সমুদ্র সৈকত এখন বেশ ফাঁকা। সকালে ভিড় ছিল স্নানের, দুপুরের দিক থেকে একেবারেই ফাঁকা হয়ে এসেছে সৈকত। কবজি উল্টে হাতঘড়িটা দেখে ধৈবত—তিনটে বাজল। আবার বিকেল হলেই লোকজনের আনাগোনা শুরু হবে। ধৈবতের অবশ্য লোকজনের ভিড় একবারেই পছন্দ নয়। আর সেই কারণেই হোটেল থেকে পালিয়ে এসেছে কাউকে কিছু না বলে। নির্জন বেলাভূমিতে বসে বসে এলোমেলো কত কথা মনে আসছে। গ্র্যাজুয়েশনের ফাইনাল পরীক্ষা শেষে এখানেই তো এসেছিল ওরা পাঁচজনে।
আজ সকালেই মন্দারমণি পৌঁছেছে ধৈবত। বর্ষা আর দেবাশিসের বিয়ে। ডেস্টিনেশন ওয়েডিং। মন্দারমণিতে রিসেপশন। অন্য যে কারোর বিয়ে হলে এড়িয়ে যেত ধৈবত, কোনও না কোনও বাহানায়। কিন্তু বর্ষা আর দেবাশিসের ক্ষেত্রে সেটা কোনওভাবেই সম্ভব ছিল না। সেই ক্লাস ফাইভ থেকে দেবাশিস, বর্ষা, ধৈবত, কৃশানু আর আমলকি — পাঁচজনের বন্ধুত্ব। আজও চারজন সেই একইভাবে একে অন্যের সাথে জুড়ে আছে, শুধু আমলকিই হারিয়ে গেছে। আর আমলকির সাথে সাথে ধৈবতের জীবনের সমস্ত আলো, রং, খুশি, স্বপ্নও হারিয়ে গেছে।
— কি রে, এখানে বসে আছিস একা একা…, কৃশানুর কথায় চমকে ওঠে ধৈবত।
— এই আর কি। তুই তো জানিস ভাই, হৈ চৈ,হাসি- মজা-হুল্লোড় আমার আর ভালো লাগে না।
— আমি বুঝি তোর কষ্টটা ধৈবত। কম দিন তো হল না বল, তিনটে বছর।
তিনটে বছর। অথচ ধৈবতের এখনও মনে হয় যে ও সেই মুহূর্তেই দাঁড়িয়ে আছে, সেই মুহূর্তকে ঘিরেই বাঁচছে।
কতবার বারণ করেছিল ধৈবত আমলকিকে, যাস না এভাবে একা একা। একটু সময় দে, নতুন চাকরি — একটু সামলে নিয়ে ছুটি পেলেই পাহাড়ে যাব, দু’জনে একসঙ্গে।
কিছুতেই শুনল না।
কী যেন সামার ক্যাম্প না কী ছিল। রাগারাগি করে ডিটেইলে কিছু শোনেওনি ধৈবত। এখন আফসোস করে, কেন শোনেনি।
— আমলকির না-থাকাটা এবার তো মেনে নিতেই হবে রে তোকে…, কৃশানু ধৈবতের পাশে বসতে বসতে বলে।
— নাআআআ।
কিছুতেই না। হতে পারে না। তুই জানিস না? আমলকির ডেডবডি পাওয়া গিয়েছিল কি? ও নিশ্চয়ই বেঁচে আছে কৃশানু। দেখিস, একদিন না একদিন ঠিক খুঁজে বের করব আমি আমলকিকে।
— কেন পাগলামি করছিস ধৈবত! তোর মনে নেই, কী বলেছিল পুলিশ, হাসপাতাল, এমনকি স্থানীয় বাসিন্দারাও। ঐ দুর্ঘটনায় কোনও মানুষের বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। আর ডেডবডির কথা বলছিস! বিয়াস কী ভীষণ খরস্রোতা, তুই জানিস না? কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে চলে গেছে…
— প্লিজ কৃশানু, আমাকে আমার বিশ্বাস নিয়ে বাঁচতে দে।
— একটা মিথ্যা বিশ্বাস আঁকড়ে ধরে তুই স্থবিরের মত জীবন কাটাবি, আর আমরা চুপ করে দেখব – কিছু বলতে পারব না তোকে! আমলকি ছাড়া তোর জীবনে আর কারোর কোনও মূল্য নেই! আরে আমাদের কথা বাদই দে, কাকু-কাকিমার কথা একবার মনে হয় না তোর? ওরা তোকে এভাবে দেখে কতখানি কষ্ট পায়, কখনও ভেবেছিস?
মৃত্যুকে কি কেউ অস্বীকার করতে পারে, নাকি পেরেছে? তোর সঙ্গে আমলকির বিয়ে হওয়ার পর যদি আমলকি মারা যেত – তুই কি এমনটাই করতিস!
— আমাকে জোর করিস না প্লিজ। আমি পারব না।, ধৈবত উঠে চলে যায় কৃশানুর পাশ থেকে।
কৃশানু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কী হবে ধৈবতের! এভাবেই বাকি জীবনটা কাটাবে?
আজকের দিনে যেখানে একটা ছেলে একসঙ্গে একাধিক প্রেমিকা, কেউ বা পরকীয়া করে জীবন কাটাচ্ছে, সেখানে ধৈবত আমলকির স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে দিনের পর দিন কাটিয়ে যাচ্ছে।
আচ্ছা, এমন কি একবারেই হতে পারে না যে আমলকি কোনওভাবে বেঁচে গিয়েছিল সেইদিন দুর্ঘটনায়? কিন্তু কী করে সম্ভব!
পাহাড়ি রাস্তা থেকে বিয়াসের জলে পড়েছিল গাড়িটা। খুব কম যাত্রীর মৃতদেহের খোঁজ পাওয়া সম্ভব হয়েছিল এবং যাদের খোঁজ পাওয়া যায়নি তাদেরও সরকারের পক্ষ থেকে শুরু করে পরিবারের সদস্য, সকলেই মৃত বলেই ধরে নিয়েছে।
নাহ, ধৈবতের সাথে সাথে কৃশানুও কী করে এমন ভুলভাল আশা করছে তাহলে…
আমলকি নেই, এটাই সত্যি।
* * *
সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনুষ্ঠানেই থাকতে হয়েছিল ধৈবতকে। তারপর অবশ্য রুমে চলে এসেছিল। মদ খাওয়ার নেশা কোনোদিন ই ছিল না, আজও নেই। অনেককে বলতে শুনেছে, নেশা করে দুঃখ ভুলে থাকা যায়। ওর কখনও সে ইচ্ছা হয়নি, বরং দুঃখের নেশাই ওকে আপন করে নিয়েছে। ব্যালকনিতে বসে বসে সমুদ্র দেখেছে অনেক রাত পর্যন্ত। ঢেউগুলো যেভাবে বালুতটে আছড়ে পড়ছে, অজস্র স্মৃতি ঠিক সেভাবেই ধৈবতের মনে এসে ভিড় করছে।
কৃশানুর কথাগুলোও কানে বাজছে বারবার। আমলকি নেই”! কী করে বিশ্বাস করবে ধৈবত! একবার যদি নিষ্প্রাণ দেহটাও দেখতে পেত — তাহলেও মেনে নিত। কিন্তু…
কে জানে, হয়তো ঠিকই বলে সবাই। আমলকি যদি বেঁচে থাকত তাহলে কি ওর বাবার সঙ্গে, ধৈবতের সঙ্গে তিনবছরে একবারও যোগাযোগ করত না? ওর বাবা যদিও কলকাতাতে থাকেন না, তাছাড়া ধৈবতের সঙ্গে খুব একটা যোগাযোগ কোনদিনই ছিল না, আজও নেই। আসলে আমলকির সঙ্গেও ওর বাবার সম্পর্ক খুব একটা সহজ বা মধুর ছিল না। মা আত্মহত্যা করার পর ওর বাবা একজনকে বিয়ে করে দিল্লি চলে যান। আমলকির ধারণা ঐ মহিলার সঙ্গে ওর বাবার সম্পর্ক থাকার কারণেই ওর মা আত্মহত্যা করেছেন। আর সেই কারণেই বাবার সঙ্গে একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছিল। যদিও সে ধারণা কতখানি সত্যি সে কথা ধৈবতের জানা নেই, কিংবা আমলকি বাবার সঙ্গে কখনও সহজ হতে পারত কিনা তাও জানা নেই — তবে এইসব কারণেই ওর পরিবারের সঙ্গে, অর্থাৎ ওর বাবা বা সৎ মায়ের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হয়ে ওঠেনি সেভাবে। কিন্তু তাও আমলকি যদি কোনওভাবে বেঁচে গিয়ে থাকে, যদি ওর বাবার কাছেও গিয়ে থাকে তাহলে কি ধৈবতের সঙ্গে যোগাযোগ করত। তাহলে হয়তো সত্যিই…
ধুস, সকাল সকাল এসব ভাবতে ভালো লাগছে না। আড়মোড়া ভেঙে পাশ ফিরে শুলো ধৈবত। কৃশানু পাশেই মরার মত ঘুমাচ্ছে। বেচারা! ফটোগ্রাফার হওয়ার কি শাস্তি। বহুরাত অবধি দেবাশিস আর বর্ষার ফটোসেশন চলেছে।
ঘুমোক আর একটু। আজ যদিও কোনও তাড়া নেই ওদের। দেবাশিস-বর্ষা, বাকি নিমন্ত্রিতরা আজ ফিরে গেলেও ধৈবত আর কৃশানু আজকের দিনটা থেকে আগামীকাল কলকাতা ফিরবে বলে ডিসাইড করেছে।
গায়ে একটা পাতলা চাদর জড়িয়ে ব্যলকনিতে এসে বসে ধৈবত। সি-বিচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আপনমনে উপভোগ করছে বেশ কিছু মানুষ। এই ছেলেমেয়েটাকে কাল থেকেই খেয়াল করছে ধৈবত। ভারি মিষ্টি জুটি, ভালোবাসায় বেঁধে বেঁধে আছে। ধৈবতের কপালে কেন সইল না ভালোবাসা!
— কি রে, অনেকক্ষণ উঠেছিস? ডাকিসনি কেন আমায়? বেশ কিছুক্ষণ পর কৃশানু এসে বসে পাশে।
— কাল কত রাতে ঘুমিয়েছিলি, তাই ভাবলাম ঘুমো আরাম করে, অল্প হেসে কৃশানুকে বলে ধৈবত।
— ভাই, সমুদ্রে এসে স্নান করব না? চল, চল…, কৃশানু তাড়া লাগায়।
— তুই যা, আমার ওসব ভালো লাগে না। ধৈবত পাশ কাটিয়ে যেতে চায়।
— আরে চল না…
অগত্যা, কৃশানুর জেদের কাছে হার মানে ধৈবত।
— স্নান করতে যাবি বলে আবার ক্যামেরা নিচ্ছিস কেন? বেজার মুখে কৃশানুকে জিজ্ঞেস করে ধৈবত।
— আর বলিস না, একটা ঝামেলায় আছি রে। তুই তো জানিস, পুনের যে কোম্পানিতে আছি এখন ওদের কাজগুলো একটু অন্যরকম বাকিদের থেকে। একটু গতানুগতিকতার বাইরে অন্যরকমভাবে ভাবে ওরা। ওদেরই একটা ম্যাগাজিনের আপকামিং প্রোজেক্টের থিম হল ভালোবাসা। তারই কভার পেজের ছবি লাগবে। সেই খোঁজেই রয়েছি এখন আমি। আর তারজন্যই ক্যামেরা সঙ্গে রাখা।
— ভালোবাসার ওপরে ছবি পাওয়া আবার কঠিন নাকি। কত কত ছবি পাবি…
— সেটাই তো।তারই মধ্যে কিছু আলাদা খুঁজে বের করতে হবে। আর সেটাই চ্যালেঞ্জ বুঝলি!
এনিওয়ে, চল তো, দেখি কিছু পাওয়া যায় কিনা…
ঘুরে ফিরে বেশ কিছু ছবি তোলা হল।ঐ ছেলেমেয়ে দু’জনের সঙ্গেও আলাপ হল। লাঞ্চের পর হোটেলের ঘরে ফিরে সেই যে ক্যামেরা আর ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে কৃশানু, তারপর থেকে আর কোনও হুঁশ জ্ঞান নেই। ধৈবত শেষে দুপুর পেরোতেই বেরিয়েছে, একাই। এলমেলো খানিক ঘোরাঘুরি করবে ভেবেই। সকাল হলেই তো কলকাতা ফিরে যাওয়া, আবার কাজের মধ্যে ডুবে যাওয়া, রোবটের মত বেঁচে থাকা। কতদিন পর বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হল। ভাগ্যিস এসেছিল।
সন্ধের বেশ খানিকটা পরে রুমে ফিরে দেখে কৃশানু নেই। রিসেপশনে রুমের চাবি আর একটা ছোট্ট চিঠি রেখে গেছে ধৈবতের জন্য।
“ভীষণ জরুরি একটা দরকারে গেলাম।”
কী বুঝবে এটুকু থেকে ধৈবত! ক্যামেরার কোনও সমস্যা? তাই যদি হয়, এখানে তো সেসব সারানো সম্ভব হবে না। তাহলে গেল কোথায় কৃশানু!
আচ্ছা, সত্যি নিজের ইচ্ছায় গিয়েছে তো? নাকি জোর করে তুলে নিয়ে গেল?
ধুর, কী সব ভাবছে ধৈবত বোকার মতো। কৃশানুকে কেউ কেন জোর করে তুলে নিয়ে যাবে, তাও আবার মন্দারমণিতে, হোটেলের ঘর থেকে!
নাহ, এসব আজেবাজে মোটেও ভাববে না। কৃশানু তো বরাবরই খামখেয়ালী। সেরকমই কিছু হবে। অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। ফিরলে খুব ঝামেলা করবে আজ ওর সঙ্গে।
রাত হতে চলল, এখনও কোনও পাত্তা নেই কৃশানুর। মোবাইলটাও তখন থেকে নট রিচেবেল। চিন্তায় পাগল পাগল লাগছে এবার।কাউকে ফোনে বেশিক্ষণ না পেলেই হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে ধৈবতের। আমলকির ফোনেও সেদিন সকাল থেকে নট রিচেবেল পেতে পেতে আর কখনও ওকে পাওয়াই হল না। ওর চলে যাওয়ার ট্রমাটা ধৈবত সারা জীবনেও কাটিয়ে উঠতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে।
দরজায় নক করছে কেউ।
ধৈবতের পা দু’টো যেন গেঁথে গেছে মাটির সঙ্গে। উঠে দরজা খুললেই যদি কোনও ভয়ংকর সংবাদ শুনতে হয়?
— আরে ভাই দরজা খুলবি তো নাকি! কতক্ষণ ধরে ডাকছি…
কৃশানুর গলার আওয়াজ পেয়ে লাফ মেরে উঠেছে ধৈবত। দরজা খুলেছে তড়িঘড়ি। মজা দেখাবে এবার ওকে…
কিন্তু ধৈবত কিছু বলে ওঠার আগেই কৃশানু ঘরে ঢুকেই ওকে জড়িয়ে ধরে।
— কী হয়েছে রে কৃশানু?
— কী হয়েছে সেটা কাল সকালে বুঝবি…আর যখন বুঝবি তখন আনন্দে পাগল হয় যাবি আমার মতোই।
— কী যে বলিস তুই! কী হয়েছে বলতে কী হচ্ছে তোর? কোথায় ছিলিস এতক্ষণ? কী করছিলি? আমি কি ভীষণ চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম জানিস? তুই এত বেয়াক্কেলে কেন রে!
—ওরে বাবা রে, ভীষণ রেগে আছিস দেখছি। আচ্ছা, ঠিক আছে দেখব, কালকে এই রাগ কোথায় থাকে, মুচকি হেসে উত্তর দেয় কৃশানু।
— আরে কী কাল কাল করে যাচ্ছিস এসে থেকে…
কৃশানু কিছুতেই রহস্য ভাঙে না।
এবার রাগের সঙ্গে সঙ্গে বিরক্ত লাগছে ধৈবতের। তাই আর কথা না বাড়িয়ে শুয়ে পড়ে।
কৃশানুর ডাকে যখন ঘুম ভাঙল তখনও পুরোপুরি ভোর হয়নি, বাইরে হালকা অন্ধকার।
— এগুলো কী পাগলামি হচ্ছে কৃশানু! আমার সানরাইজ দেখার কোনও শখ হয়নি। ছাড় না, ঘুমাতে দে ভাই।
কৃশানু জীবনে কখনও কি কারো কথা শুনেছে যে আজ ধৈবতের কথা শুনবে! একপ্রকার জোর করেই ধৈবতকে টানতে টানতে সী-বিচে নিয়ে আসে।
ও কে ওখানে? ঐ যে ঢেউগুলো যেখানে আছড়ে পড়ছে — ওখানে কে? মুহূর্তের মধ্যে ধৈবতের হার্টবিট বেড়ে যায়, মনে হয় বুঝি স্বপ্ন দেখছে।
ছুটে যায় কাছে…
— আমলকি! অস্ফুটে উচ্চারণ করে ধৈবত।
— হ্যাঁ ধৈবত, তোর আমলকি। তোর বিশ্বাস, তোর ভালোবাসা জিতে গেছে রে… কৃশানু বলে।
— কিন্তু তুই কী করে…
আর আমলকি, তুই এতদিন কোথায় ছিলিস? কেন আমার সঙ্গে কোনও যোগাযোগ করিসনি?
আমলকি কোনও উত্তর দিতে পারে না, শুধু ঝরঝর করে কেঁদে যাচ্ছে।
—ওকে একটু সময় দে ধৈবত। ততক্ষণ আমি বলছি শোন।
কৃশানু এইবলে আবার বলতে শুরু করে…
— কাল দুপুরে ক্যামেরা আর ল্যাপটপ নিয়ে বসেছিলাম, সে তো তুই দেখেছিলি। কাজই করছিলাম। হঠাৎ একটা ছবির ব্যাকগ্রাউন্ডে যাকে দেখতে পাই, তাকে দেখব দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি। ততক্ষণে তুই বেরিয়ে গিয়েছিস। তাছাড়া নিশ্চিত না হয়ে তোকে কোনও আশা দিতে চাইনি আমি। তখনই ঠিক করি যেভাবেই হোক আমি খুঁজে বের করবই, যাকে ফটোতে দেখে আমলকি বলে ভাবছি সে আদৌ আমলকি কিনা। তারপর সারা সন্ধ্যা হোটেলে হোটেলে ঘুরে, ঐ ফটো দেখিয়ে দেখিয়ে অবশেষে খুঁজে পেলাম আমলকিকে।
ও প্রথমে রাজি হচ্ছিল না জানিস, তোর কাছে আসতে। সেই দুর্ঘটনা ওর চলার শক্তি কেড়ে নিয়েছে। আর সেই কারণেই ও এতদিন তোর থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছে, পাছে তোর কাছে বোঝা হয়ে ওঠে!
বোকা মেয়েটা জানে না, ওকে ছাড়া এই তিনবছর তুই জীবন্মৃত হয়ে বেঁচে আছিস।
— আমলকি, কী করে ভাবলি রে তুই আমার কাছে বোঝা হয়ে যাবি? যদি আমার এরকম কিছু হত, তুই আমায় ফেলে দিতিস?, ধৈবত আমলকির হুইলচেয়ারের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে জিজ্ঞেস করে।
— না ধৈবত, না। কিছুতেই না। কখনও না। আমলকি কান্না ভেজা গলায় বলে।
— তাহলে তুই কেন এরকম ভাবলি? তাহলে কি আমারই ভালোবাসায় কোনও খামতি ছিল?
— না রে না, আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। নিজের এই অবস্থা মেনে নিতেই ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে গিয়েছিলাম। তারপর যদি তোর থেকে কোনও আঘাত, কোনও প্রত্যাখ্যান সহ্য করতে হত, আমি মরে যেতাম রে…
ধৈবত আরও কিছু বলত হয়ত। কৃশানু ওর হাতে চাপ দিয়ে চুপ করতে ইশারা করে। আমলকির পরিস্থিতিতে হয়ত ওটাই স্বাভাবিক ছিল।
— এতদিন ছিলিস কোথায়? ধৈবত প্রসঙ্গান্তরে যায়।
— ঐ তো অন্তরীপ বলে একটা এনজিও-তে। ওরাই আমাকে বাঁচিয়েছে রে।
দুর্ঘটনায় গাড়িটা যখন নদীতে পড়ে ভেসে যাচ্ছিল, তখনই আমি জানালা দিয়ে কোনওমতে বাইরে বেরোতে পেরেছিলাম। কিন্তু সাঁতার কাটতে পারছিলাম না, পা দু’টোতে অসহ্য যন্ত্রণা। বুঝতে পারছিলাম আমি ডুবে যাচ্ছি। তারপর আর কিচ্ছু মনে নেই। তিন দিন পর জ্ঞান ফিরেছিল। ততক্ষণে আমার দু’টো পা-ই অপারেশন করে কেটে বাদ দিয়ে দিয়েছেন ডাক্তাররা। নাহলে বাঁচানো যেত না। প্রথমে সবকিছু শূন্য হয়ে গিয়েছিল আমার কাছে। কোথায় আছি, কে বাঁচাল — কোনও প্রশ্নই আসেনি মাথায়। পরে জানতে পেরেছিলাম অন্তরীপের ফাদার বাঁচিয়েছিলেন আমাকে। ওরা বারবার জানতে চেয়েছিলেন, খবর দিতে চেয়েছিলেন বাড়িতে। কিন্তু তুই তো জানিস, বাবার কাছে ফেরার কোনও কারণ আমার নেই। আর তোর সামনে আসতে পারিনি এক অমূলক ভয়ে।
ব্যস, তখন থেকে অন্তরীপের সঙ্গেই আছি। অনাথ আশ্রমের বাচ্চাদের পড়ানো, গান শেখানো — এই নিয়েই আছি।
ওদের নিয়েই একটা অনুষ্ঠানের জন্য এখানে এসেছিলাম। ভাবিনি, তোকে পাব।
— ফাদার কোথায় আমলকি? আমাকে ওঁর সঙ্গে কথা বলতে হবে তো। আমি তো তোকে আমার সঙ্গে নিয়ে যাব। ধৈবত অধৈর্য হয়ে ওঠে।
— চিল ব্রো। আমি কালই কথা বলে নিয়েছি। ওঁর কোনও আপত্তি নেই। তবু পরে একবার দেখা করে নিস।
এখন তোরা কথা বল। কৃশানু বলে।
— আর তুই কোথায় যাবি, আমলকি জিজ্ঞেস করে।
— দেখি, আশেপাশে কী ছবি পাওয়া যায়। হালকা হেসে কৃশানু পা বাড়ায় সামনের দিকে।
কিছুটা এসে পেছন ফিরে তাকায়।
সবে সূর্য তার রক্তিম আভা ছড়িয়ে দিয়েছে সারা আকাশে, সমুদ্রের ঢেউয়ে — ভালোবাসার সুখের রং ছড়িয়ে পড়েছে আমলকির চোখে-মুখেও। ধৈবত আমলকির কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে আছে।
কৃশানু ক্যামেরায় লুক থ্রু করে। পারফেক্ট ফ্রেম। শাটার টেপার সঙ্গে সঙ্গে ফ্রেমবন্দি হয় ভালোবাসা।
ম্যাগাজিনের কভার পেজের ছবি পেয়ে গেছে কৃশানু। আমলকিকে সারাজীবনের মত যত্নে রাখবে এই ছবিতেই।
চোখের কোণের জলটা মুছে নেয় বাঁ-হাত দিয়ে।
এই জীবনে আর কখনও বলা হবে না কিছু, ভোলাও যাবে না কিছু।
নিজের মনেই হাসে। ভালো থাক আমলকি, ধৈবতের সাথে। এর বেশি কবেই বা কিছু চেয়েছিল কৃশানু! এও তো ভালোবাসাই — তাই না?