শেষ থেকে শুরু| প্রেমে পড়া বারণ | দেবজিৎ মাইতি| Bengali Love Story
0 (0)

Getting your Trinity Audio player ready...

ছোট গাড়িটা ঠিক যেখানে নামাল তার উল্টো দিকেই সুন্দরবন ফরেস্ট, সামনে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে একটা ছোট খাল, ভাটার জন্য জল একেবারে নীচে নেমে গিয়ে কাদামাটি দেখা যাচ্ছে। দুটো নৌকা উল্টানো অবস্থায় পাড়ে রাখা আছে। অনিন্দ্যর সামনে ঢালু কাঁচা-পাকা একটা রাস্তা। রাস্তার দুই পাশে প্রথম দিকটা কিছু বাড়ি ছিল তারপর কিছুটা বিস্তৃত মাঠ, রাস্তার একদম গা ঘেঁষে সারিবদ্ধ ভাবে লাগানো আকাশমণি গাছ।

বেশ কিছু দিন হল সে এখানে এসেছে শিক্ষকতার চাকরি নিয়ে, প্রকৃত শহর থেকে দূরে বনানী আবৃত একটা গ্রামে, যেখানে বিদ্যার দেবী মনোনিবেশ করলেও বিদ্যুতের দেবী পদার্পণ করতে পারেনি, তার কারণ সন্ধ্যা অবতীর্ণ হলেই এখানে অন্ধকার বিরাজমান। এত দূরে চাকরি কেন নিল এটার একটু ধোঁয়াশা তার নিজের মধ্যেও আছে, জীবনে একটা নিদিষ্ট সময়ের পরে ছেলে-মেয়েরা মা-বাবার বটগাছের ছায়াতল থেকে বেরিয়ে সাবলম্বি হওয়ার চেষ্টায় এমন পদক্ষেপ নিয়েই থাকে তা ছাড়াও আরও অনেক অপ্রাসঙ্গিক কারণ তো থাকেই। স্কুলটাতে পঞ্চম শ্রেণী অবধিই আছে। অনিন্দ্যকে নিয়ে মোট শিক্ষকের সংখ্যা তিনজন, তার মধ্যে একজন প্রধান শিক্ষক ও আরেকজন সহকারি শিক্ষক। অনিন্দ্যকে পেয়ে তারা খুব খুশি। অনিন্দ্যর চাকরিটা ঠিক স্থায়ী নয় অস্থায়ী প্রকৃতির, চুক্তি ভিত্তিক। যদি কখনও-কোন স্থায়ী শিক্ষক বা শিক্ষিকা এখানে আসতে চায় তবেই তার চুক্তি শেষ হবে, যদিও সে আশা খুবই কম, কারণ এমন অজ পাড়াগাঁয়ে শহরের লোকজন শুধুমাত্র কদিন আমোদ-আল্লাদ ও বোন ভোজনে আসতে পারে, এখানে চাকরির কথা তারা হয়ত ভাবতেও পারে না। কারণ প্রগতিশীল মানুষ আজ উন্নয়নের জোয়ারে নিজেদের সাথে তাদের নিজস্বতাকেও বিসর্জন দিয়েছে। চাকরিটা অনিন্দ্যর বেশ ভালো লাগছে। বেতন কম হলেও অনেকটা সময় পাওয়া যায় নিজের জন্য। নদীর পাড়ে বসে ভাবাতুর হয়ে দূরের বিস্তৃত বনানীর দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে নিঝুম আনন্দ উপভোগ করে সে। অস্তগামী সূর্যটা আজ একটু বেশিই আবছা হয়ে ডুবে যাচ্ছে অরণ্যের নিস্তব্ধ বুকে সাথে। হিমেল বাতাস বনভূমির ওপর দিয়ে বয়ে এসে তোলপাড় করে তুলছে অনিন্দ্যর হৃদয়, আজ মনটা একটু উদাস হয়ে আছে। জোয়ার শেষে ভাটা প্রারম্ভের পরে নদীতে যেমন চর ভেসে ওঠে, তেমনি মনের গভীরে আজ অনেকদিন পর লাব্যণের ছায়া পড়েছে, তাই হৃদয়ে রক্তের স্রোত যেন উথাল পাথাল হয়ে অলিন্দ নিলয় ভিজিয়ে তুলছে।

কলেজের সময় অনিন্দ্য বরাবরই চুপচাপ স্বভাবের ছিল, যেন সেটাই তার একমাত্র সহজাত বৈশিষ্ট্য, তার জন্য কলেজের সকলের থেকে পেয়েছে ভীতু, বেমানান মুখচোরা তকমা। কথায় কথায় ছোট করাও ছিল তাদের নিত্য দিনের রুটিন, যেন কলেজের প্রতিটি মানুষ তার প্রতি এক গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। শুধু, লাবণ্য ছিল বাকি সবার থেকে আলাদা, সেই প্রথম বন্ধু হিসাবে তার পাশে দাঁড়িয়েছিল, রীতিমত তর্কা-তর্কি করেছিলো সবার সাথে।

তারপর …

তারপর…..যা হয়…

মনের মধ্যেই একটা নতুন পর্বের সূচনা। বাক্যালাপের মধ্যে দিয়ে যাত্রা শুরু করে যে ভাবে একটা মিঠে সম্পর্ক তৈরি হচ্ছিলো তা ক্রমেই অনিন্দ্যর মনে এক বিরাট মেঘ পুঞ্জ হয়ে জমছিলো। মনে মনে একটা ভালো লাগা, আনন্দের ভাব যেন সব সময় থেমে থাকে। একদিন কলেজে অফ পিরিয়ডে কেমিস্ট্রির কি সব জটিল সমীকরণ নিয়ে দুজনে বসল, লাবণ্য বলছে অনিন্দ্য শুধুই শুনে চলেছে সেই সব আবোল তাবোল, তারই মাঝে দেখছে নড়ে চলেছে দুটো অবিশ্রান্ত, বিরামহীন ঠোঁট, একটা নেশা লেগে যাওয়ার মতো কিছু আছেই ওই গোলাপী স্পর্শে!

“কি রে হাঁদার মতো আমার দিকে তাকিয়ে আছিস কেন, খাতাটা দেখে বল পারবি কিনা?”

“এই না এসব আমি পারব না, আমার দ্বারা এজন্মে আর কেমিস্ট্রি হবে বলে মনে হয় না,

তুই বাড়ি যাবি কখন?

এই অফ পিরিয়ডের পর বলেই একটা বিরাট হাই উঠে গেল”

বাকিটা লাবণ্যই বলে পূর্ণ করল

আর মোটেই ইচ্ছে করছে না, তাই তো।

“হু”

“তাহলে চল বাড়ি যাই”

ক্লাসরুম থেকে বেরিয়েই একটা সতেজতা ফিরল অনিন্দ্যর শরীরে, যে একটু আগেও এক রাশ ক্লান্তি নিয়ে হাই তুলেছিল, তার ছিটেফোঁটাও তার মধ্যে আর প্রকাশ পেল না।

প্রত্যেকদিন লাবণ্যর সাথেই ফেরা হয় তবু যেন কিছুই পুরনো হয় না, সেই চেনা রাস্তা, সেই চেনা গলি, সেই মিত্তিরদের ভাঙ্গা দালান, পুপাইদের পোষা লাভবার্ড সবই যেন নতুন লাগে, সুন্দর লাগে ভারী মিষ্টি লাগে পৃথিবীটাকে।

প্রত্যেক রাতে অনিন্দ্যর চোখে ঘুম নামতে সময় লাগে, কত কী কল্পনার ওপর ভর করে আকাশকুসুম ভাবে সে আর মোহিত হয়ে যায়। সকালের সূর্যের আলোকরশ্মি কাঁচের পর্দা ভেদ করে ঢুকে যখন ভিতরের জড়তা কাটিয়ে তোলে, তখনও রাতের ভাবনাগুলো বাস্তব মনে হয়।

সে বার এক বর্ষার বিকেলে দুজনে ক্যান্টিনে বসে গল্প করছিল, না দুজনেই গল্প করছিল বললে ভুল বলা হবে তাদের মাঝে শুধু একজনই যেন বক্তা আর এক শ্রেষ্ঠ শ্রোতা যার শুধুই মনে হয় মেয়েটা কথা বললে বোধ হয় একটা গোলাপি আভা ছড়িয়ে পড়ে সমস্ত দিকে, কিংবা ওরকম কানের লতানো দুল বোধহয় ইহজগতে আর কেউ পরেনি, কিংবা ওষ্ঠে ওই যে বিন্দু বিন্দু মেঘ জমেছে তা হয়তো এ পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান বস্তু।

“ভিজবি!”

এমন একটা প্রস্তাবের জন্য প্রস্তুত ছিল না লাবণ্য

কিছুটা অবাক হয়ে রইল সে, কী বলা উচিত সে নিজেও ভেবে উঠতে পারল না।

“প্লিজ লাবণ্য আমি জানি না তুই কি ভাবছিস তবু তোকে এটুকু আশ্বাস দিতে পারি হাজার বর্ষা, শীত এসে চলে গেলেও, আজকের এই বৃষ্টিস্নাত বসন্ত কিন্তু কোনোদিন  ফিরে পাব না আমরা! ফিরে পাব না!

পাতার মচমচানির শব্দে পিছনে ফিরতেই অনিন্দ্য দেখল চারি এসে হাজির হয়েছে কখন।

“তুমি কখন এলে চারি?

“বেশ খানিক সময় আগে। দূর থেকেই আপনাকে দেখছিলাম, আপনি তো অনেকক্ষণ থেকেই ওই বনের দিকে তাকিয়ে মাঝে-মাঝেই হেসে উঠছিলেন। তা ব্যাপারটা কী মশাই, আমাকেও একটু বলুন, আমিও একটু হাসি।”

চারি এই গ্রামেরই মেয়ে যদিও বয়সে অনিন্দ্যের চেয়ে বছর তিনেকের ছোট সে, তবুও দুজনের মধ্যেই একটা জমাটি বন্ধুত্ব হয়ে গেছে।

“আমাদের জীবনে সব কিছুই পরিবর্তনশীল শুধু পরিবর্তনই স্থায়ী” সময়ের সাথে সাথে তাল-মিলিয়ে এই সত্য উপলব্ধি সবাই করে, অনিন্দ্যরও বেশ পরিবর্তন হয়েছে তা স্থায়ী কিনা বলা চলে না তবু হয়েছে।

“আমি তোমার কথাই ভাবছিলাম চারি, তুমি সারাদিন আমায় যেভাবে জ্বালাতন করো, সেটা ভেবেই আমার হাসি পাচ্ছিল,” অনিন্দ্য হাসতে হাসতে বলল।”

“তাই বুঝি।

আমি তো আপনাকে শুধু জ্বালাতনই করি, তাই না? আর কথাই বলব না আপনার সাথে, আমি চললুম,” বলে পা বাড়াতেই অনিন্দ্য চারির হাতটা ধরে টেনে পাশে বসিয়ে দিল।”

“এটা কি হল? টানলেন কেন অমন করে!”চারি ভ্যাবাচাকা খেয়ে তাকিয়ে রইল অনিন্দ্যর মুখের দিকে।

“তুমিও না… কি যে করি তোমায় নিয়ে। তোমায় টেনে বসালাম অল্প-স্বল্প গল্প করব বলে… বুঝলে চালি।”

“কে চালি…

আমার নাম চারি

“চাআআ… রইইইই’ বুঝলেন অনিন্দ্যবাবু।”

“আ…হা… চারি, আন্ডারস্ট্যানডিংটাই তো বড় কথা, আমি যে তোমাকেই ডেকেছি, আর তুমি যে বুঝতে পেরেছ এটাই তো বড় ব্যাপার নাকি।”

“হুঁ… তাই তো। আপনার সাথে আমার কোন কথা নেই, আপনি একটা মহা মিথ্যুক…”অনিন্দ্যকে উদ্দেশ্য করে চারি বলে বসল।

“এই মাটি করেছে! কেন… আমি আবার মিথ্যুক হতে যাব কেন?”

এবার চারি, অভিমানী গলায় বলল “কই আপনি যে আমায় বলেছিলেন কলকাতা বেড়াতে নিয়ে যাবেন, তা এতদিনে আপনার কি একবারও সময় হয়নি?”

“ও আচ্ছা… আচ্ছা…

তাহলে এই জন্য আমি মিথ্যুক প্রতিপন্ন হয়েছি তোমার কাছে। আচ্ছা তুমিই বলো আমি এখনও কি একবারও বাড়ি গিয়েছি বা অন্য কোন কারণে বাইরে কলকাতায় গিয়েছি যে তোমায় নিয়ে যাব।”

“কিন্তু… আপনি যে…”

“আচ্ছা ঠিক আছে আমি কথা দিচ্ছি এবারের পুজোর ছুটিতে তোমায় অবশ্যই নিয়ে যাব।

কি খুশী তো এবার?

এবারতো গোমড়া মুখটার বদলে হাসি মুখটি দেখাও।”

ঠোঁটের কোণে হাসির চমকে চারি চোখ নামাল।

“চলো এবার ওঠা যাক চালি, ওদিকে দেখো সূর্যটাও তো ডুবে গেছে।”

“আবার …”

“আচ্ছা …ঠিক আছে, ঠিক আছে আর বলব না চলো এবার,

এই ঠাণ্ডায় আর বসে থাকা যায়!”

পর্ব

প্রত্যহ সকালের রান্নাটা নিজেই করে অনিন্দ্য। আজ সকালেও সেই একই জোগাড়ে লেগেছে সে। স্কুল যেতে এখনও ঘন্টা-খানেক বাকি আছে এরই মধ্যে রান্না করে, চানটাও সেরে আসতে হবে। সে বরাবরই মনে মনে তুলনা করে এখানের গ্রামটা নিজের বাড়ির গ্রামের থেকে একটু হলেও আলাদা চারিদিকে কি সুন্দর সবুজ মাঠ, একটা মন মাতানো নোনতা আমেজ, প্রত্যেকের বাড়ির সাথেই লাগোয়া একটা করে ছোট পুকুর, হাতে গোনা দু-দশটা করে নারকেলগাছ, আম, জাম, সবেদা তো আছেই।

চারিদের বাড়িটা অনিন্দ্যর রান্না ঘরের একদম পাশেই,

তাই এর মধ্যে কখন সেও এসে হাজির হয়েছে, আর অনিন্দ্যের আঁকু-পাঁকু অবস্থা দেখে খিল্ খিল্ করে হেসে বলে বসল “এই জন্যেই বলি এবার বিবাহটা সেরে ফেলুন অনিন্দ্যবাবু, নাহলে কিন্তু আরও করুণ অবস্থা হতে পারে আপনার।” “আচ্ছা চারি তুমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখছ অথচ আমায় একটু সাহায্য করতে এগিয়ে আসছছ না, আমি যে জানতাম গ্রামের লোকেরা খুব দয়ালু, পরোপকারী হয়। তোমার মধ্যে যে তার ছিটেফোঁটাও নেই দেখছি।”

এই কথা শুনে চারি একটু মৃদু হেসে ভিতরে ঢুকে এল, প্রথমেই পাকা গিন্নির মতো ভাতের হাঁড়ি থেকে ভাত পর্যবেক্ষন করে, ফ্যানটা গড়িয়ে দিতে লাগল। কাজ শেষ করে চারি আবার সুমিষ্ট হাসি মুখে নিয়ে বলল, “আপনি কিন্তু আমার দেওয়া প্রস্তাবটা ভেবে দেখতে পারেন”। “কোন প্রস্তাবটা বলোতো চারি, একটা কাউকে বিবাহ করা? নাকি তোমায় বিবাহ করে নেওয়া? আমি ঠিক বুঝতে পারছি না”…অনিন্দ্য হাসতে হাসতেই কথাটা বলল।

চারির মুখ মুহূর্তের মধ্যে লজ্জায় লাল হয়ে উঠল, সে দ্রুত পদে সেখান থেকে পালাতে উদ্যত হল।

“এই যে চারি যাচ্ছটা কোথায়, দাঁড়াও বলছি… আমায় উত্তরটা তো দিয়ে যাও।”

কোন কথা না বলে চারি সেখান থেকে দৌঁড় দিল।

“আচ্ছা যাচ্ছ যাও, আমি কিন্তু নদীর পাড়ে বিকালে অপেক্ষা করব তুমি আসবে কিন্তু।”

দূর থেকে শুধু একটা মিষ্টি কণ্ঠ ভেসে এল “বয়েই গেছে।”

আজ শিক্ষকের আসতে একটু দেরি হওয়াতে স্কুলের ছাত্রছাত্রীগন এক অস্থির উন্মাদনায় মেতে উঠেছে। ক্লাসে ঢুকে তাদের চুপ করাতে গিয়ে বিশেষ বেগ পেতে হল অনিন্দ্যকে। বারকয়েক ডাস্টার ঠুকে টেবিল চাপড়ে তবেই কিছুটা আয়ত্তের মধ্যে আনা গেল তাদের। সবাইকে জোর করেই বই খুলতে বলেই, অনিন্দ্য আজকের তারিখটা বোর্ডে লিখে দিল তার পরেই নাম ডাকার খাতাটা হাতে নিয়ে নাম ডাকতে শুরু করে দিল। নাম ডাকার পর্ব শেষ হতে না হতেই যতীন উঠে এসে একটা প্যাকেট হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “স্যার আপনার জন্য কাল পেয়ারা পাড়তে গিয়ে দেরি হয়ে গেছিল তাই আর আসা হয়নি। অনিন্দ্য বেশ বুঝতে পারছে এগুলো আসলে আগের দিন না আসতে পারার ঘুষ বাবদ কিছু উপহার। এর মধ্যেই চল্লিশ মিনিট ক্লাসের পঁচিশ মিনিট অতিবাহিত হয়েছে। সতীশকে উদ্দেশ্য করে আগের দিনের পড়া জিজ্ঞাসা করাতে সে উচ্চস্বরে তা আবৃত্তি করে সবাইকে শুনিয়ে দিল।

“ঠিক আছে… ঠিক আছে বোস এবার।”

সতীশ দন্ত বিস্ফারিত করে বেঞ্চের স্থান দখল করল। পিছনের বেঞ্চের দিকে লক্ষ পড়তেই দেখল টুকি ও তার দুই সহচারীরা কী যেন একটা আলোচনায় মত্ত। ধমক দিয়ে অনিন্দ্য বলল এই টুকি কি হয়েছে কি তোদের? ধীরে ধীরে উঠে দাড়িয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় টুকি বলল, আপনি একবার এদিকে আসবেন স্যার? অনিন্দ্য কাছে যেতেই টুকি তাকে ভারতবর্ষের ম্যাপ হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, স্যার আমি কাল থেকে আমাদের ‘হেমপুর’ গ্রামটা খুঁজছি এই ম্যাপে কিন্তু কোথাও দেখতে পাচ্ছি না, আপনি একটু দেখিয়ে দিন না। এ হেন আদুরে প্রস্তাবের উত্তর দেওয়ার আগেই টিফিনের ঘণ্টা ঢং ঢং করে বেজে উঠল। আর ছেলে মেয়েরা সব অনিন্দ্যের চোখের দিকে বারকয়েক তাকিয়ে দৌঁড় দিয়ে সবাই ক্লাসের বাইরে চলে গেল। ভারতবর্ষের ম্যাপে এরকম একটা ছোট গ্রামের অবস্থান জানতে চেয়ে টুকি বিন্দুমাত্র ভুল কিছুই করেনি, কারণ এটা তার কৌতূহলী মনের প্রশ্ন। কিন্তু তাও অনিন্দ্য সে কথা ভেবে নিজের মনেই হাসতে আরম্ভ করে দিল।

পর্ব

এখানে স্কুলে তেমন কিছুই কাজ নেই। দুপুরের টিফিনটা অনিন্দ্যের মিড-ডে মিলে হয়ে যায় বাচ্চাদের সাথেই। প্রতিদিনের মতো আজও সে নদীর ঘাটটার ওপর বসে দূরে বিস্তৃত বনভূমির মনোরম আবহাওয়া অনুভব করছে আর নদীর জলের কলকল ছলছল শব্দ শুনছে। নদীর পার দিয়ে দূরে দেখা যাচ্ছে একটা বাচ্চা ছেলে হনহনিয়ে তার দিকেই এগিয়ে আসছে, কাছে আসতে বোঝা গেল ওটা নিলু। অনিন্দ্যের কাছে এসে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বলল এই নাও, এটা দিদি দিল, আর বলল যে আজকে আসতে পারবে না। প্যাকেটটা হাতে নিয়ে খুলতেই অনিন্দ্য দেখল ওর মধ্যে ৮-১০টা পাকা সবেদা আছে।

“তোর দিদি কোথায় রে নিলু?”

“দিদি…

দিদিত সমীরণ দাদাদের বাড়িতে গেছে, সমীরণদার মায়ের তো খুব শরীর খারাপ তাই দেখতে গেছে।”

“ও…

আচ্ছা নিলু তুই আমায় সমীরণদের বাড়িতে নিয়ে চল তো।”

“তুমি যাবে?”

“হু যাব চ…”

দুজনেই নদীর পার ধরে হাঁটতে আরম্ভ করল সোজা।

“এই নিলু সবেদা খাবি?”

“না… তুমি খাও, আমার বাড়িতে রাখা আছে।”

“তাতে কী হয়েছে, এই নে আমি দিচ্ছি, খা একটা।”অনিন্দ্য জোর করে ছোট্ট নিলুর হাতে একটা সবেদা গুজে দিল।

মিনাদের বাড়ির সামনে থেকে যে ঢালু পথটা নিচে নেমে গেছে সেখান দিয়ে দুজনে নেমে গিয়ে একটা মাটির বাড়ির সামনে গিয়ে উপস্থিত হল। মাটির বাড়ির বাইরে জনা কয়েক মহিলা পুরুষ জটলা পাকিয়ে ভিড় বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঘরের ভিতরে বারান্দাতে একটা মহিলা খাটের ওপর চিত হয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। আর তার মাথার কাছে একটি ছেলে বসে আছে, বোধহয় সমীরণ হবে। ডাক্তারবাবু মহিলার নাড়ি টিপে পরীক্ষা করে দেখলেন এবং কিছু উপদেশ সমেত একটা প্রেশক্রিপশান সমীরণের হাতে গুঁজে দিলেন। ভদ্রতার খাতিরে সমীরণও কিছু টাকা ডাক্তারবাবুর হাতে তুলে দিলেন। এই সব যখন একদৃষ্টিতে দেখছে অনিন্দ্য তখন একটা মৃদু টোকায় পিছনে ফিরতেই দেখল! টোকাটা চারি মেরেছে।

“এই যে মশাই আপনি এখানে!”

“কেন আমি কী আসতে পারি না?”

“না তা বলছি না…”

তার-পর মুহূর্তেই চারি নিলুর প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কটমট করে তাকিয়ে আছে।

“আহা! ওর দিকে ওই ভাবে তাকিয়ো নাতো, ওকে আমিই দিয়েছি, যা বলার আমাকেই বলো।”

“হু… তাই তো… সবটাই তো আপনার বাড়াবাড়ি।”

“আচ্ছা এতে বাড়াবাড়ির কি দেখলে? ও বাচ্চা ছেলে আমার জন্য বয়ে নিয়ে গেল কষ্ট করে, ওকে একটাও দেবো না খেতে?”

“হু…… তাই তো ও শুধু কষ্ট করে বয়ে নিয়ে গেল দেখতে পেলেন, আর আমি যে…!”

“বাবা… তুমি তো দারুণ হিংসুটে, এই নাও তুমিও একটা নাও।”দুজনের মুখেই একটা মৃদু হাসির গুঞ্জন দেখা গেল।

দুজনের দৃষ্টিই একে অপরের চোখের দিকে, অপলক দৃষ্টি চারি নামিয়ে নিয়ে বলল চলুন ওই দিকটা একটু হেঁটে আসি, চোখ নামিয়ে অনিন্দ্য বলল হ্যাঁ… চলো।

অনিন্দ্য ও চারি দুজনেই বাড়ির পাশের কাঁচা রাস্তাটা ধরে হাঁটতে আরম্ভ করল। মাথার ওপর ছাতার মতো গাছের সারি আর দুপাশে ঘাসে ঢাকা মাটি বিস্তৃত বহুদূর পর্যন্ত।

চারি সবেদাটা কিন্তু খুব ভালো খেতে। তোমাদের গাছের নাকি?

হ্যাঁ…

আচ্ছা চারি তোমাদের এদিকটা তো বেশ সুন্দর। চারিদিকটা বেশ সবুজ সবুজ আর নিস্তব্দ। একটা গাম্ভীর্যতা বিরাজ করছে পুরো রাস্তার দুপাশ জুড়ে, কই আগে তো এদিকে নিয়ে আসোনি আমাকে।

“তাই তো আজকে নিয়ে এলাম।”

কাঁচা রাস্তাটা যেখানে পাকা রাস্তায় গিয়ে মিলেছে সেখান থেকে কিছুটা দূরে কিছু লোক গাড়ী থামিয়ে বনের দিকে তাকিয়ে চেঁচামেচি করছে। দুজনে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেল বিষয়টা জানার জন্য, কাছে গিয়ে শোনা গেল পশুরাজ কোনও বিশেষ হেতুতে জঙ্গলের কিনারায় এসেছিলেন আর তাই নিয়েই এত হইচই, যদিও দুজনের কেউই পশুরাজের ল্যাজও দেখতে পায়নি, অহেতুক জনতাদের পিছনে ফেলে ওরা আরও কিছুটা নিরিবিলির দিকে এগিয়ে গেল পাকারাস্তাটা ধরে।

“আচ্ছা চারি তুমি বাঘ দেখেছ?”

একটা হাসির সাথে চারি বলল ওমা বাঘের সাথে বাস করি আর বাঘ দেখব না, আপনিও না মাঝে মাঝে এমন প্রশ্ন করেন! দূরে বনের দিকে আঙ্গুলি নির্দেশ করে চারি বলতে শুরু করল, আজ আপনি এই যে দেখছেন না, এখানে জাল লাগানো আছে পুরো বন ঘিরে, এটাতো এই সবে বছর ৪-৫ আগের লাগানো। তার আগে এখানে কোনও জালই ছিল না। সময়ে অসময়ে বাঘ গ্রামে এসে লোক নিয়ে যেত মানুষের নাকের নিচে দিয়ে। জানেন তো সরকার নতুন বাঘ প্রকল্প তৈরি করেছে বাঘ বাঁচানোর জন্য। কারন বাঘতো জাতীয় সম্পদ, যাতে তারা অবলুপ্ত না হয়ে যায় তাই তো প্রচেষ্টা সরকারের এত। কিন্তু এখানের মানুষগুলো যে গরু-ছাগলের মতো মরছে তাতে কিন্তু কারোর কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। আসলে মানুষতো জ্বর-ব্যাধি আরও কত মারন রোগে মরবেই, নাহলে বাঘের পেটে যাবে, আসলে এগুলো এখানকার মানুষদের অলিখিত অদৃষ্ট বা জঙ্গল নিয়ম বলতে পারেন। প্রত্যেকদিন এখানে বা আশেপাশের গ্রামে কেউ না কেউ মধু আনতে, কাঁকড়া মারতে, মাছ ধরতে গিয়ে বাঘের পেটে যায়। কত মানুষ- কত প্রিয়জনদের হারায় তবু জানেন এদের শিক্ষা হয় না। এরা আবারও নির্লজ্জের মতো বেরিয়ে পড়ে নিরুদ্দেশের পথে নিরুদ্দেশ হতে।  

অনিন্দ্য আর চারির মধ্যে একটা সন্ধ্যাকালীন নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে সেটা কেউই কাটিয়ে উঠতে চাইছে না, হঠাৎ চারি অনিন্দ্যের হাতটা ধরে ভিজে গলায় বলতে শুরু করল, “তুমি আমায় এই জঙ্গল কানুন থেকে মুক্ত করবে তো, বল না অনিন্দ্য করবে তো! আমায় শহরে নিয়ে যাবে তো”। চারির চোখ থেকে টুপ টুপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে।

অনিন্দ্যের ইচ্ছে হল এক্ষুনি সে চারির হাতটা নিজের হাতের মধ্যে আরও শক্ত করে নিয়ে বলবে, হ্যাঁ…… চারি করব……করব। কিন্তু কোন মন্ত্র বলে বনদেবী অনিন্দ্যর বাক স্বাধীনতা হরণ করল, তা সে নিজেও বুঝে উঠতে পারল না।

পর্ব

আজ সকাল থেকে মনটা ব্যাকুল হয়ে আছে, কার জন্য তা বলা কঠিন এ মুহূর্তে, প্রভাতের উদীয়মান সূর্যটাও উঠতে দেখা হয়নি আজ, বিছানা ছাড়তে দেরি হয়ে গেছে, একটা আচ্ছন্নতা ভর করেছে সারা শরীর জুড়ে। সকালে প্রদীপবাবুর সাথে গেটের বাইরেই দেখা হয়েছে অনিন্দ্যর, উনি স্কুলের সহকারী শিক্ষক খবরটা ওঁওঁর কাছেই পাওয়া গেছে, কালকে বিকালেই ডাক মারফত একটা চিঠি এসে পৌঁছেছে স্কুলে। চিঠির বিষয়বস্তু মুখে শুনে যতটুকু জানতে পারা গেছে, তা হল কোন নতুন স্থায়ী শিক্ষক এখানে আসতে রাজি হয়েছে, তাই কথামত অনিন্দ্যের চুক্তি শেষ হতে চলেছে। চাকরিটা আর নেই, এবার চলে যেতে হবে তাকে, এই ভাবনায় মোহগ্রস্ত হয়ে মাটির ঘরের মেঝের ওপর বসে বাঁশের খুঁটিটা শক্ত করে ধরে মাটির দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে অনিন্দ্য। গ্রামের সকলেই খবরটা কম বেশি জেনে গেছে, খবরটা তাও আরও পাকাপাকি ভাবে জানার জন্য বেলা বাড়তে স্কুলের দিকে এগিয়ে গেল অনিন্দ্য। প্রধান শিক্ষকের সাথে তার ঘরের বাইরেই দেখা হয়ে গেল। “এই যে অনিন্দ্য খবরটা তো তুমি নিশ্চয়ই শুনেছ।”

“হ্যাঁ স্যার শুনলাম আজ সকালেই”

“তাহলে কি করবে এখন!”

“এখনও কিছু ভেবে উঠতে পারিনি স্যার। দেখা যাক কী হয়!

ও ভালো কথা স্যার, নতুন যিনি আসছেন কবে আসছেন।”

“উনি কাল চলে আসবেন সম্ভবত, তাইতো চিঠিতে উল্লেখ আছে।”

“ও…… আচ্ছা।”

দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়ে গেছে, অনিন্দ্য সেই নদীর পাড়েই গোঁজ মেরে বসে আছে। আচমকা চারির কণ্ঠস্বরে অনিন্দ্যের হুঁশ ফিরল।

“এসো চারি……”

চুপ করে অনিন্দ্যের পাশে এসে বসল চারি।

“আমি হয়তো কাল পরশুর মধ্যে চলে যাব চারি।”

এক পশলা বৃষ্টির আগে যেমন নিস্তব্ধতা বিরাজ করে ঠিক তেমনি নিস্তব্ধতা জমাট বেঁধেছে চারির বুকে।

অনিন্দ্য বলে যাচ্ছে…

“আচ্ছা চারি তুমি আমায় আরও একবার জঙ্গল দেখাতে নিয়ে যাবে, কিন্তু হেঁটে নয়, এবার আর ওই দূরের ডিঙি নৌকাটা দেখিয়ে বলল-ওইটা দেখছো?

ওই,ওইটা করে।”

এইবারে আকাশে কালোমেঘের ফাঁকে রবির উদীয়মান উজ্জ্বল ঝিলিকের হাসি দেখা গেল চারির শান্ত মুখে।

“আচ্ছা আপনি আমার সাথেই বার-বার যেতে চাইছেন কেন বলুন তো?”

প্রাণোচ্ছল হাসির সাথে চারি সকৌতুকে জিজ্ঞেস করল অনিন্দ্যকে।

“ওফ্… তোমরা সব মেয়েরা কি এমনি হও, পুরুষদের শেষ শব্দ অবধি দুমড়ে-মুচড়ে না বার করা অবধি ছাড়ো,না না?”

“এখানে একটা বিশেষ কথা বলে রাখা প্রয়োজন-আপনি যদি কখনও কাউকে ভালবাসে থাকেন, আর সে কথা যদি আপনি তাহাকে বলিতে সাহস না পান তাহলে আপনি একদম নিশ্চিন্তে থাকুন কারণ আপনার অজান্তেই সেই মহিলা আপনার মনের সমস্ত কথা আপনার মুখ থেকে আত্মস্বাদ করিবে এবং যদি সে আপনার হৃদয় বন্ধনের সাথে আবদ্ধ হতে চায় তাহলে মুচকি হাসি দিয়া, আপনারে একটুখানি তরপাইয়া বিন্দুমাত্র বিবেচনা না করিয়া আপনাকে সাদরে গ্রহণ করিবে। আর যদি সে আপনাকে অপছন্দ করে, তাহলেও নিশ্চিন্ত মনে আপনার সমস্ত কথা শুনিয়া, গম্ভীর মুখে আপনার প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া, আপনার সাথে বন্ধুত্ব সুলভ সম্পর্কের তকমা জুটাইয়া দিয়া আপনার হৃদয়ে বেদনার সুরের মূর্চ্ছনা ঘটাইয়া দিয়া, অদূরে কোথাও আত্মগোপন করিবে।”

এইটুকু সময়েই চারি আরও কিছুটা নিবিড় হতে অনিন্দ্যের কাছে সরে এসে নিজের হাতটা অনিন্দ্যের হাতের মধ্যে দিয়ে আলতো ভাবে বলল কাল-যাব…কেমন!

অনিন্দ্য কিছুটা আবাক দৃষ্টিতে চারিদিকে তাকিয়ে রয়েছে। দূরে পশ্চিম আকাশ কেমন যেন লাল আবিরে রঙিন হয়ে উঠেছে, অতি পরিচিত চেনা ঢেউগুলো কেমন নদীর ঘাটে এসে মিলিয়ে যাচ্ছে।গাছের ওপর বসে থাকা পাখি দুটো হঠাৎই তাদের লীলা চাঞ্চল্য থামিয়ে দিয়েছে কোন গভীর অভিসন্ধি ক্ষনে। অধীর অপেক্ষার পর তৃষ্ণার্ত চাতকের ঠোঁটে ভিজলো একটা নরম স্পর্শে আর সূর্যটা যেন ডুবে গেল এই ঈষৎ উষ্ণতার ফাঁকে।

শিহরিত, রোমাঞ্চিত, কম্পিত, প্রফুল্ল -হৃদয়ে একটা দামামা বেজে উঠে বলে চলল,

“যাহা কিছু পুরনো ধূলো, মলিন

যাক!

যাক তবে মুছে আজি নবীনের স্পর্শে,

হোক তবে, শুরু হোক

যাত্রা এবার, নতুনের সঙ্গতে।”

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post নববসন্ত| প্রেমে পড়া বারণ | সমাদৃতা মিত্র| Bengali Love Story
Next post শ্মশান ঘাট| প্রেমে পড়া বারণ | কুমকুম| Bengali Love Story