১
মিশন রাইটার্স
সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় খট করে হোঁচট খেল ক্যামেরা পার্সন অজিত। মনামি “উফ” শব্দ করে পেছন ফিরল। অত্যন্ত বিরক্তিকর অভিব্যক্তি নিয়ে বলল, “এটা কি বিয়ে বাড়ির সুটিং হচ্ছে! একটু সাবধানে চলাফেরা কর। অনেক কষ্টে ভেতরে ঢুকতে পেরেছি, একবার জানাজানি হলে কাল থেকে সোজা মামারবাড়ি।”
মাথাটা নীচু করে নিল অজিত। আজ সকালে মনামীর সাথে সে এসেছে রাইটার্সে। এখন বাজে রাত দুটো। লেখার শুরুতেই এদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া যাক। মনামি অর্থাৎ মনামী সেনগুপ্ত হচ্ছে একজন প্যারানরম্যালিস্ট। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, বিখ্যাত এবং কুখ্যাত জায়গায় ঘুরে অশরীরীর সন্ধান করাই তার কাজ। আজ সে এসেছে রাইটার্সে। উল্লেখযোগ্যভাবে, বিনা অনুমতিতে রয়ে গেছে। অন্যজন হচ্ছে অজিত ভৌমিক। প্রথম অবস্থায় সে ড্রাইভিং এর কাজ করত মনামির স্বামীর কাছে। কিন্তু তার ক্যামেরা হ্যান্ডেলিং-এর সুপ্ত প্রতিভার খোঁজ পায় মনামি। আর কী? সোনায় সোহাগা হল মনামির । সেই থেকে দুজনের যাত্রা শুরু।
দোতলায় এসে পৌঁছল তারা। মনামি একবার ঘড়িটা দেখে বলল, “সময়টা একদম আইডিয়াল। ক্যামেরা থেকে যেন চোখ না নড়ে অজিত। আমাদের ভাগ্য ভাল যে মিস্ত্রিগুলো ঘুমাচ্ছে। নইলে সব ঘেঁটে ঘ হত।”
“আগেরদিন হলে কত যে কাঠখড় পোড়াতে হত কে জানে? তুমি তো আবার দাদাকেও কিছু জানাবে না,” অজিত বলল।
“পাগল হয়েছিস! ও ভাবে আমি একটা বোগাস জিনিসের পেছনে ছুটছি। কিন্তু তুই তো জানিস আমরা সাক্সেসের কত কাছে।”
“আচ্ছা দিদি, হেস্টিংস সাহেব এলে কি ঘোড়ার আওয়াজ হবে?”
“লোকেদের কথায় বিশ্বাস নেই আমার। ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে তো গিয়েছিলি পেলি কিছু? তারা জাস্ট লাইক এনার্জি। চোখে দেখা যায় না কিন্তু অনুভব করতে হয়।”
এমন সময় সিগন্যাল ডিটেক্টটারটা বেজে উঠল। মনামি ওমনি হাত তুলে ইশারা করে দিল অজিতকে। এর মানে তারা আসছে। কাছাকাছি আছে তারা, একশো মিটারের মিটারের মধ্যে। সিগন্যালটাকে লক্ষ্য করে এগোতে লেগেছে মনামি। ধীরে ধীরে একটা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল সে।
ঘরটাতে এখনও বই,কাগজ পত্তর ভর্তি। অজিত ক্যামেরা ঘুরিয়ে যাচ্ছে চারদিকে। সিগন্যালটা এখন অত্যন্ত স্ট্রং। কিন্তু একি! একটা আলমারির সামনে আসতেই আর কোনও উত্তর দিচ্ছে না যন্ত্রটা। মনামি কয়েকবার থাপ্পড় কষাল তাতে। তবে লাভের লাভ কিছুই হল না।
এমন সময় নিজের শরীরের একটা অদ্ভুত কিছু লক্ষ্য করল মনামি। পিঠ বেড়ে একটা অদৃশ্য বস্তু নেমে আসছে। ক্রমশ নেমে এল কোমড়ে, এবার থাইতে। দুম করে একটা আওয়াজ। অজিত একটা খাতাটা দিয়ে থাইতে মেরেছে মনামির। তারপর হাসতে হাসতে বলল, “মাকড়সা ছিল দিদি। তাই সরিয়ে দিলাম।”
ধুলোমাখা চেয়ারে বসে পড়ল মনামি। যন্ত্রটাকে টেবিলে রেখে বলে উঠল, “এইবারও লস্ট। এত কাছে এসেও কিছু পেলাম না।”
অজিত যন্ত্রটা তুলে নিয়ে বলল, “এই ঘরটায় আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলে হয় না দিদি। বেশ স্ট্রং সিগন্যাল ছিল। যদি আরেকবার …”
কথাটা শেষ হয়েছে কী হয়নি আবার রিডিং দিতে শুরু করল যন্ত্রটা। দুজনেরই চোখ জ্বলে উঠল। মনামি যন্ত্রটা টেনে নিয়ে বলল, “তুই ক্যামেরা রেডি রাখ। কাজ হবে, হবেই।”
যন্ত্রটাকে নিয়ে আবার তল্লাশি শুরু করল তারা। ঘরের পরিবেশ যথেষ্ট ভারি হয়ে উঠেছে। দুজনেই সেই কথা ইশারায় জানাল একে অপরকে। মাঝে মাঝে দমকা হাওয়া বইতে শুরু করছে ঘরের মধ্যে। হঠাৎ হঠাৎ কিছু শব্দও পাওয়া যাচ্ছে।
অজিত ক্যামেরাটা খুলতেই দেখে সেটা অফ। পকেটে রাখা এক্সট্রা ব্যাটারিটা ভরেও কাজ হল না। মনামিকে সেই কথা বলার আগেই মনামি অজিতের হাত ধরে টান দিল। বলল, “একটা জিনিস দেখ অজিত। মেশিনটাকে যতবার এই আলমারির সামনে আনছি ততবার সিগন্যাল ব্রেক করছে। আবার যেই দুরে নিয়ে যাচ্ছি অমনি চালু।”
“এমন ঘটনা তো এই প্রথমবার হল। যদি সত্যি কিছু প্যারানরমাল আইটেম থাকে তাহলে তো ব্যাপারটা উল্টো হওয়ার কথা!” বিস্ময়কর মুখে মনামির দিকে তাকাল অজিত।
“এক্সাকটলি! কিছু একটা গন্ডগোল তো আছেই। তুই একবার দেখ তো আলমারিটা খুলতে পারিস কিনা। যত ঝকমারি এই আলমারি জুড়েই।”
বিশেষ কোন জোর খাটাতেই হল না। পুরনো দিনের তালাটাকে দু-তিনবার চেয়ারের পায়া দিয়ে মারতেই সেটা খুলে গেল। ভেতরে দেখা গেল কেবল ফাইল আর ফাইল। মনামি সেইগুলোকে খুলে খুলে দেখতে শুরু করল। একটু অদ্ভুত লাগলেও কিছু বলল না অজিত। অশরীরী ছেড়ে এখন মনামির মাথায় ফাইল দেখার ভূত চেপেছে এবং সেটা অত্যন্ত বিরক্তিকর লাগলেও বলার সাহস নেই অজিতের।
খানিকবাদে ভূত দেখার মত আওয়াজ করে বসল মনামি। অজিতকে ডেকে বলল, “দেখ, কী পেলাম।”
অজিত মোবাইলের টর্চটা জ্বালাল। জিনিসটা একটা বই বা ডায়েরি গোছের কিছু। চামড়ার কভার দেওয়া। দেখে বেশ পুরনোই মনে হল তার। বলল, “এ আবার কী জিনিস? রেখে দাও, সরকারি কোনও ডকুমেন্ট হতে পারে।”
মনামি ভ্রূ কুঁচকে বলে উঠল, “গাধা একটা। এটা একটা ডায়েরি। আর মোটেই এটা সাধারণ ডায়েরি নয়। ভালো করে টর্চের আলোটা ফেল। দেখ কার নাম লেখা।”
অজিত ডায়েরিটা হাতে নিল। সামনের পাতাটা খুলে টর্চ মারল। তাতে লেখা ‘ওয়ারেন হেস্টিংস’।
আকাশ থেকে পড়ার মত অবস্থা হল অজিতের। বলল, “হেস্টিংসের ডায়েরি এখানে! এটা কী করে সম্ভব! আর এটা এইভাবে পড়ে রয়েছে এত দিন, কেউ দেখেনি!”
“হতে পারে এটা আমাদের জন্যই ছিল,” অজিতের হাত থেকে ডায়েরিটা নিয়ে সোজা নিজের ব্যাগে চালান করল মনামি। তারপর কিছু একটা বলতে যাবে ঠিক সেই সময় ঘরের ভেতর অদ্ভুত একটা আওয়াজ শুরু হল। শব্দটা যেন তাদেরকে কেন্দ্র করে বৃত্তাকারে ঘুরে চলেছে। একটা ঘরঘর কচকচ শব্দ।
দুজনে দুজনের দিকে তাকাচ্ছে। অজিত কয়েকটা ঢোক গিলে নিল। একটা চাপা ভয় তার পা দুটোকে যেন পাথর করে দিয়েছে। কেবল চোখদুটো ঘুরিয়ে চলেছে সারা ঘরে। এক সময় ফোনটা পরে গেল তার থেকে। ওমনি কোথা থেকে প্রচন্ড একটা শব্দ ঘরটাকে গিলে নিল। সাথে সাথে মাথার পেছনে একটা ভারি জিনিসের আঘাত অনুভব করল অজিত। নিমেষে চোখের সামনেটা ঘোলাটে হয়ে এল। অসহ্য যন্ত্রণায় অনুভূতি হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল অজিত। জ্ঞান হারাল সে।
২
টু(To) লালবাজার হোমিসাইড
কান চুলকোতে চুলকোতে প্রকান্ড একটা ঢেঁকুর তুললেন কানুবাবু। তারপর বললেন, “বুঝলে ভাই অনন্ত,এই পুলিশের চাকরি করতে গিয়ে একটা জিনিস বুঝেছি এতদিনে।”
ওপাশ থেকে লালবাজার হোমিসাইডে সদ্য জয়েন করা আই পি এস অনন্ত বলল, “কি বুঝলেন?”
“বুঝলাম এই যে, আমাদের কাছে যখন কেস আসে না তখন আসেই না। আবার যখন আসে তখন নিশ্বাস নেওয়ার জায়গা থাকে না,” উত্তর দিলেন কানুবাবু।
“যেমন এখন। পরপর দুটো খুন।”
“একদম। একটা মরল ছাদ থেকে পড়ে আর একটাকে গলায় ছুরি মেরে। বড়কর্তা যে কী এমন বুঝলেন কেসদুটোতে কে জানে!”
“বড় ব্যবসায়ী একজন আর অন্যজন আর্মির লোক। তারপর দুজনেরই মন্ত্রী মহলে চেনা জানা আছে স্যার। কেস না নিয়ে উপায় আছে কিছু,” নিজের টেবিল ছেড়ে উঠে এল শতাব্দী।
“তাছাড়া দুটো খুনের আগেই হোমিসাইডে ফোন এল। একজন মহিলা আমাদের জানাল যে খুন হতে পারে। আর সত্যিই খুন হল,” অনন্ত বলল।
“ওসব পাগলের কারসাজি। সেই ছড়াটা শোনোনি ‘জাল, জুয়াচুরি, মিথ্যেকথা /এই তিন নিয়ে কলিকাতা।’ কলকাতায় রোজই খুন হয়। একখান তুক লাগিয়ে দিলেই হল,” হাসতে হাসতে বললেন কানুবাবু।
তাদের কথার মাঝেই ঘরে ঢুকল সিনিয়র অফিসার অলকেশ সেন ও অফিসার রথীন সেনগুপ্ত। ঘরে ঢুকেই অলকেশবাবু কেসের ব্যাপারে জানতে চাইলেন। “যে দুজন মার্ডার হয়েছে তাদের ব্যাপারে সব জানা হয়ে গেছে শতাব্দী।”
“ইয়েস স্যার। মোটামুটি সব ডিটেলসই জোগাড় করা হয়েছে,” শতাব্দীর জবাব।
“বেশ, বোর্ডে যাও আর প্রেজেন্টেশন শুরু কর।”
ডেস্ক থেকে মার্কারটা নিয়ে বোর্ডের ওপর দুজনের কেস হিস্ট্রির গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো লিখতে শুরু করল শতাব্দী। তারপর বলতে লাগল” এখানে প্রথম যিনি মার্ডার হলেন তার নাম জগদীশ শেঠ। পেশায় কাপড় ব্যবসায়ী এছাড়াও সুদে টাকা খাটান। বাড়িতে কেবল স্ত্রী আছেন। দ্বিতীয় জন হলেন আর্মি অফিসার কমলেশ সিং। কার্গিল ওয়ারে খুব দক্ষতা দেখিয়েছিলেন। বিয়ে করেছিলেন কিন্তু ডিভোর্স হয়েছে যায় পাঁচ বছর আগে।”
“এদের মার্ডার স্ট্রাটেজির মধ্যে কোনও মিল আছে?” প্রশ্ন করল রথীন।
“নো স্যার। দুজনকে মারা হয় আলাদা দিনের দুটো আলাদা সময়ে, আলাদা জায়গায় এমনকি আলাদা টেকনিকে। জগদীশকে ছাদ থেকে ঠেলে দেওয়া হয়। এটা যে সুইসাইড নয় ফরেনসিক তা কনফার্ম করেছে। আর কমলেশকে ছুরি মারা হয় তার নিজের ঘরে।”
“এদের দুজনের খুনের সময়ই কেউ ছিলেন না আশপাশে। এমনি জগদীশবাবুর স্ত্রীও সেই সময় শপিংএ ছিলেন। আমরা ফ্ল্যাটের সিসিটিভি চেক করি কিন্তু গত একমাস ধরে দুই বিল্ডিং-এর সিস্টেম কাজ করছে না,” পাশ থেকে বলে ওঠে অনন্ত।
“গুড। তারমানে খুনি যে বা যারাই হোক হোমওয়ার্কটা ভালো করেছিল। আচ্ছা এদের মধ্যে কি কোনও যোগাযোগ ছিল?” জানতে চান অলকেশবাবু।
“সেরকম কিছুই জানা যায়নি। তবে এদের দুজনের ক্ষেত্রেই ঘরে কোনও ধস্তাধস্তির চিহ্ন নেই। জগদীশের ক্ষেত্রে না হোক কমলেশের জন্য যেটা হওয়া উচিত ছিল। সেক্ষেত্রে আমরা বলতে পারি খুনি এদের চেনা কেউ,” কানুবাবু বললেন।
“হতেও পারে আবার নাও। এদের কোনও শত্রুর খবর তো পাওয়া যায়নি,” রথীন জিজ্ঞেস করল।
“না। এরা দুজনেরই কোন ব্ল্যাক রেকর্ড আপাতত মেলেনি। প্রতিবেশীদের কাছেও কোনও রকম বাজে কিছু শুনিনি আমরা,” জবাব দিল শতাব্দী।
“ওয়েল,তাহলে বিষয়টা দাঁড়ালো এই যে আপাতত আমরা এদের দুজনের খুনী আলাদা এটা মেনেই এগোব। কিন্তু একটা কানেকশন রয়ে যাচ্ছে তাও। দ্যাট ফোন কল,” রথীনের দিকে তাকিয়ে বললেন অলকেশ বাবু।
কানুবাবু একবার সকলের দিকে চেয়ে নিয়ে বলল, “কলটাকে কি গুরুত্ব দেওয়ার মত কিছু আছে? তাছাড়া শতাব্দী তো খোঁজ করেছিল। এই কল এসেছে ভবানীপুরের কাছে কোনও রেস্টুরেন্ট থেকে আর অন্যটা আসে পাবলিক বুথ থেকে।”
“এই ক্ষেত্রেও কিন্তু সিসিটিভি নেই এমন জায়গা চয়েস করা হয়েছে। সেই রেস্টুরেন্ট এবং ফোনের দোকানের মালিকও কিছু বলতে পারছে না। বাট, খুনগুলো কিন্তু হল,” অনন্ত বলে ওঠে।
“বলছ এটা সিরিয়াল কিলিং? আগে ফোন করে তারপর খুন,” অলকেশবাবু খানিক চিন্তিত হলেন।
“সেক্ষেত্রে একটা প্যার্টান থাকে। যদি ধরেওনি এটা সিরিয়াল কিলারের কাজ তাহলে আমাদের প্রথমে এই প্যার্টানটা ধরতে হবে। তারও আগে লোকটাকে,” রথীন সবাইয়ের উদ্দেশ্যে বলে উঠল।
“রাইট। তোমার প্রথমে এই দুজনের মধ্যে কোরিলেশন খোঁজার চেষ্টা কর। যদি সিরিয়াল কিলারের কাজ হয় তাহলে এদের সাথে তার মস্তিষ্কের কোনও একটা যোগসূত্র থাকবেই। এখনকার মত ডিসমিস। রথীন একবার চেম্বারে এসো তো,” কথা শেষ করে অলকেশবাবু আর চেম্বারের দিকে চলে গেলেন। রথীন সবার দিকে তাকিয়ে একটু ঠোঁট ওলটানো। তারপর অলকেশবাবুর পেছন পেছন চেম্বারের দিকে গেল।
ঘরে ঢোকা মাত্র একটা খাম রথীনের দিকে ছুঁড়ে দিলেন অলকেশবাবু। রথীন খামটা খুলে দেখে বলল, “এই একটা এভিডেন্স কি তাকে ভিক্টিম বানানোর জন্য যথেষ্ট স্যার?”
“আমি তা বলিনি রথীন। তবে একটা সূত্র তো পাওয়া গেল। এটা আমি সবার সামনে কেন দেখালাম না নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ। আমি চাই এটা তুমি পার্সোনালি দেখ।”
“আমি দেখছি। খোচর লাগাতে হবে। রাঘব বোয়াল বলে কথা,” হালকা হাসে রথীন।
“বোয়ালের ঝোল রাঁধতে হবে। যাইহোক, এবার বল বাড়ির সবাই কেমন?”
“বাবা-মা তো দিদির কাছেই। আর মনামি তার কাজ নিয়ে থাকে সারাদিন।”
“সেকি! ম্যাডাম এখনও ভূত খুঁজে যাচ্ছেন?” কথাটা বলেই একটা বিকট হাসি ছাড়লেন অলকেশবাবু।
রথীন খানিক মুখ খুব বেঁকিয়ে বলল, “ব্রহ্মদত্তি গাছে উঠেছে। এখন সে কী একটা লেখার পেছনে পড়েছে সেই নিয়েই ব্যস্ত সারাদিন। সঙ্গে কী সব এঁকে যাচ্ছে। আমাকে তো দেখায় না কিছু।”
এমন সময় শতাব্দী ঘরে ঢুকল হাঁপাতে হাঁপাতে। বলল, “আবার ফোন এসেছিল। এবারের স্পট বলল ট্যাংরা। আমরা কি আগে থেকে পৌঁছে যাব?”
“তুমি দেখছি পুলিশের বদনাম করে ছাড়বে। পুলিশ যাবে আগে! আচ্ছা যাও। রথীন তুমিও যাও।” শতাব্দীকে গাড়ি বার করতে বলে রথীন অলকেশবাবুর ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
৩
নবাবের মৃত্যু
ফস করে সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়লেন একজন অচেনা পুরুষ। তারপর সামনে এগিয়ে এসে টেবিলের পাশে দাঁড়ালেন। টেবিলের সামনে বসে আছেন আর একজন মহিলা। ঘরে চরমতম অন্ধকার ঘিরে রয়েছে। আরও একবার ধোঁয়া ছেড়ে পুরুষ কন্ঠ বলে উঠলেন, “এর পরের ঘটনাটা কী ঘটবে? আপনার ডায়েরি কিছু বলছে না।”
“ডায়েরি সব বলছে। মিস্টার হেস্টিংসের কথা মত সব হবে। আগেও মরেছে এবারও মরবে…একে একে সবাই মরবে,” মাথা নীচু করে বসে বললেন মহিলাটি।
“আমার হাতে বেশি সময় নেই। আমাকে জানান এরপর কী হবে? অনেক কাজ বাকি পরে আছে আমার। এক এক করে সব সারতে হবে।”
“মিস্টার হেস্টিংস জানালেন এরপর নবাবের মৃত্যু।”
“কেন! নবাব কি করেছেন?”
“নবাব দুশ্চরিত্র, লম্পট। যে বন্ধুর তার জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত তার বোনের চরম সর্বনাশ করেছে সে। তাকে মরতেই হবে।”
“কীভাবে? নবাবকে কি এত সহজে মারা সম্ভব!”
মিনিট খানেক আর কোনও কথার জবাব দিলেন না মহিলাটি। টেবিলের ওপর রাখা কাগজের ওপর খসখস করে কিছু লিখলেন। তারপর ধীরে ধীরে মুখটা তুললেন। বললেন, “নবাবের দেহ নিয়ে উল্লাস হবে। সবাই দেখবে নবাব মরেছে। রক্ত, রক্ত ছড়িয়ে পরবে পথে। হেস্টিংস সাহেব হাসছেন… দেখুন…ওই যে ওখানে। আপনার কথা ফলবেই সাহেব…আপনি শুনছেন…।” চেয়ার থেকে পড়ে গেলেন মহিলাটি। একরাশ শূন্যতা ছেয়ে গেল ঘরময়।
এদিকে পুলিশের বদনাম আর ঘুচল না। এইবারেও লেট করে পৌঁছল হোমিসাইড টিম। ই এম বাইসের ধারে একেয়াটিক পার্কের ঠিক আগে একটা লরিকে ঘিরে ভিড় জমেছে। লরির পেছনে একজনকে বেঁধে দেওয়া হয়েছে দড়ি দিয়ে। পেটের নাড়ি ভুঁড়ি বেরিয়ে এসেছে। মজার কথা হল, গাড়ির চালক নিজেই জানে না তার গাড়িতে এমন একটা লাশকে বেঁধে রাখা হয়েছে। লরিটা সল্টলেক থেকে ট্যাংরার দিকে আসছিল তখনই স্থানীয় লোকজন বিষয়টা লক্ষ্য করে।
অনন্ত ভালো করে ক্ষতটা পরীক্ষা করল। তারপর রথীনকে জানাল, “মনে হচ্ছে ছুরি দিয়ে অনেকবার কোপানো হয়েছে। একেবারে পেটের ভেতর থেকে সব বেরিয়ে এসেছে।”
“কোনও আইডি পেলে পকেট থেকে?” রথীন জানতে চাইল।
“অফিসের আই ডি আছে। লোকটার নাম নবাব, নবাব আদিত্য। কিন্তু স্যার, প্রশ্ন আসছে যে খুনি যদি খুনটা করে লাশটাকে গুম করে দিত, তাহলে তো তার পক্ষেই সুবিধা হত। এমন সো অফ করার মানে কি?”
“একটা অদ্ভুত খটকা তো হচ্ছেই অনন্ত । সিরিয়াল কিলার হলে সে একবার ছুরির আঘাতেই লোকটা মারতে পারত। এমন বার বার ছুরি চালিয়ে মৃত্যুকে নিশ্চিত করার চেষ্টা করত না। কিন্তু খুনি যদি সাধারণ কেউ হয় সেক্ষেত্রে খুন করার পর নয় সে বডিটাকে পুঁতে নিত না হলে কোন সেভ জায়গায় ফেলে দিত নষ্ট করার জন্য। এখানে তো দেখছি দ্বৈতসত্তাতর আর্বিভাব হয়েছে,” কপালটা চুলকে নিয়ে বলল রথীন।
কানুবাবুর সাথে শতাব্দীও এল ওদের কাছে। প্রথমে শতাব্দী বলল, “ড্রাইভার কিছুই জানে না। বলল সে বেলঘরিয়া থেকে মাল নিয়ে আসছে। কিন্তু এমন যে কিছু তার লরিতে আছে সে বুঝতেও পারেনি। আমার মনে হচ্ছে সত্যিই বলছে ড্রাইভার।”
“মাঝে কোথাও থেমেছিল সে?”- প্রশ্ন করল রথীন।
“তিনবার। দুবার চা থেকে এবং একবার টয়লেট করতে। কিন্তু তখনও নাকি কিছুই ছিল না লরির পেছনে। বেশ জোর দিয়ে বলছে সে,” উত্তর দিল শতাব্দী।
“কেসটা দেখে সাইকো কিলারের কাজ মনে হচ্ছে রথীন। তুমিই বলো। মারবি তো মার তা বলে মারার পর এমন শোভাযাত্রা করার কোনও মানে হয়? আমার মনে হয় লোকটা বোঝাতে চায় যে সে খুন করেছে। হয় তো কোনও বদলার কেসও হতে পারে বা স্ত্রীর পরকীয়া দেখে রাগে উন্মত্ত স্বামী ঝেড়ে দিয়েছে গোপন প্রেমিককে,” রথীনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন কানুবাবু।
রথীনের সাথে বাকিরাও হেসে উঠল মিটমিটিয়ে। অনন্ত বলে উঠল, “বৌদির সাথে ওয়েব সিরিজ তাহলে ভালোই দেখা হচ্ছে।”
“দুর পাগল। বিয়ে তো করোনি, করলে বুঝতে। রোজ চাল ডাল তেলের হিসেব কষতেই দিন কেটে যায় তা ওপর ওয়েব সিরিজ,” মুখটা বেজার করে বললেন কানুবাবু।
“তোমরা এখন থামো। শতাব্দী, তুমি বডিটাকে পোস্টমর্টেমে পাঠাও। আর অনন্ত তুই এই রোডের ওপর যত কটা সিসিটিভি আছে সবকটার ফুটেজ জোগার কর। এখান থেকে বোঝা যাবে বডিটা লরিতে চাপলো কোথা থেকে। কানুদা তুমি বরং মিডিয়া, পুলিশ এবং তোমার তোপসের দলকে কাজে লেগে পড়তে বল। লোকটার ঠিকুজি বার করতে হবে।”
কানুবাবুদের সাথে রথীন অফিসে ফিরল না। গাড়ি নিয়ে সোজা মনুমেন্টের সামনে এসে হাজির হল সে। গাড়ির দরজাটা লক করে রাস্তার এদিক ওদিক দেখতে লাগল। মিনিট পাঁচেক এমন চলার পর তার ফোনটা বেজে উঠল। অচেনা নম্বর দেখে নিয়ে রথীন ফোন ধরল, “হ্যালো, কে বলছেন?”
ওপাশ থেকে নাঁকি সুরের গলা বলে উঠল, “খবর আছে। আমি ঠিক পেছনে আছি আপনার। পেছনে তাকাবেন না। নরমাল ফোনে কথার মতন কথা বলুন।”
“যে কাজগুলো দিয়েছিলাম হয়েছে?” রথীন জিজ্ঞেস করল।
“হয়েছে। হুলো বিড়ালটাকে ঘরের সামনে ঘুরঘুর করতে দেখা গেছিল। এছাড়া আচার্যবাবুও হুলোটাকে নিয়ে পার্কে এসেছিলে মোট তিনবার। হুলো রাগ করে করে চলে গেছিল।”
“কোনও কানেকশন পাওয়া গেছে?”
“আপাতত না। তবে কাজ চলছে। ঠিক সময় জানানো হবে”
“সেই ফোন কলের ব্যাপারে কিছু জানা গেল?”
“ফোনটা মনে হয় হ্যাক করে করা হচ্ছে। যেমন আমি আপনার সাথে এখানে কথা বলছি কিন্ত আমার আইপি লোকেশন দেখাচ্ছে গোয়াতে। আরও লোক লাগাতে হবে। তারজন্য কিছু টাকা লাগবে।”
“পেয়ে যাবে। কিন্তু তাড়াতাড়ি এই ফোন কলের পেছনের মাথাটাকে ধরো। এ আমাদের কাছে একমাত্র তুরুপের তাস।”
“ওকে। ওভার।”
ফোনটা কেটে যেতেই পকেট থেকে দুহাজারের পাঁচটা নোট বার করে মাটিতে ফেলে দিল রথীন। তারপর সোজা গাড়িতে উঠে বেরিয়ে গেল।
৪
গভীর রাতের আলাপ
দরজা খোলার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল রথীনের। একে রাতে দেরী করে ফিরেছে তার ওপর আচমকা এমন ঘুম ভেঙে যাওয়ায় একটু বিরক্ত হল সে। পাশ ফিরতেই দেখে মনামি বিছানাতে নেই। রাতে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস কোনও কালেই ছিল না মনামির। বরঞ্চ সে একবার শুলেই সকাল হওয়ার আগে বিছানা ছাড়ত না। বেশ কদিন ধরেই মনামির আচরণ বেশ সন্দেহজনক হয়ে উঠেছে। অজিতের হাসপাতালে ভর্তি হবার পর থেকে মনামি নিজেকে ঘরে আটকে ফেলেছে। রথীনের সাথেও কথা হয় খুব কম।
বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল রথীন। ড্রয়িং রুমে আসতেই দেখে মনামি দরজা খুলে বাইরের বের হচ্ছে। এত রাতে তাকে বাইরে যেতে দেখে ডাক নিল রথীন, “কী গো, মনামি…কোথায় যাচ্ছ এত রাতে?”
কোনও উত্তর এল না। রথীন দেখল করিডোর ধরে সোজা এগিয়ে যাচ্ছে মনামি। বার কয়েক আবার ডাকলেও কোনও সাড়া আসল না। কৌতূহলবশত রথীনও মনামির পেছু নিল। বাড়ি থেকে বের হয়ে বড় রাস্তায় চলে এসেছে মনামি। কেমন দম দেওয়া পুতুলের মত হেঁটে চলেছে সে। খানিকদুর গিয়ে একটা মুখখোলা ম্যানহোলের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। মিনিট খানেক ওইভাবে থাকার পর হঠাৎই চিৎকার করে বলে উঠল, “আপনার কাজ হয়ে গেছে মিস্টার হেস্টিংস। আপনার কথা মত সব হচ্ছে। আর মাত্র একদিন তারপর রাজাবাবুর মৃত্যু হবে। আপনি গাইড করুন। মিস্টার হেস্টিংস, আমাকে শুনতে পারছেন… হ্যালো, ক্যান ইউ হিয়ার মি…মিস্টার হেস্টিংস?”
বোবার মতন চেয়ে রয়েছে রথীন। সে নিজের চোখ কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। এ কোন মনামীকে দেখছে সে? এমন অদ্ভুত আচরণ সে কোনওদিন দেখেনি মনামির। খানিকবাদে আবার মনামি বলে উঠল, “থ্যাঙ্ক ইউ ফর গাইডিং মি। আপনার কথা মতই কাজ হবে মিস্টার হেস্টিংস। গুড বাই।”
কথাটা বলেই মাটিতে পড়ে গেল মনামি। রথীন এতক্ষণ সব দেখছিল এবার সে ছুটে এসে মনামিকে ধরল, “এই শুনছ, কি হয়েছে তোমার? আমি রথীন। কি গো?”
মনামির আর জ্ঞান নেই। একবার রথীনের দিকে তাকিয়ে তার কোলেই অচৈতন্য হয়ে পড়ল সে। মনামীকে পাঁজাকোলা করে তুলতে যাবে রথীন এমন সময় পেছন থেকে কেউ বলে উঠল। “বউকে পরে ঘরে নিয়ে যাবে রথীনবাবু,আগে ফুটেজটা আমাদের দিয়ে দিন।”
মাথা ঘুরিয়ে দেখল রথীন। গোটাচারেক গুন্ডাগোছের লোক দাঁড়িয়ে সেখানে। মনামিকে রাস্তার ওপর শুইয়েই রথীন বলল, “কে ভাই তোমরা ? আর কোন ফুটেজের কথা বলছ?”
“নখরাবাজি করছেন। জলদি ফুটেজটা দিয়ে দিন আমরা কেটে পড়ি। কেন বড় বড় মানুষদের সাথে পাঙ্গা নেন। নিজেও মরবেন বউটাকেও মারবেন,” আগের জন আবার বলে উঠল।
“তোমার বড়বাবুকে বলে দাও তার সময় ফুরিয়ে আসছে। এবার তার সাথে জেলে দেখা হবে,” কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই গুন্ডাটা একটা ঘুষি কষাল রথীনের মুখে। রথীন খানিকটা দুরে এসে পড়ল। হাত দিয়ে দেখল ঠোঁটের কোণ থেকে রক্ত পড়ছে। এবার সেও মোক্ষম প্রহার আনল। পরপর আঘাতে গুন্ডাবাহিনীর কারোর মুখ, কারোর গাল আবার কারোর কপাল দিয়ে রক্ত ঝরছে। প্রথম গুন্ডাটার পাটা মুড়িয়ে ধরে রথীন কঠিন ভাবে বলল, “তোদের মত ফুটো মস্তানদের শায়েস্তা করতে জাস্ট এক মিনিট সময় লাগবে আমার। তোদের বাপকে বলে দিস আমি ওঁকে জেলে ভরবই, যদি পারে তো আটকে দেখাক।”
সকালে সাইক্রিয়াটিস্টের অ্যাপয়েন্ট নিয়ে তারপর অফিসে এল রথীন। সেখানে ততক্ষণে অলকেশবাবুকে গতকালের কেসটা সম্পর্কে ডিটেলস বলছে অনন্ত। বাকিরাও পাশে রয়েছে। কম্পিউটার মনিটরে গতকাল মারা যাওয়া লোকটা ছবি দেখিয়ে অনন্ত বলল। “এর আসল নাম সিরাজ। এককালে ড্রাগসের ব্যবসা করত। মূলত কলেজ-ইউনিভার্সিটি ছিল ওর টার্গেট। কয়েকবার ধরাও পরে। কিন্তু গত দুবছর ধরে আন্ডারগ্রাউন্ড।”
“সিসিটিভি কি বলছে অনন্ত?”- প্রশ্ন করলেন অলকেশবাবু।
“নাথিং। আগের দুটো খুনের মতই। গাড়িটা এমন জায়গা দিয়ে এসেছে যেখানে সিসিটিভি প্রায় নেই বললেই চলে। আর যাও দু একটা পাওয়া গেছে তাতে দেখা যাচ্ছে লরির পেছন একদম ফাঁকা। যেমনটা ড্রাইভার বলেছিল,” জবাব দেয় অনন্ত।
“বাট একটা ভেরি ইন্টারেস্টিং খবর পাওয়া গেছে স্যার,” শতাব্দী মাঝখানে বলে বসল।
“কী পাওয়া গেছে?” রথীন জানতে চাইল।
“যে লরিটায় লাশটা পাওয়া গেছে সেটা যাচ্ছিল জগদীশ শেঠের গুদামে। সেখান থেকে মাল নিয়ে এক্সপোর্ট করত। জগদীশবাবু স্ত্রীও ব্যাপারটা কনফার্ম করেছে।” শতাব্দী জানাল।
“গুড। কানেকশন তৈরী হচ্ছে। খুনি সম্ভবত তাহলে এক। কিন্তু মোটিভটা কি?” অলকেশবাবু বলে উঠলেন।
“একটা স্মাগলার, একজন ব্যবসায়ী সঙ্গে একজন আর্মি, এই তিনজনের মধ্যে কী কানেকশন থাকতে পারে? যদি সত্যি কানেকশন থাকে তাহলে আরও কি মার্ডার হতে পারে। নেক্সট তাহলে কে?” প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল রথীন।
“ভাই রথীন, তুমি যদি অন্য দেশ থেকে বিনা অনুমতিতে কোন জিনিস এখানে আনো এবং বিক্রি করতে চাও তাহলে কি করবে?” হালকা হেসে বলল কানুবাবু।
“মানেটা ঠিক বুঝলাম না কানু?” অলকেশবাবু বললেন।
“এ তো জলের মত সোজা। আপনি যদি ফরেন থেকে জিনিস আনেন আপনি কাস্টমসের লোককে প্রথমে হাত করবেন। আবার আশপাশের দেশ থেকে আনলে বিএসএফ। তারপর একজন প্রফেশনাল স্মাগলারকে দিয়ে জিনিসটা সেফ জায়গায় রাখবেন। এবং তারও পরে কোনও খাঁটি বিজনেসম্যানকে ধরে সেটা বেচবেন। কমলেশবাবুও বিএসএফে ছিলেন।”
“ওহ কানুদা! ফাটিয়ে দিলে তো। নাহ, এবার বৌদি তোমাকে অপদার্থ বললে আমি আগে প্রতিবাদ করব,” রথীন কানুবাবুর ভুঁড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে বলে উঠল। অনন্ত ও শতাব্দী খানিক মিটমিটিয়ে হেসে উঠল। তবে প্রশংসার সাথে সংসারে কথা এমন হাটে বাজারে বলে দেওয়ায় একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেলেন কানুবাবু।
“ওয়েল ডান কানু। এবার তোমরা ভাব এই সিকোয়েন্স ধরে পরবর্তী লোক কোন জাতের হতে পারে,” অলকেশবাবু বলে উঠলেন।
রথীন একটু অলকেশবাবুর কাছাকাছি এসে বললেন, “একটু চেম্বারে আসবেন কথা ছিল।”
চেম্বার এসেই রথীন গতকালের সব কথা জানালো অলকেশবাবুকে। তবে ইচ্ছে করেই মনামির ঘটনাটা চেপে গেল। অলকেশবাবু শুনে টেবিলের ওপর থাপ্পড় মেরে বসলেন। তারপর বললেন, “আমাদের হাত-পা বাঁধা বুঝলে রথীন। সাধারন কেউ হলে এতক্ষণে তুলে এনে কয়েক ঘা দিলেই সব উগরে দিত। কিন্তু দেখো ক্ষমতার কী মহিমা। একের পর এক খুন হচ্ছে আমরা বুঝতে পেরেও কিছু করতে পারছি না।”
“ফুটেজ আছে তারপর যেটুকু তথ্য পাওয়া গেছে তার ওপর দাঁড়িয়ে আমরা কি প্রসিড করতে পারি না?”
“কোর্টে কেসটা দাঁড়াবেই না রথীন। এই ফুটেজটা যে ফটোশপ করা নয় এটা প্রমাণ করতেই কতবছর লেগে যাবে জানো? ক্ষমতার কাছে সবাই বশ মানে। সব্বাই।”
“বুঝলাম। তার মানে একটাই করণীয়। কট বাই রেড হ্যান্ড।”
“ফোন কলটা খুঁজে বার কর। সেই জানে খুনীর সব প্ল্যানের কথা।”
রথীন চেম্বার থেকে বেরিয়ে ঘড়িটা দেখে নিল। একটু পরেই মনামিকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে তাকে।
৫
আদিম দ্রোহ
মিঠি বারবার খাদের ধারে ঝুঁকে নীচে দেখার চেষ্টা করছে। অরুনিমা যত তাকে সরিয়ে আনছে তত সে যেতে চাইছে। কয়েকবার ধমকও খেল সে। একটু দুরে বেঞ্চের ওপর বসে অলকেশ। অনেকদিন পর তারা ঘুরতে বেরিয়েছে। আসলে পুলিশের জীবন তো আর পাঁচটা চাকরির মত নয়। সময়ের দাম এখানে নিজের জীবনের চেয়েও বেশি। অরুনিমা প্রথম প্রথম রাগ করলেও এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছে। যখন মঞ্চে উঠে অলকেশ তার সাহসিকতার জন্য পুরস্কার পায় তখন অরুনিমাই সাড়া পাড়া জুড়ে খবর রটিয়ে ছিল দায়িত্ব নিয়ে। সে এক অনন্য অনুভূতি।
এবার অলকেশ বকে উঠল মিঠিকে, “মিঠিমা, অমন করে না। মায়ের কথা শোনো। এদিকে এস দেখি।”
মিঠি এবার দমে গেল। মাথা নীচু করে এসে বেঞ্চের ওপর বসল। মেয়ের এমন মুখ দেখে অলকেশ বলল, “রাগ করেছ? আচ্ছা, আমরা দুপুরে আইসক্রিম খেতে যাব। এবার বল তো কেমন লাগছে এখানে এসে।”
“খুব ভালো পাপা। আমরা সত্যিই আইসক্রিম খাব,” কথাটা বলেই একবার মায়ের দিকে তাকাল সে। অরুনিমা হালকা চোখ বড় করে বলল, “আহ্লাদ দিয়ে মেয়েটাকে না বিগড়োলে তোমার হচ্ছে না বল!”
“বাচ্চা মানুষ খাক না। এবার তুমি বল, কেমন লাগছে কুলডিহা?” অলকেশ জিজ্ঞেস করল অরুনিমাকে।
কাছে সরে এসে অরুনিমা জানাল, “খুব সুন্দর গো। এমন কাছাকাছি পাহাড় জঙ্গল একসাথে পাব ভাবতেই পারিনি। এই একটা ছবি তুলে দাও না। আমি সামনেটায় দাঁড়াচ্ছি।”
অরুনিমার কথা মত ক্যামেরাটা বার করল অলকেশ। তারপর ছবি তোলা শুরু হল। পরপর কয়েকটা শট নেবার পর অরুনিমাকে একটু দূরে যেতে বলল সে। দূরে যেতেই আবার ক্যামেরায় চোখ রাখল অলকেশ। কিন্তু হঠাৎই মাথার পেছনে একটা প্রচন্ড আঘাত অনুভব করল সে। লোহার রডের আঘাত। ক্যামেরা হাত থেকে পড়ে গেল, সাথে অলকেশও। মুহূর্তের মধ্যে এমন ঘটনায় অরুনিমা থ মেরে গেল। অনুভূতি ফিরে আসতেই সে চিৎকার করে উঠল, “অলকেশ…শ…শ!”
এবার গুলি চলল। গুলিটা অরুনিমার কাঁধে এসে লাগল। অর্ধতন্দ্রা অবস্থায় অলকেশ দেখল অরুনিমা খাদের দিকে চলে যাচ্ছে। ক্রমশ আরও এগিয়ে যাচ্ছে সে, একসময় অরুনিমার শরীরটা খসা পালকের মত খাদে গড়িয়ে পড়ল। ভেতর থেকে প্রচন্ড চিৎকার আসলেও গলায় স্বর পেল না সে। চোখের সামনে ধীরে ধীরে শেষ হতে দেখল অরুনিমাকে।
চোখ খুলে ধড়মরিয়ে বিছানায় উঠে বসলেন অলকেশবাবু। আজ আবার সেই স্বপ্নটা দেখেছেন। অবশ্য স্বপ্ন নয়, একেবারে বাস্তব। জীবনের যে পর্যায়টা দাঁতে দাত চিপে কাটিয়েছেন, সেই জীবনটাই বারবার স্বপ্ন হয়ে ধরা দেয় ওঁর কাছে। কপালে হাত দিয়ে ঘাম মুছে নিলেন। পাশে রাখা ফোনটা তুলে দেখলেন মিঠির এস এম এস। তাতে লেখা, ‘আমার কলেজের ভ্যাকেশন শুরু হবে পাপা। আমি বাড়ি আসব। তোমায় জানিয়ে দেব ডেট টা। টিকিট বুক করে মেল করো’
মাইসরের কলেজে পরে মিঠি। সেদিনের ঘটনার পর থেকে বেশিদিন আর নিজের কাছে মিঠিকে রাখেননি অলকেশবাবু। ফোনটা বেজে উঠল। ফোনটা ধরে বললেন, “হ্যালো, অলকেশ স্পিকিং!”
ওপাশ থেকে একজন মহিলা বলে উঠলেন, “স্যার, একবার ফুলবাগান আসুন। খুন স্যার…তাড়াতাড়ি …খুন।” ফোনটা হঠাৎ করে কেটে গেল। খুনের খবরটা শুনেই অলকেশবাবু বিচলিত হয়ে উঠলেন। বিছানা ছেড়ে উঠে বেরোনো জন্য তৈরী হতে লাগলেন।
এদিকে মনামিকে নিয়ে আবার সাইক্রিয়াস্টিসের কাছে এসেছে রথীন। মনামি কথা বলা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। সবসময় কেবলই খাতার মধ্যে অদ্ভুত সব ছবি এঁকে চলেছে। ডাক্তার মনামির কাছে এসে হালকা স্বরে জিজ্ঞেস করলেন। “কাল হেস্টিংসবাবু এসেছিলেন? কি বললেন আপনাকে?”
কথাটা শেষ মনামির খুব ভালো লাগল। একগাল হেসে বলল, “এসেছিলেন। কিন্তু বলব না কি বলেছেন। বারণ আছে।”
“হেস্টিংসবাবু তো অন্য কাউকে বলতে না করছেন। কিন্তু উনি যে আমায় বললেন আপনার থেকে সব জানতেন। এবার আমি কী করি বলুন তো?” ডাক্তার বললেন।
“তোমার কাছেও এসেছিল?” খানিক মুখটা নীচু করে মনামি বলল, “কাউকে বোলো না। এবার রাজার ফাঁসি হবে। রাজা হেস্টিংসবাবুর নামে মামলা করেছে। এবার আর নিস্তার নেই,” অদ্ভুতভাবে হেসে উঠল মনামি।
“কোন রাজা? তার নামটা বল আমায়?”
“নো, নো, আমি বলবই না।”
“নামটা বলো আমায়। কোথায় ফাঁসি হবে রাজার?”
মনামি চুপ। বারকয়েক আবারও জিজ্ঞেস করলেন তিনি। কিন্তু কোনও ফল হল না। রথীন এতক্ষণ সব দেখছিল। নিজের অজান্তেই তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে আসছে। মনামি কী ছিল আর কী হয়ে গেছে। কিছুতেই সেটা মানতে পারছে না সে। এমন সময় তার ফোনটা তার ফোনটা বেজে উঠল। ফোন রিসিভ করল রথীন। এক দুবার মাথা নেড়ে ফোনটা কেটে দিল সে।
মনামিকে ডাক্তারের চেম্বারে বসিয়ে গাড়ি নিয়ে ধর্মতলায় চলে আসল রথীন। সেখানে কানুবাবু সহ বাকিরা অপেক্ষা করছিল। রথীন আসলে কানুবাবু বললেন, “ভাই রথীন,এ যে বড়সড় নেটওয়ার্ক!”
“আমরা নেটওয়ার্কটাকে ট্রেস করতে পেরেছি স্যার,” পাশ থেকে অনন্তও বলে উঠল।
“নেক্সট টার্গেট কে?” রথীন প্রশ্ন করল।
“সম্ভবত কোন পুলিশ অফিসার। নেটওয়ার্কটা নর্থবেঙ্গল থেকে অপারেট হয়। জগদীশ শেঠের কাঠের গুদাম আছে সেখানে। সেটাই এই স্মাগলিংয়ের এপিসেন্টার,” শতাব্দী জানাল।
“অফিসারের নাম জানতে পেরেছ?”
“খোচর মারফত খবর পেয়েছি একটা। তবে কনফার্ম নয়,” কানুবাবু বলে উঠলেন।
“যা পেয়েছেন সেটা নিয়েই এগোতে হবে। চলুন তার বাড়ি। এঁকে ধরেই রাঘব বোয়ালটাকে পাকড়াতে হবে। চলুন।” রথীন তাড়া দিয়ে গাড়িতে উঠতে লাগল।
গাড়িতে উঠতে উঠতে কানুবাবু বললেন। “ফোনটা এখনও এল না। বড্ড মিস করছি সেটা,” রথীন কানুবাবুর কথায় একবার হালকা হেসে গাড়ি স্টার্ট করে দিল। গন্তব্য মহিষাদল, হাওড়া।
৬
নন্দকুমারের ফাঁসি
বাড়ির গেটে লাগানো নেমপ্লেটটা দেখে আস্বস্ত হল তারা। বাড়িটাকে তিনদিক দিয়ে ঘিরে ফেলেছে সবাই মিলে । সামনের দরজায় পর পর কয়েকবার নক করল রথীন, “নন্দকুমারবাবু দরজা খুলুন। বাড়ি আমরা ঘিরে নিয়েছি।”
কোনও প্রত্যুত্তর আসল না। আবারও জোরে ধাক্কা দিল দরজায় । কিন্তু এবার এক। বাড়ির পেছন দিক থেকে কানুবাবু বের হয়ে এলেন। জানালেন, “ভাই রথীন,উঁচু পাঁচিল দেওয়া তো পেছনে। এই বয়সে হাত পা ভাঙতে পারব না ভাই। তুমি একবারটি চল।”
রথীন সেইদিকে পা বাড়াতেই যাবে এমন সময় একটা চিৎকার শোনা গেল। আওয়াজ লক্ষ্য করে বোঝা গেল সেটা বাড়ির পেছন দিক দিয়েই আসছে। এদিকে আওয়াজ শুনে শতাব্দী ও অনন্তও এসে গেছে। বেশ হন্তদন্ত হয়ে অনন্ত বলল, “আওয়াজ ডেফিনিটলি বাড়ির পেছন দিক থেকে আসছে। আমি পাঁচিল টপকে দেখছি।”
দুরন্ত লাফ দিয়ে পাঁচিল টপকালো অনন্ত। খানিকবাদে সে বাড়ির সামনের দরজাটা খুলে দিল। ঘরের ভেতরে আসতেই অনন্ত বলল, “আমরা আবারও লেট স্যার। আসুন আমার সাথে।”
অনন্ত তাদের নিয়ে বাড়ির পেছনে দিকে গেল। সেখানে একটা কুয়োর ওপর ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছেন নন্দকুমারবাবু। জিভটা ঠিকড়ে বেরিয়ে এসেছে মুখ থেকে। রথীন রাগের মাথায় মাটি থাকা একটা টবের ওপর লাথি কষাল। তারপর বলল, “ওহ সিট, এবারও হাতছাড়া হয়ে গেল। এত কাছে এসেও ধরতে পারলাম না আমরা। ওয়ার্থলেস, ওয়ার্থলেস আমরা!”
“ইনিই শেষ এভিডেন্স ছিলেন। খুনির পুরো সারকেলটা কমপ্লিট হল,” বলে উঠল শতাব্দী।
“শেষ হয়নি শতাব্দী। এখনও লাস্টম্যান মানে যে খুনি সে এখনও বাকি। এই পুরো সারকেলটার আসল মাথা সে। আমরা যদি আর একটু ট্রেস করতে পারি তাহলে…” অনন্তকে বাধা দিল রথীন। তারপর বলল, “তোমার কী মনে হয় আমি জানি না কে খুনি? স্যারও চেনেন তাকে। এই পুরো সারকেলটা আর্মস এনেছে মায়ানমার থেকে। কিন্তু ল্যাক অফ এভিডেন্স! তোমার সামনে খুনিকে দাঁড় করিয়ে দিলেও তুমি প্রমাণ করতে পারবে না যে সে খুনী।”
“আমরা না পারলেও একজন পারবে,” গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন কানুবাবু।
“কে পারবে?” রথীন সন্দেহের চোখে তাকাল কানুবাবুর দিকে।
“মনামি। সে জানে খুনি কে।”
“এর মানে কি কানুদা! মনামি কী করে জানবে। তোমাকে সেদিনকে আমি সব জানালাম। তুমি নিজে ডাক্তার সাজেস্ট করলে। ওর কি এইসবের কিছু কথা?” রথীন স্বর চড়িয়ে বলে উঠল।
কানুবাবু রথীনের পিঠে হাত দিয়ে শান্ত হতে বললেন। তারপর বললেন, “আমি জানি সব। একটা কথা বলি, তুমি সেদিন কাজে ছিলে আমি বাড়ি ফেরার পথে তোমার বাড়ি গেছিলাম। মনামিকে দেখতেই যাওয়া মূলত। সেখানে যাওয়ার পর মনামি প্রথমে আমার সাথে ভালো করেই কথা বলতে থাকে কিন্তু খানিকবাদেই অদ্ভুত সব আচরণ করতে লাগল। আমাকে ডেক্সের ওপর থেকে ওর আঁকা কিছু ছবি দেখাল। তুমি হয়ত কাজের চাপে কোনোদিন লক্ষ্যই করোনি। ছবিগুলোর প্রত্যেকটা এই খুনগুলোর সাথে রিলেটেড। সিরাজ বলে লোকটাকে গাড়ির পেছনে বেঁধে রাখা, জগদীশ শেঠের ছাদ থেকে পড়ে যাওয়া কিংবা কমলেশবাবুর গলায় ছুরি মারা সব রয়েছে সেখানে আঁকা।”
“সেদিন ডাক্তারের চেম্বারেও মনামি রাজার মৃত্যু হবে বলেছিল। কিন্তু ও কীভাবে?” চিন্তার ভাঁজ স্পষ্ট রথীনের কপালে।
“রাজা নন্দকুমারের ফাঁসি, রথীন। মনামি আমাকে কথায় কথায় জানাল, সে নাকি ওয়ারেন হেস্টিংসের কোনও ডায়েরি খুঁজে পেয়েছে। সেখানে নাকি বিশেষ বিশেষ কিছু ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। আমি অবশ্য সেই ডায়েরি চোখে দেখিনি। তবে সিকোয়েন্স মেলাতে পেরেছি।”
“আমাদেরকে বলুন স্যার?” অনন্ত জিজ্ঞেস করল।
একগাল ভরা হাসি মুখে কানুবাবু বললেন, “তবে শোন ভাই অনন্ত, প্রথম খুনটা জগদীশ শেঠের। ইতিহাসের সূত্র ধরলে সেটা দাঁড়ায় জগৎশেঠের মৃত্যু। নবাব মিরকাশিম তাকে কেল্লার মাথা থেকে ফেলে মারেন। এবার দ্বিতীয় জন, নাম কমলেশ।গতি অনুসারে দাঁড়ায় লর্ড ক্লাইভের আত্মহত্যা। তিনি ক্ষুর চালিয়ে আত্মহত্যা করেন। এবার তিন নম্বর খুন। নবাবের ওরফে সিরাজের মৃত্যু। পলাশীতে হেরে যাওয়ার পর মিরনের নির্দেশে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে খুন করে ঘোড়ার সাথে বেঁধে সারা মুর্শিদাবাদে ঘোরানো হয়। এক্ষেত্রেও তাই। শুধু ঘোড়ার বদলে লরি।আর সিকোয়েন্সের চার নম্বরটা তো শুনলেই।”
অনন্ত কানুবাবুর হাত চেপে ধরল। বলল, “স্যার আপনি তো মানে পুরোটা একাই সলভ করে দিলেন।”
“না, না, তোমরাই তো। সেই কবে পড়েছিলাম, তুমি তো সেদিন পড়ে আইপিএস হলে। এর মধ্যেই ভুলে গেছ,” সুযোগ পেয়েই উপদেশ দেওয়ার অভ্যাসটা আর একবার ঝালিয়ে নিলেন কানুবাবু।
“আর তাহলে কেউ নেই এই সিকোয়েন্সে? খুনি ছাড়া,” জিজ্ঞেস করল শতাব্দী।
“আপাতত জানি না। তবে মনামিকে চাই আমাদের। ভাই রথীন একবারটি ওকে অফিসে নিয়ে এসো,” জানালেন কানুবাবু।
“আমার কিন্তু অন্য চিন্তা হচ্ছে কানুদা। মনামি এই ঘটনাগুলো জানছে কী করে? আর একদম ওর দেখানো সিকোয়েন্সে পর পর খুন হচ্ছে। ব্যাপারটা কেমন লাগছে,” রথীন জানাল।
“সব জানার জন্যই ওকে একবার দরকার,” মাথা নাড়লেন কানুবাবু । শতাব্দীকে বডিটাকে পোস্টমর্টেমে পাঠাতে বলে মনামিকে ফোন করল।
চোখে জলের ঝাপটা যেতেই জ্ঞান ফিরল অলকেশবাবুর। মাথাটা বেশ ভার হয়ে আছে তার। একটু হুঁশ আসতেই মনে পড়ল, সুভাষ সরোবর পাশে এসেছিলেন ফোন পেয়ে। অবশ্য কাউকেই দেখতে পেলেন না সেখানে। এমনসময় পেছন থেকে একজন মুখ চেপে ধরল। বারকয়েক ছটফট করার পর আর কিছু মনে নেই তার। ঘরের ভেতরটা একবার মেপে নিলেন তিনি। বেশ কটা কম্পিউটার, কিছু সাউন্ডের জিনিসপত্র ছাড়া বিশেষ কিছুই নেই।
খানিকবাদে ঘরে ঢুকলেন একজন। প্রথমে পুরুষ মনে হলেও বোঝা গেল আসলে তিনি মহিলা। মুখটা স্কার্ফে মোড়ানো। মহিলাটি এসে একটা জলের বোতল বাড়িয়ে দিলেন অলকেশবাবুর দিকে। তারপর বললেন, “সরি, আপনাকে এইভাবে আনানোর জন্য। কোনও উপায় ছিল না। কোনও প্রবলেম হচ্ছে না তো?”
জলটা পেয়ে আগে আধ বোতল জল শেষ করলেন অলকেশবাবু। তারপর বললেন, “সবই তো বুঝলাম, কিন্তু এইভাবে আমায় ধরে আনার কারণটা যে পরিস্কার হল না।”
“আমার পরিচয়টা দিলে আপনার কাছে খানিকটা পরিষ্কার হবে বিষয়টা। আমি সেই ফোন কলের পেছনে থাকা মানুষটা। যে প্রত্যেকে বার আপনাদের ওয়ার্নিং দিয়েছে।”
“আই সি, আপনি সেই। আচ্ছা ব্যাপারটা একটু বলুন তো। আপনি কী করে জানছেন যে খুনগুলো হতে পারে? আপনি যে খুনি নন সে আমি জানি।”
“সেই ব্রেন! ঠিকই, আমি খুনি নই। তবে আমি তারই কর্মচারী।”
“মানে?”
এবার মুখ থেকে আবরণটা সরিয়ে ফেললেন মহিলাটি। তারপর বললেন, “খাদ থেকে পড়ে যাবার পর কতদিন জ্ঞান ছিল না আমি জানি না। যখন থেকে একটু সুস্থ হয়েছি দেখলাম আমার পুরনো স্মৃতি সব মুছে গিয়েছে। সেই সুযোগটাকে কাছে লাগায় সেই জানোয়ারটা। আমাকে দিয়ে তার সমস্ত অসামাজিক কার্যকলাপ কন্ট্রোল করাতে থাকে।”
অলকেশবাবু একদম চুপ করে গিয়েছেন। নিজে যা দেখছেন তা স্বপ্ন না সত্যি সেটা নিয়ে ধন্দে পড়ে গেছিলেন। খানিকবাদে বললেন। “অরুনিমা তুমি! তুমি বেঁচে আছ। এত…এত বছর পর তুমি!”
“বেঁচে আছি অলকেশ। তবে মরে বেঁচে আছি। সেদিন গুলিটা ওই জানোয়ারটাই চালিয়েছিল।”
“তুমি আমার সাথে যোগাযোগ করলে না কেন? মিঠি তোমার জন্য এখনও কেমন করে তুমি জানো?”
“উপায় ছিল না গো। এমনভাবে জড়িয়ে গেছিলাম আমি! তাই তো প্রতিশোধ নিতে চাই এবার। আর্মস ডিলিং-এর সাথে যারা যুক্ত সবাইকে সে খুন করেছে। তবে আর একজন বাকি আছে।”
“কে? বলো শিগগির।”
“রথীনের স্ত্রী মনামি। তাকেও আবার মত ম্যানুপুলেট করেছে ও। এখন মনামিই একজন যে সব জানে। সুতরাং ওকেও আর বাঁচিয়ে রাখবে না সে।”
“আমাদের এখনই যেতে হবে। রথীনকে সবটা জানাতে হবে। তুমি চলো আমার সাথে। তুমিও টার্গেট হতে পারো।”
“চলো,” অরুনিমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন অলকেশবাবু। গাড়ি উঠেই ফোন করলেন রথীনকে। তবে একবারও ফোনটা রিসিভ করল না রথীন। কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে বুঝে গাড়ির গতি বাড়ালেন তিনি।
৭
ডুয়েল টাইম
রথীনের বাড়িতে ঢোকার মুখে কানুবাবুদের সাথে দেখা হয়ে গেল অলকেশবাবুর। গাড়িটা সাইডে করে নেমে এলেন তিনি, সঙ্গে অরুনিমাও। কানুবাবু অরুনিমাকে দেখে প্রায় আকাশ থেকে পড়লেন, “বৌদি আপনি? আপনি এখনও …”
অলকেশবাবু হাত দেখিয়ে বললেন, “এ নিয়ে পরে কথা হবে কানু। আগে বলো রথীন কোথায়?”
“স্যার তো বেরিয়ে গেছেন। মনামি ম্যাডাম কিডন্যাপ হয়েছেন। সেই কথা শুনেই রথীন স্যার কোথায় যেন গেলেন,” শতাব্দী বলে উঠল।
“ও সিট, রথীন না কোনও ব্লান্ডার করে বসে। মনামি একমাত্র এভিডেন্স আমাদের হাতে। কোথায় গেছে কিছু বলেছে?” অলকেশবাবু বিরক্ত হলেন
“নো স্যার। আমি কি ট্রেস করব স্যারের নম্বর?” অনন্ত বলল।
“এখুনি করো। আমাদের ও যেতে হবে। চলো তোমরা।”
কানুবাবুকে খানিক দুরে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অলকেশবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি ওইভাবে দাঁড়িয়ে কেন? যেতে হবে তো।”
“আপনি ঠিকই বলেছেন স্যার। বড়সড় একটা কান্ড ঘটতে চলেছে,” কানুবাবু ধীরে বললেন।
“কী কান্ড ঘটবে কানু?” জিজ্ঞেস করল অরুনিমা।
কানুবাবু পকেট থেকে একটা কাগজ বার দিলেন অলকেশবাবুর হাতে। তারপর বললেন, “ছবিটা মনামি এঁকেছে। আমি ওর ঘর থেকে পেলাম।”
প্রত্যেকেই ছবিটা একবার করে দেখল। একসময় অরুনিমা বলে উঠল, “এটার মানে কি কানু? কিছু বুঝতে পেরেছ নাকি?”
কানুবাবু ঠোঁট কামড়ে বলে উঠলেন, “ডুয়েল। দুজনের মধ্যে ডুয়েল হবে।”
অলকেশবাবুরা আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করেনি। অনন্ত-র ট্র্যাক করা রাস্তা ধরেই গাড়ি চালিয়েছে শতাব্দী। আলিপুরে কাছে এসে ন্যাশনাল লাইব্রেরির দিকে এগিয়ে চলল গাড়িটা। বেশ কিছু দুর যাওয়ার পর অনন্ত শতাব্দীকে সামনের একটা গাড়িকে দেখিয়ে বলল, “এই গাড়িটা থেকেই সিগনালটা আসছে। স্যার এই গাড়িতেই আছেন হয়তো। ক্রস করো, কুইক”
শতাব্দী গাড়ির গতি বাড়িয়ে গাড়িটার প্রায় কাছাকাছি এসে গেল। একটা সময় সুযোগ বুঝে ক্রস করে ব্লক করল গাড়িটাকে। তারা গাড়ি থেকে নামতেই সেই গাড়ি থেকেও কয়েকজন বেরিয়ে এল। কিন্তু রথীন নেই তাদের মধ্যে। অলকেশবাবু চিৎকার করে বললেন, “রথীন কোথায়?”
গাড়ির ভেতর থেকে উত্তর এল, “অত তাড়া কিসের অলকেশ। রথীন আছে হয়তো কোথাও,” অলকেশবাবু দেখলেন একজন সুটবুট পড়া ভদ্রলোক মেনে আসছেন গাড়ি থেকে। আরও অবাক করে হলেন যখন দেখলেন সঙ্গে মনামিও আছে। তবে তার হুঁশ জ্ঞান স্বাভাবিক লাগছে না।
“তাহলে দেখা হয়েই গেল, মিস্টার শতরূপ সিনহা। অবশ্য দেখা হতই, অনেক হিসেব যে বাকি এখনও” চোয়াল শক্ত হয়ে এল অলকেশবাবুর।
“তোমার দেখি বড্ড তাড়া অলকেশ। একটু সবুর করে যাও। সবে তো শুরু, “শতরূপবাবু বললেন।
“মনামিকে ছেড়ে দাও শতরূপ। তোমার সব নেটওয়ার্কের খবর কিন্তু পুলিশ জানতে পেরে গিয়েছে। বাঁচার রাস্তা সব শেষ।”
“তাই নাকি, সব জেনে গিয়েছে। সব প্রমাণ আমি মুছে দেব। যেমন বারো বছর আগে মুছে দিয়েছিলাম। তোমার চ্যালাদের সেই গল্প শুনিয়েছিলে তো?”
“সেই দিন আর আজকের মধ্যে অনেক ফারাক শতরূপ। আজ অরুনিমাকে খুঁজে পেয়েছি আমি। আর মনামিকেও আমি রথীনের কাছে ফিরিয়ে দেব।”
পকেট থেকে রিভলভার বার করে মনামির মথায় ধরলেন শতরূপবাবু। তারপর বললেন, “এই বিশ্বাসঘাতককে তো পরে দেখছি আমি। স্মৃতি ফিরে পেয়েছে সেটা বুঝতেই দেয়নি আমায়। পুলিশকে ফোন করে জানানো, বার করে দেব।”
“শাট আপ শতরূপ। তুমি আমায় কোন দান দাওনি। বরঞ্চ আমার কম্পিউটার স্কিল ব্যবহার করে দিনের পর দিন আমাকে দিয়ে অন্যায় কাজ করিয়েছ,” প্রতিবাদ করে উঠল অরুনিমা।
“তোকে আমি মেরেছি আমিই বাঁচিয়ে। তবে এবার আর বাঁচানোর ভুলটা করব না। সবকটাকে এখানেই শেষ করব আজ।”
“সেই ভুলটা করতে যাবেন না শতরূপবাবু। তাহলে আমাদেরও গুলি চালাতে হবে,” অনন্ত বলে উঠল।
“চুপ কর। দুদিনের ছোঁড়া আমাকে জ্ঞান দিচ্ছে। তোদের বাপ, এই অলকেশকে জিজ্ঞেস কর আমি কে?” অনন্তর দিকে তাকিয়ে বললেন শতরূপবাবু।
“এতদিন এভিডেন্সের অভাবে স্যার আপনার বিরুদ্ধে কোনও স্টেপ নিতে পারেনি। কিন্তু এবার আর নিস্তার নেই আপনার,” কঠিন গলায় বলল শতাব্দী।
শতাব্দীর কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠলেন শতরূপবাবু। বললেন, “খুব ভয় পেয়ে গেছি আমি।”
“মনামিকে তুমি চিনলে কী করে? আর ওর কাছে থেকে কী চাও তুমি?” প্রশ্ন করলেন অলকেশবাবু।
“এটাও বুঝতে পারনি। বলি শোনো, মনামি আমার অফিসে কাজ করত। একদিন দেখি অফিস টাইমে বসে কী সব আঁকছে। আমি জিজ্ঞেস করতেই বলল, হেস্টিংস সাহেবের কোনও ডায়েরি পেয়েছে সে। সেখানে নাকি অনেক ইমপর্টেন্ট মার্ডারের ঘটনা লেখা। আমি প্রথমে গুরুত্ব দিইনি, কাজে ফাঁকি আমার আবার সহ্য হয় না। কিন্তু একদিন সন্ধের দিকে জগদীশ শেঠ আছে আমার অফিসে। শালা, আমাকে ব্ল্যাকমেল করতে শুরু করেছিল। ও চলে যাওয়ার পর আমি মনামির ডেক্সে গিয়ে দেখি ও ছবি আঁকছে আবার। ছবিটা মার্ডারের। আমি জিজ্ঞেস করলে আমাকে পুরো মার্ডারের একটা ব্লু প্রিন্ট বলে দেয় আমাকে। সেদিন থেকে বুঝে গিয়েছিলাম মনামি কাজের মেয়ে আছে।”
“তার মানে ও তোমাকে মার্ডারের প্ল্যান করে দিত আর তুমি সেই মত কাজ করতে?”
“রাইট অলকেশ। তবে মনামি একটু সাইকো হয়ে গেছে। ওকে নাকি হেস্টিংস এসে বলে যায় এই প্ল্যানের কথা। আমার অবশ্য ওসব বুঝে কাজ ছিল না। আমি শুধু ওর থেকে মার্ডার প্ল্যানটা জেনে নিতাম কায়দা করে।”
“ইউ রাসকেল। তুমি একটা মেয়ের এই রকম অবস্থার সুযোগ নিতে,” অলকেশবাবু খানিকটা এগিয়ে এলেন উত্তেজনাবশত। সঙ্গে সঙ্গে গুলি চালালেন শতরূপবাবু। তবে সেটা মাটিতে এসে লাগল। তারপর বললেন, “একদম বাড়াবাড়ি করবে না অলকেশ। কেন মরতে চাইছ। রাস্তাটা ছেড়ে দাও। মনামিকে আর ছেড়ে রাখা যাবে না। কখনো যদি মতি ফিরে আসে ওর, আমি ভাই রিস্ক নিতে পারব না। তাই মনামিকে যে মরতেই হবে,” পেছনে ফিরে তার লোকজনের উদ্দেশ্যে বললেন, “দাঁড়িয়ে দেখছিস কী? রাস্তা খালি কর!”
লোকগুলো সামনের দিকে এগোতেই একটা গাড়ি হঠাৎ করে কোথা দিয়ে এসে তাদের আটকে দিল। সবাইকে চমকে দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে এল রথীন। হাতের রিভলভারটা শতরূপের দিকে তাক করে বলল, “মনামিকে ছেড়ে দিন।”
হোক্ হোক্ করে হেসে উঠলেন শতরূপবাবু। বললেন, “এ কী ছেলের হাতের মোয়া নাকি! যে আসছে, সেই চাইছে। ওয়েট, তার আগে বল তুমি এখানে এলে কী করে?”
“যে ভাবে স্যার এসেছেন। আমাকে আপনার লোকই খবর দিয়েছিল শতরূপবাবু। সেই মত ট্রেসও করেছিলাম আপনাকে। কিন্তু মাঝে জ্যামে আটকানোর সময় আপনার গাড়িতে আমার ফোনটা ফেলে দিয়েছিলাম। কিন্তু তখন যদি একবার আন্দাজ করতাম আপনি মনামিকে এইভাবে তুলে আনবেন, তাহলে…”
“তাহলে কী? গুলি করতে? এখনও বাচ্চা আছ তোমরা। তবে শুনে রাখো মনামিকে ছাড়া আর সম্ভব নয়।”
“মনামীকে না ছাড়লে আমি সত্যিই গুলি করব শতরূপবাবু,” রিভলবারের সেফটি লকটা খুলে ফেলল রথীন।
এমন সময় পাশ থেকে অলকেশবাবু চিৎকার করে বলে উঠলেন, “না রথীন। আইন ওকে শাস্তি দেবে। তুমি গুলি চালাবে না।”
“আজ কোনও কিছুই আমাকে আটকাতে পারবে না স্যার। মনামির জন্য আমি সব করতে পারি,” রথীন বলে উঠল।
“ওয়ান্ডারফুল, রথীন। বুঝলে অলকেশ অনেকদিন পর তোমার মত একজনকে পেলাম,” অলকেশবাবু দিকে তাকিয়ে বলল শতরূপবাবু। তারপর রথীনের উদ্দেশ্যে বলে বসল, “তো ঠিক আছে রথীন, আজ গুলির খেলা হবে। জায়গাটা দেখ ভালো করে। আমরা এখন ডুয়েল রোডের ওপর দাঁড়িয়ে। আজ এখানে আবার ডুয়েল হবে। তোমার আর আমার মধ্যে। যদি তুমি জিতে যাও তাহলে মনামিকে নিয়ে যাবে তুমি। আর যদি হারো তবে মনামিকে ভুলে যেতে হবে। বলো রাজি?”
একটা বড়ো দীর্ঘশ্বাস ফেলল রথীন। মনামির দিকে চাইতে দেখল, সে এইসব থেকে অনেক দূরের কোনও এক জগতে ঘুরে বেড়াচ্ছে এখন। কোনও কিছুই খেয়ালে নেই তার। হাতের মুঠো শক্ত করে শতরূপবাবুর দিকে তাকাল রথীন তারপর বলল। “আমি রাজি।” তারপর পেছনে ফিরে বলল, “আপনারা সরে যান স্যার। ইটস ডুয়েল টাইম।”
৮
ডায়েরির শেষ পাতায়
ডুয়েল রোডের ওপর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রথীন এবং শতরূপবাবু। দুজনেই রিভলবার হাতে একে অপরের দিকে তাক করে আছে। অলকেশবাবুরা এমন অপ্রত্যাশিত অবস্থার নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকতে গিয়ে অস্বস্তিতে ভুগছেন। শতরূপবাবু এবার রথীনকে সাবধান করল, “কেন শুধু শুধু নিজের জীবন নিয়ে খেলছ রথীন। মনামিকে যেতে দাও আমার সাথে।”
রথীন রিভলভারটাকে আরও শব্দ করে ধরে বলল, “আপনি নিজের কথা ভাবুন। আজ নয় আপনি না হয় আমি, দুজনের মধ্যে একজন বাঁচবে। আর আমি স্যারের সামনেই কথা দিচ্ছি আমি বাঁচি না বাঁচি আপনি মরবেনই।”
কথাটা বেশ গায়ে লাগল শতরূপবাবুর। সে এবার তৈরি হল, “বেশ দেখাই যাক। ডুয়েল শুরু।”
কথাটা বলার পর এক..দুই…তিন গুনলেন তিনি। আর তারপরেই সেই ঘটনা ঘটল। উভয়েই গুলি চালাল। রথীন মাটিতে ছিটকে পড়েছে। অলকেশবাবু দেখলেন তার বাঁ কাঁধ দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে এসে মাটি ভিজিয়ে দিল। অন্যদিকে শতাব্দী চিৎকার করে উঠেছে, “ডেড! স্যার শতরূপবাবু ডেড।”
রথীনের চালানো গুলিটা শতরূপবাবুর কপালে এসে লেগেছে। রক্ত ছড়িয়ে পড়েছে তার গাড়ির ফ্রন্ট গ্লাসে। কানুবাবু সহ সবাই তড়িঘড়ি রথীনের দিকে দৌড়ে এল। আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে গাড়িতে তোলা হল রথীনকে। যত শীঘ্র সম্ভব তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। এখনও বাঁচানো যেতে পারে রথীনকে।
দিন সাতেক লেগে গেল রথীনের স্বাভাবিক জ্ঞানে আসতে। বেশ অনেকটাই রক্তক্ষরণ হয়েছিল তার। ডাক্তারের অনুমতি নিয়ে তাকে বাড়িতে আনা হয়েছে। আপাতত মাসখানেক মত সে বাড়িতে থেকেই চিকিৎসা করাতে পারবে। মনামির অবস্থাও খুব ভালো নয়। তাকে কাউন্সিলিং-এর জন্য পাঠানো হয়েছে দিল্লীতে। সেখানে তার দিদির বাড়িতে রয়েছে মনামি।
রথীনের বিছানা ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে সবাই। অরুনিমা সকলের জন্য কফি করে এনেছে। কফি খেতে খেতেই কানুবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা বৌদি আপনি কী করে অমন একটা মানুষের সঙ্গে কাজ করতেন?”
একটু হেসে উঠল অরুনিমা। তারপর বলল, “স্মৃতি বিভ্রম, বোঝো কানু? আমার তাই হয়েছিল। খাদ থেকে পড়বার পর আগের কথা কিছুই মনে ছিল না।”
“আচ্ছা স্যার আপনি ও রথীন স্যার কি আগে থেকেই জানতেন যে উনিই খুনগুলো করেছেন?” প্রশ্ন করল শতাব্দী।
“আন্দাজ করেছিলাম। একটা সিসিটিভি ফুটেজ হাতে আছে আমাদের। সেখানেই শতরূপকে দেখা যায়। ওর ব্যাকগ্রাউন্ড হিস্ট্রি সাথে ট্যালি করেই আমরা বুঝেছিলাম,” উত্তর দেন অলকেশবাবু।
“তাহলে ওঁকে আগেই অ্যারেস্ট করা হল না কেন?” এবার অনন্ত জিজ্ঞেস করল।
“প্রমাণ! ওই একটা ফুটেজের জন্য এতবড় রিয়েল এস্টেটের মালিককে ধরা যায় না অনন্ত। তারপর যদি সেই মানুষের ওপর মহলে হাত থাকে।”
“শুনলাম আপনার সাথের ওঁর আগে থেকেই…” শতাব্দীকে থামিয়ে দিলেন অরুনিমা। বললেন, “ওসব পুরোনো কথা এখন থাক। পরে কোনও সময় তোমাদের স্যারের থেকে জেনে নিও।”
“কিন্তু বৌদি একটা প্রশ্ন তো থেকেই যাচ্ছে। তোমরা কী করে জানলে যে শতরূপ মনামিকে কিডন্যাপ করেছে?” কানুবাবু উসখুস করতে লাগলেন।
“মনামীর হাতে শতরূপের কাজকর্মের খানিকটা আমি আন্দাজ করেছিলাম। সেই থেকে বোঝা,” অরুনিমা বলল।
সাথে সাথে রথীনও মুখ খুলল, “বাকিটা আমাকেই বলতে হবে কানুদা। দাঁড়াও,” বিছানায় ভর দিয়ে উঠে বসল রথীন। তারপর বলে, “মনামির খোঁজ পাই অজিতের থেকে। ও আমার ড্রাইভার ছিল।”
“একটু খুলে বলবেন স্যার?” অনন্ত বলল
“অজিত এককালে শতরূপবাবুর অফিসে কাজ করত। শতরূপের ওপর সন্দেহ বাড়ায় আমি ওকে শতরূপকে ফলো করতে বলি। সেই আমাকে জানায় যে মনামিকে তুলে নিয়ে গেছে শতরূপ,” রথীন বলল।
“এই হেস্টিংসের ডায়েরির রহস্যটা কিন্তু বোঝা গেল না এখনও,” অরুনিমা বলে উঠল।
“কোনও ডায়েরি নেই ম্যাডাম। তবে অজিত জানিয়েছে মনামির সাথে প্যারানরমাল জিনিস খুঁজতে ওরা রাইটার্সে গেছিল। সেখানে নাকি ওরা সত্যিই এমন একটা ডায়েরি খুঁজে পায়। কিন্তু ওখানে অজিতের একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়। তারপর থেকেই মনামির এই অবস্থা,” রথীন জানাল।
“ডাক্তার কী জানাল?” অলকেশবাবু জিজ্ঞেস করলেন।
“এটা পুরোপুরি হ্যালুসিনেশানের কেস। হেস্টিংস নিয়ে পড়াশোনা করতে করতে কোনওভাবে তার জীবনের ঘটনাগুলোকে অনুভব করতে শুরু করে মনামি। সেখান থেকে এমন সব জিনিস হ্যালুসিনেট করতে থাকে যার বাস্তবে কোনও অস্তিত্বই নেই।”
“তুমি চিন্তা কোরো না রথীন। একটু সময় যেতে দাও, দেখ সব ঠিক হবে,” অরুনিমা সান্ত্বনা দিল রথীনকে।
রথীন মাথা নাড়ল। কানুবাবু মাঝখানে বলে উঠল, “ডায়েরিটা কি ভূতের মত উবে গেল। এ তো ভয়ঙ্কর কেস।”
“এই কেসটা এবার তুমি পার্সোনালি সলভ করো কানু,” অলকেশবাবু হেসে বললেন।
কানুবাবু একগাল হেসে বললেন “যাই বলুন স্যার, মার্ডারের প্ল্যানগুলো কিন্তু খাসা ছিল। আমি ভাবছি এটা নিয়ে একখান উপন্যাস লিখব। নামও ভেবে ফেলেছি, নাম রাখব, ‘লালসাহেব লা-জবাব’। কেমন হবে নামটা?”
অলকেশবাবু মুখটা ব্যাজার করলেও পরে হেসে দিলেন। অরুনিমা হাসতে হাসতে আর এককাপ করে চায়ের বন্দোবস্ত করতে গেল।
Shrayan Bhattacharjee, khardah,kol-118,west bengal
Email id- shrayan500@gmail.com
Mob-9804946780
লেখক পরিচিতি- কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে জুলজি বিভাগের এমসি চতুর্থ সেমিস্টারের ছাত্র।লেখালেখির বিষয়ে ছোট থেকে চর্চার শুরু।অনলাইন এবং অফলাইন লেখালেখি করা হয়। বিভিন্ন সোশাল মিডিয়া পেজের নিয়মিত লেখক। এছাড়া একজন উন্মুক্ত পাঠক। পুরোনো কলকাতার ওপর গবেষণামূলক কাজ এবং পড়াশোনা চলে । ঐতিহাসিক পটভূমি বিশেষ ভাবে পছন্দের বিষয়।