প্রীতম মুখোপাধ্যাযতীর্থ মুখস্থের মত বলে যাচ্ছিল, “বাসন্তী পোলাও, পনীর বাটার মশলা, ডিমের ডালনা, চিকেন কষা……”
একমুখ জল চলে এসেছিল জিভে। সেটাকে টেনে নিয়ে আমি বললাম, “বলতে থাক, বলতে থাক। থামলি কেন? বলে যা……।”
হঠাৎ করে বেরসিকের মত বাধা দিয়ে বসল সাগ্নিক। “বলে কি লাভ? তোরা তো আজ এক সপ্তাহ ধরে খালি লিস্ট করেই যাচ্ছিস, আর প্ল্যান করেই যাচ্ছিস। কাজের কাজ কিছুই করিসনি। আর কতদিন চালাবি প্ল্যানিং করে?”
পারিজাতই বাকি ছিল। সুর ধরল,” দেখি কবে এদের ফিরিস্তি শেষ হয়, তারপর কিছু ভাবব। কিরে তাই তো?”
পাশেই বসেছিল মৃণাল। “ফাইনাল হলে তারপর খবর দে আমায়, এখন গান শুনছি, ডিস্টার্ব করিস না। ক্যারি অন।”
আপনারা হয়তো ভাবছেন, কিসের এত তুমুল আলোচনা, কিসের এই উচ্চ পর্যায়ের পরিকল্পনা ইত্যাদি ইত্যাদি। তাহলে ব্যাপারটা শুরু থেকে বলি।
আমি, তীর্থ, সাগ্নিক, পারিজাত আর মৃণাল…… এই পঞ্চপাণ্ডব হলাম হরিহর আত্মা। সেই ছোটবেলার ধুলো খেলার সময় থেকে একসাথে বড় হয়ে ওঠা আমাদের। পাঁচজন যেন কোনও কিছুতেই আলাদা নেই, একসাথে স্কুল, কলেজ সবকিছু। কিন্তু বর্তমানে চাকরি সুত্রে আমাদের অফিস আলাদা আলাদা। কিন্তু কিংবদন্তী শিল্পী মান্না দে’র “কফি হাউস” এর সাতজন বন্ধু যেমন ছিল, ঠিক তেমনি আমরা পাঁচজন। সারাদিনে একবার আমরা একসাথে হই, আর হবে নাই বা কেন! আমরা একই পাড়ায় থাকি যে! এবারে শীতকালের ছুটিতে আমরা পাণ্ডব বাহিনী ঠিক করেছিলাম কোথা থেকেও বেড়িয়ে আসব। নিজেদের একটা ছোট্ট ট্রিপ। কিন্তু কিছুতেই যেন প্ল্যানিং হয়ে উঠছিল না। না, টাকা পয়সা নিয়ে কোনও চিন্তা ছিল না। আসল কথা হল, জায়গা আর দিন কিছুতেই ঠিক হচ্ছিল না। বাকিরা নিস্তেজ হয়ে পড়লেও আমি আর তীর্থ হাল ছাড়িনি। আর তাই আজ সন্ধেতে আমরা সাগ্নিকের বাড়িতে জড়ো হয়েছি, আজ একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়ব। আর দু’দিন পরেই ছুটি পড়বে, তাই যা করার আজকেই করব। সেই নিয়ে প্ল্যানিং চলছে। এমন সময় হঠাৎ করে সাগ্নিকের মাথাটা যেন কেমন পরিষ্কার হয়ে গেল। হঠাৎ করে বলে উঠল, “পেয়েছি, পেয়েছি। জায়গা পেয়ে গেছি।” আমরা সবাই সমস্বরে বলে উঠলাম, “কোথায় কোথায় কোথায়?” সাগ্নিক বলল, “আমার গ্রামের বাড়িতে আমাদের একটা বাগান বাড়ি আছে। বাবা সখ করে তৈরি করিয়েছিলেন এক সময়। এখন সেটা শুধু কেয়ার টেকার দেখাশোনা করে। বহুদিন ভেবেছি তোদের নিয়ে যাই, ঘুরিয়ে আনি। সময় আর সুযোগ কোনওটাই হয়ে ওঠেনি। এইবার মওকা পেয়েছি। যাবি?” কেমন একটা অজানা আনন্দ আর অ্যাডভেঞ্চারের হাতছানিতে আমরা সকলেই রাজি হয়ে গেলাম। সাথে আমাদের খাওয়া দাওয়া আর থাকার কথাও ঠিক করে নিলাম। যে কদিন থাকব, নিজেদের মত খাওয়া ঘোরা আনন্দ করে কাটানো যাবে। যাক আজ সন্ধেটা ফলপ্রসু হল। সকলেই যথেষ্ট উৎসাহ নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। শনিবার অফিসের হাফ ছুটি হওয়া মাত্র সবাই বাড়ি এসে গোছগাছ শুরু করে দিলাম। আর পরদিন সকালে বেরিয়ে পড়ব আমরা ছুটি কাটাতে, এই শহর কলকাতা থেকে দুরে, সাগ্নিকের বাগান বাড়িতে। আমরা যদিও ভেবেছিলাম আনন্দ করব, কিন্তু নিয়তির ইচ্ছে হয়তো সেটা ছিল না, আর তাই হয়তো বিধাতা আমাদের অভিপ্রায় বুঝে একটু মুচকি হেসেছিলেন। আর তারপর ঠিক কী কী ঘটেছিল সেটা এখনও ভাবলে আমাদের বুক কাঁপে, হাড় হিম হয়ে যায়। আজ সকলের সাথে সেই ঘটনাই ভাগ করে নেব।
রবিবার সকাল সকাল আমরা রেডি হয়ে গিয়েছিলাম। ঘড়িতে তখন ঠিক সকাল ছটা। শীতকালের সকাল, গরম পশমের পোশাক পরে ট্রলি ব্যাগ নিয়ে আমরা বাইরে এসে দেখি, সাগ্নিক গাড়ি নিয়ে পাড়ার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের আসতে দেখেই ডাকল, “তাড়াতাড়ি চলে আয়, উঠে পড়।” আমরা গাড়ির পেছনে ব্যাগ রেখে যে যার মত জায়গায় বসে দরজা বন্ধ করে কাঁচ তুলে দিলাম। আর সকলে আড্ডা দিতে দিতে চললাম আমাদের গন্তব্যের দিকে।
আমরা যখন নিশুতিপুর পৌঁছলাম, ঘড়িতে তখন দশটা বেজে গেছে। গাড়ি এসে থামতে সেখানকার কেয়ার টেকার ভদ্রলোক এসে হাজির হলেন। আমরা সবাই গাড়ি থেকে নেমে সেই বাগান বাড়ি দেখতে লাগলাম। সাগ্নিক গাড়ি থেকে নেমে আমাদের সাথে সেই ভদ্রলোকটির পরিচয় করিয়ে দিল। “আলাপ করিয়ে দিই তোদের সাথে, ইনি হচ্ছেন বনমালী কাকু, আমাদের গ্রামের দিকের সব জমিজমা, এই বাড়ি সব কিছু ইনিই দেখাশোনা করেন। আর বনমালী কাকু, এরা হল আমার সব থেকে কাছের মানুষ, আমার সবথেকে প্রিয় বন্ধু। সৌরভ, তীর্থ, পারিজাত আর মৃণাল।” আমরা তাকে নমস্কার জানালাম। তিনি আমাদের সকলকে খুব আদর যত্ন করে বাড়ির ভেতর নিয়ে গেলেন, আমাদের ব্যাগগুলো ঘরে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন, আমাদের ঘর অবধি এগিয়ে দিলেন। গ্রামের দিকে হলেও সাগ্নিকদের এই বাগান বাড়িটি বিলাসিতায় পরিপূর্ণ। মানতেই হবে, কাকাবাবু একখানা বাগান বাড়ি বানিয়েছেন। খাসা একেবারে। আমরা সকলে একটু হাত পা ধুয়ে, পোশাক বদলে, জলযোগ করে একটু ঠাণ্ডা হলাম। ইতিমধ্যেই আমাদের সবথেকে ভোজনরসিক বন্ধুটি, অর্থাৎ তীর্থ তার ব্যাগ থেকে গোটা দশেক চকলেট বের করে নিয়ে এসে আমাদের সাথে ভাগ করে খেতে শুরু করল। আমরা সকলে জমিয়ে আড্ডা জুড়ে দিলাম। একসময় আমার মনে হল, একবার ছাদের ওপর থেকে ঘুরে আসা যাক। সকলকে বললাম, “একবার ছাদ থেকে ঘুরে এলে কেমন হয়! ছাদের ওপর থেকে গোটা গ্রামের দৃশ্যটা দেখতে কেমন লাগে সেটা দেখতে হচ্ছে।” মৃণাল বলে উঠল, “সাধু প্রস্তাব। চল দেখে আসি।” আমরা সবাই সাগ্নিকের সাথে ছাদে চলে গেলাম। সত্যিই, কী অপরুপ দেখতে লাগছে গোটা গ্রামটা! সবে সবে কুয়াশা কাটছে, দুরের ধানক্ষেত, মাঠ, মেঠো রাস্তা, সবটা কেমন ছবির মত সাজানো, যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা। কিন্তু বাকিরা যখন এসব দেখতে ব্যস্ত, আমার চোখ তখন অন্য দিকে চলে গেছে। দুরে একটা বিশাল সাদা অট্টালিকার ওপর আমার চোখ আটকে গেল। আর তার পাশেই রয়েছে গভীর জঙ্গল। বাড়িটা দেখে যেন মনে হল একেবারে শেষ প্রান্তে। কেমন একটা অজানা কৌতূহল আমাকে নাড়া দিতে লাগল। আমি সেসময় বিশেষ কিছু কাউকে বললাম না ঠিকই, তবে মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিলাম, একবার হলেও আমি সেখানে যাব। সেদিনের সারা দিনটা বেশ আনন্দেই হাসি মজা করে কাটল। দুপুরের খাবার, বিকেলের গরম গরম কফির মজা, আর রাতের ভুরিভোজ…… সব মিলিয়ে একেবারে জমজমাট ছুটি কাটাচ্ছিলাম আমরা পাণ্ডব বাহিনী। রাতে সকলে নিজেদের ক্লান্ত শরীর গুলোকে বিছানায় এলিয়ে দিলাম।
পরদিন সকাল থেকেই আমরা আমাদের প্ল্যান মত কাজ শুরু করে দিলাম। সাগ্নিক বলেছিল, ও গ্রামটা আর তার চারপাশ আমাদের দেখাবে। আমরা খোলা হাওয়ায় ঘুরব, বেড়াব, ছবি তুলবৃ এক কথায় সব রেডি ছিল। সকালের জলখাবার খেয়ে আমরা বেরিয়ে পড়তে যাব, এমন সময় বাধ সাধল বৃষ্টি। বলা নেই, কওয়া নেই কোথা থেকে এই শীতের সময় কালো করে মেঘ এসে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। আমরা সকলেই কেমন যেন মুষড়ে পড়লাম, এত প্ল্যান করেও শেষে প্রথমেই বাধা পড়ল! সাগ্নিক বলল, “কিচ্ছু চিন্তা নেই, একটু বৃষ্টি কমলেই বেরিয়ে পড়ব।” পারিজাত বলল, “আর বৃষ্টিটাও এসময়েই আসতে হল! কোনও মানে হয়?” তীর্থ তো আগেই সোফাতে গা এলিয়ে দিয়েছে, “ধুর, পুরো প্ল্যানই বেকার।“ আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, “বন্ধুগণ, আমি বলছি সকলে একটু ধৈর্য ধরুন। বৃষ্টি থামলে আমরা বেরবোই। তবে এবার আর পায়ে হেঁটে বেরনো যাবে না, কারণ রাস্তার অবস্থা খুব একটা ভালো থাকবে না। আমরা গাড়িতেই যাব এবং সময় কম থাকলে কাছাকাছি ঘুরে চলে আসব। কিন্তু যাবই।” দুপুর দুটো নাগাদ আসতে আসতে বৃষ্টি কমে এল। আমরা খাবার দাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম গাড়িতে বসে। গাড়িতে যেতে যেতে সাগ্নিক বলল, “চল আজ তোদের একটা দারুন জায়গা দেখিয়ে আনি।” সবাই জিজ্ঞেস করতে ও বলল “এখানে একটা পুরনো রাজবাড়ি আছে। এক সময় এখানকার রাজারা সেখানে থাকতেন, সে অনেকদিন আগের কথা। বাড়িটা এখনও খালি হয়ে পড়ে আছে সেই কত বছর ধরে। চল ওখান থেকে ঘুরে আসি।” মৃণাল কেমন চুপসে গিয়ে বলল, “ভাই, ভুত বাংলা নয় তো! কোথায় না কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস, কি হবে না হবে কিচ্ছু জানি না, ওখানে আমাদের যাওয়াটা কি খুবই দরকার? অন্য কোথাও গেলে হত না কি?” তীর্থও সায় দিল ওর কথায়। এইবার আমার পালা। আমি আর পারিজাত সেখানে যাবই স্থির করলাম। অবশেষে সাগ্নিক নিজেই আশ্বস্ত করল, “আরে ভাবিস না অত। রাতে যাচ্ছিস না তো! আর কেউ একাও যাচ্ছিস না। সবাই একসাথেই থাকব। দেখবি দারুন মজা হবে আর সবাই একসাথে থাকলে তোদের ভয়ও লাগবে না। অত ভাবিস না, চল।” সবাই একপ্রকার রাজিই হল আর গাড়িও এগিয়ে চলল নিশুতিপুর রাজবাড়ির দিকে। একসময় গাড়ি এসে দাঁড়াল রাজবাড়ির ফটকের সামনে। আমরা আস্তে আস্তে গাড়ি থেকে নামলাম। গাড়ি লক করে আমরা সবাই একসাথেই এগিয়ে যেতে লাগলাম। কিন্তু গাড়ির থেকে নামার পরেই আমার কেমন যেন অন্যরকম মনে হতে লাগল। চারিদিকের পরিবেশটা কেমন যেন অতিরিক্ত চুপচাপ, থমথমে। একটা গাছের পাতাও নড়ছে না, পাখির ডাক নেই, কোথাও কিচ্ছু নেই। আর আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক নিঝুম নিস্তব্ধ পুরী। আমরা সকলে আস্তে আস্তে রাজবাড়ির সীমানার ভেতরে প্রবেশ করলাম। কিন্তু কেন জানি না আমার মনে হতে লাগল আমরা যেন কারও জায়গায় অনধিকার প্রবেশ করে ফেলেছি। আর তাতে সেই ঘরের মধ্যে অদৃশ্য ভাবে থাকা কোনও কিছু বা কেউ আমাদের ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছে। আর যে কোনও মুহূর্তে তার কোপ পড়তে পারে আমাদের ওপর। আমি জানি না বাকিরা কী অনুভব করছিল, কিন্তু আমি কোনওভাবেই পুরো বিষয়টাকে আমার মনের ভুল বলে মেনে নিতে পারছিলাম না। প্রথম নিস্তব্ধতা ভাঙল সাগ্নিকই। “কিরে! কেমন!” তীর্থ কাঁচুমাচু হয়ে বলল, “খুব একটা ভালো নয় রে। কেমন একটা লাগছে যেন।” আমি বললাম, “একটা গা ছমছমে পরিবেশ রয়েছে সেটা সন্দেহ নেই, তবে একটা রহস্য রহস্য ব্যাপারও আছে, কি বলিস!” “যা বলেছিস। জায়গাটা নিঝুম হলেও বেশ অ্যাডভেঞ্চারাস।” পারিজাতের কথা শেষ হতেই মৃণাল বলল, “তোদের সব অ্যাডভেঞ্চার কি বাইরে থেকেই? ভেতরে যাওয়ার কোনও ইচ্ছে নেই কি? তাহলে চল বাড়ি যাই।” আমরা হাঁ হাঁ করে উঠলাম, “আরে রাগ করিস না উফ, যাচ্ছি তো! চল চল।” আমরা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে এইসব কথা বলছিলাম, হঠাৎ করে একটা গম্ভীর গলায় আওয়াজ এল, “এই, কে তোমরা? কোথায় যাচ্ছ?” আমরা রীতিমত চমকে উঠে ফিরে তাকালাম। দেখি একটা কালো চাদর গায়ে দিয়ে এক বুড়ো লোক দাঁড়িয়ে আছে। তার শরীর জরাভারে বিদ্ধস্ত, লাঠি হাতে নিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। কেমন যেন অদ্ভুত তার চাহনি, যেন খুব বিরক্ত হয়েছে আমাদের আসাতে। চোখগুলো কেমন যেন অদ্ভুত ধরনের। দেখলে খুব স্বাভাবিক মনে হয় না। আবার সেই মূর্তিটি জলদগম্ভীর স্বরে বলল, “কি চাই এখানে?” আমাদের হয়ে সাগ্নিকই উত্তর দিল, “দাদু আমরা রাজবাড়ি দেখতে এসেছি। ভেতরে যেতে পারি?” লোকটা কেমন একটা বাঁকা দৃষ্টিতে আমাদের দিকে দেখে জিজ্ঞেস করল, “তোমরা চুরির মতলবে এসে থাকলে ফিরে যাও।” আমরা বললাম, “না না শুধু দেখেই চলে যাব।” এই বলে আমরা বাড়ির ভেতরের দিকে পা বাড়ালাম। “ও দাদু, বলছিলাম যে—–” এই বলে মৃণাল কিছু একটা বলতে পেছন ফিরল, কিন্তু কি আশ্চর্য! পেছনে তখন কেউ ছিল না। এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে ও আমাদের বলতেই আমরাও সবাই ঘুরে দেখি, সত্যিই কেউ কোথাও নেই। দূর দুরান্তে কাউকে দেখা গেল না। এক পলকের মধ্যে ওই রকম একজন বয়স্ক লোক কোথায় উধাও হয়ে গেলেন? এটা কি করে সম্ভব? লোকটা উবে গেল নাকি? সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে আমরা সবাই এক এক করে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। ঢুকে দেখি একটা খাপছাড়া বাড়ি। বাড়িটা বাইরে থেকে যতটা জংলা, ভেতর থেকে ততটা জংলা না হলেও, কিছুটা সাজানো আর কিছুটা অগোছালো। কিছু কিছু জায়গায় দেওয়াল ভগ্নপ্রায় ও তার পলস্তারা খসে পড়েছে। আসবাবপত্র আছে এখনও, তবে তার দশা না বলাই শ্রেয়। মাকড়সার জাল আর ঝুলে ঢাকা সারা বাড়ি। বাইরের আলো খুব কম প্রবেশ করছে বাড়ির ভেতরে। আমরা কোনও ক্রমে ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম বাড়িটা। নোনা ধরা দেওয়াল, সোঁদা সোঁদা গন্ধ আর চারিদিকের দৃশ্য—— সবটা মিলে কেমন যেন একটা দম বন্ধ করা অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। আমরা সবটা ঘুরে ঘুরে দেখছি, আর নানা কথা ভাবছি, আচমকা দুরে কোথা থেকে ভেসে এল একদল শেয়ালের মড়াকান্না, কতগুলো বাদুড় বাড়ির ছাদ থেকে উড়ে গেল আমাদের মাথার ওপর দিয়ে। আমরা শুধুমাত্র জেদের বশে ঘুরছিলাম, মনে ততক্ষনে আমাদের কেমন ভয় ভয় করতে শুরু করেছে। ঘুরতে ঘুরতে আমরা দোতলার একটা বড় হলঘরে এসে উপস্থিত হলাম। সেসময় আমাদের চোখ গেল একটা শো-কেসের দিকে। এখনকার দিনের মত না হলেও কাঠের কাজে সাজানো তাকের ওপরে কিছু জিনিস রাখা দেখতে পেলাম। আমরা সেই ঘরে ছড়িয়ে গিয়ে সারা ঘরটা দেখতে লাগলাম। পারিজাত গিয়ে বসল একটা বড় চেয়ারের ওপর, জমিদারের মত পায়ের ওপর পা তুলে। সাগ্নিক ঘরটা ভালো করে ঘুরে তার কারুকার্য দেখছিল। তীর্থ গেল বারান্দার দিকে। মৃণাল গেল সেই শো-কেসটার দিকে। আমি ঘুরে ঘুরে ঘরটা দেখছিলাম, হঠাৎই আমার চোখ পড়ল একটা আয়নার দিকে। আয়নাটা দেখে আমি খুব আশ্চর্য হয়ে গেলাম। আয়নাটা আশ্চর্যের বিষয় না, বিষয় হল আয়নাটা একেবারে নতুনের মত ঝকঝক করছে। তাতে এতটুকুও ধুলো পড়েনি। এতটুকুও তাতে কালের ছাপ পড়েনি। এত বছর পরেও একটা আয়না কিভাবে এতটা ঝকঝকে থাকতে পারে? আমি কেমন একটা আকর্ষণ অনুভব করতে লাগালাম ওটার দিকে। এগিয়ে গিয়ে নিজের মুখ দেখতে পেলাম আয়নাতে। আচমকা আমি দেখতে পেলাম আমার পেছন দিয়ে ধাঁ করে একটা ছায়ামূর্তি একদিক থেকে আরেক দিকে সরে গেল। আমি প্রচণ্ড চমকে উঠে সঙ্গে সঙ্গে পেছন ফিরে তাকালাম। সেখানে কেউ ছিল না। আবার আমি আয়নার দিকে ফিরে তাকালাম, এবার আবার আমি দেখলাম, কিছু একটা ঠিক আমার পেছনেই আসছে আর হঠাৎ করে মিলিয়ে যাচ্ছে। আমি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেলাম। যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে এটার উত্তর আমি খুঁজে পেলাম না। আমি সেই ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসছিলাম, হঠাৎ এক ঝলক দমকা হাওয়া সেই ঘরটা দিয়ে বেরিয়ে গেল। আমার সারা গায়ে কেমন যেন কাঁটা দিয়ে উঠল। আমি তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসে দেখি, হলঘরে সবাই জড়ো হয়েছে, মৃণাল একটা তলোয়ার হাতে নিয়ে রাজার মত করে চেয়ারে বসে আছে আর বাকিরা ওকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। “কি রে, কেমন লাগছে আমাকে? রাজার মত লাগছে না!” পারিজাত টিপ্পনী কেটে বলল, “রাজা নয় সে রাজ পেয়াদা।” বলামাত্র সবাই মুখ টিপে টিপে হাসতে শুরু করল। আমি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ কোথা থেকে তীর্থর চিৎকার শোনা গেল। আমরা পড়িমরি করে গিয়ে দেখি, তীর্থ মেঝেতে পড়ে আছে আর একটা ছবির দিকে তাকিয়ে চিৎকার করছে। আমরা সেদিকে তাকিয়ে দেখি, দেওয়ালে দুটো ফ্রেম। একটাতে সেই বুড়োটার ছবি যাকে আমরা আসার সময় দেখে এসেছিলাম। তাতে একটা শুকনো মালা দেওয়া। আর পাশের ফ্রেমে মৃণালের ছবি, হাতে তলোয়ার নিয়ে, ঠিক একটু আগেই যেমন করে ও বসেছিল, ঠিক সেভাবে, আর তাতে হাল্কা হাল্কা লাল লাল রক্তের মত ছেটানো। তাহলে কী.! তাহলে কি সত্যিই কেউ আছে এখানে? আমরা কার কবলে পড়ে গেলাম? আর ভাবতে পারলাম না, তীর্থকে কোনওমতে সেখান থেকে তুলে নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়তে চাইলাম। কিন্তু বেরিয়ে এসে দেখি মৃণাল নেই। গোটা জায়গাটা খুঁজেও আমরা ওকে খুঁজে পেলাম না। এবার সত্যি সত্যিই আমাদের টেনশন শুরু হয়ে গেছিল। তবে কি শুধুমাত্র নিজেদের দোষে আমরা ওকে হারিয়ে ফেললাম! না না, এ হতে পারে না। কিন্তু মৃণাল কোথায়? “মৃণাল! মৃণাল!! কোথায় তুই? সাড়া দে…… মৃণাল!!!” না, কোথাও পেলাম না। কিন্তু আর এখানে থাকা যাবে না। কোনও রকমে আমরা বাইরে বেরিয়ে এসে দেখি, মৃণাল আমাদের গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা ওকে দেখে, বলা ভালো, অক্ষত অবস্থায় দেখে চরম আশ্বস্ত হলাম। “বাকি সব কথা পরে হবে, সবাই আগে গাড়িতে ওঠ তাড়াতাড়ি।” আমরা তৎক্ষণাৎ গাড়িতে উঠে সেখান থেকে বেরিয়ে পড়লাম। বাইরে তখন আবার বৃষ্টি নেমেছে, আমাদের সকলের যেন হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। আমরা বেশ কিছুটা আসার পর হঠাৎ সাগ্নিকের কাছে একটা ফোন এল। দেখি মৃণাল ফোন করছে। কিন্তু গাড়ির পেছনের সিট থেকে বসে ও ফোন করবে কেন? আমরা পেছনে তাকিয়ে দেখি সেখানে কেউ বসেই নেই। এ কি! মৃণাল গেল কোথায়? এই তো আমাদের সাথেই গাড়িতে উঠল। কোথায় উধাও হয়ে গেল চলন্ত গাড়ি থেকে? সাগ্নিক ফোনটা ধরতেই মৃণাল বলল, “কি রে? তোরা কোথায়? আমাকে নিতে এলি না? আমি রাস্তার ধারে একটা খড়ের ছাউনির তলায় দাঁড়িয়ে আছি। তাড়াতাড়ি আয় তোরা, আর ওই বাড়িতে থাকিস না। পালিয়ে আয়।” আমাদের সকলের বুক ধড়াস ধড়াস করে উঠল। মৃণাল যদি পালিয়ে ওখানে গেল, আর সেখান থেকেই ফোন করছে, তাহলে আমাদের সাথে যার দেখা হল আর যে আমাদের সাথে গাড়িতে উঠল, সে কে ছিল? কার সাথে আমরা এলাম এতটা পথ? আমরা রীতিমত ভয়ে সিটিয়ে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি ঘুরিয়ে গিয়ে মৃণালকে সাথে নিয়ে আবার বাগান বাড়িতে ফিরে এলাম। এসে সেদিন সকলেই আমরা বড় ঘরে একসাথে ঘুমিয়েছিলাম। কী যে হল তখন আমাদের সাথে সেটা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছিলাম। একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম সবাই।
পরের দুদিন বেশ ভালো মতই কাটল। আমরা বেশ ভালো ভাবেই ঘুরলাম। ওখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, নদী, পুকুরে মাছ ধরা দেখা, খেতের আলে আলে হেঁটে বেড়ানো, নৌকোয় করে ঘোরা- সব কিছু করে বেড়ালাম সকলে মিলে। তবে সেদিনের ঘটনাটা একেবারে মন থেকে মুছে দিতে পারিনি কেউই। আমরা সেদিনের পর থেকে যথেষ্ট সাবধান হয়ে গেছি, রাতে কোথাও বেরোতাম না, একেই শীতের সময়, তার ওপর গ্রামের দিক, রাত দশটার মধ্যেই সারা গ্রাম যেন নিঝুম, শুনশান হয়ে যায়। আমরা যদিও অত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ি না। খাওয়া দাওয়ার পর আমাদের বেশ অনেকক্ষণ আড্ডা চলে। সেদিনেও আমরা খাওয়া দাওয়া শেষ করে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলাম। হঠাৎ আমার কানে এল কারা যেন বাড়ির বাইরে কথা বলছে। আওয়াজটা আসছিল বাগানের দিক থেকে। আমি উঠে গিয়ে জানলাটা হাল্কা করে খুলে দেখি, বাগানে বসে কথা বলছে বনমালী কাকা আর একজন লোক। তাকে আমরা কেউ চিনি না। তবে তাদের কথাবার্তা শুনে মনে হল বনমালী কাকার পরিচিত সে, দেখে তো গ্রামের কেউ বলেই মনে হল। বাকিরা গল্পে মত্ত, আমি হাল্কা করে সেই সুযোগে কান পেতে শোনার চেষ্টা করলাম। যা শুনলাম, তাতে আমার কৌতূহল আর ভয় দুটোই কেমন যেন বেড়ে গেল। লোকটা বনমালী কাকাকে বলছিল, “শহর থেকে তো বাবুরা এসেছে শুনলাম। ওদের সবাইকে সাবধানে থাকতে বলবেন। ওরা না জানলেও আপনি তো জানেন, সামনেই অমাবস্যা। আর খাল পারের রাস্তাটা, সেই জঙ্গল থেকে শুরু করে একেবারে নীলডাঙ্গার মাঠ পর্যন্ত….. সবটাই তো জানেন আপনি সেখানে কি হয় এসময়। মন্দিরে তো বাবাঠাকুর বারবার বলে দিয়েছেন সেদিন কেউ যেন সন্ধের পর বাইরে না বেরোয়, আর ওই রাস্তা দিয়ে আসা যাওয়ার কথা তো ভাবাই যায় না! আমরা জানি সবটা, আপনিও জানেন। কিন্তু শহরের বাবুরা জানেন না। গ্রাম দেখতে এসে, ঘুরতে এসে বিপদে না পড়েন, তার জন্যই আপনাকে জানিয়ে দিয়ে গেলাম। ওদের বারণ করে দিয়েন কিন্তু।” বনমালী কাকা জবাব দিলেন, “তুই নিশ্চিন্ত থাকিস। কোনও বিপদ হবে না। আমি সবাইকে সাবধান করে দেব আর বারণও করে দেব। ওরা খুব ভালো ছেলে, কেউই ওদিন বাইরে যাবে না।” লোকটা বনমালী কাকাকে প্রণাম করে চলে গেল। আমি সব কথা শুনতে শুনতে কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম, আচমকা একটা হাত পেছন থেকে এসে আমার কাঁধে এসে পড়ল। আমি রীতিমত চমকে উঠে পেছন ফিরে দেখি, বনমালী কাকা দাঁড়িয়ে। “কি করছ এখানে?” প্রশ্ন করতে আমি একটু আমতা আমতা করে বললাম, “না কিছু না, এই একটু হাওয়া খাচ্ছিলাম। ঘরে কেমন একটু বদ্ধ লাগছিল। কিছু বলবেন কাকা?” বনমালী কাকা বলল, “না না, কিছু না। বাকিদের বাইরে বসার ঘরে দেখতে পেলাম, কিন্তু তোমাকে দেখিনি, তাই দেখতে এলাম।” “ও আচ্ছা।” এই বলে আমি আবার আড্ডাতে এসে যোগ দিলাম। কিন্তু কথাগুলো আমার কানে বাজছিল তখনও। কী এমন হয় এই গ্রামে অমাবস্যার দিন? কে এই বাবাঠাকুর? খাল পারের রাস্তাই বা কোনওটা? সেটা খারাপ কেন? ইত্যাদি সমস্ত প্রশ্ন মাথার মধ্যে ঘুরছিল। ঠিক করলাম সাগ্নিকের থেকে জানতে হবে, কারণ বনমালী কাকাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলে উনি সবটা নাও জানাতে পারেন। সেদিন আমি পারিজাতকে আমার ঘরে শুতে ডাকলাম। আমাদের দলের মধ্যে আমি আর পারিজাতই একটু অতিরিক্ত সাহসী বা ডাকাবুকো বলে পরিচিত। কিন্তু সেদিনের রাজবাড়ির ঘটনা আমাদের মনেও যথেষ্ট ভয়ের সঞ্চার করে ফেলেছে। সকলে ঘুমিয়ে পড়ার পর পারিজাতকে আমি সমস্ত ঘটনা পরিস্কার করে খুলে বললাম। সবটা শুনে পারিজাত ভীষণ অবাক হল। আমাকে হঠাৎ জিজ্ঞেস করল ও, “তোর কি মনে হচ্ছে না, এই গ্রামে, এই এলাকায় কোনও কিছুর অস্তিত্ব রয়েছে, যা আমরা বুঝতে পারছি কিন্তু দেখতে পারছি না? সোজা কোথায় বলতে গেলে, এটা একটা ভুতুড়ে এলাকা সেটা কি তোর একটুও মনে হয়নি?” পারিজাতের কথাটা শোনা মাত্র ওর হাতটা চেপে ধরে আমি বললাম। “একেবারে মনের কথা বলে দিয়েছিস ভাই তুই। আমি বেশ কয়েকদিন ধরে ঘটনা গুলো নিয়ে ভাবছি আর সাজানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু কোথাও এসে যেন হিসেবটা পুরো গুলিয়ে যাচ্ছে। সত্যি কথা বলতে আমারও ঠিক একই কথা মনে হয়েছে, এখানে কিছু বা কেউ তো আছেই।” “তুই কি ভাবছিস বলতো? কিছু কি করার কথা ভাবছিস?” পারিজাতের প্রশ্নের উত্তর তৈরিই ছিল আমার কাছে। আমি বললাম, “অমাবস্যা পড়ার আগের দিন আমি আর তুই এমনিই বেড়াতে বেরোব। আমরা খালপারের পুরো রাস্তাটা আর সাথে ওই মন্দির, সবটাই একবার দেখে আসব। কিন্তু সেকথা কাউকে এখনি জানানোর দরকার নেই। বাকিরা ভয় পেয়ে যাবে।” পারিজাত আমার কথায় সায় দিয়ে বলল, “ঠিকই বলেছিস। কিন্তু এই খাল পারের রাস্তা আর মন্দির এগুলো কোথায় সেটা জানবি কি করে?” আমি বললাম, “সেটা তুই আমার ওপর ছেড়ে দে। সে ব্যবস্থা আমিই করব। আপাতত এই কথাই রইল।” সব কথা সেরে নিয়ে আমরা সেদিনের মত ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন সকালে উঠে আমি বাগানে চলে গেলাম। সেখানে এক মালী কাজ করে, আমি দেখেছিলাম। তার কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম, “ও দাদা, বলি এখানে খালপারের রাস্তা কোনওটা গো? আর মন্দির কোথায় আছে এখানে?” মালী বলল, “এজ্ঞে, বাপঠাউর এর দরশনে যাইবেন বাবু? এখেনে এক পুরান কালের রাজবাড়ি আছে, সেটার থেকে বেশ খানিকটা দুরে ইস্টেশন, আর তার পাশ দিয়া জঙ্গল আর তার পরেই খালপারের রাস্তা। নীলডাঙ্গার মাঠ হইয়ে সেইখানা শেষ হইতেসে শ্মশান ঘাটের কাসে গিয়া। আর তার থেকে একটু দূর এগাইলেই তো আমাদের কিপাময়ি কালি মন্দির, সেখেনেই পাবেন বাপ ঠাউররে।” আমি সবটা শুনে মালীকে কিছু টাকা বকশিস দিয়ে ফিরে এলাম। এসে পারিজাতকে বললাম, আজ সবাই আমরা মন্দির দেখতে যাব। সাগ্নিককে বলে দিই। পারিজাত ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিতেই আমি সাগ্নিকের কাছে প্রস্তাব রাখলাম। সাগ্নিক বলল, “আজ তোদের ওখানেই নিয়ে যাওয়ার প্ল্যান ছিল আমার। ভালই হল, চল ঘুরে আসবি। দারুন জায়গা।” সেই মত আমরা গাড়িতে উঠে পড়লাম। কিছুক্ষনের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম মন্দিরের সামনে। গাড়ি থেকে নেমে দেখি এক বিশাল পাথরের মন্দির। সেখানে লোকে পুজো দিতে আসে। একটা বিশাল পুরোনো বটগাছ তার ডালপালা বিস্তার করে ঝুরি নামিয়ে এখনও দাঁড়িয়ে আছে স্বমহিমায়। মন্দিরে ঢুকে দেবী প্রতিমা দর্শন করে সেখানে পুজো দিলাম। কিন্তু পুজারি ঠাকুর ছাড়া অন্য কোনও ব্যক্তিকে দেখতে পেলাম না। আমি থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, “ঠাকুর মশাই, বলছিলাম আমরা বাবাঠাকুরের দর্শন করতে চাই। তাকে কোথায় পাওয়া যাবে বলতে পারেন?” পুজারি ঠাকুর মন্দিরের ডানদিকে আঙ্গুল দেখিয়ে দিলেন। গিয়ে দেখলাম, সেখানে একটি কুণ্ড রয়েছে আর তার পাড়ে এক সাধু বসে আছেন। মাথায় বিরাট জটা, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, হাতে বালা, গায়ে লাল বস্ত্র, পাশে রাখা আছে একটি ত্রিশুল ও কমণ্ডলু। আমরা সকলে তার কাছে গিয়ে প্রণাম করলাম। তিনি আমাদের দিকে তাকালেন, তাকানো মাত্র দেখি, তার চোখ দুটি জবা ফুলের মত লাল, কপালে চন্দন লেপা, গায়ের রং কালো। ভক্তির থেকে ভয় হয় বেশি। আমাদের উদ্দেশ্যে হাত তুলে বললেন, “বোম শঙ্কর! বোম কালি!” আমরা সকলে তাকে প্রণাম করে উঠে যাচ্ছিলাম। সাথে আমি আর পারিজাতও চলে যাচ্ছিলাম, সাধুবাবা হঠাৎ বলে উঠলেন, “সাহস ভালো, সেটা অতিরিক্ত দেখাসনি। সেদিন সবাই জেগে উঠবে, সব জায়গায় ঘুরে বেড়াবে। তাদের আটকাতে পারবি না তোরা। তাই যা ভাবছিস, ভুলে যা। একদম বেশি সাহস দেখাসনি। আমার মা তোদের মঙ্গল করুন। বোম শঙ্কর! বোম কালি!” এই বলেই বাবাঠাকুর আবার চোখ বুজলেন। কথাগুলো শুনে আমি আর পারিজাত একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগলাম। এই সাধু কি করে জানল আমরা কি ঠিক করেছি? আর সেটা জেনে আমাদের সাবধান করল! কিন্তু কেন? কি ঘটবে সেদিন? কারা জেগে উঠবে? যাই হোক না কেন, এই সাধুর যে কোনও অলৌকিক ক্ষমতা আছে সেটা মনে মনে আমরা দুজনেই মেনে নিয়েছিলাম। তবে কিছুতেই যেন আমাদের কৌতূহলকে দমন করতে পারছিলাম না আমরা। তবে তখন আর বিশেষ কিছু না ভেবে আমরা ফিরে এলাম সবাই। আসার সময় আমি আর পারিজাত ঠিক করলাম, এটা নিয়ে পরে আলোচনা করা যাবে।
সেদিন বিকেলের পর ঘুরে টুরে এসে সন্ধেতে সবাই বাগানে বসে গল্প করছিলাম। সাথে চপ, কাটলেট, চা সব মিলিয়ে একেবারে জমে গেছিল সন্ধেটা। আমরা সকলেই বেশ হাল্কা মেজাজে ছিলাম। সেই সাথে আমরা হিসেব করে দেখলাম, আর মাত্র দুদিন আমরা সেখানে থাকব। এর মধ্যেই আমাদের সবটা ঘোরা সেরে ফেলতে হবে। আমাদের পরেরদিন যাওয়ার কথা ছিল একটু দুরে পাশের গ্রামের দিকে। সেখানে নাকি একটা ছোট্ট পাহাড়ি ঝরনা আছে, খুব মনোরম নাকি সেখানকার পরিবেশ। আমরা সবটাই স্থির করে ফেলেছিলাম । আর কাল একটু আগে আগে বেরোবার কথা ঠিক হল। পাশের গ্রামে যেতে আসতেও সময় লাগবে। কথায় কথায় রাত সাড়ে নটা বাজল। বনমালী কাকা আমাদের খেতে ডাকতেই আমরা উঠে গেলাম খাওয়ার ঘরের দিকে। আচমকা আমার মনে হল, চারপাশের আবহাওয়াটা হঠাৎ করে যেন অতিরিক্তই ঠাণ্ডা হয়ে গেল। ততটা ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দিলাম না। গ্রামের দিকের শীত, বলাই বাহুল্য। তাই সেটাতে বিশেষ কিছু বা অন্য রকম কিছু মনে হল না। খাওয়ার টেবিলে বসে আমাদের বনমালী কাকা বলে দিলেন, “কাল সন্ধের পর থেকে তোমরা বাড়ির বাইরে কোনওমতে বের হয়ো না। কাল গোটা গ্রাম সন্ধের মধ্যে নিশুতি হয়ে যায়। সারা গ্রামে একটা গা ছমছমে পরিবেশ থাকে। কাল আমাদের গ্রামের কৃপাময়ী কালি মায়ের মহাপুজা। বাবা ঠাকুর নিজে সেদিন বিশেষ পুজো করেন। অতএব কালকের দিনটা কেউ তোমরা বাইরে বেরিয়ো না সন্ধেতে।” আমরা সকলেই তার কথায় সম্মতি জানালাম ঘাড় নেড়ে। পারিজাত একবার আমার দিকে তাকাল, আমি চোখ টিপে দিতেই ও বুঝতে পেরে গেল আর আবার গল্প শুরু হল আমাদের। রাতে আমরা সকলেই খাওয়া দাওয়া সেরে শুতে গেলাম। রাত তখন ঠিক কত, আমার খেয়াল নেই। আচমকা মনে হল, কেউ যেন আমায় ডাকছে। হ্যাঁ, আমার নাম ধরেই ডাকছে। কিন্তু কে ডাকছে? আরে, এত পারিজাতের গলা! কিন্তু ও এত রাতে আমায় কেন ডাকছে? কি দরকার পড়ল ওর? কারও কোনও বিপদ হল নাকি? “কিরে? কি হল? কোনও প্রব্লেম?” দরজার ওপাশ থেকে আওয়াজ এল, “একবার বাইরে আসতে পারবি? কথা ছিল।” আমি কি মনে করে উঠলাম। দরজা খুলে দেখি, পারিজাত দাঁড়িয়ে। “কিরে? কি হল এত রাতে ডাকছিস! সবাই ঠিক আছে তো?” পারিজাত বলল, “সব ঠিক আছে। চল আমরা বেরব। এখনি।” আমি আকাশ থেকে পড়লাম। ছেলেটা খেপে গেল নাকি? এই এত রাতে, কনকনে ঠাণ্ডার মধ্যে ও কোথায় যাবে বলছে? আমি জিজ্ঞেস করতে ও বলল, “খাল পারের রাস্তা যাওয়ার জন্য একটা ছোট রাস্তা আমি খুঁজে পেয়েছি। সেটাই দেখাব চল।” আমি অবাক হয়ে বললাম, “তুই গেলিই বা কখন আর খুঁজলিই বা কি করে?” “সব পরে বলব এখন চল তাড়াতাড়ি, নাহলে কেউ উঠে পড়বে।” এই বলে আমাকে নিয়ে ও বেরিয়ে পড়ল। আমি কেমন যেন ওর কথা শুনে চলতে শুরু করলাম। কেমন যেন আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল তখন। অন্ধকারে আমরা ঠিক কোনওদিকে যাচ্ছি, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার, পারিজাতের যেন কোনও অসুবিধাই হচ্ছে না এভাবে পথ চলতে, যেন সবটাই ওর কাছে ছবির মত স্পষ্ট। আমি ওর সাথে কতটা পথ এলাম জানি না। হঠাৎ রাতের নিস্তব্ধতাকে ভেঙ্গে খানখান করে দিয়ে কোথা থেকে একটা আওয়াজ ভেসে এল, “খোকাবাবু! ও খোকাবাবু!! দাঁড়াও দাঁড়াও!! কোথায় যাচ্ছ? দাঁড়িয়ে যাও!” আরে, এটা তো বনমালী কাকার গলা! কাকা এখানে কোথা থেকে এল? এমন সময় হঠাৎই আমাকে কেউ যেন খুব জোরে জাপটে ধরল। আমি কিছুতেই তাকে ছাড়াতে পারছিলাম না। আমি জোরে চিৎকার করে উঠতেই আমাকে খুব জোরে ঝাঁকুনি দিল কেউ। আমি কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম, তাকিয়ে দেখি বনমালী কাকা আমাকে ধরে আছে, “এত রাতে একা একা কোথায় যাচ্ছ? মরার সখ হয়েছে নাকি তোমার?” আমি কেমন অবাক হয়ে বললাম, “মরতে যাব কেন? আমি তো পারিজাতের সাথে যাচ্ছিলাম।” বনমালী কাকা বলল, “কোথায় পারিজাত? আমি তো কাউকেই দেখতে পাচ্ছি না সামনে।” আমি তাকিয়ে দেখি আমাদের থেকে বেশ খানিকটা দুরে দাঁড়িয়ে আছে ও। কিন্তু একি! কে ওটা? পারিজাত যেটা পরে ছিল সেটাই পরে আছে, কিন্তু ওর মুখটা কেমন যেন দেখতে লাগছে। যেন একটা পোড়া ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে সামনে। ওর অত সুন্দর মুখটা কেমন যেন হিংস্র আর ভয়ানক হয়ে উঠছে আস্তে আস্তে । ওর হাত পাগুলো কেমন যেন শীর্ণকায়, অস্থিচর্মসার হয়ে গেল। এই পারিজাতকে তো আমি চিনি না! তবে কে ও? সেই মূর্তিটা হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, “কি রে সৌরভ…… খাল পারের রাস্তায় আর যাবি না?” সে গলার স্বর অমানুষিক। আমার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল, আর পৌষ মাসের শীতেও আমার সারা গায়ে দরদর করে ঘাম ঝরলে লাগল। আচমকা সেই জিনিসটা আমাদের চোখের সামনে কোথায় যেন কুয়াশার মধ্যে মিলিয়ে গেল। কেমন যেন উবে গেল। আমি কোনওক্রমে বনমালী কাকার সাথে বাড়ি ফিরে এলাম। আসার পথে কাকাকে অনুরোধ করলাম ঘটনাটা কাউকে না বলতে। কাকা আমাকে আশ্বস্ত করলেন। আমি ফিরে এসে, হাত মুখ ধুয়ে নিয়ে আমার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। আর যাবার পথে পারিজাতের ঘরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে বুকটা কেমন যেন ছ্যাঁত করে উঠল। আর কিছু না ভেবে শুয়ে পড়লাম। পরদিন সকাল থেকেই তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল ঘুরতে যাওয়ার। আমি কাল রাতের কথাটা কাউকে বলিনি ঠিকই, কিন্তু মন থেকে ভয়টা আমার কিছুতেই যাচ্ছিল না। পুরোপুরি গোটা ঘটনাটার প্রভাব থেকে বের হতে পারিনি। ঘটনাটা পারিজাতের চোখ এড়ায়নি। আমি কিছুটা অসুস্থ বোধ করছি দেখে বাকিরা আমাকে দেখতে এসেছিল। আমি সকলকে আশ্বস্ত করলাম এই বলে যে, ঠাণ্ডাতে একটু গাটা ম্যাজ ম্যাজ করছে এই আর কি। আর কিছু না। দুপুরে বেশ ভালো রকম ভুরিভোজের আয়োজন করা হয়েছিল, খাওয়া দাওয়ার পর অনেকটা ধাতস্ত বোধ করছিলাম। আমি ঘরে আসার পর পারিজাত এসে বলল, ”সকাল থেকেই তোকে অন্যরকম লাগছে। এটা শুধুমাত্র গা ম্যাজ ম্যাজ করা হতে পারে না। কি হয়েছে বল তো?” আমি ওকে সবটা বলার পর রীতিমত আতঙ্কিত হয়ে গেল ও। আমার হাত টা চেপে ধরে বলল, “তুই ঠিক আছিস তো? এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল কাল, এতটা ঝড় বয়ে গেল তোর ওপর দিয়ে, আর আমরা কেউ কিছু জানতে পারলাম না! তুই বললি না ভাই আমাদের?” আমি ওকে শান্ত করলাম, “আমি একদম ঠিক আছি। চিন্তা করিস না, আর বাকিদেরও জানাব, সময় আসুক। এখন আমি সবার আনন্দটা মাটি করে দিতে চাই না। আর আজকে আমরা আমাদের প্ল্যান মতই কাজ করব।” পারিজাত সজোরে মাথা নেড়ে বলল, “অসম্ভব, আমি আর কোনও রিস্ক নিতে চাই না তোকে নিয়ে। আগের দিন সেই সাধুবাবা কি বলেছিল মনে নেই তোর? এত কিছুর পরেও? কোনও মতেই না, অসম্ভব!” আমি বললাম, “ওরে বাবা আজ তো আমরা দুপুরের পরেই বেরব, ওরা বেরিয়ে পড়ার পর আমরা যাব আর সূর্যের আলো থাকতে থাকতেই যাব। আর বিকেলের মধ্যে তো ফিরতেও হবে, বনমালী কাকা বলেই দিলেন তো কাল, আর বাকিরাও ততক্ষনে ফিরে আসবে।” অনেক বলার পর ও রাজি হল। আমরা দুজন থেকে গেলাম বাড়িতেই, আমার শরীর খারাপ বলে, আর পারিজাত আমার সাথে থাকবে বলে। “তোদের কালকে দেখিয়ে নিয়ে আসব, চিন্তা নেই। তুই রেস্ট নে। আসি আমরা।” ওরা সকলে গাড়িতে উঠে বেরিয়ে গেল। আমরা দুজন থেকে গেলাম ও বনমালী কাকা নিজের কাজে গেলেন।
ঘড়িতে তখন তিনটে বাজছে। আমি আর পারিজাত চুপচাপ বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলাম। এক সময় আমরা পৌঁছে গেলাম নিশুতিপুর রেলস্টেশনে। স্টেশনের হাল দেখে মনে হল, বহুদিনের পরিত্যক্ত, জনপ্রানীহীন, নির্জন একটা জায়গা। দিনের বেলাতেও কেমন যেন একটা শুনশান পরিবেশ সেখানে। আমার হাতে ঘড়ি ছিল আজ। সেটাতে দেখলাম, তখন বাজে সাড়ে তিনটে। এখনও কিছুটা হাতে সময় আছে, এটা দেখে আমরা সেখান থেকে চলতে শুরু করলাম আগের রাস্তার দিকে। বেশ কিছুক্ষণ পরেই এল জঙ্গল। পারিজাত আমাকে বলল, “খবরদার তুই আমার সঙ্গ ছাড়বি না। একদম সাথে সাথে চলবি।” আমিও সেটাতে সম্মতি জানালাম। আমরা জঙ্গলে ঢুকলাম। সেই জঙ্গলে ঢুকে আমাদের ভয়ে যেন হাত পা শুকিয়ে যাচ্ছিল। সূর্যের আলো যেন এখানে আসা পছন্দই করে না, কোনও রকম নিয়মরক্ষা করতে একটু আধটু ঢোকে। এক কথায়, গভীর অরণ্য বলতে যা বোঝায়, ঠিক সেটাই। সে জঙ্গলে ঢোকার পর থেকেই আমার মনে হতে লাগল, কেউ যেন সমানে আমাদের পিছু নিয়েছে। পিছু পিছু কেউ যেন আসছে, আমাদের প্রতি মুহূর্তে সে দেখছে। অথচ আমরা কেউ তাকে দেখতে পাচ্ছি না। এ যেন এক আজব লুকোচুরি খেলা। আমরা এবার জঙ্গল থেকে বেরোনোর রাস্তা খুঁজতে শুরু করলাম। হাঁটছি হাঁটছি হাঁটছি—— এক সময় আমি বললাম, “পারিজাত, আর যে পা চলছে না, তাড়াতাড়ি বেরোতে না পারলে তো মুশকিল! এত মনে হচ্ছে, যত এগোচ্ছি, ততই জঙ্গলও বেড়ে যাচ্ছে!” পারিজাত আমার কথায় কোনও সাড়া দিল না দেখে আমি পেছন ফিরে তাকালাম। দেখি পারিজাত নেই! আমি এরপর রীতিমত ভয় পেতে শুরু করেছিলাম। কোথায় গেল ছেলেটা? সুস্থ সবল ছেলেটা এভাবে কোথায় উধাও হয়ে গেল? আমি আকাশ ফাটানো চিৎকার করলাম, “পারিজাত! কোথায় তুই? শুনতে পাচ্ছিস আমার কথা? তুই কোথায়? সাড়া দে ভাই! পারিজাত!!” না, সব চেষ্টা বিফল। নিজের প্রতি নিজের রাগ, ঘৃণা সব হতে লাগল। একটা অপরাধবোধ আর বিবেক দংশন হতে লাগল আমার। ওকে আমিই তো এখানে এনেছিলাম জোর করে। কোথায় যে হারিয়ে গেল এ সময় ছেলেটা কে জানে! আর আমার সাথে হওয়া ঘটনাগুলোর পর থেকে আমি সত্যিই ভয় পেতে শুরু করেছি। ছেলেটার এই ক্ষতির জন্য আমিই দায়ি। এইসব সাত পাঁচ ভাবছি আর বেরোনোর পথ খুঁজছি, আচমকা দেখি, একটা কেমন চেহারার আধবুড়ো লোক আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। আমি ভাবলাম কে এটা? এভাবে আমাকে দেখে হাসছেই বা কেন? কি উদ্দেশ্য এর? কলকাতা থেকে আসার সময় আমি বন্দুক নিয়ে এসেছিলাম, কেউ সেটা জানত না। আজ সেটা সঙ্গে করে নিয়েই এসেছিলাম। সেটা ঠিক আছে কিনা দেখে নিয়ে আমি এগিয়ে যেতে লাগলাম। আমি কাছাকাছি আসতেই লোকটা বলে উঠল, “বাবু, আপনি কি পথ হারাইছেন? বেরোতে পারছেন নি? আমারে কইতে পারেন। আমি দেখাই দিব।” “কে তুমি? কোথায় থাক?” আমার প্রশ্নের উত্তরে সে জানাল সে এই গ্রামেরই বাসিন্দা, জঙ্গলে এসেছিল কাঠ কাটতে। আমি তাকে বললাম এই জঙ্গল থেকে আমায় বের করে দিলেই তাকে আমি বকশিস দেব। সে আমাকে নিয়ে চলল। আমি আসছিলাম ওর পাশে পাশে। লোকটাকে এবার ভালো করে দেখলাম। একটা কালো পুরনো চাদর গায়ে দিয়ে আছে। সারা শরীরটার কেমন যেন গড়ন। শরীরের হাড়গুলো বেরিয়ে পড়েছে, অপুষ্ট দেহ। সন্ধে নেমে গেল, পারিজাতের কোনও খোঁজ পেলাম না, এই গভীর জঙ্গলে ছেলেটাকে হারালাম। পাঁচজনে এসে চারজনে ফিরে যেতে হবে, কোনওদিন নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না, এত কিছু ভাবতে ভাবতে আমি চলতে চলতে আসছিলাম। কিছু পরে দেখি মশাল হাতে কিছু লোক আসছে। ভাবলাম, এসেই পড়েছি। সেই লোকগুলো কাছে এসে বলল, “কে আপনি? আজ সন্ধেতে বাড়ির বাইরে কেন? কোথা থেকে আসছেন?” তাদের সবটা বলতে তারা বলল, “তা এদিকেই আসতে হল আপনাকে? জানেন না এই নীলডাঙ্গার মাঠের পরেই শ্মশানঘাট! আর আজ সেদিকে যাওয়া মানা! কোনও ঠাকুরের ছবি আছে আপনার কাছে?” আমি তাদের বোঝালাম, “আমি কোনওমতে চলে যাব, আর সাথে তো এই কাঠুরে ভাই আছেই, কই গো?” এই বলে পাশে তাকিয়ে দেখি কেউ নেই, পেছন ফিরে দেখি কেউ কোথাও নেই। একি? লোকটা কোথায়? এই তো কিছুক্ষণ আগেও আসছিল! তাহলে কি আবার সেই!!! আর একটুও কিছু ভাবার সময় নেই, আমি এবার দৌড়তে শুরু করেছিলাম। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, যেন এক হাত দুরের মানুষ দেখা যাচ্ছে না। আমি এবার কোনও রকমে বাড়ি ফিরতে চাই, এতক্ষণে নিশ্চয়ই সবাই সবটা জেনে গেছে আর আমাদের খুঁজছে। কেমন যেন পাগল পাগল লাগছিল। চারিদিকের বাতাসে একটা কেমন অস্বস্তিকর দমবন্ধ করা গুমোট ভাব হয়ে রয়েছে। আমি মাঠ পেরিয়ে এসে গেছি মনে হল। আর একটু গেলেই বাড়ি পৌঁছে যাব। কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে একটু জোরেই পা চালালাম এবার। আচমকা আমার চোখ গেল দুরে রাস্তার দিকে। সামনে যা দেখলাম সেটা দেখে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। দেখি সেই কাঠুরেটা যাচ্ছে, আর তার সাথে এক মহিলা মাথায় ঘোমটা দিয়ে যাচ্ছে। চারিদিকে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, শেয়ালের কান্না, রাতের পাখির শব্দ, সব মিলে আমি একেবারে ভয়ে আধমরা হয়ে গেছিলাম। ওদের দেখে একটু নিশ্চিন্ত হলাম। কিন্তু লোকটা আমার সাথে আসছিল, তখন উধাও কি করে হয়ে গেল? আর আমার আগে এতদুর এলোই বা কি করে? আমি ওদের পেছন থেকে ডাক দিলাম, “ও কাঠুরে ভাই! ও দিদি! শুনছেন? এই যে! শুনতে পাচ্ছেন?” কোনও সাড়া দিল না তারা, হেঁটেই চলল। কিরে বাবা! কালা নাকি! আরেকবার শেষ চেষ্টা করব বলে ডেকে উঠলাম। সাথে সাথে দেখি ওরা দাঁড়িয়ে পড়ল। আর এক জায়গায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ওদের মাথা দুটো ঘুরে গেল আমার দিকে। আর সাথে সাথে ভেসে এল এক বিকট অট্টহাসি, “হিহি হিহি হিহি হিহি……. ।” সেই কাঠুরেটা গায়ের চাদরটা সরিয়ে দিল, আর তারপর দেখি একি! সারা গায়ে রক্তের দাগ, দুটো হিংস্র দাঁত মুখের থেকে বেরিয়ে এসেছে, লকলকে জিভ, আর গায়ে বাদুড়ের মত দুখানা ডানা। আর সেই মহিলাটি হঠাৎ কেমন ঘাড় মুখ বেঁকিয়ে, দাঁত বের করে, ভাঁটার মত জ্বলন্ত চোখ নিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে বসে পড়ল। সাথে সাথে তার হাত ও পায়ের নখগুলো কেমন হিংস্র জন্তুদের মত বড় হয়ে উঠল। দেখে মনে হতে লাগল যেন এক রক্তলোলুপ পিশাচ রক্তের লোভে জেগে উঠেছে বহুদিন পর আর সামনে শিকার দেখে সে আনন্দে আত্মহারা! সেই মহিলাটি একটা চতুষ্পদ জন্তুর মত আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। আমি কেমন যেন পাথরের মত শক্ত হয়ে গেলাম। খুব জোরে চিৎকার করতে গেলাম, কিন্তু কি আশ্চর্য! আমার গলা দিয়ে একফোঁটাও আওয়াজও বেরোল না। কিছুদুর এসে তারা দুজন থেমে গেল আর ঠিক তেমনি এক অমানুষিক, পৈশাচিক অট্টহাসি হেসে উঠল। আমি যেন চোখের সামনে আমার নিশ্চিত মৃত্যুকে দেখতে পাচ্ছিলাম। হঠাৎ আমি বুঝতে পারলাম আমার শরীরে আমি সাড় ফিরে পাচ্ছি। আমি সেখান থেকে উদ্ভ্রান্তের মত দৌড়তে শুরু করলাম। আমি জানতাম না আমি কোনওদিকে যাচ্ছি, আমার তখন খালি মনে হচ্ছিল, মৃত্যু আমার পিছু নিয়েছে। একসময় দেখি সামনে অনেক মশাল জ্বলছে আর ঘণ্টার আওয়াজ কানে এল। আমি বুঝলাম, সামনেই মন্দির। আমি কোনওক্রমে সেখানে পৌঁছে লুটিয়ে পড়লাম। আর দম নিতে পারছিলাম না, শ্বাস যেন আটকে আসছিল। এমন সময় একটা আওয়াজ এল, “আয়, উঠে আয়। মায়ের আরতি দেখবি।” তাকিয়ে দেখি, বাবাঠাকুর মন্দিরের দরজা থেকে আমাকে ডাকছেন। আমি উঠে গিয়ে সেখানে গেলাম আর দরজার বাইরে বসলাম। সেই সময় আমি দেখলাম মন্দিরের ভেতরে কেউ একজন বসে আছে। বাবাঠাকুর আরতি শেষ করে মায়ের প্রসাদ দিল। লোকটা প্রসাদ নিল। বাবাঠাকুর আরেক বাটি প্রসাদ নিয়ে লোকটিকে দিল আমায় দেওয়ার জন্য। লোকটি হাত বাড়িয়ে এগিয়ে দিল আমার দিকে। মানুষের হাত যে এতটা চলে আসতে পারে সেটা আমার ধারণা ছিল না। বাটি হাতে নিতে গিয়ে দেখি, একি! হাতে মাংস কই? এত হাড়! মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি মুখ কই? কঙ্কালের করোটি! আমি একটা বিকট চিৎকার করে সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে গেলাম। আর কিছু মনে নেই তারপর। যখন আমার জ্ঞান ফিরল আমি তখন বাগান বাড়িতে আমার ঘরে। সামনে আমার বাকি চার বন্ধু আর বনমালী কাকা বসে আছেন। ডাক্তার এনেছে সাগ্নিক। সকলকে অক্ষত অবস্থায় পেয়ে আমি খুশিতে নিজের চোখের জল ধরে রাখতে পারিনি। সকলকে জড়িয়ে ধরলাম, বাকিরাও আমাকে জড়িয়ে ধরল। বনমালী কাকা বললেন, “তুমি অনেক পুণ্যবান খোকাবাবু। নাহলে তেনাদের কবলে এতবার পড়ার পরেও তুমি বেঁচে ফিরেছ। ব্রাহ্মন বলে তেনারা তেমন কোনও ক্ষতি করতে পারেনি তোমার। এবার থেকে সব জিনিস নিয়ে আর অত বেশি সাহস দেখিও না। সাবধানে থেকো আর ভালো থেক।” সাগ্নিক জানতে চাইতে কাকা বললেন, “রাজবাড়ির লোকেরা আজও এই এলাকায় ঘুরে বেড়ায়। তারা প্রতি অমাবস্যার রাতে বাকি অশরীরীদের মতই সবার সাথে জেগে ওঠে ঘুরে বেড়ায়। এই গ্রামের ওপর তাদের মায়া এখনও কাটেনি। তাই বাবাঠাকুর এসেছেন আমাদের উদ্ধার করতে। তিনি এদের যথাযোগ্য বাবস্থা করবেন। বাবা সাধনার মাধ্যমে আর তার ক্ষমতা দিয়ে খুব তাড়াতাড়ি এই গ্রামকে তেনাদের কবল থেকে মুক্ত করবেন। আর সেই কাজ শুরুও হয়ে গেছে।” আমরা সবটা শুনে প্রচণ্ড অবাক হলাম আর নিজেরা নিজেদের ভুল বুঝতে পারলাম। সাথে এটাও বুঝলাম, কোনও জিনিস অতিরিক্ত যেমন ভালো না, তেমনি এটাও বুঝলাম যে সবসময় যুক্তি বুদ্ধি দিয়েও সবকিছুর বাখ্যা চলে না। আমি আরেকদিন সেখানে থেকে সুস্থ হয়ে উঠলাম। তারপর বাবাঠাকুর, বনমালী কাকা, আর নিশুতিপুরের বাগানবাড়িকে বিদায় জানিয়ে আমরা আবার ফিরে এলাম আমাদের আপন ডেরায়। সেদিনের সেই সব ঘটনা আজও আমার মনের মধ্যে ঠিক আগের মতই রয়ে গেছে। আর ভবিষ্যতেও থাকবে।
অশরীরী | পলক ফেলা নিষেধ |প্রীতম মুখোপাধ্যায়| Bengali Thriller Story0 (0)
Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]
You must sign in to vote