দেহজীবীর উপাখ্যান| ভয়ের দেশ |চিরঞ্জিৎ সাহা| Bengali Horror Story
0 (0)

Getting your Trinity Audio player ready...

চাবি খুলে ফ্ল্যাটে ঢুকেই সুইগিতে রাতের খাবারটা অর্ডার করে দিল মধুজা। মধ্য জানুয়ারির প্রবল শীতেও উত্তেজনা ফুটছে ফারেনহাইটে। দীর্ঘদিন ধরে সযত্নে লালিত স্বপ্নকে ছোঁয়ার ঘোর কাটেনি এখনও। বহুকাঙ্খিত সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার এবার তার ক্যাবিনেটে। রাজধানীর সুসজ্জিত রবীন্দ্র ভবন অডিটোরিয়ামে বিভিন্ন ভাষার স্বনামধন্য সাহিত্যিকদের সাথে তাকেও গতকাল দুপুরে সংবর্ধিত করা হয়েছে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে মধুজাদেবীর এহেন সাফল্যে ভীষণ উচ্ছ্বসিত বাংলার সাহিত্যজগৎ। পুরস্কৃত কাব্যগ্রন্থ’দেহজীবীর উপাখ্যান’-এর বিক্রিও শেষ একমাসে রীতিমতো আকাশছোঁয়া। অ্যাকাডেমি পুরস্কার ঘোষণার পরদিন থেকেই সোশ্যাল মিডিয়া কিংবা নিউজ চ্যানেল – সর্বত্রই হটকেক স্কটিশ চার্চ কলেজের মনোবিজ্ঞান বিভাগের স্বনামধন্য অধ্যাপিকা মধুজা সেন রচিত “দেহজীবীর উপাখ্যান।” সমালোচকদের মুগ্ধতার পারদ চড়ছে রোজ। নতুন নতুন বিশেষণের পালক জুড়ছে মধুজাদেবীর মুকুটে। পূর্বে বেশ কয়েকটি যৌথ সংকলনে তার লেখা প্রকাশিত হলেও একক কাব্যগ্রন্থ এই প্রথমবার আর অভিষেকেই রাজকীয় বাজিমাৎ। প্রকাশনার দায়িত্বে থাকা’উল্লাস’-এর মালিক উৎসব ঘোষও রীতিমতো উল্লসিত দেহজীবীর উপাখ্যানের এই অভাবনীয় সাফল্যে।

পুরস্কার পর্ব মিটতেই বিমান ধরে সোজা দমদম এয়ারপোর্ট; সেখান থেকে ব্যক্তিগত গাড়িতে সল্টলেক সেক্টর থ্রি। লিফটে চড়ে ‘আরবানা’ টাওয়ারের তেত্রিশ নম্বর ফ্লোর। ঘরে ঢুকে সবার প্রথমেই লাগেজ থেকে স্মারকটা বের করে আলতো চুমু আর তারপর ঢুকিয়ে দেওয়া সুদৃশ্য ট্রফি ক্যাবিনেটে। বেশ কড়া একটা কফি বানিয়ে নিয়ে ডিনার অর্ডার সুইগিতে। ঘড়ির কাঁটা দশটা পেরিয়েছে ততক্ষণে। কুয়াশার চাদরে মোড়া গোটা শহর। ফেসবুক খুলে আজকের ছবিগুলো একে একে আপলোড করে দিল মধুজা। কয়েক সেকেন্ডেই লাইক আর কমেন্টের বন্যা। বিদেশি বন্ধুর সংখ্যাও শেষ একমাসে বেড়েছে বেশ। ‘দেহজীবীর উপাখ্যান’-এর প্রতি পাতায় এক সমকামী আদিবাসীর নারীর প্রেমজ আকুতি নাড়িয়ে দিয়েছে গোটা বিশ্বকে। হঠাৎ আসা সাফল্যে মধুজার জীবন বদলে গেছে অনেকটাই। জনপ্রিয়তা বাড়ছে এক্সেলেরেটরে।

বেজে উঠল ডোরবেল। আপাদমস্তক শীতবস্ত্রে নিজেকে মুড়ে হাজির সুইগির ডেলিভারি বয়। ফয়েলে মোড়া সুস্বাদু, গরম খাবারগুলো একে একে মধুজা সংগ্রহ করল তার শীর্ণকায় ঠাণ্ডা হাত থেকে। বিল পেমেন্ট করা ছিল আগেই। খাবারের গন্ধে ম ম করছে গোটা ঘর। খিদেও পেয়েছে খুব। বিরিয়ানির স্বাদটা সত্যিই আজ এক অন্য উচ্চতায়। বেড়ে রেঁধেছে বটে রেস্তোঁরার রাঁধুনি। বিরিয়ানির সেন্টের সাথে এত সুন্দর করে মহুয়ার গন্ধটা মিশিয়েছে যে পুরুলিয়া না সল্টলেক বোঝা সত্যিই দায়। সাথে রয়েছে জিভে জল আনা ইয়াব্বড়ো চিকেন তন্দুরি। সমস্ত খাবারেই ভীষণ চেনা এক মেঠো সুবাস। গোটা রান্নাটাই যেন হয়েছে মাটির হাঁড়ি আর বাঁশের জ্বালানিতে। গত শীতে পুরুলিয়ার বিলাসবহুল রিসর্টে এমন স্বাদ শেষবার পেয়েছিল মধুজা। তারপর আজ আবার নিজের ফ্ল্যাটের ডাইনিং টেবিলে। সৌজন্যে সুইগি আর বিরিয়ানি প্যালেসের অচেনা রাঁধুনি। খাওয়া শেষে তৃপ্তির চোঁয়া ঢেঁকুর এল প্রায় এক সপ্তাহ পর। হাত ধুয়ে রামের একটা পেগ হাতে মোবাইল নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল মধুজা। কাল কলেজ থেকে ফেরার পথেই বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে আসতে হবে মেয়েটাকে। পুরস্কার ঘোষণার পরদিন থেকেই শুভানুধ্যায়ী আর সাংবাদিকদের ভিড় লেগেই রয়েছে ফ্ল্যাটে। পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী অন্বেষার পড়াশোনায় যাতে এসবের কোনো প্রভাব না পড়ে, তাই দিন কুড়ি আগেই রাসবিহারীতে নিজের মায়ের কাছে তাকে রেখে এসেছে দায়িত্বশীলা মধুজা। কতদিন দেখা হয় না নিজের মেয়েটার সাথে। আজই লাস্ট পেপারের এক্সাম ছিল ওর। কাল বিকেলে মায়ের হাত ধরে মেয়ে ফিরবে ঘরে। তারপর দু’জন মিলে জমিয়ে সেলিব্রেশন। এই বিরিয়ানিটাই অর্ডার করতে হবে আবারও।

গ্লাসের মদে শেষ চুমুকটা দিয়ে বাথরুমের দিকে পা বাড়াতেই ঘরের নিভন্ত আলোয় সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কারটার সামনে অকস্মাৎ থমকে দাঁড়াল মধুজা। ট্রফির গায়ে বিন্দু বিন্দু জল। দুয়েক জায়গায় কেমন যেন পোড়া পোড়া দাগ! হাতে তুলে নিতেই নাকে এসে লাগল জুঁই ফুলের সুবাস। বেশ চমকে গেছে মধুজা। মঞ্চে স্মারক হাতে নেওয়ার মুহূর্তে তো এমন কিছু চোখে পড়েনি তার। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে টলমল পায়ে এগিয়ে চলল বাথরুমের দিকে। একে দুদিনের জার্নি, তার ওপর ভরপেট খাওয়া, নেশাটাও আজ একটু বেশিই হয়ে গেছে; হয়তো সে কারণেই…. ফিরে এসে সেলফোনটা চার্জে গুঁজতে যেতেই ঠোঁটে মৃদু হাসি খেলে গেল অধ্যাপিকার। ঘড়ির কাঁটায় তখন একটা ছুঁইছুঁই। হোয়াটস অ্যাপ থ্রেডে ভেসে উঠল স্নেহলতাদির মেসেজ। স্নেহলতা সান্যাল, বর্তমান বাংলা সাহিত্যের নিঃসন্দেহে জনপ্রিয়তম মুখ। টানা দশ বছর ধরে বেস্ট সেলার তালিকা জুড়ে রয়েছে তার একের পর এক কালজয়ী উপন্যাস। দিল্লি এয়ারপোর্টে স্নেহলতাদির সাথে দেখা হওয়ামাত্রই নিজের পুরস্কারপ্রাপ্ত বই’দেহজীবীর উপাখ্যান’তার হাতে তুলে দিতে ভুল করেনি মধুজা। আজ তারই রিভিউ মেসেজে লিখেছেন স্নেহলতাদি —

“আমি রীতিমতো মুগ্ধ মধুজা। এভাবেও যে কেউ প্রেমকে ব্যাখ্যা করতে পারে, সত্যিই তা আমার কল্পনার বাইরে। এত নিখুঁত বিশ্লেষণ, এমন জীবন্ত উপমা – বাংলা সাহিত্য উজ্জ্বল এক নক্ষত্রকে পেতে চলেছে আবারও। আমি তোমার প্রেমে পড়তে চাই বারবার।”

—“অসংখ্য ধন্যবাদ স্নেহলতাদি। কৃতজ্ঞতা আন্তরিক। তোমরাই তো আমার পাথেয় গো।”

—“সমগ্র কাব্যটা যেন যোনির গন্ধে ভরপুর। যৌনতার শিহরণে এক মায়াবী সাহারা। তোমার ঋতুর রক্তে আমি নিজেকে তৃপ্ত করতে চাই, মধুজা।”

—“আমি গাঁদা হলে তুমি লাল গোলাপ, দিদি। এখনও সুইট সিক্সটিন বলে চালিয়ে দেওয়া যাবে অনায়াসে।”

—“আমি তো গাঁদার পাপড়িই শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মেখে নিতে চাই। তৃতীয় কবিতার মতোই মালী হতে চাই তোমার স্তনবৃন্তে।”

—“পারবে গোটা ফুলের সুবাস একবারে নিতে?”

—“ভিডিও কলটা করেই দেখো!”

কল করতেই মধুজা আবিষ্কার করল পূর্ণনগ্ন স্নেহলতাদিকে। কোন এক অজানা শিহরণে স্নেহলতাদির শরীরের প্রতিটি খাঁজ তীব্র মোহাবেশে আকর্ষণ করছে মধুজাকে। ট্রফির জুঁইফুলের গন্ধটাও প্রকট হচ্ছে ক্রমে। যোনি ভিজে গেছে কামরসে। নিজের ওপর যাবতীয় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে হ্যাঁচকা টানে নাইটিটা খুলে ফেলল মধুজা। চলতে থাকল নগ্ন দুই মহিলার প্রযুক্তিগত যৌনালাপ। ক্ষুধার্ত শিকারির মত দুজনেই যেন ছুটে চলেছে কামের মোহে। রাত তিনটে নাগাদ ফোনের চার্জ শেষমেষ ফুরিয়ে গেল মধুজার। পরদিন ভোরে ঘুম ভাঙল জানলার কাঁচ চুঁইয়ে ছিটকে আসা সূর্যের আলোতে। নিজেকে আজ ভীষণ অদ্ভুত লাগছে মধুজার। হঠাৎ মনে ভেসে উঠল গতকাল রাতের কথা। স্নেহলতাদির শরীরের প্রতি চরমতম দুর্বলতা সে অনুভব করছে এখনও। সদ্য পুরস্কৃত গোটা কাব্যে সমকামের জয়গান গাইলেও মানসিকভাবে মধুজা লেসবিয়ান নয় কিছুতেই। তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী স্বামী বছরের বেশিরভাগ সময় ব্যাঙ্গালোরে থাকলেও সম্পর্কে তাতে তাদের চিড় ধরেনি বিন্দুমাত্র। স্বামী স্বর্ণেন্দুর প্রতি যৌনকামনা বরাবরই বেশ তীব্র মধুজার। কিন্তু তার বদলে অন্য কোনো মেয়ের সাথে….. নাহ। এমনটা আগে কোনোদিন দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেনি মধুজা কিন্তু আজ স্নেহলতাদির শরীরের খাঁজগুলো তাকে টানছে ভীষণভাবে। উতলা মন সব ভুলে চাইছে নিবিড়তম সেক্সচ্যাট। নিজে মনোবিজ্ঞানী হওয়া সত্ত্বেও একরাতে এমন মানসিক পরিবর্তনের কারণ কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না মধুজা। বাথরুমে ফ্রেশ হতে গিয়েও আকুল হৃদয় ব্যাকুল স্নেহলতাদির উষ্ণ মেসেজের অপেক্ষায়।

ব্রেকফাস্ট সেরে কলেজের পথে রওনা হল অধ্যাপিকা। মাসি এসে কাজ সেরে দিয়ে গেছে সকালেই। গাড়িতে যেতেও যেতেও ছয় ইঞ্চির স্ক্রিনে প্রেমালাপ চলল দুজনের। নিজেকে ভীষণ অচেনা লাগছে মধুজার। সচেতনভাবে সমকাম থেকে শত হস্ত দূরে থাকা মেয়েটা বল্গাহীনভাবে স্নেহলতাদির দিকে ছুটে চলেছে কোনো এক অচিন মোহের আকর্ষণে। প্রবাসী ভারতীয়দের আয়োজিত জমকালো অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বর্তমানে সিডনিতে রয়েছেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক স্নেহলতা সান্যাল। ফিরতে ফিরতে আরও পনেরোটা দিন। তারপর দীঘার নির্জন কোনো এক ওয়ো রুমে একসাথে রাত কাটাবে ওরা দু’জন। এমনটাই প্রস্তাব দিলেন স্নেহলতাদি। লুফে নিতে দেরি করেনি মধুজাও।

কলেজ থেকে ফেরার পথে বাপের বাড়িতেই লাঞ্চ সারল অধ্যাপিকা। মেয়েও স্কুল থেকে চলে এসেছে ততক্ষণে। বিকেলে বাড়ি ফিরেই ফোন করল স্বামী স্বর্ণেন্দুকে। আধঘণ্টা টানা কথা বললেও আগের সেই তাগিদ যেন কিছুতেই আর পাচ্ছে না মধুজা। স্বর্ণেন্দুকে ভীষণ বোরিং লাগছে তার। বারবার ভেসে উঠছে স্নেহলতাদির শরীর। স্নেহলতাদির ভিডিও কলের আকর্ষণেই শেষমেষ ফোনটা কাটতে বাধ্য হল মধুজা। দিল্লি যাওয়ার আগেই’দেহজীবীর উপাখ্যান’-এর একটা কপি মধুজা ক্যুরিয়ার করে দিয়েছিল স্বামীর ঠিকানায়। স্বর্ণেন্দু সেটা গিফট করবে কোম্পানির বাঙালি ম্যানেজার সায়ন মুখার্জিকে। কপি এসে পৌঁছেছে একটু আগেই। পিয়নের হাত থেকে বইটা নিয়ে ম্যানেজারের ঘরের দিকে রওনা হল স্বর্ণেন্দু।

ভিডিও কলে নগ্ন ছবির আবদার জানালেন স্নেহলতাদি। মেয়ে পাশে থাকায় বিষয়টি প্রাথমিকভাবে এড়িয়ে গেলেও নিজস্ব শারীরিক চাহিদাতেই শেষমেষ বাথরুমে গিয়ে রিং ব্যাক করতে বাধ্য হল মধুজা। নিষিদ্ধতার কিছুটা আদানপ্রদানের পর অনলাইনে ক্লাস টানা দেড় ঘণ্টা। ততক্ষণে সন্ধ্যে নেমেছে শীতের শহরে। কালকের রাত পোহালেই মেয়ের জন্মদিন। কান ঢাকা টুপি পরে মেয়েকে নিয়ে তাই বেরিয়ে পড়া মার্কেটিংয়ে। শপিং মল থেকে বেকারি – সর্বত্রই সদ্য সেলেব্রেটির তকমা বেশ উপভোগ করছে মধুজা। অন্বেষাও ভীষণ খুশি মায়ের এই হঠাৎ জনপ্রিয়তায়। বেলুন, ক্যাডবেরি, জামা-কাপড় আর ঢাউস কেক হাতে মা-মেয়েতে ঢুকে পড়ল তন্দুর হাউসে। মধুজাদেবীকে দেখামাত্রই সমস্ত খাবার পুরোপুরি ফ্রি করে দিলেন রেস্তোরাঁর ম্যানেজার। সাহিত্যে তার বিশেষ অনুরাগ না থাকলেও খবরে কাগজে মধুজাদেবীর সাফল্যের কথা পড়েছেন তিনি। প্রস্তাব দিয়ে রাখলেন ভবিষ্যতে তাদের হয়ে একটি অ্যাড শ্যুট করে দেওয়ার। সম্মতি জানালেন মধুজাদেবীও।

ফ্ল্যাটে ঢুকতেই বিকট একটা ইঁদুর মরার গন্ধ এসে লাগল নাকে। অনেক খুঁজেও মা-মেয়ে ইঁদুরের কোনো চিহ্ন পেল না ঘরে। দরজা জানলা খুলে দিয়েছে সব। আস্তে আস্তে গন্ধটাও কমে এসেছে অনেক। বরং, এবার নাকে এসে লাগছে হাঁড়িয়ার প্রকট গন্ধ। খুব অস্বস্তি বোধ করছে অন্বেষা। ভয় লাগছে মধুজারও। ফ্লোরের কেয়ারটেকারকে আজ অবধি কখনও নেশা করতে দেখেনি সে। তার ওপর দোষ চাপানোটাও তাই যুক্তিযুক্ত হবে না কিছুতেই। এরই মাঝে হঠাৎ করে বেজে উঠল রিংটোন। মন্ত্রমুগ্ধের মতো পোশাক না বদলেই ফোন হাতে মধুজা চলে গেল পাশের ঘরে। এক ঘণ্টার ওপর ডার্টি টক চলল স্নেহলতাদির সাথে। এ ঘরে ফিরতেই হাঁড়িয়ার গন্ধকে ছাপিয়ে একটা আঁশটে গন্ধ এসে ঝাপটা মারল নাকে। খাটে মেলা একটা বইয়ের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে অন্বেষা। হাত তার যোনিতে। সাথে জোরালো শীৎকারের শব্দ। মাত্র বারো বছরের মেয়েকে এভাবে দেখে রীতিমতো স্তম্ভিত মধুজা। কাছে যেতেই চোখে পড়ল নগ্ন মেয়ের প্রচ্ছদে —‘দেহজীবীর উপাখ্যান’। মাকে দেখামাত্রই বইটা লুকোনোর চেষ্টা করলেও শেষমেষ ব্যর্থ হল অন্বেষা। মধুজার ধমকে অবশেষে জানাতে বাধ্য হল, সহপাঠী ইন্দুমতী গতকাল পরীক্ষার শেষে তাকে উপহার দিয়েছে এই বই। সাথে একটা চিরকুট —‘বনমালী তুমি, পরজনমে হইও রাধা।’ হাতের লেখাটা চেনা চেনা লাগলেও কিছুতেই ঠিক ধরতে পারছে না মধুজা। অবশ্য চেনার কথাও না। শেষ দুবছরে মেয়ের স্কুলে একবারও পা রাখেনি সে। এই বয়সের মেয়ে সহপাঠীকে সমকাম শেখাচ্ছে ভেবেই গা-টা শিরশির করে উঠল তার। পুরো ডেঁপোমির চূড়ান্ত…. প্রিন্সিপালকে সমস্তটা জানানোর কথা ভাবলেও নিজের সদ্য পুরস্কৃত বইয়ের সাফল্যের কথা ভেবেই পিছিয়ে আসতে বাধ্য হলেন নির্দ্বিধায় – ইতিমধ্যেই সমাজ তাকে দেখতে শুরু করেছে, সমকামী আন্দোলনের লড়াকু মুখ হিসেবে। এসময় এমন হঠকারী সিদ্ধান্ত ঠিক হবে না কিছুতেই। ভাবতে ভাবতে হঠাৎই চোখ আটকে গেল হোয়াটস অ্যাপ থ্রেডে। একটা লেসবিয়ান সেক্স ক্লিপ পাঠিয়েছে স্নেহলতাদি। শরীরে আনন্দের শিহরন খেলে গেল মধুজার। সম্মোহিত হরিণীর ন্যায় ডুব দিল কামের অতল সাগরে। সন্ধ্যে থেকে প্রায় সাতবার ফোন করেছে স্বর্ণেন্দু। কিন্তু বরের সাথে প্রেমালাপ আজকাল ভীষণ বিরক্তিকর মনে হয় মধুজার।

ঘুম থেকে উঠতে বেশ দেরি হল সকালে। রুটিন-মাফিক স্বর্ণেন্দুর ফোন রিসিভ করল মধুজা। কাল বিকেলেই ম্যানেজারের হাতে বইটা তুলে দিয়েছে স্বর্ণেন্দু। রিভিউ আসবে আজ। তাড়াহুড়ো করে রেডি হয়ে কলেজে রওনা হল মধুজা। ডাবল শিফটে এক্সাম ডিউটি। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে ছটা। মেয়ের স্কুল থেকেও ছুটি দিয়েছে এক সপ্তাহ। বাড়িতেই কাটবে ওর সারাটা দিন। সঙ্গে আছে মালতী মাসি। মধুজা ফিরলে তারপর বাড়ি যাবে সে। অন্বেষাকে অঙ্কের দুটো চ্যাপ্টার করতে দিয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল মধুজা। ব্যাগে রয়েছে গতকাল মেয়ের কাছ থেকে উদ্ধার করা —’দেহজীবীর উপাখ্যান।’ ডিউটির চাপে সারাদিনে আর ফোন করা হয়ে ওঠেনি স্নেহলতাদিকে। ওনার নিজেরও রাজকীয় প্রোগ্রাম আজ সিডনিতে। বাথরুমে গিয়ে একবার মনে পড়লেও নম্বরটা আর ডায়াল করেনি মধুজা। তাড়া ছিল তার নিজেরও।

বাড়ি ফিরে কলিং বেল টিপতেই দরজাটা খুলে বেরিয়ে গেল মাসি। টিফিন সেরেই মধুজা নেমে পড়বে ঘর সাজাতে। রাত পোহালেই একমাত্র মেয়ের জন্মদিন বলে কথা। সারাদিন কাল শুধু জম্পেশ সেলিব্রেশন। রাতে সমস্ত আত্মীয়-পরিজন আর দুপুরে স্কুলের বন্ধুরা। আসবে অন্বেষার বেস্টফ্রেন্ড ইন্দুমতীও। ঘরে পা দিতেই একটা চেনা সুর যেন দমকা হাওয়ার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল মধুজার কানে —“কালো জলে কুচলা তলে ডুবল সনাতন / আজ সারানা কাল সারানা পাই যে দরশন …”

—“এই গান তুই কোথায় শিখলি অণু?”- চেঁচিয়ে উঠল মধুজা।

—“মা, ইন্দুমতী ….”

—“কে এই ইন্দুমতী? কাল আসবে ও?”- ধমকের সুর মধুজার গলায়।

—“হুমম। আসবে। ও আমার বেস্টফ্রেন্ড মা। গায়ের রংটা একটু কালো, কিন্তু মনটা খুব ভালো।”

ভীষণ চিন্তিত লাগছে মধুজাকে। মাথায় প্রথমবারের জন্য নাড়া দিচ্ছে একটা অজানা আশঙ্কা। বাথরুমে ফ্রেশ হতে গেল অধ্যাপিকা। বেরিয়ে এল হঠাৎ বেজে ওঠা মোবাইলের শব্দে। শিগগিরি টিভি খুলে নিউজ চ্যানেলে চোখ রাখতে বললেন কলেজের এক কলিগ। রিমোট দিয়ে অন করতেই —“ভাইরাল হওয়া ভিডিওয়ের জের। বহুতল থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মঘাতী টেকসলভের উচ্চপদস্থ কর্মী। আজ দুপুরে হঠাৎই ভাইরাল হয় সংস্থার ম্যানেজার সায়ন মুখার্জি আর কর্মী স্বর্ণেন্দু সেনের একটি অন্তরঙ্গ মুহূর্ত। বস্ত্রহীন অবস্থায় ছিলেন দুজনেই। প্রসঙ্গত, এই স্বর্ণেন্দু সেন বিখ্যাত সাহিত্যিক মধুজা সেনের স্বামী। ম্যানেজারের চেম্বারে মিলেছে মধুজাদেবীর আলোড়ন সৃষ্টিকারী বই’দেহজীবীর উপাখ্যান’। অফিসের কোনো এক কর্মী দুজনের অজান্তেই ভিডিওটি গোপনে রেকর্ড করে ফেক অ্যাকাউন্ট থেকে ইউটিউবে ছেড়ে দেয় বলে অনুমান পুলিশের আর সেটি দেখামাত্রই লোকলজ্জায় আত্মঘাতী হন স্বর্ণেন্দুবাবু। গোটা এলাকা সিল করে দিয়েছে পুলিশ। ইতিমধ্যেই তদন্তে নেমেছে সাইবার সেল।”

দমবন্ধ হয়ে আসছে মধুজার। এলোপাথারিভাবে হাতরে চলেছে ফোনের কিপ্যাড। কলেজে থাকাকালীন প্রায় দশবার ফোন করেছিল স্বর্ণেন্দু। কিন্তু ফোন সাইলেন্ট থাকায় রিসিভ করা হয়ে ওঠেনি তখন। পাশের ঘর থেকে উত্তেজিতভাবে হঠাৎ ছুটে এল অন্বেষা। কাল তার জন্মদিন আর মা এখনও ঘর সাজানোর তোরজোড় শুরু না করায় ভীষণ বিরক্ত সে। কিন্তু মায়ের ঘরে পা রাখতে না রাখতেই বেজে উঠল ডোরবেল। ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত দশটা। বিধ্বস্ত মধুজা কাঁপা হাতে কোনোক্রমে দরজাটা খুলতেই মেরুদণ্ডে হিমেল স্রোত বয়ে গেল তার। মাকে ঠেলে “ইন্দুমতী, ইন্দুমতী” বলে ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে এল অন্বেষা। অবশ হয়ে আসা হাতদুটো দিয়ে কোনোরকম বাধাই যেন দিতে পারল না মধুজা। ইন্দুমতীর হাতের বাক্সে ফ্রায়েড রাইসের ওপর ছড়ানো ইঁদুরের মাংস আর চিংড়ি মাছ। মুখে গান —”চিংড়ি মাছের ভিতর করাত তাই ঢালেছি ঘি,

নিজের হাতে ভাব ছেড়েছি ভাবলে হবে কি?”

দৌড়ে এসে ইন্দুমতীর ঠোঁটে নিজের ঠোঁটদুটোকে সযত্নে সঁপে দেওয়ার সাথেসাথেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ল অন্বেষা। গান থামিয়ে ইন্দু চিৎকার করে উঠল — “জন্ম আর মৃত্যুদিন এক হলে কেমন লাগে ম্যাম, এবার বুঝতে পারছেন?”

ঘোলা ঘোলা চোখে মধুজার সামনে ভেসে উঠছে বছর পনেরো আগের এক মলিন দৃশ্য। মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপিকা হিসেবে স্কটিশ চার্চ কলেজে তখন সবে জয়েন করেছে সে। হঠাৎই চোখ পড়ে প্রথম বর্ষের ছাত্রী ইরিয়ানা হেমব্রমের ওপর। পুরুলিয়ার আদিবাসী পল্লী থেকে স্কটিশ চার্চে পড়তে এসেছিল মেয়েটা। থাকত হস্টেলে। ওর সাবলীল লেখার হাত দ্রুতই নজরে আসে মধুজার। বয়সের স্বল্পতার কারণে সকল ছাত্রছাত্রীর সাথেই বন্ধুর মতো মিশত নতুন ম্যাম। মনোবিজ্ঞানে ডক্টরেট মধুজা অল্পদিনেই বুঝতে পারে যে, ইরিয়ানা বিকৃতকামের অধিকারী। ছেলেদের বদলে মেয়েদের শরীর ভীষণভাবে টানে ওকে। ততদিনে কলেজ ম্যাগাজিনে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে ইরিয়ানার লেখা। সাহিত্যানুরাগী মধুজা ছেলেবেলা থেকে বহু চেষ্টা করেও এমন লেখা লিখতে পারেনি কোনোদিন। অগত্যা, ইরিয়ানাকে সে ফাঁসাল মিথ্যে প্রেমের জালে। নিজেকে তার সামনে উপস্থাপিত করল সমকামীরূপে। কলেজ শেষে শহরের প্রান্তিক কোনো পার্ক কিংবা হোটেলে প্রায়শই গোপনে দেখা করত দুজনে। নিজে সমকামী না হওয়া সত্ত্বেও মনোবিজ্ঞানের কৃতি ছাত্রী হওয়ার দরুন ইরিয়ানার মনের স্তরগুলো মধুজা উপলব্ধি করতে পারত দারুণভাবে। মুখে ক্লোরোমিন্ট গুঁজে চুমুও খেয়েছিল দুয়েকটা। সবটাই ছিল আদতে ইরিয়ানার যাবতীয় সাহিত্যসৃষ্টিকে নিজের হস্তগত করার সুচতুর কৌশল। বই প্রকাশের নেশায় তখন মশগুল মধুজা। নিজের পিরিয়ডের রক্ত দিয়ে প্রতি মাসে দুটো করে চিঠি ইরিয়ানা উপহার দিত মধুজাকে আর সেগুলোর সংকলিত রূপই আজ “দেহজীবীর উপাখ্যান।” এরপর থার্ড ইয়ারের শেষদিকে হঠাৎই গোটা কলেজ জুড়ে রটে যায় বাংলার বিভাগীয় প্রধান প্রীতম সেনগুপ্তের সাথে অধ্যাপিকা মধুজার সম্পর্কের কথা। ইরিয়ানার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। ক্লাসের করিডরে মধুজাকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করতেই ইরিয়ানাকে বিকেলে সে ডেকে পাঠায় নিজের ফ্ল্যাটে। দিনটা ছিল ইরিয়ানার জন্মদিন। আদিবাসী মেয়েটা ফ্ল্যাটে পৌঁছতেই নিজের উন্মুক্ত যোনির গন্ধে ওকে পাগল করে তোলে মধুজা। গলায় ঢেলে দেয় কয়েক পেগ কাঁচা মদ। হাতে ইনজেক্ট করে ড্রাগ। তারপর লিফট করে নিচে নামিয়ে ছেড়ে দেয় রাস্তায়। কয়েক পা এগোতেই লরি এসে পিষে দিয়ে যায় ইরিয়ানাকে। পরদিন ফলাও করে সমস্ত দৈনিকে ছাপা হয় নেশাসক্ত আদিবাসী ছাত্রীর পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যুর খবর। মৃত্যুসংবাদ সমেত মরদেহ বাড়িতে পৌঁছতেই মেয়ের ড্রাগ সেবনের অপরাধে আদিবাসী জনজাতির মোড়ল গ্রাম থেকে বিতাড়িত করে ইরিয়ানার মা-বাবাকে। তারপর তারা চলে আসে কলকাতায়। পনেরো বছর ধরে হোটেলে হোটেলে রান্নার কাজে সহায়তা করে ইরিয়ানার বাবা। এখন তার ঠিকানা সল্টলেকের এক মাঝারি মাপের রেস্তোরাঁ। মহুয়ার গন্ধ মিশিয়ে অদ্ভুত এক স্টাইলে বিরিয়ানিটা বানান তিনি।

প্রীতমবাবুর সাথে সম্পর্কটা শেষমেষ পরিণতি পায়নি মধুজার। বদলে বিয়ে হয় টেকসলভের সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার স্বর্ণেন্দুর সাথে। অফিসের কাজে বছরের বেশিরভাগ সময়টাই বাইরে কাটত ওর। তথাপি, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে ছিল এক অকৃত্রিম উষ্ণতা।

জীবনের চুয়াল্লিশটা বসন্ত পেরিয়ে আসার পর গতমাসে সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্তি মধুজার, যার সম্পূর্ণ পাণ্ডুলিপিই আদতে ইরিয়ানার। বই প্রকাশের পর থেকেই প্রতিশোধের ভূত তাই মাথায় চাপে আদিবাসী মেয়েটার অতৃপ্ত আত্মার। সুযোগটা সে খুঁজছিল বহুদিন ধরেই। ইন্দুমতীর ছদ্মবেশে মাস তিনেক আগে ঢুকে পড়া মধুজার মেয়ে অন্বেষার স্কুলে। অন্বেষা ছাড়া ওকে দেখতে পেত না কেউ। নাম ছিল না স্কুলের রেজিস্টারেও। ক্রমে সে হয়ে ওঠে অন্বেষার বেস্টফ্রেন্ড। মধুজা দিল্লি থেকে ফেরার পর থেকেই ইরিয়ানা রোজ বাতাসে ভেসে ঢুকতে থাকে ওর ফ্ল্যাটে। কিন্তু পিরিয়ড চলায় বারবারই বেঁচে যায় মধুজা। আসলে, ঋতুকালীন স্রাব বরাবরই ভীষণ প্রিয় ছিল ইরিয়ানার, চরমতম শত্রুরও বিন্দুমাত্র ক্ষতি সে করে না সেসময়। নিজের উপহারের প্রতিটি কবিতাও তাই রাঙিয়েছিল ঋতুস্রাবের লাল রক্তে। কিন্তু গতকালই পিরিয়ড শেষ হয়েছে মধুজার। নিজের চুড়িদার খুলে নগ্ন ইন্দুমতী তাই ঝাঁপিয়ে পড়ল মধুজার ওপর। বিষাক্ত কামড় বসাল যোনিতে। যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে একসময় থেমে গেল মধুজার স্পন্দন। বহুতলের জানলা ভেঙে পঞ্চভূতে ক্রমে বিলীন হয়ে গেল ইন্দুমতীরূপী ইরিয়ানা। মর্ত্যলোকে রেখে গেল’দেহজীবীর উপাখ্যান’-এর মতো এক অভিশপ্ত কাব্যগ্রন্থ। যার প্রতিটা পাতা ওল্টানোর সাথেসাথেই ইরিয়ানার ন্যায় বিকৃত যৌনক্ষুধা তথা সমকামের তীব্র আকুতি একটু একটু প্রবেশ করে পাঠকের শরীরে। স্থায়ী হয় বেশ কয়েক সপ্তাহ।

গত তিনবছরে কলকাতা শহরে ঘটে যাওয়া তিনশোটির ওপর অপমৃত্যুর ঘটনার সাথে জড়িয়ে রয়েছে বিকৃতকাম আর প্রতারণার গল্প; বডির আশেপাশেই মিলেছে ভালোবেসে প্রতারিত এক আদিবাসীর যোনির রক্তে রচিত মধুজা সেনের ‘দেহজীবীর উপাখ্যান’- এক সমকামী আদিবাসীর আত্মকাব্য, ভালোবাসতে ভালোবাসতে নিঃশেষিত হওয়ার কাব্য, প্রতারণায় ভরা কংক্রিটের শহরে মহুয়ার সুবাস ছড়ানোর কাব্য। সমকামীদের ঘৃণ্য চোখে দেখা তথাকথিত এলিট সমাজকে বিকৃতকামের জোয়ারে ভাসিয়ে ধ্বংসের এক চিরজীবী গাথা হয়ে কলকাতার বুকে রয়ে গেল’দেহজীবীর উপাখ্যান।

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post দোলনা | ভয়ের দেশ |আশিস চক্রবর্তী| Bengali Horror Story
Next post দুর্যোগের একটি রাত| ভয়ের দেশ |সুব্রত মজুমদার| Bengali Horror Story