অ্যাডিশনাল অ্যাসিসটেন্ট কমিশনারের ঘরে ঢুকবার আগে একবার থমকে দাঁড়াল আদিত্য সেন। দরজা খুলে সামনের চেয়ারে বসে থাকা যে লোকটাকে এতদিন ধরে দেখে আসছে সেই লোকটা আজ আর ওই চেয়ারে বসে থাকবে না, এটা মানিয়ে নিতে বেশ কিছুটা সময় লাগবে ওর। নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে দরজায় নক করে ভেতরে মুখ বাড়াল আদিত্য,
— মে আই কাম ইন স্যার।
ভেতর থেকে গম্ভীর গলায় উত্তর এল,
— কাম ইন প্লিজ।
ভিতরের ঢুকতেই এক লম্বা চওড়া মানুষ বড় ডেস্কটার পিছন থেকে রিডিং গ্লাসের উপর দিয়ে একটা কঠিন কিন্তু অন্তর্ভেদী দৃষ্টি ছড়িয়ে দিল আদিত্যর শরীরের উপর। গম্ভীর গলাটা আবার শব্দ করে উঠল,
— মিস্টার সেন, আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম আমি। বসুন। জাস্ট ইন টাইম। আপনি কি জানেন আমি আপনাকে কেন ডেকে পাঠিয়েছি?
— না স্যার।
উত্তর দিল আদিত্য।
— আমার পূর্বসূরী রায় সাহেব আপনার খুব প্রশংসা করেছেন। যদিও আমি কারও প্রশংসায় সব কিছু মেনে নিই না। সবকিছু যাচাই করে নেওয়া আমার স্বভাব। তো আমি আপনার কাজ দেখতে চাই। আর তার জন্য আমি আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছি। আপনি রিসেন্টলি ঘটে চলা সিরিয়াল কিলিং কেসটা নিয়ে কিছু জানেন?
— খবরের কাগজে যেটুকু বেড়িয়েছে সেটাই জানি স্যার। এখনো তিনটে মার্ডার হয়েছে। তিনজন গৃহবধূ। বয়স ত্রিশ থেকে চল্লিশের ভিতরে। তিনজন বাড়ি থেকে বেড়িয়ে কোথাও যাওয়ার পথে সকালে নিখোঁজ হয় আর তারপর পরের দিন বডিগুলো পাওয়া যায়। কোন রেপ অ্যাটেম্পট নেই।
— হুম, নট এ ডিটেকটিভ অ্যানসার। এই ডিপার্টমেন্ট থাকার সুবাদে আপনার আরও কিছু জানা উচিৎ ছিল। ওয়েল আই হ্যাভ নো অপসন লেফ্ট। আপনাকে কেসটা টেক ওভার করতে হবে। শুনুন, এই তিন ভিকটিমের মধ্যে তেমন কোন মিল পাওয়া যায়নি গৃহবধু বা বয়স ছাড়া। তবে মার্ডারগুলোর মধ্যে মিল আছে। প্রথমত তিনজন ভিক্টিমের বডিতে উপর থেকে কোন আঘাত নেই। কিন্তু ভেতর থেকে তিনজনের একটাই মিল আছে। দেয়ার আর সাম বডি পার্টস মিসিং ইন দেয়ার বডি। ওদের কিছু বডি পার্ট যেমন লিভার, হার্ট বডি থেকে বার করে নেওয়া হয়েছে। কিছু মাসল কেটে নেওয়া হয়েছে। আর শুধু তাই নয়, এইগুলো বের করা হয়েছে যখন এরা জীবিত ছিল সেই সময়।
— ও মাই গড।
— দা গড ইস নট সো ক্রুয়েল মাই সন। যাক যেটা বলছিলাম, সো প্রথম আমরা মনে করেছিলাম কোনও অর্গান ট্রাফিকিং র্যাকেটের কাজ। বাট পরে সে থিয়োরি বাদ দেওয়া হয়েছে। কারণ, প্রথমত এই সব র্যাকেটের কাজ লুকিয়ে হয়, এত প্রচার করে নয়। দ্বিতীয়, ভিক্টিমের সব অর্গান নিয়ে নেওয়া হয়নি। যেটা এইসব র্যাকেটের কাজ হলে হবার কথা নয়। তৃতীয়, ভিক্টিমদের প্রত্যেকের পাশে কিছু পাওয়া গেছে। যেমন কিছু প্রিন্ট আউট। যাতে দুটোতে ফ্ল্যাগের ছবি। তাছাড়া হাতির শুড়, সুতো, স্কেলের ছবি। একটা সংস্কৃত বই। আর একটা পেপার যাতে কিছু লেটার, নম্বর, সিম্বল কাগজে কেটে বসানো হয়েছে জিব্রিস ভাবে। যদিও ওর থেকে আমরা এখনো কিছু বের করতে পায়নি। নো ফিঙ্গার মার্ক, নো ফুট মার্ক, নো ডিএনএ। কিছু না। সো ইটস এ কেস অব সিরিয়াল কিলিং।
— কোনও সিসিটিভি ফুটেজ? মানে এখন তো মোটামুটি সব জায়গাতেই পুলিশ থেকে ক্যামেরা লাগানো আছে।
— গুড পয়েন্ট। না তাও পাওয়া যায়নি। এমন কিছু জায়গায় ভিক্টিমদের পিক আপ বা ড্রপ করা হয়েছে যা ব্লাইন্ড স্পট।
— আমাদের ইনফরমার রিং থেকে কোন খবর স্যার?
— না। সেটা পেলে তোমাকে ডাকতাম না সেন। শোনো, কেসটা নিয়ে আমি খুব চাপে আছি। আইজি সাহেব বার বার ফোন করছে। উপর থেকে চাপ আছে। তারপর মিডিয়া তো জানোই। আই নিড এ স্পিডি ইনভেস্টিগেশন। বাস্টার্ড টাকে আমি চাই সেন। এস আর্লি এস পসিবল। নাহলে আমি তো বলেছি, আমি কোন রেকমেনডেশানের ধার ধারি না। এই ফাইলে সব আছে। এটা নিয়ে যাও। লোকাল থানাকে বলা আছে। বাকি কোন কোয়ারি থাকলে ওখান থেকে ইনপুট পেয়ে যাবে। তুমি এখন যেতে পারো সেন।
— থ্যাঙ্ক ইউ স্যার। গুড ডে।
— সেন কথাটা মনে রেখো। অ্যাস আর্লি এস পসিবল।
— আই ট্রাই মাই বেস্ট স্যার।
— আই নিড রেসাল্ট নট ইউর বেস্ট। গুড ডে সেন।
2.
নিজের ঘরে আদিত্য সেন ফাইলের মধ্যে ডুবে আছে। পাশে বসা দাশবাবু অনেকক্ষণ ধরে উসখুস করতে করতেই গলা খাঁকাড়ি দিয়ে বলে উঠল।
— স্যার।
— হুম।
— ও স্যার।
— আপনি কি একটু চুপ থাকতে পারেন না দাশবাবু?
— না মানে কখন থেকে ফাইলগুলো নিয়ে বসে আছেন, বলছি কিছু পেলেন?
— না।
— তার মানে গেল। বলছি স্যার অ্যাসিসটেন্ট সিপি সাহেব কি কিছু বলল, মানে, কেসটা সলভ না হলে কোথায় পাঠাবে?
— আপনি কী একটু থামবেন দাশবাবু।
— থেমে কী করব স্যার। কেসটা না সলভ হলে তো ট্রান্সফার নিশ্চিত। আর ট্রান্সফার হলে আপনার বৌদির সাধের কুমড়ো গাছটার কি হবে স্যার? সবে স্যার গাছটা তরতর করে গ্রিল বেয়ে উপরে উঠেছে, কদিন পর ফুল ফুটবে, তার কদিন পর ফুটবলের মত কচি নধর কুমড়ো। আপনার বৌদির কচি কুমড়ো স্যার।
— ধুর মশাই এখানে বকবক না করে স্পটে যান তো, কিছু খোঁজ নিন। ভিক্টিমদের তুলবার সময় কেউ কিছু দেখেছে কিনা খোঁজ করুন। আর ওই এরিয়ার আশেপাশের রোডগুলোর কোন সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়া যায় কিনা দেখুন।
— সে দেখছি। তবে একটা কথা বলব স্যার?
— কি?
— রাগ করবেন না তো?
— রাগ করলে আপনার কিছু আসে যায় !
— না স্যার এটা কী বলছেন। আসে যায় অবশ্যই আসে যায় তবে স্যার একটা কথা মনে হচ্ছে।
— বলে ফেলুন, না বলে আপনি থামবেন না।
— না মানে বলি কী স্যার মার্ডারার বোধহয় স্কুলে ক্লাস এইটে সংস্কৃতে ফেল করত তাই এখনো মার্ডার স্পটে রাগের বসে সংস্কৃতের এইট ক্লাসের বই ফেলে যায়।
— তো আমরা এখন কি করব, স্কুলে ক্লাস এইটের যত ফেল ছেলেদের ধরে বেড়াবো?
–না মানে…
— তবে এটা ঠিক সংস্কৃত সাথে কিছু একটা যোগাযোগ রয়েছে। একটা জিনিস লক্ষ্য করেছেন সংস্কৃত বইটাতে লাইনের পর লাইন খয়েরি রঙ দিয়ে দাগ দেওয়া। খয়েরি রঙই কেন? কেন অন্য কিছু নয়। কেন ক্লাস এইট ? কিছু কি সম্পর্ক আছে। বইয়ের রাইটার বা প্রকাশক কাউকে ইঙ্গিত করছে না কি অন্য কিছু। কেন দাগ দিয়েছে খুনি। দিলেও এই হাইলাইট পেন না দিয়ে এরকম রঙ দিয়ে কেন? রঙ। রঙ দিয়ে কি কিছু। খয়েরি রঙ সংস্কৃত বই। খয়েরি সংস্কৃত। আচ্ছা খয়েরিকে সংস্কৃততে কি বলে?
— দাঁড়ান দেখছি। গুগল বাবা কি জয়। হ্যাঁ, এই তো বেড়িয়েছে। পিঙ্গল।
— পিঙ্গল!
— আচ্ছা স্যার ওই ফ্ল্যাগগুলো। একটা তো ইন্ডিয়ার আরেকটা কোন দেশ।
— পিসা।
— পিজা সে তো খাবার, সে নামে দেশ আছে?
— পিজা নয় পিসা। রিপাবলিক অব পিসা। একাদশ দ্বাদশ শতকের ইউরোপের দেশ। এখন ইটালির মধ্যে। পিসার লিনিং টাওয়ারের কথা শোনেননি?
— হ্যাঁ সে তো শুনেছি। আচ্ছা তাহলে কি খুনি ইতালির লোক? ইতালির লোক এইটে সংস্কৃততে ফেল। স্যার কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে ব্যাপারটা।
— গুলিয়ে তো যাবেই। খুনি আমাদের দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে দাশবাবু। ওকে ধরবার। মুশকিল হচ্ছে ও যে ক্লুগুলো দিচ্ছে তা পড়ার ভাষা আমাদের জানা নেই। এই সুতোগুলো দেখুন। অনেকটা হাতির শুড়ের মত। আবার এই হাতির শুড়ের ছবি এই স্কেলের ছবি। কী বোঝাচ্ছে এই ছবি গুলো।
— অঙ্ক স্যার। আমার পুরো অঙ্কর মত লাগছে। সব দিয়ে দিয়েছে চোখের সামনে কিন্তু উত্তর বের করতে পারছিনা। হেব্বি কঠিন সাবজেক্ট। ছোটবেলায় যে আমায় কী ভোগান ভুগিয়েছে। খুব ভয় পেতাম স্যার। একবার জানেন তো পরীক্ষায় গ্রাফ এল। ইকুয়েশন যা দিল তাতে গ্রাফ আর হয় না। গ্রাফের বাইরে চলে যায় পয়েন্ট। আমি ও ছোড়নেওয়ালা নই। স্যারের কাছ থেকে দুতিনটে গ্রাফ নিয়ে গ্রাফ একে ছাড়লাম। রেজাল্ট বেরবার পর অঙ্কের স্যার বেধড়ক মারধর তো করলই তারপর সে গ্রাফ ক্লাসের সবাইকে ডেকে ডেকে দেখা। গ্রাফটা হয়েছিল উল্টানো বাটির মত। স্যার আমায় বলেছিলেন এই বাটি নিয়ে বলে আমি রাস্তায় বড় হয়ে ভিক্ষা করে বেড়াব। তা…
— কি বললেন অঙ্ক! গ্রাফ? ইয়েস গ্রাফ। মাঝেমধ্যে আপনি কিছু ভালো কথা বলে ফেলেন জানেন, এবার চুপ করে থাকুন।
ছবি গুলো থেকে ফোনে ছবি তুলে আদিত্য ফোনে কাউকে কিছু পাঠাল। তারপর একটা ফোন করল কাউকে।
— হ্যালো বিকাশ, কেমন আছিস ভাই? শোন না তোকে একটা হোয়াটসাপ করেছি। ছবিগুলো দেখে বল না এই ছবিগুলোর সাথে কোন গ্রাফের বা কোন অঙ্কের কোন মিল পাওয়া যাচ্ছে কনা? একটু আর্জেন্ট আছে ভাই। হ্যাঁ হ্যাঁ, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জানা। আমি অপেক্ষা করছি।
ফোনটা রেখে আদিত্য সেন দাশবাবুর দিকে তাকালো। মুখে শুধু একটাই কথা
— এবার অপেক্ষার পালা।
3.
অ্যাডিশনাল অ্যাসিসটেন্ট কমিশনারের রুমের সামনে এসে আবার একটু অস্বস্তি বোধ করল আদিত্য, তবু নিজেকে একবার ঝাড়া দিয়ে ঢুকে পড়ল ঘরের ভেতর।
— এসো সেন। বসো।
গম্ভীর গলাটা যেন আরও গম্ভীর লাগছে আজকে আদিত্যর। কলমটা টেবিলে রেখে দেবনাথ নায়েক সোজা তাকাল আদিত্যর দিকে। তারপর বলতে শুরু করল,
— আজকে রাজ্যের যতগুলো বড় নিউজ পেপার আছে তাদের অফিসে একটা চিঠি এসেছে। কেউ একজন নিজেকে জিএফকে নাম দিয়ে চিঠগুলো লিখেছে। সেখানে সে এই খুনগুলো করেছে বলে দাবি জানিয়েছে। তার সাথে পুলিশ ও বাঙালির বুদ্ধি নিয়ে খোঁটা দিয়েছে যে এত ক্লু পাওয়া সত্ত্বেও আমরা বলে তাকে ধরতে পারছি না। সংবাদ পত্রের দফতর থেকে চিঠিগুলো আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাতে কোন ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া যায়নি এবং লেখাগুলো কম্পিউটার কপি। সুতরাং বুঝতেই পারছ আমাদের কাছে কোন নতুন কোন ফরেনসিক রিপোর্ট নেই। মুশকিল হল খুনি দাবি করেছে এই চিঠি না ছাপলে আবার মার্ডার হবে তাই সব কটা পেপার এই চিঠিটা ছাপবে বলে জানিয়েছে। আমি প্রভাব খাটিয়ে সেটা একদিন ডিলে করিয়েছি। এখন বলো আমরা কী করতে পারি?
— স্যার আমি জানি না কি করা উচিৎ তবে একটা ক্লু পাওয়া গেছে।
— কী ক্লু?
— ফিবোনাচ্চি স্যার। লিয়োনার্দো ফিবোনাচ্চি।
— সেটা কে?
— লিয়োনার্দো ফিবোনাচ্চি দ্বাদশ শতকের একজন ইতালিয়ান গণিতবিদ।
— খুনির সাথে কি সম্পর্ক তার!
— স্যার যে সূত্রগুলো দিয়েছে খুনি মানে পিসা রিপাবলিক ফ্ল্যাগ বা হাতির শুড়ের ছবি বা সুতোর ছবি, স্কেলের ছবি তার সাথে ফিবোনাচ্চি সম্পর্ক আছে। হাতির শুড় বা সুতোর বিন্যাস যদি গ্রাফে ফেলা হয় তবে ফিবোনাচ্চি গ্রাফ বের হচ্ছে আর ফিবোনাচ্চি নিজে পিসা রিপাবলিক লোক ছিল।
— নট সো কনভেনসিং টু মি। কেমন যেন বিড়াল আর রুমালের গল্প মনে হচ্ছে আমার।
— আরেকটা নাম আমরা পেয়েছি এর থেকে।
— কী?
— পিঙ্গল। সংস্কৃতে খয়েরিকে পিঙ্গল বলে।
— ইনি আবার কে?
— ভারতীয় ঋষি। গণিতবিদও।
— তাতে কী প্রমাণ হচ্ছে!?
— স্যার পিঙ্গল এবং ফিবোনাচ্চি মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে। দুজনে একটা সূত্র আবিষ্কার করেন। যাকে পরে ফিবোনাচ্চি নম্বর সিরিজ বলে আমরা জেনে এসেছি। এই সূত্রটা অনেকটা এরকম মানে প্রথম ও দ্বিতীয় অঙ্কের যোগফল তৃতীয় সংখ্যা। আবার দ্বিতীয় ও তৃতীয় অঙ্কের যোগফল চতুর্থ সংখ্যা। এই ভাবে এগিয়েছে। সংখ্যাগুলো এরকম ০, ১, ১ (০+১), ২ (১+১), ৩ (১+২), ৫ (৩+২), ৮ (৫+৩)…
— হুম হতে পারে কিন্তু তাতে আমরা খুনি সম্বন্ধে কি জানতে পারছি সেন? আমি এখানে অঙ্ক ক্লাস করতে বসিনি নিশ্চয়ই।
— না স্যার। এই ফিবোনাচ্চি নম্বর সিরিজ আমরা খুনির রেখে যাওয়া জিব্রিস নোটে বসিয়ে একটা অর্থ পেয়েছি। 9090908888 march 24 pm 9 alone ।
— ফোন নম্বর? কোথাকার?
— ব্লাড এন্ড সোল পাব।
— খুনি আমাদের আমন্ত্রণ করেছে। কিন্তু কেন?
— ধরা দেবার জন্য না সেটা নিশ্চিত স্যার।
— লেটস সি। মার্চ ২৪ তো আজকেই। এখন ৬টা বাজে। লেটস মুভ। সিভিল ড্রেসে যাব। পাবটা ফুল কভার করতে বলবে।
— আপনি যাবেন!
একটা কড়া দৃষ্টি সামনে আদিত্যর গলা আর শব্দ করল না। উল্টোদিকে গম্ভীর গলায় শুধু একটা কথা ভেসে এল,
— মেক দিস নাইট মেমরেবল ফর আস সেন অ্যান্ড ফর দ্যা মার্ডারার অলসো।
4.
দেবনাথ নায়েক গাড়ি থেকে নামতেই দেখল সামনে একটা গাড়ির পাশে হেলান দিয়ে আদিত্য দুতিন জনের সাথে কথা বলছে। ওকে দেখেই এগিয়ে এসে স্যালুট করল।
— রিপোর্ট কি?
— বড়লোকের ছেলেমেয়েদের জায়গা স্যার। সবে পার্টি শুরু হচ্ছে। আজকে আবার বিখ্যাত একজন ডিজে পারফর্ম করবে এখানে। তাই ভিড়টা বেশি। সেরকম সন্দেহজনক কাউকে পায়নি এখনও। আমাদের লোক ভেতরে আছে।
— চলো ভেতরে যাওয়া যাক।
নায়েক আর আদিত্য ভেতরে ঢুকে একটা কর্নারে টেবিলে বসল। নায়েক একজন ওয়েটারকে ডেকে দুটো ড্রিংকস অর্ডার দিয়ে চারপাশে তাকাল।
— হুম, কি মনে হয় সেন, খুনির প্রোফাইল কেমন হতে পারে?
— স্যার, খুনি ইন্টেলিজেন্ট। শিক্ষিত এবং ধনী। সে পুলিশের সাথে যখন কথা বলতে আসছে, সে নিজের কমফর্ট জায়গা খুঁজছে। যেখানে সে আগে বহু বার এসেছে। সে যখন এই জায়গা ঠিক করেছে তার মানে সে এখানে বহুবার এসেছে।
— খুনি তো এখানে চাকরিও করতে পারে?
— সেক্ষেত্রে সে এখানে ডাকত না স্যার। কেউ নিজের চাকরির জায়গায় এসব অসুবিধা আনতে চাইবে না।
— হুম। তারপর।
— বয়স পঞ্চাশের মধ্যে।
— সাধারণত এসব কেসে খুনির সাকসেস রেট বেশি ভালো থাকে ১৮ থেকে ২৪শের মধ্যে।
— আমার তা মনে হয় না স্যার। খুনির অভিজ্ঞতা আছে। সে এই কাজ আগেও করেছে। তাই কনফিডেন্স বেশ হাই। আমার মতে ৩৫ – ৪০।
— আমার মনে হয় না। যাইহোক আর?
— তার নিজের বুদ্ধির উপর যথেষ্ট ভরসা আছে। সে আমাদের বুদ্ধির কথা বলেছে। এই কনফিডেন্স আসে যখন কেউ বুদ্ধিতে অপরকে বার বার হারিয়েছে তখন। যে বারবার অ্যাপ্রিসিয়েটেড হয়েছে বুদ্ধির জন্য। চাকরি করে না বা কখনো করেনি। সম্ভবত খুনি এমন কিছু কাজ করে যাতে সে এই বুদ্ধি ব্যবহারের সুবিধা পায়। ক্যালকুলেটিভ রিস্ক নিতে পারে। ব্যবসায়ী, শেয়ার ট্রেডার, চেস প্লেয়ার এইরকম কিছু । আবার মানুষের ফিজিওলজি সম্বন্ধে ধারনা আছে। মেডিকেল স্টুডেন্ট ছিল বা আর্টিস্ট।
— এসব খুনিদের আপ ব্রিংগিয়ের সমস্যা থাকবে, সম্ভবত একাকিত্বে ভোগে।
— অনেক সিরিয়াল কিলারের কিন্তু ফ্যামেলি ম্যান হয় স্যার।
— হুম হতে পারে। তবে…
— মে আই জয়েন ইউ গাইস?
কথাটা শুনে দুজনে সামনের দিকে তাকিয়ে দেখল, একজন ভদ্রলোক দাড়িয়ে আছে। প্রায় চল্লিশ বছর বয়স। লম্বা রোগা। কাটা কাটা চোখ নাক যথেষ্ট আকর্ষণীয় করে তুলেছে মুখটাকে। যদিও চোখের তলায় কালি পড়েছে তবুও ফর্সা রঙটা আর নীল চোখের মণি বিদেশি ছাপ ফেলেছে চেহারায়। সুন্দর করে কাটা চুল মানানসই হয়েছে ওয়েল ট্রিমড গোফ দাড়ির সাথে। দামি ব্লেজারটা একবার ঠিক করে নিয়ে লোকটা এবার বিদেশি টান মাখানো বাংলায় বলল,
— আমি কি এখানে বসতে পারি?
এবার নায়েক উত্তর দিল,
— হুম। বসুন।
— আপনাদের কে কি খুব বিরক্ত করলাম? আপনাদের দেখে মনে হচ্ছে কারও অপেক্ষা করছেন। আচ্ছা আপনারা কি পুলিশ?
— কেন বলুন তো?
— মনে হচ্ছে। আসলে সত্যি বলতে ওই যে ওই টেবিলে বসে থাকা রোগা করে ভদ্রলোক, সাফারি পড়ে গোলগোল চোখে এখানে দেখছে ডু ইউ ওয়ান্ট মি টু বিলিভ উনি পুলিশ না। আর ওই যে দূরে ওই টেবিলে কাপল বসে, ওদের চোখ নিজেদের মধ্যে না থেকে বাইরে বেশি ঘুরছে। ইউ সুড ট্রেইন দেম ওয়েল মিস্টার নায়েক। বড় কেস কিছু আছে তাই না। মার্ডার কেস?
— হু আর ইউ?
— যদি বলি যার অপেক্ষা করছিলেন আমি সেই। উত্তেজিত হবেন না মিস্টার নায়েক। আপনি নিজেও জানেন আমাকে অ্যারেস্ট আপনি করতে পারবেন না। আপনার কাছে কোন প্রুফ নেই। সো আপনার কুকুরদের একটু বাইরে রাখুন। বাই দ্যা ওয়ে আমি তো একা আসতে বলেছিলাম, যে সলভ করেছিল পাজেলটা তাকে। মনে তো হয় না আপনি ওটা সলভ করেছেন মিস্টার নায়েক তো বেটার ইউ গেট লস্ট ফ্রম হিয়ার। আই ওয়ান্ট টু টক টু দিস ইয়ং জেন্টেলম্যান। মিস্টার আদিত্য সেন। ওয়েল ডান। যদিও ক্লুগুলো খুব একটা টাফ দিইনি আর না দিলে তোমরা জীবনেও আমাকে ধরতে পারতে না। সো কী জানতে চাও?
— আপনার নাম দিয়ে শুরু করি।
হাসি মুখে নরম গলায় প্রশ্নটা করল নায়েক।
— ওহ আপনি যান নি এখনও। আপনাদের পুলিশদের না আত্মসম্মান বলে কিছু নেই। অ্যান্ড আই ডোন্ট লাইক ইট।
— ঠিকই বলেছেন। কিন্তু আপনি বললেন না তো। নামটা?
— সোমেশ সমাদ্দার। বাকি পরিচয় আপনি খোঁজ পেয়ে যাবেন।
— খুনগুলো আপনি কেন করলেন সোমেশবাবু?
— খুন আমি করিনি মিস্টার নায়েক আর প্লিজ এই লো আই কিউ প্রশ্নগুলো করবেন না। আর কিছু…
— আপনি মহিলাদের অপছন্দ করেন?
অনেকক্ষণ চুপ থেকে এবার প্রশ্ন করল আদিত্য।
— না সেরকম কোন ব্যাপার নেই। মহিলাদের আমি সম্মান করি। আমার প্রচুর মহিলা এমপ্লয়ি আছে।
— মহিলাদের কষ্ট পেলে আপনি সেক্সুয়ালি প্লেজারড ফিল করেন?
— দ্যাটস এ বিলো দ্যা বেল্ট কোয়েশ্চেন। আমার সেক্সুয়ালিটি নিয়ে আমি আপনাকে জানাতে বাধ্য নই। বাট স্টিল আপনি এতটা যখন পৌছেছেন মিস্টার সেন, আমি আপনার এই প্রশ্নের উত্তর দেব। আই এম এ গে। সো নো সেক্সুয়াল প্লেসার ফ্রম দেম। আর কোন প্রশ্ন?
— আপনার কি কোন দাবি বা অ্যাজেন্ডা আছে?
আবার প্রশ্ন করল নায়েক।
— না। তাহলে চলি। আপনার দলবল তো এবার আমাকে সব সময় নজরে রাখবে। তা রাখুক তবে বাধা না দিলেই হল। আচ্ছা মিস্টার নায়েক যদিও আপনাদের আইকিউ বড্ড লো তবু জিজ্ঞেস করি মুভি দেখেন। আমার প্রিয় মুভি কি জানেন, ক্যাচ মি ইফ ইউ ক্যান। বাই।
সোমেশ সমাদ্দার বেড়িয়ে যেতে নায়েকের মুখ দিয়ে একটা শব্দ বের হল,
— বাস্টার্ড।
5.
নায়েকের ঘরে বসে আছে আদিত্য, দাশবাবু সহ পাঁচ ছয়জন অফিসার। ঘরের মধ্যে একটা থমথমে পরিবেশ। নায়েকের হাতে একটা চুরুট জ্বলছে। নায়েক একটা শূন্য দৃষ্টি তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। তারপর একটু গম্ভীর গলায় বলে উঠল,
— সোমেশ সমাদ্দারের খোঁজ পেয়েছেন?
— হ্যাঁ স্যার। জন্ম বোস্টনে। বাবা সমর সমাদ্দার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কার ছিলেন। মা কারা ফিতারি ফিনিশ। দুজনেই মৃত। সোমেশ মেডিক্যাল স্টুডেন্ট ছিল। পরে বাবার কোম্পানি ইনহেরিট করে এবং ব্যাবসা বড় করে। শুধু রাফ হিসেবে ভারতের মার্কেটে কয়েক হাজার কোটি টাকা ইনভেস্টমেন্ট আছে। ২০১৮ তে বেস্ট এন আর আই অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে…
— আর যেটা আমাদের হাত পা বেঁধে রাখছে উইথ আউট কোন প্রমাণ ছাড়া ওর বিরুদ্ধে কিছু করতে। দ্যাট বাস্টার্ড আমাদের সাথে দেখা করার আগে কোথায় ছিল জানো? চিফ মিনিস্টারের সাথে মিটিং করছিল পাঁচশো কোটি টাকার একটা প্রজেক্ট নিয়ে।
— তার মানে আমরা ওর বিরুদ্ধে কোন কিছু করতে পারব না।
প্রশ্নটা করল দাশবাবুর।
— পারি যদি আমাদের কাছে সলিড প্রুফ থাকে। আর সেটা যদি থাকে আই উইল…
— স্যার আমি একটা জিনিস বুঝতে পারছি না লোকটা কেন এখন হঠাৎ করে এ সব শুরু করল? কেন বডি পার্ট মিসিং…
— বাকি সব প্রশ্নের উত্তর কি তুমি পেয়েছ আদিত্য? ফার্স্ট ক্যাচ হিম এন্ড দেন আস্ক হিম?
— কিন্তু স্যার ভেবে দেখুন শুধু ট্রফি হিসেবে বডি পার্ট…
— পরাগ সোমেশ সাথে আর কে কে থাকে দেখো?
— স্যার আমি খবর নিয়েছি। ও এখানে খুব কম সময় থাকে। ও এলে ওর সাথে একজন বৃদ্ধ থাকে। আর একজন থাকে। ম্যাথু পেরিয়া। সম্ভবত কেরলের ছেলে। বডি গার্ড টাইপের। আর কিছু লোকাল কাজের লোক আছে।
উত্তর দিল পরাগ।
— সবাইকে জিজ্ঞেস করো তবে অফিসিয়াল কিছু স্টেপ আপাতত নেবে না। আর ওই বৃদ্ধ এবং ম্যাথু নিয়ে আরও খোঁজ খবর নাও। ওদেরকেও জিজ্ঞেস করো। বাই দ্যা ওয়ে তোমাদের একটা কথা জানাবার ছিল, আমাদের যে সংস্থা সিসিটিভি লাগিয়েছে তাতে সোমেশের ইনভেস্টমেন্ট আছে। সো সম্ভবত ও আমাদের সব খবর পাচ্ছে। আমি অলরেডি বলেছি আমাদের আইটি ডিপার্টমেন্ট কে, যে সিস্টেমের লুপহোল কিছু থাকলে সেটা বের করতে। তবুও ওরা যতক্ষণ কনফার্ম না করে, বি কেয়ারফুল। তোমরা যেতে পারো। আদিত্য তুমি বসো। আমি আর তুমি এক জায়গায় বেরোবো।
6.
গাড়ি যেখানে এসে থামল সেটা একটা ফোরওয়ে রাস্তার ধার। দুপাশে ফাঁকা। কিছু দূরে কিছু নির্মিয়মান ফ্ল্যাটের খাঁচা দেখা যাচ্ছে। রাস্তা দিয়ে স্পিডে দু একটা গাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছে। নায়েক গাড়িটা দাঁড় করিয়ে একটা চুরুট ধরাল। তারপর ঘুরে পেছনে দেখল। পিছনে তখন আরেকটা গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে। গাড়ির ড্রাইভার গাড়ি পার্ক করে এগিয়ে আসছে আদিত্যদের গাড়ির দিকে।
— আদিত্য এখন থেকে যতক্ষণ না আমি অর্ডার দবো, কোনও কথা অফিসে বলবে না। ইভেন ফোনেও না। দরকার হলে আমি বলে দেবো কী বলতে হবে। লুপহোল বন্ধ করতে হবে আগে।
লোকটা ততক্ষণে গাড়ির পিছনের দরজা খুলে ঢুকে পড়েছে। লোকটাকে দেখে নায়েক বলে উঠল,
— মর্নিং ডাক্তার সাহা। সরি দেখা করার জন্য এই ভাবে ডাকার জন্য। আদিত্য ইনি ডাক্তার সাহা। তিনজন ভিক্টিমের পোষ্ট মর্টেম ইনি করেছেন। ডাক্তার সাহা এ হল ইনস্পেক্টর আদিত্য সেন। এবার বলুন ডাক্তার সাহা আপনার কী বলার ছিল?
— দেখুন দেবনাথ বাবু। আমি বহুদিন এই পেশায় আছি। আমার একটা অভিজ্ঞতা আছে। বহুদিন এই ধরণের কেসের সাথে ডিল করেছি কিন্তু এই কেসটা একটু গন্ডগোলের বলে প্রথম থেকেই মনে হয়েছে। সাবজেক্টের বডিতে নিউরো মাসকুলার ব্লকেড ইউস করা হয়েছে। এতে সাবজেক্টের কিছু অর্গান প্যারালাইসিস হয়ে যায়। ফলে ইচ্ছা থাকলেও সাবজেক্ট কিছু করতে পারেনি। দ্বিতীয় মার্ডারার মেডিক্যাল নলেজ আছে। স্পেশালি সার্জারির হাত খুব ভালো। এবং সার্জারির প্র্যাক্টিস আছে। তৃতীয় মার্ডারার আর্টিস্ট। যে বডিপার্টস সে বডি থেকে তুলেছে তার রিপ্লেস করেছে সফ্ট প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি বডিপার্টস দিয়ে এবং তা একদম সেম এস অরিজিনাল। আর লাস্ট যেটা আমার মনে হয়েছে সেটা একটু অদ্ভুত লাগতে পারে আপনাদের। মার্ডারার শুধুমাত্র অর্গান তোলেনি কিছু মাসল তুলে নিয়েছে সাবজেক্টের বডি থেকে। ফাস্ট আমার মনে হয়েছিল এটা জাস্ট ট্রফি হান্টিং। পরে আমার মনে হয় যে এইসব বডি পার্টস ট্রফি হান্টিং হবার কথা না। তাই একটা সিদ্ধান্তে আমি পৌছেছি।
— কি?
— হি ইট বডি পার্টস। হি ইজ এ ক্যানিবল।
— আর ইউ সিওর?
— সিয়োর হবার কোন উপায় নেই দেবনাথ বাবু। এটা আমার অ্যাজাম্পশান। তবে এই অ্যাজাম্পশান ঠিক হবার চান্স আমার মতে ৯০%।
— থ্যাঙ্ক ইউ ডাক্তার সাহা। আপনার ইনপুট আমাদের খুনি ধরতে সাহায্য করবে।
— ক্যাচ হিম স্যার। এইসব রাক্ষসের এই পৃথিবীতে বাঁচবার অধিকার নেই।
— উই উইল।
ডাক্তার সাহা গাড়ি থেকে বেড়িয়ে যেতে নায়েক জিজ্ঞাসা করল আদিত্যকে,
— কী বুঝলে?
— এটা প্রথম খুন না।
— গুড। যখন যখন সোমেশ এখানে ছিল ওই সময় মিসিং মহিলাদের খোঁজ নিতে বলো তোমার টিমকে। দেখ কিছু পাওয়া যায় কিনা?
কথা শেষ হতেই নায়েকের ফোন বেজে উঠল। কিছুক্ষণ হু হু করার পর ফোনটা কেটে আদিত্যর দিকে তাকিয়ে বলল,
— চলো ১২ নম্বর বাড়িতে, সোমেশের বৃদ্ধ পরিচারককে ওখানেই নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পরাগের টিম আছে।
7.
বৃদ্ধ লোকটাকে দেখেই মনে হচ্ছে বেশ ঘাবড়ে গেছে। দূরে বসে থাকা তিন চারটে চেয়ারে লোকগুলোর দিকেই ওর চোখ ঘুরছে। একটা গলা খাঁকাড়ি শুনে উল্টোদিকে থাকা চেয়ারে নায়েকের দিকে তাকালো সে। উপরে থাকা হাই পাওয়ারের বাল্বের আলোতে তার কুঁচকানো চামড়ার চোখ আরও কুঁচকে গেল। নায়েকের প্রায় অন্ধকার চেয়ার থেকে তখন চুরুটের লাল চোখ আর ধোঁয়ার অবয়ব ছাড়া কিছু নেই। আদিত্য নায়েকের পাশ থেকে এগিয়ে আলোয় এসে প্রথম কথা বলল।
— ভয় পাবেন না। আপনার কোন ক্ষতি হবে না। আমরা আপনার কাছে কিছু ইনফরমেশন চাই। আপনি তো গোপাল বোস তাই তো?
— হু।
একটা ঘড়ঘড়ে সর্দি মাখা গলা থেকে উত্তর এল।
— আমরা সোমেশবাবু সম্পর্কে জানতে চাই? আপনি তো ওঁদের বহু পুরনো কাছের লোক?
এবার নায়েক প্রশ্ন করল।
— হু।
— কবে থেকে চেনেন ওদের?
— ছোটবাবু যখন একবছর তখন আমায় ওদেশে নিয়ে যায় বড়বাবু। ছোটবাবুর দেখাশোনা করতে। তারপর থেকে আমি ওই বাড়িতে।
— আচ্ছা সমরবাবু কেমন লোক ছিলেন?
— রাশভারী। জমিদারের মত। বাবু বড্ড রাগি ছিলেন তবে মন থেকে খুব ভালো মানুষ।
— সোমেশবাবুর মা কেমন মানুষ ছিলেন?
— ওঁকে আমি দেখিনি। আমি যাবার আগে উনি ওদের ছেড়ে চলে যান।
— সোমেশবাবুর ছোটবেলা কেমন ছিল?
— বড্ড শান্ত ছেলে ছিল ছোটবাবু। পড়াশোনায় ভালো। ভালো ছেলে।
— ঠিক করে বলুন। আমাদের কাছে কিন্তু অন্য খবর আছে। পেট থেকে সত্যি বের করতে আমরা জানি।
— এমনই ভালো ছিল তবে ছোট থেকে জীবজন্তুর উপর খুব অত্যাচার করত। একবার পাশের বাড়ির কুকুরকে… রাক্ষস! বাবু, রাক্ষস! শুধুমাত্র রাক্ষস ওই ভাবে মারতে পারে কুকুরটাকে। তারপর একবার দেশে ফিরলো একা একা। তারপর যেন কেমন পাল্টে গেল। শুনেছি এ দেশে বলে সাধু সন্ন্যাসীর পাল্লায় পড়েছিল।
— পাল্টে গেল মানে?
— ভালো হয়ে গেল। তারপর তো দেখছেন। ভালো মানুষ।
— আর এই কথাগুলো বলতে আপনাকে কত টাকা দিয়েছে সোমেশবাবু। আপনার বোস্টনে নিশ্চয়ই শম্পা বিড়ি পাওয়া যায় না গোপালবাবু। আপনার আসল নামটা কি? গোপাল তো না।
কথাগুলো বলে আদিত্য বাইরে বেড়িয়ে আসতেই একটা আননোন নম্বর থেকে ফোন ঢুকল আদিত্যর ফোনে,
— হ্যালো আদিত্যবাবু। ভালো আছেন। সোমেশ সমাদ্দার বলছি।
— বলুন।
— বলছি আমাদের বাড়ির পুরনো লোক গোপালদাকে পাওয়া যাচ্ছে না বেশ কিছুক্ষণ। তাই ভাবলাম আপনাকে একটু জিজ্ঞেস করে নি।
— হুম দেখা হয়েছিল, কিছুক্ষণ পর আপনার বাড়ি পৌঁছে যাবেন। আসলে কী জানেন ফেক নিয়ে আমাদের কাজ হয় না। আপনার কাছ থেকে এর চেয়ে বেটার অভিনেতা আশা করেছিলাম সোমেশবাবু।
— আসলে কী জানেন ভালো অভিনেতা এখানে পাওয়া যায় না। যাক ওঁকে একটু পৌঁছে দেওয়ার বন্দোবস্ত করবেন। যতই হোক বৃদ্ধ লোক তো। গুডনাইট আদিত্যবাবু ভালো থাকবেন।
ফোনটা রাখতেই পরাগ আর নায়েক পাশে এসে দাঁড়াল। পরাগ প্রশ্ন করল,
— তাহলে বাকিদের কী করব? ম্যাথুকে তুলবো কি? এমনিতে ও ঘর থেকে বের হয়নি একদম। ওর বিরুদ্ধে একটা পুরনো হিট অ্যান্ড রান কেসও পেয়েছি। কী করব স্যার?
— আর তুলে কী হবে? কোনও লাভ নেই। ছেড়ে দাও।
চুরুটটা পায়ের তলায় পিষে ফেলতে ফেলতে উত্তর দিল নায়েক।
— না স্যার। ম্যাথুকে তুলুন। আমার মনে হয় না ম্যাথু অভিনেতা হবে। প্লিজ স্যার। একবার দেখা যাক।
আদিত্যর কথায় নায়েক একবার ওর দিকে তাকা্ল। তারপর পরাগের দিকে তাকিয়ে বলল,
— তাহলে তোলো। ও যখন বলছে। দেখা যাক।
8.
গাড়ি থেকে নেমেই আদিত্য দেখল বাড়িটার দরজার এক কোনায় পরাগ দাঁড়িয়ে আছে। ও এগিয়ে গিয়ে দরজা পেরোতেই পরাগ বলে উঠল,
— নায়েক সাহেব আসবে না আদিত্যদা। উনি মনে করেন না এর থেকে বেশি কিছু পাওয়া যাবে । আমারও তাই মনে হয়। শুধুমাত্র তোমার কথায়…
— থ্যাঙ্ক ইউ পরাগ।
— নয়দিন ফিল্ডিং দিয়ে আজ পাকড়েছি শালাকে। কিছুতেই গর্ত থেকে বের হচ্ছিল না। আজ একবার শুধু বেড়িয়েছিল। তারপর..
পরাগের হাসির উত্তরে একটা হাসি দিয়ে ঘরে ঢুকে এল আদিত্য। আগের দিনের মত এ ঘরটাও অন্ধকার তবে আকারে বড়। একটা বড় বাল্ব সিলিং থেকে জ্বলে যতটা আলো দিচ্ছে তার চেয়েও বেশি অন্ধকারকে গাঢ় করেছে। আর সেই আলোর নীচে কাঠের চেয়ারে মাথা নীচু করে বসে ম্যাথু, ম্যাথু পেরেরা। আদিত্য একটা চেয়ার নিয়ে ম্যাথুর সামনে এসে বসল।
— হ্যালো মিস্টার পেরেরা।
— আমাকে এখানে ধরে নিয়ে আসার মানে কী? আপনি জানেন এর রেজাল্ট কি হতে পারে? সোমেশ জানলে…
— আমরা তো আপনাকে ধরে নিয়ে আসিনি মিস্টার পেরেরা। ইউ আর ফ্রি ম্যান টু ওয়াক আউট এনি টাইম। শুধুমাত্র কিছু কথা বলতে চাই। আপনার সাথে। একান্তে।
— আপনাদের কথা বলার পদ্ধতিটি অসাধারণ।
— খুনিদের সাথে কথা বলার পদ্ধতি হিসাবে বেশ ভালো।
— আমি কোনও খুন করিনি।
— তাহলে বলছেন সোমেশ একা গাড়িতে মহিলা অপহরন করত। আপনি থাকতেন না।
— না।
— সোমেশের পক্ষে টাফ হয়ে যেত না এক হাতে গাড়ি এক হাতে মহিলাদের ম্যানেজ করা।
–সোমেশ কিছু করেনি।
— সেটা আমি আর আপনি দুজনে ভালো করে জানি কে কী করেছে, কে করেনি। প্রশ্ন হল আপনি কি করেছেন?
— বললাম তো আমি কিছু জানি না।
— ২১শে ফেব্রুয়ারি ২০১২ আদর্শনগর থেকে এক মহিলা নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। দেবিকা সোম। পরে আর খোঁজ মেলেনি মহিলার। সেই সময় মহিলার সাত বছরের ছেলে দুজন কাকুকে মাকে নিয়ে গাড়িতে উঠতে দেখে। দুজন মিস্টার পেরেরা। ৩রা সেপ্টেম্বর ২০০৮ কিরণপার্ক, শোভনা দত্ত, মহিলার প্রতিবেশী সেদিন রাস্তার পাশে একটা সবুজ গাড়ি দাড়িয়ে থাকতে দেখে, গাড়িতে দুজন লোক ছিল। তারা অপহরনের দিন ঘটনার আগে তিন ঘন্টা ওখানে দাড়িয়েছিল। ১৫ই মে ২০১১ রসুলপুর, সামিমা জামান, মহিলার বাবা পুলিশে অভিযোগ করেন একটা লোক তার মেয়েকে কয়েকদিন ধরে ফলো করছে বলে। লোকটা আপনি ছিলেন তো?
— আমি কিছু জানি না।
— ছেলেটা কিন্তু আপনাকে চিনতে পেরেছে মিস্টার পেরেরা। প্রতিবেশী বা বাবার ডেস্ক্রিপশান আপনার সাথে মেলে।
— আমি জানি না আপনি কী বলছেন।
— আপনার এডুকেশন কোয়ালিফিকেশন কী মিস্টার পেরেরা?
— পি এইচ ডি ইন ইন মলিকিউলার বায়োলজি ফ্রম বোস্টন ইউনিভার্সিটি।
— নিউরো মাসকুলার ব্লকেড ডেভেলপ করার আইডিয়াটা আপনার তো? স্প্রে গান ইউস করা।
— আমি কিছু করিনি।
— উই ক্যাচ ইউ মিস্টার পেরেরা।
— আমি কিছু জানি না। আপনি কি আমায় অ্যারেস্ট করছেন? আমি আমার ল-ইয়ারের সাথে কথা বলতে চাই।
— রিলাক্স স্যাম আমরা তোমাকে এখনই অ্যারেস্ট করব না। তাছাড়া আমার মনে হয় না তুমি খুনগুলো করেছ। ইউ ডোন্ট হ্যাভ দ্যা গাটস টু ডু ইট। ডু ইউ? বাদ দাও। তুমি স্মোক করো?
— না। থ্যাঙ্ক ইউ।
— আচ্ছা ম্যাথু একটা কথা জিজ্ঞেস করব? পার্সোনাল।
— করুন।
— তুমি আর সোমেশ, তোমরা শুধু মাত্র বন্ধু না তাই না। তোমরা পার্টনার।
— হু।
— কতদিনের সম্পর্ক তোমাদের?
— ১৭ বছর।
— তাহলে তোমরা বিয়ে করোনি কেন স্যাম? স্টেটসে বিশেষত ম্যাশাচুশেট স্টেটসে এটা বহু দিন লিগাল।
— দ্যাটস পার্সোনাল।
— আমার মনে হয় সোমেশ তোমাকে বিশ্বাস করে না। তোমার উপর ভরসা করে না। না হলে তোমাকে লুকিয়ে রাখে এতদিন।
— এরকম কিছু না। ও আমাকে নিয়ে ওভার প্রোটেকটিভ।
— আই ডোন্ট থিংক সো। আমার একটা জিনিস মনে হচ্ছে, অ্যাকচুয়ালি সোমেশ তোমাকে ভালোবাসে না। ও তোমাকে লুজ এন্ড ভাবে। ইভেন আমার মতে সোমেশ গে নয়। হি ইস বাই সেক্সুলার। তোমার মনে হয় না তাই।
— না। ও সেরকম হলে ও বলতো। আমি ও বুঝতাম।
— তুমি বোঝো কিন্তু তুমি বলো না। তুমি ফিল করো না। ফিল করো না যখন সোমেশ খুনগুলো করে ও তখন সেক্সুয়ালি প্লেসারড ফিল করে যে প্লেসার তুমি দিতে পারো না। তখন ওকে তুমি দেখনি ম্যাথু। তখন মনে হয়নি তোমার ও চিট করছে তোমাকে। হি ইজ নট এ গে।
— না এটা ঠিক না। আমি শুনতে চাই না এসব কিছু।
— তুমি ফিল করো ম্যাথু। তুমি জানো এই কথাটা ঠিক। শুধুমাত্র তুমি ওর উপর ডিপেন্ডেন্ট হয়ে গেছ। তুমি মনে করো ওকে নিয়ে তোমার জীবন কিন্তু এখনও কি তুমি সত্যি ওকে ভালোবাসো। নিজের মনকে একবার জিজ্ঞেস করো। সোমেশের কাছে তুমি একটা বোঝা। ওর অরিজিনাল সেক্সুয়ালিটি পাবার একটা উপায় আর কিছু না।
— না। এটা ঠিক নয়।
— তুমি ভাবো, তুমি ওকে ছাড়া বাঁচতে পারবে না। কিন্তু সোমেশ কি এটা ভাবে? ভাবে না। ও তোমার সুযোগ নিচ্ছে। ও তোমাকে চিট করছে। মনে হয় না তোমার। নিজের মনকে জিজ্ঞেস করো?
— না
— ইটস টাইম টু মুভ অন ম্যাথু।
— ইউ ডোন্ট নো হিম। হি ইস ডেন্জারেস।
— উই প্রোটেক্ট ইউ। ও তোমাকে টাচ করতে পারবে না।
— না।
— ইটস টাইম টু মুভ অন। একবার ভরসা করে দেখ আমাদের। এই সুযোগ বারবার আসবে না। সারা জীবন তুমি এই ভাবে কাটাতে চাও?
— না…
–ভরসা করো আমাদের। একবার।
ম্যাথু দীর্ঘ শরীরে কাঁপুনি দিয়ে চাপা কান্না দিকে তাকিয়ে থাকল আদিত্য কিছুক্ষণ। তারপর এগিয়ে গিয়ে হাতটা রাখল ম্যাথুর কাধে। ম্যাথুর কান্নার বেগ বেড়ে গেল। আদিত্য পিছনে ফিরে পরাগের দিকে তাকিয়ে বলল,
— ম্যাথু পেরেরা অফিসিয়াল স্টেটমেন্ট দিতে রেডি।
9.
আজকে নায়েক স্যারের ঘরে ঢুকতে আর অস্বস্তি হল না আদিত্যর। নক করে সোজা ঘরে ঢুকে গেল ও। সামনের টেবিলটা খালি। দেবনাথ নায়েক জানলার পাশে দাড়িয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে সূর্যাস্তের লাল আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। হাতে স্বভাবসিদ্ধ চুরুটটার লম্বা ছাইয়ের মাঝে হাল্কা ধোঁয়া উড়ছে। একটা লম্বা চওড়া শরীর জানলার মাঝে লালচে হলুদ ব্যাকগ্রাউন্ডে অসাধারণ এক ছবির সৃষ্টি করেছে। আদিত্য এক মিনিট দৃশ্যটা দেখে থমকাল, তারপর গলা খাঁকাড়ি দিয়ে বলল,
— স্যার উই গট দ্যা বাস্টার্ড। ম্যাথু পেরেরা জবানবন্দি অনুসারে আমরা শ্যামাপুকুর গ্রামে সোমেশের বেনামি বাগান বাড়ি খুঁজে পেয়েছি। একটু আগে সিরাজুল খবর দিল ওখানে ওরা কিছু বডি পার্টস মাটি খুড়ে পেয়েছে। পরাগের টিম ম্যাথুকে নিয়ে ওদিকে রওনা দিয়েছে। ওরা কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যাবে। তারপর আমরা আরও ভালো ভাবে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করব। স্যামের মতে একুশ জন ভিক্টিমের বডি পার্ট পাওয়া যেতে পারে। ভাবতে পারেন স্যার একুশ জন। তারপর…
— তারপর আমরা কিছু করতে পারব না আদিত্য।
— এরকম কেন বলছেন স্যার! আমরা ওকে হাতের মুঠোয় পেয়ে গেছি। আর আপনি তো বলেছিলেন ওকে হাতে পেলে…
— হ্যাঁ আমি বলেছিলাম, আমি বলেছিলাম ওকে হাতে পেলে ওর শেষ দেখে…কিন্তু আমি ভুলে গেছিলাম, আমি জাস্ট একজন পাবলিক সার্ভেন্ট। যার পাবলিককে সার্ভিস দেবার ভালো মন্দ ঠিক করার কোন উপায় নেই। উপর থেকে কিছুক্ষণ আগে ফোন এসেছিল আদিত্য। সোমেশকে কিছু করতে না করেছে উপর থেকে। আমাদের হাত থেকে এই কেসটা নিয়ে নেওয়া হচ্ছে। সোমেশের কিছু হলে শেয়ার বাজারে ধ্বস নামতে পারে। আর ইকনমির এই অবস্থায় এই স্টেপ নেওয়া যাবে না বলে সরকার মনে করে। তাই স্টেট এবং সেন্ট্রালের একটা যৌথ টাস্কফোর্স এর দায়িত্ব নিচ্ছে।
— ওই রাক্ষসটাকে ছেড়ে দেবে। স্যার ওকে ছেড়ে দিলে ও আবার খুন করবে। স্যার এটা হতে পারে না।
— আমাদের কিছু করার নেই আদিত্য। সরি।
আদিত্য চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে বেড়িয়ে এল ঘর থেকে তারপর একটা ব্যালকনির পাশের দেওয়ালে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে রইল। বিড়বিড় করে বলল কিছু একটা। তারপর হঠাৎ ফোন বের করে কাউকে একটা ফোনে জিজ্ঞেস করল,
— সোমেশ কোথায়?
–…..
— ওকে আমি আসছি। ততক্ষণ কোন নতুন ডেভেলপমেন্ট হলে ফোন করো।
আদিত্য গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। সূর্য অস্ত গেছে, আকাশ কালো করে এসেছে অন্ধকার।
10.
সুন্দর সাজানো ঘরটাতে ঢুকবার আগে একবার জোরে নিশ্বাস নিল আদিত্য। লম্বা ঘর। তাতে জোরালো কোনও আলো নেই বরং হাল্কা স্নিগ্ধ আলোতে ছেয়ে আছে ঘরটাকে। ভিতরে ঢুকে মনে হয় কোন পুরানো জমিদার বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়া হয়েছে। পুরনো আসবাবপত্র, সাজসজ্জা, রঙ, গন্ধ একটা অদ্ভুত আমেজ সৃষ্টি করে। যদিও ঘরটার সৌন্দর্য আদিত্যকে প্রভাবিত করছে না এখন। তার দৃষ্টি নিবদ্ধ ঘরটার ঠিক মাঝখানে রাখা কাঠের সেন্টার টেবিলের ওপারে বসে থাকা লোকটার দিকে। সোমেশ সমাদ্দারের হাতে চায়ের কাপ। সামনে টেবিলে রাখা একটা বাটি চামচ। তার পাশে একটা দামি দাবা বোর্ড। চা জলখাবার খেতে খেতে একা একা দাবা খেলছে সোমেশ। আদিত্য ঘরে ঢুকতেই বোর্ডর থেকে চোখ আদিত্যর দিকে সরে এল সোমেশের। মুখে একটা অবজ্ঞার হাসি খেলে গেল যেন। উঠে দাঁড়িয়ে সোমেশ বলল,
— আসুন আসুন মিস্টার সেন। কেমন আছেন? বসুন। বলুন কী মনে করে? তার আগে দাঁড়ান। এই কে আছিস এক কাপ চা দিয়ে যা।
— কিছু মনে করে নয় শুধু আপনার সাথে একটু কথা বলতে এলাম।
— কথা। তা কী কথা বলতে চান আপনি! ম্যাথুকে গ্রেফতারের কথা। নাকি শ্যামাপুকুরের বাড়ির কথা। কোনওটাই প্রুফ কিছু নেই মিস্টার সেন। বেনামি বাড়ি আর ম্যাথুকে ছাড়িয়ে আনতে আমার দুমিনিট সময় লাগবে না। পুলিশের কাছে জবানবন্দি কোর্টে আপনার প্রমাণ করতে হবে মিস্টার সেন।
— না আমি লিগাল কিছু নিয়ে কথা বলতে চাই না। আমি আপনাকে নিয়ে কথা বলতে চাই।
— আমাকে নিয়ে! আচ্ছা কথা বলব। যখন এখানে এসে এভাবে জিজ্ঞেস করছেন তখন সব উত্তর দেব। তবে তার আগে আপনি বলুন আপনি দাবা খেলতে পারেন মিস্টার সেন।
— পারি।
— লেটস হ্যাভ এ গেম। আসলে একা একা খেলতে আমার ভালো লাগে না। খেলতে খেলতে কথা বলা যাবে। গেম পে চর্চা। কী বলেন? আপনি পুলিশ, আপনি সাদা। আর আমি অপরাধি, তাই আমি কালো। নিন শুরু করুন।
— ঠিক আছে। এই আমার চাল আর আমার প্রথম প্রশ্ন। গোপালবাবুর স্ক্রিপ্ট তো আপনি লিখেছিলেন না? স্ক্রিপ্টের সব কথা তো মিথ্যা নয় তাই না সোমেশবাবু?
— হা হা। হ্যাঁ আমি লিখেছিলাম আর সত্যি স্ক্রিপ্টের অনেক কথা সত্যি আবার অনেক কথা মিথ্যা। এবার আপনার ব্যাপার কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যা বেছে নেওয়া। আপনার চাল।
— আপনার মা ছোটবেলায় আপনাকে আর আপনার বাবা ছেড়ে চলে যায়। মার আদর আপনি কখনোই পাননি। কিন্তু কেন চলে যায় সোমেশবাবু? আপনার বাবা মার সম্পর্ক ভালো ছিল না। কার দোষ ছিল সোমেশবাবু? বাবার না মার। আপনার চাল।
— আমার মা যখন চলে যায় তখন আমি বড্ড ছোট। কার দোষ, কী দোষ বোঝার বয়স তখন আমার হয়নি। বাবার ভার্সন শুনে বড় হয়েছি। মার ভার্সন শুনিনি তাই বলতে পারব না।
— পরে আপনার মা দেখা করেননি, কখনও। বিশ্বাসযোগ্য হল না। নাকি দেখা করতে দেওয়া হয়নি। আপনাদের ওখানে আইন খুব স্ট্রিক্ট এ সব ক্ষেত্রে। কেন দেখা করতে দেওয়া হয়নি সোমেশবাবু। আপনার মা ড্রাগ অ্যাডিক্ট ছিল না কী কোন অপরাধি? আপনার চাল।
— মায়ের কিছু মেন্টাল প্রবলেম ছিল। পরে যখন দেখা করার চেষ্টা করি ততদিনে মার অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেছে।
— বাবার সাথেও তো আপনার ভালো সম্পর্ক ছিল না। তাই না। ডমিনেটিং বাবা সাইকো মা, নট এ গুড চাইল্ডহুড।
— আমার মনে হয় না। আসলে গোপালদা আমাকে মানুষ করে নিজের ছেলের মত। ভালো লোক ছিল। দুবছর আগে ওখানে মারা গেছে। তাই খুব একটা খারাপ চাইল্ডহুড ছিল না আমার। ভালোই দাবা খেলেন দেখছি তবে খেলার শুরুতেই বড্ড অ্যাটাকিং হয়ে যাচ্ছেন। নিন আপনার চাল।
— ওকে অন্য প্রসঙ্গে যাই। আপনার সমকামিতা, এই নিয়ে আপনার বাবার কী মত ছিল?
— যেমন সমস্ত ভারতীয় ফ্যামিলিতে হয়। বাবা এটা রোগ বলে মনে করত। চিকিৎসা করাবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু যখন কিছু করতে পারেনি তখন… আপনার কুইনকে সামলান মিস্টার সেন।
— তখন?
— তখন আর কি রণে ভঙ্গ দিয়ে সারা জীবন আমার সাথে তেতো মুখে কথা বলে গেছেন। আমাকে বলতেন আমায় দেখলে পরে ওঁর বমি আসে। আর আমিও তেমনি বয়ফ্রেন্ড নিয়ে ওঁর সামনেই ঘরে দরজা দিতাম। হা হা হা।
— আর কবে বুঝলেন যে আপনি বাই সেক্সুয়াল?
— আমি বাইসেক্সুয়াল নই অফিসার।
— আপনি প্লেজারড ফিল করেন না যখন আপনি খুগুলো করেন?
— হা হা। ইয়েস করি। তবে মেয়েগুলোর সাথে সেক্স করে নয়। ওদের নরম চামড়াগুলোর ভিতর থেকে যখন আমি ছুরি চালাই তখন। ওদের অর্গানগুলো কাটার পরও যখন ওদের ক্ষুদ্র হার্টটা লাফালাফি করে তখন। দে বিট লাইক এ রকিং মিউজিক। লাবডুব লাবডুব। ইউ সুড বি দেয়ার মিস্টার সেন। দেন ইউ ক্যান হিয়ার দ্যা মিউজিক।
— আর অর্গানগলো নিয়ে কী করেন?
— আপনি বলুন কী করি?
— ডু ইউ প্র্যাক্টিস ক্যানিবলিজম মিস্টার সমাদ্দার?
— উই আর অল ফাকিং ক্যানিবল মিস্টার সেন। আপনি আমি অল অব দেম। এই সমাজের সব জায়গায় আমরা একে অপরকে খুবলে খাই। খাই না।
— আমি আপনার কাছে সমাজের গল্প শুনতে আসিনি মিস্টার সমাদ্দার। আমি আপনার গল্প শুনতে এসেছি।
— ইউ আর ভেরি ব্রেভ ম্যান মিস্টার সেন। আপনার মনে হয় না, আপনি যে এখানে এসেছেন, এখানে আপনাকে আমি মেরে ফেলতে পারি। কেউ কিছু করতে পারবে না। এই যে আপনি চা টা খেলেন, এখানে আমি ওষুধ মিশিয়ে দিতে তো পারি মিস্টার সেন। যতক্ষণে কেউ জানবে ততক্ষণ আপনার বডি আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। আপনি কি অস্বস্তি ফিল করছেন মিস্টার সেন। আপনার হার্টবিটটা যেন আমি শুনতে পারছি।
— ভয় দেখাচ্ছেন?
— না আমি শুধু আপনাকে একটা সম্ভবনার কথা বোঝাতে চেষ্টা করছি। আপনি ভয় পাচ্ছেন কি?
— না।
— ইউ সুড। আই এম এ ভেরি ডেন্জারেস পার্সন।
— আমাকে ভয় দেখিয়ে লাভ নেই সোমেশবাবু। আমার প্রশ্নের উত্তর আপনি দিলেন না তো, আপনি ক্যানিবলিজম প্র্যাক্টিস করেন?
— মে বি।
— এটা কবে থেকে ডেভলপ করেন? সাধু সঙ্গ?
— আই মাস্ট অ্যাপ্রিসিয়েট দ্যাট ইউ আর এ গুড লিসনার মিস্টার সেন। তবে দাবাতে কিন্তু আপনি হারতে চলেছেন।
— ডু ইউ ইট দেম এভরি ডে?
— না। তবে আমি খাই। ইভেন এখনো খাচ্ছি। এই ডিসটা। আমার নিজের তৈরি। ডু ইউ ওয়ান্ট টু টেস্ট। আপনি পর্ক খেয়েছেন। এটা বেটার কোয়ালিটি পর্ক বলতে পারেন। খাবেন একটু? খেতেই পারেন। আমাদের দেশে ক্যানিবলিজম অপরাধ নয় মিস্টার সেন। ডু ইউ নো হোয়েন আই ফিল মোস্ট প্লেসারড, যখন আমার সামনে আমার অতিথিরা না বুঝে এটা খায়। আই মেক দেম ইট দেয়ার ওন কাইন্ড। আমার মত।
— ভালোই তো ছিলেন হঠাৎ সামনে এলেন কেন?
— ইচ্ছা হল।
— নাকি অন্য কিছু।
— কী হতে পারে। মনে হল তাই।
— আমার মনে হয় না। আপনি কি অসুস্থ মিস্টার সমাদ্দার? আমার মুখ চোখ কিন্তু তাই বলছে। কোন টার্মিনাল ডিজিজ। আমার এক বন্ধু আছে ওদেশে। সে আপনাকে চেনে। আপনার ডাক্তার সাথে সে মিট করেছে। ইউ আর গোয়িং টু ডাই। তাই না। আপনার হাতে বেশি দিন নেই। তাই শেষবেলায় রেকগনিসন চান। যেটা আপনি কখনো পাননি আপনার জীবনে। না বাবার কাছে না মায়ের কাছে। না সাধারণ লোকের কাছে। পয়সা আপনার আছে কিন্তু রেকগনিসন, কেউ কি জানে আপনি কতটা জিনিয়াস? কেউ জানে না। না আপনার বাবা মা না সাধারণ লোক। ইউ আর অ্যাবানডান্ট। তাই তো। জিএফকে। জিনিয়াস ফিবোনাচ্চি কিলার অর জঘন্য ফাকিং কিলার?
— আপনি একটু বেশি জেনে গেছেন অফিসার।
— কিন্তু আপনার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে মিস্টার সমাদ্দার। কারণ আমরা এই তদন্ত বন্ধ করে দিচ্ছি। দিল্লি থেকে টিম আসছে। তারা এই তদন্ত ধামাচাপা দিয়ে দেবে। তারপর…আপনার হাতে সময় তো নেই। আপনি কখনও রেকগনিসন পাবেন না। আপনার বাবার মত সবাই ভাববে আপনি কিছুই না। আসলে কেউ আপনাকে জানবেই না।
— আপনারা এই তদন্ত বন্ধ করতে পারেন না। আপনারা পুলিশ। এই দেশ এই সমাজের প্রতি আপনাদের কর্তব্য আছে।
— আমরা করছি মিস্টার সমাদ্দার। আর চেকমেট। চলি। এটাই জানাতে আমি এসেছিলাম।
— ইউ ক্যান্ট স্টপ দিস। আমাকে এভাবে ফেলে যেতে পারেন না। আপনারা হেরে গেছেন। এক্সেপ্ট ইট। আমি আবার খুন করব।
— বাই মিস্টার সমাদ্দার। হ্যাভ এ গুড নাইট।
— আমি এর শেষ দেখে ছাড়ব।
11.
ঘুম থেকে চোখ খুলে বাইরের দিকে তাকাল আদিত্য। জানলা দিয়ে বাইরের আলো পর্দা পেরিয়ে সেভাবে ঢুকছে না। তার মধ্যে আজ দিনটা একটু মেঘলা। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। ঘুমটা কিসের জন্য ভাঙল তা ভাবতে যেতেই মাথার কাছে রাখা ফোনটা ভাইব্রেটর মোডে বাজতে লাগল। মনে মনে একটু বিরক্ত হল আদিত্য। আজ তার কারও ফোন ধরার ইচ্ছা ছিল না। অফিসে যাবার ও না। ফোনটা চোখের সামনে আনতেই আদিত্য দেখল দাশবাবুর ফোন।
— হ্যালো।
— হ্যালো স্যার কোথায় আপনি? কখন থেকে ফোন করে যাচ্ছি।
— ঘুমাচ্ছিলাম।
— কেন স্যার অবেলায় ঘুমাচ্ছিলেন? আপনার কি করোলা ভাইরাস হয়েছে?
— ওটা করোনা ভাইরাস দাশবাবু। না আমার কিছু হয়নি। এমনি ঘুমাচ্ছিলাম।
— আপনার বৌদি বলে…
— ফোন করেছিলেন কেন দাশবাবু?
— আরে স্যার আপনি তো ঘুমাচ্ছিলেন এদিকে একটা বিশাল কান্ড হয়েছে।
— কী?
— সোমেশ সমাদ্দার সুইসাইড করেছে। করেছে তো করেছে তার আগে বলে ব্যাটাছেলে কী সব ভিডিও ভাইরাস করে দিয়েছে নিজেকে খুনি দাবি করে আর পুলিশ ওকে ধরতে পারেনি বলে। এ নিয়ে ওপরে তো তোলপাড় চলছে। নায়েক স্যার সমানে ওপরে ফোন করছে। মিডিয়ার লোক সব ঘুরে বেড়াচ্ছে। টিভিতে বলে আমাদের গুষ্টির তুষ্টি পুজো করছে। নায়েক সাহেব আপনাকে খুঁজছে সেই নিয়ে। আই জি সাহেব বলে মিডিয়ায় আজ বলবে, সোমেশকে আমরা ধরে ফেলেছিলাম। ভয় পেয়ে ও সুইসাইড করে বলে। তাই আপনার দরকার। আপনাকে ফোনে না পেয়ে তিনবার আমায় ধরে ঝেড়েছে। বলল অ্যাসহোলটাকে এখনই এখানে চাই আমার। বলছি স্যার অ্যাসহোল মানে কি? গাধা শুনেছিলাম, গাধার ফুটো?
— আমি আসছি।
— হ্যাঁ স্যার আসুন। তাড়াতাড়ি আসুন। এদিকে আপনার বৌদি বলছিল…
— আমি রাখছি দাশবাবু।
ফোনটা রেখে উঠে বসল আদিত্য। মনে মনে গুছিয়ে নিল কিছুক্ষণ। এখন তার অনেক কাজ। বাথরুমে ঢুকতেই সামনে আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পেল আদিত্য। প্রতিবিম্বের মুখে তখন একটা হাসি ফুটে উঠছে।