রুধির দেনা| ভয়ের দেশ | মোহাম্মদ হাসিন ইশরাক| Bengali Horror Story
0 (0)

ইন্সপেক্টর রাকিব তার চেয়ারে এসে বসলো। তার মুখে বিরক্তি। জীবনে হঠাৎ সব কিছু তালগোল পাকিয়ে গেছে যেন তার। না পারছে পরিবারের দিকটা সামাল দিতে, না পারছে এই চাকরির দিকে মনোযোগ দিতে। নতুন কেসটা বেশ ভোগাচ্ছে তাকে। প্রচুর ছোটাছুটি করতে হচ্ছে কিন্তু ফলাফল যেন শুন্য! সামনে দাঁড়িয়ে আছেন সাব-ইন্সপেক্টর ফজলুর সাহেব। তার চেহারাও বিমর্ষ খুব। অবশ্য তার এমন হাল হবার পিছনে কারণ ভিন্ন। তার খুব শখের পানের কৌটাটা গত রাতে বাসা থেকে চুরি যায়। ফজলুর সাহেব আবার বেশ পানের ভক্ত। এমন একটা বেলা নেই যখন তিনি পান খান না। খাবারের আগে একটা, খাবারের পরে আরেকটা। এভাবে নিয়ম করে চলতেই থাকে। সেজন্য তার সাথে কথা বলার সময় কখনও তাকে জাবর কাটা ছাড়া কথা বলতে দেখা যায় না। ঠোঁটে তো লাল রঙটা যেন পাকাপাকি ভাবে মিশেই গেছে!

– স্যার, দ্যাখসেন অবস্থাডা? আমি এই এলাকার সাব-ইন্সপেক্টর, আর আমার ঘর থেইকাই কিনা চোরে করে চুরি। এইডা কেমুন কথা?

– উফফ, ফজলুর সাহেব! রাখেন তো। এমনিতেই সংসারে এত ঝামেলা। তার উপর এই কেস!

– স্যার, হোক সামান্য পানের কৌটা। তাও তো চুরি। আপনে এমনে কইতে পারলেন?

– হ্যাঁ, পারলাম। এখন আর ঘ্যানঘ্যান না করে চুপ করেন তো।

– স্যার, আপনে বুঝতেই পারতেসেন না ব্যাপারডা! আমার পানের শখ আছে দেইখা আমার বউয়ের এক চাচতো ভাই আমার জন্য কোলকাতা থেইকা নিয়া আইসিল এই কৌটা। দাম কমসে কম দুই হাজার তো হইবই। যদিও জিগাই নাই, কিন্তু বুঝন যায়। আর বদজাতটা হেইডা নিয়াই ভাগলো!

– ফজলুর সাহেব, আপনি কি চুপ করবেন? আগে এই কেসটা সামাল দেই। তারপর আপনার পান নিয়ে দেখা যাবে। দরকার হলে স্পেশাল ফোর্স নিয়ে আপনার পানের কৌটা খোঁজা হবে। অবস্থা বেগতিক দেখে ফজলুর সাহেব জায়গা ছেড়ে ধীরে ধীরে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালেন। আর মুখের ভঙ্গি পরিবর্তন করে এমন এক আনমনা ভাব আনলেন যেন হুট করে খুব বড় এক বিষয় মাথায় এসে হাজির হয়েছে আর কিছুক্ষণ আগের কথাগুলি সেই বিষয়ের সামনে কিছুই না। তিনি মুখের এই ভাব পরিবর্তন আগেও অনেকবার করে এসেছেন এবং তিনি এই কাজ বেশ দক্ষতার সাথেই করে থাকেন। ফজলুর সাহেব ফোন বাজার শব্দ শুনতে পেলেন। “এমন সময় আবার কেডা ফোন দেয়? বড় স্যার নাকি? না না! উনি তো এত সক্কাল সক্কাল ফোন দেন না। তাইলে? মনে হয় আপা ফোন দিসেন। এই কয়দিন আপা আর স্যার এর মধ্যে বেজায় ঝামেলা চলতাসে। কিন্তু সেই সমস্যা আড়ি পাইতা শুনতে আবার ভালাই লাগে!”, মনে মনে বিড়বিড় করতে করতে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ফোনের কথোপকথনে কর্ণপাত করলেন।

– ফজলুর সাহেব!

– জে স্যার?

– আরেকটা খুন হইসে।

– কন কী স্যার? এইডাও কি আগেরডার মতনই?

– হু!

– কী কইসে স্যার ফোনে?

– শিমুলপাড়ায় বাজারের দিকটায় একজনের লাশ পাওয়া গেছে। লাশের শরীরের এমন কোন শিরা নেই যেটা কাটা হয় নাই। সারা রাস্তা রক্তে ভরা। খুব বিশ্রী এক অবস্থা!

– নিশ্চিত শিবিরের কাজ স্যার, আপনে সিউর থাহেন!

– এত কথার সময় নাই, চলেন ফজলুর সাহেব। এখনই যেতে হবে।

বেলা তখন ১১টা। ইন্সপেক্টর রাকিব এবং সাব-ইন্সপেক্টর ফজলুর বাজারের রাস্তার সামনে গাড়িতে বসে। তাদের মুখে বিরক্তি। কারণ পুরো এলাকার মানুষ যেন জড়ো হয়েছে বাজারের এই রাস্তায়। তারা গাড়ি নিয়ে ভেতর পর্যন্ত যাওয়ার কোন উপায়ই দেখছে না। নাহ! হেঁটেই যেতে হবে এখন! তারা বেশ খানিকক্ষণ হর্ন বাজিয়েও সুবিধা করতে না পেরে শেষমেশ পথ ধরে হাঁটা দিল। ইন্সপেক্টর রাকিব প্রতি কদম ফেলছেন আর সেই সাথে অসহায় অনুভব করছেন। তিনি তার সংসারের ঝামেলার কথা ভুলেই গেছেন এতক্ষণে। তার মাথায় শুধু ঘুরছে লাশ। বাতাস জুড়ে শুধু একটা পরিচিত গন্ধ। নাকে মুখে ভেসে আসছে সেই গন্ধ। বাতাসে লাশের গন্ধ! অবশ্য রাকিবের তাতে খুব বেশি সমস্যা হয় না। জীবনের অর্ধেকটা তার লাশের গন্ধ নাকে লাগিয়ে, লাশ দেখে দেখেই কেটেছে। কিন্তু কখনও তিনি কোন অপরাধীকে সহজে পার পেতে দেননি। তিনি লেগে থাকতে পছন্দ করেন কাজ নিয়ে। লেখাপড়া বেশি করেননি জীবনে। তবুও দেশকে কিছু দেওয়ার খুব ইচ্ছা ভেতরে ভেতরে। এবারের কেসে রাকিবের বুঝতে অসুবিধা হয়না – অপরাধী একটা বদ্ধ উন্মাদ!

যখনই রাকিবকে কোথাও প্রয়োজন হয়েছে সাথে সাথে বাসা থেকে ছুটে এসেছেন কাজে। এতে সংসারে স্ত্রী কিংবা বাচ্চাদের জন্য সময় কম দেয়া লাগলে লাগুক। তাও যদি দেশকে কিছু দিতে পারেন। যত যাই হোক দেশ আগে! কিন্তু আসলেও কি ঠিক কাজ করেছেন এমন করে? কতদিন বাচ্চাদের সাথে ভালো করে সময় কাটান না হিসাব আছে!? সকালে বাচ্চারা স্কুলে চলে যায় খুব তাড়াতাড়ি, তিনি তখন ঘুমিয়ে থাকেন। তাই তখন দেখা হয় না। বাচ্চারা সন্ধ্যা থেকে বসে থাকে তার জন্য। বসে থাকতে থাকতে এক সময় রাত গভীর হয়। তারা ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ইদানিং এমন বেশি হচ্ছে। ক্রাইম এত বেড়েছে! বাসায় ফেরার সময়ও ফোন পেয়ে ছুটেছেন কাজে। পরে বাসায় ফিরে দেখেন বাচ্চারা ঘুমিয়ে গেছে। তিনি তখন খুব ক্লান্তি নিয়ে ধীরে ধীরে বাচ্চাদের কাছে যান। তাদের কপালে চুমু দিয়ে ফিস ফিস করে বলেন, “মাফ করে দিস তোরা। খুব পচা বাবা আমি! কিন্তু একদিন তোরা বুঝবি তোদের সময় না দেয়ার পেছনে এই বাবার কত বড় এক দায়িত্ব কাজ করেছিল। সেদিন তোদের-ই গর্ব হবে!” কিন্তু আদৌ তারা কখনো বুঝবে? জীবনে কত লাশ দেখেছেন, কত মানুষের কান্না শুনেছেন, কত জন কে চোখের সামনেও মারা যেতে দেখেছেন। কিন্তু কখনো তার চোখে এতটুকু পানি আসেনি। মানুষ হিসেবে এত শক্ত হওয়া সত্ত্বেও বাচ্চাদের কথা মনে পড়লেই মনের অজান্তে চোখের কোণে পানি চলে আসে। খুব কায়দা করে আড়াল করে পানিটা মুছতে হয়। একজন পুলিশ অফিসার কাঁদছেন সেটা দেখলে আবার কেলেংকারি কাণ্ড!

এ যেন রক্তের সাগর! রক্তে মোড়ানো পথে কদম ফেলে লাশের কাছে যেতে হলো। আশেপাশে মানুষের প্রচণ্ড ভিড়। মানুষের মাঝে বীভৎসতা দেখবার একটা প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করা যায় আজকাল। একজন বয়স্ক মহিলা ওখানেই চিৎকার করে কাঁদছেন। বার বার ছুটে আসতে চাচ্ছেন ডেডবডির কাছে। কিন্তু পুলিশের লোকজন দিচ্ছে না কাছে যেতে। তাকে জোর করে ধরে রেখেছে। মহিলার চিৎকার বেড়েই চলেছে। বোধ হয় মৃত ব্যক্তির মা। একজন মায়ের চিৎকার শুনে নিজেকে সামলানো খুব কঠিন! তিনি কাছে যেতে না পেরে শেষমেশ রাস্তায় লেগে থাকা রক্ত ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছেন।

ইন্সপেক্টর রাকিব লাশের কাছে গেলেন। লাশের মুখ ফ্যাকাশে। চোখগুলি এখনো চেয়ে আছে তার দিকে। কিন্তু সেই দৃষ্টিতে এক শূন্যতা। যেন তার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বলছে, “আমার এক বিন্দু রক্তও তো ছাড়েনি! তোমরা তখন কোথায় ছিলে?” রক্তাক্ত শরীর। রক্তে ভেজা শরীরের কাপড়। কিছু কিছু জায়গায় রক্ত শুকিয়ে ছোপ ছোপ দাগ পড়ে গেছে।

(২)

মির্জাপুর কবরস্থান। শিমুলপাড়া থেকে বেশ কিছুদূর উত্তরে গেলেই এই কবরস্থান। রাত্রি তখন ২টা। আশেপাশে ঝিঁ ঝিঁ পোকার আওয়াজ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। আশেপাশে বাতি বলতে গেলে রাস্তার ধারের ল্যাম্প পোস্টের বাতি। সেটাও বেশ হালকা আভা দিচ্ছে। অনেকদিন ধরে কবরস্থানের ভেতরের বাতিটা নষ্ট পড়ে আছে। সারানোর কোন নাম নেই। সেজন্য এক বীভৎস অন্ধকার। হঠাৎ করে কোথায় যেন কুকুরের ডাক শোনা যায়। সেই ডাক রাতের বীভৎসতা বাড়িয়ে তুলছে। এক সময় কুকুরের সেই ডাক ক্ষীণ হয়ে আসে। মনে হয় খুব অস্পষ্ট শব্দে যেন কুকুর গুলো কাঁদছে!

চারিদিকে শুধু কবর। কিছু কিছু কবর এত নতুন যে মনে হয় লাশে ব্যবহৃত কর্পূর, গোলাপজলের গন্ধ বুঝি এখনো টাটকা হয়ে ভেসে আসছে বাতাসে। আর কবরস্থান ঘেঁষে থাকা গাছগুলি যেন পাহারা দিচ্ছে মৃত মানুষগুলোকে। কুকুরের কান্না আর ঝিঁ ঝিঁ-র ডাকের মাঝেও যেন এক অদ্ভুত নীরবতা বিরাজ করছে এখানে। সেই নীরবতা ভেঙে রবিন কিছু সময় পরপর নিঃশ্বাস ফেলছে। রবিনের চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। সে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে একটি কবরের দিকে। তার দুই হাতে রক্ত। ঘামের মত তার হাত বেয়ে রক্ত পড়ছে। তার জামা কাপড়েও রক্ত লেগে আছে। সারা শরীর রক্তে ভেজা। রবিন রক্তমাখা হাত তার নাকের কাছে নিয়ে ধরল। তারপর কবরের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকল, “দেখ রক্ত দেখ। তোরা কেউ নিবি এই রক্ত? কেউ খাবি? দেখ কত টাটকা! মাত্র একটারে শেষ কইরা তার কইলজা ছিঁইড়া এই রক্ত আনসি। জিন্দা থাকনের সময় তো তোগর রক্তের অনেক দাম থাহে। তইলে মরণের পরে রক্ত লাগব না ক্যান? নে নে, রক্ত নে।” রবিন জামা খুলে ঐ কবরের পাশে দাঁড়াল, যেখানে এতক্ষণ তাকিয়ে ছিল।

এক সময় রবিন রক্তমাখা হাত নিজের মুখের উপর চেপে ধরলো। তার সারা মুখ তখন রক্তের আবরণে লাল হয়ে উঠলো। বিকট শব্দে হাসতে শুরু করলো। খুব বীভৎস হাসি! তারপর ধীরে ধীরে রবিন শান্ত হয়ে বসে পরলো। এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে হাতে সিগারেট ধরায়। তারপর নিজের মনে কিছু গুন গুন করে বলতে থাকে। বলতে বলতেই তার চোখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করে। মুহূর্তের ভেতর রবিন ভেউ ভেউ করে কাঁদতে থাকে। রাতের ঝিঁ ঝিঁ আর সমস্ত কুকুর দল চুপ করে যায় সেই কান্না শুনে। এই কান্না যেন গগনবিদারী এক কান্না।

(৩)

“তখনো আমি বেঁচে ছিলাম। অবশ্য বেঁচে থাকা বলতে যা আমরা বুঝি সে অর্থে বেঁচে ছিলাম আর কী! প্রাণে স্পন্দনটুকু ছিল। কিন্তু চেতনাগুলি হারিয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই। আমার ভেতর আমি নিজেকে খুঁজে পেতাম না। বারবার সেখানে খুঁজে পেতাম এক ভিন্ন সত্তাকে। যে সত্তা আর্তনাদ করে চলছে প্রতিনিয়ত। যে সত্তা বার বার আশার আলো খুঁজে পেতে চায়। চোখ বন্ধ করলেই ভয় কাজ করা শুরু করে। যেন চোখ খোলা রাখলেই বাঁচে। অথচ আমি তখনই জানতাম আমার সময় শেষ প্রায়। নিজের ভেতরে ঘটতে থাকা স্নায়ুর ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া বারবার জানান দিত সে কথা। আমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থাকতাম। তাকিয়েই থাকতাম। ঘড়ি চলছে। কী সুন্দর করে এগোচ্ছে সময়! আমি বেঁচে আছি। অনুভব করছি প্রতি বার ঘড়ির টিকটিক করে ছুটে চলাকে। আমিও সেই কাঁটার সাথেই ছুটতে চেয়েছি। কিন্তু পারিনি। হয়রান হয়ে হাসপাতালের বিছানায় হাঁসফাঁস করে গেছি। এক সময় ক্লান্তি নামে। দৃষ্টি স্তব্ধ হয়ে যায়। আমি বুঝতে পারি চোখের পাশ দিয়ে পানি গড়াচ্ছে। কিন্তু মুছতে ইচ্ছা করে না। আবার ঘড়িতে দেখি। রাত কখন হবে? আমার দিনের হিসাব এখন ব্যাগ এর সাথে তাল মিলিয়ে চলে! এক একটা রক্তের ব্যাগের সাথে।

আমি যেন টের পাচ্ছি আমার ভেতর রক্তের কণা গুলি নিজেরাই নিজেদের মেরে ফেলছে। ধীরে ধীরে আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি। আমি প্রায়ই ঘোরের মাঝে থাকি। শুনতে পাই আমার জন্য রক্তের যোগান হচ্ছে না। শুনে আমি চোখ বন্ধ অবস্থাতেই মুখে হাসি নিয়ে আসি। নিয়তিকে আমি মানতে পেরেছি। জীবন চাইলেই আমাকে কষ্ট দিতে পারবে না। আমি এত দুর্বল মেয়ে না। এই যে হাসছি! আমি না বাঁচলেও আমার হাসি বেঁচে থাকবে।

মৃত্যু। জীবনের স্বাদ বোঝার জন্যই যেন এর আবির্ভাব। যখন মৃত্যু খুব কাছে আসে তখন বেঁচে থাকার অনুভূতিটা বুকের ভেতর বাজতে থাকে। সারা জীবন আনন্দের উপলক্ষ খুঁজে চলা মানুষও তখন বেঁচে থাকাকে উদযাপন করতে চায়! প্রতিটা নিঃশ্বাস যেন একেকটা জয় হয়ে দেখা দেয়। রক্তের কণাগুলি ছুটে যেতে থাকে আর সেই ছুটে চলাকে সে সময় যেন অনুভব করা যায়। সেই অনুভূতির মাঝেও এক তৃপ্তি খুঁজে পাওয়া যায়। নিজের শরীরের প্রতিটা অঙ্গকে তখন একেকটা আশীর্বাদ মনে হতে থাকে। প্রতিটা অঙ্গ ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। সারাজীবন ধরে যে অঙ্গগুলি সাথে ছিল, প্রতিদিন যাদের সঙ্গে নিয়ে একের পর এক সফলতা ব্যর্থতার গল্প রচিত হয়েছে, হঠাৎ করেই সেই অঙ্গগুলির প্রতি এক অদ্ভুত মায়া কাজ করা শুরু করে। যেন তারা প্রত্যেকে একেকটা নতুন সত্তা। যে সত্তাদের এতদিন শুধু ব্যবহার করে নিজেকে উন্নত করা হয়েছে কিন্তু কখনো তাদের দিকে সেভাবে খেয়াল করা হয়নি। কখনো তাদের কৃতজ্ঞতা জানানো হয়নি। নিজের অতীতের দুঃখগুলিকেও সুখ মনে হতে থাকে। ভবিষ্যৎকে দেখার এক তীব্র আশা মনের ভেতর জেগে উঠে। যে আশা বারবার শুধু আকুতি জানায় ভবিষ্যতের মাঝে আর পাঁচটা মিনিট তাকে বাঁচিয়ে রাখার!

গত তিনদিন ধরে কোন রক্তের জোগান হয়নি। আমার শরীর অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছে। নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসছে। এখন খুব অদ্ভুত জিনিস চোখের সামনে ভাসে মাঝে মাঝে। সেদিন মাঝ রাতে চোখ খোলার পর দেখি এক বিশালাকার ব্যাগ আমার সামনে দাঁড়িয়ে। সেই ব্যাগ ভর্তি রক্ত। একদম টকটকে লাল রক্ত! আমি দেখা মাত্রই ব্যাগ থেকে রক্ত ফিনকি দিয়ে ছিটকে পড়তে থাকে। আমার গায়ে এসে লাগতে থাকে। আমি দেখি আমার হাত পা রক্তের দাগে লাল হয়ে আছে। আমি চিৎকার করে উঠি। তখনই চোখ খুলে দেখি সকাল হয়ে গেছে প্রায়। তাহলে কি স্বপ্ন? কিন্তু আমি যেন এখনো অনুভব করতে পারছি আমার শরীরে রক্তের ফোঁটা গুলিকে।

আরেকদিন আরো বীভৎস ঘটনা ঘটে। সেদিনের ঘটনার কথা ভাবলেই বুক কেঁপে উঠে। আমি দেখি আমার সামনে একজন বয়স্ক মানুষ এসে দাঁড়িয়েছে। উনার হাতে এক ছুরি। উনি ছুরি দিয়ে আমাকে ইশারা করছেন। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না উনার ইশারা। আমি তাকিয়ে আছি উনার দিকে। উনি হঠাৎ করে উনার দৃষ্টি স্থির করে তাকালেন আমার দিকে। তখন আমার শরীর ঠাণ্ডা হয়ে এলো। তারপর হুট করেই উনি ছুরি দিয়ে নিজের হাতের রগ কাটতে শুরু করলেন। কিছু মুহূর্তের মাঝেই উনার হাত থেকে রক্ত ছিটকে বের হতে লাগল। আমার মুখের সামনে এনে উনি হাতটা ধরে রাখলেন। আমার চুলে, গালে, সারা শরীরে রক্ত এসে পড়ছে। আমি অবশ হয়ে পড়ছি। এই হয়ত শেষ!”

রবিন পকেট থেকে বের করা একটুকরো কাগজে লেখা কথাগুলো পড়ে নিজেকে সংবরণ করতে পারছে না। হাতের সিগারেটের প্যাকেটটা কোথায় ফেলবে সেটাও বুঝতে পারছে না। প্যাকেট হাতে নিয়েই সে রিয়ার কবরের সামনে এসে বসলো। তার হাতের সাথে লেগে প্যাকেটের গায়েও রক্ত লেগে গেছে। তারপর রবিন পকেট থেকে একটা বোতল বের করলো। সেই বোতলের মুখ খুলে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো, “দ্যাখ বইন! তাজা রক্ত! তোরে এই রক্তের জন্যই বাঁচাইতে পারিনাই। আইজ কতজনের কাছ থেইকা রক্ত আইনা দিতাসি দ্যাখ। নিবি আরো রক্ত? বল খালি তোর ভাইরে কত রক্ত লাগব!”

হঠাৎ করে রবিনের কানে বাজতে থাকে কারো পায়ের শব্দ। কেউ যেন ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে তার দিকে। সে পিছন ফিরে তাকায়। না, কেউ নেই। কিন্তু সে শব্দ ক্রমশ বাড়তেই থাকে। হুট করে রবিনের চোখে ধরা দেয় এক ছায়ামূর্তি। কবরস্থানের দরজায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে।

(৪)

পুলিশের গাড়ি সবে মাত্র মির্জাপুর কবরস্থানে এসে থেমেছে। সকাল সাড়ে সাতটা বাজে। আশেপাশে মানুষ নেই বললেই চলে। শুধু একজন মধ্যবয়স্ক দাঁড়িয়ে। তার নাম সগির মিয়া। গাড়ি থেকে রাকিব আর ফজলুর সাহেব নামলেন। আধ ঘণ্টা আগে এই সগির মিয়াই তাদের ফোন দেয়। সগির মিয়ার সাথে ফোনালাপ থেকেই রাকিব জানতে পারে কবরস্থানে কোন এক অজ্ঞাত মানুষের জামা কুঁচকে পড়ে আছে। সেই সাথে বেশ কিছু জায়গায় রক্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।

“স্যার, আমি আইসাই দেহি এহানে ওই কবরখানের কাসে কে জানি বইয়া আসে। তয় আইন্ধার এর লেইগা চেহারা দেখবার পারি নাই। আমি তো পয়লা পয়লা ডরায় গেসিলাম। মনে কইসে কোন জিনটিন নি! পরে দিয়া কাসে যাইয়া দেহি ফাক্কা, খালি এত্ত খান জায়গা জুইরা রক্ত!”, সগির মিয়া কপালের ঘাম মুছতে মুছতে রাকিবকে বলে।

“আচ্ছা, আপনি ঘাবড়াবেন না। আমরা এসে গেছি এখন আমাদের উপর ছেড়ে দেন। লাশ টাশ দেখসেন নাকি সগির ভাই আশেপাশে?”, রাকিব বেশ চিন্তিত মুখে প্রশ্ন করে।

“স্যার, অহনো অত দেহি নাই। আমি তো রক্ত আর এই জামা দেইখাই পাগল হইয়া হায় আল্লাহ কইতে কইতে দৌড় মারসি!”

“ঠিক আছে সগির ভাই। আপনি আপাতত থানায় চলেন আমার সাথে। বেশ কিছু জিজ্ঞাসা আছে। আর ফজলুর সাহেব! আপনি এখানটা আরও ভাল করে দেখতে থাকেন। আর কবরটা কার সেটা খোঁজ লাগান।”

(৫)

বেলা এগারোটা। রাকিব থানায় বসে আছে। সামনে সগির মিয়া। তার হাতে রক্তাক্ত জামা। জামাটা নিয়ে বেশ কিছু পরীক্ষা করার আছে, ল্যাবে দিতে হবে। যতদূর শোনা যাচ্ছে আর কোন খুন হয়নি। তাহলে জামাটা কার? এত রক্ত কেন এতে? খুনির জামাই যদি হয় তবে এটা ফেলে গেল কেন এভাবে? আবার কবরগুলির উপরেও বা রক্ত কেন? খুনি কি কারো খুন করে কবরে মাটি চাপা দিয়ে গেছে? সেই মানুষের জামা এটা? কিন্তু আর তো কারো লাশ কিংবা নিখোঁজ হবার খবর পাওয়া যায় নি! তাহলে? উফফ। বেশ জটিল হয়ে যাচ্ছে সব কিছু। রাকিব বুঝে উঠতে পারছে না এবারের খুনের ঘটনাগুলি এমন অদ্ভুত কেন ঠেকাচ্ছে। আগে তো কখনো এমন হয়নি।

গন্ধ। জামার ভেতরে রক্ত ছাড়াও অন্য এক গন্ধ লেগে আছে। গন্ধটা খুব অপরিচিত কিন্তু বোঝা যায় গন্ধটা যার জামা হাতে বসে আছে সেই সত্তার। প্রতিটা মানুষের কিছু বিষয় একান্তই নিজের থাকে। সে বিষয়গুলির মাঝে একটি- সে মানুষের সাথে মিশে থাকা নিজস্ব এক গন্ধ। সেই গন্ধ মানুষের অস্তিত্ব জানান দেয়। সে মানুষ কাছে না থাকলেও তার ব্যবহার করা সামগ্রীগুলির মাঝে মিশে থাকা গন্ধ বারবার তার কথা মনে পড়ায়। হয়ত সে দূরে তবুও কোন এক পিছুটান থেকেই যায় সেই গন্ধের রেশ ধরে। কিন্তু এই গন্ধ যার সে কে? খুনির-ই গন্ধ কি? রাকিবের ফোনে কল আসে। মুহূর্তেই ফোন রেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে সে।

– ফজলুর সাহেব!

– জ্যা স্যার? আবারও খুন?

– নাহ, ফজলুর সাহেব। তবে আমাকে উঠতে হবে। বাসা থেকে কল এসেছে।

– কী হইসে স্যার? বড় কোন কিসু?

– আমার মেয়ে হুট করে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে বুঝলেন? বোধহয় ডেঙ্গু!

– হায় হায়, তাড়াতাড়ি যান! ইদানিং তো ডেঙ্গু বেজায় ভয়ানক হইয়া দাড়াইসে।

– আপনি একটু এদিকটা দেখে নিয়েন। আমি যাচ্ছি। মেয়েটার জন্য দোয়া করবেন। বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছে।

(৬)

মিডফোর্ড হাসপাতাল। কেবিন নাম্বার ৪০৫। রাত সাড়ে এগারোটা। রাকিবের সামনে তার মেয়ে শ্রাবণী শুয়ে। তার শরীর প্রচণ্ড গরম হয়ে আছে। হাতে নল লাগানো। ব্যাগের পর ব্যাগ রক্ত লাগছে। শ্রাবণী চোখ খুলে তাকাতে পারছে না। এবার সারা দেশে ডেঙ্গু বেশ ভালোভাবে প্রকোপ করেছে। হাজার হাজার মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে প্রহর গুনছে। আর সেই সাথে গুনছে রক্তের ব্যাগ! রাকিবকে বেশ দৌড়াদৌড়ি করে শ্রাবণীর জন্য রক্ত জোগাড় করতে হচ্ছে। তার স্ত্রী আবার এক কাজে ঢাকার বাইরে। সব কিছু একাই সামাল দিতে হচ্ছে তাই। তার উপর খুনের সংখ্যা বেড়েই চলছে। কী যে করবে সে!

– আব্বু, আমি মাকে খুব মিস করছি।

– খুব বেশি করছিস নাকি?

– হ্যাঁ, আব্বু।

– কিন্তু কিছু যে করার নেই, মা!

– রাতগুলি এমন হয় কেন আব্বু? সব মনে করিয়ে দিতে থাকে। আমি না সারাদিন বেশ ভুলে থাকতে পারি! নিজের মনের ভেতর আসতেই দেই না যে মা এখন নেই, জানো? কিন্তু রাতটা হলেই আর পেরে উঠি না। তখন নিজের মনের চারদিকে ধীরে ধীরে গড়ে তোলা দেয়ালগুলি যেন ভাঙতে থাকে। একে একে সেই দেয়াল ভাঙতে থাকে রাতের নীরবতা। খুব চেষ্টা করি সব অনুভূতিগুলো ফেলে দিয়ে ঘুমিয়ে যেতে। কিন্তু চোখ বন্ধ করতেও ভয় করে। পলক ফেললেই যে মাকে দেখি! কী করবো বাবা বলো?

– জানি না রে, মা!

– বাবা জানো? আমি এই রাতের নীরবতার মাঝেও মা-র হাসি শুনতে পাই। মা যেন একদম ঠিক আমার পাশে শুয়ে হাসছে! আর আমি তার বুকে জরিয়ে রেখেছি নিজেকে। তুমি কি মা-র হাসি শুনতে পাও?

রাকিব তার মেয়ের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিল। তারপর শ্বাস ফেলতে ফেলতে বলল, “পাই, বেশ শুনতে পাই।”

– আমার খুব খারাপ লাগছে বাবা।

– খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে রে মা?

কোন উত্তর পাওয়া যায় না। আমতা আমতা করে কিছু বলে শ্রাবণী। তার চোখ খোলা রাখতে পারে না আর সে। প্রায় বন্ধ হয়ে আসে। রাকিব ধড়ফড়িয়ে উঠে ডাক্তারের খোঁজে রুম থেকে বেড়িয়ে পড়ে। রাত বেশ হয়েছে। ডাক্তার পাবে কিনা সে কে জানে! তবে দেরি করা চলবে না। আল্লাহকে ডাকতে ডাকতে রাকিব বেড়িয়ে পড়ে। তার মেয়ের যেন কিছু না হয়।

(৭)

শ্রাবণী তার সামনে ঝুলতে থাকা রক্তের ব্যাগ এর দিকে তাকায়। কত রক্ত টলমল করছে সেই ব্যাগে। কত সহজে বাঁধাহীন ভাবে সেই রক্ত সরু সূচ বেয়ে ঢুকে পড়ছে তার শরীরের শিরায় শিরায়। আচ্ছা রক্তের লাল রঙ এত গাঢ় কেন? খুব চোখে লাগছে। মাথা ধরেছে অনেক। মা তুমি পাশে নেই কেন? তুমি কি বুঝতে পারছ না আমি কত কষ্ট পাচ্ছি? একবার কি এসে হাত টা ধরে পাশে থাকা যায় না? একটু সময়ের জন্য কি মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে পারো না তুমি? আমার হাতে অসহ্য যন্ত্রণা করছে। ইচ্ছা করছে সব খুলে রেখে চলে আসি তোমার কাছে। বেঁচে থাকার জন্য কি আসলেও রক্তের খুব প্রয়োজন? এত দাম কেন এর! কেমন স্বাদ এই রক্তের? তোমার মনে পড়ে ছোটবেলায় একবার আমার পায়ে কাঁচ ঢুকেছিল? কত রক্ত যে পড়ল সেবার। তুমি তো চিৎকার করে উঠেছিলে। তোমার মেয়ের জন্য হুলস্থুল এক অবস্থা করে ফেলেছিলে বাসায়। কিন্তু আজকে তুমি কেন আসছ না মা? আমি বোধ হয় আর পারব না। শ্রাবণী শুনতে পেল বাবার গলা।

– ডাক্তার, আপনি প্লিজ কিছু করেন।

– সরি মিস্টার রাকিব, আমার হাতে কিছুই করার নেই।

– কিন্তু এত রাতে আমি কীভাবে এত রক্ত জোগাড় করব?

– সেটা আপনার ব্যাপার, আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুক!

রাকিব তার হাতের ঘড়ি দেখে। ঘড়িতে কাঁটায় কাঁটায় বারোটা বাজে। এই সময়ে তিন ব্যাগ রক্ত কোথা থেকে জোগাড় করবে সে? সে নিজের রক্ত দিতে চাইলেও পারবে না। ধূমপান করার পাশাপাশি তার নিজের কিছু অসুখের কারণে তার রক্ত মেয়েকে দেয়ার ক্ষেত্রে বেশ কিছু রিস্ক দেখা যাবে। রাকিব ধপ করে সামনে থাকা চেয়ারে বসে পড়ল। হাসপাতাল ভর্তি মানুষ কিন্তু তার পাশে যেন কেউ নেই। সে যেন এতজনের মাঝে থেকেও এই শহরে একা! খুব একা। তার কপালে ঘাম এসে গেছে। কী করবে সে এখন?

হঠাৎ নিজের কাঁধে একজনের হাতের স্পর্শ অনুভব করে সে। সে ফিরে তাকায়। নাহ! চিনতে পারছে না মানুষটাকে। আগে কখনো দেখেনি। কিন্তু সেই মানুষ এর মাঝে কিছু একটা আছে যেটা রাকিবের চেনা। কী অদ্ভুত! তার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।

– রক্ত লাগবে স্যার?

– আপনি কে?

– আমি কে সেটা এখন আসল বিষয় না স্যার। রক্ত দিচ্ছি মেয়েকে বাঁচান।

এই কথা বলে এক মৃদু হাসি দিয়ে রবিন এক ব্যাগ টাটকা তাজা রক্ত রাকিবের হাতে তুলে দিল।

(৮)

– ইন্সপেক্টর রাকিব?

– জি স্যার।

– আরেকটা খুন। কারওয়ান বাজারে চলে আসুন। এক্ষুনি!

– কিন্তু স্যার আমার মেয়ের অবস্থা তো জানেন।

– উহু, কিছু শুনতে চাই না আর। এই মুহূর্তে আপনাকে লাগবে।

ডেপুটি ইন্সপেক্টর কামাল হোসেন বেশ কড়া মেজাজের মানুষ। রাকিব ফোন রেখে দিয়েই রক্তের ব্যাগ সিস্টার এর হাতে ধরিয়ে দিয়ে দ্রুত বের হয়ে গেল হাসপাতাল থেকে। বের হবার আগে শ্রাবণীর কাছে গিয়ে আরেকটা বার দেখার সময়ও পেল না।

রাকিব গাড়ি করে এগোতে থাকে আর তার বারবার শ্রাবণীর কথা মনে হতে থাকে। ওর মুখটা তার চোখে ভাসতে থাকে। মেয়ের এতটা কষ্টের সময়েও মেয়ের পাশ ছেড়ে তাকে চলে আসতে হয়েছে। যদি সে পারতো এসব কিছু ছেড়েছুড়ে মেয়ের পাশে গিয়ে বসে থাকতে! মেয়ের হাত নিজের হাতে নিয়ে তাকে যদি বলতে পারতো, এই তো বাবা আছি। ভয় কিসের? কিচ্ছু হবে না। তার মনে প্রায়ই প্রশ্ন জাগে তার ভেতর যে মেয়ের প্রতি কতটা ভালোবাসা আছে তা কি শ্রাবণী কখনো বুঝবে? সে তো দেখছে তার বাবা তাকে ফেলে রেখে তার সবচেয়ে কষ্টের সময়েও চলে যাচ্ছে। দেশের ঋণ শোধ করলেও মেয়ের কাছে যে ঋণী হয়ে গেল। মেয়ে কি কখনো মাফ করবে? হয়ত। ভাবতে ভাবতেই তার চোখে পানি চলে আসে। একজন ভাল ইন্সপেক্টর হতে পারলেও একজন ভাল বাবা আর হয়ে উঠা হলো না। জীবনের কাছে আমরা বেশ নিরুপায়।

হঠাৎ করে রাকিবের মনে পড়লো যে লোকটা তাকে রক্তের ব্যাগ ধরিয়ে দেয় তার ভেতরের কোন বিষয়টা তার চেনা। গন্ধ। যে গন্ধটা সে জামার ভেতরেও পেয়েছিল! সাথে সাথে রাকিব জোরে বলে উঠলো ড্রাইভার গাড়ি ঘুরাও। হাসপাতাল যাব। ফাস্ট।

(৯)

ফজলুর সাহেব থানায় বসে আছেন। তার মাঝে মোটেও চিন্তার রেখা নেই। বেশ আরাম করে মুখে পান নিয়ে চিবুচ্ছেন আর সাথে সাথে দাঁত এর ফাঁকে টুথপিক দিয়ে খুঁচিয়ে যাচ্ছেন। রাত্রি তখন সাড়ে বারো। সাধারণত এসময় তিনি কাজে থাকেন না। তবে আজকে থাকতে হচ্ছে। হঠাৎ করে টেলিফোন বেজে উঠল।

– ফজলুর সাহেব?

– জে স্যার, বলেন।

– এক্ষুনি একটা গাড়ি নিয়ে চলে আসেন আমার মেয়ে যে হাসপাতালে আছে সেটায়। আর কোন প্রশ্ন করবেন না। আমাদের হাতে সময় নেই।

– স্যার এহুনি আইয়া পড়তাসি। খুনি শালায় কি ধরা পড়সে স্যার?

– না। আপাতত আরো কিছু পুলিশের লোক লাগবে। এখুনি জোগাড় করে তাদেরকে হাসপাতালের আশেপাশের রাস্তাগুলোয় পাহারা দিতে বলবেন। আমি প্রতিটা লোকের তল্লাশি চাই। যারা যারা ঐ রাস্তা দিয়ে যাবে তাদের প্রত্যেকের। ইচ এন্ড এভরিওয়ান।

– স্যার, সব ব্যবস্থা হইয়া জাইব। ধইরা লন খুনি শালায় আইজকা শেষ।

ফজলুর সাহেবের কথা শেষ করার আগেই ফোন কেটে দেয় রাকিব।

রাকিব এক দৌড়ে হাসপাতালের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে লিফটে উঠে পড়ে। লিফট যত উপরে উঠতে থাকে ততই তার ভেতরে হৃৎস্পন্দন বাড়তে থাকে। এর আগে যতগুলি কেস সে সলভ করেছে কোনটাই এমন মানসিক বিকারগ্রস্ত খুনির বিপরীতে না। লিফট এসে থামতেই দ্রুত এগিয়ে যায় সে জায়গায় যেখানে সে বসে ছিল। নাহ। কোথাও সেই লোক নেই।

– সিস্টার, কিছুক্ষণ আগে ঠিক এই জায়গাটায় যে লোকটা বসে ছিল সে কোথায় গেছে দেখেছেন?

– কোন লোকের কথা বলছেন? আপনাদের আত্মীয় যিনি?

– আত্মীয় মানে?

– উনি তো বললেন আপনাদের আত্মীয় হন। সেজন্য রক্ত দিয়ে গেছেন। আপনি যাবার পর তো উনি আপনার মেয়ের রুমে তাকে দেখতেও গেলেন।

রাকিবের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এসেছে যেন। সে প্রায় পাগলের মত ছুটে যাচ্ছে মেয়ের কেবিনের দিকে। কপাল থেকে ঘাম ঝড়ছে। নাহ, মেয়েকে এভাবে ফেলে যাওয়াই উচিত হয় নি। তার হৃৎস্পন্দন আরও বেড়ে গেছে। তার হাত কাঁপছে রীতিমত। সে দরজার হাতলে হাত রাখল। আরেক হাতে শক্ত করে ধরে রেখেছে রিভলবার।

(১০)

– স্যার কামডা কি ঠিক হইতাসে?

– আপনার কি ভয় লাগছে ফজলুর সাহেব? ভয় লাগলে আপনি চলে যেতে পারেন। আমি একাই পারব।

– না না স্যার, কী জে কন! পুরাডা জীবন কত বদজাত ধইরা ধইরা খালাস করসি। এইডা তো বাইচ্চা পুলা। কিন্তু খালি আমরা দুইজন মিল্লাই আইসা পড়নটা কি ঠিক হইতাসে?

– বেশি জন নিয়ে আসলে সে টের পেয়ে যেত। আজকের সুযোগটা মিস করতে চাই না।

– কিন্তু শালার মাথাডা সমইস্যাটা কী? কবরের উপ্রে কী করতাসে এইসব? লগে জিন লাগে নাই তো আবার?

– চুপ করে থাকেন ফজলুর সাহেব। আমাদের পারফেক্ট মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

রবিন হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখছে তার বোনের কবর। তার চোখ থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। চারিদিকে নীরবতা। শুধু কিছু ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক শুনা যাচ্ছে। সেই ডাকের মাঝে কিছু সময় পর পর শুনা যাচ্ছে রবিনের ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠার শব্দ। জানস বইন? আইজও একটারে মাইরা আইসি। কিন্তু আইজ রক্ত আর তোর লেইগা আনলাম না। রবিন বেশ বড় করে এক নিঃশ্বাস ফেলল। আয় দেখি তোর মাথায় হাত বুলায় দেই। রবিন তারপর উঠে গিয়ে কবরের এক পাশে সরে হাত বুলাতে লাগল। ক্যান আইজকা রক্ত তোর লেইগা আনি নাই জিগাবি না? না, তুই ক্যান জিগাবি? তোর তো আমার উপ্রে রাগ। রাগ তো থাকবই। আমি সময় থাকতে তোর লেইগা রক্ত আইনা দিতে পারলে আইজকা কি আর তুই এহানে হুইয়া থাকতি? তুই থাকতি আমার লগে মাটির উপ্রে। রবিন আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। তার চোখ বেয়ে জল পড়তেই থাকে।

যেন পুরো কবরস্থান কেঁদে উঠছে এক ভাইয়ের আর্তনাদের সাথে সাথে। বারবার সে মাথা ঠেকিয়ে আফসোস করে যাচ্ছে। কিন্তু সময়কে ফিরিয়ে আনে কার সাধ্য? জীবনের বিনিময়েও না, রক্তের বিনিময়েও না। তোর জইন্নে আবার রক্ত আনমু নে বইন। চিন্তা করিস না। রবিন হুট করে মাথায় যেন কিসের স্পর্শ পায়।

– হ্যান্ডস আপ, মিস্টার রবিন। আমি ইন্সপেক্টর রাকিব। কোন চালাকি করতে গেলেই গুলি। এমনিতেও এতগুলি খুন করার পর তোমাকে মরতেই হবে। তাই এটাই ভাল হয় চুপচাপ আত্মসমর্পণ কর। তোমার সাহস আছে বলতেই হয়। আমার নাকের ডগায় এসে পার পেয়ে গেলে। কিন্তু আর নাহ!

– আমারে মারবেন? আমারে? রবিন অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। রাতের নীরবতা ভেদ করে সেই হাসি বিকট শুনায়।

– তোমার কি মনে হয়? এসব করে পার পাবে? তোমার কি মনে হয় আমরা জানি না সামনে থাকা কবরটা তোমার বোনের? আমরা জানি না যে প্রতিবার খুন করে তুমি এইখানেই আসো? রিয়া নাম, রাইট?

– আমার বইন দিয়া কী করবেন? নিজের মাইয়ার কাসে জান। তারে তো রুমের ভিত্রে গিয়া দেইখা আইসি। দেখতে ভালাই। রবিন আবার হাসিতে ফেটে পড়ে।

– আর না, তোর মত জানোয়ারকে সাথে করে নেয়ার কোন মানে নাই। এখনই শেষ করব। কিছু বলার থাকলে বল মরার আগে।

– শেষ হওন কী? শরীরের ভিত্রের মাংসের পচন ধইরা যাওন? রগে রগে ছুইটা চলা রক্ত থাইমা যাওন? শুধু এইগুলান-ই?

রাকিবের বেশ অদ্ভুত শুনায় কথাগুলি। সে স্তব্ধ হয়ে শুনতে থাকে।

– মনের পচন ধইরা গেলে মরণ আরও আগে আসে। এই কথা বলে রবিন মাটিতে কয়েক বার থু দেয়। আশেপাশের জাগো আপনে হাঁইটা চইলা যাইতে দেখতাসেন সব লাশ। ওইগুলার মন পইচা গেসে বহু আগে। আমার বইনরে কি ঐ কুত্তাগুলা রক্ত দিয়া বাঁচাইতে পারত না? দিসে? আমি খুনি হইলে অইগুলাও খুনি।

রাকিব কিছু বুঝে উঠার আগে রবিন পকেট থেকে এক ব্লেড বের করে নিজের হাতের রগ নিজেই কেটে ফেলে। রক্ত ফিনকি দিয়ে বইতে শুরু করে। রবিন চিৎকার করে উঠে। তবে সে চিৎকারের মাঝে শুধু কষ্ট নিহিত থাকে না। যেন প্রচণ্ড রকম হিংস্রতা গ্রাস করতে থাকে তাকে। নিজের রক্ত নিজের গায়ে মেখে হাসতে থাকে সে। রাকিবের পক্ষে আর সহ্য হয়না। রিভলবারে চাপ পড়ে। রবিনের দেহ রিয়ার কবরের উপরে ধুপ করে পড়ে যায়।

(১১)

– কীরে মা! মুখ দেখি পুরো শুকিয়ে গেছে। কেমন আছিস এখন?

– বাবা, তুমি আমাকে ফেলে চলে গেলে কেন?

– আমার কাজটাই এমন মা। রাকিব মুখে কিছুটা কষ্ট নিয়েই এক হাসি এনে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।

– বাবা, তুমি কোথায় গিয়েছিলে?

– খুব পচা এক মানুষকে ধরতে। যাকে মেরে তোমার বাবা এখন দেশের হিরো। এই কথা বলে পাশে থাকা ডাক্তার মুচকি হাসি দিয়ে উঠে।

– আরেহ না, কী যে বলেন! আপনাকে ধন্যবাদ আমার মেয়ের এত দেখাশুনা করে সুস্থ হওয়া পর্যন্ত তাকে সময় দেয়ার জন্য।

– এতো আমার দায়িত্ব ইন্সপেক্টর সাহেব। বাই দা ওয়ে সময় মত রক্ত পাওয়ায় বাঁচানো গেছে। ভাগ্যিস জোগাড় করতে পেরেছিলেন আপনি। নাহলে কিন্তু সিচুয়েশন আর আমার হাতে থাকতো না।

রাকিব রিমোট হাতে নেয়। “অবশেষে গত এক সপ্তাহের মাঝে জোড়া খুনের আসামি পুলিশের হাতে নিহত। দেখে নিন এই নরপশুর চেহারা। তাকে সবাই রবিন নামেই চিনে। শিমুলপাড়া আর কারওয়ানবাজারে খুন করার পর শেষমেষ এই মানুষরূপী পশু ধরাশায়ী। বিস্তারিত খবর জানতে পারবেন পরবর্তীতে।” খুব বড় এক নিঃশ্বাস ফেলে রাকিব টিভি অফ করে দেয়। তারপর মেয়ের দিকে তাকায়। তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে মেয়ের হাসি দেখতে পায়। কী মিষ্টি করে হাসে!

রাকিব জানলায় এসে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ বাইরে তাকিয়ে থাকে। তার মাথায় পশু শব্দটা ঘুরপাক খেতে থাকে। সে খুব একটা সিগারেট খায় না। তবে আজ অনেকদিন পর হাতে সিগারেট নিয়ে একের পর এক টান দিতে থাকে। সে তার জীবনে অনেক খুনি দেখেছে। কিন্তু এই প্রথম একজনকে পশু বলতে তার দ্বিধা হচ্ছে। যতবার মেয়ের মুখের দিকে তাকাচ্ছে ততবারই নিজের গুলিতে বুক ছিন্নভিন্ন করে দেয়া পশুর প্রতি কৃতজ্ঞতা তৈরি হচ্ছে। সে কীভাবে পারল হত্যা করতে? বলা হয়, যুদ্ধ সবচেয়ে নিরীহ মানুষকেও হিংস্র করে তুলে। জীবনও তো এক ধরনের যুদ্ধ। এই যুদ্ধেও কি কোন এক পর্যায়ে নিরীহ সত্তার মাঝে পশুত্ব জেগে উঠতে পারে?

রাকিব পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ বের করে। এই কাগজটা সে গত রাত্রে যখন রবিনের সন্ধানে কেবিনে ঢুকে তখন শ্রাবণীর বিছানার পাশের টেবিলে পড়ে থাকতে দেখে। রাকিব কাগজটা মেলে ধরে চোখের সামনে।

“আপনের মাইয়ারে দেইখা আমার নিজের বইনের কথা মনে পইরা গেসে। তারেও এ্যাম্নেই কেবিনে শুইয়া থাকবার দেখসিলাম। আপনের আরও রক্ত লাগলে মালিবাগের ব্লক বি তে ২৩/৪ বাড়িত যাইয়েন। সেইহানে আরও কয়েক ব্যাগ রক্ত থুইয়া আইসি।”

লেখাগুলি পড়ে রাকিব চোখ মুছতে থাকে। কাগজের টুকরোটা সে সারাজীবন নিজের কাছে যত্ন করে রাখবে।

(শেষ)

লেখক পরিচিতি

আমি মোহাম্মদ হাসিন ইশরাক। জন্ম কুমিল্লায়। ১৯৯৮ সনে। বর্তমানে ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজিতে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছি। লিখালিখি করি শখের বশে। কলেজ থেকেই লিখালিখির সাথে সম্পৃক্ত। নটরডেম লেখককুঞ্জ ক্লাবে দুই বছর কাজ করার ভেতর দিয়ে এর প্রতি প্রবল আগ্রহ গড়ে উঠে।

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post কালো বেড়ালের কবলে | ভয়ের দেশ |ময়ূরিকা মিত্র| Bengali Horror Story
Next post শূন্য স্মৃতি| প্রেমে পড়া বারণ | তাসফিন মাহমুদ অমি| Bengali Love Story