সুমন খবরের কাগজের পাতা উল্টোতে উল্টোতে কিছু বলতেই যাবে এমন সময় দরজার বাইরে একজন বলে উঠল, “ভিতরে আসতে পারি?” সুমন ও অগ্নি সেই দিকে নিজেদের দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। আগন্তুকের বয়স হবে ষাটোর্ধ্ব, মাথার বেশিরভাগ চুল সাদা, পরনে তার সাদা ধুতি ও পাঞ্জাবি। তারা আগন্তুকে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দিল। ভেতরে ঢুকেই ভদ্রলোকটি একটি চেয়ার টেনে বসলেন, টেবিলের এই প্রান্তে আগন্তুক ও অপর প্রান্তে অগ্নি ও সুমন।
“নমস্কার আমার নাম যুধিষ্ঠির জানা।” দু’হাত জড়ো করে, আগন্তুক ভদ্রলোকটি বললেন। “নমস্কার, আমার নাম অগ্নি পাল আর ও হল সুমন সরকার।” অগ্নি বলল।
“আজ্ঞে… আপনারা কী ‘ভূত ধরা পার্টি’?” ভদ্রলোকের প্রশ্ন শুনে দুজনেই হতবাক হয়ে একে অপরের দিকে চাইল।
তারপর অগ্নি গলা খাঁকরানি দিয়ে বলল, “হুম… তা বলতে পারেন, বিদেশে আমাদের মত লোকদের ‘প্যারানর্মাল এক্সপার্ট’ বলে। তবে গোদা বাংলায় আপনি আমাদেরকে তা বলতেই পারেন।”
“যাক্… তাহলে ঠিক জায়গায় এসেছি। আমার মেয়ে আমাকে আপনাদের কথা বলে। সে আপনাদের ভিডিও-টিডিও মোবাইল ফোনে দেখে।” ভদ্রলোকটি বললেন।
“সে দেখতেই পারে, আমরা আমাদের সব কেসের ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় দিয়ে থাকি।” সুমন বলল
“কীভাবে যে আমার সমস্যার কথা আপনাদের বলি, আমার নিজেরই ভাবতে অবাক লাগছে।” এই বলে আগন্তুক একখানি রুমাল পকেট থেকে বের করে মুখমন্ডলে জমে থাকা ঘাম মুছে নিলেন।
অগ্নি এক গ্লাস জল আগন্তুকে দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “নিন জল খান, আর আপনি আপনার মত সময় নিয়ে বলুন, কোন তাড়া নেই।”
এই কথা শোনা মাত্রই, বৃদ্ধ লোকটি এক নিঃশ্বাসে সবটুকু জল খেয়ে নিলেন, তারপর একটি স্বস্তির শ্বাস ছাড়লেন, তারপর নিজের কাহিনী শুরু করলেন, “আমার বাড়ি চণ্ডীপুরে, সেখানকার জমিদার বাড়িতে গোমস্তার কাজ করি। বর্তমানে জমিদারের জমিদারি বলতে, আছে খালি কয়েক বিঘা ধান চাষের জমি। ইংরেজদের খাজনা মেটাতে মেটাতে অনেক জমি সরকারের দখলে চলে গিয়েছে। বর্তমান জমিদারের নাম অমরেশ মজুমদার, ওঁকে গ্রামের লোকেরা সমীহ করে ‘বড় দাদাবাবু’ বলে সম্বোধন করেন, তাদের সঙ্গে আমিও। বড় দাদাবাবুর স্ত্রী কমলা দেবী গত হয়েছেন বছর দুয়েক আগে। ওঁর দুই সন্তান, বড় ছেলের নাম বনি, ছোট ছেলের নাম রনি। ওঁর বড় ছেলে বনি দুবাই-এর একটি বড় টেক কম্পানির সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। সমস্যা হল ছোট সাহেব মানে রনিকে নিয়ে, সে তার বড় দাদার একদম বিপরীত ধর্মী, ছোটবেলা থেকেই সে ডানপিটে, ইদানিং মাকে হারানোর পর সে যেন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল, যা খুশি তাই করত, অসৎ সঙ্গে পরে সে নেশা-ভাঙ্গ করত, জুয়া খেলত, দিনের পর দিন এই রকম অসভ্যতামী করত, বড়দেরও মানত না, কোনও কোনও দিন তো বাড়িতেই ফিরত না সে। ব্যবসার কাজে বড় দাদাবাবুকে প্রায়ই বাইরে যেতে হয়, কখনো সপ্তাহ খানেকের জন্য কখনো বা মাস খানেকের জন্য, উনি যাবার আগে ছোট সাহেবকে হাজার বিশে’ক টাকা দিয়ে চলে যেতেন। আর ছেলেও সেই টাকা নিয়ে উশৃঙ্খল জীবন যাপন করত। দিন রাত এই রকম অরাজকতা তো আর চোখে দেখা যায় না, মশাই….!
আর থাকতে না পেরে একদিন সব কথা বড় দাদাবাবুকে বলেই দিলাম, শোনা মাত্রই উনি আমাকেই উল্টে ধমক দিয়ে বললেন, “ও যা করে করতে দাও, ওকে বাধা দিও না।” একদিন তো ছোট সাহেব নিজের বাবার সামনে মদ খেয়ে বাড়ি ফিরেছিল, তাও তার বাবা তাকে কিছুই বলল না। বড় দাদাবাবু ছেলের ভালোবাসায় ‘অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র’, ছেলের কোন দোষই তার চোখে পড়ে না।
আসলে স্ত্রী মারা যাওযার পর থেকেই বড় দাদাবাবু কেমন যেন উদাসীন হয়ে উঠেছেন। ওঁর ব্যবসায়েও বেশ কয়েক মাস ধরে মন্দা চলছিল। তো আমি ভাবলাম তাই হয়তো তিনি তার ছেলেটাকে ঠিক মত সময় দিতে পারছেন না, তাই এখন একটু এই রকম হচ্ছে, পরে সব ঠিক হয়ে যাবে।”
এতক্ষণ পরে, সুমন জিজ্ঞাসা করল, “আপনার সমস্যাটা কোথায়..? মানে আমরা আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি?”
“হ্যাঁ, আমি সেই প্রসঙ্গে আসছি” এই বলে যুধিষ্ঠিরবাবু একটু থেমে, আবার বলতে শুরু করলেন, “মাসখানেক আগে, এক পূর্ণিমার রাতে ছোট সাহেবের ঘর থেকে তার এক তীব্র আর্তনাদ শুনতে পেলাম। তার চিৎকারে শুনে বাড়ির সকলে ছুটে যায় সেখানে। বড় দাদাবাবু, আমি ও বাড়িতে থাকা বাকি চাকর-বাকরেরাও। ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল, সবাই মিলে দরজায় বার কয়েক ধাক্কা দিতেই দরজা ভেঙ্গে পড়ে যায়, ভেতরে গিয়ে দেখি রনি সাহেব মেঝেতে পড়ে আছে অচৈতন্য অবস্থায়, তার মুখ দিয়ে গাজলা বের হচ্ছে। তাকে আমরা সবাই মিলে ধরাধরি করে বিছানায় শুইয়ে দিলাম। তার গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছিল। তারপর তার চোখে মুখে ঠান্ডা জলের ঝাপটা দিতেই সে সম্বিত ফিরে পেল, তাকে ঘিরে আমরা সবাই জিজ্ঞাসাবাদ করতে লাগলাম, যে তার এই অবস্থা হল কীভাবে? তারপর সে অস্ফুট স্বরে বলল, “আমি কি…কি…কিছু জা…জানি না, আ…আমি কিছুই করিনি। আ..আমাকে ছে..ছে..ছেড়ে দাও রা… রা…রানু।”
তার মুখ থেকে ‘রানু’র নাম শুনে আমরা চমকে উঠি। সবার মুখে একটাই প্রশ্ন, “ছোট সাহেব রানুর নাম কেন নিল? কারণ রানু তো মারা গেছে মাসখানে আগে। তাহলে.?” তার পরের দিন ডাক্তার ডেকে আনা হল, এবং তার জ্বর কমানো হল। এই অবধি সব স্বাভাবিক ছিল, তারপর ঘটে বিপদ।”
“বিপদ! কেমন বিপদ?” উৎসুক হয়ে সুমন প্রশ্নটা করল
“সে কী…আর যেমন তেমন বিপদ…!” একটু থেমে তিনি আবার বলতে শুরু করলেন, “সেদিন ছিল এই সবের শুরু, তারপর প্রায়ই রাত বাড়ালেই সবার ঘুমিয়ে পড়ার পর ভেসে আসে চাপা মেয়েলি কান্নার আওয়াজ, রনির ঘর থেকে, তার কয়েক দিন পর থেকেই পুরো বাড়িতে মনে হয় কেউ যেন হাঁটাচলা করে বেড়াচ্ছে আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলে সেই হাড় হিম করা কান্না। আর ছোট সাহেব ঐ ঘটনার পর বাড়ি থেকে বেরোনো তো দূর ঘরের চৌকাঠ ডিঙোয় না। সারাক্ষণ ভয় ভয় থাকে। শুধু রনিই নয় বাড়ির প্রতিটি মানুষ এখন ভয় দিন কাটাচ্ছে। এখন এমন অবস্থা হয়েছে যে রাতে কেউই আটটার পর আর সেই বাড়িতে থাকতে চায় না। সবাই দিনের বেলায় কাজ-টাজ সেরে সন্ধ্যা হতে না হতেই সব পালাই পালাই করে। মাঝে মাঝে হিসেব-নিকেশ করতে করতে অনেক রাত হয়ে যায়, তার ফলে বাড়ি ফেরা হয় না তখন অগত্যা আমাকে থেকে যেতে হয় জমিদার বাড়িতে। কিন্তু আমার ঐ সবের ভয় নেই, তিন কাল গিয়ে এক কালে এসে ঠেকেছে। যা হবার, তাই হবে।”
এত অবধি সব শুনে-টুনে অগ্নি প্রশ্ন করল, “আপনি বললেন যে, রনি রানুর নাম করেছিল, তাই তো? কে এই রানু? আর তার মৃত্যুটা কীভাবে হয়, তার মৃত্যুটা কী স্বাভাবিক না অস্বাভাবিক? না মানে… অসুখে না অন্য কোনও কারণে তার মৃত্যু হয়?”
যুধিষ্ঠিরবাবু উত্তর দিলেন, “রানু আমাদের মালি নিতু’র একমাত্র মেয়ে, এ বছর দোল পূর্ণিমার রাতে সে ঝিলে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে। মেয়ের মৃত্যু মেনে নিতে পারেনি নিতু, তার কয়েক দিন পর সেও আত্মহত্যা করে। রানুর মৃতদেহ যখন উদ্ধার করা হল, তখন তা দেখে সবার মনে হল কেউ বা কারা যেন তার সম্মানহানি করেছিল। গরিব বলে ব্যাপারটা বেশী দূর গড়াল না।”
“রানুর মৃত্যুর সঙ্গে কী রনি জড়িত?” প্রশ্নটা করল অগ্নি ।
আমতা আমতা করে যুধিষ্ঠিরবাবু উত্তর দিলেন, “আমি নিশ্চিত ভাবে তা বলতে পারব না; তবে ঐ ঘটনার কয়েক দিন পর একজন কাজের লোক রনি ঘর পরিষ্কার করতে করতে খাটের তলায় ঝাঁট দেবার সময় সেখানে রাখা একটা বাক্স থেকে একটা লাল রঙের কাপড়ের টুকরো বেরিয়ে থাকতে দেখে, উৎসুকের বশে সেটা টানতেই, কাপড়টি বেরিয়ে আসে। কাপড়টি আসলে ওড়না ও তার সঙ্গে একটা চুলের ক্লিপও ছিল। সে সেটা দেখেই চিনতে পারে, যে ঐ ওড়না ও ক্লিপটি আসলে কার। সেই চাকর অন্দরমহলে সবাইকে বলে দেয়; তাতে আর আসল ঘটনাটি বুঝতে কারুর কিছুই বাকি রইল না।”
অগ্নি সবটুকু বুঝে বলল, “তার মানে, রনিই রানু নামক মেয়েটির সম্মানহানি করে, তার ফল স্বরূপ রনিকে ঐ মেয়েটির আত্মা হন্ট করছে। আর আপনি চান আমরা আপনার রনিকে উদ্ধার করি; তাই তো?”
উত্তরে যুধিষ্ঠিরবাবু বললেন, “হ্যাঁ… আপনি একদম ঠিক ধরেছেন।” এই বলে উনি ওদের দুজনের দিকে একটি খাম এগিয়ে দিলেন, সুমন খামটা খুলে দেখল তার মধ্যে কড়কড়ে সবুজ টাকার বান্ডিল, “অগ্রিম পনেরো হাজার টাকা এখন নিন। বাকিটা পরে কাজ হয়ে গেলে পেয়ে যাবেন।” এই বলে যুধিষ্ঠিরবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন, বিদায় নেওয়া আগে ওদের দুজনকে নিজের ফোন নাম্বার, ঠিকানা দিয়ে গেলেন।
লোকটি চলে যাওয়ার পর অগ্নি সুমনকে বলল, “একটা অপরাধীকে সাহায্য করে কী ঠিক করছি?” সুমন উত্তরে বলল, “আমাদের কাছে ছ’মাস ধরে কোনও কেস আসেনি, এতদিন পর একটা কেস এল, সেটাকেও যদি ছেড়ে দিই তাহলে কীভাবে চলবে? তুমি বেশী ভেব না সব ঠিক আছে।” সুমনের কথা শুনে অগ্নি একটু ভরসা পেল। শেষে সেও রাজী হয়ে গেল।
(২)
নির্দিষ্ট দিনে, ভোর পাঁচটার ট্রেনে রওনা দিল দুজনে, গন্তব্য স্থলে বেলা এগারোটা নাগাদ পৌঁছাল। স্টেশন থেকে বেরিয়ে কিছু দূর এগিয়ে গিয়ে দেখল মেইন রোডের বা পাশ দিয়ে একটা কাঁচা পাকা শাখা রাস্তা বেরিয়েছে। ঠিক যেমনটা যুধিষ্ঠিরবাবু বর্ণনা দিয়ে ছিলেন, এখানে আসার আগে ফোনে। রাস্তার দুপাশের বাড়িগুলো কোনওটা কাঁচা দড়মার বেড়া দেওয়া আবার কোনওটা পাকা, দু-চারটে দোতলা ও তিনতলা বাড়িও আছে। বাড়িগুলোর মধ্যে দূরত্ব পঞ্চাশ-ষাট ফুট হবে। কেস সলভ করার ফাঁকে ছুটি কাটানো হবে; দুজনেই তা ভাবল। আর কিছু দূর এগিয়ে যেতেই যুধিষ্ঠিরবাবু এবং ওঁওঁর সঙ্গে আরও দুজন, ওদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে ওরা দাঁড়িয়ে পড়ল। যুধিষ্ঠিরবাবু তাদেরকে জমিদার বাড়িতে নিয়ে যেতে এসেছেন, পাছে যদি তারা পথ ভুল করে বসে।
চলতে চলতে তারা একটা পুরনো মন্দিরের সামনে উপস্থিত হল, মন্দিরের ভেতরে পুজো হচ্ছিলো। ঘন্টার ধ্বনি ও চারিপাশে খোলামেলা পরিবেশ, এক আধ্যাত্মিকতার অনুভূতি সৃষ্টি করল ওদের দুজনের মনে।
“মন্দিরটি কত বছরের পুরনো হবে?” অগ্নি প্রশ্ন করল যুধিষ্ঠিরবাবুকে।
“তাও দেড়শো বছরের পুরনো এই চণ্ডী মন্দির। শ্রী অশোক কুমার মজুমদার, বড় দাদাবাবুর প্রপিতামহ, তিনি এই মন্দিরের স্থাপনা করেন স্বপ্নাদেশ পেয়ে। মন্দিরটি তৈরি করার সময় তৎকালীন ইংরেজ সরকার শ-দুশো বিঘা জমি, তাতে সোনালী ধান ফলেছিল, সেটি খাজনা হিসেবে দাবি করেন। আর তা না দিলে মন্দির স্থাপনের অনুমতি দেবে না ইংরেজ সরকার। অগত্যা ওঁকে তাদের দাবি মেনে নিতে হয়। এই মন্দিরের দেবী চণ্ডী খুবই জাগ্রত, তাই তো এখনও পুজো দিতে লোক আসে দূর গ্রাম থেকে। এই মন্দিরের জন্যই এ গ্রামের নাম হয় ‘চণ্ডীপুর’।” যুধিষ্ঠিরবাবু উত্তর দিলেন।
তারপর মন্দিরের পাশের রাস্তা অনুসরণ করে ওরা পৌঁছে গেল জমিদার বাড়ির সামনে। প্রকান্ড বাড়িটি পুরনো দিনের হিন্দি সিনেমার হাভেলির কথা মনে করিয়ে দেয়, দোতলা বাড়ি, দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থ বেশ চওড়া। গেট থেকে বাড়ির বারান্দার দূরত্ব হবে তাও কমপক্ষে সত্তর-আশি ফুট, আর এই দূরত্ব অতিক্রম করার জন্য রয়েছে বাধানো ছ’ফুট চওড়া রাস্তা, রাস্তার দু’পাশে নানান রঙের ফুলের বাগান। তারপর বারান্দা পেরিয়ে ঘরে ঢুকতেই সামনে একজনের আর্বিভাব হল, ছ’ফুট লম্বা, পরনে কালো রঙের সাফারি স্যুট, চোখে গোল্ডেন ফ্রেমের রিমলেস চশমা। মিশমিশে কালো চুল, তাতে ডান পাশ থেকে সিঁথি কাটা। বুঝতে কোনও অসুবিধাই হল না ওদের যে, ইনি অমরেশ মজুমদার ওরফে বড় দাদাবাবু।
ভদ্রলোক ওদের দুজনকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আপনারা কলকাতা থেকে এসেছেন বুঝি?” ওরা সম্মতিসূচক ভাবে মাথা নাড়াল। “নমস্কার, আমার নাম অমরেশ মজুমদার।” ভদ্রলোকটি হাত জোড় করে বলল। সুমন ও অগ্নি, নিজেদের পরিচয় দিয়ে ফেলল চট করে। এরপর অমরেশবাবু তাদের ভেতরে ঢোকার অনুমতি দেয়। বাড়িটি বাইরে থেকে পুরনো দেখতে হলেও, ভেতরে সব রকম অত্যাধুনিক সুবিধা আছে, বিশাল বড় ড্রয়িং রুমের মাঝখানে সোফা সেটটায় সবাই নিজের নিজের স্থান নিয়ে বসল।
ভেতর থেকে একজন জলখাবার নিয়ে এল, সেই জলখাবার খেয়ে নেওয়ার পর, অমরেশবাবু ওদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, “আশা করি, যুধিষ্ঠিরবাবু আপনাদেরকে সব কিছুই বলেছেন?” ওদের থেকে প্রায় এক সাথেই হ্যাঁ সূচক উত্তর এল। “তাহলে আমাকে আলাদা করে আর কিছুই বলতে হবে না” প্রত্যুত্তর দিলেন অমরেশবাবু, এই বলে উনি উঠে চলে গেলেন।
যুধিষ্ঠির মশাই ওদের দুজনকে গেষ্রুমে নিয়ে এলেন, “এই ঘরটি আপনারা আসবেন বলে আমি কাজের লোকদের বলে সাফ করিয়ে দিয়েছি। এবার আপনারা একটু জিরিয়ে নিন। রাতে খাবার সময় দেখা হবে, দুপুরে আমি ব্যস্ত থাকব তাই এদিকে আসতে পারব না।” যাবার সময় উনি ভোলা নামক একজন চাকরকে ডেকে ওদের দুজনের দেখা শোনার ভার দিয়ে সেই ঘর থেকে বিদায় নিলেন।
সুমন ও অগ্নি কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে এই হাভেলিটাকে এক্সপ্লোর করতে বেরিয়ে পড়ল। ভেতরে-বাইরে আনাচে-কানাচে সব জায়গায় ঘুরে ঘুরে দেখে নিল, তারপর লাঞ্চ সেরে নিজেদের রুমে চলে গেল ওরা। কিছুক্ষণ পরে ভোলাকে ডাক দিতেই সে হাজির হল ওদের সম্মুখে, তারপর তাকে বলা হয় রনির ঘরে নিয়ে যেতে, এই আদেশ শুনেই তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে য়ায়। তাকে তার ভয়ের কারণ জানতে চাওয়ায় সে আমতা আমতা করতে করতে বলল, “ছোট সাহেবের ঘর থেকে রাতে মাঝে মাঝে কান্নার আওয়াজ আসে। ভয় তখন আমরা কাঠ হয়ে যাই।”
“কান্নার আওয়াজ কী প্রতিদিন রাতে আসে?” প্রশ্ন করল সুমন। ভোলা উত্তরে বলে, “না, প্রতি রাতে আসে না ওই হপ্তায় একবার বা দুবার সেই আওয়াজ পাওয়া যায়, মেয়েলি কন্ঠের স্বর, ভয় আমরা দিনেও সেদিকে যাই না, আমাদের বাঁচান বাবু।”
“ঠিক আছে বেশ, তোমাকে সেখানে যেতে হবে না, আমাদের দেখিয়ে দাও আমরাই চলে যাচ্ছি সেখানে” অগ্নি বলল।
তারপর ভোলা রনির ঘর দেখিয়ে দেয়, দোতলার লম্বা বারান্দাটার শেষ প্রান্তের ডান পাশের ঘরটাই হল রনির। ঘরের ওরকম অবস্থানের জন্য রনিকে বাকিদের থেকে সহজেই বিচ্ছিন্ন রাখা যায়। ওরা দুজনে ঘরে ঢুকে গেল, ঘরে মাঝখানে একটা খাট, খাটের উপর শুয়ে আছে রনি, শীর্ণ শরীর দেখলেই বোঝা যায় সে অসুস্থ। ঘরে আসবাবপত্র বলতে বেশী কিছু নেই, রয়েছে একটা বাক্স। ওদের দুজনে পায়ের আওয়াজে রনি চোখ মেলে তাকাল, তারপর কনুইয়ে ভর দিয়ে উঠতে যেতেই সুমন বাধা দিয়ে বলল, “না না, উঠতে হবে না, আমরা একটু পরেই চলে যাব,” এই বলাতেই ছেলেটি আবার শুয়ে পড়ল। রনির চোখ দুটো গর্তে ঢোকা আর ঢুলু ঢুলু, তার নীচে ডার্ক সার্কেল, সারাক্ষণ সে ঘুমাচ্ছন্ন থাকে, দেওয়ালে টাঙ্গানো বছর খানেক পুরনো ছবির সঙ্গে বর্তমান রনির কোন মিল নেই বললেই চলে। দিনের আলোতে ঘরটা দেখে নেওয়া দরকার ছিল তাদের।
রাতে খাবার টেবিলে বসে, খাবার খেতে খেতে অমরেশবাবু প্রশ্ন করলেন, “কত দিন লাগবে আপনাদের কাজ শেষ হতে?”
অগ্নি বলল, “এটা নির্ভর করছে স্পিরিটের উপর, যতক্ষণ না সে আমাদের করা কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে ততক্ষণ আমাদের কাজ অসম্পূর্ণ।”
“আগামী সোমবার আমি ব্যবসার কাজে বাইরে চলে যাব, যদি তার আগে…” অমরেশবাবু কথা শেষ করার আগেই সুমন বলে ফেলল, “কোনও চিন্তা করবেন না; আমাদের কাজ তার আগেই শেষ হয়ে যাবে। আজই আমরা কাজ শুরু করে দিচ্ছি চার-পাঁচ দিনের মধ্যে আমাদের কাজ শেষ হয়ে যাবে।”
তারপর খাবার খেয়ে সবাই নিজের নিজের ঘরে চলে গেল। তারপর সুমন আর অগ্নি, রনির ঘরে এল তারপর তাদের কাজ শুরু করে দিল। প্রথমে দুদিকে দুটি ক্যামেরা সেট আপ করল, একটি রনির দিকে, অন্যটি ঘরের কোণার দিকে এমন ভাবে রাখল যাতে পুরো ঘরটা ফ্রেমে বন্দি হয়, মোশন সেন্সর যন্ত্রটি ঘরের ঠিক মাঝখানে রাখল, এই যন্ত্রের সাহায্যে পাঁচ মিটার রেডিয়াসের মধ্যে কোন মুভমেন্ট হলে এটির আলো জ্বলে উঠবে। ওরা দুজন রনির ঘরের বাইরে ও ভেতরে ইএমএফ মিটার দিয়ে স্ক্যান করল, এই মিটারে সূক্ষ যে কোন তরঙ্গ ধরা পরে তাই কোন স্পিরিট কাছাকাছি থাকলে তা এই যন্ত্রের সাহায্যে বোঝা যাবে। এই যন্ত্রপাতিগুলোর দ্বারা তাদের তদন্ত শুরু করে দিল। রনি তার বিছানায় অঘোরে ঘুমিয়ে আছে। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে তাকে ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়, যাতে মাঝ রাতে ভয় পেয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে না যেতে পারে। এই রকম সে আগে দু-তিন বার করেছিল, কিন্তু দারোয়ান প্রতি বার তাকে দেখে ফেলে, তাই রক্ষে।
কিছুক্ষণ পর ঘড়ির কাঁটা জানিয়ে দিল রাত বারোটা বাজে। সুমন অদৃশ্য শক্তির উদ্দেশ্য বলল, “এই ঘরে কী কেউ আছেন? যদি থেকে থাকেন তাহলে নিজের উপস্থিতি জানান, আপনি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।” কিন্তু ইএমএফ মেশিনে কোন আন্দোলন হল না, মোশন সেন্সরেও আলো জ্বলে উঠল না। তারপর আরও কয়েক ঘন্টা অপেক্ষা করার পর কোন কিছু হাতে এল না তাদের। বাধ্য হয়ে তারা নিজেদের রুমে চলে গেল।
প্রথম দিন ব্যর্থতার পর তারা আবার দ্বিতীয় দিন রাতে বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর নিজেদের চেষ্টা চালিয়ে গেল। তারা আবার বিফল হল। এরপর তৃতীয় দিন রাতে আবার তারা তাদের প্রয়াস চালিয়ে গেল। ঘড়িতে তখন তিনটে, ওদের দুজনের চোখ বুজে আসছিল, দুজনে ঠিক করল এখন নিজেদের ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়বে, সকালে এসে সব যন্ত্রপাতি নিয়ে যাবে, তাই যেমন ভাবা তেমন কাজ। ওরা নিজেদের ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ার কিছুক্ষণ পর একটা শব্দে ঘুম ভাঙল, বাইরে যেন একটা হৈ হট্টগোল হচ্ছে। মোবাইলে দিকে তাকিয়ে অগ্নি দেখল পৌনে চারটে বাজে। তারপর দুজনে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। রনির ঘরের দিকে থেকে আওয়াজটা আসছে। ওরা সেখানে গিয়ে দেখল ঘর থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে, রনির ঘরে আগুন লেগেছে, ইতিমধ্যে সবাই আগুন নেভানোর কাজ শুরু করে দিয়েছে। ঘন্টা খানেক মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে ওরা দুজনে ভিতরে ঢুকে দেখল তাদের ক্যামেরা সহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি আগুনে জ্বলে পুড়ে গেছে, কিছু আর আস্ত নেই। কিন্তু ভাগ্যের জোরে রনি বেঁচে যায়, অক্ষত অবস্থায়। নিজের ছেলেকে বাঁচাতে গিয়ে অমরেশবাবুর ডান হাতের বেশ খানিকটা অংশ পুড়ে যায়। বাড়ির সবাই ফিসফিস করে বলতে লাগল, “এটা ঐ অতৃপ্ত আত্মার কাজ, ঐ আত্মা আর ছোট সাহেবকে জীবিত রাখবে না।” অগ্নি ও সুমন ওদের পুড়ে যাওয়া জিনিসপত্র নিজেদের থাকার ঘরে নিয়ে আসে। যদিও এখন ভোরের সাড়ে পাঁচটা, ওদের দুজনের আর ঘুম এল না চোখে, সুমনের চিন্তা ওদের পুড়ে যাওয়া ক্যামেরা ও অন্যান্য মেশিন নিয়ে। চিন্তায় আর থাকতে না পেরে সুমন প্রশ্নটা করেই ফেলল, “আমাদের সব মেশিন নষ্ট হয়ে গেল, এখন কী হবে? নতুন কিনতে গেলে এখন প্রায় লাখ টাকার ধাক্কা, এত টাকা কোথায় পাব?” অগ্নি হাত দুটো ভাঁজ করে মাথার পেছনে রেখে বালিশের উপর হেলান দিয়ে শুয়ে ভ্রুকুটি করে উপরের সিলিং-এর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে কী একটা চিন্তা করছিল, সুমনের একটা জোরে ধাক্কা দেওয়া তার সম্বিত ফেরে এল।
“কী এত ভাবছ?” প্রশ্ন করে সুমন।
“তেমন কিছু না” উত্তর দিল সে।
সকাল সাতটা নাগাদ ওদের ঘরের দরজায় বার কয়েক টোকা পড়ল। দরজা খুলতে যুধিষ্ঠিরবাবু ঘরে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়লেন। “যুধিষ্ঠিরবাবু আপনাকে এত চিন্তিত দেখাছে কেন?” প্রশ্ন করল সুমন।
যুধিষ্ঠিরবাবু একটু বিরাম নিয়ে বলল, “চিন্তার কারণ আছে বলেই তো চিন্তিত দেখাছে; বড় দাদাবাবুর এটা মনে হচ্ছে যে, কাল রাতে যে ঘটনা ঘটল তার জন্য আপনারা দায়ী।”
“কেন?” দুজনে প্রায় এক সঙ্গে হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।
যুধিষ্ঠিরবাবু আমতা আমতা করে বলল, “ওঁওঁর বিশ্বাস আপনাদের জন্য ঐ অতৃপ্ত আত্মা আমাদের উপর রুষ্ট হয়ে এমন একটা দূর্ঘটনা ঘটায়। আর উনি চান না বেশী লোক জানাজানি হোক। তাই যদি আপনারা….”
“ঠিক আছে…. ঠিক আছে আমরা আজই চলে যাব কিন্তু যাবার আগে একবার আপনাদের বড় দাদাবাবু সঙ্গে দেখা করতে চাই।” অগ্নি বলল।
যুধিষ্ঠিরবাবু তাদের শর্তে রাজী হয়ে সম্মতি সূচক মাথা নাড়াল। আর যাবার আগে পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা খাম বের করে বলল, “এটার মধ্যে আপনাদের পারিশ্রমিক ও ক্ষতিপূরণ বাবদ দেড় লক্ষ টাকা আছে, এটা বড় দাদাবাবু আপনাদেরকে দিতে বলেছিলেন।”
সুমন সঙ্গে সঙ্গে খামটি নিয়ে নিল, খামের মুখটা খুলতেই কড়কড়ে টাকা দেখেই তার পাংশু মুখে চওড়া হাসি খেলে গেল। অগ্নি নিচু স্বরে ভ্রু কুঁচকে বলল, “স্পিরিট নিজে নিজে এসে আগুন লাগালো! স্ট্রেঞ্জ ভেরী স্ট্রেঞ্জ…!”
দুজনে নিজের ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিয়ে, ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় দেখল ড্রয়িং রুমটার সোফার উপর অমরেশবাবু পায়ের উপর পা তুলে ধূমপান করছিলেন। ওরা দুজন ও অমরেশবাবু একে অপরের সঙ্গে কুশল বিনিময় করলেন। “শুনলাম আপনার আমার সঙ্গে দেখা করতে চান?” প্রশ্ন করলেন অমরেশবাবু।
“হ্যাঁ, তেমন কিছুই না, আমি আপনাকে কিছু দেখাতে চাই।” এই বলে অগ্নি পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বার করে একটু ফোনটা ঘাঁটাঘাঁটি করে, একটা ভিডিও চালিয়ে অমরেশবাবু মুখের সামনে ফোনটা তুলে ধরল। কিছুক্ষণ ফোনের ভিডিওটা দেখার পর অমরেশবাবুর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল এবং তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে জমতে তা একত্রিত হয়ে জলধারার ন্যায় কপাল থেকে গড়িয়ে পড়ল। তারপর ফোনটা নিজের হাতে নিয়ে, ফোনটা ছুড়ে ফেলার জন্য ওঁওঁর ডান হাতটা উঁচিয়ে তুললেন, তখনই অগ্নি, অমরেশবাবুর ভাবগতিক বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে ওঁওঁর হাতটা চেপে ধরে বলল, “এমন কাজ ভুলেও করবেন না, এই ভিডিওর কপি শুধু আমার ফোনেই নয়, আরও অনেক ডিভাইসে সেভ করে রেখেছি, ভাগ্যিস আমি রনির ঘরে একটা ছোট্ট স্পাই ক্যামেরা লুকিয়ে রেখেছিলাম সবার চোখের আড়ালে, আর তাই ,,,,,,” নিজের মুখে কথা অসম্পূর্ণ রেখে অগ্নি অমরেশবাবুর হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিল, তারপর দুজনে মিলে জোর করে অমরেশবাবুকে সোফায় বসিয়ে দিল, তারপর অগ্নি নিজের কথা সম্পূর্ণ করল, “আর তাই আমি দেখতে পাই যে, আপনি মানে ‘বড় দাদাবাবু’ রনির ঘরে নিঃশব্দে ঢোকেন, সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর, তারপর আমাদের সব গ্যাজেটে আগুন ধরিয়ে দিলেন, পরে সারা ঘরে। আমি ভাবি, আপনার ঘর রনির ঘরের থেকে দূরে থাকার সত্ত্বেও কীভাবে আপনি আমাদের আগে সেখানে উপস্থিত হলেন। আর আগুন লাগানো সময় আপনার ডান হাত ও পাঞ্জাবির নীচের অংশ খানিকটা পুড়ে যায়। আমার প্রশ্নটা এখানে; কেন আপনি এটা করলেন? আর কেন আপনি নিজের ছেলেকে মারতে চান?” সুমন অমরেশবাবু কাঁধটা জোরে খামচে ধরল।
(৩)
অমরেশবাবুর মুখ রাগে লাল হয়ে গেল, রক্তবর্ণ চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত ঘষে জোরে হুংকার দিয়ে বললেন, “রনি আমার ছেলে না!”
এ কথা শোনা মাত্রই পর্দার আড়াল থেকে লুকিয়ে সব ঘটনা দেখতে থাকা যুধিষ্ঠিরবাবুও হতভম্ব হয়ে বলেই ফেললেন, “ও মা! সে কী!”
অমরেশবাবু বলতে থাকলেন, “আমার স্ত্রী কমলা মারা যাওয়ার পর আমি দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ি, আমার মাথা তখন ঠিক ছিল না। সারাক্ষণ কমলার স্মৃতি আমাকে তাড়না করত, শান্তিতে ঘুমাতে দিত না স্মৃতিগুলো। কোনও কাজে মনোনিবেশ করতে পারতাম না আর। ওদিকে আমার ব্যবসার ক্ষতি হয়েছিল প্রচুর। তাই ভাবলাম আর এই ভাবে বেশি দিন চলতে থাকলে আমি নিজেই নিজেকে শেষ করে ফেলব একদিন। এটি যাতে সত্যি না হয় তাই আমি কমলার সব স্মৃতি নিজের জীবন থেকে মুছে ফেলতে থাকি। প্রথমে আমি কমলার ব্যবহৃত সব কাপড়-চোপড় জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিলাম। তারপর তার ছবি, তার লেখা কবিতার খাতা সব জ্বালিয়ে দিলাম। একদিন কমলার পুরনো কাপড়ের ভাঁজে একটা চামড়া দিয়ে বাধানো খয়েরি রঙের ডাইরি খুঁজে পাই, ডাইরিটাকে এত গোপন করে রাখার জন্য আমার একটু খটকা লাগে, তারপর দেখি ডাইরির পাতার মাঝে ভাঁজ করা কয়েকটা চিঠি পাই। সেই চিঠিগুলি আমার ভাই সমরেশের লেখা। সেই চিঠি পড়ে জানতে পারি কমলা ও সমরেশের মধ্যে একটি প্রেম বন্ধন ছিল। সেখানে রনির কথা উল্লেখ ছিল। আর তাতেই জানতে পারি, রনি… যাকে আমি সবচেয়ে বেশী স্নেহ করতাম, সেই রনি আমার সন্তান নয়। মনে আমার আরও জোরে আঘাত লাগে। এক লহমায় সব মায়া আমি কাটিয়ে ফেলি। রনির দোষ হল ওকে দেখতে ওর মায়ের মত, সত্য জানার পর ওকে দেখলেই, কমলার আমার প্রতি করা প্রতারণার কথা মনে করিয়ে দিত। যেহেতু ও আমার ছেলে না আর ওকে দেখতে কমলার মত তাই ওকে আমি পুড়িয়ে মারব। কিন্তু মারব বললেই তো আর মারা যায় না? তাই আগে আমি আমার ব্যবসাটাকে দাঁড় করাব তারপর রনিকে শেষ করব। তারপর থেকে ওর খাবারে রোজ একটু একটু করে নেশার দ্রব্য মেশাতে থাকি, আর কেউ এটা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি। এই রকম কয়েক সপ্তাহ করার ফলে রনি ধীরে ধীরে নেশাগ্রস্ত হয়ে উঠে। আর আমি বাড়ি না থাকলে ও নিজের থেকেই নেশা করতে থাকে। যা দেখে আমি খুবই খুশি হতাম। সেদিন রাতে রনির নেশার পরিমাণটা বেশি হয়ে গিয়েছিল। আমি সেই সুযোগে ওর মাথায় এটা ঢুকিয়ে দিলাম যে, ও রানু মৃত্যুর জন্য দায়ী, আর ঐ অপদার্থটা এটা মেনে নিল। আর সবাই ভাবে রনিকে রানুর ভূতে ধরেছে। মূর্খ… মূর্খ… সবকটা মূর্খ, তা না হলে কী কেউ সাউন্ড সিস্টেমের আওয়াজ শুনে ভয় পায়?” শেষের অংশটুকু বলে অমরেশবাবু জোরে জোরে হাসতে লাগল।
এত দূর সব শুনে অগ্নি বলল, “তাই আপনি রনিকে পাগল প্রমাণিত করতে চেয়েছিলেন, যাতে আপনার কাজটা সহজ হয়ে যায়, তার মানে রানুর মৃত্যুর জন্য রনি দায়ী নয়। তাহলে রানুর কী হল? রানুকে আপনি হত্যা করেন, আর দায় রনির উপর চাপিয়ে দেন তাই তো অমরেশবাবু? এবার বলুন তো রানুকে কীভাবে হত্যা করেছিলেন?”
অমরেশবাবুর চোখ দিয়ে জল বেয়ে পড়ল, দুটি হাত দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলেন। তারপর ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে ভারী গলায় বলতে শুরু করলেন, “আমি রানুর কোনও ক্ষতি করতে চাইনি, ইচ্ছাকৃতভাবে। রানু ছিল আমাদের বাড়ির মালির মেয়ে, সে রোজ দুপুরে নিজের বাবার জন্য খাবার নিয়ে আসত, তার রূপ দেখে আর তার ব্যবহারে মোহিত হয়ে উঠি। নিজের শূন্যতা কাটানোর জন্য আরও আরেকবার বিয়ে কথা মাথায় আসে। তাই পরের দিন নিতুকে ডেকে সব কথা বলে দিলাম, সে রাজী হলেও তার মেয়ে রানু রাজী হয়নি। অনেক প্রলোভন দেখাই তাকে কিন্তু তার উত্তর একটাই আর সেটা হল ‘না’। ‘না’ শোনার অভ্যাস আমার এক্কেবারেই নেই তাই তাকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার পরিকল্পনা করে ফেলি। দিনটি ছিল দোল উৎসবের, সবাইকে সেদিন ছুটি দিয়ে দিই শুধু নিতুকে ছাড়া। নিতুকে সন্ধ্যায় নেশা করিয়ে দিলাম। তারপর তাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার নাম করে তার বাড়ি যাই। সেখান রানুকে একা পেয়ে, তার সুযোগ নিলাম। আর ভাবি, এবার রানুর আমাকে বিয়ে করা ছাড়া আর কোনও গতি নেই। কিন্তু হল তার উল্টো রানু কয়েক ঘন্টা পর ঝিলে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে। আমি ওকে মারতে চাইনি। আমি তো ওকে বিয়ে করতে চেয়ে ছিলাম। কিন্তু ও, শহরে গিয়ে লেখাপড়া করবে বলে আমাকে প্রত্যাখ্যান করে। তার কয়েকদিন পর নিতু সব বুঝতে পারে, সে আমাকে হুমকি দিতে থাকে এই বলে, যদি তাকে আমার সম্পত্তির অর্ধেক অংশ না দেওয়া হয় তাহল সে আমার নামে পুলিশের কাছে নালিশ জানাবে। সত্যি কথা বলতে, আমি পুলিশের হুমকির ভয় পাইনি, কিন্তু এ বাড়িতে আগে কোনও দিন পুলিশ আসেনি। তাই এই সব ঝামেলার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য, প্রথমে আমি তাকে কিছু টাকা দিলাম। তারপর উত্তর উত্তর তার টাকা চাওয়ার পরিমাণ বেড়েই চলেছিল এবং তা এই পর্যায়ে চলে আসে যে আমি আর সহ্য না করতে পেরে একদিন রাতের অন্ধকারে তার বাড়িতে গিয়ে, তাকে দেশী মদের নেশা করাই, তারপর তার গলা টিপে মেরে কড়িকাঠে ঝুলিয়ে দিলাম। আর সবাই ধরে নিল মেয়ের মৃত্যুর শোকে নিতু আত্মহত্যা করে। আর আমি রানুর সেদিনের পরিধান করা ওড়না ও চুলের ক্লিপ সময় সুযোগ মত সবার আড়ালে রনির খাটের তলায় থাকা বাক্সের মধ্যে রেখে দিলাম। আর তা দেখে সবার ধারণা হয় রনিই রানুর ক্ষতি করেছে। যাতে রনির প্রতি কারুর সহানুভূতি না থাকে, তাই সে মারা গেলে কেউ তার অস্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন না তোলে…”
অমরেশবাবুর পুরো কথা শেষ না হওয়ার আগেই, একটা ভারী পুরুষ কন্ঠ কানে এল সবার, “এখানে অগ্নি পাল কে আছেন?”
সঙ্গে সঙ্গে সবার চোখ গিয়ে পড়ল কন্ঠের উৎসের দিকে। তারপর সবাই দেখল চৌকাঠের ওপারে একজন পুলিশ দাঁড়িয়ে। অগ্নি তাড়াতাড়ি তার কাছে গিয়ে বলল, “হ্যাঁ… আমি অগ্নি, আমিই আপনাকে ফোন করে ছিলাম।”
অগ্নি সকালেই লালবাজারে ফোন করে সব বলে দিয়েছিল। তারপর অগ্নি ইন্সপেক্টরের হাতে ভিডিও ফুটেজ ও কিছুক্ষণ আগের অমরেশবাবুর সব কনফেশনের রেকর্ডিং তুলে দেয়। রনিকে পুলিশ উদ্ধার করে এবং তাকে হাসপাতালে পাঠানো হয় চিকিৎসার জন্য। অমরেশবাবু কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে নিজের সব অপরাধ স্বীকার করেন এবং বিচারের তার যাবজ্জীবন জেল হয়।
এই ঘটনা ছয় মাস পেরিয়ে যাওয়া পর একদিন টিভিতে খবর দেখতে দেখতে একটা ছোট্ট হেডিং অগ্নি ও সুমনের নজর কাড়ে, সেই হেডিংটা হল, “সেন্ট্রাল জেলে বছর আট্টান্নর এক আসামী গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেন, আসামীটি কয়েক মাস যাবৎ মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন, সম্ভবত ঘটনাটি ঘটে কাল রাত আটটার সময়, দোলযাত্রা উপলক্ষে জেলের বেশিরভাগ কর্মীদের ছুটি থাকায় কেউ সেই সময় ঐ সেলের আশেপাশে উপস্থিত ছিল না, সেই সুযোগেই আসামী এই পদক্ষেপ নেন, এমনটা মনে করছেন জেল কতৃপক্ষ, কিন্তু এত কড়া নিরাপত্তার মধ্যেও জেলে থাকাকালীন ঐ আসামীর কাছে ফাঁস লাগনোর জন্য লাল রঙের ওড়না এল কীভাবে? এই ভাবনাই জেল কতৃপক্ষদের ভাবিয়ে তুলছে।”
টিভিটা বন্ধ করে ওরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে নিল, ওদের আর বুঝতে বাকি থাকল না যে ঐ আসামীটি আসলে অমরেশবাবু কারণ যা যা বর্ণনা দিল নিউজে তা সবই মিলে যাচ্ছে। সুমন প্রায় ফিসফিসিয়ে বলে ওঠলো, “লাল রঙের ওড়না, দোল পূর্ণিমার রাত, দোল পূর্ণিমার রাত মানে-“
“মানে কাল ছিল রানুর মৃত্যু বার্ষিকী আর রানু তার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিল।” সুমনকে থামিয়ে শেষ অংশটুকু অগ্নি বলল।