মৃত্যুর শব্দ| পলক-ফেলা-নিষেধ | শতরূপা ভট্টাচার্য্য| Bengali Thriller Story
0 (0)

ঘড়িতে রাত পৌনে দুটো বাজে। ক্রিং ক্রিং ক্রিং করে ড্রইংরুমে চার্জে দেওয়া মোবাইল ফোনটা অনেকক্ষন ধরে বেজে চলেছে। এই শীতের রাতে এতটা উঠে ওই ঘরে গিয়ে ফোন ধরার কোন ইচ্ছেই মিতালীর নেই।

মিতালী মনে মনে ভাবল, ‘যেই ফোন করছে করুক, আননোন নম্বর হলে সকালে ট্রু-কলার অ্যাপে কলার আইডি দেখে তখন না হয় কল ব্যাক করা যাবে।’ মিতালী আশা করতে থাকল এই ফোন বাজাটা বন্ধ হয়ে যাক।

এমনিতেই শুতে শুতে অনেক রাতই হয়ে গেছে, তার ওপরে সকালে তাড়াতাড়ি অফিসেও যেতে হবে, একটা ইমপর্টেন্ট মিটিং আছে। মিতালী কম্বল দিয়ে মাথাটা ঢেকে ফেলে। কিন্তু তবুও ফোনের একঘেয়ে ক্রিং ক্রিং শব্দটা ওর মাথায় গিয়ে যেন আঘাত করছে।

ও চিৎকার করে বলে উঠল, “উফ…. সত্যি মাইরি। কী জ্বালা, অসহ্য!”

যে ফোন করেছে সেও যেন নাছোড়বান্দা, ঠিক যেন পণ করে বসে আছে, এ প্রান্ত থেকে কেউ ফোন না ধরা পর্যন্ত সে রিং করেই যাবে, করেই যাবে। মিতালী নিজেকে আর কম্বলের নীচে আটকে রাখতে পারে না। “মহা জ্বালা, মহা যন্ত্রনা” বলতে বলতে বিছানা থেকে উঠে পড়ে মিতালী। বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে মিতালী মনে মনে ঠিক করে উল্টো-পাল্টা ফোন হলে, সে যেই করুক না কেন তার গুষ্টির ষষ্টিপুজো করে তবে ছাড়বে।

গভীর রাতের এই ফোনগুলো সাধারনত হয় শোক সংবাদের, নয় তো রং-নাম্বার। মিতালী মনে মনে নিজেকে একরকম তৈরি করেই ড্রইংরুমের দিকে রওনা দেয়। ঠিক যেন সে ধরেই নিয়েছে যে, এটা উল্টো-পাল্টা ফোন ছাড়া আর কিছুই না। ড্রইংরুমের দিকে যেতে যেতে মিতালীর একবার মনে হয়, যেই ও ফোনের কাছে গিয়ে দাঁড়াবে, অমনি ফোনটা বাজা বন্ধ হয়ে যাবে।

মুখ ব্যাজার করে ড্রইংরুমের আলোটা জ্বালিয়ে মিতালী চার্জে বসানো মোবাইলের সামনে এসে দাঁড়ায়। কম্পিউটার টেবিলের ওপর রাখা মোবাইলটা তখনও বেজে চলেছে। চেয়ারটা টেনে নিয়ে সেখানে বসে, মোবাইলটা হাতে তুলে নিল মিতালী। স্ক্রীনের নাম্বারটা তার অচেনা, রিসিভ করে সে বলল, “হ্যালো, কে বলছেন? হ্যালো… হ্যালো…”

কয়েক মূহুর্ত কেটে যায়, ওপার থেকে কোন সাড়া-শব্দ নেই।

মিতালী আবারও বলল, “হ্যালো, কে বলছেন? কাকে চাই? হ্যালো… হ্যালো…”

অপর পাশ থেকে এবারও কেউ কোনও উত্তর দেয় না। এবার মিতালী বিরক্তি আর চেপে রাখতে পারে না, প্রায় চিৎকার করে বলল, “আরে, কে বলছেন বলুন তো? কোনও কথা বলছেন না কেন? রাতদুপুরে কী মস্করা হচ্ছে শুনি? ডিসগাস্টিং।”

তারপর বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে কানে মোবাইলটা ধরে তার চার্জ হওয়ার জন্য উত্তপ্ত স্পর্শ পেতে পেতে মিতালীর মনে হল, অপর পাশে কেউ একজন ঠিক যেন দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ল।

মিতালী এবার অধৈর্য্য হয়ে বলে উঠল, “হ্যালো… হ্যালো… আশ্চর্য ব্যাপার তো? কথা বলছেন না কেন? আর কথা না বললে এত রাতে ফোনই বা করেছেন কেন? যত্তসব জ্বালাতন।”

ওপাশ থেকে আবারও দীর্ঘনিঃশ্বাসের শব্দ ভেসে এল।

মিতালী আবার “হ্যালো” বলতেই ফোনটা কেটে যাবার টোন ভেসে এল। মিতালী মোবাইলটা প্রায় ‘খটাস’ করে ফেলে বলে উঠল, “যত্তসব…” এবং তার সঙ্গে আরও গোটা দুয়েক অশ্রাব্য কথা যোগ করল।

মিতালীর চোখ থেকে ঘুম পুরোপুরি উড়ে গেছে। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে মোবাইলটা চার্জার থেকে খুলে ও ওর রুমে যাবার জন্য যেই না মাঝখানের রুমের দরজার দিকে তাকিয়েছে, তখনই চমকে উঠল মিতালী। ওর মনে হল, চট করে কে যেন সেখান থেকে সড়ে গেল। মিতালীর পুরো শরীর কেঁপে উঠল। ওর সমস্ত শরীর একটা শিরশিরানি অনুভূতিতে ভরে গেল। মিতালীর ঠিক যেন মনে হল যে কেউ একজন দরজায় দাঁড়িয়ে ওকে দেখছিল। ও তাকাতেই যেন চোখের পলকে শূন্যে অবয়বটা মিলিয়ে গেল। মিতালীর পুরো শরীরটা ঝিমঝিম করতে শুরু করেছে।

কেউ আছে কিনা ভাল করে দেখার জন্য মিতালী প্রায় সঙ্গে সঙ্গে পাশের ঘরের আলোটা জ্বেলে দিল। পাশের ঘরটা মিতালীর বাবা-মার। ওঁরা আজ তিনদিন বাড়িতে নেই। মিতালীর পিসতুতো দাদা অভিষেকের বিয়ে উপলক্ষ্যে ওঁরা দুজন দূর্গাপুরে ওদের বাড়ি গেছেন। মিতালীও যাবে, কিন্তু ঠিক বৌভাতের দিন। পরশুই সেদিন। কালকের মিটিংটার জন্য সে আজ দাদার বিয়েটা মিস করল।

চিন্তাটা ভেঙে যেতে মিতালী দেখল ওর বাবা-মার বেডরুমটা আলোকিত হয়ে গেছে। বিছানাটা, আসবাবপত্রগুলো সব পরিপাটি করে গোছানো, মিতালীর ঘরের ঠিক যেন উল্টো, কারণ মিতালী একেবারেই গোছানো স্বভাবের নয়। এছাড়া আর কোথাও কোন অস্বাভাবিকতা নেই।

‘নির্ঘাত চোখের ভুল হয়েছে’, এই ভেবে মন থেকে মিতালী ব্যাপারটা উড়িয়ে দিতে চেষ্টা করল। কিন্তু ওর অবচেতন মন থেকে ব্যাপারটা কোনভাবেই বের হল না।

মিতালী একবার বিছানার নীচটায়, একবার আলমারীর পাশটায় তাকিয়ে দেখল, কেউ কি লুকিয়ে আছে? তারপর সে যেই আলো নেভাবার জন্য সুইচে হাত দিয়েছে, ঠিক তখনই ক্রিং ক্রিং করে মোবাইলটা আবারও বেজে উঠল। হাতে ধরা জিনিসটা থেকে আসা হঠাৎ শব্দে মিতালী প্রায় চমকে উঠল। বুকটা ভীষণ ধকধক করছে তার। রাতের বেলায় সব শব্দই কি একটু জোরে শোনা যায়? মিতালী নিজেকে শান্ত রেখে মোবাইলটা চোখের সামনে নিতে দেখল সেই একই নম্বর।

মিতালী ফোনটা রিসিভ করে বলল, “হ্যালো… কে?” এবার অপর পাশ থেকে শোঁ শোঁ করে শব্দ শোনা গেল। ঝড় হলে হাওয়ার যে রকম একটা শব্দ শোনা যায়, অনেকটা সেই রকম। এছাড়া অন্য কোন শব্দ নেই।

মিতালী এবার বেশ বিরক্তি নিয়ে বলল, “এত রাতে ফোন করে বিরক্ত করার মানে কী? কথা বলছেন না কেন? হ্যালো.. হ্যালো..”

হঠাৎ ফোনের শোঁ শোঁ শব্দটা বন্ধ হয়ে গেল। এবং আবারও একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলার শব্দ শোনা গেল।

মিতালী এবার রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বলল, “আরে ব্যাটা, শুয়োরের মতো খালি খালি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছিস কেন? এক বাপের ব্যাটা হলে কথা বল। যত্তসব ইডিয়টের দল।”

খুট করে ফোন রেখে দেবার শব্দ হল। মিতালী রাগে গজগজ করতে করতে আবার কলার লিষ্টটা খুলে দেখল নাম্বারটা স্ক্রীনে উঠে আছে, ‘আচ্ছা এটা এদেশের নাম্বার তো?’ হঠাৎই মিতালীর মনে হল, ‘এটা আবার কোনো ওভারসিস কল না তো? এখন তো কত ফ্রডও হয়, তাহলে? কে ফোন করল? যেই হোক, কে ফোন করেছে সেটা না জেনে শুনে এভাবে খারাপ খারাপ কথা বলা কি ঠিক হল?’

কথাটা চিন্তা করতে করতে বাথরুম হয়ে, মিতালী ওর ঘরে চলে এল। কম্বল টেনে শুতে শুতে মিতালী ঘড়ি দেখল, তিনটে বেজে পনের মিনিট। মিতালী বাঁ-পাশে কাত হয়ে শুয়ে পড়ল।

মিতালী কতক্ষণ ঘুমিয়েছে তা ও ঠিক বলতে পারবে না। ঘুম ভাঙল একটা খুটখাট খুটখাট শব্দে। সে কম্বলের ভেতর থেকে মাথাটা তুলে শুনতে চেষ্টা করল শব্দটা ঠিক কোথা থেকে আসছে। তারপর ওর মোবাইলটা হাতে নিয়ে ফ্ল্যাশটা জ্বালিয়ে ঘরের খোলা দরজা দিয়ে ড্রইংরুমের মধ্যে আলো ফেলল। ড্রইংরুমের একপাশে রাখা ফ্রিজটা স্পস্ট দেখা যাচ্ছে। ফ্রিজটার গা ঘেঁষেই রান্নাঘর। মিতালীর হঠাৎ মনে হল, রান্নাঘরে ঠিক যেন কেউ একজন দাঁড়িয়ে কিছু একটা করছে, অন্তত অবয়বটা তো সেরকমই লাগল মিতালী। খুটখাট খুটখাট শব্দটাও রান্নাঘর থেকেই তো আসছে।

এত রাতে কে হতে পারে? পুরো বাড়িতে মিতালী তো একা। তাহলে রান্নাঘরে ও আবছায়াটা কে হতে পারে? মিতালী এবার সত্যিই বেশ ঘাবড়ে গেল।

‘কে আসবে এত রাতে রান্নাঘরে? ভূত-টুত না তো?’ কিছুক্ষণ আগে যখন সে উঠেছিল, তখন মা-বাবার বেডরুমের দরজায় দেখা অবয়বটার কথা মনে পরে গেল মিতালীর। একটা অদম্য ভয়ে শরীরটা মোচড় দিয়ে উঠল ওর। ঠান্ডাটা আরও জাঁকিয়ে বসল। কিন্তু কৌতূহল বড় বিষম বস্তু, তাই মিতালী কম্বলটা গা থেকে সড়িয়ে উঠে দাঁড়াল। নাহ… ভয়টা কিছুতেই যাচ্ছে না, ক্রমশ যেন আরও বেড়ে চলেছে।

মিতালী গলা খাঁকারি দিয়ে নিজের বন্ধ হয়ে আসা গলাটা ঝেড়ে বলল, “কে? কে ওখানে?”

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই খুটখাট খুটখাট শব্দটা বন্ধ হয়ে গেল। মিতালী ওর ঘর থেকে পুরোপুরি বের হবার সাহস পেল না। সে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে পড়ে রান্নাঘরের দিকে উঁকি দিল। ঠিক তখনই ওর মনে হল, রান্নাঘরের দরজা থেকে কেউ একজন ঠিক যেন হুট করে সড়ে গেল।

মিতালী চমকে উঠে বার কয়েক বলে উঠল, “কে? কে ওখানে?”

রান্নাঘরটা বেশ অন্ধকার, কিছুই ঠিকঠাক দেখা যাচ্ছে না। মিতালী রান্নাঘরের দিকে না গিয়ে ড্রইংরুমের দিকে গিয়ে সুইচবোর্ডের দিকে সন্তর্পনে এগিয়ে গিয়ে আলোটা জ্বালাল। আতঙ্কে আর ভয়ে মিতালীর পুরো শরীর কাঁপছে। ড্রইংরুমের আলোতে রান্নাঘরের অন্ধকারটা কিছুটা কেটে গেল। সে নিজেকে সামলে নিয়ে বেশ ভয়ে ভয়ে রান্নাঘরে উঁকি দিল।

না, কেউ নেই। রান্নাঘরের বাইরে থেকেই মিতালী একটু ঝুঁকে আলোটা জ্বালাল। কেউ নেই, আসলে তো কেউই নেই। মিতালী এবার বেশ স্বস্ত্বিবোধ করল। শুধু শুধু ভয় পাবার জন্য নিজের মনেই মিতালী খানিকটা হেসে উঠল এবং বলল, “তুই একটা ভীতুর ডিম, মিতু। ভীতু একটা। বাবা-মা যদি তোর এই সাহসের কথা জানতে পারে তা হলে আর দেখতে হবে না। তোর এই সাহসের কথা আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে লিক হয়ে যাবে।”

এবার নিজের ওপর খানিকটা বিরক্ত হয়েও যায় মিতালী। কি করছে ও এসব। কাল সকালে ওর জরুরি মিটিং, ওকেই প্রেজেনটেশান দিতে হবে। আজ সাউন্ড স্লিপ ওর জন্য জরুরি ছিল। কিন্তু ও নিশাচর প্রাণীর মতো সারা বাড়িময় ঘুরে বেড়াচ্ছে আর কিছু আওয়াজের পিছু করছে। কিন্তু ওই ছায়ামূর্তিটা? না.. না.. এগুলো ওর মনের ভুল।  

রান্নাঘরের আলোটা নিভিয়ে দিয়ে, মিতালী রান্নাঘরের পাশের বেসিনে দাঁড়িয়ে চোখে-মুখে একটু জল দিল। ঠিক করল কানে হেডফোন লাগিয়ে শুয়ে পড়বে। তাহলেই এই উটকো আওয়াজ শোনা বন্ধ হয়ে যাবে। ভাবনা মতো নিজের ঘরে এসে বিছানার মাথার কাছে বসে হেডফোনটা হাতে নিতেই ওর শরীর খারাপ করতে শুরু করল। হেডফোনটা টুকরো টুকরো করে কেউ যেন কেটে দিয়েছে। এই তো শোবার সময়তেও…

ভাবনাটা পূর্ণ করতে পারল না মিতালী। আবারও খুটখাট খুটখাট শব্দটা শুনতে পেল। ওর মনে হল কেউ যেন ইচ্ছে করে খুটখাট করে শব্দটা করছে, এবং এমন করে শব্দটা করছে যেন মিতালী শুনতে পায়। ভয়ে আবারও ওর শরীরটা ঝিমঝিম করে উঠল।

মিতালীর মনে আবারও ভূতের তত্ত্ব চলে আসে। কিন্তু পরক্ষণেই ভূতের চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে ও অপেক্ষা করতে লাগল আরো শব্দ শোনার জন্য। কিন্তু না… আর কোনও শব্দ হল না। মিতালীর রুম থেকে বেড়িয়ে আর রান্নাঘরের দিকে তাকাতে ইচ্ছে করল না। ওর হঠাৎ কেন যেন মনে হতে লাগল, রান্নাঘরের দিকে তাকালে ও ভয়ঙ্কর কিছু একটা দেখতে পাবে।

নানান আজে-বাজে চিন্তা ওর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। নিজের ফ্ল্যাটে এমনভাবে এমন একটা পরিস্থিতির সম্মুখীণ হতে হবে, তা ও কখনও কল্পনাও করতে পারেনি। যদিও মিতালী নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করে যে, ভয় পাবার কোন কারনই নেই। সবই হয়ত তার মনের ভুল। কিন্তু তবুও কেন যে ভয়টা যাচ্ছে না? বরং একটু একটু করে অজানা ভয়টা ওকে আরো বেশী বেশী জড়িয়ে ধরছে। আসলে ভয় ব্যাপারটাই এরকম, একবার কেউ ভয় পেতে শুরু করলে ভয়টা আস্তে আস্তে বাড়তেই থাকে, বাড়তেই থাকে। কাটাতে চাইলেও কাটতে চায় না।

মিতালী বিছানায় শুয়ে পুরো ব্যাপারটা বিশ্লেষন করতে শুরু করল। ওর ধারনা তাতে ভয় ব্যাপারটা যদি চলে যায়। ও ঠিক করল নিজেই নিজের সঙ্গে মনে মনে কথা বলে পরিবেশটা সহজ করবে এবং এই কাজটা করে যদি ঘুমটা আসে।

মিতালী ওর প্রশ্ন উওর শুরু করল, “মিতালী, তুমি ভয় পাচ্ছ কেন?”

“না, আমি ভয় পাচ্ছি না।”

“উহু… নিজের কাছেই মিথ্যা? ডাক্তার, উকিল আর ডিটেকটিভের কাছে মিথ্যা বলতে নেই। এখন তো তুমি নিজেই ডিটেকটিভ। তাই পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে আমি বুঝতে পারছি, তুমি এই মূহুর্তে ভয়ে কেঁচো হয়ে আছ। কি ভয় পাচ্ছ না?”

“তা, কিছুটা ভয় পাচ্ছি তো। মিথ্যা বলে লাভ নেই।”

“কেন পাচ্ছ?”

“জানি না, বলতে পারব না।”

“আবারও মিথ্যা? উহু… ঝেড়ে কাশ তো। ঝেড়ে কাশ। তারপর টুক করে সত্যিটা বলে ফেল। সেল্ফ অ্যানালাইসিস করতে বসে মিথ্যা বললে তো কোন কাজের কাজ হবে না।”

“আমার মনে হচ্ছে, এই মূহুর্তে আমি ছাড়াও এ ফ্ল্যাটে কেউ একজন আছে।”

বলতে বলতে মিতালী টের পায় ওর মধ্যে আবারও সেই ঝিম ধরানো ব্যাপারটা চলে এসেছে। মাথার পেছনের চুলগুলো ঠিক যেন আপনা-আপনি একটু একটু করে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে।

অস্বস্তির ভাবটা কাটাতে মিতালী আবার প্রশ্ন করে, “কে আছে এই ফ্ল্যাটে?”

“আমি জানি না?”

“কীভাবে বুঝলে যে তুমি ছাড়াও এই ফ্ল্যাটে আরও কেউ আছে?”

“ড্রইংরুম থেকে মোবাইলটা ধরে নিয়ে ফেরার সময় মনে হল, কেউ একজন হুট করে সড়ে গেল বাবা-মার ঘরের দরজা দিয়ে। রান্নাঘরের দরজাটায়ও একই ব্যাপার ঘটল।”

“এটা তোমার মনের ভুল । বিজ্ঞান বলেও তো একটা বিষয় আছে সোনা। হঠাৎ আলো থেকে অন্ধকারে তাকালে এমনটা তো হতেই পারে। ভিসুয়াল অ্যাডাপটেশান বলে একটা কথা আছে তো? সবই আলো-অন্ধকারের খেলা।”

“কিন্তু, কিন্তু… একটু আগে যে, রান্নাঘর থেকে খুটখাট খুটখাট শব্দ শুনতে পেলাম। সেটাও কি মনের ভুল? সেটা তো আর কোনও আলোর খেলা নয়?”

“না, সেটা মনের ভুল বা আলোর খেলা না হয় নাই হল, কিন্তু ইঁদুরের খেলা তো হতেই পারে নাকি?”

“তুমি কি রান্নাঘরে কাউকে দেখতে পেয়েছ?”

“না।”

“তাহলে… শব্দটা ইঁদুরই করেছে, নাকি?”

মিতালী নিজের প্রশ্নের উত্তরে বেড়িয়ে আসা যুক্তিটা একেবারেই উড়িয়ে দিতে না পারে না। তবুও বলল, “আমাদের এই অ্যাপার্টমেন্টে তো কোন ইঁদুর নেই।”

“তুমি তো আর বিড়াল না সোনা। কি করে জানবে যে ইঁদুর আছে কি নেই? ইঁদুরের খবর রাখে শুধু বিড়াল।”

“না, এই যুক্তিটা মানতে পারলাম না। পাঁচ বছর এই অ্যাপার্টমেন্টে এসেছি, কোনদিনও কোন ইঁদুর দেখিনি। আওয়াজটা কে করল? ইঁদুর এটা হতেই পারে না।”

“সব তোমার মনের ভুল সোনা। আসলে এই ফ্ল্যাট বাড়িতে তুমি ছাড়া আর কিছুই নেই। কম্বল চাপা দিয়ে এবার ঘুমাও, অনেক বিশ্লেষণ হয়েছে।”

মিতালী নিজের কথার উত্তরে নিজের অজান্তেই মাথা নাড়ল। নিজের সঙ্গে কথোপকথনের মাধ্যমে হওয়া এই বিশ্লেষণে মিতালীর ভয়টা অনেকটা কমে গেল। চোখেও ঘুম চলে এসেছে।

মিতালী কম্বলটা মাথা পর্যন্ত টেনে যেই পাশ ফিরে শুয়েছে, ঠিক তখনই তার ঘরের টিউব লাইটটা আপনা-আপনি নিবে গেল। সঙ্গে সঙ্গে মিতালীর পুরো শরীর ভয়ে-আতঙ্কে আবারও শক্ত হয়ে গেল। মাথা থেকে পা পর্যন্ত একটা শিরশিরানি অনুভূতি প্রবাহিত হয়ে গেল। মিতালী চুপ করে বিছানায় পড়ে রইল কি হয় তা দেখার জন্য।

কয়েক মূহুর্ত কোন কিছুই হল না। ড্রইংরুম থেকে দেয়াল ঘড়ির টিক টিক শব্দটা শুধু শোনা যাচ্ছে। খানিকক্ষণ পর আবারও রান্নাঘর থেকে সেই পরিচিত খুটখাট খুটখাট শব্দটা শোনা গেল। তবে এবারের শব্দটা মিতালীর মনে হল আগের চেয়েও অনেক বেশি জোরে হচ্ছে। যে শব্দটা করছে তার মধ্যে আর কোনও রাখ-ঢাকের ব্যাপার নেই। যেন কে শব্দ শুনল, আর কে, না শুনল, তাতে তার কিছুই যায় আসে না।

এবার মিতালী কি করবে বুঝতে পারল না? শব্দের পরিমান একটু একটু করে বাড়ছে। ঠিক যেন রান্নাঘরে কোন ব্যক্তি তার আহারের ব্যবস্থা করছে, কুটনো কাটছে, মশলা বাটছে, গ্যাস জ্বালছে।

মিতালী থাকতে না পেরে আবারও বলে উঠল, “কে রে? রান্নাঘরে কে?”

আবার মিতালীর প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গেই খুটখাট খুটখাট শব্দটা বন্ধ হয়ে গেল। মিতালী কি যে করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে, কম্বলের উষ্ণতা গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছে, জানুয়ারীর এই শীতেও সে অজানা ভয়ে দরদর করে ঘামছে। বুকের মধ্যে হাপরে যেন পাড় পড়ছে। মিতালী মনে মনে যতজন দেবতার নাম জানত, সবার নাম বলতে বলতে প্রণাম করতে লাগল। ভয়ের সময় সব যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।

মিতালী ঠিক করল, যা হোক হবে ও এক দৌড়ে রান্নাঘরে যাবে। আজ দেখতেই হবে রান্নাঘরে কে? হোক সে অশরীরী, ভয়ঙ্কর ভূত। সব কিছুর একটা সীমা আছে। সেই রাত দুটো থেকে এই অত্যাচার চলছে। প্রথমে ফোনে, তারপর মিতালীর বাবা-মার ঘরে, এখন রান্নাঘরে উপদ্রব। এটা তো দুনিয়া ছাড়া জ্বালাতন হয়ে গেছে।

কোনদিন কোন অলৌকিক অস্তিত্বের উপস্থিতি টের পায়নি মিতালী। এই ফ্ল্যাট বাড়ির কখনও কোন ব্যাড রিপোর্টও পায়নি ওরা। তাহলে? এই অস্বাভাবিক উপস্থিতির মানে কী?

ভয় পেলেই ভয়। মন শক্ত করে মিতালী। রান্নাঘর থেকে আর কোন শব্দ শোনা গেল না। মিতালী কান খাড়া করে বিছানায় আধ শোয়া হয়ে শুয়ে আছে। ঘরের টিউব লাইটটা ক্রমাগত চিড়িক চিড়িক করে জ্বলছে আর নিভছে, জ্বলছে আর নিভছে। শিরদাঁড়ার মধ্যে থাকা সুষুম্নাকান্ডের মধ্যে বয়ে চলা তরলের স্রোতকে অনুভব করতে পারে মিতালী। ও ওর ঘরের দরজাটা দিয়ে রান্নাঘরের দিকেই তাকিয়ে আছে। সব অদৃশ্য ও অশ্রাব্য।

কিছুসময় পর আবারও শুরু হল খুটখাট খুটখাট শব্দ। মিতালী এবার এক ঝটকায় উঠে দাঁড়াল, এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজল, হাতে নেবার জন্য। কিন্তু কিছুই পেল না যেটাকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা যাবে। যদিও অশরীরীর সামনে সব অস্ত্রই অচল, তবুও তা ওকে খানিকটা ভরসা দিত, এই আর কী… মনে মনে বিরক্ত হল মিতালী, এই ভেবে যে, দরকারে খুঁজলে কিছুই পাওয়া যায় না।

শেষমেষ ড্রেসিং টেবিলের একপাশে রাখা ফুলদানিটা হাতে নিয়ে মিতালী ওর ঘরের দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। রান্নাঘরের শব্দের তীব্রতা এখন অনেকটাই কমে গেছে। মিতালী ড্রইংরুমের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে দেয়াল ঘড়িতে দেখল সাড়ে তিনটে বাজে।

তারপর খুব আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল মিতালী, রান্নাঘরের ভেতরে উঁকি দিতেই ও যা দেখল তাতে ওর পুরো শরীর অবসন্ন হয়ে পড়ল। বিস্ময়ে আতঙ্কে ওর মনে হল ও এখনই মাথা ঘুরে পরে যাবে। নিজের চোখকে ও বিশ্বাস করতে পারছে না। ও দেখল রান্নাঘরের মেঝেতে বসে একটা আবলুস কাঠের মতো কালো কুচকুচে দশাশয়ী লোক একাগ্র মনে শিলেতে মাংস কাটা চপারটা ধার দিচ্ছে। এবার খুটখাট আওয়াজটা শান দেবার ঘসঘস আওয়াজে পরিবর্তিত হয়ে গেছে। হাত-পা কাঁপতে শুরু করে দিয়েছে মিতালীর।

মিতালীর ঘরের দপদপ করা আলো-আঁধারিতে লোকটার মুখটা দেখা যাচ্ছে না। লোকটা বা ওই লোকটার ছায়ামূর্তিটা একাগ্রতা সহ কাজ করে চলেছে।

মিতালীর মুখ দিয়ে অস্পষ্টভাবে বের হয়ে এল, “কে?”

সঙ্গে সঙ্গে লোকটা মিতালীর দিকে মুখ তুলে তাকায়, রক্তাভ সাদা মুরগির ডিমের মতো বড় বড় দুটো মনিহীন চোখের চাহনি দেখে মিতালীর ভেতরটা পর্যন্ত কেঁপে উঠল।

কাঁপতে কাঁপতে মিতালী কোন মতে তোতলাতে তোতলাতে ফুলদানী ধরা হাতটা তুলে ধরে বলল, “কে? কে?”

মিতালীর পুরো শরীর এবার থরথর করে কাঁপতে শুরু করল। সে চোখে আর ঠিক মতো কিছু দেখতে পাচ্ছে না। ওর মনে হতে লাগল যে কোন মূহুর্তে ওর হার্ট আট্যাক হয়ে যাবে।

রান্নাঘরের মেঝেতে বসা লোকটা কোন কথা বলল না, শুধু মিতালীর চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে আস্তে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। মিশকালো লোকটা অন্ধকারে মিশে ক্রমশ পায়ে পায়ে এগিয়ে যেতে থাকে মিতালীর দিকে। মুখটা তার নীচের দিকে করা হলেও সেই বিভীষিকা কিন্তু চোখ দুটো উল্টো করে মিতালীর দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কারও চোখ যে, এত ভয়ঙ্কর হতে পারে তা মিতালীর কল্পনাতেও ছিল না। লোকটার ভয়ঙ্কর চাহনির কাছে মিতালী হঠাৎ যেন আরও অনেক অনেক বেশি অসহায় হয়ে পড়ল।

মিতালী পেছাতে পেছাতে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “তুমি কে? কী চাও? এত শব্দ করছিলে কেন?”

লোকটা তার জ্বলন্ত চোখ দিয়ে মিতালীর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে মাংস কাটার চপার সমেত হাতটা তুলে মিতালীকে ইশারা করল। প্রতি পদক্ষেপে সে যেমন যেমন মিতালীর দিকে এগোতে লাগল, তেমন তেমন লোকটার গাল বেয়ে বেয়ে পচা-গলা মাংস খসে খসে পরতে লাগল। মাংসের পেছনে থাকা কঙ্কালটা ক্রমশ দেখা যেতে থাকল।

ভয়ে-আতঙ্কে দিশাহারা হয়ে যায় মিতালী। মাথায় একটা চিন্তা এল মিতালীর। তাহলে এটাই কি তার শেষ? চোখের সামনে কি তার মৃত্যু এসে উপস্থিত হয়েছে? মিতালী শুনেছিল মৃত্যু নিঃশব্দই হয়, এও তাই নিস্তব্ধ। কিন্তু এতক্ষণ ধরে এই যে এত রকমের শব্দ সে শুনছে, সেগুলো তাহলে কি?

মিতালীর কানে ঠিক যেন একটা হাওয়ার ঝটকা এসে ফিসফিসিয়ে বলে গেল, “ওগুলো… ওই শব্দগুলো তোর মৃত্যুর শব্দ রে।”

চমকে উঠে মিতালী সামনের দিকে তাকায়। সামনে তখন এক বিশালদেহী কঙ্কাল, দু-হাত বাড়িয়ে দিল মিতালীর গলার দিকে। মিতালী নিজেকে বাঁচাতে তার হাতে থাকা ফুলদানীটা কঙ্কালটার দিকে ছুঁড়ে মারল।

সামনে থেকে কঙ্কালটা অদৃশ্য হয়ে গেল। মিতালীর ছোঁড়া ফুলদানী সোজাসুজি উড়ে গিয়ে রান্নাঘরের তাকে রাখা বাসনের ওপর লাগতে সব বাসনকোসন সমেত ফুলদানীটা ঝনঝন করে মাটিতে পড়ল।

মিতালী এই ব্যর্থতার পর দেখল কঙ্কালটা আবারও দৃশ্য হয়েছে। করোটির চোখের কালো খোপে আগুনের ভাঁটার মতো দুটো কি যেন জ্বলতে লাগল। মুখের উন্মুক্ত বত্রিশ দাঁতে কেমন একটা ভয়ঙ্কর পৈশাচিক হাসি ফুটিয়ে সে মিতালীর দিকে এগিয়ে আসল। ভাবটা ঠিক যেন সে তার অভিষ্টে সফল। মিতালীর মৃত্যু-কাহিনি তার লেখা হয়ে গেছে।

বিভীষিকাত্রস্ত হয়ে মিতালী ছুটে সেখান থেকে পালানোর জন্য পেছন ঘুরতেই এক গাঢ় পিচ্ছিল তরলে পা পিছলে সে পড়ে গেল, রুমের দরজার সঙ্গে প্রচন্ড আঘাত লাগল ওর মাথার। করোটি ফেটে সেখান থেকে মাটিতে ছিটকে পড়ল রক্ত-ঘিলু।

মিতালীর হাত থেকে ছুটে আসা ফুলদানীর আঘাতে রান্নাঘরের বাসনকোসন ঝনঝন শব্দে পড়াতে পুরো অ্যাপার্টমেন্টের লোকজন জেগে ওঠে। নীচ থেকে সিকিউরিটি গার্ড সহ অনেকে এসে অনেকক্ষন কলিংবেল বাজায়। তারপরেও মিতালী দরজা খোলে না, সবাই আলোচনা করে পুলিশে আর মিতালীর বাবা-মাকে খবর দেয়।

পুলিশের লোক দরজা ভেঙ্গে মিতালীকে মাটিতে রক্তাক্ত অবস্থায় পরে থাকতে দেখে। মিতালীকে প্রাথমিক দৃষ্টিতে মৃত বলে মনে হয়, তারপর ফরেনসিক চিকিৎসক কনফার্ম করেন মিতালী মৃত। মাথায় ভীষণ আঘাত লাগার জন্য ওর সাথেসাথেই মৃত্যু হয়েছে। বাড়িতে অস্বাভাবিক কিছুই পাওয়া যায় না। পুলিশেরা কয়েকটা ব্যাপার বুঝতে পারে না…

এক, কাকে উদ্দেশ্য করে মিতালী সেই ফুলদানীটা তার ঘরের দরজার সামনে থেকে রান্নাঘরের দিকে ছুঁড়েছিল? দুই, মিতালী তার বিছানায় তার হেডফোনটা টুকরো টুকরো করে কেন কেটেছিল? তিন, মিতালী কিসে পা আটকে বা পিছলে মাটিতে পড়ে গেছিল? পুলিশরা যদি একটু ভালো করে লক্ষ্য করত, তাহলে দেখতে পেত মিতালীর পায়ের নীচে রক্ত। সেই অপার্থিব রক্তে পা পিছলে পড়ে মিতালীর মৃত্যু হয়েছে। তারা যদি একটু কান খাড়া করত, তাহলে শুনতে পেত, গত রাতে অনুরণিত হওয়া মৃত্যুর শব্দটা… যেটা আজ রহস্য হয়ে ফ্ল্যাটের দেওয়ালে দেওয়ালে হাহাকার করে চলেছে।

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post নয়নের আলো| কঠোর ভাবে প্রাপ্তমনস্কদের জন্য | অনির্বাণ সরকার| Bengali Stories for Matured
Next post হেস্টিংসের ডায়েরি| পলক-ফেলা-নিষেধ | শ্রয়ণ ভট্টাচার্য্য| Bengali Thriller Story