স্যাঁতস্যাতে হাত
ঘুমন্ত অনির হাতটা তিতিরের গলার কাছে এসে পড়তেই চমকে ওঠে তিতির, শুধু তাই নয়, মুহূর্তের জন্য একরাশ ভয়ের অনুভব যেন ছুটে বেড়ায় তার মনের অলিগলিতে। তার কণ্ঠার হাড়টা খামচে ধরতে চাইছে অনির হাতটা। ঘুমের ঘোরে এমনটা প্রায়ই করছে অনি, যেন কিছু আঁকড়ে ধরতে চাইছে। ভীষণ ভয় পেলে মানুষ যেমনটা করে কিংবা ডুবন্ত মানুষ যেভাবে আঁকড়ে ধরতে চায় খড়কুটোকে! কিন্তু হাতটা কেমন যেন অস্বাভাবিক ঠান্ডা যেন কোনও সর্পিল ছোঁয়ার মত; ভিজে ভিজে – ঠান্ডা!
স্পর্শটা কেমন যেন অচেনা! বিবাহিত জীবন আর প্রেম পর্ব মিলিয়ে বছর আষ্টেক অনির ছোঁয়ায় অভ্যস্ত তিতির… অথচ সেই ছোঁয়া আজ কেমন যেন অচেনা লাগছে। মনে হচ্ছে হাতটা অনির নয়, কোনও এক নারীর কমনীয়তা মাখানো। তবে কি হাতটা… নাহ্! অন্ধকার ঘর তার উপরে ঘুমের ঘোর; বড্ড বেশি ভেবে ফেলছে সে। আসলে অন্ধকার মানুষের মনের গোপন কুঠুরীতে জমিয়ে রাখা ভয়গুলো নিয়ে খেলতে ভালবাসে। আধ-ভেজা জানালার ফাঁক দিয়ে ঘরে এসে পড়েছে রাস্তার আলো, পর্দাটা সরে গেছে বোধহয়। কেমন একটা অদ্ভুতুড়ে রহস্যে ঘেরা মনে হচ্ছে তাদের এই বেডরুমটাকে। একটু কি গা ছমছম করে তিতিরের, আসলে অনির প্রলাপগুলো এমনভাবে মাথার মধ্যে জমিয়ে বসেছে… ঘুম চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসে তিতির। হাত বাড়িয়ে বেড সুইচটা জ্বালাতেই একরাশ উজ্জ্বল আলো কাটিয়ে দেয় সবটুকু বিভ্রম।
হাতটা অনিরই। এখন হাতটা খামচে ধরে আছে বেডশিটটা। বেডশিটটা ছাড়িয়ে তিতির অনির হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নেয়, তিরতির করে কাঁপছে অনির সমস্ত শরীরটা। তিতিরের হাতটা সবলে আঁকড়ে ধরে অনি যেন ডুবন্ত মানুষের শেষ সম্বলের মত। স্বপ্ন দেখছে অনি। হয়ত সেই দুঃস্বপ্নটা। এমন আগে হত না, এখন মাঝে মধ্যেই হচ্ছে। মাসখানেক আগে সিকিম বেড়াতে গিয়ে সেই যে শুরু হল…!
স্বপ্নের ঘোর কাটতে এখন কিছুটা সময় লাগবে অনির। মাঝে তো একবার ওর শরীরটা সিটিয়ে শক্ত হয়ে গিয়েছিল। অথচ চোখগুলো ভাবলেশহীন ভাবে খোলা ছিল। মুখ থেকে অবিরত একটা মৃদু গোঙানির আওয়াজ করছিল যেন ভীষণ আতঙ্কিত! সেদিন মুখে মাথায় জল দিয়ে ঘুম ভাঙিয়েও ঘোরলাগা চোখদুটো স্বাভাবিক হতে বেশ খানিকটা সময় লেগে গিয়েছিল।
এই সময়গুলোয় নিজেকে বড্ড অসহায় লাগে তিতিরের। পাগলের মত ভালবাসে ও অনিকে। এই মুহূর্তগুলোয় অনির কষ্ট যেন চোখে দেখা যায় না, শুধু তিতিরই এই মুহূর্তগুলোর নীরব দর্শক। উফ্! একটা মানুষ তার বীভৎস স্বপ্নের জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে পারছে না, এর থেকে অসহায় অবস্থা বুঝি আর কিছু নেই! স্বপ্নটাকে সত্যি ভেবে নিদারুণ কষ্ট পাচ্ছে শুধু ঘুমটা ভাঙার অপেক্ষা। তিতিরও ভয়ের স্বপ্ন দেখে যেমনটা আমরা সবাই দেখি। এই তো একদিন চারপাশের ঘিরে ধরা কালো ছায়াগুলো একটু একটু করে এগিয়ে আসছিল তিতিরের দিকে, তারা মিশে যাচ্ছিল তিতিরের সর্বাঙ্গে তার রক্তে, তার নিঃশ্বাসে, তার বুকের ধুকপুকানিতে! তারপর তিতিরের শরীরটা ফ্যাকাশে প্রাণহীন হয়ে একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছিল কালো একটা সুড়ঙ্গে! উফ্, সমস্ত শরীরটা ঘেমে গিয়েছিল তিতিরের। চোখ খুলে ঘরের অন্ধকার আবছায়ায় মুহূর্তের জন্য স্বপ্নটাকেই বাস্তব বলে মনে হচ্ছিল। তারপর একটু একটু করে ঘোর কেটেছে, ধাতস্ত হয়েছে নিজেই। পাশে শুয়ে থাকা অনিকে জড়িয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। তবে অনি কেন পারছে না স্বাভাবিক হতে? সত্যিই কি কোনও মানসিক বিকৃতির শিকার হয়েছে ও!
প্রথম যে রাতে অনির এমনটা হয় সেদিন তো প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিল তিতির। তখন ওরা সিকিমে, ছোট্ট লজটার সেই নীলাভ আলোমাখা ঘরটার কথা তিতির জীবনে ভুলতে পারবে না। বিয়ের পর থেকেই তিতিরকে জড়িয়ে ঘুমানো অনির অভ্যাস। সেদিনও অনির হাতে নিজের মাথা রেখে ওর বুকের কাছে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছিল তিতির।
* * *
সীমাহীন সৌন্দর্য্যে লুটোপুটি খাচ্ছে দূরের পাহাড়গুলো, কুয়াশার মত মেঘেরা আচ্ছন্ন করে আছে পাহাড়ের সবুজকে, আকাশটা বড্ড বেশি নীল। চোখের আরাম, মনেরও। বিশেষ করে শহুরে জীবদের কাছে এর মূল্য ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। এখানে বাতাসের গন্ধটাই আলাদা। বুক ভরে বাতাসের গন্ধ নিচ্ছিল তিতির। আবেশে বুঁজে আসছিল দুচোখ। হাঁটতে হাঁটতে পাইন সারির ছায়াপথের ভিতর দিয়ে কতদূর এসে পড়েছে কে জানে! এ জায়গাটা আধো অন্ধকার, ঘন গাছগুলোর জন্য তো বটেই তাছাড়া একরাশ কুয়াশার মত মেঘে ঢেকে যাচ্ছে জায়গাটা। পাহাড়ের এই একটা জিনিস বড্ড ভালোলাগে তিতিরের, এই মেঘ আছে তো এই মেঘ নেই। কেমন শিরশিরে অনুভূতি সর্বাঙ্গে মাখিয়ে সরে যায় মেঘের দল। এই জায়গাটা মেঘে ঢেকে বড্ড ঝাপসা। সামনেই রাস্তাটা ভেঙে মিশেছে গভীর খাদে। একটু এদিক ওদিক হলেই তলিয়ে যেতে হবে ওই অতলে। মুছে যাবে তার সমস্ত অস্তিত্ব। সামনের খাতের দিকে একবার তাকায় সে। মাফলারটা মাথায় জড়িয়ে দাঁড়ায় কিছুক্ষণ। চিরকাল সে একটু নির্জনতাই পছন্দ করে, এখানে তো অনন্ত নির্জনতা।
অনিটা গেল কোথায়! হয়ত ছবি তুলতে ব্যস্ত। হোক, একটু নিজের মত করে কাটাক। মেঘটা আরো ঘন হচ্ছে, চেপে ধরছে সর্বাঙ্গে…সামনে এখন পুরোটা অদৃশ্য। আচ্ছা, যদি কেউ এখন পিছন থেকে টুক করে একটু ধাক্কা দেয়… রোমাঞ্চিত হয় তিতির। ঠোঁটের কোণে খেলে যায় মৃদু হাসি। কী সব উদ্ভট ভাবনা মাঝেমাঝে উঁকি দিয়ে যায় মাথায়।
হঠাৎই পিছন থেকে কোমরটা জড়িয়ে ধরে অনি একবার ঠেলে দেওয়ার ভঙ্গিমা করে। চমকে পিছিয়ে আসে তিতির,
“ইস্, কী যে করো! অবশ্য ধাক্কা দিলেও ক্ষতি নেই, আমার না পাখি হতে খুব ইচ্ছে করে। খাতে তলিয়ে যেতে যেতে আমার দুটো ডানা মেলে দেব, তারপর তোমার থেকে অনেক দূরে ভেসে যাবো… মিলিয়ে যাব বিন্দু হতে হতে…”
কোনও উত্তর দেয় না অনি। আরো গভীরভাবে তিতিরকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রেখে। অদ্ভুত এক ভালোলাগায় ভেসে যায় মুহূর্ত।
মেঘটা সরছে, রোদের আঁকিবুকি নেমে আসছে পাইনের পাতার খাঁজ থেকে। আবিষ্ট অবস্থাটা কাটতে তিতির অবাক হয়ে দেখে কোথায় অনি, কোথায় তাকে জড়িয়ে থাকা হাতদুটো। অথচ কিছু একটা এখনো নিবিড়ভাবে ঘিরে আছে তার কোমর!
আতঙ্কিত তিতির ঘুরে দেখতে চায়, তখনই ছোট্ট একটা ধাক্কা…
শূন্যে ভাসছে তিতিরের শরীরটা। নাহ্! পাখি হতে পারেনি তিতির। তবু পাখির মত দুটো হাত ছড়িয়ে ভাসতে চাইছে। কোনও এক অদৃশ্য শক্তির টানে ছিঁড়ে যাচ্ছে তার হাতদুটো, রক্ত ঝরছে। ডানা কাটা পাখির মত ধপ করে মাটিতে আছড়ে পড়ে তার শরীরটা… থ্যাতলানো, চাপ চাপ রক্তে মাখামাখি!
উফ্! কী বীভৎস স্বপ্নটা। সম্বিৎ ফিরে পেতে সময় লাগে কয়েক মুহূর্ত। নিজের হাতদুটো ছুঁয়ে বুঝে নিতে হয় সেগুলো অক্ষতই আছে। সীমাহীন আতঙ্কে এই ঠাণ্ডা আবহাওয়াতেও বেশ গুমোট লাগছে। কম্বল সরিয়ে দেয় তিতির। উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে চোখে মুখে একটু ঠাণ্ডা জলের ছিটে দিয়ে ফেরে।
ঘরটার এই নীলচে আলোটা তার বেশ পছন্দের। কেমন মাদকতা ছড়ানো। হানিমুন কাপলদের জন্য আদর্শ। এমন দুঃস্বপ্ন থেকে বাস্তবে ফিরে অনিকে একটু জড়িয়ে শুতে ইচ্ছে করে তিতিরের।
এ কি! অনি কি জেগে আছে! চোখদুটো খোলা, কিন্তু কেমন যেন নিস্তরঙ্গ, একটা হাতে খামচে ধরে আছে বিছানার চাদরটা। শরীরটা টানটান, কম্বলের তলাতেও অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা। থেমে থেমে নিঃশ্বাস পড়ছে, ঠোঁট দুটো তিরতির করে কাঁপছে…
“ক-ক্কি হল অনি? এই অনি, অনিইইই…”
নিঃস্তব্ধ ঘরে নিজের আতঙ্কিত স্বরে নিজেই শিহরিত হয় তিতির!
বিদেশ বিভূঁইয়ে অনিকে এই অবস্থায় দেখে কেমন ভরসাহারা লাগে। মাথা কাজ করে না। ডাকবে কাউকে? আগে একটু জলের ছিটে দিয়ে দেখলে হয়। জলের ছিটেতে ঘোর কাটে অনির। কেমন একটু ঘোলাটে চোখে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর তিতিরের কোলে মাথা গুঁজে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“একটা ভিজে স্যাঁতস্যাতে হাত … আমাকে ডাকছিল… ওই ওই ওখানে!”
অনির আঙ্গুলকে অনুসরণ করে তিতিরের চোখ চলে যায় টেবিলটার দিকে। যেখানে রয়েছে একটা ঢাউস আয়না। নীলচে আলোয় কেমন অদ্ভুত দেখাচ্ছে আয়নাটাকে! বদ্ধ ঘরেও কেমন যেন ধোঁয়াটে কুয়াশা ঘিরে আছে আয়নার সামনে।
পর্ব:২
আয়নার অন্ধকারে
–
“কেমন অদ্ভুত দেখ আয়নাটা?”
তিতিরের ফরমায়েশ মত টুকটাক কেনাকাটা সেরে ঘরে ঢোকে অনি। আজ রাতটাই তাদের বেড়ানোর শেষ দিন। কাল ভোরেই বেরিয়ে যাবে তাই গোছগাছ যেটুকু বাকি ছিল সেরে নিচ্ছিল তিতির। অনি ঘরে ঢুকতেই আবিষ্কারের ভঙ্গিমায় তিতির জিনিসটা দেখায় অনিকে।
“বাহ্! বেশ সুন্দর তো।”
অনির মুখ থেকে এই অকৃত্রিম মুগ্ধতা মাখা বাক্যটি বেরিয়ে আসে।
বেশ ঢাউস সাইজের আয়না। তার চারদিকে নক্সা কাটা কাঠের ফ্রেম, ফ্রেমে অনেকগুলো মুখের আদল খোদাই করা। তবে মুখগুলো কেমন অস্পষ্ট, মুখগুলোর পাশে একটি করে ছোট্ট গর্তের মত মোটিফ। তবে আশ্চর্যের বিষয়, আয়নাতে মুখের প্রতিবিম্ব ধরা পড়ছে না। সবটাই যেন কেমন কালো কাচের মত!
“বেশ অদ্ভুত জিনিসটা তো, মুখ দেখা যাচ্ছে না; অথচ আয়না! এমন অদ্ভুত জিনিস তোমার মত পাগলেরাই জোটাতে পারে। তা কত টাকা খসালে, কখন কিনলেই বা?”
“আরে, কিনিনি। পেয়েছি। আরো অবাক হবে, আয়নাটাকে মুখের একদম কাছে ধরে দেখ…”
তিতির আয়নাটা তুলে ধরে অনির মুখের একেবারে সামনে। বিস্ময়মাখা উচ্ছ্বাস ঝরে পড়ে অনির গলায়,
“আরিব্বাস! দারুণ তো!”
দূরের কিছু প্রতিবিম্বিত হচ্ছে না সেই কাচে। একদম মুখের উপর ধরলে কেমন আশ্চর্য কৌশলে কালো কাচে একটা মোটা কালো ফ্রেমের মত তৈরি হচ্ছে আর সেই ফ্রেমের মাঝখানে দেখা যাচ্ছে নিজের মুখের ছোট্ট একটা প্রতিবিম্ব । অথচ একটু পিছিয়ে গেলেই চারপাশের কালোটা বাড়তে বাড়তে প্রতিবিম্বটাকে গিলে নিচ্ছে। আয়নাটাকে ধীরে ধীরে মুখের কাছে সরিয়ে আনলে আবার একটু একটু করে ফিরে আসছে নিজের প্রতিবিম্ব।
“এমন আয়নাও হয় কখনও…কী জানি! তা কোথায় পেলে আয়নাটা?”
“বেডের নিচে। আমার স্লিপারটা বেডের নিচে ঢুকে গিয়েছিল, সেটা বের করতে গিয়ে দেখি কাগজে মোড়া কী একটা পড়ে আছে। প্রথমে ভাবলাম থাক, তারপর কৌতূহল হল, বের করে দেখি ধুলোয় ভর্তি। প্যাকিং ছিঁড়ে ধুলো মুছে দেখলাম ফ্রেম বাঁধানো কালো কাচ! ভালো করে দেখতে গিয়ে মুখের কাছে সরিয়ে এনে দেখি এই ব্যাপার…”
“বাহ্! দারুণ জিনিস আবিষ্কার করেছ দেখছি।”
“জিনিসটা বোধহয় কেউ গেস্ট হাউসে ফেলে গেছে, জানো। রিসেপশনে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ওরা লোক পাঠিয়েছিল। দেখে বলল, ওদের কারও নয়, ঘর পরিষ্কার করতে গিয়েও নাকি চোখে পড়েনি নাকি ওদের। ওরাই বলল, চাইলে আমি এটা নিতে পারি।”
“কি দরকার! অন্যের জিনিস… থাক না।”
“এমন একটা জিনিস পেয়েও ফেলে রেখে যাব!”
“দেখো, যা ভালো বোঝো করো। চল, এখন একটু ঘুরে আসা যাক, বৃষ্টি থেমেছে ।“
“হ্যাঁ, চলো। আজকের রাতটাই তো… কাল তো আবার ফিরতে হবে।”
আয়নাটা টেবিলে রেখে বেরোনোর জন্য তৈরি হয়ে নেয় তিতির।
সন্ধ্যা নেমে এসেছে, সেই সঙ্গে বাতাসে ভিড় করে বেড়াচ্ছে কুয়াশার মত ভেজা মেঘের দল। তিতিরের খুব ইচ্ছে হচ্ছিল উঁচু পাথরটায় কিছুক্ষণ বসে দূরে জ্বলে ওঠা বৌদ্ধ মনাস্ট্রির আলো দেখে। এমনি অন্ধকারে নিজেকে মিশিয়ে বসে থাকতে বেশ লাগে, আর পাশে যদি অনি থাকে তবে তো কথাই নেই। পাহাড়ে বেড়াতে এলে জার্নিটা খুব কষ্ট দেয় ঠিকই কিন্তু এই মনোরম সবুজ, এই বন্য নির্জনতা, এই ভেজা মাটির গন্ধ, এই আদুরে মেঘের ছোঁয়া আর ওই স্নিগ্ধ সুন্দর মনাস্ট্রি – সব কষ্টের উপর এমন ভাললাগার প্রলেপ বুলিয়ে দেয় যে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। যেমন এই মুহূর্তে তিতিরের মনে হচ্ছে অনির হাতটা ধরে অনন্তকাল এই পাথরের চাঁইটার উপর বসে থাকে। কিন্তু অনির কেমন লাগছে কে জানে! ওই যে এমন মনোরম আবহাওয়াতে তার পাশে এসে না বসে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরিয়েছে। সিগারেট একদম সহ্য হয় না তিতিরের। অনির আবার সকাল সন্ধ্যায় নিয়ম করে দুটো খাওয়া চাই, নাহলে নাকি মাথা ধরে। এই যে তিতিরের এখন ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছে অনিকে একটা চুমু দেওয়ার… সিগারেট খেলে আর চুমু দেওয়া যায় নাকি! বড্ড আনরোমান্টিক হয়ে যাচ্ছে অনিটা।
মেঘটা আবার ঘন হচ্ছে, ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে মাথা। হাত দুয়েক দূরত্বে পাথরের উপর বসে থাকা তিতির যেন মিলিয়ে গেছে কোথায়। সিগারেটটায় জোরে টান দেয় অনি, সিগারেট খেতে খেতে তিতিরের কাছে গেলে বাবুর আবার গোঁসা হবে। ফেলে দিলেও হয়, কিন্তু ফেললে আজকের মত কোটা শেষ। তার মত চেন স্মোকারকে এখন গুনে গুনে খেতে হয়, সেকি কম কষ্ট!
“কি হল, চলে এলে যে…”
কাঁধে হাতের স্পর্শ পেয়ে বলে ওঠে অনি। কেমন ভেজা ভেজা বরফ ঠান্ডা হাত তিতিরের। ছাতাটা খাঁটিয়ে বসেনি নাকি! তিতির হাতটা অনির পুলোভার আর জামার নিচে ঢুকিয়ে কোমরটা জড়ায়। হাত গরম করার জন্য এরকম দুষ্টুমি তিতির প্রায় করে। কিন্তু এই ঠান্ডা ওয়েদার আর বৃষ্টিতে এমন বরফ ঠান্ডা হাত কেউ গরম পিঠে দেয়! তাছাড়া পুলোভারটা উঁচু হয়ে ফাঁকা পিঠে ঠান্ডা বাতাস কামড় বসাচ্ছে।
“আঃ! তিতির, কি দুষ্টুমি হচ্ছে?”
একটু জোরের সঙ্গেই বলে ওঠে অনি।
“কি করলাম আবার, এই তো আমি এখানে…”
পাথরের ঢিবিটার উপর বসেই উত্তর দেয় তিতির। চকিতে হাতের টর্চটা জ্বালিয়ে ঘুরে দাঁড়ায় অনি। সত্যিই তো পাথরের ঢিবির উপরেই বসে আছে তিতির! তবে এই মুহূর্তের অনুভবটা! স্বপ্ন নাকি! হাতের জ্বলন্ত সিগারেটটা হাতের উপরের চামড়ায় ছোঁয়ায়, আঃ! বেশ জ্বালার অনুভব ছড়ায় মুহূর্তে! ঠিক এমনই স্পষ্ট শৈত্যের অনুভূতি ছড়িয়ে পড়েছিল সমস্ত শরীরে কয়েক মুহূর্ত আগে! ছোঁয়াটাও অবিকল তিতিরের মত! কিন্তু তিতির তো রাস্তার ওপাশে পাথরটার উপর এখনও বসে। তবে কে এমন আশ্লেষে আবিষ্ট করতে চাইল তাকে! মৃদু ভয়ের শিহরন খেলে যায় সমস্ত শরীরে। হাত থেকে স্খলিত আধপোড়া সিগারেটটা থেকে ধোঁয়ার শিখা মিলিয়ে যেতে থাকে বাতাসে।
তিতিরের হাতটা ধরে বেশ জোরেই লজের দিকে হানা দিয়েছিল অনি। দূরত্বটা যেন এক লহমায় পার করতে চাইছিল। পাতলা মেঘগুলো মাখামাখি হচ্ছিল চোখে মুখে, ঠিক যেন অপার্থিব ছোঁয়ার শিরশিরানি। হোটেলের বন্ধ ঘরে ঢুকতে পারলে অন্তত এই অনুভবটা থেকে মুক্তি পাবে।
সিকিমের এই এলাকায় টুরিস্ট বেশ কম। আসলে নির্জনতায় প্রেম সবসময় উপভোগ্য হয়ে ওঠে কিন্তু সব নির্জনের মধ্যেই কি কোনও অজানা ভীতি থাবা গুটিয়ে বসে থাকে? কে জানে! মনের অস্বস্তিটা তিতিরের কাছে ভেঙে ওকে অহেতুক ভয় পাইয়ে দিতে মন চায় না অনির, হতেও তো পারে জ্যাকেটটা কোনও ভাবে উঁচু হয়ে ঠান্ডা হাওয়ার শিরশিরানিকে কারও স্পর্শ বলে মনে হয়েছে! কিন্তু বড্ড জীবন্ত স্পর্শটা; এমন মনের ভুল হল তার!
মাথার মধ্যে বিভ্রান্ত কিছু ভাবনায় চোখে ঘুম আসছে না কিছুতেই। ঘরের নিঃস্তব্ধতা কেমন যেন থমথমে লাগে, পাশ ফিরে শুয়ে অনি। পাশে তিতির অঘোরে ঘুমাচ্ছে, নাইটল্যাম্পের মৃদু নীলচে আলোটায় ওকে স্বপ্নপুরীর রাজকন্যার মত মায়াবী লাগছে। পুরু কম্বলের তলায় ওর নরম শরীরটার সঙ্গে মাখোমাখো আবেগে ভাসতে মন চাইছে। মাথার মধ্যে চলতে থাকা কাটাকুটি খেলাটা এখন অনেকটা ফিকে। তিতিরের ঠোঁটদুটোতে একটা নিবিড় চুম্বন মাখাতে যায় অনি।
ঠকঠক ঠকঠক—আওয়াজটা অনির কানে বেশ ধাক্কা দেয়। এত রাতে এমন করে নক করছে কে? চুমুটা অসমাপ্তই থেকে যায়। উঠে বসে অনি। না, কোথাও কোনও শব্দ নেই তো! তবে কি মনের ভুল? হতেও পারে! আজ দিনটাই খারাপ; একটার পর একটা ভ্রান্তির শিকার হচ্ছে! নাহ্! যে করেই হোক ঘুমাতে হবে।
বাইরে এলে এই এক সমস্যা ঘুম আসে না কিছুতেই। আগে বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে গেলে সবসময় ব্যাগে ঘুমের মালপত্তর থাকত; পরপর কয়েক পেগ চাপিয়ে দিলেই, আঃ! শান্তি! কিন্তু তিতির এসব ব্যাপারে ভীষণ কড়া! ভাগ্যে দুটো বিয়ারের ক্যান অ্যালাউ করেছিল। একটা এখনও আছে। ওটাই ভরসা। নার্ভগুলোকে শান্ত করতে হবে। টেবিলের উপর রাখা বিয়ারের বোতলের দিকে এগিয়ে যায় অনি।
ঠকঠক ঠকঠক! নাহ্! এবার আর কোনও ভুল নেই। খুব কাছেই নক করছে কেউ! দরজাটা তো অনেকদূরে… মনে হল কানের খুব কাছেই কেউ নক করল! কোথায়? নীলচে আলোমাখা ঘরটায় ভালো করে চোখ বোলায় অনি। বিছানার উপর মোটা কম্বলটা ঢেকে তিতির ঘুমাচ্ছে। জানালার স্বচ্ছ কাচে কুয়াশার পুরু আস্তরণে রাস্তার আলো ফিকে বিন্দুর মত দেখাচ্ছে। এই টেবিলটা আর তার একপাশে তাদের লাগেজ ছাড়া ঘরের আর কোথাও কিচ্ছু নেই। একটা মৃদু নিঃশ্বাসের শব্দ হল কি! নাহ্! ঘুমন্ত তিতিরের নিঃশ্বাসের শব্দটাই নিঃস্তব্ধ ঘরে এমন শোনাচ্ছে। কিন্তু এই যে আবার শব্দটা হল, মনে হল কানের ঠিক পাশেই!
বিয়ারের বোতলটার ঠিক পাশেই রাখা সেই আয়নাটা! কেমন একটা অস্পষ্ট ধোঁয়াটে লাগছে আয়নার কালো কাচটা। ঠাণ্ডা আবহাওয়াতে এমনটা হয়, কাচের উপর ভেজা ভেজা আস্তরণ জেগে ওঠে। বিয়ারের বোতলটা তুলে নিতে যায় অনি। এবার একদম স্পষ্ট সেই ঠকঠক আওয়াজটা! বিস্ফারিত চোখে অনি দেখে ওই আওয়াজটা আসছে ওই আয়নাটার ভিতর থেকে! আয়নার সামনেটা যেন আরো বেশি ঘোলাটে! ফ্রেমে খোদাই করা মুখগুলো কেমন যেন জীবন্ত, ওদের অস্পষ্ট অবয়ব এখন স্পষ্ট… প্রতিটি মুখের একজোড়া জ্বলন্ত চোখ তাকিয়ে আছে তার মুখের দিকে! ঠকঠক আওয়াজটা বাড়ছে, তিরতির করে কাঁপছে আয়নাটা। একি! আয়নার উপরের ধোঁয়াটে জলীয় আস্তরণে স্পষ্ট একটা হাতের ছাপ!
পর্ব:৩
প্রতিবিম্বের ফাঁদে
আয়নাটার সামনে পাথরের মত নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে অনি। তার যে পালানোর উপায় নেই। এই মুহূর্তে অসংখ্য স্যাঁতস্যাতে ঠাণ্ডা হাত জড়িয়ে ধরেছে তার পা। ধীরে ধীরে সেই লোভাতুর হাতগুলো উঠে আসছে তার পা বেয়ে উপরে। তার শরীরে ঘুরে বেড়াচ্ছে হাতগুলো… কিছু খুঁজছে তার পাঁজরের আশেপাশে! তীব্র ঘৃণায় অনির সমস্ত শরীরটা সিঁটিয়ে যেতে থাকে। হাতগুলো এবার ঘুরছে তার কাঁধে, গলায়, কন্ঠনালীতে। একটা কনকনে ঠান্ডা হাত উঠে আসে তার মুখে, আঙুল ছোঁয়ায় তার ঠোঁটে… উফ্! আর সহ্য করতে পারছে না অনি। এবার সত্যি পাগল হয়ে যাবে।
আয়নায় এখনও সেঁটে আছে সেই হাতটা। অনির কেমন যেন মনে হয় ওই হাতটার মালিক তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে তার অসহায়তা। ভয়ার্ত চোখে অনি দেখে ওই হাতটা মুছে দিচ্ছে আয়নার উপরের জলীয় দ্রবণ। স্পষ্ট হয়ে উঠছে সবটা… আয়নার কাচ ভেদ করে হাতটা এগিয়ে আসছে তার দিকে! কোনও নারীর হাত। ওই হাতের চুড়িগুলো তার ভীষণ চেনা… চুড়ির রিনরিনে বোলটাও যেন তার রোজকার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। নাহ্! কোনও ভুল নেই। হাতটা তিতিরের। হাতটা এগিয়ে আসছে… অনির গালে আলতো করে ছুঁয়ে যায় হাতটা। এই স্পর্শ অনি চেনে, তিতির ছাড়া কেউ এমন ভাবে ছুঁতে পারে না!
কিন্তু কেমন যেন নিষ্প্রাণ ফ্যাকাশে লাগে হাতটাকে। স্পর্শটা তেমন আদরমাখা হলেও বড্ড বিবর্ণ হাতটা! হাতটা আবার একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছে আয়নার অন্দরে। যাবার আগে হাতটা তাকে ইশারা করে ডাকে, অনিরও কেমন যেন ইচ্ছে হয় সে ডাকে একবার সাড়া দিতে।
আচ্ছা, হাতটা যদি তিতিরের হত তবে কি সে একবার ছুঁয়ে দেখত না? শরীর জুড়ে সরীসৃপের মত বেয়ে বেড়ানো হাতগুলো কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে। এখন সে মুক্ত। হাতটাকে ছুঁয়ে দেখতে এগিয়ে যায় অনি… ধরতে যায়… পারে না। শুধু আয়নার বাইরে বেরিয়ে থাকা তর্জনীর প্রান্তটি ছুঁতে পারে।
ছোঁয়া মাত্রই শরীর জুড়ে এক অদ্ভুত এক শিহরন, এমন অনুভব তো সেই চূড়ান্ত ভাললাগার মুহূর্তগুলোতে তিতিরই দিতে পেরেছে তাকে! তাহলে ওই হাতটা কার? কেনই বা ধোঁয়াটে তার অবয়ব? কেনই বা অতি পরিচিত ছোঁয়ায় তাকে শিহরিত করতে চাইছে বারবার? কোথায় যাওয়ার জন্য ইশারা করছে তাকে! কি রহস্য লুকানো আছে ওই আয়নার অন্দরে!
নাহ্! ওই আয়নার অন্দরে যাওয়া ছাড়া কোনও উপায় নেই। তার মাথার কোষগুলোতে ঘুণপোকার মত লেগে থাকা প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে যেতেই হবে ওই অজানা দুনিয়ায়। কীভাবে যাবে সে? শুধু ওই হাতটাই বোধহয় পারে তাকে ওই রহস্যের উৎসে পৌঁছে দিতে।
তর্জনীটা আঁকড়ে ধরে অনি, অজানা দুনিয়ায় তলিয়ে যাওয়ার আগে শেষ অবলম্বনের মত। তার একটি পা এখন আয়নার অন্ধকারে, আরেকটি এখনও এই বাস্তবের জমিতে। পিছু ফিরে তাকায় অনি। ওই তো বিছানায় তার তিতির কেমন নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। তাহলে কেন সে সাড়া দিচ্ছে তিতিরের মত ছোঁয়ার ওই প্রবঞ্চকের আকর্ষণে! যদি ওই আয়নার অন্দরে হারিয়ে যায় সে! আর কি ফেরা যাবে কখনও তিতিরের কাছে? ওদিকে আয়নার ভিতরে সেই হাত দুর্নিবার আকর্ষণে টানছে তাকে। নাহ্! সাড়া দেবে না সে। বাইরের পৃথিবীর বাতাসকে দুহাতে খামচে ধরে সেই আকর্ষণ প্রতিহত করতে চায় অনি…
“অনি, অনি… আবার স্বপ্ন দেখছ?”
ঘুমটা সহজে ভাঙে। কেমন যেন ঘোলাটে চোখে তাকায় অনি, তারপর স্খলিত স্বরে বলে,
“জানো, আমি হারিয়ে যাচ্ছিলাম তোমার কাছ থেকে…”
অনির মাথাটা নিজের বুকে টেনে নিয়ে কান্নাভেজা স্বরে তিতির শুধু এটুকু বলতে পারে,
“হারিয়ে যেতে দিলে তো…”
* * *
মাঝে মাঝেই রাতগুলো জুড়ে নেমে আসে একটা অস্থিরতা। অনির বদলটা যেন বেশি করে ধরা পড়ে তিতিরের চোখে। এমনিতে অফিসে যাচ্ছে, কাজ করছে, তার সঙ্গে খুনসুটি করছে তবু কোথাও যেন কিছু মিসিং! একদিন তিতিরের মনে হয়েছিল, ওই আয়নাটাই সমস্যার মূলে! নিজের দুগালে চড় মারতে ইচ্ছে হয়েছিল, ওই জিনিসটা সঙ্গে করে আনার জন্য। দেওয়াল থেকে খুলে ভেঙে ফেলতেও গিয়েছিল। কেন যে পারেনি, কে জানে! তারপর সারাটা দুপুর ধরে আয়নাটা এদিক ওদিক উল্টেপাল্টে দেখেছিল, আয়নায় ভেসে ওঠা নিজের ক্ষুদ্র প্রতিবিম্বের দিকে অনেকক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে ছিল। আয়নায় ভেসে ওঠা তিতিরের মুখটা অবিকল তার মত, কিন্তু কেমন প্রাণহীন বিবর্ণ, চোখগুলোয় কষ্টের ছাপ, হাসিটা কেমন মেকি! নিজেকে অনেকক্ষণ খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে তিতির ভেবে নিয়েছিল, এই আয়না বোধহয় মনের ছবিকে ভাসিয়ে তোলে। সত্যিই তো এই মুহূর্তে তার মনটায় একরাশ বিষাদ! আয়নার ফ্রেমে খোদাই করা মুখগুলোকেও যেন কেমন বিষন্ন মনে হয় তিতিরের। ওই মুখগুলো তবে কি বুঝে গেছে তিতির আয়নাটা ভেঙে ফেলতে চায়! নাহ্! ভাঙা হয়নি আয়নাটা! তবে সরিয়ে দিয়েছিল দেওয়াল থেকে।
বাড়িতে এসে আয়নাটা দেখতে না পেয়ে অনির মাথা খারাপ হওয়ার উপক্রম! তিতির বুঝিয়েছিল,
“প্রতিদিন ওই আয়নাটাকেই ঘিরেই তোমার দুঃস্বপ্নগুলো ঘোরাফেরা করে, সেই বেড়াতে যাওয়া থেকে শুরু তারপর একমাস কেটে গেছে… এখনও চলছে সেই দুঃস্বপ্ন। তাই সরিয়ে দিয়েছি।”
“কোনওটাই আমার স্বপ্ন নয়, তিতির। তোমাকে কতবার বলেছি, আমি সত্যিই সবটা ফিল করেছি। আর একবার তিতির, আমি শুধু দেখতে চাই আয়নার ভিতরে হারিয়ে যাওয়া তোমার হাতের মত ওই হাতটা কার। আমি তার মুখ দেখিনি, দেখতেও চাইনা কিন্তু তার প্রতিটি ছোঁয়া অবিকল তোমার মত… সেদিন ঘুমন্ত তোমাকে দেখে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল জানো। মনে হচ্ছিল ওই অন্ধকার দুনিয়া থেকে পথ চিনে যদি না আবার তোমার কাছে ফিরতে পারি! খুব কষ্ট হচ্ছিল, তাই তুমি ডাকতেই ফিরে এলাম…আর একটিবার তিতির, আমি দেখেই ফিরে আসব।“
ভীষণ অসহায় লাগে তিতিরের! তবে কি সত্যিই অনি পাগল হয়ে যাচ্ছে? নাকি সে নিজেই? স্বপ্ন আর বাস্তবের মধ্যে তফাৎ কে করতে পারছে না! সে নাকি অনি?
অনির চোখের কোলে অস্পষ্ট কালির ছোপ তিতিরের মনে একরাশ বিষাদের কালো মেঘ ঘনিয়ে তোলে। ওর ঘোলাটে মনের অস্থিরতা যেন সংক্রমিত হয় তিতিরের মনেও ।
মাঝখানে তিতিরের জোরাজুরিতে একদিন অনি কাউন্সেলিং করাতে গিয়েছিল, তিতিরও ছিল সঙ্গে। ডাক্তারের কথায়, অনি কোনওভাবে স্ট্রেসড। কিছু ওষুধ আর পর্যাপ্ত ঘুমেই ঠিক হয়ে যাবে ও। আজকাল রাতগুলো প্রায় জেগেই কাটে তিতিরের। ঘুমন্ত অনির মুখের দিকে তাকিয়ে ভীষণ স্বস্তি পায় ও। পুরো একটা সপ্তাহ কেটে গেছে অনি নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। ডাক্তারের ওষুধেই কাজ দিচ্ছে তবে।
তিতির আজ একটু ঘুমাবে। কোন্ হাত তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় অনিকে, কেনই বা তাড়িয়ে বেড়ায়; নাকি সবটাই অনির কল্পনা! প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে কতগুলো রাত সে দুচোখের পাতা এক করেনি। একদিন রাতে ওই আয়নাটার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে খুঁজতে চেয়েছিল রহস্য; গা শিরশির করে উঠেছিল একবার। ঘরের আলো-আঁধারীতে ফ্রেমে খোদাই করা মুখগুলোকে কেমন জীবন্ত মনে হচ্ছিল, মুখগুলোর বিষাদ মুছে গিয়ে কেমন কুটিল মনে হচ্ছিল। একবার তো মনে হল কোনও অস্পষ্ট অবয়ব এসে দাঁড়িয়েছে তার পিছনে, এক্ষুনি বুঝি একটা হিমঘরে জারিত বিবর্ণ হাত তার আজীবনের ক্ষুধা নিয়ে উঠে এসে চেপে ধরবে তার কন্ঠনালী!
নাহ্! এগুলোর কোনটাই হয়নি। আয়নার কালো কাচটায় আলো-ছায়ার খেলা ছাড়া আর তেমন কিছু চোখে পড়েনি। আর তাই সবটাই অনির মনবিকলন বা বিভ্রম বলেই মনে হয়েছিল। তাই আজ রাতে তিতির শান্তিতে একটু ঘুমাবে। বড্ড ক্লান্ত তার চোখদুটো; পরিশ্রান্ত সে!
* * *
তন্দ্রার ঘোরে সদ্য আচ্ছন্ন অনির চোখদুটোর উপরে হাতটা আদুরে স্পর্শ মাখায়, তারপর তার সমস্ত মুখে আদর মাখিয়ে ঠোঁট ছুঁয়ে ওর খোলা শরীরের ওম মাখে হাতটা। যেন সমস্ত অপার্থিব শৈত্য ঘুচিয়ে পার্থিব জীবনের উষ্ণতা মেখে প্রাণ ফিরে পেতে চায়। ছোঁয়াটা অবিকল তিতিরের স্পর্শের মত। পাশ ফিরে তিতিরকে গভীর আশ্লেষে বাঁধতে গিয়ে তন্দ্রা ছুটে যায় অনির। এই তো তিতির নিজের দুটো হাত জড়ো করে তার উপর মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। তবে কি…! নাহ্! আজ এর শেষ দেখেই ছাড়বে।
বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় অনি। ওই তো ঘোলাটে ধোঁয়া ধোঁয়া কুয়াশার ভিতরে আত্মগোপন করে নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছে ওই রহস্যময়ী। ডাকছে তাকে নিজের দুনিয়ায়… কী আছে ওখানে! দেখতেই হবে। এতদিন সে যা অনুভব করেছে কোনওটাই যে তার মনের বিকার নয়, এটা প্রমাণ করাও যে খুব দরকার।
একবার মনে হয়, তিতিরকে ডাকে, ও দেখুক অনি পাগল নয়। তারপর ভাবে, থাক ঘুমোচ্ছে! যাওয়ার আগে কী ভেবে ঘুমন্ত তিতিরের কপালে একটা চুমু এঁকে দেয় অনি।
নাহ্! আর দেরি করলে চলবে না। হাতটা মিলিয়ে যাচ্ছে আয়নার অন্দরে। ওই হাতটা ধরেই তো পৌঁছতে হবে আয়নার অন্দরে। হাতটা ছুঁয়ে ফেলে অনি। হাতটাও যেন এই অপেক্ষায় ছিল, অনেকদিন পর বোধহয় এমনভাবে কারও হাত শক্ত করে ধরতে পেরেছে। হাতটা এক হ্যাঁচকা টানে অনিকে টেনে নেয় আয়নার অন্দরে। একবার পিছন ফিরে দেখে অনি, নাহ্! এখন আর কিছু করার নেই। পুরো শরীরটাই এখন আয়নার ভিতরে। বাইরের কাচের দেওয়ালে একবার ধাক্কা দেয় সে।
একটু একটু করে ভিতরের দিকে এগিয়ে যায় অনি। চারপাশটা নিরেট অন্ধকার, সেই রহস্যময়ী গেল কোথায়! আরেকটু এগোয় সে, পায়ের নিচে মেঝেতে চ্যাটচ্যাটে জলীয় কিছু পড়ে। এই নিকষ কালো অন্ধকারে পথ চলা মুশকিল। হাতড়ে হাতড়ে পথ চলতে থাকে সে। পিছল মেঝেতে একবার পড়েও যায়, সমস্ত গা হাতে ঘিনঘিনে একটা তরল লেপ্টে থাকার অনুভূতিতে কেমন যেন বমি উঠে আসতে চায়। আদৌ কি কিছু আছে এই অন্ধকার অতলে! নাকি শুধু হারিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিচ্ছু নেই।
এই অবিশ্রান্ত অর্থহীন চলা কখন থামবে কে জানে! অন্ধকারটা যেন তার সজীব অস্তিত্বকে গ্রাস করতে আসছে, নাকি গ্রাস করেছে বহু পূর্বেই। আদৌ কি কোনও সজীবতা অবশিষ্ট আছে তার মধ্যে? নাকি, সেও এই অন্ধকারের জীবে পরিণত হয়েছে? এত শীত করছে কেন, কেনই বা প্রসারিত অন্ধকার পথটা এমন সঙ্কুচিত হচ্ছে? সমস্ত শরীরে প্রচণ্ড যন্ত্রণা কামড় বসাচ্ছে।
ওই তো দূরে একটা আলোর উৎস, ক্ষীণ কিন্তু তীব্র। চোখে জ্বালা ধরায়। আলোক বিন্দুটা যত কাছে সে এগিয়ে যাচ্ছে অন্ধকার পথটা ক্রমশঃ সরু হয়ে আসছে। দাঁড়িয়ে পথ হাঁটা দায়; অন্ধকার ভেদ করে হামা দিয়ে এগোতে থাকে অনি। সমস্ত শরীর ঘষে যায় দেওয়ালে, রক্ত ঝরে তবু কিসের এক দুর্নিবার আকর্ষণে এগিয়ে চলে সে। নাহ্! এবার শ্বাসরোধ হয়ে আসছে, প্রাণবায়ুর বড়ই অভাব এখানে। আরেকটু কষ্ট তারপর ওই আলোক বিন্দুর কাছে পৌঁছনো যাবে।
অন্ধকারে অভ্যস্ত চোখদুটো ধাঁধিয়ে দিচ্ছে ওই আলোক রশ্মি। আলোটা বড্ড যন্ত্রণা দিচ্ছে চোখদুটোয়, অন্ধকারটাই সহনীয় ছিল। চোখ বন্ধ করে অনি। কী আশ্চর্য! বন্ধ চোখের সামনে ঠিক সিনেমার মত ভেসে ওঠে কিছু দৃশ্যপট।
ওই তো তিতির একটা কাগজের মোড়ক খুলছে… এখন ওর হাতে ধরা কালো আয়নাটা… আয়নাটা ও মুখের কাছে ধরতেই ওর চোখদুটো থেকে বিস্ময় ঝরে পড়ল। আয়নার কালো কাচের মাঝে বিন্দুর মত ফুটে উঠেছে ওর প্রতিবিম্ব। কিন্তু ও কি? আয়নাটা রেখে ও চলে যাওয়ার পরেও যে ওর প্রতিবিম্বটা তেমনি রয়ে গেল! তারপর আয়না থেকে জলজ্যান্ত আরেকটা তিতিরের মত বেরিয়ে এল ওর প্রতিবিম্বটা, ঠিক যেন ওর ক্লোন!… ওই তো একটা মেঘ ভেসে আসছে, চারপাশে জমাট বাঁধছে… অনি সিগারেট টানছে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে, তিতির বসে আছে রাস্তার উল্টোদিকে পাথরটার উপর… অবিকল তিতিরের মত কেউ এসে জড়িয়ে ধরেছে তাকে গভীর আশ্লেষে! উফ্! কি ভয়ঙ্কর! আর দেখতে পারে না অনি। চোখ খোলে।
নাহ্! আর এক মুহূর্ত নয়। আয়নার ওপারে তিতিরের কাছে ফিরতেই হবে তাকে। পাগলের মত ছুটতে থাকে অনি। কালো কাচের দেওয়ালটার সামনে এসে পৌঁছে জোরে ধাক্কা দেয়, জোরালো ঘুঁসিতে ভেঙে দিতে চায় পলকা কাচের দেওয়াল। কিন্তু কী কঠিন এই ঘেরাটোপ। ফাঁদে পড়া জন্তুর মত দেওয়ালে মাথা কোটে অনি।
ঝাপসা কালো কাচের দেওয়ালে হাত বোলায় অনি, একটু স্বচ্ছ হয়, বাইরেটা এখন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।
“তিতিইইইর… তিতিইইইর!!”
অনির ব্যর্থ চিৎকার প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে তার নিজের কাছে। বেশ বুঝতে পারে আর কখনও তার ডাক পৌঁছবে না তিতিরের কানে।
স্ট্রিট লাইটের ছিটে এসে পড়েছে ঘরে। আলো আঁধারি ঘরটায় বেচারী তিতির একা ঘুমাচ্ছে। ভাবছে অনি বোধহয় পাশেই আছে। কিন্তু তিতিরের বুকে মাথা রাখতে কি পারবে আর কখনও…
ঝাপসা চোখে নিজের বিছানার দিকে তাকায় অনি। ওখানেই তিতির ঘুমিয়ে আছে, ঘুমন্ত তিতিরকে রাজকন্যার মত লাগে… কাচের দেওয়ালে চোখ রাখে অনি। তখনই আতঙ্কে হিম হয়ে যায় তার সর্বাঙ্গ। কী দেখছ ও! ওটা স্বপ্ন না সত্যি? অনি দেখে, অবিকল তার মত দেখতে কারও বুকে মাথা রেখে তার নিবিড় আলিঙ্গনে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে তিতির!
“ওটা আমি নই, তিতির…”
প্রতিধ্বনিত শব্দেরা বলে যায়, “আমি নই…আমি নই”! তারপর শব্দেরা হারিয়ে যায় কোথাও। পড়ে থাকে শুধু একরাশ হতাশা আর দীর্ঘশ্বাস!
চোখ ফেটে জল আসে অনির। ঠিক তখনই পিছন থেকে কেউ নিবিড়ভাবে অনিকে জড়িয়ে ধরে তার ঘাড়ে ঠান্ডা নাকটা ঘষতে ঘষতে অবিকল তিতিরের গলায় বলে ওঠে,
“কষ্ট পেও না, আমি তো আছি তোমার জন্য…”