মাদ্রাসায় হাফেজি পড়ার সময় এক মঙ্গলবার রাতে একা একা প্রস্রাব করতে উঠেই বিপদে পড়ে যায় শাহাবুদ্দিন। নিজের রুম থেকে বেরিয়ে প্রথমে দক্ষিণ দিকে যেতে হয়। সামনে পুকুর। এটাকে একটা ছোটখাটো দীঘিও বলা চলে। শাহাবুদ্দিন মাদ্রাসার যে রুমে থাকে সেখান থেকে বেরিয়ে সোজা হাঁটলে পুকুরের ঘাটে পৌঁছনো যায়। ঘাটের সোজাসুজি উত্তর পাশে পশ্চিমে গেলেই মসজিদ। মসজিদ থেকে পুকুরকে বিভক্তকারী রাস্তাটা সোজা চলে গেছে আরও পশ্চিমে। মসজিদ আর পুকুরের শেষ একই জায়গায়। রাস্তাটা গেছে আরো খানিকদূর। একেবারে মাদ্রাসার শেষ সীমায়। রাস্তাটার মাথায় বেশ কয়েকটি টিনের ছাউনির ঘর রয়েছে। এগুলোই আসলে মাদ্রাসার শিক্ষক শিক্ষার্থীদের জন্য টয়লেটঘর। আর এখানেই পশ্চিম দিকের মাদ্রাসার সীমানা শেষ।
মাদ্রাসা সীমানার গা ঘেঁষে অবস্থিত পূর্বেকার জমিদারের বংশধরদের বাড়িটার এই কোণাটা বড্ড নির্জন, নিরিবিলি। দক্ষিণ দিকে বেশ কিছুদূর, মাদ্রাসা পুকুরের পাড় প্রান্ত সহ বড় করে একটা এলাকা জমিদার পরিবারের অধীনে। এখানে অনেক পুরানো পুরানো গাছপালা যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতের নবীন প্রবীণ প্রাণী ও পশু। জায়গাটা দেখলেই বোঝা যায়, এখানে লোকের চলাচল বড্ড সীমিত।
এই ঝোপঝাড়ের মধ্যে নিবিড়ভাবে বিস্তৃত একটা তেঁতুল গাছের গা ঘেঁষে একটা কুটোগাদার উপর হঠাৎ চোখ পড়ে শাহাবুদ্দিনের। সে প্রস্রাব করে ফিরে যাচ্ছিল। কুটোগাদার একেবারে মাথায় পা দুটো রেখে দু’হাতে তেঁতুল গাছটার ডাল ধরে চুপচাপ বসে থাকা একটা বিবর্ণ অবয়ব চক্ষুগোচর হয় শাহাবুদ্দিনের। তার সমস্ত শরীর কেঁপে ওঠে। রাত তখন দ্বিপ্রহর। চারিদিকে কোনও সাড়াশব্দ নেই। চাঁদ মাঝে মাঝে মেঘের পর্দা ফুঁড়ে আলোকিত করছে রাতের পৃথিবীকে। এমন পরিস্থিতিতে কুটোগাদার একেবারে মাথায় একটা বয়স্ক বুড়ি তার তীর্যক দৃষ্টি অপলকভাবে ফেলছে শাহাবুদ্দিনের উপর। বুড়িটার চোখদুটো জলন্ত আগুনের মতো টগবগে লাল।
“কে আপনি?” কাঁপতে কাঁপতে বলল শাহাবুদ্দিন। কিন্তু অপর পাশ থেকে কোনও উত্তর এল না। শাহাবুদ্দিন টের পেল বুড়িটার চোখ ক্রমশ বড় হচ্ছে। সে আর কোনও কথায় বলতে পারল না। সমস্ত শরীর শীতল হয়ে আসছে। বারো বছরের এই সাহসী ছেলেটি ভয়ে একেবারে বেলুনের মতো চুপসে গেল। আলো আঁধারির রাতে প্রায় পঞ্চাশ ফুট দূরত্বে থাকা অবয়বের চোখকে খুব স্পষ্টভাবেই দেখতে পাচ্ছিল শাহাবুদ্দিন। বুড়িটার চুলগুলো দুধের মতো ধবধবে সাদা। কয়েকটা চুল তার নাক বেয়ে গালে এসে পড়েছে। বুড়িটা কোনও কথা বলছে না। শাহাবুদ্দিনও বুড়ির থেকে চোখ সরাতে পারছে না। ভয়ে না পারছে দৌড় দিতে আর না পারছে চিৎকার করে কাউকে ডাকতে। শুধু দাঁড়িয়ে থেকেই অবশেষে জ্ঞান হারায় সে।
পরদিন সকালে জ্ঞান ফিরতেই শাহাবুদ্দিন নিজেকে আবিষ্কার করল বাড়ির বিছানায়। মাথার কাছে বসে আছে তার বাবা। সে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘরের অন্যপ্রান্তে তাকিয়েই চিৎকার করে বাবাকে জড়িয়ে ধরল। তেলের বোতল ও আরও দু-একটি জিনিসপত্র নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বসে থাকা তারই ওস্তাদ বা হুজুরকে দেখে চমকে উঠল । কিন্তু কেন?
নিজের হুজুরকে দেখে ভয়ের কী আছে। হুজুর তো তাকে সাহায্য করতে এসেছে। শাহাবুদ্দিনের এমন আচরণের কারণ কেউ-ই বুঝতে পারল না। বাবার কোল থেকে কোনওভাবেই ছাড়ানো গেল না তাকে যতক্ষণ না হুজুর বাড়ি থেকে চলে গেল।
তারপর কেমন যেন থ মেরে বসে থাকা শাহাবুদ্দিন মুখ খুলল। বলল, হুজুরকে দেখে তার ভীষণ ভয় হচ্ছিল আজ। হুজুর কেমন যেন বড় বড় আড়চোখে তাকাচ্ছিল তার দিকে। ঠিক গতকাল রাতের বুড়িটার মতো। হুজুরকে দেখেই তার গতকাল রাতের কথা মনে পড়ে গেল।
হুজুর যেতে না যেতেই বিকট শব্দে চিৎকার করে বাড়ির মধ্যে একটা হুলস্থুল অবস্থা বাঁধিয়ে দিল শাহাবুদ্দিন। হুজুরকে ফিরিয়ে আনতেই তাকে দেখে পুনরায় অজ্ঞান হয়ে গেল সে।
হুজুর তার গলায় একটা মাদুলি ঝুলিয়ে দিয়েছে। একটা ছোট বোতলে তেল রেখে তাতে দোয়া কালাম পড়ে ফু দিয়ে তা ব্যবহারের নিয়ম কানুন বলে চলে যাওয়ার সময় হুজুর বলে গেল, আর কোনও সমস্যা হবে না ইনশাআল্লাহ।
শাহাবুদ্দিনের বাবা হুজুরকে ধন্যবাদ জানিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আর কবে যেতে পারবে মাদ্রাসায়?
হুজুর ধীরে ধীরে জবাব দিল, দুএকদিন পরেই পাঠিয়ে দিবেন। একটু জিরিয়ে নিক ।আর চোখে চোখে রাখবেন একটু।
মাসখানেক পরে শাহাবুদ্দিন মোটামুটি সেরে উঠল। পূর্বেকার কাহিনী প্রায়ই ভুলতে বসেছে। সে এখন মাদ্রাসার অন্যতম মেধাবী ছাত্র। পবিত্র আল-কুরআনের পঁচিশতম পারা সদ্য শেষ করেছে সে। কোনও সমস্যাই হয় নি। তারপর থেকে কোনওদিন রাতে আর একা একা প্রস্রাব করতেও বেরোয়নি শাহাবুদ্দিন। কিন্তু পূর্ব ঘটনার ঠিক এক মাস পরে একদিন রাত একটার দিকে হঠাৎ প্রস্রাবের প্রচণ্ড চাপ অনুভব করে শাহাবুদ্দিন। কাউকে না ডেকেই মাদ্রাসার ছোট ঘরটা থেকে টয়লেটের উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়ে সে।
সেখান থেকে ফিরতেই হঠাৎ সেই কুটোগাদার দিকে চোখ পড়ে শাহাবুদ্দিনের। ভয়ে হাত পা কাঁপতে থাকে। কিন্তু আজ সেখানে কাউকেই দেখা গেল না। মাথা ঘুরিয়ে ফিরে যাওয়ার জন্য কদম ফেলাতেই পিছন থেকে তাকে কে যেন ডাকল,
“শাহাবুদ্দিন, এদিকে এসো।”
শাহাবুদ্দিন প্রথমে ভয়ে চমকে উঠলেও পরক্ষণে কড়া ব্রেক করে দাঁড়িয়ে আল্লাহকে ধন্যবাদ দিল। কারণ কণ্ঠটা তার হুজুরের।
—তোমাকে একটা জিনিস দেবো আমি।”
শাহাবুদ্দিন কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। সে শুধু ভাবছে, হুজুর এত রাতে এখানে কী করবে। আবার এ-ও ভাবছে, রাত বোধহয় বেশি হয়নি।
হুজুর এবার কড়া গলায় বলল,
—শুনতে পাচ্ছ না কী বললাম?
শাহাবুদ্দিন হঠাৎ থতমত হয়ে জবাব দিল,
“জ্বি হুজুর!”
হুজুরের দিকে ফিরতেই শাহাবুদ্দিনের চোখমুখ আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল। হুজুরের হাতে শাহাবুদ্দিনের ছোটবেলায় হারিয়ে যাওয়া সেই স্বর্ণের আংটি।
এই আংটিটার জন্য কত কিছুই না করেছে বেচারা শাহাবুদ্দিন আর ওর পরিবার!
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় শাহাবুদ্দিনের পরিবারে একটা দুঃসংবাদ আসে। তার দাদিমা মারা যায়। দাদিমা মারা যাওয়ার পরই আংটিটা হাতে পরা শুরু করে সে। আংটিটা তার দাদিমারই। দাদিমা তাকে উপহার হিসেবে দিয়েছিল এবং বলেছিল,
—নে দাদুভাই, আংটিটা তোর দাদাভাইকে দিয়েছিলাম যখন আমরা প্রেম করতাম তখন, বুঝলি? তোর মতন ছোট ছিলাম আমরা তখন।
—প্রেম করলে আংটি দিতে হয় দাদিমা?
—হে হে হে, হ্যাঁ গো দাদু, বুঝবা, বুঝবা সব। আর শোনো, আংটিটা গুছিয়ে রাখবা। এটা কিন্তু সোনার আংটি। তুমি যখন বড় হবা, আমি যখন মরে যাব কেবল তখনই আংটিটা ব্যবহার করবা। হবে তো?
শাহাবুদ্দিন আংটিটা নাড়াচাড়া করে ঘাড় নেড়ে জবাব দেয়, আচ্ছা দাদি।
সে থামে না। পুনরায় দাদিকে প্রশ্ন করে,
—তোমাকে এটা কে দিয়েছিল দাদিমা? তোমারও দাদিমা তোমাকে দিয়েছিল?
—পেয়েছিলাম।
—কোথায় পেয়েছিলে?
—আচ্ছা দেখি তোর হাতে ঠিকঠাক হচ্ছে কিনা।
শাহাবুদ্দিন হাত আগিয়ে দেয়।আংটিটা তার হাতে সামান্য বড় হয়ে যাচ্ছে। দাদিমা বললে,
—তাহলে সে কথায় থাক। এখন গুছিয়ে রেখে দাও।
সেখান থেকে মাস খানেক পরে তার দাদিমা মারা যায়। পানিতে ডুবে তার মৃত্যু হয়। সন্ধ্যার সময় ওজু করতে পুকুরে গিয়েছিল। আর পৃথিবীর মুখ দেখা হয়ন তার। পুকুরের ঠিক মাঝখানে দাদিমাকে মৃত ভেসে উঠতে দেখা গিয়েছিল। তার চোখমুখ, চোয়াল, কান, নাক, চুল সর্বোপরি গলা থেকে মাথা পর্যন্ত কোনও অংশই চেনা যাচ্ছিল না। কাদা দিয়ে যেন লেপা হয়েছে মুখখানা। খুব স্পষ্টই বোঝা গেল, তার মাথাটাকে কাদায় পোতা হয়েছিল। কিন্তু কে করবে এই কাজ? শাহাবুদ্দিনের দাদিমার তো কোনও শত্রু ছিল না!
শাহাবুদ্দিনের যেদিন জন্ম হয় আকষ্মিকভাবে ঠিক সেদিনই তার দাদা মারা যায়। সে মায়ের কাছে শুনেছিল, দাদাও পুকুরে ডুবে মারা গেছে । দাদা আর দাদিমা দুজনেই পুকুরে ডুবে মারা গেল এই বিষয়টা শাহাবুদ্দিনের মনে বারবার ঘুর খায়। সে কোনওভাবেই এই সমীকরণটা মেলাতে পারে না। গ্রামের অনেকেই এমনকি শাহাবুদ্দিনের বাবা-মা, একমাত্র বড় বোন সবাই এই সমীকরণ মেলাতে ব্যর্থ। অনেক হুজুরই বলেছে, জিনেরা মেরেছে। কিন্তু কেন মারবে? এই প্রশ্নের উত্তর কেউ খুঁজে পেল না।
যায়হোক, দাদিমা মারা যাওয়ার পর তার কথামতো আংটিটা বের করে ডান হাতের অনামিকায় পরিধান করল শাহাবুদ্দিন। বাবার কথা অমন্য করেই স্কুলে আংটিটা পরে গেল একদিন। ফিরে এসে বাবার সামনে কেঁদে ফেলল সে। আংটি খুইয়ে ফেলেছে।
বাবা রেগেমেগে উঠে বললেন,
—কী বললি তুই?
শাহাবুদ্দিন কথা বলে না। বাবা বজ্রের মতো গর্জন করে বিষয়টার বিস্তারিত জানতে চাইল।
—কী হয়েছে বল, কোথায় ফেলেছিস? নিষেধ করেছিলাম না আমি? কেউ কেড়ে নিয়েছে?
শাহাবুদ্দিন মাথা নাড়িয়ে জবাব দেয়, না।
—তবে?
—পথে কেমন একটা লোক আমার কাছে চেয়েছিল। আমি আঙুলের দিকে তাকিয়ে দেখি আংটি নাই।
—মিথ্যে কথা। এই লোকটা কে?
—চিনি না।
—একদম মিথ্যে বলবি না। তুই চিনিস না অথচ তোর আংটির খবর রাখে। কে সে? দেখতে কেমন?
—খোঁচাখোঁচা দাড়ি আর মথায় লম্বা লম্বা চুল। সাদা গায়ের রং। কানে একটা রিং আছে।
ছেলের কথা বিশ্বাস হল না তার।
ছেলেকে হেঁচকা টান দিয়ে বাইরে বের করতেই বাড়ির মধ্যে আর্তনাদ শুরু হয়ে গেল। শাহাবুদ্দিনের মায়ের ভীষণ পেট ব্যাথা করছে। তার বাবা দৌড়ে গেল ধাত্রী ডাকতে। কারণ তার স্ত্রী গর্ভবতী। যেকোনও সময় সুখবর আসতে পারে এই আশায় ধাত্রী ডাকতে যাওয়া!
আংটির বিষয়টা এ যাত্রায় ঢাকা পড়ল। কিন্তু রোগীকে দেখে ধাত্রী যা বলল তাতে সব আশা ভেঙে চুরমার। জঠরের ভিতরের সন্তানের নাকি নড়নচড়ন থেমে গেছে!
দুদিন পরে পুরোপুরিভাবে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, শাহাবুদ্দিনের অনাগত ভাই পৃথিবীর মুখ দেখবে না। শাহাবুদ্দিনের পরিবারের সবারই মন ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। মায়ের আংটি আর অনাগত সন্তান এই দুটোকে হারিয়ে তার বাবা ধর্মকর্মে মন দিল। এরই ধারাবাহিকতায় এক হুজুরের পরামর্শে শাহাবুদ্দিনকে হাফেজিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি করা হয়। এই হুজুর, ইনি আর কেউ নন, বর্তমান শাহাবুদ্দিনের হুজুরই তিনি।
সেখান থেকে প্রায় দু’বছর পরে আজ এই গভীর রাতে শাহাবুদ্দিনের সামনে সেই হুজুর ঐতিহ্যবাহী আংটিটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এবং বলছে,
“এটা আমি তোমাকে দেবো বিনিময়ে আমাকে একটা জিনিস দিতে হবে।”
শাহাবুদ্দিন সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যায়। “কী নেবেন বলেন।”
—তোমার মাদুলিটা আমাকে দিতে হবে।
কথাটা শুনতেই হুজুরের চোখের দিকে তাকিয়ে শাহাবুদ্দিনের গা ছমছম করে ওঠে। ভয় তাকে চরমভাবে গ্রাস করে যায়। হুজুরের চোখ একেবারে লাল হয়ে উঠেছে। তাছাড়া হুজুর তো কখনই তাদের সাথে এরকম বিষয় নিয়ে আলোচনা করে না পড়ালেখা ছাড়া। তাছাড়া এই গভীর রাত!
শাহাবুদ্দিনের দেহের কম্পনকে উদ্দেশ্য করে হুজুর বলে, “ভয় পেয়ো না শাহাবুদ্দিন,আমি ওটা আবার তোমাকে ফেরত দেবো। আর আমিই তো তোমাকে দিয়েছিলাম ওটা।”
শাহাবুদ্দিন গলা থেকে মাদুলিটা খুলে ফেলল। হুজুর হাত পেতে দাঁড়িয়ে আছে। যে-ই না হাতে দিতে যাবে সে-ই হাত সরিয়ে নিল হুজুর। লাফিয়ে উঠল শাহাবুদ্দিন। সে কাত হয়ে সেটা তুলতে যাবে আর অমনিই একটা মহিলার বিকট কণ্ঠ ভেসে এল। “তুলবি না, তুলবি না একদম।”
শাহাবুদ্দিন ধীরে ধীরে মাথা উঁচু করতে লাগল। প্রথমে হুজুরের জুতো, তারপর পায়ের পাতা, এরপর পাঞ্জাবিতে ঢাকা জানু সবই হুজুরের হওয়ায় তার ভয় কিছুটা কমলো। মাদুলি তবু তুলল না।
কিন্তু পুরো মাথাটা যখন উঁচু করে সে তার হুজুরের দিকে তাকাল তখন তার পায়ের তলার সমস্ত মাটিই হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম। দেখলো, মানুষটির পা থেকে বুক পর্যন্ত একদমই হুজুরের মতো আর মাথাটা কুটোগাদার সেই বুড়ির। শাহাবুদ্দিন মূহুর্তেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। সকাল বেলায় তার ঘুম ভাঙতেই সে নিজেকে আবিষ্কার করল হুজুরের ঘরে। মূহুর্তেই কেঁপে ওঠে ওর সমস্ত শরীর। হুজুরকে দেখে দৌড়ানোর জন্য উঠে পালাতে গিয়ে হুজুর তার হাতটা ধরে ফেলল।
—শাহাবুদ্দিন, ওই শাহাবুদ্দিন!
শাহাবুদ্দিন অজ্ঞান হয়ে গেছে পুনরায়। হুজুর তাকে শুশ্রূষা করে ভালো করে তুলল।
—হুজুর,আংটিটা কোথায়?
জিজ্ঞাসার ভঙ্গিতে চোখ স্থির করে হুজুর বলে,
—কোন আংটি?
—কাল রাতে যেটা দেখালেন ওটা আমার হুজুর।
ভূতে ধরায় ছেলেটা উল্টোপাল্টা বকবক করছে, হুজুর ব্যপারটা বুঝতে পারলেন। উনি শাহাবুদ্দিনের বাবাকে ডেকে তাকে বাসায় পাঠিয়ে দিলেন। মাদ্রাসা থেকে দুই দুইবার এই ভয়ংকর অবস্থার শিকার হওয়া শাহাবুদ্দিনকে তার বাবা চিরতরে নিয়ে গেলেন। তার বিছানাপত্র, বইপুস্তক সবকিছু বাড়ি ফেরত আনা হল। শাহাবুদ্দিনকে পুনরায় ভর্তি করা হল গ্রামের স্কুলে। সেখানে তার বড় একটা বন্ধু সার্কেল গড়ে উঠল। ভূত-প্রেত বলে কেউ তার জীবনে একপ্রকার নেই-ই। খুবই সাধারণ অথচ হাসিখুশি প্রাণচাঞ্চল্যপূর্ণ একটা জীবন অতিবাহিত করতে লাগল সে। তার গলায় এখন তাবিজ কবজ থাকে না। দরকারই হয় না।
বছর খানেক পরে বৈশাখ মাসের এক নির্জন দুপুর। প্রচণ্ড রৌদ্রতাপে পুড়ছে সবকিছু। বাইরে মানুষজন একেবারে নেই বললেই চলে। এমন সময় শাহাবুদ্দিন তার এক বন্ধুর সাথে বেরিয়েছে আম খুঁটতে। মনের অজান্তেই হোক আর কৌতুহলবশতই হোক শাহাবুদ্দিন আর তার বন্ধু সেদিন হাঁটতে হাঁটতে মাদ্রাসার পাশে সেই জমিদার বাড়ির বাগানে গিয়ে উঠল। বাগানে ঢুকল চুরি করে। কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে ঢুকেছে তারা। কেউ দ্যাখেনি। মানুষের কোনও ছায়াও দেখতে পেল না তারা। তারা আম খুঁটা শুরু করল। বিশাল বড় আমবাগান। আমগাছগুলোও বহুদিন আগেকার। দেখলেই বোঝা যায়। দুহাত দিয়ে গাছকে আঁটানো যায় না।
আম খুঁটতে খুঁটতে দুজন বাগানের দু’প্রান্তে পৌঁছে গেছে। কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। শাহাবুদ্দিন পৌঁছে গেছে কুটোগাদার একেবারে পাশে। তেঁতুল গাছটার দক্ষিণ প্রান্তে রয়েছে একটা বড় আমগাছ। কুটোগাদার দিকে চোখ পড়তেই গা ছমছম করে ওঠে শাহাবুদ্দিনের।
শাহাবুদ্দিন খানিকটা অবাক হয়। আজ প্রচুর আম পড়েছে তালায়। কিন্তু কেন? আজ তো ঝড় হয়নি। তবে এত আম পড়ল কেন? বোধহয় মালি সকালে আম খুঁটতে আসেনি। এইসব ভাবতে ভাবতে মাথা নিচু করে পুনরায় খুঁটতে গিয়েই শাহাবুদ্দিন বাধা পায়।
—আম তুলবি না।
কর্কশ কণ্ঠে কুটোগাদার পাশ থেকে গর্জন করে ওঠে সেই বুড়িটা। আজ আর উপরে নয়, নিচেই দাঁড়িয়ে আছে। বুড়ির নিষেধ অমান্য করে শাহাবুদ্দিন আমটা হাতে করে তুলে আনে। বুড়িটাকে রাতে দেখা আগের সেই বুড়ির সাথে খুব একটা মেলাতে পারে না শাহাবুদ্দিন। আগের বুড়িটার চুল ধবধবে সাদা ছিল আর এটার চুল আধপাকা। আগের বুড়িটার চোখ লাল, বিবর্ণ ও বড় বড় ছিল। কিন্তু এবারকার বুড়িটা খুবই স্বাভাবিক।
শাহাবুদ্দিন তবুও ভয় পেয়ে যায়। বুড়ি পুনরায় বলে,
—আমটা রেখে দে, দে আগে!
—রাখব না। কী করবে তুমি?
—ভালো হবে না বলে দিচ্ছি।
শাহাবুদ্দিন তার বন্ধুকে ডাক দেয় কিন্তু কোনও সাড়া আসে না অপর প্রান্ত থেকে। বুড়িটা এবার বিদঘুটে একটা হাসি দিয়ে বলে, কেউ আসবে না আজ।
শাহাবুদ্দিন আমটা নিয়েই দৌড় দেয়। দুই কদম যেতে না যেতেই তার পিঠে ভীষণ শব্দের একটা ধাক্কা এসে লাগে। সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। পিছনে ফিরে দেখতে পায়, মাদ্রাসায় পড়াকালীন কুটোগাদায় দেখা সেই ধবধবে সাদা চুল,রক্তবর্ণ চোখের বুড়িটা তীর্যক চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে ভয়ে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে। কিন্তু চারিদিকে কেউ নেই। আমের বস্তাটা ফেলে উঠেই জীবন বাঁচানোর দৌড় দেয় শাহাবুদ্দিন। একদৌড়ে পৌঁছে যায় বাড়ি। সঙ্গে সঙ্গে জ্বর আসে তার। শুয়ে শুয়ে বিস্তারিত খুলে বলে তার মা’কে। মা কৌতুহলী হয়ে প্রশ্ন করে,
—কিন্তু তোর বন্ধু জাকির কই? ওর কিছু হয়নি তো?
—জানি না আম্মু।
শাহাবুদ্দিনের জ্বর ক্রমশ বাড়তে থাকে। তার বাবা ডাক্তার, কবিরাজ একের পর এক আনতেই থাকে। কিন্তু শাহাবুদ্দিন আর পরের দিনের সূর্য দেখার সুযোগ পেল না। সকালবেলায় তাদের বাড়িটা ভরে গেল মানুষে। সবাই অবাক, দুঃখিত। তেরো চৌদ্দ বছরের এক তাজা প্রাণ ঝরে গেল!
ভিড়ের মধ্যে জাকিরকে দেখে কান্না থামিয়ে তার কাছে ছুটে গেল শাহাবুদ্দিনের মা।
—তোর কিছু হয়নি তো বাবা?
—আমার কী হবে কাকিমা? আমি তো যাইনি।
শাহাবুদ্দিনের মা অবাক হয়ে যায়।
দুদিন পরে শাহাবুদ্দিনের বোন রাবেয়া অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করে। গভীর রাতে নদীর তীরে গিয়ে বসে, জামা কেটে মানুষকে শরীর দেখায়, কুড়াল নিয়ে কাট কাটতে যায় ইত্যাদি। তার বাবা তর পায়ে শেকল বাঁধল। শহর থেকে এক নামকরা হুজুরকে ডেকে আনল। শাহাবুদ্দিনের ওস্তাদ হুজুর তো আছেই। তারা দুজনে মিলে শাহাবুদ্দিনের বোন রাফিয়ার পিছে থাকা প্রেতাত্মাকে হাজির করল।
—তোমরা কারা?
—রাফ্রা এ্যানির বন্ধু।
—এটা আবার কে?
—বলব না।
—না বললে তোমাদেরকে বোতলে বন্দী করব।
—বলছি
—বলো
—রাফ্রা এ্যানি ও তার স্বামী মাদ্রাসার পাশে জমিদার বাড়িতে থাকত। তারা ইংল্যান্ড থেকে এসেছিল ব্যবসা করতে।
—যাই হোক, ওসবের দরকার নেই। রাবেয়ার কাছে এসেছ কেন সেটা বলো।
—জমিদারের সাথে এ্যানির স্বামীর বন্ধুত্বের সুবাদে তারা এখানে ঠাঁই পায়..
—আমরা এসব শুনতে চাই না।
—আমি আপনার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি।
—হ্যা
—এ্যানির শ্বশুর তার সাথে জোরপূর্বক শারীরিক সম্পর্ক করতে চেয়েছিল একাধিকবার। সে না পারত স্বামীকে কিছু বলতে আর না পারত শ্বশুরকে বাধা দিতে। একদিন সে তার শ্বশুরকে খুন করে।
—বললাম না, এসব গল্প আমরা শুনতে চাই না। এসব গল্প আমরা জানি।
—কীভাবে জানেন?
—গল্প শুনেছি।
—আর আমরা তখন সেটা দেখেছি। ছোট ছোট ছিলাম আমরা।
—কিন্তু এসব কথার..
—দরকার আছে।
—বলো দেখি
—এ্যানির স্বামী তার বাবার খুনিকে আঁচ করতে পারে।
—কিন্তু আমরা তো জানি, এ্যানির স্বামী রিচার্ডের আপন বাবা ছিলেন না উনি। এদেশে এসে বাবা পাতিয়েছিলেন।
—জ্বি। রিচার্ড এ্যানির কোনও কথাতেই বিশ্বাস না করে তার উপর বিশ্বাস হারালেন। উনি জমিদারের সহায়তায় স্ত্রীকে অভিনব এক শাস্তির ব্যবস্থা করলেন। তা হল, এ্যানিকে সবসময় পুরুষ সেজে থাকতে হবে।
—হ্যাঁ, তারপর অপমান সহ্য করতে না পেরে সে আত্মহত্যা করে।
—আর সুইসাইড নোটে তার মৃত্যুর পিছনে স্বামীকে দায়ী করে যায় সে। রিচার্ডেরও শাস্তি হয়। তদন্তের জন্য তাদের দুজনের দাম্পত্য জীবনের সমস্ত জিনিসপত্র কারা-কতৃপক্ষকে হস্তান্তর করা হয়। শুধু একটা জিনিস বাদে। একটা আংটি। এ্যানির আংটি।
রাবেয়াকে প্রশ্ন করতে থাকা হুজুরদের পাশে বসে থাকা রাবেয়ার বাবা তার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল, মিথ্যে কথা বলবে এবার। হুজুর তাকে ইশারায় থামতে বলে রাবেয়া তথাপি জিনকে পুনরায় জিজ্ঞেস করল,
—তারপর কী হল?
—এই আংটিটা রাজিয়া বেগম (শাহাবুদ্দিনের দাদি) চুরি করেছিল। সে তখন বারো বছর বয়সী ছিল।
—কিন্তু তাতে তোমাদের কী?
—এ্যানি আমাদের কাছে এসে অনুরোধ করেছিল আংটিটা যেন আমরা উদ্ধার করে দিই।
—রাজিয়া বেগমের স্বামীকে মারলে কেন?
—আমরা মারিনি। আমরা জানি না।
—তোমরা মিথ্যে কথা বলছ।
—আমাদের গুরুরা পরামর্শ করে এ কাজ করেছে। আমাদেরকে কিছু বলা হয়নি।
—তাদেরকে ডেকে আনো।
—তারা বেঁচে নেই।
—আচ্ছা, শাহাবুদ্দিনকে তো তোমরাই মেরেছ। কেন?
—প্রথম দিন এ্যানি তাকে শুধু ভয় দেখিয়েছিল। আর তারপর ওর কাছে থাকা তাবিজের জন্য আমরা আমাদের আস্তানায় সুখে থাকতে পারতাম না। মাদ্রাসার পাশেই আমাদের আস্তানা।
—তোমরা জঘন্য একটা অপরাধ করেছ। তোমাদেরকে শাস্তি পেতেই হবে।
কেউ কোনও কথা বলে না। শাহাবুদ্দিনের হুজুর জিজ্ঞেস করে,
—তোমরা আমার চেহারা নিয়েছিলে কেন?
—ও আপনার কথা অমান্য করে না বলে।
—যাইহোক, তোমাদেরকে শাস্তি পেতেই হবে। আর রাবেয়ার ঘাড়ে এসেছছ কেন?
—আমরা চলে যাব দূর বনে। এদিকে আর কোনওদিন আসব না। আমাদেরকে ক্ষমা করে দিবেন।
—তোমরা মানুষকে খুন করেছ তার বদলে কোনও সৎকাজ করেছ কিছু?
—আমরা যাওয়ার সময় শাহাবুদ্দিনের পরিবারকে যাবতীয় শয়তানের হাত থেকে রক্ষার উপায় বলে যাব।
—বলো দেখি
—বাড়ির চারপাশে চারটি তাবিজ পুঁততে হবে। আর….
বেশ কিছু উপায় বলে রাবেয়ার কাছ থেকে সরে গেল প্রেতাত্মা। হুজুররাও চলে গেল। বাড়িটা এখন ফাঁকা। খিড়কিতে উদাস বসে থাকা শাহাবুদ্দিনের মায়ের বুকটা সবচেয়ে বেশি ফাঁকা।
~~সমাপ্ত~~