শ্মশান ঘাট| প্রেমে পড়া বারণ | কুমকুম| Bengali Love Story
0 (0)

আজ ২২শে জানুয়ঋ। সুখময় আর মিনতিদেবীর আটত্রিশতম বিবাহবার্ষিকীতে……. (মিনুর পাশে বসে সুখময়,)

সুখময়: ……ও মিনু! মিনু! আজকের দিনের কথা তোমার মনে পড়ে! আমার তো খুব  মনে পড়ে, জানো মিনু! তুমি সেদিন কি সুন্দরই না লাগছিলে! টুকটুকে লাল বেনারসী শাড়ি আর চন্দনের সাজে কি অপূর্ব যে লাগছিল!…বাড়িময় লোকজন। আমার মা, বৌদিরা তো তোমার রূপ দেখে অবাক হয়েছিল। …. জানো আমার তখন যে কী গর্ব হচ্ছিল, তোমায় বলে বোঝাতে পারব না।

আজ আটত্রিশ বছর পর তুমি আবার সেই বিয়ের বেনারসী আর চন্দনের সাজে…. তফাৎ কেবল একটাই, তোমার সাথে আমায় কেউ বরের সাজে সাজাল না। ওরা কেন বলত এমন করে? আমাকেও তো তোমার পাশে বরের সাজে রাখতে পারত বলো? বড়ো হিংসুটে ওরা।

হঠাৎ সুনিত (সুখময় ও মনিতির একমাত্র ছেলে) বলে উঠল;

– বাবা! ও বাবা! কি বিড়বিড় করছ? এমন কোরো না বাবা (কাঁদতে কাঁদতে)। তুমিও এমন করলে আমার কি হবে বলো বাবা?

খুব শান্ত দুটো চোখে ছেলের দিকে একবার ঘুরে তাকালেন সুখময়। তারপর মিনুর দিকে ফিরে,

-দেখলে তো মিনু, আমি তোমায় বলছিলাম না ওরা বড়ো হিংসুটে। তোমার ছেলেটাও ওদের দলে নামম লেখাল। তোমার আমার ভালোবাসার গভীরতা আজও পরীক্ষার সম্মুখীন হয়ে উঠেছে জানো মিনু!

বাবার ডান পাশে দাঁড়িয়ে অস্থির গলায় সুখময়ের বিশ।বছরের ছেলে বলে উঠল,

– বাবা! ….. প্লিজ! চুপ করো।

ছেলের কথায় কোনও রকম পাত্তা না দিয়ে আবার ও বলতে থাকলেন সুখময় বাবু,

– তবে মিনু! তুমি একদম ভয় পেয়ো না। দেখো প্রতিবারের মতো এবারও আমাদের ভালোবাসাকে জিতাবোই। তুমি একদম চিন্তা কোরো না কেমন!

বাবার কষ্ট দেখতে না পেরে, কাঁদতে কাঁদতে ঐ ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন সুনিত। পাশের ঘরের সোফায় পিসিকে দেখতেই, কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠল,

– পিসি! পিসি গো! বাবাকে একটু বোঝাও না গো। কেন এমন করছে বাবা?

মাথা নিচু করে বসে থাকা শিবাণী (মানে সুখময়ের বড়দিদি) ধীরে ধীরে মাথা তুলে বললেন,

– কি বলি বলত? আমার ভাইটা যে বৌ অন্ত প্রাণ ছিল রে বাবিন ( সুনিতকে বাড়ির লোকেরা ভালোবেসে বাবিন নামেই ডাকত) ভালোবাসার এমন ফাঁকি কি মেনে নিতে পারবে রে তোর বাবা?

অশ্রুসিক্ত চোখে বাবিন,

– পিসি! ….. তুমিও!

উঠে দাঁড়িয়ে বাবিনের দিকে দু পা এগিয়ে এসে,

– হ্যাঁ রে, বাবিন। আমিও।

একটু থেমে বাবিনের কাঁধে স্নেহের হাতটি রেখে বাবিনের মুখের দিকে হাল্কা দৃষ্টিতে তাকিয়ে শিবাণীদেবী বলতে থাকলেন,

– জানিস তো বাবিন! তুই তো তোর বাবাকে জন্ম থেকে চিনিস, কিন্তু আমি বাবুকে (সুখময় বাবুর মা দিদির দেওয়া আদরের নাম) চিনি ওর জন্ম থেকে। কোলে পিঠে মায়ের মতো করে মানুষ করেছি তোর বাবাকে।

বাবিন অস্থির গলায় আবার বলে উঠল,

– তাহলে, বাবা বোঝাও না একটু। প্লিজ পিসি কারুর জন্য না হয় আমার কথা ভেবে বাবাকে একটু বোঝাও।

গায়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে শিবাণীদেবী একমাত্র ভাইপোকে আশ্বাস দিয়ে বলল,

– আচ্ছা বাবা! তুই এখন শান্ত হও সোনা-বাবা। আমি দেখছি…..

একটু থেমে আবারও বললেন,

– আসলে কি জানিস তো বাবিন! তোর বাবা খুব সরল প্রকৃতির মানুষ। যখন কাউকে ভালোবাসে, মন প্রাণ ঢেলে ভালোবাসতে জানে। বিয়ের পর থেকে দেখেছি, তোর মা-কে কেমন আগলে আগলে রেখেছেন!

………. একবার জানিস, তোর মায়ের জ্বর হয়েছিলো, তোর বাবা একেবারে অস্থির হয়ে উঠেছিল তোর মাকে সুস্থ করে তোলার জন্য। সেই লোকটা আজ এমন করবে, সেটাই তো স্বাভাবিক বল!

– সবটা আমি বুঝতে পারছি পিসি। কিন্তু আমাদের তো বাবাকে বাঁচাতেই হবে, বলো। তোমরা না পারো, আমিই দেখি কী করা যায়!

কথাটা শেষ করেই চোখের জল মুছতে মুছতে আবার বাবা-মায়ের ঘরের দিকে চলে গেল বাবিন। ঘরে ঢুকতে দেখল, বাবা তখনও মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছেন আর বলছেন,

– বিয়ের দিন ঠিক যেভাবে তুমি ফুলের সাজে রূপসী হয়ে উঠেছিলে, আজও তুমি ফুলের মালায় ঢেকে আছ। সেদিনকার মতো আজও বাড়িটা ফুলের গন্ধে ম-ম করছে।

ধীরে ধীরে বাবার পাশে এসে দাঁড়ালেন সুনিত। বাবা কাঁধে আলতো করে হাতটা রাখতেই সুখময় বাবু বাবিনের দিকে ফিরে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন,

– দেখ! দেখ! বাবিন, তোর মাকে কি সুন্দর লাগছে! জানিস ঠিক এমন সুন্দর লাগছিল বিয়ের দিনও।

দুচোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল বাবিনের। বাবার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে বাবাকে জড়িয়ে ধরল বাবিন। কম্পিত স্বরে বারবার বাবাকে বোঝাতে লাগল সে,

– এমনটি কোরো না বাবা। মা আর নেই….. নেই আমাদের মাঝে। তোমাকে এই সত্যটা মেনে নিতেই হবে বাবা। একটু শক্ত হও আমার সোনা বাবা।

অবাক স্থির দৃষ্টে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন সুখময়। বাকহীন তিনি। কেবল দুচোখ বেয়ে জল, গালের উপর দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে বুকের জামাটার উপর। সবটা জানেন তিনি, তার ভালোবাসার মানুষটা ঘন্টাখানেক আগেই পৃথিবীর সব মায়া ত্যাগ করে সবাইকে ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু তার মন যে মানতেই চায় না সে কথা! ৩৮ বছর আগে এই দিনে যে মানুষটা তার হাত ধরে পথ চলার প্রতিশ্রুতি বদ্ধ ছিল, আজ এতটা সময় পেড়িয়ে ঠিক সেই একই দিনে তাকে একা করে স্বার্থপরের মতো ইহলক ত্যাগ করল: এ যে মেনে নিতে পারছেন না সুখময়বাবু। অস্পষ্ট ভাষায় বিড়বিড়িয়ে উঠলেন:

– দেখ বাবু, বাড়িটা ফুল আর ধূপের গন্ধে ভরে গেছে, ঠিক আমার আর তোর মায়ের বিয়ের দিনের মতো!

ছেলে দেখতে পেলে, তার বাবা মৃত মায়ের বাঁ হাতটাকে নিজের দুইহাত দিয়ে চেপে ধরেছে এবং ক্রমশ ঢুলে পড়ছে মৃতদেহের বুকের উপর:

– বাবা!….. বাবা!….. (সুনিত চিৎকার করে উঠল)

সবটা বুঝে ওঠার আগেই সুনিতের বাবাও….

পাশের ঘর থেকে সুখময় বাবুর মা, দিদি, প্রতিবেশীরা ছুটে এলে দেখতে পেল:

দুটি ভালোবাসার মানুষ আজ মর্ত্যের মায়া ত্যাগ করেছে। হয়তো এখন তারা অগধ প্রেমের ঝুলি নিয়ে সংসার স্থাপন করেছে সদূরে, কোনও এক মায়াজালের দেশে!

আজও সেই দিন, ২২শে জানুয়ারী। আজ থেকে বহু বছর আগে এই দিনের বাড়িটা ভরে উঠেছিলো শঙ্খ, ঊলুধ্বনি আর আত্মীয়দের আনন্দ সোরগোলে। আজ সেই একই দিনে!….. বাড়ি ভর্তি লোক, অনেক শোরগোল: তবে তা শোকার্তে ভরা।

একইদিনে আজ থেকে ৩৮বছর আগে এখানে ছাতনাতলায় শুরু হয়েছিলো নবদম্পতির প্রেমকাহিনী, আজ তারা আবার নতুন করে তারা তাদের ভালোবাসাকে যেন অমরত্ব দিতে চলেছে: শ্মশানঘাটে! ভালোবাসা হয়তো এভাবেই বারবার প্রমাণ করে দেয় জীবন মরণকে তুচ্ছ করার ক্ষমতা কেবল তারই আছে।……

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post শেষ থেকে শুরু| প্রেমে পড়া বারণ | দেবজিৎ মাইতি| Bengali Love Story
Next post স্বপ্নের জলছবি| প্রেমে পড়া বারণ | শ্রী স্নেহাশিস সামন্ত| Bengali Love Story