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ফিরে গেলাম নিজের ঘরে। ডিনারের ডাক এলো অন্যদিনের থেকে একটু আগেই। বিনয়ের সঙ্গে রামদেও জানাল যেহেতু আবহাওয়া খারাপ হওয়ার কথা রাত্রির থেকে তাই ওরা কাজ শেষ করে একটু তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরতে চায়। আমার আপত্তি করার কোন কারণ ছিল না, অতএব গিয়ে বসলাম ডিনার টেবিলে। মালহত্রাকে দেখলাম না। অবাক হলাম। জিজ্ঞেস করলাম রামদেওকে। জানতে পারলাম ওনার শরীর ঠিক আছে কিন্তু উনি আজকের দিনটা একলাই কাটাতে চান। আজকের ডিনার উনি ঘরেই খাবেন। রামদেওকে আরও বলেছেন যে আমি যেন আজকে তাঁর এই অনুপস্থিতি মার্জনা করি। আগামীকাল সকালে উনি সুদে আসলে পুষিয়ে দেবেন। একটা স্পেশাল সারপ্রাইজের ব্যবস্থা করেছেন তিনি শুধু আমার জন্য। যদি তখন জানতাম কি সেই সারপ্রাইজ, তাহলে তৎক্ষণাৎ উঠে গিয়ে তাঁকে বাধা দিতাম।
কোনরকমে পেটে কিছু পুরে হাতটা ধুয়ে নিজের ঘরের দিকে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছি দেখি মুখটা কাঁচুমাচু করে রামদেও দাঁড়িয়ে আছে, হাতদুটোকে জড়ো করে।
“কি ব্যাপার রামদেও, কিছু বলবে?”
“হাঁ স্যর, যদি আপনার সময় হয় তো বলব।”
“আমার সময়ের কোন অভাব নেই। আমি তো এখনেই থাকব, তোমাদেরই তো দূরে যেতে হবে। নাও যা বলার আছে ঝটপট বলে ফেল।”
“কি বলব কি ভাবে বলব বুঝতে পারছি না। আমরা মুখ্যু মানুষ অত কিছু বুঝি না, জানিনা। আপনারা পড়ালেখা জানা ভদ্রলোক আপনাদের কেমন করে বোঝাতে পারব জানিনা।”
“আহা কি হয়েছে আগে বলত শুনি তারপর দেখা যাবে আমি কি ভাবছি না ভাবছি। চল চল দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
“তাহলে শুনুন। ওই যে লোকটার সঙ্গে সাহেবের ঝগড়া হয়েছে ও লোকটা একজন ফকির। এরা এমনিতে কারো ক্ষতি করে না। নিজের মনে থাকে। কিন্তু কোন কারণে যদি এরা রেগে যায় আপনার ওপর তাহলে আপনার নিস্তার নেই। তাই কেউ এদের সহজে ঘাঁটায় না। অনেক তুকতাক জানে। লোকটা ভূতপ্রেতও চালাতে পারে। হিন্দু না মুসলমান তাও কেউ জানেনা। কিছুদিন হোল এখনে এসে আস্তানা গেড়েছে। কেউ ওকে ঘাঁটায় না। এরা ভবঘুরে কখন বেশীদিন এক-জায়গায় থাকে না। আমাদের সাহেব খুব ভালো লোক, আমি চাইনা ওনার কোন ক্ষতি হোক। ও সাহেবকে শাসিয়েছে দেখে নেবে বলে। যা বলেছে তাই করে ছাড়বে। আমার ভীষণ ভয় করছে ওনার জন্য। আজকের রাতটা আমি থেকে যেতে পারতাম কিন্তু খুব জরুরী দরকার আছে বারীশের আগে বাড়ি পৌছুতে হবে।”
“তুমি সাহেবকে এতটাই পছন্দ কর জেনে ভাল লাগল। আচ্ছা তুমি লোকটার সম্বন্ধে এত কথা জানলে কেমন করে। আর সাহেবকে যে শাসিয়েছে তাই বা তুমি জানলে কি করে। তুমি তো তখন ওখানে ছিলে না।”
“স্যর লোকটাকে সবাই ভয় করে কেউ ধারেকাছে যায় না। কিন্তু লোকটা বাচ্চাদের খুব পছন্দ করে। ওদের সঙ্গে গল্প করে ওদের ম্যাজিক দেখায়। ওদের মুখ থেকেই সব শোনা। আর আজকের ঘটনাটা তো আমাদের কানু, যে আপনাদের ফাইফরমাশ খাটে, সে লুকিয়ে সবকিছু দেখেছে আর শুনেছে। লোকটা তো আস্তে কথা বলছিল না। বেশ জোরে আর হিম্মতের সঙ্গে বলছিল। আর যেটা কানুকে সবথেকে অবাক করেছিল সেটা শুনলে আপনিও বিশ্বাস করতে পারবেন না স্যর।”
কথা শেষ করে রামদেও আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম “কি হল রামদেও, থামলে কেন? কি হয়েছিল যে আমি বিশ্বাস করতে পারব না। বলে তো দেখো। নাও আর দেরি না করে বলে ফেল।”
“কি জানি স্যর আপনি কি ভাববেন কে জানে। আমি এখানে আপনাদের সেবা করে খাই। আপনাদের নিন্দে মন্দ করা আমাদের ভালো দেখায় না। আপনি জোর করছেন তাই বলছি। আমাদের সাহেব খুব সাহসী লোক, ভয়ডর জানেন না। আমরা খুব ভাল করে জানি সে কথা। লোকটা যখন কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসছিল সাহেবের দিকে তখন সাহেব তাঁর কোমর থেকে পিস্তলটা বের করেছিলেন ওকে ভয় দেখানোর জন্য। লোকটা ভয় পেয়ে কয়েকটা পা পিছিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে নিচু হয়ে এক মুঠো ধুলো তুলে নিয়ে মন্ত্র পড়ে সেই ধুলো ছুঁড়ে দিয়েছিল সাহেবের দিকে। কানু বলে সেই ধুলোর আঘাতে আমাদের সাহেব নাকি প্রায় টলে পড়ে যাচ্ছিলেন। তারপর সাহেবের কি হোল কে জানে তিনি আর কোন কথা না বলে সোজা বাংলোর দিকে হাঁটতে শুরু করলেন টলতে টলতে। লোকটা নাকি সাহেবের পালিয়ে যাওয়া দেখে বিকট জোরে হাসতে লাগল আর গলা ফাটিয়ে বলতে লাগল “ডোলি সাজাকে রাখনা। আজই আয়েঙ্গে জরুর আয়েঙ্গে। উঠাকে লে যাউঙ্গা। কোই রোক নেহি পায়গা। মজা আয়েগা। মজা আয়েগা।”
আমি রামদেওকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম “তুমি কোন চিন্তা করনা। আমি তো আছি। তাছাড়া টাইগার আছে। ও তোমার সাহেবকে নিজের জীবন দিয়ে রক্ষা করবে। তাছাড়া সাহেবের কাছে রিভলভার আছে আর সেটা উনি চালতেও পারেন। তুমি ঘরে যাও, কাল যখন আসবে দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে।”
রামদেও চলে গেল, আমিও আমার ঘরে গিয়ে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম। ঘুম আসছিল না, একটা গল্পের বই পড়তে শুরু করলাম। মন বসাতে পারলাম না। অনেক চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। মালহত্রা কই আমাকে রিভলভার আর ধুলো ছোঁড়ার কথাটা তো বলেননি। হয়ত ভুলে গেছেন, বা হয়ত ইচ্ছে করে বলেন নি। বা কানু বলে ছেলেটা বাড়িয়ে বলেছে রামদেওকে। লোকটা কি সত্যি তুকতাক জানে? কি করতে পারে লোকটা? কারু কি এত ক্ষমতা থাকতে পারে যে মালহত্রার মত একটা লোক কে ভয় দেখাতে পারে। আজকালকার দিনে এইসব জিনিষ হয় নাকি? এতই যদি ওর ক্ষমতা থাকে তাহলে ও এত গরিব হয়ে জীবন কাটাচ্ছে কেন।
ঝড় বৃষ্টির জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ। কানু ঘরে একটা হ্যারিকেন জালিয়ে দিয়ে গেছে। আবছা অন্ধকার আর দপ দপ করে জলা হ্যারিকেনের আলো ঘরটাকে কেমন রহস্যময় করে তুলেছে। ছোটবেলায় অন্ধকারকে ভীষণ ভয় পেতাম। সারা শরীরটাকে লেপের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে কুঁকড়ে শুয়ে থাকতাম। লেপের উত্তপ্ত গরমকে সহ্য করার বদলে অন্ধকারের অজ্ঞতার জামিন হিসেবে পেতাম এক ঐন্দ্রজালিক নিরাপত্তা। আমার মনে পড়ে আমার ঘাড়ের খাড়া হয়ে থাকা লোমকূপ গুলো আমায় বলত অন্ধকারকে ভেদ করে খুঁজে দেখ ঘরের সবথেকে অন্ধকার কোনাটাকে। ওই কোনাটাতেই দেখতে পাবে ঠিক তোমার মত আরও দুটো চোখ তোমার দিকেই তাকিয়ে আছে। মনে হত ওই কোনা থেকে একটা গাড় কালো আকৃতি নড়েচড়ে উঠল আর চুপিসারে আগিয়ে আসছে আমার পায়ের দিকে। চোখ দুটো খুলে রাখতে কষ্ট হলেও খুলে রাখতাম কারণ মনে হত চোখ বন্ধ করলে ওই আকৃতিটা এসে আমাকে ধরে ফেলবে। ঠিক ওই সময়ে আমি একটা খুব জোরে নিঃশ্বাস নিতাম।
নিজের চিন্তায় এমনই মগ্ন ছিলাম যে খেয়াল করিনি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। মালহত্রার ঘর আমার থেকে অনেকটা দুরে। কানখাড়া করে শোনার চেষ্টা করলাম কোন অস্বাভাবিক আওয়াজ বা চলাফেরার আওয়াজ। শুধু ঝড় আর বৃষ্টির আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই কানে এলো না। নিশ্চিন্ত হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম।
ঘুমটা ভেঙ্গে গেল একটা আওয়াজে। মনে হল ঘরের বাইরে থেকেই আসছে আওয়াজটা। কান পেতে রইলাম। আপনা থেকেই চোখটা গিয়ে পড়ল কাঁচের জানলাটায়। ভয়ে আমার হাত পা হিম হয়ে গেল। একটা ছায়ামূর্তি মাথা-ভরতি ঝাঁকড়া চুল আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। গলা দিয়ে স্বর বেরল না। মুখটাকে দুটো হাত দিয়ে চেপে ধরলাম যাতে কোনরকম শব্দ না বের হয়। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মূর্তিটা। তবে কি লোকটা এসেছে। লোকটার কথায় ভুতের ভয়টা ভেঙ্গে গেল, উঠে এলো একটা রাগ আর বিদ্বেষ। টর্চ-লাইটটা খুঁজে পেলাম না। বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম, এগিয়ে গেলাম জানলার দিকে। দেখলাম আমার দৃষ্টিভ্রম। একটা গাছের ছায়া এসে পড়েছে কাঁচের জানলাটার ওপর। ফিরে এলাম বিছানায়। ঘুম ভাঙল সকাল বেলায় দরজায় ধাক্কা দেওয়ার আওয়াজে। কে এত জোরে ধাক্কা দিচ্ছে, কোন বিপদ হল নাকি? তাড়াতাড়ি উঠে দরজাটা খুলে দিলাম। দেখলাম রামদেও দাঁড়িয়ে আছে, পাশে রামধিন। দুজনেরই মুখ শুখনো।
“কি হয়েছে রামদেও? তোমার সাহেবে ঠিক আছেন তো?”
দুজনেই একসঙ্গে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।
“কি বলব স্যর, রামদিন সাহেবের ঘরে গিয়েছিল পুচতাছ করতে। গতকাল তিনি রামদিনকে বলেছিলেন আপনাকে নিয়ে একটা জায়গায় বেড়াতে যাবেন। ও যেন সকাল বেলায় এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করে। ও দরজায় প্রথমে দুটো টোকা দিয়েছিল। সাড়া না পেয়ে স্যর স্যর করে ডেকেও ছিল। কোন সাড়া পায় নি। হঠাৎ লক্ষ্য করল যে দরজাটা ভেজানো, ভেতর থেকে বন্ধ নয়। তখন ভয় পেয়ে আমাকে গিয়ে ডেকে আনে। আমি আর রামদিন ঘরে ঢুকে সাহেবকে কোথাও দেখতে পেলেম না। তন্ন তন্ন করে সব দেখলাম। ভিতরে বাইরে সবজায়গায়। সাহেব আর টাইগার দুজনেই গায়ব, চিহ্নমাত্র নেই। আপনি কি রাত্তিরে কোন আওয়াজ বা চিৎকার শুনেছিলেন? কি করব বলুন হুজুর?”
এমন একটা পরিস্থিতির জন্য আমিও প্রস্তুত ছিলাম না। তবু নিজেকে শান্ত করে বললাম “শোন তোমরা এতটা উতলা হচ্ছ কেন? এমন তো হতে পারে যে উনি টাইগারকে নিয়ে কথাও বেড়াতে বেড়িয়েছেন। একটু বাদেই ফিরে এসে তোমাকে বলবেন রামদেও চা লাগাও, আর লাঞ্চ প্যাক করে দাও আমরা এক্ষুণি বেরব। আর গতকাল আমি কোন আওয়াজ বা চিৎকার শুনতে পাই নি। বরঞ্চ গতকাল ঘুমটা ভালই হয়েছিল অন্যদিনের তুলনায়। তোমরা তোমাদের কাজে মন দাও আমি গিয়ে সাহেবের ঘরটা একবার দেখে আসি।”
“ঠিক আছে স্যর, আপনি যেরকম বলছেন তাই যেন হয়। আমি আপনার চা আর জলখাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি। মসলা চা চলবে ত স্যর।”
আমি মাথাটা নেড়ে হেসে সম্মতি জানালাম। ঘরের দরজাটা বন্ধ করে পা বাড়ালাম মালহত্রার ঘরের দিকে। ব্যোমকেশ, শারলক হোমস আর কিরীটী রায়ের প্রায় সব বই পড়া ছিল। তাই সত্যান্বেষীর কাজের কোন ত্রুটিই রাখলাম না। কিন্তু কিছুই পেলাম না। কোন ধস্তাধস্তির চিহ্ন নেই। বিছানাতে কেউ শুয়ে ছিল তার প্রমাণ আছে। জানলার কাঁচ অটুট। ঘরের দরজা খোলা ছিল। অতএব উনি নিজেই দরজা খুলে বেরিয়েছেন। কেউ জোর করে ঘরে ঢুকে ওনাকে কোলে করে তুলে নিয়ে যায় নি। যেটা খটকা লাগল সেটা হোল যে ওনার বেডরুম স্লিপার আর গতকাল যে জুতোটা ওনাকে পরতে দেখেছিলাম দুটোই পড়ে আছে। তার মানে ওনার আর একটা পেয়ারের জুতো ছিল। সাহেব মানুষ আর পয়সাওয়ালা লোক আমার মত মধ্যবিত্ত বাঙালি তো নন। সেটা হওয়াই স্বাভাবিক। নিশ্চিন্ত মনে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। রইলাম মালহত্রার ফিরে আসার অপেক্ষায়।
অপেক্ষায় রইলাম কিন্তু মালহত্রা আর ফিরে এলেন না। পুলিশে খবর দেওয়া হল। তারা এলো তদন্ত শুরু হল। আমার নাম ঠিকানা লিখে নিয়ে আমাকে তারা ছেড়ে দিল। পুলিশের ধারনা মালহত্রা ভয় পেয়ে একবস্ত্রে পালিয়ে গেছেন। পরে সময়মত উদয় হয়ে সব কিছু সবিস্তারে বলবেন। সেই আশা নিয়ে ফিরে এলাম কলকাতায়। ভেবেছিলাম ঘটনার শেষ এখানেই হবে। কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর ভগবান ভাবেন আরেক। একদিন অফিসের বড় সাহেব আমাকে ডেকে যা বললেন তা শুনে আমার চক্ষু চড়ক গাছ। আমি যে ছোট অর্ডারগুলো হাসিল করেছিলাম, সেই কোম্পানি এখন তাদের বড় অর্ডারগুলোও আমাদের দেবে বলেছে। আর এও বলেছে যে এই ডিলটা করার জন্য শুধু আমাকেই যেন পাঠানো হয়। আমার তো হাতে চাঁদ পাওয়ার মত অবস্থা। লক্ষ লক্ষ টাকার মাল সাপ্লাই দিতে হবে। আমার কমিশনটা চট করে হিসেব করে নিলাম। আরও খুশী হওয়া বাকি ছিল। বড় সাহেব খুশী হয়ে আমার বেতন আর কমিশন দুটোই বাড়িয়ে দিলেন। এরকম আশ্বাসও দিলেন যে এই ভাবে কাজ করতে থাকলে আমি একদিন কোম্পানির পার্টনার হতে পারি।
কোম্পানিতে পৌঁছে কাজ হাসিল করে বেরতে অনেক রাত হয়ে গেল। কোম্পানির বড় সাহেবরাই আমাকে ওনাদের বাংলোয় থাকার বন্দবস্ত করে দিলেন তার সঙ্গে গাড়ি আর ড্রাইভার। এসে পৌছুলাম সেই পুরনো বাংলোয়। কত স্মৃতি কত কথা মনে পড়ে গেল। দেখলাম রামদেও, রামধিন নেই তার বদলে আছে টমাস আর আনসারি। রাতটা কোনোরকমে কাটিয়ে দিলাম। টমাস ডাক দিয়ে গেল ব্রেকফাস্টের জন্য। দেখলাম এলাহি ব্যাপার করেছে টমাস আমাকে খুশী করার জন্য। গতবারে রামদেও আমার কত যত্ন করেছিল তার গল্প শুনিয়েছিলাম ডিনার টেবিলে গতরাত্রে। এ যে তারই ফল আমার তাতে কোন সন্দেহ রইল না। আমার ট্রেন সন্ধ্যের আগে নয়, অতএব হাতে অনেকটা সময়। কি করে কাটাব ভাবছি। হঠাৎ কানে এলো সেই পুরনো ডুগডুগির আওয়াজ। ছবির মত সব মনে পড়ে গেল।
“স্যর আপনার হাতে তো অনেকটা সময় আছে যান গিয়ে খেলাটা দেখে আসুন। চমৎকার খেলা দেখায় লোকটা। আমরাও যাব। আসুন না স্যর।” টমাসের অনুরোধ।
“আমি দেখেছি ওর বাঁদরের খেলা যখন আগেরবার এসেছিলাম। আরেকবার দেখার ইচ্ছে নেই। তোমরা যাও দেখে এস, আমি এখানে বসে একটু জিরিয়ে নি। শুধু আমার জন্য এক গ্লাস ঠাণ্ডা জল রেখে যেও যাওয়ার আগে।” আমি পাশ কাটিয়ে যাবার চেষ্টা করলাম।
“না স্যর ও এখন আর বাঁদর খেলা দেখায় না। ওর বাঁদরীটা একটা দুর্ঘটনায় মারা যায়। তারপর কয়েকমাস ও খেলা দেখানো বন্ধ করে দিয়েছিল। এখন ও ভালুকের খেলা দেখায়। এ ভালুক যে সে ভালুক নয় স্যর। এ লেখাপড়া জানা ভালুক, অঙ্ক করতে পারে। যোগ বিয়োগ গুন ভাগ যা দেবেন স্যর ঝটপট করে দেবে। আমরা তো অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। আমরা তো অতো অঙ্ক জানিনা তাই ভালুকটাকে শক্ত অঙ্ক দিতে পারিনা। আপনি যদি আজ আসেন তাহলে খেলা খুব জমে যাবে।”
সত্যি কথা বলতে কি জংলিকে আর একবার মুখোমুখি দেখার ইচ্ছে আমার একেবারেই ছিল না। মনের কথা মনে রেখে বললাম “ঠিক আছে, তোমরা যাও, আমি একটু বাদে আসছি।”
ভালুক অঙ্ক করে। গাঁজাখুরির আর জায়গা পেলে না। গরিব আর অশিক্ষিত লোকদের মাথায় কাঁটাল ভেঙ্গে খাচ্ছে। আর খাবে নাই বা কেন। পৃথিবীর অনেক লোকই তো এই ভাবেই রুজি রোজগার করে। লোকটাকে সত্যি বাহবা না দিয়ে পারলাম না। আগেও আমি ওর তারিফ করেছি যখন ও মালহত্রার মতো ধড়িবাজ লোককে ভয় পাইয়ে ফেরার করে দিয়েছিল। কিন্তু কিসের একটা দুর্নিবার আকর্ষণ আমাকে পাগলের মত আমাকে পেয়ে বসল। আমার কানে কানে কে যেন ফিসফিস করে বলল “এসো না, এসেছ যখন দেখেই যাও না।”
মন্ত্রমুগ্ধের মত উঠে পড়লাম। নিশির ডাকের নেশার মতো ঘোরে আমি এগিয়ে গেলাম যেদিকে চলছিলো খেলা সেইদিকে। যখন পৌঁছলাম তখন খেলা প্রায় শেষের দিকে। ভালুকটা একটা লম্বা চেন দিয়ে বাঁধা। একটা অংশ ওর গলায় বাঁধা আর একটা অংশ ধরে আছে জংলি। ভালুকটা খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে দুটো হাত দিয়ে একটা পাত্রকে ধরে সব জমায়েত লোকের কাছে পয়সা চাইছে। কেউ খুশি হয়ে খুচরো পয়সা, কেউ টাকা যার যেরকম ক্ষমতা দিচ্ছে। বাচ্চারা মাটি, ইট পাটকেল তুলে দিচ্ছে আর দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছে জংলির তাড়া খেয়ে। আমি ভিড়ের মধ্যে লুকিয়ে ছিলাম যাতে জংলি আমাকে দেখতে না পায়। ভালুকটা ঘুরতে ঘুরতে আমার কাছাকাছি এসে দাঁড়াতেই হঠাৎ তার চোখ আমার ওপর পড়ে। আমাদের দু জোড়া চোখ আটকে গেল মুহূর্তের জন্য। তারপরেই ভালুকটা একটা তীব্র আর্তনাদ করে উঠল। সে ছটফট করতে লাগলো পাগলের মত। মাটিতে পড়ে লুটোপুটি খেতে লাগলো। মনে হল কান্নায় ভেসে যাচ্ছে সে। ভালুকের এই দশা দেখে সবাই ভয় পেয়ে ছুটতে লাগল যে যেদিকে পারে। ভিড় ভেঙ্গে গেল। জংলি বোধহয় এতক্ষণ নেশার ঘোরে ছিল। সম্বিত ফিরে পেতেই বেধড়ক পিটতে শুরু করল ভালুকটাকে একটা মোটা লাঠি দিয়ে। আমিও ছুটছিলাম আবার পিছন ফিরে দেখার চেষ্টা করছিলাম জংলির দৃষ্টির আড়াল থেকে। মার খেয়ে ভালুকটা শান্ত হল। উঠে দাঁড়ালো দুটো পায়ে ভর দিয়ে। হাঁটতে শুরু করল জংলির সাথে সাথে। জংলি চলেছে সামনে আর পেছন পেছন চলেছে ভালুকটা ডান পায়ের ওপর ভর দিয়ে বাঁ পাটাকে টেনে টেনে। আমি ছোটা বন্ধ করে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। তবে কি ——-?
সন্ধ্যের সময় আনসারি আমাকে স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে গেল। বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হোল না। একটা ফাঁকা কামরা দেখে উঠে পড়লাম। মালপত্র জায়গায় রেখে জানলার ধারে একটা সিটে বসে পড়লাম আয়েস করে। মালহত্রার কথাটাই আজ সব থেকে আগে মনে পড়ছে। সব কিছু তো ওনার কাছেই শেখা। প্রথম দিনের আলাপে উনি আমাকে শিখিয়েছিলেন কয়েকটা কথা। সুযোগ চট করে আসেনা, যখন আসবে সাথে সাথে ব্যবহার করা উচিৎ। ঘুষ ছাড়া কোন কাজ হয় না। সব দেশে সব সময়ে। হয় ক্যাশ নয় কাইন্ড। ফেল কড়ি মাখ তেল। কাকে কি ভাবে দিতে হবে সেটা জানা একটা আর্ট। ঘোমটা দিয়ে থাকলে উপরে ওঠা যায় না। চাকরি করে কেউ কোনদিন বড়োলোক হয় না। টাকা দিয়ে টাকা বানাতে হয়।
মনে পড়ল দ্বিতীয় দিনের কথা। যেদিন তিনি থমথমে মুখে ফিরলেন জংলির কাছে তাড়া খেয়ে। যে কথাগুলো কানু রামদেওকে বলেনি।
“শুনলে অবাক হয়ে যাবেন। লোকটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে অনেক কিছু জানে। কি করে জানল? এই মুহূর্তে কাউকে বলাটা খুব দরকার। মনটা একটু হাল্কা হবে। পাথর বয়ে বেড়াচ্ছি বুকের মধ্যে। আশাকরি আপনি পাঁচকান করবেন না। প্রথমেই বলে রাখি যে আমি দোষ গুনে মিলিয়ে একজন মানুষ। গুনের থেকে দোষের মাত্রাটা হয়তো একটু বেশী। কয়েকবছর আগে একটা নারীঘটিত ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েছিলাম। খুন পর্যন্ত গড়িয়ে ছিল। পুলিশ আমাকে সন্দেহ করেছিল কিন্তু প্রমাণের অভাবে আমাকে ধরতে পারেনি। লোকটা সেই কথা রাগের মাথায় আমাকে বলে দিল। আমি ওকে ভয় পাইনা। কিন্তু ওর সন্দেহটাকে ভয় পাই। আপনাকে তো বলেছি আমি টাকা পয়সা নিয়ে ঘোরাফেরা করি। আমি চাই ও আসুক আজ আমার ঘরে। আমি দরজাটা খুলেই রাখব। এলেই ওকে গুলি করব। এক ঢিলে দুটো পাখি মারব।”
রামদেও আর রামধিন যেদিন এসে আমার দরজায় ধাক্কা দিয়ে বলল যে মালহত্রাকে পাওয়া যাচ্ছে না প্ল্যানটা তৎক্ষণাৎ আমার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। সত্যান্বেষীর বেশ ধরে মালহত্রার ঘরে ঢুকে টাকা-ভর্তি ব্রিফকেসটা হাসিল করতে অসুবিধে হোল না। তখনকার দিনে দু লাক টাকা অনেক টাকা। একটা অসুবিধে ছিল যদি মালহত্রা ফিরে আসে আর আমাকে চ্যালেঞ্জ করে তাহলে কি হবে। তার উত্তরও তৈরি ছিল।
“এই নিন আপনার ব্রিফকেস, আপনার টাকা সুরক্ষিত ছিল আমার কাছে আপনার অবর্তমানে।”
অনেকদিন পরে বুকটা আজ হাল্কা লাগছে। একটা ভারী পাথর নেমে গেছে। একটা সিগারেট ধরিয়ে সুখটান দিলাম তারপর ধোঁয়াটা জানলার বাইরে ছড়িয়ে দিলাম। ধোঁয়াটা ভাসতে ভাসতে একসময় সম্পূর্ণ মিলিয়ে গেল। তাকিয়ে রইলাম সেইদিকে অনেকক্ষণ। অজান্তে আমার মুখে ফুটে উঠল একটা পরিতৃপ্তির হাসি।