হোস্টেলে থেকে বাড়ি এলেই আমার অন্যতম প্রধান কাজ ছিল পাশের বাড়িতে ছুট লাগানো। আসলে তান্ত্রিক দাদুর গল্প না শুনলে আমার বাড়িতে দিন যেত না। শুধু আমি নয়, বুবাই, আকাশ, তরুণ সবাই আসত। আমরা সন্ধের দিকে দাদুর বাড়ি যেতাম আর সেই এক আবদার, গল্প শোনা। দাদু তার জীবনের নানা বৈচিত্র্যময় ঘটনা সুন্দর ভাবে গল্পের ছলে বলতেন, তার সবটাই একেবারে সত্যি কিনা সেটা নিয়ে সন্দেহ ছিল। কিন্তু গল্পগুলো শুনতে আমাদের খাসা লাগত। তবে দাদুর একটাই শর্ত ছিল, গল্পের মাঝে কথাগুলো সত্যি কী বানানো এ নিয়ে কোনও প্রশ্ন করা যাবে না, প্রশ্ন করলেই তিনি ভীষণ রেগে বলতেন, “তোদের সব কিছুতেই সন্দেহ, সবাই এক একজন বৈজ্ঞানিক কিনা!” কাজেই আমরা চুপচাপ গল্পগুলো শুনতাম, শুধু কিছু বুঝতে অসুবিধা হলে জিজ্ঞেস করতাম। এরপর অনেক দিন কেটে গেছে, কর্মসূত্রে এখন কলকাতা ছেড়ে ব্যঙ্গালোর পাড়ি দিতে হয়েছে, তাই আর বেশি বাড়ি আসা হয় না, আর দাদুর গল্প ও অনেকদিন শোনা হয়নি। কিন্তু লকডাউনের সময় অনেকদিন কাজ বন্ধ থাকায় বেশ কিছুদিন বাড়িতে কাটিয়েছি। একদিন হঠাৎ করে মনে হল দাদুর সঙ্গে অনেকদিন দেখা হয়নি, একবার দেখা করে আসি। তাই গেলাম দাদুর বাড়ি। দেখি আগের চেয়ে চেহারা অনেক ভেঙে গেছে, শরীরে বয়সের ছাপ স্পষ্ট। গিয়ে প্রণাম করলাম।
পিঠে হাত চাপড়িয়ে বললেন, “কিরে, এতদিন পরে দাদুকে মনে পড়ল!”
কিছুটা লজ্জিত হয়ে বললাম, “না না, আসলে কাজের চাপ থাকে তো, তাই আসা হয়নি।”
দাদুর চেহারার পরিবর্তন হলেও কথার সেই তেজ আজও আছে। তিনি তো আর যে সে লোক নন, এককালের এলাকার নামকরা তান্ত্রিক রাসবিহারী মুখুজ্জে, আমাদের কাছে তান্ত্রিক দাদু।
আমি বাড়ি ফেরার উপক্রম করছিলাম কিন্তু উনি নিজে থেকেই বললেন, “আজ গল্প শুনবি না?”
আমি থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। দাদুর গল্প, না বলা যায় না। সেই কৈশোরের স্মৃতিগুলো চাঙ্গা হয়ে উঠল। বললাম, “তুমি বলবে?, তাহলে আমি নিশ্চই শুনব।।”
দাদু বললেন, “বেশ তবে শোন।”
এই বলে হাতে থাকা চায়ের পেয়ালায় একটা চুমুক দিয়ে শুরু করলেন ——
আজ থেকে প্রায় বছর দশেক আগেকার কথা। তখন সকাল সাতটা মত হবে। আমি সকালের প্রাতঃভ্রমন সেরে ঘরে এসে জল খাবার খাচ্ছি, এমন সময় আমার ছাত্রজীবনের বন্ধু সৌমেন আমার কাছে এল। সেই কবে একসাথে কলেজে পড়তাম, তারপর যোগাযোগ খুব কম ছিল, তবে মাঝে মধ্যে দেখা হত। আসলে ওর বাড়ি এখানে ছিল না, ওদের বাড়ি মালদা। তাই মাঝে মাঝে কলকাতা এলে, ও আমার কাছে আসত। এতদিন পরে বন্ধুকে দেখে আমার খুব আনন্দ হল। সাথে দেখলাম বছর পনেরোর এক মেয়ে। ও আসতে আমি ওকে সামনের চেয়ারে বসতে বললাম। তোর দিদিমাকে চা জল খাবার আনতে বলে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “কি রে, এতদিন পর হঠাৎ কী মনে করে?”
ওর মুখটা কেমন শুকনো দেখাচ্ছিল। কিছুটা সংকোচ করে বলল, “আসলে, তোকে যে কীভাবে কথাটা বলি!”
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, “বল না কী হয়েছে, আমায় নির্ভয়ে সব বলতে পারিস।”
ও বলল, “খুব বিপদে পড়েছি। “
আমি বললাম, “বিপদ! কী রকম বিপদ?”
এতক্ষনে ওর চা জল খাবার এসে গেছে। দেখলাম ওর সঙ্গে থাকা মেয়েটি মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে আছে।
ও চায়ে অন্যমনস্ক ভাবে একটা চুমুক দিয়ে রেখে দিল, তারপর বলতে শুরু করল, “আমার ছেলে কলকাতায় বদলি হয়েছে। আর আমাদেরও ইচ্ছে ছিল এখানেই থাকব। তাই মাস দুয়েক হল একটা বাড়ি কিনেছি। বেশি দূর নয়, এখান থেকে মাইল পাঁচেক হবে। তিনতলা বাড়ি, একটু সস্তা দামেই পেয়েছি। বাড়ির লোক কেউ নেই, আত্মীয়রা তাই বেচে দিয়েছে। বাড়িটা বেশ ভালো। আমি, আমার স্ত্রী, আমার ছেলে, বৌমা আর এই নাতনি, আমরা পাঁচজনে থাকি। প্রথম সপ্তাহে কিছু বুঝতে পারিনি। কিন্তু তারপর লক্ষ করলাম আমার নাতনি কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছে। যে মেয়ে সারাদিন হাসি খুশি থাকত, সে একেবারে মনমরা হয়ে থাকছে। খাওয়া দাওয়াও তেমন করছে না। ভাবলাম হয়তো নতুন জায়গায় মন বসছে না। কিন্তু যত দিন যেতে লাগল, ও তত বেশি রুক্ষ, শুষ্ক হয়ে উঠল। আর মাঝে মাঝে খুব রেগে যেতে লাগলো। ওর বাবা তাই দিন পনেরো আগে এক মনোবিদের কাছে নিয়ে গেল। তাতেও কোনও লাভ হলো না। ভেবেছিলাম কিছুদিন গেলে হয়তো এমনি এমনি ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু কালকের ঘটনার পর আমি খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছি।”
এই বলে সে পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরাল। ওর চোখে মুখে গভীর উদ্বিগ্নতার ছাপ লক্ষ করলাম।
আমি উৎসুক ভাবে প্রশ্ন করলাম, “কী ঘটেছে কাল?”
ও আবার বলতে শুরু করল, “কাল সন্ধ্যাবেলা ও ঘরের মধ্যে ছিল। ও থাকে দোতলার দক্ষিণ পাশের ঘরে। ওর মা কিছু একটা দিতে ওর ঘরে গিয়েছিল। কিন্তু গিয়ে দেখে সে এক বীভৎস কান্ড। আমার নাতনি খাটের তলায় বসে আছে, ওর মুখে রক্তের দাগ, আর হাতে ধরা আছে আধখাওয়া একটা ইঁদুর। ওর মাকে দেখে ও বেরিয়ে এল, তারপর বাকি ইঁদুরটাকে মায়ের চোখের সামনেই চিবিয়ে চিবিয়ে খেয়ে নিল। ওর মা তো এসব দেখেশুনে ভিরমি খাওয়ার অবস্থা। ওকে জিজ্ঞেস করতে ও বলল, ওর নাকি এসব খেতে খুব ভালো লাগে। আমি বুঝতে পারলাম নিশ্চই কোনও প্রেতাত্মা ওকে বশ করেছে। না হলে কেউ জ্যান্ত ইঁদুর খায়! তুই কিছু কর রাসবিহারী, আমার নাতনিটাকে বাঁচা।” এই বলে সে ছল ছল চোখে আমার দিকে অসহায়ের মত তাকাল।
এতক্ষন ওর নাতনি মুখ নিচু করেই ছিল। আমি সব শুনে ওর নাতনিকে বললাম, “মা, মুখটা একটু তোলো।” ও তখন মুখ তুলে আমার দিকে তাকাল। চুল উস্কোখুস্কো, যেন বহুদিন স্নান করেনি। মুখটা ফ্যাকাসে, চোখগুলো ঢুকে গেছে। ওকে দেখেই আমি বুঝে গেলাম কোনও দুষ্ট আত্মা ওকে বশ করে রেখেছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তোর নাম কি মা?”
ও তখন বলল, “আমার নাম যাই হোক, আমি তোমাকে চিনি।”
আমি অবাক হলাম, যে মেয়েকে আমি এর আগে কখনো দেখিনি, সে কিনা বলে আমাকে চেনে! আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “তুই আমায় কোথায় দেখেছিস আগে।”
সে উত্তর দিল, “কেন, আমরা তো একসাথে চৌধুরীদের বাড়িতে যজ্ঞ করেছিলাম, মনে নেই?”
আমি ওর কথা শুনে চমকে গেলাম। আসলে এটা ওর কথা নয়, ওর মধ্যে থাকা প্রেতাত্মা কথা বলছে। আমার বুঝতে বাকি রইল না কী ঘটেছে। কিন্তু আমি আর তখন আমার বন্ধুকে বেশি কিছু বললাম না। শুধু আমার ফোন নাম্বারটা দিয়ে বললাম রাতে আমাকে ফোন করতে। ওরা বাড়ি ফিরে গেল।
রাত আটটা নাগাদ ফোনটা বেজে উঠল। আমি ফোন তুলতেই ওপার থেকে বন্ধুর উদ্বিগ্ন গলা ভেসে এল, “কি রে, কিছু বুঝলি? আমরা খুব চিন্তায় আছি ।”
আমি বললাম, “হুঁ, বুঝেছি। আচ্ছা এটা কি আগে নবকৃষ্ণ পট্টনায়েকের বাড়ি ছিল?”
ও বলল, “সে তো জানি না, তবে হ্যাঁ, যারা বাড়ি বিক্রি করেছে তাদের পদবিও পট্টনায়েক।”
আমি বললাম, “তবে আমি নিশ্চিত, এটা ওরই বাড়ি। যখন তোর নাতনি বলল, ও আর আমি একসাথে চৌধুরীদের বাড়িতে যজ্ঞ করেছি, তখনই আমি বুঝতে পেরেছি ওটা নবকৃষ্ণের আত্মা।”
বন্ধু বলল, “কিন্তু কী হয়েছিল উনির?”
আমি বলে চললাম, “তবে শোন। নবকৃষ্ণ পট্টনায়েক ছিলেন এলাকার এক নামকরা তান্ত্রিক। তিনি যেমন ছিলেন নানান তন্ত্র মন্ত্রে সিদ্ধহস্ত, তেমনই খুব জেদি এবং ক্রোধী। এটা বছর কুড়ি আগের কথা। তিনি তখন প্রায়ই তারাপীঠে যেতেন এবং কী সব প্রেতসাধনা করতেন। অনেকে তাকে এসব করতে বারণ করেছিল। কিন্তু তিনি কারও কথা শোনেননি। ধীরে ধীরে কেমন বদমেজাজি আর উশৃঙ্খল হয়ে উঠলেন। সবাই বলতো এসব প্রেত সাধনার ফল। তারপর একদিন শুনতে পাই উনি নাকি নিজের বাড়িতে ফাঁসি লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। তিনি বিয়ে করেননি আর তার নিজের বলে তেমন কেউ ছিল না। তাই অপঘাতে মৃত্যু হলে যে সমস্ত বিধি মেনে শ্রাদ্ধ করতে হয়, সেসব কেউ করেনি। আর তাঁর বাড়ি তোরা কিনে ওখানে আছিস। আমি নিশ্চিত ওই তোর নাতনির শরীরে অবস্থান করেছেন। “
সব শুনে আমার বন্ধু ভয়ে কেঁদে ফেলল, ও কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “এর থেকে কি মুক্তির কোনও উপায় নেই?”
আমি বললাম, “চিন্তা করিস না, উপায় নিশ্চই আছে। তবে একজন তান্ত্রিকের আত্মা অত্যন্ত শক্তিশালী। এ কে কাবু করা আমার সাধ্য নয়। আমার পরিচিত একজন আছেন, যিনি কাছেই এক হনুমান মন্দিরের পূজারী। উনি নিশ্চই পারবেন। আমি কালই উনির সঙ্গে কথা বলে তোকে জানাচ্ছি।”
ওইদিন রাতে আমার ঠিক ঘুম হল না। খালি চোখের সামনে ওই মেয়েটার শুকনো মুখ, কোটরে ঢোকা চোখ এর ছবি ভাসছিল। পরদিন সকালে আটটা নাগাদ গেলাম হনুমান মন্দিরে। তখন ওখানকার প্রধান পূজারী অনিরুদ্ধানন্দ শাস্ত্রী পুজোর কাজে ব্যস্ত ছিলেন। কিন্তু আমাকে দেখে উনি নিজেই আসন ছেড়ে বাইরে এলেন। আমি প্রণাম করতে উনি আশীর্বাদ দিয়ে আমার আসার কারণ জানতে চাইলেন। আমি সব ঘটনা খুলে বললাম। উনি বললেন, নিশ্চয়, এ ব্যাপারে উনি আমাদের সাহায্য করবেন।
পরদিন সকালে উনি আমার বাড়িতে এলেন এবং ওঁর কথা মত আমি আমার বন্ধুকেও ডেকেছিলাম ও সাথে করে ওর নাতনির ঠিকুজি কুষ্টি আনতে বলেছিলাম। শাস্ত্রী মশাই ওই ঠিকুজি নিয়ে অনেক্ষন গণনা করলেন। তারপর প্রায় আধঘন্টার জন্য গভীর ধ্যানে মগ্ন হলেন। যখন চোখ খুললেন ওঁকে বিচলিত লাগছিল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী দেখলেন শাস্ত্রী মশাই?”
উনি গম্ভীর গলায় বললেন, “মেয়েটির ঘোর বিপদ। ওকে যে তান্ত্রিকের আত্মা ধরেছে, সে কর্ণ পিশাচিনীর শাপে মারা গেছে।”
শুনে আমি চমকে গেলাম। আমার বন্ধু তখন হতভম্বের মত জিজ্ঞেস করল, “কর্ণ পিশাচিনী কি ঠাকুর মশাই?”
অনিরুদ্ধানন্দ শাস্ত্রী বলে চললেন, “কর্ণ এর অর্থ কান। কর্ণ পিশাচিনী হল যক্ষিনী বিদায়ের সপ্তম রূপ যা অথর্ব বেদে দেওয়া হয়েছে। কর্ণ পিশাচিনী হলো পিশাচদের এক বিশেষ ভাগ। যাদের সাধনা করে বশ করতে পারলে, সারাক্ষন সাধকের কানে কানে কথা বলতেই থাকে। সাধক সহজেই যে কোনও আসন্ন বিপদ, ভবিষ্যতে কী ঘটতে চলেছে, কোন কাজের কী পরিণাম হতে চলেছে, তা জানতে পেরে যায়। এটি ভ্রুয়ের কেন্দ্রের পিছনে অবস্থিত আজ্ঞা চক্রের মাধ্যমে সক্রিয় হয়। তবে এদের নিয়ন্ত্রণে রাখা খুবই কষ্টসাধ্য। এরা কানে কানে কথা বলা শুরু করলে আর থামতে চায় না। তন্ত্রে পিশাচ হল অত্যন্ত নিম্ন শ্রেণীর এক জীব। সাধারণ মনুষ্য সমাজে যা কিছু ঘৃণ্য ও উচ্ছিষ্ট তার উপরেই লালিত পালিত হয় এই পিশাচগণ। মানুষ ও ভুতের মাঝামাঝি একটি স্তরে এদের অবস্থান। বৌদ্ধিক শক্তিতে এরা মানুষের থেকে অনেক নিম্ন পর্যায়ের হলেও, অন্যান্য সমস্ত ক্ষেত্রে এরা অসীম শক্তিধর। তাই মন্ত্র বলে এদের একবার বশে আনতে পারলে এদেরকে দিয়ে ক্রীতদাসের মতো সব কাজ করিয়ে নেওয়া যায়। বিভিন্ন দুরূহ অসাধ্য কাজও সহজেই মানুষ করতে পারে এদের সাহায্যে। তবে পিশাচ সিদ্ধ হতে গেলে সাধকের মধ্যেও পিশাচের কিছু লক্ষণ দেখা যায়। যে সাধক পিশাচ সাধনা করে তার দেহ সম্পূর্ণ কালো কয়লার বর্ণ ধারণ করে। এছাড়া সারাক্ষন নোংরার মধ্যে থাকে, মল-মূত্র ভক্ষণ করতেও পিছুপা হয় না। অনেক সময় মড়ার মাংস খায়, মড়ার মাথা কেটে নিয়ে গিয়ে ক্রিয়া করে। এইসব অতি নিম্ন গুন তার মধ্যে প্রকাশ পায়। এদের কাজে লাগানো মানে আগুন নিয়ে খেলা করা। পিশাচসিদ্ধ হওয়ার পর সাধক যদি সামান্য অনিয়ম করে বা অসাবধানতাবশত নিজের প্রতিকার নিতে ভুলে যান। তবে ওই পিশাচের হাতেই তাকে মরতে হয়।”
আমি বললাম, “তবে নবকৃষ্ণ পট্টনায়েক কি করেছিলেন, কেনই বা তিনি আত্মহত্যা করলেন?
শাস্ত্রীমশাই বললেন, “ঘোর পাপ করেছিলেন। কর্ণ পিশাচিনীর সাধনা সাধারণত পঞ্চমুন্ডি আসনে বসে করতে হয়। তিনি তারাপীঠে গিয়ে পঞ্চমুন্ডি আসনে বসে কর্ণ পিশাচিনীর সাধনা করতেন। এই পঞ্চমুন্ডির আসন খুব ভয়ানক, সবাই এতে বসে সাধনা করার সাহস পায় না। চন্ডালের মাথা, বিষধর সাপের মাথা, শেয়ালের মাথা, হনুমানের মাথা আর অপঘাতে মৃত কোনও ব্যক্তির মাথা, এই পাঁচ মাথাকে শোধন করে মাটিতে পুঁতে তার ওপর বেদী করে এই পঞ্চমুন্ডির আসন প্রস্তুত করা হয়। কিন্তু উনি খুব সাহসী ছিলেন পঞ্চমুন্ডি আসনে বসে দিন রাত ধরে জপ করে গেছেন কর্ণ পিশাচিনী মন্ত্র,
‘ওমঃ হ্রীম কর্নপিশাচি মেম কর্নে,
কথায়া হুম ফাট্ স্বাহাঃ’
এবং তিনি কর্ণ পিশাচিনী সিদ্ধও হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তারপর ভয়ানক এক পাপ করে বসেন। নিজের কামকে নিজের আয়ত্তে রাখতে পারেননি। বাড়িতে কাজ করতে আসা এক নিচু জাতের বিধবা মেয়ের সাথে শারীরিক সম্পর্ক করেন। ওঁর ব্রহ্মচর্য নষ্ট হয়। আর এতে কর্ণ পিশাচিনী ওঁকে ভয়ঙ্কর শাপ দেন। যার ফলে উনি মস্তিস্ক বিকৃত হয়ে নিজেই নিজের গলায় ফাঁসি লাগিয়ে মারা যান। আর ওর আত্মা শাপিত হয়ে যায়। তিনি যে ঘরে ফাঁসি লাগিয়েছিলেন সেই ঘরেই মেয়েটি থাকত। তাই নবকৃষ্ণ মশায়ের অতৃপ্ত আত্মা মেয়েটির শরীর ব্যবহার করে তার বাসনা পূরণের জন্য। এর থেকে মেয়েটিকে মুক্ত করতে না পারলে ওর নিশ্চিত মৃত্যু হবে ও মৃত্যুর পর মেয়েটিও ভয়ঙ্কর পিশাচে পরিণত হবে।”
আমার বন্ধু তখন শাস্ত্রী মহাশয়ের পা ধরে আকুতি করল, “আপনি যেভাবেই হোক আমার নাতনিকে মুক্ত করুন, ওকে বাঁচান।”
শাস্ত্রী মশায় বললেন, “নিশ্চয়ই করা যাবে। তবে ওই ঘরে সম্ভব নয়। ওখানে প্রেতাত্মার শক্তি অনেক বেশি। আপনার নাতনিকে এখানে আনতে হবে। আমি এখানেই ওকে মুক্ত করব।”
ঠিক হল কালই এই কাজ হবে। এর জন্য আগে থেকে যজ্ঞের প্রস্তুতি নেওয়া হল। হোমের আহুতির জন্য এক ঝুড়ি শুকনো লঙ্কা, কিছু পাতিলেবু, এসব আরও নানা জিনিস আনা হল।
পরদিন যথা সময়ে অনিরুদ্ধানন্দ শাস্ত্রী মশায় চলে এলেন। আমি যজ্ঞের আয়োজনও সব করে ফেলেছিলাম। কিন্তু তখনই ফোন বেজে উঠল। আমার বন্ধু খুব ভয়ার্ত গলায় বলল, “নাতনি কেমন করছে। ওর কাছে কাউকে ঘেঁষতে দিচ্ছে না। ওকে আমরা কিছুতেই ধরতে পারছি না। ও বাড়ির মধ্যে লাফালাফি করছে। কখনও দেওয়ালে হাঁটছে। আমরা কী করব ভেবে পাচ্ছি না, তুই একবার এখানে আয়।”
ওর কথা শেষ হতে না হতেই ফোনটা কেটে গেল। আমি শাস্ত্রীমশাইকে সব বললাম। উনি বললেন, “আমাদের ওখানে এক্ষুনি যেতে হবে।”
আমরা যজ্ঞের সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে গাড়ি করে তৎক্ষণাৎ রওনা দিলাম।
গিয়ে দেখি বাড়ি ঘরের আসবাবপত্র সব ছড়ানো ছিটানো। আমার বন্ধু বিষণ্ণ মনে বসে আছে। মেয়েটির বাবা, মা ভয়ে কাঁদছে। মেয়েটি ছাদের একটা রেলিং ধরে ঝুলে আছে আর ভয়ানক হাসি হাসছে।
শাস্ত্রীমশাই প্রেতাত্মার উদ্দেশে জিজ্ঞেস করলেন, “কেন তুই মেয়েটির শরীরে আছিস? ওকে ছেড়ে দে ।”
মেয়েটির মধ্যে থাকা আত্মা তখন বিকট হাসি হেসে বলল, “যে কার্যের জন্য আমি শাপিত হয়েছি, আমি মেয়েটির শরীরকে সেই কাজে লাগাতে চাই। আমি ওকে সম্ভোগ করতে চাই। তোরা চলে যা। আমার খুব শক্তি, তোদের সবাইকে আমি মেরে ফেলব।”
শাস্ত্রী মহাশয় তন্ত্র সাধনা করে কিছু প্রেতকে নিজের বশে রেখেছিলেন, প্রয়োজন মত ওদের ব্যবহার করতেন। উনি ওদের দিয়ে নবকৃষ্ণ বাবুর প্রেতাত্মাকে ঘিরে রাখলেন এবং বার বার গায়ত্রী মন্ত্র জপ করে ঘরের চারিদিকে জলের ছিটা দিতে লাগলেন। এর ফলে কিছু সময়ের জন্য প্রেতাত্মা চলে গেল। মেয়েটি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। তখন শাস্ত্রী মশায় ওর মাথায় গঙ্গাজল ঢেলে দিলেন। তারপর বললেন, “এখানে কিছু করা যাবে না। মেয়েটিকে হনুমান মন্দিরে নিয়ে যেতে হবে। ওখানে প্রেত এর শক্তি অনেক কমে যাবে, ওকে কাবু করা সম্ভব হবে।”
মেয়েটিকে নিয়ে ওর বাবা, আমি আর শাস্ত্রী মশায় গাড়ি করে মন্দিরের উদ্দেশে রওনা দিলাম। কিন্তু পনের মিনিটের মধ্যেই আবার প্রেতাত্মা ফিরে এল। কি অমানুষিক শক্তি তখন মেয়েটির। ওর বাবাকে আঁচড়াতে লাগল, গাড়ির জানালার কাঁচে মাথা ঠুকতে লাগল। আমি হনুমান চাল্লিশা মন্ত্র আর শাস্ত্রীমশায় গায়ত্রী মন্ত্র আওড়াতে লাগলাম। কোনওক্রমে আমরা হনুমান মন্দিরে এলাম। ওখানে শাস্ত্রী মশায়ের কথায় বাকি পুরোহিত এবং সেবকরা মেয়েটিকে জাপটে ধরে মন্দিরে হনুমানের মূর্তির সামনে নিয়ে এল। স্থান মাহাত্মের জন্য মেয়েটির ওপর প্রেতের প্রভাব একটু কমেছে। ও চোখ বুজে চুপচাপ বসে রইল। এরপর শাস্ত্রী মশায় প্রেত শান্তি যজ্ঞ শুরু করলেন। শুকনো লংকা আগুনে আহুতি দিলেন। মন্ত্র পড়ে লেবু কেটে কেটে মেয়েটির ওপর ফেলতে লাগলেন।
এবার মেয়েটি রক্তাভ চোখে শাস্ত্রীর দিকে তাকালো। ভয়ানক আর্তনাদ করে বলল, “আমাকে ছেড়ে দে, ছেড়ে দে বলছি।”
শাস্ত্রীমশাই বললেন, “না, তুই এখানেই হনুমানের স্মরণে থাকবি। এখানেই এখন তুই বন্দি। যখন তোর সম্পূর্ণ শুদ্ধি ঘটবে তখনই তুই মুক্তি পাবি।”
এই বলে হোমে ঘন ঘন শুকনো লংকার আহুতি দিতে থাকলেন। মেয়েটি ছটপট করে চিৎকার করতে করতে চুপ হয়ে গেল। সবাই মিলে একসাথে বললাম, “জয় শ্রীরাম ভক্ত হনুমানের জয় ।”
এখন মেয়েটি সম্পুর্ন রূপে প্রেতাত্মা থেকে মুক্ত। শাস্ত্রী মশাই তার মাথায় হনুমানের সিঁদুর লাগিয়ে দিলেন আর হাতে বেঁধে দিলেন মন্ত্রপুত কবচ, যাতে ভবিষ্যতে আর কোনও দুষ্ট আত্মা তাকে কাবু না করতে পারে। মেয়েটি চোখ মেলল। ওকে খুব ক্লান্ত লাগছিল। ও জল চাইল। ওকে তখন জল আর হনুমানের প্রসাদ দেওয়া হল। ও পেটভরে খেল।
এই বলে দাদু থামলেন। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত এতক্ষণ শুনছিলাম। সত্যিই কী ভয়ানক।
দাদু বলল, “কী রে, বাড়ি যাবি না? “
আমি বললাম, “ইচ্ছে তো করছে সারারাত গল্প শুনতে, কিন্তু বাড়ি তো যেতেই হবে।”
দাদু হেসে পিঠ চাপড়ে বললেন, “আবার একদিন আসিস, আর একটা গল্প শোনাব।”
—— (সমাপ্ত)