(১)
এটি নিছক একটি প্রেমের গল্প কিন্তু এটিকে এক জোড়া মানব মানবীর দুঃসাহসী ভ্রমণ কাহিনীও বলা চলে। যাক বেশি ভণিতা না করে আসল গল্পে এগোনো যাক। এই গল্পের প্রধান চরিত্রের একজনের পরিচয় আগে দেওয়া যাক। ইনি হলেন ঋতিকা রায়চৌধুরী, একটি আই.টি ফার্মে ১বছর হল চাকরী করেছেন, বয়স ২৪, বাবা মিঃ ঋতব্রত রায়চৌধুরী একজন নেভি অফিসার,মা দেবিকা রায়চৌধুরী একজন বোটানি প্রফেসর। এবার ওর চেহারার বর্ণনা একটু দেওয়া যাক — উচ্চতা ৫ফুট ৬ইঞ্চি, ছিপছিপে গড়নের, দুধে আলতার মতো গায়ের রং, উচ্ছল ঝর্নার মতো লম্বা একপিঠ ঘন কালো চুল,হরীনির মতো গভীর উজ্জ্বল দুটি চোখ, টিকালো নাক, ফুলের পাপড়ির মতো ঠোঁটের ওপর বাঁধভাঙা হাঁসি খেলা করে যায়। এককথায় যাকে বলে ডাকসাইটের সুন্দরি। স্বভাবে কিছুটা চাপা ধরনের হলেও সে খুব বুদ্ধিমতী ও সাহসী, সব সময় যেকোনো পরিস্থিতিতে ঠান্ডা মাথায় সামলানোর ক্ষমতা তার আছে। ঋতিকার ডাক নাম ঋতু। তো এই ঋতু এরকম আকর্ষণীয় হওয়া সত্ত্বেও জীবনে প্রেম হয়নি কখনও। দু-একটি প্রেমপ্রস্তাব সে পায়নি তা নয় তবে তা সিরিয়াস কিছু না। এর কারণ হিসেবে ঋতু অবশ্য বলে, গার্লস স্কুল তারপর বি.এস.সিও লেডি ব্রেবোর্ন থেকে,আর তারপর তো এম.এস.সি আর চাকরি, সেই চাপের মধ্যে আর প্রেম হয়ে ওঠেনি। কিন্তু আসল ব্যপার হল ঋতু তার পড়াশোনা কেরিয়ারকেই প্রাধান্য দিয়ে এসেছে চিরকাল, তার সবসময় মনে হতো কেরিয়ারের একটা ঠিকঠাক জায়গায় পৌঁছে যাই আগে, জীবনকে উপভোগ তো পরেও করা যায়।
জীবনে ২৩ টা বসন্ত এই ভাবে কাটানোর পর ঋতুর মন বিদ্রোহ ঘোষণা করল। তার মনে হল এমন কিছু একটা করতে হবে যা সে আগে কখনও করেনি। বাবার বদলির চাকরি হওয়ায় ছোট থেকে অনেক জায়গায় ঘুরেছে তারা, কিন্তু একেবারে একা সে কখনও ঘুরতে যায়নি। যখনই কোথাও ঘুরতে গেছে তার সাথে বাবা মা না হলে স্কুল-কলেজের বন্ধু বান্ধব ও শিক্ষক শিক্ষিকারা ছিলেন। তার বাবা যেহেতু নেভি অফিসার তাই তার অনেকদিন থেকে মনে হতো সে একেবারে একা বেরিয়ে পড়বে সমুদ্র যাত্রায়, সে তার ইচ্ছা জানিয়ে দিল বাবা-মাকে। প্রথমে মিঃ এবং মিসেস রায়চৌধুরী রাজি না হলেও পরে মেয়ের জেদের কাছে তাদের হার মানতে হল।
আর একটা সুযোগও এসে গেল মিঃ রায়চৌধুরীর কাছে, তার বন্ধু অজিত সেন সস্ত্রীক রিটায়ারমেন্টের পর সিঙ্গাপুর বেড়াতে যাচ্ছেন। সেখান থেকে ইন্দোনেশিয়া সহ আরও কয়েকটা জায়গায় তারা যাবেন। আর এর মধ্যে কিছুটা সমুদ্রযাত্রাও আছে। তাই আর দেরি না করে মিঃ রায়চৌধুরী সমস্ত ব্যবস্থা করে ফেললেন। তারপর মেয়ের চব্বিশ বছরের জন্মদিনে তাকে সেই কথা জানালেন। শুনে ঋতু তো মহা খুশি, কিন্তু মিঃ অজিত সেন ও তার স্ত্রী সঙ্গে থাকবেন শুনে ঋতুর মনটা খচখচ করতে লাগল। তখন মিঃ রায়চৌধুরী তাকে বললেন অজিত সেনরা তার সঙ্গে থাকলেও তার কোনও ব্যাপারে নাক গলাবেন না। সেটা শুনে ঋতুর মন কিছুটা আশ্বস্ত হল। যাই হোক দেখতে দেখতে সেই দিন এসে গেল ঋতুর জীবনে, যখন সে কার্যত একা বেরিয়ে পড়ল সমুদ্র সফরে।
(২)
অফিস থেকে ১২ দিনের ছুটি নিয়েছিল ঋতু। ঠিক হয়েছিল প্রথমে সিঙ্গাপুর তারপর সেখান থেকে বিলাসবহুল ক্রুসে ইন্দোনেশিয়ার বিনটান আইল্যান্ড হয়ে, সিঙ্গাপুরে ফিরে পাটায়া ঘুরে ,তারা ফিরবে।
নির্দিষ্ট দিনে তারা সিঙ্গাপুরে পৌঁছায় সেখানে কিছুদিন ঘুরে সিঙ্গাপুরের মারিয়ানা বে ক্রুস পোর্ট থেকে বিকাল পাঁচটার সময় তাদের জাহাজ যাত্রা শুরু করে। এর মধ্যে মিস্টার ও মিসেস সেনের সঙ্গে ঋতুর ভালোই ভাব হয়ে গেছে। ওঁরা ঋতুর অনেক খেয়াল রাখেন এবং তাকে অনেক ব্যাপারে সাহায্য করেন। কিন্তু তার ওপর কোনো কর্তৃত্ব করার চেষ্টা করেন না। জাহাজের মধ্যে মিস্টার ও মিসেস সেনের একটা আলাদা কেবিন, এবং ঋতুর জন্য একটা আলাদা কেবিন নেওয়া ছিল। জাহাজের মধ্যে নানা রকমের আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থা ছিল তারমধ্যে নানা রকমের রেস্টুরেন্ট ,বার , ক্যাসিনো , নাচ-গান ও নানা রকমের মনোরঞ্জনের ব্যবস্থাও করা ছিল, ডেকের উপরে ছোটখাটো একটা পার্কের মতো ব্যবস্থা, তার সঙ্গে জাহাজের চারিদিক ঘিরে সমুদ্রের নীল জলরাশি, এক অপার্থিব সৌন্দর্যের সৃষ্টি করে। জাহাজে ঋতুর কেবিনটি ছিল অনেক বিলাসিতায় পরিপূর্ণ, তার মনে হল কখনও যদি এইসব বিলাসিতা ছেড়ে সভ্যতার আদিম জগতে আদিম মানুষের মতো জীবনযাপন তাকে করতে হয় ,সে কি পারবে। কিন্তু সেই আদিম জীবন যে নিকট ভবিষ্যতে তার জন্য অপেক্ষারত ছিল তা কে জানতো। জাহাজে উঠে তারা জানতে পারে তাদের জাহাজে একটি অ্যাডভার্টাইজমেন্ট এর শুট করা হবে। কিছুটা শুটিং তাদের জাহাজে এবং কিছুটা তাদের গন্তব্য বিনটান আইল্যান্ডে হবে। এর জন্য বেশ কিছু শুটিংয়ের কাস্ট এন্ড ক্রু এবং উঠতি একজন মডেল তাদের জাহাজে উঠেছেন। মিস্টার সেন বললেন,
-” ভালই হল ঘোরার সাথে সাথে বেশ শুটিং দেখার মজাও পাওয়া যাবে।”
জাহাজে তাদের সবার উদ্দেশ্যে সন্ধ্যেবেলা একটি ওয়েলকাম পার্টি অরগানাইজ করা হয়েছিল । সেখানে নির্দিষ্ট সময়ে জাহাজের সমস্ত লোকজন উপস্থিত হলেন তারমধ্যে ঋতিকা, মিস্টার এবং মিসেস সেন, অ্যাড কোম্পানির সমস্ত লোকজনও ছিলেন। সেখানেই মিস্টার সেন অ্যাডভার্টাইজমেন্ট এর উঠতি মডেল রাহুল চ্যাটার্জীকে দেখতে পেলেন। রাহুলকে দেখতে পেয়ে তিনি তার দিকে হাসিমুখে এগিয়ে গেলেন। রাহুলও তার দিকে সহাস্য মুখ করে তাকাল। বোঝা গেল তাদের মধ্যে নিশ্চয়ই কোন পূর্ব পরিচয় আছে। এবার মিস্টার সেন রাহুলের সাথে হ্যান্ডশেক করে বললেন,
– “আরে তুমি রাহুল না , আমার বন্ধু সুশী মানে সুশান্ত চ্যাটার্জির ছেলে?”
রাহুল বলল,
– “হ্যাঁ আঙ্কেল আপনাকে সেই ক্লাস ইলেভেনে লাস্ট দেখেছিলাম। তারপর আপনি তো আমাদের বাড়িতে আসাও কমিয়ে দিয়েছিলেন, আর আমিও স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে তারপর পুনে চলে যাই ফিল্ম স্টাডিজ নিয়ে পড়াশোনা করতে তাই আপনার সাথে আর কোনও যোগাযোগ ছিল না, তা আপনারা সবাই ভালো তো? আপনার তো এতদিনে রিটায়ার্ড করে যাওয়ারও কথা।”
-“হ্যাঁ বাবা রিটায়ার করেছি, তা বৌদির মারা যাওয়ার পর তোমাদের বাড়িতে যাতায়াত কমে গেলেও তোমাদের সব খবরাখবর আমি পাই। তোমার বাবার কাছে, তোমার এই মডেলিংয়ের কথাও শুনেছি।”
– “তা আঙ্কেল আপনি এখানে , রিটায়ারমেন্টের পর সপরিবারে বেড়াতে বেরিয়েছেন বুঝি?”
-“বেড়াতে বেরিয়েছি ঠিকই, তবে সপরিবারে ঠিক নয় আমার গিন্নী সঙ্গে আছেন তবে ছেলেমেয়েরা কেউ আসতে পারেনি। মেয়ের তো বিয়ে হয়ে গেছে সে তো আমেরিকায়, আর ছেলে চাকরিসূত্রে ব্যাঙ্গালোরে তবে তাদের অভাব আমার এই বন্ধুর মেয়েটি পূর্ণ করে দিয়েছে।”
ঋতু অনেকক্ষণ থেকেই সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল । জাহাজে ওঠার সময়েই সে রাহুলকে দেখেছে। বেশ চোখে পড়ার মতো চেহারা যাকে বলে টল ,ডার্ক, হ্যান্ডসাম। গ্রিক গডের মতো বডি, মাথাভর্তি চুল, আর চোখগুলো বাদামী রঙের, রীতিমতো সিনেমার হিরোদের মত। এই সময় মিস্টার সেন বলে ওঠেন,
-“তোমাদের আলাপ করিয়ে দি — এ হচ্ছে আমার অফিস কলিগ ঋতব্রত রায়চৌধুরীর মেয়ে ঋতিকা, কম্পিউটার সাইন্স নিয়ে পড়াশোনা করে এখন একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরী করছে।”
এরপর রাহুলের দিকে তাকিয়ে বলেন,
-” আর ও হচ্ছে রাহুল, আমার স্কুল ফ্রেন্ড সুশান্ত চ্যাটার্জীর ছেলে একে তুমি চেনো।”
ঋতিকা রাহুলকে বলল,
– “আপনাকে তো অনেক অ্যাডভার্টাইজমেন্টেই দেখেছি । তা আপনি কি সিনেমা করার কথাও ভাবছেন?”
– “হ্যাঁ, এখান থেকে ফিরে অনেকগুলো অ্যাড শুটিং আছে । আর অনেকগুলো ফিল্মের অফারও পেয়েছি।”
এইসময় মিসেস সেন কয়েকটা ড্রিংকস ওদের অফার করলেন। আর ওদের সঙ্গে যোগদান করলেন। এরপর অনেকক্ষন তাদের কথাবার্তা চলতে লাগল। কিছুক্ষন পরে সবাই একসাথে ডিনার করে একে অপরকে গুড নাইট জানিয়ে শুতে চলে গেলেন।
নতুন জায়গায় ঋতুর সেইভাবে ভালো ঘুম হয় না, তবে সারা দিনের ক্লান্তিতে রাতের প্রথমদিকে ঋতু একটু একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে তার ঘুম ভেঙে গেল আর নানা রকম চিন্তা তার মাথায় ভিড় করতে লাগল। তার মনে হল, সে তো ভেবেছিল জীবনে নতুন কিছু করবে, একেবারে একা একা সে ঘুরতে বেরোবে। কিন্তু সেন আংকেলরা সঙ্গে থাকায় তার একেবারে একা আসা হল না। ওঁরা তাকে প্রায় কিছুই করতে দেন না। সব কাজেই তাকে সাহায্য করেন। তার আরও মনে হল, এরপর ফিরে গিয়ে আবার সেই অফিস আর বাড়ি, সেই এক গতের জীবন । এইরকম আরো নানা চিন্তায় তার মাথাটা গরম হয়ে গেল। কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে সে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল। তারপর ভাবল একটু ডেকের উপর থেকে ঘুরে আসবে। এই ভেবে সে কেবিন থেকে বেরিয়ে পড়ল। ডেকের উপর এসে সে দেখল ছড়ানো-ছিটানো কিছু লোকজন ডেকে আছে। কিন্তু চারিদিক প্রায় ফাঁকা বললেই চলে আর এই রাত দুটোর সময় ডেকে থাকবেই বা কে… সে দেখল, একদিকে দুজন বৃদ্ধ দম্পতি নিঃশব্দে বসে আছেন। আর এক কোনে কিছু কম বয়সী ছেলে মেয়ে হৈ হুল্লোর করছে,আর ড্রিংক করছে। জাহাজের ভেতরের কোনও হোটেল বা বিনোদনের জায়গা থেকে হাল্কা গানের শব্দ ভেসে আসছে। তার সঙ্গে জাহাজ চলার এবং সমুদ্রের জলের শব্দ মিলে এক অদ্ভুত কোরাসের সৃষ্টি হয়েছে।
ঋতু একটা কোনা বেছে নিয়ে রেলিং ধরে দাঁড়াল। সমুদ্রের জলের রং তখন কালো, নক্ষত্র খচিত আকাশটাও কালো, সমুদ্রে যেন কিছুটা তারার আলো এসে পড়েছে সেই দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ঋতুর মাথায় চিন্তাগুলো আরো জট পাকাতে থাকে। ওই বৃদ্ধ দম্পতিদের দিকে তাকিয়ে তার মনে হয় ওই বয়সে পৌঁছে সে কোথায় থাকবে?
যখন সে এইসব ভাবছে সে অনুভব করল তার পাশে কে যেন এসে দাঁড়িয়েছে। ঋতু সেই দিকে মুখ ঘুরিয়ে দেখল সেখানে রাহুল দাঁড়িয়ে আছে। ডেকের উপরের হাল্কা আলো তার মুখের ওপর এসে পড়ছে। সেই আলোয় তার বাদামী চোখগুলো যেন আরো বাদামী হয়ে উঠেছে। সমুদ্রের হাওয়ায় চুলগুলো উড়ছে। সে একটা নীল রঙের পাতলা শার্ট পড়েছিল। তার ফলে তার প্রত্যেকটা সুঠাম, বলিষ্ঠ, পেশী আলাদা করে চোখে পড়ছিল । ঋতু বেশ কিছুক্ষণ তার দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল,
– “আরে আপনি এই সময় এখানে কী করছেন?”
-” আপনি বা কী করছেন? রাত দুটো বাজে সে খেয়াল আছে?”
-” নতুন জায়গায় ঘুম আসছিল না। তাই একটু খোলা হাওয়ায় এসে দাঁড়ালাম।”
-” আমার এমনিতেই রাত জাগা অভ্যেস। আচ্ছা একটা কথা বলুন আপনি হঠাৎ সেন আংকেলদের সঙ্গে এলেন কেন?”
ঋতু একটু হাসলো তারপর বলল,
– ” আসলে ব্যাপারটা হল আমি ভেবেছিলাম যে একদম একা ঘুরতে বেরোব। কিন্তু সেন আঙ্কেলরাও এখানে আসছিলেন তাই ওঁদের সঙ্গে এলাম।”
-” আচ্ছা তো হঠাৎ একা বেরোনোর ইচ্ছা হল কেন?
– “আসলে অনেকদিন ধরে শুধু পড়াশোনা চাকরি এই সব থেকে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। জীবনে সেইভাবে ইনজয় করার জন্য কিছুই করা হয়ে ওঠেনি। তাই ভাবছিলাম এমন কিছু একটা করা যাক জীবনে আগে কখনও করিনি। “
-” আচ্ছা এবার বুঝেছি বিয়ে দেবার আগে বাবা তার বাধ্য মেয়েকে বললেন— যা সিমরান যা, জিলে আপনি জিন্দেগি। আর মেয়েও ছুটে ছুটে এসে সিঙ্গাপুরের জাহাজ ধরল।”
এই বলে রাহুল হা হা করে হেসে উঠল।
-” মোটেও না আমাকে ওরকম ভাবে বাবা মোটেও বলেনি। আমি এখানে এসেছি, বিকজ আই এম আ ইন্ডিপেন্ডেন্ট ওম্যান। আর এখানে আসার সমস্ত খরচাও আমি নিজে বিয়ার করছি।”
-” আচ্ছা তো আপনার মতে একটা মেয়ে তার খরচা নিজে বহন করতে পারলেই ইন্ডিপেন্ডেন্ট হয়ে যায়।”
-“তো আপনি কি মনে করেন মেয়েরা ড্রিঙ্ক করলে, স্মোক করলে, দশটা ছেলের সাথে ফিজিক্যাল রিলেশন করলে, আর কুড়িটা বয়ফ্রেন্ড রাখলেই ইন্ডিপেন্ডেন্ট হয়ে যায় ।”
-” না আমি সেটা বলছি না কিন্তু ইন্ডিপেন্ডেন্ট মেয়েদের সেটাই লক্ষণ। অন্ততপক্ষে শিক্ষিত, সুন্দরী, স্মার্ট মেয়েদের দুটো তিনটে অ্যাফেয়ার তো থাকেই। আপনারও কী কোনও বয়ফ্রেন্ড নেই?”
-” না আমার কোনও বয়ফ্রেন্ড ছিল না, আর এখনও নেই। সেরকমভাবে আমি কখনও ভাবিনি।”
-“এই কথাটা আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে বলেন? আপনার মত সুন্দরী মেয়ের কোন বয়ফ্রেন্ড নেই?”
-” না নেই। আপনি বিশ্বাস করুন আর না করুন। আচ্ছা আমার অ্যাফেয়ার নিয়ে তো অনেক কথা বলছেন। আপনার গার্লফ্রেন্ডের সংখ্যা কটি?”
-” গার্লফ্রেন্ড বলতে যা বোঝায় সেরকমভাবে কেউ নেই। বাট আমাদের পেশায় স্ট্যাটাস মেন্টেন করার জন্য এরকম কিছু রিলেশনের কথা ছড়িয়ে় রাখতে হয়। আচ্ছা একটা কথা বলুন আপনার কোনও গার্লফ্রেন্ড… মানে…?”
-” কী বলতে চাইছেন আমি লেসবিয়ান?”
-” না এমনি জিজ্ঞেস করলাম আরকি।”
-” আচ্ছা আপনি আমাকে নিয়ে তো অনেক কথা বলছেন। আপনি নিজের জীবনে কি করেছেন? রোজকার কাজের বাইরে নিজের জীবন নিয়ে কখনও কিছু নতুন করার কথা ভেবেছেন?”
-” হ্যাঁ ভেবেছি। সেটা এখনও করিনি, তবে করব। আর সেটা কালকেই করব ।”
-” কী করবেন? কোন সিক্রেট কিছু , সেটা কী আমাকে বলা যায়?”
-” হ্যাঁ, সেটা আপনি শুনতে পারেন। এখানে আমার আরেকজন বন্ধুর আসার কথা ছিল। কিন্তু হঠাৎ শরীর খারাপ হয়ে যাওয়ায় সে আসতে পারেনি। আচ্ছা আপনি বিয়ার গ্রিলসের নাম শুনেছেন?”
-” আরে হ্যাঁ আমি তো সারাক্ষণ টিভিতে ওঁর প্রোগ্রাম দেখি। জানেন তো মাঝে মাঝে আমার মনে হয় আমিও যদি এরকম কোনও দুঃসাহসী অভিযানে যদি যেতে পারতাম তাহলে খুব ভালো হতো। যার জন্য আমি নানা রকম, ওঁর শেখানো ট্রিক্স প্র্যাকটিসও করেছি।”
কথাগুলো খুব উচ্ছসিত হয়ে এক নিশ্বাসে বলে গেল ঋতু।
-” আচ্ছা, তাই নাকি? আমি আর আমার বন্ধু সেরকমই একটা অ্যাডভেঞ্চারের প্ল্যান করেছিলাম। কিন্তু এই ট্রিপে ও আসতে পারল না। তাই ভাবলাম সেটা আর সম্পূর্ণ করা গেল না ,কিন্তু তারপর ভেবে দেখলাম আমি একাই যাব।”
-” আপনি কোথায় যাবেন?”
-” আসলে বালি থেকে উত্তরের দিকে অনেকগুলো অনাবিষ্কৃত ছোট ছোট দ্বীপ আছে। আমাদের প্ল্যান ছিল ট্যুরের দ্বিতীয় দিনে আমরা জাহাজের মধ্যে না গিয়ে জাহাজের লাইফবোটে উত্তর দিকে সেই দ্বীপগুলোতে গিয়ে একটা দিন কাটাব। তারপর,জাহাজ যখন ফিরবে আবার জাহাজে ফিরে আসব। আমি ভাবছি কাল একাই সেখানে যাব।”
-” কিন্তু এক্ষেত্রে একা গেলেতো অনেক বিপদ আসতে পারে।”
-” আরে ম্যাডাম, এই বিপদের মধ্যেই তো অ্যাডভেঞ্চার। তবে এই কথা কিন্তু কাউকে বলা যাবে না। তাহলে যাওয়াটা মাটি হয়ে যাবে।”
-” আচ্ছা আমি কি আপনার সাথে যেতে পারি?”
-” আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন!”
-” কেন আপনি যদি যেতে পারেন তাহলে আমি কেন পারব না? আমি মেয়ে বলে কি অ্যাডভেঞ্চারাস হতে পারি না। আমি অনেকদিন থেকে শুধু এটাই ভেবে যাচ্ছিলাম যে কী এমন করা যায় যাতে জীবনে একটু অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ পাওয়া যায়। আর আপনার তো সব প্ল্যান ঠিক করাই আছে। বেশ বিনা ঝামেলাতেই আমি একজন সঙ্গী পেয়ে গেলাম।”
রাহুল কিছুক্ষন নিষ্পলক দৃষ্টিতে ঋতুর দিকে তাকিয়ে থাকলো বোঝার চেষ্টা করল মেয়েটা মজা করছে না তো! কিন্তু ঋতুর স্থির দৃষ্টি তাকে বুঝিয়ে দিল মেয়েটি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
ঋতু বলল, “তাহলে আমি কিন্তু যাবই।আপনি প্লিজ আর না করবেন না ।”
-“আচ্ছা যদি কোনো বিপদ হয় সেই রেসপনসিবিলিটি কে নেবে ,বা আপনার যদি কিছু হয়ে যায় তখন তো সবাই আমাকেই দোষী ভাববে।”
-“ওহঃ মিস্টার রাহুল আপনি এতো নেগেটিভ কেন ভাবছেন বলুন তো?আর বিপদ আসলে আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারব আর আমার বিপদ হলে আপনি সাহায্য করবেন।দুজন থাকার এটাই তো সুবিধা।”
-“আপনাকে তো বলাটাই ভুল হয়েছে।তাহলে আপনি গিয়েই ছাড়বেন?”
-“অবশ্যই যাব। ভুল যখন করেই ফেলেছেন তখন ভুলের খেসারত দিন।”
এইকথা বলেই ঋতু হাহা করে হেঁসে উঠল। রাহুল দেখল ঋতুর হাঁসি যেন তার চোখে মুখে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে। এই ভুবন ভোলানো হাঁসি যে কতো পুরুষের প্রাণ কেড়েছে ভগবান জানে। দক্ষিণ চীন সাগরের বুক থেকে উঠে আসা ঠান্ডা বাতাস গা জুড়িয়ে দিচ্ছে। সেই বাতাসে ঋতুর চুলগুলো এলোমেলো হয়ে শয়তানি করার চেষ্টা করছে, ঋতু মাঝে মাঝে দুহাতে চেপে ধরে তাদের শান্ত করছে, ঋতুর সাদা নাইট গ্রাউনটাও হাওয়ায় উড়ছে ,পাতলা গ্রাউনের মধ্যে দিয়ে তার শরীরের প্রত্যেকটা ভাঁজ, তার সৌন্দর্যে আলাদা মাত্রা যোগ করেছে। রাহুলের মনে হল এই মেয়েটার সাথে একদিন নিভৃতে কাটাতে পারলে মন্দ হয় না, এটা যদি ডেট হিসাবে ধরা হয় এরকম ডেটের কথা কেউ কোনোদিন শুনেছে।
রাহুল বলল, “ও কে মিস রায়চৌধুরী, তাহলে আমরা কাল রাতে বেরব। আর বাকি প্ল্যান আমি কাল আপনাকে সকালে জানাব।”
ঋতু কিছু বলতে যাচ্ছিল, রাহুল তার আঙুল ঋতুর নরম ঠোঁটের ওপর রেখে বলল,
– “না না,আর একটাও কথা না, কাল থেকে অনেক পরিশ্রম আছে আজকের রাতটা ভালো করে রেস্ট নিতে হবে। যান এবার ঘুমিয়ে পড়ুন।”
ঋতু মৃদু হেঁসে গুডনাইট জানিয়ে চলে গেল। বাকি রাতটাও যদিও উত্তেজনায় তার ভালো ঘুম হল না। বেশ কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে ঋতু উঠে পড়ল । কেবিনের জানলা দিয়ে তখন বাইরের গোলাপি আভা দেখা যাচ্ছে। সূর্যোদয় যদিও তখন হয়নি। ডেকের ওপর থেকে অনেক মানুষের কলরব ভেসে আসছে। সবাই সানরাইজ দেখার জন্য অপেক্ষা করছে। ঋতুও চটপট ওপরে গেল। সূর্যোদয়ের সাথে সাথেই অনেক ফোন ও ক্যামেরা জ্বলে উঠল। সারা আকাশ বাতাস ভরে উঠল এক অপার্থিব নৈসর্গিক দৃশ্যপটে। সূর্যের সাতরঙা মাধুরী ছড়িয়ে পড়ল দক্ষিণ চীন সাগরের জলের প্রত্যেকটি বিন্দুতে। ঋতুও বেশ কিছু ছবি টবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেড়ে দিল।
ডেকটা তখন বিভিন্ন মানুষের ভিড়ে ভর্তি। কেউ এমনি ঘুরে বেড়াচ্ছে, কেউ এক্সারসাইজ করছে, কেউ তাদের প্রিয় পোষ্য নিয়ে লনে পাইচারী করছে,আবার কেউ সুইমিংপুলে স্নানও করছে। সেন আংকেলরা বা রাহুল এখনও কেউ ওঠেনি। ঋতু তার কেবিনে ফিরে গেল ফ্রেশ হতে।
তারপর সারাদিন খুব ভালই কাটল। ব্রেকফাস্ট টেবিলে রাহুলদের সাথে অনেক গল্প হল, রাহুল সারাদিন শুটিংএর কাজে ব্যস্ত থাকল। ঋতু, সেন দম্পতি এবং জাহাজের অন্য লোকজনরা উপরি পাওনা হিসাবে শুটিং দেখতে পেলেন। তার মাঝখানে রাহুল অবশ্য ঋতুকে তার প্ল্যানটা জানাতে ভোলেনি। লাঞ্চের সময় রাহুল ঋতুকে বলল,
– “এই আপনাআপনিটা বন্ধ করে আমরা কি তুমিতে আসতে পারি?”
ঋতু সেই মনকাড়া হাঁসি মিশিয়ে বলল,
– “অবশ্যই।”
ঋতু ও রাহুল ক্লান্তি দুর করতে দুপুরে একটু ঘুমিয়ে নিল । সন্ধ্যেবেলা তাদের জাহাজ গিয়ে পৌঁছল বিনটান আইল্যান্ডে। তাদের জন্য সেখানে নানা রকমের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। তার মধ্যে বনফায়ার, স্থানীয় উপজাতিদের নাচগান, এইসব তো ছিলই, তাছাড়াও কোস্টাল খাওয়াদাওয়া আর টেন্টের মধ্যে রাত্রিযাপনের অ্যাডভেঞ্চারেরও ব্যবস্থা ছিল। বিনটান আইল্যান্ডে রাহুলের কিছু নাইটশুটও ছিল এটাই তাদের প্রোগ্রামের লাস্ট শুট ছিল,তাই এরপর রাহুল ফ্রী। এদিকে অ্যাডভেঞ্চারের অপেক্ষায় উত্তেজিত হচ্ছিল। ডিনারের সময় রাহুল তাকে দুটোর সময় রেডি হয়ে থাকতে বলল।
তাদের প্ল্যানটা ছিল দুটোর সময় যখন সব লোকজন টেন্টের মধ্যে ঘুমিয়ে পরবে তখন তারা জাহাজের মধ্যে গিয়ে লাইফবোট নিয়ে বেরিয়ে পড়বে। তাদের গন্তব্য দক্ষিণ চীন সাগরের উত্তরে অনাবিষ্কৃত দ্বীপপুঞ্জ। রাহুল আর তার বন্ধু মিলে আগে থেকেই ম্যাপ তৈরি করে রেখেছিল সেই ম্যাপ অনুযায়ী তারা যাবে । রাহুল লাইফবোটের সিকিউরিটিকে আগে থেকেই বেশ কিছু টাকা দিয়ে রাজী করিয়ে রেখেছিল, যাতে তারা সহজেই একটা লাইফবোট পেয়ে যায়। প্রথমে সিকিউরিটি রাজী না হলেও রাহুল যখন বলল তারা জাহাজ সিঙ্গাপুর পৌঁছানোর আগেই লাইফবোট নিয়ে, জাহাজে ফিরবে তখন সে রাজী হয়ে যায়। ডিনার করে রাহুল আর ঋতু তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নিল। রাত দুটো বাজতেই তারা লাইফবোটের কাছে হাজির হল। সেখানে তখন কোনও মানুষ ছিল না। তারা লাইফবোট খুলে নিয়ে জলে নামাল। তারপর নিজেরাও তার মধ্যে উঠে যাত্রা শুরু করল।
তারা যাত্রাপথে প্রথমদিকে অনেক ক্রুইস ,অনেক ছোট বড় বোট দেখতে পাচ্ছিল, কিন্তু আস্তে আস্তে চারিদিক ফাঁকা হয়ে গেল। তাদের চারদিকে শুধু ধূ ধূ বিস্তীর্ণ সমুদ্রের সুদুরপ্রসারী জলরাশি, আর মাথার উপর ওল্টানো বাটির মতো নখত্রখোচিত আকাশের ছাদ।
ঋতুর মনে হতে লাগল এই সীমাহীন সাগরে কী তাদের এই ছোট্ট বোট চিরকালের মতো হারিয়ে যাবে!
ঋতুর মনোভাব বুঝতে পেরেই যেন রাহুল বলল,
– ” সব ঠিকঠাক থাকলে সন্ধ্যের আগেই আমরা কোনও একটা দ্বীপে পৌঁছে যাব। যদি দাঁড় টানতে হাত ব্যথা করে তাহলে তুমি একটু রেস্ট নিয়ে নিতে পারো।”
ঋতু বলল,- “না না আমার এখন রেস্ট নেওয়ার দরকার নেই।”
(৩)
পরের দিন দুপুরের দিকে তারা চীন সাগরের বুকে এক অজানা দ্বীপে পৌঁছল। সেই দ্বীপটার গঠন একটু অদ্ভুত রকমের, দ্বীপটা প্রায় গোলাকৃতির,চারদিক উঁচু পাহাড়ের প্রাচীর এমন ভাবে ঘিরে রেখেছিল যে দূর থেকে দেখলে পুরোটাকেই সমুদ্র থেকে উঠে আসা একটা খাড়া পাথরের পাহাড় বলে মনে হয়। সেই জন্যই বোধহয় এটা মানুষের খুব একটা চোখে পড়েনি । সামনে গেলে বোঝা যায় সেই পাহাড়ের প্রাচীরের মাঝে ফাঁকা, সেই ফাঁকা জায়গাটার মাঝে পাথর আর্চের মতো হয়ে এমন গঠনের সৃষ্টি করেছে যে সেটাকে প্রবেশ দ্বারের মত মনে হয়,আর সেখান দিয়ে সমুদ্রের জল দ্বীপের মাঝখান পর্যন্ত গোল হয়ে গিয়ে ব্যাকওয়াটারের সৃষ্টি করেছে । দ্বীপের সামনের দিকটা বিস্তীর্ণ বেলাভূমি আর এখানে প্রায় রোজ দিনের শেষে বৃষ্টি হওয়ায় পিছনের দিকটা ঘন জঙ্গলে ঢাকা।
ঋতু এবং রাহুলের চেনা গাছের মধ্যে সেখানে বেশ কিছু নারকেল গাছ চোখে পড়ল। সেই ব্যাক ওয়াটারের জল এতই স্বচ্ছ যে পুরো সমুদ্রের তলা অব্দি দেখা যায় ,জল বেশী গভীর না। এই এককোমর সমান হবে আর তার মধ্যে প্রচুর মাছ আর সামুদ্রিক প্রাণী কিলবিল করছে। সারাদিন দাঁড় টেনে রাহুল ঋতু দুজনেই খুব ক্লান্ত ছিল। তাই সেই বেলাভূমির উপর একটা গাছের নীচে হাত-পা ছড়িয়ে বসে তারা কয়েক ঘণ্টা বিশ্রাম করে । আর ঠিক করে রোদ একটু পড়ে গেলে আশপাশ একটু দেখে নিয়ে থাকার ব্যবস্থা করবে।
তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সবই বোটের মধ্যে ছিল। রাহুল বলল,
-” জোয়ারের জল এলে ‘সিবীচের’ ওপর অনেক অংশ ডুবে যায় আমাদের একটু ভেতরের জঙ্গলের দিকে থাকা উচিত ।”
সেই অনুযায়ী তারা বীচ থেকে একটু ভেতরে কিছুটা জঙ্গল পরিষ্কার করে নিল। সেখানে বোটের মধ্যে থাকা ত্রিপল দিয়ে একটা থাকার জায়গা করে নিল। যাতে বৃষ্টি এলে মাথা বাঁচানো যায়। তারপর গেল আগুন জ্বালাবার জন্য কিছু কাঠ জোগাড় করতে।
দুজনেই খুব খুশি এরকম একটা মনোরম আশ্রয় সহজেই পেয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু হায় তখনও তারা জানতো না তাদের জন্য কিছুক্ষণের মধ্যেে কী চরম বিভীষিকা অপেক্ষা করছে। সেই সবে সূর্য আকাশে রঙের হলি খেলে সমুদ্রে ডুব দিয়েছে । ঘড়িতে তখন সাড়ে ছ’টা।
ব্যাপার ঘটল ঠিক তখনই। তাদের পায়ের তলার মাটি হঠাৎ প্রচন্ড ভাবে নড়ে হল । ঋতু রাহুলকে কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তখনই তারা দেখল, প্রায় চারতলা সমান উঁচু ঢেউ এগিয়ে আসছে বীচের দিকে। রাহুল ঋতুকে বলল,
-” যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের ওই গাছটার ওপরে উঠতে হবে ।”
কিন্তু তাহলেও কি এই বিশাল জলরাশির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে! তারা দেখল, সেই বিশাল পর্বতপ্রমাণ জলরাশি অনেক উঁচু হলেও সেই দ্বীপের চারিদিকের পর্বতগুলোকে পার করে ভেতরে প্রবেশ করতে পারল না। কিন্তু সেই প্রবেশদ্বারের মতো যে ফাঁকা জায়গাটি ছিল সেখান দিয়ে বেশ কিছুটা জল দ্বীপের মধ্যে ঢুকে পড়ল। তারা দেখতে পেল পুরো সিবীচটা জলে ডুবে গেল। আর সমুদ্রের জল জঙ্গলের দিকেও বেশ কিছুটা এগিয়ে এল।
বারবার এরকম বিশাল বিশাল ঢেউ সেই পাহাড়ের গায়ে আছড়ে পড়তে লাগল, এক এক সময় মনে হল এই ঢেউয়ের ঘায়ে হয়তো ওই পাহাড়ের প্রাচীর ভেঙে পড়বে । কতক্ষন যে এইভাবে চলল সেটা ঋতু এবং রাহুল বুঝতে পারল না। তার মধ্যে শুরু হল বিশাল ঝড়-বৃষ্টি ও বজ্রপাত। রাহুল আর ঋতুর মনে হল এটাই বোধহয় তাদের জীবনের শেষ দিন। সেই গাছের ওপরে একসময় তাদের মনে হল, আর বোধহয় বসে থাকতে পারবে না। কিন্তু নীচে পড়ে গেলে সাক্ষাৎ মৃত্যু। কোনোরকমে তারা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে গাছের উপর নিজেদের আটকে রাখল। এইভাবে কখন যে সেই কালরাত্রি কেটে গেল তারা বুঝতেও পারল না। সকালবেলা যখন সূর্যের প্রথম কিরণ তাদের মুখে এসে লাগল, তখন তাদের জ্ঞান ফিরল। আর আগের দিন রাত্রে বিভীষিকার কথা তাদের যেন একটা দুঃস্বপ্ন মনে হচ্ছিল। কিন্তু, আশপাশের অবস্থা দেখে সেগুলো যে সত্যিই ছিল সেটা তারা অনুভব করতে পারল । কাল যখন থেকে সেই দুর্যোগ শুরু হয়েছিল আর আজ সকাল পর্যন্ত তারা একটাও কথা বলতে পারেনি। এতক্ষণ পর ঋতু মুখ খুলল, -“আচ্ছা এটা কি ছিল!”
– “যতদূর বোঝা যাচ্ছে প্রথমে খুব জোর ভূমিকম্প হয় তারপর সুনামি।”
– “সুনামি, তুমি সিওর কী করে হচ্ছো? জোয়ারের জন্য তো জল আসতে পারে।”
– “ভূমিকম্প তো আমরা বুঝতেই পেরেছি। আর সাধারণত এইরকম সমুদ্রে ভূমিকম্পের পর সুনামি হয়, আর এত বিশাল ঢেউ সুনামি ছাড়া হতেই পারে না।”
সেই সময় গাছের নীচে তাদের বোটটার অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে আর দ্বীপের বহু জায়গায় তখনও সমুদ্রের জল জমে আছে।
রাহুল আর ঋতু আস্তে আস্তে গাছ থেকে নামল। ঋতু বলল,
– “এই দ্বীপটা পাহাড় দিয়ে ঘেরা, না হলে আজ পুরো সমুদ্রের তলায় ডুবে যেত। আর আমাদেরও খুঁজে পাওয়া যেত না। আচ্ছা এই সুনামি তো অনেকটা জায়গা জুড়ে হয়। তাহলে আমাদের জাহাজ আর বিনটান আইল্যান্ডে যারা ছিল তাদের কী অবস্থা হয়েছে বলো তো?”
রাহুলের মুখ দিয়ে কথা সরল না। সত্যিই, কী যে হয়েছে ভাবতেও ভয় করে। রাহুল বলল,
– “আমাদের অবস্থা এখন কি রকম সেটা এখন ভেবে দেখা উচিত।”
ওদের বোটটা অনেক জায়গা থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সেটা আর ব্যবহার করার মতো অবস্থায় ছিল না। তবে তাদের ভাগ্য ভাল ছিল, যে বোটের ভেতরের কোন জিনিস ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি বা হারায়নি। কারণ তারা ঝড়ের ভয়ে আগে থেকেই দুটো গাছের মাঝখানে বোটটাকে আটকে রেখেছিল। রাহুল বলল,
– “আমাদের এখান থেকে ফেরার আর কোন উপায় রইল না। না জানি আমাদের খোঁজ না পেয়ে আমাদের বাবা মার কী অবস্থা হবে।”
ঋতু বলল,
– “হ্যাঁ আমার মা যে কী করবেন সেটা আমি ভাবতেও পারছি না। এখানে ফোনের টাওয়ারও নেই, যে কেউ আমাদের ফোন করতে পারবে, বা আমরা কাউকে ফোন করতে পারব। কিন্তু বাবা নিশ্চয়ই কিছু ব্যবস্থা করবে। আমাদের খুঁজে না পেয়ে নিশ্চয়ই কোনও উদ্ধারকারী দল আমাদের খুঁজবে। তাহলে আমরা যদি ঠিকঠাক ভাবে সিগন্যাল দিতে পারি, তারা নিশ্চয়ই আমাদের কাছে পৌঁছাবে”
-“কিন্তু এই দ্বীপটার গঠন এমনি যে কোনও উদ্ধারকারী দল এলে আমরা সহজে তাদের দেখতে পাব না। আর তারাও আমাদের খুঁজে পাবেনা।”
-“বি পজেটিভ এই ভাবে ভেবো না। এখন এটা তো বোঝাই যাচ্ছে যে আমাদের এখানে বেশ কিছুদিন কাটাতে হবে। চলো আমরা এই দিনগুলো যাতে ভালোভাবে কাটানো যায় তার ব্যবস্থা করি।”
– “হ্যাঁ আমাদের আগে থাকার মত একটা ঠিকঠাক ঘর বানাতে হবে, আমাদের বোটের মধ্যে বেশ কিছু খাবারের প্যাকেট আছে, আর জলের বোতল আছে তাই সেগুলো তো কিছুদিন চলবেই। তাছাড়া এখানে মাছ তো প্রচুর আছে,বোটে মাছ ধরার ছোট্ট জালও আছে আর নারকেল আর অন্যান্য ফলও পাওয়া যাবে আমাদের সেগুলো সংগ্রহ করে খাবার ব্যবস্থা করতে হবে।”
সেই মত তারা কাজ শুরু করে দিল। তাদের সঙ্গে একটা জল ফিল্টার করার যন্ত্র ছিল। সেখানে প্রত্যেকদিন বিকালের দিকে বৃষ্টি হওয়ায়, পানীয় জলের কোন অভাব ছিল না।
আস্তে আস্তে তারা বেশ কিছুদিন সেখানে ভালোভাবেই কাটিয়ে দিল। সেখানে থাকতে তারা বেশ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল। তাদের রুটিন ছিল এরকম —সকালবেলা রাহুল সমুদ্র থেকে মাছ কাঁকড়া আরো নানারকম জলজ প্রাণী, যেগুলো খাওয়ার উপযুক্ত সেগুলো সংগ্রহ করত। আর ঋতু জঙ্গল থেকে সিগাল পাখির ডিম, আর খাবার উপযোগী কিছু হার্বস সংগ্রহ করতো। তার মা যেহেতু বোটানির প্রফেসর তাই সেও কিছু গাছপালা চিনতো। খাবার উপযোগী, আর কোনও কাটাছেঁড়া বা সামান্য শরীর খারাপের জন্য মেডিসিনাল প্লান্ট সে সহজেই চিনতে পারতো। আর সেগুলো সংগ্রহ করত। সেখানে প্রচুর নারকেল গাছ থাকায় নীচে বেশকিছু নারকেল পড়ে থাকতো। সেগুলো সংগ্রহ করত। তারা বিভিন্ন সারভাইভাল সোতে দেখে গাছ দিয়ে বাসস্থান বানানোর কৌশল শিখেছিল। সেই অনুযায়ী তারা একটা সুন্দর কুটির তৈরি করে। রাহুল জঙ্গল থেকে আগুন জ্বালাবার জন্য কাঠ নিয়ে আসতো তারপর তারা দুজনে মিলে সংগ্রহ করা খাবার রান্না করে খেত। সারাদিনটা তাদের এই ভাবেই কেটে যেত।
রাহুল তার একটা ছোট্ট গীটার নিয়ে গিয়েছিল সন্ধ্যার পর রাহুল সেটা বাজাতো। আর ঋতু গান করত। এইভাবে দিন যেতে লাগল।
এর মধ্যে একদিন আকাশে পূর্ণচন্দ্র, গোটা সমুদ্র রুপালি চন্দ্রালোকে ভরে উঠেছে, সারা সমুদ্রের মধ্যে কেউ যেন চূর্ণ-বিচূর্ণ করে প্রচুর কাঁচের টুকরো ছড়িয়ে দিয়েছে, সমুদ্রের পাড়ে বালির উপর চাঁদের আলো পড়ে যেন মনে হচ্ছে একটা বিশাল সাদা কার্পেট বিছানো আছে। রাহুল আর ঋতু সমুদ্রের পাড়ে আগুন জ্বালিয়ে বসেছিল ঋতু বলল,
– “আচ্ছা আমরা যদি আর কোনোদিনও না ফিরে যেতে পারি?”
-” তাহলে আর কি হবে আদম আর ইভের মতো আমরাও একটা নতুন সভ্যতা সৃষ্টি করব । “
-“তাহলে তো আমাদের বিয়ে করতে হবে।”
বলেই সে খুব জোরে হেসে ফেলল।
-” চলো করে ফেলি ।”
– ” এখানে বিয়ে কী করে করবে? এখানে তো কিছুই নেই।”
-” কেন সমুদ্র আছে। আর এই দেখো আমি তোমার জন্যে কী রেখে দিয়েছি।”
এই বলে সে একটা ঝিনুকের তৈরি মালা বার করল।
-“বাঃ, এটা তুমি আমার জন্য তৈরী করেছ?”
রাহুল একটু হেসে,
– “না আমি মালা পড়ে বসে থাকব।”
– “সে না হয় বুঝলাম কিন্তু বিয়ে কী করে করব?”
রাহুল কিছু না বলে সমুদ্রে গিয়ে নামল। সেই চন্দ্রালোকিত রাত্রে সমুদ্রের ঠান্ডা জল আর মিষ্টি বাতাস প্রাণ ভরিয়ে দিল।
ঋতুও তার সাথে সমুদ্রে গিয়ে নামল। অনেকক্ষণ তারা সমুদ্রে জলকেলী করল। তারপর পাড়ে উঠে রাহুল আগুনের সামনে বসল আর ঋতু তার কাঁধের উপর মাথা রেখে বসল। গিটারটা নিয়ে রাহুল বাজাতে শুরু করল আর ঋতু একটা মিষ্টি গান ধরল। মনে হতে লাগল যুগের পর যুগ এই ভাবেই দুটি মানব মানবী প্রেমের প্রাসাদ গড়ে তুলেছে।
আরো কিছুদিন এইভাবে কেটে গেল। ঋতু আর রাহুল এখন প্রায়ই জঙ্গলের বেশ কিছুটা ভেতরের দিকে ঘুরে বেড়ায় । এর মধ্যে তারা একেক সময় সেই নির্জন দ্বীপের মধ্যে মানুষের বসবাসের চিহ্ন খুঁজে পায়। ঋতু, রাহুলকে বলে,
– ” আচ্ছা এই যে বিয়ার ক্যান, নারকেলের ছোবড়া, বাসনপত্র এগুলো কোথা থেকে আসে বলোতো।”
জঙ্গলের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে তারা দেখতে পায় একটা উঁচু ঢিবির ওপরে অনেক লতাপাতা আর গাছপালা গজিয়ে উঠেছে। তাদের মনে কৌতুহল জাগে। ঋতু, রাহুলকে বলল,
– ” আচ্ছা এই ঢিবিটা এই জঙ্গলের মধ্যে কীরকম অদ্ভুত ধরনের লাগছে না?”
– ” চলো কাছে গিয়ে একবার দেখা যাক।”
কিন্তু কাছে যেতেই তাদের ভুল ভাঙলো সেটা কোনো ঢিবি নয়, সেটা আসলে একটা কুঁড়ে ঘর। কিন্তু দেখেই বোঝা যাচ্ছে অনেক বছর এটা ব্যবহার করা হয় না। ঘরটা পুরো লতাপাতায় ঢেকে গেলেও, সামনের দিকে একটা দরজার ফাঁক বোঝা যাচ্ছে। রাহুল, ঋতু লতাপাতা সরিয়ে কুটিরের ভেতরে ঢুকল। ঘরটির মেঝেতে সিমেন্টের প্রলেপ বোঝা যাচ্ছে। ঘরে ঢুকতেই চোখে পড়ে একটা ছোটো টেবিল,খাটিয়া আর খাটিয়ার ওপরে ও কি!
রাহুল, ঋতু আঁতকে ওঠে। খাটিয়ার ওপরে দেখা যাচ্ছে একটা নরকঙ্কালের মাথা, বাকি দেহটা ছেঁড়া চাদরে ঢাকা পড়ে আছে । একটু ধাতস্থ হয়ে তারা ঘরের চারিদিকে চোখ বোলালো। ঘরে কয়েকটা ছোট ব্যাগ, আর টেবিলে কিছু জিনিস তারা দেখতে পায়। ঋতু বলল,
– “আচ্ছা এটা কে বলতো? দেখেতো মনে হচ্ছে বহু বছর আগে মারা গেছেন। “
-“ওঁর জিনিসপত্রগুলো দেখি তাহলে বোঝা যাবে।”
ওরা টেবিলের ওপর একটা নোটপ্যাড দেখতে পেলো বেশ ভালো মানের হওয়ায়, জিনিসটা নষ্ট হয়নি এখনও। সেটা ওল্টাতে কয়েকটা পাতা জুড়ে চোখে পড়ল একটা দীর্ঘ চিঠি। চিঠিটা ইংলিশে লেখা। তর্জমা করলে এইরকম দাঁড়ায়—
“হ্যালো, আমি টম রবার্টস ,আমার আসল বাড়ি অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরায়। কিন্ত গত ২৫ বছর ধরে আমি এই দ্বীপের বাসিন্দা। যে ব্যক্তি বা ব্যক্তিগণ আমার মৃতদেহটি খুঁজে পাবেন তিনি দয়া করে খ্রিস্টান মতে আমাকে সমাহিত করার ব্যবস্থা করবেন এই দ্বীপের মধ্যেই। এর জন্য আমার সম্পর্কে আপনাদের জানা দরকার। আমি এক বনেদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করি। পৈতৃক সূত্রে অনেক সম্পত্তির অধিকারী যেমন হই, তেমন নিজেও বিভিন্ন ব্যবসা বানিজ্য করে সম্পত্তির পরিমাণ বৃদ্ধি করি। আমার একটি বোন ছিল মেরী। বাবা মা মারা যাবার পর আমিই খুব ভালো একটি ছেলের সাথে তার বিয়ে দি। আমি নিজেও কিছুদিনের মধ্যেই মার্গারেট নামে একটি মেয়ের প্রেমে পড়ি, এবং আমাদের প্রেমের বন্ধন যখন কয়েক বছর পর সুদৃঢ় হল, আমরা বিয়ে করি। বিয়ের পর ম্যাগি(মার্গারেট) আমার জীবন তার ভালোবাসা আর স্নেহ দিয়ে ভরিয়ে রেখেছিল। ওকে ছাড়া আমার জীবন ছিল অন্ধকার,অসম্পূর্ণ। বিয়ের কয়েক বছর পর আমাদের একটি ছেলে হল ,নাম দিলাম জনাথন। কিন্তু তারপরেই ম্যাগি খুব অসুস্থ হয়ে পরে। এমনিতেই সে দূর্বল ছিল। তার ওপর অতিরিক্ত রক্তপাতের ফলে ম্যাগি মারা যায়। আর তার সাথে সাথেই আমার জীবনও শেষ হয়ে যায়। আমার বোন তখন আমার কাছে ছুটে আসে ,বিয়ের বহু বছর পরেও সে নিঃসন্তান ছিল তাই মাতৃহারা জনাথনকে সে মাতৃস্নেহে বুকে টেনে নেয়। আমার আর তখন ম্যাগীকে হারিয়ে পার্থিব কোনো জিনিসের প্রতি কোনো আগ্রহ ছিল না। তাই আমিও আর আপত্তি করিনি।তখন আমার আর কোনও মানুষের সঙ্গ কিংবা কারোর সাথে কথা বলা, এইসব দুর্বিসহ মনে হতো। মেরী অনেক চেষ্টা করেছিল আমাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে কিন্তু কিছু লাভ হয়নি। আমি আত্মহত্যা করার কথাও ভেবেছিলাম। কিন্তু সাহসে কুলিয়ে ওঠেনি। তাই অবশেষে ঠিক করলাম এমন কোথাও চলে যাব যেখানে কোনও মানুষের সংস্পর্শে আসতে হবে না। সমগ্র পৃথিবী থেকে দূরে,সব কিছু ছেড়ে চলে যাব। সেই মতো সমস্ত সম্পত্তি মেরী,জনাথন আর যাকে যা কিছু দেওয়ার দিয়ে খুঁজে নিলাম এই দ্বীপটা। এখানে চলে এলাম কাউকে কিচ্ছু জানতে না দিয়ে। এখানে শুধু আমি আর আমার ম্যাগীর স্মৃতি।
এখানে বেঁচে থাকার জন্য যা সামান্য কিছু দরকার তা নিয়ে আসতাম সামনের একটা জনবসতি পূর্ণ দ্বীপ থেকে। আমি একটা ছোটো ডিঙি নৌকায় সমুদ্রে যাতায়াত করি। ২৫ টা বছর ম্যাগীর স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে এইভাবেই কাটিয়ে দিলাম। পরিবার বা আর কারোর সাথেই কখনও যোগাযোগ করার চেষ্টা করিনি। কিন্তু আজ শেষ সময়ে তাদের কথা খুব মনে পড়ছে। আমার লেখার শক্তিও ফুরিয়ে আসছে,এই জনহীন জায়গায় সামান্য রোগও মৃত্যুর কারণ হতে পারে। আমাকেও কাবু করেছে সামান্য জ্বর, আমার ডিঙিতে করে চিকিৎসা করাতে যাওয়ার শক্তি ছিল না,আর অসুস্থতার জন্য খাদ্য সংগ্রহ করতে না পারায় কদিন ঠিক করে খাওয়াও হয়নি।তাই মৃত্যুকে আটকানো গেল না। যাক আমার হাতে আর বেশী সময় নেই তাই আসল কথাটা বলে ফেলি। ম্যাগী যেহেতু আমাদের সন্তান রূপে আমাকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ উপহারটি দিতে চলেছিলো তাই আমিও তাকে একটি উপহার দেব বলে ঠিক করি। এর জন্য আমি আমার সম্পত্তির অর্ধেক দিয়ে একটি বিরল দুর্মূল্য ব্লু ডায়মন্ড কিনে সেটা দিয়ে একটা আংটি তৈরি করি। হায় ! উপহারটা দেওয়ার আগেই তো ম্যাগী আমাকে ছেড়ে চলে গেল। আমি এই আংটিটা আমার সঙ্গেই রেখেছি। আমি চাই যে সজ্জন ব্যক্তি আমার সৎকারের ব্যবস্থা করবেন তিনি যেন এটা নেন। আমার মন বলছে সেই ব্যক্তির হৃদয় নিশ্চই ভালোবাসা পূর্ণ হবে। তাই এই আংটিটা যদি তিনি নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে উপহার দেন তাহলে আমার আত্মা শান্তি পাবে। আংটিটা আমার টেবিলে ড্রয়ারের মধ্যে রাখা আছে। আর যদি আমার ছেলের সাথে আপনাদের দেখা হয় তাকে বলবেন আমি তাকে খুবি ভালবাসতাম। তার জন্য রেখে যাচ্ছি একটা ম্যাপ।
আমি যে দ্বীপ থেকে খাবার সংগ্রহ করতে যেতাম সেখানে এক গরীব জেলের সাথে আমার পরিচয় হয়। তার ছেলের টিউমার অপারেশন করার জন্য টাকার দরকার ছিল। সেই জেলের টাকা ছিল না। আমি তাকে আমার একটা দুর্মূল্য আংটি দিয়ে সাহায্য করি। এর বদলে সেই জেলে আমাকে বলে,
-“বাবু আপনাকে দেবার তো আমার কাছে কিছু নেই । তবে আমার প্রপিতামহ স্পেনের একটা জাহাজের সারেং ছিলেন। তিনি একটা দুর্ঘটনায় আহত হয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। তার গুলি লেগেছিল। আমার প্রপিতামহ সবাইকে বলেন তাদের জাহাজের ক্যাপ্টেন অনেক সম্পত্তি একা ভোগ করার জন্য তাকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন। বাড়ি ফিরে প্রপিতামহ একটা ম্যাপ তৈরি করেন। আর পরিবারের লোকেদের বলেন সম্ভবত সেই জাহাজের ক্যাপ্টেন সেই ম্যাপে দেখানো একটা দ্বীপে আমেরিকার আদিম ইনকা মানুষদের অনেক ধনসম্পদ লুকিয়ে রেখেছেন। পরিবারের লোকেদের, প্রপিতামহ সেই সম্পদ উদ্ধার করতে বলেন। কিন্তু আমরা গরীব আমাদের এই সমুদ্র যাত্রার সামর্থ্য ছিল না। তাই আমরা তা করতে পারিনি। আমি আপনাকে এই ম্যাপটা দিচ্ছি। যদি পারেন এই সম্পদ আপনি উদ্ধার করবেন।”
আমার এই সম্পদ উদ্ধারের প্রয়োজন বা ইচ্ছা কোনোটাই ছিল না। তাই এই ম্যাপটা আমার ছেলের জন্য রেখে যাচ্ছি । না থাক, আর কোনও আবদার করব না। আর লিখতে পারছি না। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।”
চিঠিটা এখানেই শেষ হয়েছে। রাহুল আর ঋতু ঠিক করল এই ব্যক্তির সৎকারের জন্য যতটুকু পারে ব্যবস্থা করবে। এই ব্যাক্তির ব্যাবহার করা যন্ত্রপাতি সেখানেই ছিল তার মধ্যে মাটি খোঁড়ার জন্য প্রয়োজনীয় কোদাল ,কুড়ুল, শাবলও তারা পেয়ে যায়। যদিও খুব পুরনো, কিন্তু কাজ চলে যায়। সেগুলো দিয়ে দুজনে মিলে অনেক পরিশ্রম করে মাটি খুঁড়ে সেই ব্যক্তিকে কবর দিল। কাঠ দিয়ে একটা ক্রস বানিয়ে সেখানে পুঁতে দিল। আর জঙ্গল থেকে আনা কিছু ফুল দিয়ে তার কবরটা সাজিয়ে দিল। তারপর তার আত্মার শান্তির জন্য ভগবানের কাছে প্রার্থনা করল।
এরপর তারা টমের কুটির থেকে চিঠিটা আর তার কিছু কাগজ পত্র আর ম্যাপটা নিজেদের সঙ্গে নিল। আর ড্রয়ার থেকে আংটির বাক্সটাও অবশ্য নিতে ভুলল না।
এইসব নিয়ে তারা যখন নিজেদের আস্তানায় ফিরল তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে সেদিনও ছিল একটি পূর্ণ চন্দ্র রাত্রি। সারাদিনের ক্লান্তিতে আর ঘটনার আকস্মিকতায় তারা প্রায় বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। সাদা বেলাভূমির ওপর তারা যখন পাশাপাশি বসল। রাহুল তখন বাক্সের মধ্যে থেকে প্লাটিনামের সুন্দর নকশা করা রিংয়ের ওপর বসানো নীল হীরক খণ্ডটি বার করল । চাঁদের রুপালি আভায় মনে হল সারা ব্রম্ভান্ডের যত নীল রং আছে ,আকাশ, সমুদ্র,নিহারিকা সব এই এক খন্ড হীরের মধ্যে এসে মিশেছে । রাহুল ঋতুর অনামিকায় সেই আংটিটা পড়িয়ে দিল। তারপর দুটি নরনারীর দুটি চোখ ,ঠোঁট,মন, শরীর সব একে অপরের সাথে মিশে গেল। তারা মেতে উঠল এক আদিম শরীরী খেলায়।
এরপর কিছুদিন কাটে। তাদের এই সুখের দিন তাড়াতাড়িই শেষ হয়ে গেল। হঠাৎ রাহুলের খুব জ্বর হল। ঋতু তার সাধ্য মত যথাসম্ভব করল । তার যতরকম ভেষজ গাছপালা জানা ছিল ,সব রকম টোটকা করেও কিছু হল না। ফলে ঋতু কিরকম ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ল, এই নির্জন দ্বীপে বিনা চিকিৎসায় সামান্য জ্বরও ভয়ংকর হতে পারে। এই চিন্তায় অন্যমনস্ক হয়ে সে একটা পাথরে ঠোক্কর খেল। আর তার পায়েও মোচড় লাগল।তারা দুজনেই কার্যত অক্ষম হয়ে পড়ায় তাদের খাবার সংগ্রহও লাটে উঠল। এইভাবে রোগের যন্ত্রণায়,অনাহার, অর্ধাহারে তাদের সুখের স্মৃতি, তাদের এই নির্জন দ্বীপে অভিযানের আনন্দ সব ম্লান হয়ে গেল। বারবার তাদের টমের সেই কথাটাই মনে হতে লাগল। সামান্য রোগও এখানে মৃত্যুর কারণ হতে পারে। এই কয়েক দিনের মধ্যেই রাহুলের গ্রীক গডের মত শরীর বেশ ভেঙ্গে পড়েছে। আর ঋতুর সোনার মত গায়ের রং কিরকম ফ্যাকাসে সাদা হয়ে গেছে। তাদের চোখের কোলে জমেছে হতাশার অন্ধকারের কালি।
এইরকমই আর একটি যন্ত্রণাময় রাত কাটিয়ে তারা বেশ বেলা পর্যন্তই শুয়ে ছিল। উঠেই বা লাভ কী, সেইতো কষ্ট পেতে হবে।
এই রকমই দুজনে ভাবছে হঠাৎ ঋতু কিসের যেন শব্দ শুনতে পেল। কান খাড়া করে ভাল করে শুনে ঋতু, রাহুলকে জোড়ে ঝাঁকুনি দিয়ে ডাকল। ঋতু বলল,
– “এটা জাহাজের শব্দ না?”
দুজনে চোখ কচলে ভালো করে দেখেই উত্তেজিত হয়ে হল । হ্যাঁ ওটা তো জাহাজই। দুজনে কোনও রকমে পড়ি কী মরি করে তাদের সব সিগন্যাল দেওয়ার জিনিসগুলো নিয়ে এল। রাহুল টর্চ জ্বেলে নিভিয়ে আর আয়নার সাহায্যে সিগন্যাল দিতে লাগল। ঋতু একটা ফ্ল্যাগ নিয়ে নাড়াতে শুরু করল। ঋতু বলল,
– “নিশ্চই বাবা আমাদের খোঁজার জন্য সার্চ পার্টি পাঠিয়েছে।”
– “এটা মরীচিকা বা স্বপ্ন নয় তো।”
এই বলে রাহুল বারবার নিজের গায়ে চিমটি কেটে দেখতে লাগল।
তাদের এত উত্তেজিত হওয়ার আর সিগন্যাল দেওয়ার অবশ্য দরকার ছিল না। কারণ সেই জাহাজটি সেই দিকেই আসছিল।
আর তারপর যখন জাহাজটা সেই দ্বীপে এসে ভিড়ল অতিরিক্ত উত্তেজনায় আর ক্লান্তিতে তারা দুজনেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেল।
(৪)
ঋতু আর রাহুল যখন চোখ খুলে দেখলো, তারা একটা জাহাজের কেবিনের ভেতর শুয়ে আছে।আর তাদের চারপাশে কয়েকজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন। ঋতু আর রাহুল নিজেদের পরিচয় দিয়ে সব কিছু খুলে বলল। কিন্তু যখনই তারা তাদের উদ্ধারকারীদের এবং সেই উদ্ধারকারী দলের প্রধানের পরিচয় পেল তখন ঋতু তার পায়ের ব্যথা ভুলে প্রায় লাফিয়ে উঠে বলতে লাগল,
– “আছে আছে আমাদের টেলিপ্যাথির জোর আছে”।
আর রাহুল তো “ইউরেকা ইউরেকা” বলেই চেঁচিয়ে হল।
তাদের আশপাশের লোকেরা ভাবল হয়তো এরা কোনও শক পেয়ে পাগল হয়ে গেছে। আসল ব্যাপার হল তাদের উদ্ধারকারী দলের প্রধান আর কেউ নয় টম রর্বাটসনের ছেলে জনাথন। টম এই দ্বীপে চলে আসার পর তার বোন আর বোনের হাসব্যান্ড টমের অনেক খোঁজ করেন। কিন্তু কিছুতেই কোনও লাভ হয়নি। অনেক খোঁজার পর তারা টমকে পাওয়ার আশা ত্যাগ করেন। কিন্তু জনাথন বড়ো হয়ে আবার নতুন উদ্যমে আবার নিজের বাবার খোঁজ শুরু করে।আর সৌভাগ্যবশত টম যে দোকান থেকে তার প্রয়োজনীয় জিনিস সংগ্রহ করতো সেই দোকানের মালিকের সাথে জনাথনের কার্যত পরিচয় হয়। তার কাছ থেকেই জনাথন জানতে পারেন তার বাবা এই চীন সাগর আর ভারত মহাসাগরের মাঝে কোনও নির্জন দ্বীপে আছেন। যদিও তার সঠিক আস্তানার খবর ওই দোকানের মালিকটি দিতে পারেননি। কিন্তু এটুকু জানার পরই জনাথন এই অঞ্চলের সব দ্বীপগুলোতে তার বাবাকে খোঁজা শুরু করেন। বেশ কয়েকমাস খোঁজার পর এক ভয়াবহ সুনামির জন্য তাদের আটকে যেতে হয়। এই সুনামিতে বহু দ্বীপ ধ্বংস হয়ে, সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে গেছে। অবশেষে তারা এই দ্বীপটিতে খুঁজতে এসেছেন।
রাহুল আর ঋতু জনাথনকে টমের ব্যাপারে সব কিছু বলে। আর টমের চিঠি, দরকারি কাগজপত্র ও সেই ম্যাপটা দেয়। হ্যাঁ সেই আংটিটা অবশ্য তারা জনাথনকে দিতে ভোলেনি। কিন্তু টমের চিঠি পড়ার পর জনাথন বলেন এই আংটিটা বাবা তাকে যে বা যারা সমাহিত করবে তাদের, মানে আপনাদের দিয়ে গিয়েছিলেন। তাই এই আংটিটা আপনাদেরই প্রাপ্য। আপনারা যদি এটা দয়া করে গ্রহণ করেন, তাহলে আমিও খুশী হব। আর আমার বাবার আত্মাও শান্তি পাবে। এরপর ঋতু আর রাহুল আংটিটা নিতে আপত্তি করেনি।
জনাথন তার বাবার কবরের ওপর এই দ্বীপেই একটা সমাধি তৈরী করেন। রাহুল আর ঋতুর চিকিৎসার ব্যবস্থা, আর তাদের দেশে ফেরার সমস্ত ব্যবস্থাও করে দেন।
তারা যখন বাড়ি ফিরল তখন তো সবাই ভূত দেখার মতই চমকে ওঠে। পরে অবশ্য তাদের সব বৃত্তান্ত শুনে খুশিতে ফেটে পড়ে। সেই ভয়ংকর সুনামিতে ভারত , ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুরের উপকূল অঞ্চল,আর ছোট ছোট দ্বীপগুলো সব ধ্বংস হয়ে গেছে। হাজার হাজার মানুষ মারা গেছেন। তার মধ্যে মিস্টার সেন আর তার স্ত্রীও আছেন। রাহুল আর ঋতু ভাগ্যের জোরে যেহেতু এই দ্বীপটায় পৌঁছে গিয়েছিল তাই বেঁচে গেছে। এই গল্পটা এখানেই শেষ। রাহুল আর ঋতু অবশ্য একসঙ্গে জনাথনের অভিযানে এবং আরও অনেক অভিযানে গিয়েছিল কিন্তু সেই গল্প পরে অন্য কোনও দিন হবে।