প্রতিশোধ | পলক ফেলা নিষেধ |দীপঙ্কর পইড়া | Bengali Thriller Story
0 (0)

Getting your Trinity Audio player ready...

স্কুল থেকে একা টিফিনের সময় বাড়ি ফেরার পথে, শ্মশানের কাছে আসতেই তনুর গা ছমছম করে উঠল৷ “তনু” মানে তনুশ্রী, দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রী সে৷ কাকুর ছেলের মুখে ভাত, তাই ছুটির আগেই স্যারকে বলে বাডির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিল৷ অন্যান্য দিন বন্ধুরা সাথে থাকায় মনের কোনে কোনও উদ্বেগের অস্তিত্ব অনুভব করেনি সে৷ কিন্তু আজ কেন এমন হল সে বুঝে উঠতে পারলো না৷ নিজেকে সামলে নিয়ে শ্মশানটা পেরিয়ে লোকালয়ে প্রবেশ করতেই ভয় কেটে গেল তার। বাড়ির কাছাকাছি চলে আসার পর, তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিল তার পিছনে কেউ আসছে। পিছন ফিরে দেখে কেউ কোথাও নেই৷ বাড়ি ফিরে অনুষ্ঠানের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়ায় সে সমস্ত কিছু ভুলে গে৷ রাতে ডিনার সেরে শুধু নাইট বাল্প জ্বালিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল তনু৷ মাঝ রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল তার৷ কেমন যেন একটা খস খস শব্দ শুনতে পেল সে৷ অস্পষ্ট আলোয় স্পষ্ট দেখল দরজার পাশ থেকে একটা অন্ধকার ছায়া মূর্তি নিঃশব্দে এগিয়ে আসছে তার কাছে৷ তনু অনুভব করল কেউ যেন তার পাশে বিছানায় এসে বসল৷ হাত,পা অসাড় হয়ে আসছে তার, চিৎকার করে মা,বাবাকে ডাকতে চাইল কিন্তু পারলো না৷ এমন সময় একটা বরফের মতো ঠান্ডা কিছু স্পর্শে চমকে উঠল সে৷ তারপর দেখতে পেল একটা অস্পষ্ট ধোঁয়ার মতো কিছু অংশ ঘুরতে ঘুরতে একটা অবয়ব তৈরি হল৷ ধীরে ধীরে মানুষের মতো রূপ ধারন করল সেটা, এবার তনু আরও ভয় পেয়ে গেল৷ অবয়ব টি সম্পূর্ণ রূপ ধারণ করার পর তার খুব চেনা চেনা বলে মনে হল৷ ও হ্যাঁ, এটা তো তার খুব প্রিয় বান্ধবী রিমির মূর্তি৷ যে প্রায় দুই বছর আগে রাস্তার পাশে খেজুর গাছে আত্মহত্যা করেছে৷ হঠাৎ একটা কর্কশ অথচ মেয়েলি কন্ঠে বলে উঠল “তুই আমার কাছে আয়, আমি অনেক দিন একা একা আছি৷ তোকে ছেড়ে থাকতে পারছি না, আমি প্রত্যেকদিন তোর উপরে নজর রাখি৷ তুই কোথায় যাস, কী করিস। কারণ তোকে আমার প্রয়োজন৷ আমি আমার প্রতিশোধ তোর মাধ্যমেই নেব৷ আমি তোর বাড়ির পাশের এই খেজুর গাছে থাকি, এবার তোকে নিতে এসেছি৷ ছোটবেলার মতো আমরা দুজন একসঙ্গে থাকব, একসঙ্গে খেলাধুলা করব। তুই আমার সাথে আয়।” তার পর তনুর হাত ধরে টানতে লাগল মূর্তিটি৷ তনুর হাত, পায়ের মতো এবার মুখও কাজ করল না৷ এক সময় সমস্ত শক্তি একত্রিত করে চিৎকার করে বলে উঠল, “বাঁচাও! বাবা বাঁচাও!” আচমকা ঘুম ভেঙ্গে গেলে তনু দেখল একা বিছানায় শুয়ে আছে সে। কয়েক সেকেন্ড অতিবাহিত হওয়ার পরেই সে বুঝল, ঘুমন্ত অবস্থায় স্বপ্ন দেখেছিল৷ এবার নিজেকে নিজেই লজ্জিত বলে মনে করল সে৷ পাশের রুম থেকে তার মা, বাবা হঁক দিলেন, “কী হয়েছে রে তনু?”

লজ্জিত হয়ে বলল, “কিছু না মা, স্বপ্ন দেখছিলাম একটা৷”

ভোর হতেই সূর্যের দীপ্তিমান আলোয় রাতের কথা ভুলেই গেল তনু৷ সকালের পড়া, স্কুল, বিকালে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মেরে আর মনে রইল না কিছু৷ রাতে শুতে যাওয়ার সময়ও সেই কথা মনে পড়ল না তার৷ মধ্য রাতে আবার হঠাৎ তনুর ঘুম ভেঙে গেল৷ গতকালের মতো আজকেও সে নাইট বাল্পের অস্পষ্ট আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেল, সামনে দাঁড়িয়ে আছে দুই বছর আগে মরে যাওয়া তার ছোটো বেলাকার বন্ধু রিমি৷ হৃদস্পন্দন বাড়তে লাগল তার, আজকে নিশ্চয়ই ভুল দেখছে না গতকালের মতো৷ আজকেও সে চিৎকার করতে চেষ্টা করল কিন্তু বিফল হল৷ ধীরে ধীরে অশরীরীর আত্মা তার খাটে এসে বসল৷ রাগান্বিত কন্ঠে বলল, আমি তোকে নিয়ে যেতে এসেছি, তুই চল৷ মন্ত্রমুগ্ধের মত তনু বিছানা থেকে উঠে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল, বাড়ির দরজার গেট খুলে বাইরে বেরিয়ে গেল সে৷ বাড়ি থেকে প্রায় পাঁচশো মিটার দূরে একটা বড় খেজুর গাছ, সেই গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়াল ছায়ামূর্তিটি৷ তাকে অনুসরণ করে তার কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল রিমি৷ ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে গাছে উঠে গেলে তাকে অনুসরণ করে রিমিও গাছের কিছুটা অংশ উঠে ঝপ করে নিচে পড়ে গেল৷ ভোর হল, পাখির কিচিরমিচির গানের শব্দে ঊষার অবসানের পর সূয্যিমামা উদয় হল৷ বাড়ির সমস্ত দরজা খোলা দেখে তনুর মা-বাবা অবাক হয়ে গেল। ঘরে তনুকে না দেখতে পেয়ে প্রতিবেশীরাও সবাই মিলে খোঁজাখুঁজি শুরু করল৷ তনুর পাড়ার এক দাদা মৃনাল, বড় খেজুর গাছের নিচে সংজ্ঞাহীন ভাবে তনুকে পড়ে থাকতে দেখে সবাইকে খবর দেয়৷ চোখেমুখে জল দিতেই জ্ঞান ফিরল তনুর৷ সবার প্রশ্নের জবাবে সে বলল, কিভাবে এখানে এসেছি কিছুই জানি না৷ সবাই ভাবল সম্ভবত ঘুমের ঘোরে চলে এসেছে৷ এরপর কেটে গেল সপ্তাহ খানেক নির্ঝঞ্ঝাট ভাবে৷ সবকিছুই ঠিক আছে কোন সমস্যা নেই৷ তবে স্কুল থেকে ফিরে বিকালবেলায় বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে যায় না, খেজুরগাছের নিচে বসে থেকে একা একা গুন গুন করে গান গায়। দেখে যেন মনে হয় কার সঙ্গে কথা বলে সে, কখনো কখনো গম্ভির হয়ে যায় l প্রথমেই এ কথা কেউ জানত না, কিন্তু তার কাকুর মেয়ে মুন একদিন দেখল খেজুর গাছের নিচে একা একা হেসে যাচ্ছে৷ অদৃশ্য কারও সঙ্গে যেন মনের সুখে কথা বলে যাচ্ছে৷ তৎক্ষণাৎ তনুর মাকে গিয়ে খবর দিল সে৷ তার মা এসে দেখে চুপচাপ স্থির হয়ে বসে খেজুর গাছের দিকে তাকিয়ে আছে তনু৷ তার মা তাকে সেখান থেকে বাড়ি নিয়ে গেল৷ এর পর থেকে তাদের বাড়ীতে আশ্চর্য রকমের ঘটনা ঘটতে শুরু করল৷ সারাদিন সবকিছু ঠিকঠাকই থাকে কিন্তু রাত্রিবেলা ঘরের মধ্যে বিভিন্ন আওয়াজ শোনা যায়৷ যেন ঘরের মধ্যে কেউ ফুটবল খেলছে৷ ঘরের মধ্যে কোন জিনিসপত্র গোছানো থাকে না, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকে সব চতুর্দিকে৷ একদিন তনুর মা এই ঘটনর কারণ কী জানার জন্য, রাত্রিতে না ঘুমিয়ে অপেক্ষা করবেন বলে ঠিক করলেন৷ রাত তখন প্রায় আড়াইটা তনু দরজা খুলে বাইরে বারান্দায় বেরিয়ে এল৷ তারপর কৃষ্ণপক্ষের ঘন অন্ধকার মোচনের উদ্দেশ্যে উড়ে বেড়ানো জোনাকি পোকা গুলোকে ধরে ধরে খেতে লাগল৷ হাত দুটি অনেকটা লম্বা হয়ে গ্রিলের বাইরে থেকে পোকা ধরে মুখে পুরছে৷ দৃশ্য দেখে তনুর মা আতঙ্কিত হয়ে যেই না তাকে ডাকতে যাবে এমন সময় একটি সাদা ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে তনুর সামনে একটি মেয়ে রুপ ধরল৷ তনুর মা রুপা দেবী শিউরে উঠলেন৷ একি! এ কি করে সম্ভব? দু বছর আগে যে মারা গেছে সে কিভাবে এখানে আসতে পারে৷ আর কিছু মনে নেই রুপা দেবীর, জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যান মেঝেতে৷ সকালবেলায় ডাকা ডাকিতে তনুর ঘুম ভাঙল৷ শয্যা ত্যাগ করে দেখে বাড়িতে অনেক মানুষ জড় হয়েছে৷ তার মা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে, মাথা ফেটে রক্ত বেরিয়ে অনেকটা অংশ ভিজে গেছে৷ ডাক্তার কে খবর দেওয়া হল, ডাক্তার এসে ইঞ্জেকশন ও ওষুধ দেওয়ার কিছু সময় পরে রুপা দেবীর জ্ঞান ফিরলো। জ্ঞান ফিরতেই চিৎকার করে বললেন, তনু কই? দরজার পাশেই দাঁড়িয়েছিলো তনু। মায়ের কাছে যেতেই মা যেন তাকে দেখে ভয় পেল, এই কি রাতের সেই তনু? রুপা দেবী তনুর মুখের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। কিন্তু তনুর স্বাভাবিকত্ব দেখে তাকে জড়িয়ে ধরে হাউ – হাউ করে কেঁদে উঠলেন।

তনু বলল, মা তোমার কি হয়েছে?

তুমি কিভাবে পড়ে গিয়ে মাথা ফাটালে?

রুপা দেবী নিরুত্তর থাকলেন।

   নিরুপদ্রব ভাবে দু-দিন কেটে গেল। আবার একদিন গভীর রাতে তনুর পাশে এসে বসল রিমির অতৃপ্ত আত্মা। হিমশীতল হাতের স্পর্শে আতঙ্কিত হয়ে ঘুম থেকে উঠে বসল তনু। এখন আর ভয় পায় না সে। দুই বন্ধু একসঙ্গে বাড়ি থেকে চুপি চুপি বেরিয়ে গেল। রিমির ছায়ামূর্তিকে অনুসরণ করে সেই খেজুর গাছের নীচে এসে দাঁড়াল তনু। পাশে একটা ছোট পুকুর আছে, পুকুরে হাত বাড়াতেই বড় একটা মাছ চলে এল তনুর হাতে। কাঁচা মাছটিকে মনের আনন্দে যত্নসহকারে যখন চিবিয়ে খাচ্ছে, রাস্তার বিদ্যুতের খুটিতে জ্বলা আলোতে সব দেখে চমকে উঠলেন তনুর মা রুপা দেবী। পিছনে কখন যে পিছু নিতে নিতে এতদুর চলে এসেছেন তিনি, তা তনু বুঝতেই পারেনি। কাঁচা মাছ চিবিয়ে খাওয়ার সময় তনুর পিঠে হাত রাখতেই ক্ষুব্দ হয়ে পিছনে ফিরল তনু । এ কি! তনু কোথায়? রক্তাক্ত বিশ্রী মুখমন্ডলে রিমির অবয়ব স্পষ্ট, চোখ দুটো যেন আগুনের গোলা, দাঁতগুলো বেরিয়ে আছে আক্রমন করার ভঙ্গিতে, গাল দুটো কাটা,ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরছে সেখান থেকে।৷ হাত দুয়েক পিছনে লাফিয়ে পিছিয়ে এলেন রুপা দেবী। কিন্তু মেয়ের জীবন বাঁচানোর লক্ষ্যে বুকে সাহস এনে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “রিমি তুই এখানে এসেছিস কেন?”

 “আমার মেয়েকে ছেড়ে দে!”

      আগুন পিণ্ড চোখদুটি আরও জ্বল জ্বল হয়ে গেল নিমেষে। বলল, “হ্যাঁ আমি ফিরে এসেছি, আমি প্রতিশোধ নিতে এসেছি। প্রতিশোধ না নিয়ে আমি তোর মেয়েকে ছেড়ে যাব না। আমি রক্ত খেতে চাই, রক্ত।”

রুপা দেবী বললেন, “তুই বল আমাকে কি করতে হবে, আমি তোর সব কথা শুনব। কিন্তু তনুকে ছেড়ে দে রিমি।”

কর্কশ গলায় রিমির রুপ ধারী তনু বলল, “আমি ছাড়বো না তোর মেয়ে কে, আর যদি তুই জোর করে ছাড়াতে চাষ তাহলে আমিও জোর করে তনুকে আমার কাছে নিয়ে যাব। কথাটা মনে রাখিস। কথাটা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ধপাস্ করে নিচে পড়ে যায় তনুর সংজ্ঞাহীন দেহটি।পুকুর থেকে জল নিয়ে তনুর উপর ছিটিয়ে দিলেন রুপা দেবী। জলের ঝাপটায় জ্ঞান ফিরেলো তার। এত গভীর রাতে হঠাৎ রাস্তায় নিজেকে আবিষ্কার করে মাকে বলল, “আমরা এখানে কেন মা?”

রুপা দেবী বললেন, “কিছুনা, দুজন ঘুরতে ঘুরতে এসে গেছি। চল্ বাড়ি চল্। সেদিন বাকী রাতটুকু না ঘুমিয়ে কেটে গেল রুপা দেবীর। অপরদিকে তনু কিছু একটা আন্দাজ করেছে, সে অনুভব করছে তাকে যেন অন্য কেউ পরিচালনা করছে। এই দুশ্চিন্তায় ও রিমির অতৃপ্ত আত্মার কার্যকলাপে তনু এবং তার মায়ের অবস্থা করুণ হতে লাগল। কথাটা তনু আর তার মায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, কিছুদিনের মধ্যে সব জানাজানি হয়ে গেল।

আশেপাশে মানুষজনও বুঝেছে তনু আর এখন আগের তনু নেই। রিমির অতৃপ্ত আত্মা তাকে ভর করেছে। গোপনে তার বাবা নারায়ন বাবু বহু চেষ্টা করেছেন। তান্ত্রিকের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের তাবিজ, ঔষধ নিয়ে এসেও কোন লাভ হয়নি তনুর।

নারায়নবাবু তার বন্ধুর কাছ থেকে দশ কিলোমিটার দুরে হারাধন তান্ত্রিকের খোঁজ পেলেন। গ্রামের তিন জন লোককে নিয়ে শীঘ্রই তান্ত্রিকের কাছে পৌঁছালেন তাঁরা। হারাধন তান্ত্রিক সমস্ত কথা শুনে কিছু একটা ভেবে বললেন, সামনের অমাবস্যায় আমি তোর বাড়ি যাব। এখন বাড়ি চলে যা।

      পরের দিন আবার একটা অঘটন ঘটানোর চেষ্টা চালিয়েছিল তনু। আসন্ন সন্ধ্যার ধুলোমাখা গোধুলীর রক্তিম আলোয় প্রতিবেশীর মৃনালের উপর হঠাৎই আক্রমন করে বসে সে। ডান পাশের গালের উপর তনুর তীক্ষ নখ বসে যাওয়ায় রক্ত ঝরতে লাগল মৃনালের। ঘটনায় চাঞ্চল্য ছড়ালো গ্রামের মধ্যে। সবাই খুব ভয় পেয়েছে, সন্ধ্যার পর এক থমথমে নিরবতা ঘিরে থাকে বাড়ি চারপাশে। সন্ধেসন্ধের পর তাই কেউ এমুখো হয় না।

    অমাবস্যার সকালে হারাধন তান্ত্রিক তনুর বাড়ি এলেন কিন্তু বাড়িতে প্রবেশ করার আগে গেটের কাছে থমকে দাঁড়ালেন। ভালো করে বাড়িটিকে ও বাড়ির চারপাশটাকে দেখে, তারপর বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করলেন তিনি। রুপা দেবী তনুকে তান্ত্রিকের কাছে নিয়ে এলেন। তনুর চোখের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে হারাধন তান্ত্রিক বললেন, “তোর মেয়েকে ঘরে নিয়ে যা। রুপা দেবী মেয়েকে ঘরে রেখে পুনরায় ফিরে এলেন। তান্ত্রিক বললেন, “আজ খুব কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হবে তোদের। ভাগ্যক্রমে আমি এসে পড়েছি। আজকের রাত খুবই ভয়াবহ, গ্রামের সবাইকে বল আজ সন্ধের পর যেন কেউ ঘর থেকে না বের হয়। এই অমাবস্যার রাতে এক অঘটন ঘটাবে এই অতৃপ্ত আত্মা, চরম প্রতিশোধ নেওয়ার স্বপ্ন দেখছে সে। আজই তোর মেয়ের দিন শেষও হয়ে যেতে পারে, তবে আমি চেষ্টা করবো তাকে বাঁচাতে। এই আত্মা চায়না তোরা কোনও ওঝা বা গুনিনকে খবর দিস। আমি আসায় সে প্রচন্ড ক্ষুব্ধ হয়েছে। তনুর বাবা নারয়ন বাবু হারাধন তান্ত্রিকের পায়ের নিচে পড়ে অঝোর ঝোরে কাঁদতে লাগলেন। বললেন, আপনি আমার মেয়েটিকে বাঁচান বাবা। এই নিষ্পাপ মেয়ে টি কে আপনি বাঁচান। হারাধন তান্ত্রিক বললেন, আমি চলে এসেছি যখন তোদের আর কোনও ভয় নেই । কোন খেজুর গাছের কাছে তোর মেয়ে গিয়েছিল সেখানে আমায় নিয়ে চল। তনুর মা-বাবা এবং কয়েকজন গ্রামবাসীকে নিয়ে হারাধন তান্ত্রিক খেজুর গাছের কাছে যাওয়ার জন্য রওনা দিলেন, বাড়ির পশ্চিম দিকে ধান ক্ষেতের পাশে খেজুর গাছটি রয়েছে। চারিদিকে লতা ও ঝোপ ঝাড়ে আচ্ছাদিত। খেজুর গাছটির থেকে প্রায় একশো মিটার দূরত্বে যাওয়ার পরই, হঠাৎ করে কোথা থেকে যেন একটা প্রচন্ড উটকো ঝড় শুরু হল। যেন খড়কুটোর মত উড়িয়ে নিয়ে যাবে সবাইকে। কিন্তু দূরের গাছের দিকে তাকিয়ে সবাই দেখলেন সেদিকে গাছ একটুকুও নড়ছে না। হারাধন তান্ত্রিক ঝড়ের গতি উপেক্ষা করে নিজেকে সামলে নিয়ে, মন্ত্রপূতঃ জল চারিদিকে ছড়িয়ে দিতেই আশে-পাশের ঝড়ের গতিবেগ তৎক্ষণাৎ কমে গেল। শুধু মাত্র খেজুর গাছ টি প্রচণ্ড বেগে নড়তে লাগল। গাছের শুকনো অংশগুলো বহু দূরে উড়ে গেল, গাছের পাতাগুলো লাফিয়ে পড়ছে। হারাধন তান্ত্রিক সঙ্গে থাকা সকলের উপরে মন্ত্রপুত জল ছড়িয়ে দিলেন। তারপর গাছের চারিদিকে ঘুরে ঘুরে গাছের উপর মন্ত্রপুত জল ছুড়ে মারতেই, মুহূর্তের মধ্যে গাছ স্বাভাবিক হয়ে গেল। গাছের চারিদিকে আরো কিছুক্ষণ মন্ত্র বলে হারাধন তান্ত্রিক তনুর বাড়ি ফিরে গেলেন।

    বিকালে হারাধন তান্ত্রিকের কথা মতো গ্রামের সবাইকে সন্ধ্যার পর বাইরে বেরোতে নিষেধ করে দিলেন নারায়ন বাবু। কারণ আজ গ্রামের কোনও না কোনও বাড়িতে বিপদ অনিবার্য। এরপর তনুর বাড়ির চারিদিকে একটা মন্ত্রপূত গণ্ডি কেটে দিলেন। এবং মন্ত্রপূতঃ জল ছড়িয়ে দিয়ে বললেন, “আজ রাতে যা কিছুই হোক না কেন, বাড়ির বাইরে যাতে কেউ না বেরোয়।” তাছাড়া তনুকে যেন বিশেষভাবে লক্ষ রাখা হয়। কোন অবস্থাতেই সে যেন বাড়ির বাইরে না যেতে পারে, সমস্ত দরজা, জানালা ভালোভাবে লাগিয়ে রাখতে বললেন তান্ত্রিক। গোধূলির রক্তিম আলোয় তান্ত্রিক নিজের সমস্ত সরঞ্জাম নিয়ে খেজুর গাছের নিচে একটা ফাঁকা জায়গায় রেখে এলেন। নারায়নবাবু প্রতিবেশী দুজন লোক কে নিয়ে হোম – যজ্ঞের জন্য প্রয়োজনীয় কাঠ সহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রেখে এলেন সেখানে। সন্ধ্যা নামতেই সমস্ত গ্রামটা নিস্তব্ধ হয়ে গেল, দূরে শিয়ালের ডাক স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল। গাছে প্যাঁচার ডাক শুরু হল।থমথমে পরিবেশে সবাই প্রহর গুনতে লাগল। কখন যে কী হবে তাই সবাই সন্ত্রস্ত।

    রাত তখন প্রায় সাড়ে ন’টা, তান্ত্রিক একা যজ্ঞে বসে মন্ত্র উচারন শুরু করছে। এমন সময় খেজুর গাছটি প্রচন্ড নড়তে শুরু করল। হারাধন তান্ত্রিক যজ্ঞের আগুন কুন্ডে কিছু একটা ফেলে দিতেই একটা রক্তান্ত, বিভৎস নারী রুপ অগ্নিকুন্ডের পাশে ছটপট করতে লাগল। বিশ্রী কাটা-ছেড়া মুখমওলে কর্কশ গলায় চিৎকার করে বলল, তুই আমায় বন্দী করলি কেন?

তান্ত্রিক বলল তুই কে? কী কারনে এখানে এসেছিস?

বুকে দুহাতে জোরে জোরে আঘাত করে বলল আমি প্রতিশোধ নিতে চাই। শেষ করে দেব আমি।

তোর নাম কী?

আমি রিমি !

তনুশ্রীর কাছে এসেছিস কেন?

আমি ওর বান্ধবী, আমার উপর যারা পাশবিক নির্যাতন করে রক্তাক্ত অবস্থায় এই গাছে ঝুলিয়ে দিয়ে আত্মহত্যা বলে রটিয়ে ছিল, তাদের রক্ত খাব। শেষ করে ফেলব তাদের।

তোর কাজ শেষ হলে তুই তনুকে ছেড়ে দিবি তো?

স্থির হয়ে রইল রিমির বিভৎস অতৃপ্ত আত্মা।

তান্ত্রিক এবার কঠিন কন্ঠস্বরে বললেন, আমি চাইলে এখুনি তোকে আটক করতে পারি। কিন্তু তোর উপর হওয়া অন্যায়ের শাস্তি তুই দে সেটাও আমি চাই। কিন্তু তনুকে ছেড়ে যাওয়ার কথা না দিলে, বন্দী করে আমার কাছে রেখে দেব তোকে।

একটু বাধ্য হয়েই বলল ঠিক আছে ছেড়ে দেব।

সঙ্গে সঙ্গে আগুনের কুন্ডুতে তান্ত্রিক মন্ত্র বলে কিছু একটা ফেলতেই অদৃশ্য হয়ে গেল রিমির ভৌতিক রুপ। কিছু সময় পরে এক তীব্র ঘূর্নিঝড়ের টের পেল সবাই, যেন তুলোর মতো সব কিছু উড়িয়ে নিয়ে যাবে। এমন সময় নিঃস্তব্ধ থমথমে গ্রামে দুটি বিকট আওয়াজ ও মানুষের শেষ ভয়ার্ত চিৎকার শোনা গেল। যেন এক প্রচন্ড বাজ পাখী টালির চাল ভেদ করে, ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে গেল তার শিকার। তারপর তনু গোঁ গোঁ করতে করতে মাটিতে পড়ে যাবে এমন সময় তার অচেতন দেহটিকে ধরে নেয় তার মা।

      সকালে পাখির কিচির-মিচির শব্দে সমস্ত গ্রামবাসীর নিদ্রাভঙ্গ হল। খেজুর গাছের নিচে যজ্ঞের পোড়া কাঠ ছাড়া তান্ত্রিকের কোনও অস্তিত্ব নেই। কিন্তু গাছে ঝুলছে দুটি রক্তাক্ত দেহ I কেউ যেন প্রচন্ড ক্ষোভে তীক্ষ্ণ, ধারালো নখ দিয়ে ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলেছে দেহ দুটি কে। গলা ও মুখ ফালা ফালা করে দিয়েছে কেউ। নারায়নবাবু দুজন প্রতিবেশীকে সঙ্গে নিয়ে দুটি ঝুলন্ত দেহের কাছে গিয়ে হতবাক হয়ে গেলেন। গাছে ঝুলছে মৃনাল ও তার বন্ধু মানিক।

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post পাপ | পলক ফেলা নিষেধ |দীপ্তেশ মাঝি | Bengali Thriller Story
Next post পোড়া বাড়ির কান্না | পলক ফেলা নিষেধ |সত্যজিৎ প্রধান| Bengali Thriller Story