তান্ত্রিকের আরেকটি গল্প| পলক ফেলা নিষেধ | দীপঙ্কর মন্ডল| Bengali Thriller Story
0 (0)

গল্প সবসময় বানিয়ে লেখা হয় না কদাচিৎ দু’একখানা কাহিনী ভাগ্যক্রমে শোনা যায় যা লেখার তাগিদ সর্বদাই অনুভূত হয়। গল্প শুনে একে অযৌক্তিক অতীন্দ্রিয়বাদী মস্তিষ্কের কল্পনা বলে উড়িয়ে দিতেই পারেন তাতে আমার কোনও ক্ষোভ নেই কারন এ গল্প আমিও ষোলোআনা বিশ্বাস করি না। কিন্তু মুশকিল থেকে যায় বাকি দু আনায়। যাই হোক আসল কথায় আসি আজ যে কাহিনী আমি এখানে বলব তা সংগ্রহ হয়েছে এক অলস বর্ষনসিক্ত সন্ধ্যার আড্ডায়। আমাদের বাড়ি থেকে দশ মিনিটের হাঁটা পথে শশ্মান। নির্জন জায়গা। বিশেষ করে সন্ধ্যেবেলা উচ্চমার্গের চিন্তা এবং বায়ু সেবনের জন্য আদর্শ। এখানে দাহ কার্য বিশেষ হয় না বললেই চলে। শ্মশানের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ভাগীরথী হুগলি নদী।

আমি মাঝে মাঝে সে শ্মশানে যাই গান শুনতে। গানের আসরে কদাচিৎ দুএকজন ওস্তাদ লোক আসেন। রোজকার বাউল কীর্তনের ফাঁকে তারা বাজিয়ে শোনান আশাবরী বা কাফী। তারই লোভে যাওয়া। এই গান শুনতে গিয়েই পরিচয় হয় বিজ্ঞ ঠাকুরের সঙ্গে।

বিজ্ঞ ঠাকুরের আসল নাম বিজ্ঞানন্দ। ওঁকে কেউ জিজ্ঞাসা করলে এই নামটাই বলেন। এই নামটি নাকি ওঁর গুরুদেবের দেওয়া। তান্ত্রিক মানুষ এই অর্থে যে উনি কালী সাধক এবং এককালে তার চর্চাও করেছেন। এমনিতে সর্বদা রক্ত কৌপিন পড়েন না বা কপালে রক্ত চন্দনের ফোটা বা কন্ঠে রুদ্রাক্ষের মালাও নেই। একসময় তন্ত্রসাধনা করলেও এখন আর তার চর্চা করেন না। ভগবান বুদ্ধের মতো কঠিন সাধনার পথ ছেড়ে মধ্যপন্থা অবলম্বন করেছেন। একসময়ের কঠোর জীবন যাপনের ফলে পঁচাত্তর বয়সেও তিনি অনেক তরতাজা। ফর্সা গায়ের রং আর কাধপর্যন্ত ঝোলানো কাঁচা পাকা চুল। কথার ফাঁকে ফাঁকে হাত বোলান সাদা গোফদাড়িতে। আমি তাকে ঠাকুরমশাই বলেই ডাকি। ঠাকুরমশাই শুনলে অনেকের মনে হতে পারে তিনি রাশভারী লোক। তিনি কিন্তু মোটেও সেরকম নন। বিশেষ করে আমাকে পেলেই বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে গল্প বলতে শুরু করেন। গল্পের বিষয় কখনও অলৌকিক বা কখনও তার জীবনে ঘটে যাওয়া হাস্যরসাত্মক ঘটনা।

অনেক দিন বিজ্ঞ ঠাকুরের আস্তানায় যাওয়া হয়নি। আজকে আকাশের যা অবস্থা তাতে না যাওয়াটাই ভালো। ঘন কালো মেঘ টহল দিচ্ছে আকাশে যাতে বাড়ি থেকে কেউ বার না হয়। তার ওপর তার গর্জন। মেঘের চোখ রাঙ্গানির ভয়ের চাইতে বিজ্ঞ ঠাকুরের গল্পের টানটা আজকে বেশি মনে হচ্ছে।

ইতস্তত ভাব কাটিয়ে ছাতাটা নিয়ে বার হলাম। একফোঁটা দুফোটা করে বৃষ্টি পড়ছে। বোঝাই যায় গুছিয়ে নামবার আগের মহড়া।

আজকে শ্মশানে ঢুকতেই গাটা ছম ছম করে উঠলো। তিথি নক্ষত্র যাই থাক আকাশ ঘনকৃষ্ণ মেঘে আচ্ছাদিত থাকার কারণে চারিপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। গুরুগম্ভীর মেঘের ডাকে একটু চমকে উঠলাম। বটগাছের তলায় মন্দিরের প্রদীপের টিম টিমে আলো দেখা যাচ্ছে। বাঁ পাশে মন্দির লাগোয়া বিজ্ঞ ঠাকুরের ঘর। মন্দিররের অদূরে আরেকটি বেড়াবিহীন ঘরে গানের আসর বসে। সেখানে আজকে জাঁকজমক কম। বৃষ্টির কারণে সেখানে অনেকেই আসেনি। দুএকজনকে দেখা গেল গল্পগুজব করতে। একটু কাছে যেতে দেখলাম ঢোলবাদক নিতাইয়ের যায়গায় বসে আছে হরি। ঢোলে বেতাল চাটি মেরে সে সবাইকে সজাগ রাখার চেষ্টা করছে। হরির এহেন বেতালা চাটিতে ঢোলটি যে বিশেষ বিরক্ত তা ঢোলের বোলেই বোঝা যায়। আমি সোজা হেঁটে মন্দির প্রাঙ্গণে এসে উঠলাম।

ঠাকুরমশায়ের ঘরখানি অন্ধকার। বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল উনি ঘরে নেই নাকি। আজকে আসাটা তাহলে বৃথাই হল? আজকে তো শুক্রবার, ঠাকুরমশাইয়ের চেম্বার থাকবার কথা নয়। বৃথা আসা নিয়ে দরজায় টোকা দিচ্ছি আর আড়ে আড়ে ডানদিকে দেবীমুর্তির দিকে দেখছি। ছিন্নমস্তা কালীর মূর্তি। এর পুজো শ্মশানেই হয়। কাম রতির ওপর দণ্ডায়মানা আলুলায়িত কুন্তলা পীনোন্নত পয়োধরা নাযজ্ঞোপবীতধারিনী এই মূর্তি কালিমায়ের সবচাইতে ভয়ঙ্কর রূপ। দেবী ডানহাতের কাতরি দিয়ে নিজ মুণ্ড ছিন্ন করে বাম হাতে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। কবন্ধ থেকে উৎসারিত রক্তের ত্রিধারা বামে ডাকিনী ডানে বর্ণনির এবং আরেকটি নিজের মুখে গিয়ে পড়েছে।

দরজায় টোকা পড়তেই ঠাকুরমশাই এর গম্ভীর গলা শোনা গেল, দাঁড়াও খুলছি। ঘরের ভেতরে আলো জ্বলে উঠল। তিনি দরজা খুলে বললেন, এসো এসো।

ঘরে ঢুকতে ঢুকতে জিজ্ঞাসা করলাম, ঘর অন্ধকার করে রেখেছেন কেন?

তিনি জবাব দিলেন, কোন কাজ নেই চুপচাপ বসেছিলাম। এমনি এমনি আলো জ্বালিয়ে কী করব? খুব জোর বৃষ্টি নামবে মনে হচ্ছে। তোমার হাতে ওইগুলো কি?

বললাম, পেয়াজি আর মুড়ি। শুধু মুখে কি আর গল্প জমবে তাই নিয়ে এলাম। ঠাকুরমশাই টেবিলটা ফাঁকা করতে লাগলেন। ঘরখানি জিনিসপত্র ঠাসা হলেও বেশ গোছানো। দেয়ালজুড়ে কয়েকটি কাঠের রেক কর্তি কাচের শিশি। দেয়ালের উত্তর পাশে ছোট একখানি তক্তাপোশ আর তার সামনে টেবিল। ঠাকুরমশাই শুধু শ্মশানের সাধক পূজারী নন। তিনি একজন ডাক্তার, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করেন। এই বিষয়ে তার ডিগ্রী আছে। তিনি বেশ অব্যর্থ ওষুধ দিতে জানেন। তিনি হোমিওপ্যাথি নিয়ে পড়াশোনা শেষ করে কোন অজানা কারণে ঘর বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন ঈশ্বর সন্ধানে। বহু জায়গায় ঘুরে শেষে এইখানে এসে থিতু হন। এখান থেকে কিছুদূরে একটা বাজার, সেইখানে তার ছোট্ট একটি ডিসপেনসারি রয়েছে। তাকেই তিনি বলেন চেম্বার।

ঘরের এক কোনায় খুঁজে পেতে দুটি লঙ্কা নিয়ে এলেন তিনি। একমুঠো মুড়ি তুলে মুখে দিতে যাব এমন সময় ফস করে কারেন্ট চলে গেল। জানতাম যাবে। ঠাকুরমশাই হ্যারিকেন জ্বালিয়ে বসলেন। একগাল মুড়ি মুখে পুরে বললেন, একবার ভেবেছিলাম যে একজন ভৈরবি জোটাই। এইসব টুকিটাকি কাজ করতে একসময় আর ভালো লাগত না।

-জোটালেই পারতেন। কে বারণ করেছিল?

-কেউ বারণ করেনি। নিজেই নিজেকে নিরস্ত করেছিলাম একটা ঘটনার পর।

এইবার ঠাকুরমশাই গল্পের খাতা খুলবেন। তিনি বলতে লাগলেন, তখন আমার বয়েস কত হবে, ওই পঁয়তাল্লিশ। এ শ্মশানে এসেছি ততদিন দশবছর হয়ে গেছে। পুজোর মাসখানেক পরে হঠাৎ একদিন এখানে এসে ডেরা বাঁধল এক তান্ত্রিক আর তার সাধনসঙ্গিনী। এই জুটিকে সাধারণত বলা হয় ভৈরব আর ভৈরবী। সেই ভৈরবের নাম ছিল কালোবরণ আর ভৈরবীর নাম ছিল তারা। এই তারার ওপর আবার তারা ভর করতে।

-তারায় তারা ভর। ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না।

-হ্যা ব্যাপারটা তাই। তারার ওপর সন্ধের পর ভর হত কালীমায়ের অর্থাৎ তারা মায়ের। সন্ধের পর বিস্তর লোক জুটত সে আসরে। কেউ আসত বহুদিনের বাতের ব্যাথা সারাতে, কেউ আসত কানের দুল পুকুরের ঠিক কোন জায়গায় জাল ফেললে পাওয়া যাবে তার সন্ধান নিতে। সবাই সঙ্গে করে নিয়ে আসত ফল মূল কলা মূলো ইত্যাদি। অনেকে নগদ টাকাও দিত। এতে দুজনের বেশ ভালো আয় হত। তারা ছিল নিপুণ অভিনয় পটিয়সী। আমি সাধক মানুষ, মায়ের ভর যে ওই ভাবে হয় না তা আমি জানি।

যখন কোন ভক্ত থাকত না তখন লক্ষ্য করে দেখেছি ভৈরব ভৈরবীতে মোটেই সদ্ভাব নেই। দু’জনের মধ্যে ঠোকাঠুকি লেগেই থাকত।

একদিন দুপুরে দেখি কালোবরণ সত্যি সত্যি ভৈরব মূর্তি ধারণ করেছে। তারার চুলের মুঠি ধরে কিল মারতে মারতে টেনে বারান্দায় নিয়ে এসেছে। আমি দৌড়ে গিয়ে তারাকে ছাড়ালাম।

সেদিন শীত পড়েছে জাঁকিয়ে। সন্ধ্যার পরে একজন দুজন করে ভক্ত আসত লাগল। সন্ধের পর পরই ভর হবে। বেশ কিছু ভক্ত জুটতেই তারা বেরিয়ে এল ঘর থেকে চুল উস্কো খুস্কো চোখ লাল। মাথা ডাইনে বাঁয়ে ঘোরাচ্ছে। কালোবরণ হাত জোর করে সামনে এসে বসলো। এটা ওদের রোজকার কর্ম।

এমন সময় একজন মহিলা সামনে এসে হাত জোর করে শুয়ে পড়ে বলল, আমার মেয়েটাকে বাঁচাও মা। দিন দিন কেমন শুকিয়ে যাচ্ছে।

তারা ঘোর লাগা কন্ঠে বলল, যা ঘরের ভেতরে একটা কলসি আছে নিয়ে আয়।

মহিলা, যাই মা, বলে কলসি আনতেই ভৈরবী তারা কালোরনকে বলল, যা খালে গিয়ে তিন ডুব দিয়ে এক কলসি জল নিয়ে আসবি।

কালোবরণ প্রমাদ গুনল। এই ঠান্ডায় জলে ডুব দেওয়া আর বোলতার চাকে হাত বোলানো একই ব্যাপার। কিন্তু কালোবরণ কি আর করে মা তারার আদেশ। অবশেষে তাকে তাই করতে হয়েছিল। এভাবেই তারা দুপুরের মারের প্রতিশোধ নিয়েছিল কালোবরণের ওপর। কথায় আছে না স্ত্রী বুদ্ধি ভয়ঙ্কর। তার নমুনা অন্য অর্থে হলেও সেই দেখেছিলাম। তারপর থেকে আর ভৈরবীর আশা করিনি।

মুড়ি বেগুনি শেষ। উঠে হাত ধোবার জন্য দরজা খুলতেই বৃষ্টির তাড়া খেয়ে একরাশ ঠান্ডা হাওয়া ঘরের মধ্যে ছুটে এল। বাইরে মেঘ ভেঙ্গে বৃষ্টি নেমেছে। হ্যারিকেনের আলো ঘরের ভিতরে যে পরিবেশ‌‌ সৃষ্টি করেছে তা বিশেষ একরকম গল্পের জন্য উপযুক্ত। ঠাকুরমশাইকে সন্তর্পনে সেইদিকে নিয়ে যাওয়াটাই এবার আমার লক্ষ্য।

জামার খুঁটে হাত মুছতে মুছতে ঠাকুরমশাইকে জিজ্ঞাসা করলাম ঠাকুরমশাই এই ছিন্নমস্তা দেবীর দুপাশের এই ডাকিনী, বর্ণনী এরা কি পিশাচ?

বড় এক টিপ নস্যি নিয়ে রুমাল দিয়ে নাক‌ ঝেড়ে তিনি জবাব দিলেন, না এরা পিশাচ নয়, শিবের সহচর যেমন নন্দী ভৃঙ্গী তেমনি দেবী ছিন্নমস্তার সহচর ডাকিনী বর্ণনী। এদের যদি ক্যাটাগোরাইজ কর তো এরা হল যোগিনী সম্প্রদায়ভুক্ত।

ঠাকুরমশাইয়ের মুখে এই ক্যাটাগোরাইজ কথাটা ঠিক পায়েসে জিরে দেওয়ার মতো শোনাল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে এই পিশাচ কারা ঠাকুরমশাই?

তিনি বললেন, সহজ ভাষায় যদি বলি এই পিশাচ হল গিয়ে নিচ কোটির একটি ভয়ানক জীব। এ মহাজগতের অনেক স্তর হয়। তোমরা আধুনিক বিজ্ঞান জানা আজকালকার ছোকরা। তোমাদের বিজ্ঞানও নাকি এই মহাবিশ্বের বিভিন্ন স্তরের ব্যাপারটা মেনে নিয়েছে?

ঠাকুরমশাইয়ের গল্পের ফাঁকে বিজ্ঞানের যুক্তি টেনে গল্প মাটি করার কোনও প্রবৃত্তি হল না। বললাম, হু তারপর?

-আমাদের সাধনার ভাষায় এই স্তরগুলকে বলা হয় শিবলোক, ব্রক্ষলোক, চন্দ্রলোক এইসব। এই সব লোক একাধারে যেমন স্তর তেমন স্থানও। তো এই পিশাচ হল ভিন্নস্তরে থাকা এক প্রকার মহাশক্তিধর অশরীরী। এরা আমাদের দেহ গঠনের সংজ্ঞায় অশরীরী হলেও কখনও কখনও দেহ ধারণ করতেও সক্ষম। এদের জন্ম হয় প্রেতযোনিতে। এই প্রেতযোনি ব্যাপারটা তোমাকে বুঝিয়ে বলি—

আমি দেখলাম মূল গল্প থেকে সরে যাচ্ছেন ঠাকুরমশাই। বললাম, আপনি তো বলেন বহু শ্মশান ঘুরে বহু সাধনা করেছেন, আপনি কখনও এই পিশাচ সাধনা করেননি?

-দশমহাবিদ্যার সবকটি সাধনা করলেও ও সাধনা কখনও করিনি। এগুলো ভালো সাধনা নয়। এর সাথে ঈশ্বর সাধনার কোন যোগ নেই। এই সাধনায় সাধক আবাহন করে পিশাচিনী। আর তাকে বশ মানিয়ে সাধক প্রাপ্ত হয় বিশেষ ক্ষমতা। শুধুমাত্র এই ক্ষমতার লোভে সাধক প্রবৃত্ত হয় এই সাধনায়। তোমাকে একটা উদাহরন দিলে ভালো বুঝবে। যেমন ধরো কর্ণপিশাচিনী সাধনায় যদি কেউ সিদ্ধ হতে পারে সে হতে পারে ভূত-ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা শুধু তাই নয় সে যে কোনও নারীর রূপ ধরে তুষ্ট করে সাধককে। তবে এর বিনিময়ে সাধককে ভয়ঙ্কর মূল্য দিতে হয়।

-আপনি এ জাতীয় সাধক দেখেছেন?

-তা দেখেছি বৈকি এমনকি এ শ্মশানেই দেখেছি।

-সে ঘটনাটাই শুনিনা তবে।

আরেকটিপ নস্যি নিয়ে, দুবার নাক টেনে ঢোক গিলে বলতে শুরু করলেন ঠাকুরমশাই, সে বহু বছর আগের কথা । বহু জায়গায় ঘুরে নানাবিধ সাধনার পরে থিতু হলাম এই শ্মশানে এসে। এখন তো পাকা মন্দির দেখছো তখন ছিল দরমার বেড়া আর খড়ের চালের মন্দির।‌ আর এ জায়গাটাও ছিল জঙ্গলা। ওই খালের পাড় দিয়ে ছিল ছোট ছোট আশশেওড়া সহ নানাবিধ গুল্মের ঝোপ। আরও পশ্চিমে গেলে বড় বড় গাছের জঙ্গল। এখন তো দেখছি ওইদিকে জঙ্গল সাফ হয়ে পাড়া বসে গেছে। তখন এখানে শিয়াল ছাড়াও বাঘরোলও দেখতে পাওয়া যেত। এখানে আসতে দেখলাম বটগাছের গায়ে মন্দিরের পেছনে একটি কুঁড়ে ঘর রয়েছে। তার সামনে এসে দেখি এখানে আরও দুজন তান্ত্রিক রয়েছেন। একজন সত্তরোর্ধ্ব আরেকজন ত্রিশের এর আশেপাশে বয়স। একজন গুরুদেব আরেকজন তার চ্যালা। শ্মশানে নতুন এসেছি। গিয়ে গুরুস্থানীয় তান্ত্রিককে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম ঠুকলাম। মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন তিনি। এরপর পাশে আরেকটি ছোট কুটির নির্মাণ করে সেখানেই থাকতে শুরু করলাম।

গুরুদেবের সঙ্গে যে শিষ্য ছিল তার নাম ছিল বানীভূষণ আর গুরুর নাম ছিল কৃষ্ণাচার্য। একে আবার মেখলা, কনখলার গুরুদেব ভেবো না। মেখলা, কনখলার গল্পটা বলেছি তোমায়? যারা তাদের গুরুদেবকে নিজেদের মাথা কেটে নিবেদন করেছিল।

ঠাকুরমশাইয়ের এই এক সমস্যা আসল গল্প বলতে গিয়ে গল্পের উপশাখায় ঢুকে যান আর সে পথে গিয়ে সমুদ্রে মিশে যান। কোনও দিন হয়তো গল্প শুরু করলেন ধূমাবতী দেবীর সাধনা দিয়ে শেষ করলেন হেপার সালফেট আর ব্রায়োনিয়া প্রয়োগ নিয়ে। আমি বললাম, না বলেননি তবে সেটা পরে একদিন শোনা যাবে। আপনি বানীভূষণ আর কৃষ্ণাচার্যের ঘটনাটা বলুন।

-আচ্ছা। তা এই কৃষ্ণাচার্য আগমশাস্ত্রে ছিলেন বিশেষ পারদর্শী কিন্তু বানীভূষণ কে প্রথম থেকেই আমার অপছন্দ ছিল। লক্ষন দেখে সাধক চেনা যায়। রুদ্রযামল তন্ত্র মতে সাধক হবেন বীরাচারী। ছয় রিপু হবে তার বশবর্তী। বানীভূষণ যে রিপুর বশীকরণ শিখতে আসেনি তাই কয়েকদিনেই বোঝা গেল। মারন, উচাটন, সম্মোহন এইসব নিম্নাঙ্গের সাধনা শেখাটাই তার মূল উদ্দেশ্য।

সে যাই হোক, বানীভূষণ পারতপক্ষে আমায় ঘাঁটায় না আর আমিও বানীভূষণ কে এড়িয়ে চলি। এভাবে কিছুদিন চলার পরে একদিন দেখি আমার প্রতি বানীভূষণের ভারী বন্ধুভাব জেগে উঠেছে। অকারণে আমার কুটিরে এসে খেজুরে আলাপ জোড়ে। বানীভূষণের শাস্ত্রজ্ঞান ছিল কাকের সংজ্ঞীত জ্ঞানের মতোই। এভাবে অনর্থক কথোপকথন কতক্ষন আর চালানো যায়। তার এহেন আচরণের কারনটা কিছুতেই স্পষ্ট হচ্ছিলো না। একদিন ঘুঘু তার ধানের গোলার খবরটা বলল‌। বানীভূষণ প্রেমে পড়েছে। আমি শুনে তো ভীষন মুষড়ে পড়লাম। এ সহজে আমাকে ছাড়বে না। প্রেম হল গিয়ে একরকমের পেটের অসুখে। এ অসুখে পড়লে পেটে কথার গোলা ফুলে ফেঁপে ওঠে। কাউকে সে কথা না বলতে পারলে আলসার পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে। তো বানীভূষণ রোজ সন্ধ্যেবেলায় আমাকে নদীর পাড়ে ডেকে নিয়ে সারাদিনের ধারাবিবরণী শোনায়।

মেয়েটির নাম মালতি। শ্মশান থেকে রাস্তা বেরিয়ে পাড়ার ভেতরে ঢোকার মুখে তখন একটা বারোয়ারী জলের কল ছিল। বানীভূষণ সেখানেই মালতিকে জল নিতে দেখেছে। এখন কৃষ্ণাচার্য বানীভূষণ কে যখন তখন ডেকে আর পান না। জঙ্গলে কাঠ আনতে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বানীভূষণ হয়তো কোনও গাছের গোড়ায় বসে ঘন্টা দুয়েক কাটিয়ে দেয় অথবা সে চলে যায় জল আনতে। বানীভূষণের তখন ওই কলের জল ছাড়া অন্য কলের জল রোচে না।

হঠাৎ একদিন দেখি বানীভূষণের মুখে আষাঢ়ের মেঘ। বিকেলে যথারীতি বানীভূষণ আমাকে ডেকে নিয়ে গেল নদীর পাড়। বুঝলাম গুরুতর কিছু হয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে বানী।

বুকের চাপা রাগের স্তর ভেদ করে বানীভূষণ বলল, আজকে কলে গিয়ে দেখি আজকে মালতী একা এসেছে। ওকে বললাম যে আমি ওকে ভালবাসি। এই কথা শুনে ও কলসি নিয়ে প্রায় তেড়ে এল! বলল এক্ষুনি এখান থেকে চলে যা নয়তো এই কলসি তোর মাথায় ভাঙ্গবো। এতবড় অপমান।

একথা শুনে আমার পেল হাসি কিন্তু যা পরিস্থিতি তাতে আমার কাঁদা উচিত। বানীভূষণের চেহারার বর্ননা তো তোমায় দিইনি। বেঁটে খাটোর চাইতে ইঞ্চি খানেক লম্বা। গাঁয়ের রং একদম কালো বলা যাবে না। কিন্তু মুখে তার কূটিল চিন্তার একটা স্থায়ী সিলমোহর ছিল। যা দেখে হয়তো মালতীর পছন্দ হয়নি। এদিকে বানীভূষণ ও দ্বিতীয়বার প্রস্তাবের কোনও উৎসাহ পাচ্ছে না কারন অনেকেই তখন মাটির কলসি নিয়ে জল নিতে এলেও মালতীর কলসিটা ছিল পেতলের।

হঠাৎ বানীভূষণ বারোয়ারী কলের জলে একটা দুর্গন্ধ পেতে শুরু করল। সে আর ওই কলে জল আনতে যায় না। এরপর কিছুদিন বানীভূষণ থম মেরে রইল। তারপর সে হঠাৎ একদিন সাধনায় মনোনিবেশ করল। রাতের বেলায় জঙ্গলের পাশে গিয়ে আগুন জ্বালিয়ে হোম যজ্ঞ করে।

আমি বললাম, যাক মালতী তাহলে ফনীভূষনের চেতনার আগুনে ঘি ঢালতে পেরেছিল।

ঠাকুরমশাই গল্পে বাঁ হাত দেবার জন্য একটু বিরক্ত হলেন। বললেন, আরে পুরোটা আগে শোনোই না।

-আচ্ছা বলুন।

-বানীভূষণ হোম যজ্ঞ করে ভালো কথা কিন্তু তার হোম যজ্ঞের উপকরণ দেখে বুঝলাম সে আর কিছুই না মালতীকে বশীকরণ করার জন্য এই সব করছে। ছিন্নমস্তা ‌কালীর মন্ত্রে আছে, মুন্ডকর্তৃধরা রক্তা সাধকাভীষ্টদায়িনী। বর্ণিনীডাকিনিযুক্তা সাপি মামভিতোহবতু ইত্যাদি ইত্যাদি। লম্বা এই মন্ত্রের শেষ অংশটুকু ব্যবহৃত হয় বশীকরণের জন্য।

বানীভূষণ  তখন রাগে অন্ধ। সে বুঝতে পারছে না সে মহাবিদ্যা নিয়ে ছেলেখেলা করছে। তন্ত্রবিদ্যা ইশ্বরলাভের এক গূঢ়বিদ্যা। বানীভূষণের মতো লঘুচিত্তের মানুষেরাই এ বিদ্যাকে ধুলোয় টেনে নামিয়েছে।

আমিও সংকল্প করলাম মালতীর এ সর্বোনাশ হতে দেব না। আমিও গোপনে তৈরী করলাম রক্ষাকবচ। এখন মুশকিল হল তা মালতীকে দেই কি করে? শেষে আমিও বানীভূষণের মতো জল নেবার সময় মালতীকে ধরলাম। কেন জানিনা মালতী আমায় বিশ্বাস করল। আমার দেওয়া কবচ সে হাতে পরে রাখল। এইদিকে বানীভূষণের কোনও‌ তন্ত্রমন্ত্রে কাজ হয় না দেখে শেষে সে একসময় হাল ছেড়ে দিল।

ঠাকুরমশাই একটু থামতেই আমি বললাম, এর মধ্যে তাহলে কর্ণপিশাচিনী কোথায়।

ঠাকুরমশাই হ্যারিকেনের আলোটা একটু কম করে বললেন, আসল গল্প তো এখনো শুরুই করিনি। তোমার কি তাড়া আছে তাহলে না হয় পরে একদিন বলবো।

ঠাকুরমশাই বলে কী! এতো মই নিয়ে টানাটানি। আমি ব্যাতিব্যস্ত হয়ে বললাম, না না তাড়া কিসের? আপনি বলতে থাকুন।

ঠাকুরমশাই আবার শুরু করলেন, বানীভূষণ কিছুদিন চুপচাপ থাকবার পরে একটা ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্ত নিল। সে মালতিকে যে পাবে না তা সে বুঝে গেছিল। তার অবদমিত কাম ক্রোধ প্রশমিত করবার জন্য সে গ্ৰহন‌ করেছিল অন্য পন্থা।

একদিন রাতের দিকে কৃষ্ণাচার্য আর বানীভূষণের কথার শব্দে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। কাছে পিঠে কোথাও শিয়াল ডাকছে। তার ফাঁকে ভেসে আসছে বানীভূষণের গলা, আমি তো শব সাধনা করেছি। আমি পারবো এই সাধনা।

কৃষ্ণাচার্য একটু উত্তেজিত কন্ঠে বলল, তুই জানিস এর পরিণাম কি হতে পারে?

 -হ্যাঁ জানি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

-না, তাহলে জানিস না। কর্ণপিশাচিনীর হাত থেকে মৃত্যুর পরেও রেহাই নেই।

-আমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারব সে শক্তি। আপনার আশীর্বাদে কোন সাধনায় ভয় পাইনি এ পর্যন্ত। আপনি আমায় অধিকার দিন গুরুদেব।

বড় কাতর শোনাচ্ছে বানীভূষণের গলা। কৃষ্ণাচার্য একটু নিরব থেকে বললেন, এখন শুয়ে পড় কাল রাত্রে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেবো তোকে।

এরপর দুজনেই নিরব। আমি বাইরে বেরিয়ে এলাম। রাত্রি দ্বিপ্রহর হবে। চিন্তিত মুখে পদচারণা করতে লাগলাম বাইরে। বানীভূষণ কর্ণপিশাচিনী সাধনা করবে! এ বড় ভয়ঙ্কর সাধনা। যে স্থানে এ সাধনা করা হয় সে স্থানও আর নিরাপদ থাকে না। এ সাধনার জন্য শ্মশানের চাইতে গভীর জঙ্গলই প্রসস্ত। কর্ণপিশাচিনী কোন ভুত-প্রেত নয়। এ গুপ্ত স্তরে থাকা দুর্বার শক্তিধর পিশাচ। এ সাধনায় সিদ্ধ হলে কর্ণকুহরে সর্বদা ফিসফিস করে কথা শোনা যায়। এমনকি ঘুমের মধ্যেও তার বিরাম নেই। সাধকের যে কোনও প্রশ্নের নিখুঁত উত্তর দেয় কর্ণপিশাচিনী। যে কোন নারীর রূপ ধরে সাধকের লালসা চরিতার্থ করে সে। ধীরে ধীরে সাধকের সমস্ত জীবনীশক্তি শুষে নেয় সে। সাধকের মৃত্যু নয় তো মস্তিষ্কের বিকার এই সাধনার শেষ পরিণতি।

বানীভূষণ নিষ্ঠাভরে তার গুরুদেবের পদসেবা করেছে বহুদিন। কৃষ্ণাচার্য আর না করতে পারলেন না শিষ্যকে। এরপর কয়েক রাত্রি ধরে হল শিক্ষাদান পর্ব। আসন বন্ধনী মন্ত্র আবাহন মন্ত্র সহ বাকি সমস্ত ক্রিয়াকর্ম শিখিয়ে দিলেন শিষ্যকে। আমি সন্ধ্যার পর ধুনি জ্বালিয়ে বসে থাকি বাইরে। আর বানীভূষণকে দেখি একে একে জোগাড় করছে সমস্ত উপাচার।

বানীভূষণ আমার সঙ্গে প্রায় কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। সারাদিন সে প্রায় ব্যস্ত থাকে। কখনও জঙ্গল থেকে কেটে নিয়ে আসে বাবলার ডাল কখনও বা চলে যায় রক্ত চন্দনের খোঁজে। এভাবে অবশেষে তার সমস্ত জোগাড় যন্ত্র সারা হল। এইবার আসন প্রস্তুত করবার জন্য উপযুক্ত জায়গা খুঁজতে লাগল সে। এ সাধনা লোকচক্ষুর আড়ালে করাটাই শ্রেয়।

শ্মশান থেকে একটু দক্ষিনে জঙ্গলের ওপারে নদীর পাড়ে গিয়ে যে বেলাভূমি পড়ে সেখানে তৈরি হল আসন। এ সাধনায় সাধককে একটি গণ্ডি কেটে তার মধ্যে সাধনা করতে হয়। সাধারণত এগারো দিন থাকতে হয় সেখানে। সাধন চলাকালীন ওই গন্ডি ছেড়ে বেরোনো চলবে না। এ ক’দিনে সাধককে লক্ষাধীক বার কর্ণপিশাচিনীর মন্ত্র উচ্চারণ করতে হয়। সাধককে সেই গণ্ডির মধ্যে দক্ষিণ মুখী হয়ে বসতে হয়। সামনে থাকে সাধন স্থল।

কৃষ্ণপঞ্চমীর দিন বানীভূষণ সমস্ত উপাচার পুটলিতে বেঁধে কৃষ্ণাচার্যকে প্রণাম করে চলল সাধন ক্ষেত্রে। সন্ধের আঁধারে বানীভূষণ মিলিয়ে গেল জঙ্গলের দিকে। বানীভূষণ চলে গেলে কৃষ্ণাচার্য একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কুটিরে প্রবেশ করলেন। শত হলেও বহুদিনের শিষ্য তো। প্রায় সন্তানের মতোই দেখতেন বানীভূষণ কে।

দুতিন দিন কেটে যাবার পর বানীভূষণের চিন্তা অনেক দূর হয়ে গেল। কৃষ্ণাচার্যের নিত্য নৈমিত্তিক কাজকর্ম আমিই করে দিই। মাঝে একবার ভেবেছিলাম এ যায়গার পাট চুকিয়ে অন্য কোথাও চলে যাই। কৃষ্ণাচার্য প্রবীন সাধক, তাকে ছেড়ে যেতে মন চাইছিল না। যত দিন যায় তত এই প্রাচীন বিদ্যা লঘু হয়ে পড়ে। কৃষ্ণাচার্য ছিল সেই আদি বিদ্যার ধারক তাই তার সঙ্গ লাভ করে আমার তাতে অনেক উপকারই হয়েছে।

এভাবে একদিন দুদিন করে দিন ছয়েক কাটল। আমি সচরাচর জঙ্গলের দিকটা তেমন যাই না। সেদিন দেখলাম ধুনির কাঠ প্রায় শেষ। সারাদিন বিভিন্ন কাজে সেটা খেয়াল হয়নি। এদিকে বিকেল হয়ে এসেছে। রান্নার জন্যও কিছু কাঠ প্রয়োজন। অগত্যা রওনা হলাম কাঠ আনবার জন্য।

নদীর পাড়ের এ জঙ্গল খুব বেশী একটা বড় ছিল না। সঙ্গে একটা দা নিয়ে এলাম শুকনো কাঠ নিচে পাওয়া না গেলে গাছের ওপরে শুকনো‌ ডালপালা কাটবার জন্য। জঙ্গলের এপাশে একবার ঘুরে তেমন কাঠ না পেয়ে দক্ষিণ দিকে চলে এলাম। এখানে গাছপালা যে খুব ঘন তা নয়। গাছের ফাঁক দিয়ে নদী দেখা যায়। এদিক ওদিক তাকাতে একটা শিরীষ গাছের মোটা ডাল দেখলাম শুকিয়ে আছে। ডালকাটতে উপরে উঠতেই চোখে পড়ল বানীভূষণের সাধন গন্ডী। তারক দেখলাম তার মধ্যে উদভ্রান্তের মতো বসে বসে দুলছে। আর বোধহয় মন্ত্র পড়ছে। কর্ণপিশাচিনীর মন্ত্রে আছে—

ওঁ এইম হ্রীম শ্রীম দম হুম ফট

কনক বজ্র বৈদুর্য মুক্তা অলংক্রাট ভূষনে

আহে আহে আগচ্ছ আগচ্ছ

মাম কর্ণে প্রবিষ্য প্রবিষ্য

মাম কর্ণে প্রবিষ্য প্রবিষ্য মানেটা বুঝতে পারছ তো? এসব মন্ত্র তো ভালো মন্ত্র নয় তাই সম্পূর্ণ মন্ত্র তোমায় আর নাই বা বললাম।

বিজ্ঞ ঠাকুরের এহেন কথায় আগ্ৰহ আরও বেড়ে যায়। আমি বললাম, পুরোটা একবার শুনিই না। আমি তো আর ও সাধনা করতে যাব না।

বিজ্ঞ ঠাকুর বললেন, মন্ত্রের একটা ক্ষমতা আছে জান তো? আর তা যদি কর্ণপিশাচিনীর মন্ত্র হয় সে আরও ভয়ঙ্কর। আমি তোমায় মন্ত্রের যে অংশটুকু বললাম গল্পের প্রয়োজনে ওইটুকু যথেষ্ঠ। তারপর শোনো, বলে তিনি আবার বলতে শুরু করলেন।

আমি বানীভূষণের থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলাম। এ সাধনা দেখাও ভালো না। খুবই জঘন্য দৃশ্য। স্নানের বালাই নেই। খাওয়াদাওয়ার কোন বাছবিচার নেই। এর আগে আমি দেখেছি কর্ণপিশাচিনী সাধনা করতে গিয়ে অনেক সময় ভয়ে সাধক মাঝপথে পালিয়ে আসে। সেটা করাটা আরও বিপদজনক। বানীভূষণ দেখলাম এখনো তার সাধনায় মগ্ন। আমি গাছ থেকে নিচে এলাম। আমি কাঠ ছোট ছোট করে কেটে তা নিয়ে কুটিরের দিকে এগোলাম।

এই ভাবে এগারো দিন কাটল। তারক তার লক্ষ্যে অবিচল। এগারো দিন পরে আমাবস্যা। শেষ এইদিন সাধকের পক্ষে খুব গুরুত্বপূর্ণ। সাধনায় সিদ্ধ হলে কর্ণপিশাচিনী সাধকে দেখা দিয়ে তাকে কিছু শর্ত দেয় সেই শর্ত সাধক কোনমতেই লঙ্ঘন করতে পারবে না। তারপর কোনও কিছুর বলি চায়। সেটা ছাগল, মুর্গি সহ যে কোনও কিছু হতে পারে।

সেদিন রাতে আর চোখে ঘুম আসছে না। কুটীরের বাইরে বসে আছি ধুনি জ্বালিয়ে। রাত কত হল বোঝার উপায় নেই। ধুনি যখন নিভু নিভু হঠাৎ জঙ্গলে সমবেত কন্ঠে কিছু পাখি ডেকে উঠল। নদীর পাড় হতে শোনা গেল কিছু শেয়ালের আর্তনাদ। লক্ষণ যা বলছে তাতে বুঝলাম বানীভূষণ সাধনায় সফল হয়েছে। কর্ণপিশাচিনী এসেছে তার কাছে।

আমি ধীরে ধীরে উঠে কুটিরে প্রবেশ করলাম। যখন ভোর হয় হয় তখন বানীভূষণের গলার শব্দে চমকে উঠলাম। সে তার গুরুদেবকে অস্বাভাবিক কন্ঠে ডাকছে। আর ফাঁকে ফাঁকে ফিস ফিস করে কারো সঙ্গে যেন কথা বলছে।

আমি উঠে বাইরে বেরিয়ে এলাম। একি চেহারা হয়েছে বানীভূষণের। গায়ের চামড়া পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। সারা গায়ের দুর্গন্ধ দূর থেকেও নাকে এসে লাগছে। বানীভূষণ আমার দিকে একবার তাকালো ঠিকই কিন্তু সে দৃষ্টি স্থির রাখতে পারছে না। মাঝে মাঝে ডাইনে বাঁয়ে চেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে কিছু দেখার চেষ্টা করছে আর সেই অদৃশ্য বস্তুটার সাথে ফিস ফিস করে কথা বলছে। কৃষ্ণাচার্য বেরিয়ে এলে বানীভূষণ তাকে প্রণাম করে একটা অদ্ভুত হাসি দিয়ে নদীর দিকে মিলিয়ে গেল। কৃষ্ণাচার্য দেখলাম মাথা নিচু করে একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে কুটিরে ঢুকে গেল।

এরপর কয়েক দিন কেটে গেল। বানীভূষণ দিনের বেলা মাঝে মাঝে আসে বটে কিন্তু রাতের বেলা কোথায় যেন সে অদৃশ্য হয়ে যায়। সে যে সারাদিন কোথায় থাকে কি খায় তা কিছুই জানা যায় না। একদিন সন্ধ্যেবেলা দেখলাম জঙ্গলের দিক থেকে দুজন লোক আমাদের কূটিরের দিকে হেঁটে আসছে। একজন সামনে আরেকজন ঠিক পেছনে তার গায়ে গায়ে। একটু কাছে আসতেই বুঝলাম একজন বানীভূষণ। তার ঠিক পেছনেই একটি নারী মূর্তি। জলে ডুবন্ত মানুষের চুল যেমন এলমেলো ভাবে দোলে তার চুলও ঠিক সেইরকম ভাবে দুলছে। মুখের বর্ণনা তোমায় আর দিচ্ছি না। বানীভূষণ কাছে আসতেই সে মূর্তি মিলিয়ে গেল। আমি পড়ে গেলাম মহা দুশ্চিন্তায়। কর্ণপিশাচিনীর দেহ ধারণ করা মোটেই ভালো লক্ষন নয়। সেইদিনের পর থেকে বেশ কিছু রাত আর ঘুম হয়নি। মন্ত্র দিয়ে দেহবন্ধনী করে প্রায় সারারাত জেগে বসে থাকতাম।

এদিকে বানীভূষন‌‌‌ দিন দিন আরও শীর্ন হতে থাকে। চোখ দুটো উদ্ভ্রান্ত। কৃষ্ণাচার্য পড়ে গেলেন মানসিক দন্দ্বে। শিষ্যকে কোন মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিলেন তিনি। একদিন সন্ধ্যায় ধুনির আলোয় বসে কৃষ্ণাচার্য বলতে থাকেন, বানীভূষণকে আর বাঁচানোর কোনও উপায় নেই। একটা ঝুঁকি নিয়েছিলাম বুঝলে। ভেবেছিলাম ও এ শক্তি নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও পারতে পারে। না তা আর হল না। ওকে আমি মন্ত্র না দিলে কোথায় গিয়ে মন্ত্র নিত কে জানে। একটু ভুলচুক হলে সাধনকালেই ওর মৃত্যু হত। এ আর দেখা যায় না, আমি এই ভুল শোধরাবার একটা শেষ চেষ্টা করবো জানি না কী হবে।

আমি মুখ নিচু করে রইলাম। এর কোনও প্রতিকার আমার জানা নেই। বললাম, ওর উদ্দেশ্যে একটা মঙ্গল যজ্ঞ করলে হয় না?

-মঙ্গল যজ্ঞ করলে হবে না। যে নিজের আত্মা শয়তানের কাছে বন্ধক দিয়ে রেখেছে তার কথা ভগবানও কানে তোলেন না। একটা পদ্ধতি আছে তা ওই বানীভূষণের ওপরেই প্রয়োগ করতে হবে।

সকালে উঠে কৃষ্ণাচার্য আমাকে বললেন কিছুটা কাঠকয়লা জোগাড় করে নিয়ে আসতে। আর কিছু গাছের নাম বলে দিলেন তার শিকড় আর ডাল আনবার জন্য। সেগুলো নিয়ে ফিরে আসতে দেখলাম তিনি কোথা থেকে একটি মৃত কাক নিয়ে এলেন। তার পাখনা আর লেজ থেকে কয়েকটি পালক খুলে নিয়ে আমাকে বললেন, সেটিকে নদীর পাড়ে মাটি খুঁড়ে পুঁতে আসতে। আমি যথারীতি তাই করে এলাম। তারপর দেখলাম তিনি মন্ত্র পড়ে সেগুলো পুড়িয়ে ছাই করে রেখে দিলেন করোটির মধ্যে। যে পদ্ধতিতে কৃষ্ণাচার্য পিশাচিনী বধ করবেন ভেবেছিলেন তা যে কতটা কার্যকরী হবে সে সম্বন্ধে আমি অতটা অবগত না হলেও মনে মনে বুঝতে পারছিলাম কাজ হবে না।

সেইদিন সারাদিন আর বানীভূষণের দেখা পাওয়া গেল না। সে এল পরের দিন সন্ধ্যার কিছু আগে। গুরু কৃষ্ণাচার্যকে দেখে বানীভূষণ দেখলাম আজ আর প্রনাম কোরলো না। সে দুরে দাড়িয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে ফিস ফিস করে কথা বলে চলেছে। কার সাথে যে কথা বলছে তা দেখা না গেলেও সে ভয়ংকরকে অনুভব করা যায়। কৃষ্ণাচার্য একটু কাছে আসতেই বানীভূষণ বলল, কোমরে কি গোঁজা? ছাই, হিঃ হিঃ। মরতে না চাইলে কেউ এমন কর্ম করে?

এর মানে কৃষ্ণাচার্য কী করতে চাইছেন বানীভূষণ তা বুঝতে পেরেছে।

কৃষ্ণাচার্য তার কোমরের কোঁচা থেকে ছাই বার করার আগেই বানীভূষণ দৌড়ে নদীর পাড় ধরে অদৃশ্য হয়ে গেল। ওই রকম রোগা দুর্বল চেহারা নিয়ে মানুষ যে এত গতিতে দৌড়তে পারে তা না দেখলে বিশ্বাস করবে না। আমি আর কৃষ্ণাচার্য হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। বানীভূষণ সত্যি সত্যি ভবিষ্যত দেখতে পায়!

অন্যান্য দিনের মতো সেদিনও চোখের পাতা বন্ধ করে বেড়ায় হেলান দিয়ে রাত জেগে বসে আছি। চোখের পাতা বন্ধ করে এভাবে বসে থাকলে অজান্তেই ঘুম চলে আসে। রাত তখন কত হবে জানি না হঠাৎ নারী কন্ঠের খিল খিল হাসির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল। শব্দটা ঘরের চারিপাশে ঘোরাঘুরি করছে। রক্ত হিম করা হাসির শব্দ যে কার তা বুঝতে অসুবিধে হয় না। পিশাচিনী এখন আর শত্রুর শেষ রাখতে চায় না। কৃষ্ণাচার্যও অনেক তন্ত্রে সিদ্ধ। তাকে নিধন করাও সহজ কাজ নয়। তবুও একবার উঠে দাঁড়ালাম। আমার কাছে সবসময় ছোট চাকুর মতো একটা অস্ত্র থাকে। ওর বিশেষত্ব এবং কাজ পরে তোমায় একদিন বলব।

আমি বললাম, হ্যাঁ পরে একদিন শুনব। তারপর?

-আমি কোমর থেকে চাকুটা হাতে নিয়ে বাইরে এলাম। এসে দেখি কেউ কোথাও নেই। সে হাসির উৎসও নীরব।

আবার ঘরে ফিরে এলাম। তখন যা ঘুম হতে সকালের দিকে তাই উঠতামও অনেক বেলা করে। সেদিন উঠে কৃষ্ণাচার্যকে কোথাও দেখতে পেলাম না। হয়তো নদীর দিকে কোনও কাজে গেছেন। বেলা বয়ে যায় তবুও কৃষ্ণাচার্যের কোন দেখা নেই। অবশেষে তার ঘরে ঢুকে দেখলাম তিনি চোখ বন্ধ করে চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন। কয়েকবার ডাকতেও তিনি সাড়া দিলেন না। আমি কাছে এসে হাতের নাড়ি টিপতেই বুঝলাম তিনি মৃত। গুরুহত্যার মতো মহাপাপ সেই প্রথম প্রত্যক্ষ করলাম। মনটা ভীষন ভেঙে গেল। গ্ৰামের লোক ডেকে কৃষ্ণাচার্যের যথাসাধ্য মত শ্রাদ্ধ শান্তি করলাম।

তারপরও কিন্তু আমি এ শ্মশান ছাড়িনি। মৃত্যু ভয়ই যদি থাকবে তবে আর এ পথে নামতাম না। এরপর কিন্তু বানীভূষণ কে প্রায় মাসখানেক এ শ্মশানে দেখা গেল না। সে পরেবার যখন ফিরে এল তখন সে বদ্ধ উন্মাদ। পোশাক শতছিন্ন। কখনও সে হাসে কখনও কাঁদে। রাতের দিকে বানীভূষণকে দেখতে পাই না। দিনের বেলা ক্ষিদের তাড়নায় সে আসে। মুঠো ভরে খাবার তুলে মুখে দেয়। আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে খাবার গড়িয়ে পড়ে। মাটি থেকে সে খাবার তুলে সে খাবার আবার মুখে দেয়।

একদিন বানীভূষণ না আসায় তাকে খুঁজতে গেলাম। এভাবে চললে তাকে বেশিদিন বাঁচানো যাবে না। নদীর পাড় ধরে হেঁটে জঙ্গলের এপাশে এসে তাকে দেখতে পেলাম। যেখানে তার সাধনক্ষেত্র ছিল সেখানে শুয়ে আছে বানীভূষণ। কাছে এসে দেখলাম হাত পাগুলো মোচড়ানো, চোখের দৃষ্টিতে অপার বিস্ময়। বানীভূষণের প্রানহীন দেহটা সোজা করে শুয়ে চোখটা বন্ধ করে দিলাম। একদিনে সে যে অপার্থিব আনন্দ এবং নারকীয় কষ্ট ভোগ করেছে তা আমাদের কল্পনারও অতীত।

ঠাকুরমশাই থামলেন। বৃষ্টি এখনো টিপ টিপ করে পড়ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, বানীভূষণের মৃত্যুর পর আর কিছু দেখেননি।

-দেখেছি তো কতকিছুই কিন্তু সে কর্ণপিশাচিনী আর দেখিনি। বানীভূষণ তাকে ডেকেছিল তাকে নিয়েই সে চলে গেছে।

বেশ রাত হয়ে গেছে, এবার উঠতে হয়। এখনও বিদ্যুত আসেনি। আমি বললাম, আজ তাহলে উঠি।

দরজা খুলতে দেখলাম, গানের আসরে যে ক’জন ছিল তারা সবাই বাড়ি চলে গেছে। ঠাকুরমশাই বিছানার পাশ থেকে একটা টর্চ এনে হাতে দিয়ে বললেন, এই অন্ধকারে যেতে সমস্যা হবে। এইটা নিয়ে যাও।

সমাপ্ত

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post আভিমুখ‍্য| পলক ফেলা নিষেধ | অনির্বাণ পাল| Bengali Thriller Story
Next post দ্য প্যারানর্মাল এক্সপার্টস্| পলক ফেলা নিষেধ | অঙ্কিতা দাস| Bengali Thriller Story