পুরোনো জিনিস কেনা বেচার ওয়েবসাইটে রীতিমতো প্রায় প্রত্যেকদিন সন্ধ্যে বেলা চোখ বোলানো আমার দীর্ঘদিনের অভ্যেস। ঘরে বেশ অনেক জিনিস ইতিমধ্যে এসেও গিয়েছে ওখান থেকেই। কোন কিছু পছন্দ হলে এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে ওদের প্রক্রিয়া অনুযায়ী, বিজ্ঞাপন দাতার সঙ্গে যোগাযোগ করে কিনে ফেলি।
পুরোনো জিনিস ঘরে তোলার এক উপরি ফায়দা হলো, বস্তুটির সঙ্গে জড়িত স্মৃতি, ঘটনা, সব বাড়ি এসে পৌঁছয়। আর সেটা আবিষ্কার করতে পারলে আলাদা ভালো লাগা এসে জোটে। সে কারণে পুরোনো কিছু কিনলে আমি সর্বদা সেই বস্তুটির খানিকটা ইতিহাস জানতে চাই বিক্রয় কর্তার কাছ থেকে। এ সবের মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় হলো গত বছর কেনা বীর দেশ নায়ক সুভাষ বোসের পাথরের মূর্তিটি। মূর্তিটির নির্মাণ করেছেন একজন স্বাধীনতা সংগ্রামীর সন্তান, বিখ্যাত দক্ষিণী ভাস্কর্য শিল্পী শ্রী যুক্ত রামানুজ গোপালাচারী। এক নজরেই সেটি দেখলে মোহিত হয়ে যেতে হয়। বর্তমানে সেই অতুলনীয় মূর্তিটি আমার শোবার ঘরের টেবিলে আশ্রয় নিয়ে আমার ঘরের শোভা বর্ধন করে চলেছে।
শনিবার দিন সন্ধে বেলায় এরকম ই একটা বিজ্ঞাপন দেখে আমার চোখটা আটকে গেলো। বিজ্ঞাপন টা ছিল একটা দোলনার। অপূর্ব কারুকার্যে সজ্জিত বৃহৎ আকৃতির দোলনা টি। বিক্রেতা যে কটি ছবি ওয়েবসাইটে আপলোড করেছেন প্রত্যেকটির মধ্যে এক অদ্ভুত আকর্ষণ রয়েছে। সৌন্দর্যে চোখ ধাঁধিয়ে যাবার জোগাড়। এর বয়েস অধিক হলেও তার যৌবন কাল যেন অতিক্রান্ত হয়নি। নকশার বৈচিত্র্য দেখলে সহজেই অনুমান করাই যায় বস্তুটি দুঁদে শিল্পী দ্বারা নির্মিত। নিম্নে দেয়া ফোন নাম্বারে কল করে বিজ্ঞাপনে উল্লেখ্য নামটি বলতেই ওপাশ থেকে এক ভদ্রলোক বললেন — ইয়েস স্পিকিং।
গলার স্বর ভারী। আমি বললাম — আপনি বাঙালি?
— হ্যাঁ! এদেশীয়।
— আপনার বিজ্ঞাপনে দেয়া দামটা কি ফিক্সড?
— অবশ্যই নয়, আপনি এক কাজ করুন সামনের রবিবার বিকেলে আমার এখানে চলে আসুন। জিনিসটাকে নিজের চোখে দেখেও নেবেন আর দাম নিয়ে কিছু বলার থাকলে সামনা সামনিই ভালো। আমি আমার প্রপার ঠিকানা আপনার এই নম্বরে টেক্সট করে দিচ্ছি।
— ওকে।
বলে ফোন কাটতেই মিনিট খানিকের মধ্যে ঠিকানাটা এসে গেল। ভদ্রলোকের পুরোনাম সমরেশ সান্যাল। বিজ্ঞাপনে এস এস লিখেছিলেন ভদ্রলোক। বাড়ি মুর্শিদাবাদ জেলার আজিমগঞ্জ। আমার এখন থেকে তিন ঘণ্টার পথ। ঠিকানায় যা উল্লেখ ছিল সে মাফিক পৌঁছাতে বিশেষ অসুবিধে হয়নি। ডোর বেল টিপতেই এক জন বেরিয়ে প্রাথমিক কিছু জিজ্ঞাসা বাদ করে বসার ঘরে নিয়ে গিয়ে বসতে দিল। আশপাশ চাইলে সহজেই বোঝা যায় বেশ সম্ভ্রান্ত আর সচ্ছল পরিবার। কোনরকম দায়ে পড়ে দোলনা টা বেচতে তিনি রাজি হননি নিশ্চয়। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে আরও কিছু পুরোনো সৌখিন বেশ মূল্যবান বস্তুও চোখে পড়েছে। মিনিট পাঁচেক পর দু কাপ চা সামনের টেবিলে রেখে চলে গেল আরও একজন লোক। পরক্ষণেই ঘরে ঢুকল সমরেশ বাবু। এসেই হাত জোড় করে বললেন– আমিই বিজ্ঞাপন টা দিয়েছিলাম।
ভদ্রলোকের বয়েস ষাটোর্ধ। লম্বা স্বাস্থ্যবান। কাঁচা পাকা মাথা ভর্তি চুল। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। পরনে পাঞ্জাবী। এসেই উল্টো দিকের সোফায় বসে চা এর কাপটা তুলে নিয়ে বললেন — কোথা থেকে আসা হচ্ছে?
আমার নাম ঠিকানা কর্ম সকল জানার পর বললেন — জিনিসটা দেখবেন নিশ্চয়?
আমি সম্মতি দিলে উঠে পড়ে বললেন –চলুন ওদিক টাই। তারপর কয়েকটা ঘর টপকে ডাইনিং এর পাশ থেকে সিঁড়ির পাক দণ্ডী পেরিয়ে একেবারে উঠে পড়লাম তে তলার ছাদে। উঠেই চোখে পড়লো দোলনা টা। মাথার ওপর শেড দেয়া বিশাল আকৃতির দোলনা। কোথাও এক ফোঁটা ও খুঁত নেই। এতক্ষণে বুঝলাম ছবিতে এর আসল সৌন্দর্য কিছুই ধরা পড়েনি। আমাকে আশ্চর্য দৃষ্টি নিয়ে বস্তু টিকে পর্যবেক্ষণে করতে দেখে সমরেশ বাবু বললেন — আপনার মনে ধরে গেছে নিশ্চয়?
আমি হাসলে তিনি বললেন — বিজ্ঞাপন দেয়ার পর আপনিই প্রথম কাস্টমার যে এটাকে ছুঁয়ে দেখছে। কাল রাত্রে কয়েকজন ফোন করেছিল বটে। তবে আপনার কথা শুনে বেশ পজিটিভ বলে মনে হয়েছে বলেই ওদের না করে দিই।
— ভালোই করেছেন। জিনিসটা আমিই নেবো। — বললাম আমি।
— এ জিনিস কারো অপছন্দ হবে না। এসব এখন পাবেন কোথায়? আমি জন্মে থেকে এটাকে এভাবেই দেখছি। বংশের কে কবে কোথা থেকে এটাকে আনিয়ে ছিলেন বলতে পারবো না। এতো বছর হয়ে গেলেও কোথাও একটা চটে যাওয়া বা ঘষা খাওয়ার চিহ্ন পাবেন না।
— আমার অনুমান এটা ব্যবহার ও হয়নি।
একথা শোনার পর ভদ্রলোক খানিক চুপ মেরে গেলেন। তারপর বললেন — আপনাকে সম্পূর্ণ ব্যাপারটা খুলে বলায় ভালো। কারণ আমি তো আর ব্যবসাদার নয়। নেহাত কিছু মনের ভাবনার বশীভূত হয়েই একপ্রকার এটাকে ছেড়ে দিচ্ছি এটা ভাবতে পারেন।
সমরেশ বাবুর কথা গুলো ভেতরে জাবর কাটলে বললাম — ভাবনা টা কি রকম?
— জানি আপনার মতো শিক্ষিত মানুষের কাছে ওসবের কোনো মূল্য নেই। আপনি সেটাকে কু সংস্কার হিসেবেও মানতে পারেন। আসলে এ দোলনায় বংশের কেউ ই সেরকম চড়েনি। এমনকি আমিও না। আমার পরিবার বাইরে থাকে, তারা তো এটিকে চোখেও দেখেনি। এই বাড়ি আমার পূর্ব পুরুষের ভিটে। বাবার মুখে শুনেছিলাম এই দোলনায় আমার ঠাকুরদা একবার মাত্র চড়ে রাত্রে খোলা আকাশের দিকে চেয়ে তারা খসা দেখছিলেন। সে রাতে তিনি আর নীচে নামেন নি। সকাল বেলা বাড়ির লোক তাঁকে উন্মাদ অবস্থায় আবিষ্কার করেন। ওনার এই অবস্থার পর এই দোলনা এক প্রকার পরিত্যক্ত অবস্থাতেই ছিল বেশ কিছু কাল। আমি যখন পড়াশোনার জন্য দেশের বাইরে যায়, হঠাৎ একদিন সেখান থেকে শুনি আমার মাকে আর পাওয়া যাচ্ছে না। তড়িঘড়ি সেখান থেকে ফিরে এসে শুনি, শেষ বার মাকে এই দোলনা তেই দুলতে দেখা গিয়েছিল। তারপর কত থানা পুলিশ কিছুতেই কোনো হদিশ পাওয়া গেলনা আজ অব্ধি। এখন আমরা তাঁকে মৃত বলেই ধরে নিয়েছি। এরপর ও আমি এটাকে অপয়া বা অলৌকিক বস্তু বলে মনে করিনি। কিন্তু আমার সমস্ত শিক্ষা বিশ্বাস কে আঘাত হানলো মাস দুয়েক আগের ঘটনা টা।
দম নেবার জন্য সমরেশ বাবু খানিক থামলে আমি জিজ্ঞাসা করলাম– কি সেই ঘটনা?
সমরেশ বাবু ঢোক গিলে বললেন — আমার বাড়ির পুরোনো চাকর ভোলা কে গত দু মাস আগে এই দোলনার ওপর মরে পরে থাকতে দেখে আমি এটিকে বাড়ি থেকে দূরে সরানোর কথা ভাবি। এসব আপনাকে বলে ফেললাম কারণ আমি একজন সাধারণ নির্ভেজাল মানুষ। আজ অব্ধি কারো ক্ষতি আমি জ্ঞানত করিনি। আমার মাধ্যমে আপনার ক্ষতি হোক এ আমি চাইনা। এখন সিদ্ধান্ত আপনার।
আমি সবটা শুনে ভাবলাম একটা নিষ্প্রাণ দোলনা বংশ পরম্পরায় বাড়িতে রয়েছে আর ওতে চড়ে বসেই সকলের ক্ষতি হয়েছে এ যুক্তি মেনে নেয়া যায়না। দুর্ঘটনার প্রাক্কালে প্রত্যেকে চড়েছে এটা কাকতালীয় ব্যাপার। কিংবা এও হতে পারে ওনার নিকট কোনো মানুষ এই লোভনীয় বস্তুটিকে হাতানোর উদ্দেশ্যে এরকম ঘটনা সমরেশ বাবুর মাথায় ঢুকিয়ে থাকতে পারেন। ওটিকে জড়িয়ে অদ্ভুতুড়ে কাহিনী রটিয়েও থাকতে পারেন। গৃহ ত্যাগী অনেক মহিলাই তো পৃথিবীতে রয়েছে, ভোলাকে কেউ মেরে দোলনায় শুয়ে দিয়ে থাকলে আশ্চর্য হবার কি আছে? ঠাকুরদা সারা রাত জেগে তারা খসা দেখবেন, এই ব্যাপার টিই তো সব চেয়ে বড় পাগলামি। না! এই তিনটি ঘটনার সঙ্গে কোনভাবেই দোলনার যোগাযোগ নেই। সুতরাং এটি আমি কিনছি এটাই ফাইনাল। এতসব ভেবে সমরেশ বাবুকে বললাম — দাম টা কত দেব বলুন?
সমরেশ বাবু কপালের ঘাম রুমালে মুছে ফেলে বললেন — কিছুটা কমিয়ে যা ইচ্ছে হয় দেন। বিক্রির ব্যাপারে আপনাকে খোলসা করে আগেই তো সব বলে ফেলেছি, এরপরে আর দর দামে আটকাবে না।
বস্তুটির প্রাচীনত্ব, শিল্প পরিচয় অনুযায়ী যে রেটে সেটিকে আয়ত্ত করে ফেললাম তা কল্পনাতীত। কয়েক জন লোক ডাকিয়ে সেটিকে শেড সমেত ধরাধরি করে গাড়িতে তুলে বাড়ি পৌঁছাতে রাত হলো। বাড়ি পৌঁছে দেরি আর সহ্য হয়না, এক্ষুনি তাতে চড়ে বসি, যেন চাইছে মন। ছুটে গিয়ে প্রায় ঘুমন্ত অবস্থা থেকে তুলে দু চার জন লোক ডেকে সেটিকে সেটিং করাতে করাতে রাত এক-টা পাড় হলো। উপরি কিছু পয়সা দিয়ে লোকদের ছেড়ে দিলাম। আমার ঘরের ডাইনিং পেরিয়ে যে বৃহৎ আকৃতির বারান্দা রয়েছে ওখানেই ওটিকে জায়গা করে দিলাম। বারান্দা থেকে সামনে তাকালে পূর্বে গাছ পালা ঘেরা জলাশয় দেখা যায়। ইচ্ছে, দোলনায় বসে রোজ ভোর বেলা সূর্য উদয় দেখবো। সারাদিনের ক্লান্তিতে খাওয়া সেরে ঘুমটা সহজেই এসে গেল। কয়েক ঘণ্টা ঘুমের পর হঠাৎ একটা শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল। ইন্দ্রিয় সজাগ হতেই শুনলাম দোলনা শব্দ ছেড়ে দুলছে। খানিকক্ষণ বিছানাতেই পড়ে শব্দ শুনতে লাগলাম। হম, ঠিক তাই, দোলনায় তো দুলছে! শব্দ টা ডাইনিং ছাড়িয়ে ঘরের জানলা দরজার ফাঁক ফোকর দিয়ে কানে পৌঁছচ্ছে। উঠে গিয়ে বাইরের দিকের জানলা খুলে দেখি না, সেরকম ঝড়ো হাওয়া নেই যে তার বেগে ধাক্কা খেয়ে দোলনা টা দুলবে! তবে? চোর ঢুকলো নাকি? ওরকম একটা মহা মূল্য বান বস্তু পাতলা গ্রিল দেয়া বারান্দায় বসানোটা মুর্খামি করেছি এই ভেবে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম বারান্দার দিকে। বারান্দায় প্রবেশের দরজার কাছে দাঁড়াতেই দোলনার দোলার শব্দের সঙ্গে আরও কিছু শব্দ কানে ভেসে এলো। দুই রকমের শব্দ। এক, কেউ যেন বেশ জোর দিয়েই বারান্দার মেঝে তে পায়ের ধাক্কা মেরে দোলনায় দুলছে। আর দুই, তার সঙ্গে নারী পুরুষের মিশ্রিত হাসির কণ্ঠস্বর। আশ্চর্য! এতো রাত্রে কারা ঢুকলো ঘরে? বাইরে চাঁদ ডোবার সময় হয়ে এসেছে। তবে আলোটা জোরালো। দরজায় আতস কাঁচ বসানো ছিদ্র দিয়ে বারান্দায় তাকিয়ে দেখি। একজন বেশ শক্ত সামর্থ্য জোয়ান লোক দোলনার পিছনে দাঁড়িয়ে সমানে সেটিকে ঠেলছে আর দোলনায় বসে দোল খাচ্ছে একজন পুরুষ আর একজন নারী। প্রত্যেকের চেহারা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। স্ফটিকের মত জ্বলন্ত চোখ নিয়ে গগন বিদারী কণ্ঠে হেসে চলেছে ওরা। পুরুষটির মুখ-ভর্তি দাঁড়ি রয়েছে। অগোছালো বিশ্রী দাঁতের পাটি সামনের দিকে প্রসারিত। বয়স্কা মেয়েটি এলোমেলো লকলকে সাপের ফণার মতো চুল বিছিয়ে রেখেছে তার সর্বাঙ্গে। দোলনার দুলুনিতে অন্ধকার ছেড়ে সমানে উড়ছে। এরা কারা? সমরেশ বাবুর ঠাকুরদার দাঁড়ি ছিল সেটা ওনার বাড়ির দেয়ালে টাঙানো ছবিতে দেখেছি। । আর বাকি দু’জন তাহলে কি ওনার মা আর চাকর ভোলা?এর বেশি চাঁদের আলোয় কিছু দেখা যাচ্ছে না। গভীর ঘুম থেকে উঠে ঢুলু ঢুলু চোখে আমি কি ভুল দেখছি? তাহলে কানে প্রবেশ করছে যে শব্দ সেও কি ভুল? ধীরে ধীরে তিনজনই বীভৎস ক্রুর জ্বলন্ত দৃষ্টি নিয়ে আমার সামনের দরজার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে সমানে হেসে চলেছে। একপলকে দেখলে মনে হয় ওরা প্রত্যেকেই আমাকে যেন দেখতে পাচ্ছে। ভয়ে আমার সর্বাঙ্গ দিয়ে একটা হিমেল স্রোত যেন খেলে গেল। হৃৎপিণ্ড বুকের ভেতর লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে। মাথা থেকে ঝরে পড়ছে ঘাম। খানিক বাদে ওরা দোলনা ছেড়ে দরজার দিকে আসতে লাগলো। প্রাণ ভয়ে খানিকটা পিছিয়ে হাত বাড়িয়ে বারান্দার লাইট টা জ্বেলে পুনরায় দরজায় চোখ রাখতেই দেখি সব উধাও। দোলনা স্থির। এক মুহূর্তে কয়েকটা নিশাচর বিকট শব্দে চিৎকার করে উঠলো। আশে পাশের ঝোপ ঝাড় থেকে সশব্দে সরে পড়লো হিংস্র শিকারিরা। চোখের দৃষ্টি সূক্ষ্ম করেও আর ওদের দেখতে পায়নি। তাহলে এতক্ষণ আমি কি ভুল দেখছিলাম? সবটাই হ্যালুসিনেশন কি?হতেও পারে! সমরেশ বাবুর তার পরিবার আর দোলনার সঙ্গে জড়িয়ে যে কথা গুলো বলছিলেন সে সব না বিশ্বাস করলেও মাথায় খেলা করেছিল অনেক ক্ষণ। তাছাড়া জার্নি আর ঘুমের ঘাটতি তে মাথা গরম হয়ে গিয়ে এরকম কিছু একটা ঘটে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়!
পরদিন সকাল বেলা এরকম একটা দুষ্প্রাপ্য শৈল্পিক বহুমূল্যের জিনিস বারান্দা রাখা নিরাপদ হবে না ভেবে লোকজন পুনরায় ডাকিয়ে ডাইনিং এর এক কোনে তুলে বসালাম। সুবৃহৎ ডাইনিং হল এর এতে শোভা টা অনেকটাই বাড়লো। তারপর সারাদিন অফিসে কাটিয়ে সন্ধেয় বাড়ি ফিরে সদর দরজার কাছে এসে লক খুলতে যাবো, এমন সময় ঘরের ভেতর থেকে আবার সেই দোলনা দোলার শব্দ। দরজায় কান পাতলে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে শব্দ টা। কেউ তাতে বসে দুলে দুলে এর সুখ উপভোগ করছে। হাতের চাবিটা খুব সাবধানে আবার পকেটে চালান করে দিলাম। আস্তে আস্তে সদর দরজা থেকে সরে বাড়ির একপাশে এসে ঘরের জানলা খুলে, উঁকি দিয়ে দেখি, হ্যাঁ ঠিক!দোলনা দুলে চলেছে। নিভন্ত সূর্যের আলোয় মুখ বোঝা যায়না, তবে দোলনার সর্বাঙ্গ জুড়ে এক মেয়ে শুয়ে রয়েছে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। উন্মুক্ত চুলের গোছা মেঝেতে দুলে দুলে স্পর্শ করে চলেছে। শাড়ির আঁচল হাওয়ায় দোলনার গতির বিপরীতে উড়ছে। দৃশ্য টা যতটা সম্ভব দেখে থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। কে এই আগন্তুক নারী? বন্ধ দরজা ডিঙিয়ে ঢুকলোই বা কিভাবে? একরাশ প্রশ্ন আর দুশ্চিন্তা নিয়ে ছুটে এসে সদর দরজা খুলে ডাইনিং এ পৌঁছে দেখি সব উধাও। দোলনা স্থির। কোথায় গেল সে? এঘর সেঘর ছাদের সিঁড়ির অব্ধি গিয়েও তার দেখা নেই। শূন্য ঘর আমার দিকে যেন অবাক দৃষ্টি দিয়ে চেয়ে আছে। পোশাক ছেড়ে বাথরুমে ঢুকে যখন সারাদিনের ক্লান্তি দূষণ ধুয়ে ফেলবার জন্য মুখে জলের ঝাপটা দিচ্ছি, আবার সে শব্দ! দোলনাটা দুলছে, তবে খুব আস্তে। তাড়াহুড়ো করে দরজা খুলে দেখি দুলছে বটে তবে তাতে কেউ চড়ে নেই। সামনের জানলা টা এর আগে যে আমি খুলে ডাইনিং এ চেয়ে ছিলাম সেখান থেকে একটা বাতাসের স্রোত ঢুকে দোলনা টাকে একবার নাড়িয়ে দিয়ে গেছে। নিজের মিথ্যে কৌতূহল ধরা পড়ায় একগাল হেসে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। রাতের খাবার সেরে ওটিতে শুয়ে একবার সজোরে দুলিয়ে দিয়ে স্মার্টফোনে চোখ মেলে অভ্যেস মতো ওয়েবসাইট ঘাঁটছি। বেশ আরাম দায়ক উপলব্ধি। শরীরের নার্ভ গুলোকে যেন আলতো করে ছুঁয়ে দিচ্ছে কেউ। সূক্ষ্ম একটা ঘন বাতাস যেন মাথার চুলের ফাঁকে বিলি কাটছে। ধীরে ধীরে স্বল্প স্পন্দনের একটা স্পার্ক যেন রোমাঞ্চ ধরাচ্ছে সর্বাঙ্গে। কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না। আচমকা অনুভব করলাম আমার বুকের ওপর নুইয়ে পড়া দুটো পা এর আঙ্গুল স্পর্শ করছে। বরফের মতো শীতল, দোদুল্যমান আঙ্গুল গুলি আমার সারা বুক ময় ঘোরা ফেরা করছে। সেই পা বরাবর দৃষ্টি উঠিয়ে দেখি দোলনার ওপরের কাঠামো থেকে একটি নারী শরীর ফাঁস লাগিয়ে ঝুলছে। কোমর অব্ধি বিস্তারিত চুলে সর্বাঙ্গে বিছিয়ে আছে। বিস্ফারিত কোটর থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসা রক্ত বর্ণের চোখ দুটো স্থির। ফ্যাকাসে জিভ থুতনি পেড়িয়ে ঝুলে আছে অনেকটা। নিথর হাত দুটো কাঁধ থেকে ঝুলে পড়েছে। ফাঁসের দড়িতে ঘাড় ভেঙে বেঁকিয়ে রয়েছে। তৎক্ষণাৎ লাফিয়ে উঠে পড়লে মৃত দেহটি খানিক দুলে উঠলো। পড়নে এক টুকরো কাপড়। কাপড়টি বিশেষ কায়দা করে হাঁটু থেকে বুকের ওপর পর্যন্ত ঢাকা রয়েছে। শরীরে অলংকার এর চিহ্ন নেই। ভয় আস্তে আস্তে ছেয়ে পড়লো সর্বাঙ্গে। নড়বার যেন শক্তি নেই। হৃৎপিণ্ডের গতি বেড়ে যাওয়ায় কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম এক মুহূর্তে জড়ো হয়ে পড়লো। অথচ শরীরে শীত শীত ভাব। জানলার থেকে হালকা বাতাস এলে পড়েই ঝুলন্ত দেহটা মৃদু মৃদু দুলে উঠছে। এদিকে অল্প একটু শ্বাস নেবার জন্য মুখ প্রসারিত করে বাতাস টেনে নিতে হচ্ছে আমাকে। কোন কিছু করে বসবার আগেই শুনলাম কারা যেন ভারী জুতোর মোটা শব্দ করে এগিয়ে আসছে ঘরের দিকেই। বন্ধ দরজা ভেদ করে কিভাবে প্রবেশ করলো এরা? আর কখনই বা ঢুকে পড়লো? আমার সামান্য ঘুমের অবসরে কি? হাজারো দুশ্চিন্তায়, আতঙ্কে মাথার শিরা ছিঁড়ে যাবার জোগাড়।
শব্দের গতি আরও কাছে এলে চরম বিপদের আশঙ্কায় সরে পড়লাম দরজার আড়ালে। সেখান থেকে উঁকি দিয়ে দেখি এক সাহেব চুরুট মুখে দিয়ে প্রবেশ করছে আর তার সঙ্গে একজন লোক। তবে পোশাক আশাক হাল ফ্যাশনের নয়। সাহেবের পড়নে পুরোনো আমলের লাল কোর্ট মাথায় সিপাহী দের টুপি। সঙ্গে আশা লোকটার গায়ে খদ্দরের ফতুয়া। কোমরে জড়ানো খাটো করে পড়া এক ফালি কাপড়ের টুকরো। দু কাঁধের থেকে ঝোলানো একটা বৃহৎ কাপড়ের ঝোলা। এরপর সাহেবটি লোকটাকে মেয়েটির ঝুলন্ত মৃত দেহ খানি দেখিয়ে ইংরেজি টানে বাংলায় বলল — ইহা হইতে তুমি কি বানাইতে পারিবে?
লোকটা লাশটার কাছে গিয়ে গা টিপে পরীক্ষা করে ফিরে এসে হাসি হাসি মুখ করে বললো — সাহেব ওর হাড় বেশ পুরু, অনেক কিছুই বানানো যেতে পারে, আবার খুব ভালো একটা জিনিস বানানো যেতে পারে।
সাহেব চুরুট টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বললো — কুইক! আমার আজিকেই চাই। আমার ওয়াইফ মেরীর ব্যর্থ ডে তে এই গিফট দিতে চায়।
লোকটা সাহেবের আদেশ পেয়ে ব্যাগে করে আনা অনেক গুলি কাঁচের শিশি মেঝেতে বিছিয়ে একটা বড় পাত্রে এক এক করে মেশাতে থাকলো। সেই দ্রবণ থেকে উঠে আসা উৎকট ঝাঁঝালো গন্ধ আর ধোঁয়া সারা ঘর ময় যেন ছড়িয়ে পড়লো এক মুহূর্তে। তারপর দেহ টিকে নামিয়ে মেঝে তে রেখে সম্পূর্ণ দ্রবণ নিথর দেহের ওপরে ঢালতেই তৎক্ষণাৎ রক্ত, মাংস, চুল, কাপড় সব গলে গিয়ে উন্মুক্ত হয়ে পড়লো একটা সাদা ধবধবে কঙ্কাল। এক নিমিষেই যেন সমস্ত পেলব মাংস পিণ্ড কর্পূরের মতো হাওয়ায় অদৃশ্য হয়ে গেল। দরজার আড়াল থেকে শ্বাস রুদ্ধ অবস্থায় সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে পাথর বনে গেলাম। এরপর লোকটা ঝুলি থেকে একে একে ক্ষুদ্র বৃহৎ সরঞ্জাম বার করে খুট খাট শব্দে কর্মে লিপ্ত হলো। প্রথমে সমস্ত জোড় থেকে হাড় গুলি খুলে ফেলে মেঝেতে জড়ো করলো। সাহেব তখন সোফায় গা এলিয়ে চুরুটে নিমগ্ন। লোকটা মেয়েটির সমস্ত হাড় খুলে নিয়ে নিপুণ শিল্পীদের মতো যেন কি একটা তৈরি করছে। সময় যত অতিবাহিত হচ্ছে আস্তে আস্তে রূপ পাচ্ছে সেই সফেদ বস্তুটির ভাস্কর্য। সূক্ষ্ম ভাবে একের পর এক টুকরো হাড় জোড়া দিয়ে ক্রমে ক্রমে আকার পাচ্ছে বৃহৎ কিছু। বুকের পাঁজর খানা মেঝেতে পেতে তার ওপর দুই পাশে উরু ও পা এর হাড় দিয়ে এমন ভাবে সেজে উঠেছে যেন এক পলকে দেখলে মনে হবে হাতির দাঁতের কারুকার্য। বাহু পা এর হাড়, হাত পা এর অঙ্গুলই কোনো কিছুই শিল্প কর্মে বাদ পড়ছে না। খুট খাট শব্দ আর নিপুণ কলা নৈপুণ্যে শিল্প কর্ম শেষ হলে বস্তুটির পূর্ণাঙ্গ রূপ দেখে আমার বুকের ভেতরে ধড়াস করে উঠে যেন একটা পাথর চাপা পড়লো। চোখের শিরা বুঝি ফেটে যায় সে দৃশ্যে। মেরুদণ্ড বেয়ে একটা কাঁপুনি যেন মুহুর্মুহু ওঠা নামা করছে। এ কি দেখছি আমি! এও কি সম্ভব! মাথার ভেতরের চিন্তার শেষ না হতেই কানের পাশটায় শুনলাম — সব সম্ভব। তুমি এখন তোমার কৌতূহল, অবশিষ্ট সাহস আর অসমাপ্ত কর্তব্যের বশীভূত হয়ে সময়ের দ্বার খুলে ফেলেছো।
ভেসে আসা কথার দিকে মুখ ফিরিয়ে দেখি সেই মৃত ঝুলন্ত মেয়েটি দাঁড়িয়ে রয়েছে আমার ঠিক পাশেই। গলায় জমা চাপ চাপ রক্তের দাগ। এ মুখ আমি আগেও কোথায় যেন দেখেছি, তবে জীবিত অবস্থায়। আমি আঁতকে উঠে ভয়ে দেয়ালে সেটে পড়লে, মেয়েটি চুপ থাকার ইশারা দিয়ে হাতের নির্দেশ দিয়ে বললো — এই দিকে!
আমি মন্ত্র মুগ্ধের মতো এগিয়ে গেলাম তার পিছু পিছু। তারপর পাশের ঘরে ঢুকেই মেয়েটি বলতে শুরু করলো — ওই সাহেবের নাম হ্যামিল্টন উড। আমি যে সময়ের কথা বলছি তখন মাস্টারদার আদর্শে স্থানে স্থানে গড়ে উঠছে বিপ্লবীদের গুপ্ত সমিতি। ভারত মাতার শৃঙ্খল মোচনের জন্য তরুণ যুবকদের তখন সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে লাল মুখো সাহেবদের সিপাহী রা। এই শয়তান কুখ্যাত সাহেব কে ইংল্যান্ডের থেকে আনা হয়েছে বিপ্লবীদের দমন করতে। বিপ্লবীদের ধরে ধরে হত্যা করে লাশ উধাও করে দেয় এই পিশাচ। আমি নিজে একজন মাস্টারদার আদর্শে অনুপ্রাণিত বিপ্লবী ছিলাম। দলের নির্দেশে আমি হ্যামিল্টন সাহেব কে মারতে গিয়েছিলাম কাজের মেয়ের ছদ্মবেশে ওর বাংলোতে। উদ্দেশ্য ছিল খাবারে বিষ মিশিয়ে শেষ করবো নিষ্ঠুর সাহেবকে। কিন্তু সাহেব তার কৃত কর্মের জন্য সর্বদা সতর্ক থাকতো। তাই নিজের পোষা কুকুরকে খাবার খাইয়ে সে খাবার খেতো প্রতিদিন। এটা আমাদের কারো জানা ছিলনা। শেষ টাই আমি ধরা পড়ে যায়। আমাকে আঘাত করে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে দেয় সাহেব। ওতেই আমার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর আমি এই হিংস্র সাহেবের নৃশংসতার আসল ব্যাপার জানতে পারি। কেন বিপ্লবী বীর সন্তানদের লাশ পাওয়া যায়না। সেই সময় বাংলায় পশুর হাড় দ্বারা নির্মিত শিল্পের রমরমা বাজার ছিল। সেই সমস্ত শিল্প কর্ম বিদেশে রপ্তানি করা হতো। সাহেবের সঙ্গে যে রয়েছে, ওই বেঈমান শিল্পী সেরকম ই এ দেশের ভাস্কর্য শিল্পী। অর্থের লোভে বিপ্লবীদের হাড় দিয়ে সাহেবের জন্য তৈরি করে এক একটা ভাস্কর্য। আর সেগুলি শিল্পের নামে চালান হয়ে যায় ইংল্যান্ড। ওতে এমন ভাবে পালিশ করা হয়, যা দেখে মনে হয় হাতির দাঁতের ভাস্কর্য। আগে পশুর হাড় দিয়ে ও এই জাতীয় শিল্প কলা ও তৈরি করতো। ওর তাতে পসার না জমলে এই নিষ্ঠুর সাহেবের ষড়যন্ত্র এ সামিল হয়ে বিপ্লবীদের হাড়কে শিল্প কর্মের কাজে লাগায়। ওই দুজনে তৈরি করেছে দেশের বীর বিপ্লবীদের মৃত্যুর কারখানা। দেশের আসল শত্রু এই দুজনেই। দেশের লোকজন ঠিক এভাবেই ইংরেজ শাসক দের পদলেহন না করলে কবেই এ দেশ স্বাধীন হতো।
এ নির্মম কাহিনীর শোনার পর আমার শরীর থেকে কর্পূরের মত ভয় উড়ে গিয়ে প্রতিশোধ স্পৃহা জন্মে উঠলো। চোখ মুখ সর্বাঙ্গ দিয়ে যেন আগুন ঝরে পড়ছে আমার। এক মুহূর্তে সেই সাহেবের আর তার সাগরেদ এর বুকে বুলেট গুঁজে দিতে পারলে যেন ভেতরের আগুন শান্ত হয়। এরকমই ভাবছি মেয়েটি আবার বলে উঠলো– ঠিক তাই। এখনই উত্তম সময় এগিয়ে যাও, আমিও ওই সাহেবকে খতম করতেই চেয়েছিলাম। পারিনি!
মেয়েটির অতৃপ্ত আত্মা আমার মনের কথা শুনে ফেলতে পারছে। এটা এর আগেও আমি টের পেয়েছি।
বিপ্লবী মেয়েটি আবার বলে উঠলো– এর আগে যারাই ওই দোলনায় চড়ে বসেছিল তাদের আমি বোঝাতে চেয়েছিলাম বিপ্লবী সংগ্রামের কথা। কিন্তু …
কথা শেষ না করতে দিয়েই আমি তাকে ইশারা দিয়ে ডাকলাম ডাইনিং এর দিকে। সেখানে গিয়ে দেখি দোলনা সম্পূর্ণ প্রস্তুত, এখন তাতে পালিশ আর রং চড়ছে। ঘরের টেবিলে রাখা অনলাইন থেকে কেনা পাথরের প্রিয় সুভাষ বোসের মূর্তিটা ডান হাতে তুলে নিয়ে সাহেবের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই সাহেব সোফা থেকে লাফিয়ে উঠে চুরুট ফেলে বললো — হোয়াট! হাও ইট’স পসিবল! গৌতম, ইউ আর অ্যালাইভ? ইম্পসিবল! আমি নিজে তোমার বুকে গুলি করিয়াছি।
সঙ্গে সঙ্গে কর্মরত লোকটা তীব্র আর্তনাদ করে বুকের বাম দিকে হাত রেখে মেঝেতে উল্টে পড়ে গেল।
সাহেবের চোখে চোখ রাখতেই মনে হলো এর সম্মুখীন এর আগেও হয়েছি। এক মুহূর্ত দেরি না করে, বহুদিনের সঞ্চিত ক্রোধ জোয়ালামুখীর মতো উগরে, পাথরের মূর্তি দিয়ে সাহেবের মাথার ওপর বার বার আঘাত করে রক্ত বন্যা বহিয়ে দিলাম। পরক্ষণেই সাহেবের নিথর দেহ সশব্দে আছড়ে পড়ে রইল মেঝেতে। আমার রাগ যেন তবু থামেনা। হাতের কাছে একটা বন্দুক পেলে যেন বুকটা ঝাঁঝরা করে দিতে পারলে শান্তি আসে। যেন কবে থেকেই জমে থাকা একরাশ ক্রোধ কিছুতেই ফুরিয়ে যেতে চাইনা। কয়েক মিনিট পর মৃত দেহের দিকে তাকালে চেহারা টা আবারো ভীষণ চেনা মনে হতে লাগলো। তবে ঘৃণা, তীব্র একটা ঘৃণা আমার পিছু কিছুতেই ছাড়ছে না। এরপর মেয়েটির আত্মাকে জিজ্ঞাসা করলাম — সাহেব আমাকে দেখে গৌতম ভাবলো কেন, এই গৌতম টা কে?
মেয়েটি বললো — আমাদের বিপ্লবী সমিতির একজন কর্মী, যে সাহেবকে হত্যা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়, । সাহেব তাকে হত্যা করে লাশ গায়েব করে দিয়েছিল।
তারপর খানিক চুপ থেকে মেয়েটি আবার বলল — গৌতম আর তোমার চেহারা এক।
আমি অবাক হয়ে মেয়েটির দিকে চাইতেই বাতাসে মিলিয়ে গেল সে। আমার দুচোখ আপনা হতেই বুঝে গেল। কতক্ষণ পর সে চোখ খুলে ছিল জানি না। চোখ খুলে দেখি আমি দোলনায় দুলছি। হুসমুসিয়ে উঠে চোখ কচলে দেখি কোথাও কিছু নেই। শূন্য ঘর আমাকে যেন গিলে খেতে আসছে। তাহলে এতক্ষণ কি স্বপ্ন দেখছিলাম? না! এ কি করে সম্ভব? তাহলে সমরেশ বাবুর কথা গুলি কি সত্যি? এই দোলনা কি অপয়া! অভিশপ্ত! অলৌকিক! নাকি মৃত্যু পুরীর রাস্তা? লক্ষ্য করলাম ডান হাতের চেটোতে সামান্য ব্যথা। ভয়ংকর স্বপ্নের রেশ কিছুতেই যেন কাটে না। মাথার ভেতর যেন এখনো বুদবুদ কাটছে। উঠে গিয়ে চোখ মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে বাথরুমের আয়নায় দৃষ্টি ফেলে দেখি জামায় রক্তের ছিটে!বিস্ফারিত চোখ আর ঝুলে পড়া চোয়াল নিয়ে টলতে টলতে ঘরে ফিরে টেবিলের ওপর রাখা সুভাষ বোসের পাথরের মূর্তিটির দিকে চোখ পড়তেই দেখি সেটি রক্ত মেখে জবজব করছে!! নজর ঘুরিয়ে দোলনার ওপর ফেলতেই দেখলাম সেটা দুলে উঠলো। দোদুল্যমান দোলনার দিকে নিষ্পলক ভাবে চেয়ে থেকে আমার পুরাণে বর্ণিত বৃত্রাসুর বধের জন্য দধীচি মুনির আত্মা ত্যাগের কথা মনে পড়ে গেল।