আকাশ মেঘে মেঘাচ্ছন্ন হয়ে আছে, না বৃষ্টি এখনও আসেনি। তবে মাঝে মাঝে বিদ্যুতের অপলক চমকানি এসে আলোকিত করে যাচ্ছে কালো কফিনটাকে। আবার কয়েক মুহূর্ত পরেই কাজল কালো মেঘরাশি পড়ন্ত বিকালকে কালো যবনিকা দিয়ে নাটকীয়ভাবে আঁধারে ঢেকে দিচ্ছে। কিছু বেদনাতুর আঁখির সম্মুখ হতে আস্তে আস্তে কফিনটি মিশে গেল দু-এক ফোঁটা বৃষ্টির জলে সিক্ত মাটির সাথে। এখন থেকে শুধু কবররের ওপরে ফলকে লেখা জেনেলিয়া লুই হয়েই বেঁচে থাকবে জেনি। আস্তে আস্তে সিমেটারি ফাঁকা হয়ে গেল। অর্ণব এখনও জেনেলিয়ার সমাধির সামনে বসে ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। অর্ণবের বন্ধু প্রিয়াংশু তার কাঁধে হাত রেখে বলল, “এবার ওঠ বাড়ি যেতে হবে। আর তাছাড়া খুব জোরে বৃষ্টিও নামবে মনে হচ্ছে। চল, তোকে আমি বাড়ি দিয়ে আসি। জেনির মৃত্যুটা আমরা কেউই মেনে নিতে পারছি না। এই তো সে দিনের কথা মনে হয়, জেনির সাথে তোর বিয়ের ঠিক হল। তোদের বিয়েতে আমরা কত মজা-আনন্দ করলাম। আর আজ দেখ…” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অর্ণবের হাত ধরে তাকে গাড়ির কাছে নিয়ে প্রিয়াংশু । গাড়ির ফ্রন্ট ডোরটা খুলে, সে বলল, “কি হল গাড়িতে ওঠ।”
“নাহ, প্রিয়াংশু তুই বাড়ি যা, আমি একটু চার্চে যাব। চিন্তা করিস না। আমি বাড়ি ফিরে তোকে ফোন করব।”
প্রিয়াংশু একটু ভেবে বলল, “নাহ, আমি যাই তোর সাথে। আমার তো এখন তেমন কোন কাজ নেই।”
“নাহ, ভাই তুই আয়। জেনির আত্মার শান্তির জন্য আমি একটু একা প্রে করতে চাই।” প্রিয়াংশু আর বাকবিতণ্ডায় না গিয়ে গাড়ি নিয়ে বাড়ির পথে রওনা দিল। আর অর্ণব চলল গির্জার অভিমুখে। কিছুক্ষণের মধ্যে শুরু হল বহুক্ষণের অপেক্ষারত প্রবল ঝড়-বৃষ্টি। বৃষ্টির জলের সাথে অর্ণরের চোখের জল মিশে গিয়ে যেন শহরের পথঘাট ভিজিয়ে একাকার করে দিল।
রাতের অবিরাম বৃষ্টিকে হার মানিয়ে অবশেষে ঝকমকে সকাল হতে না হতেই প্রিয়াংশু অর্ণবের বাড়ি এসে উপস্থিত হল। অর্ণব ফ্ল্যাটে একাই ছিল। বেশ ঝাঁ চকচকে সাজানো গোছানো ফ্ল্যাট। এতদিন জেনি নিজের হাতে সাজিয়ে রাখত। চারিদিকে সৌখিনতার ছোঁয়া স্পষ্ট। তবে অর্ণবের পৈত্রিক বাড়ি বিষ্ণুপুরে। সেখানে তার বাবা–মা থাকেন। কর্মসূত্রে অর্ণব কলকাতায় থাকে, যদিও কলকাতাও তার স্থায়ী ঠিকানা নয়। অর্ণব এম.পি.টি কোম্পানীতে চাকরি করে। কাজের জন্য অনেক সময়ে তাকে বিদেশেও থাকতে হয়েছে। গত দুবছর সে একটানা কলকাতায় আছে। বলা যায়, জেনির আবদারেই কলকাতায় থাকা। নাহলে অর্ণব বিদেশে থাকাতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। তবে প্রজেক্ট ওয়ার্কটা শেষ হলে আবার হয়ত বিদেশ চলে যাবে।
প্রিয়াংশু ঘরে ঢুকে দেখে অর্ণব প্যাকিং করছে। কিছুটা হতচকিত হয়ে সে জিজ্ঞাসা করল, “কি রে কোথায় যাচ্ছিস? বিষ্ণুপুর?”
অর্ণব কিছু উত্তর না দিয়ে সোজা রান্নাঘরে চলে যায়। কিছুক্ষণ বাদে সে বেরিয়ে আসে, হাতে দু’কাপ কফি নিয়ে। একটা কফি প্রিয়াংশুর হতে দিয়ে সামনের টেবিলের ওপর থেকে জেনির ফটোটা নিয়ে, তাতে একবার হাত বুলিয়ে সে বলল, “জেনির কাছে যাচ্ছি।”
প্রিয়াংশু অর্ণবের অস্বাভাবিক কথায় চমকে উঠল। সে কফিটা টেবিলের ওপর রেখে উদ্বেগের স্বরে জানতে চাইল, “জেনির কাছে মানে? কী সব বকছিস? দেখ জেনি আর নেই। ব্যাপারটা সত্যি হয়ত মানা সহজ নয়, তবে সত্যিটা তোকে মেনে নিতেই হবে। সে আর ফিরে আসবে না। তুই কাজে মন দে, দেখবি সব ঠিক হযে যাবে। আচ্ছা বেশ কয়েকদিন তুই আমার সাথে আমার বাড়িতে চল, এখানে আর থাকতেও হবে না।”
“নারে, আমাকে যেতেই হবে। তোর মনে আছে, আমি যখন নেদারল্যান্ডের একটা প্রজেক্ট ওয়ার্কের ব্যাপারে ওখানে গিয়েছিলাম, জেনির সাথে তখনই প্রথম আলাপ হয়েছিল? তোর অবশ্য পূর্ব পরিচয় সূত্রেই ওর সাথে আলাপ হয়েছিল। কী মিষ্টি ব্যবহার করত! জেনির ব্যবহারই আমাকে প্রথম মুগ্ধ করেছিল। বিদেশ বিভূঁইয়ে জেনি হয়ে ওঠে আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। দিনের বেশির ভাগ সময়টা কাটত ওর সাথে ঘুরে। আর কবে যে জেনি আমার এত কাছের মানুষ হয়ে উঠল তা বুঝতেও পারিনি।”
“হ্যাঁ, জানি রে। তারপর তুই যখন কলকাতায় চলে এলি, জেনি একদিন আমার কাছে এল। খুব ড্রিংক করেছিল। আমাকে বারবার বলছিল তোর কাছে যেতে চায়। এদিকে তুই জেনিকে তোর কলকাতার ঠিকানা দিতে বারণ করেছিলি।”
“হ্যাঁ, তখনও তো বুঝেই উঠতে পারিনি জেনির প্রতি আমার মনোভাবটা কী রকম। আর ও যে কাজের সাথে যুক্ত ছিল সেটা আমার পছন্দ ছিল না। কিন্তু সেই রাতে যখন জেনি নেশার ঘোরে সবটা বলল — আমার জন্য ও ওই কাজও ছেড়ে দেবে, তখন কিন্তু আর দেরী করিনি বল? জেনিকে তো নিয়ে এলাম, কিন্তু রাখতে পারলাম না আর। সেই চলে গেল আমাকে ছেড়ে। জেনির নেদারল্যান্ডে একটা জমি আছে। জানিস তো, ওর ও ব্যবসার ভার আমাকে দিয়েছিল। ও সেই জমিতে একটা অনাথ আশ্রম খুলবে ভেবেছিল। আমি ওই ব্যাপারেই আইনি কাজগুলো মেটাতে যাচ্ছি। আর ওখানেই তো আমার আর জেনির ভালবাসার দিনগুলো আছে। কাল সকালে ফ্লাইট।”
প্রিয়াংশু তার আবেগের কাছে নতি স্বীকার করে অর্ণবের মতকে সহমত জানাল, আর অনেকক্ষণ গল্প করে বাড়ি চলে গেল। রাত প্রায় ১টা বাজে। অর্ণবের খাবার টেবিলের ওপর দুটো খাবার প্লেট পড়ে আছে। টেবিলের সামনের সোফাতে সে বসে ড্রিঙ্ক করছে। সামনের টিপয়ের ওপর রাখা জেনির ফটোটা বেশ উজ্জ্বল লাগছে। মনে হচ্ছে আজও জেনি যেন তার সামনে বসে কথা বলছে, তার দিকে ভালোবাসা ভরা দৃষ্টি দিয়ে তাকে কাছে ডাকছে। কিন্তু বাস্তবে সে যে এখন সত্যি অধরা। বাইরে দমকা হাওয়ার বেগে ব্যালকনির সামনে কাচের সৌখিন টেবিলটার ওপর রাখা বিদেশী ফুলদানিটা পড়ে গিয়ে ভেঙে চৌচির হয়ে গেল। টলটলে পা আর বেসামাল শরীর নিয়ে টলতে টলতে অর্ণব ব্যালকনির কাচের দরজাটা বন্ধ করতে উঠল। কিন্তু সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল; কাচের ব্যালকনিতে কে ওটা, ব্ল্যাক ড্রেস পরে দাঁড়িয়ে আছে! অর্ণব চোখটা রগড়ে নিয়ে আবার দেখে। না, সে তো কিছু ভুল দেখছে না। সত্যিই একটি মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। ভালো করে লক্ষ্য করে দেখে…এ তো জেনি! কী আশ্চর্য! অর্ণব ‘জেনি’ বলে ডেকে ব্যালকনির সামনে ছুটে যায়, কিন্তু না আর কাউকে সে দেখতে পায় না। মনে মনে হাসে আর সে ভাবে, “তাহলে কি আমি নেশার ঘোরে ভুল দেখলাম! হতে পারে, জেনি তো আর নেই। নাহ, আর ড্রিঙ্ক করব না। কাল সকালে বেরতে হব্ শুয়ে পড়ি।” অর্ণব পাশের ঘরে গিয়ে নরম বিছানায় সেঁধিয়ে যায়, আর ধীরে ধীরে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।
সকাল সকাল অর্ণব ব্যাগ গুছিয়ে, রেডি হয়ে বেরতে যাবে ঠিক সেই সময় ডবসন হাজির। ডবসন জন্মসুত্রে আফ্রিকান। সে আফ্রিকান আদিবাসী সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। ছোটবেলা থেকে অসীম দারিদ্রতার মধ্যে বড় হয়েছে। জঙ্গলে মৌচাক ভাঙা থেকে শুরু করে এমন কোন কঠোর পরিশ্রমের কাজ নেই, যেটা সে করেনি। কিন্তু জঙ্গলের জীবন তাকে আপন করতে পারেনি। পনেরো বছর বয়েসে ডবসন সেই যে জঙ্গল ছেড়ে সভ্য জগতের বৈভবের টানে ঘর ছাড়ল, ব্যস সেই থেকে তার দৌড় শুরু। এমন কি পৈতৃক নাম ঝাঞ্ঝু পাল্টে, সে নিজেই নিজের নাম রাখে ডবসন। দেশ-বিদেশে ওর প্রচুর ব্যবসা। কুচকুচে কালো মুখের ফাঁক থেকে সাদা দাঁতসহ লাল মাড়িটাও বেরিয়ে আসে, যখনই ডবসন হাসে। ডবসন কাদা মাখা জুতো পায়ে গটগট করে এগিয়ে এসে, সোফায় গিয়ে বসল। অর্ণব মেঝের দিকে চোখ দিয়ে দেখল, সারা ঘরটা কাদায় কাদা হয়ে গেছে। একটু বিরক্তির সুরে বলল, “ডব, তুমি এখন এখানে কী করছ? আমি এখনই বেরোবো। কিছু বলার থাকলে তাড়াতাড়ি বলো।”
ডবসন অবাক হয়ে বলল, “আরে কোথায় যাচ্ছ? কাল জেনির খবরটা শুনে আমিও খুব হতচকিত আর ব্যাথিত হয়েছি। কী ফুটফুটে মেয়ে ছিল জেনি। তোমার অনেক আগে থেকে ওকে চিনি, জানোই তো। কিন্তু এভাবে ওর মৃত্যু… সত্যিই ভাবা যায় না। জেনি এত ড্রিঙ্ক করত জানতাম না। তা তুমি কোথায় যাচ্ছ?”
আসল কথাটা চেপে অর্ণব বলল, “বাইরে প্রোজেক্টের কাজে যাচ্ছি।”
ডবসন বলল, “আমি জানি অর্ণব তুমি জেনির জমিটা বিক্রি করতে যাচ্ছ। আমার কাছে লুকিয়ে কী লাভ! যাও আমিও কয়েকদিন পর যাচ্ছি। দেখা হবে সেখানে। আর বাকি কথা না হয় ওখানেই হবে। মানে ওই জমির ভাগ তো আমার ডেফির-ই প্রাপ্য। এরপর ডবসন অর্ণবকে বিদায় জানিয়ে চলে যায়। ঠিক তার পর-মুহূর্তেই প্রিয়াংশু অর্ণবের ফ্ল্যাটে আসে। কৌতুহলবশত সে জানতে চায়, “অর্ণব এই মাত্র দেখলাম ডবসন গাড়ি করে চলে গেল, ও আবার তোর কাছে এসেছে? লোকটাকে আমার খুব সন্দেহ হয়। তুই তো ছিলিস না। আমার মনে হয়, সেই সুযোগেই জেনিকে সুইসাইড করার জন্য ও বাধ্য করেনি তো!”
অর্ণব অবাক হয়ে যায়। “তুই এসব কী বলছিস! আর তুই এত কী করে নিশ্চিত হচ্ছিস! আমার তো মনে হয় জেনি আমার জন্য শেষ হয়ে গেল। ওকে আমি সত্যিই সময় দিতে পারিনি। তাই মানসিক অবসাদে ও এই অঘটনটা ঘটিয়েছে। কিন্তু এসবে ডবসন আসছে কোথা থেকে? হ্যাঁ ও জেনিকে একসময় বাধ্য করেছে ওই সব কাজ করতে। তবে আমার সাথে বিয়ে হওয়ার পর তো ডবসন কোনদিন ওকে ওর কাজে ইনভল্ভ করেনি। কিন্তু তুই এই রকম কথা বলছিস কেন?” প্রিয়াংশু আমতা আমতা করে বলল, “না লোকটা তো সুবিধের নয়, তাই মনে হল। আমি তো ভাবতেই পারি না জেনি সুইসাইড করেছে। তোর কাউকে সন্দেহ হয় না? যাক, বাদ দে কখন বেরোচ্ছিস?”
“এই তো বেরোব।”
“হ্যাঁ চল আমি গাড়ি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি, তোকে ছেড়ে দেব।” গাড়িতে মালপত্র তুলে দুজনে গাড়ি চড়ে এয়ারপোর্টে উপস্থিত হল। প্রিয়াংশু অর্ণবকে ছেড়ে দিয়ে চলে যায়। আর অন্যদিকে অর্নব জেনির স্বপ্নপূরণের উদ্দেশ্যে রওনা হতে চলে। কিন্তু ভাগ্য অর্ণবের জন্য অন্য কিছু ভেবে রেখেছিল। সে হঠাৎ এয়ারপোর্টে অসুস্থ হয়ে যায়। আবার তাকে ফ্ল্যাটে নিয়ে আসে প্রিয়াংশু। অর্ণব এসে থেকে এক কথাই বলে চলছে, “জেনি বেঁচে আছে আমি ওকে দেখেছি, ও ফিরে এসেছে।”
কী এমন হল যার ফলে অর্ণব এমন করছে! কিছুই বুঝতে পারছিল না প্রিয়াংশু। শুধু একই কথা সে জেনিকে দেখেছে। আর ক্রমাগত বলে যাচ্ছে, জেনির আত্মা মনে হয় শান্তি পায়নি। ও অপরাধীর শাস্তি চায়। অগত্যা অর্ণবকে মানসিক চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়।
###
চারিদিকে আলোর রোশনাই। একটা বড় সুইমিং পুলের সামনে দেশি বিদেশি মাথার জমজমাটি ভিড়। বিদেশি গান আর মদের আসরে সবাই মশগুল। ডবসন আজ এই পার্টির আয়োজন করেছে। ডবসনের আজ খুব খুশির দিন। বিদেশে তার নতুন প্রজেক্টগুলো রমরমিয়ে চলছে। ডবসন তার সঙ্গী সাথীদের স্বাগতম জানাচ্ছে। এমন কি প্রিয়াংশুও এই পার্টিতে আর পাঁচজনের মত আমন্ত্রিত। প্রিয়াংশুকে দেখে ডবসন এক মুখ হাসি নিয়ে উল্লাসে বলে উঠল, “ওয়েলকম মাই ফ্রেন্ড্… তোমার জন্যই তো এত খুশি। সত্যি তুমি আমায় বাঁচিয়ে দিলে। নইলে তো আমি ফেঁসে যেতাম। কী যে হত! জেনি সেদিন শেষবারের মত আমার বাড়ি এসেছিল, আমাকে শাসিয়ে বলেছিল, আমি যদি নেক্সট টাইম এই একই রকম জোর করি তো ও নাকি আমাকে পুলিশে দেবে। হুঃ, অত সোজা নাকি! সব প্ল্যান করে সাজিয়ে নিলাম ছকে ছকে। ব্যাস, সেই মতই জেনি হল চিরদিনের মত আউট আর অর্ণব পাগল। থ্যাংকস প্রিয়াংশু, সবই তোমার জন্য সম্ভব হয়েছে। জেনি পর্ণ দুনিয়ায় একজন সেলিব্রেটি ছিল। আসলে সব ব্যবসাটাই তো ওর ছিল। আমি ছিলাম ওর একমাত্র সেক্রেটারি। ভেবেছিলাম জেনিকে প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে সবটা আমার নামে করে নেব। কিন্তু ওই অর্ণব সব বানচাল করে দিল। জেনিকে তো আর পর্ণ করতেই দিল না, আর সব ব্যবসায় নজর রাখত। কিন্ত আমার চোরা কারবারি ধরা পড়ার ভয় ছিল। তাই প্ল্যানটা পাল্টে ফেললাম, জেনির সৎ মায়ের মেয়ে ডেফির সাথে হাত মেলালাম। জেনি ডেফিকে খুব ভালোবাসত, কিন্তু ডেফি জেনিকে একদম সহ্য করতে পারত না। আর সেটাই আমার্ট্রাম্প কার্ড হল। জেনিকে ব্ল্যাক মেল করা শুরু করলাম যে সে যদি আমাকে পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি না দেয়, তাহলে ডেফিকেও পর্ণ দুনিয়ায় টেনে আনব আর জেনির শ্বশুর বাড়িতে সব জানিয়ে দেব। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। তারপরের ভূমিকায় তো তুমি আছ।”
প্রিয়াংশু মদের গ্লাস থেকে এক চুমুক মদ খেয়ে বলে, “হ্যাঁ ডব ইউ আর রাইট। ডব তুমি আমার সেই কবেকার বন্ধু। আমার যে আজ এত নামডাক, সবই তো তোমার জন্য। তোমার হয়ে কাজ করব না তো কার হয়ে কাজ করব! দেখ, তোমার কথা মত কেমন অর্ণবকে ড্রাগ পুশ করে দিয়ে পাগল করে দিলাম। আরে ডব, তোমার সঙ্গিনী ডেফি কই? আজ তো তোমাদের এনগেজমেন্ট।”
“দাঁড়াও আসছে, আর একটু ধৈর্য ধরো। আরে ওই তো এসে গেছে।”
একটা লাল গাউন পড়েছে ডেফি। আজকের দিনটা তার কাছে যে কতটা স্পেশাল সেটা তার চোখ মুখের উজ্জ্বলতাতেই প্রকাশ পাচ্ছে। লাল গাউনে তার রূপের লাবণ্য দ্বিগুণ হয়ে উঠেছে। ডেফির বাদামী চোখের উজ্জ্বল দৃষ্টি দিয়ে যে কোনও পুরুষকে আকর্ষিত করতে পারে। তার পোশাক সাজবেশ দেখেই আন্দাজ করা যায়, তার বৈভবময় জীবনযাত্রার ঝলক। জেনি ডেফির চেয়ে আরো বেশি সুন্দরী ছিল, আর সেটাও একটা হিংসার কারণ ছিল ডেফির কাছে। ডবসন আর ডেফির এনগেজমেন্ট পার্টিটা বেশ হৈ চৈ করে শেষ হল। তারা দুজনে পাশাপাশি দুটো রুম নিয়েছে। রাতে হঠাৎ ডেফির রুমের দরজাটাতে কে যেন সজোরে তিন চার বার ধাক্কা মারল। ডেফি বাইরে বেরিয়ে এসে দেখল কেউ নেই। সে আবার দরজাটা দিয়ে ওয়াশ রুমে ফ্রেশ হতে ঢোকে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই ডেফি ভয়ে আর্তনাদ করতে করতে ছুটে রুমের দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ে। তারপর ছোটে ডবসনের রুমের দিকে। জোরে জোরে ডবসনের দরজায় ধাক্কা দিতে থাকে সে, আর চিৎকার করতে থাকে, “ডবসন প্লিজ ওপেন দ্যা ডোর। হেল্প মি…” ডবসন নেশা ভরা চোখে দরজা খুলে বলে, “ডেফি কী হয়েছে, এ রকম দেখাচ্ছে কেন তোমায়? যেন মনে হচ্ছে তুমি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে আছ! কী হয়েছে” ডেফির গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। তার কণ্ঠস্বরই রোধ হয়ে গেছে, তবু হাঁপাতে হাঁপাতে ডেফি বলল, “ডবসন জেনির ভূত, আমি দেখেছি। অর্ণব ঠিক বলেছে জেনির আত্মা আমাদের পিছু করেছে। আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে। প্লিজ কিছু করো।” ডবসন ডেফির কথা শুনে হো হো করে হাসতে হাসতে বলল, “ড্রিংক তো আমিও করেছি, আমার মনে হয় তোমার একটু বেশি হয়ে গেছে। আমি বলেছিলাম “আজ এক সাথে থাকি।” এই বলে ডবসন ডেফির কোমরটা জড়িয়ে ধরল। তাকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। ডেফি আরও কিছু বলতে যাবে… কিন্তু তার আগেই ডবসনের উষ্ণ শ্বাস আর ঠোঁটের ছোঁয়া তাকে বাকহীন করে দিল। তার নরম কোমরের ভাঁজে ভাঁজে হাতের আঙ্গুল দিয়ে ডবসন আঁকিবুকি করতে লাগল। ডেফি আহ্লাদি বিড়ালের মত ডবসনকে আঁকড়ে ধরল। দুজনে যখন একে অপরকে চরম সুখ দেওয়ার জন্য উন্মত্ত হয়ে উঠেছে, ঠিক সেই মুহূর্তে দরজায় আবার কে যেন সজোরে ধাক্কা দিতে লাগল। ডবসন বিরক্তের সঙ্গে বলল, “এত রাতে কে জ্বালাতে এল, ডেফি একটু অপেক্ষা করো আমি দেখে আসছি।” ডেফি আশঙ্কার সুরে বলল, “না ডবসন যেও না। যদি… ”
ডবসন বলল, “তুমি এখনও এসব ভাবছ? বোকা মেয়ে, ওসব হয় না।” সে এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলে অবাক হয়ে যায় — সত্যি কেউ নেই। বিরক্ত হয়ে বলে, “এই ইন্ডিয়ান হোটেলগুলোতে কোনও প্রাইভেসি নেই। একেবারে বাজে।” এই বলে সে দরজাটা সপাটে বন্ধ করে দেয়। ঠিক তখনই দরজার কাছে আবছা আলোয় ফুটে ওঠে জেনির মুখটা। ডবসন চোখ রগড়ে আবার দেখে, তাও দেখতে পায় জেনি তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সে চেঁচিয়ে বলে, “ডেফি তুমি সত্যি বলে, জেনি… জেনির আত্মা…”
বিছানা থেকে বেরিয়ে ডেফি ওভার কোটটা চড়িয়ে ডেফি বলল, “কী বলছ! কোথায় আমি এখন দেখতে পাচ্ছি না তো…”
“এই তো আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে দেখতে পাচ্ছ না তুমি! কে তুমি, জেনি? তুমি তো মৃত। তোমাকে আমি মারিনি।” ডবসন যখন এসব বলছে, তখন ঘরের নাইট ল্যাম্পটা নিভতে জ্বলতে লাগল; একসময় পুরো ঘরটা অন্ধকার হয়ে গেল। ডেফি চিৎকার করে ডাকল, “ডবসন কোথায় তুমি, সব অন্ধকার। আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না। বাঁচাও, বাঁচাও আমাকে যেন কেউ টানছে।” কিন্তু ডবসনের কোনো সাড়াই পাওয়া গেল না। ডেফির চিৎকার ওই অন্ধকার ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে শুধু ধ্বনিত ও প্রতিধ্বনিত হতে লাগল।
ডেফি অচেতন হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। তার সামনে কিছু লোক ব্যাপারখানা জানার জন্য ঝুঁকে পড়ে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকে দেখছে। প্রিয়াংশু ডেফির চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে তার জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করছে। প্রায় দশ মিনিট বাদে, ডেফির জ্ঞান ফিরে এল। সে আতঙ্কের সাথে বলে উঠল, “ডবসন কোথায়? জেনি আমাকে মেরে ফেলবে।” প্রিয়াংশু ডেফিকে শান্ত করে জানায় যে কাল রাতে সুইমিং পুলে ডবসনের দেহটা পাওয়া গেছে। ডবসন আর নেই। দেহ পোস্ট মর্টেম করতে পাঠানো হয়েছে। ডেফি কান্নায় ভেঙে পড়ে।
পুলিশ তদন্তে নেমেছে। প্রিয়াংশু কয়েকদিনের জন্য ডেফিকে তার বাড়িতে রেখে দেয়। একদিন পর ডবসনের রিপোর্ট আসে মৃত্যুর কারণ অতিরিক্ত মদ্যপান। যেহেতু মোটা দরের কোনো প্রমাণ ছিল না, তাই কেসটা আর এগলো না। ডেফি এক সপ্তাহে নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়েছে। সে আজ শপিং করতে বেরিয়েছে। তাকে তার পছন্দের জিনিসপত্র কিনে নিতে হবে আজ, কারণ দু’দিন পর সে আবার নেদারল্যান্ডে ফিরে যাবে।
এদিকে প্রিয়াংশু চেম্বারে গিয়েছে। একটা মিটিংএ সে যখন খুব ব্যস্ত, ঠিক সেই সময় ডেফির ফোন আসে। ডেফি কান্না কান্না সুরে বলে, “প্রিয়াংশু, আমি মলের চেঞ্জিং রুমে আবার জেনিকে দেখেছি। বাঁচাও আমাকে… এবার ও আমাকে মেরে ফেলবে।” প্রিয়াংশু ডেফিকে আশ্বস্ত করে আর মলের সামনে অপেক্ষা করতে বলে। সে মিটিং থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে মলের কাছে যায়, কিন্তু ডেফি কোথাও নেই। প্রিয়াংশু তাকে ফোন করে, কিন্তু তার মনে হয় ফোনের রিংটোনটা খুব কাছাকাছি কোথাও বাজছে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে সে দেখে সামনের কার পার্কিংয়ের রাস্তায় তার ফোনটা পড়ে আছে। কিন্তু ডেফি কোথাও নেই। বাড়িতেও নেই। প্রিয়াংশু সব কথা পুলিশকে জানায়।
কিছুদিন পর প্রিয়াংশুর কাছে খবর আসে গঙ্গা থেকে একটা লাশ ভেসে উঠেছে। ডেফি। যদিও এতদিনে লাশটা ফুলে উঠেছে, তার পোশাক ও মুখের আদল দেখে অনুমান করা যায় ওটাই ডেফি। তার উপর মাছে শরীর খুপলে দিয়েছে প্রায়। এবার প্রিয়াংশুর মনে ভয়টা বেশ ভালো রকম নাড়া দেয়। কারণ সেও এই কুকর্মের সাথে একইভাবে জড়িত। সে অর্ণবের সাথে রিহ্যাবে দেখা করতে যায়। অর্ণব একটা দেওয়াল ভর্তি করে শুধু একটাই কথা লিখে যাচ্ছে জেনি সবাইকে শাস্তি দেবে। অর্ণবকে ডাকে প্রিয়াংশু। অর্নব ঘোলাটে দৃষ্টিতে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখে আর বলে, “জেনি যা চায় তাই হবে। পালিয়ে যা, সবাই পালিয়ে যা।” প্রিয়াংশু ভয় পেয়ে যায় আরও। বাড়ি গিয়ে রাতে তার ঘুম হয় না। সবসময় একটা ভয় তাকে পেয়ে বসে। কিন্তু সত্যি বলতে কী, সে মৃত জেনিকে সে দেখেনি। কয়েক মাস পর আসতে আসতে এই ভীতিটা তার কেটে যায়। সে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। কিন্তু সেই ভয় কে কি উপেক্ষা করা যায়? না উপেক্ষা করতে সেও পারেনি। এক ঝড় জলের রাতে প্রিয়াংশু তার চেম্বারে বসে বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করছিল, ঠিক সেই সময় টেবিলের সামনে দেখল জেনি দাঁড়িয়ে হাসছে। প্রিয়াংশুর সারা শরীরে তড়িৎ খেলে গেল। বাইরে বিদ্যুতের ঝলক যেন প্রিয়াংশুর মনে আতঙ্কের দামামা হয়ে গর্জে উঠল। সে বসার জায়গা থেকে উঠে পিছু হাঁটতে শুরু করল বাইরে অঝোর বৃষ্টির মধ্যে সে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ছুটতে লাগল। “বাঁচাও, বাঁচাও আমি মরতে চাই না,” বলতে বলতে হাইরোডের ওপর দিয়ে দৌড়াতে লাগল। পিছন থেকে একটা লোডেড ট্রাক এসে তাকে রাস্তার ওপর পিষে শেষ দিল।
সামনে বড়ো সবুজ মাঠ। চারিদিকে ফুলের মেলা, পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে নদী। আর সেই খোলা আকাশের নীচে একটা সাদা ধবধবে বাড়ি। বাড়ির ভিতরটা খুব সুন্দর করে সাজানো গোছানো আছে। মেঝেগুলো কাচের আয়নার মত চকচক করছে। সামনের সোফায় একজন বসে আছে, আরেক জন ঘরের চিমনির আগুন জ্বালাছে। সোফায় বসে থাকা ব্যক্তিটি চিমনির সামনে এসে বলল, “ডেফি তোমাকে অনেক থ্যাংকস। তোমার জন্য সব সম্ভব হয়েছে। আর তুমি এত বিশ্বাস করে যখন আমাকে সব সম্পত্তি ও ব্যবসার সব কিছু লিখে দিয়েছ, তখন আমারও দায়িত্ব এখন তোমার জন্য কিছু করার। এক কাজ করো তুমি তোমার দিদির জায়গাটা নাও।”
ডেফি উৎসাহের সাথে বলল, “অর্নব তাহলে তুমি আমাকে বিয়ে করবে সত্যি? আমি খুব খুশি।”
“না না আমি সেটা বলতে চাইনি। আমি বলছি, পর্ণ ইন্ড্রাস্ট্রিতে তোমার দিদি যা করত তুমি ও তাই করো।”
“কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি তো যা করেছি তোমার জন্য। এসব কাজ আমি কোনদিন করিনি। জেনি করতো। ও আমাকে এসব করতে দেয়নি। আর আমিও এসব পছন্দ করি না। আমি তো এয়ার পাইলটের ট্রেনিং নিয়েছি। না এসব কাজ আমি কোনও মতেই করব না। তোমার কথা মত ডবসন আর প্রিয়াংশুকে জেনির আত্মার ভয় দেখিয়েছি, ওদের মারতে তোমাকে যথা সম্ভব সাহায্য করেছি। এমন কি ডবসনের সব বেআইনি কারবার কৌশলে তোমার নামে করে দিয়েছি। তার প্রতিদান কি এটাই? তুমি তো বলেছিলে দিদির সম্পত্তির জন্য দিদিকে বিয়ে করছ। আর সেই থেকে তোমার প্ল্যান মতই আমি কাজ করেছি এতদিন। আর ফল কি এই?”
“না তোমাকে করতেই হবে। নাহলে আমি তোমার দিদি জেনি, ডবসন আর প্রিয়াংশুকে যেখানে পাঠিয়েছি তোমাকেও সেখানে পাঠিয়ে দেব। এক মিনিটও লাগবে না। এত দিনের পরিশ্রম আমি কী করে বৃথা হতে দিই। তোমাকে এই কাজ করতে হবেই,” অর্ণব বলল।
ডেফি রেগে গিয়ে বলল, “বেশি বাড়াবাড়ি করলে আমি পুলিশকে সব বলে দেব।”
“হা হা ভুলে যেও না তুমি ওদের নজরে মৃত। আর কী বলবে শুনি?”
“বলে দেব তুমি জেনিকে মেরেছ। আর আমার থেকে শিখে জেনির থ্রি ডি সিমিলার হলোগ্রাফি বানিয়ে সবাইকে ভয় দেখিয়ে মেরেছ।” দুজনের মধ্যে একটা কথা কাটাকাটি শুরু হয়ে যায়। এই সময় একটা ফুলদানি পড়ার আওয়াজ হয়। দুজনে ঘুরে দেখে জেনি সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অর্ণবের রাগ সপ্তমে গিয়ে পৌঁছায়।
সে বলে, “তোমার এত সাহস ডেফি…” এই বলে অর্ণব ডেফিকে সোফায় ফেলে তার গলাটা চেপে ধরে। ডেফি চাপা গলায় বলতে থাকে, “না অর্ণব আমি কিছু করিনি। আমি জানি না জেনির এই থ্রি ডি হলোগ্রাফি ইমেজ কে করেছে এখন। প্লিজ লাগছে আমায় ছেড়ে দাও। আমি তোমাকে ভালবাসি এটা কেমন করে করতে পারি?”
অর্ণব উন্মত্তের মত দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলল, “কী করে পারি! নিজের দিদিকে ফাঁসাতে পারো আর আমাকে নয়! আমি কিন্তু তা হতে দেব না। আমার পথে যেই বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে তাকেই মরতে হবে। নয় তুমি আমার কথা মত পর্ণস্টার হবে, নাহলে মরবে।” অর্ণবের মধ্যে লুকিয়ে থাকা হিংস্র দানব যেন সব ছারখার করে দেবে বলে জেগে উঠেছে। কিন্তু কে যেন অর্ণবের মাথার কাছে বন্দুক ঠেকিয়ে বলল, “তোমার খেলা শেষ অর্ণব…” অর্ণব ঘুরে দেখে এটা কোন থ্রি ডি’র তৈরি হলোগ্রাফি নয়, এ তো বাস্তবেই জেনি। অর্ণবের বুক শুকিয়ে আসে। ডেফির গলাটা ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সে বলে, “তুমি বেঁচে আছ! কিন্তু কী করে?” ডেফিও সোফা থেকে উঠে বসে বলে, “দিদি তুমি বেঁচে আছ!”
জেনি হালকা হেসে বলে, “মরেই তো গিয়েছিলাম কিংবা বলতে পারো মেরেই তো ফেলতে চেয়েছিলে আমাকে। কিন্তু পাপের শাস্তি দেওয়ার জন্যই হয়ত বেঁচে ফিরে এলাম। তোমাদের দুজনের মুখগুলো দেখে মনে হচ্ছে যেন ‘পালে বাঘ পড়েছে,’ গল্পটা শুনেছ নিশ্চয়ই? এতদিন আমার হলোগ্রাফি বানিয়ে তোমাদের পথের কাঁটাগুলোকে সরিয়েছ। এখন তোমাদের পালা।”
অর্ণব সেই মুহূর্তেই নিজের ভোল পাল্টে নিয়ে যত্নশীল সুরে বলল, “না জেনি তুমি ভুল বুঝছ, আমি তোমার অপরাধীদের শাস্তি দিয়েছি। এই ডেফি তোমার বোন যাকে তুমি নিজের থেকে বেশি ভালবাসতে, সে তোমাকে ঠকিয়েছে। আমি তো তোমাকে পাগলের মত এখনও ভালোবাসি। ডেফিকে তুমি নিজের হাতে শাস্তি দাও জেনি। তারপর আমরা দু’জনে অনেক দূরে চলে যাব। যাতে কেউ আমাদের কোন ক্ষতি করতে না পারে। তুমি বেঁচে আছ দেখে আমি যে কী শান্তি পেয়েছি, তা আমিই জানি…”
জেনি বলল, “তাই বুঝি! কিন্তু তুমি যখন আমাকে ধাক্কা দিয়েছিলে, আমি তখন এক ঝলকে স্পষ্ট ব্যালকনির আয়নায় তোমার মুখটা দেখেছিলাম। তাই নাটকগুলো আমার কাছে করা বৃথা। এবার বলি আমি বাঁচলাম কী করে? আমার মৃতদেহটা যখন সমাধি দিয়ে চলে গেলে তারপর হয়ত কেউ আমার আঙুলে থাকা হিরের আংটির লোভে আমাকে কবর থেকে তুলে আমার রিং ফিঙ্গারটা আংটি সহ কেটে নেয়। আর প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিল বলে আমাকে ওই অবস্থায় রেখে পালায়। কিন্তু ওইটাই আমার কাছে ঈশ্বরের আশীর্বাদ হয়ে ফিরে আসে। আমার সেন্স অরগ্যানগুলো আবার কাজ করতে শুরু করে। ওখানকার মালী আমাকে ওই অবস্থায় দেখে আবার কবর দিতে যায়। কিন্তু সে লক্ষ্য করে আমার জ্ঞান আছে। সে তখন আমাকে তার বাড়ি নিয়ে গিয়ে সুস্থ করে তোলে। আর সে আমার কথা মত কবরটাকে আগের মত করে সাজিয়ে দেয়, যাতে কারোর সন্দেহ না হয়। তুমি এদিকে একে একে লোক দিয়ে ডবসন আর প্রিয়াংশুকে যে হত্যা করো, সে খবর আর কেউ না জানুক আমি জেনে যাই। আমি চাইলে অনেক আগে তোমাদেরকে ধরিয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু তুমি ঠিক আবার কিছু ফন্দি এঁটে আমাকে মারার চেষ্টা করতে।”
অর্ণব বলে, “তা তুমি কি ভাবছ এখন বেঁচে যাবে? এখানে আমাদের কে চেনে? আমি তোমাকে এখানে মেরে পুঁতে দিলেই বা কে জানবে? ভালোই হল দুই বোনকে এক সাথে মারব। ওসব বন্দুকের ভয় পাই না আমি।” এই বলে টেবিল থেকে একটা ছুরি তুলে সে ডেফির গলার কাছে ধরে, আর জেনিকে তার বন্দুক ফেলে দিতে বলে। জেনি বাধ্য হয়ে তার বন্দুক ফেলে দেয় মেঝের ওপর। ঠিক সেই সময় কয়েকটা গুলির শব্দ… আর ডেফি মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে। ডেফির জামাটা লাল রক্তে ভরে গেছে। জেনি ছুটে গিয়ে ডেফিকে জড়িয়ে ধরে। ডেফি কাঁদতে কাঁদতে বলে, “দিদি আমাকে ক্ষমা করে দে, আমি তোর সাথে অনেক অন্যায় করেছি। আমাকে ক্ষমা করে দে…”
পাশে অর্ণবের অর্ধ মৃত দেহটা মাটিতে পড়ে আছে, পুলিশের গুলিতে প্রায় ঝাঁঝরা হয়ে গেছে সে। তবু সাইকো মানুষের মত হেসে হেসে ‘আমি সব শেষ করে দেব’ বলতে বলতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল সে। এরপর বিচারে ডেফির শাস্তি হয়। আর জেনি পর্ণ ইন্ড্রাস্ট্রি চিরতরে বন্ধ করে দেয়। আর এই নেদারল্যান্ডের জমিতে গড়ে তোলে অনাথ আশ্রম আর পিছিয়ে পড়া শিশুদের শিক্ষা কেন্দ্র। জেনি ইন্ডিয়ায় ফিরে আসে। ফিরে যায় বিষ্ণুপুরে অর্ণবের বৃদ্ধ বাবা-মার কাছে। যাঁদের কাছে তাঁদের সন্তান আজও নিরপরাধ।
সমাপ্ত