Getting your Trinity Audio player ready...
|
সকাল সাতটায় রুটিনমতো ঘুম ভাঙল বিউটির। পাশে শুয়ে অঘোরে ঘুমাচ্ছে প্রণয়। শীতের নরম রোদ এসে ছুঁয়েছে প্রণয়ের গাল- ঠোঁটে, শিশুর মতো পবিত্র দেখাচ্ছে ওকে। বিউটি সস্নেহে ওর চুল ঘেঁটে কপালে একটা চুমু খায়, প্রণয় এখন উঠবে না, ওর উঠতে বেলা হবে ততক্ষণে বিউটি কাজে বেরিয়ে যাবে। ঘুমের আলস্য ছেড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে বিউটি দ্রুত হাতে দিনের প্রাথমিক কাজ সারে। স্নান করে কপালে একটা সিঁদুরের টিপ আঁকে খুব যত্নে, এই সিঁদূরের টিপই একমাত্র প্রসাধন বিউটির। সকালের স্নিগ্ধ আলোয় বিউটির কপালের টিপটি দেবীর তৃতীয় নয়ন হয়ে ভেসে ওঠে। রান্নাবান্না সেরে সকালের খাওয়া খেয়ে একটা সালোয়ার কামিজ পরে নেয় বিউটি, ঘড়িতে তখন সাড়ে দশটা বাজে। এগারোটার মধ্যে কল টাইম বিউটির। এর দেরী হলেই ওরা টাকা কাটবে।বাসে উঠে পেছনের সিটে বসে যেতে যেতে বিউটি মনে করতে চেষ্টা করে কাল কোন পোজটা দিয়েছিল যেন!।
-তুমি কী কর মাধবীলতা?
-ওই আর কী, পেট চালানোর জন্য একটা অমাধ্যমিক মেয়ে যা করতে পারে!
– মানে তুমি কি?
– না না যা ভাবছ তা ঠিক না! তবে তার চেয়ে বেশী সম্মানের কাজও কিছু করি না, অন্তত যাদের হয়ে কাজ করি তাঁরা তেমনই ভাবেন, জানো কেউ কেউ এমন ভাবে চায় যেন মনে হয় চোখ দিয়েই গিলে খাবে..এতদিন এই লাইনে আছি কোনটা শিল্পীর চোখ আর কোনটা লোভের চোখ সব বুঝি… অবশ্য সকলে এক নয় বুঝলে, নইলে কী আর এতদিন টিকে থাকতে পারতাম!
-আচ্ছা মাধবীলতা আমার চোখে তুমি কী দেখতে পাও?
-আশ্রয়।
-আমার কথা জানতে ইচ্ছে হয় না? আমি কে? কী?
-অন্য একদিন শুনবো না হয় আজ বরং…
এভাবে হচ্ছে না, হাতটা পেটের কাছে রাখুন প্লিজ! চোখের উদাসী ভাবটাও আসছে না কিন্তু! কাল কতবার বোঝালাম একটুও মনে থাকে না আপনার! কোথা থেকে যে এদের ধরে আনে কে জানে! ন্যুড মডেল হওয়া কী আর সকলের কাজ! আপনি ভাবতে চেষ্টা করুন কাল সারারাত আপনার প্রেমিক আপনার সাথে লীলাখেলা করে আজ সকালে পালিয়েছে, সকালে ঘুম ভেঙে উঠে কেমন লাগবে আপনার! নাহ এভাবে হয় না আপনি বরং দশ মিনিটের ব্রেক নিন, মডেল ঠিক না হলে স্টুডেন্টরা আঁকবে কী করে..। নিজের গায়ে সালোয়ার কামিজটা আলগোছে জড়িয়ে নিয়ে ক্লাসের বাইরে বেরোয় বিউটি। গলার দলা পাকানো কান্নাটা কোনও ক্রমে গিলে নেয় সে। না সে হেরে যাবে না। তাকে পারতেই হবে একটা সোনালী দিনের স্বপ্ন সত্যি করতে হলে আজকের এই অপমানটুকু গায়ে মাখলে চলবে না তার। ক্লাসে ঢুকে নগ্ন হয়ে ফের নিদ্দিষ্ট জায়গায় বসে বিউটি। এবার আর পোজ দিতে ভুল হয় না তার। চোখের সোনালী দিনের স্বপ্ন লুকিয়ে রেখে পাকা অভিনেত্রীর মত চোখে মুখে ফুটিয়ে তোলে প্রতারিত অভিসারিকার অসহায়তা।
-বল শালা আমায় ফেলে পরকীয়া করতে যাবি? কেন একটু মোটা হয়ে গেছি বলে কী আর সুখ দিতে পারি না!? শালা কি ভেবেছিস আমার বাড়ির বিছানায় রেন্ডি নিয়ে ফুর্তি করবি? দেখ মিষ্টার সেন, দেখ আমি পারি কিনা সুখ দিতে! দেখ আমিও পারি তোর মত ঘরে রান্ড ঢোকাতে! হি হি হি হি!
হাসির লহরি শেষ হতেই হাতে ধরা সিগারেটটা মিসেস সেন চেপে ধরে প্রণয়ের পিঠে। একটা আর্তনাদ করে ওঠে প্রণয়, ও জানে ও যত চেঁচাবে তত প্লেজার হবে মিসেস সেনের। পেমেন্টও সেই আন্দাজে হবে, সেই টাকায় প্রণয় আর বিউটি মাল্টিপ্লেক্সে মুভি দেখবে..ডিনারটাও করা যাবে নিশ্চয়ই! স্যাডিস্ট হলেও মিসেস সেন এমনিতে হাতখোলা.. মিসেস সেন তার বিপুলকায় শরীরটা নিয়ে চেপে বসে প্রণয়ের ওপর নিজের স্বামীর ওপর জন্মানো সব ক্ষোভ ওর ওপর দিয়ে উশুল করতে করতে ধীরে ধীরে শান্ত হবেন, তারপর সব মিটে গেলে কিছুক্ষণ কাঁদবেন হয়ত প্রণয়কে বসিয়ে গল্পও শোনাবেন। কীভাবে একজন সাধারণ মেয়ের থেকে আজ তিনি ব্যভিচারিণী হয়েছেন, প্রণয় মন দিয়ে সব শুনবে তারপর চোখ লাল করে মিসেস সেন একটা মোটা অঙ্কের টাকা তার হাতে দিয়েই কাতর গলায় বলবেন -আবার কবে ফ্রি থাকবে তুমি নীলকমল! বহু বছর হয়ে গেল এই লাইনে প্রণয়ের, চোখ দেখে ও বলে দিতে পারে কোন মহিলা কী চায়? কার ওরিয়েন্টেশনস কী!। এই জন্যই হয়তো বাজারে নীলকমলের চাহিদা তুঙ্গে।
আচ্ছা রাজপুত্র তুমি না বলেছিলে একদিন তোমার সব কথা বলবে?-
বলেছিলাম বৈকি!, তুমিই তো শুনতে চাওনি সেদিন বলেছিলে অন্যকোনও দিন শুনবে!?
ধরে নাও আজই সেই অন্য দিন!-
বেশ, বলো কী শুনতে চাও!?-
তোমার কথা, যতটুকু বলতে ইচ্ছে করে বল।–
বেশ, শোনো বাবা মা চলে যাবার পর আমার দায়িত্ব নিতে কেউ চায়নি। তখন কপর্দকশূন্য বছর ষোলোর আমি বাধ্য হয়ে স্কুলের পড়া ছেড়ে দিয়ে সার্ভাইভ করার জন্য একটা হোটেলের বয়ের কাজ নিই, মালিক ভদ্রলোকের অনেক বই ছিল দেশি-বিদেশী, আমি কাজের পাশাপাশি ওই বইগুলো পড়তাম অনেক। ওই বয়সেই আমার কেমন মনে হয়েছিল এই পৃথিবীতে আলগা চটকহীন মানুষের ভাত নেই। ছোট থেকেই চেহারা ভালোর দিকে আমার, একদিন এই হোটেলেই আমার আলাপ হয় এক প্রভাবশালী মহিলার সাথে, ঘটনাচক্রে ওঁওঁর কাছেই আমার হাতেখড়ি হয় এই কাজের। আর ওঁওঁর হাত ধরেই আমি সম্পূর্ণ আলাদা এক জগতে পা রাখি। এই পেশা আমায় বেঁচে থাকার অর্থ যোগাত আর আমি অনেক নি:সঙ্গ, অর্থবান মহিলাকে জোগাতাম বেঁচে থাকার রসদ, শুধু শারীরিক নিবৃত্তি করাই নয়, তাদের মানসিক শান্তি দেওয়ার কাজও করি আমি। মাধবীলতা, আমি জানি এই মুহুর্তে আমাকে খুব ঘেন্না হচ্ছে তোমার। কিন্তু আমি মনে করি রাতের ওই কাজের সময়টুকু চূড়ান্ত প্রফেশনাল আমি, আর নিজের কাজকে সম্মান করি আমি, আমার কোনও রিগ্রেট নেই আমার কাজ নিয়ে… ওই বয়সে বেঁচে থাকার জন্য হোটেলে অন্যের এঁটো বাসন ধোয়ার চেয়ে এই পথটাই আমার উপযুক্ত মনে হয়েছিল…
হুম বুঝলাম। আচ্ছা এবার বলোতো রাজপুত্র আমাদের কী এক হওয়া যায়?
মানে! আমি জিগলো এটা জানার পরেও তুমিঃ..
আমার পেশার কথা জেনেও তো তুমি ছেড়ে যাওনি আমায় তাহলে আমিই বা কেন পারব না?
কিন্তু মাধবীলতা আমাদের সংসার আর পাঁচটা সংসারের মত স্বাভাবিক হবে না? তুমি মেনে নিতে পারবে তোমার স্বামী অন্য মেয়েমানুষকে..
আচ্ছা রাজপুত্র শুধু সিঁদুর পরালেই বিয়ে হয় বুঝি!?
না, কখনওই না কিন্তু আমাদের,সন্তান! যদি সে কখনও প্রশ্ন করে!?
যারা প্রতিদিন বেঁচে থাকার রূপকথা রচনা করে চলেছে সেই মানুষদের সন্তানেরা অত দুর্বল হয় না, তুমি দেখো যদি কোনও দিন আমাদের কোনও সন্তান হয়, তবে সে নিশ্চয়ই আমাদের বুঝবে..
আমি তোমায় কিছুই দিতে পারব না মাধবীলতা! সহ্য হবে না তোমার আমার সঙ্গ..
দিনের শেষে অনেক গভীর রাতে যখন শিল্পীর ভাবনা আর নি:সঙ্গ নারীরা ঘুমিয়ে পড়বে, যখন তোমার আমার দুজনেরই এক ছাদের নীচে ফেরার সময় হবে তখন কী কখনও কখনও মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়াতে পারবে?
পারব মাধবীলতা।
তারপর ধরো খুব মাঝে মধ্যে বাজার করে ফিরতে পারবে আমার সাথে? বৃষ্টি ভিজতে পারবে?
পারব মাধবীলতা। –
আমার দিন শেষের একদম নিজস্ব আস্তানা হতে পারবে?
পারব মাধবীলতা!।
জীবনের কাছে এর চেয়ে বেশি কোনও দিন কিছু চাইনি আমি রাজপুত্র!।আমার বেঁচে থাকার স্বপ্ন হয়ে দু চোখে নেমে এস…।
রাত গভীর। ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে ঘরে ঢোকে প্রণয়। আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরবে ভেবেছিল কিন্তু রাত এগারোটার সময় একটা কল চলে আসলো..। টেবিলে ঢাকা দেওয়া খাবার খেয়ে বিছানায় এসে শোয় ক্লান্ত প্রণয়। চাঁদের আলো এসে পড়েছে পাশে শোয়া বিউটির মুখে, বড় পবিত্র দেখাচ্ছে ওকে।স্নেহভরে বিউটির চুল ঘেঁটে দেয় প্রণয়, তখনই চোখ খোলে বিউটি সেই বাসি কাজল দেওয়া আয়ত চোখের দিকে চেয়ে প্রণয় বোঝে এখনও কত সুন্দর! আর বিউটি কি দেখে? যুদ্ধ-ক্লান্ত এক রাজপুত্রকে। যে সারাদিনের বেঁচে থাকার যুদ্ধ করে গভীর রাতে তার কাছে এসেছে একটু আশ্রয়ের জন্য। আর কয়েক ঘন্টা বাদেই সূর্য উঠবে আবার, নিজেদের কাজে বেরোতে হবে ওদের রুটিন মাফিক। আবার সারাদিনের রোজনামচা! তবুও ওরা জানে রাতে একে অপরের কাছে এই ফিরে আসা এই চোখে চোখে চেয়ে একে অপরকে দেখা এটাই সত্যি, এই চেয়ে থাকাই বেঁচে থাকা।