বন্য নয় অন্য প্রেম| কঠোর ভাবে প্রাপ্তমনস্কদের জন্য | পিয়ালী ঘোষ| Bengali Stories for Matured
0 (0)

_অপুদা, সিক্স প্যাক-ট্যাক বানিয়ে দিনদিন নিজেকে দিনদিন যা হ্যান্ডু করছ…উফ্! মাথা ঘুরে যাচ্ছে তোমাকে দেখে!  নিজেকে কী কষ্টে যে কন্ট্রোল করে রেখেছি…

বলতে বলতে একটা দুষ্টুমি মাখানো হাসি হাসে কিংশুক। অর্পণের ঠোঁটের কোণেও একটা চাপা হাসি ফুটে ওঠে। বলে,

_কী যে বলিস?

_না গো অপুদা, সত্যি। তুমি যখন ঘুমাও, আমি কতদিন তোমার দিকে তাকিয়ে থাকি জানো? এমনিতে দেখলে তো বকা দেবে, তাই তুমি ঘুমালে তোমাকে দেখি। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে তুমি কতবার হেসে ওঠো জানো? কী সুন্দর যে লাগে তোমাকে!

অর্পণ হাসে। বলে,

_যাই কর ভাই, চিঁড়ে ভিজবে না। আমি তোর মতো হোমো নই, আমার পিছনে পড়িস না, বুঝলি? অন্য পার্টনার খোঁজ।

_ধুস! তোমার শুধু উলোপাল্টা কথা। তবে তুমি তো জানোই তোমাকে আমি ভালোবাসি। সে তুমি আমাকে ভালো বাসো আর নাই বাসো তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না। আমি হোমো বলে কি আমার ভালোবাসার কোনো মূল্য নেই? এই যে তোমার সঙ্গে রুম শেয়ার করি, তোমার সঙ্গে গল্প করি, তুমি অন্যদের মতো আমার মেয়েলী স্বভাব নিয়ে খিল্লি করো না, আমাকে তোমার মনের কথা খুলে বলতে পারো… এগুলোই আমার কাছে অনেক জানো?

কথা বলতে বলতে কিংশুক এসে বসেছে অর্পণের বিছানায়, ওর পাশে। অর্পণ জানে , কথা বলতে বলতেই শরীর ছুঁয়ে দেওয়ার ছুতো খোঁজে ছেলেটা। প্রথম প্রথম অস্বস্তি হলেও আজকাল আর কিছু বলে না ওকে। ওকে ছুঁয়ে যদি কেউ আনন্দ পায় তো পাক। তাছাড়া প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে এই ছেলেটাই পাশে থাকে তার। ভোররাতে মেসে ফিরলে এই ছেলেটাই ঘুমচোখে উঠে দরজা খুলে দেয়। ছোটখাট অসুখ-বিসুখে রাত জেগে পাশে থাকে। পকেটমানির টাকা থেকে ওর জন্য ফল কিনে আনে। ধুয়ে কেটে খাইয়েও দেয়, না খেলে অভিমান করে।

 আজও কিংশুক ওর কোমরটা জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় কী একটা বলতে যাচ্ছিল। ঠিক তখনই তার তলপেটের উপরে কিংশুকের স্পর্শ লাগতেই অব্যক্ত এক যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠল অর্পণ, ব্যথায় মুখ সমেত কানদুটো পর্যন্ত লাল হয়ে গেল। চরম বিরক্তিতে ওর মুখ থেকে বেরিয়ে এল অশ্রাব্য এক গালি। যা ওর প্রকৃতির সঙ্গে যায় না। ও নিজেও জানত না ওই নোংরা খিস্তিগুলো যেগুলো ওকে পয়সার তাগিদে হজম করতে হয়, সেগুলোকে ওর মগজ সযত্নে সংগ্রহ করে রেখেছে। শুধু কী তাই, ক্ষেত্রবিশেষে সেগুলোর প্রয়োগও করে ফেলছে! শান্ত মুখচোরা নিরীহ ভদ্র ইত্যাদি বাছবাছা উপমা দিয়ে যারা তার ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট তৈরি করত তারা কি আজ আদৌ মেলাতে পারবে, গ্রাম থেকে মাত্র দুটো বছর আগে উঠে আসা ছেলেটা এতোটা বদলে গেছে!

গালাগালি খেয়ে কিংশুক মুহূর্তের জন্য হতবাক হয়ে গিয়েছিল। অর্পণের প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়ে তার ধারণা হয়েছিল, অর্পণও হয়ত তার থেকে বিশেষ কিছু চায়, ওরও হয়ত ভালোলাগে তাকে। কিন্তু আজ তো সে এমন কিছুই করেনি, যাতে অর্পণ এমন ক্ষেপে গিয়ে তার মা তুলে গালাগালি করতে পারে! মুহূর্তে তার চোখদুটোয় জল চিকচিক করে উঠেছিল। সেদিকে তাকিয়ে অর্পণেরও ভীষণ খারাপ লাগছিল। বেশ্যাপাড়ার নোংরা গালি পাওয়ার মতো কাজ তো ছেলেটা করেনি। সে মৃদুস্বরে বলল,

_সরি, ভাই, বেরিয়ে গেছে মুখ ফস্কে… আসলে কী জানিস, টয়লেটে অসাবধানে সিগারেটের ছ্যাঁকা লেগে তলপেটের নিচটা পুড়ে গিয়েছিল। তার উপর ওই জায়গাতে প্যান্টের সঙ্গে ঘষা লেগে দগদগে ঘা হয়ে গেছে। তাই তুই হাত দিতেই…

কথা শেষ করতে না দিয়েই কিংশুক ব্যথামাখা স্বরে বলল,

_আমি না চিরকাল তারকাটা পাবলিক! কী যে করে বসি তার ঠিক নেই! ইস্, তোমাকে কত কষ্ট দিলাম। দেখি কোথায় কী হয়েছে?

_না ভাই, থাক।

একটা সঙ্কোচ কাজ করছিল অর্পণের। একজন পুরুষ রুমমেটকে নিজের তলপেট দেখানোই যায়, কিন্তু কিংশুক তো শুধু পুরুষ নয়; কিংশুক বিশেষ, তার চাহিদাও বিশেষ। সেটা জানার পর নিজের খোলা শরীর দেখিয়ে ওকে উত্তেজিত করার কোনো মানেই হয় না। ওর জন্যই আজকাল রুমে ড্রেস চেঞ্জ পর্যন্ত করে না অর্পণ। তারপর পোড়াটা দেখে যদি হাজারটা প্রশ্ন করে বসে! ওর মনে যদি অবিশ্বাস দানা বাঁধে! ছ্যাঁকা খাওয়া এক আর এভাবে পোড়া আরেক; এটা তো যে কেউ বুঝে ফেলবে। তখন যদি ও প্রশ্ন করে, কে তোকে এমন করে ছ্যাঁকা দিল? কী উত্তর দেবে এর। তাই বিষয়টা এড়িয়ে যেতে তাকে একটু রুক্ষ হতেই হলো,

_সাধে গাল দিই তোকে, তুই মালটাই না বহুত হারামী আছিস। শুধু ছুতো খুঁজিস…

_আরে না না, ভাবলাম কী হয়েছে দেখি। আচ্ছা থাক। শুধু শুধু অপমানিত হওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই আমার…

আহত মুখে একটু রাগ দেখিয়েই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল কিংশুক। এক্ষুনি আর ফিরবে না, ওকে ভালো করেই চেনে অর্পণ। অর্পণের কাছে ঝাড় খেলেই ওর প্রেমিকার মতো গোঁসা হয়। দু চারদিন থমথমে মুখে ঘোরে, কথা-টথা বলে না বিশেষ। অর্পণও ওকে বিশেষ পাত্তা দেয় না এই সময়টা, তারপর দিনকতক কাটলে সুড়সুড় করে হাজির হয়। হাসিমুখে পাশে বসে, কথা বলে, ভাব জমানোর চেষ্টা করে। অর্পণ ইচ্ছে করে মুখ গোমড়া করে মজা নেয়, ওর চোখমুখে ফুটে ওঠা আকুতি উপভোগ করে… তারপর আবার মিলমিশ করে নেয়। অর্পণ মাঝেমাঝে ভাবে এই মেয়েলি মুখ আর স্বভাবের ছেলেটা যদি সত্যিই কোনো মেয়ে হতো তবে কি তাকে এমন করে উপেক্ষা করতে পারত ও? কে জানে। কিংবা এমনটাও তো হতে পারত কিংশুক যেভাবে তাকে চায়, ঠিক সেভাবে যদি রঙ্গন তাকে চাইত! তাহলে বোধহয় জীবনটা অন্য খাতে বইত ওর।

রঙ্গন নামটা মনের গলিতে উঁকিঝুঁকি মারতেই অর্পণের যন্ত্রণায় যেন প্রলেপ পড়ল। ভার্সিটির রঙিন প্রজাপতিদের ভিড়ে ও যেন একটা রাণী মৌমাছি। যার চলনে বলনে দাপুটে দেমাক আর আভিজাত্য পুরো মাত্রায় মেশানো। যার মধ্যে শুধু সৌন্দর্য্যের চটক নেই বরং এমন কিছু একটা আছে যার সামনে পুরুষকুল মাথা নত করতে বাধ্য। তাছাড়া তার সাহচর্য পেতে হলে হুলের দংশনও খেতে হয় অবধারিত ভাবে। যে মেয়ে ছাত্রছাত্রীদের দাবিদাওয়া নিয়ে অবলীলায় ক্যাম্পাসের সামনে ধর্ণায় বসে যেতে পারে, বেঞ্চ বাজিয়ে ডিবেট করতে পারে, ছাত্র রাজনীতির ঝান্ডা ধরে রক্ত গরম করা ভাষণ দিতে পারে আবার সেই মেয়েই ক্যাম্পাসের খোলা মাঠে সকলের সামনে বয়সে ছোট একটা ছেলের ঠোঁটে অবলীলায় চুমু দিয়ে বলতে পারে,

_তোর ঠোঁটদুটো দেখে চুমু দিতে ইচ্ছে করছিল।

অর্পণ ওকে বিশেষভাবে আবিষ্কার করে ওই চুমুপর্বের দিনটাতে। নিজের গ্রামের গণ্ডির বাইরে সে সেই অর্থে দিন কাটায়নি কখনও। গ্রামের স্কুল কলেজের বৃত্তেই তার জীবন কেটেছে এতকাল। এমনিতেই সে একটু অন্তর্মুখীন, তারপর এই বিশাল ক্যাম্পাসে এসে তার তো ডাঙায় তোলা মাছের মতো অসহায় লাগতে শুরু করেছিল। সহজে বন্ধুত্ব পাতানোর সহজাত ক্ষমতা না থাকায় এই জনঅরণ্যেও একা একা লাগত তার। নিজের ক্লাসরুমের প্রথম বেঞ্চটায় সে একাই বসত। ক্লাসরুমে সে যেন কেমন একটা অস্পৃশ্য জীবের মতো একাই ফার্স্ট বেঞ্চ দখল করে বসে থাকত। পাশে বসার মতো পেত না কাউকে। একটা জিনিস সে অবশ্য লক্ষ্য করে দেখেছে, স্কুল জীবনে ফার্স্ট বেঞ্চের জন্য কাড়াকাড়ি থাকলেও কলেজ থেকেই সবাই যেন পিছনের বেঞ্চের দিকে সরে যেতে চায়, যেন সেখানে গোপন মধু জমা আছে! অর্পণ অবশ্য চিরকাল “ফার্স্ট বেঞ্চে বসা গুড বয়”। তাকে এই তকমাই দিয়েছিল রঙ্গন।

সবে ভার্সিটিতে তার সপ্তাহ খানেক কেটেছে। সেদিন ডি বি স্যার জলদগম্ভীর স্বরে “বীরাঙ্গনা” পড়াচ্ছিলেন। ক্লাসের দরজা বন্ধ করেই পড়ান উনি। আচমকা ধাঁ করে খুলে গেল দরজা, চমকে উঠলেন প্রফেসর সহ গোটা ক্লাস। ফার্স্ট ইয়ারের কচি খোকা খুকুরা এখনও ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে তেমনভাবে পরিচিত হয়নি, তাদের প্রাথমিক পরিচয় হয়ে গেল এই দিনই। স্যারের পারমিশনের তোয়াক্কা না করেই ক্লাসে ঢুকল একটা মেয়ে, এবং তার পিছু পিছু কিছু অনুগত সহচর। মেয়েটাকে অবশ্য ব্যবহারের দিক থেকে কতটা মেয়ে বলা যায় সে নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল অর্পণের। তার পরণে একটা হাতা গোটানো শার্ট আর ছেঁড়া খোঁড়া জিন্স। মাথার চুল কদম ফুলের মতো করে ছাঁটা। তবে তার একহারা শরীরে অবশ্য নারীত্বের চিহ্ন একটু বেশি মাত্রাতেই প্রকট। সে আর তার দলবল ঢুকতেই টিচার ক্লাসে ঢুকলে সম্মান জানানোর জন্য ছাত্রেরা যেমন উঠে দাঁড়ায় তেমনি গোটা ক্লাস উঠে দাঁড়িয়েছিল, কেবল অর্পণ ছাড়া। ঘটনার আকস্মিকতায় হতবাক অর্পণ বুঝতেই পারেনি তার পিছনে সকলে উঠে দাঁড়িয়েছে আর সে সামনের বেঞ্চে ভ্যাবলার মতো বসে আছে।

মেয়েটি প্রফেসরের উদ্দেশ্যে বলেছিল,

_অনেক তো বইয়ের শিক্ষা দিলেন, স্যার। এবার আপনি আসুন আমরা একটু জীবনের পাঠ পড়াই এদের…

ক্লাস শুদ্ধু সকলেই অবাক হয়েছিল এই দেখে যে, স্যার একটি প্রতিবাদ মাত্র না করে ক্লাস ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। স্যার চলে যাওয়ার মেয়েটি অর্পণের দিকে এগিয়ে এসে বলেছিল,

_পায়ে ব্যথা?

অর্পণ প্রশ্নের মানে না বুঝে বোকার মতো কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলেছিল,

_কই না তো!

সাজানো দাঁতের পাটিতে মুক্তো ঝরিয়ে গালে টোল ফেলেছিল মেয়েটি। তারপর ওকে বলেছিল,

_তাহলে তো তুই ভারী ঘোরেল চিজ আছিস। আরে সিনিয়রদের সম্মান দেওয়া বলে একটা জিনিস আছে নাকি? দাঁড়াও দেখি দুপায়ের উপর… কী, দাঁড়াতে পারো নাকি এখনো হামা টানো?

উঠে দাঁড়িয়েছিল অর্পণ। প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে তেজিয়ান ভঙ্গিমায় ভাষণ ঝাড়ল রঙ্গন। ছাত্রদের কীভাবে বঞ্চনা করে চলেছে প্রফেসর থেকে সরকার পর্যন্ত, সেই নিয়ে ফিরিস্তি দিল। গোটা ক্লাস নিঃস্তব্ধ হয়ে শুনছিল যখন তখন অপমানে কান গরম হয়ে কান্না পেয়ে যাচ্ছিল ওর। ছাত্রদের বঞ্চনা নিয়ে ভাষণ দিচ্ছে অথচ তার প্রতি এমন অনুচিত ব্যবহার কেন মেয়েটার? জোর করে সম্মান আদায় করে নেবে! কে এমন কেউকেটা ও? ছাত্র ইউনিয়নের কোনো লিডার নিশ্চয়ই। অর্পণের বুকের ভিতর ক্ষোভ ফুঁসে উঠছিল। বক্তৃতা শেষ করে মেয়েটা হুকুম জারি করল,

_ফার্স্ট বেঞ্চের গুড বয়, পরের ক্লাসটা করে লাঞ্চ ব্রেকে ইউনিয়ন অফিসে দেখা করিস, তোকে একটু ঘষা মাঝা করতে হবে।

মেয়েটা ক্লাস ছেড়ে বেরিয়ে যেতেই কটা ছেলে উঠে এসে তার পাশে বসে বলেছিল,

_কী লাকি তুই ভাই! প্রথম দেখাতেই রঙ্গনদির নজরে পড়ে গেলি!

অর্পণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়েছিল। ওর মুখের ভাষা পড়ে ছেলেগুলো বলেছিল,

_আরে, রঙ্গন বোস; জানিস না নাকি? কাউন্সিলর ত্রিলোচন বোসের মেয়ে, যুব রাজনীতির উঠতি মুখ…

অর্পণ একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলেছিল,

_ওঃ! নেতার মেয়ে। তাই সকলে এত তোল্লাই দিচ্ছে!

সেদিন ইচ্ছে করেই ইউনিয়নমুখো হয়নি ও। কতদূর কী করতে পারে ওই রঙ্গন, দেখার ইচ্ছে ছিল বোধহয়!

অর্পণের জন্য পরের চমকটা অপেক্ষা করছিল ফ্রেশার্সের দিন। সেই মঞ্চের উপর ছাইরঙের তাঁতের শাড়ি আর কালো বিডসের গয়না পরে রঙ্গন মাইক্রোফোন হাতে উপস্থাপিকার ভূমিকায়। এক বিখ্যাত গায়িকার আসার কথা ছিল, তাঁর জন্য বাঁধা নির্দিষ্ট সময়ের আগে ক্যাম্পাসের স্টুডেন্টরা একের পর এক পারফরমেন্স করে চলেছিল। তারপর শোনা গেল সেই গায়িকা এসে গেছেন, প্রস্তুতির জন্য আধঘন্টা সময় লাগবে তাঁর। ওই আধঘন্টায় রঙ্গন তার সুললিত কন্ঠে একের পর এক বলে চলেছিল সুনীল আর জীবনানন্দের কবিতা। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল অর্পণ। সেও কবিতা ভালোবাসে, শুধু সাহিত্যের ছাত্র বলেই নয় ছোট থেকেই টুকটাক লেখালেখির অভ্যাস ছিল তার। আর এখন তো বাদামি মলাটের ডাইরির পাতাগুলো ভরিয়ে ফেলেছে প্রায়। তেমন বন্ধু হয়ে ওঠেনি এখনও কেউ, তাই ক্লাসের ফাঁকে টুকটাক আঁচড় কাটে ডায়রীতে, সময়টাও বেশ ভালো কাটে, একা লাগে না। তাছাড়া কবিতা পাঠ করতে এবং ভালো কবিতা শোনাটাও তার সমান পছন্দের। সে ভাবতেই পারেনি দাদাগিরি দেখিয়ে বেড়ানো আর গলা ফাটিয়ে বক্তৃতা দিয়ে বেড়ানো মেয়েটির গলায় এমন ভাব আর কারুকাজের অদ্ভুত মিশেল আছে। গোটা পাঁচেক কবিতা শোনানোর পর রঙ্গন বলল,

_আমাদের হাতে আর মিনিট দশেক আছে। এইটুকু সময়ে আমি পাঠ করছি এক সুপ্ত কবির গুপ্ত কবিতা…

গুপ্ত কবিতা কথাটা বলার সময় সে চোখ মটকে এমন একখানা ভাব দেখালো যে সকলে হো হো করে হেসে উঠল। গুপ্ত কবিতা মানে সকলেই ধরে নিয়েছিল আদি রসাত্মক কোনো কবিতা। রঙ্গন গলাটা একটু ঝেড়ে নিয়ে হাতের মুঠোর ভেতরে রাখা কাগজটা মেলে ধরল চোখের সামনে, তারপর বলে চলল,

_তোমার নদীর মতো বুক ছুঁয়ে আমার উপলভূমি ধুয়ে যায়

তবু খরা জেগে থাকে,

 বন্ধ্যা নারীর মতো পড়ে থাকে হৃদয় আমার।

মরা জ্যোৎস্না একলা কেঁদেছে আর কবে?

নিমফুল গন্ধ মাখা চাঁদটাকে খরিদ করেছে কোনো প্রিয়

তার দয়িতার তরে!

আমি তাই শূণ্য হাতে বসি তোমার দুয়ারে

যদি মুষ্ঠিভিক্ষা দাও একমুঠো ভালোবাসা।

ওইটুকু নিয়ে আমি ছেড়ে যেতে পারি এ গ্রহের খড়কুটো

ওইটুকু নিয়ে আমি জিতে নিতে পারি অসীমের সুখ

ওইটুকু

শুধু ওই ভালোবাসাটুকু রেখো এক কাঙালির তরে।

অর্পণের বুকের ভিতরটায় কে যেন হাতুড়ি পিটছিল, হাতের তালু ঘেমে উঠছিল। এ কী হচ্ছে? কেনই বা হচ্ছে! ওই মেয়েটা এমন করে তার পিছনে পড়ে গেছে কেন? সে তো কোনো ক্ষতি করেনি ওর। তার ডায়রির পাতা থেকে কীভাবে রঙ্গন সংগ্রহ করল কবিতাটা!

ওদিকে আরেকটি কবিতা পাঠ করে চলেছে রঙ্গন,

_ভিজে আঁচলে ঢাকা মায়ের মতো আর্দ্র তোমার আদর

তুমি এক ক্ষণিকা

আমার কবিতার হারানো শব্দেরা তোমার পায়ে পায়ে পথ হাঁটে

তোমার পদ্ম কোরক পায়ে কখনও কী বিঁধেছে ওরা

যদি বা বেঁধে কলমের সূচিমুখ হয়ে তা জমুক আমার শরীরে

ব্যথা নীল অঙ্গে ছুঁয়ে দাও তুমি পলাশ রাঙা ভালোবাসা…

মাথাটা এবার ঝিমঝিম করছিল অর্পণের। কী করতে চলেছে ও! ওর লেখা কবিতাগুলো তবে কি চুরি করল মেয়েটা? সুপ্ত কবি কথাটা উল্লেখ করেছে বটে তবে তার নাম তো একবারও নেয়নি। নিজের লেখা বলে চালাবে নাকি? আর যদি তার নাম নেয়ও তাহলেও তার কবিতা পাঠ করার আগে তার অনুমতিটুকু নেবে না!

ততক্ষণে তিন নম্বর এবং শেষ কবিতা পাঠ করছে রঙ্গন,

_আমি শেফালিকা ভালোবাসিনি কখনও।

যতই শারদ গন্ধ জুড়ে থাক তোমার বৃন্তে,

তবু তুমি মৃতার ঠোঁটের মতো ফুরাও অকালে।

আমি রঙ্গন ভালোবাসি,

প্রসূতির যোনির মতো সৃজনের দাগ লেগে থাকে তোমার শরীরে।

আমি নিজেকে খুঁজে পাই

খুঁজে পাই আমার অনাদি কামনা, একটি ফুটন্ত রঙ্গনে।

কানের লতি গরম হয়ে উঠছিল অর্পণের! কী অবস্থা! এরপর যদি কবি হিসাবে তার নাম নেয় তাহলে গোটা ক্যাম্পাসে তাকে নিয়ে কী পরিমাণ খিল্লি হবে, সেটা ভাবতেও পারে না সে। তাছাড়া এই কবিতায় জড়িয়ে আছে রঙ্গনের নামও। যদি সকলে ভেবে বসে রঙ্গন কে নিয়ে ফ্যান্টাসি করে এই কবিতা লিখেছে সে! তাছাড়া রঙ্গন যদি নিজেও ভাবে এমনটা! তার ডায়রির পাতায় এই কবিতাটা দেখেই হয়ত, ভরা অনুষ্ঠানের মাঝে তাকে অপদস্ত করার জন্য এইসব করে চলেছে। কিন্তু তার কাছে তো কোনো প্রমাণই নেই, এই কবিতা যখন সে লিখেছে তখন সে রঙ্গন কে দেখেইনি। অর্পণের মনে হয় সে ছুটে পালায় এই সমস্ত কিছু থেকে…

রঙ্গন বলে চলেছে,

_আমরা সেই গুপ্ত কবির কাছে আরো কবিতার দাবি জানিয়ে রাখলাম, যাতে যখন তখন তার ভাণ্ডার লুঠ করে কবিতা নিয়ে আসতে পারি। তবে সে তার কবিতায় আমার নাম ব্যবহার করেছে এটা আমার কাছে বিশেষ এক আনন্দের ব্যাপার। আমি আশা করব সে আমাকে নিয়ে পুরো একটা কবিতা লিখে ফেলে আমাকে উপহার দেবে গোপন প্রেমপত্রের মতো। তাহলে আজ আর বেশি কথা নয়, আমাদের মুগ্ধ করতে মঞ্চে আসছেন সবার প্রিয় শিল্পী…

অর্পণের বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। কিন্তু এ কী বলল মেয়েটা, গোপন প্রেমপত্র! তাহলে কী রঙ্গনও ভাবছে তাকে উদ্দেশ্য করে সে লিখেছে ওই কবিতা! নাহ্! ওর ভুল ভাঙাতেই হবে।

ভার্সিটির ফেস্টে লুকিয়ে চুরিয়ে পান পর্বও চলে। উদ্যোক্তাদের অনেকেই স্টেজের পিছনে একটু আধটু টেনেছে। এখন তাদের আর বিশেষ কিছু কাজ নেই শুধু বিশেষ শিল্পীর গানের তালে উদ্দাম নৃত্য করা ছাড়া। অর্পণ আর বসে থাকতে পারছিল না, অধিকাংশই এখন নিজের সিট ছেড়ে উঠে গানের সঙ্গে শরীর দোলাচ্ছে। অর্পণের এখনও এসব ধাতস্ত হয়নি, জনসমক্ষে নাচার আড় ভাঙতে পারেনি ও। তার কেবলই মনে হচ্ছিল, এবার হোস্টেলে ফিরে গেলেই হয়। ও উঠে পড়ে ফেস্ট-হল ছেড়ে বেরিয়ে করিডর ধরে হাঁটতে লাগল। করিডর প্রায় ফাঁকা, সবাই ভিড় জমিয়েছে ফেস্ট-হলে। দুচারজন যুগলে মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে, এই নিরিবিলিতে প্রেমটাকে একটু জমিয়ে নিতে। ও ওদের পাশ কাটিয়ে এগিয়েই যাচ্ছিল, হঠাৎ পিছন থেকে কেউ ডাকল। এই গলা চেনে সে। থমকে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরল, ওর বুকের মধ্যে তখন অকালের মেঘ গর্জন করে চলেছে।

_আমার প্রেমে পড়ে গেছিস নাকি? তোর মতো কচি ছেলেরা সব ধপধপ করে আমার প্রেমে পড়ে যে কী করে মাঝেমাঝে ভাবি! আমি তোর থেকে অন্তত বছর পাঁচেকের বড় হব, তা জানিস? কী যেন ছিল লাইনটা… উম্ম…ইয়েস… খুঁজে পাই আমার অনাদি কামনা… ফার্স্ট বেঞ্চের গুড বয় তো দেখছি ভিতরে ভিতরে একটা ইয়ে…

_না না। বিশ্বাস করো রঙ্গনদি…

_দিদি!

টোল পড়া উচ্ছ্বসিত হাসি হাসে রঙ্গন। বলে,

_দিদি মাই ফুট। রাতে শুয়ে শুয়ে আমাকে নিয়ে ফ্যান্টাসি করে প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলবে আর তারপর দিদি দিদি করবে। রঙ্গন কারো দিদি নয়, বুঝলি। তোমার ডাইরির পুরো জেরক্স আমার কাছে আছে, বুঝলে সোনা। বেশি ভালোমানুষির দেখানোর চেষ্টা ক’রো না। আমার না ন্যাকা ছেলেদের সহ্য হয় না আবার…

রঙ্গনের গলার স্বর চড়ছিল। অর্পণ প্রায় কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল,

_বিশ্বাস করো এ কবিতা তোমাকে নিয়ে লেখা নয়।

_তবে কি তোর প্রেমিকাকে নিয়ে লিখেছিস? আচ্ছা ক’বার শুয়েছিস তার সঙ্গে? ক’বার শুলে পাতার পর পাতা শরীর গরম করা কবিতা লেখা যায়?

_তুমি ভুলভাল অর্থ বের করছ। এমন শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করে বাংলা সাহিত্যে অনেকেই কবিতা লিখেছেন, এতে দোষের কিছু নেই। আর এই কবিতা তোমার সঙ্গে পরিচয়ের অনেক আগেই আমি লিখেছি। এই কবিতায় আমি বোঝাতে চেয়েছি…

_থাক থাক। তোর কাছে কবিতার ক্লাস করতে আসিনি আমি, আমি তোর কাছে একটা দরকারে এলাম। আমার না এখন ভীষণ চুমু খেতে ইচ্ছে হচ্ছে, চুমু খেতে জানিস তো?

অর্পণের হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছিল।  তার একুশ বছরের জীবনে এমন উৎকট পরিস্থিতির মধ্যে তাকে পড়তে হয়নি কখনো। সে ভাবছিল, পাগল নাকি মেয়েটা, নাকি একটু বেশিই নেশা করে ফেলেছে! ছুটে পালাতে পারলে বাঁচে, কিন্তু সে উপায়ও নেই। রঙ্গন ঘন হয়ে এসেছে তার কাছে, ওর একটা হাত শক্ত করে ধরেছে। অর্পণ একবার রঙ্গনের মুখ থেকে চোখ সরিয়ে  করিডরের দিকে তাকায়। ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যুগলেরা উৎসাহী চোখে এখন তাদের দিকে তাকিয়ে। লজ্জায়, সঙ্কোচে কান গরম হয়ে মাথা অবধি ঝিমঝিম করে ওঠে অর্পণের। রঙ্গন আরো সরে এসেছে। ওর উন্নত নরম অঙ্গদুটির স্পর্শে অর্পণের সংযম গলে পড়তে চাইছে। রঙ্গন ওর ঠোঁট দুটো এগিয়ে দিয়েছে ওর দিকে। তীব্র মদের গন্ধের ঝাপট এসে লাগছে অর্পণের নাকে। কিন্তু নেশা না করেও অন্যরকম এক নেশার আবেশে চোখ বুজে আসতে চাইছে ওর। কী করবে ও? এই নারীর ঠোঁটে জীবনের প্রথম চুমুর দাগ এঁকে দেবে?

চোখ বন্ধ করে অর্পণের ঠোঁটদুটো নেমে আসতে চায় রঙ্গনের ঠোঁটে। ঠিক তখনই করিডরের উল্টোদিক থেকে আসে একটা ছেলে। ওদের ওই অবস্থায় দেখে মুহূর্তের জন্য থমকায়। ঠিক তখনই রঙ্গন অর্পণ কে ঠেলে সরিয়ে হাত ধরে টেনে নেয় ছেলেটিকে। পাগলের মতো নিজের ঠোঁটদুটো ছেলেটার ঠোঁটে ডুবিয়ে শোষণ করতে থাকে। মূর্চ্ছাহতের মতো দেখতে থাকে অর্পণ। প্রথম নারীর ঠোঁটের স্বাদ অধরাই থেকে যায়। শরীর জুড়ে প্রবাহিত হতে থাকা শিহরন মুছে গিয়ে এখন হাজারটা বিষ হুল বিঁধছে তার শরীরে। প্রতিটি রোমকূপে জেগে উঠছে কান্না আর যন্ত্রণা।

ছেলেটার ঠোঁট থেকে ঠোঁট সরিয়ে রঙ্গন বলেছিল,

_সরি, ভাই, নেশার ঘোরে হয়ে গেছে, কিছু মনে করিস না। ক্ষতি তো তোর কিছু হয়নি, উল্টে লাভ হলো, তাই না?

ছেলেটাও ভেবলে যাওয়া অবস্থা কাটিয়ে একটা বোকা বোকা হাসি হেসে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে রঙ্গন বলল,

_ন্যাকামি আমার পোষায় না, বুঝলি! শালা, চুমু খেতে যাচ্ছে, না হিমালয় চড়তে চলেছে; এত্ত সময় লাগলি পুরো মুডটাই নষ্ট। মনে রাখিস, রঙ্গন কারো জন্য অপেক্ষা করে থাকে না…

ভীষণ ঘেন্না হচ্ছিল অর্পণের। এভাবে চুমু খাওয়া যায়, যাকে তাকে, ইচ্ছে হলেই! ভেবেই গা গুলিয়ে উঠছিল ওর। নাহ্! ওই মেয়েটার রুচির উপর সন্দেহ হচ্ছে এবার। ওর থেকে যত দূরে থাকা যায় ততই ভালো।

কিন্তু দূরে থাকতে পারেনি অর্পণ। রঙ্গন বিষাক্ত সরীসৃপের মতো ওকে নিজের জালে জড়িয়ে নিয়েছে, কীভাবে যে একটা বছর কেটেছে ভাবলেই অর্পণের মাথাটায় ঘুলিয়ে ওঠে পাঁক জল। নিজের উপর ঘেন্না হয়। কিন্তু কিচ্ছু করার নেই ওর, পালানোর পথ নেই।

রঙ্গনের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে ঘরের দরজা বন্ধ করে অর্পণ। তারপর সন্তর্পণে নামিয়ে দেয় ট্রাউজার। ছোট্ট আয়নাটা রাখে তলপেটের সামনে। এতক্ষণ পর নিজের ক্ষত দেখে আঁতকে ওঠে নিজেই। কাল রাতের দাগ। পুড়ে কালো হয়ে কুঁচকে গেছে চামড়া। ওর ঠোঁটের কোলে একটা বিষাদের হাসি ফুটে ওঠে তুলোয় করে একটু ওষুধ নিয়ে লাগাতে লাগাতেই ওর মনে পড়ে কালকের বীভৎস রাতটার কথা।

ওদের পেশায় এখন সরাসরি এজেন্টদের অ্যাকাউন্টে প্রি-পেমেন্ট হয়। এজেন্টের অ্যাকাউন্ট থেকে তার অ্যাকাউন্টে ঢুকে গেছে বাইশ হাজার টাকা। একটা রাতে বাইশ হাজার! কোন্ চাকরি তাকে দিত। যদিও সব রাতগুলোয় এমনটা হয় না। তবু এই টাকাটার জন্য সে পোড়ার দাগ হজম করে নিতে পারবে। প্রথমেই পেমেন্ট শুনে তার সন্দেহ হয়েছিল। কোনো কাস্টমার তাকে এতটা পে করবে ভেবেই সে অবাক হয়েছিল। এজেন্ট নিয়োগী ম্যাডাম বলেছিলেন,

_আরে, ওই মেয়েটার বিশেষ একটা নিড আছে। ওটা ছাড়া সে কারো সঙ্গে শোয় না। তলপেটের নিচে একটা লম্বা লাল জড়ুল ছিল। আমাদের এখানের কোনো মালের ওই দাগটা নেই। তোর অনেকটা ওরকম দাগ আছে আমি জানতাম। দিলাম কটা ছবি পাঠিয়ে অ্যান্ড ইউ আর চোজেন। শালী, এককথায় পঁচিশ হাজার মাল্লু দেবে। তুই কেটেকুটে বাইশ পাবি…

অর্পণ একটু কিন্তু কিন্তু করে বলেছিল,

_তা ব’লে এত! লাফড়া হবে না তো?

অর্পণের ধান্দার নাম রোহিত আহুজা। নিয়োগী ম্যাডাম এবার বেজায় রেগে বলেছিলেন,

_তোরা শালা কুত্তার জাত। শুঁকে শুঁকে মরবি তাও আচ্ছা, ভালো মন্দ খেতে দিলে হজম করতে পারবি না। দেখ রোহিত, আমি কিন্তু ডিল ফাইন্যাল করে দিয়েছি, আর ভৌক্তে হবে না তোকে। রাত আটটায় সোজা চলে যাবি…

আর কথা বাড়ায়নি ও। একটা সময় প্রেমিকা রঙ্গনকে ভালো ভালো ট্রিট দেওয়ার জন্য হাতে কাঁচা পয়সার দরকার ছিল ওর। রঙ্গন বলত,

_দ্যাখ, ময়দানে বসে ফুট কড়াই খাওয়া কিংবা ভিক্টোরিয়ার চুমু চুমু খেলা আমার পোষাবে না! কত মালদার ছেলে আমার পিছনে পড়ে আছে জানিস তো…

সেটা খুব ভালো করেই জানে ও। রঙ্গন কাউন্সিলরের মেয়ে, মেলা পয়সা ওদের আর কোথায় সে গ্রাম থেকে উঠে আসা একটা অপগণ্ড। হিসেব করে মাপা পয়সা হাতখরচ পায়। প্রথমটা তো ভেবেছিল, রঙ্গনের চক্করে পড়বে না। তারপর রঙ্গনই ওকে টেনেছে নিজের আগুনে। সেও একটা নির্বোধ পতঙ্গ, ঝাঁপ দিয়েছে, পুড়ে মরেছে। সে তো এড়িয়ে যেতে চেয়েছিল রঙ্গনকে। তারপর দেখেছে এড়ানো যায় না। কারণে অকারণে রঙ্গন ওর সামনে এসে পড়েছে, ওকে নিজের ভালোবাসার জালে ফাঁসিয়েছে। তখন অনেকের কাছে শুনেছিল, এটা নাকি রঙ্গনের একটা খেলা! বিশ্বাস করতে মন চায়নি। আসলে ওকে প্রথমটায় পাত্তা না দিয়েই ভুলটা করেছিল অর্পণ। তাই বোধহয় অর্পণকে নিয়ে খেলা করার একটা জেদ চেপে গিয়েছিল মেয়েটার। অর্পণ কিন্তু ওর খেলাকেই ভালোবাসা বলে ভেবেছে। তার শরীর আর মনে তখন লেগে আছে রঙ্গনের ছোঁয়া। বয়সে বড়, খামখেয়ালি মেয়েটার ভালোবাসায় ভিজে যেতে সময় লাগেনি ওর।

একদিন রঙ্গনই বলেছিল,

_এভাবে আর কতদিন,  ভালোবাসার চার্মটাই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে… আই রিয়েলি নিড ইউ। তোর ইচ্ছে করে না আমার শরীরটাকে ফিল করতে। তোর ইচ্ছে করে না, আমার মধ্যে ডুবে যেতে? আমি তো প্রতি রাতে তোকে ফিল করি অর্পণ। তুই আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসছিস আর আমি হারিয়ে যাচ্ছি… আমার শরীর জুড়ে একটা নদীর স্রোত টের পাই আর তোর কল্পিত শরীরটাকে জড়িয়ে ধরি। প্লিজ, কিছু একটা কর…

কী করবে সে? মাত্র ছমাস রঙ্গন আর তার সম্পর্কের। এই ছমাসে নিজেকে নতুন করে চিনেছে অর্পণ। এর আগে সে যে নিজেকে মৈথুন সুখে তৃপ্ত করেনি তা নয় কিন্তু এভাবে প্রতিরাতে ফোনের উল্টোপিঠে এক কামার্ত নারীকণ্ঠ তার শরীরকে জাগিয়ে তোলেনি এর আগে। সে নিজেও কল্পনা করেছে রঙ্গনের প্লাবিত শরীরটাকে। সে নিজেও অবাক হয়ে নিজেকে আবিষ্কার করেছে, রঙ্গনের শরীরের গন্ধ না পেলে আজকাল পাগল পাগল লাগে ওর। ক্লাস বাঙ্ক করে রঙ্গনের পিছন পিছন ঘোরাতেই আজকাল সে নিজের জীবনের সার্থকতা খুঁজে পায়। কিন্তু কোথায় কীভাবে দুজন উপভোগ করবে স্বর্গীয় সুখানুভূতি, ডুবে যাবে একে অপরের মধ্যে?

হোটেলের ঠিকানাটা রঙ্গনই দিয়েছিল। একটু হাই রেট কিন্তু সেফ। একবারের রুম ভাড়া  আড়াই হাজার। তবে ঝকঝকে এসি রুম, কোথাও কোনো গোপন ক্যামেরা নেই, গ্যারান্টেড। এদিকে রঙ্গন তো বলেই খালাস, রুম ভাড়া জোগাড়ের চিন্তায় অর্পণের রাতের ঘুম লাটে ওঠার জোগাড়। বাবার কাছে চেয়ে পাঠালে দিতে পারবে কিনা সন্দেহ, উল্টে শুরু হবে উকিলের জেরা। তখনই মাথায় এসেছিল জব খোঁজার চিন্তাটা। পার্ট টাইম কিছু একটা করতে পারলে পকেট ভরা থাকে। না হলে রঙ্গনের সামনে নিজেকে বড় খেলো মনে হয়। ওয়েব অ্যাড্রেস সার্চ করতে করতেই পেয়েছিল ঠিকানাটা, বিজ্ঞপ্তিতে লেখা ছিল, “প্রতিরাতে মিনিমাম তিনহাজার আর্ন করার সুযোগ!”

কৌতূহল মেটাতেই পরের দিন সে হাজির হয়েছিল ওই ঠিকানায়। গিয়ে দেখেছিল ঝাঁ চকচকে একটা জিম। জিমে সে কী কাজ পেতে পারে! ভিতরে ঢুকে রিসেপশনে বসা মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করতে তাকে পাঠিয়ে দিয়েছিল একটা ছোট্ট ঘরে। সেখানেই নিয়োগী ম্যাডামের সঙ্গে প্রথম দেখা। হিন্দি বাংলা মিশিয়ে একটা অদ্ভুত টোনে কথা বলেন মহিলা, বয়স পঞ্চাশ ছাপিয়েছে কিন্তু উগ্র সাজগোজে ঢাকা পড়ে গেছে মহিলার বয়স। তিনি বলে উঠেছিলেন,

_বড়িয়া চিজ তো তুই! সির্ফ থোড়া জিম করে আরেকটু পেটানো চেহারা করতে হবে।

তখনও অর্পণ বুঝে উঠতে পারেনি তার কাজটা আসলে কী! নিয়োগী ম্যাডাম বুঝিয়েছিলেন,

_ মর্দ লোগদের শুতে তখলিফ হয় না, শোও আর মাল কামাও। সিম্পল। কোনো পরিসানি নেই শুধু শালীগুলোকে খুশ করা তারপর দিনভর আরামসে কাটাও।

জীবনে এই প্রথম জিগালো শব্দটা শুনেছিল অর্পণ। নিদারুণ অস্বস্তিতে ভরে উঠছিল তার মনটা। রঙ্গনের সঙ্গে শোওয়ার জন্য তাকে কিনা একটা অপরিচিত মেয়ের সঙ্গে শুতে হবে! এটাও কি সম্ভব? শেষে কিনা সে হবে মেল প্রস্ট! ওদিকে নিয়োগী ম্যাডাম বলে চলেছিলেন,

_জি ভরকে সোচে নাও, বেটা। তবে ইসসে বড়িয়া কাম তোমার কোয়ালিফিকেশনে মিলবে না। এখানে কাম ভি, মস্তি ভি। পেহলে কিতনে বার ইন্টারকোর্স কিয়া হ্যায়?

অর্পণ মাথা নিচু করে বলেছিল,

_একবারও না।

কেমন টেনে টেনে তিতকুটে হাসি হেসে নিয়োগী ম্যাডাম বলেছিলেন,

_মেরা দুধ পিতা বাচ্চা, আরে, তোমার জন্য তো আজ রাতেই কাম মিলবে। ভার্জিন গাই খুঁজছে একটা কাস্টমার। তোমার কিছু ছবি খিঁচতে হবে, আরে চন্দু, ইধার আ। এই ছেলেটার কিছু ধুঁয়াধার ছবি খিঁচে দে। ওর লোয়ার পার্টের ছবিও আলগ সে খিঁচনা।

একটু ভাববার সময় চেয়েছিল অর্পণ। নিয়োগী ম্যাডাম একটু বিরক্তির সঙ্গে বলেছিলেন,

_জিন্দেগি ভর সোচতে থাকিস, প্যাহলে প্রোফাইল তো বনা লে। ফির কাম করিস কী না করিস তোর মর্জি।

টলতে টলতে ওখান থেকে বেরিয়ে সোজা মেসে ফিরে বিছানায় সোজা হয়ে শুয়ে পড়েছিল। কেবল মনে পড়ছিল চন্দু কীভাবে ছবি তোলার ঘরে তাকে নিয়ে গিয়ে উত্তেজক ছবি আর ভিডিও দেখিয়ে তাকে উত্তেজিত করে তার বর্ধিত লিঙ্গের ছবি তুলেছিল। ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল, ঘুমের ঘোরে একটা সুন্দর স্বপ্ন ঘিরে রেখেছিল তাকে। যেন রঙ্গন মেঘের মতো ভাসতে ভাসতে নেমে এসেছে ওর শরীরে। মিশে যাচ্ছে ও, ওর ছোঁয়ায় দ্রব হচ্ছে অর্পণের সমস্ত অঙ্গ। স্বপ্নের ঘোর কাটল একটা ফোনের আওয়াজে।

অপরিচিত নম্বর। উল্টোদিকের মানুষটা বলল,

_শুন, আজ রাতে একটা কাম আছে। উহ ভার্জিন খোঁজা পার্টির আজ রাতে লাগবে একজনকে। রাজি থাকলে দোমিনিট কে অন্দর সোচকে বাতানা। আজ রাতের জন্য ফাইভ থাউজ্যান্ড পে করবে, টোয়েন্টি পার্সেন্ট আমাদের। বাকিটা তোর। না করলে ভি জানা, তোর আই ডি ক্যানসেল করিয়ে দেব। ফির করতে রহো, তুমহারা উহ সতীপনা।

অর্পণ সেই রাতেই হয়ে গিয়েছিল রোহিত আহুজা। সেই রাতে সে গিয়ে পৌঁছেছিল যে ঠিকানায় সেখানে ক্লায়েন্ট ছিলেন ষাটোর্ধ এক বৃদ্ধা। দেখেই ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল ওর। শেষে কিনা ওর ফুল ঠাকুমার বয়সের একজনের সঙ্গে তাকে…! ওর অস্বস্তি অনুভব করে ভদ্রমহিলা নিজেই এগিয়ে এসে ওর হাত ধরে বসালেন লিভিং রুমের পুরু গদিতে। তারপর নরম সুরে জিজ্ঞাসা করলেন,

_খেয়েছ কিছু?

ও মাথা নেড়ে ইতিবাচক সম্মতি জানিয়েছিল। ভদ্রমহিলা তবু উঠে গিয়ে ফ্রিজ থেকে বের করে এনেছিলেন, একটা বড়ো ব্ল্যাক ফরেস্ট কেক। জন্মদিনের কেক। তারপর বলেছিলেন,

_অবাক হচ্ছ তো? সকলেই হয়। আসলে কী জানো, এটা আমার খেয়াল বলতে পারো, আমি প্রতি বছর এই দিনটায় একজন তোমার বয়সি ভার্জিন ছেলেকে ডেকে এনে তার সঙ্গে রাত কাটাই। না না, রাত কাটাই বলতে গল্প করে রাত কাটাই। সারারাত ধরে আমার কষ্টের কথা বলি তাকে। বলি, আজ আমার মৃত ছোট ছেলের জন্মদিন, যে ঠিক তোমার মতো বয়সে সুইসাইড করেছিল। বলি, আমার বড় ছেলের কথা, যে বউ ছেলে নিয়ে বিদেশে থাকে, আমার খোঁজটুকুও নেয় না। সারারাত তোমাকে আমার গল্প শোনানোর জন্য ডেকেছি। ভয় পেয় না। আমি এও জানি ভার্জিন ছেলেরা খুব একটা ডেসপারেট হয় না। আজ পর্যন্ত যতজনকে ডেকেছি কেউ মিস বিহেভ করেনি আমার সঙ্গে, তুমিও করবে না আশা করি।

জীবনের প্রথম রাতের অভিজ্ঞতা ভালোই হয়েছিল অর্পণের। নিজের অ্যাকাউন্ট না থাকায় নিয়োগী ম্যাডামের কাছ থেকে হাতে হাতে পেয়ে গিয়েছিল চার হাজার টাকা। একরাত গল্প করে কাটিয়ে চার হাজার টাকা। যেন বিশ্বাসই হচ্ছিল না ওর!

তারপর কেমনভাবে যেন জড়িয়ে গেছে, জাল কেটে বেরোতে পারেনি। বেরোনোর চেষ্টাও করেনি। এমনকি রঙ্গন প্রেমটা ভেঙে দেওয়ার পর আরো বেশি করে জড়িয়েছে। ক্লায়েন্টের মুখে রঙ্গনের মুখটা বসিয়ে চূড়ান্ত সঙ্গমে তৃপ্ত করেছে ক্লায়েন্টের উপবাসী শরীরগুলোকে।

তবে প্রায় বছর দেড়েকের কেরিয়ারে কালকের রাতের মতো সাইকো ক্যারেক্টার সে আগে কখনো দেখেনি! প্রথমে পাগলের মতো আদর করেছে তাকে, নিজেই তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেছে অর্পণের শরীরটাকে। তৃপ্ত হওয়ার পর হঠাৎই সিগারেট ধরিয়ে জ্বলন্ত সিগারেট চেপে দিয়েছে ওর তলপেটের নিচের লাল জড়ুলটায়। তারপর ও চিৎকার করে ওঠার আগেই ওর মুখ চেপে ধরে হিসহিসিয়ে বলেছে,

_আমি পুরুষের শরীরে সঙ্গমের দাগ রেখে দিতে ভালোবাসি, এমনিতে তোমাকে এতগুলো টাকা দিইনি। এই দাগটার জন্য তোমার আজীবন মনে থেকে যাবে আমাকে।

তারপর হাউ হাউ করে কেঁদে বলেছিল,

_তার জীবনে কোনো দাগ রাখতে পারিনি, জানো? তাই সে আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পেরেছে অবলীলায়। তাই আর ভুল করি না…

আরো যেন কীসব বলে চলেছিল মেয়েটা। সদ্য পোড়ার জ্বালার মধ্যেও অর্পণের বুকটা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছিল, ওর কেবলই মনে হচ্ছিল, এই মেয়েটার আকুতির সঙ্গে তার ব্যথাও মিশে আছে কোথাও একটা। মিলে যাচ্ছে তাদের অনুভব! সে-ও তো কোনো দাগ রেখে যেতে পারেনি রঙ্গনের শরীর মনের কোনোখানে। ওর খুব ইচ্ছে হচ্ছিল মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে সান্ত্বনা দেয়। মেয়েটার পিঠে আলতো করে হাত রেখেছিল ও। মেয়েটাও অবাক ঘোলাটে চোখে তাকিয়েছিল ওর দিকে। তারপর উঠে গিয়ে ওষুধ আর তুলো এনে ওর হাতে দিয়ে বলেছিল,

_লাগিয়ে নিয়ো। ব্যথা কমে যাবে। ক্ষমা করে দিয়ো আমাকে।

ওষুধটা লাগিয়ে নিল অর্পণ। যেদিন সারারাত জাগে, সেদিনটা সকালে প্রাণ ভরে ঘুমিয়ে নেয়। ক্লাস ডুব মারে। মেসের সকলেই জানে ও কোনো একটা কলসেন্টারে পার্টটাইম জব করে। কেউ বড় একটা বিরক্ত করে না ওকে। বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়ে একটু বইপত্তর নিয়ে বসে। আজকাল পড়তেও তেমন মন লাগে না। তবে পড়তে তো হবেই, একটা চাকরি জোগাড় করে সরে যাবে এই লাইন থেকে। কিন্তু আজকাল চাকরির যা আকাল, আদৌ কি সে সরে আসতে পারবে এই পেশা থেকে? যদিও এই কাজটা নিয়ে তার কোনো অপরাধবোধ নেই, নিজের শরীরের শ্রমের বিনিময়েই তো সে রোজগার করছে। শুধু এখানে শ্রমের ধরণটাকে সভ্য সমাজ এখনও ভালো চোখে দেখতে না, এই যা। তবে তার জন্য কত অতৃপ্ত মানুষ তো একটু ভালো আছে! কথাটা ভেবেই হাসে অর্পণ। আবার তার মন পক্ষে বিপক্ষে যুক্তির খেলায় মেতে উঠেছে!

বালিশটা টেনে নিয়ে ঘুমের দেশে তলিয়ে যায় অর্পণ। কাল সবে একটা বড় কাস্টমার পেয়েছে, আর একটা সপ্তাহ নিয়োগী ম্যাডাম তাকে কোনো কাজ দেবে না। এই সপ্তাহটা একটু নিজের মতো করে কাটাবে সে। ফোনটাকে সাইলেন্ট করে দিয়েছে। এখন তার স্বপ্নে রঙ্গন আসবে, ওর সঙ্গে অনেকটা সময় কাটাতে হবে। এই রঙ্গন বড় ভালোমানুষ। তার অহংকার নেই, চটুল ভাব নেই, রাগ নেই। সে শুধু নরম আদরে সিক্ত করে ওর মনটা। ওকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়।

কিংশুকের মৃদু ধাক্কায় ঘুম ভাঙল ওর।

_কত বেলা হয়েছে জানো, দুটো বাজে। খাবে না?

ধড়মড় করে উঠে বসে অর্পণ। কী মিষ্টি স্বপ্নটাই না সে দেখছিল! রঙ্গনের ঠোঁটদুটো তীব্র আশ্লেষে লেহন করছে তার ঠোঁট দুটোকে। বড্ড জীবন্ত স্বপ্নটা। ওর ঠোঁটে যেন সেই সোঁদা পরশ লেগে আছে এখনও। রাগ হয় কিংশুকের উপর। কী দরকার ছিল তাকে জাগানোর? বলে,

_তুই কলেজে যাসনি কেন? আর আমি কতক্ষণ ঘুমাবো সেটা আমার ব্যাপার, ডাকার কোনো দরকার ছিল কি?

_আসলে মাসিমা বলেছেন, আড়াইটার পর আর দুপুরের মিল দেওয়া হবে না, তাই…

_ওঃ! তা বাইরে কী খাবার কিনতে পাওয়া যায় না?

_সরি।

_আর কত সরি বলবি তুই? পরের বার আমাকে বিরক্ত করার আগে যেন ওই সরিটা মাথায় থাকে।

_থাকবে। আচ্ছা, একটা কথা বলব, রাগ করবে না?

_হ্যাঁ, ভীষণ রাগ করব, তোর কথা শোনার ইচ্ছে নেই আমার।

_তোমার পোড়াটা এখন কেমন আছে অপুদা?

_সেরে গেছে।

গামছা টেনে নিয়ে বাথরুমের দিকে চলে যায় অর্পণ। সেদিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে কিংশুকের বুকের ভিতর থেকে। বড্ড কষ্ট হচ্ছে তার। যে কষ্টটা সে কাউকে বলে বোঝাতে পারবে না। অপুদাকে সে ভীষণ ভালোবাসে, সবসময় চায় অপুদার মুখে হাসি লেগে থাকুক। সকালেও অপুদার মেজাজ খিঁচড়ে ছিল, তাকে যা নয় তাই বলেছে! আর এখনও। আচ্ছা, অপুদা কী পারে না ওর সঙ্গে একটু ভালো করে কথা বলতে? ও জানে অপুদা হোমো নয়, ওকে কোনোদিন ভালোবেসে উঠতে পারবে না। তাছাড়া কোনো একটা মেয়েকে অপুদা ভীষণ ভালোবাসত, আগে অনেকবার তার কথা শুনেছে। কিন্তু সে সম্পর্কও ভেঙে গেছে অনেকদিন। তবু কি নিজের প্রতি একটু ভালো ব্যবহার অপুদার কাছ থেকে প্রত্যাশা করাটা ওর অপরাধ? আজ তো ইচ্ছে করেই কলেজে যায়নি। ভেবেছে, সারাদিন অপুদার সঙ্গে থেকে সকালবেলার খিটিমিটিটা মিটমাট করে নেবে, কিন্তু কোথায় কী!

স্নান সেরে বেরোতেই সামনের টেবিলের দিকে চোখ যায় অর্পণের। খাবার ঢাকা দেওয়া আছে। সেটা যে কার কীর্তি বুঝতে অসুবিধা হয় না ওর। ছেলেটা সত্যি ওকে একটু বেশিই ভালোবাসে। ওকে কথায় কথায় এত বকাঝকা করা ঠিক হচ্ছে না! কিংশুক ঘরে নেই। কোথায় আছে জানে অর্পণ। তবে এখন ওর মান ভাঙানোর মতো সময় নেই। ফোনে নিয়োগী ম্যাডামের খান দশেক মিসড কল। কল ব্যাক করে ও।

_খুদ কো কেয়া সামঝতা হ্যায় তু, কুত্তে কা আউলাত।

নিয়োগী ম্যাডামের মুখ খুব খারাপ। বেজায় ক্ষেপেছেন। ও বলে,

_থোড়া তমিজ তো রাখিয়ে, ম্যাডামজী।

_হারামী, কত্তবার ফোন লাগিয়েছি, কোথায় ছিলিস? শমশানে তোর চিতা উঠছিল নাকি?

_আরে সরি, ম্যাডামজী। বোলিয়ে…

_শুন, তোকে এই কামটা দেওয়ার কোনো ইচ্ছা আমার ছিল না। সিরফ হাতে তেরা মাফিক কোনো মাল নেই…

_লেকিন মেরা তবিয়ত কুছ আচ্ছা নেহি, কল রাত কে পার্টি নে পেট মে ঘাও দে দিয়া…

_কেমন ঘাও?

_সিগ্রেট সে জ্বলা দিয়া।

_ওর তু শুয়র জরুর চুপচাপ হজম করেছিস?

_ক্যা করু ফির? আপ হি তো ভেজে থে ওঁহা… মেরে তো কুছ শুনি নেহি আপনে! ইতনা পে করনে কা এহি ওয়াজা হ্যায়। ছোড়িয়ে উহ সব…

_পর এক মুশকিল হয়েছে? আমি তো পেমেন্ট উঠিয়ে নিয়েছি আজ রাতের পার্টির। সোচাথা তোকে পাঠিয়ে দেব, তো এখন বহুত সমস্যা হয়ে গেল… দেখ, আগর তু ম্যানেজ করতে পারিস তো…

নিয়োগী ম্যাডামের গলা এখন নরম হয়ে এসেছে। ভারী অদ্ভুত মানুষটা। কখনও বদরাগী, কখনও নরম আর মিঠে। মানুষটা এমনিতে ভালোই আর টাকা পয়সার ব্যাপারে ভীষণ স্বচ্ছ। একটা দিনও পেমেন্ট নিয়ে খিচখিচ করতে হয়নি অর্পণকে। এই মানুষটা পেমেন্ট নিয়ে ফেলেছে যখন, তখন তো যেতেই হয়। অর্পণ বলল,

_অ্যাড্রেস ভেজ দেনা।

কাজটা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন নিয়োগী ম্যাডাম। এমন ডিল অর্পণ এর আগে কখনো করেনি। মনে মনে বলল,

_শালা, সতী-সাবিত্রী মার্কা মেয়েরা কেমন দিনদিন বদলে যাচ্ছে… যাক যাক। যত বদলাবে তত রোখড়া আসবে।

ব্যাপারটা হলো, এখন বিয়ের আগে ব্যাচেলরস্ পার্টির কনসেপ্ট চালু হয়েছে। বিয়ের আগে বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে একটু হই

হৈহুল্লোড় আর কী! যেন বিয়ের পরে সবকটা বউ আর বর ছাড়া কোনো ঝোপে কোপ বসাবে না! তো এখানের ব্যাচেলরস্ পার্টিটা করছে হবু কনে আর তার বান্ধবীরা, সেখানে তাদের এন্টারটেইনের জন্য দরকার একটা পুরুষ সঙ্গীর। তাদের পুরুষ বন্ধুর সংখ্যা কিছু কম নয়, তবে কী নিজেদের চেনাজানা পুরুষের সঙ্গে ইন্টুমিন্টু করলে পাঁচকান হওয়ার ভয় থাকে কিন্তু জিগালো ভাড়া করলে ব্যাপারটা গোপনীয় থাকে। মজাও হয়, আবার সেফ থাকাও যায়।

সন্ধে নামতেই ভালো করে ড্রেসআপ করে মাথার লম্বা চুলগুলো ব্যাক ব্রাশ করে একটা পনিটেল বাঁধল অর্পণ। পোড়া জায়গাটায় দুটো স্কিন কালারের ব্যান্ডেড আটকে নিয়েছে। উগ্র আলো না থাকলে তেমন কিছু বোঝা যাবে না, চড়া আলোয় কে-ই বা রতিসুখে মজা পায়? এখন সে রোহিত। ছোট আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই মুগ্ধ হয় সে। একবার আড়চোখে নিজের বিছানায় বসে থাকা কিংশুকের দিকে তাকায়। মাথা নিচু করে বইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে ছেলেটা। অর্পণ নিশ্চিত জানে, ও এতক্ষণ তাকেই দেখছিল, শুধু অভিমান দেখানোর জন্য প্রশংসা করেনি। অর্পণ ইচ্ছে করেই বলে,

_কেমন লাগছে বলত আমাকে?

কিংশুক চোখ তুলে তাকায়, তারপর মুখে একটু বিষাদের হাসি ছড়িয়ে পড়ে। তারপর মুখে কিছু না বলে মাথা নিচু করে নেয়।

একটা নির্জন বাগান বাড়িতে ব্যাচেলরস্ পার্টির আয়োজন করা হয়েছে, দেখেই মনে হচ্ছে মালদার পার্টি। ঠিকানাটা আরেকবার চেক করে ভিতরে ঢোকে সে। কয়েকটা মেয়ে রঙিন প্রজাপতির মতো ঘুরছে, ওদের একজন এগিয়ে আসে ওকে দেখে। মেয়েটি ওকে অপেক্ষা করতে বলে ভিতরে যায় কোড জানতে, সিক্রেট কোড আদানপ্রদান হয়। নিশ্চিত হওয়ার পর অর্পণকে ভিতরে আসতে বলে ওরা। একটা সোফা দেখিয়ে দেয় বসার জন্য, ঠিক যেন আরাম করে বসতে পারে না ও, মেয়েদের মনোরঞ্জন তার পেশা কিন্তু একসাথে এতজন! এখানে পানপর্ব শুরু হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। মেয়েগুলো নেশাতুর চোখে তাকাচ্ছে ওর দিকে। দুজন তো সোফার দুটো হাতলে বসে শরীর এলিয়ে দিয়েছে ওর গায়ে। একটি মেয়ে একটা রঙিন গ্লাস এগিয়ে দেয় ওর দিকে। ও হাতে নেয়, ঠোঁটে ছোঁয়ায়, খাওয়ার ভান করে। একটু আধটু খাওয়া চলতেই পারে ক্লায়েন্টদের মন রাখার জন্য, কিন্তু ক্লায়েন্টের কাছে গিয়ে পুরো ড্রাঙ্ক হওয়া ওদের পেশার দস্তুর নয়। একটা মেয়ে তো প্রায় ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে খুলে ফেলে ওর জামার বোতামগুলো। চুমু দিতে থাকে ওর খোলা বুকে, আরেকজন ওর আঙুলগুলো মুখে পুরে লেহন করতে থাকে। মুহূর্তেই প্রায় বিবস্ত্র হয়ে পড়েছে ও। হিংস্র বাঘিনীর মতো মেয়েগুলো যেন দীর্ঘদিনের উপবাসী শরীর নিয়ে হামলে পড়েছে ওর উপর। ওর তলপেটের নিচটা ঘষে যাচ্ছে, ব্যথা হচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা হজম করে ওদের ক্ষুধা শান্ত করতে থাকে ও।

হঠাৎই বন্ধ ঘরের ভিতর থেকে জড়ানো গলায় কেউ যেন বলে ওঠে,

_শালা, বিয়ে আমার, মাল ভাড়া করলাম আমি আর তোমরা ফুর্তি মারছ… তোরা বন্ধু না শত্রু?

গলার স্বরটা কেমন যেন চেনা লাগে। একটা মেয়ে বলে ওঠে,

_সেই সন্ধে থেকে বোতলের পর বোতল টেনে হুঁস ছিল না, এখন শোয়ার জন্য হুঁস ফিরেছে।

তারপর চিৎকার করে বলে,

_কদিন পরে তো বরের সঙ্গে রোজ শুবি, রঙ্গন। আজ আমাদের একটু এঞ্জয় করতে দে…

ভিতর থেকে উত্তর আসে,

_বরের সঙ্গে শোয়ায় কী কোনো থ্রিল আছে? তাই বাইরের মালের ব্যবস্থা করে একটু মজা পেতে চাইছিলাম। নে নে, তোরাই মজা নে। মালটাকে এঁটো করে দিয়েছিস…

নাহ্! কোনো ভুল শুনছে না অর্পণ। এই গলাটা সে চেনে। তার মনে পড়ে, এই মেয়েটার আবদার রাখতেই সে নেমেছিল এই পেশায়। প্রথম রোজগারের টাকা দিয়ে ওর বলে দেওয়া হোটেলের কামরা পর্যন্ত বুক করে সেখানে পৌঁছে রঙ্গনের অপেক্ষায় রাত কাটিয়েছে। রঙ্গন আসেনি। ফোন সুইচড অফ করে রেখে দিয়েছিল। পরে কৈফিয়ত চাইলে বলেছিল, সে নাকি অর্পণকে পরীক্ষা করে দেখতে চেয়েছিল যে অর্পণের চরিত্র কেমন! শুধু শোওয়ার জন্যই নাকি অর্পণ প্রেম করছে বয়সে বড় রঙ্গনের সঙ্গে। অর্পণ জানতে চেয়েছিল, তাহলে রাত জেগে ফোনে যৌনগন্ধী কথা বলে কেন রঙ্গন? রঙ্গন বলেছিল, ফোনে অনেককিছু চলতে পারে, তাই বলে বাস্তবে অর্পণ এমন নিচে নামতে পারে বলে সে নাকি ভাবতেই পারেনি!

চোখের সামনে যেন অন্ধকার হয়ে আসছিল অর্পণের। সে যেন অন্ধকার একটা কুয়োর মধ্যে পড়ে হারিয়ে যাচ্ছে কোথাও, যেখান থেকে বেঁচে ফিরতে পারবে না সে কখনো। দম বন্ধ হয়ে আসছিল ওর। কখন যে মেয়েগুলোকে নিজের শরীর থেকে ঠেলে সরিয়ে কোনরকমে পোশাক চড়িয়ে বেরিয়ে পড়েছে তা সে নিজেও জানে না। রাত তখন কটা তাও মনে নেই তার, শুধু মেসের কলিং বেলটার উপর সমস্ত শক্তি দিয়ে চেপেছিল। দরজা খুলেছিল কিংশুক। সে বোধহয় এই ফেরার অপেক্ষাতেই ছিল। সামনে কিংশুককে দেখে অবুঝ শিশুর মতো কেঁদে আছড়ে পড়েছিল। কিংশুক কোনো প্রশ্ন করেনি। তাকে ধরে এনে যত্ন করে শুইয়ে দিয়েছিল বিছানায়। অর্পণ ওকে ছাড়েনি। ডুবতে থাকা মানুষের খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতো কিংশুকের কোলে মাথা রেখে একটু আশ্রয় খুঁজতে চেয়েছিল। ওর চোখের কোল বেয়ে ঝরে পড়া দীর্ঘদিনের অবরুদ্ধ জলের ধারা ভিজিয়ে দিচ্ছিল কিংশুকের শরীর। নিস্পলক চোখে কিংশুক তাকিয়ে ছিল তার ভালোবাসার মানুষটার দিকে, যেন এই অন্ধকারেও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল অর্পণকে, পড়ে নিতে পারছিল ওর মনের সমস্ত কষ্ট। অর্পণের ক্লান্ত কপালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল ও। ধীরে ধীরে অর্পণের ক্লান্ত অবসন্ন শরীরটা ওরও কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমন্ত অর্পণের কপালে জীবনের প্রথম চুমুর দাগ আঁকল কিংশুক। তারপর তাকিয়ে রইল ভোরের রঙ লাগা আকাশটার দিকে এক নতুন জীবন আরম্ভের অপেক্ষায়।

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post অপ্রকাশিত| প্রেমে পড়া বারণ | চিরঞ্জিৎ সাহা| Bengali Love Story
Next post পাতালপুরের রাজকন্যা| কঠোর ভাবে প্রাপ্তমনস্কদের জন্য | আফতাব হোসেন| Bengali Story for Matured