মুক্তির স্বাদ| কঠোর ভাবে প্রাপ্তমনস্কদের জন্য | -| Bengali Stories for Matured
0 (0)

অজানা এক পথে চলতে গিয়ে একটা সময় হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। পথ ছিল না বেরিয়ে আসার। ক্লান্তি আর দুর্বলতা আমায় কিছু বছরের জন্য থামিয়ে দিয়েছিল। শহরের ব্যস্ততা আর মানুষের অর্থের দিকে এমন করে দৌড়ানো আমায় অদ্ভুত এক মানসিক সমস্যার মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। কিছু ভাল লাগছিল না। একা থাকি, আর অফিসের বাইরে কিছু অবশিষ্ট নেই আমার জীবনে। এর থেকে মুক্তি পেতে অনেক দিন ধরেই খুঁজছিলাম, আজ সেই সুযোগ এসে গেল। গ্রামের বাড়িতে ও গ্রামের সেই পুরানো দিনগুলোয় ফিরে যাবার এক অনবদ্য সুযোগ এসে গেল। ছোটকাকার ছেলে ভুবন চিঠি পাঠিয়েছে লিখেছে “বৈষয়িক ব্যাপার, দাদা তোকে আসতে হবে।” স্থির করে ফেললাম যাব। এতদিন পর গ্রামের বাড়িতে যাব, এটা ভেবেই আজ আর উদ্দীপনা চেপে রাখতে পারছি না। অফিসের স্টাফ ও বসের চোখে আমি মিস্টার সমৃদ্ধ সেন, অথচ গ্রামের বাড়িতে ও পুরানো পাড়ায় আমি সেই ছোট্ট বিল্টু । কতদিন কেউ আমায় বিল্টু বলে ডাকেনি, হয়তো সেই ডাক শোনার অছিলায় আমারই ভিতর থেকে কোনও এক আর্তি ছোটবেলার সেই দিনগুলোতে ফিরিয়ে দিতে চাইল। কেউ একজন বিল্টু দা বলত, আজ সে সব স্মৃতি। রোমাঞ্চকর সেই স্মৃতি ভাবলেই মনটা কেমন হারিয়ে যায়। মনে হয় এইতো সেদিনের কথা, অথচ পেরিয়ে এসেছি অনেকগুলো বছর। এতক্ষন গাড়িতে আসতে আসতে সেই কথাই ভাবছিলাম। লালবাজারের ক্রসিংটায় গাড়িটা জোরে ব্রেক কসতে সম্বিত ফিরল। “বাবু কাল কি একটু ছুটি হবে” বলল ড্রাইভার সনাতন।

আমি বললাম “হ্যাঁ, কাল অফিস আসছি না, আমি ক’দিনের জন্য গ্রামের বাড়ি যাচ্ছি। তুমি কদিন ছুটি নিতে পার।” যানজট পেরিয়ে দুরন্ত গতিতে মার্সেডিজ’টা এগিয়ে চলল।

অস্তমিত সূর্যের শেষ আলোর রেখাটা তখনও অল্প রয়ে গিয়ে পড়ন্ত বিকেলের মাধুর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বাড়ি ঢুকলাম সাড়ে ৬টা।

কাল সকাল সকাল তৈরি হয়ে বের হতে হবে। আজ মা-বাবা বেঁচে থাকলে আমার গ্রামের বাড়ি যাবার আনন্দে ভীষণ খুশি হতেন। আমার তখন ১৫ বছর বয়স। বাবার চাকরি থেকে অবসর নেবার পর অনিচ্ছা সত্ত্বেও শহরে আসতে হয়। প্রথমে খুব কষ্ট পেয়েছিলাম, শহরের আদপ-কায়দা সেই ভাবে আত্মস্থ করতে পারিনি। এখন বয়স বাড়ার সাথে সাথে অনেকটা সয়ে গেছে। তাও অবসর পেলে ডাইরি লিখে সেই হারিয়ে যাওয়া কৈশোরের মূল্যবান স্মৃতিগুলো সাজিয়ে দিই।

ফ্লাসব্যাক :-

কবিতা লিখে যখন কলেজে প্রথম হই এক বান্ধবী প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিল। গ্রামের হারিয়ে যাওয়া সুখস্মৃতি আমার হৃদয়-মন থেকে তখনও হারায়নি। বলতে গেলে আমিই হারাতে দিইনি।

আজ কেন জানি না ছোটবেলার একটা রোমাঞ্চকর স্মৃতি মাথার মধ্যে এসে গেল। স্মৃতির মধ্যে ডুব দিলে এই ঘটনা গুলো বারবার মনে পড়ে। একবার বর্ষায় বন্যা হয়েছিল আর সেই সময় আমরা আমাদের ডোঙ্গা করে অমড়াগড়ি চলে গিয়েছিলাম। আমরা বলতে আমি আর ধীমান। শরৎচন্দ্রের নৈশ অভিযানের মত বেরিয়ে পরে কি অসম্ভব বিপদে পড়েছিলাম তা আজ কর্পোরেট বাবু হয়ে ভাবতে বসে খুব হাসি পাচ্ছে। আবার মাঝে মাঝে এটা ভেবে আনন্দও হচ্ছে যে আমি কর্পোরেট জগতে নাম করলেও নিজের মাটি, নিজের মাতৃভূমিকে এখনও ভুলিনি। নিজের গ্রামের ভাষা, গ্রামের পথ ও গ্রামের সংস্কৃতি এখনও আমি বয়ে বেড়াচ্ছি। বাবা যা চেয়েছিল তা হয়েছি। চেয়েছিল আমি মানুষ হই , পাশাপাশি সুযোগ পেলে নিজের গ্রামের ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে যেন রাখি। আমি শহরের আদব-কায়দা এখন বেশ রপ্ত করে ফেললেও ভুলতে পারিনি গ্রামের মাটির সেই টান। শুধু চলে গেছে কয়েকটা দশক। তার পাশাপাশি চলে গেছে কিছু মানুষ। অনেকে এই পৃথিবী ছেড়ে অনন্তলোকের পথে যাত্রা করেছে আর অনেকে কাছে থেকেও যেন হারিয়ে গেছে। তেমনই এক অতীতকে আমি হাতড়ে চলেছি। জানি না সেই অতীত বর্তমানে ধরা দেবে কি না।

স্মৃতির সরনী দিয়ে চলতে গেলে অনেক সময় ধাক্কা খাই আমি, কিন্ত ভালো কিছু ঘটনার রেশ বয়ে নিয়ে চলে মনটাও খুব তৃপ্ত হয়। কেন জানি না নিজের আদি বাড়িতে যাবার সুযোগ আসতে কত স্মৃতি পরপর আমার মনে ধাক্কা দিচ্ছে। ভুলতে যদিও চাইছি না তাই হয়তো সেই স্মৃতি আরও বেশি করে আমায় সেই পথে নিয়ে চলেছে।

যখন বাবা ও মা বেঁচে ছিলেন তখন গ্রামের ফল, ফুল, পুকুর, মাছ এসবের সাথে খুব অ্যাটাচমেন্ট ছিল। মাঝে মাঝেই বাবা কত গল্প রাতে শুয়ে শোনাতো। তখন রাতগুলো কোনও এক পরীর  কল্পনার দেশের থেকেও অনেক বেশি আকর্ষণীয় ছিল। অনিল কাকার পাগলামি দেখে বাবা সে কি হাসাহাসি করেছিল সে গল্প শুনলে ভারি মজা হত। বাবা সাহিত্যের পাতা থেকে চরিত্রগুলোকে এমনভাবে উপস্থাপিত করত যে আমি সেই গল্পের এক বর্ণময় নাটকীয় চরিত্রের কুশীলভ হয়ে যেতাম। আর যখন বাবা রামায়ণের পৌরাণিক কাহিনী শোনাতো তখন আমার হৃদয়ে লব-কুশের তিরন্দাজি ও রাবণের দশমাথার কথাই ঘুরঘুর করত।

দাদুর সাথে পাখি শিকার করতে যাবার গল্পও আজ আমার কাছে মনে হয় এই কালকের ঘটনা।

বাবার সাথে শুয়ে গল্প শুনতে শুনতে আমি ঘুমের দেশে পাড়ি দিতাম। গ্রামের মাটির সাথে তখন আমার ছিল আন্তরিক টান। সকাল হলে স্কুলের তাড়া আর বৈকাল হলে মাঠে গিয়ে ক্রিকেট, ‘বুড়িবসন্ত’ খেলা। ফুটবলটা খুব কমই খেলতাম।

এখানে বলে রাখি ‘বুড়িবসন্ত’ খেলার পিছনে একটা কারণ ছিল সেটাই এবার বলব। ঐ খেলা শুধু ছেলেরা খেলত না,ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে সকলের সক্রিয় সহযোগিতায় খেলাটা রঙ্গিন হয়ে উঠত। আমার দিদিরাও যোগ দিত এই খেলায়। এই খেলাটাতেই মেয়েদের সাথে খেলার সুযোগ হত। ছোট থেকে পুতুলের সাথে থাকতে একটা অদ্ভুত ভালোলাগা তৈরি হয়েছিল।

তবে সেটা ঠিক প্রেম নয়। তবে সেটা ভালোবাসার একটা শুরু। এছাড়াও ছুটির দিনে পুকুরে স্নান করতে নেমে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটানোর স্মৃতি আজ চোখে জল এনে দেয়। তখন যা ছিল সবই ভীষণ আনন্দের ও খুব উজ্জ্বল। গ্রাম ছেড়ে শহরে আসার পর পড়ার চাপ আর অবাঞ্চিত ব্যস্ততা আমায় সবকিছু সাময়িক ভাবে ভুলিয়ে দিয়েছিল। রাতে আর বাবার কাছে গল্প শোনার অবকাশ পাইনি। জীবনটা হয়ে পড়ল ভীষণ মেকানিক্যাল, ভীষণ ক্লিসে। গান শুনবো সেটাও যেন পড়ার জন্য ক্ষতিকর এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। যদিও বাবা কখনও কোনও ব্যাপারে বাধা দেয়নি, তাও পড়াশোনা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আমায় তেমনই করতে বাধ্য করল। আমিও তা মাথা পেতে নিলাম। ভিতরে কষ্ট হত তাও মুখে বলার ইচ্ছা বা আগ্রহ হয়নি। বাবা তবুও গ্রামের বাড়ি যেত, কিন্তু আমি আর যেতে পারিনি। কোনও এক অভিমান যেন আমার মনকে গ্রামের থেকে অনেক দূরে নিয়ে চলে গিয়েছিল।

সে কারণ আজ মনে পড়লে বড্ড খারাপ লাগে।

মনে পড়ে সেই দুঃস্বপ্ন ভরা দুপুরকে। মাধ্যমিক পরীক্ষা তখন দু’সপ্তাহ বাকি। গ্রামের দুপুর সবসময় রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার সাক্ষী থাকে। সেদিনও এমনই হবার ছিল, কিন্তু হল অন্যকিছু। ঝিলপুকুরের পাড়ে বসে পুতুলের সাথে কাঁচা আম খাচ্ছিলাম। ছেলেমানুষ হলে যেমন হয়। মনে কোনও পাপ চিন্তা জন্ম নেয়নি আমাদের। হাসাহাসি আর ঠাট্টা-ইয়ার্কি করে বেশ অনেকটা সময় কেটে গেল।

হটাৎ শুনতে পেলাম মালতি কাকিমা খুব জোরে চেঁচাচ্ছে। মনে হল যেন সকল গ্রামবাসী আমাদের দিকে ছুটে আসছে। সামনে আসতে বুঝলাম আমাকে আর পুতুলকে জড়িয়ে একটা নোংরামির খেলায় মেতেছেন উনি। দুজনে আলাদা দুপুরে কি করছি এসব জানতে সবাই আমার ও পুতুলের দিকে তাকিয়ে। আমাদের মধ্যে সুন্দর ও মিষ্টি এক বন্ধুত্ব ছাড়া সেই বয়সে সত্যিই কিছু ছিল না। পুতুলকে ভাল লাগত, ওঁর সাথে থাকলে মনে এক ভীষণ শান্তি বিরাজ করত। এর বেশি ঐ বয়সে আর কি বা থাকতে পারে। বয়সন্ধির সময় হরমোনের পরিবর্তনের সাথে ছেলে-মেয়েদের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন হয় ঠিকই, কিন্তু আমাদের তখনও অসভ্যতা করার চিন্তা বা ইচ্ছা কোনটাই হয়নি।

অন্যদিকে মা যে পুতুলকে ঘরের বউ করবে এমন কথাও বলেছিল আমাদের বন্ধুত্ব দেখে।

আমাদের বন্ধুত্ব তখন প্রেমের পর্যায়ে আসেনি, যদিও তখন এসব ভাবতামও না। পরস্পরের প্রতি ভালোলাগা ছিল, এর চেয়ে বেশি কিছু নয়। তবে তা নোংরামি বা অসভ্যতার মতো কিছু নয়। কিন্তু এদের  চিন্তাভাবনা যে এতটা নোংরা সেটা আগে আমি বুঝতে পারিনি। সেদিন তাঁদের স্বরূপ দেখেছিলাম। বাবা স্কুল থেকে ফিরতে তাঁর কাছে নালিশ জানান হল। বাড়ির মান-সম্মানের কথা ভেবে বাবাও সিদ্ধান্ত নিলেন আমাকে আর গ্রামে রাখবেন না। শুধু পরীক্ষাটা হবার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে এমন একটা ধাক্কা সত্যিই আমাকে খুব ভাবিয়ে তুলেছিল। ওদিকে পুতুলের মনের মধ্যেও কি চলছিল সেটাও বুঝতে অসুবিধে হয়নি। মা কিন্ত গ্রামের কয়েক জনের এই নোংরা কথায় বিশ্বাস করেনি, কারণ মা আমাদের ভালো ভাবে চিনত ও জানত। মা পুতুলকে একবারই ডেকে বলেছিল “তু্ই কাঁদছিস কেন পাগলী আমি তোকে কি কিছু বলেছি? তু্ই আমার মেয়ে আর কারও কথায় তোকে দুঃখ পেতে দেখে আমার ভীষণ খারাপ লাগে তা তু্ই জানিস না?”

তখন ছিল কৈশোরের বন্ধুত্ব ও একটা ভালোলাগা। আমি জানতাম মা পুতুলকে নিজের মেয়ের থেকেও বেশি ভালোবাসত। শৈশব থেকে আমি, বিশু, ধীমান ও পুতুল একসাথে কত কিনা করেছি। শৈশবের আনন্দঘন স্মৃতি যখন যৌবনে এসে ধরা দেয় তখন অনেক সময় জাগরণেও স্বপ্ন দেখার ইচ্ছা প্রকাশ পায় ।

মনে পড়ে সেই সময় মা ও পুতুলের কথা আড়াল থেকে আমি অনেকবার শুনেছিলাম। বুঝতে পারতাম মা ভবিষ্যতে পুতুলকেই নিজের ছেলের বউ করবে এমন মনস্থির করে ফেলেছিল। যেহেতু পুতুলের মা অল্পবয়সে মারা যায় তাই পুতুল আমার মাকেই নিজের মায়ের মত মনে করত। পুতুলের থেকে বয়সে আমি ৬মাসের বড় ছিলাম। কিন্তু আমরা একই ক্লাসে পড়তাম। একটা সময় সে আমায় ‘তু্ই’ সম্মোধন করতে গিয়ে মায়ের কাছে খুব বকা খেয়েছিল। তার পর থেকে আমায় বিল্টু দা বলেই ডাকত, আর আমিও এই দাদা ডাকটা বেশ পছন্দ করতাম। মনে পড়ে ক্লাস নাইন হবে তখন আমার কথা না শোনার জন্য কঞ্চি দিয়ে মাথায় মেরেছিলাম আর বুঝিয়ে দিয়েছিলাম আমি তোর দাদা হই। কথা না শুনলে এমন মার আরও খেতে হবে। ভয় দেখিয়ে ছিলাম যেন বাড়ি ফিরে মা’কে না কিছু বলে। আমার মা  পুতুলের মুখ দেখেই বুঝে গিয়েছিল যে নিশ্চয়ই আমি কিছু করেছি। তবে পুতুলের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোলাগা আমার সেদিন আরও বেড়ে গিয়েছিল। আমার আদেশের ফলে মা’কে সে কোনও অভিযোগ জানায়নি। মা এতটাই ভালো চিনত তার পুতুলকে যে অনায়াসে তার মুখ দেখে বলে দিয়েছিল যে তার পাগল ছেলে নিশ্চয়ই কিছু করেছে। এক অদ্ভুত জাদুবলে বাড়ি ফিরতে আমায় মায়ের সন্দেহের মুখে পড়তে হয়েছিল এবং ধরা পড়ে জুটেছিল বকা। এমন ছোট ছোট অনেক স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠছে আজ।

কিন্তু ঐ ঘটনার পর এমন এক কালবৈশাখী ঝড়ে চারিদিক কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। গ্রামের এমন প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে শহরের ইট কাঠ পাথরের জঙ্গলে আসতে না চাইলেও আমাকে বাধ্য হয়ে চলে আসতে হল।

যে কথা বলছিলাম…

মালতি কাকিমার করা সেই অভিযোগ পুতুল আর আমাদের জীবনের পথকে অন্যদিকে নিয়ে চলল। এদিকে অনিল কাকা সকলের কথায় বিশ্বাস করে নিজের মেয়েকে সরিয়ে নিলেন আমাদের কাছ থেকে। মা সেদিন পুতুলের বাড়ি থেকে এসে আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আমি কিছু শুনিনি।

 কয়েকদিন আমাদের বাড়ির আশেপাশে পুতুলকে দেখা গেল না। মাধ্যমিকের আগে আর একবারের জন্যও তার সঙ্গে দেখা হয়নি। পরীক্ষা শেষ হল ১৫ই মার্চ। আমাকে নিয়ে বাবা-মা চলে এল ইনকমপ্লিট হওয়া আমাদের শহরের বাড়িতে।

তখন বুঝিনি যে কেন এমন হল আমার আর পুতুলের সাথে। কয়েকমাস পরে ছোটকাকা জানাল যে মালতি কাকিমা ও তাঁর স্বামী জীবেশ আমাদের থেকে একটা জমি দখলের জন্য বাবাকে গ্রাম থেকে তাড়াতে চাইছিল। বাবা খুব আত্মসম্মান নিয়ে জীবন অতিবাহিত করেছেন। একটু অসম্মান বাবার মনে বিরাট আঘাত দিত। এটা গ্রামের প্রতিটা মানুষ জানত। তাই তাঁর আত্মসম্মানে আঘাত দিতে আমায় বলির পাঁঠা বানান হয়েছিল। মাঝখান থেকে পরিবারের সম্মান বাঁচানোর জন্য আমার আর পুতুলের সুন্দর সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। যদিও জীবেশ কাকা আমাকে গ্রামছাড়া করলেও জমিটা লিখে নিতে পারেনি। জীবেশ কাকা বাবার অবর্তমানে একটা জমি জাল সই করে লিখে নেবার প্রচেষ্টা করেছিল। ছোটকাকা অতটা চালাক ছিল না। তাই ভুল বুঝিয়ে জমির দখল করার চেষ্টা তাঁর মাথায় অনেকদিন ছিল। অবশেষে তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন। এছাড়াও কৈশোরের পুতুলের দিকেও লোলুপ দৃষ্টি ছিল জীবেশ কাকার। শুধু জমি নয় পুতুলকে জোর করে পাবার নোংরা চিন্তাও তাঁর মাথায় ছিল। কিন্তু তা অবশেষে সম্ভব হয়নি। একটা নারীর জীবনে তাঁর শত্রু তাঁর শরীর। ছোট থেকেই পুতুলের চেহারার মধ্যে একটা অদ্ভুত আকর্ষণ ছিল। কিছু মানুষের কাছে এটা ছিল ভোগ করার বস্তু। বাবা কিছুদিন পরে গ্রামে গিয়ে নিজের ও পরিবারের হারান সম্মান ফিরিয়ে এনেছিলেন। সকলের সামনে মালতি কাকিমার ষড়যন্ত্রের মুখোশ খুলে দিয়েছিলেন। জীবেশ কাকার চরিত্রের নগ্ন রূপটাও সকলের সামনে এসে পড়ে। কিন্তু আমার জেদও কম ছিল না। প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আর গ্রামের বাড়িতে ফিরব না। কিন্তু আমি অপমানের জ্বালায় এমনকি পুতুলের সাথে দেখা করব না এমন পণও করেছিলাম। এরমধ্যে অনিল কাকা একটা ভুল করে বসল। তিনি নিজের সম্মানের কথা ভেবে পুতুলকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে সম্পূর্ণ চিন্তা মুক্ত হতে চাইলেন। তিনি জানতেন যে এটা একটা ষড়যন্ত্র ছিল তাও কেন জানি না পুতুলকে আমাদের পরিবার থেকে দূরে করার যাবতীয় প্রচেষ্টা চালিয়ে গেলেন। জানি না আজ তাঁর চিন্তাভাবনার বদল হয়েছে কিনা।একটা পরিবারের সাথে আরেকটা পরিবারের ভালোবাসার সম্পর্ক কেমন যেন কলুষিত হয়ে গেল। সকলের ভুল ভাঙলেও কেমন একটা বাধা মনের মধ্যে দেওয়াল তুলে দাঁড়িয়ে ছিল। পুতুল যে সাহস করে কিছু বলবে তেমন সুযোগ হয়তো পায়নি, না হলে আমার সাথে একবারও দেখা করার চেষ্টা করল না। এটা ভেবে আমিও কিছুদিন মনমরা হয়ে ছিলাম, পরে আসতে আসতে পড়াশোনার চাপে এমনকি বলতে পারা যায় অভিমানে আর পুতুলের কথা ভাবিনি।

বর্তমান :-

কলেজ পাশ করে যখন একদিকে চাকরি ও অন্যদিকে ম্যানেজমেন্টের কোর্স করছি তখন একটি মেয়ে নম্রতা একপ্রকার আমায় তার প্রেমিক কম হাসব্যান্ড বানিয়ে ফেলেছিল। আমি তাকে কিছুতেই বোঝাতে পারিনি যে আমি এখন বিয়ে করছি না। সে কি বুঝেছিল জানি না, তবে আমার জন্য বোধহয় নিজের জীবনের সব ত্যাগ করতেও তৈরি ছিল। কিন্তু আমি তার ব্যবহার কখনও অপছন্দ করিনি, আসলে কৈশোরের ভালোলাগাকে ভুলতে না পেরে আজ যৌবনে এসেও নতুন করে কিছু শুরু করতে পারিনি। সেই জন্য কাজের বাইরে মেয়েদের নিয়ে ভাবনাকে প্রশ্রয় দেবার চিন্তা মাথায় আনিনি।

নম্রতা তাঁর শরীরী আবেদনে আমায় কাছে টেনে নিয়েছিল। তাঁর মধ্যে ছিল একটা মোহময়ী আবেদন, যে কোনও পুরুষ আকৃষ্ট হবে। আমিও তাঁর আবেদনে ঘায়েল হয়েছিলাম। এমনই এক ভ্যালেন্টাইন্স ডে’তে আমায় জড়িয়ে চুমু খেয়ে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেছিল, কিন্তু আমি কেন জানি না নিজের কাছে অপরাধী মনে করে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলাম। সেদিন তাঁর চোখে আমি যৌনতার আগুন দেখেছিলাম। নম্রতার চাহিদা ছিল শুধু শরীরটা। কিন্তু তাঁর শরীর এটা চাইলেও আমি নিজের মনকে সামলে নিয়ে গেস্ট হাউস থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। তখন হয়তো পুতুলের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল।

সেই ঘটনার পর আর ভাবিনি। এখন অফিসের ব্যস্ততা ও বাড়ি গিয়ে গল্প বই পড়া এই নিয়ে বেশ আছি।

এখন অনেক বদল হয়েছে গ্রামের। বাবা মারা যাবার আগে একবার গ্রামে যাবার সুযোগ এসেছিল, কিন্তু পুতুলের প্রতি অভিমানে আর যেতে চাইনি। জানতাম পুতুলের অন্য ছেলের সাথে বিয়ে হয়ে গেছে।

আর বিশেষ খবর ছিল না।

পরদিন সকাল ৭টা

সারারাত কত ভালো-মন্দ স্মৃতি রোমন্থন করে ঘুমাতে গিয়েছিলাম। সেইসব  চিন্তা করে ঘুমাতে গিয়ে উঠতে একটু বেলা হয়ে গেল। ট্রেনে যাব তাই ট্রলি ব্যাগ নিয়ে স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। ঘন্টা দুয়েক লাগবে। হাওড়া থেকে আমতা, তার পর বাস বা ম্যাজিক গাড়িতে আরও কিছুক্ষন। এর পরেই পৌঁছে যাব আমার গ্রাম ঝিখিরাতে। গ্রামের মানুষের সুরাহার জন্য ট্রেন লাইন আমার গ্রামের কাছাকাছি আনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু সে প্রস্তাব গ্রাহ্য হয়নি। ফলে আমতা পর্যন্ত ট্রেনে গিয়ে বাকিটা পথ কাটা সার্ভিস করেই যেতে হল। দাদুর জমিদারির নিদর্শন এখনও কিছু কিছু আছে। পুরানো মন্দির, রাসমঞ্চ সেও ভগ্নপ্রায়। ফেসবুকের সৌজন্যে বহু বিশিষ্ট মানুষ গ্রামের ১০০ বছরের নানা ঐতিহ্য সম্পর্কে জ্ঞাত হয়েছেন, কিন্তু সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়নি। আমি রথতলায় নেমে পুরানো সিনেমা হল ও কিছু বন্ধ হয়ে যাওয়া দোকানের দিকে তাকিয়ে হারিয়ে গেলাম। এক মাঝবয়সী ভদ্রলোকের ডাকে চেতনা ফিরল। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বলল “বিল্টু না, হ্যাঁ ঠিক চিনেছি। পুরো সাহেব হয়ে ফিরেছিস।” আমি চিনতে পারিনি। প্রায় ২০ বছর পর আজ পা রাখলাম গ্রামের মাটিতে। শুধু মুখ দেখে চেনা সত্যিই কষ্টকর। আমি কিছু বলব, এমন সময় সে পরিচয় দিল । সে আমার ছোটবেলার বন্ধু বিশু। নামটা চেনা, কিন্তু মুখের পরিবর্তন এতটাই হয়েছে যে নিজের পরিচয় না দিলে চেনা যেত না। যাইহোক তাঁর সাথেই বাকি পথটুকু গেলাম। ছোটবেলার দুস্টুমি, মারামারি, সাঁতার কাটা, মল্লিকা সিনেমা হলে অ্যাডাল্ট সিনেমা দেখা এসব বলতে বলতে বিশু এগিয়ে চলল, এমন কি আমার ট্রলিটাও মাথায় করে নিয়েছে। আজ যখন প্রথম গ্রামের মাটিতে পা দিলাম সত্যিই কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি পেলাম। সেই মাঠ, সেই পুকুর, সেই রাস্তা। কিছুটা নতুন মনে হল রথতলার দিকটা, ঐ দিকে কয়েকটা নতুন দোকান হয়েছে। পাশাপাশি মল্লিকা সিনেমা হলের ভগ্ন দশা দেখে সাময়িক খারাপ লাগল। এই সিনেমা হল ছিল কৈশোরের সবকিছু । এমন কোনও দিন যায়নি যেদিন হলে ঢুকে নতুন সিনেমা দেখিনি। বিশুর সাথে হাঁটতে হাঁটতে অতীত দিনের স্মৃতিগুলো হাতড়ে চলতে লাগলাম। বিশুর কথা অনুযায়ী সে গ্রামের স্থানীয় পঞ্চায়েতে চাকরি করে। কাকাদের ছেলেরা বড় হয়েছে। পুরানো লোক বলতে অনিল কাকার কথা জানতে খুব ইচ্ছা হচ্ছিল। হটাৎ মনে হল বিশুকে কি এক্ষুনি কিছু জিজ্ঞাসা করব, না থাক এই বলে আপাতত চুপ করে গেলাম।

সারাদিন পাড়ায় বহু লোক আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল, নিজের জ্ঞাতি বলতে ছোটকাকার ছেলে ও তার বৌ। বাকি কাকাদের ছেলেরা সম্পত্তি বিক্রি করে অন্য জায়গায় চলে গেছে। শুধু আছে ভুবন। ওদের কাছেই খেলাম। ছোটকাকার ছেলে ভুবন মাছের ব্যবসা করছে। পূর্বপুরুষের জমি ও পুকুর ভাগে দিয়ে দিব্বি আছে। ভুবনের মেয়ে রিম্পিকে একটা ছোট উপহার দিলাম। গ্রামের যাবতীয় খোঁজ খবর ওর থেকেই নিতাম।

বৈকালে নতুন পুকুরের পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে একটা নিষ্পাপ ও লাবণ্যময়ী মুখ দেখে চমকে উঠলাম। ও এখনও এখানেই আছে নিজের মনে বললাম।

কত স্মৃতি, কত স্বপ্ন ও কত কথা আজ মনে পড়ে গেল। এগিয়ে গেলাম। বললাম “তুমি অনিল কাকার মেয়ে পুতুল না?”

প্রশ্নটা শুনে শুধু একটু হেসে চলে গেল।

সবার মুখ ভুলে গেলেও ঐ মুখ আমি ভুলতে পারিনি। শুনেছিলাম ওর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল পাশের গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত ঘরের ছেলের সাথে। আমি ভাবতেও পারিনি যে এতদিন পর তাকে এই ভাবে আবার এই গ্রামেই দেখতে পাব।

সন্ধ্যাবেলা আমি বিশুকে সঙ্গে করে গেলাম অনিল কাকার বাড়ি। আমাদের বাড়ি থেকে ১মিনিট হাঁটলেই রথতলা, আর সেখানেই বাড়ি পুতুলের। পুরানো সেই দরজা আজও একই আছে। বিশুর ডাকে অনিল কাকা বেরিয়ে এলেন আর আমায় দেখে প্রথমে চিনতে না পারলেও,পরক্ষনেই চিনতে পেরে আমায় আসার জন্য বিশেষ ভাবে তৎপর হয়ে পড়লেন। আমি প্রণাম করে ওনার দেখান জায়গায় বসলাম। বিশু একটা কাজের অজুহাতে চলে গেল। আমি অনিল কাকার সাথে কথা বলতে শুরু করেছি,এমন সময় ভিতর থেকে একটা মিষ্টি গলার আওয়াজ ভেসে এল। অনিল কাকা তাকে যাচ্ছি বলে ভিতরে গেলেন। কিছুক্ষন পর ফিরে এসে আমায় বললেন “তা বাবা, তোমার কাজ, অফিস সব ঠিক চলছে তো, তুমি ভালো আছ বাবা?”

আমি হ্যাঁ বলতে গেলাম, তখনই ঘর থেকে পুতুল বেরিয়ে এসে আমায় একটা গ্লাসে জল ও বাতাসা দিল। আমি তা গ্রহণ করে শুধু অবাক হয়ে তার দিকে চেয়ে থাকলাম। পুতুল রান্না করতে ঘরে চলে গেল,আর বলে গেল “আজ এখানে খেয়ে যেও।”

অনিল কাকা পুতুল এর জীবনে ঘটা ট্রাজিডি বলতে শুরু করলেন। আমি জিজ্ঞাসা করার আগেই উনি মেয়ের বিয়ে ও এতদিন ঘটা সব ঘটনার বিবরণ দিতে লাগলেন। “তোমরা চলে যাবার বছর পাঁচেক পর পাশের গ্রামের সম্ভ্রান্ত পরিবারের একমাত্র ছেলের সাথে পুতুলের বিয়ে দিলাম। কিছুটা আপত্তি ওর থাকলেও আমি কান দিইনি। স্বামী সংসার করতেই গিয়েছিল, কিন্তু একটা দুর্ঘটনা সব শেষ করে দিল।” এই বলে হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকলেন। আমি হাতটা ধরে সান্ত্বনা দিতে থাকলাম। কিছুটা সামলে উনি আবার বলতে শুরু করলেন। “বিয়ের দিন থেকে একটা রাত বাড়িতে কাটায়নি জামাই। নারীসঙ্গ তাকে পাগল করে তুলেছিল। প্রথমে এসব শুনিনি। ঘটক এসব চেপে রেখেই বিয়ের সম্বন্ধ এনেছিল। আমিও মা মরা মেয়েটাকে বিদায় করতে কেমন উদভ্রান্তের মত হয়ে পড়েছিলাম। বিয়ের পর এসব জানার পর নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হতে লাগল। পুতুল বেচারা এসব মেনে নিয়েছিল। স্বামীর ভালোবাসা পায়নি, তাও শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে আসেনি। বিয়ের প্রথম রাতে পুতুলের বিছানায় এক বাইরের মেয়েকে নিয়ে হরিনারায়নের নোংরামি কোন মেয়ে নেবে বল?

জামাই এর কাছে পুতুল অভিযোগ জানাতে জুটেছিল মার। তাই সে মুখ বুজে এসব সহ্য করেছিল। একদিন রাতে হরিনারায়ণ নিজের ঘরে অন্য পুরুষকে ঢুকিয়ে পুতুলের সম্মান নেবার চেষ্টা অবধি করে, এসব মুখপুড়ি লজ্জায় কাউকে কিছু বলেনি।

বিয়ের পরই হরিনারায়ণ পুতুলকে যৌন পেশায় নামানোর জন্য বিক্রি করে দিতেও পিছপা হয়নি।

শুনেছিলাম কলকাতায় এক নিষিদ্ধপল্লীতে হরিনারায়নের নিয়মিত যাতায়াত ছিল। ওখানে পুতুলকে নিয়ে যাবার চেষ্টায় ছিল।

হরিনারায়ণের প্রধান কারবার ছিল নারী পাচার। পরিবারের অবাধ্য ও কুলাঙ্গার সন্তান ছিল। মেয়েটার শরীরটা নিয়ে পিশাচগুলো যা নয় তা করেছে, কিন্তু পুতুল হার মানেনি।

বিয়ের একমাসের মধ্যে খবর এল এক পুরানো বাড়িতে জামাই হরিনারায়নের মৃতদেহ পাওয়া গেছে।

এটা খুন তা সহজেই অনুমান করা যায়। আমার তাতে দুঃখ পাইনি। যেদিন মৃত্যু হয়েছিল সেদিন পুতুলকে বিধ্বস্ত অবস্থায় পাশের জঙ্গলে অর্ধনগ্ন অবস্থায় মিলেছিল। ভয়ে ও লজ্জায় পুতুল একদম চুপ হয়ে গিয়েছিল। পুলিশ আমার মেয়েটাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে। তবুও বলব মেয়েটা বেঁচে গেছিল। লোকাল থানার বড়বাবু নিজ দায়িত্বে তদন্ত করে এক রহস্যময়ী মহিলা সহ আরও এক কুখ্যাত অপরাধীকে গ্রেপ্তার করে, আর পুতুলকে আমি আমার কাছে নিয়ে চলে আসি। তদন্তে জানা যায় হরিনারায়ণ নিজের বিবাহিত বউকে অবশেষে খারাপ জায়গায় বিক্রি করতে চাইছিল না, আর তার জন্য সেদিন হরিনারায়ণকে খুন করে পুতুলের শরীরটাকে ভোগ করতে জঙ্গলের দিকে চলে গিয়েছিল। কোনও অজ্ঞাত কারণে খারাপ কিছু করতে পারেনি। কয়েক দিনের মধ্যে বেয়াই ও বেয়ান মারা যান। পুতুল আর ও বাড়ি মুখো হয়নি। কয়েক মাস খুব কষ্টে ছিল।”

এই শুনে আমি কি বলব ভেবে পেলাম না। শুধু মনে মনে এটাই বলতে থাকলাম যে একটু অপেক্ষা করতে পারল না পুতুল।

এই কথা শুনে চলে আসতে যাব, পুতুল ডাক দিল “বাবা তোমার অতিথিকে হাত মুখ ধুতে বল। আমি ছোলার ডাল আর লুচি আনছি।” 

আমার প্রিয় খাবার মা বানাত, আজ পুতুল সেই খাবার আমার জন্য বানিয়েছে,ও এখনও আমার প্রিয় খাবারের কথা মনে রেখেছে এটা ভেবে কেমন চোখের কোনে জল এসে গেল। ঘরের আলোটা অল্প উজ্জ্বল হওয়ায় সকলের মুখের ছোট ছোট অভিব্যক্তি ঠিক আন্দাজ করা যায় না। চোখটা মুছে পুতুলের দেওয়া খাবার খুব আনন্দের সাথে গ্রহণ করলাম। অনিল কাকা আমার সাথে বসে খেল।

“বুঝলে বাবা এই মা মরা মেয়েটাকে আগলে রেখেছি অনেক গুলো বছর। জানি না আগামী দিনে কি আছে ওর কপালে” বললেন অনিল কাকা।

এখন ওঁর মতো মেয়েকে কে বিয়ে করবে?

আসলে সেদিন তোমার সাথে ঘটা অন্যায় ব্যাপারটা বুঝেও মুখপুড়িকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, সে একটুও মুখ খোলেনি। তোমার বাবা-মা ছিলেন সাক্ষাৎ ভগবান। মেয়েটার অসম্মানের কথা ভেবে তোমাকে শাস্তি দিয়ে শহরে নিয়ে চলে গেল বড়দা ও বড় বৌদি । আমিও নিজের ভুলের জন্য তোমার বাবার মুখোমুখি হতে পারিনি। জানি বড়দা খুব আঘাত পেয়েছিল। কিন্তু কি বা করতাম। গ্রামের লোকের নোংরা কথা শুনে শুনে শেষে পুতুলের মনের কথা না বুঝে জোর করে ভাল ছেলে ভেবে বিয়ে দিলাম। আর কি হয়ে গেল। আজ নিজ কৃতকর্মের জন্য বড্ড কষ্ট পাচ্ছি।”

আমি শুধু শুনে গেলাম, কোনও উত্তর দিলাম না।

আর কি উত্তর দেব সেটাই ভাবছিলাম। যে পুতুলকে আমি আমার মত করে ভালোবেসে আপন করে নেবার স্বপ্ন দেখেছিলাম, সেই পুতুলের শরীরটা নিয়ে কিছু জানোয়ার কি না অন্যায় করেছে। এটা ভাবতেই মাথায় আগুন চেপে গেল, আর মনে হল এসব একবার জানলে জানোয়ার গুলোকে উচিত শাস্তি দিতাম। হায় ভগবান!

খাবার খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে পুতুলকে আসছি বলে অনিল কাকাকে প্রণাম করে বাড়ির পথে রওনা দিলাম। আসতে আসতে কত কথা মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। বাড়ি এসে ছোটকাকার ছেলের সাথে কিছুক্ষন কথা বললাম আর এও জানলাম ওর মেয়েকে পড়াতে রোজ সন্ধ্যাবেলা পুতুল এই বাড়িতে আসে। আজ আমি এসেছি বলে আসেনি এখানে। কাল আসবে।

ঘড়িতে দেখলাম ৮টা ১৫ মিনিট। এত সকাল ঘুমাই না। কিন্তু গ্রামের মানুষের কাছে এখন গভীর রাত। আমার শোবার ব্যবস্থা আমাদের পুরানো ঘরেই হয়েছে। বহুদিন তালাবন্ধ ছিল। আজ ভাই ও তার বউ এসব পরিষ্কার করে রেখেছে। বাবা,মা ও আমার স্মৃতি জড়ানো এই ঘর আমায় নস্টালজিক করে তুলল। শুয়ে শুয়ে পুরানো দিনের কত স্মৃতি রোমন্থন করছিলাম। এই বিছানায় শুয়েই বাবার কাছে কত গল্প শুনেছি সেটা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম।

ঘুম ভাঙল ছোট্ট ভাইঝির ডাকে। সকাল সকাল পুতুল দিদির সাথে সে হাঁটতে ও ফুল তুলতে বেরোয়। আজ তাই আমায় নিয়ে যেতে সে ছুটে এসেছে। কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে আমি ছোট্ট বাচ্ছার হাত ধরে বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে। খামারের কাছে হলুদ শাড়িতে পুতুলকে দেখে আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। কি রূপ, কি দৃপ্তি তার চোখে। যৌবনের প্রতীক সে। মনে হল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি এই নারীকে আমি দুচোখ মেলে দেখছি। আমার চোখ আটকে গেছে, মুখে কিছু বলার ছিল না। পুতুল খিল খিল করে হাসলো, আর রিম্পিকে বলল “তু্ই যা এখন, পরে তোর সাথে ফুল তুলব।” রিম্পিকে চলে যেতে বলে পুতুল আমার সাথে কিছুটা সময় কাটাবে বলে ঝিল পুকুরের দিকে নিয়ে গেল। কাল থেকে শুধু আমি ওকে দেখেই গেছি আর স্মৃতিগুলো হাতড়ে গেছি। আজ প্রথম বার কিছু বলার সুযোগ এসে গেল, বলতে গেলে এটাও পুতুলের জন্যই। ঝিল পুকুরের কাছে আসতে পুতুল বলল “কি গো বিল্টু দা, মনে পড়ে সেই দিনগুলো?

জানো আজও যখন সুযোগ হয় এখানে বসে সেই হারানো দিনের কথা গুলো একা বসে ভাবি, আর নিজের মনেই হাসি। কত দুরন্ত ছিলাম।”

বললাম “তু্ই, মানে তুমি অনেক সুন্দর হয়েছ।” আবার খিল খিল হাসি হেসে পুতুল বলল ‘তুমি?’

“কবে থেকে আবার আমায় তু্ই থেকে তুমি বলা শুরু করলে ?”

একটু অপ্রস্তুত হয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম “ধুর, আসলে বহু দিন পর তোর সাথে দেখা, তাই বেড়িয়ে গেছে।”

এবার আমি একটু ধাতস্থ হলাম। কুন্ঠা ছেড়ে মনের সব দ্বার খুলে পুতুলের সাথে কথা বলতে শুরু করলাম। দূরের মুসলিম পাড়া থেকে নামাজের শব্দ ভেসে এল। সূর্যের আলো এখনও ফোঁটেনি। একটা মৃদু হাওয়া ভেসে আসছিল। বোধহয় এই সময় ঝিলপুকুরের দিকটা কেউ আসে না। অথচ এত সকাল পুতুল স্নান করে নতুন পোশাক জড়িয়ে শুধু আমার সাথে দেখা করতে চলে এসেছে। গায়ে অদ্ভুত এক আকর্ষণীয় সুগন্ধ। আমি মুগ্ধ হয়ে ওর দিকে চেয়ে রইলাম। আর বললাম “তু্ই একটু অপেক্ষা করতে পারলি না?”

উত্তর দেবার আগেই দেখলাম ওর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। বুঝলাম এই প্রশ্নের উত্তর পুতুলের কাছে নেই। “আমি গেলাম যে বছর তার পর কোনও যোগাযোগ রাখতে পারিনি, অথচ তোর বিয়ের খবর পেয়েছিলাম। রাগে, দুঃখে, অভিমানে আসিনি। কত আঘাত পেয়েছি। তোকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখেছিলাম, কত রঙ্গিন ছিল সেই স্বপ্ন। মা তোকে কত ভালোবাসত। শহরে যাবার পর এমন দিন ছিল না যেদিন মা তোর কথা বলেনি। মায়ের শেষ ইচ্ছাও ছিল তোকে আমার বউ করবে,কিন্তু তু্ই হয়ে গেলি অন্যের। সেদিনই ঠিক করেছিলাম আর যোগাযোগ রাখব না।” ক্ষীণ ও মিষ্টি গলায় পুতুল বলল “আজ কেন এলে ?”

কান্না ভেজা গলায় সে বলল -“তোমার পুতুল নষ্ট হয়ে গেছে। তোমার পুতুল তার এই শরীর রক্ষা করতে পারেনি। তাও তুমি কেন আমার কাছে এমন ভাবে ফিরে এলে? “

“আমি এমনি এসেছি। কিছু জমিজমার কাগজ সই করতে ভুবন ডাকল, তাই আসতে হল। না হলে ও সমস্যায় পড়ে যাবে। ওর মেয়ে রিম্পির ভবিষ্যতও এর সাথে যুক্ত। আমি বিয়ে করিনি, তাই ঘর টুকু রেখে গ্রামের সব জায়গা জমি ওকেই দিয়ে যেতে এসেছি।”

আমি আরও বললাম ” তোকে আমি আজও ভালোবাসি। কোনও এক দুঃস্বপ্ন ভরা ঘটনা ও কিছু জানোয়ারের জন্য তু্ই নিজেকে অপরাধী ভাবছিস কেন? “

নিজেকে সামলে নিয়ে একটু চুপ থেকে পুতুল বলল “জান বিল্টু দা আমার স্বামীর মৃত্যুর তদন্তে আসা অফিসার আমায় বিয়ে করতে চেয়েছিল। তখন আমার মানসিক অবস্থা যা তাতে এসব ভাবিনি। সেই অফিসার আমায় খুব সাহায্য করেছিল। অমন খারাপ পরিস্থিতিতে একটুও বিপদে আমায় পড়তে দেয়নি।”

“আচ্ছা” বললাম আমি।

আমি পরিবেশটা হালকা করতে বলে বসলাম “তোর মনে পড়ে তোকে একবার বলেছিলাম যে তোকে আমি কিস্ করব…”

এই কথা শুনে পুতুল লজ্জা পেয়ে একটু এগিয়ে গেল আর আমার দিকে হালকা চাহনি দিয়ে বলল “মনে আছে।”

“তুমি তখন নাছোড়বান্দা, যেন ওটা না পেলে জীবন বৃথা। সত্যিই তুমি পাগল ছিলে। যেন পৃথিবীতে আমি ছাড়া আর কোনও মেয়ে ছিল না।”

আমি অস্ফুটে বললাম “তা জানি না, তবে তোর কাছে কিছু চাওয়ার মধ্যে একটা জোর ছিল। মনে হত তোর প্রতি যা ইচ্ছা তাই অধিকার ফলানো যায়।” “আমার মনে ইচ্ছা থাকলেও ভয়, লজ্জায় সেদিন আমি তোমায় কিস্ দেব না এটা জানিয়ে দিয়েছিলাম। তাতে বাবুর কি রাগ” বলল পুতুল। আমি বললাম “আসলে তোর জন্য আমি সব কিছু করতে পারতাম। তখন ছিলাম একদম উন্মাদ। কেমন একটা পুতুল পাগল ছেলে ছিলাম। প্রেম ছিল কিনা জানি না কিন্তু তোকে ভীষণ পছন্দ করতাম। জানিস এখন এসব ভাবলে কেমন ছেলেমানুষী মনে হয়।” এবার পুতুলের ছেলেবেলার মত মনে হল।

“আচ্ছা তুমি কেন বিয়ে করলে না বিল্টু দা ” বলল পুতুল।

কিছুক্ষন চুপ থেকে বললাম “তোকে ছাড়া আর কাউকে আমি আমার হৃদয়ে ঠাঁই দিইনি। হয়ত তোর মত এত আপন কাউকে কখনও ভাবিনি, তাই বিয়ে করার সিদ্ধান্ত আমি নিইনি। অফিসের অনেক মহিলা স্টাফ চেষ্টা করেও সমৃদ্ধ সেনকে হাতের মুঠোয় আনতে পারেনি। সেদিন যে অনুভূতি বলার বা বোঝার বয়স ছিল না আজ তা চিৎকার করে বলতে দ্বিধা নেই আমার। আসলে আমি একজনকেই ভালোবেসে ছিলাম। সেটা তু্ই, হ্যাঁ শুধু তুই।”

 আমার কথাটা শেষ হবার পর পুতুল কিছু বলল না।

নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম দুজনে। একটা কোকিলের ডাকে একটু পিছনে তাকালাম। আবার কথা শুরু হল।

“জান এখন আমি মানসিক ভাবে অনেকটা নিজেকে শক্ত করেছি। একটা স্কুলে পড়াই। অনেক স্টুডেন্ট। খুব আনন্দে কেটে যায়। তোমার ভাইঝি রিম্পিকে রোজ সন্ধ্যাবেলা বাড়িতে পড়াতে যাই। খুব ব্রিলিয়ান্ট মেয়ে। গ্রামের প্রধান সমস্যা হচ্ছে শিক্ষার অভাব, আর অসভ্য কিছু ছেলেদের মাত্রাছাড়া বদমাইসি।

আমার সাথে নোংরামি ঘটার পর কিছুদিন সব চুপ ছিল। এখন আবার মেয়েদের উপর একটার পর একটা অন্যায় ঘটে চলেছে। প্রতিবাদ করার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে সবাই।

জান আমাদের স্কুলটাকে একটা বড় বিল্ডিং বানানোর জন্য প্রোমোটার বিপুল নামের একটা বেয়াদপ কয়েকটা ছেলেকে লাগিয়েছে। কাল স্কুলে স্টুডেন্টদের সামনে আমায় অপমান করে গেল। জানি না কি হবে”  এই বলে থামল পুতুল। আমার রোমান্টিক কথা বলার আর সুযোগ এল না। আমি আপাতত পুতুলের সাথে ওর সমস্যার ভিতরে ঢুকতে শুরু করলাম। দুজনে উঠে বাড়ি চলে এলাম। এর পর ভুবনের বউয়ের হাতের রুটি তরকারি খেয়ে পুতুলের কথা মত স্কুলের দিকে গেলাম। সকালে বাজারে ভীষণ ভিড়। গণেশ দা, বৃন্দে দা, ছোটকা দা, উত্তম দা, বিনয়বাবু, গোপালবাবু আরও কত জনের সাথে সাক্ষাৎ হল। মোটামুটি সবাই আমার মুখ চিনতে পেরেছে। আসলে বাবার মুখের অবিকল ছাপ আমার মুখে হওয়ার জন্য কারোর চিনতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি। পুতুল ও আমি স্কুলে ঢুকলাম। দেখলাম কিছু সিমেন্ট, বালি পাশে ডাই করা। বুঝতে অসুবিধা নেই যে প্রোমোটার থাবা বসিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে কি করব ভাবছি, এমন সময় প্রদীপ এর ফোন। এটাও সম্ভব?

আমি পুলিশের সাহায্য নেব এটা ভাবছি, আর তখনই প্রদীপের মতো এমন পুলিশ অফিসার বন্ধুর ফোন এল। অনেক কথার মধ্যে পুতুলের সমস্যা ব্যাখ্যা করলাম। স্থানীয় থানার সাথে কথা বলে রাখবে জানাল প্রদীপ। এর বেশি কিছু বলল না সে। ফোন ছেড়ে দিয়ে পুতুলের ক্লাসের দিকে গেলাম। শিক্ষিকা রূপে পুতুল আজ মানবতার পূজারী। সাক্ষাৎ সরস্বতী। ধীরে ধীরে ক্লাসে পড়াতে লাগল। আমি খানিকটা সময় স্কুলের চারিদিকে ঘুরতে লাগলাম আর অতীতের সেই হুল্লোড়ের স্মৃতিকথা রোমন্থন করতে থাকলাম। এর পরও অনেকটা সময় কাটালাম স্কুলের ভিতরে অবস্থিত মন্দিরে বসে। আমি কিছুক্ষন থেকে এলাকার মানুষদের সাথে কথা বলতে বলতে এগিয়ে গেলাম হাটপুকুরের দিকে। একটি লোক কিছুটা বিবর্ণ পোশাকে আমায় এসে বলল “কথা আছে পাশে আসুন।” অনিচ্ছা সত্ত্বেও গেলাম। তিনি যা বললেন তাতে পিলে চমকে যাবার উপক্রম হল। ড্রাগ, মাদক, হিরোইন, চরস, গাঁজা সহ একাধিক জিনিসের ডিল হবে আজ এই হাটপুকুরের কাছে এক ভাঙা মন্দিরে। সঙ্গে নারী পাচারের মত জঘন্য কাজও হবে। আর যে যে বাঁধা দেবে তাদেরকে শেষ করে দেবার চক্রান্ত হচ্ছে। ব্যাপারটা নিশ্চিত হতে সন্ধ্যাবেলা আসতে হবে এই সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি তাঁর পরিচয় জানার আগেই তিনি হটাৎ উধাও হয়ে গেলেন। চারিদিক আমার ভীষণ চেনা। তাও যেন অনেক কিছু বদলে গেছে এই ২০ বছরে, কিন্তু এইখানের প্রাচীন মন্দির ও জঙ্গলটা একই রকম রয়ে গেছে। মনে হয় কেউ ইচ্ছা করেই এখানের জঙ্গল সাফ করতে দেয়নি। আর যত এমন পোড়ো জঙ্গল থাকবে ততই সমাজবিরোধীদের আস্তানা গড়ে উঠবে। পুতুল, বিশু এদের সাথে অনেক বার স্কুলের ছুটির পর এসেছিলাম সেটা ছোটবেলার কথা। আজ কিছুটা কৌতূহল নিয়েই এলাকার কিছুটা অংশ মোটামুটি দেখে চলে এলাম। সারাদুপুর বাড়িতে কাটল। পুরানো আলমারি থেকে ছোটবেলার খেলনা বের করে দেখছিলাম। কেমন হাসি লাগছিল। দুপুরে শুয়ে শুয়ে পুতুলের কথাই ভাবছিলাম। অপেক্ষা করছিলাম সন্ধ্যা হবার। আর সেই লোকটির কথা মত হাটপুকুরে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।

সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ ঘরে বসেছিলাম। আজও পুতুল আসেনি। রিম্পিকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলাম “তোর পুতুল দিদি আসবে না?”

রিম্পি বলল “স্কুলে তো  বলেছিল আসবে ,কিন্তু এখনও তো আসেনি জ্যেঠু।”

আমি বললাম “কিছু গন্ডগোল আছে।”

এর পর কিছু একটা আশঙ্কার কথা ভেবে গেলাম অনিল কাকার বাড়ি। কাকা জানালেন “পুতুল স্কুল থেকে বাড়ি আসেনি।”

মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল। এতক্ষন তো তার বাইরে থাকার কথা নয়। এতদিন পর পুতুলকে পেয়েও আজ হারিয়ে ফেললাম, এই ভেবে মাথা ঘুরতে থাকল।

অজানা অনেক সম্ভবনা আমার মাথায় কিলবিল করতে থাকল। কি করব ভেবে চলে গেল কয়েক মিনিট। সময় যেন খুব দ্রুত এগিয়ে যেতে থাকল। মনটা বড় অস্থির হয়ে পড়ল। আর বাড়িতে সময় নষ্ট না করে ছুটলাম হাটপুকুরের দিকে, ঐ দিকে একটা পোড়ো মন্দির আছে। যদি খারাপ কিছু হয়ে থাকে তবে তা ঐ সব অসভ্য ছেলেগুলোর দ্বারাই হবে। আমার আন্দাজ ঠিক। বিশু ও আমি তন্নতন্ন করে খুঁজে অবশেষে পুতুলের পায়ের একটা নুপুর পেলাম। সন্দেহ আরও তীব্র হল। মন্দিরের পাশে বাঁশ বাগানের ওখানে হালকা একটা হাওয়ায় পুতুলের হালকা কিন্তু চাপা কণ্ঠ পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম দুজনে। চার জনের দুষ্কৃতী দলকে দশ মিনিটের মারামারিতে শুইয়ে দিলাম আমরা। পুতুলের কোনও ক্ষতি করতে পারেনি। অজানা ভয় ও ভবিষ্যত আতঙ্কে পুতুল ভেঙে পড়ে আমায় জড়িয়ে ধরল। আমি কি বলব ভেবে না পেয়ে দু হাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরলাম। পুতুলের ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার ভঙ্গিতে ভালোবাসার স্বাদ পেলাম আমি । পুতুল বলতে থাকল “তুমি আমায় আগলে রাখ বিল্টু দা, তুমি আমায় ছেড়ে যেও না …”

আমি আমার সব উত্তর পেয়ে গেলাম। কতক্ষন পুতুল আর আমি পরস্পরকে জড়িয়ে ছিলাম মনে নেই। প্রদীপের গলার শব্দে সম্বিত ফিরল। “স্পেশাল ব্রাঞ্চের অফিসারদের নিয়ে আজ এখানেই আসছিলাম আমি । শুধু প্রোমোটার চক্কের মাথা চুনিলাল ও তার সাথে যুক্ত চুনোপুটিদের ধরার সঠিক লোকেশন ও সঠিক তথ্য ছিল না, তাই এতদিন ধরতে পারিনি। পুতুলের দ্বারা অনেকটাই জেনেছিলাম। আর আজ তোর ফোন পাবার পর এটা পরিষ্কার হয়ে যায়” বলল প্রদীপ।

“আসলে আমি বিগত কয়েকদিন ধরেই ঝিখিরার এখানে প্রোমোটারি, মাদক পাচার, দুষ্কৃতীরাজের খবর পাচ্ছিলাম। বড় অপরাধী ও মাফিয়া বীরাপাকে ধরতে জাল বিছাই। হরিনারায়ণ এদের হয়েই কাজ করত। পুতুল আমায় এখানকার খবর নিয়মিত দিত। তার মধ্যে তোর ফোন পেয়ে এক বিপদের আঁচ পেয়ে আজই চলে আসি। পুতুল স্কুলের মধ্যে এমন দুষ্কৃতীরাজ মেনে নেয়নি। তাই ওরা ওকে সম্মান নষ্টের ভয় দেখায়। স্কুলের মধ্যে একরাশ ছেলে-মেয়ে ও শিক্ষকদের সামনে চুড়ান্ত অপমান ও আপদস্ত হতে হয় পুতুলকে। তবুও পুতুল ভয় পায়নি। গ্রামের স্কুলে ছেলে-মেয়েরা পড়াশোনা করে বড় হলে সমাজবিরোধীদের কাজ কঠিন হয়ে পড়ে। তাই তারা সবসময় চায় পড়াশোনা বন্ধ করতে। এক্ষেত্রেও তেমনটাই হয়েছে। সে যাই হোক আজ তু্ই এসে পুতুলের সম্মান রক্ষা করে মানুষের পরিচয় দিলি ভাই সমৃদ্ধ” বলল প্রদীপ।

“তু্ই কি জানিস পুতুলের স্বামীর মৃত্যু তদন্ত আমি করেছিলাম বহু বছর আগে। এমনকি বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছিলাম। তার পর ট্রান্সফার হয়ে কলকাতা চলে যাই। বিয়ে করে সুখে দিন কাটাচ্ছিলাম। কিন্তু কয়েকমাস আগে স্থানীয় থানা থেকে পুতুলের সাথে কথা হয়, আর তখন থেকেই এই অপরাধীদের ধরার চেষ্টা শুরু করে দিই। আর এও জানতে পারি তুই আর পুতুল পরস্পরকে ভালোবাসিস। সুতরাং বন্ধু চালিয়ে যাও আর পারলে তুমি বিয়ে না করার মৌনব্রত এবার ভেঙে ফেল” এই বলে সব কটা দুষ্কৃতীকে সঙ্গে নিয়ে প্রদীপ বেরিয়ে গেল।

আমি বিশুকে এগিয়ে যেতে বললাম। পুতুলকে সঙ্গে নিয়ে আমি বাড়ির পথে রওনা দিলাম। এতক্ষনে গ্রামের সবাই জেনে গেছে যে আজ কি ঘটেছে। তিমির সেনের ছেলে এক নারীর সন্মান বাঁচিয়েছে এটা আজকের সবথেকে বড় খবর। ভাবিনি এখানে এসে আমার জন্য এই অপেক্ষা করছিল। যাই হোক অনিল কাকার কাছে পুতুলকে দিয়ে আমি বাড়ি চলে এলাম। বাড়িতে সবাই খুব খুশি। পাড়ায় সবাই আমার সঙ্গে দেখা করে গ্রামের কায়দায় প্রশংসা করতে লাগল। কিছুটা অবাক লাগল, ভাল লাগছিল না। বার বার সেই পুতুলের কথাই মনে পড়তে লাগল। রিম্পি হাত ধুয়ে খেতে ডাকল। ভুবন ও আমি একসাথেই খেলাম। রাতে ঘুম আসতে অনেকটা দেরি হল।

পরদিন সকালে রিম্পি আর ডাকতে আসেনি, পুতুলও আজ ফুল তুলতে আসেনি। বুঝতে অসুবিধা হল না যে কালকের বীভৎসতা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। একটা ভয় ও ট্রমা এখনও কাজ করছে পুতুলের মধ্যে এটা বুঝতে অসুবিধা হল না আমার।

আমি তাড়াতাড়ি চা খেয়ে বেরিয়ে গেলাম অনিল কাকার বাড়ি। বিছানায় শুয়ে পুতুল। অনিল কাকা আমায় ভিতরে যেতে অনুমতি দিলেন। একাকী এক যুবতী নারী বিছানায় শুয়ে আর আমি তার ঘরে প্রবেশ করব এটা ভেবে একটু কুন্ঠা ও লজ্জা বোধ হল। তাও আমি এগিয়ে গেলাম।

পুতুলের শরীর আজ চাপা আতঙ্কে কাঁপছে। শরীরের আন্দোলন প্রতিটা অঙ্গ কে আলাদা ভাবে চিনিয়ে দিতে প্রস্তুত। বক্ষ যুগল কম্পমান। চোখ থেকে একফোঁটা করে জল মুখ বেয়ে বুকের উপর এসে পড়েছে। আমি তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম।

একটু বসে হাত দুটো ধরে ট্রমা থেকে বের করার নানা কথা বলতে থাকলাম, আর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম। পুতুল হাসার চেষ্টা করেও স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে পারছিল না। এই ভাবে দু’দিন গেল।

আর আমি আছি মাত্র একদিন। কালই রওনা দেব। তাই আজ পুতুলের খবর নিতে যেই না লিচুতলার দিকে গেছি, অমনি রিম্পি আমায় ইশারায়  ঝিলপুকুরের দিকে যেতে বলল। আমি গিয়ে দেখি লাল রঙের শাড়ি পরে অপূর্ব এক সুন্দরী যুবতী ঘাটের পাড়ে বসে কারও জন্য অপেক্ষা করছে। বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে ওটা আমার পুতুল।

এগিয়ে গেলাম। আমার হাত ধরে টেনে বসিয়ে আমার ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে দীর্ঘ চুম্বনে ভরিয়ে দিল। এক হাত ধরে আর অন্য হাতে ইশারা করে চুপ করতে বলল। দীর্ঘ এক চুম্বন আমায় স্থির করে দিল। আমি বলার সুযোগই পেলাম না। কৈশোরের সেই চাওয়া কিস্ , আজ যৌবনে দাঁড়িয়ে এমন ভাবে ফিরিয়ে দেবে পুতুল তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। মৃদু হাওয়া আর পাখির ডাকে মুখরিত এমন মুহূর্তে দুজন যুবক-যুবতীর এমন চুম্বন যেন সময়কে থামিয়ে দিয়েছিল। পুতুল তার সবটুকু দিয়ে আমায় চুমুতে ভরিয়ে দিল। আমার এতদিনের সব চাওয়া একটা দীর্ঘ চুম্বনের মধ্যে দিয়ে সে বুঝিয়ে দিল। আমার ভালোবাসার পরিপূর্ণতা পেল আজ। কতক্ষন যে আমি পুতুলের সাথে চুম্বনরত অবস্থায় ছিলাম জানি না। এমনকি পুতুলের স্পর্শ পেয়ে ছাড়তে চাইছিল না। একটা দূরের বাসের হর্ণের শব্দে আমরা লজ্জা পেয়ে সরে গেলাম। চুম্বন শেষে পুতুল বলল “এবার দেখলে তো আমি কিস্ দিতে পারি। তোমার পুতুল শহরের যে কোনও আধুনিক মেয়ের থেকে কোনও অংশে কম যায় না। এবার বুঝলে তো?”

“আমি বললাম তু্ই ভাল নেই , তাই আমি তোর খোঁজ নিতে যাচ্ছিলাম। হটাৎ রিম্পি বলল…”

“থাক বিল্টু দা, এখন বল আমায় তুমি কি আজও ভালোবাসো? আজও কি আমার সব দায়িত্ব তুমি নিতে পারবে, আজও কি আমার সম্মান ও সুরক্ষার ভার তুমি নিতে পারবে?”

আরও বলে চলল “বাবা হয়তো এই প্রস্তাব তোমাকে দেবে। জানিনা তুমি রাজি হবে কি না। তাই তোমার চাহিদা অনুযায়ী তোমার পুতুল তোমায় কিস্ করে কৈশোরের চাওয়া ইচ্ছা আজ পূরণ করেছে।”

কথা থামল না আবার বলে চলল “আমি জানি তোমরা ছেলেরা কি চাও,মেয়েদের কিস্ করা তাঁদের সাথে লিভ-ইন করা, আর তারপর তাকে ছেড়ে চলে যাওয়া।” আমি বুঝতে পেরেছি আমি তার কথার একটাও জবাব দিইনি তাই মেয়ে অভিমানে এই সব অবান্তর কথার উৎপত্তি ঘটিয়েছে । পুতুল বলেই চলল “পুতুলের মতো মেয়ে দেখলেই তাকে পেতে ইচ্ছা হয় তাই তো আমার বিল্টু দা।”

আমি উদার্থ কণ্ঠে গেয়ে উঠলাম “অভিমান আজ ভুলেছি ক্ষমা কর যদি থেকো না দাঁড়ায়ে, রুদ্ধ দুয়ার খুলেছি…”

গান গাইতে গাইতে এবার আমি পুতুলকে জাপটে ধরে বুঝিয়ে দিলাম তোর বিল্টু দা তোকেই চায়, অন্য কাউকে নয়। আর চায় আজও তোর ভালোবাসা তোর প্রেম। আমি বললাম “বাকি ছেলেরা কেমন আমি জানি না কিন্তু তোর প্রতি আমার প্রেম সেদিনও যা ছিল আজও তাই আছে।”  আমার শরীরের স্পর্শ পুতুল সত্যিই খুব নিশ্চিন্ত বোধ করছে, তাই জোর দিয়ে ছাড়ানোর চেষ্টা করল না। পুতুল বলে চলল “মনে পড়ে তোমরা ছেলেরা আমাদের মেয়েদের দেখার জন্য স্কুলের গেটে বসে থাকতে, এমন কি পুকুরে সাঁতার কাটার সময় লুকিয়ে লুকিয়ে আম গাছ থেকে তা দেখতে। ছিঃ ছিঃ কি লজ্জা, মেয়েদের স্নান …”

আমি মুখে হাত দিয়ে চেপে ধরলাম। পুতুল চুপ করে গেল। আমি বহু দিন পর নারী শরীরের স্পর্শ ও তার শরীরের ধুঁকপুকুনির শব্দ স্পষ্ট শুনতে পেলাম। কেমন এক রোমাঞ্চিত ভাব ফুটে উঠল আমার দেহে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি নারী আর সেই নারীর মন ও দেহের অধিকার এমন ভাবে পাব ভাবিনি। পুতুল তার হাতের স্পর্শ দিয়ে আমায় আপন করে নিল।

পুতুল বলল “ক্লাস নাইনে,তুমি আমায় একটা প্রেমপত্র দিয়েছিলে মনে পড়ে? তুমি তখন আমাকে কারোর সাথে শেয়ার করতে পারতে না, মনে পড়ে? তোমার কাকার প্রাইভেটে এক বন্ধুর সাথে জড়িয়ে বীণা আমায় খুব ছোট করেছিল, তখন তুমি কি করেছিলে… কি মনে পড়ছে?”

আমি বললাম না যে কৈশোরের ঘটে যাওয়া সব স্মৃতি আমার কাছে সযত্নে সুসজ্জিত আছে। আমি যে কিছুই ভুলিনি। আমি এটাও বলতে পারিনি যে তোকে পাবার জন্য অনেক চেষ্টা করেও যখন পাইনি, তখন আমি কি মানষিক যন্ত্রনার মধ্যে চলে গিয়েছিলাম। আমি নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিলাম। বাবা-মায়ের অক্লান্ত ভালোবাসায় আমি আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসি। আর তখন থেকেই ঝিখিরাতে না আসার মন করে নিয়েছিলাম। আজ জানি এই কথা গুলো খুব অপ্রাসঙ্গিক। তাই পুতুল বলে চললেও আমি আর এসবের উত্তর দিলাম না। তাকিয়ে থাকলাম পুতুল এর ঠোঁটের দিকে। মুখ দিয়ে সুললিত কণ্ঠের মাধুর্য ঝরে পড়ছে, আর আমি সেই মাধুরী কুড়িয়ে নিচ্ছি। শুধু তাঁর দিকে তাকিয়ে তা অনুভব করার চেষ্টা করছি।

পুতুল বুঝল আমি তার কথা শুনছি না। থেমে গেল। নিষ্পাপ চাহনি আমায় দেখছে, আর আমি শুধু তার চোখের দিকে তাকিয়ে ভালোবাসার নির্যাস গ্রহণ করছি। নির্ভেজাল ভালোবাসা আর হৃদয়ের এমন মিল আসমুদ্র হিমাচল অবধি বিস্তৃত। একটু বাদে ঘোর কাটল। উঠে পড়লাম, পুতুল হালকা ঠোঁটের হাসিতে একটু এগিয়ে গেল।

আমি  পুতুলের সাথে ওদের বাড়ি গেলাম। দুয়ারে অনিল কাকা বসেছিল। আমি আসতেই “এসো এসো বাবা বসো। তোমার সাথে কিছু কথা ছিল। তোমার আপত্তি না থাকলে বলি ” বলল অনিল কাকা। আমি বললাম “এ মা ছিঃ ছিঃ আপনি বলুন।” আমার হাত দুটো ধরে উনি বললেন যে “আমার ঐ মা মরা মেয়েটার সব দায়িত্ব তোমাকে দিলাম। যে ভুল আমি করেছিলাম আজ তোমার সাথে বিয়ে দিয়ে সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই। তুমিই আমার মেয়েকে সুখে ও শান্তিতে রাখতে পারবে বাবা বিল্টু, তাই আমি তোমাদের চার হাত এক করে দিতে চাই, আমায় নিরাশ কর না। বড়দা ও বড়বৌদি বেঁচে থাকলে এই কথাগুলো নিয়ে তাঁদের কাছেই যেতাম। তুমি বাবা আমায় কথা দাও, তাহলে নিশ্চিন্তে মরতে পারব।” এই বলে উনি মাথা নত অবস্থায় চুপ করে রইলেন। পাশের ঘর থেকে পুতুলের কাশির শব্দে আমি বুঝতে পারলাম রসিকতা করছে। আমি অনিল কাকাকে সম্মতি দিলাম। কালই ভাল দিন আছে শুনলাম। আজই বেলা থেকে প্রস্তুতি নিতে শুরু করল আমার গ্রামের পাড়ার লোকজন, তারা চায় এই বাড়িতেই আমার বিয়ে হোক। অগত্যা শহরে যাওয়া দিন চারেক পিছিয়ে দিলাম। কাল সারাজীবনের জন্য আমার হয়ে যাবে পুতুল। পুতুলকে ফিরে পেয়ে জীবনের সব পাওয়া আমার হয়ে গেল। আমি কৈশোরে যে প্রেম করেছিলাম,প্রথম যৌবনে তার পরিণতি প্রাপ্তি হবে ভেবেছিলাম। কিন্তু তখন তা হয়নি। আজ মধ্য যৌবনে এসে পুতুলকে পেয়ে আমার জীবনের সেই সুখস্মৃতি ফিরে এসেছে। সব কিছু কেমন স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। পুতুল আজ আর এল না। কাল বিয়ে তাই হয়ত আজ আসতে চাইছে না। আমার যে আর একা ভাল লাগছে না।

গোটা পাড়া হটাৎ করে এক অদ্ভুত আনন্দের স্বাদ পেয়ে উল্লসিত। বাঁধ ভাঙা উচ্ছাস বোধহয় গ্রামেই সম্ভব। সব আমার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। ঘটনা গুলো এতো দ্রুত ঘটছে যে আমি ঠিক বুঝে উঠছে পারছি না।

সারারাত খুব উত্তেজনায় কাটল।

আজ বুধবার।

আজ আমার বিয়ে। সকাল থেকেই সানাই বাজছে। ভুবন আর বিশু এই সব করেছে। ওদের পাগলামি বলে বোঝানো যাবে না।

প্রতিটা নিয়ম ভুবনের বৌ ও পাড়ার কাকিমারা সযত্নে করল। আমার গায়ে ছোঁয়া হলুদ পুতুলের বাড়ি গেল। সন্ধ্যা বেলা টুনি বাল্বের আলোয় সুসজ্জিত হয়ে আলোকময় হয়ে উঠল গ্রাম। পুতুল ও আমার নতুন জীবন শুরু হল।

পাড়ার পলাশ, নিশীথ,কল্লোল,পিন্টু,সুনিতা,মিলন দা,বাবুল দা,সুকুমার দা সকলের যেন নিঃশ্বাস ফেলার ফুরসত নেই। আমি ভাবিনি এত দিন পরে গ্রামে এসে পাড়ার ভাই-বোনেদের এত ভালোবাসা ও গুরুজনদের এত আশীর্বাদ পাব। স্বপ্নেও ভাবিনি যে আমার জীবনের এমন মুহূর্ত আসবে যেদিন কৈশোরের দিনের হারানো ভালোবাসা এমন করে ফিরে পাব। আমি অভিভূত, ভগবানের কাছে আমার চিরঋণ রয়ে গেল। আজ ভালো ভাবে সব কিছু মিটে গেল।

কাল আবার ছোট খাটো কাজ আছে। বন্ধু-বান্ধব পরিচিতদের সেই ভাবে নিমন্ত্রণ করার অবকাশ পাইনি। সব কিছু এত দ্রুততার সাথে ঘটল যেন সবই স্বপ্ন মনে হচ্ছে।

বৃহস্পতিবার

আজ ভাবছি অন্তত প্রদীপকে নিমন্ত্রণ করব। পুতুল ও আমার জীবনে ওর অবদান কম নয়। কাল বৌভাতে যদি আসে ভীষণ আনন্দিত হতাম।

সারাদিন আগামীকালের আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত থাকলাম। ভুবন ও পাড়ার ছেলেরা আমার বৌভাতের সব আয়োজন করেই ফেলেছে। আজ রাতে পুতুলের কথাই শুধু মনে পড়তে লাগল, হয়তো সেও আমার স্বপ্নেই বিভোর।

শুক্রবার

আজ সকালের সূর্যটা তার আলোর জোয়ারে  চারিদিক কেমন উদ্ভাসিত করে তুলেছে। পাখির কাকলিতে আমার পাড়া মুখরিত। নতুন প্রভাত দেখছি চোখ খুলে। বিশ্ব জুড়ে শুধু আমার প্রেমের বন্দনা সঙ্গীত শুনতে পাচ্ছি।

বৌভাতের সন্ধ্যায় বহু নিমন্ত্রিত এসে পুতুল ও আমাকে আশীর্বাদ করে গেলেন। ভুবন ও অনিল কাকা মানুষজন দের খাইয়ে তবে ফেরত পাঠালেন।

বৌভাত হল এখানেই, এই বাড়িতেই । সব শেষে আমি ঢুকলাম আমার ঘরে। ফুলের গন্ধে ঘরটা ম ম করছে। আজ ফুলসজ্জার রাতে পুতুলের রূপের ছটা চাঁদের আলোকেও হার মানিয়েছে। পুতুলকে লাগছে আজ অপূর্ব সুন্দরী। সারা শরীর জুড়ে এক মিষ্টি গন্ধের সুবাস। লজ্জায় রাঙা হয়ে বিছানার একপাশে বসে। পুতুলকে মনে হচ্ছিল সদ্য ফুটে ওঠা গোলাপ। পুতুলকে কাছে পাবার এমন মিলন রাত আমার জীবনে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। আমি ঘরে ঢুকে পুতুলের এমন চাঁদবরণ মুখটা দেখতে যাব এমন সময় ও সেই ছোটবেলার মতো খিলখিল করে হেসে উঠল। এমন রোমান্টিক মুহূর্তে হাসি কেমন বেমানান লাগল। আমিও ছাড়ার পাত্র নই। পুতুলের চোখের দিকে তাকালাম। চোখের মধ্যে নীরব কিন্তু এক না পাওয়া যৌনতার মিষ্টি আবেশ দেখতে পেলাম। হাতের উপর হাত রেখে পুতুলের ঠোঁটের উপর হালকা একটা চুম্বন দিলাম। সারা শরীরে ইলেকট্রিক খেলে গেল। পুতুলের শরীর উত্তেজনায় আন্দোলিত হতে থাকল। শরীরের প্রতিটা অঙ্গ শিহরিত হচ্ছে। আজ সে আমার কাছে নিজেকে সমর্পন করেছে। নারীর শরীরের উষ্ণতায় আমার সারা শরীর উত্তেজিত। মন চাইছে মিলনের এই রাত যেন শেষ না হয়। পুতুল শুধু ফিসফিস গলায় বলল “বিল্টু দা আমি আজ মুক্তির স্বাদ পেলাম। তুমি আমায় তোমার করে নাও। আমার শরীর, মন আমি তোমায় সোঁপে দিলাম। তুমি তোমার ভালোবাসা ও উষ্ণতায় আমায় আপন করে নাও, আমায় শীতল করে দাও। আমি আর পারছি না, তোমার জন্য এতকালের এই অপেক্ষা আমার সুখের চিহ্ন হয়ে থাকুক। আমার শরীরে এঁকে দাও তোমার ভালোবাসার প্রতীক।” দুজনের হৃদয় আজ মিলিত হচ্ছে। নিস্তব্ধ রাতে শুধু দুটো মানুষের হৃৎস্পন্দন  শোনা যাচ্ছে। চারিদিকের কোলাহলের কোনও শব্দ আসছে না কানে। বিছানা জুড়ে দুজন হারানো নারী -পুরুষ তাঁদের প্রেমের আগুনে ঝাঁপ দিয়ে নতুন পৃথিবী শুরু করতে চলেছে। নিয়নের আলোয় ঘরটা মুখরিত, আর পুতুলের শরীরের স্পর্শে আমার শরীর উত্তেজনায় পূর্ণ। চুম্বন আর ভালোবাসায় এতদিনের স্বপ্নের পরিপূর্ণতা পেল। প্রকৃতি তার দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করছে আর ফুল দিয়ে বন্দনা গান গাইছে।

আকাশ-বাতাস মুখরিত পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র সম্পর্ক নারী-পুরুষের আদি ও অকৃত্রিম ভালোবাসার এমন মিলন পর্ব দেখে।

আকাশের চাঁদের হালকা আলো জানালার ফাঁক দিয়ে ঘরে ঢুকেছে, চারিদিক শান্ত। নিস্তব্ধতা সারা ঘর ময়। সারা আকাশ শান্তির জয়গান গাইছে।

নীরব রাতের এই মহামিলন যেন অতীতের কোনও হারানো স্মৃতিকে ফিরিয়ে দিচ্ছে ।

আনন্দে মুখরিত চারিদিক, আর ঘরে শুধু দুটি মানুষ। তারা আজ এক হয়েছে। ভালোবাসার স্পর্শে মহামিলনের রাত যেন বেড়েই চলল।

কবির ছন্দে বলতেই হয় – ‘চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে…’

                     *সমাপ্ত*

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post অর্ধাঙ্গ| কঠোর ভাবে প্রাপ্তমনস্কদের জন্য | আবু মুহম্মদ রাকিবুল হাসান সিয়াম| Bengali Story for Matured
Next post অপেক্ষায় মোড়ানো ভালোবাসা| কঠোর ভাবে প্রাপ্তমনস্কদের জন্য | সুলতান মোহাম্মদ শাহরিয়ার নিলয়| Bengali Stories for Matured