পুরোপুরি মনে থাকে না। মনে থাকে শুধু কাঠগোলাপ গাছটা। হলুদ রঙের ফুলে ছেয়ে আছে। আর তার তলায় রোদ্দুর দাঁড়িয়ে আছে, একটা নীল রঙের পাঞ্জাবি পরে। আলো এক ছুটে রোদ্দুরের সামনে।
-রোদ্দুর তুই এসেছিস!
রোদ্দুর হাসে।
-তোর আঙুলটা একবার ছুঁয়ে দেখব রোদ্দুর?
আলোর আবদারে রোদ্দুর বাড়িয়ে দেয় হাতটা। কিন্তু আলো তার হাতটা ছুঁয়ে দেখার আগেই প্রতিবার স্বপ্নটা ভেঙে যায়!
অনেকেই বলে স্বপ্নে নাকি রঙ দেখা যায় না। কিন্তু প্রতিবারই স্বপ্নটা দেখার পর আলোর মনে গেঁথে থাকে হলুদ আর নীল রঙটা।
তারপর আর ঘুম আসে না। পাশেই জানালা। হাত দিয়ে টেনে কোনক্রমে ভারী পর্দাটা সরায়। জানালার ছিটকিনিটা নীচে হওয়ায় কোনক্রমে খুলতে পারল হাত বাড়িয়ে। তারপর আলতো ঠেলতেই খুলে গেল পাল্লাটা। হলুদ রঙের আলো ছড়িয়ে জনশূন্য মধ্যরাতের শহরে। ও জানে আজ পূর্ণিমা। না চাইতেও কবে পূর্ণিমা, তার খোঁজ রাখে আলো। পূর্ণিমা এলে মনে হয় রোদ্দুর কাছাকাছি আছে। যদিও আকাশে চাঁদ দেখা যাচ্ছে না। খানিক দূরের লম্বা ফ্ল্যাট বাড়িটার আড়ালে চাঁদ লুকিয়ে পড়েছে। ফ্যাটফ্যাটে সাদা রঙের একটা ফ্ল্যাটবাড়ি। যখন ওটা ছিল না, আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ দেখা যেত। তখন জোৎস্নায় স্নান করত চারিদিক। সাদা বাড়িটা সরাসরি দেখা যাচ্ছে বিছানা থেকে। আলো চোখ বন্ধ করে। শীত চলে যাওয়া শুরু করেছে। তাও ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছে। বয়স বাড়লে হয়ত মানুষের একটু বেশিই ঠাণ্ডা লাগে। তার ওপর এই রোগ-ব্যাধি। কম্বলটা আরও একটু গায়ে টেনে নেয়। ও চোখ বন্ধ করে প্রাণপণে সাদা ফ্ল্যাটবাড়িটাকে সরাতে চাইছে। সেটা সরে গেলেই চাঁদ বেরিয়ে আসবে এক সমুদ্র জোৎস্না নিয়ে। আলো তলিয়ে যেতে থাকে। জোৎস্না রাতে চোখ বন্ধ করলেই পুরনো দিনে ফিরে যাওয়া যায়। সেই ভালো থাকার দিনগুলোয়।
চোখ বন্ধ করে থাকতে থাকতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল জানে না। যখন ঘুম ভাঙল এক ঝাপটায় খানিক ঠাণ্ডা বাতাস এসে লাগল গায়ে। পাখি ডাকছে। একটু দূরে সোফায় বসে ঘুমোচ্ছে তার আয়া। এবার তাকে ডাকতেই হবে। তার নাম মালতি। মালতিকে ডাকতেই সে ধড়ফড় করে উঠে বসে।
-বাথরুমে যাব।
মালতি তাড়াতাড়ি উঠে এসে আলোর হাত ধরে। জিজ্ঞাসা করে,
-জানলার পর্দা কে সরালো?
-আমিই সরিয়েছি। গতকাল পূর্ণিমা ছিল না!
আলোর উত্তর শুনে মালতি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
আলোর মনে হয় সে আর বেশিদিন বাঁচবে না। এখন প্রতিদিনই রাত্তিরে ঘুমোতে যাওয়ার সময় বুকের মধ্যে একটা হতাশা তৈরী হয়। দিনের আলো ফুটলে আবার মনে হয় হয়ত আরও কিছুদিন ঈশ্বর তাকে অনুগ্রহ করবেন। কিন্তু ওর মনের মধ্যে সব আশা ধীরে ধীরে অস্তমিত হয়ে গেছে। রোদ্দুর যে আসবে বলেছিল! এত এতগুলো বছর পেরিয়ে গেল! তাহলে কি ও সত্যিই আর আসবে না!
মালতি একেবারে তার মুখ ধুইয়ে জানালার ধারে চেয়ারে বসিয়ে দিল। এই সময় আলো খানিকক্ষণ কাগজ পড়ে। একটু দূরের চায়ের দোকানটুকু শুধু দেখা যায় জানলা দিয়ে। উনুনের ধোঁয়া পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে। অদ্ভুত ব্যাপার। একবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি এসেও চায়ের দোকানগুলো এখনও উনুনে চা বানায়! আধুনিকতা সবাইকে স্পর্শ করলেও চায়ের দোকানগুলোকে ছুঁতে পারেনি!
সামনের বিকাশবাবুদের বাড়িতে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ লাল হয়ে আছে। সেদিকে তাকিয়ে আলোর বারবার স্বপ্নটার কথা মনে পড়ছে। যদিও স্বপ্নে আলো বরাবরই কাঠগোলাপ গাছ দেখে। কিন্তু কাছাকাছি কাঠগোলাপের গাছ নেই। আলো ছোটবেলায় বিশ্বাস করত স্বপ্ন সত্যি হয়। কিন্তু জীবনের শেষবেলায় এসে আর কোনকিছুই সহজে বিশ্বাস হতে চায় না। রোদ্দুরও বলেছিল তার আলোর সাথে দেখা করতে আসবে। অবশ্যই আসবে। বলেছিল, কোনও এক ভোরে চৌকাঠে ফুল বিছিয়ে দেবে আলোর জন্য। কিন্তু কত বছর কেটে গেল, কত বসন্ত চলে গেল। রোদ্দুর কই এল না!
ঠিক কত বছর আগের কথা? সেইদিন রাত্তিরে হঠাৎ বেজে উঠেছিল ফোন। তখন আলো কলেজে পড়ে। সামনে পুজো। সেদিন রাত্তিরেবেলাতেই সবে পরিচয় হয়েছে হিমুর সঙ্গে। ইংরাজি সাহিত্য, থ্রিলার পড়তে ভালোবাসা মেয়েটা।পুরনো একটা শারদীয়া পত্রিকা বের করে খুঁজে পেয়েছিল হিমুকে। তখন রাত প্রায় এগারোটা। বাড়ির সকলে রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়েছে, আলো একা ঘরে শুয়ে শুয়ে হিমু পড়ছিল। পড়ছিল আর ডুবে যাচ্ছিল। তখনই ফোনটা বেজেছিল।
-হ্যালো!
-আলো মুখার্জি কথা বলছেন?
-আপনি কে?
-আপনার লেখা কবিতাগুলো পড়লাম। খুব সুন্দর লেখেন। ছাপবেন?
-আপনি কে?
-সরি, পরিচয় দেওয়া হয়নি। আমি রোদ্দুর। আমার একটা প্রকাশনী আছে। আপনার কবিতাগুলো পড়ে ভাবছিলাম…, আপনি কি কবিতাগুলো ছাপতে চান?
-তার জন্য রাতদুপুরে ফোন করলেন? ফোন নম্বর পেলেন কোথায়?
-আপনার পেজ থেকে!
আলোর খেয়াল হয়, সোশ্যাল মিডিয়ায় ওর কবিতার পেজে ফোন নম্বর দেওয়া আছে। ফোন নম্বরটা বোধহয় রাখা উচিত হয়নি। কে না কে, রাত এগারোটার সময় ফোন করে উল্টোপাল্টা বকছে। কেটে দিয়েছিল ফোনটা।
তারপর টুং করে ছোট্ট একটা মেসেজ ঢোকে।
‘আমার কোন অসৎ উদ্দেশ্য নেই। একটু কথা বলতে পারি?’
তারপর আবার ফোন। কবিতা থেকে শুরু করে ফেলুদা, সৌমিত্র, সব্যসাচী, সব্যসাচী চক্রবর্তীর দুই ছেলে, তাঁদের অভিনয়, কত কিছু নিয়েই কথা হল। কথা হতে হতে মাঝরাত। আলোর সাথে রোদ্দুরের পরিচয় হল সেদিন।
-রোদ্দুর তুই খুব অদ্ভুত।
আলো বলত।
-কেন রে?
জিজ্ঞেস করত রোদ্দুর।
ততদিনে ওরা আপনি থেকে তুইতে নেমে এসেছে।
রোদ্দুর সত্যিই অদ্ভুত। রোদ্দুর আচমকা ঝড়ের মত তীব্র, রোদ্দুর সুনীল সমুদ্রের মতই গভীর, ঢেউয়ের মতোই উচ্ছ্বসিত।
একদিন রাতে আলো তখন পড়াশোনায় ডুবে আছে। বেজে উঠল ফোনটা। ফোনটা ধরতেই আলোর বুকের ভেতরে মিহি মিহি গুঁড়ো বরফ পড়তে শুরু করে। টলটল করছে নদীর জল। আকাশে পূর্ণিমার ভরন্ত চাঁদ। রোদ্দুর নৌকায় ভাসছে। ওর শরীর জুড়ে জোৎস্না মাখামাখি। পূর্ণিমা!
রোদ্দুর চেঁচায়,
-চল আলো, তোকে নৌকা করে ঘুরিয়ে আনি।
পূর্ণিমার রাতে জ্যোৎস্না মাখা নদীর রূপ এত সুন্দর আলো কোনদিন ভাবতে পারেনি। সেই প্রথম ওর জোৎস্না রাতে নৌকা ভ্রমণ।
রোদ্দুর হেঁড়ে গলায় গান ধরেছিল,
‘আজি জোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে। বসন্তের এই মাতাল সমীরণে।’
আলো হেসে কুটোপাটি।
বিকেল হলেই রোদ্দুর বলত,
-আলো, ছাদে চল।
আলো একদৌড়ে ছাদে।
রোদ্দুরের কাছে তার সঙ্কোচের কিছু ছিল না। নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার, সাজিয়ে নেওয়ার ছিল না। পরিপাটি হয়ে সামনে যাওয়ার দায় ছিল না।
রোদ্দুর ওকে বলত,
-আমার সামনে অত সেজেগুজে, চুল আঁচড়ে আসতে হবে না। তুই যখন যেমন, তখন তেমনভাবেই থাকিস। তুই মানুষটা এমনিই সুন্দর।
আলো জানত সে সুন্দর নয়। সুন্দর বলার মতন কিছুই তার নেই। তার শ্যামলা রঙ, তার চশমায় ঢাকা চোখে কেউ কোনদিন সৌন্দর্য দেখেনি।
বিকেলবেলা ছাদে গিয়ে দুজনে প্রাণভরে গান গাইত, কবিতা পড়ত। রোদ্দুর উদাত্ত কন্ঠে আওড়াতো,
“পাগলী, তোমার সঙ্গে ভয়াবহ জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ধুলোবালি কাটাব জীবন
এর চোখে ধাঁধা করব, ওর জল করে দেব কাদা
পাগলী, তোমার সঙ্গে ঢেউ খেলতে যাব দু’কদম।”
রোদ্দুর কিছু বললে আলো না করতে পারত না। তার চাওয়ায় কোনও জোর ছিল না। সে ছিল আস্ত একটা ছেলেমানুষ। তার হঠাৎ হঠাৎ ছেলেমানুষিগুলোকে আলো অস্বীকার করতে পারত না। জোর দিয়ে কখনও বলতে পারে নি, যাব না ছাদে। যাব না তোর সাথে রাস্তায় হাঁটতে।
যেদিন বিকেলে ছাদে যেতে ইচ্ছে করত না, ওরা হাঁটতে বেরোত রাস্তায়। কখনও আলো রোদ্দুরকে শহরের রাস্তা চেনাত, কখনও রোদ্দুর আলোকে নিয়ে চলে যেত আলপথে, নদীপাড়ে।
দু’জনে মিলে বসে থাকত নদীর পাড়ে।
আলো আবৃত্তি করত নির্মলেন্দু গুন,
‘কতবার যে আমি তোমোকে স্পর্শ করতে গিয়ে
গুটিয়ে নিয়েছি হাত-সে কথা ঈশ্বর জানেন।
তোমাকে ভালোবাসার কথা বলতে গিয়েও
কতবার যে আমি সে কথা বলিনি
সে কথা আমার ঈশ্বর জানেন।
তোমার হাতের মৃদু কড়া নাড়ার শব্দ শুনে জেগে উঠবার জন্য
দরোজার সঙ্গে চুম্বকের মতো আমি গেঁথে রেখেছিলাম
আমার কর্ণযুগল; তুমি এসে আমাকে ডেকে বলবে
‘এই ওঠো,
আমি, আ…মি…।’
আর আমি এ-কী শুনলাম
এমত উল্লাসে নিজেকে নিক্ষেপ করব তোমার উদ্দেশ্যে
কতবার যে এরকম একটি দৃশ্যের কথা আমি মনে মনে
কল্পনা করেছি, সে-কথা আমার ঈশ্বর জানেন।
আমার চুল পেকেছে তোমার জন্য,
আমার গায়ে জ্বর এসেছে তোমার জন্য,
আমার ঈশ্বর জানেন- আমার মৃত্যু হবে তোমার জন্য।
তারপর অনেকদিন পর একদিন তুমিও জানবে,
আমি জন্মেছিলাম তোমার জন্য। শুধু তোমার জন্য।’
রোদ্দুর হয়ত বাসে চেপে কোথাও যাচ্ছে, আলোকে বলত,
– বসে বসে বোর হই। যতক্ষণ বসে থাকব, কবিতা শোনাবি।
আলো তসলিমা নাসরিনের কবিতা আবৃত্তি করত…,
যেন ওরই মনের কথাগুলো…
‘…তোমাকে অনেক সময় রক্তমাংসের মানুষ বলে মনে হয় না,
হঠাৎ ঝড়ে উড়ে হৃদয়ের উঠোনে
যেন অনেক প্রত্যাশিত অনেক কালের দেখা স্বপ্ন এসে দাঁড়ালে।
আগে কখনও আমার মনে হয়নি ঘুম থেকে অমন আচমকা জেগে উঠতে আমি আসলে
খুব ভালোবাসি
আগে কখনও আমার মনে হয়নি কিছু উষ্ণ শব্দ আমার শীতলতাকে একেবারে পাহাড়ের
চুড়োয় পাঠিয়ে দিতে পারে
আগে কখনও আমি জানিনি যে কিছু মোহন শব্দের গায়ে চুমু খেতে খেতে আমি রাতকে
ভোর করতে পারি।’
জ্যাম হত রাস্তায়। হাজার গাড়ির হর্ন। তারমধ্যে কবিতার আসর বসত ওদের। তারপর একসময় বিরক্ত হয়ে রোদ্দুর নেমে পড়ত বাস থেকে।
হুট করে হাঁটুগেড়ে বসে পড়ত ফুটপাথের চুড়িওলার সামনে।
– আলো তোর জন্য চুড়ি কিনছি। তোর হাতের মাপ জানি না।
– কিনে তোর কাছে রেখে দে। হাতে হলে হবে, না হয় বাক্সে তুলে রাখব।
শুধু কি রোদ্দুরই এরকম পাগলামো করত? আলোও তো তিস্তার পাড় থেকে নদীর পাথর, রাস্তা থেকে বুনোফুল, সমুদ্রের পাড় থেকে ঝিনুক কুড়িয়ে আনত! এমনকি বিয়ের পর নিউ মার্কেটে শ্বশুরবাড়ির সকলের জন্য পুজোর জামাকাপড় কিনতে গিয়ে রোদ্দুরের জন্য একটা সবুজ রঙের পাঞ্জাবি কিনে ফেলেছিল। পরে যদিও সেটা মামাতো দেওরকে দিয়ে দিতে হয়!
রোদ্দুর রিক্সায় উঠে একধার ঘেঁষে বসত। বলত,
-ভাব তুই পাশে বসে। তোর সাথে যাচ্ছি।
তুমুল বৃষ্টি নামল একদিন। রোদ্দুর নেমে পড়ল রিক্সা থেকে।
– আ…লো…
– ভিজছিস কেন পাগল?
– চল, দু’জনে মিলে ভিজি…!
রোদ্দুর পাগলের মতন ভিজেছিল। আলো এক দৌড়ে চলে গিয়েছিল ছাদে।
ঈশ্বরের কৃপায় সেদিন আলোর ছাদ জুড়েও বৃষ্টি নেমেছিল।
দু’জনে মিলে ভিজে হাপুশুটি।
রোদ্দুরের ভালোবাসায় ওর মাথার চুল থেকে জল ঝরত। পায়ের পাতায় আলতা রঙ লাগত। রোদ্দুর সমুদ্রে গেলে আলোর পায়ে এসে ঢেউ ভাঙতো।
কখনও সময় কাটাতে দু’জনে গান শুনত একসাথে। রোদ্দুর বলত,
-আমার প্রিয় গানটা শুনবি?
-কোন গান?
রোদ্দুর গান চালাত, রবীন্দ্রনাথ…
‘আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে…
তাই হেরি তায় সকলখানে…!’
আলো হাসত। বলত,
-তোর প্রিয় যত গান আমাকে নিঃশর্ত দান করে দিবি?
রোদ্দুরও হাসত উত্তরে।
-আর তুই কী দিবি?
-আমি তোর একটা ছবি এঁকে দেব।
-তুই ছবি আঁকতে পারিস?
রোদ্দুর অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল।
-পারি তো।
-আমায় একটা ছবি এঁকে দিবি? আমার ছবি?
আলো সেদিন মাঝরাত অবধি খাতায় আঁকিবুকি কেটেছিল পেন্সিল দিয়ে।
আলো ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছিল। নিজের সমস্তটুকু নিয়ে রোদ্দুরের দ্বারে রেখে দিচ্ছিল আস্তে আস্তে।
তারমধ্যেই একদিন আলোর জেঠু একদিন অফিস থেকে ফিরে আলোর বাবাকে ডাকলেন।
-তোর মেয়ের জন্য বিশ্বনাথবাবুকে বললাম। ওঁওঁর ছেলে যাদবপুরের ইঞ্জিনিয়ার। ভালো চাকরি করে।
ওদের বাড়িতে জেঠুর কথা ছিল বেদবাক্যের মতন। কেউ কখনও অমান্য করেনি, কেউ কখনও অমান্য করার কথা চিন্তাও করতে পারে না। জেঠু বলছেন মানেই সেটা অব্যর্থ। সেটাই আইন।
আলোর বাবাই কিছু বলতে পারলেন না, আর আলো নিজে তো চিরকাল মুখ বুজে থাকা, চোখ নামিয়ে কথা বলা মেয়ে। যে রোদ্দুরের ভালোবাসায় ভেসে গিয়েছিল। কিন্তু কখনও রোদ্দুরকে জিজ্ঞেস করা হয়নি, রোদ্দুর কি আলোকে ভালোবাসে!
রোদ্দুর হেসেছে আলোর সাথে, কেঁদেছে আলোর সাথে, রোদ্দুর গান গেয়েছে, কবিতা বলেছে, আবার শাসনও করেছে আলোকে। অভিমান করলে ওর জন্য কাঠগোলাপ সাজিয়ে রেখেছে। কিন্তু ভালোবেসেছে কিনা জিজ্ঞাসা করা হয়নি তো কোনদিন!
সেই জোৎস্না রাতে আলো রোদ্দুরকে বলেছিল,
-জেঠু আমার বিয়ে ঠিক করেছে রোদ্দুর।
আলোর চোখের পাতা কাঁপছিল, গলার স্বর কাঁপছিল, আলোর ঠোঁট থরথর করে কেঁপে উঠেছিল কথা বলতে গিয়ে, তবু রোদ্দুরের গলা কাঁপেনি। রোদ্দুরের চোখ দেখে সেই মুহূর্তে আলোর মনে প্রশ্ন জেগেছিল, এই চোখকেই কি মৈত্রেয়ী দেবী ‘ন হন্যতে’ উপন্যাসে বলেছিলেন পাথরের মতন চোখ?
রোদ্দুর বলেছিল,
-আয় একসাথে লিখি…।
ওরা লিখেছিল…
‘তোকে দিলাম আজ রাত্রের
বিরক্তিহীন অবসর।
তোকে দিলাম চাঁদমাখা রাত
কবিতায় মুখর।
তোকে দিলাম ছেলেমানুষি
আবোল তাবোল ইচ্ছেঘুড়ি।
তোকে দিলাম কুমিরডাঙা
লুকোচুরি আর চাঁদের বুড়ি।
তোকে দিলাম কেষ্ট ঠাকুর
চৌরাশিয়ার বাঁশি।
তোকে দিলাম আবেগ যত,
প্রবল বানভাসি।
তোকে দিলাম সৎ প্রেমিকের
দাম না পাওয়ার ক্রোধ,
তোকে দিলাম পুড়িয়ে দেওয়া
অপেক্ষাদের রোদ।’
সেদিন আলো হু হু করে কেঁদেছিল।
রোদ্দুর বলেছিল,
-তুই যেখানেই থাকিস, যার আমানত হয়েই থাকিস, তুই আমারই থাকবি আলো। আমি কোন না কোনদিন ঠিক আসব তোর সাথে দেখা করতে।
তোর জন্য ফুল বিছিয়ে রাখব তোর চৌকাঠে।
তারপর বহুবছর কেটে গেল ওভাবেই। শুধু এই আহ্নিক গতি আর বার্ষিক গতি। দিন যায়, বছর যায়। যেতে হয় বলেই যায়। না গিয়ে তাদের উপায় নেই বলেই যায়।
আলো ডাক পাড়ে,
-মালতি।
সকাল আটটা।
মালতি ব্রেকফাস্ট এনে রাখে টেবিলে।
দুটো রুটি। লাউয়ের তরকারি। চিনি ছাড়া লিকার চা এক কাপ। আর, আলো অবাক হয়! প্লেটের পাশে একটা মুখবন্ধ খাম। যত্ন করে লেখা আছে
‘আলো মুখার্জি!’
কত বছর হল বিয়ে হয়েছে। সেই 2017 তে! আর এখন 2057! তখন থেকে তো আলো মুখার্জি আলো রায় হয়ে আছে! এত বছর পরে মুখার্জি লেখা দেখে অবাকই হয়!
খামের মুখ ছিঁড়তেই বেরিয়ে আসে দু’টো কাঠগোলাপ! সঙ্গে একটা চিঠি!
আলোর বুকের ভেতরের সেই বহুকাল ধরে সযত্নে পুষে রাখা তিতির পাখি হৃদয়টা কেঁপে কেঁপে ওঠে।
-কে দিল মালতি? কোথায় পেলি?
টের পায় কন্ঠও কাঁপছে।
মালতি ঠোঁট ওল্টায়।
– লেটার বক্সে পড়েছিল।
লেটার বক্সে! পুরনো বাড়ির লেটার বক্সে আগে তাও কিছু ব্যাঙ্কের বা অফিসের দরকারি চিঠিপত্র আসত, এখন তো ফাঁকাই পড়ে থাকে। দেওয়ালের গায়ে লাগান একটা অপ্রয়োজনীয় জিনিস।
তবে কি, তবে কি…
ভাবতে ভাবতেই আলো কাঁপা কাঁপা হাতে চিঠি খোলে।
‘আলো
জানি পৃথিবীর আর সকলে আমায় ভুলে গেলেও তুই আমায় ভুলবি না। হয়ত আজও বসে আছিস আমার অপেক্ষায়। আমি তোকে বলেছিলাম যে আসব। শুধু তোর সাথে দেখা করার জন্যই আমি আসব। চুল পেকেছে বহুদিন, বুড়ো হয়েছি। এই বুড়ো বয়সে একদিন যদি তোর সঙ্গে দেখা করি, দু’দন্ড বসি, সমাজ নিশ্চয়ই এখন চোখ রাঙাবে না!
আমি কথা রেখেছি আলো। আমি তোর শহরে এসেছি।’
আলো হাঁক পাড়ে,
-মালতি। আমায় একটা ভালো শাড়ি পরিয়ে দে তো। ওই আকাশী শাড়িটা বার কর।
-এখন ভালো শাড়ি পরবে? কেউ আসবে নাকি গো?
মালতি যারপরনাই অবাক হয়।
আলো শুধু হাসে। বলে,
-জানালার পর্দাগুলো সব সরিয়ে দে। আজ রোদ্দুর আসবে।
আলোর বৃদ্ধ মুখে কিশোরীবেলার হাসি। আজ ওর বহুকালের স্বপ্নটা সত্যি হতে চলেছে। আজ একবার হলেও ও রোদ্দুরের আঙুলটা ছুঁয়ে দেখবে।