যে কাহিনী আমি শোনাতে যাচ্ছি তা আমার এক নিকট বন্ধুর কাছে শোনা। আমি বাংলাদেশের একটি নাম করা সংবাদপত্রের সাংবাদিক। আমি কাহিনীটা শুনেছিলাম সেই ব্যক্তির কাছেই যার সঙ্গে এই ঘটনা ঘটেছিল। মৃত্যুশয্যায় কেউ কিছু বললে তা মিথ্যে হয় না, তাই আমার কাছে তার কথা অবিশ্বাস করার মত কিছু ছিল না। তবে ঘটনাটি অন্যান্য মানুষদের কাছে অবিশ্বাস্য হওয়ায় কোনও সংবাদপত্রে ছাপা হয়নি। আমার বন্ধুটি এই কাহিনীটি এতটাই উপজীব্য ভাবে আমার সামনে তুলে ধরেছিলেন যে পুরো কাহিনীটি আমি কিছুটা ঘটনাক্রম অনুযায়ী সাজিয়ে নিয়ে বলছি, তার জবানিতেই। তবে এই কাহিনী বিশ্বাস বা অবিশ্বাস করা একান্তই পাঠকদের ওপর নির্ভর করছে।
(১)
আমি সুব্রত রায়চৌধুরী, একটি বহুজাতিক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার কলকাতা ব্রাঞ্চের ম্যানেজার। যে ঘটনা আমি হসপিটালের বেডে আশি শতাংশ বার্নড অবস্থায় বলছি সেটাকে অনেকেই আমার অসুস্থ, বিকৃত মস্তিষ্কের খেয়াল ভাবতে পারেন। কিন্তু একমাত্র আমিই জানি এই ঘটনা সম্পূর্ণ সত্যি আর এই ঘটনার সাক্ষী হিসাবে শুধু আমিই জীবিত আছি।
আমি বিবাহিত, এবং একটি ফুটফুটে পঞ্চবর্ষীয় কন্যার পিতা। আমি আর মোটামুটি আটটি মাস পরে আর একবার পিতৃত্বের সুখ লাভ করতে চলেছিলাম। সব মিলিয়ে আমি বেশ সুখী গৃহস্থ ছিলাম, তবে সুখ যে আর বেশিদিন স্থায়ী হবে না সেটা কল্পনাতেও কখনও ভাবিনি।
এই বছর আমাদের কোম্পানির উপর মহল ঠিক করে, তাদের ব্যবসার বিস্তার এবার বাংলাদেশেও করবে। তাই তারা বাংলাদেশের ঢাকা শহরে নিজেদের নতুন অফিস প্রতিষ্ঠা করেছিল। সেই ব্রাঞ্চের দেখাশোনার ভার এসে পড়ল আমার ওপর।
কাজের দায়িত্বের সাথে সাথে এর জন্য বেশ কিছুটা পকেটপূর্তিও হবে। আর যেহেতু কিছু মাস পরে আমার পরিবার বৃদ্ধিও ঘটতে চলেছে, তাই এই সুযোগটা আমি সুবর্ণ সুযোগ হিসাবেই কাজে লাগালাম। আমার বাংলাদেশে যাওয়ার ও সেখানে থেকে কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় নথিপত্র, সব ব্যবস্থা কোম্পানিই করে দিল। কিন্তু আমার মেয়ে মাম্মাম আর স্ত্রী রূপার পাসপোর্ট,ভিসা সব ব্যবস্থা আমাকেই করতে হবে।তাই ওদের যেতে কিছুটা সময় লাগবে। এর জন্য আমি আগেই আমার কর্মস্থলে রওনা দিলাম। আমার কোম্পানি বাংলাদেশে আমার পরিবারকে নিয়ে থাকার জন্য একটি বাড়ির ব্যবস্থা করেছিল। বাড়িটা ঢাকার নিকটবর্তী নরসিংদী নামক স্থানে। প্রপার ঢাকা শহরে খুবই স্থানাভাব, তাই সেখানে কোনো বাড়ির ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি, বাড়িটা ঢাকার নিকটবর্তী একটা শহরতলী অঞ্চলে।
বাংলাদেশে, স্ত্রী কন্যাকে নিয়ে আসার আগে আমি বেশ কিছুদিন আমাদের এখানকার অফিসের এক সহকর্মী স্থানীয় মকসুদ আলম আর তার পরিবারের তত্ত্বাবধানে ছিলাম। তার পরিবার আমাকে খুবই যত্নে রেখেছিলেন। তাদের আতিথেয়তার কোনো তুলনা হয় না। যতদিন না আমাদের থাকার বাড়িটা রিনোভেশনের কাজ শেষ হয় আমি ওঁদের বাড়িতেই ছিলাম।
(২)
স্ত্রী কন্যাকে নিয়ে আসার আগে এক উইকেন্ডে বিকালবেলায় যে বাড়িতে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল সেটা দেখতে গেলাম। যদিও ভেবেছিলাম সকালেই সেখানে যাব কিন্তু সেটা আর হল না। সেদিন ছিল শনিবার, অনেকদিন থেকেই ভাবছিলাম ঢাকার বিখ্যাত ঢাকেশ্বরী মন্দিরটা দেখে আসব। তাই সেদিন সকালেই গেলাম মন্দির দেখতে। আর যথারীতি মন্দিরে যেতে গিয়ে সকালটা কেটে গেল। যে ব্যক্তিকে আমাদের কোম্পানি থেকে বাড়িটি রিপেয়ার, রিনোভেশন আর সাজানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, সেই স্থানীয় বিল্ডার কাম ইন্টেরিয়রডেকরেটর আব্দুল ভাইকে আগে থেকেই বলা ছিল, তাই তাকেও জানিয়ে দিলাম সকালে না গিয়ে বিকালে যাব বাড়ি দেখতে। বিকালে তার সাথেই বাড়িটা দেখতে গেলাম, কারণ বাড়ির চাবি তার কাছেই থাকে।
বাড়ির গেটে ঢুকতেই কিরকম একটা অনুভূতি হল, যেন বহুকালের জমে থাকা হতাশা, দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা এসে আমাকে ঘিরে ধরতে লাগল। যেন আমার ভেতরে থাকা কোনও স্বত্তা বার বার আমাকে বলছিল কিছু একটা আছে, কোনও এক অজানা, অশুভ শক্তি। আমি আধুনিক যুগের ছেলে, এসব শুভ-অশুভ , ভগবান-ভুতে আমার বিশ্বাস নেই, তাও এরকম অনুভূতি কেন হল বুঝলাম না। আপনারা হয়তো ভাবছেন তাহলে, সকালে মন্দিরে কেন গিয়েছিলাম। ঢাকা শহরের বিখ্যাত ঢাকেশ্বরী মন্দির, সেটা দেখার জন্যই সেখানে গিয়েছিলাম। যাই হোক, সবরকম ভুলভাল চিন্তাকে উড়িয়ে দিয়েই বাড়িতে ঢুকলাম। বাড়িটার গঠন দেখে বোঝা যায় বেশ পুরনো আমলের বাড়ি। বড় বড় ঘর, করিবর্গার ছাদ, সব ঘরেই দক্ষিণ খোলা বিশাল সব জানলা। পুরনো বাড়ি হলেও রিপেয়ার করে ,নতুন রং করে বাড়িটার ভোল পুরো পাল্টে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। আব্দুল ভাই আমাকে সব ঘুরে দেখাতে লাগলেন। এখানে মর্ডান কিচেন আর বাথরুমের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। বাড়িটা দোতলা,নিচের তলায় দুটো ঘর,একটা বসার ঘরের মতো ডাইনিং স্পেস,একটা রান্নাঘর ও বাথরুম,আর ওপর তলায় চারটে ঘর আর বাথরুম। বাড়ির সামনে অনেকটা ফাঁকা উঠান। আব্দুল ভাই আমাকে বললেন,
“দেখুন কত্তা আগে এখানে বাগান ছিল। তারপর জায়গাটা ঝোপঝার আর জঙ্গলে ভরে যায়। আমরা সব পরিষ্কার করে দিয়েছি তাই এখন ফাঁকা জমি।”
ভাবলাম ভালই হল রূপার খুব বাগান করার শখ, এই জায়গায় ভালোই বাগান করা যাবে। বাড়িটার চারদিক পাঁচিল ঘেরা আর সেই পাঁচিলের মাঝখানে বাড়িতে ঢোকার গেট। বাড়িটার আশেপাশে বেশ অনেক দূর পর্যন্ত কোনো জনবসতি বা সামনের রাস্তাতেও সেরকম লোকজন দেখলাম না। আমি আব্দুল ভাইকে বললাম,
“বাড়িটা দেখে বেশ পুরনো আমলেরই মনে হচ্ছে, তা এটা কী জমিদার বাড়িটারি ছিল নাকি ভাই?”
“আরে না না কত্তা জমিদার বাড়ি নয় তবে বাড়িটা যিনি বানিয়েছিলেন তখনকার দিনে বেশ অবস্থাপন্ন ঘরেরই লোক ছিলেন।”
“তা বাড়িটা কত পুরনো হবে?”
একটু দেঁতো হেঁসে আব্দুল ভাই বলতে শুরু করলেন,
“তা ধরুন, ১০০ বছর বয়েস হয়েছে। প্রথম যিনি বানিয়েছিলেন, ভারতের স্বাধীনতার পর দেশভাগ হলে তারা পাকিস্থান সরকারের হাতে বাড়ি বেচে, ভারতে চলে যান। তারা হিন্দু ছিলেন কিনা। তখন এখানে সব লোক বাড়ি সম্পত্তি বেচার জন্য ছুটোছুটি করছে, ঠিক দাম পাচ্ছে না ,অনেকের সম্পত্তি বেদখল হয়ে যাচ্ছে। তা এই বাড়ির কত্তা বেশ প্রভাবশালী লোক ছিলেন। সরকারি মহলে ওঠাবসা। তাই সরকারের হাতেই বাড়ি তুলে দিয়ে ঠিকঠাক টাকা হাতে পেয়েছিলেন।
তারপর তো এখানে সরকারি সব লোকজন থাকত। ১৯৭১এ বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এই বাড়িটাকে ব্যবহার করে তাদের ক্যাম্প হিসাবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এক উদ্বাস্তু পরিবার বাড়িটা জবরদখল করে নেয়। তারাই প্রায় চল্লিশ বছর ধরে এখানে ছিল। তারপর দশ বছর আগে বাংলাদেশ সরকার এই জবরদখলকারী পরিবারটাকে এখান থেকে সরিয়ে সরকারি সম্পত্তি পুনরুদ্ধার করে।”
“বাব্বা, এ বাড়ির তো অনেক ইতিহাস। যে পরিবার লাস্ট এ বাড়িতে ছিল, তারা এখন কোথায় থাকেন?”
“আমাদের সরকার খুব ভালো কত্তা, জবরদখলকারী ওই পরিবারকে এই গ্রামেই পুনর্বাসন দিয়ে সরকারী আবাসে থাকতে দিয়েছে, টাকাও দিয়েছে। শেষ বয়সে বুড়োবুড়ির কপাল খুলে গেছে। মেয়ের বিয়ে হয়ে যাবার পর ওই পরিবারের ওই বুড়োবুড়িই তো শুধু বাকি ছিল এই বাড়িতে।”
“তাহলে তো ভালোই। বাড়িটা যে এত পুরনো দেখে কিন্তু বোঝার উপায় নেই।”
“আরে কত্তা এরকম কী আর ছিল। উদ্বাস্তুদের হাতে পড়ে তো যাচ্ছেতাই অবস্থা হয়েছিল বাড়িটার। ওদের তুলে দেওয়ার পর সরকারি ভাবে কিছুটা রিপেয়ার হয়। সে বলতে গেলে কিছুই নয়। তারপর তো আপনাদের কোম্পানি বাড়িটা কিনে আমাকে দায়িত্ব দিলে, আমি সব ঠিকঠাক করি।”
“হ্যাঁ, আপনি খুব ভালো কাজ করেছেন। বোঝাই যাচ্ছে আপনাকে এর পেছনে অনেক খাটতে হয়েছে।”
“হ্যাঁ তা তো হয়েছেই তার ওপর এ বাড়ির কাজ করতে এখানে কী লোক পাওয়া যায়। যাও বা পাওয়া যায় তাও দুদিন কাজ করেই পালিয়ে যায়।”
এই কথা বলেই আব্দুল ভাই কিরকম একটু থতমত খেয়ে চুপ করে গেলেন। যেন কিছু কথা গলার কাছে আটকে ফেললেন।
“কেন খুব খারাপ অবস্থা ছিল বুঝি? তাই বেশী খাটার ভয়ে লোক কাজ করতে চাইত না?”
“হ্যাঁ ঠিক, ঠিক ধরেছেন কত্তা।”
ঘুরতে ঘুরতে তখন আমরা এ বাড়ির ছাদে এসেছি। ছাদটা খুব বিশাল। এই বাড়ির চারদিকটা ছাদ থেকে দেখা যায়। অনেক দূর পর্যন্ত, চারদিকে শুধু বাঁশঝাড় আর ঝোপজঙ্গল। যে দেশে থাকার জায়গার এত অভাব, সেই দেশে এত জায়গা ফাঁকা কি করে পড়ে থাকে সেটা ভেবেই একটু অবাক হলাম।
ছাদে যখন থেকে পা রেখেছি তখন থেকেই কিরকম অস্বস্তি হচ্ছিল। ধীরে ধীরে সেটা আরও বেড়ে, একটা ঠান্ডা হাওয়ার স্রোত যেন আমাকে ঘিরে ফেলল। দম বন্ধ হয়ে যায় তার মধ্যে,আর সঙ্গে আবার সেই বাড়িতে ঢোকার সময় যে রকম অনুভূতি হয়েছিল, সেই অনুভূতি। তখন বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে চলেছে। আব্দুল ভাই আমাকে বললেন,
“এখানে তো এখনও ইলেক্ট্রিসিটি দেওয়া হয়নি, আপনারা যেদিন আসবেন সেদিন দেওয়া হবে। তাই অন্ধকার হলে আবার অসুবিধা হবে,এখন তাহলে যাওয়া যাক?”
“হ্যাঁ চলুন।”
আমরা ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম। আব্দুল ভাইয়ের বাড়ি আমার গন্তব্যের উল্টোদিকে, তিনি সেদিকে যেতেই মনে পড়ল পূজো দিয়ে সেই প্রসাদের টুকরিটা ওই বাড়িতে একতলার একটা ঘরের টেবিলে রেখেছিলাম, বেরোনোর সময় আর নেওয়া হয়নি। কিন্তু আবার সেখানে আনতে যাওয়া অসম্ভব তাই আর আব্দুল ভাইকে ডাকলাম না।
(৩)
এর কিছুদিন পর একটি রবিবার সেই সবে মকসুদ ভাইদের সাথে ব্রেকফাস্ট করতে বসেছি, হঠাৎ ওঁদের এক কাজের লোক এসে জানালেন আমার সাথে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক দেখা করতে এসেছেন। আমি একটু অবাকই হলাম বৃদ্ধ ভদ্রলোক আবার এখানে কে এলেন আমার সাথে দেখা করতে! যাই হোক উঠে গিয়ে ভদ্রলোকের সাথে দেখা করলাম। দেখলাম ভদ্রলোকের বয়স ষাটের কাছাকাছি, কী তার থেকে বেশী হবে। দেখে বোঝা যায় উনি হিন্দু বাঙালি, পরনে সাদা ধুতি ও পাঞ্জাবি, মাথা জোড়া টাক ও মাথার নিচের দিকে কয়েক গাছি পরিপক্ব কেশ, চোখে হাই পাওয়ারের কালো ফ্রেমওলা চশমা। সাদা গোঁফের নীচে ঠোঁটে একটা নিপাট ভালো মানুষি নিরীহ হাঁসি। কস্মিনকালেও ওঁকে আগে দেখেছি বলে তো মনে পড়ল না। নমস্কার প্রতিনমস্কারের পর উনি কোনোরকম পরিচয় পর্বে না গিয়ে সরাসরি আমাকে বললেন,
“ওই বাড়িটায় আপনারা থাকবেন না। আপনি এখনকার ছেলে আমার কথা হয়তো বিশ্বাস করবেন না, কিন্তু ও বাড়ি আবার অপবিত্র হয়ে গেছে।”
“আপনি কে আগে সেটা তো বলুন। আর আপনার কথাগুলো ঠিক বুঝলাম না একটু বুঝিয়ে বলবেন।”
“আমি রণজিৎ সেন, এই গ্রামেই সরকারি আবাসনে থাকি। ওই বাড়ি তৈরি করেছিলেন আমারই পূর্বপুরুষ। দেশভাগের পর আমার পরিবার ইন্ডিয়া চলে যায়। তারপর আমার দাদু বাংলাদেশ স্বাধীন হলে আবার নিজেদের বাড়িতে ফিরে আসে। কিন্তু ততদিনে পাকিস্থানি সেনাবাহিনীর অত্যাচারে ওই বাড়ি অপবিত্র হয়ে গেছে। আমার বৃদ্ধ ঠাকুরদা ছিলেন সিদ্ধতান্ত্রিক, তিনি অনেক পূজাঅর্চনা করে ওই বাড়ি বন্ধন করে দেন। তাই আমরা ওখানে থাকতে পেরেছিলাম। আমাদের শুধু ওঁর দেওয়া কতকগুলি বিধিনিষেধ মেনে চলতে হতো। যেমন— ওই বাড়ির চারধারে পরিবেষ্টিত রক্ত চন্দনের বন্ধন যাতে না উঠে যায় সেদিকে নজর রাখা , আর প্রতি অমাবস্যায় মা ঢাকেশ্বরীর পুজো করে আবার সেই বন্ধন দেওয়া। কোনো আমিষ খাবার ওই বাড়িতে ঢোকানো বারণ। বাড়িতে ভালো করে প্রত্যেকদিন পূজা অর্চনা করা , আর বাড়ির চারদিকে দেওয়ালে আঁকা পবিত্র চিহ্নগুলো ও চারকোনে রাখা পবিত্র জিনিসের কাপড়ে মোড়া থলিগুলো যত্ন করে সংরক্ষণ করতে হত। কিন্তু সরকার ওই বাড়ি নেওয়ার পর রিপিয়ারিংয়ের নামে সব বন্ধন ছিঁড়ে,সব নষ্ট করে বাড়িটাকে আবার অপবিত্র… বাসের অযোগ্য করে দিয়েছে। গ্রামে যখনই শুনলাম ওই বাড়িতে লোক থাকতে আসছে তখন খোঁজ খবর করে আপনার কথা জানতে পারি। ওই অপবিত্র বাড়িতে থাকতে গেলে কী বিপদ যে ঘটতে পারে তা ঠিক জানি না, তবে সে যে খুব সাংঘাতিক বিপদ হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কত পাপ কাজ হয়েছে ওই বাড়িতে, কত কান্না, কত কষ্ট, যন্ত্রণা মিশে আছে ওই বাড়ির প্রতিটি দেওয়ালে, কোনায় কোনায়। তাই আপনাকে বলছি ওখানে থাকতে যাবেন না।”
“ঠিক আছে আমি দেখব, ওই বাড়িতে যাতে থাকতে না হয়।”
তারপর ওঁকে নমস্কার জানিয়ে পত্রপাঠ বিদায় করলাম। আসলে ওঁদের এতদিনকার বাসস্থানে অন্য লোক এসে থাকবে, তাহলে আর তো এত ভালো বাড়ি ফিরে পাবেন না। এটা হয়তো উনি মেনে নিতে পারছেন না। এতদিন জবরদখল করে বাড়ি ভোগ করছিলেন। বাড়ি বিক্রি করে টাকাও নেবেন আবার বাড়িও ভোগ করবেন সখ মন্দ নয়। তাই এইসব গালগল্প শুনিয়ে, ভয় দেখিয়ে বিদায় করতে চাইছেন আমাদের। কিন্তু আমারও নাম সুব্রত রায়চৌধুরী এত সহজে ভয় পেয়ে, এমন সুন্দর বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার পাত্র আমি নই।
সেদিনের পর আর মাঝখানে কয়েকটা দিন রণজিৎবাবুর সঙ্গে দেখা হয়নি। আর কাউকে এ ব্যাপারে অবশ্য আমি কিছু জিজ্ঞেসও করিনি। হায়, তখন যদি বুঝতাম কী ভুল আমি করতে যাচ্ছি।
(৪)
এর কিছুদিনের মধ্যেই রূপা এসে গেল মাম্মামকে নিয়ে। আমরা সবাই মিলে যখন সেই বাড়িটির গেটের ভিতর ঢুকলাম, রূপা হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। আমি রূপাকে বললাম,
“কী হল গো, দাঁড়িয়ে পড়লে কেন?”
“কিরকম যেন একটা মনে হল। ঠিক বোঝাতে পারব না।”
বুঝলাম আমার মতো তারও একই রকম অনুভূতি হয়েছে। কিন্তু পাছে সে ভয় পায়, তাই তাকে আর কিছু বললাম না। শুধু বললাম,
“আরে তুমি তো জানোই প্রেগনেন্সির সময় এরকম হয়। নানা রকম চিন্তা মাথায় ঘোরে। এখন চলো ভেতরে চলো।”
আমরা ভেতরে ঢুকলাম। রূপা আর আমি নানারকম সাংসারিক কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। বাড়িতে সব জিনিসপত্র ঠিকঠাক গুছিয়ে রাখা, নিজেদের সুবিধা মতো সব দরকারি জিনিস গোছগাছ করা, এইসব ব্যস্ততার মধ্যে দিনটা কেটে গেল। তবে গোটা বাড়িটা কিরকম ঠান্ডা, স্যাঁতস্যাঁতে, আর কী একটা বিশ্রী দুর্গন্ধে প্রাণ বেরিয়ে যেতে লাগল। রূপা এর জন্য খুব রেগে গেল।
সন্ধ্যের সময় রূপা একটা ঘরে দেখলো লাল কাপড়ে বাঁধা কী সব যেন আছে, তার চারদিকে লাল রঙের হিজিবিজি লেখা আর নকশা। দেখে মনে হল এগুলো কোনো তান্ত্রিক পূজার উপকরণ। তখন আমার সেই রণজিৎবাবুর কথা মনে পড়ল। সেদিন উনি এসে আমাকে কী কী বলেছিলেন সেগুলো বললাম রুপাকে। রুপা তো হেসেই খুন। বলল,
“এখনকার দিনেও এসব বিশ্বাস করে এমন লোকও আছে নাকি? উনি হয়তো ভেবেছেন— এরা আমাদের বাড়িতে এসে থাকবে, এদেরকে এইসব উল্টোপাল্টা বলে ভয় দেখানো যাক। এরকমভাবে হয়তো যারাই এই বাড়িতে আসবে তাদের ভয় দেখাবেন। কেউ এই বাড়িতে না থাকলে বাড়িটা পড়ে থাকবে আর তারপর ওঁরা আবার জবরদখল করে নেবেন।”
“হ্যাঁ ঠিকই বলেছ আমারও একই মত।”
ধর্মবিশ্বাসের ব্যাপারে রুপা আর আমার চিন্তাভাবনা একইরকম। ওরও এই সব ভুত-তুট, শুভ অশুভতে কোনও বিশ্বাস নেই। রূপা বলল,
“এই জিনিসগুলো থেকেই নিশ্চই এরকম দুর্গন্ধ আসছে।”
এই বলে ও সেই কাপড়ের থলিটা তুলে নিয়ে জানলা দিয়ে টান মেরে ফেলে দিল, যদিও তাতে দুর্গন্ধ গেল না।
ঠিক তখনই সমস্ত বাড়ির আলোগুলো কিছুক্ষণ কাঁপাকাঁপি করে নিভে গেল। আমি রূপাকে বললাম,
“কারেন্ট গেল বোধহয়। অন্ধকারে এই নতুন জায়গায় আর বেশী কিছু করার দরকার নেই, অল্প কিছু খেয়ে শুয়ে পড়া ভালো।”
আমাদের সেদিনকার দুপুরের আর রাতের খাবার-দাবার মকসুদ ভাই, তার বাসা থেকেই পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আমরা রাত নটার মধ্যেই খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়লাম।
শুয়ে বেশ কিছুটা ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল। সেই বীভৎস পুতিগন্ধ তখন ভয়ংকর বেড়ে গেছে, গন্ধের চোটে প্রাণ বেরিয়ে যাবার জোগাড়। কিরকম গাটা গুলিয়ে উঠল, তাই ছুটলাম বাথরুমের দিকে। আর তখনই দেখলাম গোটা বাড়িটাতে বেশ কিছু মশাল আর কেরোসিনের আলো জ্বলছে। বাড়িটার চেহারাও পাল্টে গেছে। সেই ঝকঝকে তকতকে বাড়িটার দেওয়ালগুলো নোনাধরা, পুরানো হয়ে গেছে। আর সারা দেওয়াল জুড়ে টাটকা রক্তের ছোপ। কী মনে হতে, আমি নীচের তলায় গেলাম দৌড়ে।
সেখানে আরও বীভৎস দৃশ্য — কিছু নগ্ন পুরুষকে লোহার কাঁটাযুক্ত তার দিয়ে পিছমোড়া করে বেঁধে অনেক দাড়িওয়ালা, সেনাবাহিনীর পোশাক পড়া ব্যক্তি, বেওনেট, চাবুক আর গরম লোহার শিক দিয়ে নৃশংস ভাবে পেটাচ্ছে। পোশাক দেখে বোঝা যাচ্ছে যারা মারছে, তারা সত্তরের দশকের পাকিস্থানি সেনাবাহিনীর লোক। দেখে মনে হচ্ছে মার খাওয়া লোকগুলো মার খেতে খেতে মর্মবিদারি চিৎকার করছে, সেনাবাহিনীর মুখে সশব্দ ক্রুর অট্টহাসি। কিন্তু কোনও শব্দ আমি কানে শুনতে পাচ্ছি না। পুরো ঘটনার সমস্ত শব্দ যেন কোনো অজানা মন্ত্রবলে আমার কানে পৌঁছচ্ছে না। মার খেতে খেতে অজ্ঞান হয়ে গেলে, তাদের মুখ ডুবিয়ে রাখা হচ্ছে জলে,তারপর জ্ঞান ফিরলে তাদের ক্ষতে নুন আর লঙ্কা গুঁড়ো ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। তারপর তাদের সামনে নিয়ে আসা হল কিছু উলংগ মহিলা ও শিশুদের। একেবারে কচি শিশু যাদের বয়স একবছরের মধ্যে, তাদের ওই মহিলাদের কোল থেকে কেড়ে নিয়ে দেওয়ালে ছুঁড়ে ছুঁড়ে, মেরে ফেলা হল। দেওয়ালগুলো শিশুদের রক্তে রক্তাক্ত হয়ে গেল। একটু বড় শিশুদের আর মহিলাদের ওপর চললো ধর্ষণ আর অকথ্য অত্যাচার। তাদের জননাঙ্গে গরম লোহার শিক ঢুকিয়ে দেওয়া হতে লাগল। আর শিশুগুলোকে দুজন করে সেই পিশাচ সেনা মিলে দুদিক থেকে পা ধরে টেনে জরাসন্ধের মতো দু-আধখানা করে দিল। এই নৃশংস দৃশ্য দেখে সেই মার খাওয়া পুরুষগুলো নিশব্দ আর্তনাদে ফেটে পড়ল। ধর্ষিত আধমরা মহিলাদের চুলের মুঠি ধরে টেনে হিঁচড়ে দোতলা পেরিয়ে ছাদে নিয়ে যাওয়া হল। আমি শিউরে উঠলাম দোতলায় তো রুপা আর মাম্মাম আছে। এই পিশাচগুলো ওদের কোনও ক্ষতি করবে না তো! কিন্তু ওরা ওই ঘরের দিকে গেল না।
ছাদে টাঙানো আছে অনেক লোহার তার। সেই তারের সঙ্গে মহিলাদের চুল দিয়ে বেঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া হল। সেখানে ঝোলানো আছে আরও অনেক ক্ষতবিক্ষত মহিলার দেহ। তাদের স্তনে আর পাছায় অনবরত গরম লোহার শিক দিয়ে মারা হতে লাগল। সেই মারের চোটে অনেক মহিলা ওই অবস্থাতেই মলমূত্র ত্যাগ করে ফেলছে, আর বাতাসে আরও বেশি করে সেই নারকীয় দুর্গন্ধ বেড়ে যাচ্ছে। আমি ভয়, কষ্ট আর সেই গন্ধের চোটে বমি করে ফেললাম। আর তখনই আমার ঘুমটা ভেঙে গেল।
হ্যাঁ, তখন পুব আকাশের প্রথম সূর্যের কিরণ এসে পড়েছে ঘরে। আমি দেখলাম, আমি, রুপা দুজনে বমি করে জেগে উঠেছি। আর মাম্মাম তারস্বরে চিৎকার করে কাঁদছে। রুপা বলল,
“আমি একটা ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখেছি।”
এই বলে সে তার স্বপ্নের বর্ণনা দিল। আমিও বললাম আমিও এটাই দেখেছি।
রুপা বলল, “এরকম কীভাবে হল বলো তো?”
“আসলে নতুন জায়গায় এসেছি তো। আর খাওয়া দাওয়াটাও একটু বেশি হয়ে গেছিল। মকসুদ ভাই এত খাবার দিয়েছিলেন – তাই হয়তো শরীর খারাপ হয়ে, এইসব ভুলভাল দেখেছি।”
এরপর দিনটা স্বাভাবিক ভাবেই শুরু হল। গত রাতের সেই ভয়ংকর স্বপ্নের স্মৃতি মন থেকে মুছে রোজনামচার কাজে মন দিলাম। গতকাল অফিসে ছুটি নিয়েছিলাম তাই আজ অফিসে যেতেই হল। রূপাকে বললাম
“আমি তাড়াতাড়ি ফিরে আসব। আর মাম্মামের মনে হয় শরীরটা খারাপ হয়েছে তাই এইভাবে কাঁদছে। যদি সারাদিন না ঠিক হয় আমি এসে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। “
রূপা শুধু বলল, “ঠিক আছে।”
বেশী কিছু না বললেও আমি বেশ বুঝতে পারলাম এখানে এসেই এই সব অদ্ভুত জিনিস আর ঘটনা ওকে বেশ বিব্রত করেছে। তখন রণজিৎবাবুর কথাগুলো মনে পড়ল। ওসব বিশ্বাস না করলেও রূপার শরীরের কথা ভেবে ঠিক করলাম সেরকম কোনও প্রবলেম হলে অফিসে বলে বাড়ি বদলানোর চেষ্টা করব।
তাড়াতাড়ি ফিরব বললেও অফিসের কাজ সারতে বেশ দেরী হল। রূপাকে ফোন করার উপায় নেই কারণ ওই বাড়িতে ফোনের টাওয়ারই থাকে না। এই বিষয়টাও একটা চিন্তার কথা।
যখন বাড়ি ফিরলাম দেখলাম গোটা বাড়িটা যেন কোনো মৃত্যুপুরীর কালো দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও যেন একটু আলো বা শব্দের স্পর্শটুকুও নেই। বাড়িতে ঢুকতেই সেই প্রাণনাশক দুর্গন্ধ। আলোর সুইচ দিতে গিয়ে দেখলাম কারেন্ট আজও নেই। আমি চিৎকার করে ডাকলাম, “রুপা … মাম্মাম।”
কোনো সাড়া নেই। আমার বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল, ওদের কিছু হয়নি তো। আমি সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগলাম। অবশেষে রুপাকে আবিষ্কার করলাম দোতলার ঘরের খাটের নীচে। মাম্মামকে বুকে জড়িয়ে ও খাটের নিচে কুঁকড়ে বসেছিল। ভয়ে রূপার গলা যেন বন্ধ হয়ে গেছিল। অনেক কষ্টে ও শুধু বলতে পারল,
“ওরা নীচে আছে। আমাকে ধরবে…”
“কে আছে নীচ, কারা ধরবে তোমাকে?”
“ওরা, ওদের ছোঁয়া যায় না, কিন্তু ওরা সবাইকে ছুঁতে পারে।”
দেখলাম রূপার গায়ে কতকগুলো কালশিটে দাগ। ওর মুখটা শুকনো পাতার মতো, ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। আস্তে আস্তে রুপা অচেতন হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল।
আমি রূপার জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করলাম। জ্ঞান ফেরার পরেও রুপা কোনও কথা বলতে পারল না। রাতে তো খাওয়াদাওয়া কিছু হলই না। মাম্মামও ঘুমিয়ে আছে। আমি একটু গ্লুকোজ আর নুন চিনির জল ওদের খাওয়ালাম নিজেও খেলাম। আজ রাতটা কোনোভাবে এই বাড়িতে কাটিয়ে দিই, কাল অন্য কোথাও যা হোক একটা ব্যবস্থা করব। এই বাড়িতে আর নয়। এই চিন্তা করে শুয়ে পড়লাম।
সেদিন রাতেও আবার সেই স্বপ্ন। কিন্তু আজ সেটা আরও জীবন্ত। দেখলাম, আগের ঘটনাগুলো আবার ঘটল তারপর সেই পাকিস্থানি সেনাবাহিনীর পোশাক পরা পিশাচরা আমাদের ঘরে ঢুকেছে আর আমাদের তিনজনকে চাবুকের আঘাতে ফালা ফালা করে দিচ্ছে। তারপর আমাদের তিনজনকে ঘর থেকে টেনে হিঁচড়ে বার করে নীচে নিয়ে গেল। আমাকে একটা লোহার চেয়ারে বসিয়ে দিল। আর ঠিক তখনই রূপার আর্তনাদ। ঘুম ভেঙে ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসলাম। সকাল হয়েছে। রূপাও উঠেছে। আর মাম্মাম যথারীতি তারস্বরে চেঁচিয়ে কাঁদছে।
আমাদের সারা শরীরে অদ্ভুতভাবে চাবুকের দাগ, আর আমাদের নড়ার ক্ষমতা নেই। রুপা কান্নায় ভেঙে পড়ল আর বলতে লাগল,
“আমার এখানে একদম ঠিক লাগছে না। তুমি অন্য কোথাও থাকার ব্যবস্থা করো।”
আমিও তাই ঠিক করলাম। আমার সেদিন অফিস যাওয়ার এতটুকু ক্ষমতা নেই। যন্ত্রণায় শরীর ছিঁড়ে যাচ্ছে। একটু বেলা বাড়তেই আমি কোম্পানির হেডঅফিসে ফোন করে বললাম,
“আমাদের এখানে খুব অসুবিধা হচ্ছে আপনারা ইমিডিয়েট অন্য থাকার ব্যবস্থা করুন।”
তারা বললেন তারা আজই সব ব্যবস্থা করবেন, কিন্তু সব হতে আজকের দিনটা টাইম লাগবে।
কিছু করার নেই আজ এখানে থাকতেই হবে। আমি মকসুদ ভাইকেও ফোন করলাম কিন্তু উনি জানালেন আজ ওঁদের বাড়িতে কিছু গেস্ট এসেছেন। আমরা যদি ওঁদের বাড়িতে যাই তাহলে একটু কষ্ট করে থাকতে হবে। আমরা যদি থাকতে পারি তাতে ওঁদের অসুবিধা নেই। রুপা বলল,
“না না, একটা তো দিন কোনোরকমে কাটিয়ে দেওয়া যাবে। ওঁদের ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই।”
আমিও একমত হলাম। তখনও বুঝিনি কী ভুল করলাম। রুপা তখন একটু ধাতস্থ হয়েছে। কিন্তু কালকের কথা ওকে আর কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। আর ও কিছু বলল না।
দিন বাড়ার সাথে সাথে গোটা বাড়িটা জুড়ে অসংখ্য ছায়ামূর্তিদের ঘুরতে দেখা গেল। তাদের দেহ স্বচ্ছ তবে তারা যে আছে, আর আমাদের ঘিরে তাদের অস্তিত্ব, আমরা খুব ভালো করেই টের পেতে লাগলাম। এবার আমি বুঝতে পারলাম রূপার এত ভয় পাওয়ার কারণ আর কেন এই বাড়িতে কাজ করার জন্য কোনও লোক পাওয়া যেত না।
সন্ধ্যা হওয়ার সাথে সাথেই সেই ছায়ামূর্তিগুলো নিরেট হতে শুরু করল। ক্রমে তাদের ঠান্ডা স্পর্শ আমাদের গায়ে এসে লাগতেই আমরা ঠিক করলাম, আর না, এ বাড়ি ছেড়ে এক্ষুনি পালাতে হবে। মাম্মামকে কোলে নিয়ে আমি আর রুপা দৌড়ে গেলাম গেটের কাছে। কিন্তু গেটের বাইরে তখন জমাট অন্ধকারের দেওয়াল, সেই দেওয়াল যেন নিরেট, তাতে এগোতে গেলেই ধাক্কা লেগে যাচ্ছে। বুঝলাম এখান থেকে আর পালানো সম্ভব নয়, আমরা এক অন্য ডাইমেনশন বা সময়ের নারকীয় জগতে পৌঁছে গেছি। ঠিক সেই সময়ে আমাদের ঘিরে ফেলল কিছু পুতিগন্ধময়, সেনাবাহিনীর পোশাকধারী, পোড়া টুকরো হওয়া হাত ,পা, ও শরীরের নানা অংশ। সেই কাটা হাত ,আর টুকরো হয়ে যাওয়া শরীরগুলো আমার কোল থেকে মাম্মামকে কেড়ে নিল ,তারপর রুপা আর আমাকে হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে নিয়ে চললো ভেতরে। বাইরে তখন শোনা যাচ্ছে গুলিগালা আর বোমার শব্দ আর ভেতরে শুধুই আর্তনাদ। আমাকে একটা লোহার চেয়ারের সঙ্গে কাঁটাতার দিয়ে বেঁধে ফেলা হল। সেখানে বাঁধা ছিল আরও অনেক অনেক মানুষ। তাদের চিৎকার আমি শুনতে পাচ্ছি না, কিন্তু তারা যে অতিকষ্টে আর্তচিৎকার করছেন তা তাদের অভিব্যক্তিতে বোঝা যায়। আমার গোটা শরীরে তার পেঁচিয়ে সেই তার দিয়ে বিদ্যুৎ চালনা করা হল। আমি নিস্তেজ হয়ে পড়লে, অন্যান্য শিশু ও মহিলাদের সঙ্গে মাম্মাম আর রূপাকেও সেখানে আনা হল। ওদের পোশাক ছিঁড়ে উলংগ করে, গরম লোহার শিক দিয়ে মারা হতে লাগল। আমি বললাম,
“ওদের ছেড়ে দাও রুপা প্রেগনেন্ট। কেন তোমরা এরকম করছ আমাদের সাথে? আমরা কী করেছি?”
তাতে পিশাচগুলো নিঃশব্দ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। আমার সারা শরীর সেই কাঁটা তারের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হচ্ছিল। তারপর ওদের গণধর্ষণ শুরু হল। আমি চোখ বন্ধ করে আর্তনাদ করছিলাম, তখন পিশাচগুলো আমার চোখের পাতায় আর মুখে স্টিকিং প্লাস্টার আটকে দিল। আমাকে খোলা চোখে, মুখ বন্ধ করে এই নারকীয় দৃশ্য সহ্য করতে হচ্ছিল। ওরা মাম্মামকে সেই শিশুদের মত আধখানা করে ফেললো। তারপর রূপার রক্তাক্ত দেহটা চুলের মুঠি ধরে ছাদে নিয়ে চলল। আমাকেও সেখানে চেয়ার শুদ্ধু গড়িয়ে, লাথি মেরে নিয়ে যাওয়া হল। ছাদে, ওরা ধারালো অস্ত্রের ঘায়ে আমার শরীরটা ফালাফালা করে, তাতে নুন আর লঙ্কা ঘষতে লাগল। ওঃ, সেকি কী অসহনীয় নরক যন্ত্রণা — হে ঈশ্বর এর থেকে মৃত্যু ভালো। আমি অজ্ঞান হয়ে গেলে আমার মুখে পিশাচগুলো প্রস্রাব করে জাগিয়ে তুলল। রূপার সেই রক্তাক্ত শরীরটাকে তারের সঙ্গে ওর চুল দিয়ে বেঁধে, ওকে গরম লোহার শিক দিয়ে পেটাতে লাগল।
আর পারছি না। ঠিক এই সময় আকাশে বোমারু বিমানের শব্দ, আর তীব্র আলোর ঝিলিক। সঙ্গে সঙ্গেই নেমে এল বোমা। তারপরেই তীব্র বিস্ফোরন। আর আমার কিছু মনে নেই।
(৫)
এরপর চোখ খুলে দেখি আমি হসপিটালে। আমার চারদিকে একটা ঠান্ডা সাদা আস্তরণ। সম্ভবত সেই লোহার চেয়ারে বাঁধা থাকার জন্য আমি এখনও বেঁচে আছি। আমার সামনে দাঁড়িয়ে আব্দুল ভাই, সেই বৃদ্ধ রণজিৎ সেন, আর আমার সহকর্মী মকসুদ ভাই। কান্না ভেজা গলায় আব্দুল বললেন,
এসব কী হয়ে গেল কত্তা! এরকম যে হতে পারে আমি স্বপ্নেও কল্পনা করিনি। ওই বাড়িতে যে কিছু আছে তা ওখানে কাজ করতে গিয়ে টের পেয়েছিলাম। কিন্তু আপনারা যদি ঐ বাড়িতে না থাকেন তাহলে ঐ বাড়ির দুর্নাম হয়ে যেত। তাই আপনকে কিছু বলিনি। প্রথম দিন সেই ঢাকেশ্বরী মন্দিরের প্রসাদের জন্য আপনি কিছু বুঝতে পারেননি। আপনার মঙ্গলের জন্য আমি কিছু পুজোটুজো করেছিলাম ওই বাড়িতে। আর এক তান্ত্রিককে দিয়ে যজ্ঞ করিয়ে কিছু পবিত্র জিনিস রেখে এসেছিলাম বাড়িতে। কিন্তু আপনাদের কিছু বলতে সাহস হয়নি। আর আপনারাও হয়তো ওসব বিশ্বাস না করে, সেই পুজোর বাঁধন, জিনিসপত্র ফেলে দিয়েছিলেন।”
আমাকে রণজিৎবাবু বললেন,
“ঠিক কী ঘটেছিল বলুন তো আপনার সঙ্গে?”
ওঁদের আমি সব ঘটনা বললাম। তারপর রণজিৎবাবু বললেন,
“আমরা ওই বাড়িতে থাকলেও ঠাকুরদার দেওয়া সেই বাঁধন আর নিয়মগুলির জন্য কোনোদিনও কিছু দেখিনি। বাড়িটার আশেপাশে নানারকম অলৌকিক ঘটনা ঘটত যার কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। তাই এই বাড়ির আশেপাশে কেউ ঘেঁষতো না,বাড়ির চারিদিকের সব জায়গা জনবসতিহীন ভাবেই পড়ে থাকে। তবে বাড়ির ভেতরে কোনোদিন কিছু ঘটতে দেখিনি। ঠাকুরদা যখন সেই যুদ্ধের পর ওই বাড়িতে আসেন তখন বাড়ির অবস্থা ভয়ংকর ছিল। বোমার আঘাতে বাড়ির অনেক ক্ষতি হয়েছিল। আর নানা রকম অতিলৌকিক ঘটনাও ঘটতো ওই বাড়িতে। ঠাকুরদার কাছে আমি অনেক ছোটবেলায়, আপনি যেরকম বললেন ওরকম কিছু ঘটনা শুনেছিলাম। আর কাল ছিল ৫ই ডিসেম্বর – সেই দিন, যেদিন ওই বাড়িতে ইন্ডিয়ান আর্মি বোমা ফেলে পাকিস্থানি সেনা ক্যাম্প ধ্বংশ করেছিল। আপনি তো আমার কথা শুনলেন না।
আমি জানতাম না ওইদিন ঠিক কী হতে পারে। তবে খারাপ কিছু একটা হবে সেটা বুঝতে পারছিলাম। সারা রাত আমার ঘুম হয়নি। ভোরবেলা তাই আব্দুলকে নিয়েই ছুটলাম, ওই বাড়িতে। গিয়ে দেখি গোটা বাড়ি পুড়ে ছাড়খার। ভেতরে, নীচের তলায় একটা বাচ্ছার পুড়ে যাওয়া শরীরের টুকরো, আর বাড়ির ছাদে এক মহিলার পোড়া দেহাংশ। আপনার দেহটা একটা লোহার চেয়ারে কাঁটাতার দিয়ে বাঁধা, ছিন্নভিন্ন।”
এই কথা শোনার পর আমার চারদিকের বাতাস যেন কমে আসতে লাগল, আমার যেন দম বন্ধ হয়ে গেল। আমি বললাম,
“তার মানে মাম্মাম, রুপা আর বেঁচে নেই। সব আমারই ভুল। কাল যা হয়েছে তার একটা কারণ হয়তো আমার বাবা।”
সবাই একসঙ্গে বলে উঠলেন,
“তার মানে!”
“আমার বাবা ছিলেন ইন্ডিয়ান এয়ার ফোর্সের একজন পাইলট। বাংলাদেশের যুদ্ধের সময় উনি মিগ -২১বোমারু বিমানের চালকের দায়িত্বে ছিলেন। ওই বিস্ফোরণ হয়তো উনিই ঘটিয়েছিলেন। কাল তারই বদলা হয়তো ওই নারকীয় পিশাচ বাহিনী নিল।”
এরপর আর আমি কোনও কথা বলতে পারলাম না। শরীর ভয়ঙ্করভাবে জ্বলে উঠল। কষ্টে বুকটা ফেটে যেতে লাগল। তারপর ধীরে ধীরে ঠান্ডা হয়ে আসতে লাগল শরীর। আর কোনো জ্বালাযন্ত্রণা নেই। আমার শিওরে দুদিকে দুধ সাদা পোশাক পড়া রুপা আর মাম্মাম। ওরা আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকল। আমিও এই ছিন্নভিন্ন শরীর ছেড়ে ওদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।
মিস্টার সুব্রত রায়চৌধুরীর গল্প এখানেই শেষ। এই ঘটনার একটা উপসংহার আছে। এই দুর্ঘটনা ঘটার পর পুলিশ তদন্তে সেই বিস্ফোরণের কোনও কারণ খুঁজে পায়নি। আর বাড়িটার সাথে প্রশাসনের নাম জড়িত থাকায় বাড়িটা এরপর চিরকালের মতো সিল করে দেওয়া হয়, এই নিয়ে আর কোনো জলঘোলা হয়নি। যে সফটওয়্যার কোম্পানি বাড়িটা কিনেছিল তার সি. ই.ও হঠাৎ মারা যায়। তারপর কিছুদিনের মধ্যেই কোম্পানি বন্ধ হয়ে যায়। তাই নরসিংদীর সেই ঘটনা চিরকালের মতো ধামাচাপা পড়ে যায়।