জীবন্ত তারা | পলক ফেলা নিষেধ | সৌমিক নস্কর | Bengali Thriller Story
0 (0)

একটা দেহ পড়ছে ছাদ থেকে। চোখ দুটো তার বন্ধ। মুখে লেগে একটা অলীক হাসি। যেন শতকালের তৃপ্তি। মাটির সংস্পর্শে আসতেই মাথার পিছন থেকে একটা গাঢ় তরল বেরিয়ে আসছে। চোখের কোলে এক ফোঁটা জল; সেইটা কি সুখের!

আজ উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার শেষদিন। মনটা মোটেই ভালো নেই রোহনের। পরীক্ষার শেষে, হল থেকে বেরোচ্ছে উদাসীন মুখে। মনখারাপের ছাপ মুখমন্ডল জুড়ে। কার ভালো লাগে! পরীক্ষার শেষে সময়-খানা বন্ধুদের সাথে না কাটিয়ে গ্রামের বাড়িতে অতিথি আমন্ত্রণপত্রকে কঠোরভাবে পালন করতে।

খারাপ লাগছে আরও এই ভেবে! দেবপর্নার সাথে দেখা হবে না। কত আশায় বুক বেঁধে ছিলাম এতদিন। পরীক্ষাটা একবার শেষ হবে প্রতিদিন দেখা করব দুজনে, ঘুরতে যাব, আড্ডা মারবো পার্কের বেঞ্চে। কিন্তু সেইসব কি করেই বা সম্ভব। উদাসীন মনে প্রতিফলিত হতে লাগল এই সব শব্দ।

অটোতে উঠে বাড়ির পথে রওঁ দিলাম অটো থেকে নেমে পয়সাটা মিটিয়ে দরজা খুলে সটাং প্রবেশ করলাম ঘরে। কিছু কথা না বলে সোজা উঠে গেলাম সিঁড়ি বেয়ে নিজের ঘরে। ব্যাগটা বিছানায় একপ্রকার ছুঁড়ে ফেলে গড়িয়ে পড়লাম বিছানায়। পরক্ষনেই শোকেস থেকে লুকিয়ে রাখা সিগারেটের বাক্স-টা নিয়ে উঠে গেলাম ছাদে। মা এই সময় ছাদে আসে না, তাই ভয়ের কিছু নেই। একরাশ মন খারাপীদের দূর করার উদ্দেশ্যে ধরালাম সিগারেট।

স্নান করে, খাবার খেয়ে অবশেষে যখন নিজের ঘরের চৌকাঠ মারালাম ঘড়িতে তখন ২:৪৭। ফোনটা হাতে নিতেই দেখলাম দেবপর্ণা ফোন করেছিল ফোনটা সাইলেন্ট থাকার দরুন শুনতে পাইনি। ঘুরিয়ে কল ব্যাক করলাম। ও পাশ দিয়ে শান্ত মলিন কণ্ঠস্বর ভেসে এল।

— কী রে পরীক্ষা কেমন হল?

— হ্যাঁ ভালো, তোর?

— ভালো নয় তবে পাশ করে যাব। একটা মিষ্টি মাদকতার হাসি দিয়ে কথাটা বলল।

এতক্ষণের জমে থাকা মনখারাপী যেন দ্বার খুলে বেরিয়ে গেল দিগন্তে।

— স্মিত কন্ঠে বললাম; তা ভালো।

— শেষমেষ কী হল?

— না-রে যেতেই হবে কিছু করার নেই।

— আচ্ছা যা ভালো করে ঘুরে আয়।

— হ্যাঁ, ওইটুকু বলে ফোনটা রাখলাম।

আজ রবিবার, দেশের বাড়িতে যাওয়ার দিন। সকাল-সকাল ঘুমটা ভাঙল। জিনিসপত্র আগেভাগে গুছানো ছিল তাই দেরী হবার সম্ভাবনা নেই। সকাল ৬:৪৫ ট্রেন হাওড়া স্টেশন থেকে। ৬:১৫ নাগাদ অটো ধরে হাওড়া স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওঁ হলাম। ট্রেনটি ছাড়বে হাওড়া স্টেশনের ছ নম্বর প্লাটফর্ম থেকে। টিকিট আগে থেকেই কাটা ছিল, শুধু অপেক্ষা এখন ট্রেনে ওঠার। এই সময়টা শীত থাকার কথা নয় তবুও বেশ কিছুদিন যাবৎ অল্প শীতের আমেজ রয়েছে। কুয়াশাচ্ছন্ন স্টেশন। আজকে যেন! তুলনামূলকভাবে কুয়াশা বেশি পড়েছে। দূর থেকে কুয়াশার শক্ত আবরণ পর্দা ভেদ করে এগিয়ে আসছে একটা চা-ওয়ালা। তার থেকে চা খেয়ে শরীর কিছুটা যেন উষ্ণতার ছন্দ ফিরে পেল। অবশেষে ট্রেনটি যখন প্লাটফর্ম ছাড়লো ঘড়িতে তখন ৬:৪৭। জানলার ধারে বসে অপেক্ষারত প্রহর গোনা শুরু করলাম। কি করব ভেবে না পেয়ে মনের অবকাশে একটা মেসেজ করলাম দেবপর্ণাকে। বেচারী এখনও ঘুমাচ্ছে তাই রিপ্লাই পাওয়ার আশা নেই। হাঁসলাম নিজের আনমনে ওর মিথ্যা আজ ফাঁস হয়ে গেছে! ও আবার নিজে বলে আমি তো ৬:৩০ আগে ঘুম থেকে উঠে পড়ি। হাঁফ ছেড়ে কিছু করার মতন না খুঁজে পেয়ে গান চালিয়ে হেডফোনটা কানে গুঁজলাম। জানলার কাঁচের পর্দায় চোখ রেখে বাইরে দৃশ্য লক্ষ্য করলাম। একের পর এক গাছ, ঘরবাড়ি তাদের লক্ষ্য করে খুব দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসছে; আবার প্রাক্তন প্রেমিকের মতন উপেক্ষা করে মিশে যাচ্ছে নিজেদের গন্তব্যে। দূরে কিছু সরষে চাষের জমি হলুদ রঙের আভাতে মিশে যাচ্ছে সমস্ত দিক। সামনে কিছু পুকুর কচুরিপানায় বিধ্বস্ত, তাদের পৃষ্ঠতলকে আলিঙ্গন করছে কুয়াশার মলিন পর্দা। দূরের দিগন্ত আবছা কুয়াশা যেন গ্রাস করেছে সব। কুয়াশার অন্তর যেন সমুদ্রের মতো বিশাল সবকিছুকে নিজের মধ্যে বিলীন করতে পারে সে। জানলার কাঁচের ফাঁক দিয়ে প্রকৃতির শীতল হাওয়ার স্পর্শ রোহনের মুখসহ সারা অঙ্গ কাঁপিয়ে দিল। ঘড়িতে এখন 9:10 সূর্যের তির্যক কিরণ সমস্ত ভূখণ্ডে উষ্ণতার আঁচ ছড়িয়ে দিচ্ছে। এখনো সিউড়ী স্টেশনে পৌঁছাতে আড়াই-ঘন্টা মতন লাগবে তারপর সেখান থেকে বাস ধরে আরও কিছুক্ষণ গেলেই তালতলা গ্রাম আর সেখানেই বাবার দেশের বাড়ি।

হঠাৎ ফোনের ম্যাসেজ টোন-টা বেজে উঠল। মুহূর্তের খন্ডাংশে মনের ভিতর আত্মগোপন করে থাকা আনন্দ ঠোটের উপর তার প্রতিচ্ছবি ফুঁটিয়ে তুললো। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছি দেবপর্ণার ম্যাসেজ। কথার অবকাশে যেন হারিয়ে গিয়েছিলাম। কত প্রশ্ন ওর, কী করছিস! এখন কোথায় আছিস! আর কতক্ষণ লাগবে! ব্রেকফাস্ট হয়েছে কিনা! উত্তর দিতে গিয়ে যেন হারিয়ে গিয়েছিলাম বাস্তব জগতকে উপেক্ষা করে প্রেমের জগতে। মায়ের কথায় হুশ ফিরে এল।

— ফোন পরে দেখবি, এখন চ’ স্টেশন এসে গেছে।

–ও আচ্ছা! যাচ্ছি।

এই শুনে ফোনটা পকেটে রেখে; বেরিয়ে এলাম ট্রেন থেকে। সিউড়ী স্টেশনে এসে পৌঁছেছি। চারিদিকে হট্টগোল, লোকেদের কোলাহল। বাবা-কে অনুসরণ করে এগিয়ে গেলাম। স্টেশন থেকে বেরিয়ে ইতিমধ্যে চৌরাস্তায় এসে বাসে উঠলাম; আর বেশিক্ষণের এর রাস্তা নয়, ৪৫ মিনিটের কাছাকাছি হবে। সিটে বসার সম্ভাবনা নেই তাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বোধহয় যেতে হবে বাকি পথ। এক মনে ভাবলাম কেমন হবে গ্রামের বাড়ি! সচরাচর নগরায়ন ছেড়ে গ্রামে কোনদিনও থাকিনি। বাবার দেশের বাড়ি যাচ্ছি এই প্রথম। আর বন্ধু-বান্ধবদের সাথে যতবার পিকনিক করতে গিয়েছিলাম! সেখানে গানের তীব্রতা আর লোকেদের জন-কোলাহলে গ্রামের শান্তি কিংবা নিস্তব্ধতা বিন্দুমাত্র আঁচও পাইনি। এই প্রথম কোনও গ্রামের বাড়িতে থাকা হবে। আর সবচেয়ে বড় কথা বেশ কিছুদিনের জন্য। একদিকে যেমন আনন্দ হচ্ছে। অপরদিকে একটু মনখারাপী যেন লেগে আছে। মনের অজান্তে একটা শব্দগুচ্ছ ভেসে এল বন্ধুদের সাথে কিংবা দেবপর্ণার সাথে অনেক মুহূর্ত-তো মনে জমা আছে। তার কিছুটা ব্যতিক্রম হলে খারাপ হবে না বোধহয়।

বাসটা এসে থামল। বাবার কথা মতন এখান থেকে অটো ধরে আরও মিনিট খানেকের রাস্তা হবে তাদের গ্রাম অতঃপর বাড়িও বলা যেতে পারে। পাশের একটা চায়ের দোকান থেকে চা খেয়ে যাত্রাপথের অর্ধেক ক্লান্তি যেন মিটে গেল। বাবার মনে একপ্রকার আনন্দের উচ্ছ্বাস লক্ষ্য করলাম সেটাই স্বাভাবিক। কোন ছোটবেলায় বাবা সেই গ্রামের বাড়িতে শেষবার এসেছিল। যখন তার বয়স মেরেকেটে ১৫ কিংবা ১৬ হবে। এত বছর ধরে শহরে তার পড়াশোনার শেষ, তারপর তাঁর চাকরি জীবন, বিবাহ জীবনের শেষে আবার সেই গ্রামের বাড়িতে উপস্থাপন। এত আবেগ বোধহয় মনে চাপা রাখা যায় না। তা মুখ দিয়ে কিংবা অঙ্গভঙ্গির উপস্থাপন দিয়ে প্রকাশ্যে আসবেই। ট্রেনে আসার সময় এই সব আবেগ, অনুভূতির কথা একের পর এক শুনে এসেছে সে। চা খাওয়া শেষ হয়েছে। সবে উঠে দাঁড়িয়েছি একটা অটো-ওয়ালা হাঁক পারল আমাদের উদ্দেশ  করে।

— কোথায় যাবেন দাদা?

— অনিন্দ্য ভট্টাচার্যের বাড়ি।

— অনিন্দ্য ভট্টাচার্য! সে তো মারা গেছে।

— হ্যাঁ জানি, আমি ওঁর নাতি হই।

— ও আচ্ছা, বসুন দাদা বসুন। আপনারা বোধহয় শহরে থাকেন?

— হ্যাঁ, এই গ্রামের বাড়িতে একটু ঘুরতে এসেছি।

— অনিন্দ্য ভট্টাচার্য নাম শুনেছি খুব। খুব ভালো লোক ছিলেন উনি।

বাবার ঠোঁটে নিবিড় হাসি চোখ এড়ায় না কারোর।

— তা দাদা এত বছর পর! কোনও উৎসব আছে নাকি?

— নানা তেমন কিছু নয়; ওই ছেলের পরীক্ষা শেষ হল তাই ভাবলাম কটা দিন একটু ঘুরে যাই। সচরাচর তো আর আসা হয় না।

— ও ভালো ভালো, না আমি ভাবলাম আপনাদের সেই পুরনো মন্দির বাড়ির কিছু উৎসব হবে হয়তো।

বাবার ঠোঁটে লেগে থাকা হাসির প্রতিবিম্ব মুহূর্তের খন্ডাংশের জন্য উধাও হয়ে গেল।

— না মানে অনেকে বলছিল; পুরনো সেই মন্দিরে যদি আবার নতুন করে পুজো শুরু করা যায়, তাহলে সব দোষ বোধহয় কেটে যেতে পারে।

— এক প্রকার এড়িয়ে গিয়ে উত্তর দিল বাবা; তেমন কোনও খবর আপাতত নেই।

— হ্যাঁ তাও ঠিক, আপনি শহরে থাকতেন এত বছর পর গ্রামের বাড়িতে আসছেন; জানবেন বা কি করে।

একটা দীঘির পাড়ে এসে অটোটা দাঁড়াল।

বাবা বলে উঠল;

— এর নাম শ্যামলা দীঘি।

ছোটবেলায় বাবা নাকি অনেকবার স্নান করেছেন। গরমকালে এই দীঘির জলে স্নান করতে নামলে আর উঠতে মন চাইত-না; এত ঠান্ডা তার জল। এখনকার হাল আর তখনকার হালের মধ্যে যেন বিস্তর ফারাক শ্যামলা দীঘির স্বচ্ছ জলকে গ্রাস করেছে কচুরিপানার রাজত্ব। একজন গৃহবধূকে দেখলাম বাসন ধুচ্ছে সেই দীঘির জলে। সেই দীঘির পাড়ে একটা চায়ের দোকান আছে। বড় বড় করে লেখা বীরেনদার চায়ের দোকান। আর তার পাশ দিয়ে একটা সরু রাস্তা ঢুকে গেছে গ্রামের অন্তরে। বাবার কথামতো হেঁটে চললাম সেই রাস্তা ধরে। রাস্তার দু’পাশে শুধু গাছ, মুহূর্তের সেই ক্ষুব্ধ খন্ডাংশে মনে হল “শান্তির কিংবা নিস্তব্ধতার যদি প্রকৃত রূপ কিছু থেকে থাকে তাহলে এইটা” তবে শহর সভ্যতার অনেক জিনিস আছে এই গ্রামে। শহরে থাকাকালীন গ্রাম-বাংলার যে রূপকে নিজের মনের মধ্যে এঁকেছিলাম তার বিন্দুমাত্র নেই। মাটির বাড়ি, মাটির রাস্তা তার পরিবর্তে এসেছে পিচের রাস্তা, পাকা বাড়ি। তবে অদ্ভুত তো অন্য জায়গায় শহরের প্রায় অর্ধেক সুবিধা এখন গ্রামের মধ্যে; তাও যে নিথুর নিস্তব্ধতা শহরে খুঁজে পাওয়া যায় না তা গ্রামের জীবনে বর্তমান।

রাস্তার পাশে স্ল্যাবের উপর বসে থাকা একটা লোককে বাবা জিজ্ঞাসা করলেন

— আচ্ছা দাদা অনিন্দ্য ভট্টাচার্যের বাড়িটা সোজা গেলে পাব তো? আসলে অনেকদিন পর আবার গ্রামে এলাম তো তাই ঠিক মনে পড়ছে না।

— আপনি কে!

— আজ্ঞে সম্পর্কে আমি ওঁর নাতি হই।

— ও আচ্ছা আচ্ছা, হ্যাঁ এই পথ ধরে সোজা চলে যান। তা দাদা খবরটবর ভালো তো?

— স্মিত কন্ঠে বাবা উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ ভালো দাদা’

সবাই জানত আমরা আজ আসব। তাই আমার বোন-কে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল দরজার সম্মুখে। বোন হচ্ছে আমার ছোট কাকার মেয়ে। আমাদের বাবারা তিন ভাই। বড় যিনি এখন শহরে আছেন, মেজ আমরাই, ছোট কাকা গ্রামের বাড়িতে থাকেন মা ওরফে আমার ঠাকুমার সাথে। তার একটি মেয়ে নাম সুস্মিতা। বাবার মুখে শুনেছি ক্লাস এইটে পড়ে। লম্বা, উজ্জল মুখশ্রী চুলগুলো কোঁকড়ানো, তবে তার শারীরিক গঠন দেখলে মনে হবে খাওয়া ছাড়া কিছুই বোঝে না। আর এমনিতে কথা কম বলে, আর সবসময় প্রায় হাসে। অপরিচিত বলে কথা বলতে ইতঃস্ততবোধ করছে কি! লজ্জা পাচ্ছে সেটা ঠিক বোঝা যায় না। ঠাকুমার মুখের হাসি এক পলকে দেখলে মনে হবে যেন হাতে চাঁদ পেয়েছে।

— ওমা খোকা তুই কত বড় হয়ে গেছিস! একেবারে যেন তোর বাবার মুখ বসানো।

অজানা প্রশ্নের উত্তর বোধহয় হাসি ছাড়া আর কিছুই হয় না। তাই একগাল হাসিতেই উত্তর দিলাম সেই প্রশ্নের।

— প্রতিবছরই তোর বাবাকে ফোন করি, যে খোকার পরীক্ষা শেষ হলেই এসে ঘুরে যাবি। কিন্তু তোর বাবার এত কিসের কাজ কী জানি বাপু!

বাবা একবার হেসে ঠাকুমাকে জড়িয়ে ধরল।

— আর রাগ করে থেক না এবার তো চলে এসেছি; তাও আবার এক-দুই দিনের জন্য নয়। একেবারে এক মাসের জন্য।

— হয়েছে হয়েছে অনেক হয়েছে; তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে খেতে বস।

এতক্ষণে বোধহয় ঠাকুরমা একটা কাজের কথা বলেছে। যাত্রাপথেই বেলা গিয়ে দুপুর এসেছে। গ্রামের চাঁপা কলের জলে হাত-পা ধুয়ে সমস্ত ক্লান্তি যেন মুহূর্তে পালিয়ে গেল শরীর থেকে।

দুপুরের খাবারটা বেশ জমজমাটি হল ভাত, ডাল, কাতলা মাছের ঝাল আর মুরগির মাংস এছাড়া চাটনি, মিষ্টি তো আছেই।

সন্ধ্যা হব হব প্রায়। সূর্যের অস্ত যাচ্ছে পাশের মাঠের গা ঘেঁষে। একটা যেন সোনালী আভা ভরিয়ে দিচ্ছে পুরো গ্রামবাংলা। শহরে ইট, কাঠ, কংক্রিট জাল ভেদ করে সূর্যের এই সোনালী আভা এতটা তীর্যক ভাবে তার চোখে এসে পড়েনি। সত্যি একজন শহরে থাকা মানুষের কাছে গ্রামের এই সৌন্দর্য বোধহয় সোনার চেয়ে কম কিছু নয়।

পাঁচ দিন হয়ে গেছে দেবপর্ণাকে একটা ফোন পর্যন্ত করা হয়নি। আসলে সারাদিন বাড়ির মধ্যে থাকা হয় আর বিকেলের দিকে বাবার আর কাকাদের সাথে গ্রামের চারিপাশটা একটু করে দেখা হয়। এই পাঁচদিনেই বোনের সাথে খুব ভাব হয়ে গেছে। প্রথমদিকে ভেবেছিলাম একদম কথা বলে না কিন্তু এখন যা দেখি ঠিক তার উল্টো। মাঝে মধ্যে তো হাতে পায়ে ধরে চুপ করতে বলা হয়। কিন্তু এবার মনটা ফাঁকতাল খুঁজছে একা একা বেরিয়ে পড়তে চাইছে এবার; শুধুমাত্র গ্রামটাকে একা একা পরিদর্শন করার মজাটাই আলাদা সেটা নয় দেবপর্ণার সাথে ফোনে কথা বলার একটা মোক্ষম সুযোগ। তাই ঠাকুমার কাছে একবার আবদার করতেই সুযোগটা হাতে চলে এল। মা মাঝখানে বলেছিল যদিও

— একা একা ঘুরবি, তুই আদৌ রাস্তাঘাট কিছু চিনিস না।

— ঠাকুমা একপ্রকার ধমক দিয়ে বলল “তোর ছেলে বড় হয়েছে ওকে একা একা একটু ঘুরতে দে”; আর তাছাড়া এই গ্রাম যা ছোট তাঁতে হারিয়ে যাওয়ার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই।

আনন্দে উচ্ছ্বসিত মন মুহূর্তেই ঠিক করল যে কাল থেকে বেরিয়ে পড়বে সে নিজের মতো করে।

সকালবেলা জলখাবার টুকুন খেয়ে বেরিয়ে পড়তে যাচ্ছি এমন সময় ঠাকুমা এল আমার কাছে।

— কি ব্যাপার ঠাকুমা কিছু বলবে!

ঠাকুমা নিজের আঁচল মুড়ি দিয়ে রাখা একটা ৫০ টাকার নোট আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন।

— কি কিছু আনতে হবে! আমি খানিকটা বিস্ময়ের সুরে বললাম।

— না না কী আবার আনবি? বড় হয়েছিস ব্যক্তিগত ভাবে কিছু খাওয়ার তো ইচ্ছা করেই তাই না। তাই আগেভাগে তোর হাতে ধরিয়ে দিলাম।

এই বলে ঠাকুমা বেরিয়ে যাচ্ছিলেন হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে বললেন;

— একমাত্র বীরেনদার দোকানে ওই সব পাওয়া যায়। এছাড়া এই গ্রামে আর দোকান নেই। তোদের শহরের মত নয় একটা ছেড়ে আরেকটা দোকান।

ঠাকুমা বেরিয়ে যেতে বুঝলাম; তিনি আগেকার মানুষ হলেও আগেকার পন্থা বিশ্বাসী মানুষ নন। এই মুহুর্তের অতিক্ষুদ্র সংলাপে অনেক কিছু বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন। শুধুমাত্র টাকা দিয়ে কটা কথা নয়; একটা বন্ধুর মতন করে ভালোবেসে দিয়ে গেলেন। টাকা তো তার কাছেও ছিল, তবে যে বন্ধুসুলভ আচরণ করলেন সেটাকে বোধহয় উপেক্ষা করা যায় না।

প্রথমেই বীরেনদার চায়ের দোকানে যাব ঠিক করলাম। রাস্তা দিব্যি মনে আছে। গ্রামের রাস্তা শহরের মতন অত পেঁচাকোণা নয়। চায়ের দোকানে এসে চা খেয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। একটা সুখটান দিয়ে শ্যামলা দীঘির পাড়ে এসে বসলাম। গ্রামের কিছু মধ্যবয়স্ক লোকের আড্ডা বসেছে। গাঁজার কল্কেতে আগুন ধরিয়ে টান দিচ্ছে একের পর এক জন। দেবপর্ণাকে একটা ফোন করলাম, ফোনটা তৎক্ষণাৎ বিজি বিজি বলে কেটে গেল।

— রাগ করেছে নাকি কদিন তাকে ফোন করা হয়নি এমনকি তার ফোন পর্যন্ত তোলা হয়নি বলে। নিজের আনমনেই বললাম।

আরও একবার কল ব্যাক করলাম কিন্তু আবারও সেই একই উত্তর; কিছুটা নিরাশ হয়ে ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে সিগারেটে কিছু তীব্র টান দিলাম। সিগারেটটা ফেলে কয়েকটা মুহূর্ত অপেক্ষা করলাম যদি দেবপর্ণা আবার কল ব্যাক করে এইভাবে, আর এছাড়া এত তাড়াতাড়ি বাড়িতে গিয়ে বা কি করব।

একটা তরুণ যুবতী সেই দীঘির পাড়ে এল। হাতে একদল এঁটো বাসন নিয়ে নেমে গেল। শাড়ির আঁচলটাকে নাভির কাছে গুঁজে বাসন ধোয়া শুরু করল। মধ্যবয়স্ক লোকগুলির মধ্যে একজন জিজ্ঞেস করল;

— কি রে সরমা আজ তোর মা এল না!

মেয়েটার কাঁধের পাশ দিয়ে নেমে গেছে কোঁকড়ানো চুল। চোখদুটি কাজলের মায়াবী ছাপে পরিপূর্ণ। চাপা গায়ের রং আর তার সাথে মিষ্টি হাসির এক ঝলকে উত্তর দিল;

— না গো কাকা, মায়ের শরীরটা তেমন ভালো নেই।

প্রায় আধঘন্টা মতন বসেও যখন কোনও কল এল না তখন বাধ্য হয়ে উঠে পড়লাম।

তবে বাড়ি ফিরব না এখন গ্রামটা একটু ঘুরেই দেখি সচরাচর তো আর আসা হয় না।

গ্রামের উত্তর দিকে গ্রামের প্রবেশদ্বার অর্থাৎ বীরেনদার চায়ের দোকান, শ্যামলা দীঘি। তবে গ্রামের দক্ষিণ দিকে যাওয়া হয়নি, তাই ঠিক করলাম গ্রামের দক্ষিণ দিকেই যাব যতটা যাওয়া যায় আর কি। গ্রামের দক্ষিণ দিকের দৃশ্যটা কিছুটা এক। এইদিকেও একটা পুকুর আছে তবে এখানে শ্যামলা দীঘির মত কোনও পাড় দেওয়া নেই। রাস্তা বেয়ে ঢালু মাটি সোজাসুজি নেমে গেছে পুকুরের অন্তরে। আর চারিপাশে গাছেদের সারি তো আছেই। এই দিকে লোকজন খানিকটা কম, ভুল বললাম অনেকটাই কম। ওই প্রান্তে  জঙ্গল দেখলে শান্তি, নিস্তব্ধতার ব্যাকুলতা মিষ্টতা চোখে পড়ে। তবে এই দিকটায় একেবারেই তার উল্টো কিসের জন্য ভয় ধরে মনে। চলতে চলতে অনেকটাই পথ ইতিমধ্যে চলে এসেছি, পিচের রাস্তার বদলে এসেছে এবড়োখেবড়ো, গর্তমার্কা মাটির পথ।

বাথরুম পেয়েছে কিন্তু জায়গা কোথায়!

তাই চলমান পথ থেকে বেরিয়ে কিছুটা জঙ্গলের ভেতরে ঢুকলাম। গ্রামের দিক এখানে বাথরুম করা আলাদা কোনও জায়গা নেই। তাই একপ্রকার বাধ্য হয়ে জঙ্গলের ভিতরে প্রবেশ করতে হল। মাটিতে আগাছার আস্তরণ, পাশ বেয়ে বেড়ে উঠেছে নিমগাছ, আমগাছ আর বাঁশবাগানের ঘন জঙ্গল মাঝে মধ্যে এর ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায় দু-একটা পেয়ারাগাছ, আর কলাগাছে ঘেরা জঙ্গল। মাঝে মধ্যে কিছু হলদে রঙের ফুল চোখে পড়ল প্রথমে সরষেফুল বলে মনে হলেও হাত দিয়ে সেটা চোখে পড়ল না।

— কোনও জঙ্গলি ফুল হবে হয়তো! নিঃশব্দে কথাটা বেরিয়ে গেল।

বাথরুমের উপযুক্ত বলে সে জায়গাটাকে নির্বাচন করলাম; তা থেকে কিঞ্চিৎ দূরে আমগাছের পাতার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে একটা মন্দিরের স্ট্রাকচার।

বাথরুম করা শেষ হতেই কৌতূহলবশত যাচাই করতে গেলাম। ২ ফুট লম্বা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা মন্দির বর্ধিত অংশটি। একবার পুরোটা চক্রাকার আবর্তন করেও কোনও প্রবেশপথ দেখতে পেলাম না। কৌতুহলকে দমন করা একটা অলৌকিক শক্তি যা হয়তো সাধারণ মানুষের মধ্যে নেই। তাই বাধ্য হয়ে পাঁচিল-টপকে প্রবেশ করলাম মন্দির সংলগ্ন মাটির পদাভূমিতে। অবাক হয়ে গেলাম এটা কী করে সম্ভব! এখনতো মার্চের প্রায় শেষের দিক, পাতাঝড়ার মরশুম তো নয়। মন্দির বর্ধিত অঞ্চলটির গাছ গুলিতে একটা পাতা নেই। মানুষের মাংসমুক্ত কঙ্কালগ্রন্থি যেমন দেখতে তেমনি শুধু ডালপালাগুলো অবশিষ্ট আছে। মাটির পৃষ্ঠতলে যেন ঝরাপাতার বন্যা বইছে। মন্দিরটার দিকে একনজরে তাকাতে কিছুটা যেন অবাক হয়ে গেলাম। মন্দিরটা ইট-পাথরের তৈরী নয় বরঞ্চ কাঠের তৈরি। রথ যেমন হয় তবে তার চেয়ে অনেকটাই বড় আয়তনে। মন্দিরটা যেন কোনও রুপ নেই, রং নেই পুরোটাই সাদা ফ্যাকাশে। প্রখর দৃষ্টিনিক্ষেপ করলে বোঝা যায় মন্দিরটা বোধহয় লাল রংয়ের ছিল। কিছু কিছু জায়গায় অল্প ফ্যাকাশে লাল রঙের আভা প্রস্ফুটিত হচ্ছে আর বাকি পুরোটাই সাদা, ফ্যাকাশে। সমস্ত কৌতুহলদের একত্রিত করে মন্দিরের ভেতরে প্রবেশ করলাম। ঢোকার আগেই মন্দিরের বাইরে মাটির উপর পড়েছিল কী একটা জিনিস! সূর্যের আলোতে চকচক করছে তার প্রান্ত! একটা পাতা সরিয়ে জিনিসটা হাতে তুলতেই দেখলাম মার্বেল পাথর দিয়ে তৈরি একটা তারা। খুব সুন্দর দেখতে, তার অঙ্গের উপর খোদাই করা কিছু অক্ষর। সেই অক্ষরের বর্ণমালা বুঝতে না পারলেও জিনিসটা খুব ইউনিক। এই জায়গার কিছু বাস্তবায়িত স্মৃতি থাকবে চোখের সামনে এই ভেবে পকেটে পুরলাম।

চাতালে পা রাখার আগে একটি মাত্র সিঁড়ি আর এইটা শুধুমাত্র ইট-পাথরের তৈরি। ঢোঁকার মুখটা অনেকটাই সংকীর্ণ একদমই মাথা হেঁট করে ঢুকতে হয়। তবে মন্দিরের ভিতরটা অনেকটাই বড় প্রায় ১০ জন অনায়াসে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। কোন অসুবিধা নেই। ভিতরে পচা আঁশটে একটা গন্ধ। কাঠগুলিতে বোধহয় পচন ধরেছে। এতদিন যাবৎ প্রকৃতির সমস্ত মার সহ্য করেছে সে, আর কী করে ভালো থাকা যায়। ভিতর থেকে মন্দিরটাকে দেখলে বোঝা যায় তা পুরোটাই ফাঁপা। রথের মত স্ট্রাকচার ওয়াইজ সাজানো তবে বাইরে থেকে। ভিতরের প্রান্ত ত্রিভুজের মতো উঠে গেছে ওপরে আর তার অগ্রভাগ সুঁচের মতো হয়ে ঢেকে দিয়েছে প্রকৃতির আলো। চাতালে কোল ঘেঁষে উঠে গেছে একটা কাঠের প্রান্ত আর সেই প্রান্তের উপর একটা পাথরের তৈরি বেদী রাখা আছে। ওইটাই বোধহয় ঠাকুরের আসন। তবে তার মধ্যে কোনও ঠাকুরের স্থান নেই আছে একটা মাথার খুলি আর হাতের পাঁচটা আঙুল এর হাড় তার মধ্যে অনামিকার আঙ্গুলটা নেই। মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল সময়, কালচক্র পৃথিবী। এক দৌড়ে পাঁচিল টপকে বেরিয়ে এসেছিলাম রাস্তায়। পাদুটি থর থর করে কাঁপছে বুকে হার্টবিটের মাত্রা পেরিয়েছে, অবিচ্ছিন্ন মুখে ভয়ের রেখা স্পষ্ট। গলা শুকিয়ে কাঠ অল্প হলেও জলের দরকার। এদিকটায় লোক কম তাই সাহায্যের কোনও অবকাশ নেই। হাঁপাতে হাঁপাতে বাড়িতে এলাম। তিন গ্লাস জল খেয়ে শরীরে কিছুটা জোর ফিরে পেলাম।

আজকের বিকেলটা ছাদেই কেঁটেছে। দুপুরের ভাত-ঘুমটা আজ আর হয়নি। পরিবারের কিছু মানুষের সাথে আড্ডা দিতে দিতেই বিকেলের পর্দা সরিয়ে মৌন সন্ধ্যার চাদর ঢেকেছে আকাশ। গ্রামের সন্ধ্যা অনেকটাই অন্যরকম চারিদিকে পাখিদের ছোটাছুটি ডাক আর তার মাঝখান দিয়ে ভেসে আসছে শঙ্খধ্বনি। একের পর এক বাড়িতে শঙ্খ বাজছে। সেই শঙ্খের ধ্বনি এই সুন্দর মায়াবী সন্ধ্যাকে আরও অন্যূনতম করে তুলেছে।

শহরে তার রাতে ঘুম আসতে চাইত না। একদম মাঝরাতে এক চিলতে শান্ত হাওয়ায় তার দুচোখ মিলিয়ে যেতে ঘুমের শহরে। কিন্তু যত দিন যাবৎ সে গ্রামে এসেছে ঠিক তার বিপরীত হয়েছে। খাবার-দাবার শেষ করে বিছানায় এসে শুতেই তার দুই চোখ বুজে যেত একরাশ ঘুমের পরতে। কেন জানিনা আজ হঠাৎ তার ঘুম আসছে না। রাত এখন ১১:00 বাজে নিশ্চুপ শান্ত এই গ্রাম এক টুকরো আওয়াজ নেই। গ্রামের দিকে এখন অনেক রাত তবে শহরে এখনও হই হট্টগোল চলছে। চুপচাপ শুয়ে আছে রোহন। তার চোখে চেয়ে আছে দিগন্ত লক্ষ্য করে। কিছু অবিন্যস্ত ভাবনা তার মাথায় খেলছে।

মেয়েটাকে ভারি সুন্দর দেখতে যাকে দীঘির পাড়ে আজ সকালে দেখেছে। কী ডোরা-ডোরা চোখ যেন হাজার গল্প লুকানো সেই চোখে। সেই চোখের দিকে তাকালে শত রাগ মুহূর্তের মধ্যেই বিলীন হয়ে যেতে পারে মহাশূন্যে। পুরুষের মন সৌন্দর্যের প্রতি সর্বদাই দুর্বল। সব সৌন্দর্যকে পুরুষজাতি রাখতে চায় নিজের অধীনে। যে সুন্দর্য যত বেশি দুর্লভ তাকে পাওয়ার চেষ্টা আরও যেন প্রবল হয়ে ওঠে। যদি দেবপর্ণার সাথে তার কোনও সম্পর্ক না থাকত তাহলে সে বলেই দিত তার অন্তরে রাখা এই ভালোবাসার কথা।

ইস, ইস কি ভাবছে এইসব সে! এতটা খারাপ চিন্তা ধারা আসছে কি করে তার মাথায়! দেবপর্ণা না থাকতো মানে! সেই প্রথম আর সেই শেষ।

ভোররাতে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে রোহন। দেবপর্ণা রাস্তা পার হচ্ছে আর দূর দিয়ে ছুটে আসছে একটা যাত্রীহীন বাস। বাসটা সজোরে ধাক্কা মারে দেবপর্ণা-কে। দেবপর্ণার ক্ষতবিক্ষত শরীর ছিটকে পড়ে রাস্তার ওপাশে। মাথায় সজোরে লেগেছে কান দিয়ে ক্রমাগত রক্ত বেরোচ্ছে।

ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে যায় জানলার পাশে ভোরের আভা স্পষ্ট। এটা কি স্বপ্ন! এই অবাস্তব স্বপ্নের মানে কি! নিঃশ্বাসে তীব্রতা কিছুটা বেড়ে এসেছে। কাল সকালে দেবপর্ণাকে ফোন করতে হবে।

সকাল দশটা দীঘির পাড়ে যথারীতি এসে বসলাম। ফোন করব একটা। একবারেই ফোনটা রিসিভ হল। ও পাশ দিয়ে একটা ক্লান্ত, শান্ত হতাশায় বিলীন কণ্ঠস্বর ভেসে এল। কন্ঠটা দেবপর্ণার মায়ের।

— দেবপর্ণা মারা গেছে; বাস অ্যাকসিডেন্টে।

মুহূর্তের খন্ডাংশে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল সময়। ফোনটা ও পাশ দিয়ে কেটে যায়। সে যেটা শুনেছে সেটা কি সত্যি! না এখনো সে কোনও কল্পনার জগতে বিরাজমান। চোখ দিয়ে আস্তে আস্তে জল গড়িয়ে পড়ছে। সেদিকে এখনো পর্যন্ত লক্ষ্য যায়নি। ইন্দ্রিয়গুলো যেন বিকলাঙ্গ হয়ে গেছে মুহূর্তের খন্ডাংশে।

আজ সারা দিন কিছু পেটে পড়েনি। সেই সকালের জলখাবার টুকুন বাদে। শরীরটা ভালো নেই এই বলে এড়িয়ে গেছে সবার কাছে। এখন ঘড়িতে রাত ১২’টা বাজে। গ্রাম আগের মতোই নিস্তব্ধ কোনও শব্দ নেই। শুধু ঘড়ির টিক-টিক শব্দটুকু কানে আসছে। বাইরে বৃষ্টি এসেছে মুষুলধারে। শহর ভিজছে, গ্রাম ভিজছে, ভিজছে আর একটা মন লোকচক্ষুর আড়ালে। সেই বৃষ্টির তীব্রতা বোধহয় বাইরে হওয়া বৃষ্টির থেকেও শতগুণে বেশি। দুটো ভারাক্রান্ত নয়ন সঙ্গোপন করছে আস্তে আস্তে নিজেদের মধ্যে।

দীঘির পাড়ে সরমা এসেছে বাসনপত্র ধুঁতে। বৃষ্টি হওয়ার জন্য চাতাল গুলি ক্রমশ পিছল হয়ে গেছে। বাসনপত্র ধুয়ে বেরিয়ে আসার পথে তার বাঁ পা-টা পিছলে যায় মাথাটা সজোরে লাগে চাতালে; মাথা দিয়ে ক্রমাগত রক্ত বেরোচ্ছে। তার আহত শরীরের সমস্ত শক্তিকে সংযত করে সে উঠে দাঁড়ায়। অবসন্ন শরীরের ভার সামলাতে না পেরে দ্বিতীয় তথা শেষবার পিছলে গিয়ে পড়ে জলের মধ্যে। সাঁতার জানে না মেয়েটি; আতঙ্কে তলিয়ে যায় তার শরীর। ডুবে যায় জলের মধ্যে।

ভোররাতে আর চোখ খোলে-না রোহনের। তার ক্লান্ত শরীর উসখুস করতে করতে এলিয়ে পুনরায়

নিদ্রায়।

সকালে মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙ্গে। জানিস কি হয়েছে আজ! এই গ্রামের একটা মেয়ে নাম সরমা; সে সকালবেলা বাসনপত্র ধুতে গিয়েছিল শ্যামলা দীঘির পাড়ে। বাকিটা আর শোনে না রোহন সে বুঝে গেছে কী হচ্ছে, বলাবাহুল্য কী হয়েছে তার সাথে। মেয়েটার নিথর শরীরের পাশে বসে, তার বাবা-মা হাউ-মাউ স্বরে কাঁদছে। এই কষ্টকে বোধহয় গোপন করা যায় না। দেবপর্ণার মা হয়তো এমন ভাবেই কেঁদেছিল। মৃতদেহটাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হল শ্মশানের উদ্দেশ্য।

কোনও কূল-কিনারা নেই এত প্রশ্নের! সময় এখন প্রহর গুনতে ব্যস্ত। যে ঘটনাগুলি তার সাথে ঘটে চলেছে। সেইগুলি একেবারেই কি কাকতালীয়! না বাস্তবের সাথে এর যোগসুত্র আছে। ক্লান্ত মন কোনও উত্তর খুঁজে পায়না দিগন্তের। আজ আবারও একটা রাত্রি আসবে, আজও কি হবে একই ঘটনা! যা বিগত কয়েক রাত্রি ধরে ঘটছে।

আজকে জেগে থাকার চেষ্টা করে রোহন। যদি ওইসব অদ্ভুত স্বপ্নদের এড়িয়ে যাওয়া যায়। ঘড়িতে রাত ১’টা শরীর চাইছে চোখদুটি বুজতে কিন্তু মন তাঁতে সায় দিচ্ছে না। কতক্ষণ চলবে এই অপলক যুদ্ধ। আগের মতই উত্তর জানা নেই রোহনের। কালকের মত বাইরে আবার বৃষ্টি এসেছে। জানালা দিয়ে শীতল ঠান্ডা হাওয়া বুজিয়ে দিতে চায় তার ক্লান্ত নয়ন। ঠান্ডা হাওয়ার স্রোতে শরীরটা ক্রমশ ঝিমিয়ে যাচ্ছে। একটু উঠে জানালাটা বন্ধ করার শক্তি যেন নেই। অবশেষে মনটা হার মানল তার এই যুক্তিসংগত ইচ্ছের কাছে।

বীরেনদার চায়ের দোকানে আগুন লেগেছে। বাঁশের তৈরি থাম্বাগুলো দাউদাউ করে জ্বলছে।সে বেরিয়ে আসতে চাইছে দোকান থেকে। কিন্তু পারছে না। একটা কালো বড় বড় নখ যুক্ত হাত তার পা-কে চেপে ধরে রেখেছে। সে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে যাচ্ছে ক্রমশ। কিন্তু সব প্রচেষ্টাই যেন ব্যর্থ। জামাতে তার আগুন লেগেগেছে পুড়ছে চামড়া পুড়ছে দেহ। তীব্র উত্তাপে তার দেহ পুড়ে রূপ নিল কাঠ-কয়লার সমাধিস্থ।

ঘুমন্ত রোহনের চোখের কোল ঘেঁষে এক ফোঁটা অশ্রুবিন্দু গড়িয়ে পড়ল বালিশে। যেন কোনও অলিখিত অভিশাপ। একদম সকালে ভিড়ের মাঝে গা না-এলিয়ে রোহন ছুটল অন্যদিগন্তে। তার অপরিণত মস্তিষ্ক বলছে সেই মন্দির কোন না কোনভাবে যুক্ত এইসবের জন্য।

ঠাকুরমা ডাকতে এসেছে রোহনকে। তার ঘর বাইরে থেকে বন্ধ। দরজার শিকলটা খুলে এক নজরে ঘরের ভিতরে দেখতে বোঝা গেল রোহন সেখানে নেই। অপরিষ্কার বিছানা ঘুম থেকে উঠে পরিস্কার করেনি সে। কিন্তু সে কোথায়! বাথরুমে কিংবা ঘরের কোনও প্রান্তে থাকলে ঠাকুরমা জানতে পারতো। অন্তত ডাক দিলে একবার সাড়া দিত। এতবার হাঁক দেবার পরেও যখন কোনও সাড়া পায়নি তাহলে সে ঘরে নেই। কিন্তু এত সকাল-সকাল ছেলেটা গেলই বা কোথায়! অবশেষে ঠাকুমা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বিছানা পরিষ্কার করতে যাচ্ছে এমন সময় চোখের নজরে এল একটা জিনিস।

বালিশের তলা দিয়ে আড়চোখে তাকিয়ে আছে একটা জ্বলজ্বলে তারা। মুহূর্তের ক্ষুদ্র খন্ডাংশে ঠাকুমার বুকটা কেঁপে উঠল হার্টবিটের মাত্রা বেড়ে চলেছে ক্রমশ।

হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে রোহন। সে যা দেখছে তা কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না তার। যে পরিত্যক্ত মন্দির সে দেখেছিল, আজ যেন তার কোনওটাই অবশিষ্ট নেই। মরা গাছগুলিতে পাতা এসেছে একরাশ। ঝরাপাতার অবশিষ্টাংশ নেই মাটিতে। তার পরিবর্তে সবুজ কিছু ঘাস বেড়ে উঠছে। মন্দির সাদা ফ্যাকাশে রংয়ের পরিবর্তে হয়েছে জীবন্ত লাল। ভয় গ্রাস করছে রোহনের মন। তবে যাই হোক ভিতরে তাকে ঢুকতেই হবে। হাজারও প্রশ্নের উত্তর তাকে পেতেই হবে। যদিও সে একদম ঠিক কিনা জানে না সে নিজেই। তবু মনের কথা এতটাও ভুল হতে পারে না। পাঁচিল টপকে মন্দির বর্ধিত অংশটিতে এসে পরল। পাঁচিলটার কোনও পরিবর্তন হয়নি। যেমন আগেও দেখেছে ঠিক তেমনি আছে। পরিবর্তন হয়েছে শুধু পাঁচিলের ওপ্রান্তের অংশ। থর থর পায়ে একরাশ ভয়, একরাশ প্রশ্ন, একরাশ কৌতুহল নিয়ে প্রবেশ করল মন্দিরের ভিতর। যদি এইসবের জন্য! মন্দিরটা দায়ী হয় তাহলে এর শেষ দেখে ছাড়বে। তার ভালোবাসার মানুষকে যে কেড়ে নিয়েছে তাকে এত সহজে ছেড়ে দেবে না। মুহূর্তেই সমস্ত ক্রোধ সমস্ত রাগ এসে তার মনের ভয়কে ধোঁয়ার মতো হাওয়ায় মিশিয়ে দিল। বাইরের মতো ভিতরের প্রতিচ্ছবি একই। নতুন ভাবে তৈরি হয়েছে যেন সব। কাঁচা কাঠের গন্ধ আসছে। হঠাৎ ঝড়ো হাওয়ার কানে এল রোহনের। তীব্র হাওয়ার বেগে বাইরের গাছগুলো দুলছে। দোলার অহমিকা দেখলে মনে হবে! যেন কোনও প্রাকৃতিক শক্তি নয় বরঞ্চ অপ্রাকৃতিক, অবাস্তবিক শক্তির হাত এর পিছনে। আকাশে মেঘ করে এসেছে মুহূর্তেই বৃষ্টি এল ঝেঁপে। আকাশ যেন মায়াবী চাদর দিয়ে ঢেকে দিল সমস্ত আলো। পুরোপুরি অন্ধকার নয় তবে এতটা অন্ধকার যে চোখের দৃষ্টিকে তীব্র থেকে তীব্রতর করলে স্পষ্ট বোঝা যাবে সামনের বর্ধিত অংশ। রোহন একবার চোখ বুলিয়ে নিল মন্দিরের সমস্ত খন্ডাংশে। মুহূর্তেই একটা ঠান্ডা হাওয়া স্রোত রোহনের অন্তঃসত্ত্বা কাঁপিয়ে দিল। ঠিক পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না! তবে; হ্যাঁ একটা কালো অবয়ব কিঞ্চিৎ দূরে দাঁড়িয়ে। দৃষ্টিশক্তি কে তীব্রতর করলে বোঝা যায়! অবয়ব-টা পিছন ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে। হাঁড় ভাঙ্গার কট-কট শব্দ হচ্ছে। আর অবয়েবের মুখটা ধীরে ধীরে সামনের দিকে ঘুরছে। শুধু মুখটা তার ঘুরছে বাকি শরীরটা দাঁড়িয়ে আছে স্থিতিশীল দণ্ডায়মান। চোখ দুটিতে কাঠ-কয়লার তীব্র আঁচ। বিধ্বস্ত তেজী সে দুটিচোখ। একটা মানুষের অন্তরসত্তা কাঁপিয়ে দেওয়ার যথেষ্ট। অবয়বটা রোহনের দিকে না এসে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল মন্দিরটার বেদীটাকে লক্ষ্য করে। বেদীটার সামনে এসে দাঁড়িয়ে উঠে পড়ল তার ওপর। একটা বিশেষ ভঙ্গিতে বসল সেটার উপর। ব্যায়াম শাস্ত্রে যাকে বলে অর্ধকূর্মাসন। অর্থাৎ পা দুটি ভাঁজ করে বসে, তার উপর শরীরের সমস্ত ভাড় দিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে উবু হয়ে শুয়ে পড়া। কালো নিকষ হাত দুটি নমস্কার করার ভঙ্গিতে মাথার পিছন হইতে সামনের দিকে এল। হঠাৎ একটা ক্যাঁচকোঁচ শব্দে হুশ ফিরল রোহনের। মন্দিরের দরজা আস্তে আস্তে বন্ধ হচ্ছে। বেরোনোর চেষ্টা করার আগেই দরজাটা সজোরে বন্ধ হয়ে গেল। তীব্র আর্তনাদ “বাঁচাও-বাঁচাও”সেই শব্দ, সে চিৎকার মন্দিরের ভিতরেই আটকা পড়ে গেল। তার সামান্য আওয়াজটুকু বাইরের পৃথিবী জানতে পারলো না। আকাশ হঠাৎ গর্জে উঠল। সজোরে একটা বিদ্যুত চমকাল। সেই বিদ্যুতের নীলচে আভা মুহূর্তে ভরিয়ে দিল মন্দিরের ভিতর। রোহন তার মনকে শান্ত করল আর সেই মুহূর্তের খন্ডাংশে রোহন দেখলো! কাঠের তৈরি মন্দিরে ছোট্ট একটা ফাঁক। একদমে ছুটে গেল সেখানে সজোরে একটা লাথি মারল কাঠের ফাঁকের অংশটাতে। বহুকাল আগের তৈরি মন্দির পচা কাঠের দণ্ডায়মান স্ট্রাকচার আজও দাঁড়িয়ে আছে। তবে সেই সজোরে লাথি-তে খুবই ক্ষুদ্র তবে একটা মানুষ গলে যাওয়ার মতো সুড়ঙ্গ তৈরি হল। রোহন হাঁটু গেড়ে বসে বেরিয়ে যাওয়ার আগে একবার তীর্যক দৃষ্টিতে অবয়ব-টার দিকে তাকাল। অবয়বটার যেন কোনও বিকার নেই। সে ওই অদ্ভুত ভঙ্গিমায় এখনও বসে আছে।

বাড়ি ফিরে এক ঝাঁক প্রশ্ন এড়িয়ে রোহন ঢুকে গিয়েছিল বাথরুমে। তার পা দুটি থর-থর করে কাঁপছে। শীতল জলের স্পর্শ একরাশ কালো ভয়ের অভিশাপকে নিংড়ে-নিংড়ে বার করছিল তার শরীর থেকে। ঠাকুরমা আজও তাকে বাঁচিয়েছে! একঝাঁক প্রশ্নের হাত থেকে। রোহনের কাছে তো কোনও উত্তর ছিল না; কেন সে এই বৃষ্টি বাদলের দিন একা-একা ঘর থেকে বেরিয়েছে! কী বলতো সে! আদৌ কি এইসব অবাস্তবিক কথা বলা যায় কাউকে!

কারেণ্ট নেই আজকে গ্রামে। ঝড়ের দাপটে কারেন্টের পোস্ট ভেঙে পড়েছে। তবে মোটেও গরম লাগছে না রোহনের একঝাঁক সজীব শীতল হাওয়া স্পর্শ করছে তার শরীর। আকাশে কিছু ক্ষুদ্র মেঘের খন্ড উড়ে যাচ্ছে। আর তাদের কোলঘেঁষে আড়চোখে ধরা দিচ্ছে নক্ষত্রেরা। দূরে টিপ টিপ করে জ্বলমান মোমবাতি আর লন্ঠনের আলো অন্ধকারের অভিশাপ থেকে বাঁচিয়ে রেখেছে বাড়িগুলিকে। আজ মোটেও মন ভালো নেই তার। আকাশের কালো মেঘেদের মতন একরাশ বিষাদে আচ্ছন্ন তার মন। রাত আরও গাঢ় হচ্ছে। আকাশে চাঁদ এখন প্রকট জ্বলমান। হওয়ার মাত্রা কিছুটা শিথিল হয়েছে তবে সম্পূর্ণ নয়। দরজায় একটা টোঁকা পড়ল। মুহূর্তেই নিস্তব্ধতার ঘোর-টা ভয়ে পরিণত হল রোহনের কাছে। ক্রমাগত টোঁকা পড়ছে দরজার পাল্লায়। একটা ভয় নির্মিত কণ্ঠস্বর দরজার এপাশ দিয়ে শোনা গেল;

— কে!

পরক্ষনেই উত্তর এল।

— আমি ঠাকুরমা, বাবু দরজা খোল।

দরজাটা খুলতেই ঠাকুরমা প্রশ্ন করে উঠল!

— বাবু এখনো ঘুমাসনি!

–না মানে ঘুম আসছিল না।

— সেটাই স্বাভাবিক কারেন্ট চলে গেছে। আর আমাদের গ্রামে পরিষেবা ব্যবস্থা তোদের শহরের মতো অত ভালো নয়। ফোন করলেই ঠিক করতে চলে আসে।

— না না গরমের জন্য নয়। এমনি ঘুম আসছিল না।

— ও আচ্ছা, বাবু একটা প্রশ্ন করি তোকে! অত সকালে কোথায় গিয়েছিলিস!

রোহনের মুখে জবাব নেই। বলা বাহুল্য কোনও উত্তর নেই। কী বলবে সে! গ্রাম ঘুরতে যায় সে। তাও এত সকালে নয় বেলা দশটার পর। তাহলে কী বলা যায়! এই প্রশ্নের কোনও স্বাভাবিক উত্তর আছে কি তার কাছে!

— না মানে ওই আর কি; কাঁপা কাঁপা গলায় কথাগুলি বেরিয়ে আসে রোহনের কণ্ঠস্বর দিয়ে।

— আমি কিন্তু সবই জানি! কোথায় গিয়েছিলিস! কেনই-বা গিয়েছিলিস!

মুহূর্তে খন্ডাংশের জন্য রোহনের হাত-পা কেঁপে কেঁপে ওঠে। মানেটা কী! ঠাকুরমা সব জানে মানে! কৌতুহল রঞ্জিত কথাগুলো মন যেন বলে উঠল।

— তুমি জানো মানে, কী জানো!

— মন্দিরের গল্প জানি। তোর বালিশের তলায় লুকিয়ে রাখা তারার গল্প জানি। এমনকি তুই আজ কেন গিয়েছিলিস! তারও গল্প জানি।

— মানে কী জানো তুমি!

— তুই বলবি না আমি বলব?

শান্ত একটা কণ্ঠস্বর নিঃশব্দের প্রাদুদেশ ভেঙে বলল;

— তুমি বলো। আমার গল্পের পুরোটাই গোলমেলে।

ঠাকুরমা উঠে দরজাটা বন্ধ করে এল। আস্তে করে রোহনের পাশে এসে বসল। শোন তবে;

আমার শ্বশুরমশাই অনিন্দ্য ভট্টাচার্য। তোর বাপের মুখে নামটা শুনেছিস বোধহয়! এই গ্রামটার নাম নেহাত মন্দ ছিল না। এখনো লোক তার নাম করেন। বলা বাহুল্য এখনো আমাদের কথা যে জোর বা মর্যাদা আছে সেটা শুধুমাত্র তার জন্য। একজন সাদামাটা মনের মানুষ মানুষের সেবা তার মূল ধর্ম ছিল। আর সেই জনসেবাকেই তিনি তার পেশা হিসেবে নিলেন। তিনি প্রথম থেকেই বাম রাজনীতি করতেন। রাজনীতির থেকেও জনসেবামূলক কাজের প্রাধান্য বেশি ছিল তার কাছে। ঠাকুর-দেবতার প্রতি প্রথম থেকেই তার ভালোবাসা অনেকটাই ছিল। তাই তিনি গ্রামের উত্তর সীমান্ত একটা কৃষ্ণের মন্দির প্রতিষ্ঠা করলেন। সেটাই ছিল তার জীবনের অন্যতম ভুল। যদিও প্রথমদিকে তেমন কোনও মতবিরোধ ছিল না। প্রতিদিন পুজা হত জাঁকজমক করে। সন্ধ্যাআরতি, শাঁখের কূলধ্বনির শব্দ পুরু গ্রামটাকে ভালোবাসার চাদরে ঢেকে দিয়েছিল। প্রতি মানুষের সাথে মানুষের মিল, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, দুবেলায় পেট ভর্তি খাবার। সন্ধ্যায় সব মানুষ একত্র সমাবেশে কীর্তন এইসব নিয়ে এই গ্রাম বেজায় সুখী ছিল। কৃষ্ণকে আমরা মূলত প্রেমের দেবতা বলি। আর প্রেম, ভালোবাসা যেখানে অধিষ্ঠা করেন তার থেকে সুখ বোধহয় অন্য কোনও জায়গায় নেই।

এমন করেই চলছিল সব। হেসে খেলে আনন্দ করে। তারপর সেই নেমে এল ভয়াবহ এক অভিশাপ। ৩৭ বছরের বাম আমলের অবসান হল। সেই বারে হেরে গিয়েছিলাম ভোটে কিন্তু তাতে কোনও দুঃখ ছিল না অনিন্দ্য ভট্টাচার্যের মনে। বরং একরাশ গ্রাম সংক্রান্ত চিন্তা দলা পাকিয়ে ছিল তার মনে। সেই বছর ধানে মড়ক লাগল। চাষীদের মুখে প্রথমবার লক্ষ্য করেছিলেন বিষাদের স্বাদ। সেই বছরেই বন্যা হয়েছিল সমস্ত গ্রাম অনাহারে আচ্ছন্ন। শ্বশুরমশাই যতটা পেরেছিলেন সাহায্য করতে করেছিলেন। কিন্তু ভাগ্যের কী অদ্ভুত পরিহাস। দিগম্বর সাহা যিনি আমাদের গ্রামের প্রধান পুরোহিত ছিলেন। এক দুর্যোগের রাতে মন্দিরের সন্ধ্যা আরতি সেরে দরজা বন্ধ করে বাড়ি ফিরছিলেন। সেই সময় বজ্রাঘাতের কবলে পড়ে প্রাণ হারান। ঈশ্বর কী নিষ্ঠুর! যিনি তাঁর পূজা করতেন তাঁকেই সবার আগে তুলে নিলেন। তাও একদিকে ভালো এরপর যে অভিশাপের কবল নেমে এসেছিল এই গ্রামে তা তিনি সহ্য করতে পারতেন না। এক সন্ধ্যার কথা। মানসিক ভাবে ভারাক্রান্ত অনিন্দ্য ভট্টাচার্য শ্যামলা দীঘির পাড়ে নিশ্চুপ ভাবে বসে ছিলেন। সেই সময় দেখা হয় মুখভর্তি সাদাকালো দাঁড়ি, একরাশ ঘন পাকা চুলে পরিপূর্ণ মাথার এক তান্ত্রিকের সঙ্গে। ওই আগেই বলেছিলাম খুব সাদামাটা সহজ-সরল মনের ভদ্রলোক ছিলেন শ্বশুরমশাই। তার কাছে দুষ্ট ব্যক্তি ও সাধু সমতুল্য ছিল। তান্ত্রিকের পায়ে একবার নমস্কার করে তার দুঃখকে উজার করে দেয় তার কাছে। “যে মানুষের মানসিকতা দূষিত সে সৎ জায়গাতে এলেও খারাপের আধিপত্য বিস্তার করবে এটাই স্বাভাবিক” সেটার বিপরীত এখানেও হয়নি। সেই রাতে শ্বশুরমশাই সেই তান্ত্রিককে বাড়িতে নিয়ে আসেন। রাতের নৈশভোজ করানোর জন্য। তিনি রাতের খাবার সেরে চেয়ারে বসে বলেন;

— আমি অনুভব করতে পারছি! এই গ্রামে অপদেবতার নজর পড়েছে। তাই এই অপার্থিব অমঙ্গল গুলি ঘটছে।

— বাবা ঠাকুর কি করা যায়! এ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য।

— কোনও সাধারন দেব-দেবীর পূজাআচ্চা করলে হবে না। অপ-দেবদেবীর বিরুদ্ধে তন্ত্রের ব্যবহার সাফল্যজনক।

— বাবা; আপনার যা মন চায় আপনি করুন। আমি শুধু শান্তি চাই।

পরেরদিন গ্রামের সেই মন্দিরে প্রথম প্রবেশ করে অমঙ্গল। উচ্ছেদ হয় এতদিনের আরষ্ঠ দেবতা। তার পরিবর্তে আসে! সেই তান্ত্রিকের ঝুড়ি থেকে বার করা একটি লাল সিঁদুর মাখানো মানুষের খুলি। সেটাই নাকি উচ্ছেদ করবে সমস্ত অভিশাপ। শ্বশুরমশাই-কে কিসের যেন একটা মোহ গ্রাস করেছিল। সব ধরনের অযুক্তিবিশিষ্ট নিয়মের কোনরূপ বিরোধিতা করেননি তিনি। প্রত্যেক অমাবস্যায় একটা করে যজ্ঞ হত। আর সেই যোগ্যের আগুন নিভানোর মূল উপকরণ ছিল রক্ত। জীবন্ত জন্তুকে সে আগুনের সামনে বলি দিয়ে তার শরীর বেয়ে গড়িয়ে পড়া তাজা রক্ত দিয়ে আগুন নেভানো হত। আর পরেরদিন সেই জন্তুর মাংসবিহীন দেহ পড়ে থাকতো মন্দির বর্ধিত অঞ্চলে। মাছি ভ্যানভ্যান করতো শকুন, চিলের প্রধান আস্তানা ছিল মন্দির বর্ধিত অঞ্চল। তান্ত্রিকের মতে “বাবার প্রসাদ সবাই খাক”। কালক্রমে গ্রামের ভালোবাসার অটুট বন্ধন ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। পারিপার্শ্বিক ঝগড়া কলহ দিন-দিন বেড়েই চলেছিল গ্রামে। কিন্তু শ্বশুরমশায়ের কাছে সবই ছিল স্বাভাবিক একদম আগের মতন। তার শরীরে দশা দিনকে দিন আরও ভগ্নপ্রায় হতে থাকে। রোগা শীর্ণ হাড়ের কাঠামো যেন দণ্ডায়মান। বুকের কোটর থেকে বেরিয়ে এসেছিল হাড়ের ধাঁচা। তিনি যখন খাবার খেতে বসতেন! দেখে মনে হতো! তিনি খাচ্ছেন না তার শরীর দিয়ে অন্য কেউ খাচ্ছে। প্রতিরাতের মতন সেদিন রাতেও তিনি খাওয়া-দাওয়ার পর্ব সমাপ্তি করে ঘুমিয়ে ছিলেন সেই নিদ্রা আর কেউ ভঙ্গ করতে পারেননি। শ্বশুরমশাইয়ের মৃত্যুর পর আরও অধিকারবোধ বেড়ে যায় তান্ত্রিকের। পূর্ব পুরোহিতের পরিবার বিরোধিতা করে সেই তান্ত্রিকের নিয়ম-আচার এর বিরুদ্ধে। আরও ক্ষুদ্ধ আরও তেজি হয়ে ওঠে সে। একটা মন্ত্রপূত “তারা” কে যেন লুকিয়ে রেখে এসেছিল সেই পুরোহিতের বাড়িতে। তারপর একের পর এক মৃত্যু হতে থাকে গ্রামে। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের কথা পড়েছিলিস বোধহয়! সেখানে খাদ্যের আকাল লেগেছিল। আর এই গ্রামে লেগেছিল মানুষের আকাল। একের পর এক পরিবার ধ্বংস হয়ে যায়। মন্দিরের লাল রং ধীরে ধীরে আরও তীব্র হতে থাকে। সেই নরপিশাচ শুধু রক্ত চাইতো। অঝোর নিদ্রায় স্বপ্নগুলো বলে দিত পরের দিনের ভবিষ্যৎ। আজ সকাল হতে না হতেই একটার পর একটা মৃতদেহ চলে আসত লোকের সামনে। কিছু পরিবার ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়। শোনা যায় তাদেরও জীবনদান দিতে হয়েছিল। গ্রামের লোকে সংখ্যা যখন হাতে গোনা হয়ে গিয়েছিল! তখন তারা পরিকল্পনা করে তান্ত্রিককে হত্যা করার। যে মানুষ প্রতি রাতে মৃত্যুর ভয় নিয়ে ঘুমাতে যায়, তার জীবনে আর কোনও কিছুর পিছুটান থাকেনা বোধহয়। দশ-বারো জন গ্রামবাসী একত্রে হামলা করে সেই মন্দিরে। এক লাথিতে ভেঙে দেয় সেই দরজা তারপর সেই তান্ত্রিকের গলা ধরে বাদ দিয়ে দেয় মুন্ডুটাকে। আবার একটা আগুন জ্বলে সেই আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে যায় তান্ত্রিকের দেহ আর তার সাথেই জ্বলতে থাকে মার্বেল পাথরের তৈরি সেই তারা।

এরপর কেটে যায় একটা মাস। এক সিদ্ধ পুরোহিতের সাহায্যে মন্দিরটাকে ঘিরে ফেলা হয় অভিশাপ মুক্তির মন্ত্রে। এত কাল যাবৎ প্রহরীদের মতন পাহারা দিচ্ছিল বোধহয় গ্রামের সেই নিরীহ প্রাণঘাতী মানুষগুলো। পরে যদিও আলোচনা হয় সেই মন্দির পুনঃস্থাপন করার। মন্দিরের আদি দেবতার পূজা পাঠ শুরু করার। কিন্তু সেই শতাব্দী প্রাচীন অভিশাপের কথা মানুষ আজও ভুলতে পারেনি। তাই বোধহয় হুজুক উঠলেও কেউ তাতে সম্মতি দেয়নি। এই প্রথম রোহন একটা কথা বলে শান্ত স্বরে;

— ঠাকুরমা!

কথাটাকে চুপ করিয়ে দিয়ে ঠাকুরমা বলে উঠে!

আমি জানি তুই কি বলবি! তোর প্রিয়জন থাকতেও এই সাধারন মানুষগুলোর মৃত্যু হল কেন! আসলে বিগত কদিন যাবৎ তুই যাদের কথা সবচেয়ে বেশি ভেবেছিস মৃত্যুটা খালি তাদেরই হবে।

এক বিন্দু ঘাম কপাল থেকে ঝরে পড়ে রোহনের। একরাশ ভয় পুনরায় তার গলা চেপে ধরে যেন। তার মানে কি! ঠাকুমা একটু কাঁসছে উঠে দাঁড়িয়ে টেবিলের মধ্যে রাখা জলের বোতলটা খুলে জলপান করে রাখতে যাচ্ছে সেই সময় দুটো লালচে চোখ ঠাকুমার পিছন হইতে দণ্ডায়মান। যেন কাঠ-কয়লা জ্বলছে চোখের অলীক কোটরে। মুহূর্তে সেই ক্ষুদ্র খন্ডাংশে ঠাকুমার গলা চেপে ধরে এই নরপিশাচ। রোহন উঠতে যাবে তার আগেই একটা ছুরির ফলা ঠাকুমার গলার আর-পার হয়ে যায়। ঠাকুমার দেহটা লুটিয়ে যায় মাটিতে।

তিনটে মাস কেটে গেছে। চোখের নিচে পরা কালি আরও ঘন হয়েছে। সিগারেটের ধোঁয়া ক্রমশ ছারখার করছে তার ফুসফুস দুটোকে। অতীত এমন একটা দুঃখ যাকে বোধহয় মুছে ফেলা যায় না। তাকে বয়ে যেতে হয় মৃত্যুর আগে পর্যন্ত। রোহন উঠে দাঁড়াল হাতে সিগারেটটা তার অজান্তেই হাত থেকে পড়ে গেল। ছাদের একদম কার্নিশে দাঁড়িয়ে সে। মনে জমা শত বিরহ অশ্রু হয়ে পড়ছে মাটিতে। দেবপর্ণাকে কতটা ভালোবাসত সে। শুধুই কি দেবপর্ণা! তার ঠাকুমাকেও কিছুদিনে এতটা বেশি আপন করে নিয়েছিল সে। ঠাকুরমা তো একটা বয়সজ্যেষ্ঠ বন্ধু ছিল তার কাছে। আজও কি বলতে পারবে এইসব কথা! সে তাদেরকে ঠিক কতটা ভালোবাসত। হ্যাঁ মৃত্যুর পর সে পারবে তাদের কাছে যেতে তাদেরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে। তাদের বলতে ঠিক কতটা ভালোবাসতো সে। ক্রমশ তার পা-দুটো আলগা হয়ে যায়। শরীর তার নিজের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। একটা দেহ উপড়ে পড়ে মাটিতে। যারা গ্রাম ছেড়েছিল শোনা যায় তারাও মারা গিয়েছিল।

Contact = 9674135247

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post ছবি | পলক ফেলা নিষেধ | কল্পেশ মান্না | Bengali Thriller Story
Next post অনীশ্বর | পলক ফেলা নিষেধ | নুজহাত ইসলাম নৌশিন | Bengali Thriller Story