যখন ১৩টা বাজে| কঠোর ভাবে প্রাপ্তমনস্কদের জন্য | -| Bengali Story for Matured
0 (0)

প্রাক্তন ব্যাংক ম্যানেজার প্রিয়তোষ বাগচি আজ এক সপ্তা হল অবসর নিয়েছেন তাঁর ত্রিশ বছরের চাকুরী জীবন থেকে। নিজের বাড়িতে তাই আজ ফেয়ারওয়েল পার্টির আয়োজন করেছেন। দোতলা ছিমছাম বাড়িটার হলঘরে বিশিষ্ট গন্য মান্য নিমন্ত্রিত ব্যক্তিদের মাঝখানে নিতান্ত সাধারণ চেহারার অতি সাধারণ পোশাক পরিহিত অ্যান্টিক শপের মালিক সুবীর দত্ত ভীষণ চিন্তিত মুখে ফ্যাকাশে দৃষ্টি নিয়ে বেশ অনেক ক্ষণ ধরেই তাকিয়েছিলেন প্রিয়তোষ বাগচির দিকে। প্রিয়তোষ ব্যাপারটা বেশ খানিকক্ষণ লক্ষ করার পর হাতে পানীয় সমেত গ্লাস নিয়ে এগিয়ে আসেন সুবীর দত্তর কাছে,

“কী… সুবীর! সেই থেকে দেখছি একটা মাত্র গ্লাস নিয়ে বসে আছ। আমি ভাই একলা মানুষ।  গেস্টদের একলাই সামলাচ্ছি। তা ভাই তোমাকে যথেষ্ট টাইম দিতে পারছি না বলে রাগ হল নাকি হে?”

বলেই হো হো হেসে উঠে সুবীরের পিঠটা খানিক চাপড়ে দিলেন। সুবীর দত্ত অত্যন্ত সসব্যাস্ত হয়ে জবাব দিলেন,

” আরে না ভাই, আমি তো দেখছি তুমি কত ব্যস্ত মানুষ। আর তা ছাড়া তোমার এই সব লোকজনের মাঝে আমি বড়ই বেমানান। কাউকে চিনি না। কথা বলারও কেউ নেই। আমি বরং আজ তাড়াতাড়ি বেরই। দোকানে এসো ভাই, তখনই কথা হবে।”

প্রিয়তোষ অত্যন্ত লজ্জা পেয়ে বললেন,

“কিছু মনে করো না ভাই, তোমার সাথে আমার এবার থেকে রোজ দেখা হবে। কারণ চাকরি নেই। বাড়িতেই থাকবো সারাক্ষণ। কিন্তু এই অফিসের লোকজনের সাথে তো আর দেখা হবে না বলেই মনে হয়, তাই ওদের রিসিভ করতে একটু সময় লাগছে।”

বলে নিজের গ্লাসে চুমুক দিলেন।

প্রিয়তোষ নিজের এমন ব্যবহারে যাতে বিন্দুমাত্র লজ্জা না পান তার জন্য সুবীর যতোটা সম্ভব পরিবেশ হালকা করে বলেন,

” আরে ভাই ঠিকই তো। তোমার তো এবার সর্বক্ষণের সঙ্গী আমিই। তুমি ওদের দেখো। আমি বরং পেটপুজোটা সেরে আসি। “

বলেই মৃদু একটু অট্টহাসি দেওয়ার চেষ্টা করেও যেন পারলেন না।

“আরে হ্যাঁ নিশ্চয়ই। এসো এসো। খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন ছাদে। একেবারে রুফটপ পার্টি যাকে বলে….. হাহাহাহাহাহাহাহাহা….।”

উফ্… । কী বাঁচাই না বেঁচেছে আজকে সুবীর। চোখ মুখের ভাবখানা আজকে অন্তত স্বাভাবিক রাখা উচিত ছিল তাঁর। কিন্তু পারলেন না। কোথাও যেন একটু হলেও কষ্টে বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠছিল সুবীর দত্তের। এ তল্লাটে মানুষটার বন্ধু বা শুভাকাঙ্ক্ষী বলতে একমাত্র সুবীর। আজকে তিনিই তাঁর সাথে……! নাহ্ থাক। এইসব নিয়ে বড্ড বেশিই ভাবছেন তিনি। যা হয়ে গেছে, তা হয়ে গেছে। ভেবে লাভ নেই। আর যা করেছেন বুঝে শুনেই করেছেন তিনি। এতে এত ভাবনার কী আছে!

মনে মনে এহেন সাত-পাঁচ কথা ভাবতে ভাবতে সুবীর দত্ত এগোচ্ছিলেন বাড়ির দিকে। ভরপেট খাওয়া আজকাল আর সয় না সুবীর দত্তের। মদটাই তো গোলমাল করে বেশি। নাহ্ মনে হচ্ছে বাড়ি গিয়ে বমি না করলে কষ্টটা কমবে না। অ্যান্টাসিড সবসময় সঙ্গে থাকে। আজ আনা হয়নি। বয়স তো বাড়ছে। শরীরের ওপর এত অত্যাচার সইবে কেন! আসলে এ কষ্ট যতো টা না শরীরের তার থেকে ঢের বেশি মনের। মানসিক ও শারীরিক অশান্তি ঝেড়ে ফেলতে গিয়ে সে দুটো আজকে যেনো আরো বেশি চেপে বসলো ঘাড়ের ওপর। জোরে পা চালালেন বাড়ির দিকে। আজকে পায়ে হেঁটেই ফিরলেন সুবীর। শরীর সুস্থ রাখতে অন্তত মিনিট কুড়ি হাঁটা ভালো।

অতিথিদের আপ্যায়ন করা চাট্টিখানি কথা নয়। বিল্টু আর গৌরী না থাকলে এত লোককে সামলানোই যেতো না। ছেলে মেয়ে দুটো অনেক খেটেছে আজকে। উফ্…. ।বড় ক্লান্ত লাগছে প্রিয়তোষের। এই প্রথম তাঁকে বড় বেশি ক্লান্ত মনে হচ্ছে। চাকুরি জীবনের অবসরে এবারে তাঁর যে বিশ্রামের সময়, আর যে দৌড়াতে হবে না জীবনের লক্ষ্যে সে তাঁর মন বুঝে গেছে বলেই হয়তো ক্লান্তি গুলো জড়িয়ে ধরতে চাইছে তাঁকে? তারা বলছে এবার থামো। ঢিমে তালে চলুক জীবন। ক্লান্তিতে দু চোখ জুড়িয়ে এলো।

সকালে ঘুম ভাঙল মিনতির দরজা ধাক্কানোর শব্দে। সুবীর দত্ত যেন ভূত দেখেছেন। একেবারে চমকে উঠে বিছানার ওপর বসলেন। ততক্ষণে শুনতে পেলেন মিনতি ক্যারকেরে স্বরে,

“দাদা ওঠো, চা এনেছি, দাদা….”

বলে একবারও শ্বাস না নিয়ে ডেকেই চলেছে। মহা বিরক্তি লাগল সুবীরের। অনেক গুলো রাত বিনীদ্র কেটেছে তাঁর। ভয়ে আতঙ্কে এতদিন দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছিলেন। এই প্রথম একটা রাত পরম শান্তিতে ঘুমলেন তিনি। তবে এই ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসার একটা প্রধান কারণ হল প্রিয়তোষ। তার কোনো দুঃসংবাদ আশা করেই এই ধড়ফড়িয়ে ওঠা। কারণ….। থাক সে কথা না হয় কিছুক্ষণ পরই জানানো যাবে।

“এতো জোরে চিৎকার করিস কেন রে? নিশ্বাস না নিয়েই কথা বলে যাস… ।মরে যাস না কেন?”

বলেই রেগে মেগে দরজা খুললেন সুবীর। দরজার বাইরে চায়ের কাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মিনতি ন্যাকা ন্যাকা স্বরে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে,

“আ মলো! বলি মরে গেলে তোমাকে সোহাগ করবে কে গা! বুড়ো বয়সে রস তো নেহাত কম নয়! একেবারে চুপচুপ করছে!”

বলতে বলতেই ঘরে ঢুকে টেবিলের ওপর চায়ের কাপটা রাখে মিনতি। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে গেলে সুবীর তার কোমরটা জড়িয়ে ধরে। সঙ্গে সঙ্গে মিনতি বাধা দিতে দিতে বিরক্তির সুরে বলে,

” ছাড়ো তো দিকিনি বাপু। মেলা কাজ পড়ে আছে। চা টা খেয়ে আমাকে উদ্ধার করো। “

বলেই মুখ ঝামটা মেরে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। সুবীর অনেক দিন পর আরাম করে চা খেলেন আজ।

ঘুম থেকে উঠে প্রিয়তোষ দেখেন বিল্টু আর গৌরীর যেন কাজে ঠিক মন নেই। বারে বারে প্রিয়তোষের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। বিল্টু মাঝে মাঝেই অকারণে মুখে একটা বোকা বোকা হাসি টেনে বলছে,

“মা, মাঝের ঘরটা ভালো করে পরিষ্কার করেছিস তো?”

গৌরী একটু যেন অপোক্ত অভিনয় করে বললো,

“দেখেছিস তো অবস্থা। ওগুলো না সরালে পরিষ্কার হবে কী করে?”

প্রিয়তোষ মনে মনে হাসলেন। সত্যিই…. শরীরের বয়স বাড়লেও মনের বয়স সকলেরই বোধহয় একই থাকে। কালকে অতিথিদের আনা উপহার গুলো গৌরি বিল্টুরা দেখতে চাইছে। এ যেন ওদের একটা উৎসব। তাই ওই উপহার গুলো যে ঘরে রাখা আছে সেই ঘরের কথা স্মরণ করাচ্ছে বারেবারে। আস্তে আস্তে বললেন,

বাক্সগুলো খুলে আগে জিনিসগুলো বার কর। তারপর প্যাকেটগুলো ফেলে দে। চল আমিও যাই। দেখি কী কী দিলো সবাই।

সঙ্গে সঙ্গে দুজনের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো আনন্দে। কী নির্মল সেই মুখের অভিব্যক্তি। এই উপহার গুলো তাদের নিজেদের নয়। তবু সেগুলো দেখার আনন্দে চোখে মুখে এই আনন্দ দেখতে বেশ ভালোই লাগে। তবে ওরা জানে ও থেকে অনেক কিছুই ওদের প্রিয়তোষ দেবেন। বিল্টু দৌড়ে সেই ঘরে চলে গেল। গৌরী

“এখুনি করছি দাদাবাবু।”

বলেই হাত থেকে ঝুল ঝাড়ুটা রেখে সেও দৌড়ালো।

সুবীর ভাবতে থাকে একবার প্রিয়তোষকে কি ফোন করবে? আবার পরক্ষণেই ভাবে, না থাক। যদি কিছু সন্দেহ করে। কিন্তু কিছুতেই কাল রাতে থেকে নিজের মনটাকে শান্ত করতে পারছেন না সুবীর। আসলে যেদিন থেকে কাজটা তিনি করবেন বলে ভেবেছেন সেদিন থেকেই মনে উচাটন শুরু হয়েছে। সে যেন থামতেই চায় না।

“মিনতি…। এই মিনতি…। আজ কী রান্না করলি রে?”

নিজের ঘরে বসে বসেই লম্বা একটা হাঁক পাড়লেন।

“ঝিঙে-আলু পোস্তো, ঝিঙে খোসা বাটা আর মুগের ডাল।”

রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে জবাব দিল মিনতি।

“পোস্ত, মুগডাল এইসব খাইয়ে আমাকে মারার প্ল্যান করছিস নাকি রে!”

একটু যেন রসিকতার সুরেই বললেন সুবীর। মিনতি সঙ্গে সঙ্গে হাতে খুন্তি নিয়ে ছুটে এসে ঝাঁঝাঁলো গলায় বললো,

” শালা তিন কাল গিয়ে এক কালে ঠেকেছে, তাও তো এই তিরিশ বছরের মিনতিকে নিয়ে বিছানায় রোজ রমদারমদি না করলে ঘুম হয় না। আর সেই উপরি টাকায় আমার বরের চিকিচ্ছে হচ্ছে। তা বলি তোমাকে মেরে আমার বরটাকে যমের দোরে পাঠাবো নাকি? এত বোকা এই মিনতি নয়, বুঝলে?”

বলেই আবার ধমধম্ করে রান্নাঘরে চলে গেল। সুবীর একটা বাঁকা হাসি হাসলেন। মিনতির পিছনে লাগলে এইভাবে রেগে গিয়ে চারটে গালাগাল দেয়। শুনতে খুব একটা ভালো না লাগলেও এখন এই মুহূর্তে প্রিয়তোষের একটা কোনো ভালো-মন্দ খবর না পাওয়া পর্যন্ত এইভাবে জোর করে হেসে-খুশেই সময় কাটাতে হবে। আজ দোকানে যান নি। চাপা একটা টেনশন কাজ করছে তো। বাবলু দোকান ঠিকঠাক সামলাতে পারছে কি কে জানে। কম্পিউটারে চোখ রাখতে হবে এবার। দোকানের একটা ক্যামেরা যদিও খারাপ হয়েছে, তবু বাকি যে পাঁচটা আছে ওতেই কাজ হয়ে যাবে।

“দেখ মা! কী বড় বাক্স!”

বিল্টু পেল্লাই সাইজের একটা বাক্সর দিকে আঙুল দেখিয়ে গৌরীকে বললো কথাটা। প্রিয়তোষ বললেন,

“যতোটা মনে পড়ছে ওটা আমার বন্ধু সুবীর দত্ত দিয়েছে। কিন্তু এত বড় মাপের বাক্স। কী আছে? কই দেখি খোল তো ওটা।”

প্রিয়তোষ গৌরীর হাতে কাঁচিটা দিতে দিতে বলে,

” সুবীরের অ্যান্টিক শপ রয়েছে। নিশ্চয়ই অ্যান্টিক কিছু একটা দিয়েছে।”

“ওটা মানে কী গো জেঠু?”

বিল্টুর প্রশ্নের উত্তরে প্রিয়তোষ বলেন,

“মানে অতি প্রাচীন বা খুব পুরোনো আসবাব বা অন্য কোনো জিনিস যেখানে বিক্রি হয় তাকে অ্যান্টিক শপ বলে। এই ধর জমিদার আমলের কোনো নকশা করা আয়না বা কাঠের আলমারি বা পালঙ্ক, তারপর ধর কোনো নবাবি আমলে কোনো তলোয়ার, কোনো রাজার আমলে কোনো দেবী মূর্তি। এইসব আর কি! এগুলোর অনেক দাম হয়। লোকজন অনেক দামে কিনে নিয়ে যায় বাড়িতে এইসব জিনিস। “

গৌরী ততক্ষণে খুলে ফেলেছে বাক্সখানা। বাক্স খুলতেই বেরিয়ে এলো একটা প্রমান মাপের দেওয়াল ঘড়ি। অতি সূক্ষ্ম নকশা কাটা চারিদিকে। পুরো ঘড়িটাই কাঠের। মাঝে মাঝে আবার সোনা আর রুপোর পাত বসানো। সে কাঠের পালিশ এতই চকচক করছে যে যেন মনে হচ্ছে সদ্য পালিশ করিয়ে এখনই অনা হয়েছে। গৌরী আর বিল্টু নিজেদের চোখ দুটোকে এতটাই বড় করেছে যেন মনে হচ্ছে কোনো ভূত ফেলেছে। তবে ওদের এই চোখ বড় করার কারণ যে কোনো ভূত ছিল না, বরং ছিল তার থেকেও বেশি সাংঘাতিক তা পরক্ষণেই বুঝতে পারলেন প্রিয়তোষ।

“এ কী গো দাদাবাবু! এতে যে ১৩ লেখা রয়েছে গো! তেরোটা আবার কখনো বাজে নাকি? বারোটার পর তো একটা বাজে!”

গৌরী যে এরকম একটা কথা বলবে তা ভাবতেও পারেন নি প্রিয়তোষ। সাথে সাথে মেঝের ওপর রাখা বিশাল ঘড়িটা এক হাতে টেনে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলেন তিনি। এত ভারী জিনিসটা সুবীর একা একা বয়ে আনলো কী করে কে জানে। চোখটা কুঁচকে গেল প্রিয়তোষের। এমন জিনিস তো বাপের জন্মে কখনো দেখেন নি তিনি। ঘড়ির মধ্যে তেরোর ঘর! মানে মোট তেরো ঘন্টা? এ কী করে সম্ভব? মজা করেছে সুবীর? না না। তা কেন করবে? উপহার দিয়েছে যখন, তখন নেহাত মজা তো করেনি সে। কিন্তু রেলের ঘড়ির মত তেরো চৌদ্দ করে তেইশ পর্যন্ত ঘর থাকলে অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু এ যে তেরোর পরে সোজা এক রয়েছে। মানে এক দিকে ছাব্বিশ ঘন্টা বোঝাচ্ছে?

“আচ্ছা শোন বাকি বাক্স গুলো তাড়াতাড়ি খুলে একদিকে সব রেখে দিয়ে বাক্স গুলো ফেলে দে। আমি একবার আসছি। আর এই ঘড়িটা খাটের ওপর রাখ। মেঝেতে রাখিস না। পা লেগে যদি কিছু ভেঙে টেঙে যায়।”

কী যেন ভেবে পাশের ঘরে চলে গেলেন প্রিয়তোষ। বিল্টু আর গৌরীও ভারী অবাক হয়েছে। কিন্তু খুব বেশি মাথা না ঘামিয়ে ওনার কথামত বাকি বাক্স গুলো খুলতে লাগল লাগলো তারা।

পাশের ঘরে এসে সুবীরকে একটা ফোন করলেন প্রিয়তোষ। বেশ খানিকক্ষণ রিং হবার পর ওপার থেকে কাঁপা কাঁপা স্বর শোনা গেল সুবীরের।

“হ্যালো!”

“প্রিয়তোষ বলছি রে। বিরক্ত করলাম?”

‘প্রিয়তোষ’ নামটা শোনামাত্র বুকের ভিতরে একটা ঢং করে ঘন্টাধ্বনি হল। এতক্ষণ তো প্রিয়তোষের-ই অপেক্ষা করছিলেন সুবীর। হয় তার ফোন আসবে, নয়তো সে নিজে তার বাড়িতে আসবে।

“হ্যাঁ ভাই বল। সকাল সকাল একেবারে বন্ধুর কথা মনে পড়ে গেল?

নিজের উত্তেজনাকে যারপরনাই প্রশমিত করে বললেন সুবীর। ওপার থেকে যান্ত্রিক আওয়াজ ভেসে এলো প্রিয়তোষের।

” তুই একটা অ্যান্টিক ঘড়ি গিফট্ করেছিস তাই না? “

” হ্যাঁ রে। কেন পছন্দ হয়নি? “

” পছন্দ হওয়া না হওয়া নয়। ওতে তেরো লেখা রয়েছে। মানে ঘড়িতে তেরোটা বাজবে…। ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না…। তাই জানতে চাইছি ।”

“আরে ওটা পেয়েছিলাম রাজস্থানের রাজপুত রাজা যশোবন্ত সিং এর বংশধর অর্জুন সিং-এর কাছ থেকে। উনি এখন থাকেন দুবাইতে। শিলিগুড়িতে ওনার নিজস্ব বাড়ি আছে। কলকাতায় ব্যবসার কাজে এসেছিলেন। তখন ওনার পূর্বপুরুষের এই পেল্লাই মাপের ঘড়িটা আমার দোকানে বিক্রি করে দিয়ে যান। তবে খুবই নগন্য মূল্য দাবি করেন। মাত্র হাজার টাকায় কিনেছিলাম এটা ওনার থেকে। “

কী নিপুণ দক্ষতায় এতগুলো মিথ্যা কথা সাজিয়ে গুছিয়ে ঝরঝর করে বলে দিলেন সুবীর। এইভাবে মিথ্যা কথা ঝরঝর করে এর আগে আরো একবার বলেছিলেন। তার ফল হয়েছিল মারাত্মক। যদিও সেই ঘটনা আজকের এই ঘটনার সাথে প্রত্যক্ষ নাকি পরোক্ষ ভাবে জড়িত তা আপনারাই বিচার করবেন।

” সে না হয় বুঝলাম। কিন্তু এই ঘড়ি দেখে সময় মেলাতে গেলে তো সব কিছু গণ্ডগোল হয়ে যাবে। বারোটার পর তেরোটা বাজা মানে সাধারণ ঘড়ির একটা বাজার সমান। বিল্টু গৌরী সময় নির্ঘাত গণ্ডগোল করে সব কাজে এক ঘন্টা দেরি করে দেবে যে….”

বলেই হোহোহো করে হেসে ওঠেন প্রিয়তোষ। সুবীরও তালে তাল মেলাতে একটু যেন মেকি হাসি হাসার চেষ্টা করলেন বটে, তবে তাঁর মনে একটাই ভয়, যদি প্রিয়তোষ জিনিসটা ফেরত নেওয়ার কথা বলে তখন কী করবেন তিনি?

” কী ভাই চুপ করে গেলি কেন? “

প্রিয়তোষের কথায় চমক ভাঙল।

” একটু কানেকশন প্রবলেম হচ্ছে ভাই।”

আবার একটা মিথ্যে।

“শুনতে পাচ্ছিস এবার?”

“হ্যাঁ শুনতে পাচ্ছি বল।”

“বলছি ঘড়িতে ওই তেরোর ঘরটা কি এমনিই ফলস্ বানানো হয়েছে? মানে লোকজনের দৃষ্টি আকর্ষন করার জন্য তো রাজা মহারাজাদের উটকো উটকো সব শখ ছিল। সেইরকম কিছু নাকি রে? “

এবার পড়লেন মহা বিপদে। সুবীর কী উত্তর দেবেন! এত ফলস্ নয়। ওই তেরোর ঘর মানুষকে তাঁর নিদারুন সত্যের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়। সেটা ফলস্ কিভাবে হতে পারে? বললেন,

“আমি ঠিক জানি না রে। শুধু দেখলাম ঘড়িটা চলছে। অর্জুন সিং বলেছিলেন তাঁর দাদু যশোবন্ত সিং আমেরিকায় এক ব্যারিস্টারের বাড়ি আমন্ত্রণ পেয়ে গেছিলেন। সেই ব্যারিস্টার কোন এক সায়েন্টিস্টকে দিয়ে এ ঘড়ি বিশেষ ভাবে তৈরি করিয়েছিলেন যশোবন্ত সিংকে উপহার দেবার জন্য। এতই উন্নত সব যন্ত্রপাতি এতে রয়েছে যে সেই বিজ্ঞানী বলেছিলেন এ জিনিস প্রায় হাজার হাজার বছর সঠিক সময় দেখানোর ক্ষমতা রাখে। দেখেছিস না কেমন নতুনের মত একেবারে ঝকঝক করছে! আমি নিজেই ওটা রাখতাম। ওই নমিতা ঝাড়াঝাড়ি করতে গিয়ে ফেলে ভেঙে দিলে কী হবে বল! তাই ওটা তোর কাছে থাক। গৌরী খুব সাবধানি। ও ঠিক রাখবে। “

” তবে একটা জিনিস বুঝতে পারছি না তোর ওই অর্জুন সিং কেনো বিক্রি করে দিল এটা? বংশের ঐতিহ্য বলে কথা!”

” সে বউকে সঙ্গে নিয়ে দুবাইতে থাকে। মা বাবা কেউ নেই। এত দামী একটা জিনিস ঘরে এমনি এমনি রাখতে চায়নি। আবার অন্য দেশেও নিয়ে যেতে চায়নি। নিজের দেশের মধ্যেই রাখতে চেয়েছিল। তাই আমার কাছে বিক্রি করে। কারণ আমার থেকে যারা জিনিস কেনে তারা তো সেগুলো ভেঙে ছড়িয়ে নষ্ট করার জন্য কেনে না! জানে সুরক্ষিত থাকবে।”

ব্যাংক ম্যানেজারের পদ থেকে অবসর নিলেও জেরা করার অভ্যাসটা একেবারে রক্তে মিশে গেছে প্রিয়তোষের। সুবীর ভাবছিলেন কতক্ষণে ফোনটা রাখবেন প্রিয়তোষ। সুবীরকে খুশি করে নিজের তিনি বললেন,

” ও আচ্ছা বুঝলাম। ঘড়িটা ব্যবহার করব। তুই যে অ্যান্টিক কিছুই উপহার দিবি সে আমি জানতাম। তবে এমন চমকে দেওয়া উপহার দিবি ভাবিনি। খুব খুশি হয়েছি রে। ব্যবহার করব। সময় পেলে আসিস। কথা হবে।”

ফোন কেটে দিলেন প্রিয়তোষ। পাশের ঘরে পুনরায় ফেরত এসে দেখলেন গৌরী সব প্যাকিং বাক্সগুলো একধারে ডাঁই করে রেখেছে। আর বিল্টু উপহার গুলো সব উল্টে পাল্টে দেখছে। তিনি বললেন,

” গৌরী, বেলা হল অনেক। ঘরটা পরিষ্কার করে রান্নাঘরে যা এবার। আমি ও থেকে বেছে বেছে কয়েকটা তোদের দেবো। এখন ওসব থাক। এক ধারে রেখে দে।”

গৌরী কথামত কাজ করে বেরিয়ে গেল। বিল্টুও পিছন পিছন তার মায়ের সঙ্গে রান্নাঘরে চলে গেল। প্রিয়তোষ ঘড়ির পিছন দিকে চাবি ঘুরিয়ে দম্ দিলেন। টাইম সেট করলেন। এখন বাজে ৯টা কুড়ি। ঘড়ির কাঁটা ঘুরতে শুরু করলো। দেওয়ালে লাগানো হুকে ঝুলিয়ে দিলেন ঘড়িটা। পেন্ডুলাম দুলিয়ে সে নিজের মত চলতে শুরু করলো টিক টিক টিক টিক।

সুবীর যেন একটু বেশিই চিন্তায় ডুবে যাচ্ছিলেন ধীরে ধীরে। মিনতির হাত থেকে বুঝি খুন্তিটা মেঝেতে পড়ল ঠং করে। সেই আওয়াজ ঘোর কাটলো। ল্যাপটপ খুলে বসলেন। দোকানে বাবলু কী করছে দেখতে হবে তাঁকে। কিন্তু বেশিক্ষণ কম্পিউটার স্ক্রিনে মনোনিবেশ করতে পারলেন না। কোথাও যেন একটা অপরাধ বোধ কুরে কুরে খেতে শুরু করেছে তাঁকে। নিজেকে বিপদ থেকে বাঁচাতে ছোটোবেলার বন্ধুকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে কি সে ভালো করলো? কে জানে!

প্রিয়তোষ বারোটার মধ্যে দুপুরের খাবার খেয়ে নেন। নিজের শরীরের খেয়াল একটু বেশিই রাখেন। ডিউটি আওয়ার্সের ফাঁকে পরমা ফোন করে খোঁজ নিত খেয়েছি কিনা। পরমা চলে যাবার পর সে খোঁজ নেবার আর কেউ নেই। রিটায়ারমেন্টের পর এই গৌরী আর বিল্টুই তাঁর একমাত্র নির্ভরস্থল। সুবীরই খোঁজ দিয়েছিল এদের। রেল লাইনের নিচে বস্তিতে থাকলেও ওদের ব্যবহার আচার বড় মার্জিত। ডঃ যখন প্রথম বললেন পরমা কোনোদিনও মা হতে পারবে না, তখন থেকেই সন্তান স্নেহ কী জিনিস সেই অনুভূতির স্বাদ কেমন তা জানার সৌভাগ্য হারিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এই শেষ বয়সে বিল্টুকে দেখার পর মনের কোণের সেই স্নেহমাখা নরম অংশটা যেন নড়ে চড়ে বসেছে। বাচ্চাটা সর্বক্ষণ মায়ের আঁচল ধরে ঘোরে। পড়াশোনা করে না। প্রিয়তোষ ভাবছেন ওকে স্কুলে পাঠাবেন। নিজে বসে ওকে লেখাপড়া দেখাবেন তিনি। এতে যে গৌরীর বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই সে খবর তিনি এক সপ্তা আগেই জেনেছেন।

“দাদাবাবু, খাবার হয়ে গেছে। খেতে দেব?”

গৌরীর কথায় চমক ভাঙল।

“হ্যাঁ দে। তোরা তোদের খাবারটা নিয়ে চলে যা। বিকেলে ঠিক সময়ে চলে আসিস। সন্ধে দিতে হবে। মাথায় থাকে যেন।”

স্বামী বাইরে বাইরে যেহেতু কাজ করতেন সেহেতু পরমা সারা জীবন পুজো আচ্ছায় নিজেকে একেবারে সোঁপে দিয়েছিলেন। প্রিয়তোষ এত বছর পর এ বাড়িতে পা দিয়ে পরমার ইচ্ছের বিরোধিতা করতে চান না। পুজো করা, সন্ধে দেওয়া এই ঐতিহ্যগুলোর মধ্যেই বেঁচে থাকুক পরমা। প্রিয়তোষের খাওয়া হলে গৌরী বাসন মেঝে নিজেদের খাবার নিয়ে চলে যায়। দুপুর পৌনে একটা। আর সেই অ্যান্টিক ঘড়ির কাঁটা বলছে এখন পৌনে তেরোটা। প্রিয়তোষ বিছানায় বসে শেক্সপিয়রের একটি নভেল নিয়ে ডুবে যান তাতে।

ক্রমশ……



২য় পর্ব:

সুবীর সারা ঘর উদ্ভ্রান্তের মত পায়চারি শুরু করেছেন দেখে মিনতি বললো,

“আ মল! বলি ভিমরতি ধরলো নাকি? ঘরের এ মাথা ও মাথা করছো কেন?”

“বিরক্ত করিস নি। যা এখন। দুটোর সময়ে খেতে দিবি। যা।”

একটু যেন কড়া ধমকের সুরেই বললেন কথা গুলো। মিনতি এমন ব্যবহার আশা করেনি। সে এক প্রকার মুখ ঝামটা দিয়ে সরে গেল সেখান থেকে। সুবীরের মাথায় শুধু প্রিয়তোষের কথা ঘুরতে থাকে। সে কী করছে, কেমন আছে, এইসব। সুবীর নিজে ধরা পড়ে যাবে না তো প্রিয়তোষের কাছে!



প্রিয়তোষ পড়তে পড়তে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছেন। বাড়িতে তিনি এখনো একা। গৌরীরা চলে গেছে অনেক আগেই। চাকুরী জীবনের শেষে এই প্রথম শান্তিতে ভাত ঘুম দিচ্ছেন অনেক দিন পর। ঘরের দেয়ালে ঝোলানো ঘড়িটাতে ঢং ঢং করে তেরোবার ঘন্টা বাজলো। তেরোটা…. । প্রিয়তোষ জানেন না যে এই মুহূর্তটা হল বারোটা আর একটার মাঝে ক্ষুদ্র একটা চুল ঘেরা ফাঁক। যে এই ঘড়িতে দম দিয়ে চালাতে শুরু করে তার জীবনের সব কিছু পাল্টে যেতে থাকে এই সময়ে। সে বর্তমান থেকে পাড়ি জমায় অতীতে। একটা মাত্র ঘন্টা সে সুযোগ পায় অতীতের ভুল গুলো শুধরে নেওয়ার। কিন্তু সে জানবে কী করে এত রহস্য? হা হা হা হা হা হা…..। সেটাই তো সব থেকে বড় রহস্য।

একটা বেশ ভারি কোনো জিনিসের অতিরিক্ত ঘর্ষনের আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে যায় প্রিয়তোষের। নিজেকে আবিষ্কার করেন পুরোনো একতলা বাড়িতে, যেখানে পরমাকে বিয়ে করে প্রথম এনেছিলেন। এ কী! এ কী করে সম্ভব! তিনি তো ঘুমাচ্ছিলেন নিজের দোতলা বাড়ির বিছানায়। শেক্সপিয়রের একটা নভেল হাতে ধরা ছিল। কিন্তু সেইসব কোথায়? ঘর্ষনের আওয়াজটা থেকে থেকে বেড়েই চলেছে। ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলেন পায়ে পায়ে। দেখলেন তাঁর স্ত্রী পরমা শিলে বাটনা বাটছেন আর মা উঠোনে বড়ি রোদে দিচ্ছেন। এ কী! পরমা তো সেই কবেই মারা গেছে! আর মা তো তারও অনেক আগে! পরমাকে এত অল্প বয়সী সুন্দরী দেখতে লাগছে কীভাবে? আর মায়েরও তো কই কোমর ভাঙেনি! কী হচ্ছে এইসব তাঁর সাথে! চোখের সামনে মা, পরমা, দেয়াল, চেয়ার, টেবিল, উঠোন সব কেমন যেন গোল গোল পাক খেয়ে ঘুরতে লাগলো একসাথে। সেগুলো ঘুরতে ঘুরতে যেন একটু বিন্দুতে মিলিত হচ্ছে। মনে হচ্ছে এখুনি তার ভিতর প্রিযতোষ ঢুকে যাবে এত বেশি সেই বিন্দুটির আকর্ষণ! সঙ্গে সঙ্গে মাথা ঘুরে দড়াম্ করে মেঝের ওপর পড়ে গেলেন প্রিয়তোষ।

প্রিযতোষ চোখ খুলে দেখতে পেলেন তাঁর মুখের ওপর গৌরী ঝুঁকে পড়েছে। বিল্টু তার পাশেই হাতে জলের বোতল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রিযতোষ ধীরে ধীরে উঠে বসলেন। নিজেকে একতলার বারান্দায় আবিষ্কার করে বিস্মিত হলেন তিনি।

“কী হয়েছিল দাদা বাবু? আপনি এই ভর সন্ধেবেলা একতলায় কী করছিলেন? মাথা ঘুরে পড়ে গেছিলেন?”

প্রিয়তোষ কোনো কথার উত্তর দিতে পারলেন না। শুধু অবাক চোখে চারিদিকে তাকাতে লাগলেন আর ভাবতে লাগলেন তিনি তো দোতলার বিছানায় শুয়েছিলেন। স্বপ্নে দেখেছিলেন যে একতলায় দাঁড়িয়ে আছেন! কিন্তু ঘুম ভাঙার পর সেটা সত্যি কিভাবে হয়ে গেল! কিছুতেই হিসেব মেলাতে পারেন না প্রিয়তোষ। গৌরী যদি জানতে পারে যে উনি কিভাবে ওপর থেকে নিচে নেমে এসেছেন জানেন না, বা স্বপ্নে দেখেছিলেন এখানে দাঁড়িয়ে থেকে মাথা ঘুরে পড়ে গেছিলেন, এইসবে বিশ্বাস করবে কি করবে না তার থেকেও বড় কথা হলো ওরা দুজনে ভয় পেয়ে একেবারে হুলুস্থূল কান্ড বাঁধাবে। তাই যতোটা সম্ভব নিজেকে সংযত করে প্রিয়তোষ বললেন,

“এই নিচের ঘরে একটা বই নিতে নেমেছিলাম। মাথাটা হঠাৎ ঘুরে গেল।”

আস্তে আস্তে গৌরীর কাঁধে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে আসেন প্রিয়তোষ। মাথার পিছনে বেশ সজোরে লেগেছিল বোধহয়। একটু যেন ব্যথা ব্যথা করছে। শাঁখ বাজানোর আওয়াজ কানে যেতে সম্বিত ফিরল তাঁর? সন্ধে হয়ে গেছে? তিনি তো সেই খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়েছিলেন একটা নাগাদ। তারমানে চার পাঁচ ঘণ্টা এইভাবে মেঝেতে সে পড়েছিলেন? ভেবেই শিহরিত হলেন প্রিয়তোষ।

“বাবা, আমার তো দেখেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেছিল। ভালো মন্দ কত কিছু যে ভাবছিলাম! কেন যে আপনি নিচে নামেন? আমাকে বলতে পারতেন, আমি সকালে বাড়ি যাওয়ার সময়ে বইপত্র সব বের করে রেখে যেতাম!”

গৌরী যে বেশ ভালো রকম ভয় পেয়েছে তা ওর কথার ধরনেই ভালো বোঝা যাচ্ছে। বিছানার চাদর টা ঠিক করতে করতে বললো,

” আপনি একটু রয়ে সয়ে আমাকে গায়ের জামা গুলো দিয়ে দেবেন, কেচে দেব। মেঝের ওপর পড়ে ছিলেন ওই জামা পরে। ওগুলো আর পরতে হবে না।”

” আয় আমার কাছে আয়। “

গৌরীর কথায় সম্মতি জানিয়ে বিল্টুকে নিজের কাছে ডাকলেন। সে তার মায়ের আঁচল ধরে অনেকক্ষণ থেকে দাঁড়িয়ে আছে প্রিযতোষের দিকে চেয়ে। বিল্টু ওঁর সামনে যেতে ধীরে ধীরে বললেন,

” লেখাপড়া করবি? স্কুলে ভর্তি করে দেব। “

বিল্টুকে কিছুমাত্র উত্তর দেবার অবকাশ না দিয়ে গৌরী জানালার পর্দা গুলো টেনে দিতে দিতে বললো,

“এখন ওসব থাক। আপনি জিরোন তো। এইসব নিয়ে পরে কথা হবে।”

কথাটা বলেই বিল্টুর হাত ধরে বেরিয়ে যেতে যাচ্ছিল গৌরী। প্রিয়তোষ তাকে কোনো রকমে বাধা দিয়ে বললেন,

” আরে শোন। বিল্টু আমার কাছে থাক। গল্প করি খানিক।”

গৌরী যে এই কথায় খুব একটা খুশি হয়নি তা তার মুখ চোখের ধরন দেখেই বোঝা গেল। তবু দাদা বাবুর কথায় ছেলেকে সেখানে রেখেই চলে গেল ঠাকুরঘরে। সন্ধে দিতে হবে তো।

সুবীর ভাবছিলেন একবার প্রিয়তোষকে ফোন করবেন। কিন্তু কী মুখে করবেন! ওই ঘড়ি উপহার দিয়ে তাকে যে বিপদের মুখে ফেলেছেন তার তো কোনো ক্ষমা নেই। একমাত্র যদি…….. । নাহ্….। ফোনটা করাই যাক।

দু বার রিং হবার পরেই ফোন তুললেন প্রিয়তোষ।

“হ্যালো সুবীর। বল…।”

খানিক থেমে সুবীর প্রশ্ন করলেন,

“কী করছিস রে! বই পড়ছিস নাকি?”

“না ভাই। এই বিল্টুর সাথে গল্প করছি। তুই কি দোকানে?”

সুবীর বেশ অবাক হলেন। কী ব্যাপার! ওর সাথে কি কিছুই ঘটেনি? এত স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছে? সুস্থ আছে তো? কিছু

“তুই কি সুস্থ আছিস? “

এমন কথা কি কাউকে জিজ্ঞাসা করা যায়? তাই কথাটা ঘুরিয়ে বললেন,

” না ভাই দোকান যাইনি আজ। ভাবলাম তোকে ফোন করে ডেকে নিই। ফ্রি থাকলে আসতে পারিস। বোর হচ্ছি।”

“না রে। আজ যাব না। শরীর বিশেষ ভাল নেই। মাথা ঘুরে পড়ে গেছিলাম। গৌরী এসে তুলেছে। ও এখন আমাকে কোথাও বেরোতে দেবে না। কড়া নজরে রাখছে। পাকা মেয়ে একটা…. ।হা হা হা হা।”

এতক্ষণ যে কথাটা শুনতে চাইছিলেন ঠিক সেই কথাটাই জানতে পারলেন সুবীর। তার মানে ওই অভিশপ্ত ঘড়ি তার খেল দেখাতে শুরু করে দিয়েছে। এবারে একটু খোলসা করে তো না জানলেই নয় যে ঠিক কী ঘটেছিল! তাই বেশ উদ্বিগ্ন স্বরে সুবীর প্রশ্ন করলেন,

” সে কি রে! কি করে? মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার ব্যামো আবার কবে থেকে ধরলো তোকে?”

একসাথে একটু বেশিই প্রশ্ন করে ফেলেছেন বুঝতে পেরে তৎক্ষণাৎ চুপ করে গেলেন সুবীর।

“আরে সেইরকম কিছু নয়। ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বই পড়তে পড়তে। তারপর……. ।”

কী একটা ভেবে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে প্রিয়তোষ বললেন,

” ছাড় তো। আমিও যেমন…! কি সব বলে চলেছি। আচ্ছা শোন বিল্টুবাবু এখানে এবার বোর হচ্ছে। ওকে গল্পটা বলে শেষ করি। তোর সাথে পরে আবার কথা হবে বুঝলি? “

ফোন রেখে দিলেন প্রিয়তোষ। সুবীর মুখ দিয়ে একটা বিরক্তিসূচক শব্দ করলেন। ইশ্…। শোনা হলো না বাকিটা। কিন্তু যেভাবেই হোক তাকে জানতেই হবে।

গৌরী বাসন মেজে ঘর মুছে বাড়ি যাবার সময়ে পইপই করে বলে গেল,

” একদম নিচে নামবেন না। বাথরুমে সাবধানে যাবেন। আমি রাতের দিকে একবার ফোন করে খোঁজ নেব।”

প্রিয়তোষ হেসে বলেন,

“ঠিক আছে রে মা। খোঁজ নিবি। তোরা যা। রাত হয়ে গেল।”

গৌরী চলে গেলে প্রিয়তোষ ভাবেন এই গৌরী না থাকলে যে তাঁর কি হতো কে জানে। নিজের সন্তানের মতো আগলে রেখেছে প্রিযতোষকে।

প্রিয়তোষ মনে মনে ভাবলেন, এমন কথা পরমা বলত। কত সাবধানে রাখত সে প্রিয়তোষকে। গৌরীর কথা শুনে পরমার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। ঘড়িতে ঢং ঢং করে ন’টা বাজলো। এতক্ষণ প্রিয়তোষ খেয়াল করেন নি দেয়াল ঘড়ির সাথে শোকেসে রাখা লাফিং বুদ্ধার পেটের মধ্যে রাখা ঘড়িতেও ন’ টা বাজে। এটা কিভাবে সম্ভব। এই ঘড়ির তো এক ঘন্টা স্লো চলার কথা। কারণ তেরোটার ঘর আছে। তবে কি ওটা ফলস্? তাই হয়তো হবে। ব্যাপারটা নিয়ে আর মাথা ঘামালেন না প্রিয়তোষ।

” কী হলো কী? আজকে এমন নেতিয়ে আছো কেন? কী হয়েছে বলো দেখি? “

নমিতা, সুবীরের তলায় পৃষ্ট হতে হতে ঝাঁঝালো গলায় বলে।

সুবীর নিজের কাজ সারতে সারতে হাঁফাতে হাঁফাতে উত্তর দিল,

“অনেক চিন্তা আছে রে মাথায়! তোর মত নাকি! যে কাপড় তুলে দাঁড়িয়ে পরবো, উপরি টাকা নিয়ে চলে যাব! “

কথাটা শোনা মাত্র নমিতা রেগে গিয়ে এক ঝটকা মেরে সরাতে যায় সুবীরকে। কিন্তু সুবীর নমিতার অভিসন্ধি বুঝে হিংস্র জন্তুর মত গোঁ গোঁ করে তার চুলের মুঠি ধরে পা দুটোকে আটকে রাখে প্রবল আক্রোশে। হাঁফাতে হাঁফাতে বলে,

” উঠিস না। আর একটু….। “

তৃপ্তির শেষ বিন্দুতে এসে এক সময়ে সুবীর ছেড়ে দেয় নমিতাকে। নমিতা শাড়ি ঠিক করতে করতে বলে,

“কিসের এত চিন্তা গো তোমার? তা শুনি কী আবার হল?”

সুবীর একটা সিগারেট ধরিয়ে ঝাঁঝালো স্বরে বলে,

“তোকে অত জানতে হবে না। যা নিজের কাজে যা। আর শোন গায়ে ভালো করে সাবান মাখবি। শালা বোঁটকা গন্ধ গায়ে। এখন যাহ্।”

নমিতা অনেক কিছু বলার জন্য মুখ খুলেও আবার মুখটা বন্ধ করে নিল। শুধু একটা বিকৃত ভঙ্গি করে বেরিয়ে গেল বাইরে।

রাত এগারোটা। নভেলের বাকি অংশটুকু শেষ হল এতক্ষণে। এবার না ঘুমলে আবার ভুলভাল স্বপ্ন দেখে তাহলে ঘুমের মধ্যেই হাঁটতে থাকবেন প্রিয়তোষ। এসির ফ্যান স্পিড টা বাড়িয়ে দিয়ে গায়ে একটা পাতলা চাদর চাপিয়ে শুয়ে পড়লেন। ঘুমটা ভেঙে গেল। বাথরুমে যেতে হবে একবার। হাত বাড়িয়ে বেড সুইচ অন করে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন বারোটা পঞ্চান্ন। মানে সাধারণ সময় একটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি হলেও দেয়াল ঘড়ি জানান দিচ্ছে,

“না….. । এখন তেরোটা বাজতে আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি…..।”

প্রিয়তোষের মাথায় এক ছেলেমানুষি খেলে গেল। ভালোই হলো এমন সময়ে ঘুম ভেঙ্গে গিয়ে। এবার দেখতে পাবেন দেয়াল ঘড়ির ওই তেরোর ঘরটা সত্যি নাকি ফলস্। নিজের এই ছেলেমানুষির কথা চিন্তা করে নিজেই একটু হেসে নিলেন। নিজেকে নিজেই বললেন, ওটা ফলস্ই হবে। কারণ অন্যান্য ঘড়ির সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে এই ঘড়িও সঠিক টাইমই দেয়। তাও! রাত বিরেতে ঘুম ভেঙ্গে একটু নিজের সাথেই নিজের খেলা করতে ইচ্ছে করলো প্রিযতোষের। তাড়াতাড়ি উঠে বাথরুমে গিয়ে কাজ সেরে ফিরে এলেন বিছানায়। গৌরী যে তাঁকে সাবধানে বাথরুমে যেতে বলেছিল সে কথা বেমালুম ভুলে গেলেন তিনি। বোতল থেকে দু ঘোঁট জল খেয়ে বোতলটা টেবিলে রাখতে যাবেন এমন সময়ে ঘড়ির পেন্ডুলাম মাথা দুলিয়ে ঢং ঢং করে তেরো বার ঘন্টা বাজিয়ে এক সময়ে শান্ত হল। এখন পুরো তেরোটা বাজে। সঙ্গে সঙ্গে প্রিযতোষের চারপাশে ঘটলো এক অদ্ভূত পরিবর্তন। দেয়াল, আলমারি, বিছানা, টেবিল, শোকেস, জানালা, দরজা সব কিছু গোল গোল পাক খেতে শুরু করেছে চোখের সামনে ঠিক সকাল বেলার মত। জানালার বাইরের কুকুরের চিৎকারটাও আর শোনা যাচ্ছে না। একেবারে নিস্তব্ধ চারিদিক। শুধু সামনের ঘুর্ণায়মান দৃশ্যের ঘুর্ণনের বেগ যতো বাড়তে থাকে তত এক ধরণের যান্ত্রিক আওয়াজ কানে যেন তালা লাগিয়ে দিতে থাকে প্রিযতোষের। পাখা, এক্সহস্ট ফ্যান বা টেবিল ফ্যান বা ওয়াশিং মেশিন যখন ঘুরতে শুরু করে তখন যেমন একটা যান্ত্রিক ঘূর্ণনের তীব্র একটা শব্দ কানে আসে ঠিক সেইরকম শব্দটা। সেই দৃশ্য বেশিক্ষণ সহ্য করতে না পেরে আবার বিছানার ওপরই শুয়ে পড়লেন প্রিয়তোষ।

ঘুম ভাঙল ওনার স্ত্রী পরমার ডাকে।

“কি গো…। শুনছো? আর কতক্ষণ ঘুমাবে বলতো? ওঠো ওঠো।”

প্রিয়তোষ বিছানায় উঠে বসে পুনরায় অবাক হয়ে যান পরমাকে এত অল্প বয়সী সুন্দরী দেখে। সে ভিজে চুল মুছতে মুছতে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ডাকছিল প্রিযতোষকে। বিছানার বাড়ে লাগানো আয়নায় নিজেকে দেখে চমকে ওঠে, এ কী? এ কী প্রিয়তোষ নাকি সেই আঠাশ-তিরিশ বছর বয়সী পরমার সেই প্রিয় আর মায়ের “পুপু”? চুলের রং ঘন কালো। গায়ের মুখের চামড়া একেবারে টানটান। চেহারায় বয়সের ছাপ হঠাৎ করেই উধাও হয়ে গেছে যেন। ওঁকে উঠে বসতে দেখে পরমা বলে,

“মা তোমার ছোটো বেলার অনেক গুলো পুরোনো জামা খুঁজে পেয়েছে জানো? সেগুলো দেখাবে বলে তোমাকে ডাকছে সিঁড়ির ঘরে। যাও তাড়াতাড়ি।”

চকিতে মনে পড়ে যায় পুরোনো কিছু আধ ভাঙা স্মৃতি। এই ঘটনাটা সে জানে। পরমা সেদিন এই শাড়িটাই পরেছিল সেদিন। মা যেদিন ছোটোবেলার জামা কাপড় খেলনা আর বইপত্র-র ট্রাঙ্কটা খুলেছিল সেদিনই তো…. । হ্যা….। সেদিনই তো মা সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে….। আর কিছু ভাবতে পারেন না প্রিয়তোষ। বিছানা থেকে নামতে যাবেন এমন সময়ে সিঁড়ি দিয়ে ওনার মা নির্মলা দেবীর নিচে নেমে আসার শব্দ হল,

“পুপু তোকে কখন থেকে ডাকছি। কত জিনিস বের করেছি দেখাব বলে। বউমা বলেনি নাকি রে!”

প্রিয়তোষ দৌড়ে বেরিয়ে যান বাইরে। “মা…..নেমো না, দাঁড়াও…. ।” বলেই তরতরিয়ে উঠতে থাকেন সিঁড়ি দিয়ে।

“কেন রে কী হলো?”

কথাটা বলতে বলতেই একটা পা পিছলে টাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়েন একেবারে ছেলের বুকের ওপর। ভাগ্যিস প্রিয়তোষ ততক্ষণে সামনে এসে পড়েছিলেন, তাই মা কে ধরে নিতে পেরেছিলেন। নাহলে আজ কী যে হতো!

নিজের মায়ের মুখটা এক ঝলক দেখেছিলেন তিনি। ভীষণ রকম হতচকিত ও অবাক দৃষ্টিতে ছেলের বুকের ওপর পড়ে ছেলের মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে শুধু বললেন,

“তুই জানলি কী করে বাবা যে আমি পড়ে যাবো?”

ব্যাস্…. । সঙ্গে সঙ্গে মায়ের মুখ, সিঁড়ি, রেলিং, বারান্দা সব কিছু গোল হয়ে পাক খেতে খেতে একটা বিন্দুতে গিয়ে মিলিয়ে যায়। প্রিয়তোষ চোখের সামনে সব কিছু ঘোলাটে দেখেন। চারিদিকে সমস্ত রকম আসবাবের রং মিলেমিশে কেমন যেন একটা রামধনু রং সৃষ্টি করেছে চারপাশে। শরীরটা পালকের মত হালকা হয়ে এল।

ঘুম যখন ভাঙল তখন প্রিয়তোষ দেখলেন বিছানায় শুয়ে আছেন, কেমন যেন এঁকে বেঁকে। এইভাবে বালিশে মাথা না দিয়ে এসির দিকে সরাসরি মাথা দিয়ে উনি তো কখনো ঘুমোন না। চকিতে মনে পড়ে গেল কিছুক্ষণ আগের ঘটনা। চারিদিকে একবার তাকালেন। নাহ্। সব কিছু তো ঠিকই আছে। হঠাৎ চোখ চলে গেল দেয়ালে আটকানো নির্মলা দেবীর ছবিটার দিকে। এ কী…..! এটা কিভাবে সম্ভব? অতি বৃদ্ধা নির্মলাদেবী দিব্যি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বাড়ির পাশের ফুলবাগানে ফটো তুলেছেন! কিন্তু তাঁর কোমর যে সেই কোন কালে যখন সবে সবে প্রিয়তোষ বিয়ে করেছিলেন তখনই সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে……। মনে পড়ে যায় কিছুক্ষণ আগে চোখের সামনে ঘটে যাওয়া দৃশ্য। চারিদিকে সব কিছু ঘুরছিল। মা সিঁড়ি থেকে নামার সময়ে পা পিছলে গেল। ও…… । প্রিয়তোষ তো পড়ে যেতে দেন নি তাঁর মা কে। ধরে নিয়েছিলেন। তাই কোমর ভাঙ্গারও কোনো প্রশ্নই ওঠে না। দেয়াল ঘড়িতে ঢং করে একটা বাজলো। সব মনে পড়ছে প্রিযতোষের। সকালে একতলায় পড়ে থাকা। এখন বিছানায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাওয়া। এ সব কিছুর সঙ্গে এই দেয়াল ঘড়ির খুব গভীর যোগ রয়েছে। কারণ তেরোটার ঘন্টা পড়ার পরই এই অস্বাভাবিক ব্যাপারটা ঘটলো তাঁর সঙ্গে। তবে কি ওই তেরো নম্বর ঘরের কোনো বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে! সে কি অতীতে ফিরিয়ে দেয় মানুষকে। তার নিজের ভুল গুলো শুধরে নেবার আরেকটা সুযোগ করে দেয়? তাই আজ তাঁর মায়ের এরকম দু পায়ে দাঁড়ানো ছবি দেয়ালে টাঙানো দেখতে পাচ্ছেন! প্রশ্ন অনেক। কিন্তু উত্তর একটাই। এই তেরো ঘর ওয়ালা ঘড়ি অতীতে ফিরিয়ে দেয় মানুষকে তার ভুল শুধরানোর. জন্য।

সুবীর অনেক ক্ষণ কোনো কথা বলতে পারলেন না। সামনে রাখা চায়ের কাপটা হাতে তুলে নিতেও এখন লজ্জা লাগছে তাঁর। কী বলা উচিত আর কী বলা উচিত নয় তা সঠিক অনুধাবন করতে না পেরে একেবারে পাথরের মূর্তির মতো চুপ করে রইলেন।

“কি রে, বল কিছু! তুই জানতিস না?”

চমক ভাঙলো প্রিয়তোষের কথায়।

“না রে। তোকে তো বলেছিলাম। আমি কখন ঘড়িটাতে দম্ দিয়ে দেখিনি। আর এ ঘড়ি যখন অর্জুন সিং বিক্রি করতে আসেন তখন আমি দুপুরে খেতে গেছিলাম বাড়িতে। বাবলু ছিল দোকানে। ও নিজেই কথাবার্তা বলে কিনে নিয়েছিল। এই দিন চারেক হবে ওটা আমার দোকানে এসেছিল। তারপরই তুই নিমন্ত্রণ করলি। আমি ওটা উপহার দিলাম তোকে। তেরোটা বাজলে যে ঠিক কি হয় তা বাবলু জিজ্ঞেস করেনি অর্জুন সিংকে। অর্জুন সিং-ও এইসব বলে নি। সব জাত ব্যবসায়ী বুঝলি কি না! সত্যি বললে যদি না কিনি, তাই চেপে গেছিল হয়তো। আমি নিজেও জানি না ওটা আদৌ চলে কিনা। আমি তো এমনি তোর ড্রইং রুমে এরকম একটা সোনা-রুপোর পাত বসানো ঘড়ি সাজিয়ে রাখার জন্য দিয়েছিলাম। “

গড়গড় করে মিথ্যে কথা গুলো অবলীলায় বলে তারপর থামলেন সুবীর।

” হম্…..।বুঝলাম।

ঠোঁটের নিচেটা বার দুয়েক ঘসে নিলেন প্রিয়তোষ। আবার ওনাকে চুপ করে থাকতে দেখে সুবীর বললেন,

“তাহলে ওটা যদি তোকে সমস্যায় ফেলে তাহলে বল। নিয়ে চলে যাব। বেচে দেব অন্য কোথাও।”

সঙ্গে সঙ্গে প্রিয়তোষ সুবীরের হাতখানা চেপে ধরে দুই দিকে ঘাড় ঝাঁকিয়ে বলেন,

“না না। একদম না। আমি ওই ঘড়ি কাজে লাগিয়ে এইবার নিজের সমস্ত রকম ভুল শুধরে নেবো। জীবনে ভুল তো একটা করিনি ভাই। সেই গুলো সব যদি শুধরে নিতে পারি, তবে জীবনটা আরো সুন্দর হবে। আমি ওটা দেবো না। ও থাক আমার কাছেই।”

বেশ অনেকটা বেলা করেই সুবীর বেরিয়ে গেলেন প্রিযতোষের বাড়ি থেকে।

ক্রমশ……

গল্পনাম : যখন ১৩টা বাজে

৩য় ও অন্তিম পর্ব:

সুবীর ঘরে এসে থম্ মেরে বসে গেলেন। হাজার হাজার চিন্তার জাল মাথায় জট পাকাতে শুরু করেছে। এরকমও ঘটে? সত্যি কথাটা কিছুতেই প্রিয়তোষকে বলতে পারলেন না সুবীর। ওই ঘড়ি প্রিয়তোষের কাছে এত প্রিয় হয়ে উঠলেও সেটা যে সুবীরের কাছে ছিল একটা অভিশাপের মত। প্রিয়তোষ ওই ঘড়ি নিজের কাছে রেখে অতীতের সব ভুল শুধরে নিতে চান। ওটাকে কাছ ছাড়া করতে চান না। আর দু দিন আগে পর্যন্ত সুবীর ওই ঘড়ি ঘর থেকে দূর করার জন্য কত রকমই চেষ্টা না চালিয়েছেন। দেখতে গেলে নিজের প্রতিহিংসা চরিতার্থ আর নিজেকে বিপদ থেকে বাঁচানো এই দুই কার্যসিদ্ধির উদ্দেশ্যে ঘড়িটাকে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন সুবীর। কিন্তু একটা কার্য সিদ্ধ হলেও একটা কিন্তু হল না। হল ঠিক তার উল্টো।

প্রিয়তোষ, তাঁর স্ত্রী পরমা আর সুবীর একই কলেজে পড়তেন। সুবীর পরমার প্রতি নিজের ভালোবাসাকে হাবেভাবে ভালোভাবে বুঝিয়ে দিলেও পরমা একদিন সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন যে তিনি প্রিয়তোষকেই ভালবাসেন এবং ভবিষ্যতে তাঁকেই বিয়ে করবেন। সেই থেকে সুবীরের মনে একটা চাপা রাগ তৈরি হয় ওদের দুজনের প্রতি। সারা জীবন সুযোগের অপেক্ষা করে যাবার পর এই শেষ বয়সে এসে শেষ পর্যন্ত সুযোগ পেলেন নিজের ভালোবাসা না পাওয়ার বদলা নেওয়ার। সেই সুযোগ আর হারাতে চান নি। কিন্তু এ যে প্রিয়তোষের কাছে শাপে বর হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।

“কী হলো বলতো? কয়েক দিন ধরেই দেখছি, বড্ড বেশিই ভাবছ আজকাল? ব্যাপার কী?”

মিনতি শাড়ি খুলতে খুলতে বললো। সুবীর মিনতির কোমরটা পেঁচিয়ে ধরে এক ঝটকায় কাছে টেনে নিয়ে তার উন্মুক্ত পেটের মধ্যে মুখ ঘষতে ঘষতে বললেন,

“ওসব তোকে বুঝতে জানতে হবে না, তুই আমাকে খুশি করে দিস। তাহলেই হবে। “

অভ্যস্ত হাতে মিনতির ব্লাউজটা খুলে বক্ষযুগলের মাঝে জিভ দিয়ে স্পর্শ করেন সুবীর। মিনতির মুখ থেকে বেরিয়ে আসে তীব্র শিতকার। দুজনে শরীরী খেলায় উন্মত্ত হয়ে ওঠেন। সারা রাত চলে একে অপরকে তৃপ্তি করার এই সাধনা। আসলে অতিরিক্ত মানসিক চাপ উপস্থিত হলেই তার থেকে সাময়িক রেহাই পাবার একমাত্র উপায় হিসেবে সুবীর আবিষ্কার করেছেন মিনতির শরীর নামক ওষুধটিকে।

আজ একেবারে তৈরি হয়েই বসেছিলেন প্রিয়তোষ নিজের অতীতে ফিরে যাবার জন্য। তেরোটা বাজতে আর দশ মিনিট বাকি। ঘড়ির দিকে বিস্ফারিত নেত্রে একভাবে তাকিয়ে বসে থাকলেন তিনি। তেরোটার ঘন্টা বেজে উঠলো। আবার সেই আগের মত চারিদিকে দৃশ্য পাক খেতে খেতে মিলে গেলো একটা বিন্দুতে। এবার আর প্রিয়তোষের মাথা ঘুরলো না, জ্ঞান হারালেন না। সেই বিন্দুর দিকে তাকিয়ে এক দৃশ্টে চেয়ে বসে রইলেন তিনি। তারপরই চোখের সামনে ফুটে উঠলো অতীতের আরেক কাহিনী। নিজেকে তিনি আবিষ্কার করলেন কলেজের লাইব্রেরি হলে। যেখানে তাঁর নিজের দুই ঠোঁট আটকা পড়ছে দেবীকার ঠোঁটের মাঝে। চকিতে ভেসে ওঠে স্মৃতি। আর দু মিনিট দেরি হলেই লাইব্রেরিয়ানের হাতে ধরা পড়বেন তিনি এবং প্রিন্সিপাল তাঁকে অন্যান্য প্রফেসরের সামনে চূড়ান্ত অপমান করবেন। দেবীকা লজ্জায় সুইসাইড করবে। এইসব মনে পড়ার সাথে সাথেই দেবীকাকে তিনি এক ঝটকায় সরিয়ে দিলেন। দেবীকা, প্রিয়তোষের এমন অদ্ভূত আচরণে অপমান বোধে একেবারে গুটিয়ে গেলেও তাদের থেকে ঠিক কয়েক পা দূরত্বে লাইব্রেরিয়ানকে দেখতে পেয়ে নিজেকে সামলে নেয় এবং প্রিয়তোষের দিকে লাইব্রেরিয়ানের অলক্ষ্যে একটা উড়ো চুম্বন ছুঁড়ে দিয়ে বেরিয়ে যায় সেখান থেকে। প্রিয়তোষ মাথা চুলকিয়ে হেসে বই খোঁজায় মনোনিবেশ করেন।

আজকাল প্রিয়তোষ বেশ খোস মেজাজে থাকেন। সকালে রাত্রে প্রতিদিন দু বেলা করে পড়াতে বসান বিল্টুকে। বিল্টু দুই থেকে দশ নামতা, যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ সহজেই শিখেছে। বেশি কষ্ট করতে হয়নি ওর পিছনে। এবার ওকে একটা স্কুলে ভর্তি করানোর মতলব আঁটতে থাকেন প্রিয়তোষ। এখন ওনার মাত্র দুটি কাজ। এক হল বিল্টুকে পড়ানো আর দুই হলো ওই তেরোটা বাজার অপেক্ষা করা, অতীতের সমস্ত ভুল শুধরে নেওয়া।

তবে এখন প্রিয়তোষের আর সুবীর দুজনেরই একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। তবে সেই সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে একলা প্রিয়তোষের কারণেই। তা হলো তাঁদের দুজনের স্মৃতিতেই এখন দ্বৈত ঘটনার স্মৃতি বিদ্যমান। অর্থাৎ, যেমন প্রিয়তোষের মায়ের কোমর না ভাঙা তেরোটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে আটকেছিলেন প্রিয়তোষ সেটা যেমন সুবীর আর প্রিয়তোষ দুজনেই জানেন আবার একই ভাবে ওনার মা যখন কোমর ভেঙে বিছানায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছিলেন সেটাও ওনাদের মনে আছে। অর্থাৎ অতীত বদলে গেলেও স্মৃতিতে কোনো বদল আসেনি। একই ব্যাপার ঘটেছে দেবীকার ক্ষেত্রেও। তবে এই ঘটনা শুধুমাত্র ওঁদের দুজনের সাথেই হয়েছে। বাকিদের ওপর এর কোনো প্রভাব পড়েনি। প্রিয়তোষের অনুভূতির সঙ্গে সুবীরের অনুভূতির এই অদ্ভূত মিলের কথা জানতে পেরেছিলেন সুবীরের থেকেই, তবে প্রিয়তোষের দ্বৈত স্মৃতির ব্যাপারটা স্বাভাবিক হলেও, তাঁর সাথে সাথে সুবীরেরও এই দ্বৈত স্মৃতির কারণ সঠিক অনুধাবন করতে পারলেন না দুজনের কেউই।

এনারা দুজন ছাড়া অন্যদের ওপর যে এই দ্বৈত স্মৃতির প্রভাব পড়ছে না তার প্রমাণ পাওয়া যায় গৌরীর কথায়। গৌরী তো আগে থেকেই জানতো যে প্রিয়তোষের মায়ের কোমর ভাঙা। তবু সে প্রিয়তোষ নিজের মাকে স্বপ্নে যখন সিঁড়ি থেকে পড়ে যাওয়া থেকে আটকালেন এবং নির্মলাদেবীর কোনো ক্ষতি হল না, ঠিক তার পরের দিন গৌরী ঘরের ঝুল ঝাড়তে ঝাড়তে ওনার বাঁধানো ছবির দিকে তাকিয়ে বললো,

“মা বয়স হলেও অনেক শক্ত ছিলেন বলুন দাদা বাবু! কেমন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ফটো তুলেছেন! কখনো একটা হাতে লাঠি পর্যন্ত নেন নি।”

সেদিনই প্রিয়তোষ বুঝতে পারেন যে এই ঘটনার প্রভাব শুধুমাত্র সুবীর আর তাঁর ওপরই পড়ছে। আর কারোর ওপর নয়।

একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মনটা খুব হালকা লাগছিল প্রিয়তোষের। গৌরীকে বললেন ব্রেকফাস্টে কচুরি আর আলুর তরকারি খাবেন। গৌরী এত খুশি হবার কারণ জানতে চাইলে তিনি বললেন,

“জানিস, স্বপ্নে দেখলাম আমি একটা বড় দুর্ঘটনার হাত থেকে একজন শিশুকে বাঁচালাম। সেই আনন্দে আজ কচুরি পার্টি হবে।”

গৌরী এক গাল হেসে বলেছিলো,

“স্বপ্ন বই তো কিছু নয়। তাও মনে আনন্দ যখন পেয়েছেন হোক তবে কচুরি। এখুনি বানিয়ে আনছি।আপনি হাত মুখ ধুয়ে নিন।”

বিল্টু হাত তালি দিতে দিতে বলে উঠলো,

” কী মজা! আজ কচুরি খাব, কী মজা! “

আসল ব্যপারটা তো আর গৌরী জানে না। আসলে প্রিয়তোষ বহু বছর আগে একবার রাস্তা পার হবার সময়ে দেখেছিলেন ফুটপাথের ধার থেকে একটা ছোট্ট বাচ্চা মেইন রোডের একেবারে মাঝখানে ছুটে চলে এসেছিল। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটা বাইক হঠাৎ এসে তাকে পিষে দিয়ে চলে যায়। ওই ঘড়ির তেরোটা বাজার স্বপ্নে সেই দৃশ্যটি দেখতে পেয়ে প্রিয়তোষ সেখানে দাঁড়িয়ে পড়েন। ওই বাচ্চাটা নিয়ম মত যেই ছুটে বেরিয়ে আসতে যায় অমনি তার হাত ধরে আটকান তিনি এবং ফুটপাথে বাচ্চার এভাবে হাত ছেড়ে রাস্তার দিকে ছুটে যাওয়া দেখে প্রচন্ড ভয় পেয়ে বসে থাকা তার মায়ের কাছে দিয়ে আসেন।

সুবীর আজকাল যেনো একটু বেশিই ভয়ে ভয়ে থাকেন।
প্রিয়তোষের শরীর বিশেষ ভালো ছিল না। একটু যেন জ্বর জ্বর মত এসেছে। রাতে যেমন সময়ে ঘুমোতে যান তেমন সময়েই ওষুধ খেয়ে ঘুমোতে গেলেন। যতোই শরীর খারাপ হোক না কেন, ওই ঘড়ি তো তাঁকে দিয়ে অতীতের ভুল শুধরানোর কাজ করিয়েই ছাড়বে। তেরোটা বাজলো ঢং ঢং করে। প্রিয়তোষ নিজেকে আবিষ্কার করলেন সুবীরের বাড়িতে। সুবীরের মা খুব যত্ন করে পরমাকে সাধ খাওয়াচ্ছেন। যতো টা সম্ভব তখন পরমার প্রেগন্যান্সির সাত মাস চলছে। যেহেতু তিনজন একই কলেজে পড়তেন সেহেতু বন্ধুত্ত্ব ছিল খুব বেশি। সুবীরের ভালোবেসে এই সাধের আয়োজন করেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ যে কী হয়েছিল পরমার কে জানে! বাড়ি ফিরে আসার পর শুরু হয় বমি। তারপর রক্তপাতও শুরু হয়ে যায়। আরো নানান শারীরিক সমস্যা হলে তাড়াতাড়ি নার্সিংহোমে ভর্তি করেন প্রিয়তোষ। জানা যায় বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে গেছে বিষাক্ত কিছু পেটে যাওয়ার কারণে। এবং পরমা কোনোদিনও আর মা হতে পারবে না।

প্রিয়তোষ দেখেন টেবিলে খাবার সাজিয়ে দিয়ে খেতে বসে বলছেন সুবীরের মা। ঠিক তখনই ওদের কাজের মেয়ে মানদা ইশারায় প্রিয়তোষকে কিছু একটা বোঝাতে চায়। প্রিয়তোষের মনে পড়ে যায় সেদিন মানদার এমন অসভ্য ব্যবহারে গা গুলিয়ে উঠেছিল। কিন্তু আজ কেন জানি না সে ইশারা আর উপেক্ষা করতে পারলেন না প্রিয়তোষ। হাত ধুতে যাওয়ার অছিলায় মানদার সাথে একান্তে দেখা করার সুযোগ পেলে মানদা তাঁকে জানায়,

“ও খাবার দিদিমণিকে একেবারে খেতে দিও না। সব খাবারে নিজে হাতে করে তোমার বন্ধু আনারসের কাঁত মিশিয়েছে গো। বাচ্চাটা একেবারে নষ্ট হয়ে যাবে ও খাবার খেলে। মাসিমা কিছু জানে না এসব। তোমার ওই বন্ধু এসব নিজে থেকে করেছে, এভাবে বন্ধুর পিছনে কেন ছুরি মারল তা জানি না বাপু। আমি আড়াল থেকে সব দেখেছি। “

পিছন ঘুরে দেখে সুবীর দেখে পরমা প্লেটের মধ্যে ভাত অল্প একটু তরকারি দিয়ে মেখেছে। কিভাবে পরমাকে আটকাবে কিছুই বুঝে উঠতে না পেরে চট করে একটা বুদ্ধি খেলে যায় মাথায়। পরমা মুখে ভাত পুরতে যাবে এমন সময়ে প্রিয়তোষ অভিনয় করে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে দুম্ করে পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে পরমা হাতের ভাত প্লেটে ছুঁড়ে ফেলে দৌড়ে আসে প্রিয়তোষের দিকে। ওঁকে নিয়ে অনেক ক্ষণ জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করার পর প্রিয়তোষ স্বাভাবিক হয়ে ওঠেন। পরমার আর খেতে ইচ্ছা করে না। দৌড়ে আসার জন্য সেও কিছুটা অসুস্থ বোধ করে। শেষে তারা কিছু না খেয়েই বাড়ি ফিরে আসে। বাচ্চাটা বেঁচে যায়।

চোখ মেলেন প্রিয়তোষ। আনন্দে দিশেহারা হয়ে পড়েন। দিন না রাত কিছুই যেন বুঝতে পারেন না। ঘরে রাখা শোকেসের দিকে চোখ যেতে তিনি দেখেন, তার উপর একটা ফুটফুটে বাচ্চার ছবি। তার পাশেই একজন বেশ সুদর্শন চেহারার সুপুরুষকে দেখা যাচ্ছে। এটাই তাহলে প্রিয়তোষের ছেলে! স্মৃতি তাজা হয়ে উঠতে থাকে তাঁর। ওনার ছেলে তো এখন চাকরি সূত্রে ব্যাঙ্গালোরে। এত আনন্দ বোধহয় তিনি কোনও দিনও পান নি। নিজের মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে ছেলেকে ফোন করেন প্রিয়তোষ, ওপার থেকে শোনা যায় ছেলের গলা,

“কী হয়েছে বাবা? এত রাতে? শরীর ঠিক আছে তো?”

ভীষণ আতঙ্কিত হয়ে চূড়ান্ত উদ্বিগ্ন কন্ঠে প্রশ্ন করে প্রবাহ,

বাবার প্রতি ছেলের এমন উদ্বেগ দেখে প্রিয়তোষ মনে মনে বেশ খুশি হলেন, বললেন,

“না বাবা , তোকে নিয়ে একটা খারাপ স্বপ্ন দেখলাম। তাই চিন্তা হল। ফোন করলাম। বিরক্ত করলাম বল? “

” উফ্… । খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম গো। একটুও বিরক্ত হই নি। এগুলো স্বপ্ন ছাড়া তো কিছু নয়। আমি ঠিক আছি। ঘুমিয়ে পড়। রাখি?”

“হ্যাঁ বাবা রাখ।”

ফোন রেখে দিলেন। ছেলেকে আর কিভাবে বোঝাবেন তিনি যে নিজের ছেলেকে একটু আগেই বাঁচিয়েছেন উনি? কে বিশ্বাস করবে তাঁর কথা? পরক্ষণেই মাথাটা যেন জ্বলে উঠলো রাগে, ক্ষোভে, ঘেন্নায়। সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করাটাও তাঁর কাছে ভীষণ কঠিন ব্যাপার। সুবীরকে এর শাস্তি পেতেই হবে। রাগে দাঁত কিড়মিড় করে ওঠে প্রিয়তোষের।

পরের দিন সকাল হতেই প্রিয়তোষ হানা দেন সুবীরের বাড়িতে। সুবীরকে দেখে মনে হল যেন প্রিয়তোষের জন্যই এতক্ষন অপেক্ষা করছিলেন। দরজা খোলার সাথে সাথেই প্রিয়তোষ হুড়মুড়িয়ে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করে সুবীরের ওপর ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মত ঝাঁপিয়ে পড়ে কলার চেপে ধরে বলেন,

“শুয়োরের বাচ্চা! পরমার খাবারে আনারস মিশিয়ে আমার বাচ্চাকে মারতে চেয়েছিলিস? কেন! বল কেন! কী ক্ষতি করেছিলাম আমরা তোর? উত্তর দে!”

বলেই ঠাস করে একটা চড় কসিয়ে দিলেন সুবীরের গালে।

সুবীর আর প্রিয়তোষ ড্রইং রুমে মুখোমুখি বসে আছেন। সুবীরের চোখ মাটির দিকে। প্রিয়তোষের চোখ থেকে তখনও আগুন ঝরে পড়ছে। সুবীর শুরু করলেন,

“আমি জানতাম তুই আসবি আমার কাছে। মনের মধ্যে একটা চাপা কষ্ট নিয়ে বসে ছিলাম এত দিন। হালকা হল আজ।”

মুখের পেশি কঠিন করে চিবিয়ে চিবিয়ে প্রিয়তোষ বললেন,

“যা বলবি সোজাসুজি বল। কোনো রকম ভণিতা করার দরকার নেই।”

সুবীর আবার বলতে শুরু করলেন,

“তোকে বলেছিলাম আমার দোকানে অর্জুন সিং ওই ঘড়িটা বিক্রি করতে এসেছিল। মিথ্যে বলেছিলাম ।অর্জুন সিং নামের আদতে কোনো মানুষ নেই। আমিও এটা উপহার পেয়েছিলাম আমার জন্মদিনে। তখনও তোর রিটায়ারমেন্ট হয়নি। তখন তুই আমেদাবাদে পোস্টিং। ওটা ক্যুরিয়ারে এসেছিল। কে পাঠিয়েছে বা কোথা থেকে এসেছে কিছুই জানতাম না। শুধু সঙ্গে একটা চিরকুট ছিল। যাতে লেখা ছিল,

“মোট তেরোবার ঘটবে ঘটনা।”

তোর মত আমিও অবাক হয়েছিলাম ঘড়ির মধ্যে তেরোর ঘর দেখে। আর চিরকুটে লেখা মানেটাও বুঝতে পারিনি সেদিন। পরে বুঝেছিলাম। কিন্তু বেশ ভালো লেগেছিল এরকম অ্যান্টিক একটা ঘড়ি উপহার পেয়ে। তাই কে পাঠিয়েছে বা কোথা থেকে পাঠিয়েছে তা জানার আর চেষ্টা করিনি। দম্ দিয়ে দেয়ালে টাঙিয়ে রাখলাম। সেই দিন থেকেই ঘটলো বিপত্তি।

বসে ছিলাম অনেক রাত পর্যন্ত তেরোটা সত্যিই বাজে কিনা দেখার জন্য। তন্দ্রা এসে গেছিল। ঠিক তখন তেরো বার ঘন্টা পড়লো ঘড়িতে। ঘুমটা চটকে গেল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে একেবারে চমকে উঠলাম। দেখলাম একটা ছোট্ট শিশু ঘড়িটার ঠিক ওপরে দেয়ালের মধ্যে কেমন যেন টিকটিকির মত দুটো হাত দুটো পা ছড়িয়ে আটকে আছে। আমি আঁতকে উঠলে মুখ দিয়ে একটা অস্ফুটে একটা শব্দ বেরিয়ে গেল। ঠিক তখনই বাচ্চাটা ধীরে ধীরে দেয়ালের ওপর ওইভাবে আটকে থেকেই শুধু মুখ টুকু আমার দিকে ঘোরালো। এ কী! একেবারে ১৮০° ঘুরে গেছে মুখখানা আমার দিকে। উফ্… । কী বীভৎস সেই মুখ। রক্ত ঝরে পড়ছে। তার রূপ ভাষায় বর্ণনা করা যায়না। আমার বিচার – বুদ্ধি তখন সব লোপ পেয়েছে। প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করতে চাইলাম, কিন্তু পারলাম না। হালকা একটা গোঁগানি বেরিয়ে এলো মুখ দিয়ে। তারপর চোখের সামনে সব কিছু অন্ধকার।

পরের দিন সকালে যখন জ্ঞান ফিরল তখন আটটা বেজে গেছে। মিনতির কলিং বেলের আওয়াজে দরজা খুললাম। আমার মুখ চোখে আতঙ্ক এমন ভাবে বসে গেছিল যে সেটা ওপর থেকেই দেখা যাচ্ছিল। মিনতি খানিক সন্দেহ করেছিল। করেছিল বোধহয়। ওকে কিছু বুঝতে না দিয়ে তড়িঘড়ি ঘরে এসে দেয়াল থেকে ঘড়িটা নামিয়ে দম্ বন্ধ করে দিতে যাই। কিন্তু পারি না। কিছুতেই তা করা যায় না। কান্না পাচ্ছিল আমার।

সেদিন আর দোকানে যেতে পারলাম না। দুপুরে আর ওই ঘরে থাকিনি। পাশের ঘরে বসে কিছু হিসেবেপত্র মেলাচ্ছিলাম। কান সজাগ হয়ে উঠলো। শুনতে পেলাম ঢংঢং করে তেরোটা বাজলো। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই আশে পাশের চিত্র বদলে যেতে থাকলো। চারিদিকে শুধু চাপ চাপ আঁধার। দেখলাম যে ঘরে বসে আছি সেই ঘরের আলমারির ওপর বসে রয়েছে কাল রাতের দেখা সেই রহস্যময় শিশু। হামাগুড়ি দিয়ে আলমারির একেবারে ধারের দিকে চলে আসছে। দেখে মনে হচ্ছে এই বুঝি ঝাঁপিয়ে পড়বে আমার উপর। চেয়ার থেকে উঠে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করতে গিয়ে দেখলাম শরীরে বিন্দুমাত্র নড়ার ক্ষমতা নেই। আমার মনের আশঙ্কা সত্যি হল। বাচ্চাটা একেবারে বাদুড়ের মত উড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো ঘাড়ের ওপর। তারপর আর কিছু মনে নেই।

জ্ঞান ফিরলে দেখলাম মিনতি আমার চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিচ্ছে। এইভাবে প্রায় এক সপ্তাহ চললো। প্রতিদিন দুবার করে এই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবার পর মন থেকে ভয় যেন একেবারে উবে গেল। বারবার মনে হচ্ছিলো কেন এমন হচ্ছে তা হয়তো আমি জানি। শুধুমাত্র একটা বাচ্চা আমাকে কেন ভয় দেখাবে? বুঝতে পারলাম এ আমারই পাপের ফল। আমি যে তোর স্ত্রী-এর সন্তানের মৃত্যুর জন্য দায়ী। এ বুঝি তোরই মৃত সন্তান। নিজের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে এসেছে। সিদ্ধান্ত নিলাম এসব শেষ করতে হবে এবার। ঘড়িটা একদিন ভাঙ্গার চেষ্টা করলাম। ছুঁড়ে ছুঁড়ে বহু বার মাটিতে আছাড় মারলাম। কিন্তু নাহ্….।কিছুতেই ভাঙলো না সেটা। শেষে আশা ছেড়ে দিলাম। সেদিনটা ছিল সপ্তম দিন, অর্থাৎ প্রতিদিনের এই ঘটনার তেরোতম বার। হঠাৎ মনে পড়ে গেল চিরকুটের লেখাটার কথা,

“মোট তেরোবার ঘটবে ঘটনা”।

কিছুটা যেন আশার আলো দেখতে পেলাম। রাত তেরোটা বাজতে আর পাঁচ মিনিট বাকি। চোখে রুমাল বেঁধে বিছানার এক ধারে জড়োসড়ো হয়ে বসে রইলাম, কানে দিলাম তুলো। যাতে ওই বীভৎস মূর্তি দেখতে না পাই, কিচ্ছু শুনতে না পাই। বুঝলাম তেরোটা বাজলো। খিলখিল করে শিশুর হাসির শব্দ কানে এলো। যেন মনে হল সে গোটা ঘরময় ছোটাছুটি করছে। একসময় ষষ্ঠেন্দ্রীয় জানান দিল সে আমার বিছানার ওপর উঠে আসছে। আতঙ্কে কুঁকড়ে গিয়ে এইসব চিরকালের মতো বন্ধ হবার প্রহর গুনতে লাগলাম। তারপর যেন মনে হল আমার চাদরে টান পড়ছে, কেউ যেন সেটাকে টানছে। আর তারপরই ঝনঝন্ করে একটা প্রচণ্ড যান্ত্রিক শব্দ। আস্তে আস্তে চোখের চাপা সরিয়ে দেখলাম দেয়াল থেকে খুলে ঘড়িটা মেঝেতে পড়ে গেছে। বাচ্চাটা ঘরের কোথাও নেই। ঘড়িটা হাতে তুলে দেখলাম সেটা বন্ধ হয়ে গেছে নিজে থেকেই। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। তার পরই নিমন্ত্রণ পেলাম তোর। ও জিনিস আর ঘরে রাখতে চাইনি। পরমাকে ভালোবাসতাম। সে কখনো বোঝেনি। তাই রাগের বশে ওর বাচ্চাকে নষ্ট করলাম। তাতেও একটা চাপা রাগ থেকেই গেছিল। তাই ঘড়িটা তোকে গিফট্ করে দিলাম। ভেবেছিলাম তুইও আমার মত পৈশাচিক কিছু দেখতে পাবি। কিন্তু……… ।”

প্রিয়তোষ, সুবীরকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,

” কিন্তু সেটা আর হল না। কারণ যে যেমন কর্ম করেছে তাকে ঠিক তেমন ফল দেবার জন্য ঘড়ির ওই তেরোর ঘর। তুই আমার বাচ্চাকে নষ্ট করেছিলিস, তাই বাচ্চার প্রেতমূর্তি তোকে ভয় দেখিয়েছে। আমি অনেক গুলো ভুল কাজ করা থেকে নিজেকে আটকাতে পারিনি বলে আফসোস হতো,তাই আমি অতীতে গিয়ে সেগুলো শুধরে নেবার সুযোগ পেলাম। “

“ঠিক। তুই লাকি। তেরোবার সুযোগ পাচ্ছিস অতীত শুধরে নেবার। কিন্তু কে ঘড়িটা পাঠাল আমাকে, এটা একটা রহস্য। তার সাথে তাহলে কী ঘটেছিল! আরো খারাপ কিছু? নাকি……॥”

“সাথে সাথে তোর সাথে বন্ধুত্ব রাখার ভুলটাও শুধরে নিলাম। ভালো থাকিস। যোগাযোগ করার আর চেষ্টা করিস না। “

সুবীর দত্তের বাড়ি থেকে গটগটিয়ে বেরিয়ে গেলেন প্রিয়তোষ বাগচী।

🙏সমাপ্ত🙏

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post পাতালপুরের রাজকন্যা| কঠোর ভাবে প্রাপ্তমনস্কদের জন্য | আফতাব হোসেন| Bengali Story for Matured
Next post আবার| কঠোর ভাবে প্রাপ্তমনস্কদের জন্য | -| Bengali Story for Matured