তিন নম্বর ফ্লোর| পলক ফেলা নিষেধ | ঈপ্সিতা মল্লিক| Bengali Thriller Story
0 (0)

বাসে আসতে আসতে হেনার বাড়ির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। আসলে বাড়ি থেকে দূরে সে কখনো থাকেনি। থাকতে আসত না, যদি না তার বাবার চাকরিটা চলে যেত। তার বাবা শহরে কাজ করত। হঠাৎ একদিন ধুম জ্বর নিয়ে বাড়ি যায়। পরীক্ষা করে জানা যায় ডেঙ্গু আক্রান্ত। পুরোপুরি সুস্থ হতে অনেক সময় নেয়। তখনই চাকরিটা চলে গেছে।

তার মা টুকটাক হাতের কাজ করত। তার বাবাও সেই কাজে লেগে পড়ে। তবে তাতে আয় যৎসামান্য হয়। কোনওরকমে পেট চালান।

সে সবে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছে। বলাবাহুল্য এর বেশি পড়াশুনা করা তারপক্ষে সম্ভব নয়। তাই হেনার মা তার বিয়ের জন্য সম্বন্ধ দেখতে শুরু করে। কিন্তু বিয়ে দেবার মত টাকা তাদের কাছে নেই। সেটা না হয় ধার দেনা করে দেবে। তার উপর ছেলেরা আবার পণ চায়।

এরমধ্যে তার মামিমা হসপিটালে নার্সের চাকরিটা ছেড়ে দেবে জানায়। সেই জায়গায় কর্তৃপক্ষ নতুন নার্স নেবে। তাই হেনা কাজটা নিতে চায় কিনা তার মামিমা জানতে চায়। হেনার মা বিয়ের দিকে কিছু সুবিধা না করে উঠতে পারায় হেনাকে পাঠিয়ে দেয় মামার বাড়ি।

হেনার মামার বাড়ি মফসসলে। তার মামা গার্ডের চাকরি করে শহরের এক আবাসনে। তাই বাড়িতে থাকে না। এদিকে মামিমার নার্সিং এর চাকরিতে মাঝে মধ্যেই রাতে ডিউটি করতে হত। মামার একমাত্র মেয়ে তিন্নি এখন ক্লাস নাইনে পড়ে। রাতে একা একটা মেয়ে বাড়িতে থাকবে সেটা চলতে পারে না। সেই কারণেই কাজ ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

হেনার গ্রাম থেকে মামার বাড়ি আসতে দুঘন্টা সময় লাগে। বাড়ির রাস্তা তার চেনা ছিল। মামার বাড়ি পৌঁছাতেই তার মামিমা তাকে ঘরে নিয়ে যায় এবং জল মিষ্টি খেতে দেয়।

“মামিমা, তিন্নিকে দেখছি না। ও কোথায়?”

“ও, পড়তে গেছে। এক্ষুণি আসবে। তুই বস। আমি ভাতের ফ্যানটা গড়িয়ে আসছি।”

হেনা চারপাশে তাকিয়ে দেখে কিছুই বদলায়নি। সেই অনেক বছর আগে ও একবার এসেছিল। ছোট দুটো ঘর আর দালানের কিছুটা জুড়ে রান্নাঘর।

মামিমা কিছুক্ষণের মধ্যে তার জন্য নুন চিনির জল নিয়ে এল। খাওয়া শেষ হতে হেনা বাথরুমে গেল স্নান করতে। সে লক্ষ্য করল বাথরুমের ভিতরে যে ছোট আয়নাটা ছিল সেটা কেউ খুলে নিয়েছে। স্নান সেরে ঘরে এসেও দেখল কোথাও আয়না নেই। সে একটু অবাক হল তারপর নিজের ব্যাগের দিকে চোখ পড়তেই মনে পড়ল সে একটা মস্ত জিনিস ভুলে গেছে।

মামিমাকে সে আচারের বয়াম দুটো ধরিয়ে দিল। মামা আচার খেতে খুব ভালোবাসে। তাই ভাইয়ের জন্য তার মা আচার বানিয়ে পাঠিয়েছে। মামিমার সাথে এরপর সে দুটো কথাই বলছিল যখন তিন্নি পিঠে ব্যাগ নিয়ে ঘরে ঢোকে।

হেনাকে দেখে তিন্নি যেন তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল। ভাবখানা দেখে হেনা ভীষণ অবাক হয়ে যায় আর সেই সময় তিন্নি ছুটে ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। হেনার মুখের অবস্থা দেখে মামিমা বলে উঠে, “ও, তুই কিছু মনে করিসনি। সকাল থেকে টিউশন পড়ে এসেছে তো!”

দুপুরে খেতে বসে হেনা জানতে পারল তার রাত্রে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে তিন্নির সাথে। এখন সে কিছুটা ধারণা করতে পেরেছে তিন্নির ওই ব্যবহারের কারণটা। মামিমা তিন্নিকে ওইভাবে দরজা বন্ধ করে দেওয়ার জন্য বকাবকি করে। তিন্নি তারপর হেনার সাথে কথা বলেছে। ওই যতটা না বললে নয় অতটাই।

রাত্রে হেনা ক্যাম্প খাটে শুয়ে ভাবছিল আগামী দিনের কথা। তার অল্প ভয় লাগছে। জায়গাটি একেবারেই নতুন আর মানুষজনও। কাজের প্রথমটায় তাকে শুধু শেখানো হবে তাই যা মাইনে দেওয়া হয় তার অর্ধেক পাবে। এইভাবে ছয় মাস শেখার পর তাকে পার্মানেন্ট করা হবে তখন পুরো মাইনে। প্রথমদিন মামিমা তাকে নিয়ে যাবে।

এতকিছু ভাবতে গিয়ে তার ঘুম আসছিল না। তাই ছটফট করছিল সে। তিন্নি পাশের বিছানায় ঘুমোচ্ছে। তার বিছানাটা একজন শোওয়ার মত তাই তাকে ক্যাম্প খাটের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। হঠাৎ তিন্নির বিছানা থেকে শুনতে পেল…

“না, আমি করিনি, আমি করিনি ও কাজ। তুমি চলে যাও।”

হেনা প্রথমে ভাবে কথাটা তাকে বলা হচ্ছে। তাই সে তড়াক করে উঠে বসে। কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারে তিন্নি ঘুমের মধ্যেই বলে চলেছে। একই কথা বারংবার আওড়াচ্ছে। ক্রমশ কথা বন্ধ হয়ে কান্না শুরু হল। হেনা বুঝতে পারে না এইসময় কী ওকে ঘুম থেকে তুলে দেওয়াটা ঠিক হবে!

সে ভাবছে কী করবে এমন সময় তার চোখ চলে যায় জানলার দিকে। সঙ্গে সঙ্গে তার বুকটা ধড়াস করে উঠে। জানলায় দাঁড়িয়ে ওটা কে? স্পষ্ট নয় তবু বোঝা যায় ছায়া ছায়া কেউ একজন ওইখানে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে ভিতরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এরপর তিন্নির কান্না বন্ধ হয়ে যায়। ঠিক যেমন হঠাৎ করে শুরু হয়েছিল তেমনই।

হেনা দেখে তিন্নি পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। তারপর আবার তার চোখ চলে যায় জানলার দিকে। সেখানে আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না।

বাকি রাতটা হেনা জানলার দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দেয়।

পরের দিন সকালে তিন্নি তখন ঘুমাচ্ছে, হেনা মামিকে রান্নার কাজে সাহায্য করবে এই ভেবে উঠে পড়ে। আগের দিনের রাতের ঘটনাটাও সে বলবে ভাবছে এমন সময় দেখে তার মামির ঘরের দরজা আধ খোলা হয়ে আছে। যেটা সব থেকে আশ্চর্য সেটা হল তার মামিমা একটা পরচুলা পরে নিচ্ছে মাথায়। মামিমার মাথার চুল যেন কেউ খাবলে নিয়েছে। সে এমনভাবে কোনও আয়না ছাড়া পরচুলাটা পরল যেন কতদিনের অভ্যাস! এত নিখুঁত করে পরচুলাটা বানানো যে কাল সে বুঝতেও পারেনি ওটা মামিমার নিজের চুল নয়। রাতে সে এটা খুলে রাখে আবার সকালে পরে নেয়। কিন্তু মামিমার একরাশ ঘন চুলের কী হল?

মামিমা পিছন ফিরেছে দেখে হেনা ছুটে রান্নাঘরে ঢুকে যায়। হাতের সামনে থাকা চায়ের বাটিটা উনুনে বসিয়ে দেয়।

ঘর থেকে বেরিয়ে হেনাকে রান্নাঘরে দেখে মামিমা চমকে উঠল।

“ও, তুই উঠে পড়েছিস?”

“হ্যাঁ, মামিমা।”

“নতুন জায়গায় ঘুম আসছিল না বোধহয়?”

“মামিমা?”

হেনার গলায় ভয় শুনে তার মামিমা কাছে এসে বলল,”কি হয়েছে হেনা?”

“কাল রাতে আমি জানলায় কাউকে দেখেছি।”

“কাকে দেখেছিস?”

“একটা ছায়া।”

“ছায়া….!!”,মনে মনে বিড়বিড় করে মামিমা বলল,”এখনও আসে?!”

“কিছু বলছ মামিমা?”

“না, কিছু না। কার ছায়া বুঝতে পেরেছিস? মানে ছেলে না মেয়ে?”

“না, সেটা বুঝতে পারিনি।”

“আচ্ছা ছাড়। তুই চা করে নে। আমি ভাতটা বসিয়ে দিচ্ছি। তুই একটু দেখিস কেমন? তিন্নি আজ স্কুল বেরোবে। তারপর তোর দুপুরের খাবার দেব। অনেক কাজ আছে।” এই বলে মামিমা কাজে লেগে গেল।

হেনা তিন্নির সে স্বপ্ন দেখে কথা বলার ব্যাপারটা পুরোপুরি এড়িয়ে গেল। সে তখনও অবাক হয়ে মামিমার চুলের দিকে দেখছে।

কিছুক্ষণ পর সে দেখল মামিমা গোটা ঘরে ধুনো দিচ্ছে। সে ধোঁয়াতে সারা ঘর অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে।

খাওয়া শেষ করে সে আর তার মামিমা বেরিয়ে পড়ল হসপিটালের উদ্দেশ্যে। তিন্নির খাবার গুছিয়ে রেখে আসা হয়েছে। সে সকাল থেকে উঠে হেনার সাথে কথা বলার প্রয়োজন মনে করেনি। আর হেনাও কথা বলেনি।

হেনার রোজকার যাতায়াতের জন্য তার মামার সাইকেলটা বরাদ্দ হয়েছে। মামিমা পথে যেতে যেতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলার ভাব করে বলতে শুরু করল, “শোন, ওই হসপিটালের যে লিফ্ট আছে ওটা শুধুমাত্র চার তোলায় উঠার জন্য ব্যবহার করা হয়। যদি কখন চার তলায় যাওয়ার দরকার পড়ে তবে লিফটে উঠে পিছন ঘুরে দাঁড়াবি।”

“কিন্তু কেন মামিমা?”

“ও কিছু নয়, এমনি। আর শোন ভুলেও কখনো তিন তলায় যাবি না। এমনিতে সিঁড়ি বন্ধ করা আছে তিন তলায় যাওয়ার তবে লিফটে করে উঠা যায়। কিন্তু একদম যাবি না ওখানে।”

হেনা ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়ল।

দিনের প্রথম ভাগটা হেনার ভালই কাটল। অন্য নার্সরা মিশুকে। শুধু হেড নার্স একটু রাশভারী মহিলা। হেনা জানতে পারল চার তলায় আই সি ইউ পেশেন্ট, দুতলায় জেনারেল বেডের পেশেন্ট আর একতলায় আউটডোর মানে ডাক্তারদের পেশেন্ট দেখার চেম্বার তার সাথে রিসেপশন আছে। তিন তলা সম্পূর্ণ ভাবে বন্ধ।

দিনের শেষে বাড়ি এসে হেনা ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে কাদা হয়ে গেল। হঠাৎ রাতে কোনও এক অস্বস্তিতে ঘুম ভেঙে গেল। যেন মনে হল কিছু একটা এমন জিনিস উপস্থিত হয়েছে যেটার হওয়ার কথা নয়। ঘুম ভাঙতেই তার বাথরুম যাওয়ার দরকার হয়ে পড়ল। পা টিপে টিপে এমনভাবে সে উঠে যাতে তিন্নির ঘুম না ভাঙে। উঠতেই আবার সে শুনতে তিন্নির সেই কথাগুলো..

“না, আমি করিনি, আমি করিনি ও কাজ। বললাম তো। তুমি চলে যাও। যাও বলছি।”

হেনার গা শিউরে উঠল। তাহলে কি আবার আজকে জানলায় এসে দাঁড়িয়েছে সেই মূর্তি? চোখ ফেরালেই তাকে দেখতে পাওয়া যাবে? কিন্তু না আজ জানলায় কেউ নেই। তাহলে আগেরদিন ওটা তার মনের ভুল ছিল। এই সময় সে দরজা খুলে তিন্নির দিকেই দৃষ্টি দিয়ে অন্যমনস্কভাবে দালানে বেরিয়েছে বাথরুমের দিকে যাবে বলে হঠাৎ তার মনে হল গালের উপর কারোর ঠাণ্ডা নিশ্বাস পড়ল। মুখ ফিরিয়ে তাকাতে সে দেখল একটা পাংশুটে সাদা মুখ তার দিকে জিভ বের করে হাসছে। মুখটা তার মুখের খুব কাছে। লাফিয়ে সে পিছিয়ে যেতে গিয়ে পায়ে পা জড়িয়ে পড়ে গেল। তার মুখ দিয়ে একটা চিৎকার বেরিয়ে এসেছিল। সেই শুনে তিন্নি ঘুম থেকে উঠে পড়ে। এরপর হেনা আলো জ্বালিয়ে গোটা দালান, রান্নাঘর খুঁজেও কাউকে পায় না কিন্তু আজব ব্যাপার এই যে দালানে কেউ নেই।

ঘরে এসে হেনা দেখে তিন্নি বিছানায় বসে মুখ চাপা দিয়ে কাঁদছে। সে কাছে বসে শান্ত করতে চায় তাকে।

“কেন কাঁদছিস? কি হয়েছে?”

“দিদি, তুই এখান থেকে চলে যা।”

“কেন রে? তোর ঘরে থাকি বলে পছন্দ নয়?”

“না, পছন্দ নয়। তুই চলে যা।”

“চলে গেলে পেট চলবে না রে। পেটের দায়ে রয়েছি।”

এরপর হেনা তিন্নিকে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। সে লক্ষ্য করে তিন্নির গলায় ঝুলছে একটা বড় তাবিজ যেটা আগে ছিল না। সম্ভবত আজ সকালে মামিমাকে কাল রাতের কথা জানানোর পর এটার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

হসপিটালের কাজ হেনার বেশ ভালই লাগছে। তবে অন্য নার্সরা নিজেদের মধ্যে কীসব কথা বলে যেটা হেনা কাছে গেলেই বন্ধ করে দেয়। তার মনের কৌতূহল সেজন্যে বেশি করে বাড়ছে। খালি নতুন জায়গা বলে সে কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারছে না।

সেদিন রাতের পর ওইরকম ঘটনা আর ঘটেনি। তাই মামিমাকে হেনা আর কিছু জানায়নি। হসপিটালে সব ভাল তবে একটা জিনিস হেনা লক্ষ্য করেছে তিন তলার বন্ধ কলাপসিবল গেটের দিকে তাকালে যেন কেমন গা ছম ছম করে। তিন তলায় উঠার সিঁড়িটা চাপ চাপ অন্ধকারে ঢাকা থাকে সকালবেলাতেও। তার যেন মনে হয় কেউ যেন ওখানে দাঁড়িয়ে তার দিকে নজর রেখে চলেছে।

হেনা বাড়ি ফেরার জন্য তাড়াহুড়ো করে সাইকেল বের করছিল। আজ একটু রাত হয়ে গেছে। হসপিটালে নার্সের সংখ্যা যেন দিন দিন কমে যাচ্ছে। সে আসার পর অনেকেই ছেড়ে চলে গেছে। আর নতুন কেউ আসেওনি। এর কারণটা সে ঠিক বুঝতে পারেনি। কিন্তু কাজের চাপ প্রচন্ড রকম বেড়ে গেছে। নিশ্বাস ফেলার সময় পর্যন্ত নেই। সাইকেল বের করে হঠাৎ তার কী মনে হল হসপিটালের দিকে ফিরে তাকাল। জানলায় একজন দাঁড়িয়ে আছে। যে হালকা হেসে ওকে হাত নেড়ে টাটা করল। হেনাও হাতটা নাড়ল। তারপর সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে আসবে এমন সময় মনে পড়ল পেশেন্টটা কোনও ফ্লোরে দাঁড়িয়ে আছে? পিছন ফিরে সেই জানলার দিকে তাকাতেই দেখল সেখানে কেউ নেই এবং সেটা বন্ধ, অন্ধকার। আর সেটা এই হসপিটালের একটি মাত্র ফ্লোরেই সম্ভব। কোনওদিকে না তাকিয়ে সে বাড়ির দিকে সাইকেল ছুটিয়ে দিল।

আজ হেনার মামা বাড়ি এসেছে। হেনাকে দেখে সে ভীষণ খুশি হয়েছে। আরো একটা খুশির ব্যাপার হল হেনা আজ প্রথম মাইনে পেয়েছে। তার মায়ের কথা মত সে তার মাইনের অর্ধেক টাকা মামার হাতে তুলে দেয়। মামা প্রথমে নিতে চায়নি। অনেক জোর করাতে সে কিছু টাকা রেখে বাকিটা হেনাকে ফিরিয়ে দেয়। সেই টাকায় একটা ফোন কিনে নিতে বলে। সত্যিই হেনার একটা ফোনের খুব দরকার। একটা নয় আসলে দুটো ফোন। তার মায়ের কাছে ফোন নেই। সপ্তাহে একবার সে মাকে ফোন করতে পারে। রবিবার যখন পাশের বাড়ির পিন্টুদা শহর থেকে বাড়ি ফেরে তখন হেনা মামিমার থেকে ফোন নিয়ে কথা বলে।

হেনা তার ওই তিন তলায় কাউকে দেখার কথাটা কোনও নার্সকে বলতে পারে না। না জানি কে কীভাবে কথাটা নেবে! তবে সেই ভয়টা যে তিন তলা থেকে তাকে কেউ দেখছে এখন যেন বেশি করে জাঁকিয়ে বসেছে। সে কয়েকবার কিছু নার্সকে কথায় কথায় জিজ্ঞাসা করেছিল যে তিন তলাটা কেন বন্ধ রাখা হয়েছে? তারা অগোছাল ভাবে জানিয়ে ছিল তিন তলায় কোনও এক ডাক্তার নাকি দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিল। কিন্তু কি দুর্ঘটনা সেটা কেউই তাকে খোলসা করে বলেনি। এড়িয়ে গেছে। হেনা বুঝতে পারে না হাসপাতাল মানেই তো বাঁচা মরা লেগে থাকবে। আলাদা করে কী এমন হল যাতে একটা ফ্লোরকে বন্ধ করে দিতে হল!

হেনার হাতে কিছু পয়সা থাকায় সে একদিন সময় করে একটা আয়না কিনে বাড়ি ফিরল। আয়নাটা তার মামিমাকে নিয়ে গিয়ে দেখাতেই সে রে রে করে উঠল।

“তুই জানিস না? এই বাড়িতে আয়না লাগানো বারণ।”

মামিমার গলা শুনে মনে হল যেন সে এবার কেঁদেই ফেলবে।

“কিন্তু কেন?”

“আয়না দেখলে আমার তিন্নি ভীষণ ভয় পায়। তুই ওটা আমায় দে আমি ফেলে দিয়ে আসি।”

হেনা অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল যখন তার মামিমা আয়নাটাকে তার হাত থেকে ছোঁ মেরে নিয়ে নিল।

তার মুখে কোনও কথা সরছে না। কি বিচিত্র!

হেনার এরপর অল্প রাগ হয় মামিমার উপর। সে আর জিজ্ঞাসাও করেনি তিন্নি আয়না দেখে কেন ভয় পায়? যাই হোক সে তার দরকারটা এখন থেকে হসপিটালে মিটিয়ে নিতে থাকে।

দেখতে দেখতে হেনার সেই হসপিটালে দুমাস হয়ে গেছে। এখন কাজের অতিরিক্ত ব্যস্ততার জন্য, কেউ দেখছে, এই ভয়টা কেটে গিয়েছে। একদিন যদিও সে তার মাকে সেদিন তিন তলায় কাউকে দেখতে পাওয়ার কথাটা বলে ফেলেছিল। মা প্রথমে ভয় পেয়ে যায় পড়ে সাহস জুগিয়ে ভগবানের নাম করতে বলে।

একদিন সকালে হেড নার্স তাকে এসে জানাল এখন থেকে তাকে আই সি ইউ তে ডিউটি দিতে হবে কারণ আই সি ইউ তে ইমার্জেন্সী পেশেন্টরা থাকে আবার তার সাথে সেখানে কর্মরত একজন নার্স কিছুদিন হল হসপিটাল ছেড়ে দিয়েছে। আউটডোরে যে কত দূরদূরান্ত থেকে লোকেরা ডাক্তার দেখাতে আসে তার ঠিক নেই। সেই ভিড় সামলানো চারটিখানি কথা নয়! নার্সের সংখ্যা সেই তুলনায় খুব কম হয়ে পড়েছে। হসপিটাল কর্তৃপক্ষকে বারবার এই কথা জানিয়েও কোনও লাভ হচ্ছে না।

হেড নার্স তাকে লিফটের দিকে নিয়ে যেতে যেতে বলল,”শোনো চার তলায় যখনই উঠবে অথবা নামবে মুখ যেন সবসময় লিফটের উল্টোদিকে থাকে। বুঝেছ? মানে এই দরজা দিয়ে উঠলে।”

হেনা দেখল হেড নার্স দিদি লিফটে উঠে দরজারদিকে পিছন ফিরেই বলতে শুরু করল,”লিফটের এই যে বোতামগুল দেখছ। জিরো মানে হল একতলা, ওয়ান মানে দুতলা, টু মানে তিনতলা, থ্রি মানে চারতলা। এই দুই বোতামটা আমরা সেলোটেপ দিয়ে রেখেছি যাতে কেউ ভুল করেও হাত না দিয়ে ফেলে। লিফটারও ব্যবস্থা করা হবে যাতে তিনতলায় না দাঁড়ায় কিন্তু কিছু অনিবার্য কারণবশত সেটা হয়ে উঠছে না। তাই যে কথাগুল বললাম যেন মাথায় থাকে। লিফটে উঠবে দরজা টেনে বন্ধ করবে কারণ কোলাপসিবল দরজা তারপর পিছনে ফিরে যাবে। পিছন ফিরেই বোতাম টিপবে। একদম দরজার দিকে তাকাবেই না যতক্ষণ না চার তলা আসে। নামার সময়তেও একই জিনিস।”

হেনা সব শুনে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। প্রতিটা ফ্লোর আসে আর একবার করে ঘটাং ঘটাং শব্দ হয়। মনে মনে গুনতে থাকা হেনা যখন বুঝল এইবার তিন তলা এসেছে এই সকালেও ওর গাটা কীরকম ছমছম করে উঠল। চার তলায় এসে থামতে হেড নার্স দিদি দরজা খুলে এগিয়ে গেল। তার পিছনে হেনা।

আই সি ইউ তে তখন ডিউটিতে ছিল গোলগাল চেহারার পারমিতা। খুব মিষ্টি মেয়েটা। হেনাকে দেখে এক গাল হেসে এগিয়ে এল।

হেড নার্স দিদি বলতে শুরু করল, “শোনো পারমিতা, হেনা অভিজ্ঞতার দিক থেকে খুবই ছোট। তাই ওকে এখন কাজ শিখতে এখানে ডিউটি দেওয়া হচ্ছে। তুমি একটু একটু করে ওকে সব বুঝিয়ে দাও যেন পরে ও তোমার সাথে কাজ করতে পারে। আর তুমি হেনা মন দিয়ে সব কিছু বুঝে নাও।”

হেড নার্স দিদি চলে যাওয়ার পর পারমিতা তাকে টুকটাক জিনিস বোঝাতে থাকে। আই সি ইউ তে এখন তিনজন পেশেন্ট ভর্তি আছে।

পারমিতা আর হেনা আই সি ইউ এর করিডোরে যে বেঞ্চ পাতা আছে সেটায় লাঞ্চ করতে বসেছিল। হেনা আর কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে জিজ্ঞাসা করে বসে, “পারমিতা একটা কথা আমাকে বলবে?”

“কি কথা?”

“তিন নম্বর ফ্লোরে এমন কী হয়েছিল যে সেদিকে তাকান পর্যন্ত বারণ?”

“এই আমাকে না এইসব কথা তোমাকে বলতে বারণ করেছে!” পারমিতা রীতিমত কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল।

“আমাকে বলতে বারণ করেছে?” হেনা ভীষণ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে।

“হ্যাঁ তুমিও যদি অন্যদের মত ছেড়ে দাও সেইজন্যে,”পারমিতা আঙ্গুল কামড়ে বলে উঠে। দেখেই মনে হয় সে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছে।

হেনা হেসে বলে, “আমার ছেড়ে যাওয়ার উপায় নেই। গ্রামের টুয়েলভ পাশ মেয়েকে কে চাকরি দেবে!! আর পয়সা টাকার অবস্থা এমন খাবার পয়সা ছিল না গো। তুমি নির্দ্বিধায় বল। আমি ছেড়ে যেতে পারব না।”

“সত্যি বলছ? ছেড়ে যাবে না?”,পারমিতা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বলে উঠে।

“তোমায় ছুঁয়ে বলছি যাব না।”, হেনা জবাব দেয়।

“আচ্ছা তাহলে বলি। এই হসপিটালে একটা দিদি কাজ করত। দিদিটা খুব ভাল ছিল গো। আমি নাম নিতে পারছি না। ভয় করে।দিদিটার সেবা অন্তঃপ্রাণ ছিল। সারাদিন হসপিটালেই কাটাত। দিদিটার অনেকদিন ধরে কার সাথে নাকি প্রেম ছিল। কিন্তু সারাদিন কাজ করে সময় দিতে না পারায় বিয়ের কথা হয়েও সম্পর্ক ভেঙে যায়। সেই দুঃখে দিদিটা সুইসাইড করে। তাও আবার এই হসপিটালে ওই তিন নম্বর ফ্লোরে।” এতটা বলে পারমিতা ঢোক গেলে।। হেনা জলের বোতল এগিয়ে দিতে ঢক ঢক করে অনেকটা জল খায়।

“তাহলে আমি শুনেছিলাম কোনও ডাক্তার মারা গেছে! হেনা বলে উঠে।

“সেটা তো এই ঘটনাটার পরে। কী জানি কেন ডাক্তার বাবু ওই ফ্লোরে অপারেশন রুমে ছিল। ওঁর সাথে তোমার মামিমাও ছিল। হঠাৎ আমরা তোমার মামিমার চিৎকারে ছুটে গিয়ে দেখি, তোমার বোন তিন্নি কোনও কারণে বোধহয় তোমার মা সাথে দেখা করতে এসেছিল, সে অপারেশন রুমের দরজার সামনে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। তোমার মামিমার চুল ছিঁড়ে গোটা মেঝেতে ছড়িয়ে আর ডাক্তার বাবুর হাতে ছুড়ি ঝুলছে। গলাটা যেন তিনি ফালাফালা করে কেটে ফেলেছেন। উফ! কি ভয়ানক দৃশ্য!”

কিছুক্ষণ থেমে পারমিতা আবার বলতে শুরু করল, “তারপর থেকে তোমার মামিমা তো আর এল না হসপিটালে। আমাদের সবাইকে চুপ থাকতে বলে রটানো হল ডাক্তারবাবু অপারেশন রুমে দূর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন। কাগজে তো সেই নিয়ে কত লেখালিখি। তারপর থেকে জানো ওই ফ্লোরে কাউকে যেতে দেওয়া হত না। কিন্তু লিফটে করে যাওয়ার সময় যেই ওই ফ্লোরের দিকে তাকাত তারা কাউকে দেখত যে তাদের দিকে তাকিয়ে হাসছে। তারা সবাই বলেছে সে অনেকটা নাকি দিদিটার মত দেখতে। এইরকম অনেক নার্স দেখে ভয় অজ্ঞান হয়ে গেছে গো। তাই তো অনেকে ছেড়ে দিচ্ছে হসপিটাল।”

“কি বলছ!!! আমি তো কিছুই জানি না এসবের,” হেনা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়।

“সে আমি প্রথম দিনই বুঝেছি। দেখছ না যারা জানে ব্যাপারটা তারা কেউ এই হসপিটালে চাকরি করতে চাইছে না। তাই তো কোনও নতুন নার্স আসছেও না,”পারমিতা খাবার মুখে তুলে বলে।

“কিন্তু আমি একটা জিনিস বুঝতে পারলাম না মামিমার চুল ছিঁড়ে কে দিল?” হেনা প্রশ্ন করল।

“আমরা সবাই যেটা বুঝতে পেরেছি ওটা দিদিটার ভূত। যে প্রথমে ডাক্তারববুকে মেরেছে তারপর তোমার মামিমা সেখানে ছিল তার উপরেও আক্রমণ করেছে!”পারমিতা চোখ গোল গোল করে বলে উঠে।

“আচ্ছা দিদিটা মারা যাওয়ার পর তোমরাও তো ওইখানে গিয়েছিলে। তোমাদের কি কিছু করেছিল?”, হেনা আবার প্রশ্ন করে।

“না আমাদের কাউকে কিছু করেনি।” পারমিতা ভেবে বলল।

হেনা মনে মনে ভাবছে এই এতগুলো কথা মামিমা তার থেকে এড়িয়ে গেল কেন? আর তিন্নির সেই স্বপ্ন, জানলায় সেই ছায়া এইসব কিছুর সাথে কি এই ঘটনার কোনও যোগ আছে? হঠাৎ পারমিতার কথায় সে চমকে উঠল।

“কি ভাবছ এত?”

“কিছু না। আচ্ছা, তুমি সব জেনে এখানে আছ কেন?”

“মা আমাকে চাকরি করতে শহরে যেতে দেবে না গো! আর এখানে এই একটাই হসপিটাল আছে।”

“তোমার নার্সিং করতে ভালো লাগে?”

“হ্যাঁ লাগে তো। কত ইচ্ছা ছিল ডাক্তারি পড়ব কিন্তু ওই অঙ্ক আমার মাথায় ঢোকে না। কত মোটা মোটা বই পড়তে হয় বাবা গো! ও আমার দ্বারা হবে না।”

খাওয়া শেষ করে তারা কাজে লেগে পড়ে। হেনার মাথায় কতকিছু ঘুরপাক খাচ্ছে। মামিমার পরচুলা পরা, তিন্নির স্বপ্ন, জানলায় ছায়া, ঘরেতে আয়না না রাখা, তাকে দেখে কারোর হাত নাড়ানো। কত ঘটনা!

রাতে ফিরে সেভাবে মামিমাকে জিজ্ঞাসা করবে যে, তার থেকে মামিমা এত কথা লুকিয়েছে কেন? কিন্তু পরক্ষণেই তার মায়ের একটা কথা তার মনে পড়ে যায়। সে যখন তার মাকে একবার চুপিচুপি জানিয়েছিল মামিমার পরচুল পরার কথা। তার মা তাকে পরিষ্কার জানিয়েছিল যাদের বাড়ি আছে তাদের মন জুগিয়ে চলতে আর কাজের বাইরে অন্য বিষয়ে মাথা না ঘামাতে। তাই অনেক কষ্ট করে সে সেদিন স্বাভাবিক ব্যবহার করে।

পরের দিন সকালে এসে শোনে পারমিতা আজ কাজে আসেনি। সকাল থেকে তার নাকি বমি আর জ্বর শুরু হয়েছে। তাই হেড নার্স দিদি আউটডোরে হেনার সাথে যেই দিদি থাকেন তাকে ডিউটি দিয়েছে। হেনাকে আজ আউটডোর একাই সামলাতে হবে।

সারাদিন ধরে আউটডোর সামলাতে হেনা হিমশিম খেতে থাকে। সব শেষ হতে হতে রাত 7টা বেজে গেছে। সব নার্সরা বাড়ি রওনা দিয়েছে। রাত্রে ডিউটিতে থাকা নার্সরা এখনও আসেনি। হেনা সবেমাত্র বাড়ির দিকে পা বাড়িয়েছে রিসেপশনে একটা ফোন আসে চারতলা থেকে যে সেখানে এক পেশেন্টের সিরিয়াস কন্ডিশন কারোর হেল্প লাগবে। রিসেপশনে যিনি ছিলেন আশেপাশে কাউকে দেখতে না পেয়ে হেনাকেই রিকোয়েস্ট করে একবার গিয়ে দেখতে। তার মধ্যেই সে কল করে কোনও ডাক্তারকে ডেকে নেবে। হেনাও তার কথা শুনে পড়ি কি মরি করে দৌড় লাগায় লিফটের দিকে।

কেউ লক্ষ্য করে না হেনা লিফটে উঠে পিছন ফিরতে ভুলে গেছে।

চারতলা কখন আসবে এইভেবে যখন হেনা উতলা হচ্ছে তখন হঠাৎ তার লিফট থেমে যায়। কলাপসিবল দরজার ফাঁক দিয়ে তার চোখ পড়ে সামনের অন্ধকার করিডোরে। সেই মুহূর্তে সে বুঝতে পারে তার করে ফেলা চরম ভুলটা। তৎক্ষণাৎ সে পিছনে ফিরে যায়। আর তিন নম্বর বাটনটা জোরে জোরে চাপতে থাকে কিন্তু লিফট কিছুতেই উঠতে চায় না। এমন সময় সে বুঝতে পারে তার পিছনে কলাপসিবল দরজার ঠিক ওপারে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। তার ঠাণ্ডা নিশ্বাস হেনার হাত পায়ে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে। ধীরে ধীরে সে দরজাটা টেনে খুলছে। এখন সে হেনার খুব কাছে এসে পড়েছে। সে যেন হেনাকে শুকছে ভাল করে। হেনার ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছা করে কিন্তু ঘাড় শক্ত করে সে দাঁড়িয়ে থাকে। এমন সময় ওর চুল ধরে সজোরে কেউ টেনে নিয়ে যেতে থাকে অন্ধকারে। মাথার প্রচন্ড যন্ত্রণায় সে জ্ঞান হারায়।

হেনারুপী এক মূর্তি পা বাড়ায় লিফটের দিকে।

চারতলা থেকে নার্সকে ফুরফুরে মেজাজে নামতে দেখে রিসেপশনে থাকা মুকুল অবাক হয়ে যায়।

“কি গো দিদি? পেশেন্ট ঠিক আছে?”

“হ্যাঁ ঠিক আছে! কেন কি আবার হবে?”

“তুমি তো এইসবে ফোন করে বললে যে পেশেন্ট এর অবস্থা ক্রিটিক্যাল। ডাক্তার ডাকতে। কাছে কোনও নার্স থাকলে পাঠাতে। আমি তো পাঠালাম হেনাকে। ডাক্তারদেরও ফোন করছি কিন্তু কারোর ফোন লাগছে না।”

“তুই কি ডিউটিতেও আজকাল টানছিস? করিস না ভাই। চাকরি চলে যাবে। আর কীবলছিস হেনা? ও তো যায়নি চারতলায়!”

“তাহলে কোথায় গেল? ওর সাইকেল তো এখানেই পড়ে আছে। বেচারি তাড়াহুড়োতে ওটাকে ফেলেই ছুটেছিল। আমি তুলে রাখলাম।”

“কি বাজে বকছিস? এইসবে রাতের নার্স আসাতে আমি নামলাম। অনেক রাত হল। আর বকাসনি। বাড়ি যাব। ভালো লাগছে না।”

মুকুলের মনের সন্দেহ ওকে দুতলায় নিয়ে ছুটল। সেখানেও সবার এক কথা হেনাকে তারা দুতলাতেও আসতে দেখেনি। এরপর ডক্টরদের কেবিন, বাথরুম সব জায়গা ভাল করে খোঁজা হল কিন্তু কোথাও হেনাকে পাওয়া গেল না। শুধুমাত্র একটা ফ্লোর কেউ খুঁজে দেখতে সাহস পেল না। তবে কি!?

দরজায় আওয়াজ শুনে হেনার মামিমা এসে দরজা খুলে দেখল হেনা দাঁড়িয়ে। সাইকেলটা নেই দেখে সে জিজ্ঞাসা করল, “কিরে সাইকেলটা কি হল?”

“আনতে ভুলে গেছি।”

“আনতে ভুলে গেছিস!”

হেনা তার মামিমাকে উপেক্ষা করে ঘরে ঢুকে এল। ঘরে ঢুকে সে চারপাশ এমনভাবে দেখতে থাকল যেন কাকে খুঁজছে।

“তুই ঠিক আছিস হেনা?”

“আচ্ছা মামিমা, তোমার চুলগুলোর কী হল?”

“চুল…? চুলের আবার কী হবে?!”

“আমি দেখেছি তুমি পরচুলা পরে থাক। এখন বল কী হয়েছিল? তুমি হঠাৎ কাজ ছেড়েই দিলে কেন? রাতের জন্য তো অন্য নার্স আছে। তোমায় তো রাতে ডিউটি কোনওদিন দেয়নি।”

“কে বলল? হ্যাঁ দিয়েছে। তুই কি করে জানবি? দুদিন?!”

“তাহলে তুমিই বল। সত্যি বলবে কিন্তু।”

“এর মধ্যে সত্যি মিথ্যার কী আছে?”

“তাহলে আমি বলি। তুমি আর ডাক্তারবাবু মিলে শেফালীকে খুন করেছ। সেই শাস্তি ডাক্তারবাবু তো পেয়েছে তুমিও পেয়েছ। শেফালীর আত্মা তোমার চুল টেনে ছিঁড়ে দিয়েছে। তুমি সেই থেকে আয়না দেখতে ভয় পাও। তোমার চুলের ওই হাল তুই সহ্য করতে পারো না।”

“না, আমি খুন করিনি। মিথ্যা কথা।”

“খুন করনি? তুমি আর ডাক্তারবাবু মিলে কন্যাভ্রণ্ হত্যা করতে। সেই কথা শেফালী জানতে পেরে তোমাদের কনফ্রন্ট করায় তোমরা তাকে খুন করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিয়ে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দাও।”

“তুই কে? তুই এত কথা কি করে জানলি?”

“সেখানেও তুমি থামলে না। তোমার নিজের মেয়েকে তুমি খুব নিষ্পাপ ভাব তাই না? সে একজন খুনি।”

“না, আমার মেয়ে খুনি নয়।”

“তাই? ওর ঘুমের মধ্যে বলা কথা থেকে তুমি কিছুই জানতে পারোনি? তুমি এত নীচ নিজের মেয়ের জীবনের সওদা ভাবলে ভাগ্নীকে দিয়ে করবে? ছি!”

“তুই কে? কে তুই?”

“আমার নামে রটালে আমি নাকি মানসিক অবসাদে ভুগছিলাম। তাই ওই রকম একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

মামিমা শেষের কথাগুলো শুনে বুঝতে পারে এটা হেনা নয়। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। শেষ মুহূর্তে মামিমা দেখল সেই দুচোখের বীভৎসতা। দুটো ঠাণ্ডা হাত তার গলা টিপে সমস্ত প্রাণ বায়ু নিঃশেষ করে দিল।

আজ কোচিং থেকে বেরিয়ে তিন্নি অবাক হয়ে গেল। রাস্তায় আছে হেনা দিদি। সে অবাক হয়ে দেখল তার গায়ে এখনও হসপিটালের পোশাক। সে এগিয়ে গিয়ে বলল, “দিদি? তুই এখানে?”

“তোকে নিতে এসেছি।”

“কিন্তু তোর সাইকেল কই? আর এই ড্রেসে?”

“সাইকেল লাগবে না। চল না আমার সাথে।”, এইবলে সে তিন্নির হাতটা ধরে।

কী বরফের মত ঠাণ্ডা হাত তার! তিন্নি মোহগ্রস্ত এর মত চলতে থাকে।

চলতে চলতে কখন সে পুকুর পাড়ে এসে পড়েছে খেয়াল নেই।

“দাঁড়া দিদি, পুকুরে পড়ে যাব তো!”

“আজ থেকে এক বছর আগে তুই তো এইভাবেই ফেলে দিয়েছিলি বর্ণালীকে। আমি সব জানতে পেরেছি।”

“তুই কী করে জানলি?”

“তুই তো ঘুমের মধ্যে সব বলেছিস।”

তিন্নি হেনার হাত ছেড়ে দুহাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে থাকে।

“আমি করতে চাইনি। আমি করতে চাইনি।”,কান্নার দমক তুলে বলে উঠে তিন্নি।

“তুই আর বর্ণালী দুজনেই ভালবাসতিস রাজকে। বর্ণালী তোর বেস্ট ফ্রেন্ড তাই সে তোকে বলেছিল সেই কথাটা। তুই দেখলি তোর সাথে দেখতে ভাল হবার কম্পিটিশনে বর্ণালী আগে তাই তুই ওকে এখানে নিয়ে এলি। তুই ভালো করেই জানতিস বর্ণালী সাঁতার জানে না আর দুপুরবেলা এইদিকটা ফাঁকাই থাকে। তুই বর্ণালীর অন্যমনস্ক হবার সুযোগ নিয়ে ওকে ঠেলে ফেলে দিলি। তারপর ও নিশ্বাস না নিতে পেরে তড়পাতে তড়পাতে মরল। তাই ও এখনও এখান থেকে যেতে পারেনি। ওই দেখ অপেক্ষা করছে!” এই বলে হেনা হাতটা পুকুরের দিকে দেখাল।

তিন্নি সেইদিকে তাকিয়ে দেখল সত্যিই জল থেকে মাথা তুলে আছে কেউ একটা। অন্ধকারে পরিষ্কার দেখা যায় না। তার উপর কান্নায় ওর চোখে ঝাপসা হয়ে আছে। কিন্তু ব্যাপারটা আঁচ করে সে ভয় পেল।

“চল, যাই ওর কাছে।”

“মানে?”

“ও আমার একমাত্র বোন। কাকিমা মারা যাওয়ার পর আমিই ওকে মানুষ করেছি। ও ডাকছে যাব না? চল, তুইও চল।”

“কি বলছিস? তোর বোন? তুই….”

তিন্নি কিছু বুঝে উঠার আগেই ওর হাত খামচে ধরে পুকুরে লাফ মারল দুজন… না, না একজন। অন্যজন তো হাওয়া হয়ে মিলিয়ে গেল।

অনেকক্ষণ খাবি খাওয়ার পর তিন্নির শরীরটা ভেসে উঠল জলের উপর।

শেফালী আজ অনেকদিন পর মুক্তি পেল। তার খুনিরা শাস্তি পেয়ে গিয়েছে। শুধু তার নয় তার বোনের খুনিকেও সে ছাড়েনি। সেদিন যখন তিন্নি তার মায়ের সাথে দেখা করতে যায় তখন থেকেই তার স্বপ্ন দেখা শুরু হয়। স্বপ্নে তাকে কেউ যেন এসে বলত সে খুনি। তার মা অনেক চেষ্টা করেছিল। জলপড়া, নুনপড়া, মাদুলি দিয়ে সব কিছু ঠিক করার কিন্তু মনের ভিতরের অপরাধবোধ তাকে শান্তিতে ঘুমাতে দিত না।

সেদিন রাতে অনেক সাহস সঞ্চয় করে মুকুল একাই গিয়েছিল তিন নম্বর ফ্লোরে। যা ভেবেছিল তাই। হেনা সেখানেই পড়েছিল। অজ্ঞান কিন্তু অক্ষত অবস্থায়।

সমাপ্ত

লেখিকা পরিচিতি : আমি ঈপ্সিতা মল্লিক। থাকি হাওড়াতে। পেশায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। ইঞ্জনিয়ারিং পড়ার পর আইটি সেক্টরে কর্মরত। অবসর সময় গল্প লিখি। প্রধানত ভৌতিক,অলৌকিক।

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post মরীচিকা| পলক ফেলা নিষেধ | পিয়ালী ঘোষ| Bengali Thriller Story
Next post ছক| পলক ফেলা নিষেধ | রাজশ্রী দত্ত| Bengali Thriller Story