কাহিনীর শেষে| পলক ফেলা নিষেধ | অনির্বাণ সরকার| Bengali Thriller Story
0 (0)

জোড়া মন্দির, টাকি – ৪ঠা এপ্রিল, ২০০৪

গল্পের শেষ অনুচ্ছেদ লেখা সম্পূর্ণ করে সুবিমলবাবু চায়ের পেয়ালাটা হাতে তুলে নিলেন। চা এখনও গরম আছে, ধোঁয়া উঠছে, তবে পেয়ালার ভিতরের পরিধিজুড়ে বুদ্‌বুদ্গুলি ক্রমশঃ মিলিয়ে যাচ্ছে।

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে তিনি পেয়ালায় চুমুক দিলেন। বাঃ, বেশ উপাদেয়! মনে একটা খুশী-খুশী ভাব নিয়ে ধীরপায়ে হেঁটে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন।

বাড়ির পুবদিকের এই বারান্দা থেকে সূর্যোদয় দেখা যায়। সবে ভোর হয়েছে, পাখির ঝাঁক দলে-দলে বেরিয়ে পড়েছে, আকাশে হালকা একটা আলোর ছাপ। তবে অলস মফস্বল শহরের ঘুম এখনও ভাঙেনি; রবিবারের সকাল একটু দেরীতেই হয় এখানে।

সুবিমলবাবুর চোখে ঘুম নেই। সারারাত জেগে লিখে গল্পটা সম্পূর্ণ করেছেন। এখন খানিক প্রসন্নচিত্তে ভোরের এই স্নিগ্ধ পরিবেশে গরম চায়ের আমেজ নিচ্ছেন।

বারান্দার বাইরে সামনের পেয়ারাগাছে একজোড়া চড়ুই রোজ সকালে এসে বসে কিচির-মিচির করতে থাকে। আজ এখনও ওদের আসবার সময় হয়নি। এই মুহূর্তে ওদেরকে একবার দেখতে ইচ্ছে করছে ওঁর। জানা নেই, আবার কবে দেখা হবে ওদের সাথে!

এই এলাকাটা বসবাসের পক্ষে খুব আরামদায়ক। নিরিবিলি, ফাঁকায় ফাঁকায় বাড়ি, খুব বেশী চওড়া না হলেও রাস্তাঘাট বাঁধানো, মাঝেমধ্যে একফালি করে মাঠ, একখানা বড় ঝিল। সবচেয়ে উঁচু বাড়িটা তিনতলা, হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট রমেন্দ্রনাথ ঘোষালের। এখনও অবধি হোটেল ব্যবসায়ীদের হাত পড়েনি এই অঞ্চলে; পড়লে এতদিনে ইছামতীর পাড়ের মত হোটেল-গেস্ট হাউজ়ের ছড়াছড়ি হয়ে যেত।

সুবিমলবাবুর পেশা কী, সেটা বলা ভারী কঠিন! ভদ্রলোক লেখালিখি করেন, তবে সাহিত্যচর্চায় তাঁর পেট চলে না। টাকির এই পৈতৃক বাড়ি, বংশ-পরম্পরায় পাওয়া যৎসামান্য সম্পত্তি আর যৌবনকালে স্বল্পবেতনের একটা অস্থায়ী চাকরি থেকে যেটুকু উপার্জন করেছেন, তা-ই দিয়েই কোনওমতে চলে যায়। এখন অবিশ্যি সবই তলানিতে ঠেকেছে, কপর্দকশূন্যপ্রায়।

কলেজে পড়ার সময় থেকেই তিনি সাহিত্যচর্চা আরম্ভ করেন। কিছু স্থানীয় পত্র-পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিতও হয়। এরপর বিভিন্ন সাহিত্যসভা ও কবি-সম্মেলনে অহরহ অংশগ্রহণ এবং লেখালিখিতেই পূর্ণ মনোনিবেশ করার ফলে তাঁর আর জীবনের বাকি দিকগুলোতে মনোযোগ দেওয়ার অবকাশ হয়নি। ফলস্বরূপ না তাঁর পড়াশুনা সম্পূর্ণ হয়েছে, না তিনি সংসার বা দীর্ঘমেয়াদি চাকরি-বাকরি করতে পেরেছেন।

লেখালিখিতেও যে তাঁর বিশেষ নাম হয়েছে, এমনটাও নয়। সাহিত্যিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সব চেষ্টাই জলে গেছে! নামকরা প্রকাশনা সংস্থাগুলি তাঁর গল্প-উপন্যাস ছাপতে নাকচ করে দিয়েছে বারবার। আর উঠতি বা অনামা প্রকাশনা সংস্থাগুলো টাকার বিনিময়ে ছাপার কথা জানিয়েছে। কিন্তু নিজের লেখা গল্প বা উপন্যাস পয়সা খরচ করে বই হিসেবে ছাপিয়ে প্রকাশ করার মত ক্ষমতা তাঁর নেই। সুতরাং, সুবিমলবাবুকে বাধ্য হয়েই নিজের যাবতীয় সাহিত্যকীর্তি বাক্সবন্দী করেই রাখতে হয়েছে এতদিন!

মাসতিনেক আগে হঠাৎই এক প্রকাশক তাঁকে লোক দিয়ে ডেকে পাঠান। বেশ বড় ও নামকরা প্রকাশনা সংস্থা, কাজেই তাদের ডাকে না যাওয়ার কোনও কারণ নেই। সুবিমলবাবু গিয়ে দেখা করলেন সেই প্রকাশকের সঙ্গে। জানা গেল, তাঁর লেখা কোনও একটি উপন্যাসের কাহিনী অবলম্বনে একটি সিনেমার গল্প তৈরী হবে।

এই প্রকাশকের কাছে তিনি আগেও এসেছিলেন তাঁর কয়েকটি উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি নিয়ে, কিন্তু তখন ভদ্রলোক সেগুলো ছাপতে রাজি হননি। এবারে সেই লোকই যে এমন প্রস্তাব দেবেন, সেটা সুবিমলবাবুর কাছে কল্পনারও অতীত ছিল!

মহানন্দে তাঁর সেই উপন্যাসের স্বত্ব বিক্রী করতে রাজি হয়ে গেলেন তিনি। তাঁর এতদিনের সাধনার ফল পেলেন বলে মনে হল, সেইসঙ্গে তিনি লেখক হিসেবে সুনাম অর্জনের স্বপ্ন দেখতে আরম্ভ করলেন। উপরন্তু সেই প্রকাশক তাঁকে আশ্বাসও দিলেন, সিনেমার কাজ সম্পন্ন হলে তিনি সুবিমলবাবুর লেখা ছাপাবেন।

একসপ্তাহ পরে সেই প্রকাশকের কাছে গিয়ে তাঁর উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি জমা দিয়ে এলেন। কথা রইল, সিনেমার কাহিনী তৈরী সম্পূর্ণ হলে সুবিমলবাবু তাঁর পারিশ্রমিক ও গল্পকার হিসেবে সাম্মানিক পাবেন। এই ঘটনার পর থেকে তিনি নতুন উদ্যমে লেখালিখি শুরু করে দিলেন।

ঘটনার মোড় ঘোরে গত শুক্রবার। সুবিমলবাবু অত্যন্ত আকস্মিকভাবে জানতে পারলেন, তাঁর লেখা উপন্যাসের কাহিনী অবলম্বনে যে সিনেমা তৈরী হচ্ছে, সেখানে লেখক হিসেবে তাঁর কোনও নামোল্লেখই নেই! তিনি তৎক্ষণাৎ ঘটনার সত্যতা যাচাই করার জন্য সেই প্রকাশকের দরজায় কড়া নাড়লেন। অবাক কাণ্ড, সেই প্রকাশক তখন তাঁর সঙ্গে এরকম কোনও চুক্তি হয়ইনি বলে দাবি করলেন; উলটে তিনি সুবিমলবাবুকেই মিথ্যে রটনা রটানোর দায়ে প্রবল ভর্ৎসনা করলেন!

এরপর সুবিমলবাবু দিশাহারার মত দোরে দোরে ঘুরলেন, চেনা-পরিচিত সকলকেই তাঁর সাথে হওয়া এরকম অন্যায় ও মিথ্যাচারের কথা জানাতে লাগলেন, এমনকি সেই সিনেমার পরিচালকের সাথে দেখা করে তাঁকেও ব্যাপারটা বললেন। কিন্তু তাঁর কথা কেউই বিশ্বাস করলেন না – যাঁর একটাও লেখা বই আকারে বের হয়নি, তাঁর গল্প নিয়ে হবে সিনেমা!

অপমান, তিরস্কার, বিশ্বাসভঙ্গের চরম হতাশা – এই তিনে মিলে সুবিমলবাবুর মননে চূড়ান্ত আঘাত হানল। অর্থ উপার্জন অবশ্যই একটি অন্যতম লক্ষ্য ছিল তাঁর, কিন্তু তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল লেখক হিসেবে স্বীকৃতি, দীর্ঘদিনের কাঙ্ক্ষিত সুনাম। এক দুর্বৃত্ত প্রকাশক ও এক দুর্নীতিপরায়ণ চিত্রপরিচালকের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে তিনি জীবনের প্রতি এতটাই বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠলেন যে, পরিশেষে নিজের অন্তিমের আবাহনই তাঁর কাছে একমাত্র পন্থা বাকি রইল!

গতকাল অবধি তাঁর সাথে হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ জানিয়ে সুবিচার চেয়ে অবশেষে বিফল হয়ে সুবিমলবাবু বহুদিন পর চোখের জল ফেললেন। স্বীকৃত সাহিত্যিক হওয়ার সব স্বপ্ন এবার ভেঙে চুরমার হয়ে গেল! জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যর্থতাই তো জুটেছে তাঁর ভাগে, তবে সেসবের জন্য বহুলাংশে তিনি নিজেই দায়ী। কিন্তু আজকের এই ব্যর্থতার দায় তো তাঁর নয়! আজ তিনি এক জঘন্য ষড়যন্ত্রের শিকার। কিছু অসচ্চরিত্র মানুষের মুখের কথা অন্ধভাবে বিশ্বাস করার ফল ভোগ করছেন। অথচ তিনি নিরুপায়, এই অবিচারের বিরুদ্ধে কিচ্ছু করার সামর্থ্য নেই তাঁর। বিগত ঐ শনিবারের সেই রঙিন বসন্তের শুষ্ক সন্ধেবেলাটি একজন হতভাগ্য অসহায় অক্ষম মানুষের নিজের ব্যর্থতার গ্লানিতে লজ্জাবনত হয়ে জীবনের কাছে শেষবারের মত হেরে যেতে দেখেছিল।

চরম সিদ্ধান্তটা তিনি গতকাল সন্ধেবেলায়ই নিয়ে ফেলেছেন। সেইমত ইঁদুর মারার বিষ কিনে এনেছিলেন বাড়ি ফেরার সময়। ঘরে এসে অনেকক্ষণ অন্ধকারের আশ্রয়ে মাথা নত করে বসেছিলেন, ভাগ্য আর ভগবানকে দোষারোপ করেছিলেন মনে মনে। শেষে তাঁর লেখার টেব্‌লে আলো জ্বালিয়ে বসে গত তিরিশ বছর ধরে তৈরী করা সন্তানের মত সযত্নে লালিত স্বরচিত পাণ্ডুলিপিগুলো হাতে নিয়ে একের পর এক চোখ বুলিয়ে গেছেন। এত কাহিনি, এত চরিত্র, এত ঘটনা – সব অনাদরে অসম্মানে অবহেলার অতল গহ্বরে পড়ে থাকবে?

একবার ভাবলেন, ওগুলোর অন্তিম সংস্কার করে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে ফেলবেন। পরক্ষণেই তাঁর মনে হল, ঐ লেখাগুলোর তো কোনও দোষ নেই, ওগুলো তো সত্যিই ওঁরই সন্তান!

অবশেষে তাঁর লেখকসত্তা সে-কাজে বাধা দিল। পাণ্ডুলিপিগুলোকে আবার তিনি তাঁর বাক্সে পুরে রাখলেন। চোখ থেকে দু’ফোঁটা জল ঝরে পড়ল টেব্‌লে রাখা তাঁর লেখার খাতাটার উপর। তৎক্ষণাৎ তাঁর দৃষ্টি গেল সদ্য শুরু করা নতুন একটি গল্পের অসম্পূর্ণ পাণ্ডুলিপির দিকে। সেটা দেখামাত্র তাঁর চোখদু’টো আনন্দে জ্বলজ্বল করে উঠল। বুক ভরে শ্বাস নিলেন, অনেকটা হালকা বোধ হচ্ছে তাঁর। সমস্ত দুঃখ-কষ্ট-গ্লানি মনের এক অচিন কোণে চেপে রেখে নতুন এক উদ্যম ফিরে পেলেন তিনি – অসম্পূর্ণ গল্পটা যে সম্পূর্ণ করতে হবে!

জীবনে হারানো-প্রাপ্তির হিসেবটা আপাতত স্থগিত রেখে চোখের জল মুছে আর সময় নষ্ট না করে সুবিমলবাবু লিখতে বসে গেলেন। মুখ্য নারীচরিত্রের জবানিতে এক ত্রিকোণ প্রেমের কাহিনী – “স্পন্দন”, যার পরতে পরতে রয়েছে ভালবাসার কথা। পাতার পর পাতা কলম চলল, আর তার সাথে ছন্দ মিলিয়ে যেন “স্পন্দন”-এর চরিত্ররা তাদের সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেতে লাগল! সেইসঙ্গে একজন ব্যর্থ মানুষ পরাস্ত হল এক স্বীকৃতিহীন সাহিত্যিকের কাছে।

গল্পের শেষ পর্যায়ে যেখানে ঘটনার সঙ্গে কাহিনীর চরিত্রদের উপলব্ধি সাঁকো বাঁধে, সে-পর্যন্ত লিখে সুবিমলবাবু খানিক বিরতি নিলেন। সারারাত না ঘুমিয়ে একটানা লিখেছেন, ফলে হাত ও পিঠ ব্যথা করছে! মনের উপর চাপটা খানিকটা লঘু হয়েছে। এখন ওঠার সময় হল।

ঘরে যেটুকু রসদ ছিল, তা-ই দিয়ে এক কাপ চা বানালেন সুবিমলবাবু। টেব্‌লে কাপটা রেখে বিষের শিশিটা খুলে পুরোটা ঢেলে দিলেন কাপে। তারপর এগোলেন গল্পের যবনিকার দিকে।

আকাশটা আজ বোধ হয় নতুন সূর্য নিয়ে সুন্দরভাবে সেজে উঠবে। ঝির্‌ঝিরে বাতাস গাছের পাতাদের নাড়িয়ে নবীন সবুজে আন্দোলিত করে বয়ে যাবে। পাখ-পাখালির দল নতুনভাবে আকাশের গাঙে ডানা মেলে দেবে। সাগরের উত্তাল ঢেউ আবার আছড়ে পড়বে শান্ত সৈকতে, নদী তার অববাহিকা জুড়ে বইতে থাকবে সময়ের সাথে সাথে। আবার মানুষজন পথে বেরোবে জীবনধারণের লক্ষ্যে, সূর্যাস্তের পর আবার সেই বাড়ি ফেরার তাড়া, ঘরে ফেরার গান। ফের শহরজুড়ে ঝলসে ওঠা নিয়নের আলোয় রাতের জ্যোতিষ্করা ম্লান হয়ে যাবে। আরেকটা দিন এভাবেই কেটে যাবে আরেক নতুন দিনের অপেক্ষায়।

এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে চিরকাল, কেবলমাত্র সুবিমলবাবুর জীবনে নামবে পূর্ণবিরতি! আরও বহু কাহিনী, আরও অনেক চরিত্র তাঁর লেখনীতে জন্মগ্রহণ করার ঈপ্সা নিয়ে আজীবন অন্তরালেই থেকে যাবে, পরিণতি পাবে না আর। ব্যর্থতা ও বিশ্বাসঘাতকতার বোঝা তিনি আর বহন করতে পারছেন না।

চা শেষ করে লেখার টেব্‌লে ফিরতেই সুবিমলবাবুর মাথাটা ঝিম্‌ঝিম্‌ করে উঠল। বিষের প্রভাব শুরু হয়ে গিয়েছে বুঝি! নিজের লেখা শেষ গল্পটা পুরোটা পড়লেন তিনি। তাঁর অন্যান্য লেখাগুলির মত এই লেখাতেও মানুষের সুখ-দুঃখ-আনন্দ-বেদনা বেশ ভালই ফুটে উঠেছে। সাহিত্যের গুণে এই গল্পটিকেও তিনি দশে দশ দিলেন, স্বগতোক্তি করলেন, ‘আমার লেখার কদর কেবল আমিই করতে পারি!’ তারপর ঐ গল্পের পাণ্ডুলিপিটাও সযত্নে তাঁর বাক্সে রেখে দিলেন।

ভীষণ অস্বস্তি অনুভব করছেন তিনি। গরম খুব একটা নেই, তবুও প্রচণ্ড ঘাম হচ্ছে তাঁর। ঘর থেকে বেরিয়ে আবার বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এসেছে, বুকের কাছটা চাপ ধরে আসছে, অল্প অল্প মাথা ঘুরছে। শরীরের সমস্ত পেশীগুলো শিথিল হয়ে গেছে।

কোনওরকমে চশমাটা খুলে ফেললেন চোখ থেকে। চারদিক আরও ঘোলাটে হয়ে এল! পা-দু’টো খুব ভারী হয়ে গেছে, শরীর ছেড়ে দিয়েছে, মুখে একটা গোঙানি। পেটের ভিতর থেকে গরম কী একটা তরল গলার কাছে এসে আটকে আছে। তা’হলে কি তাঁর মৃত্যু আসন্ন?

হঠাৎ নিজেকে নড়বড়ে মনে হল সুবিমলবাবুর! বারান্দার রেলিং ধরতে গিয়ে টাল সামলাতে না পেরে তিনি উপুড় হয়ে সেখানেই পড়ে গেলেন। মুখ থেকে ফিন্‌কি দিয়ে সেই তরল তাঁর গলা ঠেলে বেরিয়ে এসে বারান্দার মেঝেটা লাল করে দিল। দু’চোখে গাঢ় অন্ধকার ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে তাঁর ইন্দ্রিয়ের সমস্ত ক্ষমতা নিমেষে লোপ পেয়ে গেল। পরমুহূর্তেই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন।

বারান্দায় পড়ে থাকা সুবিমলবাবুর অসাড় মৃতদেহটির পানে তাকিয়ে পেয়ারাগাছের ডালে সবে এসে বসা চড়ুই পাখিদু’টি নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে কিচির-মিচির করতে লাগল।

জোড়া মন্দির, টাকি – ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০০৬

আজ মহালয়া। ঠিক ভোর পাঁচটায় দিগন্ত নিজের নতুন কেনা নোকিয়া-১১১০ মোবাইল ফোনে হেডফোনটা গুঁজে স্পীকারে রেডিও চালু করল। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের উদাত্ত কণ্ঠে “মহিষাসুরমর্দিনী” আরম্ভ হয়েছে। শরতের শিউলি-ফোটা ভোরে ইছামতীর ঝির্‌ঝিরে বাতাসে ঐ অনুষ্ঠানটি শোনা যেন এক মায়াবী অভিজ্ঞতা! কলকাতায় এ-জিনিস একেবারেই দুর্লভ।

আজ তার মনটা ভাল আছে। মাত্র দু’দিন হল সে এখানে এসেছে, এরই মধ্যে একটি নতুন উপন্যাসের কাহিনী ও চরিত্রবিন্যাস করে ফেলেছে সে! এখন সেটাকে লিখে খসড়া থেকে পাণ্ডুলিপিতে পরিণতি দেওয়া বাকি।

গত পরশু দিগন্ত যখন টাকি রোড স্টেশনে এসে নামল, তার মনটা ভীষণই খারাপ ছিল। দু’বছর আগে বই-আকারে তার প্রথম উপন্যাস “শরণ্যা” তার বাবার প্রকাশনা সংস্থা “রীড” থেকে প্রকাশিত হওয়ার মাসখানেকের মধ্যেই শহুরে পাঠকমহলে দুর্দান্ত সাড়া ফেলে দিয়েছিল। সেই উপন্যাসের কাহিনী নিয়ে বাংলায় একটি সিনেমাও তৈরী হয়, যা কিনা আবার সুপারহিট হয়েছে! অল্প কিছুদিনের মধ্যে সে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিল। সাহিত্যিকের সুনাম, পুরস্কারের শিরোপা, অভিনন্দনের বন্যায় সবকিছু যেন স্বপ্নের মতই লাগছিল তার।

হঠাৎই স্বপ্নভঙ্গ হল; সে আবিষ্কার করল, তার লেখনীতে আর কোনও সুসংহত কাহিনী রচিত হচ্ছে না! যা-কিছু সে লিখছে, সবই অপাংক্তেয়, তার নিজেরই মনঃপুত হচ্ছে না। সে বুঝল, নতুন লেখাগুলো ছাপা হলেও “শরণ্যা”-তে পাঠকমহলের যে প্রত্যাশা তৈরী হয়েছে, সেগুলোর কোনওটাই তা পূরণ করতে পারবে না।

এরপর বহু দেশী-বিদেশী গল্প-উপন্যাস, খবরের কাগজের খুঁটিনাটি, এমনকি বিভিন্ন ছায়াছবির কাহিনীও তাকে কোনওভাবেই সাহায্য করতে পারল না! দু’তিনটে গল্পের প্লট নিয়ে সে লেখা আরম্ভ করেছিল বটে, কিন্তু খুব একটা এগোতে পারেনি। এদিকে আরও অন্যান্য প্রকাশনা সংস্থাগুলি ক্রমাগত তার কাছে লেখা চাইতে লাগল। ফলে তার মনের উপর চাপ আরও বেড়ে গেল। ‘দিচ্ছি’ ‘দেব’ করে করে এতদিন কোনওমতে সে প্রকাশকদের শান্ত করে রেখেছিল। কিন্তু এতে সে দেখল যে তার খ্যাতির বিচ্যুতি ঘটছে, বাজারে রটছে, ‘দিগন্ত দেবনাথ এক উপন্যাসের সাহিত্যিক – “ওয়ান টাইম ওয়ান্ডার”।’ কিংবা, ‘একটি বই বেরতেই এত অহঙ্কার!’

ধীরে ধীরে হতাশা গ্রাস করতে লাগল দিগন্তকে। এক মনোবিদ চিকিৎসক বন্ধুর শরণাপন্ন হল সে, জানতে পারল, তার লেখক-প্রতিবন্ধকতা অর্থাৎ “রাইটার্স্‌ ব্লক” চলছে! তারই পরামর্শে অবশেষে সেই প্রতিবন্ধকতা থেকে মুক্তি পাওয়ার উদ্দেশ্যে সে কলকাতার কোলাহল ও চাহিদার থেকে দূরে নিরিবিলি এই টাকি শহরে চলে এল।

দিগন্ত টাকির এই বাড়িটার সন্ধান পেয়েছিল ঐ মনোবিদ চিকিৎসক বন্ধুর কাছেই। শহুরে হৈ-হট্টগোল থেকে যোজন দূরে ইছামতী নদীর পাড়ে নিরালা পরিবেশে ছিমছাম এই বাড়িখানা একবার দেখেই তার ভাল লেগে গিয়েছিল। দু’টো বড় বড় ঘর, একটা রান্নাঘর আর একটা বৈঠকখানা-মত আছে। বৈঠকখানার সামনে রয়েছে একফালি বারান্দা। বারান্দার একপ্রান্তে একটা ছোট বাথরুম, তাতে ভারতীয় প্রণালীর শৌচাগার। বাড়িটির অবস্থা বেশ ভালই, পরিচর্যা হয় বোঝা গেল। অবিন্যস্ত গাছ-গাছালিতে ঘেরা একতলা পাকা বাড়িটার অনাড়ম্বর বহিরাবরণ ও মানানসই অন্দরমহল যথার্থই শান্তমনে নির্বিঘ্নে লেখালিখি করার জন্য আদর্শ।

বাড়ির বর্তমান মালিকানা রয়েছে টাকি সম্মিলনী ক্লাবের হাতে, যার সেক্রেটারি রঘুনাথ হালদার অতি সজ্জন ব্যক্তি। দিগন্ত তিনমাস এই বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকবে শুনে তিনি যারপরনাই আনন্দিত – ‘আপনার মত স্বনামধন্য মানুষের পায়ের ধুলো এ-মাটিতে পড়ল, এ যে আমাদের পরম সৌভাগ্য! আপনার কাহিনী অবলম্বনে তৈরী সিনেমাটিও আমার দেখা। দারুণ গল্প, কি অসাধারণ পারফরম্যান্স্‌ প্রত্যেক আর্টিস্টের, যেন বইয়ের পাতা থেকেই উঠে এসেছে সিনেমার পর্দায়!’

গর্ববোধ হল দিগন্তের; তার কাহিনী কতদূর অবধি প্রভাব বিস্তার করেছে! এরপর এ-কথা সে-কথার মধ্য দিয়ে সে জানতে পারল, এই বাড়িটা ছিল সুবিমল অধিকারী নামে স্থানীয় এক ব্যক্তির। তিনিও নাকি লেখক ছিলেন, প্রতিবছর তাঁর লেখা ‘আরোহণ’, ‘সামাজিক’ ইত্যাদি স্থানীয় লিট্‌ল ম্যাগাজ়িনে বেরত। এছাড়াও তাঁর কয়েকটি ছোটগল্প ‘শুকতারা’ ও ‘আনন্দমেলা’-র শারদীয়া সংখ্যাতেও প্রকাশিত হয়েছিল।

‘কিন্তু ভদ্রলোক সাহিত্যিক হিসেবে প্রাপ্য খ্যাতিটুকু পেলেন না জীবনে,’ হতাশ গলায় বললেন রঘুনাথবাবু, ‘কেন জানি না, কোনও প্রকাশনা সংস্থা তাঁর উপন্যাস বই হিসেবে ছাপতে রাজি হয়নি! অথচ আমরা যারা এখানকার পঠন-পাঠন সমিতির সঙ্গে যুক্ত আছি, ওঁর লেখা পড়েছি, যথেষ্ট ভাল লিখতেন সুবিমলদা। ভাগ্যের ফেরে ক্রমাগত আশাহত হতে হতে শেষমেশ সুইসাইডই করে বসলেন তিনি!’

‘সুইসাইড! বলেন কী?’ দিগন্তের কণ্ঠে বিস্ময়।

‘আজ্ঞে,’ দুঃখিতভাবে বললেন রঘুনাথবাবু, ‘এই বাড়ির বারান্দায় বিষ খেয়ে মরে পড়েছিলেন। শেষে আমরাই ক্লাবের পক্ষ থেকে সুবিমলদার মরদেহ শ্মশানে নিয়ে গিয়ে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করি।’

দিগন্ত একদৃষ্টে বারান্দার মেঝের দিকে তাকিয়েছিল কিছুক্ষণ। অবশেষে রঘুনাথবাবুর কথায় তার সম্বিত ফিরেছিল। ভদ্রলোক তাকে বাড়ির চাবি হাতে তুলে দিয়ে এক-এক করে সব বুঝিয়ে দিতে লাগলেন। সুবিমল অধিকারীর ব্যবহৃত আসবাবপত্রগুলোই সে ব্যবহার করতে পারবে, তাতে কোনও অসুবিধা নেই। এছাড়াও বাজার ও রান্নাবান্না, বাড়িঘর পরিষ্কার, জামাকাপড় ধোয়া-কাচা – এসবের জন্য একজন ঠিকে কাজের লোক রয়েছে। সে সারাদিন থেকে কাজকর্ম সেরে বিকেলে চলে যাবে।

এতদূর ট্রেন-জার্নির ধকল, দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করে খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিল দিগন্ত। বিকেলের দিকে সে তার লেখার খাতা নিয়ে বসল। একটা সাসপেন্স্‌ থ্রিলার লেখা শুরু করেছিল, সেটারই প্লট নিয়ে নানা ভাঙাগড়া চলছিল তার মাথায়। এবারে সে গল্পটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা শুরু করল। এরপর তার পরিকল্পনায় রয়েছে একখানা প্রেমের গল্প এবং একটি গোয়েন্দা-কাহিনী। সবগুলো গল্পই প্রাথমিক পর্যায়ে লেখা আরম্ভ করেছিল সে কলকাতাতে বসেই, এমনকি মুখ্য চরিত্রগুলির অবয়বও তৈরী করে ফেলেছিল, কেবল মূল ভাবনাগুলো স্বচ্ছভাবে তার মাথায় আসছিল না। আর সেজন্যেই সে আরও বেশী হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। তবে এবারে সে মনস্থির করে এসেছে, গল্পগুলো এখানেই লিখে সম্পূর্ণ করে তারপর কলকাতায় ফিরবে সে।

বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টা করা সত্ত্বেও কিছু অসমঞ্জস বাক্য ছাড়া আর কিছুই লিখতে পারল না দিগন্ত। মাথার ভিতর সমস্ত চিন্তাভাবনা এলোমেলোভাবে ঘুরপাক খাচ্ছে, কোনওভাবেই সেগুলো সারিবদ্ধ হতে চাইছে না! এ তো মহা মুশকিলে পড়া গেল! তবে কি তার “রাইটার্স্‌ ব্লক” চিরস্থায়ী হয়ে গেল?

ঘর ছেড়ে বারান্দায় এসে একটা সিগারেট ধরাল সে। ধোঁয়াটা ভীষণ স্নিগ্ধ লাগছে তার। বায়বীয় পথে সেই ধোঁয়া বারান্দার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে গলে সামনের পেয়ারাগাছটায় গিয়ে মিলিয়ে গেল। বাগানের বিভিন্ন গাছের আড়াল থেকে নানারকম পাখির দল ঝাঁক বেঁধে শব্দ করতে করতে উড়ে চলে গেল। গাছের পাতার বিচ্ছিন্নতার মধ্যে দিয়ে আকাশটা দেখা যাচ্ছে। সূর্যাস্ত হতে বেশী দেরী নেই। আকাশে ভেসে চলা পেঁজাতুলোর মত মেঘগুলোর ফাঁকফোকর দিয়ে সোনালী রোদ বিক্ষিপ্তভাবে ঠিকরে বেরচ্ছে। ইছামতীর মৃদু হাওয়া শরৎকালের এই বিকেলে এমন পরিবেশকে মনোমুগ্ধকর করে তুলছে।

এমন সময় ঘরের ভিতর থেকে খট্‌ করে একটা ধাতব শব্দ কানে এল দিগন্তের। সঙ্গে সঙ্গে সে ঘুরে তাকাল ঘরের ভিতরে। কাজের লোক চলে গেছে, সারা বাড়িতে সে এখন একা!

হাতের জ্বলন্ত সিগারেটে শেষ টান দিয়ে বাগানের দিকে ছুঁড়ে ফেলে সে ঘরের ভিতরে এসে দাঁড়াল। যৎসামান্য আসবাব – একটা তক্তপোষ আর একসেট চেয়ার-টেব্‌ল। তক্তপোষে তার বিছানাপত্র, আর টেব্‌লের উপর তার লেখার খাতা ও সংসদ বাংলা অভিধান। গোটা ঘর ফাঁকা। তা’হলে শব্দ কীসের? ঘরে সাপ কিংবা ইঁদুর-টিদুর নেই তো? নাকি, চোর ঢুকেছে এ-বাড়িতে?

শেষেরটা একেবারেই অসম্ভব, কারণ লোকাল ক্লাবের তত্ত্বাবধানে থাকে এই বাড়ি। আর, বাড়ির যা যত্ন হয় বলে মনে হয়, এখানে ইঁদুরের উৎপাত না হওয়ারই কথা। তাছাড়া এই বাড়ির রান্নাঘরে খাদ্যের রসদের আমদানী আজই তার সাথেই হয়েছে। তবে চারিপাশের জঙ্গলের ঘনত্ব দেখে সাপ-খোপের উপদ্রবের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

দিগন্ত সবগুলো ঘরের আনাচে-কানাচে ভাল করে দেখে নিল কোথাও কিছু আছে কিনা। সবই তো পরিষ্কার, তা’হলে ঐ ধাতব শব্দের উৎস কী? তার মনের ভুল নয় তো?

লেখার ঘরে ফিরে এল সে। শব্দটাকে শোনার ভুল মনে করে আবার লিখতে বসবে, ঠিক তক্ষুনি তার চোখে পড়ল দরজার মাথার সমান উচ্চতায় একটা কাঠের তাক, তাতে বেশকিছু জিনিসপত্র কাপড় মুড়ে ঢাকা আছে। এ-জিনিস তার কাছে নতুন নয়, কলকাতায় তাদের নিজেদের বাড়িতেও এরকম তাক রয়েছে। সেখানে পুরনো স্যুটকেস, অব্যবহার্য ব্যাগপত্র, রদ্দি কাগজ, টিনের বাক্সে চাল, মুড়ি, ইত্যাদি রাখা হয়।

দিগন্ত কিছুক্ষণ স্থিরদৃষ্টিতে সেই তাকের দিকে তাকিয়ে রইল। শুধুমাত্র একটা কাঠের বাক্সের এককোণা উঁকি দিচ্ছে কাপড়ের ফাঁক দিয়ে, আর বাদবাকি জিনিস কাপড়ে ঢাকা থাকায় সেগুলো কী বোঝা যাচ্ছে না। তাকে রাখা ঐ জিনিসগুলোর স্তূপ দিগন্তকে যেন প্রবলভাবে আকর্ষণ করছে! অদম্য এক কৌতূহল অনুভব করছে সে, যার তাড়নায় তার মন চাইছে কাপড় সরিয়ে সেই জিনিসগুলো তাক থেকে নামিয়ে এনে দেখতে।

অবশেষে নিজেকে আর প্রতিহত করে রাখতে পারল না সে। চেয়ার টেনে এনে তার উপরে দাঁড়িয়ে তাকের ঐ ঢাকনা কাপড়খানি একটানে সরিয়ে মেঝেতে ফেলে দিল। একগাদা ময়লা ধুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গিয়ে উড়ে এসে লাগল তার চোখে-মুখে। ধুলো ঝেড়ে নিয়ে সে আবার দেখল তাকটিতে। টিনের তৈরী কিছু বাক্স-প্যাঁটরা, কিছু পুরনো বাসনপত্র, একখানা টেব্‌ল ফ্যান, আর একটা কাঠের বাক্স – সবই আপাতদৃষ্টিতে অতিসামান্য ও গৌণ। টিনের বাক্সগুলি খালি, তবে ওজন দেখে মনে হল, কাঠের বাক্সটিতে বোধ হয় কিছু আছে।

অন্য জিনিসগুলোকে যথাস্থানে রেখে আবার আগের মত কাপড়ে ঢেকে দিয়ে দিগন্ত এবার সেই কাঠের বাক্সটিকে তার লেখার টেব্‌লে রেখে ভাল করে পর্যবেক্ষণ করল। দৈর্ঘ্যে ফুটদেড়েক, প্রস্থে ও উচ্চতায় একফুট, কোনওরকম কারুকার্যবিহীন এক সাধারণ কাঠের বাক্স। বাক্সের ঢাকনার মাঝামাঝি অংশে একটি আংটা ও হুক থেকে ছোট্ট একটা তালা ঝুলছে। মরচে ধরা তালাটা ধরে একটু এদিক-ওদিক ঝাঁকিয়ে ছেড়ে দিতেই সেটা আংটায় গিয়ে বারি খেয়ে সেই ধাতব শব্দ উৎপন্ন করল।

দিগন্তের কৌতূহল চরম সীমায় পৌঁছে গেছে। বাক্সটা খুলে দেখতেই হবে, ওতে কী আছে! এ-তালার চাবি খুঁজতে বসা বৃথা, সুতরাং ঘরের দরজার বড় তালাটা দিয়ে দু’একবার সজোরে আঘাত করতেই বাক্সের তালাটা খটাস্‌ করে খুলে গেল। ঢাকনা খুলতেই পুরনো কাগজের গন্ধ ভেসে এল তার নাকে, সেইসঙ্গে চোখে পড়ল লম্বা বাঁধানো খাতায় ঝক্‌ঝকে সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা একটি পাণ্ডুলিপি – সুবিমল অধিকারী রচিত কাহিনী “স্পন্দন”! শুধু সেটাই নয়, একের-পর এক গল্পের খাতা যেন সেই কাঠের বাক্স উপচে বেরিয়ে আসতে লাগল!

টেব্‌লের উপর পাণ্ডুলিপির খাতাগুলি সাজিয়ে রাখল সে। সবশুদ্ধ বত্রিশটা খাতা, তারমধ্যে না-জানি কত কাহিনীর পাণ্ডুলিপি লুকিয়ে রয়েছে! দিগন্ত ফাঁকে ফাঁকে কোনও-কোনও লেখার কয়েকটি অনুচ্ছেদ পড়ে দেখেছে; রঘুনাথবাবু ভুল বলেননি, সুবিমল অধিকারীর লেখার গুণগত মান বেশ ভাল ছিল। এমন লেখক মর্যাদা পায় না এদেশে, কী দুর্ভাগ্য!

সব খাতা সাজানো হয়ে গেলে এবার দিগন্ত লেখার তারিখ অনুযায়ী পাণ্ডুলিপিগুলি একে-একে পড়তে আরম্ভ করল। সবচেয়ে পুরনো যে লেখাটি এখানে পাওয়া যাচ্ছে, সেটার রচনাকাল ১৯৮৭ সালের নভেম্বর মাস। গল্পের নাম “প্লাবিত মরু”, এক জনবহুল শহরে বন্যা হওয়ার পর সেখানকার মানুষজনের জীবনের কাহিনী। এর পরের উপন্যাসটি লেখা হয়েছে ১৯৮৯-এর মার্চে, ইছামতীতে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে চোরাকারবারের প্রেক্ষাপটে কাহিনী “সলিল-সমাধি”। দু’টি লেখাই অনবদ্য। এছাড়াও আরও যেসব লেখা রয়েছে খাতাগুলিতে, সবেতেই কাহিনীর নতুনত্বের ছাপ যেমন স্পষ্ট, তেমনই সাহিত্যের বিচারেও সেগুলো যথেষ্ট সমৃদ্ধ।

সেদিন ভোররাত অবধি একটানা বসে সুবিমল অধিকারীর লেখাগুলি পড়েছিল সে। এত সুন্দর কাহিনীবিন্যাস, চরিত্র-চিত্রায়ণ ও বিষয়-উপস্থাপন সত্যিই প্রশংসা ও বহুল প্রচারের দাবি রাখে! উপরন্তু ঐ কাহিনীগুলো বুঝি তার লেখনীকেও অনুপ্রাণিত ও উদ্দীপিত করেছিল। কারণ পরদিন সকালেই সে রাতজাগা চোখে লিখতে শুরু করেছে তার নতুন উপন্যাস, আধুনিক সমাজের পটভূমিকায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দশম অবতার কল্কির আবির্ভাব ও ধর্মের পুনঃস্থাপনের গল্প – “সম্ভবামি যুগে যুগে”।

মহালয়ার পুণ্যপ্রভাতে দিগন্তের অন্তরের লেখকসত্তা কাহিনী গড়ার এক নতুন সূচনা করল।

যাদবপুর, কলকাতা – ১লা জুলাই, ২০২০

প্রায় মাসতিনেকের লকডাউন শেষে আজ থেকে জনজীবন আবার ছন্দে ফিরতে শুরু করেছে। সারা পৃথিবী করোনা ভাইরাসের মারণ ছোঁয়াচে আগ্রাসনের কবলে। বিগত মাত্র ছ’-সাত মাসের মধ্যেই সেই অতিমারী কেড়ে নিয়েছে বহু প্রাণ! সেই রোগ ছড়ানোর শৃঙ্খল ভাঙার জন্যেই ছিল লকডাউন – অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা ব্যতীত সমস্ত রকম জমায়েত, ব্যবসা-বাণিজ্য, যানবাহন, শিক্ষাপ্রাঙ্গণ, খেলাধূলা ইত্যাদি বন্ধ।

সকাল থেকেই ঝির্‌ঝিরে বৃষ্টি পড়ছে। আকাশে ভারী মেঘ জমেছে। চারদিক বাতাসে ভাসমান জলীয় বাষ্পে ঈষৎ ঝাপসা। বৃষ্টির সঙ্গে হালকা ঝড়ো হাওয়াও বইছে। বিকেলের পর অল্পক্ষণের জন্য ঝলমলে রোদ উঠে গোটা আকাশজুড়ে রামধনু তৈরী করেছিল। তারপরই হঠাৎ কী খেয়াল হতেই আবার সেই অস্তাচলের সূর্য মেঘের আড়ালে লুকিয়ে পড়েছে!

দিগন্ত তার বাড়ির দোতলায় দক্ষিণ-পূর্ব কোণে তার লেখার ঘরে পাতা একটা ডিভানের উপর একটি কুশ্যনে বাঁ কনুইয়ে ভর করে হেলান দিয়ে শুয়ে তারই লেখা সদ্য প্রকাশিত নতুন একটি উপন্যাস পড়ছিল। গতকাল সন্ধেবেলা “রীড”-এর এডিটোরিয়াল টীম তার কাছে বইটার প্রথম মুদ্রিত সংস্করণ পাঠিয়েছে। কুড়িখানা অথর্স কপি, প্রচ্ছদ, প্রিন্টিং ও বাইন্ডিং দারুণ করেছে এবার! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “কর্ণকুন্তীসংবাদ” এবং “ব্রাহ্মণ” কবিতা দু’টিকে সংযুক্ত করে বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে কর্ণ ও সত্যকামের যৌথ কাহিনী নিয়ে লেখা তার এই উপন্যাসটির সে নাম দিয়েছে “অভিসম্পাত”। গত পরশুই রবীন্দ্রসদনে বিশিষ্ট সাহিত্যিকদের উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে বইটি।

এই নিয়ে দিগন্তের এটা সাতাশতম উপন্যাস। আজ সে একজন আন্তর্জাতিক স্তরের খ্যাতিমান লেখক, বহু সিনেমার গল্পকার, অজস্র মানুষের অন্যতম প্রিয় সাহিত্যিক। জীবনের প্রথম উপন্যাস “শরণ্যা” যখন প্রকাশ পায়, তখনও সে এধরনের খ্যাতির আস্বাদ পেয়েছিল। কিন্তু তারপর ক্রমাগত দু’বছর তার আর কোনও লেখা পাঠক-পাঠিকাদের মন জয় করতে পারেনি। ধীরে ধীরে সে সকলের বিস্মৃতির আড়ালে তলিয়ে যাচ্ছিল।

সেসময় চরম হতাশার কবল থেকে মুক্তি পেতে সে সবকিছু ছেড়ে এই শহর থেকে অনেক দূরে ইছামতী নদীর তীরে টাকিতে গিয়ে মাসতিনেক কাটিয়ে এসেছিল। সেখানকার মুক্ত পরিবেশের গুণেই হয়ত অবশেষে সে ফিরে পেয়েছিল লেখার ছন্দ। প্রায় চোদ্দ বছর আগে মহালয়ার ভোরে যে নতুন কাহিনী-রচনা সে আরম্ভ করে, ইছামতীর জলে দুর্গাপ্রতিমার বিসর্জনের সাথেই তার মনের সব হতাশাও দূর হয়ে যায় সে-কাহিনীর হাত ধরে।

সেবছর শীতেই প্রকাশিত হয় সেই উপন্যাস – “সম্ভবামি যুগে যুগে”। এরপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি দিগন্তকে, তার কলমে একের-পর এক রচিত হয়েছে কালজয়ী সব উপন্যাস। প্রত্যেকটি “বেস্ট-সেলার”। কয়েক লক্ষ টাকার রয়্যালটি উপার্জনের সাথে সাথে সাহিত্যজগতে জ্যোতিষ্মান নক্ষত্রের যশোলাভ, সোশ্যাল মিডিয়ায় অপরিসীম ফ্যান-ফলোয়িং এবং একাডেমি অ্যাওয়ার্ড দিগন্ত দেবনাথের নাম স্বর্ণাক্ষরে গ্রোথিত করেছে!

প্রসিদ্ধির সঙ্গে কিছু আবশ্যিক প্রতিবন্ধকতাও আসে। সে যখন-তখন যেখানে-সেখানে যেতে পারে না, রাস্তার ধারে গাড়ি থামিয়ে ভাঁড়ের চা খেতে পারে না, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে জমিয়ে আড্ডা দেওয়াও হয় না বহুদিন! লেখার ক্রমাগত প্রগতির বাধ্যবাধকতা ছাড়াও প্রকাশকদের চাহিদা মেটানোর দায়ে ইচ্ছে থাকলেও অনেক জায়গায় যেতে পারে না সে, আবার অনিচ্ছা সত্ত্বেও কোথাও কোথাও যেতেই হয় তাকে। এসবের প্রণেতা তথা পৃষ্ঠপোষক অবিশ্যি তারই বাবা অনন্ত দেবনাথ, “রীড”-এর কর্ণধার। তার অধিকাংশ উপন্যাসই তো “রীড” থেকেই ছেপে বেরিয়েছে।

আজ সন্ধ্যায় ‘আলাপন’ নামক একটি পত্রিকা থেকে এক সাংবাদিকের আসার কথা আছে দিগন্তের সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য। ঐ পত্রিকাটির পয়লা বৈশাখ সংখ্যায় তার একটি ছোট গল্প প্রকাশিত হয়েছিল, যার জন্য সে সরকারের পক্ষ থেকে সামাজিক বিষয়ে বছরের শ্রেষ্ঠ লেখক মনোনীত হয়েছে। লকডাউনে তার জনসমক্ষে আসাটা বন্ধ ছিল। সেজন্য এই ইন্টারভিউটা পিছতে পিছতে এতদিনে আজকের সন্ধ্যায় নির্ধারিত হয়েছে।

গল্পের মাঝামাঝি অবধি পড়ে বইটা উলটে রেখে দিয়ে দিগন্ত ডিভান ছেড়ে উঠে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল। অন্ধকার নেমেছে, রাস্তার বাতিগুলি সেই অন্ধকারের সঙ্গে লড়াই করে জিতে চারিদিক আলোকিত করে দিয়েছে! বৃষ্টি থেমে গেছে। জমজমাট রাস্তা মানুষজন-গাড়িঘোড়া-দোকানপাটের সম্মিলিত কোলাহলে মুখরিত। অথচ এই রাস্তাই মাত্র একদিন আগে পর্যন্ত যেন শ্মশানের স্তব্ধতায় মৌনব্রত ধারণ করেছিল!

বাড়ির কম্পাউন্ডের মেইন গেটে সিকিউরিটি একটি অচেনা লোকের জামাকাপড়-ব্যাগপত্র চেক করছে। এই বুঝি সেই সাংবাদিক এল! সিকিউরিটি-চেক শেষ হলে লোকটি একতলার সদর দরজার দিকে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই একবার উপরে ব্যালকনির দিকে তাকাল। মুখে মাস্ক থাকায় চেহারাটা বোঝা গেল না, তবে চোখদু’টো মনে হল যেন বেশ উজ্জ্বল।

বহুদিন পর ইন্টারভিউ দেবে বলে দিগন্ত আজ জিন্সের প্যান্টের সাথে সুতির ফুলশার্ট পরেছে, বুকপকেটে গুঁজে রেখেছে তার প্রিয় সোনালী কলম, চোখে পরেছে রিমলেস্‌ চশমা, যেটা সে বিশেষ উপলক্ষ্যেই পরে থাকে। অনভ্যাসে তার বুকটা খানিক দুরু-দুরু করছিল দুপুর নাগাদ, পরে অবশ্য সেটা ঠিকও হয়ে যায়; এখন সে ইন্টারভিউ-এর জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত।

খানিকক্ষণ পর তার সেক্রেটারি সুপ্রিয় এসে খবর দিল, ‘আলাপন’ পত্রিকা থেকে সাংবাদিক রাণা মিত্র এসেছেন দিগন্তের সাক্ষাৎকার নিতে। ‘পাঠিয়ে দাও,’ বলল দিগন্ত, ‘আর তুমি আজ বাড়ি চলে যেতে পার। কাল সকালে এসে যেও সময়মত, কেমন? কাল একটু ন্যাশনাল লাইব্রেরী যাব একটা গল্পের প্লটের ব্যাপারে।’

সুপ্রিয় মাথা নেড়ে চলে গেল।

‘রাণা মিত্র’ নামটা কেমন যেন চেনা-চেনা লাগল দিগন্তের। খুব কমন নাম হলেও মনের গহিনে কোথাও বুঝি নামটা লুকিয়ে রয়েছে!

তার মনের সংশয় স্মৃতির মণিকোঠায় বিচরণ করবার ফাঁকেই দরজায় এসে দাঁড়াল এক দীর্ঘদেহী মাঝবয়সী ভদ্রলোক। পরনে ডেনিম ব্লু জিন্সের জামা-প্যান্ট, মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুল, মাস্কের আড়ালেও চাপদাড়ির অস্তিত্ব স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। চোখের দৃষ্টি অন্তর্ভেদী, যেন তাকিয়েই মনের সব কথা বুঝে ফেলবে!

‘নমস্কার, আমি রাণা মিত্র, ‘আলাপন’ থেকে আসছি,’ গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বরে ব্যক্তিত্ব ফুটে বেরচ্ছে, ‘আপনার সঙ্গে ইন্টারভিউ-এর অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।’

দিগন্ত স্বাগতমের ভঙ্গিতে বলল, ‘নমস্কার। ভিতরে আসুন।’

একতলার সদর দরজা দিয়ে ঢুকেই বাঁদিকে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। তারপর বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে দিগন্তের অফিস; সেখানে জনাদশেক ছেলে-মেয়ে তার হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি থেকে কম্পিউটারে টাইপ করে সেগুলোর সফ্‌ট ভার্শান বানায়। তবে লকডাউনের প্রভাবে এখনও সে-অফিস বন্ধ।

দোতলায় সিঁড়ি পেরিয়ে বাড়ির মূল অন্দরমহল – একপাশে দিগন্তের শোবার ঘর, অন্যপাশে অনন্তবাবুর, মাঝের জায়গাটা ড্রইং-কাম-লিভিং-কাম-ডাইনিং স্পেস, তার একধারে রান্নাঘর। সিঁড়ির এপাশে তার লেখার ঘর ও লাগোয়া ব্যালকনি। বাড়িতে ঠিকে কাজের লোক বলতে খোকন, সারাদিন থেকে কাজ সেরে সন্ধের পর চলে যায়। এছাড়াও রাঁধুনি-মালী-সিকিউরিটি গার্ড নিয়ে আরও গোটা পাঁচেক কাজের লোক আছে তাদের। আর, অনন্তবাবুর প্রকাশনা সংস্থা “রীড” থেকে আকছার লোকজনের আসা-যাওয়া লেগেই থাকে এ-বাড়িতে।

রাণা মিত্র ঘরে ঢুকে প্রথমেই পকেট থেকে একটি স্যানিটাইজ়ারের শিশি বার করে তা থেকে অল্প একটু স্যানিটাইজ়ার হাতে নিয়ে দু’হাত ভাল করে ঘষে নিল। হাস্যকণ্ঠে বলল, ‘কোভিড প্রোটোকল!’

‘আমি আবার ঐসব প্রোটোকল মানতে পারব না,’ হাসিমুখেই অথচ বিরক্তির সাথে বলল দিগন্ত, ‘মাস্ক পরলে দমবন্ধ হয়ে আসে। তবে হাত আমার ধোয়া, আর এ-বাড়িও ফুললি স্যানিটাইজ়ড।’

দিগন্ত তার ডিভানে বসেই ইন্টারভিউ দেবে, আর রাণা বসল কিছুটা তফাতে রাখা একটা কাঠের চেয়ারে।

খোকন এইসময় এসে চা-টিফিন দিয়ে বাড়ি চলে গেল। খাওয়ার ফাঁকে টুকটাক ওদের কথোপকথন চলতে থাকল। জানা গেল, রাণা থাকে বেলেঘাটায়, বাবা-মা ও ভাইকে নিয়ে তাদের মধ্যবিত্ত পরিবার। ‘আলাপন’-এ তার নতুন চাকরি। এর আগে কিছু অ্যাড-এজেন্সিতে কাজ করেছে সে।

দিগন্তও সংক্ষেপে তার কথা জানাল। মা গত হয়েছেন আজ প্রায় কুড়ি বছর। সে অকৃতদার, সংসার করার মানসিকতাও আর নেই। অনন্তবাবুও বেশীরভাগ সময় থাকেন “রীড”-এর অফিসে। সাহিত্যচর্চা আর বই ছাপানো – এই নিয়ে ওদের দুই বাবা-ছেলের দিব্যি দিন কেটে যাচ্ছে।

হ্যান্ডিক্যাম, মাইক্রোফোন ইত্যাদি সেট-আপ করে ইন্টারভিউ আরম্ভ হল। রাণাই প্রথম কথা শুরু করল, ‘দিগন্তবাবু, শুরুতেই আপনার নতুন উপন্যাস “অভিসম্পাত”-এর অশেষ সাফল্য কামনা করি।’

দিগন্ত বিগলিতস্বরে জবাব দিল, ‘ধন্যবাদ।’

‘আমাদের পত্রিকা ‘আলাপন’ থেকে বেরনো সামাজিক বিষয় নিয়ে আপনার লেখা ছোট গল্প “দায়ী” আপনাকে এবছরের শ্রেষ্ঠ লেখকের সম্মান এনে দিয়েছে। এ-বিষয়ে আপনার মতামত কী?’

‘আমি আপনাদের পত্রিকার এডিটোরিয়াল টীমের কাছে চিরকৃতজ্ঞ আমার গল্পটিকে ছাপানোর জন্য। আর শ্রেষ্ঠ লেখকের সম্মান একটা স্বীকৃতিমাত্র, সেটা আমার লক্ষ্য নয়। সমাজের বিভিন্ন স্তরে নৈতিক অবক্ষয় আমায় যেভাবে ভাবিয়েছে, আমার গল্পের পাঠকদেরও যদি সেভাবে ভাবায়, তা’হলেই আমার প্রচেষ্টা সার্থক হবে।’

‘সবাই জানে, মাত্র আঠারো বছর বয়সে আপনি “শরণ্যা”-র হাত ধরে লেখক হিসেবে চূড়ান্ত সুনাম অর্জন করেছিলেন। কিন্তু এরপর প্রায় দু’বছর আপনার কোনও লেখাই পাঠকমহলে বিশেষ ছাপ ফেলতে পারেনি।’ একটু থেমে বলল রাণা, ‘এর পিছনে কী কারণ ছিল যদি বলেন –’

মুচকি হেসে জবাব দিল দিগন্ত, ‘এ-প্রশ্নের উত্তর আমি আগেও বহুবার দিয়েছি!’ তারপর স্মৃতিচারণ করতে করতে সে রাণাকে সংক্ষেপে তার টাকির পর্বটা বলল।

দিগন্তের বক্তব্য শেষ হলে রাণা তার মুখের মাস্ক খুলে নিয়ে বলল, ‘বেশ, এবার তা’হলে এমন প্রশ্ন করি, যার উত্তর আপনি আগে কখনও দেননি।’

দিগন্ত কতকটা হতচকিত হয়ে গেল রাণার কথায়। সে কোনও ধারণাই করতে পারল না যে এরপর তাকে কোন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। তবে মাস্ক খুলে ফেলায় রাণার চেহারাটা এবারে সে ভালভাবে দেখতে পেল, আর দেখেই ভীষণ অবাক হয়ে গেল। রাণার মুখমণ্ডল ও দেহসৌষ্ঠবের সঙ্গে তার বহু পুরনো একটি গল্পের প্রধান চরিত্রের আশ্চর্য সাদৃশ্য রয়েছে; এমনকি তার কল্পিত বাচনভঙ্গি ও কণ্ঠস্বরও একদম মিলে যাচ্ছে চোখের সামনে বসে থাকা বাস্তবের এই রাণা মিত্রের সঙ্গে। শুধু তাই-ই নয়, সেই চরিত্রের নামও যে ছিল ‘রাণা মিত্র’!

প্রায় বছর পনের আগে সে একটি প্রেমের কাহিনী লিখতে আরম্ভ করেছিল, যদিও সে-কাহিনী আর সম্পূর্ণ করা হয়ে ওঠেনি তার পক্ষে। এই লোকটি যেন সেই গল্পের প্লট থেকেই হুবহু উঠে এসেছে বাস্তবে! এ যে ভয়ানক কাকতালীয় ব্যাপার!

দিগন্ত বিমূঢ় হয়ে রাণার মুখের পানে তাকিয়ে আছে, এমন সময় তার পরবর্তী প্রশ্নটা তাকে আরও অবাক করে দিল – ‘আপনার চিন্তায় এমন কোনও গল্প আছে, যা লিখতে শুরু করেছিলেন, কিন্তু শেষ করতে পারেননি?’

এ-প্রশ্নের কী উত্তর দেবে দিগন্ত? রাণাকে কি বলা উচিৎ হবে তার সেই তিনটি অসম্পূর্ণ গল্পের কথা? বললেই তো স্বাভাবিকভাবে পরের প্রশ্ন হবে, গল্পগুলো কেন সে সম্পূর্ণ করেনি আর। সেই প্রশ্নের উত্তরে কী বলবে সে? এরা সাংবাদিক, তার সম্পর্কে কিছু একটা ভুলভাল ছেপে দিলে মুহূর্তে এই খ্যাতির জৌলুস বদনামের আঁধারে মিলিয়ে যাবে! না, সেটা হতে দেওয়া যাবে না। কিছু গোপনীয়তা তো বজায় রাখতেই হবে।

অবশেষে মিথ্যার আশ্রয় নিল দিগন্ত, রাণার ঐ প্রশ্নের উত্তরে ছোট্ট করে শুধু ‘না’ বলে দায় এড়াল।

রাণা অকস্মাৎ মুখ গম্ভীর করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে কোনওরূপ ইঙ্গিত না দিয়েই ক্যামেরা বন্ধ করে মাইক্রোফোন খুলে ফেলল!

দিগন্ত বিস্ময়কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল, ‘এ কী করছেন? ইন্টারভিউ শেষ নাকি?’

জলদগম্ভীর গলায় জবাব দিল রাণা, ‘আপনি মিথ্যে বলেছেন, আর আপনার ইন্টারভিউ নেওয়ার কোনও মানে নেই।’

দিগন্ত হতভম্ব হয়ে গেছে। ডিভান ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে সে রাণাকে কঠিনস্বরে প্রশ্ন করল, ‘আপনি কীভাবে বলতে পারেন যে আমি মিথ্যে বলেছি? আপনার এতবড় আস্পর্ধা হল কী করে?’

রাণা এবার সটান তার চোখে চোখ রেখে একটা তির্যক হাসি হেসে তাকে পালটা জবাব দিল, ‘আমায় চিনতে পারেননি আপনি? আমি তো আপনার অসমাপ্ত কাহিনী “পুরানো সেই দিনের কথা”-র রাণা; আমি যে সব জানি দিগন্তবাবু!’

কথাটা শুনে দিগন্ত চরম বিস্ময়ের ঘোরের মধ্যেই ভয়ে উত্তেজনায় দু’পা পিছিয়ে গেল। কী বলছে লোকটা? এও কি সম্ভব – তার কাহিনীর চরিত্র সশরীরে তারই সামনে এসে উপস্থিত? নিজের কোনও জ্ঞানেন্দ্রিয়কেই যে বিশ্বাস হচ্ছে না তার!

নাঃ, এ হতে পারে না। লোকটা নির্ঘাত কোনও ঠগ, অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে, এখন আন্দাজে ঢপ দিচ্ছে। ইশ্‌, বাড়িতে কেউ নেই, সুপ্রিয়টাকেও বিদায় করে দিয়েছে সে আজকের মত! ভীষণ আফশোস হচ্ছে তার, বাড়িতে অন্ততঃ আরেকজন লোক থাকলে ভাল হত।

কিন্তু লোকটি প্রবঞ্চকই যদি হয়, তা’হলে সে তার সেই গল্পের নামটা জানল কী করে? সেটা তো কারুরই জানার কথা নয়! আজ অবধি সে কাউকে ঐ অসম্পূর্ণ গল্পগুলি সম্পর্কে কিচ্ছু বলেনি। গল্পগুলোর অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপিগুলি আজও অনাদরে পড়ে আছে তার দেরাজের কোনও এক অজ্ঞাত কোণে।

শেষে অন্য কোনও উপায় না দেখে সে চিৎকার করে সিকিউরিটিকে ডাকতে গেল। কিন্তু তাজ্জব ব্যাপার, গলা দিয়ে কোনও আওয়াজ বেরল না!

আতঙ্কে তার গলা শুকিয়ে কাঠ, দর্‌দর্‌ করে ঘাম হচ্ছে, হাত-পা কাঁপতে আরম্ভ করেছে, হৃৎপিণ্ডটা এত জোরে ধকধক করছে যে এখুনি বুঝি ওটা বুক চিরে বেরিয়ে আসবে!

ওদিকে রাণা এক-পা দু’পা করে দিগন্তের দিকে এগিয়ে আসছে আর তাকে লক্ষ্য করে বলে চলেছে, ‘আমার ও শ্রীপর্ণার ভালবাসার গল্পটা ওরকম মাঝপথে নিয়ে ছেড়ে দিলেন! সুবিমল অধিকারীর কাঠের বাক্স থেকে তাঁর পাণ্ডুলিপিগুলো বের করে সেগুলো কপি করার কাজে এতটাই আত্মহারা হয়ে গেলেন যে, আমাদের কথা আর মনেই রইল না আপনার?’

দিগন্তের মুখ থেকে একটা ‘হাঁ-হাঁ’ শব্দ বের হল, কথা বলার মত অবস্থা নেই তার!

আচমকা কোত্থেকে একটা দমকা বাতাস এসে ঘরে ঢোকার দরজাটাকে দড়াম করে বন্ধ করে দিল। প্রায় একইসঙ্গে ব্যালকনিতে যাওয়ার দরজাটাও সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল। মাথার উপরে সিলিং ফ্যানটা যেন গতি বাড়িয়ে  আরও জোরে শব্দ করে ঘুরতে শুরু করল। ঘরের আলোগুলোও স্তিমিত হয়েই আবার দপ্‌ করে জ্বলে উঠল!

দিগন্ত হঠাৎ হোঁচট খেয়ে চিৎ হয়ে ডিভানেই পড়ে গেল। সেই ঝটকায় তার চোখের চশমাটা খুলে মেঝেতে পড়ে তৎক্ষণাৎ ভেঙে কয়েক টুকরো হয়ে গেল। আচমকা তার চোখের সামনেটা ঝাপসা হয়ে এল। আবছা দৃষ্টিতে সে দেখল, রাণার শরীরটা যেন বদলে গিয়ে সেখানে লম্বাগড়ন একটি অবয়ব দাঁড়িয়ে আছে!

দৃষ্টি একটু স্বচ্ছ হতেই দিগন্ত সামনে যাকে দেখতে পেল, সেও তার বহুদিনের চেনা – তারই লেখা একটি অসমাপ্ত গোয়েন্দা-কাহিনীর মুখ্য চরিত্র, নাম ইন্দ্র সেন। দাড়ি-গোঁফ কামানো পরিষ্কার পেটানো চেহারা, চোখদু’টি ভীষণ তীক্ষ্ণ।

ইন্দ্র করজোড়ে নমস্কার জানিয়ে দিগন্তের উদ্দেশে বলল, ‘আমায় চিনতে নিশ্চয়ই অসুবিধা হয়নি আপনার। গোয়েন্দা গল্প লিখবেন বলে মনস্থির করলেন, প্রধান গোয়েন্দাচরিত্র তৈরী করলেন, অথচ গল্পটাই বানালেন না! নিউজ়পেপার থেকে ঘটনাটা নিলেন, তারপর আমায় ক্রাইম সীনে এনে ফেলে চুপ মেরে গেলেন কেন বলুন তো?’

দিগন্তের মাথায় ও বুকে প্রচণ্ড ব্যথা আরম্ভ হয়েছে, ভীষণ অস্বস্তিবোধ হচ্ছে তার। ইন্দ্রের গমগমে কণ্ঠস্বরে কানদু’টো গরম হয়ে গেছে। মাথাটা যেন ব্যথার চাপে ফেটে চৌচির হয়ে যেতে বসেছে!

ইন্দ্র ফের বলতে লাগল, ‘সুবিমলবাবু অনেক উচ্চমানের সাহিত্যিক ছিলেন। কিন্তু তিনি আপনার একটি শখের বলি হয়েছেন! আমার অনুসন্ধানজাত তথ্য এটা।’

ডিভানে আধশোয়া অবস্থাতেই দিগন্ত বিস্ময়াবৃত কৌতূহলভরা নজরে ইন্দ্রের দিকে তাকাল।

‘আপনার শখ ছিল লেখক হওয়ার,’ বলে চলেছে ইন্দ্র, ‘কিন্তু কোনও যুৎসই গল্পের প্লট আপনার মাথায় আসছিল না। তখন তাঁর উপন্যাসের কাহিনী অবলম্বনে সিনেমার টোপ দিয়ে সুবিমলবাবুর কাছ থেকে অসদুপায়ে তাঁর গল্প “শরণ্যা”-র পাণ্ডুলিপি নিয়ে নিলেন আপনার বাবা! প্রথমে বই-আকারে ছেপে বের করলেন আপনার নামে, তারপর তৈরী হল সিনেমা। আপনি রাতারাতি বিখ্যাত সাহিত্যিক হয়ে গেলেন, আর ওদিকে সুবিমলবাবু অখ্যাত লেখক হিসেবেই অন্তরালে নীরবে নিজেকে শেষ করে দিলেন! অনামা সাহিত্যিকের লেখা সকলেরই অজানা, এবং তার দাবিও উপেক্ষিত।’

দিগন্ত অশেষ যন্ত্রণার মধ্যেও নিশ্চুপ। তার সারা শরীর অবশ হয়ে আসছে ধীরে ধীরে, যেন কোনও মহাপাপের শাস্তি অজগরের মত গিলে খাচ্ছে তাকে!

‘আর, গত চোদ্দ বছর ধরে সুবিমলবাবুর লেখাগুলোই সামান্য অদলবদল করে সমানে নিজের নামে ছাপিয়ে এসেছেন, সেটাও আমার জানা।’ জোরগলায় কথাগুলো বলে ইন্দ্র দিগন্তের দিকে পিঠ করে ঘুরে দাঁড়াল।

আবার তার দৃষ্টি অপরিষ্কার হয়ে এল, চোখের কোটর বেয়ে নেমে এল অশ্রু। এ যেন রঙ্গমঞ্চে আলো-আঁধারির আড়ালে পালাবদল ঘটছে! এক চরিত্রের বিদায় হয় অন্য চরিত্রের উদয়ে।

দিগন্তের শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি কমে এসেছে, এই বুঝি হঠাৎ করেই থেমে যাবে! এই বুঝি দুর্বল দু’টি চোখের পলক বুজে নেমে আসবে মৃত্যু!

এইসময় সে একটা ক্রূর হাসির শব্দ শুনে চোখ তুলে তাকাল।

সামনে যে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তার চুল-দাড়ি-গোঁফ সব কামানো। দু’চোখের নিষ্ঠুর দৃষ্টি ও ঠোঁটের কোণের বাঁকা হাসি তার নির্দয় খল চরিত্রের পরিচয় দিচ্ছে। এই চরিত্রও দিগন্তেরই সৃষ্টি, তার সাসপেন্স্‌ থ্রিলারের ভয়ঙ্কর খলনায়ক শমন!

নিজের ন্যাড়ামাথায় হাত বুলিয়ে শমন নির্মমকণ্ঠে বলল, ‘পাপের হিসেব পেয়ে গেছেন, এবার শাস্তির জন্য প্রস্তুত হন। আমার চরিত্রের কার্যকলাপের মধ্যে অন্যতম প্রধান হল হত্যা! আপনি আমায় তৈরী করলেন, তারপর অসম্পূর্ণ রেখে দিলেন। ফলে আমি হত্যা করতেই থাকব, আমার কোনও অন্তিম পরিণতি নেই।’

দিগন্ত আর সহ্য করতে পারল না, প্রচণ্ড যন্ত্রণায় ছটফট করে উঠল। এতক্ষণ ধরে অবিশ্বাস্য ঘটনার সাক্ষী থেকে তার জীবনীশক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে। টলতে টলতে শেষবারের মত নিজের লেখার টেব্‌লের কাছে গিয়ে তলার দেরাজের কম্বিনেশন লক খুলে দেরাজটার হ্যান্ডেলটা ধরে টানতেই ভিতর থেকে উঁকি দিয়ে বেরিয়ে এল চোদ্দ বছর আগে টাকিতে পাওয়া সুবিমলবাবুর কাঠের বাক্স। কোনওক্রমে সে বাক্সটা বের করে ঢাকনা খুলে মেঝের উপর রাখল। পুরনো কাগজগুলি মুচমুচে হয়ে গেছে, ফ্যানের হাওয়ায় উড়ছে। পরম শ্রদ্ধাসহ পুরো পাণ্ডুলিপির তাড়াটাকে একটা প্রণাম করেই মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল একাডেমি অ্যাওয়ার্ড-প্রাপ্ত সুবিখ্যাত ঔপন্যাসিক দিগন্ত দেবনাথ।

রীড”-এর অফিস, কলেজ স্ট্রীট, কলকাতা – ১লা জুলাই, ২০২০ রাত সাড়ে ন’টা

আধো-অন্ধকারে মাথা নিচু করে বসে আছেন অনন্তবাবু। শরীরটা বেশ কিছুদিন ধরেই খারাপ। জ্বর-সর্দি-কাশি কিছুতেই কমছে না! ডাক্তারের পরামর্শে কোভিড-টেস্ট করাতে দিয়েছেন, রিপোর্ট আসতে দিনসাতেক লাগবে। ততদিন পর্যন্ত ডাক্তারবাবুর উপদেশ অনুসারে ওষুধ খেতে হবে।

আজ এখানে সকাল থেকে বৃষ্টি পড়েছে, কখনও ইলশেগুঁড়ি, আবার কখনও মুষলধারে। গোটা কলেজ স্ট্রীট চত্বর জলে ডুবে গেছে! একটু আগে পর্যন্তও বৃষ্টি হয়েছে, তবে আপাতত বৃষ্টি বন্ধ আছে। আকাশ এখনও মেঘলা, আবার যেকোনও সময় বৃষ্টি নামতে পারে।

কোভিড প্রোটোকল মেনে পঞ্চাশ শতাংশ লোক নিয়ে অফিস চালাতে হচ্ছে তাঁকে, তাই সম্পাদনার কাজগুলোর চাপ একটু বেশীই পড়ে গেছে তাঁর উপর। এরইমধ্যে ছেলে দিগন্তের নতুন বইপ্রকাশের ঝক্কি সামলেছেন, অন্যান্য লেখকদের লেখারও এডিটিং, প্রুফ-চেকিং ইত্যাদি করেছেন। এই অতিমারীর সময়ে এত ধকল সামলাতে গিয়েই বোধ হয় তাঁর শরীর খারাপ হয়েছে!

অকস্মাৎ তাঁর চেম্বারের ডোরবেল বেজে উঠতেই ভদ্রলোক চমকে উঠলেন।

অফিসে তো এখন আর কেউ নেই, তা’হলে বেল বাজিয়ে এই অসময়ে তাঁর চেম্বারে আসতে চাইছে কে?

অনন্তবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে দরজা খুললেন। করিডোরের আলোছায়াতে একটি বয়স্ক মানুষ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছেন, পরনে সাদা ধুতির উপর হাতা ভাঁজ করা পাঞ্জাবী ও চোখে কালো মোটা ফ্রেমের চশমা। কাঁচাপাকা চুলগুলো ব্যাকব্রাশ করে আঁচড়ানো। ঐ অনুজ্জ্বল আলোতেও ওঁর দু’চোখের উজ্জ্বলতা চোখে পড়ে।

অনন্তবাবু বিরক্তির সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘অফিস তো বন্ধ, আপনি কী জন্যে এসেছেন এখন?’

আগন্তুক ঐ বয়স্ক ভদ্রলোক অনন্তবাবুর আরও কাছে এগিয়ে এসে তাঁর চোখের দিকে সোজা দৃষ্টিতে তাকিয়ে জোড়হাতে সম্বোধন করে পরিষ্কার গলায় বললেন, ‘চিনতে পারছেন? আমি সুবিমল অধিকারী।’

# রচনাকাল : জুলাই ২০২১।।

লেখক পরিচিতি

লেখক হিসেবে অনির্বাণ সরকারের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে ২০১৯ সালে, 24by7Publishing.com-এর মাধ্যমে। তাঁর প্রথম প্রকাশিত বইটির নাম “প্রান্তিক”। এছাড়াও অন্যান্য বিভিন্ন মাধ্যমে ও অঋক বইওয়ালা কর্তৃক প্রকাশিত “ভয়ের দেশ – দ্বিতীয় খণ্ড” এবং “প্রেমে পড়া বারণ” বইদু’টিতে তাঁর লেখা দু’টি ভিন্ন স্বাদের গল্প স্থান পেয়েছে। এক মধ্যবিত্ত বাঙালী পরিবারে জন্ম ও বড় হওয়ার দৌলতে ছোট থেকেই পড়াশুনা প্রাধান্য পেয়েছে তাঁর দৈনিক জীবনপঞ্জীতে। তথাপি, শখের বশে ও মনের ঝোঁকে তিনি সাহিত্যচর্চা শুরু করেছিলেন অনেক ছোটবেলা থেকেই। তাঁর এই লেখালিখি চলত পড়াশুনার ফাঁকেই। পেশায় একজন ইঞ্জিনীয়ার এবং এক সর্বভারতীয় সংস্থায় কর্মরত এই লেখক জীবনকে যেভাবে পেয়েছেন, সেভাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন নিজের লেখায়।

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post নরসিংদীর নারকীয় সেই বাড়ি| পলক ফেলা নিষেধ | মৌলী কুন্ডু| Bengali Thriller Story
Next post আড়ালে করোনা | পলক ফেলা নিষেধ | সমীরণ সামন্ত| Bengali Thriller Story