নয় নয় করে আমাদের বন্ধুত্ব বেশ কয়েক বছর পেরিয়েছে। কর্মসূত্রেই আমাদের পরিচয় হয়। পেশাগত দিক থেকে আমরা দুজনেই সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত। সেই সূত্রেই আমাদের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হয়।
অবশ্য আমরা ঘুরতে ভালোবাসি দুজনেই তা সে কাজের বাহানাতেই হোক আর ছুটির মেজাজে। আমার বন্ধু রঞ্জন; মানে রঞ্জন বনিক আর আমি শুভঙ্কর মাইতি, সেবার একসাথে নিমন্ত্রণ পেয়েছিলাম দূর সম্পর্কের এক জ্যাঠামশাইয়ের কাছ থেকে। আসলে ঠিক নিমন্ত্রণও বলা চলে না বরং এটা বললে ভালো হয় যে কয়েকদিনের জন্য বাড়ি পাহারা দেওয়া। আবার অন্যভাবে ভাবলে বলা যায় ওই অত বড় বাড়ি পাহারা দেওয়ার জন্য যখন আমাদেরকে ডাকা হয়েছে তাও আবার অত দূর থেকে তখন রাজকীয় আতিথেয়তার বন্দোবস্তও নিশ্চয় হয়েছে। অতঃপর সেই সুবাদে নিমন্ত্রণও বলা চলে। সে যাই হোক আমাদের যেতেই হবে জ্যাঠামশাইয়ের কড়া হুকুম। আসলে হয়েছে কি ব্যাবসার কাজে কয়েকদিনের জন্য জ্যাঠামশাইকে শহরের বাইরে যেতে হচ্ছে আর সেই কারণেই আমাদের হাঁক ডাক। আপনজন বলতে জ্যাঠামশাইয়ের কেউ নেই,বিয়েও করেননি। অতঃপর একা একাই থাকেন। আর সময় পেলেই আমাদেরকে ডেকে নেন আড্ডা দেওয়ার জন্য। তবে এবার ব্যাপারটা একটু আলাদা। শুনলাম ব্যবসায়িক কারণে বেশ কয়েকদিন হল তিনি পুরনো বাড়িটি ছেড়েছেন। এখন তার নতুন বাড়ি শহরে থেকে প্রায় অনেকটাই ভিতরে অন্তত নতুন ঠিকানা তো তাই বলছে। ঠিক হল শনিবার রাত্রে ট্রেন ধরে পরদিন সকাল আটটা নাগাদ জ্যাঠামশাইয়ের বাড়ি পৌঁছব। তল্পিতল্পা সহ আমি ও আমার বন্ধু রঞ্জন পরদিন সকালে হাজির হলাম ঠিকই তবে আটটা নয় ঘড়িতে তখন সোয়া বারোটা। কথা ছিল আটটায় পৌঁছানোর পর একসাথে জলখাবার সেরে আমাদেরকে যথাযথ নির্দেশ দিয়ে জ্যাঠামশাই রওনা হবেন গন্তব্যের উদ্দেশে ব্যবসায়িক কারণে। এইসব কিছুই সময়মতো হতে পারত যদি আগের রাতে আমরা দশটা কুড়ির পরিবর্তে ছটা পঁয়ত্রিশ এর ট্রেনটা ধরতে পারতাম। যদিও বেশ কিছু কারণে তা আর হয়ে ওঠেনি। অতঃপর সেগুরে বালি! পূর্বপরিকল্পনা গেল সব ভেস্তে।
বাড়িতে পৌঁছতেই দেখলাম গেটের বাইরের নেমপ্লেটে বড় বড় হরফে লেখা তপন মোহন সিকদার। জ্যাঠামশাইয়ের ভালো নাম। অবশ্য বড় নেমপ্লেটের নীচে ছোট নেমপ্লেটে দেখলাম পুরনো কায়দায় লেখা অবনী চাটুজ্জে রায়, যা দেখে বেশ অবাক হলাম। ততক্ষনে আমার সতীর্থ সদর দরজা পেরিয়ে বাড়ির অন্দরমহলে প্রবেশ করে গেছে। তবে কী বাড়ির বাইরে নেমপ্লেট দেখে যতটা না অবাক হয়েছিলাম তার থেকে কয়েকগুণ বেশি অবাক হলাম বাড়ির ভেতরকার চেহারা দেখে। একবারের জন্য মনে হল আদৌ সঠিক ঠিকানায় এলুম তো! পরক্ষণেই মনে হল, না বাড়ির বাইরে তো স্পষ্ট জ্যাঠামশাইয়ের নাম দেখলাম। তখনও এইসব ভাবছি হঠাৎ করেই জ্যাঠামশাইয়ের গুরুগম্ভীর গলার স্বরে আমার ঘোর কাটল। দেখলাম জ্যাঠামশাই বেশ চটেই আছেন। অবশ্য চটে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। নিজের বাম হাতের দম দেওয়া ঘড়িটির কাঁটার দিকে তাকিয়ে জ্যাঠামশাই রঞ্জনকে বোঝাতে লাগলেন ঠিক কতটা দেরি আমরা করেছি। জল বেশি দূর গড়ানোর আগেই জ্যাঠামশাইকে সবটা বুঝিয়ে বললাম। ততক্ষনে পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। হাতে বেশি সময় নেই তাই জ্যাঠামশাইয়ের নির্দেশ মেনে স্নান সেরে একেবারে দুপুরে খাওয়ার টেবিলে হাজির হলাম। পরিচয় হল জ্যাঠামশাইয়ের এক এবং একমাত্র বিশ্বস্ত খাস লোক নন্দলালবাবুর সাথে। পরিচিত ভঙ্গিতেই জ্যাঠামশাই বুঝিয়ে দিলেন নন্দলালবাবুই এ বাড়ির সব। একেবারে কেয়ার টেকার থেকে কষা মাংসের রাঁধুনি। মানুষটার সাথে কথা বলে বুঝতে পারলাম তার প্রতি জ্যাঠামশাইয়ের এতটা নির্ভরতার কারণ। অত্যন্ত শান্ত স্বভাবী আর পরিশ্রমী মানুষ বলেই মনে হল। আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম খাওয়ার টেবিলের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বাড়িটির ব্যাপারে বেশ কিছু জিজ্ঞাসা করবো। অতঃপর কথায় কথায় সেই প্রসঙ্গ ও উঠল। আসলে এরকম বাড়ি এখনকার দিনে খুব একটা দেখা যায় না কেবল শোনা যায় রূপকথা আর ভূতের গল্পে। সাত পাঁচ না ভেবেই সটাং জ্যাঠামশাইকে প্রশ্ন করে বসলাম, “আচ্ছা! জ্যাঠামশাই আপনি তো একা মানুষ, তার সত্ত্বেও পুরনো বাড়ি ছেড়ে হঠাৎ এই রাজপ্রাসাদে এসে উঠলেন কেন? তাও আবার শহর থেকে এতটা ভিতরে! কোনও বিশেষ কারণে বুঝি?”
কিছুটা হাসি মুখ নিয়েই জ্যাঠামশাই উত্তর দিলেন, “আরে না, না; কোনও বিশেষ কারণ কেন হবে। আসলে ছোটবেলা থেকেই আমার একটা শখ ছিল এরকম রাজপ্রাসাদ স্বরুপ বাড়িতে থাকার বা বলতে পারো কেনার। পড়ে বড় হয়ে যখন ব্যাবসাও করছি আর আমার আর্থিক সঙ্গতি ও যখন খুব একটা খারাপ না তখন পুরোনো নেশাটা আবার মাথা চাড়া দিয়ে বসল। খোঁজ ও শুরু করলাম কিন্তু পেলাম না। সব আশা যখন ছেড়ে দিয়েছি তখন হঠাৎ এক ভদ্রলোক এই বাড়ির খবর নিয়ে হাজির। আমিও দেখলাম এত কম দামে একেবারে জলের দরে যখন বাড়িটা হাতে এল তখন আর ছাড়া যায় কেন। কোনও রকম সাত পাঁচ না ভেবেই আমিও কিনে নিলাম বাড়িটি। সেই থেকে তো এখানেই রয়ে গেছি।”
কষা মাংসের বাটিটা নিজের দিকে এগিয়ে, রঞ্জন বলল, “ও! তাহলে এই ব্যাপার, তবে যাই বলুন বাড়িটি কিন্তু খাসা, শুধু একটু পুরনো বটে।”
রঞ্জনের কথার সাথে সুর মিলিয়ে আমিও বাড়িটির বেশ প্রশংসাই করলুম।
উত্তরে জ্যাঠামশাই জানালেন, “হ্যাঁ, একটু পুরনো তো বটেই। তবে তোমরা তিনতলার দিকের ঘরগুলোতে থাকতে পারো; ওগুলো আবার নতুন করে সাজানো হয়েছে।
নন্দলালবাবুকে আমাদের থাকার ঘরের ব্যবস্থা করতে বলে ও আমাদেরকে বাকিটা বুঝিয়ে দিয়ে জ্যাঠামশাই খাওয়ার টেবিল ছাড়লেন। সন্ধের আগেই তিনি রওনা দিলেন। অতঃপর এই রাজপ্রাসাদসম বাড়িতে এখন মানুষ বলতে আমি, রঞ্জন আর নন্দলালবাবুই।
দুপুরের ভাত ঘুমের পর আমি আর রঞ্জন ঠিক করলাম বাড়ির আশপাশের সাথে সাথেই বাড়ির ভিতরটাও ঘুরে দেখবো। পরিকল্পনা অনুযায়ী বেরিয়েও পরলাম। বাড়িটির আশেপাশে যতদূর চোখ যায় দোকান বাজার তো দূরের কথা কোনও জনমানবের অস্তিত্ত্বটুকু পর্যন্তও নেই। চারিদিকে বাঁশের বন আর ঘন গাছের কারণে সূর্যাস্তের আগেই সন্ধ্যা নেমে এল। অতঃপর ফিরে এলাম বাড়ির ভিতরে। এবার পালা বাড়ির ভিতরের অংশ ঘুরে দেখার। একাল সেকালের বনেদিয়ানা কারুকার্য আর শাল সেগুনের অসম্ভব সব তাক লাগানো আসবাবপত্রে প্রতিটা ঘর যেন একে অন্যকে টেক্কা দিতে চায়। ব্যতিক্রমী খালি একটি ঘর। ঘরটির দরজার আস্ত একটা তালা ঝোলানো। আশ্চর্য লাগল এটা দেখে যে সে তালায় বিগত কয়েকবছরে কারোর হাত পড়েছে বলে মনে হয় না। বন্ধ ঘর ঘিরে কৌতুহল যেন ক্রমশই জমাট বাঁধতে লাগল। ভাবলুম নন্দলালবাবুকেই একবার জিজ্ঞেস করে দেখব।
রঞ্জন তখন চায়ের জন্য নন্দলালবাবুকে বলতে গিয়েছিল। আসা মাত্রই রঞ্জন বলল, “একেবারে ঠিক জাগায় এসে দাঁড়িয়েছিস দেখছি, এই তিনতলাতেই সিঁড়ি দিয়ে উঠে প্রথম এবং দ্বিতীয় ঘরটিতেই আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে বাকি দিনগুলোর জন্য।”
“এখন চল চা না হলে আবার জুড়িয়ে জল হয়ে যাবে”
চায়ের জন্য নিচে নেমে এলাম ঠিকই কিন্তু মনটা যেন সেই বন্ধ ঘরের সামনেই পড়ে রইল।
আর দ্বিধা না করেই নন্দলালবাবুকে জিজ্ঞেস করে বসলুম, “আচ্ছা, নন্দলালবাবু আপনি তো এ বাড়িতে আছেন বেশ অনেকদিন হল। বলতে পারেন তিনতালার শেষের দিকের ঘরটা বন্ধ কেন?”
“আজ্ঞে এ ব্যাপারে আমার তো কিছু জানা নেই বাবু! যবে থেকে এ বাড়িতে এসেছি আপনার মতো আমিও ও ঘর কে ওরকম বন্ধই দেখেছি। মালিককেও কখনও কিছু জিজ্ঞেস করিনি এ ব্যাপারে। আপনিই বলুন না চাকর হয়ে আর কতটুকুই বা জিজ্ঞেস করা যায়, তাই আর সাহস হয়ে উঠেনি।”
“না, না ঠিক আছে, মনে কৌতুহল জাগল তাই জিজ্ঞেস করলাম আর কি!”
“আচ্ছা,বাবু আপনারা রাতে কি খাবেন যদি বলেন?”
“দুপুরে খাওয়াটা একটু বেশিই হয়ে গেছে তাই হালকা কিছু হলে ভালোই হত।”
নন্দলালবাবুকে রাত্রের খাবার সম্পর্কে যথাযথ নির্দেশ দিয়ে আমরা ছাদের দিকে রওনা হলাম।
ঘুটঘুটে অন্ধকার আর চারিপাশের নিস্তব্ধতায় সদ্য পরিচিত বাড়িটিকে যেন অচেনা মনে হতে লাগল। সকালে যে বাড়িটি দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলাম রাতের অন্ধকার বাড়তেই তাকে দেখে কেমন যেন ভয় ভয় ঠেকতে লাগল। ভয়টা যে আমার আগাগোড়াই একটু বেশি! রঞ্জন অবশ্য ব্যতিক্রমী ব্যাটার ভয় ডর বলে কিছু নেই। এই তো এখনি লোডশেডিং হতেই মোমবাতি আনতে ওই ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যেই নিচে গেছে নন্দলালবাবুর কাছে। আমার তো বাপু ভেবেই কেমন গলা শুকিয়ে আসছে।
মোমবাতি হাতে রঞ্জন হাজির হলেই, কিছুটা ভয় ভয় করেই নিচে নেমে এলাম।
ততক্ষনে খাবার নিয়ে নন্দলালবাবু টেবিলে অপেক্ষা করছে। তাই আর বিলম্ব না করেই খেতে বসে গেলাম। খেতে খেতে রঞ্জন নন্দলালবাবুকে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা নন্দলালবাবু,আজ রাতে কি আর পাখা ঘোরার সম্ভবনা আছে?”
নন্দলালবাবুর উত্তর, “আজ্ঞে বাবু আজ রাতে তো আর আসবে বলে মনে হয় না।”
কিছুটা উদ্বেগজনক ভাবেই আমি বললাম, “বলো কি হে! এই ভ্যাপসা গরম আর আলো ছাড়াই সারাটা রাত কাটাতে হবে।”
“আজ্ঞে বাবু তাছাড়া তো আর কিছু উপায় দেখছি না। পারলে দরজা-জানালা খুলে রাখবেন, তাহলে গরম কিছুটা কম হবে আর কি।”
শুনেই আমার চক্ষু চড়কগাছ হওয়ার উপায়। এই নির্জন, অন্ধকার বাড়িতে দরজা খুলে ঘুমোবো, রক্ষে করো বাপু!
কথাটা শোনা মাত্রই নন্দলালবাবু আর রঞ্জন একযোগে হেসে উঠলেন। আমিও আর কিছু বললাম না।
কিছুটা অস্বস্তি নিয়েই খাওয়া দাওয়া সেরে উঠলাম।
নন্দলালবাবু একেবারে যে নিখুঁত পরিশ্রমী মানুষ তাতে আর সন্দেহ নেই। আগে থেকেই আমাদের দুজনের ঘরে মোমবাতি আর টর্চের ব্যবস্থা করে রেখেছেন পাছে রাত্রে আমাদের প্রয়োজন পরে তাই আর কী।
সিঁড়ি দিয়ে উঠে তিনতলায় প্রথম ঘরে রঞ্জনের এবং দ্বিতীয় ঘরটাতে আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে।
এতকিছুর মধ্যেও সেই বন্ধ ঘরের পেছনে রহস্যটা কী এবং কেনই এত জলের দরে ওই ভদ্রলোক বাড়িটি বিক্রি করলেন তা মাথায় ঘুরতে লাগল।
ঘড়িতে তখন পৌনে দশটা, রঞ্জন নিজের ঘরে যেতেই দরজা জানালা বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম। আগের দিন রাতের ক্লান্তি এখনও চোখে মুখে স্পষ্ট। তাই বন্ধ ঘর সম্পর্কে যাবতীয় চিন্তা ভাবনা দূরে রেখে ঘুমিয়ে পড়লাম।
প্রায় দু-আড়াই ঘন্টা ঘুমের মনে হল কেউ যেন একটা দরজা ধাক্কাচ্ছে, ঘুমের ঘোরে আর কিছু না ভেবেই আবার পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়লাম।
কিছুক্ষন পর আবার সেই একই শব্দ, তবে এবার আগের তুলনায় কিছুটা জোরে।
এবার পাশ ফেরার পরিবর্তে বিছানার উপর উঠে বসলাম। সারা ঘর জুড়ে তখন শুধুই অন্ধকার। মোমবাতি অনেক আগেই নিভেছে। মনে মনে ভাবলাম, কোনও কারণে কি তাহলে রঞ্জন। কিন্তু ও যেরকম ঘুমকাতুরে এরকমটা তো হওয়ার কথা নয়।
শব্দটা তখনও হচ্ছে,হয়েই চলেছে অনবরত। বিছানার পাশে থাকা টেবিলের উপর থেকে টর্চটা হাতে নিয়ে দরজার উপর আলো ফেলতেই শব্দটা বন্ধ হয়ে গেল। এবার খাট থেকে নেমে দরজার সামনে হাজির হলাম।
“কেএএ, কে এত রাতে দরজা ধাক্কাচ্ছে!” কোনও উত্তর নেই। দরজাটা খুলে বাইরে বেরোতেই দেখলাম দরজার বাইরে তো দূরের কথা গোটা বারান্দাতেই কেউ নেই।
ছুটে গেলাম রঞ্জনের ঘরের দিকে, দেখলাম রঞ্জনের ঘরের দরজাটা হাট করে খোলা।
মনে মনে ভাবলাম তাহলে কি রঞ্জন কোনও কারণে এসেছিল? তবে যায় যদি তাইই হয় তাহলে একবার গিয়ে জিজ্ঞেস করে আসাই ভাল।
রঞ্জনকে জিজ্ঞেস করে যা জানলাম তাতে চোখ কপালে ওঠার জোগাড়।
গরম একটু বেশি থাকাতে রঞ্জন রাতে দরজা খোলা রেখেই ঘুমিয়ে ছিল।আর সে আমার ঘরের দরজাতেও ধাক্কা দিতে যায়নি।
তবে কি নন্দলালবাবু? না! নন্দলালবাবু তো থাকেন একতালা তে আর এত রাতে আমাকে ডাকবেনই বা কেন? ডাকার হলে আমাকে না পেয়ে রঞ্জনকেও নিশ্চয়ই ডাকত। তা যখন ডাকেনি তখন নন্দলালবাবুও না। তবে দরজা ধাক্কালো কে?
এই চিন্তা করতে করতে ঘরে ফিরে এসে আবার দরজাটা বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম। ঘড়িতে তখন প্রায় দেড়টা বাজতে রায়।
ঘুম আবার কিছুটা ধরে এসেছে তখনই ঘটল এক আশ্চর্য ঘটনা।
কর্কশ শব্দে কে যেন কানের মধ্যে ফিসফিসিয়ে বলছে, “দরজাটা খোলো, খুলে দাও দরজাটা। আওওওওমি বেরোবো, আমার যে দম বন্ধ হয়ে আসছে!”
মূহুর্তের মধ্যে উঠে বসলাম বিছানার উপরে, ততক্ষনে হাড় হিম হয়ে এসেছে আমার। শিরা-উপশিরা দিয়ে বইছে ভয়ের শীতল স্রোত। দরজা টা আবারও কে যেন ধাক্কা দিচ্ছে তবে এবার বিগত বারের তুলনায় আরও জোরালো হয়েছে শব্দটা। টর্চটা জালিয়েই চিৎকার করে উঠলাম “কেএএএএ! কে দরজা ধাক্কাচ্ছে?”
কিছুটা ভয় আর বিস্ময়ের সঙ্গে উত্তর এল, “আওও..মি রঞ্জন দরজাটা খোল।”
আর দেরি না করেই দরজাটা খুললাম। দেখলাম দরজার সামনে বিধ্বস্তের মতো দাঁড়িয়ে আছে রঞ্জন যেন ভূত দেখেছে এমন। ঘড়িতে তখন দুটো বেজে পনেরো মিনিট হতে যাচ্ছে।
ভয়ের কারণ জানতে চাইলে সে জানাল, আমার মতো একই কর্কশ শব্দ সেও শুনেছে।
এতক্ষণ ব্যাপারটা অদ্ভুতুড়ে বলে মনে হলেও এখন তা সত্যি সত্যি ভুতুড়ে বলেই মনে হল। অতঃপর দুজনে ঠিক করলাম আর আলাদা ঘরে নয় একসাথেই বাকি রাতটুকু এক ঘরেই কাটিয়ে দেবো। দরজাটা আবার বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম কিন্তু ঘুম আর এল না। কিছু সময় যেতেই আবার সেই একই কর্কশ শব্দ তবে এবার তার সাথে যেন কারো কান্নার শব্দ এসে মিশেছে। দরজাটা আবার কেউ ধাক্কাতে শুরু করেছে।
টর্চটা হাতে নিয়ে বললাম, “না, না আর থাকা যায় না। এবার পুরো ব্যাপারটা বাইরে গিয়েই খতিয়ে দেখতে হবে দেখছি।”
রঞ্জনও আমার সাথে টর্চ হাতে বেরোবার জন্য প্রস্তুত হয়েছে ঠিক এই সময় দরজার সামনে থেকে মনে হল এক ছায়ামূর্তি সরে যাচ্ছে। আশ্চর্য লাগল এটা দেখে যে সেই ছায়ামূর্তি ওই বন্ধ ঘরের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। আমরাও পিছু নিলাম সেই ছায়ামূর্তির। তারপর যা দেখলাম তাতে আর সন্দেহ নেই যে এ বাড়ি ভুতুড়ে।
বিকেলের সেই তালাবন্ধ ঘর এখন আর বন্ধ নেই। মেঝেতে পড়ে আছে সেই মরচে পড়া আস্ত তালাটি। দেরি না করেই প্রবেশ করলাম সেই ঘরে। কান্নার শব্দটা এখন আর হচ্ছে না। মাকড়সার জাল আর ধুলোর অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না সে ঘরের ভিতরে। তবে এটা পরিষ্কার যে কর্কশ কান্নার শব্দ আর ছায়ামূর্তির উৎস এই ঘরই। তবে এখন যেন সবকিছুই আবার আগের মত হয়ে গেছে শান্ত আর নির্জন।
হঠাৎ করেই মনে পড়লো নন্দলালবাবুর কথা। নন্দলালবাবু থাকেন একতালা তে কাজেই সেই বন্ধ ঘর ছেড়ে রওনা দিলাম নন্দলালবাবুর ঘরের দিকে। সিঁড়ি বেয়ে তখনও এক তালাতে পৌঁছয়নি, শব্দটা আবার ও শুরু হয়েছে তবে এবার আমাদের পিছু পিছু কেউ যেন এগোচ্ছে মনে হল।
নন্দলালবাবুও দরজাটা আলগা করেই শুয়েছিলেন।
নন্দলালবাবু, নন্দলালবাবু….. উঠুন একটু, একটিবারের জন্য।
চোখে আঙ্গুল ঘষতে ঘষতে আর লম্বা হাই তুলে নন্দলালবাবু বললেন, “আজ্ঞে বাবু আপনারা এত রাতে! কোনও কিছু প্রয়োজন, আপনারা ঠিক আছেন তো?”
নন্দলালবাবুর কথাই কেমন যেন খটকা লাগল। “আচ্ছা, নন্দলালবাবু আপনি কি কোনও কান্নার শব্দ শুনেছেন।”
“আজ্ঞে বাবু এ আপনি কি বলছেন! এই রাত বিরেতে কান্নার শব্দ কেন শুনব, আর কাঁদার মতো এ বাড়িতে আছেই বা কে!”
রঞ্জন বলল, “তাহলে শোনেননি বলেছেন?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ বাবু। মিছে কথা কেন কইবো।”
“আচ্ছা তাহলে আপনি আমাদের সাথে একবার তিনতলায় চলুন দেখি। ওখানে কি সব আজগুবি কান্ড ঘটছে, আমরা তো ঠিক করে ঘুমোতেই পারলাম না।”
“আজ্ঞে বাবু আজগুবি কান্ড! বলেন কি?”
“হ্যাঁ, আজগুবি কান্ডই বটে। সেই তালাবন্ধ ঘরের দরজা কে যেন খুলে তালাটি মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। আর সে ঘর থেকে বিদঘুটে সব আওয়াজও আসছে। চলুন, আপনি আমাদের সাথে একবার না গেলে ঠিক বুঝতে পারবেন না।”
নন্দলালবাবু কিছুটা হেসেই উত্তর দিলেন, “আজ্ঞে বাবু আপনারা যখন বলছেন তখন আমি যাচ্ছি ঠিকই, কিন্তু আমার মনে হয় এ আপনাদের চোখের ভুল। সে তালা খোলে এমন সাহস কার আর আছে!”
নন্দলালবাবুর কথাই এখন যেন কেমন সন্দেহজনক লাগছে ওনাকে। মনে হল তিনি বোধহয় সবই জানেন কিন্তু তাও কিছুতেই মুখ খুলতে নারাজ।
আচ্ছা, চলুন তবে যাওয়া যাক,গিয়েই না হয় দেখা যাবে, কে ঠিক – আমার অভিজ্ঞতা না আপনাদের চোখে।
নন্দলালবাবুর অভিজ্ঞতার কাছে হার মানল আমাদের দৃষ্টিশক্তি। সেই ঘরের সামনে পৌঁছতেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠলেন নন্দলালবাবু।
কি বাবু, আগেই তো বলেছিলুম, এ আপনাদের চোখের ভুল বই আর কিছু নয়।
সত্যিই বোধহয় তাই, সে ঘরের দরজা বিকেলে যেমন তালা বন্ধ অবস্থায় দেখেছিলাম এখনও ঠিক সেই অবস্থাতেই আছে,এতটুকুও এদিক ওদিক হয়নি সে। ভয় আর পরবর্তী রাতটুকুর কথা ভেবে হাড় হিম হয়ে আসছে আমার। রঞ্জন আর আমি একে অন্যের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।
না, না এ কিছুতেই হতে পারে না। এই তো কিছুক্ষন আগে অবধি এই ঘর খোলা অবস্থাতেই পড়েছিল। এখন কি করে বন্ধ হতে পারে, আর বন্ধ করবেই বা কে।
রঞ্জন ও আমার কথার সাথে কথা মিলিয়ে, “এ যে দেখছি ভুতুড়ে কান্ড!”
নন্দলালবাবুর মুখে তখনো একই কথা, “আজ্ঞে বাবু আপনাদের নেশ্চই কোনও ভুল হচ্ছে, এরকম কিছু আগে কোনদিন তো এ বাড়িতে ঘটেনি।”
নন্দলালবাবুর সাথে তখনও আমাদের কথাবার্তা চলছে ঠিক এইসময় রঞ্জনের ঘর থেকে বিকট অদ্ভুত এক বিকট শব্দের আওয়াজ এল মনে হল যেন কেউ ঘরের জিনিসপত্রগুলো ফেলতে শুরু করেছে। ছুটে গেলাম রঞ্জন আর আমি ঘরের দিকে। আমাদের ধারনাটাই ঠিক প্রমানিত হল। ঘরের সমস্ত জিনিস কে যেন মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। কিছু বুঝে উঠার আগেই ঠিক একই শব্দ এবার আমার ঘর থেকেও এল। কোনও দিকে না তাকিয়েই দৌড়ে গেলাম আমার ঘরে। ঘরে পৌঁছতেই আমি দেখলাম এক ছায়ামূর্তি আমার দিকে আঙ্গুল উঁচিয়ে ঘর ছাড়ার নির্দেশ দিচ্ছে, কাউকে ডাকার আগেই আমি জ্ঞান হারালাম।
জ্ঞান ভাঙতেই দেখি রঞ্জন আমার পাশে বসে এবং নন্দলালবাবু মেঝেতে বসে ঝিমোচ্ছেন। তখন প্রায় ভোর হয়ে এসেছে। ভয়টা আমার তখনও কাটেনি চোখ বুজলেই ভেসে উঠছে সেই ভয়ঙ্কর ছায়ামূর্তির চেহারাটা।
কিছুটা বিরক্তি নিয়েই রঞ্জন বলল,”না, না এরপর এ বাড়িতে আর এক মুহূর্তও নয়।”
কাল সকাল হতেই আমরা এ বাড়ি ছেড়ে কলকাতা রওনা হব।
“আজ্ঞে বাবু এ আপনি কি বলছেন! বড়বাবু না ফেরা অবধি আপনারা যে এ বাড়ির অতিথি। আপনাদের আপ্যায়নে যেন কোনও ত্রুটি না হয় এ যে বড়বাবুর কড়া হুকুম। এখন এভাবে আপনারা চলে গেলে আমি যে এই বয়সে এসে কাজ হারাব। কাজ হারালে দুটি বেলা খাবোই বা কি?”
রঞ্জনের স্পষ্ট উত্তর সে আর এক মুহূর্তও এ বাড়িতে থাকতে রাজি নয়।
আমি বললাম, “আচ্ছা,সে না হয় আপনার চাকরি যাবে না। কিন্তু আমরা এ বাড়িতে থাকতে পারি তবে তার আগে আপনাকে আমাদের কিছু কথা জানাতে হবে।”
নন্দলালবাবু কিছুটা না বোঝার ভান করে, “আজ্ঞে বাবু আমার কাছে আপনাদের কিই বা জানার থাকতে পারে। আর আমি জানিই বা কি!”
সহজ কথায় কাজ হবে না জেনে কিছুটা রেগে গিয়েই আমি বললাম, “দেখুন নন্দলালবাবু আপনি যে সবটা জানেন এ বাড়ি আর বিশেষত ওই বন্ধ ঘর সম্পর্কে তা নিয়ে এখন আমাদের বিন্দুমাত্র ও আর সন্দেহ নেই। এখন আপনি যত তাড়াতাড়ি তা আমাদের কে জানাবেন ততই আপনার পক্ষে মঙ্গল। নতুবা আপনার চাকরিটা বোধহয় আর নাও থাকতে পারে।”
কিছুটা কাঁচুমাচু মুখ করে এবার নন্দলালবাবু বললেন, “আজ্ঞে বাবু এরকমটা করবেন না দয়া করে, তাহলে যে না খেতে পেয়ে মরে যাব।
আপনারা যখন সবটুকুই জেনে গেছেন তখন আর নুকিয়ে লাভ নেই; তাহলে শুনুন, তখন আমি সবে নতুন কাজ নিয়ে এ বাড়িতে এসেছি। এ বাড়ির তখন জমজমাট রাজকীয় অবস্থা। আভিজাত্য এবং জৌলুস যেন ঠিকরে ঠিকরে পড়ছে। এ বাড়ির কত্তা অবনী চাটুজ্জে রায়। তার কথায় এ বাড়িতে এ বাড়িতে কাক পক্ষী ও বসতে সাহস বোধ করে না। বাপ-দাদুর অঢেল সম্পত্তি আর নিজের ব্যাবসার জেরে তার অহংকার এ মাটিতে পা পড়ে না। অর্থ, মান যশ ছাড়া তিনি আর কিছুই বোঝেন না। কোনও সম্পর্কই তার কাছে নিজের মানের থেকে বড় নয়। তার একমাত্র মেয়ের বয়স যখন ছয় বছরে পড়েছে কর্কট রোগে বউ হারা হলেন কত্তাবাবু। তারপর আর বিয়ে করেননি। এদিকে তার একমাত্র মেয়ে ধীরে ধীরে বড় হতে লাগল। বাপের গুনের সমস্ত বিপরীত গুণই যেন সে পেয়েছে। বন্ধ ঘরের পরিবেশ তার একদম পছন্দ নয়। পরিবর্তে বাইরের পরিবেশ আর বন্ধুদের সঙ্গই তার কাছে মাতৃসম। তবে সেই ভালোলাগাই তার কাছে কাল হয়ে উঠেছিল। একমাত্র মেয়ে একটু বড় হতেই বিত্তশালী পরিবারের এক ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে ঠিক করলেন কত্তাবাবু।
বিয়ের কথা মেয়ের কানে যেতেই সে ও পণ করল এ বিয়ে সে করবে না। তার মতে এখনও তার বিয়ের বয়স হয়নি। কিন্তু কে শোনে কার কথা, কত্তাবাবুও জেদ ধরলেন এ বিয়ে হবেই। কত্তাবাবুর জেদের কাছে হার মেনে ছোট্ট মেয়েটি মা হারা দুঃখ আর অভিমানে নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে বসলো। দিনের বেশিরভাগ সময়ই সে ঘরের দরজা বন্ধ করে রাখে তখন। এরপর একদিন ছেলের বাড়ি থেকে মেয়েকে আশীর্বাদ করতে এলেন কয়েকজন। মেয়ের আশীর্বাদ ঘিরে অঢেল আয়োজন করেছেন কত্তাবাবু। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সবটাই মাটিতে মিশল। আশীর্বাদ গ্ৰহণের পরিবর্তে ছেলের বাড়ির লোকজনের মুখের উপর সে বলে বসে যে, এ বিয়ে করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। সে এখনও বিয়ের যুগ্যি হয়নি। এই কথায় তার কাছে কাল হয়ে উঠল, নিজেই সে নিজের মৃত্যু ডেকে এনেছে।
একবাড়ি লোকের সামনে লজ্জায় মাথা কাটা গেল কত্তাবাবুর। চোখে মুখে তার তখন শয়তান বাসা বেঁধেছে। হিড় হিড় করে টানতে টানতে একমাত্র মেয়েকে নিয়ে গিয়ে তালাবন্ধ করলেন তিনতালার সেই ঘরে। স্পষ্ট হুকুম করলেন কেউ যেন তার দরজা খোলা তো দূরের কথা তাকে একফোঁটা জল ও না দেয়। এরপর বেশ কয়েকদিন গেলেও কত্তাবাবু কঠোরই রইলেন। সকাল থেকে রাত অবধি সে ঘরের দরজা ধাক্কায় আর বলে, “দরজাটা খোলো, খুলে দাও দরজাটা। আওওওওমি বেরোবো, আমার যে দম বন্ধ হয়ে আসছে।”
এরপর একদিন হঠাৎ করেই দরজা ধাক্কানো বন্ধ হয়ে গেল। তবুও কত্তাবাবু কঠোরই রইলেন। এরপর যতদিনে সে ঘরের দরজা খুললেন ততক্ষনে সব শেষ। ফুটফুটে ছোট্ট শরীরটায় তখন পচন ধরে গেছে। মানুষ পচা গন্ধে সারা বাড়িতে তখন টেকবার উপায় নেই। বাবু তখনও কঠোরই রইলেন বললেন, “দুষ্টু গরুর থেকে শূন্য গোয়াল অনেক ভালো, গেছে না আপদ বিদেয় হইছে।”
শেষকৃত্যটুকুও করতে রাজি হননি পরিবর্তে সেই ঘরের দরজা অমন অবস্থাতেই বন্ধ করে রেখেছিলেন। তারপর থেকে সে ঘরের দরজা ওই একই রকম ভাবে বন্ধই পড়ে থাকে। এরপর কত্তাবাবু আর বেশিদিন বাঁচেননি। শেষ দিকে তিনি প্রায়শই দমবন্ধ আর জলকষ্ট অনুভব করতেন। অথচ তার দেখাশোনা আর চিকিৎসকের জন্যে হাজারও একটা লোক ছিল।
তারপর জল অনেক দূর গড়িয়েছে এ বাড়ির মালিকানা ও বেশ কয়েকবার বদলেছে।
অনেকেই এ বাড়িতে এসেছিলেন বাড়িটিকে ভালোবেসে থাকতেও চেয়েছিলেন তবে শেষ পর্যন্ত মাস দুয়েক এর বেশি কেউ আর থাকতে পারেন নি। শুধু রয়ে গেছি আমি।
অনেক চেষ্টা করার মুখ দিয়ে কথা বেরোলো আমার বললাম, “এ আপনি কী গল্প শোনালেন নন্দলালবাবু! অহংকার, প্রতিপত্তি আর জেদের বশে একটা মানুষ যে এতটা নিষ্ঠুর হতে পারে তা বোধহয় এর আগে কখনও শুনিনি।”
রঞ্জন বলল, “আচ্ছা, নন্দলালবাবু আপনার বড় কত্তা মানে আমাদের জ্যাঠামশাই এ ব্যাপারে কিছু জানেন।”
মাথা ঘুরিয়ে নন্দলালবাবু বললেন, “আজ্ঞে বাবু, না।”
“তাহলে এবার বোঝা গেল কেন জ্যাঠামশাই এত কম দামে এ বাড়ি হাতে পেয়েছিলেন, কি তাই তো নন্দলালবাবু?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ বাবু আপনি ঠিকই ধরেছেন।”
“আচ্ছা নন্দলালবাবু, জ্যাঠামশাই তো এ বাড়িতে এসে উঠেছেন বেশ অনেক দিনই হল। ওঁর সাথে কখনও এরকম হয়েছে বলে তো মনে হয় না । কি বলিস রঞ্জন?
“হ্যাঁ, একদম। তাই ই যদি হবে তাহলে জ্যাঠামশাই এতদিনে এ বাড়িতে আর থাকতেন না।”
“আচ্ছা নন্দলালবাবু, এর পেছনে কি কারণ থাকতে পারে বলে আপনার মনে হয়?”
“আজ্ঞে বাবু অত কারণ টারন এর ঘোর প্যাঁচ আমার এই মোটা মাথায় ঢোকে না। তবে এটুকু বলতে পারি যে, “বড়বাবুর গরমটা আগাগোড়াই একটু বেশি, দরজা না খোলা রেখে রাতে তিনি ঘুমোতে পারেন না। তবে যেদিন থেকে দরজা বন্ধ করে ঘুমানোর অভ্যাস করবেন তারপর কী হবে সে আমি বলতে পারব না। হয়তো তারপর দিনই এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে পারেন।”
দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে এবার আমি বললাম, “আচ্ছা, তাহলে এই ব্যাপার। মোদ্দা কথা হল এ বাড়িতে যে বা যিনিই আছেন ওই বন্ধ ঘর আগলে; তিনি কিছুতেই চায় না যে এ বাড়ির কোনও দরজা বন্ধ হোক। তা সে রাতেই হোক বা দিনে। কী নন্দলালবাবু আমি কিছু ভুল বললাম কি?”
আজ্ঞে না বাবু, “আপনি ঠিকই বলেছেন।”
নন্দলালবাবু আরও বললেন, “আজ্ঞে বাবু সবটাই তো আমি আপনাদের বললুম আর আপনারাও সবটুকুই শুনেছেন। এখন বড়বাবু যতদিন না ফেরেন আপনাদের থাকার ব্যবস্থা আমি একতালাতেই করি! কি বলেন বাবু?”
রঞ্জন এবার আর না করল না। আমিও রঞ্জনের সুরে সুর মিলিয়ে বললাম, “হ্যাঁ, তাছাড়া যে আর কোনও উপায় দেখছি না আমি।।”
ততক্ষনে সকাল হয়ে গেছে। নন্দলালবাবু আমাদের জন্য চায়ের ব্যবস্থা করলেন আর থাকার ব্যবস্থা করলেন একতলার দুটি ঘরে।
এরপর আরও দুটো দিন ওই বাড়িতেই কাটল আমাদের। তবে কোনরকম কোনও ভৌতিক কান্ড ছাড়াই। অবশ্য এর পেছনে যথেষ্ট কারণও আছে। বিগত দুই রাতেই আমরা ঘরের দরজা খোলা রেখেই ঘুমিয়েছিলাম।
সন্ধ্যার ট্রেনে জ্যাঠামশাই ফিরলেন। এ বাড়িতে থাকা খাওয়ার কোনও অসুবিধা আমাদের হয়েছে কিনা তিনি জিজ্ঞেস করলেন। একে অন্যের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে জ্যাঠামশাইয়ের কাছ থেকে বিগত কয়েকদিনের ঘটনা আমরা চেপে গেলাম। এর পেছনে অবশ্য নন্দলালবাবুর কোনও হাত ছিল না।
ঠিক হল পরদিন সকালেই আমরা রওনা দেবো এ বাড়ি ছেড়ে কলকাতার উদ্দেশ্যে।
ফিরে আসার কিছুদিন পর যোগাযোগ করেছিলাম জ্যাঠামশাইয়ের সাথে। জানিয়েছিলাম সেই রাত্রে আমাদের সাথে ঘটে যাওয়া ভয়ঙ্কর ভুতুড়ে কান্ড আর সেই বাড়ির ইতিহাস সম্পর্কে। প্রথমে বিশ্বাস না করলেও নন্দলালবাবুর কথায় তিনি সবটা বিশ্বাস করেন।
এরপর আর জ্যাঠামশাইয়ের সাথে যোগাযোগ হয়নি। তিনি সে বাড়ি বিক্রি করলেন না সেখানেই থেকে গেলেন আর নন্দলালবাবুরই বা কি হল সবটাই এখনও আমাদের কাছে অন্ধকার সেই বন্ধ ঘরের ভিতরের মতোই। তবে হাজার চেষ্টা করেও সেই ভয়ঙ্কর রাত আর সেই ছায়ামূর্তির কথা মন থেকে এখনও ভুলে উঠতে পারিনি।