এইরে পুড়ে গেল!
মেহেদী কোনরকমে টুথব্রাশটা বেসিনে আধা ধুয়ে ঝুড়িতে রাখতে গিয়ে নিচে ফেলে দিয়ে ছুটে গেল রান্নাঘরে। একেবারে পুড়ে গেছে – কত শখ করে ইউটিউব, গুগল৷ সাথে নিজের মাথা ঘেঁটে ভিন্নধর্মী নুডলস রান্না করতে চেয়েছিল, সব একেবারে পানিতে ডুবল।
চার রকম মাংস সাথে চিংড়ি ভেজে তারপর তাতে নুডলস ভেজে অন্যরকম কিছু করতে চেয়েছিল, হলো না । দুই দিন ধরে এক চিন্তাই করছিল জিনিসটা বানানো হলে না জানি কত টেস্ট হবে।ইউটিউব, গুগল কোথাও ঘেঁটে চার রকম মাংস দিয়ে নুডলস- এরকম রেসেপি পায়নি। হুট করেই মাথায় এত, তারপর দুই দিন ধরে আয়োজন করে রেডি করল।
সবকিছু নষ্ট হয়ে গেল। চুলা যে বাড়িয়ে দিয়েছিল সেটা ঘুম ঘুম চোখে খেয়াল হয়নি।একা একটা ফ্ল্যাটে ছুটির দিনে সম্পূর্ণ নিজের মতো থাকে। সকাল সাতটা আর দুপুর বারোটার মাঝে ছুটির দিনে আলাদা কোনও পার্থক্য মেহেদী করতে পারে না।
পুড়ে যাওয়া মাংস, নুডলস একসাথে ঘোঁট পাকিয়ে গেছে। মনটা যথেষ্ট খারাপ হয়ে গেছে। আজ বাইরে যাওয়ার কোনও প্ল্যান মেহেদীর ছিল না। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল যাবেও না। এই পুড়া মাংসই খাব, এটার আলাদা টেস্ট আছে।
গত দুইদিন ধরে কবুতর, মুরগি, খাসি আর গরুর মাংসে যত রকম মশলা আছে সব দিয়ে ম্যারিনেট করে ডিপ ফ্রীজে রেখে দিয়েছিল। বুঝতেই পারছেন যথেষ্ট শৌখিন ব্যাচেলর মেহেদী। এই শৌখিনতা বেতন বাড়ার সাথে সাথে হয়েছে। আগে যথেষ্ট গরিবই ছিল, বেতন বৃদ্ধির সাথে সাথে শখ, বিলাসিতা হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে।
মাঝে মাঝে মনে হয় ফ্ল্যাটে মেয়ে মানুষ রাখলে কেমন হয়! ব্যস ওই মনে হওয়া পর্যন্তই, কতকিছুই তো মনে হয়। এতসব পাত্তা দিলে কি চলে? চলে না। এসব উত্তর নিজেই নিজেকে দেয় আর অকারণে খুশি হয়ে যায়।
মোটামুটি মেহেদীর জীবন সুস্থ, স্বাভাবিক এবং নিরাপদ জীবন। কিন্তু সমস্যা তো বলে কয়ে আসে না এবং যখন এসেই যায় তখন সমূলে একটা বড়সড় ধাক্কা দিয়েই যায়।
পুড়া মাংস খাবার পর বিশাল দেয়াল টিভিটা ছেড়ে আকক করে একটা ঢেকুর তুলল। ঢেকুর তোলার পর কেমন জানি লাগল, সেই কেমন লাগাটা পাত্তা না দিয়ে রিমোট দিয়ে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতে চলে গেল।
এইরে… সর্বনাশ.. আহহা ধরেই ফেলল- শিটট, হরিণ শিকারের পর্বটা মেহেদীর খুব পছন্দের। একা একা ছুটির দিনে সোফায় বসে দেখতে দেখতে নিজেই আফসোসের সাথে ধারা বিবরণ দিয়ে যায়। বেশ ভালো লাগে। আজ অবশ্য ভালো লাগল না তেমন। ঝুমুঝুম এর কথা মনে পড়ল, হরিণী ঝুমঝুম।
চপলা হরিণী ঝুমঝুম, আর সে ছিল সেদিন জিওগ্রাফি চ্যানেলের বাঘ। ছুটির দিনটা মাটি করার কোনও ইচ্ছে নেই, তারপর ও মনে হচ্ছে – অফিস থেকে সোজা গত শনিবার দুপুরে মতিনের ফ্ল্যাটে চলে গিয়েছিল। না, কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে যায়নি।
এই অলস লাঞ্চ আর ব্রেকফার্স্টের মাঝামাঝি ব্রাঞ্চ টাইমে মনে হচ্ছে তার অবচেতন মনে পাপ ছিল। উদ্দেশ্যটা লুকিয়ে ছিল কিন্তু খালি ফ্ল্যাটে জ্বরপীড়িতা ঝুমঝুমকে দেখে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। লালচে ঠোঁট, হালকা ফ্যাকাশে গাল আর নিস্তেজ শরীর নিয়ে ঝুমঝুম যখন দরজা খুলে দিয়েছিল – পরস্ত্রীকে তো সে এই বাঘের মতোই ধাওয়া করেছিল।
অস্বস্তি হচ্ছে, শরীর ঘামছে। এমন তো হওয়ার কথা না। ভর দুপুরে কেমন জানি ভয় ভয় লাগছে।
খালি ফ্ল্যাটে দৌড়ে ফ্রীজের কাছে যাওয়ার কোনও মানে হয় না। কিন্তু মেহেদী তড়াক করে এক ছুটে ফ্রীজের কাছে গেল। কেন জানি মনে হচ্ছিল ফ্রীজের ঢালা খুললে কিছু একটা দেখবে। হরর সিনেমায় যেমন হয় আর কি – ঠান্ডা পানিত বোতলে রক্ত, মানুষের শরীরের আলগা অংশ। এরকম কিছু অবশ্য দেখল না। সব স্বাভাবিক। খোলা ফ্রীজের দিকে অপলক কয়েক মিনিট তাকিয়েও ভয়ের মতো কিছু পেলনা বরং পেলেই স্বস্তি হত। ভয়টা কেটে যেত।
মনের মধ্যে ভয় থম মেরে গেঁথে আছে। এটা সরাসরি ভয়ের চেয়ে বেশি যন্ত্রণার, এক সামনাসামনি কিছু থাকলে সেটাকে না হয় মোকাবেলা করল কিন্তু এই চোরা ভয়কে –
টিপটপ.. টিপটপ..
পানি পড়ার স্বাভাবিক শব্দ। বুকটা ধড়াস করে উঠলো।
পা টিপে টিপে বাথরুমের সামনে গেল। দরজা খুলতে গিয়েও খুলল না। কান পেতে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। মন বলছে দরজার খুললেই দেখবে কমোডে মাথা ছাড়া কেউ বসে আছে, টিপটপ রক্ত সাদা মোজাইকে নকশা তৈরি করছে নয়তো একটা কাটা হাত কমোড থেকে বের হচ্ছে আর ক্রমাগত লম্বা হচ্ছে। হয়েই যাচ্ছে, হতে হতে ছাদ ফুঁড়ে – আর ভাবতে পারে না মেহেদী। দমবন্ধ লাগছে, দরজা ঠেলে ঢুকল – সব স্বাভাবিক।
বেসিনের আয়নায় মুখ দেখল, চোখ যাচ্ছে বাথরুমের দরজায়। যদি আচমকা লেগে যায়! ঘাড় ঘুরিয়ে দুই পা সরে দরজারটা খুলে রাখল। ছোট, বড় যে বাথরূমই পাক না কেন, দরজা বন্ধ করবেনা। কেউ তো আর বাসায় নেই, খামোখা দরজা লাগিয়ে কার সাথে ভদ্রতা দেখাবে।
বেসিনের আয়নার ঠিক উপরে ধবধবে সাদা আলো দেওয়া লাইট জ্বলছে।এত আলো আয়নায় পড়ছে যে কালো মেহেদীকে মোটামুটি স্যান্ডার্ড রঙের লাগছে। ডান গালের কাটা দাগটা এই আলোতে বড্ড চোখে লাগে।
‘হারামী’ দাগ রেখে দিল। জৃলছে এখনও। ঝুমঝুমের নেলপলিশ করা লাল নখ নিস্তেজ হওয়ার আগ মুহূর্তে চোখ গলাতে ব্যর্থ হয়ে গালেই দাগ করে দিল। হারামী একটা।
গাল কাটা মেহেদী। রবিবার অফিসে আশরাফ এই নামেই ডেকেছিল মেহেদীকে। সদ্য কাটা গালে এই নামটা টেস্টিং সল্ট ঢেলে দিল। মতিন পাশের ডেস্ক থেকে কিভাবে যেন তাকিয়েছিল। ক্রুদ্ধ, রাগী চোখে মনে হয়। ঝুমঝুম কি সব বলে দিয়েছিল!
বেসিনের আয়নায় গভীর মনোযোগে নিজেকে দেখে। ঘটনার পাঁচদিন হয়ে গেছে। কাটা দাগটা বসে গেছে গালে। শালার জীবন… কিন্তু ঝুমঝুম –
ক্যাঁচ… ক্যাওও শব্দ করে বাথরুমের দরজাটা আধখোলা হয়ে রইল । স্বাভাবিক ঘটনা, শীতের শেষে উতাল পাতাল বাতাস নিয়ে বসন্ত আসে। কিন্তু মেহেদী ভয় পেয়ে গেল। দরজার কাছে গিয়ে একটা লাথি দিল সজোরে।
ক্লান্ত বিধ্বস্ত হয়ে সোফায় গা এলিয়ে দিল। না,বেসিনের আয়নায় ভৌতিক কিছু ঘটেনি।মনে মনে প্রত্যাশা ছিল হয়তো রক্ত মাখা মুখ দেখবে নয়তো বেসিনের ট্যাপে পানির বদলে রক্তের ফোয়ারা- তেমন কিছুই ঘটেনি। সব স্বাভাবিক। কিন্তু ভয় যাচ্ছে না।
শারীরিক কোনও পরিশ্রম না করেও শরীর ভেঙে আসছে। ভাবতে গেলেও যেন ভয়ানক পরিশ্রম হয় আজ টের পেল মেহেদী।
দেয়াল ঘড়িতে একটা দুই বাজছে। ঘুম থেকে উঠার পর মাত্র এক ঘন্টা বিশ মিনিট সময় কাটাল। অথচ মনে হচ্ছিল অনেক সময় পার করে দিয়েছে। এখন আর ঘুম ও আসবেনা নতুন করে, মাথা পুরাপুরি ফ্রেশ। কাল রাত দশটায় ঘুম দিয়ে আজ সকাল এগারোটা পঁয়তাল্লিশ মিনিটে জেগে ছিল। আবার ঘুমানোর মানে হয় না।
পায়ে পায়ে মেইন দরজার কাছে গেল। অবচেতন মন বলছিল, এই দরজা আর খুলবে না। চিরতরে বদ্ধ ঘরে পঁচে মরতে হবে। দরজা খুলল, বাইরে উঁকি দিল। এই তো সোবহান সাহেব ফোনে কাকে ধমকাতে ধমকাতে নিচে নামছিলেন, মেহেদীকে দরজার বাইরে ঘাড় বের করা অবস্থায় দেখে অমায়িক গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি, সব ভালো তো?’
মেহেদীর কাছ থেকে প্রশ্নের ফিরতি উত্তর না নিয়েই আবার ধমকাতে শুরু করলেন, ‘অপদার্থ যেখান থেকে শুরু করে সেখানেই শেষ করে।রাস্কেল কোথাকার।’
তিনতলার একটা ফ্ল্যাট এবং আশেপাশে, উপরে নিচে সব ঠিকঠাক আছে কিন্তু এত ভয় কেন লাগছে। আশেপাশে এত মানুষ, কোলাহল তারমধ্যে ও মেহেদীর কেমন জানি লাগছে।
দরজা লাগিয়ে দিল। নিজের চোখেই তো দেখল মেইন দরজা খোলাও যাচ্ছে আবার বন্ধ ও হচ্ছে। ‘ভয়ের কি আছে? কোনও ভয় নেই। দিন দুপুরে আর কি হবে – আমি যা বোকা, শুধু শুধু ভয় পাচ্ছিলাম। ‘ নিজেকে কথাগুলো তিন বার শোনাল। নিজের কন্ঠ একা ঘরে কেমন জানি হাস্যকর লাগল।
অফিসে এত মানুষের ভিড়ে নিজের কণ্ঠ তো স্বাভাবিকই লাগে। তারপর মেহেদীর আচমকাই মনে হল একা একা আসলে সে কখনো সশব্দে নিজের সাথে তেমন কথা বলেনি। হয় টেলিফোনে কথা বলেছে নয় গান বাজিয়ে একসাথে গলা মিলিয়েছে। আর ছোট বেলায় যা হত সে তো টেক্সট বই সামনে নিয়ে নিজেকে বুঝানো। তাতেও জড় হোক দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে বই থাকত।
বেশি ভাবলে বেশি সমস্যা, আর ভাবব না – মনে মনে নিজেকে বোঝাল মেহেদী । গ্লাসের পানিতে লেবু চিপে দিতে গিয়ে একটু চমকে উঠল।কয়েক সেকেন্ডের জন্য। মনে হচ্ছিল লেবু না সদ্য খুন হওয়া হৃদপিণ্ড ওর হাতে। চিপার জন্য ফোঁটা ফোঁটা রক্তে গ্লাস ভরে যাচ্ছে।
ঝন ঝনা টুং। মেহেদী ভড়কে গেছে।
ঘরময় গুঁড়ো গুঁড়ো কাঁচ। জানলা গলে সূর্যের আলো গুঁড়োগুলোতে পড়ায় ঝিকঝিক করছে। পরিষ্কার করা দরকার কিন্তু মেহেদীর শরীর অবশ অবশ লাগছে।
এই তো কাঁচের গুঁড়োর পাশে একদম স্বচ্ছ তরল পানি। নিজস্ব কোনও রঙ নেই, যে পাত্রে রাখা হয় তার রঙ ধারণ করে। ক্লাস থ্রীয়ের বিজ্ঞান বইয়ে পানির পরিচয় তো এভাবেই দেওয়া।
নীল টাইলসে পড়ার জন্য পানি নীল লাগছে, লাল তো না। গ্লাসের রঙ ক্রিস্টাল। তাহলে ঝামেলা কোথায় হচ্ছে! নিজের মাথার চুল এক হাতে মুঠো করে বিছানায় গা এলিয়ে দিল।
মেহেদীর বংশে পাগলামির ধাত আছে। এই একটা জিনিস মেহেদী খুব ভয় পায়। কোনওমতেই পাগল হতে চায় না। অথচ মাথায় কত পাগলামি চিন্তা আসে, এগুলো বাস্তবায়ন করলেই তো সে পাগল বনে যাবে।
মাঝেমধ্যে আশেপাশের মানুষকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে, ‘এই যে ভাই, আমার মাথায় যে যে চিন্তাগুলো আসে, আপনার ও কি আসে।’ বলা হয় না কথাটা। যদি পাগল ভাবে। অফিসের বসকে সেদিন ইচ্ছে করছিল লাথি দিয়ে ফেলে দেওয়ার জন্য। ডেস্কে ডেস্কে কাজ দেখে বেড়াচ্ছিল থলথলে শরীরের বসটা। মেহেদী মনে মনে বলছিল, ‘শুয়োর তোকে যদি এখন লাথি দিয়ে ফেলে দিই।’
ওই মনে মনে পর্যন্তই। তারপর নিজের কাজে যতটা মনযোগ দেওয়ার তারচে বেশি দিয়েছিল। বিশ্বাস নেই নিজের উপর, একদমই নেই।
কাজ শেষে রাস্তায় রিকশা ঠিক করার মুহূর্তে পাশের ডেস্কের আবিদ সাহেব স্বাভাবিক ভাবে বলেছিলেন, ‘জানেন, বস শুয়োরটাকে দেখলে পা নিশপিশ করে, মন চায় লাথি দিয়ে ফেলে দিই।’
মেহেদী অবাক হয়েছিল তারপর খুশি। যাক বাবা বাঁচা গেল, আমি তবে পাগল নই।
ঘড়িতে সবে তিনটা তিন বাজে।
মেহেদী সন্ধ্যা নামার জন্য অপেক্ষা করছে। এখনও তিন ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে। ছুটির দিনে সন্ধ্যার আগে কখনো ঘর থেকে বের হয় না। অলিখিত রুলস আর কি।
সময় কাটানোর জন্য একটা ম্যারাথন গোসল দেওয়া যায় ভাবতে ভাবতে বাথরুমে ঢুকে গেল। দরজা হাট করে খোলা। ঝরনা ছেড়ে গলা খুলে গান শুরু করল। এমনিতে তো আর সময় পায়না, আজ একটা দফারফা হয়ে যাক এমন একটা ভাব।
গান অবশ্য বেশিক্ষণ গাইল না। চোখ তুলে তাকাল, না পানিই তো বের হচ্ছে। কিন্তু একটু আগে যেন মনে হল ঝরনা থেকে থিকথিকে মাংস, কলিজা, রক্ত বের হচ্ছে – বাথরুমের দেয়ালে হেলান দিয়ে ঝর্ণার পানি পড়ার দৃশ্য দেখতে লাগল। সব তো স্বাভাবিক। নিজের হৃদপিণ্ডের ধুক ধুক শব্দটা শুনে নিজেরই ভয় লাগছে। ঘরের মেঝে পানিতে ভেসে যাচ্ছে। হুট করে মনে হলো একা ঘরে বাথরুমের দরজা লাগানোর কারণ হচ্ছে ওই মেঝেতে যেন পানি না পড়ে – ঠিক এইজন্যই সে বাথরুমের দরজা লাগায়। ঝর্ণা বন্ধ করে ছোট করে শ্বাস নিল, স্বস্তি লাগছে একটা সমস্যার সমাধান করতে পেরে।
কোমরে তোয়ালে জড়িয়ে বাথরুম থেকে বের হয়ে এল। একা ঘরে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। ফ্রেশ গোসলের পর একটা ফ্রেশ খিদে ভাব। এবার আর অবশিষ্ট পোড়া মাংস নয়, ডিপ থেকে ম্যারিনেট করা মুরগির মাংস বের করল।
আহহা… কখন যে হবে – তেলে মাংস ছেড়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ছিল।
এমা একি কাণ্ড! মাংস ভাজি হচ্ছে না! মেহেদী চোখ কয়েকবার কচলে দেখল সব ঠিকঠাক। চুলা জ্বালানো, পরিমাণ মতো আঁচ দেয়া আবার কড়াইয়ে তেল ও দিয়েছে। তাহলে!
‘হবে না রে, হবে না। ‘
এরচেয়ে ভূমিকম্প হলেও মেহেদী সামলে নিতে পারত, এ কোন তাজ্জব ব্যাপার স্যাপার!
নিজের বুকে যাবতীয় সূরা কালাম পড়ে ফুঁ দিতে গিয়ে ও দিল না। এ পর্যম্ত কখনো স্রষ্টা, আল্লাহ বা ঈশ্বর যেই থাকুক না কেন কখনো ডাকতে হয়নি। আসলে ডাকার মতো পরিস্থিতি আসেনি। যখন যা লেগেছে তা কাজের মধ্যেই অর্জন করে নিয়েছে। ছোটবেলা দেখেছে বাপ নামাজ পড়ত তাই শখ করে ঘরে একটা জায়নামাজ আছে তাও আবার আলমারিতে তোলা।
অবিশ্বাসী মন নিয়ে স্রষ্টাকে ডাকতে কেমন লজ্জা লাগল। আচ্ছা দেখিই না কি কাহিনি বলে মেহেদী মনে সাহস সঞ্চয় করল। বুকের ভেতরে যেমন লাগছে তা আর একটু্ক্ষণ বেশি চললে এমনিই মরে যাবে। এরচেয়ে মুখোমুখি হওয়া ভালো।
‘এহেম, কি হবে না? কেন হবে না? ‘
কোনও সাড়া শব্দ নেই।
মনে তোলপাড় চলছে, তবে কি বংশের পাগলামি ভর করল! ‘এর চেয়ে কোন ভূত ব্যাটা কথা বলছিল সেটাই তো ভালো ছিল ‘ বিড়বিড় করতে করতে তোয়ালে পাল্টে একটা হাফ প্যান্ট পরে নিল।
‘তোর মাংস ভাজি হবে না রে, অপদার্থ।’
মনে একটু বল ফিরে পেল। ‘তা না হলে না হবে। আপনার এত উদ্বেগ কেন জনাব?’
‘আমার মুরগি চুরি করে আনলি, আর আমায় বলিস উদ্বেগ ক্যান।’
মেহেদী টের পাচ্ছে খিদে হু হু করে বাড়ছে। ম্যারিনেট করা মাংসের ঘ্রাণে পাগল পাগল লাগছে।এদিকে তেল গরম হওয়ার কোনও বালাই নেই।
‘শুনুন, আপনি যেই হোন না কেন আপনার মুরগি আমি চুরি করে আনিনি। সুপার শপ চিনেন? ওখান থেকে আনা।’
‘এ্যাহ, বললেই হলো!’
‘ভালো ঝামেলা করছেন তো আপনি। এই দেখুন সুপার শপের রিসিট। ‘কষ্টের টাকায় শ্রেষ্ঠ বাজার।’
অদৃশ্য কার দিকে রিসিট তুলে ধরল মেহেদী। কিছুক্ষণ শব্দহীন।
‘চোর, বাটপার সব।’
‘এ তো মহা ফ্যাসাদ। রিসিট দেখালাম তাও বকছেন। খামোখা গালি গালাজ আমার ভালো লাগে না বলে রাখলাম।‘’
‘আরে ব্যটা তোকে এবার গাল দিইনি। সুপার শপেকে গালি দিয়েছি। ওরা কি ভালো জিনিস দেয় রে! আমার মুরগি কুদ্দুস চুরি করেছে তাও এক বছর হল। সেই মুরগি খুঁজতে গিয়ে আমি ট্রেনের তলে চাপা পড়লাম তাও হিসেবে গিয়ে ধর এক বছরের কম কিছু দিন হবে। সেই মুরগি কিনা তুই কিনে আনলি। ছ্যাঁ ছ্যাঁ, এরচেয়ে বিষ কিনে খা।’
মেহেদীর মুখ খুশি খুশি হয়ে উঠল। এই তো তেল গরম হচ্ছে, মুরগির বাদামী হচ্ছে। জিভে জল সামলানো কঠিন এই মুহূর্তে। আর যা খিদে।
‘তা আপনার ইচ্ছে না হলে না খাবেন। টাকা দিয়ে কেনা। আর খিদেও লেগেছে খুব।’
‘তা তো খাবিই, কপাল আমার মুরগিটা খুঁজতে গিয়ে ট্রেন চাপা পড়লাম। বড় মেয়েটা খবর পাই ভেগে চলে গেছে। কষ্ট কি আমার কম।’
‘আহ্হা, অনেক বকবক করেছেন। থামেন তো এবার।’
‘নামাস নে, নামাস নে। আর একটু ভাজা হোক। লোভী তৈমুর লং হয়ে মরবি নাকি জিভ পুড়িয়ে।’
কথাটা মনে ধরেছে মেহেদীর। ভূত হোক আর বাতাসই হোক, খারাপ কিছু তো বলেনি। আরেকটু ভাজা ভাজা করে প্লেটে তুলে নিল।
‘আহহা, প্লেটে একটা টিস্যু দিয়ে নিতি। তেল লেগে যাবে তো।’
এ দেখি মহাযন্ত্রণা। সব কিছুতে বেটার সমস্যা। দিব নাকি গরম চামচ ছুঁড়ে – ভাবতে ভাবতে চামচটা ছুঁড়ে দিল।
‘চোখের মাথা নেই নাকি। তুই দেখতে পাসনি বলে যে আমি এই ঘরে নেই কে বললো তোকে? গরম চামচটা যে লাগালি পায়ে ফোস্কা পড়ে ফুসকার মতো ফুলে উঠেছে। বার্নল আছে ঘরে?’
‘মাংসের রানে কামড় দিয়ে মুখ দিয়ে ঝালের কারণে উহুহহ করতে করতে বলল, ‘আছে, খোঁজা লাগবে। আপাতত বাথরুম থেকে পানি ঢেলে আসুন।’
‘তিনি মাংস গিলবেন আমার মুরগির আর আমি পরিশ্রম করে বাথরুমে যাব পায়ে পানি ঢালতে! আর কি বা বলবে– এখনকার ছেলে- ছোকরারা মনে করে যা চোখে দেখা যায় না তার অস্তিত্ব নেই, আরে গাধারা ঈশ্বর দেখা যায় না বলে কি ঈশ্বর নেই রে? এসব অনুভব করে নিতে হয়।’
‘উফফ, বেঁচে থাকতেও কি এত বকবক করতেন আপনি? সেই তখন থেকে ক্যাট ক্যাট করে কান, মাথা সব ধরিয়ে দিচ্ছেন। চাপায় ব্যথাও লাগে না?’
নিঃশব্দ।
মেহেদী বিশাল স্ক্রিনের টিভিটা খুলে দিল। চারদিকে পর্দা টেনে দিল। নিষিদ্ধ জিনিস দেখার সময় ঘর অন্ধকার রাখাতেই আরাম লাগে চোখে। ফ্রীজ থেকে বিয়ারের বোতলটা বের করল।
‘ওরে কি খাচ্ছিস?’
মেহেদীর মেজাজটা এবার খারাপ হলো। এই ব্যাটা চায় কি! এখন কি সোফায় বসে বসে টিভিতে ওইসব ও দেখবে নাকি! জ্বালা।
‘বিয়ার। খাবেন নাকি?’
‘মরবি রে তুই, অকালে মরবি। মদ, নারী, পাশা তিন সর্বনাশা, প্রবাদে আছে।’
মেহেদী হাসল। ‘বুড়ো মশাই বিয়ার খেলে কেউ মরে না। আমি প্রায়ই খাই।’
‘কেমন রে খেতে!’
‘আপনি তো মরে পৃথিবীর পাঠ চুকিয়ে দিয়েছেন, এত কৌতূহল ভূত জন্মে কি মানায়?’
‘আর বলিস না, একটা জীবন গেল মদ, নারী, পাশা কোনওটাই ধরে দেখা হল না। ওদিকে শুনি আমার বড় ছেলে আমেরিকা গিয়ে বিরাট জুয়া খেলে – জুয়া খেলেই নাকি কোটি টাকা! ভাবা যায়!’
বিয়ারের বুদবুদের দিকে প্রেম প্রেম দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মেহেদী। ঝুমঝুমের কথা মনে পড়ছে।এও এক ঝামেলা, সবকিছুতে যদি পরস্ত্রীর কথা মনে হয় তাহলে তো চরিত্র নিয়ে টান পড়বে। নিজেকে তো চরিত্রবানই মনে হয়। ওই একটা দিন একটু শুধু ঝামেলা হয়েছিল, এছাড়া তো নারীঘটিত কোন ব্যাডরেকর্ড নেই।
মুখে বিয়ার জমিয়ে চোখ বন্ধ করল। বুড়ো ভূতটাকে এই মুহূর্তে অসহ্য লাগছে।
‘আপনি এখান থেকে যান তো।’
‘ও বাবা, আমি কী করলাম? দেখি একটু টিভি। আমার বউ ছিল দুনিয়ায় ধুমসী। ওয়াক, শুধু তলতলে চর্বি। টিভির বেটি গুলোতো একেকটা চিকন বাঁশ। কেমন তড়বড় করে নাচছে।’
মেহেদী ভ্রূ কুঁচকাল। ভূতটাকে যদিও আশেপাশে দেখা যাচ্ছে না, তবুও কেউ পাশে বসে নিষিদ্ধ আনন্দের সঙ্গী হচ্ছে ভাবতে অস্বস্তি লাগছে। এসব জিনিস একা দেখেই অভ্যস্ত মেহেদী।
‘ওরে গান – বাজনা হচ্ছে বোধহয়, কিন্তু শব্দ টের পাচ্ছি না। ঠোঁট নাড়ানো শুধু বোঝা যাচ্ছে।’
‘তো?’
‘সাউন্ডটা দে।’
‘পারবনা। আমি শব্দ ছাড়া শুনে অভ্যস্ত।’
ভূতটা যথেষ্ট বিরক্ত মেহেদীর উপর, ‘তুই তো দেখি জেতা ভূত। আমি তো মরে ভূত হয়েছি না পারতে।’
‘ধ্যাত্তেরি… ’
‘মুখ খারাপ করবি না, তোর আগে থেকে এই ফ্ল্যাটে আমি আছি। তুই আসলি মাত্র তিন মাস, আমি মরার পর থেকে আছি। আমার জানাযায় এই ফ্ল্যাটের কেয়ারটেকার আসমত ছিল, আমি সুরুৎ করে ওরে ঘাড়ে ভর দিয়ে চলে এলাম। এলাকার মানুষ, আর যাই হোক ঘাড় থেকে তো ফেলে দিবে না।’
‘খুবই ভালো হয়েছে। তা আমার কান কেন ঝালাপালা করা, ঝিম ধরে থাকেন। ভালো লাগে না ক্যাও ম্যাও।’
‘তোর কান কে ঝালাপালা করতে আসল! আমার মুরগি চুরি করে খাচ্ছিলি, তা দেখেই জ্বলে উঠলাম। ওই মুরগি ধরতে গিয়েই তো অবয়সে প্রাণটা গেল। কষ্ট কি আমার কম।’
‘চুপ, চুপ। আর একটা কথাও না।’
‘তোর সাথে কে কথা কইছে- তুই ফ্ল্যাটে না থাকলেই বরং সুবিধা। যন্ত্রপাতি টিপে টুপে দেখা যায়। বেশ সময় কাটে। তোকে একটা সত্যি কথা বলি, ওই গ্লাসে যেটা খাচ্ছিস খুব আয়েশ করে – ওটা আমিও মাঝেসাঝে খাই। ঢকঢক করে কাল বিকেলেও খানিকটা খেলাম, জুত হল না। ‘
‘চুপপ। আর না।’
মাথা টিপটিপ ব্যথা করছে। বিশ্রী রকম বাজে অনুভূতি, মনে হচ্ছে খারাপ কিছু হবে। আর বুড়ো ভূতটাও এতক্ষণ কটকট করে চুপ মেরে গেছে। এখন তো বলাও যায় না একটু কথা বলুন।
গ্রামের বাড়িতে দাদা ভূতের গল্প বলতো। এখন ভাবলেই হাসি পায়, বোকা ছাড়া কে এসবে ভয় পায়। দাদা বেঁচে থাকলে বলতে পারতো, ‘দেখুন দাদা মশাই, ভূত এখন ঢকঢক করে বিয়ার খায়, বিকিনি পরা মেয়েছেলে খুঁজে মরার পর। হা হা হা।’
মেহেদী মাথা সোজা করার চেষ্টা করতে গিয়ে পারল না। শরীরটা অসার লাগছে।পা মেলে শুয়ে পড়ল সোফায়। অর্ধেক পা সোফার বাইরে চলে গেছে, লম্বা তো কম না। পুরো মেপে মেপে পাঁচ ফিট এগারো ইঞ্চি। মেহেদীর পাশে খুব কম মেয়েকেই মানায়।
‘এ্যাহ, গায়ে পা তুলে দিলে। ভালোরকম বেয়াদব তো তুমি।’
‘ওহ, এখনও যাননি।’
‘না, খুঁজছিলাম।’
‘কি?’
‘ওই টিপার যন্ত্র- রিমোট নাকি যেন বলছিলে ওটা দিয়ে সাউন্ড বাড়ানোর বোতামটা।’
‘পেলেন না?’
‘নাহ, এক বছর হল আজোও বোতামটা খুঁজে পেলাম না।’
মেহেদীর হাসি পেল। এক বছর ধরে একটা ভূত রিমোটে সাউন্ড বাড়ানোর বোতাম খুঁজে পেল না। আর দাদা বলত, ‘ভূত নাকি ঘাড় মটকে দেয়।’ হা হা হা।
‘হাসলে যে?’
‘বলুন তো মনে মনে আমি কি ভেবে হাসলাম?’
খুকখক, ঝকর ঝক শব্দের কয়েকটা কাশি। নিরবতা।
‘তোমার মন, তুমি জানো কি চলছে। আমি কি করে বলব – মজা নিচ্ছো নাকি?’
‘তা না, সব সময় তো শুনে আসছি যে ভূতেরা নাকি অতীত, ভবিষ্যৎ, মনের কথা সব জানে।যেকোনও কাজ চট করে মুহূর্তে করে ফেলে।’
‘ভূত তোমার বাপের চাকর কী না – চট করে কাজ করবে। মনের কথা কেন, কোনও ধরনের কথাই জানে না। ফালতু সব বদনাম।’ ‘’
মাথাটা আর কোনও মতেই সোজা রাখা যাচ্ছে না। বুক জুড়ে অসহনীয় ব্যথা, মুখ ঘামে জবজব করছে। সর্বনাশ! হার্টঅ্যাটাক না তো? জীবনে এখনও অনেক ভোগ করা বাকি। বয়স আটাশ বছর তিন মাস পনেরো দিন। ‘স্রষ্টা, আল্লাহ যেই থাকো আমায় সুযোগ দাও। প্লিজ সুযোগ দাও।’
‘খারাপ লাগছে নাকি?’
মেহেদী চোখ খুলল। শরীর হালকা লাগছে অনেক, একটু আগের আচমকা ব্যথার তীব্রতা নেই।
চুপ করে রইল খানিকক্ষণ। আসলেই কি স্রষ্টা বলে কিছু আছে? আকুল হয়ে ডাকার কিছুক্ষণ পর- এক মিনিটের মধ্যে ব্যথা কমে গেল! কাকতালীয় ছাড়া আর কিছু না। এখন মনে হচ্ছে বোকার মত না ডাকলেও ব্যথা কমত।
পর্দাটা সরিয়ে দিল। সন্ধ্যা নেমে গেছে। বেরুতে হবে, সিগারেট আনতে হবে। বুড়ো ভূতটা থাকুক একা। সিগারেট না হলে আর চলছেই না।