হিয়ার মাঝে| প্রেমে পড়া বারণ | কৌশিকী বল| Bengali Love Story
0 (0)

কপালে লাল টিপ, হাত ভর্তি চুড়ি আর লাল বেনারসি পরে আজ আমি সেজেছি সবাই আমার রূপের প্রশংসায় পঞ্চমুখ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে সত্যি যেন নতুন করে পেলাম আজ সত্যিই আমাকে অপরূপা লাগছে রোদ্দুরকেও ধুতি আর পাঞ্জাবিতে কী সুন্দরটাই না লাগছে ওর থেকে চোখ ফেরাতেই পারছি না আমি আজ আমাদের একসাথে এক যুগ পূর্ণ হল আমাদের বারো বছরের বিবাহবার্ষিকী আজ সেই আনন্দে আজ দিল্লিতে আমাদের ফ্ল্যাটে বিশাল অনুষ্ঠান সকলের উপস্থিতিতে গমগম করছে চারিদিক সকলের মুখেই এক কথা,

কি সুন্দর মানিয়েছে দুজনকে একদম মেড ফর ইচ আদার

আমার আর রোদ্দুরের আট বছরের মেয়ে মিলিও আজ আনন্দে মাতোয়ারা চারিদিকে ছুটে বেড়াচ্ছে সে আসলে পরিবারের ভালোবাসা তো সে কখনও পায়নি তাই একটু লোকজন দেখলে খুব খুশি হয় এত লোকজন ভালোবাসে যেই মেয়েটা সে কোনোদিন  পেলই না পরিবারের ভালোবাসা বুঝলই না ঠাকুরদা, ঠাকুমা, পিসি, পিসো সবার ভালোবাসা কাকে বলে হয়তো মিলির আজ এই পরিস্থিতির জন্য আমিই দায়ী ভাবতে ভাবতেই আজ এই খুশির দিনেও চোখের কোণায় জল চিকচিক করে উঠল আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল অতীতের পর্দা

আমার নাম প্রিয়াঙ্কা আমি তখন ক্লাস টুয়েলভে পড়ি কলকাতা থেকে তিন ঘণ্টা দূরে এক মফঃস্বলে আমাদের বাড়ি পড়াশোনা করতে আমার একেবারে ভালো লাগত না নাচ করতে আমি খুব ভালবাসতাম ছোট থেকেই অনেক ছোট থেকেই আমি অনেক ফাংশনে নাচ করেছি সবাই আমার নাচের প্রশংসা করত কিন্তু একটু বড়ো হতেই বাবা বলেছিল,

“এবার থেকে তোমার ফাংশনে নাচ করা বন্ধ ভদ্র মেয়েরা এভাবে চারিদিকে নেচে বেড়ায় না তার চেয়ে পড়াশোনায় মন দাও তোমার দিদিকে দেখো কত ভালো পড়াশোনায়

সেই থেকে শুধু বাড়িতেই অনুশীলন চলতো আমার কিন্তু আমার মন যে চাইতো সেই অত মানুষের ভিড়ে নিজেকে নৃত্যের তালে ভাসিয়ে দিতে বুঝতে পারতাম না যে একটা শিল্প প্রদর্শনীতেও এত কেন সমস্যা

আমার বাবা একটা দোকানে কাজ করত মা এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে বহু বছর আগে অভাবের সংসারে দুই মেয়ের পড়াশোনা চালাতে হিমশিম খেতে হত বাবাকে আমার দিদি কলকাতার এক কলেজে কেমিস্ট্রি নিয়ে মাস্টার্স করছিল আর তার পাশে আমি, যে কিনা ক্লাস টুয়েলভে দু’বার পড়ছিলাম বাবার অনেক আশা ছিল আমাদের দুজনকে নিয়ে কিন্তু পড়াশোনা যে কিছুতেই আমার মাথায় ঢুকত না অনেক চেষ্টা করেও পারতাম না তাই বাবার চিন্তার শেষ ছিল না আমাকে নিয়ে তবে আমি জানতাম যদি আমি নৃত্যকে সঙ্গী করে ভবিষ্যতে এগোই তবে নিশ্চয়ই পারব বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে কিন্তু সেই সুযোগও যে আমার ছিল না অবশেষে আমি ক্লাস টুয়েলভ পাশ করলাম কিন্তু আর পড়ার ইচ্ছে হল না ঘরেই বসে ছিলাম হঠাৎ একদিন পাশের বাড়ির এক কাকিমা অনিকেতের সম্বন্ধটা আনলেন আমার জন্য অনিকেত পেশায় সরকারি চাকুরে কলকাতায় নিজেদের বাড়ি কিন্তু বয়েসে আমার থেকে দশ বছরের বড়ো বাবা প্রথমে একটু না-না করেছিলেন কিন্তু পরে সবাই বলেছিল,

“আরে তোমার ছোট মেয়েটা তো আর বড়োটার মত মেধাবী নয় ও আর কি করতে পারবে জীবনে? তার চেয়ে বিয়ে দাও অন্তত একটা নিশ্চিত জীবন পাবে আর বয়েসটা কোনও ব্যাপার নাকি ছেলেরা একটু বেশি বয়সী হলে কিছু হয় না

বাবা আর আপত্তি করেনি আমার ইচ্ছে না থাকলেও বাবার ইচ্ছেতে বিয়ের পিঁড়িতে বসি মেধাবী না হোক অন্তত বাধ্য মেয়ে তো হতেই পারি

আমার মত একটা বেশিদূর পড়াশোনা না করা মেয়ে বউ হয়ে আসে কলকাতার এক ধনী অভিজাত পরিবারে অনিকেতের বাড়িতে ওর মা, বাবা, এক বোন আর শুনেছি ওর একটা ভাই আছে সে বাইরের রাজ্যে চাকরি করে ছুটি পায়নি বলে বিয়েতেও আসতে পারেনি, তবে চেষ্টা করছে কলকাতায় বদলি হওয়ার

বিয়ের পরের দিনই গলদা-চিংড়িতে নুন বেশি হওয়ায় শাশুড়ি মায়ের কটাক্ষ শুনতে হয়েছিল তিনি চিৎকার করে বলেছিলেন,

“এতগুলো মাছ সব দিল নষ্ট করে বলি তোমায় কি বাপের বাড়ি থেকে কিছু শিখিয়ে পাঠায়নি?”

পাশ থেকে আমার ননদ বলেছিল,

“কি করে জানবে মা বলো তো? যতসব ছোটলোক গরীব ঘরের মেয়ে হয়তো জীবনে এত দামী মাছ চোখেই দেখেনি

চোখ ফেটে জল এসেছিল সেদিন আমার তো মা ছিল না, ভেবেছিলাম হয়তো আর একটা মা পাব একটা নতুন পরিবার হবে আমার কিন্তু এক নিমেষে সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল আমার সবার থেকে লুকিয়ে আড়ালে চোখের জল মুছেছিলাম আমি

দেখতে দেখতে বিয়ের কয়েক মাস পেরিয়ে গেল কিন্তু একবারও নিজের বাবা আর দিদির সাথেও দেখা করতে যাওয়ার অনুমতি মেলেনি আমার দিদি এখন চাকরি নিয়ে ব্যাঙ্গালোরে থাকে বাবাকেও সেখানে নিয়ে গেছে আমার খুব ইচ্ছে করত ওদের সাথে দেখা করতে কিন্তু বাড়িতে বললেই বলত,

“তুমি অত দূর গেলে সংসারের কাজ কে করবে?”

বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসত শুধু এই বাড়িতে যে আমার জায়গা শুধু একটা কাজের লোকের সেটা ভালোই বুঝতাম আমি পায়ের ঘুঙুর দুটো সযত্নে তুলে রেখে দিয়েছিলাম আলমারিতে এখন আমার নাচ শুধু স্বপ্ন হয়েই রয়ে গেছে

আমার স্বামী মানুষটাও যেন বড্ড হিসেবি সারাদিন সে নিজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত কতথাকত আমার দিকে তাকানোর তার সময় নেই শুধু রাতে নিজের প্রয়োজন মেটাতে সে আসত আমার কাছে কেমন যেন ঘৃণা হত আমার নিজেকে একটা প্রয়োজনের বস্তু মনে হত শুধু আমারও তো ইচ্ছে করত অনিকেত আমার সঙ্গে বসে গল্প করুক একদিন আমরাও যাই সিনেমা দেখতে একদিন আমরাও খেতে যাই রেস্টুরেন্টে আমার রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে খুব ভালো লাগত আমারও ইচ্ছে করত কখনও ঘুম না এলে অনিকেত আমার মাথায় হাত বুলিয়ে গুনগুন করে গেয়ে উঠবে আমার প্রিয় গান,

“আমার পরান যাহা চায় তুমি তাই তুমি তাই গো…”

কিন্তু সেই সব কিছু যেন স্বপ্ন হয়েই থেকে গিয়েছিল

একদিন সাহস করে তাকে বলেছিলাম,

“আমি কোনোদিন  ভিক্টোরিয়া দেখিনি চলো না এই রবিবার ভিক্টোরিয়া যাই

অনিকেত বলেছিল,

“নাহ্, সারা সপ্তাহের খাটনির পর ওই রবিবার আমার আর বেরোতে ইচ্ছা করে না

আর কিছু বলিনি আমি মনে মনে ভেবেছিলাম,

“তুমি তো বেরোও কিন্তু আমার জীবনটা যে এই চার দেওয়ালে বন্দি কখনওও কি আমার সুখের কথা ভাব না তুমি আমি যে তোমার অর্ধাঙ্গিনী

কথাটা মনে আসলেও মুখে আনতে পারিনি কারণ মানুষটা বেশ রাগী আমার ভয় করত খুব

একদিন সাহস করে ঘুঙুরটা বের করে একটা গানের লাইনের সাথে কয়েক পা নেচে উঠেছিলাম আমার ননদ সুপর্ণা দেখে নিয়েছিল কীভাবে যেন তারপরই কথাটা তুলে দিয়েছিল অনিকেত আর তার মায়ের কানে তারপরই ঘরে সেদিন প্রচণ্ড অশান্তি হয়েছিল

শাশুড়ি মা বলেছিলেন,

“ছিঃ ছিঃ ভদ্র বাড়ির বউ পায়ে ঘুঙুর বেঁধে নাচছে

অনিকেত রাগতস্বরে জিজ্ঞাসা করেছিল,

“এসব কি সত্যি?”

আমি ভয়ে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলেছিলাম,

“আসলে আমি ছোটবেলা থেকেই নাচ করতে ভালবাসতাম তাই আর কি অনেকদিন পর ইচ্ছে করছিল…”

আমার কথা পুরো করার আগেই অনিকেতের শক্ত হাতের সজোরে একটা চড় এসে পড়েছিল আমার গালে

সে চেঁচিয়ে বলেছিল,

“তোমার সাহস তো কম নয় আমাদের বাড়ির বউ হয়ে তুমি নেচে বেড়াবে আর যেন দ্বিতীয় দিন এমন না হয়

আমি কান্না মাখা গলায় বলেছিলাম,

“আর এমন ভুল হবে না এবারের মত ক্ষমা করে দাও আমায়

ঘুঙুরটা টান মেরে ফেলে দিয়েছিল সেদিন অনিকেত

অনেক কেঁদেছি সেদিন কিন্তু এই বাড়িতে আমার চোখের জল মুছে দেওয়ার কেউ নেই যদিও আমি মনে মনে জানতাম যে আমি কোনও অন্যায় করিনি কিন্তু তবু প্রতিবাদ করার সাহস ছিল না আমার আমি আমার ভাগ্যকে মেনে নিয়ে এই নরকেই মানিয়ে নিয়েছিলাম সময়ের সাথে

একদিন হঠাৎ আমার শ্বশুরমশাই খুব খুশি হয়ে সকলকে ডেকে বললেন,

“আরে রোদ্দুর ফোন করেছিল ওর বদলি হয়ে গেছে কলকাতায় সামনের সপ্তাহে ও আসছে

অনিকেত আর সুপর্ণা খুব খুশি হল সেই খবর শুনে বাড়ির সবাই খুব খুশী শুধু আনন্দ নেই আমার মনে আমি ভেবেছিলাম হয়তো বাড়ির বাকি সদস্যদের মতো আরও একজন বাড়ল আমাকে হেয় করার রোদ্দুরের আসার দিন চলে এল

সেদিন সকাল থেকেই বাড়িতে উৎসবের আমেজ শাশুড়ি মা নিজে হাতে রোদ্দুরের পছন্দের রান্না করছিলেন একদিন অন্তত সংসারের হাড়ভাঙা খাটুনি থেকে রেহাই পেয়ে আমার বেশ ভালোই লাগছিল ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলল আর দরজায় কলিং বেলের শব্দ হল একসময় সুপর্ণা আমাকে বলল,

“নিশ্চয়ই রোদ্দুরদা এসেছে তাড়াতাড়ি দরজাটা খোলো

আমি তড়িঘড়ি গিয়ে দরজাটা খুললাম

দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা আমার থেকে বয়সে কিছুটা বড়, সাদা টি-শার্ট পরা হাসি মুখের ছেলেটাকে দেখেছিলাম সেদিন প্রথম এর আগে অবশ্য ফ্যামিলি অ্যালবামে রোদ্দুরের কিছু ছবি দেখেছি আমি, কিন্তু ছবির থেকেও সামনাসামনি যেন অনেক বেশি সুপুরুষ সে

রোদ্দুর ঘরে ঢুকে হাসিমুখে বলেছিল,

“তুমিই তাহলে আমার নতুন বৌদি তাই তো?”

“হ্যাঁ

“আরে তোমার সাথে দেখা করার ইচ্ছা কবে থেকেই ছিল যাক এবার তো এখানেই থাকছি এবার জমিয়ে গল্প করা যাবে

সাথে সাথে শাশুড়ি মা বললেন,

“আরে তুই এত খাটনি করে এসেছিস আগে গিয়ে বিশ্রাম নে

রোদ্দুর সত্যি ক্লান্ত ছিল তাই আর কথা না বাড়িয়ে ঘরে চলে গেছিল কিন্তু আমার মনে খুশির ঝড় উঠেছিল রোদ্দুরকে যেমন ভেবেছিলাম সে হয়তো সত্যি তেমন না এতদিন পর অন্তত কারোর সাথে গল্প করতে পারব নিজের মনের কথা জানাতে পারব ভেবেই আমার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠেছিল দুপুরে খাবার পর রোদ্দুর এসেছিল আমার সাথে আলাপ করতে অনিকেত তখন অফিসে ছেলেটা এসেই এক গাল হেসে বলেছিল,

“তোমার সাথে একটু আলাপ জমাতে এলাম গো বৌদি তোমার অসুবিধা নেই তো?”

আমি বললাম,

“না না, বসো

সাথে সাথেই রোদ্দুর সোফায় গা এলিয়ে বসল

“আচ্ছা তোমার নাম তো প্রিয়াঙ্কা না দিয়ে টমেটো দিতে পারত

আমি চোখ বড়বড় করে বললাম,

“কেন?”

“তুমি দেখো তোমার নাকটা পুরো টমেটোর মতো লাল সেইজন্য

রোদ্দুরের কথায় আমি হেসে উঠলাম এতদিন পর এই বাড়িতে আমি কারোর কথায় হাসি ফুটল আমার

রোদ্দুর আবার বলল,

“আচ্ছা বৌদি তোমার কি করতে ভালো লাগে?”

এই বাড়িতে এতদিনে আমার ভালো লাগার খবর কেউ নেয়নি কিছুক্ষণ থেমে উত্তর দিলাম,

“রবীন্দ্রসংগীত শুনতে খুব ভালো লাগে আর ঘুরতে যেতে

নাচের কথাটা আর বললাম না

এবার রোদ্দুর প্রায় সোফা থেকে লাফিয়ে উঠে বলল,

“ওহ্‌ রিয়েলি! আমারও এই দুটো জিনিস খুব ভালো লাগে আর আমি নিজে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখেওছি অনেক বছর

“তাই! কই আমাকে একটা শোনাও

রোদ্দুর গান ধরল,

“আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাইনি তোমায় দেখতে আমি পাইনি…”

রোদ্দুরের গানটা শুনতে শুনতে আমার মনে হচ্ছিল আমি যেন অন্য কোনও জগতে চলে এসেছি কী মধুর গলা ওর নিখুঁত সুর তাল আমার পা দুটো অজান্তেই যেন তাল দিয়ে উঠছিল ওর গানের সাথে

এরপর থেকে রোদ্দুর আর আমি ভালো বন্ধু হয়ে উঠি

আমার সব ভালো লাগার খোঁজ নিত রোদ্দুর দিনের শেষে সারাদিনের গল্প করার একজনকে পেয়েছিলাম আমি এই দম বন্ধ করা চার দেওয়ালের মাঝে রোদ্দুর ছিল আমার জন্য এক তাজা বাতাস একদিন কথায় কথায় রোদ্দুরকে বলেছিলাম,

“জানো তো আমি ছোটবেলা থেকেই নাচতে ভালবাসতাম কিন্তু বাবার পছন্দ ছিল না তাই ফাংশনে নাচা বন্ধ করে দিই তবে অনুশীলন চলত কিন্তু এই বাড়ির কারোর সেটাও পছন্দ না এমনকি আমার ঘুঙুরটাও ফেলে দিয়েছে তোমার দাদা

রোদ্দুর আমার হাতে ওর একটা হাত রেখে বলেছিল, “চিন্তা কোরো না বৌদি তুমি একদিন আবার নাচতে পারবে ঠিক

আমার শরীরে শিহরন খেলে গেছিল ওর স্পর্শে কি নিষ্পাপ ওর স্পর্শ অনিকেতের মত লালসার ছোঁয়া নেই ওর স্পর্শে

ছাদে কেউ বেশি ওঠে না তাই বিকেলে ছাদে বসে রোদ্দুর আমায় গান শোনাত আমি হারিয়ে যেতাম ওর কণ্ঠে কখনও আমার পা দুটো নেচে উঠত ওর গানের সাথে রোদ্দুর আমায় আটকাত না বলত,

“পা দুটোকে আটকে রেখো না আর বৌদি তারা যে ভেসে বেড়াতে চায় সঙ্গীতের তালে

তখন সত্যিই নিজেকে ভাগ্যবতী মনে হত

দেখতে দেখতে আমার জন্মদিন এল কিন্তু এই বাড়িতে আমার জন্মদিন মনে রাখার মত কেউ নেই অনিকেতেরও মনে নেই কিন্তু শুধু একজনই ভোলেনি রাত্রি ১১টার সময় সবাই ঘুমিয়ে পরার পর রোদ্দুর আমাকে আমাদের বাড়ির উঠানের এক কোণে নিয়ে গেল আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম,

“কি ব্যাপার? এখানে কেন নিয়ে এলে?”

“আজ তোমার জন্মদিন তাই একটা গিফট এনেছি

বিস্ময়ে আমি হতবাক হয়ে রইলাম কিছুক্ষণ এই বাড়িতে আমার জন্মদিনও কেউ মনে রেখেছে, আবার উপহারও এনেছে!

রোদ্দুর একটা রঙিন বাক্স আমার হাতে দিয়ে বলেছিল,

“শুভ জন্মদিন! নাও খুলে দেখো কেমন হয়েছে

আমি বাক্সটা খুলতেই আনন্দে চোখে জল চলে এল একজোড়া পায়ের ঘুঙুর খুব যত্ন করে রাখা সেখানে

রোদ্দুরকে বলেছিলাম,

“তোমাকে কীভাবে ধন্যবাদ জানাব সত্যি জানি নাএটা আমার বেস্ট গিফট

“আরে ধুর ধন্যবাদের কি আছে! তোমার উপর আমারও দায়িত্ব আছে কিছু

সেদিন থেকেই কেমন যেন ভালো লাগা জন্মেছিল রোদ্দুরের উপর কিন্তু আমি যে ওর বৌদি এই অনুভূতি প্রকাশ পেলে যে সর্বনাশ হয়ে যাবে এ যে চরম অন্যায় কিন্তু তবু রোদ্দুরকে হারাতে আমি চাই না সারাদিনের পর অন্তত মনের কথাটুকু তো ভাগ করতে পারি আমি ওর সাথে

একদিন জামাকাপড় ধোয়ার সময় অনিকেতের সাদা শার্টে লিপস্টিকের দাগ পেয়েছিলাম আমি তো লিপস্টিক পরি না, তবে? বুঝেছিলাম অনিকেত অন্য নারী সঙ্গে জড়িয়েছে সেদিন রোদ্দুরের কাছে গিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিলাম রোদ্দুর আমার চোখের জল মুছিয়ে বলেছিল,

“কেঁদো না বৌদি একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে

এই বাড়িতে আমার চোখের জল মোছারও কেউ আছে ভেবেই একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলাম প্রতি রাতে অনিকেতের স্পর্শগুলো যেন আরও অসহ্যকর হয়ে উঠেছিল আমার কাছে আমার ইচ্ছে করত একটা গোটা দিন আনন্দ করে কাটাতে ভিক্টোরিয়ায় ঘুরতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আইসক্রিম খেতে সেই ইচ্ছের কথা একদিন বলেছিলাম রোদ্দুরকে

ও বলেছিল,

“ঠিক আছে একদিন আমি তোমাকে নিয়ে যাব

আমি অবাক হয়ে বলেছিলাম,

“কীভাবে? বাড়ির কেউ জানলে যে কি ভাববে

“কেউ কিছু জানবে না আমি ঠিক তোমায় নিয়ে যাব

একদিন যখন অনিকেত অফিসে ছিল আর বাকি সবাই মিলে এক আত্মীয়ের বাড়ি গেছিল, সেদিন হঠাৎ দুপুরের মধ্যে রোদ্দুর অফিস থেকে চলে এল আমি বললাম,

“তুমি এই সময়ে কি করে চলে এলে?”

“অফিসে হাফ ছুটি নিয়ে চলে এলাম আজ তোমায় ভিক্টোরিয়া নিয়ে যাব রেডি হয়ে নাও

আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ নিজের কানকে যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না

রোদ্দুর আবার বলল,

“কি হল? যাও

“হ্যাঁ এক্ষুণি যাচ্ছি

আমার মনে আনন্দের শেষ ছিল না আমি একটা লাল শাড়ি পরে রেডি হয়ে নিলাম তাড়াতাড়ি রোদ্দুরের বাইকে বসলাম ও বাইক স্টার্ট দিল প্রথমে ওকে ধরে বসতে ইতস্তত করলেও পরে ওকে ধরেই বসতে হল মনে হচ্ছিল যেন সব সুখ ভগবান আজ আমার ঝুলিতে দিয়েছে ভিক্টোরিয়ায় পৌঁছে চারিদিকের সবুজের মাঝে দাঁড়িয়ে এক আলাদা শান্তির অনুভূতি লাগছিল আমার একটা বেঞ্চে বসে নিজেদের মধ্যে নানান গল্পে মেতে উঠেছিলাম আমরা‌ কিছুক্ষণের জন্য ভুলে গিয়েছিলাম আমার জীবনের সব দুঃখগুলো রোদ্দুরের দৃষ্টিতেও যেন কোথাও খুঁজে পেয়েছিলাম ভালোবাসার ছোঁয়া তারপর একসাথে দাঁড়িয়ে আইসক্রিম খেয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিলাম কেউ আসার আগেই সেই দিনটা সত্যি আমার জীবনের স্মরণীয় দিন

কিন্তু এত সুখ কি আমার কপালে সয় একদিন শাশুড়ি মা সবাইকে ডেকে বললেন,

“আমি আর তোমাদের বাবা রোদ্দুরের বিয়ে ঠিক করেছি আমার এক বান্ধবীর মেয়ের সাথে আগামীকাল তারা আসছে

কথাটা শুনেই এক অজানা আতঙ্কে আমার বুক কেঁপে উঠেছিল রোদ্দুরের দিকে তাকিয়ে বুঝেছিলাম তার মুখেও নেমেছে বেদনার ছায়া

অনুভব করলাম দুগাল বেয়ে নেমে আসছে নোনতা জলের ধারা ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে কেঁদেছিলাম অনেকক্ষণ তারপর নিজেকে প্রশ্ন করেছিলাম,

“আমি কাঁদছি কেন? কেন এত কষ্ট হচ্ছে আমার? রোদ্দুর আমার দেওর আর আমি ওর বৌদি এর বাইরে হয়তো আমরা খুব ভালো বন্ধু তাহলে ওর বিয়ের খবর কেন এতটা বেদনা দিচ্ছে আমাকে?”

ক্ষতবিক্ষত হৃদয় যেন উত্তর দিয়েছিল,

“ভালোবাসার ছোঁয়া লাগিয়েছে যে এই হৃদয়ে সেই মানুষটা অন্য কারোর হয়ে গেলে হৃদয় থেকে রক্ত তো ঝরবেই

সাথে সাথে নিজেকে বললাম, কিন্তু এ যে মহা পাপ এ যে অন্যায় আমি এত বড় পাপ কীভাবে করে ফেললাম সেদিন পাশেই কোথাও কোনও অনুষ্ঠান হচ্ছিল সকাল থেকেই মাইকে বাজছিল রবীন্দ্রসংগীত কিন্তু হৃদয়ের ক্রমাগত রক্তক্ষরণের মাঝে প্রিয় রবীন্দ্রসংগীতও বিস্বাদ লাগছিল আমার

দেখতে দেখতে বিকেল হল রোদ্দুর আমাকে আমাদের বাড়ির উঠানে নিয়ে গেল ওর চোখেমুখেও দুঃখের ছায়া দুপুর থেকেই আকাশে মেঘ জমেছে বৃষ্টি আসবে আসবে করছে রোদ্দুর আমার হাতদুটো ধরে বলেছিল,

“এই মেঘ শুধু আজ আকাশে জমেনি, জমেছে আমার মনে আর আমি জানি তোমার মনেও জমেছে সেই মেঘ আমি যে তোমায় খুব ভালোবাসি প্রিয়াঙ্কা তুমি কি আমার হবে?”

আমি তীব্র গতিতে ওর হাত ছাড়িয়ে বলেছিলাম,

“তুমি কি পাগল হয়ে গেছ? আমি তোমার বৌদি

“কিন্তু এই সম্পর্কে তুমি যে খুশি না কতদিন আর তুমি এই নরক যন্ত্রণা সহ্য করবে? চলো না আমরা চলে যাই এই সবকিছু ছেড়ে অনেক দূরে যেখানে শুধু সুখ আর সুখ আমি গোটা সমাজের সঙ্গে লড়বব তোমার জন্য

আমারও বলতে ইচ্ছে করছিল,

“নিয়ে চলো আমাকে তোমার সাথে দুজন মিলে একটা ছোট্ট সংসার গড়ে তুলব একসাথে

কিন্তু মনের ভাবনা প্রকাশ পেলে যে সর্বনাশ হয়ে যাবে তাই রোদ্দুরের থেকে ছুটে চলে যাচ্ছিলাম দূরে ঠিক সেই সময় পাশের মাইক থেকে ভেসে এল প্রিয় রবীন্দ্রসংগীতের সেই লাইন,

“তুমি সুখ যদি নাহি পাও যাও সুখের সন্ধানে যাও…”

আর পারলাম না নিজেকে সামলাতে আমিও একটা মানুষ আমারও ভালো থাকার অধিকার আছে জীবনে আমিও চাই জীবনে প্রেমের ছোঁয়া পিছনে ঘুরে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম রোদ্দুরকে সাথে সাথে রোদ্দুর নিজের সমস্ত উষ্ণতা দিয়ে জড়িয়ে ধরল আমাকে ঠিক সেই সময় আকাশের বুক চিরে ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল সেই বৃষ্টিতে ভিজে যেন আরও পবিত্র হয়ে উঠল সমাজের চোখের নিষিদ্ধ প্রেম কতক্ষণ সেইভাবে ছিলাম আমরা জানি না ঘোর কাটল শাশুড়ি মায়ের চিৎকারে,

“শেষমেশ এই দিন দেখতে হল হায় রে কপাল কোন কুক্ষণে এমন চরিত্রহীনা মেয়ে এনেছিলাম ঘরে

তাকিয়ে দেখলাম ঘরের সবাই দাঁড়িয়ে সেখানে সকলের চোখে একরাশ ঘৃণা

অনিকেত বলল,

“ছিঃ ছিঃ শেষে এই দিন দেখতে হল

বলেই আমাকে মারতে হাত তুলল রোদ্দুর সেই হাত ধরে বলল,

“আর নয় দাদা অনেক হয়েছে অনেক করে নিয়েছ তোমরা ওর উপর অত্যাচার এবার থেকে ও আমার দায়িত্ব

শাশুড়ি মা এগিয়ে এসে রোদ্দুর এর গালে একটা চড় মেরে বলল,

“তুই একদম চুপ কর অসভ্য ছেলে

“না, চুপ করব না দাদা তো ঘরে বউ রেখে অন্য মেয়ে নিয়ে ঘোরে

অনিকেত এবার একটা ঢোক গিলে বলল,

“বাজে বকিস না

এরপর সেই নিয়ে তুমুল অশান্তি হল আমার বাবা আর দিদিকে ডাকা হল বাবা আর দিদিও বলল,

“তুই এমন করার আগে আমাদের মান সম্মানের কথা ভাবলি না

কিন্তু আমি জানি আমি কোনও অন্যায় করিনি আমারও জীবনে ভালো থাকতে ইচ্ছে করে এরপর পুরো সমাজ আমাদের ছিঃ ছিঃ করল অনিকেত ডিভোর্স দিয়ে দেয় আমায় আমাকে আর রোদ্দুরকে বাড়ি থেকে বের করে দেয় রোদ্দুর আমাকে নিয়ে সব ছেড়ে দিল্লি চলে আসে শুনেছি অনিকেত আবার বিয়ে করেছে এখানে কেউ জানে না আমাদের অতীত আমরা নিজেদের মত করে সাজিয়েছি আমাদের সংসার আবার আমি নাচ শুরু করি রোদ্দুর আমাকে একটা নামকরা শিক্ষকের কাছে ভর্তি করে অনেকগুলো রিয়েলিটি-শো তে বিজেতাও হয়েছি আমি আমার নিজের নাচের স্কুলও খুলেছি আজ আমি রোদ্দুর আর মিলিকে নিয়ে সত্যি খুব সুখী

“এই যে চলো, কেক কাটার সময় হল যে

রোদ্দুরের কণ্ঠ কানে আসতেই বাস্তবের মাটিতে ফিরে এলাম আমি অতীতের কথা মনে পড়ায় চোখের কোণে জমা জলটা মুছে নিলাম তাড়াতাড়ি

বারো বছরের বিবাহ বার্ষিকীর কেকটা কাটার পর সবাই শুভকামনা জানালো আমাদের এত সুখ যে আমার কপালে ছিল সত্যি ভাবিনি কোনোদিন

তারপর একসময় রোদ্দুর সকলকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“আমার আপনাদের সকলকে কিছু কথা বলার আছে প্রিয়াঙ্কা আসলে আমার স্ত্রী হওয়ার আগে আমার বৌদি ছিল

সকলে বিস্ফারিত চোখে তাকাল রোদ্দুরের দিকে আতঙ্কে আমার বুকটা কেঁপে উঠল আবার কি সমাজের সেই কটাক্ষের মুখে পড়তে হবে আমাদের!

রোদ্দুর ততক্ষণে আমার জীবনের সকল ঘটনা বলে চলেছে সকলের সামনে সবাই সব শুনে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে শেষে রোদ্দুর বলল,

“আমার মনে হল এই ব্যাপারটা এত লুকিয়ে রাখার কিছু নেই বরং সকলকে জানানো উচিত আমরা কোনও অন্যায় করিনি শুধু ভালোবেসেছি মানুষের জীবনে বেঁচে থাকতে গেলে প্রেম খুব প্রয়োজনীয় যে সম্পর্কে ভালোবাসা নেই সেই সম্পর্ক বয়ে বেরিয়ে সারাজীবন কষ্ট করার কোনও মানে নেই সবার অধিকার আছে ভালো থাকার এবার আপনারা চাইলে আমাদের তিরস্কার করতে পারেন কিন্তু তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না

সকলের চোখে জল চলে এল সবটা শুনে সকলেই হাততালি দিয়ে উঠল আমার দুচোখ দিয়ে খুশির অশ্রু ঝরে পড়ল আমি দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম রোদ্দুরকে রোদ্দুর তার হাত দুটো দিয়ে আমাকে শক্ত করে ধরে গুনগুন করে গেয়ে উঠল,

“আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাইনি তোমায় দেখতে আমি পাইনি…”

সকলে আবারও বলে উঠল,

“সত্যি, মেড ফর ইচ আদার

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post শূন্য স্মৃতি| প্রেমে পড়া বারণ | তাসফিন মাহমুদ অমি| Bengali Love Story
Next post আরেক জীবন| প্রেমে পড়া বারণ | কাজী তাসফিয়া| Bengali Love Story