নাইট ল্যাম্পের নীলচে আলোটা ছড়িয়ে পড়ছে ঘরের চতুর্দিকে। দেখা – না – দেখায় মেশা আলো আঁধারির যেন অদ্ভুত কোন খেলা। নিকষ কালোয় গা ঢাকা দেওয়া ঘরের প্রতিটা কোণে একাকীত্বের চারাগাছগুলো আজ তরতরিয়ে বাড়ছে। কে জল দেয় ওই গাছে? কে দেয় সার? কার প্রশ্রয়েই বা এমন অপ্রতিরোধ্য গতিতে বেড়ে উঠছে এরা? শোবার ঘরের কাঁচের জানলার ধার ঘেঁষে এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়ায় দয়িতা। জানলা পেরিয়ে উল্টোদিকের বারান্দায় দুটো ছায়ামূর্তি। সজোরে মাথা নাড়ছে, হাত ছুঁড়ছে কখনও, কাছে এসে ধাক্কা দিচ্ছে, আবার পলকে সরে যাচ্ছে যেন কয়েক যোজন দূরে। যেন জীবন্ত কোন নির্বাক চলচিত্র। এমন ভাবেও দূরে সরে যাওয়া যায়? নিঃশব্দে, চুপিসারে? হাতের ফোনটায় আবারও চোখ চলে গেছে। ফোনে বিশেষ মানুষটির জন্য বিশেষ রিংটোন সেভ করা। তার ডাক নির্ভুল কান অবধি পৌঁছে যাবে। সবটা জানে দয়িতা। তবু বারবার চোখ চলে যায়। খানিকটা বদভ্যেসের মত। একটা পরিচিত উত্তেজনা। হাইস্কুলে পড়তে এক একটা মুখ দেখলেও এমনি হত; মনে হত আবার দেখি, আরেকটি বার। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি আসতে গিয়েও মিলিয়ে গেল, যেন মেঘলা দিনের সূর্য। ছায়ামূর্তি দুটো অপেক্ষাকৃত ঘন হয়ে এসেছে। জানলার পর্দাটা ঝটিতি টেনে দেয় দয়িতা। বিচ্ছেদের অভ্যেসে প্রণয়ের প্রলেপ আর নাই বা পড়ল।
ল্যাভেন্ডার ডিফিউজারের গন্ধটা নাকে আসতে চোখ বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে দয়িতা। ডানহাতটা আলগাভাবে ঝুলছে চেয়ারের হাতল থেকে। অন্য হাতের আঙুলগুলো অন্যমনস্কভাবে টুলের ওপর রাখা ব্রোকেন হার্টের বিচিত্র পাতা ছুঁয়েছে। গেল বছর ঠিক এই সময়টাতেই অফিসের সামনের একটা নার্সারি থেকে গাছটা কিনে এনেছিল দয়িতা। প্রথম কদিন যত্নের আতিশয্য, যেন বাড়ির নতুন বউ। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে পাশে এসে দাঁড়ানো, নেট ঘেঁটে তার পরিচর্যার নিয়মটুকু শিখে নেওয়া। তারপর কবে কখন অভ্যেসে মিশে গেছে মনে পড়ে না দয়িতার। হপ্তায় দুবার জল, গরমের সিজনে আলগা মাটিতে সামান্য সার… এই সামান্য যত্নেই হাত-পা ছড়িয়ে বেড়েছে গাছটা। লতানে শাখা প্রশাখা চতুর্দিকে বিস্তার করে সে আজ নিজের অস্তিত্ব জাহির করে সবার নজর কাড়তে চায়। পারে না। ঠিক যেমন পারেনি দয়িতা। তার পছন্দে অপছন্দে একান্ত আপন করে সাজিয়েছিল নিজের ছোট্ট জগত। জানলায় টাঙানো নেটের পর্দা থেকে খাবার টেবিলের ক্রচেট রানার… দু-কামরার ফ্ল্যাটটায় সর্বত্র তারই হাতের ছোঁয়া। সব কিছুতে থেকেও যে কীভাবে না-থাকার দলে নাম লেখানো যায়!
কোলের ওপর ফোনটা কবার ভাইব্রেট করতেই ভ্রুযুগল সামান্য কুঞ্চিত। চোখ খুলেই মুহূর্তে ফের বুজে ফেলে দয়িতা। অন্ধকারের এক সুবিশাল বৃত্তের কেন্দ্রে তার বসবাস। অন্ধকারটাই এতদিনে চোখ সওয়া। ফোনের সামান্য আলোতেই যেন ঝলসে ওঠে সবটা। যেন তার দৃষ্টি এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়ে যায় সুতীব্র কোন ফ্ল্যাশের লাইট।
আজ অফিসে লাঞ্চের পর থেকেই অস্বস্তিটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সেকেন্ড হাফে শুভেন্দু দয়িতার প্রমোশনের খবরটা পাকাপাকি ভাবে জানিয়ে দিল সবাইকে। বন্ধুমহলে এক ধাক্কায় সাধারণ নাগরিক থেকে সেলিব্রিটি। অফিসের শেষে কেক মাখামাখি, ক্যামেরার পটাপট ফ্ল্যাশে বন্দী নিজস্বী। কারা যেন এক ঝটকায় অন্ধকার থেকে আলোর কোন বৃত্তে এনে আসীন করেছে দয়িতাকে। এদের সবাই কি সত্যিই চায় দয়িতা আজ আলোয় ভাসুক? সুতীব্র কোন আলোর কেন্দ্রে বসে অনভ্যস্ত চোখে দয়িতা বুঝতে চেয়েছে সবটা। বাইরের কোলাহল, হাততালি সেই থেকে আবছা কোন শব্দের মত মাথার পেছনে বেজে চলেছে। সন্দেহ যেন বদ কোন নেশা, বড্ড ছোঁয়াচে। মানুষ থেকে মানুষের প্রতি ছড়িয়ে পড়ে।
ফোনের নম্বরটা চেনা, নাম ফুটে উঠেছে। ফোনের স্ক্রিনে আঙুল চালিয়ে কানে ধরে, “বল, শাল্মলীদি…”
“আমি কি বলব রে, আজ তো তুই বলবি,” হাসছে শাল্মলী, “এত বড় একটা খবর। অফিসে সবাই ঘিরে ছিল তোকে। তাই তখন আর পারসোনালি উইশ করা হয়নি। তা, হবু বরকে জানানো হয়েছে? কি বলছেন সুজয়বাবু?”
গত দু ঘণ্টায় ফোনের কল-লগ জুড়ে থাকা নামটা হঠাৎ কেমন ছ্যাঁকার মত লাগে দয়িতার। এক একটা নাম কেমন অজান্তেই অস্তিত্বের অংশ হয়ে ওঠে। জড়িয়ে থাকে আপাদমস্তক। হিসহিসিয়ে বলে – রেহাই নেই। যেমন চিরটাকাল সকলের মুখে শুনে এল দয়িতা, মায়ের নাকি একটাই পরিচয়, মা প্রফেসর চৌধুরীর স্ত্রী। মা কোনদিন ওই পরিচয়টা থেকে বেরোতে পারেনি। অবশ্য বেরোতে চেয়েছিল কিনা সেটাও এখনও অজানা রয়ে গেছে দয়িতার। কিন্তু ওর নিজের বেলা? চাইলেই কি সবকিছু পাওয়া যায়? এই বাড়ির সদর দরজায় যে নামটা বড় বড় হরফে শোভা পায়, সোসাইটির বিল থেকে ইলেক্ট্রিক বিল, সবেতে ওই একটাই নাম। সুজয়। এমনকি টেবিলের ওপর রাখা ওই লাল ভেলভেটের বিয়ের কার্ডটার ওপরেও। যার নামের সাথে একদিন স্বেচ্ছায় জড়িয়েছিল নিজের নাম, তার জীবনের সঙ্গে নিজেকে জড়াতে এতটা ঠেকছে কেন আজ? অবিরাম প্রশ্নগুলো বিশ্বচরাচরব্যাপী মেঘের মত ঢেকে রাখে আর সব কিছু।
“কি রে, চুপ কেন? জানাসনি সুজয়কে?”
শাল্মলীর গলায় নড়ে চড়ে বসে দয়িতা। ঠোঁটের কোণে জোর করে হাসির রেখা টেনে বলে, “তিনি বড় ব্যস্ত মানুষ, শাল্মলীদি। দয়িতার মত সামান্য ব্যাঙ্কের কেরানীর খবর রাখতে বয়েই গেছে তাঁর। সামান্য কেরানীর আবার প্রমোশন! এর চেয়ে ঢের ঢের ভাল খবর রোজ পাতে পড়ে ওঁওঁর। বিশ্ব সংসারের সৃষ্টি রহস্য উদ্ঘাটনের ভার নিয়েছেন যিনি, তাঁর কি হবু বউয়ের প্রমোশনের খবরে আটকা পড়লে চলে? প্রতিনিয়ত তাঁর চোখের সামনে মহাজগতের উপুড় করা ডালা। আমি বুঝি গো, এত সামান্য খবর তাঁকে বিস্মিত করে না। অহেতুক এই ছেলেমানুষি উচ্ছ্বাসও যে মানায় না তাঁকে।”
হাসিচ্ছলে কথাটা বললেও ভেতর থেকে উঁকি মারা অভিমানী সুরটা ঠিক ধরতে পেরেছে শাল্মলী। অভিমানের ভাষা গরগরিয়ে পড়ে ফেলা যার তার কম্ম নয়। সে ভাষায় রীতিমত দখল থাকা চাই। তারও কি অভিমান কিছু কম আছে! কিন্তু সব অভিমানদের সামনে আনতে নেই, কথাটা জানে শাল্মলী। তাই গোপনেই তাদের বেড়ে উঠতে দেয়। দলা পাকিয়ে আসা দুঃখটাকে গলা পথে ঠেলে দিয়ে জানতে চায়, “কি রে দয়ি, আজও কি সে বড্ড ব্যস্ত?”
না বলতে পারা রিনরিনে বুকের ব্যথার কারণটুকু যখন অন্য কেউ বুঝে ফেলে, তখন বোধহয় কষ্টটাকে বেঁধে রাখা যায় না আর। বাঁধভাঙা সর্বগ্রাসী জলের তোড়ে ভেসে যায় মনের প্রতিটা ইঞ্চি। একটুখানি সময় ফুঁপিয়ে কাঁদল দয়িতা, একেবারে বাচ্চার মত। আস্তে আস্তে হালকা লাগছে একটু, জমাট বাঁধা মেঘটা গলছে অল্প অল্প। ধরা গলায় বলল, “এসে থেকে বার কয়েক ফোন করেছি। একবারও ধরল না। পরে অবশ্য মেসেজ করেছে। প্রথমবার লিখেছে কাজে ব্যস্ত, পরেরবার বন্ধুর বাড়ি নৈশভোজে। কাজ, বন্ধু, ক্লাব… ওর এই সব কিছুতে আমি কোথায়, শাল্মলীদি? এত সব কিছুর কোলাহলে আমার অন্তস্থ নৈঃশব্দ্যটুকু কেমন করে ধরবে ও, বলতে পার? কলকাতা থেকে পুনে, এমন কী দূরত্ব? এই বাড়িটায় আমার আর থাকতে একটুও ভাললাগে নাগো। একা… সম্পূর্ণ একা। ওই একটা নামের গন্ধ চারিদিক থেকে ঢেকে রাখে শুধু। দমবন্ধ লাগে।”
নিশ্চুপে কথাগুলো শুনছিল শাল্মলী। কাছের, খুব কাছের কোন মানুষ কাঁদলে কেমন লাগে? শাল্মলীর মনে পড়ে, ছেলেবেলায় সে কান্নাকাটি জুড়লে বাবা কেমন পালাত। দরজার পেছনে লুকিয়ে চোখের জল মুছে আবার ফিরে আসত। বাবার রোগটা পেয়েছে শাল্মলী। বেশি কথা না বাড়িয়ে ফোনটা কেটে দিয়েছে। পালিয়েছে। অদৃশ্য কোন দরজার পেছনে। ঠিক বাবার মত।
ফোনটা নামিয়ে রেখে ভাবে দয়িতা, শাল্মলীদি রেখে দিল? শাল্মলীদি ঠিক ঠিক চেনে দয়িতাকে। ওর কোনটা কখন দরকার, মন কেমন, রাগ, অভিমান… সবটা। অথচ এতগুলো দিন পরেও নিজেকে কেমন রহস্যের জালে জড়িয়ে রেখেছে। যেন দুর্বোধ্য হায়ারোগ্লিফিক। এতদিনের চেষ্টাতেও ওর মনের অলিগলির কতটুকুই বা চিনেছে দয়িতা? সময়টা তো নেহাত কম হল না। নয় নয় করেও প্রায় দেড় বছর তো হবেই। তখন সদ্য প্রেমে পড়েছে দয়িতা। সুজয়ের সাথে। ম্যাট্রিমনিয়াল সাইটেই আলাপ, ফোন নম্বর চালাচালি, বাড়িতে বাড়িতে যোগাযোগ, কুঞ্চিত কদাচিৎ সম্মুখ দর্শন। বিয়ে দেওয়ার তাড়া দুই পক্ষেই ছিল না। সবাই চাইত, ছেলে-মেয়ে দুটো আরও একটু এগোক কর্মজীবনে, নিজেদের পায়ের তলার মাটিটুকু শক্তপোক্ত করুক আগে। সব যখন ঠিক হয়েই আছে, তখন বিয়ের দিন তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না। দেখতে দেখতে মাসখানেকের মধ্যে কলকাতার একটা ব্যাঙ্কে চাকরিও পেয়ে গেল দয়িতার। বর্ধমান থেকে ডেলিপ্যাসেঞ্জারি নাকি বাড়ি ভাড়া, এসব ভাবতে ভাবতেই সুজয়এর কাছে, সুজয়ের কলকাতার ফ্ল্যাটে এসে থাকার কথাটা পাড়ে। সে থাকে পুনেতে, চাকরি সূত্রে। কলকাতার ফ্ল্যাটটা ক’বছর ফাঁকাই পড়ে আছে। অবশ্য দয়িতার পরিবার রক্ষণশীল, প্রথমে মানতে নারাজ। শেষ পর্যন্ত সুজয়ের বাবা মায়ের প্রশ্রয়েই উদয়ন সোসাইটির সাত তলার এই দু কামরার পায়রার খোপে এসে ওঠে দয়িতা। চাকরিতে ঢোকার হপ্তাখানেকের মধ্যেই খানিকটা কাকতালীয় ভাবেই দয়িতার পরিচয় হয় শাল্মলীদির সাথে। একই ব্যাঙ্কের চাকুরে। এই একই সোসাইটিতে বাড়ি। বৃদ্ধা মাকে নিয়ে একাই থাকে। সেদিন থেকে আজ অবধি এক সাথে যাতায়াত, বন্ধুত্ব, আড্ডা… অফিসে সবাই ওদের দুটিকে ডাকে হরিহর আত্মা। মাঝে মাঝে আজও ভাবে দয়িতা, শাল্মলীদির মত শক্ত খুঁটিটা না পেলে নতুন শহরে একা টিকে থাকতে পারত? হাতে ধরে সবটা শিখিয়েছিল, উত্তর কলকাতার অলিগলি চেনা তারই পায়ে পা মিলিয়ে। দয়িতা যে একা, কক্ষনো বুঝতেই দেয়নি। ছাতার মত আগলে রেখেছে সবটুকু সময়। প্রথম প্রথম সুজয়ও দিনে তিন চারবার ফোন করত দয়িতাকে। ঘুম থেকে উঠে, লাঞ্চ টাইমে, বিকেলে, আবার রাতে শুতে যাওয়ার আগে। কত যে গল্প, কত কথা। হাঁকপাঁক করত। সারাদিনের খবর না জানলে বুঝি তার ভাত হজম হত না। এক একটা ফোনালাপে যেন অপরিচিতার অন্দরমহলে হানা দেওয়ার কোন অদম্য ইচ্ছা ছিল তার ভেতর। আর আজ…? জানার তীব্র বাসনাটুকু ফুরিয়ে গেলেই কি বাকি সবকিছু অভ্যেস হারিয়ে যায়? এক ঘেয়ে হয়ে যায় অতি পরিচিত মানুষটাও। ব্যস্ততা তো আসলে একটা অজুহাত, তাই না? কথাটা কোথায় যেন পড়েছিল দয়িতা।
ঘড়ির কাঁটা সাড়ে এগারো ছাড়িয়ে এগিয়েছে আরও কিছুটা, একটা অজানা আশঙ্কা ক্রমশ ঘিরে আসছে দয়িতাকে। বারোটা বাজতে তো আর বিশেষ দেরি নেই। বছরের এই বিশেষ দিনটার কথাও কি ভুলে যাবে সুজয়? গত বছর এই দিনে কত প্রতিশ্রুতি দিয়েই না সে বেঁধেছিল দয়িতাকে। অবশ্য তার বেশির ভাগটাই শুধু চাওয়া। আজ বোঝে দয়িতা, নিঃস্বার্থ হতে শেখেইনি কোনওদিন মানুষটা। দয়িতা তো তাকে অদেয় কিছুই রাখেনি। নিশ্চয়ই সবকিছু ভুলে যায়নি সুজয়? অন্তত এই একটা দিনের কথা…। এক একটা মিনিট যেন এক একটা প্রহর। সম্ভব অসম্ভবের দোলাচলে অবিরত কাঁপছে বুকটা। নিস্তব্ধ ঘরে কান না পাতলেও শোনা যায় তার শব্দ। ঘন হয়ে আসা নিঃশ্বাসে আতঙ্কিত চোখের জল ঝরে পড়ার আগেই মুহূর্তে বাষ্প হয়ে উড়ে যাচ্ছে। গোপনে যেন কোন প্রশ্নপত্র সাজিয়ে বসেছে দয়িতা। এই পরীক্ষায় আজ তার হার-জিত যেন বলতে পারে অনেক কিছু, দিতে পারে কঠিন কোন রায়। ফোনের স্ক্রিনে নিবদ্ধ শান্ত চোখদুটোর আড়ালে কেউ কি ফিসফিসিয়ে বলছে আজ দয়িতা হেরে যাবে? পরক্ষণেই কিসের জোরে বুক বাঁধছে আবার? অপেক্ষার আপাত দীর্ঘ সময়টা ক্রমশ কমতে কমতে আর মাত্র কয়েকটা সেকেন্ড। একটা আওয়াজ হলেই ছিটকে উঠে ফোন ধরবে দয়িতা, ক্ষমা করে দেবে বাকি সব কিছু।
ঘড়ির কাঁটা অবশেষে বারোটা ছুঁয়েছে। একটা টুংটাং শব্দে ভরে উঠেছে সমস্ত ঘর। চমকে উঠেছে দয়িতা। একি তারই ফোনের শব্দ? অপাঙ্গে চেয়ে দেখছে ফোনটার দিকে। অন্ধকার স্ক্রিনে সে তো তেমনি ঘুমিয়ে আছে। বরং আওয়াজটা আসছে দরজা থেকে। কেউ বেল টিপেছে, এত রাতে…? মুহূর্তে জেগে ওঠা আশার একটা গ্যাস বেলুন ফেটেছে, ঝনঝন শব্দে ভাঙছে তিলে তিলে গড়ে তোলা কাঁচের কোন সুবিশাল তোরণ। আরেকবার বাজছে বেল।
নিজের হাতে বানানো কেকটা খাবার টেবিলে নামিয়ে দয়িতাকে জড়িয়ে ধরেছে শাল্মলী। আলতো হাতে ওর খোলা চুলে হাত বুলিয়ে কানের কাছে ফিসফিস করে বলে, “আরেকটা বছর বুড়ি হয়ে গেলি রে পাগলি। শুভ জন্মদিন। জানতাম তোর মন খারাপ, তাই ফোন না করে এই অসময়ে তোর বাড়িতেই আসতে হল। চল, একবার নিচে যাবি? ভাল লাগবে। বাইরের বেঞ্চিটায় বসলে যে বলিস ভাললাগে?
দয়িতার চোখের কোল বেয়ে এক ফোঁটা জল শাল্মলীর পিঠ ছুঁয়েছে। সত্যি কি আর কেউ ওকে এভাবে বোঝে? কোনদিন বুঝেছে…?
রাতের আকাশ দেখতে বরাবর ভারী ভাল লাগে দয়িতার। রবিঠাকুরের ওই গানের লাইনটা… আঁধারের গায়ে গায়ে পরশ তব সারারাত ফোঁটাক তারা নব নব। ছেলেবেলায় খুব গাইত দয়িতা। সন্ধ্যে হলেই ছাতে উঠে যেত। কালপুরুষ, সপ্তর্ষিমণ্ডল… বাবা চিনিয়ে দিত। ভারী ভাল লাগত। যখন তখন মন উজাড় করে কথা বলত তাদের সাথে। অন্ধকারের বুকে কত আলোকবিন্দু। সর্বগ্রাসী বেদনার অন্ধকারে আকাশের দিকে তাকিয়ে আজও তেমনি ছোট ছোট আলো হাতড়ে বেড়ায় তাই দয়িতা। এই যেমন শাল্মলীদি। অনেকটা ধ্রুবতারার মত। সবচেয়ে উজ্জ্বল। অফিসে ওদের একসাথে দেখে মাঝে মধ্যে চোখ টিপেছে অনেকে। কান অবধি উড়ে এসেছে কত ফিসফাস। তবে ওই কান অবধিই। কোনদিনই সেসব কথায় পাত্তা দেয়নি দয়িতা, দিতে মন চায়নি। মানুষটা যে বড্ড ভাল। স্বপ্রভ। নিজে জ্বলে অন্যকে আলো দেয়। এমন ভাল মানুষটা কোনদিন নিজে বিয়ে করল না কেন? খুব জানতে ইচ্ছে করেছে দয়িতার। আজ প্রশ্নটা করেই ফেলল।
আগে কক্ষনো এমন চমকাতে দেখেনি শাল্মলীদিকে। টুকুন সময় চুপ করে রইল, তারপর আস্তে আস্তে মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিল। দয়িতা হাতের ওপর হাত রেখেছে শাল্মলীর। বলল, “কি গো, আমাকেও বলা যায় না? অফিসে ওরা যা বলে…”
“ঠিকই বলে…” দয়িতার মুখের কথাটা কেড়ে নিয়ে ফিরে তাকিয়েছে শাল্মলী, “ঠিকই বলে ওরা। ইউনিভার্সিটিতে পড়তে একজনকে ভাল লাগত। সমাজ সেদিন মানেনি। আইনও মানেনি। একা মা কত আর সামাল দিত? আমার নাকি রোগ হয়েছে… লোকের আরও কত খারাপ কথা…”
“আর এখন? আইনে তো আটকায় না আর…”
শাল্মলীর মাথা নিচু, চিবুক বুক ছুঁয়েছে। আলতো ঘাড় নাড়ল, “স্বামী পুত্র নিয়ে তার এখন ভরভরন্ত সংসার। আর সে ভাল লাগাটাও নেই। এখন নতুন করে… ভয় করে।”
“সত্যি কাউকে ভালোবাসো না এখন? নাকি বলতে চাও না?” দয়িতা সরু সরু চোখে যেন ভেতর অবধি মেপে নিতে চায়। শাল্মলী নিশ্চুপ। পাথরের মত স্থির। দেখে মুচড়ে ওঠে দয়িতার বুক। ভালবাসা… প্রেম… সাহিত্য থেকে রুপোলী পর্দার সর্বাধিক আলোচিত শব্দটা নিজেও কেমন ধোঁয়াটে। ভালবাসা কি কেবল একটা আকর্ষণ? চুম্বকের দুই বিপরীত মেরুর মত? নারী-পুরুষ… পুরুষ-নারী…? কেন, ভালবাসা মানে বন্ধুত্ব নয়? পাশে থাকা নয়? লিঙ্গ নির্বিশেষে? কে ভালবাসে দয়িতাকে? সুজয়…? যার সারাদিনের কর্মকাণ্ডে থেকেও নেই দয়িতা? ফোনালাপের ভেতর দিয়ে যে কোনদিন পারে না দয়িতার দুঃখগুলোকে ছুঁতে? কোনদিন যে দয়িতার মনের খবর রাখেনি? কেজো গলায় “ভাল থেকো” বলেই যে তার দায় মিটিয়েছে? সেই মানুষটা? নাকি অন্য কেউ? এমন কেউ যে সত্যিই ভাল রাখতে জানে, পাশে থাকতে জানে, আনন্দ দুঃখের শরিক হতে জানে? যার কাছে দয়িতার মন কোন স্বচ্ছ সেলোফেন। একজন যে নিঃস্ব হবে জেনেও দুহাতে শুধু দিয়ে গেছে? কে রাখে দয়িতার মনের এমন হিসেব? উত্তরটা বোধহয় জানে দয়িতা। তাই অজান্তেই বোধহয় একবার কেঁপে ওঠে। ভালবাসার সংজ্ঞাটাই আজ বদলে দেবে দয়িতা। অসংখ্য প্রত্যাশার হট্টগোল আর কিছু ধাঁ-চকচকে সামাজিকতার সুদৃশ্য মোড়কে সেজে আসা সম্পর্কে আর যাই হোক, ভালবাসাটা এতদিনেও খুঁজে পায়নি দয়িতা। বরং, একসাথে পাশাপাশি বসে রাতের আকাশে তারা দেখে যে, চোখের ভাষা যে নিঃশব্দে পড়ে ফেলে, চোখের জল মোছাতে জানে যে, সেই তো জানে প্রেমের আসল মানে।
শাল্মলীর হাতে রাখা হাতটা আরও শক্ত করে দয়িতা, “ভালবাসো তো, বিয়ে করবে আমায়?”
সোজা হয়ে বসেছে শাল্মলী, বুকের মধ্যে যেন ঢাক বাজছে। গমগমে। আকাশে একসাথে এক হাজারটা বাজির রোশনাই। কারা যেন লাফাচ্ছে সমস্ত শরীর জুড়ে। এক নিমেষে যত বস্তাপচা ক্লিশের তলায় স্বেচ্ছায় চাপা পড়ছে মন। সহস্র প্রাণের শক্তি নিয়ে দয়িতার চোখে চোখ রাখে। অন্ধকারেও পরিষ্কার দেখে শাল্মলী, একজোড়া জ্বলজ্বলে চোখে নিজের চোখের প্রতিফলন।