(এক)
ভোর তিনটে বেজে তিরিশ মিনিট,ভোর বলার থেকে রাত বলাটাই বোধহয় অনেক ভালো হবে।কারণ শহরের মানুষের কাছে তো সকালের শুরু হয় সূর্যদেবের আগমনে নয়,তাই তাদের কাছে সকাল হয় যখন ঘুম ভাঙে তখন,তা ঐ বেলা আটটাও হতে পারে আবার দশটাও,যার যেরকম অভ্যেস,যে যেরকম ভাবে বিছানাকে ভালোবাসে এই আর কি।আমার বিছানার উপরে রাখা মোবাইলের অ্যালার্মটা কেঁপে কেঁপে বেজে উঠল।ঘুম হয়ত ভাঙত না,কারণ একবার অ্যালার্মের শব্দে কোনদিনও আমার ঘুম ভেঙেছে কি না,তা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে চতুর্থ গোল টেবিল বৈঠক বসানো দরকার।তা সে যাইহোক সেদিন কিন্তু ঘুম ভাঙল,হয়ত তার পিছনে এক অমোঘ টান ছিল,সেদিন ছিল পনেরই আগষ্ট।চুয়াত্তরটা বছর পার করে ফেলেছি আমরা স্বাধীন দেশের পথে হাঁটতে হাঁটতে।তবে এই স্বাধীনতা নামক শব্দটি নিয়ে আমার আবার একটু অ্যালার্জী আছে,তাই তার আলোচনা করতে গেলে হয়ত পাতার পর পাতা চলতে থাকবে,শেষ আর হবে না।পনেরই আগস্ট যেন সবার কাছে একটা কেমন ছুটি ছুটি গন্ধ,বিপ্লবীদের আত্মবলিদানের কথা স্মরণ করে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করা,সে সব এখন লোক দেখানো, ছুটির আমেজটাই যেন হল আসল রাজা।
তা সে যাইহোক ঘুম থেকে উঠে চোখে মুখে জল দিয়ে বেরিয়ে পড়েছি,সময় তখন রাত পৌনে চারটে।শ্যামনগর স্টেশন থেকে প্রথম ট্রেন ভোর চারটে বেজে ষোল মিনিটে,যদিও লোকাল ট্রেন বন্ধ,স্টাফ স্পেশাল ট্রেনই বর্তমানে লোকাল ট্রেনের মতন করে চলছে,তবে ট্রেনের সংখ্যাটাই যা কম,কিন্তু ভিড়ের কোন কমতি নেই, বরং আরও গাদা গাদা লোকের ভিড় বার-বার লোকাল ট্রেনের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।আসলে আমাদের সমাজের কিছু বুদ্ধিজীবি ও রাজ্যের(পশ্চিম বঙ্গ) মুখ্যমন্ত্রী এবং আমলাদের ধারণা—যে লোকাল ট্রেন চালালে অতিমারীর প্রকোপ বাড়বে,কারণ করোনা(corona virus) ভাইরাসটি লোকাল ট্রেনকে খুব ভালোবাসে,সত্যিই ২০২১ সালে দাঁড়িয়েও আমাদেরকে কত কিছুই মুখ বুজে সয়ে যেতে হয়,আহা! এই না’হলে বৈচিত্র্যময় ভারতবর্ষ ! তবে শুধু যে লোকাল ট্রেনকে এই করোনা ভাইরাস ভালোবাসে,তা কিন্তু নয়,বরং লোকাল ট্রেনের থেকেও স্কুল কলেজগুলোকে এই ভাইরাস অনেক বেশি ভালোবাসে,এক্কেবারে পরকীয়া প্রেমের মতন গাঢ় মাখা-মাখা প্রেম।
অগত্যা কিছু করার নেই,স্টাফ স্পেশাল ট্রেনে করেই আজ বাড়ি যেতে হবে।আমি শ্যামনগরে কর্মসুত্রে ভাড়ায় থাকি,তা খুব বেশিদিন হয়নি,কারণ যেখানে ভাড়ায় থাকি,ওখানকার কেউই আমায় চেনে না,আর চিনবেই কী করে ! কর্মসুত্রে শ্যামনগরে এসছি তা ঐ দেড় বছর হল,আসার সাথে সাথেই তো শুরু হয়ে গেল লকডাউন,তাই বাইরে বেরনোও তেমন নেই,তার সাথে আবার মুখে মাস্ক,মানুষের সাথে চেনা পরিচিতি হওয়া সত্যিই ভীষণ চাপের ব্যাপার,ঐ যাদের বাড়িতে ভাড়ায় থাকি,তারাই হয়ত একটু আদ্রু চেনে,তাও হয়ত বাইরে দেখলে চিনতে পারবে না,কারণ পরিচয়ের মাঝে চার দেওয়াল যে কখন বাধা হয়ে যায়,বর্তমানে তা ধরা খুব মুশকিল।
অনেকদিন পর আমরা একত্রিত হব এই পনেরই আগস্ট-এ, তেরঙ্গা পতাকার নিচে,সে যেন এক আলাদা অনুভূতি,ভাবলেই যেন রক্তে একটা আলাদা শিহরণ জেগে ওঠে।তাই আমার মনটা একাই আহ্লাদে আটখানা হয়ে রাস্তায় হেঁটে চলেছে,আর আমার সেই আপ্লুত হৃদয়ের ছন্দের সাথে ছান্দিক গতিতে তালে তালে এগিয়ে চলেছে অন্ধকারের এক ছায়া মাখানো অদৃশ্য ঘোর।
হঠাৎ বুক কেঁপে উঠল আট দশটা কুকুরের চিৎকারে,আট দশটা কি! পরপর দেখলাম গলি থেকে বেরিয়ে আসল,বাচ্চা বুড়ো মিলিয়ে মোট ত্রিশ পঁয়ত্রিশটা মতন কুকুর,যেন পুরো এলাকাটা পাহারা দেওয়া ওদের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে,সে কি গলা ফাটানো চিৎকার ! ঠিক যেমন পাড়ার কচি নেতারা দুদিন রাজনীতিতে এসে নিজেদেরকে বেশ নেতা নেতা মনে করে,এবং ফকট-দালালী করে,অথচ রাজনীতির ‘র’ ও বোঝে না!
কিন্তু এখন ওসব ভাবার সময় নেই, ভয়ে বুকটা ঢিপ ঢিপ করছে,যদি তেড়ে আসে চোর ভেবে ! এত রাতে রাস্তায় জনপ্রাণী কিছুই নেই,শুধু ঐ কুকুরগুলো আর আমি,কারণ শহর এবং মফস্বল পুরোটাই শুনশান,রাত জাগার পর এখন গভীর তন্ময় ভাবে অঘোরে ঘুমোচ্ছে এ শহর।আমি কিন্তু তবুও বুকে সাহসের একটুকরো চাঁই বেঁধে একটু একটু করে এগিয়ে চলেছি।অনেকক্ষণ চিৎকার করল কুকুরগুলো,আমার পিছন পিছন কিছুটা এলও চিল্লাতে চিল্লাতে,কিন্তু আমাকে কিছুই বলল না,শুধু নিজেদের মধ্যে চিল্লাচিল্লি করল,হয়ত ওরা বুঝতে পেরেছিল যে আজ তেরঙ্গা পতাকার নিচে দাঁড়িয়ে হিন্দুস্থানের জয়ধ্বনি দেওয়ার দিন,আমাদের দেশের পঁচাত্তর তম স্বাধীনতা দিবস উৎযাপনের দিন,কিন্তু ওরা হয়ত এটা বোঝেনি যে আজ রঙিন জলে লিভারকে স্নান করিয়ে নরম মাংসের উষ্ণতা উপভোগ করার মাধ্যমে ছুটি কাটানোর দিন।ওরা কি অতকিছু বোঝে ? ওরা তো ঠিক দেশের সাধারণ মানুষের মতন অবুঝ প্রাণী,মাথায় গু গোবর যা ঢেলে দেবে তা’ই সুড়ুৎ সুড়ুৎ করে ঢুকে যাবে,ঠিক ঐ হাওড়া স্টেশনের সাবওয়ের মতন।আসলে রাজনৈতিক নেতারা সাধারণ মানুষকে যেমন করে বোঝাবে ঠিক তেমনই বুঝে যাবে তারা,তবুও কিন্তু তারা স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক।
(দুই)
ভয়ের সিঁড়ি বেয়ে বুকের ধুকপুকুনিকে সঙ্গে নিয়ে একটু একটু করে উঠে চলে গেলাম শ্যামনগর স্টেশনে,রেলের ঘড়িতে সময় তখন ভোর চারটে বেজে সাত মিনিট।স্টেশনে গিয়ে আমি রিতিমত আঁতকে উঠলাম টিকিট কাউন্টারে লোকের লাইন দেখে,এত ভোরে এত মানুষ কোথায় যাবে ! যে যার কাজে ব্যস্ত সবাই,আসলে এরা সবাই কেজো,এদের কাছে স্বাধীনতা দিবসের কোন ছুটি নেই,তেরঙ্গা পতাকা উত্তোলন করে দিনটাকে উৎযাপন করবার কোন ভ্রুক্ষেপই নেই,পেটের টান আজকে এদেরকে রেলের কাউন্টারে টিকিটের লম্বা লাইনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে,যদিও এই পেটের টান আজকের দিনে রাজনৈতিক নেতাদের এক মহৎ দান কিংবা অবিস্মরণীয় এক সৃষ্টি বলা যেতে পারে,যেমন জার্মানীর হিটলার করেছিলেন,যার মধ্যে একটা যেন বেশ চমকপ্রদ কৃত্রিমতা আছে।তাই যদি পৃথিবীর আশ্চর্য জনক তালিকায় ভারতবর্ষের রাজনীতিকে ফেলা যায়,তা’হলে অবশ্যই ভারতীয় রাজনীতি একটা ভালো জায়গায় নিজের স্থান করে নেবে,এতে কোন সন্দেহ নেই।এই দান বা অবিস্মরণীয় সৃষ্টি না থাকলে ভোটবাক্সে খেটে খাওয়া মানুষ যে ভোট দান করবে না ! তা কিন্তু নেতারা ভালো করেই জানে।সে যাইহোক,তখনও কিন্তু স্টেশনের উপর কিছু মানুষ আপন খেয়ালে তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় শুয়ে রয়েছে,লোকের কোলাহলে এদিক ওদিক একটু আদ্রু পাশ ফিরছে বটে ,কিন্তু ওঠবার তাদের অতটাও তাগিদ নেই। আসলে যাদের ঘরই হল রেলের প্ল্যাটফর্ম,তাদের কাছে কি স্বাধীনতার দিন ! কি-ই বা অন্য কোন দিন! তাদের কাছে বছরের তিনশ পঁয়ষট্টি দিনই সমান,প্ল্যাটফর্মই তাদের স্বর্গের বিছানার একমাত্র ঠিকানা।তবুও তো এ সমাজের বুকে আমাদেরকে স্বাধীনতা দিবস পালন করতে হবে,কারণ আমরা যে শিক্ষিত সম্রদায়,তাই তা জোরপূর্বক প্রমাণ করাটা আমাদের কাছে যেন এক আবশ্যক ব্যাপার,যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা হাস্যকর মনে হয়।
এতক্ষণে লম্বা লাইনটা কাউন্টারের সম্মুখে পদার্পণ করল,টিকিট কেটেই এক নং প্ল্যাটফর্ম থেকে দু নম্বর প্ল্যাটফর্মে চলে গেলাম,কারণ শিয়ালদাগামী ডাউন ট্রেন দু নং প্ল্যাটফর্মেই আসবে,লাউড স্পীকারে ঘোষণা হয়ে গেছে।দু নং প্ল্যাটফর্মে একটা চায়ের গুমটি মতন দোকানে বন্দে মাতরম্ গান বাজছে,কাকু ফুটন্ত দুধের মধ্যে ডাবুটা একবার ডুবিয়ে ফাঁটছে আবার তুলে নিচ্ছে,না’হলে যে দুধ উথলে পড়ে যাবে।কাকু চা বানাতে বানাতে সেই গানের সুরে গুনগুন করে সুর মেলাচ্ছে।আসলে কিছু মানুষের রক্তেই থাকে এই স্বাধীনতার সুখকে পরম আত্মীয় করে নেওয়ার অভ্যাস,যেমনটা এই কাকুর আছে,তাই সমস্ত বাধা বিপত্তি ত্যাগ করেও দেশের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনে মেতে উঠেছে,অথচ যারা দেশের সেবক অথবা সেবিকা হিসেবে নিজেকে বড়াই করে,শুধু বড়াই করে না বরং রাজনৈতিকভাবে নিযুক্তও করে, সেইসব নেতা মন্ত্রীরা লোক দেখানো মেকি স্বাধীনতা দিবস পালন করে,এবং নিজের দলের কোন্ কোন্ নেতা স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহন করেছিলেন,তাদের ইতিহাসই শেখানো বুলি আওড়ানোর মতন কপচাতে থাকে, শুধুমাত্র জনগণকে নিজের নেতৃত্বাধীনে বা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য।
কাকুর দোকানের সামনে বসে বসে ফুলের ঝাঁকা সাজাচ্ছে এক বয়স্কা মাসি,মাসির চুলে সবেমাত্র পাক ধরেছে,হয়ত স্বাধীনতার উচ্চ শিখরে পৌঁছনোর সিঁড়ির সন্ধান মাসি ছোটবেলায় পায় নি,তাই হয়ত পড়াশুনো করার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে,তাই হয়ত আজ ফুলের ঝাঁকা সাজানো এবং বাজারে বিক্রি করার অভ্যাস তার রক্তে সয়ে গেছে, অথবা হয়ত মাসি পড়াশুনো করেও কিছু করতে পারে নি।তবে মাসিও বোধহয় জানে আজ পঁচাত্তরতম স্বাধীনতা দিবস,তাই ঝাঁকা ভর্তি করে ফুল নিয়ে এক্কেবারে ভোর ভোর বেরিয়েছে, হয়ত হাওড়ার ফুলের মার্কেট ধরার জন্য।কারণ আজ বিভিন্ন শহিদ বিপ্লবীদের গলায় ফুলের মালা চড়বে,সেজে উঠবে তাদের শরীর রঙিন ফুলের সুবাস মাখা পাপড়িতে।
ট্রেনের হুইশেল শুনতে পেয়ে লাইনের দিকে তাকালাম,দেখলাম উঁকি বাড়িয়ে ট্রেন আসছে কি না ! ঐ সবাই অভ্যাসের বশে যা করে আর কি।সে যাইহোক প্ল্যাটফর্মে ট্রেন যেন আজ একটু বেশি স্বাধীন ভাবেই ঢুকছে,আজ স্বাধীনতা দিবস সেটাও কি ট্রেনটা অনুভব করতে পারছে ! না কি ছুটির দিনেও স্টেশনে এত লোকের সমাগম দেখে ট্রেনটা বেশ ক্রোধান্বিত হয়েছে ? লোকোপাইলট ব্রেক কষছে হয়ত,কিন্তু তা যেন শোনার পাত্র সে নয়,তাই বেশ দ্রুত গতিতে সে প্ল্যাটফর্মের মধ্যে ধেয়ে আসছে,সেও যেন আজ কারও নিয়ন্ত্রণে থাকতে চাইছে না।সত্যিই ,কী অমোঘ এক টান আছে যেন এই তিনটে রঙের মাঝে ! অবশেষে ট্রেনটি যেন তার গতিকে থামাল ,মনে হয় যেন কোন দায়িত্বশীল(নিজ মনে মনে) নেতা তার রাজনৈতিক ভাষণ দেওয়ার জন্য দায়িত্ব সহকারে মঞ্চের উপর উঠে জনসাধারণকে যে যার গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে,হতে পারে তা হয়ত মিথ্যে,কিন্তু দিচ্ছে।আস্তে আস্তে সবাই যখন ট্রেনে উঠে পড়ল তখন সে তার কর্মে ব্রতী হওয়া ইঞ্জিনকে নির্দেশ দিল চালু হওয়ার জন্য।হুইশেল দিয়ে শব্দ করতে করতে ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বেরিয়ে এগিয়ে চলল,যেন সেও আজ পতাকার নিচে দাঁড়াবে বলে দুরন্ত গতিতে এগিয়ে চলেছে,মাঝে মাঝে গতিপথে মন্দন সৃষ্টি করছে,বিভিন্ন স্টেশনে দাঁড়াচ্ছে,ঠিক যেমন করে রাজনৈতিক নেতারা ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যে প্রকল্পের আশ্বাস দিয়ে চলে বক্তৃতার মধ্যে মধ্যে,এবং শ্রোতামণ্ডলীর হাতের তালির অণুরণন থামিয়ে দেয় জনসভার নিঃশব্দতা।
(তিন)
জানালার কাছে সিটটা অনেক দিন পর পেলাম,সত্যিই এই সিটের মজাই আলাদা,যারা দূর দুরান্তে যাত্রা করে তারা এক্কেবারে অন্তর থেকে বোঝে এই ব্যাপারটা।বেশ রোমাঞ্চকর দৃশ্য,জানালার ধারে বসে বসে হাওয়া খেতে খেতে যাওয়া,বাইরের দৃশ্য অক্ষীগোলকের মধ্যে আবদ্ধ করা,ট্রেনের গতিময়তার সাথে চলমান শহরের প্রকৃতিকে দেখা, সে যেন এক আলাদা অনুভূতি।
ধীরে ধীরে আকাশ পরিস্কার হতে লাগল,রেল লাইনের আশে পাশে বস্তিগুলোতে ঝুপড়ির মধ্যে থেকে মানুষের শরীরের গন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়াতে লাগল,সে গন্ধ যেন স্বাধীনতার গন্ধের থেকেও অনেক বেশি তীব্র।সব্বাই দুমুঠো ভাতের জোগাড় করার জন্য সূর্য ওঠার আগে থেকেই উঠে যুদ্ধে নেমে পড়েছে,তাই তাদের কাছে স্বাধীনতা দিবস খেলনার মতন মনে হয়।রেল লাইনের পাশের দৃশ্য দেখতে দেখতে এবং সেই দৃশ্যের দৃশ্যপটে নিজেকে নায়কের চরিত্রে কল্পনা করতে করতে, কখন যে ট্রেন দমদম বিধান-নগর স্টেশন পেরিয়ে শিয়ালদা ঢোকার উপক্রম করছে বুঝতেই পারলাম না।ট্রেন যখন একটু স্লো হল এবং ট্রেনের লাইট পাখা বন্ধ হয়ে গেল,ঠিক তখনই বুঝতে পারলাম যে ট্রেন শিয়ালদা ঢুকছে,নারকেল ডাঙা কারশেডের কাছে লাইন ক্রশ করতে গেলে এমনটা হয়।আসলে আমরা মানুষরা এরকমই,কোনকিছুর প্রভাব যতক্ষণ না পর্যন্ত নিজের উপর আসছে, ততক্ষণ পর্যন্ত কোন বিষয়ই খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করি না।যদি কামরার মধ্যে আলোর অভাব না হত কিংবা পাখা বন্ধ হওয়ার কারণে গরম না লাগত এবং রেলের কামরায় উপস্থিত প্রায় সবারই রাতের অপরিণত ঘুম ভাঙার দৃশ্য না চোখে পড়ত,তা’হলে টেরই পেতাম না যে ট্রেন কারশেড লাইন ক্রশিং-এ এসে গ্যাছে।রাজনীতিতেও ঠিক তেমনটাই হয়ে চলে, সবাই লুটেপুটে চেঁটেপুটে খাওয়ার পরে যখন জিভের আঁচড়টা আমাদের মতন জনসাধারণের গায়ে এসে পড়ে,ঠিক তখনই আমরা চাঁটা স্থানে ক্ষতচিহ্নের ব্যথা বুঝতে পারি।তার আগে নেতা চোথারা পুরোই চেঁটে চেঁটে খাল বানিয়ে রাখে,তা কিন্তু আমাদের ধর্তব্যের মধ্যে রাখি না,বরং আমরা তাদেরকে ভোট টা দিয়ে সেই খালে জল ঢোকাই,আর জল ঢুকলে তো অনায়াসে তার সাথে সাথে কুমিরও ঢুকবে এ আর অস্বাভাবিকের কী আছে ?
ট্রেন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রয়েছে কারশেডের কাছে।একজন হকার দেখলাম লাইন ধরে দৌড়ে দৌড়ে আসছে,সত্যিই কী টাইমিং ! ও হয়ত জানেই যে এই সময়ে এই ট্রেনটা এখানে দাঁড়াবেই,তাই শিকারীর মতন ওঁত পেতে বসে ছিল,যেই ট্রেনটা যখনই থামল তখনিই যেন তার দৌড়ানোর গতি অনেকগুণে বেড়ে গেল।সত্যিই এত সকালেও সে ফেরিওয়ালার ঝোলা কাঁধে বেরিয়েছে ফেরি করবে বলে,হয়ত সারাদিন ফেরি করে রাতে বাড়ি ফিরবে সামান্য কিছু টাকা নিয়ে,যা দিয়ে তার কিছুই হবে না,তবুও তো কিছু হবে,এই হল আশা।একসময় ট্রেনের চাকা নড়ে উঠল,সাথে সাথে মনে হল পুরো শরীর সহ মনটাই দুলে উঠল সবার।সবাই কেজো,কাজে চলেছে,কেউ কেউ অফিসের বসের পরাধীনতায় বন্দী হতে চলেছে,আবার কেউ কেউ কাস্টোমারের আদানপ্রদানের কাছে বন্দি হতে চলেছে,পরাধীনতার শৃঙ্খলে বন্দী সবাইকে হতেই হবে,তবুও কিন্তু আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক,স্বাধীনতা আমাদের রক্তে টগবগ করে ফুটছে।
ট্রেন শিয়ালদা ঢুকল,পাঁচ নং প্ল্যাটফর্মে,তখন রেলের ঘড়িতে সময় দেখলাম,ভোর পাঁচটা বেজে পনের মিনিট।আমি যাব আপাতত সুভাষগ্রাম,তারপর ওখান থেকে বিশ্বনাথের বাইক-এ করে আমাদের মিলন স্থল,এক্কেবারে তেরঙ্গা পতাকার পাদদেশে।শিয়ালদা থেকে দক্ষিণ শাখায় ডায়মণ্ড হারবার লোকাল আছে পাঁচটা বেজে পঁচিশ মিনিটে।হাতে তখন আরও সাত মিনিট সময় আছে,তাই এক কাপ চা খাওয়াই যেতে পারে।কারণ কয়েক সেকেন্ডে মানুষ একশ মিটার দৌড়ে চলে যাচ্ছে চোখের নিমেষেই,অলিম্পিকে সোনা জিতছে,আর আমি তো সামান্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চা-এ চুমুক দেব,এ আর এমন কি কঠিন ব্যাপার।চা-এ চুমুক দেব,এমন সময় হাতের চেটোতে ছোট্ট নরম এক আঙুলের স্পর্শ,পিছন ফিরে ঘুরে দেখি বছর ছয় সাতেকের একটি বাচ্চা মেয়ে,সে আমার হাতের মধ্যে আঙুল গুঁজে দিয়ে ইশারা করছে খাবার খাবে।সত্যি বলতে কী গায়ের রোমকূপগুলো যেন সজোরে ক্রন্দিত স্বরে জেগে উঠল।এত ভোরে এরা খিদের জন্য হাত পাতে ? চুয়াত্তরটা বছর পার করে ফেললাম,ইংরেজদের অত্যাচারিত ভারতবর্ষকে মুক্ত করলাম,কিন্তু এ কোন্ ভারতবর্ষ তৈরী করলাম ! যেখানে এই চুয়াত্তর বছরেও অভুক্ত পেটের টানে নরম একটা হাত করুণ দৃষ্টিতে হাত পাতে ! চোখের কোণাটা ভিজে গেল,আপন নিয়মে হাত চলে গেল তার মাথায়,খাবারের দোকানের কাছে নিয়ে গিয়ে তার হাতে তুলে দিলাম এক টুকরো আনন্দের সামান্যতম মাটির পাত্র,হয়ত তা ভীষণ ঠুনকো,কারণ আজ আছে কাল নাও থাকতে পারে।
(চার)
ট্রেনের হুইশেল বেজে উঠল,দৌড়ে গিয়ে ট্রেন ধরলাম।সুভাষগ্রাম স্টেশন থেকে শুরু হল বাইক সফর।যদিও বিশ্বনাথ খুব ভালো বাইক চালায়,এর আগেও ওর বাইক-এ চড়েছি,কিন্তু তবুও খেয়াল রাখতে হবে,কারণ আজ অনেক ভোরে উঠেছি,তাই যদি চোখ লেগে যায় ! এমনিতে ছেলে হিসেবেও ‘ও’ খুব ভালো ছেলে।বিশ্বনাথ সুভাষগ্রামে কর্মসুত্রে ভাড়া থাকে।আমি বিশ্বনাথ নিতাই ও আরও কয়েকজন মিলে আমরা একটা গ্রুপ তৈরী করেছি,যার দ্বারা বিভিন্ন সামাজিক কাজ কর্ম করব,এটাই হল আমাদের উদ্দেশ্য,বিশেষ করে শিক্ষার অগ্রগতি।কারণ বর্তমান করোনা(covid-19) পরিস্থিতিতে শিক্ষার যা হাল তার কথা কী আর বলব ! স্কুল কলেজ বন্ধ,কিছু কিছু কলেজে অনলাইন ক্লাস হচ্ছে,কিন্তু তার যা বিচ্ছিরি অবস্থা।সবাই স্মার্ট ফোন নিয়ে ভিডিও গেম ডাউনলোড করছে আর দিনরাত তাতেই ব্যস্ত থাকছে।পড়াশুনোর পাঠ তো প্রায় চুকেই গ্যাছে বললে চলে,বই খাতা নোট দেখে দেখে বাড়িতে বসে পরীক্ষা দিতে গেলে আবার পড়তে হয় না কি ! সত্যিই ভাবতে অবাক লাগে, রাজনীতির চাপে পড়ে শিক্ষানীতি ক্রমশ খাদের দিকে নেমে যাচ্ছে।
বাইকের পিছনে বসে বসে চোখ লেগে যাচ্ছিল,এত ভোরে কোনদিনও উঠিনি তো, তাই ভীষণ ঘুম পাচ্ছে,ঠান্ডা হাওয়া চোখের পাতা দুটোকে যেন চুম্বকের দুই বিপরীত মেরুতে রূপান্তরিত করেছে,কোন মতেই যেন আর তাদেরকে দূরে সরিয়ে রাখা যাচ্ছে না,মিলনের অন্তিম প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে তারা।তবুও তাদের মিলনে বিচ্ছেদ ঘটাতে হবে,কারণ আমাদেরকে খুব শীঘ্রই পৌঁছতে হবে,স্বাধীনতার পতাকা আমাদেরকে সাদরে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে,তার সেই আহ্বানে আমাদের সবাইকে একত্রিত হতেই হবে।আমাদের গ্রুপের পক্ষ থেকে আজ স্বাধীনতা দিবসে পতাকা উত্তোলনের সাথে সাথে কিছু আনুষঙ্গিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে তার মধ্যে বিশেষ করে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে,সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান যা আজকের দিনে হারিয়ে যাচ্ছে এবং সবুজায়নের জন্য চারাগাছ বিতরণ।
কিছুদিন আগে আমরা সবার সম্মিলিত সহযোগিতায় বর্তমানের ডিজিটালাইজড শিক্ষার অগ্রগতির জন্য ছেলে মেয়েদের কম্পিউটার ট্রেনিং এর সামান্যতম ব্যবস্থা করতে পেরেছি,তাই আজও হয়ত এই অনুষ্ঠানটির সাফল্যতা আনতে পারব,এইসব ভাবতে ভাবতে বিশ্বনাথের হেলমেটের সঙ্গে আমার হেলমেট একবার ঠোকা খেয়ে গেল,তখন আবার নড়ে চড়ে বসলাম।
বর্তমানে এই মহামারীর কবলে রাজনৈতিক মিটিং মিছিল সমাবেশ ইলেকশানের প্রচার,এমনকি কোন রাজনৈতিক নেতার জন্য ধর্ণায়ও বসা যেতে পারে,হাজার হাজার লোক জমায়েত হতে পারে,সবই হতে পারে কিন্তু কোন শিক্ষামূলক কাজ কর্ম হবে না,স্কুল কলেজ খুলবে না,এ যেন এক স্বৈরাচারিতা,যেন শিক্ষা সংস্কৃতিকে ধংস করে দেওয়ার অদম্য প্রচেষ্ঠা।তাই আজ কোভিড প্রোটোকল মেনে আমরা আমাদের গ্রামে ছেলেমেয়েদেরকে শিক্ষার অগ্রগতির গতিময়তায় সামিল করার চেষ্টা করেছি।
বিশ্বনাথ বাইক চালাচ্ছে,তাই ওর সাথে কথা বলব না বলে ঠিক করেছিলাম,কিন্তু মন আর মানল না।তাই জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম,” বিশু তুই বড় পতাকা,ছোট কাগজের পতাকা আর দড়ি বা সুতো ব্যাগে নিয়েছিস তো মনে করে ?”
ও বলল,” হ্যাঁ তপন’দা নিয়েছি,কিন্তু জান কালারিং বেলুন পেলাম না।”
আমি বললাম,” ও যেতে যেতে রাস্তায় পেয়ে যাব বোধহয়,চল দেখতে পেলে নিয়ে নেব। “
বিশু বলল,” তপন’দা এই কারণেই তোমাকে এত বেশি ভালোবাসি,কারণ তুমি সবসময় পজেটিভ কথা বল।”
আমি বললাম ,” ও তেমন কিছু না রে,পজেটিভ নেগেটিভ মিলিয়েই তো সবকিছু প্রশম থাকে,তাই ওসবে অতবেশি মাথা না ঘামানোই ভালো,আমাদের শুধু সমাজের ভালোর জন্য কর্ম করে যেতে হবে,তার ফলের আশা করে কী লাভ ? তাই সে ফল পজেটিভ-ই হোক আর নেগেটিভ-ই হোক তাতে আর কী-ই বা এসে যায় ! “
বিশু আর কিছু বলল না।আমরা যখন আমাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছলাম,তখন সময় সকাল আটটা বেজে চল্লিশ মিনিট।সব ছাত্রছাত্রীরা এসেছে,কেউ ফুল নিয়ে এসছে,কেউ ফুলের খুব সুন্দর সুন্দর মালা গেঁথে নিয়ে এসছে।সত্যিই আনন্দে হৃদয়ের প্রতিটি রক্তকণা দোলনায় দোল খেতে চাইছে।আমি নিতাই আশীষ গৌরাঙ্গ বিমল বিশ্বনাথ সবাই মিলে ছোট কাগজের পতাকাগুলো সাজিয়ে দিলাম, সুতোতে বেঁধে টাঙিয়ে দিলাম।বড় কাপড়ের পতাকাটাতে ফুল বেঁধে বাঁশের মধ্যে ঝুলিয়ে বেঁধে রাখলাম।নিচে বেদি বানানো হল,বেদিতে রাখা হল আমাদের প্রকৃত নিঃস্বার্থ নেতা বলে আমি যাকে শ্রদ্ধা করি,আমাদের সবার শ্রদ্ধেয় এবং প্রণম্য নেতাজিকে।সুভাষচন্দ্র বসু সত্যিই তিনি নেতাজি।
একসময় বেজে উঠল শঙ্খধ্বনি,প্রজ্জ্বলিত হল দ্বীপশিখা,আমাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল স্বাধীনতার এক সুবাস।আমাদের মধ্যে প্রধান অথিতি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মহাশয় শ্রীযুক্ত মানস বাবু মহাশয়,তাই তাঁকে দিয়েই আমরা পতাকা উত্তোলনের কাজ শুরু করলাম।সমবেত কন্ঠে ধ্বনিত হল বন্দে মাতরম্ ,জয় হিন্দ এবং সমবেত সুরে উচ্চারিত হল বিশ্বকবির উপহার দেওয়া আমাদের জাতীয় সঙ্গীত।
ভারত মায়ের বীর সন্তানদের ত্মবলিদানের জন্য এক মিনিটের নিরবতায় ব্রতী হলাম সবাই।এই নিরবতায় হয়ত সবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে সমস্ত বিপ্লবীদের বলিদানের ইতিহাস,কিন্তু আমার চোখের উপর ভেসে উঠল সকালের সেই ছোট্ট নরম হাত,যে হাতের আজ কলম ধরে অক্ষরমালায় গা ভাসানোর কথা ছিল,যে হাত দিয়ে এই সমস্ত বিপ্লবীদের শহিদ বেদিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য জ্ঞাপন করার কথা ছিল,কিন্তু সেই হাত পেটের টানে আজ নিরুপায়,সংকুচিত।
চোখটা ভিজে উঠল,বর্ষার জলে মাটির উঠোনে যেমন করে কাদা জমে যায়,ঠিক তেমন করে মনের ভিতরটাতে ঘন মেঘের বর্ষণ হয়ে গেল, হৃদয়ের রক্ত সব ঘন থকথকে কাদা-কাদা হয়ে গেল।তাই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে ফেললাম ওদের জন্য,হ্যাঁ ওদের জন্য আমাদেরকে কিছু একটা করতেই হবে।হ্যাঁ যা সমাজে তৈরী করবে এক মৌলিক ছায়া।
গোপাল পৈলান