-কীরে, এসে গিয়েছিস? ব্যাট হাতে নিয়ে দরজা ঠেলে ঢুকতে ঢুকতে বলল সুবীর।
-এই আধ ঘন্টা খানেক হল। তোর খেলা কেমন হল? বিছানার ওপর একটু উঠে বসে আধশোয়া অবস্থায় বলল মৃণাল।
-ওই হল আর কি, তুই কখন এলি বল।
-এই ঘন্টাখানেক হল। একটু চান সেরে শুয়ে শুয়ে বঙ্কিম উপন্যাস পড়ছিলাম।
-তুই আর তোর বঙ্কিম। ওই কর তুই সারাদিন। তা পঙ্কজ আর সুভাষ কোথায়? কোথাও গেছে নাকি?
-সুভাষ তো কলেজে গেছে। ওর নাকি আজকে কোন অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার কথা ছিল। আর পঙ্কজ মনে হয় সিনেমা দেখতে গেছে কোথাও, এসে থেকে দেখা পাইনি তার।
-ওকে নিয়ে আর পারা গেল না। সারাদিন সিনেমা আর সিনেমা। যাই হোক, আমি চললাম স্নান করতে, ওরা এলে দরজাটা খুলে দিস।
-সে আর বলতে।
-আর হ্যাঁ, ল্যাংচা এনেছিস তো ওখান থেকে?
-অবশ্যই, মিহিদানাও আছে। ওই টেবিলের ওপর রাখা আছে। সুভাষ তো অলরেডি মেরে দিয়েছে দুটো। হাসতে হাসতে বলল মৃণাল।
-সেটাই স্বাভাবিক। ও যা পেটুক। আমি চান করে এসে খাব বরং।
-হ্যাঁ, তাই যা তবে।
বাগবাজারের এই ছোট্ট মেসে আজ তিন বছর ধরে বাসিন্দা এই চারজন। নিকটবর্তী এক ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্র তারা। বাড়ি কারোরই কলকাতা শহরে নয়। তবে আঞ্চলিক পার্থক্য ভুলে গত তিন বছরে পরম বন্ধু হয়ে উঠেছে তারা।
খুড়তুতো দাদুর শরীর খারাপের কারণে কিছুদিনের জন্য দেশের বাড়ি গিয়েছিল মৃণাল। আজ বুধবার একেবারে তাঁর শ্রাদ্ধশান্তি সেরে ফিরেছে সে।
দুপুরবেলা খাওয়া-দাওয়ার পর তাই ঘরে বসে আড্ডা দিচ্ছিল চার বন্ধু। দেখতে দেখতে শক্তিগড়ের শেষ ল্যাংচাটাও উধাও হয়ে গেল সুভাষের উদরগহ্বরে। কলেজ, গ্ৰাম নিয়েই আলোচনা চলছিল ওদের। ম্যাটিনি হলে আজ রাজ কাপুরের সিনেমাটা নাকি খুব ভালো লেগেছে পঙ্কজের।
পাঁচটা বাজতেই সুভাষ হঠাৎ করে বলে উঠল, ভাইলোগ, পাড়ার মোড়ের মাথায় নতুন ফুড ক্যান্টিন খুলেছে একটা, যাবি নাকি একবার?
-নিউ ক্যালকাটা ক্যান্টিনটা তো? হ্যাঁ, আমিও দেখলাম সেদিন, বলল পঙ্কজ।
-উফ্। তোর শুধু খাওয়া আর খাওয়া। এইতো একটু আগেই এতগুলো ল্যাংচা মেরে দিলি। সেগুলো হজম কর না আগে, বিরক্তির স্বরে বলে উঠল সুবীর।
-হুম। সবাই তো আর তোর মতন ব্যায়ামবীর নয়। খাও প্রাণ চায় যাহা। এই হল আমার মন্ত্র।
-নিকুচি করেছে তোর মন্ত্রের।
-আরে, আরে। শুধুমুধু নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করছিস কেন রে তোরা? আর সুভাষ পাড়ায় নতুন ক্যান্টিন করেছে আমায় বলিসনি কেন তুই? দুজনের ঝগড়া থামাতে বলে উঠল মৃনাল।
-সকাল থেকে আর টাইমই পেলাম কই বলার? এখন বলবো ভাবলাম সেই ফুরসতই দিল না কেউ। আর সুবীরকে তো কিছু বলার নেই। কাঁচুমাচু মুখ করে বলল সুভাষ।
-ছাড়, ওসব কথা বাদ দে। সাড়ে পাঁচটা তো বাজতে চলল। চল তাহলে একবার ঘুরেই আসা যাক। তুইও চল না সুবীর।
না বলে মুখ ঘুরিয়ে নিল সে।
-আরে চল না ভাই। বেকার মাথা গরম করিস কেন তুই? পঙ্কজের অনুরোধে অগত্যা রাজি হতে হল সুবীরকে।
ক্যান্টিনে গিয়ে প্রত্যেকে মর্জি মত খাবার অর্ডার দেওয়ার পর পঙ্কজ হঠাৎ সুভাষকে জিজ্ঞেস করে উঠল, আচ্ছা তুই কি এখানে আগেও এসেছিস?
-কই না তো। কেন? ঢোক গিলে উত্তর দিলে সুভাষ।
-সত্যি বলছিস? কপাল কুঁচকে প্রশ্ন পঙ্কজের।
সুভাষকে চুপ করে থাকতে দেখে মৃণাল বলল, কেন রে পঙ্কজ, কী ব্যাপার?
-তেমন কিছু না। তবে ওর খাবারের অর্ডারটা একটু বেশি তাড়াতাড়ি দিয়ে ফেলল ও। সবগুলোতে চোখ বুলিয়ে দেখার টাইমের আগেই। তাই জিজ্ঞেস করছিলাম আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলি নাকি তুই কি খাবি এখানে এসে?
ধরা পড়ে ফিক করে হেসে সুভাষ বলল, আগেও এসেছিলাম এখানে একবার বটে। তবে সেদিন বেশি কিছু নিইনি।
হো হো করে হেসে উঠল সুবীর।
-পাড়ায় নতুন খাবারের দোকান খুলেছে আর তুই সেখানে প্রথমদিনই গিয়ে হাজির হবি না সেটা অসম্ভব। আমারও প্রথম থেকে ওই সন্দেহই হচ্ছিল।
-আর পঙ্কজ তোরও গোয়েন্দাগিরির অভ্যেসটা আর গেল না। বলে তার পিঠ চাপড়ে দিল সে।
খাবার চলে এসেছিল ইতিমধ্যেই। তাই খাওয়া শুরু করতে আর সময় নষ্ট করল না ওরা।
-্কী? কেমন? ব্যায়ামবীর? ফিসফ্রাইয়ে কামড় বসিয়ে বলে উঠল সুভাষ।
-স্বাস্থ্যকর নয় যদিও। তবে স্বাদে যে অসাধারণ তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। ডিমের ডেভিল খেতে খেতে উত্তর দিল সুবীর।
-কবিরাজিটাও মন্দ নয় কিন্তু। ডালডায় ভাজা মড়মড়ে মাটন কবিরাজিতে দু কামড় বসিয়ে অনুধাবন পঙ্কজের।
-এই দোকানের সব জিনিসই সেরা। ঘোষণা গর্বিত সুভাষ ঘোষ।
-তুই জানলি কী করে? আগের দিন এসে গোটা মেনুটাই সাবাড় করে দিয়েছিলি নাকি? মজার ছলে বলে উঠল সুবীর।
-না তা নয়। তবে আমি যে কোনও রেস্টুরেন্ট বাইরে দেখলেই বুঝতে পারি খাবার কেমন হবে। সবকিছু টেস্ট করবার দরকার পড়ে না আমার।
-বিশেষজ্ঞ মানুষ। ঠোঁট উল্টে উত্তর দিল পঙ্কজ।
-কী রে ব্যাটা? তুই তো কিছু বলছিসই না। ভালো লাগছে না নাকি খাবার। মৃণালের দিকে তাকিয়ে বলল সুভাষ।
-আহ্। নাহ্। খাবার তো ভালোই। খুবই ভালো। চটক ভেঙে হাতে ধরে থাকা চিকেন পকোড়াটার দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল সে।
-কি ভাবছিস এত বল তো? কবিরাজিতে আরেক কামড় বসিয়ে প্রশ্ন পঙ্কজের।
-না তেমন কিছু নয়…
-প্রেমে পড়লি নাকি আবার কারও? হাসতে হাসতে বলল সুবীর।
-আহ্। তুইও না। বলতে দে না ওকে। বলল সুভাষ।
-হ্যাঁ, বল তুই। বলল পঙ্কজ।
-একটা কথা ভাবছিলাম আসলে।
-কী কথা?
-আমি গ্রামে থাকাকালীন একটা ঘটনা ঘটেছিল আসলে। সেটা নিয়েই ভাবছিলাম।
-কী ব্যাপার? আঙ্গুল চাটতে চাটতে জিজ্ঞেস করল সুবীর।
-গ্রামে আমাদের পৈত্রিক বাড়ির কাছেই বাড়ি আছে একটা। ঘটনাটা সেখানেরই।
-কী ঘটনা?
-দীর্ঘদিন ধরেই খালি পড়ে থাকে বাড়িটা। আমি যাওয়ার দুদিন আগেই একটা নতুন ভাড়াটে পরিবার এসেছিল ওখানে।
-তারপর? বলল সুভাষ।
-আমি আসার আগের দিন কে জানে কেন তল্পিতল্পা সব গুছিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেল তারা।
-চলে গেল মানে? কোথায় গেল? খাওয়া শেষ করে বলে উঠল পঙ্কজ।
-শুনলাম অন্য কোথাও ভাড়া পেয়ে গেছে নাকি। কিন্তু…
-বাড়িঘরদোর ভালো ছিল না নাকি? সুবীর বলল।
-না। অন্য আরও কোথাও ভালো জায়গা পেয়ে চলে গেছে আশা করি। বলল সুভাষ।
-নতুন বাড়ি, এক হপ্তা থেকেই চলে যাবে? এটা অদ্ভুত না?
-কোনও উপদ্রব আছে নাকি বাড়িটায়? মৃনালের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল পঙ্কজ।
-হুম, সে রকম তো শুনিনি কোনওদিন কিছু। তবে…
-আচ্ছা, বাড়িটার মালিক কে? কোথায় থাকে? তার কাছে গেলেই তো পরিষ্কার হয়ে যায় পুরো ব্যাপারটা।
-ওটাই তো মুশকিল রে সুবীর, অনেক দিন আগে ওই বাড়িতেই থাকত তারা। এখন চাকরিসূত্রে বোম্বে চলে যাওয়ার পর ফাঁকাই পরে থাকে বাড়িটা।
-ও, মানে এমনি সময়ে কেউ থাকে না বাড়িটায়?
-না।
খাওয়া হয়ে যাওয়া পরেও অনেকক্ষণ বসে ছিল ওরা। তাই উঠে পড়ল এবার। আলোচনার যোগসূত্র ছিন্ন হয়ে গেল তাই।
পরের দুদিন কাজ আর পড়াশোনার চাপে এই নিয়ে আর কোনও কথা হয়নি ওদের মধ্যে। তবে সেদিনের আলোচনার কথা ভোলেনি কেউই। গ্ৰীষ্মের ছুটি ক্রমশ এগিয়ে আসায় কোথায় যাওয়া যায় ছুটিতে, এই নিয়ে আড্ডা বসায় আবার উঠে এল কথাটা।
কলকাতার আশেপাশে সব ঘোরার জায়গাই খরচ, ভিড়, দূরত্ব ইত্যাদি কারণে বাতিল হয়ে যাওয়ায় পর সুভাষই হঠাৎ বলে উঠল, আচ্ছা মৃনালদের বাড়ির ওখানেও তো যাওয়া যায়?
-এত জায়গা থাকতে শক্তিগড় কেন হঠাৎ? বলল সুবীর।
-কারণ আছে বৈকি বৎস। রহস্যজনকভাবে বলে উঠল সুভাষ। তারপর মৃনালের দিকে তাকিয়ে বলল সেদিনের ঘটনাটার পুরোটা কিন্তু তুই বলিসনি আমাদের। ওই বাড়িতে অস্বাভাবিক কিছু নিশ্চয়ই আছে, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।
-হুম, কথাটা খারাপ বলিসনি সুভাষ। সেদিনের পর থেকেই আমার মনেও এই সন্দেহ জেগে উঠেছিল বটে, বলল পঙ্কজ।
বন্ধুরা হঠাৎ তার গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার জন্য এত আগ্রহ দেখাচ্ছে দেখে কিছুক্ষণের জন্য অবাক হয়ে গিয়েছিল মৃণাল। এবার কথা বলে উঠল সে, দেখ, সবই তো বুঝলাম। ওই বাড়িতে যাওয়ার জন্য তোরা সবাই খুবই উৎফুল্ল সেটা বুঝতে পারলাম, কিন্তু সত্যি বলতে আমার নিজের অন্তত মনে হয় না ওখানে আদৌ কিছু অলৌকিক আছে বলে। বাড়িটা ফাঁকা নির্জন জায়গায় নয় মোটেই, বরং লোকালয়ের একেবারে মাঝেই। তাছাড়া ওখানে কোনও অদ্ভুত আলৌকিক কোনও ঘটনা কোনওদিন ঘটেছে বলে আমি অন্তত শুনিনি। আমরা ওখানে যেতে পারি। ওই বাড়িতে থাকার ব্যবস্থাও বোধহয় করা যাবে। কিন্তু তোদের হতাশ হওয়ার সম্ভাবনাটাই বেশি থাকবে।
-হুররে! ব্যাস। তাহলে ব্যবস্থা হয়েই গেল শেষপর্যন্ত। আনন্দে চেঁচিয়ে ওঠে সুভাষ।
-কিন্তু…
-আর কোনও কিন্তু নয় মৃনাল। মনে রাখবি তুই কিন্তু রাজি হয়ে গিয়েছিস অলরেডি। বলে ওঠে পঙ্কজ।
-বেশ, তবে আমিও রাজি। এতক্ষণ চুপ করে বসেছিল সুবীর। শেষ পর্যন্ত বন্ধুদের সঙ্গে গলা মেলাতেই হল তাকে।
-ঠিক আছে তবে; তোরা যখন এতটাই উৎসাহী, তখন যাওয়াই যাক ওখানে। তবে তিন ঘন্টার ট্রেন জার্নির রাস্তা। ব্যাগপত্র গোছগাছ করা শুরু করে ফেলতে হবে কাল থেকেই কিন্তু। গ্রীষ্মের ছুটি আসতে বেশি দেরি নেই আর।
-ও নিয়ে ভাবিস না। সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। সঙ্গে কিছুটা খাবার-দাবারও নিয়ে নেব বরং।
-তোর শুধু খাওয়া আর খাওয়া। বিরক্ত মুখে বলল সুবীর।
-হিঃ!হিঃ!
২ রা মে, সোমবার। মেসের ঘরের দরজার তালাচাবি বন্ধ করে তা ম্যানেজারের হাতে তুলে দিয়ে ঝোলা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পরলো চারমূর্তি। গন্তব্য হাওড়া স্টেশন।
সাড়ে দশটা নাগাদ বর্ধমান লোকালে চেপে বসল ওরা চারজন। প্ল্যাটফর্ম নম্বর চার।
কী জানি কেন আজকের এই ট্রেনে ভিড় ছিল না বিশেষ। গাড়িতে উঠে তাই হাত-পা ছড়িয়ে বসল ওরা। ব্যাগগুলো চালান করে দিল সিটের নিচে।
কিছুক্ষণ পরে গাড়ি ছাড়তেই প্রথম কথা বলে উঠল পঙ্কজ।
-আচ্ছা মৃণাল, একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল।
-হ্যাঁ বল না।
-তুই যে বলছিলি ওই ভাড়াটে পরিবারটা তিন দিন থেকেই চলে যায় ওই বাড়ি ছেড়ে… এরকম কি আগেও ঘটেছে? নাকি এই প্রথমবার?
-ছোটবেলা থেকেই তো দেখেছি বাড়িটাকে; সত্যি বলতে বাড়িওয়ালারা চলে যাওয়ার পর বেশিরভাগ সময় খালিই পড়ে থাকত বাড়িটা। ওই সব জায়গায় বাড়ির ভাড়াটে পাওয়া এমনিতেও খুবই দুঃসাধ্যকর। আর তাছাড়া ওই বাড়ির ভাড়া এতটাই বেশি যে ভাড়াটেরা ওই বাড়িটা এড়িয়েই চলত। তবে ওই বাড়ির কোনও অপবাদ আমি শুনিনি এখনও পর্যন্ত।
-আমাদের আবার কোন টাকা পয়সা দিতে হবে না তো ওখানে থাকবার জন্য? জিজ্ঞেস করল সুবীর।
-আরে না না। ওই নিয়ে চিন্তা করিস না। বাড়ির মালিক আমার বহুদিনের পরিচিত। আমি নিজেই গেয়েছি কতবার ঐ বাড়িতে। ছোটবেলায় আমি মাঝে মাঝেই ওই বাড়িতে গিয়ে থাকতাম।
-ইদানিংকালে গিয়েছিলি নাকি কোনও সময়? বলল সুভাষ।
-হাঁ গিয়েছিলাম বটে। এই তো আগেরবার যখন এসেছিলাম দেশের বাড়ি তখনও গিয়েছিলাম ওই বাড়িতে।
-তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে ওই বাড়িতে সন্দেহজনক, ভৌতিক অথবা অলৌকিক কোনও কিছু থাকার সম্ভাবনা যথেষ্ট কম। তবে সেরকম কিছু না পেলেও আমার অন্তত আফসোস হবে না কোনও। গরমের ছুটিটা অজপাড়াগাঁয়ের কোনও গ্রামে কাটাতে পেরেই আমি খুশি। বলে বসল সুভাষ।
-এই ব্যাপারে আমি তোর সঙ্গে একেবারে একমত। ভূতের দেখা পাই কী আর না পাই, গরমের ছুটিটা যে খারাপ কাটবে না সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিন্ত। বলল সুবীর।
-তোদের উৎসাহ দেখে আমারও কিন্তু আনন্দ হচ্ছে যথেষ্ট। চিন্তা করিস না; ভূতের বাড়ি, ল্যাংচা আর মিহিদানা বাদ দিয়েও শক্তিগড়ে অনেক কিছু আছে দেখবার, করবার। খাওয়া-দাওয়ারও কোনওরকম কমতি হবে না কোনও। পুকুর-খেত সবই আছে আমাদের নিজস্ব। সুভাষের দিকে তাকিয়ে বলল মৃণাল।
-বাহ্। শুনে মনটা খুশি হয়ে গেল বটে। হাসিমুখে বলে উঠল সুভাষ।
-ওখানে গিয়ে অন্তত চার-পাঁচ কেজি ওজন অন্তত বাড়বে তোর, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিন্ত। হাসতে হাসতে বলল পঙ্কজ।
গল্পগুজব হাসিঠাট্টা মজা করতে করতে শক্তিগড় স্টেশনে এসে দাঁড়াল ট্রেন। বেশিক্ষণ দাঁড়ায় না গাড়ি ওই স্টেশনে তাই ব্যাগপত্র নিয়ে হুড়োতাড়া করে নেমে পড়ল ওরা প্ল্যাটফর্মে।
-এরপর কোনদিকে? স্যুটকেসটা কাঁকলে করে মৃণালের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল পঙ্কজ।
-এদিকে চলে আয়। বলে স্টেশন থেকে বেরোবার জন্য পা বাড়ালো মৃণাল।
ওর পিছু পিছু গিয়ে স্টেশনের বাইরে রিক্সা স্ট্যান্ডে গিয়ে দাঁড়াল বাকি তিনজন। চারজনের জন্য দুটো রিক্সা করতে অসুবিধা হল না বিশেষ। মল্লিকপাড়া বলতেই রাজি হয়ে গিয়েছিল প্রথম রিক্সাদুটো।
মেইনরোড ছাড়িয়ে মেঠো গেঁয়ো রাস্তা ধরে মিনিট পনেরো চলবার পর মৃণালের ইঙ্গিতে একটা বড় বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল রিক্সাগুলো।
বাড়ির চেহারা আর সৌন্দর্য দেখে সুবীর, পঙ্কজ আর সুভাষ প্রত্যেকেই যে অবাক তা বোঝা যাচ্ছিল ভালোই। গ্রামের এত ভেতরে এত বড় রংচঙে চকমেলানো সুন্দর বাড়ি বোধহয় আশা করেনি তারা।
-দাঁড়িয়ে রইলি কেন? ভেতরে চল। রিকশার ভাড়া মিটিয়ে বন্ধুদের তাড়া দিল মৃণাল।
শুরুর দিকে হতভম্বতা কাটিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল ওরা।
একটু ডাকাডাকি করতেই বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন এক বয়স্কা মহিলা।
-রাঙাপিসি, এবারের ছুটিতে বন্ধুদের নিয়ে চলে এলাম। আর তুমি কেমন আছ?
-ভালো বাবা, ভালো। মঙ্গল হোক তোমাদের সবার। বলে কুঁজো হয়ে হাঁটতে হাঁটতে সদর দরজা দিয়ে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে গেলেন তিনি।
-চলে আয়, বলে বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেল মৃনাল। বাকিরা ওর পিছু পিছু বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই এবার বেরিয়ে এলেন সম্ভবত মৃণালের মা। বন্ধুদের আসার খবর বোধহয় তিনি আগে থেকেই জানতেন সাদর আদর আপ্যায়ন করে ভিতরে ডেকে নিয়ে গেলেন তাদের।
চান হাতমুখ ধুয়ে ওরা যখন খেতে বসল ঘড়িতে তখন একটা বাজে। গ্রামে হলেও এই বাড়িতে অভাব নেই কোনও কিছুরই, পাকা স্নানঘর থেকে শুরু করে পুকুরের বাঁধানো ঘাট সব রকমেরই ব্যবস্থা করা আছে।
দুপুরের খাবার আয়োজন হয়েছিল এলাহি। শহর থেকে এসেছে ছেলের বন্ধুরা, তাদের কাছে বৈভব দেখাবার জন্যই বোধহয় এই ব্যবস্থা। মৃণালের বাবাও বসে ছিলেন ওদের সঙ্গে খেতে, অনেক কথা হচ্ছিল তাঁর সঙ্গে পঙ্কজ, সুভাষদের। গ্রামের সুমধুর পরিবেশে সুন্দর বাড়িঘরদোরের মধ্যে পড়ে ভুলেই গিয়েছিল ওরা এখানে আসার আসল কারনটা। ওদের এখানে অন্তত এক হপ্তা থাকার অনুরোধ করেছে মৃণালের মা নিজে। সেই সময় আর কী কী খেতে পাবে সেই ভাবতে ভাবতেই কাতলা মাছের মাথা চিবাচ্ছিল সুভাষ; মৃণালদের নিজেদের পুকুরের মাছ।
খেতে খেতেই এবার আসল কথাটা বলে ফেলল পঙ্কজ।
-আচ্ছা, কাকু পাশের বাড়িটায় কেউ থাকে না বুঝি?
পলাশবাবু গালে কাতলা সর্ষের ঝোলমাখা একরাশ ভাত পুরে দিয়ে পঙ্কজের দিকে তাকিয়ে বললেন, কেন? ও কথা বলছ কেন?
-না মানে, বাড়িটা তো এই বাড়ির ঠিক পাশেই। কিন্তু এসে থেকে কোনও লোকজনকে দেখলাম না ঢুকতে বা বেরোতে। অথচ বাইরে থেকে দেখে কিন্তু পরিত্যক্ত বলে মনেও হয় না। তাই জিজ্ঞেস করছিলাম আর কি। কেউ থাকে না মনে হয়…
-ও বাড়িতে আসলে বেশিরভাগ সময়টাই কেউ থাকে না। মালিকেরা সব বিদেশে, তবে মাঝে মাঝে ভাড়া দেয়। বেশিরভাগ সময় ফাঁকাই পরে থাকে। তবে পৈতৃক বাড়ি হিসেবে খুব যত্ন করে গুছিয়ে গাছিয়ে রেখেছে আর কি। থালার ভাতে ডাল ঢালতে ঢালতে বললেন মৃণালের বাবা।
-ও আচ্ছা। বুঝলাম।
খাওয়া শেষ করে উঠে পড়ল ওরা। ইতিমধ্যেই ওদের চারজনের জন্য দুটো ঘর নির্দিষ্ট হয়েছে। মৃণাল আর সুভাষ থাকবে একটায়, আরেকটায় পঙ্কজ আর সুবীরের থাকার ব্যবস্থা হচ্ছে।
মৃণালদের বাড়ি দুতলা। এই গ্রামে এখনও অব্দি সুভাষদের চোখে দুতলা বাড়ি দুটোই পড়েছে। একটা মৃণালদের, অন্যটি ঠিক তার পাশেই; কিন্তু ফাঁকা। খাওয়া শেষ করে হাত মুখ ধুয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে সুবীর বলে উঠল, আচ্ছা, বাড়ির মালিকেরা আসলে থাকে কোথায়?
-উপরে চল বলছি। সংক্ষিপ্ত উত্তর মৃণালের।
খাওয়া দাওয়া করে একেবারে ছাদে উঠেই বিশ্রাম নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল ওরা। আজকে রোদ নেই বিশেষ, ফুরফুরে হাওয়া বয়ে যাচ্ছে চারিদিকে; বিকেলের দিকে কালবৈশাখী আসবে মনে হয়।
আশেপাশে উঁচু বাড়ি বিশেষ না থাকায় মৃণালদের থেকে এলাকার অনেকটা অংশই ভালোভাবে দেখা যায়। মৃণালদের বাড়ির লাগোয়া পশ্চিমদিকের বিশাল বড় বাগান। সেখানে আম, বট-ঝাউ হেন গাছ নেই যা নেই। মৃণালের বাবার সঙ্গেই কথা বলে বোঝা গিয়েছিল গাছপ্রেমী মানুষ তিনি। তারই প্রতিফলন মনে হয় এই সুবিস্তীর্ণ বাগান। বাগান ছাড়িয়ে রয়েছে ক্ষেত। ছোটো ক্ষেত, মূলত শাকসবজি আনাজ চাষ হয়; পুরোটাই মৃণালদের মালিকানাধীন।
ওদের যে জন্য এখানে আসা সেই বাড়িটা পাশাপাশি হলেও ঠিক কাছাকাছি নয় আসলে। মৃণালদের ছাদ থেকে বেশ ভালোভাবেই দেখা যায় সেটাকে। দুটো বাড়ির মাঝখানে একটা নিচু পাঁচিল আছে, কিছুটা ছাড়িয়ে এক ফালি ফাঁকা জমি; তারপরেই ওই বাড়িটা। মৃণালদের বাড়ির মতই ওটাও দুতলা; দেখতেও বেশ সুন্দর। দেখেই বোঝা যায় কেউ না থাকলেও পরিচর্যা হয় নিয়মিতই। চারপাশে কিছুটা বাগান আছে, তবে সেটার পরিচর্যা হয় না বোধহয় নিয়মিত, সেটা দূর থেকেই বোঝা যাচ্ছে ভালোভাবে; আগাছায় ভর্তি হয়ে গেছে পুরো জায়গাটা।
-আচ্ছা, বাড়িটায় তো কেউ থাকে না বললি তাহলেও এত গোছগাছ সুন্দর কেন? ছাদের পাঁচিলে হেলান দিয়ে জিজ্ঞেস করল সুবীর।
-কেয়ারটেকার আছে আসলে ওখানে একজন। রাতে থাকে না, প্রত্যেকদিন আসেও না। কিন্তু তাও মাঝে মাঝে এসে ঘরদোর পরিষ্কার করে দিয়ে যায়, সেইজন্যই।
-ও আচ্ছা।
-এখন আমারও সামনাসামনি দেখে মনে হচ্ছে ওখানে ভূত থাকার সম্ভাবনা কিন্তু যথেষ্ট কম। বলে উঠল পঙ্কজ।
-তবে এখানে আসাটা যে বৃথা গেছে তা কিন্তু বলা যাবে না। মৃণালদের পুকুরের মাছগুলোর টেস্ট কিন্তু হেবি।
-সত্যিই তোকে নিয়ে আর পারা গেল না। বন্ধুর বাড়িতে এসেও তোর শুধু খাওয়া আর খাওয়া। পঙ্কজ ঠিকই বলেছিল ট্রেনে, তুই এখান থেকে চার-পাঁচ কেজি ওজন না বাগিয়ে ফিরবি বলে মনে হয় না আর। ঠাট্টার স্বরে বলল সুবীর।
-আচ্ছা, ওখানে যাওয়ার বন্দোবস্ত কবে করা যায় বল তো? এবার বলে উঠল পঙ্কজ।
-তোরাই ঠিক কর না বরং। যেদিন বলবি সেদিনই হবে। ও বাড়ির দারোয়ান আমার চেনা। একটু কথাবার্তা বললেই রাতে থাকার জন্য চাবি দিয়ে দেবে।
-এসেই যখন গিয়েছি, তখন আর অপেক্ষা করে লাভ কি বল। কালই চল না। একরাত্রির তো ব্যাপার আর ভূতদর্শন হবে বলে আমার অন্তত মনে হয় না।
-সেতো তোদেরকে আগেই বলেছিলাম। আর ঠিক আছে, দারোয়ানকে বলে বরং কাল সকালেই চাবি জোগাড় করে রাখবো আমি।
-গুড। এখানে আসার মূল উদ্দেশ্য পূরণ হল তাহলে। ব্যবস্থা যখন করা হয়েই গেল, তখন আজ বিকেলটা একটু ঘুরে আসবি নাকি পুকুরের দিকে? পাঁচটা তো বাজতে চলল ঘড়িতে। মৃণালের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল সুভাষ।
-পুকুর না। আজ থাক, কাল যাব। অন্ধকার হতে বেশিক্ষণ বাকি নেই এমনিতেও আর সন্ধের দিকে পুকুরের ওদিকে না যাওয়াই ভালো। আরও ইন্টারেস্টিং একটা জিনিস দেখাবো তোদের আজকে। চলে আয়। বলে সিটের দরজার দিকে এগিয়ে গেল সে।
সিঁড়ি দিয়ে একতলায় নেমে সদর দরজা দিয়ে বাইরের মেঠো রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল ওরা।
-তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল মৃণাল। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে পিছন থেকে বলে উঠল সুভাষ।
-হ্যাঁ, বল না।
-আচ্ছা, আজকে সকালে তোদের বাড়িতে যে বয়স্ক মহিলাকে দেখলাম, তিনি কে ছিলেন রে?
-ও উনি? ইসস্, আমিই আসলে ভুলে গিয়েছিলাম তোদের বলতে। উনি আসলে আমাদের এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়া, সম্ভবত বাবার পিসির কেউ হন। আমাদের গ্রামেই থাকেন উনি, পুবপাড়ায়। আশেপাশের আত্মীয় বলতে শুধু আমরাই আছি।
-ওও।
হাঁটতে হাঁটতে মাঠ ছাড়িয়ে ওরা কখন একটা বিশাল বড় পুরোনো মন্দিরের ঠিক বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে নজরই করেনি কেউ। মন্দিরটা বহু পুরনো দেখলেই বোঝা যায় চারিদিক অপরিচ্ছন্ন, অযত্নের ছাপ স্পষ্ট। মন্দিরের পাঁচিল আর ছাদ ফাটিয়ে বিস্তারিত হয়েছে এক বিশাল বড় অশ্বত্থ গাছ। সূর্যের কিরণ সেই ফাটল দিয়ে প্রবেশ করে ছড়িয়ে পড়ছে মন্দিরের ভিতরের চাতালে।
-আয়। বলে মন্দিরের ভিতরে প্রবেশ করল মৃণাল।
-এখানে ভিতরে সাপটাপ নেই তো রে? বাইরে দাঁড়িয়ে জিগ্যেস করল পঙ্কজ।
-থাকতেও পারে। মজার ছলে বলল মৃনাল।
-এ মন্দির তো অনেক পরনো মনে হচ্ছে। ভেতরে ঢুকে চারপাশটা দেখে বলল সুভাষ।
-অনেক। বারোভুঁইয়ার নাম শুনেছিস কোনদিনও? তাঁদেরই একজনের এলাকা ছিল এটা। সেই আমলেই তৈরি। বহু পুরনো শিবমন্দির ছিল। এখন অবশ্য ব্যবহার করে না কেউ, তাই জঙ্গল আগাছায় ভর্তি হয়ে গেছে পুরো এলাকাটা।
-ও আচ্ছা, বুঝলাম।
মন্দির দেখে যখন ওরা বাড়ি ফিরল, তখন পশ্চিম আকাশে অস্ত নিয়েছেন সূর্যদেব। কলকাতা শহরের মতন এখানে রাস্তায় কোনও আলো নেই। তাই বেশি দেরি করলো না ওরা আর বাড়ি ফিরতে। সঙ্গে টর্চ এনেছে যদিও কলকাতা থেকে, কিন্তু মন্দিরে যাওয়ার সময় তা সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার কথা খেয়াল পরেনি ওদের কারোরই।
পরেরদিন কী হবে সেই নিয়ে ভাবতে ভাবতেই সেই রাতটা কেটে গেল ওদের। ইতিমধ্যেই মৃণালের বাবার সঙ্গে কথা বলে ওই বাড়িতে থাকার অনুমতি নিয়ে নিয়েছে ওরা। তবে মৃণালের মত তাঁরও বিশ্বাস ওই বাড়িতে ভৌতিক বা আলৌকিক আদৌ কিছু নেই।
যাই হোক, পরেরদিন সকালবেলা উঠতে বেশ দেরি হয়ে গেল ওদের। উঠেই ওই বাড়িতে যাওয়ার তোড়জোড় শুরু করে দিলো ওরা। আগের দিনের রাতের খাওয়াটা হয়েছিল জম্পেশ। হাতমুখ ধুয়ে জলখাবার খাওয়ার আগেই মৃণাল বেরিয়ে পড়ল পাশের বাড়ির দারোয়ানের কাছ থেকে চাবি আনার জন্য। ইতিমধ্যে পঙ্কজ সুভাষ সুবীর ওই বাড়িতে একরাত থাকার জন্য ব্যাগপত্র সব গুছিয়ে নিয়েছে। কলকাতা থেকে আনা টর্চ, শতরঞ্জি, মশা তাড়ানোর ধূপ, মোমবাতি, তাসের প্যাকেট সবই একটা ব্যাগে। রাতের খাবার দাবার বিকালের দিকে একেবারে খেয়েই ওই বাড়িতে যাবে ঠিক করল ওরা।
ইতিমধ্যে সকালবেলা মৃণাল আর পঙ্কজ গিয়ে একবার দেখে এসেছে বাড়ির ভিতরটা। সব নাকি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নই আছে, ওদের আর কিছু ঝাড়াঝুড়ির দরকার নেই।
আগের দিনের মতন সেদিনের খাওয়াও হয়েছিল জাঁকজমকদার। রাতের খাবার খেয়ে সন্ধে সাতটা নাগাদ ব্যাগপত্র আর জিনিসগুলো গুছিয়ে নিয়ে ওরা মৃনালদের বাড়ি থেকে বেরোতে যাবে, ঠিক সেই সময়ই সদর দরজায় ওদের সঙ্গে দেখা হল মৃণালের বাবার পিসির।
ওদের দেখে চওড়া হাসি ফুটে উঠল বৃদ্ধার মুখে। হেসে জিজ্ঞেস করলেন, এই সন্ধেবেলা কোথায় যাচ্ছ বাছারা?
-পাশের বাড়িতে যাচ্ছি ঠাকুরমা। আজ রাতটা ওখানেই কাটাব ঠিক করেছি আমরা চারবন্ধু মিলে। মৃনাল কিছু বলবার আগেই ফস করে উত্তর দিয়ে বসল সুভাষ।
কী জানি কেন কথাটা শুনেই তাঁর মুখটা কেমন যেন কালো হয়ে গেল।
-মল্লিকদের বাড়ি? কেন বাবা? ওখানে কি কাজ পড়ল আবার তোমাদের? শান্তস্বরে জিজ্ঞেস করলেন মহিলা।
-তেমন কিছু নয় ঠাকুমা। শহর থেকে এসেছে ওরা। পাশের বাড়িটা দেখে পছন্দ হয়েছে। তাই আমিই ঠিক করলাম ওদেরকে সঙ্গে নিয়ে একরাত কাটিয়ে আসব ওখানে, বলল মৃণাল।
-তা ভালো। তবে রাতটা ওখানে না কাটালেই বোধহয় ভালো করতে বাছারা। গভীর স্বরে বলে উঠলেন বৃদ্ধা মহিলা।
-এরকম কেন বলছেন ঠাকুরমা? কারো কোনও সমস্যা আছে নাকি? এবার জিজ্ঞেস করে উঠল সুবীর।
-থাকতেও তো পারে। বড়কর্তা ওই বাড়িতে কারো রাত কাটানো পছন্দ করেন না একদম। একটু সাবধানে থেক তোমরা কিন্তু। সদর দরজা দিয়ে মৃণালের ঠাকুরমার বেরিয়ে যাওয়ার সময় কথাগুলো কেমন যেন সুদূর ভবিষ্যৎবাণীর কানে বেজে উঠল মৃণাল পঙ্কজদের।
দেরি হয়ে যাচ্ছিল তাই আর অপেক্ষা না করে মল্লিক বাড়ির দিকে পা বাড়াল ওরা। বৃদ্ধার কথায় মনের গভীরে কোথাও যেন একটা আশঙ্কা আর ভয় কিন্তু ঢুকে গিয়েছিল ওদের সবারই।
-আচ্ছা। এই বড়কর্তাটিকে বলতো? এই বাড়ির মালিক বোধহয়, নাকি? রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করে উঠল পঙ্কজ।
-উম হুম্, সে সম্ভাবনা কম। এই বাড়ির মালিক যারা বিদেশে আছে, তাদের কারোরই বয়স পঞ্চাশের বেশি নয়। তাদেরকে ঠাকুমা বড় কর্তা বলে সম্বোধন করবে বলে অন্তত আমার মনে হয় না।
-তবে? কে হতে পারেন উনি? পাশ থেকে জিজ্ঞেস করে উঠল সুভাষ।
-জানি না। তবে ওই সব জিনিস নিয়ে চিন্তা করিস না বেশি। এমনিতেও ঠাকুমার ভুলভাল বকার অভ্যেস আছে একটু। বয়সের দোষ আর কি। এমনও হতে পারে, এসব কিছুই সত্যি নয়। শুধু আমাদের একটু ভয় দেখাবার জন্যই বোধহয় কথাগুলো বললেন উনি। মল্লিকবাড়ির ফটক পেরিয়ে ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে উত্তর দিল মৃনাল।
বাড়িটা মৃণালদের বাড়ির মতই দুতলা আর বেশ বড়ই। আপাতত ওরা ঠিক করেছে দুতলার দক্ষিণ ঘরটাতেই আজকের রাতটা কাটাবে। মৃণালের মতে ওটাই বাড়ির সবথেকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ঘর এবং যথেষ্ট বড়ও আছে অন্য ঘরগুলোর থেকে তুলনায়। অন্তত সকালবেলা এসে তাই দেখে গেছে সে।
সেই কথা মতই সিড়ি ভেঙ্গে দরজা তালা খুলে সেই ঘরে ঢুকে গুছিয়ে-গাছিয়ে বসল ওরা। রাত সবে সাড়ে সাতটা, এত তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ার কোনও প্রশ্নই নেই আপাতত। যদিও এই ঘরে বিছানা, তক্তপোশ সব ব্যবস্থাই করা আছে। ঘরটা যথেষ্ট বড় হওয়ায় ওরা ঠিক করল মেঝেতে শতরঞ্জি পেতে না বসে চৌকিতে বসেই তাস খেলবে কিছুক্ষণ।
বাড়ির মালিকেরা দেশে ফিরলে এখানে এসে এই ঘরটাতেই থাকে। সেই জন্যই বোধহয় এত পরিপাটি করে সাজানো এই ঘরটা। সেটা ইতিমধ্যেই মৃণালের কাছ থেকে জেনে নিয়েছে বাকিরা।
রাত আটটা নাগাদ সবকিছু ঠিকঠাক করে সাজিয়ে গুজিয়ে তাস খেলতে বসবে ওরা, ঠিক তখনই বাড়ির কারেন্ট চলে গেল হঠাৎ করেই। এইসব প্রত্যন্ত গ্ৰামে এই এক রোজকার সমস্যা যদিও, কারেন্ট থাকে না অনেক সময়ই; বিশেষ করে রাতের দিকে।
তাই ওই নিয়ে আর বেশি না ভেবে মোমবাতি জ্বেলে তক্তপোশের উপর ছড়িয়ে বসে পড়ল ওরা। বাইরে যে পুরো ঘুটঘুটে অন্ধকার, তা কিন্তু নয়। আজকে পূর্ণিমা, তাই চাঁদের আলোর দৌলতে জোৎস্না মুখরিত চারিদিকে সবকিছুই দেখা যাচ্ছে মোটামুটিভাবে।
খেলতে খেলতে ঘড়ির কাঁটা কখন যে বারোটার সীমা ছাড়িয়ে গেছে কেউ নজরই করেনি ওরা। রাতে খাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বিস্কুট, চানাচুরের প্যাকেট এনেছিল ওরা সঙ্গে করে, তাই খিদে মেটাবার কোনও অসুবিধে অন্তত ওদের হয়েনি সেই রাতে।
তক্তপোশের মাঝখানে মোমবাতি জ্বালিয়ে চারিদিকে ঘিরে বসে তাস খেলছিল ওরা। দুজন দুজন করে মুখোমুখি হয়ে বসেছিল ওরা। মৃণালের উল্টোদিকে বসেছিল সুভাষ। হঠাৎ করে খেলতে খেলতে মৃণালের পিঠের দিকে দেওয়ালটায় একটা জিনিস নজরে পড়ল ওর।
দেওয়ালটায় কার যেন একটা তেলরঙে আঁকা ছোটখাটো পোট্রেট টাঙানো আছে, সেটা ঘরে ঢুকেই চোখে পড়েছিল ওদের। এতক্ষণ অব্দি সেদিকে বিশেষ নজর পড়েনি সুভাষের। কিন্তু এখন সেটার দিকে তাকিয়ে তার যেন মনে হল টাঙানো ফটোটার নিচের দিক থেকে কোনও এক অজানা কালো তরল যেন ক্রমশ গড়িয়ে পড়ছে দেওয়ালের গা বেয়ে ধীরগতিতে।
মোমবাতির অল্প আলোর জন্য সেটা কী ঠিক করে ঠাওর করে উঠতে পারল না সুভাষ। কিন্তু দেওয়ালে পড়া মোমবাতির আলোয় মৃণালের লম্বা ছায়ার পাশে রাখা ছবিটার ব্যাপারে হঠাৎ যেন কেমন সন্দেহ জেগে উঠল তার মনে।
এইসব কিছু নিয়ে ভাবতে গিয়েই মনে হয় অন্যমনষ্ক হয়ে গিয়েছিল সে কিছুক্ষণের জন্য। হুঁশ ফিরল পঙ্কজের ধাক্কায়।
-কী রে, তোর দান এবার। দে নারে। কখন থেকে বলা হচ্ছে। বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট তার গলায়।
বাস্তবের জগতে ফিরে এসে সুভাষ তার এক দান দিতেই মৃণাল বলে উঠল, কী নিয়ে এত ভাবছিস বল তো সুভাষ? খেলায় একদম মন নেই দেখছি তোর আজ।
কোনও এক অজ্ঞাত কারণের জন্যই বোধহয়, উত্তরটা দেওয়ার সময় কেমন যেন কেঁপে গেল সুভাষের গলাটা।
-তো-তোর পিছনে…
-আমার পিছনে? কী হয়েছে? তৎক্ষণাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে নিজের পিছনের দেওয়ালে দৃষ্টি পড়ল তার।
ততক্ষণে বোধহয় পঙ্কজ আর সুবীরও আঁচ পেয়েছে সুভাষের অস্বাভাবিকতার।
হাতের কাছে রাখা টর্চটা নিয়ে দেওয়ালের দিকে এগিয়ে গেছে মৃণাল। ফটোটার ওপর আলো পড়তেই সুভাষ পেছন থেকে দেখতে পেল হঠাৎ করে যেন দেওয়ালের মধ্যেই মিলিয়ে গেল কালো ধীরগতিতে বহমান তরল রেখাটা। কোনও এক অজানার আতঙ্ক যেন গ্রাস করে উঠল তাকে।
-কিসের কথা বলছিলি বল তো সুভাষ? কিছুই তো নেই সেরকম এখানে আর এই ফটোটা…এটা দেখেই বোধহয় ভয় পাচ্ছিস বুঝি?
ধীরে ধীরে মাথাটা উপর-নিচ নাড়াল সুভাষ।
-হাহা, ও দেখে ভয় পাওয়ার মত কিছুই নেই কিন্তু। আসলে এই বাড়ির প্রাক্তন মালিকের ফটো এটা। শুরু থেকেই আছে। এখানের বাড়িটা তো উনিই তৈরি করেছিলেন আসলে। নাম ছিল ময়ূররঞ্জন মল্লিক। অনেকদিন হল মারাও গেছেন।
মৃণাল তার কথা শেষ করতে না করতেই হঠাৎ একটা অদ্ভুত চিৎকার করে তক্তপোশের উপর লাফিয়ে উঠল পঙ্কজ।
-ওও কী? ওটা কী দেখলাম ওখানে? বলে চেঁচিয়ে উঠল সে।
-কী-কীইই হল রে আবার? চমকে উঠে পঙ্কজ এর দিকে তাকাল সুবীর। চারজনের মধ্যে স্বঘোষিতভাবে সবথেকে বীর আর শক্তিশালী হয়েও এই পরিবেশে পরে সাহসের স্তম্ভ যে নড়ে গেছে তার, সেটা তার কেঁপে ওঠা গলায় ভালো করেই বোঝা যাচ্ছিল।
প্রশ্নটার পঙ্কজ সরাসরি উত্তর না দিয়ে আতঙ্কিত গলায় তাকে বলে উঠল, তো-তোরা চল এখান দিয়ে এক্ষুনিই। আ-আমার ভালো লাগছে না একদম। মনে হচ্ছে খু-খুব খারাপ কিছু একটা হতে চলেছে আমাদের সাথে, আর এক মুহূর্তও এখানে থাকা যাবে না আমাদের।
সুভাষ আর পঙ্কজ কী দেখে যে এইরকম করছে তা কিছুতেই বুঝতে পারছিল না মৃণাল আর সুবীর। কিন্তু ওদের মনেও ভয় যেন বিন্দু বিন্দু করে দানা বাঁধছিল। কিসের যে ভয় ওরা ঠিক বুঝতে কিংবা বলতে পারছিল না। কিন্তু কোনও খারাপ কিছু নিয়েই যে তা, সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই আর।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা ঠিক করে ফেলল এই বাড়িতে বিশেষ করে এই ঘরে আর থাকা সম্ভব নয় ওদের পক্ষে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওখান থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছিল ওরা সবাই। তাড়াহুড়োতে তাই থেকে বার করা জিনিসগুলো আর গুছিয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে নিল না আর ওরা।
ওরা তাড়াহুড়ো করে ঘর থেকে বেরোতে যাবে, ঠিক তখনই ঘটল আরেকটা কান্ড। ঘর থেকে বের হবার সময় হঠাৎ করে চৌকাঠে হোঁচট খেয়ে দালানের মেঝেতে হুমড়ি খেয়ে পড়ল সুবীর। ঘটনাটায় হয়তো এতটা ভয় পেত না ওরা কেউই, যদি না আরও একটা জিনিস চাক্ষুষ হত ওদের। দালানে দাঁড়িয়ে থেকে ওরা দেখতে পেল হঠাৎ করেই যেন নিভে গেল ঘরের তক্তপোশের উপর রাখা বড় মোমবাতিটা। সেটাও অবশ্য অতটাও অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু তার সঙ্গেই ওরা শুনতে পেয়েছিল ঘরের ভিতরে থাকা কারও যেন ফুঁয়ের আওয়াজ।
ঘাড় ঘুরিয়ে ঘরের মধ্যে সেই দৃশ্য দেখে আতঙ্কে মেঝে থেকে লাফিয়ে দাঁড়িয়ে উঠে দৌড়ে এসে পঙ্কজকে জড়িয়ে ধরল সুবীর।
-কে..কে ওখানে? তোতলাতে তোতলাতে জিজ্ঞেস করল মৃণাল।
দুতলার ওই ঘরে এই সমস্ত কিছু প্রত্যক্ষ করার পর আর ওখানে দাঁড়িয়ে থাকার সাহস ছিল না ওদের কারোরই। নিজেদের হাত ধরাধরি করে কলকাতা থেকে আনা টর্চগুলো জ্বেলে নেমে এল ওরা বাড়ির একতলায়। ওদের মধ্যে মৃনালই প্রথম সাহস সঞ্চার করে বলে উঠল, ওই ঘরে তুই কী দেখে চেঁচিয়ে উঠলি রে পঙ্কজ?
-ফোটোর লোকটা… হাঁপাতে হাঁপাতে বলল পঙ্কজ।
-ফোটোর লোক?
-ঘরে মোমবাতি জ্বলছিলো ঠিকই। কিন্তু সব কিন্তু দেওয়ালে আলো পড়ছিল না ভালো করে। তুই যখন টর্চ নিয়ে ফটোটাকে দেখছিলি, ঠিক তখনই দেখলাম ওদিকের দেওয়ালে হঠাৎ একটা মানুষের মুখের অবয়ব ফুটে উঠছিল যেন। ক্রমে স্পষ্ট হতেই দেখতে পেলাম ঠিক ঐ ফোটোর মতই যেন দেখতে সেই মুখটা। টাকমাথা, ঝুঁপো গোঁফ, বসা গাল। আমি তোকে বলতে যাব, ঠিক সেই সময় মুখটা যেন দেওয়াল থেকে উঠে এসে সঙ্গে সঙ্গে মিশে গেল হাওয়ায়। একেবারে আমার চোখের সামনে। মনে হচ্ছিল আমার মুখের উপরই যেন আছড়ে পড়বে ওটা। সেইজন্যই আমি চিৎকার করে উঠেছিলাম ভয়ে।
-হুঁ।
-এই বাড়িটার চরিত্র স্বাভাবিক নয় মোটেই। আগের ভাড়াটেরা যে কেন মাত্র তিনদিন থেকেই চলে গেছে তা এবার বুঝতে পারছিস তো? মৃণালকে বলল সুবীর।
-হুঁ। কিন্তু…
মৃণাল আরও কিছু একটা কথা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার কথা আর শেষ করতে পারল না সে। কারণটা যদিও ওরা সবাই এতক্ষণে বুঝতে পেরেছে। একতলার খোলা দালানেই এতক্ষণ দাঁড়িয়ে কথাবার্তা বলছিল ওরা, ওদের চারজনের প্রত্যেকেই যেন কোনও একটা অস্বাভাবিক অলৌকিক বস্তুর উপস্থিতি অনুভব করল সেই জায়গায়। দোতলায় ওঠার সিঁড়ির দিক থেকে এসে দমকা হাওয়ার মত সেটা আঘাত করল ওদের।
কিন্তু অদ্ভুতভাবে সাধারণ হাওয়ার মতন ওদের পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল না ওটা। এই জিনিসটা যেন ঠিক ওদের হাড়-পাঁজর, শরীর ভেদ করে বয়ে গেল দালানের অন্য প্রান্তে।
তারপর কী হল তার কিছু আর মনে নেই ওদের। পরের দিনের ভোরের আলো মৃণালের চোখে পড়তে চোখ মেলে তাকাল সে। চারপাশে একটু নজর পড়তেই বুঝতে পারল মল্লিকবাড়ির একতলায় দালানের মেঝেতে শুয়ে আছে সে এবং সে শুধু একা নয়, তার বন্ধুবান্ধবরাও সেটাই করেছে ।
শরীরে একটু জোর দিয়ে উঠে দাঁড়াল মৃণাল। আগের দিন রাতে ঠিক কী হয়েছিল সেটা মনে পড়ছিল না ওর। দাঁড়িয়ে ওঠে সুভাষদের কাছে এগিয়ে গেল তাই। ধীরে ধীরে এক এক করে বন্ধুদের জাগিয়ে তোলবার পর একটাই প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আসছিল ওদের মাথায়।
মল্লিক বাড়িতে আগের দিন রাত কাটাতে আসার কথা ভালো করেই মনে আছে ওদের প্রত্যেকের সবারই। কিন্তু এতগুলো ঘর আর তাদের চাবি ওদের সঙ্গে থাকা সত্বেও একতলার দালানে কেন গাদাগাদি করে ঘুমোচ্ছিল ওরা?
উপরন্তু আরও একটা কথা। সুভাষ,পঙ্কজ, সুবীরদের জাগাবার সময় মৃণালের মনে হচ্ছিল ঠিক ঘুম না, বরং অজ্ঞান হয়েই পড়ে আছে ওরা। সে নিজেও কি তাই ছিল নাকি?
-ঠিক কী হয়েছিল বল তো কাল রাতে? মাথা চুলকাতে চুলকাতে জিজ্ঞেস করল পঙ্কজ।
-আমারও কিন্তু ওই একই প্রশ্ন। সবাই জড়াজড়ি করে এখানেই একতলা দালানে পড়েছিলাম কেন? মৃণালের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল সুভাষ।
-আমার যতদূর মনে পড়ছে, দোতলার কোনের দিকের ঘরটায় ছিলাম আমরা। বেশ বড় ছিল ঘরটাও। রাতে তাস খেলতে বসে ছিলাম আমরা সবাই ওখানে। কিন্তু হঠাৎ করে এখানে এসে পড়লাম কী করে? কখনই বা এলাম? বলল সুবীর।
-কিছুই মাথায় ঢুকছে না আমার। দোতলায় ওপরে গিয়ে একবার দেখে আসবি নাকি ঘরটা? বাকিদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল মৃণাল।
-হ্যাঁ। তাই চল না। গিয়ে দেখে আসি একবার কী হল ঠিক ব্যাপারটা আমাদের সঙ্গে কাল রাতে।
সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাবে ওরা সবাই দোতালায়, ঠিক তখনই কিসের একটা আওয়াজ হল দুতলায়। আকস্মিক আওয়াজের উৎস অনুসন্ধান করবার জন্য ওরাও তাড়াহুড়ো করে দোতলায় উঠতে গিয়েই দেখতে পেল একটা সাদা বিড়াল ঘুরে বেড়াচ্ছে সেখানে, দোতলার বারান্দায়।
কোনের ঘরটার দিকে এগিয়ে যেতেই হঠাৎ করে আরও চমকে উঠল ওরা।
ঘরটা তালাবন্ধ!
-মানেটা কী এসবের? পাগলের মত চিৎকার করে উঠল সুবীর। কী হচ্ছেটা কী এখানে এসব?
আরও বিস্ময়কর কারণ দরজার বাইরে রাখা একটা ব্যাগ, সেটাও ওদের পরিচিত যদিও। কলকাতা থেকে ওদেরই আনা দামী পুমার ব্যাগ। ব্যাগটার পাশেই রাখা মোমবাতি শুদ্ধু একটা মোমবাতিদানী, সেটাও অবশ্য বিন্দুমাত্র অপরিচিত নয় ওদের কাছে, মৃণালের বাড়ি থেকে রাতের জন্য এখানে আনা ওগুলো।
মোমদানীটা অবশ্য উল্টে পড়ে আছে। কারণটা সম্ভবত ওই বেড়াল বাবাজি।
-এতে তো সবই জিনিসপত্র ভরা আছে দেখছি আমাদের। এমনকি আধখাওয়া চানাচুরের প্যাকেটটাও। মেঝেতে রাখা ব্যাগটার দিকে এগিয়ে গিয়ে সেটা খুলে বলল পঙ্কজ।
-হুম, ব্যাপারটা কী হচ্ছে বল তো? বাড়ি থেকে আনা জিনিসপত্র বের করবার পর আবার ব্যাগে ঢুকিয়ে ঘরের দরজার তালা বন্ধ করে কখন ঠিক বাইরে বেরিয়ে এলাম আমরা? মনে পড়ছে কি কিছু তোদের? বলে উঠল মৃনাল।
-উম্ হুম্। নাহ্ তো। কিছুই না। আমার অন্তত মনে পড়ছে না কিছুই। দুদিকে মাথা নাড়াতে নাড়াতে বলল সুভাষ।
-আমারও কিন্তু ঠিক মনে পড়ছে না কিছুই। বলল সুবীর।
-আশ্চর্য। রাতে জিনিসগুলো সব ব্যাগে পুরে, গুছিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম আমরা সবাই। ঘরের দরজায় চাবি দিয়ে নিচেও নেমে গিয়েছিলাম মনে হয়। কারোরওই কিছুই মনে নেই? অদ্ভুত ব্যাপার তো। বলল মৃণাল।
-মনে পড়েছে! হঠাৎ করে বলে উঠল পঙ্কজ।
-কী? কী মনে পড়েছে? বল তো, সমস্বরে বলে উঠল বাকিরা।
-রাত আটটা নাগাদ যে পাড়ার কারেন্ট চলে গিয়েছিল মনে পড়ে তোদের?
-হ্যাঁ, হ্যাঁ। ঠিক বলেছিস। এবার আমারও এবার মনে পড়ছে ঘটনাটা একটু একটু। কারেন্ট চলে যাওয়ার পর তক্তপোশের উপর মোমবাতি জ্বেলে তাস খেলতে বসেছিলাম আমরা সবাই। বলল সুভাষ।
-হ্যাঁ, ঠিকই বলছিস তুই। আমারও মনে আছে ঘটনাটা। বলল মৃণাল। চানাচুরের প্যাকেটটাও তখনই খোলা হয়েছিল বোধহয় আমাদের খাওয়ার জন্য।
-সেসব তো ঠিক আছে। কিন্তু তাস খেলা ছেড়ে আমরা বাইরে বেরিয়ে এলাম কখন? জিনিসপত্রই বা গোছালাম কখন? আর দোতলা ছেড়ে নিচের এক তলায় গিয়ে দালানে শুয়েছিলাম কেন আমরা? প্রশ্ন করল সুবীর।
অনেকক্ষণ ওই বাড়ির দোতলায় দাঁড়িয়ে থেকে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা তর্কাতর্কি বিতর্ক করেও কোনও ঠিকঠাক উত্তর খুঁজে পেল না ওরা, যা দিয়ে কাল রাতের রহস্যের ব্যাখ্যা করা যায়।
ইতিমধ্যে এইসবের মধ্যে সময় যে কখন গড়িয়ে গেছে তা লক্ষ্য করেনি ওরা কেউই। ভোরের আলো পেরিয়ে ততক্ষণে সূর্য আকাশে চড়ে উঠেছে আরও। ঝামেলা থামিয়ে এবার মৃনালদের বাড়ি ফিরে যাবে, ঠিক করল ওরা সবাই মিলে।
সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ বাড়ি ফিরতে ওরা প্রথমেই দেখতে পেল মৃণালের অথর্ব পিসিকে।
ওদেরকে দেখে হেসে উঠলেন তিনি।
-এখন বাড়ি ফিরছ বুঝি বাবারা? তা ভালো। তা কেমন কাটালে মল্লিকবাড়িতে আগের রাত? কোন বিপদ-আপদ হয়নি তো তোমাদের? সবাই সুস্থ হয়ে ফিরছ তো? জিজ্ঞাসা করলেন উনি।
-হ্যাঁ ঠাকুমা। সবাই ভালো। সবই ভালো। ভালোই কেটেছে আমাদের ওখানে কাল রাত। আমতা আমতা করে উত্তর দিল মৃণাল।
-বাহ্, বেশ। তা ভালো। আর কাটবে নাই বা কেন ভালো ভাবে তোমাদের ওখানে কাল রাতে? কাল রাতে যখনই শুনলাম তোমরা যাচ্ছ ওই বাড়িতে, আমি তো বাড়ি গিয়ে ঠাকুরকে কত প্রার্থনা করেছি যাতে তোমরা ভালো ভাবে থাকো, তোমাদের রক্ষা করবার জন্য ওই বাড়িতে কাল রাতে।
-এরকম কেন বলছ ঠাকুরমা? কী এমন বিপদ আছে ওই বাড়িতে? বলল মৃণাল।
-সে সব জানি নে বাছারা। তবে শুনেছি যে ওই বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা নাকি বেশিদিন ভোগ করতে পারেননি ওই বাড়িটা। বাড়িতে গৃহপ্রবেশের কিছুদিনের পরেই মারা যান নাকি উনি। তাই অত চিন্তা হচ্ছিল তোদের জন্য কাল রাতে। ওই জন্যই তো আমার ঠাকুরকে ডাকছিলাম বারবার। যাই হোক তোদের কিছু খারাপ হয়নি দেখে খুশিই হলাম আর কি। ভালো ভাবে থাকিস তোরা। আমি চলি। কাজ আছে আজ আরও কিছু দরকারি।
নড়বড়ে পায়ে সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইল ওরা কিছুক্ষণ।
কী যে হল ব্যাপারটা কাল রাতে, ওরা বুঝতে পারছে না এখনও।
ওরা কেউ দেখতে পেল না, কিন্তু মল্লিকবাড়ির পশ্চিমদিকের কোনের ঘরটার দেওয়ালে টাঙানো ময়ূররঞ্জন মল্লিকের ছবিটার মুখে ফুটে উঠল একটা পাতলা হাসি।
–