Getting your Trinity Audio player ready...
|
আমি, জয়া আর দীপা। সেই ছোটবেলা থেকেই আমরা একসাথে থাকতাম। এক থালে খাওয়া, এক খাটে ঘুমানো, এক টেবিলে পড়তে বসা, মোটামুটি সবই একসাথে। কারণ আমরা তিন জনই একই ঘরের সন্তান। শৈশব যখন মনে পরে আমার, চোখ বন্ধ করে সেই দিন গুলোর কথা ভাবি আমি। এখানে কোনো চরিত্রই কাল্পনিক নয়, সবই বাস্তব, স্মৃতিগুলোও সত্যি।
আমাদের মধ্যে জয়া সবার বড়, আমি মাঝে আর দীপা সবার ছোট। স্কুল ব্যাগ কাঁধে নিয়ে যখন হাঁটতাম মনে হতো তিনটা কচ্ছপ হেঁটে যাচ্ছি আমরা। ধীরে ধীরে হেলে দুলে হাঁটতাম। চলতে ফিরতে কখনো জয়াকে লাথি মারতাম, কখনো দিতাম দীপার গায়ে থাবা। দীপা শান্ত মেজাজের হলেও জয়া ছিল ভীষণ দুষ্টু। আমার সাথে দুষ্টুমিতে পেরে উঠতো না বলে এটা ওটা বলতো দীপাকে। বেচারি দীপাটা আমার আর জয়ার দুষ্টুমি সইতে না পেরে কান্না করতো। আমি তো দীপাকে একবার রেগে গিয়ে স্লেট ছুড়ে মারি। স্লেটটা দীপার গায়ে না লেগে আয়নায় গিয়ে পরে, আর আয়নাটা ভেঙে যায়। এতে দীপার কিছু হয়নি দেখে আমি ওর গালে খামচি দি, এতে ওর গালে দাগ হয়ে যায়, মেয়েটা এখন বিশ/বাইশ বছর, ভালো করে পরখ করলে হয়তো দাগটা এখনো দেখা যাবে ওর গালে।
পাড়ার আর দশ জনের মতো আমরাও ক্রিকেট খেলতাম। সবাই ছেলে আর জয়া একজন মেয়ে খেলতো আমাদের সাথে। সারা পাড়ায় ছোটদের মধ্যে আমি আর জয়া, আমরা দুজনই বামহাতি ব্যাটসম্যান ছিলাম। আমরা বাড়ির উঠোনে ঠাকুর ঘরের সামনে খেলতাম। জয়া শুধু বাম দিকেই বল মারতো, আর বাম দিকে ছিল ঠাকুর ঘর। ঠাকুর ঘরের চালায় বল তুলে দিতো জয়া। তাই আমদের লিডার সবুজ মামা নতুন আইন করে যে, ঠাকুর ঘরের চালে বল মারলে ক্যাচ ধরতে পারলে সেটা আউট হবে। সবুজ মামাটা কে জানেন? আমাদের সবার গুরু, সবাই মামার কথা শুনতাম। যতটুকু মনে পরে, ছোটবেলায় মামা আমাদের গরুর গোবর খায়য়ে দিয়েছিল। এমন কোনো জঘন্য দুষ্টুমি নেয় মামা আমাদের সাথে করে নি। তবে এখন এসব মনে পরলে হাসি পাই। কি বোকাটাই না ছিলাম ছোটবেলায়!
একদিন জয়া আমাকে আউট করে বসলো, আমাকে আউট করে জয়া নাচতে শুরু করে দিলো। আমি রেগে গিয়ে জয়ার মাথায় ব্যাট দিয়ে মেরে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিলাম। জয়া খুব কান্না করেছিল, ওর মা এসে আমার নামে আমার মায়ের কাছে নালিশ করে। তারপর রাতে পড়তে বসলে আমাকে সারা বাড়ি ঘুরে আসতে বলা হয়। কি বিশ্রি একটা শাস্তি! আমি রাতের অন্ধকারে ভয়ে ভয়ে সারা বাড়ি ঘুরতে গিয়ে কান্না করে দিই। পরে আবার জয়ার কাছে ক্ষমা চাইতে হয়।
আরেক দিনের ঘটনা। আমাদের সমবয়সীদের মধ্যে আরও দুজন ছিল। ইন্দ্রানী মাসি আর আমার বন্ধু নয়ন। সবুজ মামা নয়নকে নিয়ে বেশি দুষ্টুমি করতো। খেলতে গিয়ে বল হারিয়ে গেলে নয়নকে পাঠাতো বল আনতে, স্নান করতে গিয়ে নয়নকে পানিতে চেপে ধরতাম আমরা, কতবার যে নয়নের গামছা, প্যাণ্ট খুলে দিয়েছিলাম এসব মনে নেই। তখন এসব তামাশা দেখে হাসতাম সবাই মিলে, এখন সময়ের প্রয়োজনে বড় হয়ে গিয়েছি সবাই, কেউ এরকম দু্ষ্টুমি করতে দেখলে ডাক দিই। অথচ যাদের ডাক দিচ্ছি তাদের ঐ বয়সে আমরা ওদের চেয়েও বেশি দুষ্টুমি করেছিলাম।
যেকোনো বন্ধের দিনটা আমরা বেশি উপভোগ করতাম। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে আমরা তিনজন চলে যেতাম পুকুরে। দাঁত ব্রাশ করতে করতে কতবার যে টুথপেস্ট খেয়ে
ফেলেছি, কতবার যে টুনুর গায়ে কুলি করে ফেলেছি তার হিসেব নেই। যাই করতাম না কেন, টুনু আমাদের সবসময় ভরসা দিতো, সমস্ত বিপদ থেকে আমাদের আগলে রাখতো, টুনু হলো আমাদের তিনজনেরই দ্বিতীয় মা, সম্পর্কে আমার মায়ের আপন কাকাতো বোন মানে আমার মাসি।
এই ধরেন, ভাত খাওয়ার পর পেটে মোচর দিয়ে উঠলো। আমি, জয়া, দীপা তিনজন একসাথেই টয়লেটে যেতাম। ছোট তো তখন, তাই ল্যাট্রিনে যেতে ভয় হতো। বাড়ির বড় উঠানেই আমরা লাইন ধরে তিনজন বসে যেতাম আর কাজ সেরে টুনুকে ডাকতাম- টুনু, আসো, ধুয়ে দাও। ডানহাতে লেবু পাতা নাকে দিয়ে আর বামহাতে বদনা নিয়ে টুনু আমাদের সাফ করে দিতো। আহা, হাসি পাচ্ছে, ব্যাপারটা কত্ত মজার তাই না!
স্কুলে যাওয়ার সময় যতটা না কান্না করতাম, স্কুল ছুটির পর তার চেয়ে বেশি খুশি হতাম। আমি আর জয়া প্রথমে একই ক্লাসে পড়তাম। রত্না দিদিমণির ক্লাসে জয়া আমার পাশে বসেছিল। আমার একটা ছাতা ছিল যেখানে একটা প্লাস্টিকের বাঁশি লাগানো ছিল। জয়া একটু পরপর বাঁশিতে ফুঁ দিতো আর রত্না দিদিমণি বারবার বিরক্ত হয়ে যেতো। পরে তিনি জয়াকে ডেকে ছাতার বাঁশিটা একটা ব্লেড দিয়ে কেটে নিয়ে নিয়েছিলেন। আমি স্কুল ছুটির পর বাঁশিটা বাজিয়ে ঘরে ফিরতাম। জয়ার কারণে আমার আর বাঁশি বাজানো হয় নি। তারপর যখন জাতীয় সংগীত গাইতাম, আমাদের হেড স্যারের কাছে সেই বাঁশিটা দেখেছিলাম। তিনি ওটাতে ফুঁ দিয়ে আমাদের “সোজা হও/ আরামে দাঁড়াও” বলতেন। কি আর আরামে দাঁড়াতাম! জয়ার কারণে আমার আরামটা হারাম হয়ে গিয়েছিল।
সেই বছর বার্ষিক পরীক্ষার আগে আমার থাইরয়েড গ্রণ্থি ফুলে যাই। আমি ভীষণ কষ্ট পাচ্ছিলাম, গলাটা ভীষণ ব্যথা হয়ে গিয়েছিল, পরীক্ষায় বসা প্রায় দুষ্কর হয়ে পরে। ফলে শহরে গিয়ে আমার টনসিল অপারেশন করানো হয়। আমি জয়ার সাথে আর একই ক্লাসে পড়তে পারি নি। সেই থেকে আমি আর দীপা সহপাঠী হয়ে গেলাম। সাধারণত ছয় বছরের বাচ্চাকে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করানো হয়। আমাকে আমার মা পাঁচ বছর বয়সে ভর্তি করিয়ে দেয়। সৃষ্টিকর্তা যা করেন ভালোর জন্যই করেন, আমি ছয় বছর বয়স থেকে আবারও প্রথম শ্রেণিতে পড়বো। আমি দীপ, আর ও দীপা, আমাদের নামটা বেশ মিল। আর জুটি হিসেবে দীপ-দীপা’কে তো পুরো স্কুল চিনতো।
জয়ার বাবা কলেজের কর্মচারী ছিলেন। বন্ধের দিনে ওনাকে ঘরে পেলে ওনার সাইকেলের পেছনে বসে উপজেলা সদরে ঘুরতে যেতাম। পলাশ মামার সাথে কত ক্রিকেট খেলেছি, সুমন মামার কাঁধে চড়ে কতবার বাজারে গিয়েছি, আর শিমুল মামা তো ছিল আমার বন্ধুর মতো। মামা-ভাগনে তখন থেকেই কুস্তি খেলতাম। আমি এমনেতেই ফর্সা, তার ওপর মামার মার খেয়ে একদম লাল হয়ে যেতাম-এটা আমার মনে নেই, মামার মুখে শুনেছি। খেলায় স্বাভাবিক ভাবে আমিই হারতাম।
যখন বৃষ্টি হতো, বর্ষাকালে আম পরলে কে কার আগে আম কুড়োবে সেটা নিয়ে ছোটখাটো যুদ্ধ হয়ে যেতো। বাড়ির পেছনে বড় আম গাছের আম, নয়নদের গাছের লিচু আম, ইন্দ্রানী মাসিদের কলা আম কিংবা সবুজ মামাদের সিন্দুর আম- সব কুড়িয়ে কে কয়টা পাবে তার ভাগ হতো। সবুজ মামা নয়নকে কাজ করাতো বেশি, খেতে দিতো একদম কম। নয়নের বাড়ি থেকে লবণ, মরিচ, মসলা সব এনে আমরা খেতাম আর নয়নকে দিতাম আমের খোসাটা। এরকম অপমান করে আমরা এক প্রকার পৈশাচিক মজা পেতাম। আর আম কাটার দায়িত্বটা থাকতো বরবারের মতো ইন্দ্রানী মাসির। কারণ ওদের ঘরের পেছনে ছোট একটা জায়গা জুড়ে আমরা আম খেতাম।
বিকেলে গরমের দিনে ক্রিকেট খেলতাম আমরা আর শীতের সময় বেশি চলতো লুকোচুরি খেলা। কেও চোর হলে তার আর রক্ষে নেই। পরপর তিনবার চোর হলে তার মাথায় পিঁপড়া রেখে উলুধ্বনি দিতাম, আর বলতাম- আজকে তোর সাথে পিঁপড়ার বিয়ে।
রাতে সবুজ মামা, ইন্দ্রানী মাসি কিংবা নয়নের সাথে দেখা হতো না। আমরা তিনজন পড়তে বসতাম একই টেবিলে। জয়ার বাবা জয়ার জন্য অর্থ বই কিনে আনতো। অর্থ বইকে বর্তমানে আমরা গাইড বই বলে থাকি। সেই অর্থ বই নিয়ে চলতো কাড়াকাড়ি। জয়া এক ক্লাস ডিঙিয়ে যাওয়ার পর, বই গুলো আমাকে দিবে না কি দীপাকে দিবে তা নিয়ে হাঙ্গামা হতো। স্বভাবতই জয়ার বইগুলো আমিই পেতাম।
আমাদের তিনজনের বেশ মিল ছিল বলা যাই। একসাথে থাকা, খাওয়ার পর, অসুখও একদম একসাথে, তাও একই অসুখ। চিকেন পক্স হয়েছে আমাদের তিন জনের, সাথে খোঁস-পাঁচড়ার মতো বিশ্রি রোগ। আমাদের মা-মাসিরা আমাদের শরীরটাকে গরম পানি দিয়ে প্রতিদিন ধৌত করতেন। কোনো একদিন আমরা আবার সুস্থ-সাবলীল হয়ে যেতাম। কিন্তু আমাকে একবার জলবসন্ত আক্রমণ করেছিল। সে যে কি কষ্ট কি বলবো! তবে সেই সময় ছোট বয়সে না বুঝলেও এখন বুঝতে পারছি যে পরিবার, একজন মানুষের জীবনে কি পরিমাণ গুরুত্ববহ। একটি ভালো পরিবার পেতে গেলে সাধনা করতে হয়। হয়তো আগের জন্মে অনেক পুণ্য করেছিলাম তাই সবার আদর-যত্ন পাচ্ছি।
স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষায় আমি সবসময় প্রথম আর দীপা হতো দ্বিতীয়। বাড়িতে আসলে আমাদের নিয়ে মোটামুটি সেদিন ভালো একটা ভোজনপর্ব হয়ে যেতো। মেজ দাদু কাগজের ঠোঙা বানাতো। আমাদের বই পুরোনো হয়ে গেলে দাদুকে দিয়ে দিতাম, দাদু আমাদের জন্য প্রায় সময়ই পিঁয়াজু নিয়ে আসতো। ব্রাহ্মণহাটের মিলন কাকার দোকানের মিষ্টি কিংবা কালী মন্দিরের সামনে বসা জোয়ান লোকটার নিজ হাতে তৈরি পিঁয়াজুর স্বাদ এখনও ভুলি নি।
একবার স্কুল থেকে ফেরার পথে দীপার ডায়রিয়া হয়ে যায়। আমাদের পেছনে ফেলে দৌড়তে থাকে দীপা। পরে ঘরে গিয়ে শুনি চাপ সামলাতে না পেরে নিজের পোশাক নোংরা করে ফেলেছে দীপা। ছোটবেলায় প্যাণ্টে হিসু করা কিংবা মলত্যাগ করে চুপটি করে বসে থাকা- কে করে নি এসব? আমিও তো বুল্টি মাসির ওপর রাগ করে হিসু করে দিয়েছিলাম। মাসি বাইরে বসে কাঁথা সেলাই করছিল। আমি ছাদে উঠে জানালার কোণায় গিয়ে একদম মাসির মাথায় মুত্র বিসর্জন করে দিয়েছিলাম। দুষ্টুমির কথাগুলো মনে পরলে শৈশবে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে।
রাত যখন আটটা নয়টা হয়, সেজ দীদার কাছে আমরা তিনমূর্তি বসে যেতাম মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে। সেজ দীদার পরিবারকে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী যখন তাড়া করেছিল ওনারা পুকুরের পানিতে ডুবে ছিল নাকটা উপুড় করে দিয়ে। ঘরের পুরুষ মানুষগুলো গাছের ওপর, খাটের নিচে কিংবা মাটির বড় চুলার ভেতরেও ডুকে আশ্রয় নিতো। উদ্দেশ্য একটাই বাঁচতে হবে। আমাদেরকে একাত্তরের ভয়াল কাহিনির গল্প শুনাতেই হয়তো সেজ দীদা এখনো বেঁচে আছেন। গল্প শুনতে গিয়ে দীদার পাশে বসে এক প্রকার অব্যক্ত ভালোবাসা খুঁজে পেতাম।
আমাদের তিনজনের এই গল্পে সবচেয়ে যে টি প্রাধান্য পাবে তা হলো ভালোবাসা। যতই খুনসুটি হোক না কেন, দিনশেষে আমরা আবার এক হয়ে যেতাম। কেউ কাউকে ফেলে খেতাম না, কোথাও গেলে আবার ফিরে আসার একটা টান থাকতো। কোনো অপরাধ করলে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দেওয়ার একটা আলাদা মজা পেতাম। যেমন ধরুন- সবুজ মামাদের বাড়িটা পাকাপোক্ত করবে। তার জন্য ভেনগাড়ি করে মালামাল আনা হচ্ছিল। আমি, জয়া আর ইন্দ্রানী মাসি গাড়িতে চড়ে বসলাম। হঠাৎ ভেনের শেষপ্রান্তে গিয়ে তিনজনই দাঁড়িয়ে গেলাম। আর ভেন চিৎপটাং! উল্টে গিয়ে ইন্দ্রানী মাসির ওপর আমি আমার ওপর জয়া। জয়া উঠেই দৌড় দিলো, আমি কোনো রকমে উঠলেও ইন্দ্রানী মাসিকে তুলতে যাই নি ভয়ে। মাসিকে ফেলে আমরা পালিয়ে গেলাম। পরে শুনলাম, ভেনওয়ালা মাসিকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। জয়ার কিছু হয় নি, আমার চোখের নিচে ছিড়ে গিয়েছিল আর ইন্দ্রানী মাসি শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাত পেয়েছিল।
আনন্দ মামার কথা একটু না বললেই নয়। নামে কাজে একদম মিল। আমাকে আর জয়াকে ভীষণ কাঁদাতো মামা। আমরা যেখানে পড়তে বসতাম, সেই টেবিলের পাশে একটা মুরগির বাসা ছিল। একদিন আমাকে মুরগির বাসার ভেতরে আর জয়াকে ওপরে বসিয়ে দিলো মামা। আমি ঘেমে যখন কান্না শুরু করে দিলাম, মামা আমাকে বার করে মাটিতে নামিয়ে দেয় কিন্ত জয়াকে নামাই নি। এরপর খুব বিচ্ছিরি একটা কাজ করেছিল মামা। খুবই হাস্যকর কথাটা। মামা জয়ার গাল চিপে ধরে হা করায় জয়ার মুখে থু থু দিয়েছিল। ছি! কেমন কথা! জয়া রেগে যায় আর ওর মা’কে আনন্দ মামার নামে নালিশ করে দেয়। পরে আনন্দ মামার সাথে কী ভাবে জয়ার বনিবনা হয় আমার মনে নেই।
কোনো কারণে যদি আমাদের কপালে সিংগার বা সমুচা জুটতো তাহলে সেদিন বিরিয়ানি খাচ্ছি মনে করে খেতাম। মনে করুন, পলাশ মামা সিংগারা এনে দিলো। কে খাবে, কয়টা খাবে সেটা বড় কথা না, একটু গন্ধ পেলেও মনে করতাম আমরা বিরিয়ানি খাচ্ছি। আহা! এখন দিনে দিনে না হোক প্রতি সপ্তাহে অন্তত এসব খাই। একসময় যা আমাদের কল্পনা ছিল তা এখন আমাদের কাছে কিছুই না। সময়টা পাল্টাচ্ছে, আমরাও বদলে যাচ্ছি।
খাবারের কথা যখন বললাম, আঁচাড়-চকলেট খাই নি তা কি করে হয়! গ্রামের ছেলে মেয়ে হয়ে এক টাকার বাদাম খাবো না, দুই টাকার আইসক্রিম খাবো না তা কি মানা যাই! প্রতিদিন জুটতো না, যদি এক টাকা পেতাম মা বাবার কাছে, ওটা দিয়ে স্কুল থেকে ফেরার সময় বরই আঁচাড় কিংবা চালতার আঁচাড় কিনতাম। সবাইকে একটু করে করে ভাগ করে দিয়ে নিজে যা থাকতো তাই খেতাম। এখন তো ছেলেমেয়েরা একশ দুশো টাকা নিয়ে স্কুলে যায়, দশ টাকার ডেইরি মিল্ক চকোলেট, তিরিশ টাকার চকবার আইসক্রিম, একপ্লেট ফুচকা কিংবা চটপটি না হলে দিন যায় না ওদের। আমাদের সময়ে এসব খাওয়া দূরে থাক, নামও শুনি নি। আর যদি বন্ধের দিনে বাড়িতে থাকাকালে আঁচাড় বিক্রেতা আসতো, আমাদের মোক্ষম অস্ত্র ছিল টুনু। টুনুকে জড়িয়ে ধরে, কাপড় টেনে ধরে, হাত পা ধরে টেনে হিঁচড়ে বার করতাম ঘর থেকে। টাকা থাক আর না থাক, আঁচাড় খেতে হবেই আমাদের। বিক্রেতাকে টাকা পরে দেয়ার কথা বলে আমরা নাচতে নাচতে ঘরে আসতাম। এক টাকা দামের নারিকেল আইসক্রিম, বস্তা আইসক্রিম আমাদের সাপ্তাহিক খাদ্য তালিকায় থাকতো। আইসক্রিম খেয়ে ঠাণ্ডা লাগলে মায়ের বকুনি তখন কে শুনে! সুমন মামা যদি চিপস কিনে আনতো সেটা নিয়ে কাড়াকাড়ি পরে যেতো। ওই চিপ্স নামের খাবারটাই ছিল আমার সবচেয়ে বড় দু্র্বলতা। আর যদি শিমুল মামা লাল চকলেট গুলো কিনে আনতো, চকলেট খাওয়ার পর, চকলেটের খোসা চোখের ওপর দিয়ে বলতাম- আকাশটা, লাল হয়ে যাচ্ছে। আর যদি জরি চকলেট বা ঝিকিমিকি চকলেট এনে দিতো কেউ তাহলে জরিগুলো হাতে পায়ে লাগিয়ে নাচতাম। এক টাকা দিয়ে দুটো জরি চকলেট আর এক টাকা দিয়ে চারটে লাল চকলেট খেয়ে বড় হয়েছি বলে আমরা তিনজনই হয়তো দশ টাকার বেশি দামি চকলেট না খেয়ে একটু কম দামি পাঁচ টাকার চকলেট কিনে খাই এখন। জীবনে চলতে গেলে অনেক হিসাবী হতে হবে, সেটা ছোটবেলার খাদ্যাভ্যাস থেকেই আমরা শিখেছি। ইচ্ছের ঝুলিতে অনেক কিছু থাকলেও বিরিয়ানির স্থলে আমাদের সাদা ভাত খেতে দিলেও কিছু মনে করতাম না।
ছুটির দিন কিংবা সাপ্তাহিক ছুটি বিশেষ করে শুক্রবারে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বসে যেতাম বাংলা ছায়াছবি দেখতে। এই যে, এখন যেসব মোবাইলে গুগল বা ইউটিউব করলেই পাওয়া যায় ওসব আমরা জানতামও না। জানবোই বা কি করে! কারও তো এন্ড্রয়েড মোবাইল নেই, বটম ফোন থাকলেও তা শুধু কথা বলার জন্য। এখন যত বড় হচ্ছি, মোবাইলের ব্যবহাটাও বাড়ছে, সবাইকে নিয়ে বসে সিনেমা দেখাও হয় না। আর হবেও কী করে? আজকাল তো জসিম, ববিতা, শাবানা, আলমগীর, প্রবীর মিত্র, অমল বোস, দিলদার- ওনাদের জায়গায় বেশরম বিশিষ্ট কতিপয় নায়ক নায়িকার আগমন ঘটেছে। এসব কি পরিবার নিয়ে দেখা যায়! নিজের একটা পরিপক্বতা আছে না!
শুক্রবার প্রতি সন্ধ্যায় আলিফ লায়লা দেখতাম আমরা। আলিফ লায়লার মাথা কাটা জ্বীন, জাদুকর গুল্ফাম, সাদা ভূত দেখে কতবার যে ভয়ে চিৎকার দিয়েছিলাম, জানা নেই। টুনু তো দেখতেই পারতো না। দেখবেই কি করে, টুনু বেশ সাংসারিক মেয়ে। স্নান করতে গেলে টুনুর ওড়না দিয়ে আমরা মাছ ধরতাম। একটা চিংড়িও যদি পেতাম, ছোট একটা পুকুর বানিয়ে পানি দিয়ে ওখানে মাছটা রেখে দিতাম। আমাদের স্নান করানো, কাপড় পরানো, খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো সমস্ত দায়িত্ব ছিল টুনুর। আমরা চিরকাল ঋণী এই নারীর কাছে।
ইন্দ্রানী মাসিদের ঘরের পেছনে আমাদের একটা জমি ছিল। ওখানে মোটামুটি সকল ধরণের সবজি চাষ হতো। ধানগাছ কাটার পর অবশিষ্ট অংশকে আমরা আমাদের ভাষায় “ন্যাড়া” বলি। ঐ ন্যাড়া কাটার একটা প্রতিযোগিতা হতো আমাদের। কাঁচি দিয়ে ন্যাড়া কাটতে গিয়ে হাত কেটে ফেলা আমাদের সাধারণ ব্যাপার ছিল। হাত কাটুক আর যাই হোক, আমরা গ্রামের সন্তান, কাটা-ছেড়ায় ভয় পেতাম না।
কাটাকাটির কথা যখন এলো, চুল কাটার কথাটা একটু বলি।নিতাই নাপিত ছিল আমাদের স্থায়ী নাপিত। আমরা তিনজন এক লাইনে বসে যেতাম, নিতাই নাপিত আমাদের মাথা মুণ্ডন করে দিতো। জয়া আর দীপা মেয়ে বলে চুল রাখতো আর আমাকে প্রায়ই মাথা মুণ্ডন করে দেয়া হতো। এ নিয়ে কত কান্নকাটি করতাম আমি। বড় হয়ে কিন্তু নিজের ইচ্ছেটা পূরণ করতে পেরেছি, আমি মেটামুটি কাঁধ পর্যন্ত চুল রাখি এখন।
আচ্ছা! ছোটবেলায় গ্রামে বড় হয়েছেন, কিন্তু রান্নাবাটি খেলা খেলেন নি, এমন কেউ আছেন? ঠাকুর ঘরের মেঝেতে আমরা রান্নাবাটি খেলতাম, আর বৃৃষ্টি হলে আমাদের ঘরের ভেতর। মাটি এনে তা পানিতে ভিজিয়ে কাদামাটি বানিয়ে কত যে থালা বাসন বানিয়েছিলাম আমরা! ছোটবেলায় ছোটখাটো কুমোর ছিলাম বটে। তিনটা ছোট ইটের টুকরো এনে চুলো বানিয়ে ওখানে মাটির তৈরি পাতিল বসিয়ে দিতাম। আর আগুন তো নেই, তাই মুখে একটু শোঁ শোঁ শব্দ করে চুলায় আগুন জ্বলছে ভাব নিতাম। আমি বাজার থেকে তরকারি এনে দিতাম, দীপা তরকারি কুটে দিতো, জয়া রান্না করতো। এই নিয়ে ছিল আমাদের তিন অবুঝ বাচ্চার ছোট্ট সংসার। মাঝে মাঝে অতিথি হিসেবে পুরোহিত মশায় আসতেন। আমাদেরকে বলতেন- দাদুভাই, রান্না হলে আমাকেও ডাকিও। আমরাও ব্রাহ্মণ দাদুকে মাটির বাসনে ভাত তুলে দিয়ে খেতে দিতাম। ভাত মানে কী জানেন? ধুলো বালি হলো ভাত আর ছোট উদ্ভিদের পাতা হলো তরকারি।
দীপা ছাড়া আমরা সবাই সাইকেল চালাতে পারতাম। আমি জয়া, সবুজ মামা কতবার যে সাইকেল প্রতিযোগিতা দিয়েছি তার হিসেব নেই। বিশ্বাস করুন, মাত্র তিন টাকা দিয়ে তখন এক ঘণ্টা সাইকেল চালানো যেতো। একদিন দুপুরে বড়রা সবাই খাওয়া দাওয়া নিয়ে ব্যস্ত। দীপা আর জয়া মনে হয় টিভি দেখছিল। আমি বাড়ির বাইরে জয়ার বাবার সাইকেলে রেইনট্রি গাছের একটা পাতা ঢুকিয়ে দিয়ে খেলছিলাম। হঠাৎ পাতাটা সাইকেলের শিকলে আটকে যায়। আমি বোকা ছেলেটা পাতাটাকে বার করতে গিয়ে এক অঘটন ঘটিয়ে ফেলি। এক হাতে সাইকেলের প্যাডেল ঘুরাচ্ছি আর অন্য হাতে পাতাটা টান দিয়ে বার করতে চাচ্ছিলাম। ফলাফল যা হওয়ার হলো- আমার তর্জনী আর মধ্যমা আঙ্গুলে সাইকেলের দাঁত একদম ভালো মতো ঢুকে গেলো। বাড়িতে শিমুল মামা না থাকলে সেদিন আমার কি হতো জানি না! মামা এসে অনেক কষ্টে আমার হাতটা বার করে এনেছিল। আমি কান্না করতে করতে আধমরা হয়ে গিয়েছিলাম। পরে সবুজ মামার বাবা ডাক্তার দাদু আমার চিকিৎসা করান। এলাকায় ডাক্তার দাদুর ডাক্তারির বেশ সুনাম ছিল, এখনও আছে বটে।
আমাদের গ্রামে দুর্গা পূজায় সবচেয়ে বেশি মজা হতো। যাদের চিনতামও না, তাদেরও সেদিন দেখা যেতো। বিভিন্ন বয়সের বিভিন্ন কিছিমের মানুষের সমাগম হতে। ঢাক ঢোল পিটিয়ে, মন্ত্র ধ্বনি উচ্চারণ করে মাইক ফাটিয়ে, ধুতি-পাণ্জাবীতে পুরুষ আর শাড়ী পরিহিতা রমণীদের আগমন হতো পূজো মণ্ডপে। সে এক অপূর্ব, অনাবিল, অসাধারণ মুহূর্ত ছিল। এখনো সব ঠিকই আছে। কিন্তু পূজো মণ্ডপে মন্ত্রের ধ্বনির থেকে পশ্চিমা দেশের সংগীতের আওয়াজ বেশি শুনা যায়। কারো কারো ভাষায়, এটাই নাকি মডার্ন হওয়ার একটা শর্ত। বুঝিনা আমি, লালন ফকিরের দেশে মাইকেল জ্যাকসন এসেছে বলে কি আমাকেও বাঙ্গালীর বেশ ছেড়ে ববি বা ড্যানি সাজতে হবে?
জন্মাষ্টমী পূজাতেও কম মজা হতো না কি! শহরের আত্মীয় স্বজনরা আসতো। আগের বছরের প্রতিমা বিসর্জন দিয়ে নতুন প্রতিমা আনা হতো। বসুদেব আর কৃষ্ণ ঠাকুরকে জয়ার বাবা একাই কাঁধে তুলে নিয়ে আসতো আর আমি ঠাকুরের সাথে বাহন হিসেবে থাকা শেয়ালের মূর্তিটা নিতাম। বিসর্জনের পর প্রতিমার কাপড় গুলো পুকুর থেকে তুলে আনতাম। ওগুলো গায়ে জড়িয়ে মোটামুটি কৃষ্ণ ঠাকুর সেজে একটা ভাব নিতাম। নারিকেল পাতা দিয়ে তৈরি বাঁশি হাতে নিয়ে কৃষ্ণ সাজতাম। তখন যদি মোবাইল থাকতো কত স্মৃতি যে ধারণ করে রাখতে পারতাম! এখন বাড়ির জন্মাষ্টমী পূজোটা ঘটা করে হয় না। আর বড় হয়ে গিয়েছি বলে হয়তো নকল কেষ্ট ঠাকুরও সাজা হয় না।
দুই চোখ বেয়ে দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পরলো আমার। আজ সব সত্যি মিথ্যে মনে হচ্ছে আমার। মনে হচ্ছে, কৃষ্ণচূড়া ফুল গাছটার নিচে বসে আমি আমার শৈশবটাকে ভাবছি। জয়া আর দীপা চুলাচুলি করছে, সবুজ মামা আমাকে ক্রিকেট খেলতে ডাকছে, ইন্দ্রানী মাসি আম কাটছে আর বেচারা নয়ন ছেলেটা পাপী বান্দার মতো দাঁড়িয়ে আমাদের কার্যকলাপ দেখছে। আজ আমার ভাবনাটা হয়তো সত্যি কিন্তু চাওয়াটা সম্পূর্ণ অলীক কিংবা কাল্পনিক। আমার মামা-মাসি, ভাই-বোনদের সবারই মোটামুটি বিয়ে শাদী হয়ে গিয়েছে, বাচ্চাও আছে কারও কারও। সবাই কত পরিণত হয়ে গিয়েছে। আমিও বা ছোট না কি! তেইশ বছরের এই আমি যুবক ছেলেটা কিছুক্ষণের জন্য ফিরে গিয়েছিলাম নিজের পাঁচ/ছয় বছরের জীবনে। আত্মীয় স্বজন সবাই ঠিকই আছে, নেই শুধু আগের মতো পরিবেশটা, আগের মতো শৈশবটা, সেই ঠাকুর ঘরের চালাটা কিংবা লাল লাল ফুলে ভরে ওঠা কৃষ্ণচূড়া ফুল গাছটা। যে গাছের ছায়ায় আমরা আমাদের রঙিন জীবনটা কাটিয়েছিলাম, খেলতে গেলে বল আটকে গিয়ে আর ছক্কা হতো না কিংবা দৌড়ানি দিতে গিয়ে উষ্ঠা খেয়ে পরে যাওয়া-কোনো অস্তিত্ব নেই আজ কৃষ্ণচূড়া গাছটার।
শৈশবের সেই আইসক্রিম’অলাটা আর আসে না, শুনলাম বার্ধক্য জনিত কারণে মারা গিয়েছেন উনি। আঁচার বিক্রেতাটা তো কবেই গত হয়েছেন। বার্ধক্যকে যদি খণ্ডানো যেতো তাহলে আজকে আমি আবার সবাইকে চাইতাম আমার পাশে। সময়ের তাগিদে আমরা সবাই অনেক বড় হয়ে গিয়েছি। সেই ঝড়ের দিনে আম কুড়ানোর স্মৃতি, মেজ দাদুর পিঁয়াজু কিনে আনা, বর্ষায় ভেলায় চরে পুকুরে ঘুরা, বৃষ্টিতে ভিজে সর্দি-কাশি হয়ে ঘরে এসে মায়ের উদোম কেলানি খাওয়া কিচ্ছুটি আজকে আর নেই। সম্ভব হলে ফিরে আনাও যাবে না। কিছু স্মৃতি অমলিন হয়ে মন থেকে মুছেও গিয়েছে। নিজের শৈশবটাকে নিয়ে চিন্তা করতে গেলে এখন নিজেকে বড় পাপী বলে মনে হয়। বইয়ের পাতাই যত অক্ষর লিখেছি তত বছর বেঁচে থাকুক আমার এই স্মৃতিগুলো। একদিন নিজের ছেলেকে কিংবা নাতিকে রূপকথার গল্প বলে শুনিয়ে দিবো এসব।
অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি, পড়তে বসার সময় যেই ভাবে বসতাম বাম পাশে জয়া আর ডান পাশে দীপা এসে সেই ভাবে বসলো। আমি ওদেরকে একই সমান্তরালে আমার চোখের সামনে বসিয়ে দিলাম। আমরা এখন তিনটি বিন্দু, বিন্দুত্রয়ী একসাথে যোগ করে তিনটি রেখা তৈরি করলাম, এবার আমরা সুতরাং এ বসে আছি আর গল্পের সারাংশটা লিখার চেষ্টা করছি। কিন্তু কিছুতেই লিখতে পারছি না, যতই সারাংশ লিখতে যাচ্ছি, গল্পটা বর্ণনা হয়ে যাচ্ছে।
জয়া আর দীপা একজন অন্যজনের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই দীপা আমার হাত থেকে খাতা-কলম টেনে নিয়ে বললো- গল্পের সমাপ্তি কর। জয়া বললো- সবুজ, ইন্দ্রানী, নয়ন সবাই লুকিয়ে পরেছে। তুই চোখ বন্ধ করে এক থেকে দশ পর্যন্ত গুণতে থাক, তুই চোর, আমাদের খুঁজে বার করবি। বলেই আমাকে বসিয়ে রেখে দুজনে উঠে গেলো। দীপা আবার পেছন ফিরে বললো- এই চোখ বন্ধ কর, আমরা লুকিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত চোখ খুলবি না