“বলছি নতুন এসেছেন নাকি?”
সবে হাত-পা-মুখে জল দিয়ে একটু জিরিয়ে বসে দেখছি জানলাগুলো থেকে কেমন হাওয়া আসে। হঠাৎ এই অপিরিচিত খ্যাচখ্যাচে গলার শব্দে দরজার দিকে ফিরে তাকাই। দেখি একজন লুঙ্গি- স্যান্ডো গেঞ্জি পড়া রোগা লিকলিকে ভদ্রলোক দন্তবিকশিত করে দাড়িয়ে আছেন। নতুন এসেছে, এখনি পাত্তা না দিলে পরে মুশকিল হতে পারে এই ভেবে বেশ একটু অলস ভাবেই আমি তাকে একটা শুকনো হাসি দিয়ে অভিবাদন জানিয়ে বলি – “ আজ্ঞে এই সকালে আসলাম। আপনি বুঝি পাশের ঘরে থাকেন?”
ভদ্রলোক কেমন যেন পাগলাটে গোছের বলে আমার মনে হল। চুলগুলো উসকো খুসকো। গায়ের স্যান্ডো গেঞ্জিটা ও কেমন ছেঁড়া। ভদ্রলোক ঘরের এদিক ওদিক তাকিয়ে বললেন – “ এ বাড়িতে থাকতে যাব কেন? মরার জন্য নাকি! নতুন তো ওই জন্যে টের পাচ্ছেন না। কয়েকদিন থাকুন। আর হ্যাঁ্আর একটা ঘর জোগাড়করে রাখুন। এ ঘরে ১ মাসের বেশি থাকতে পারবেন, আর যদি থাকতেও পারেন তবে সেটা এ জগতে না। দেখুন, দেখুন কেমন একটা গন্ধ বের হচ্ছে না। দেখুন। আমি চলি হ্যাঁ, ভালো থাকবেন”।
আমার মাথায় কিছু ঢুকল না। ঢুকতে দিলাম না। কী বলে গেলেন ভদ্রলোক! মাতাল নাকি? ঘরে এসে আমিই তো রুম ফ্রেসনার দিলাম। আর এই আষাঢ়ে ভুতের গপ্পে আমি ভয় পাব বলে কি মনে হয় ভদ্রলোকের? লোকটার নির্ঘাত কোন উদ্দেশ্য আছে। লোকটা থেকে দূরে দুরে চলতে হবে।
দিন চারেক হন্নে হয়ে খোঁজার পর কলকাতার একেবারে বাইরে ঘিঞ্জি একটা পাড়ায় শেষমেশ ১৩০০ টাকায় এই বাড়িটা পাই। কয়েকদিন স্টেশনে কাটালাম্ এখন তাও মাঠ গোঁজার হয়েছে। কী আর হবে। বাবা মারা গিয়েছিল ৩ বছর আগে, মা ও চলে গেল গত মাসে। জ্যাঠা বলল খেটে খেতে। কেউ ভালোবাসে না আর আমার বাড়িতে। তাই ভাবলাম যা টাকা আছে তা দিয়ে্ আর একটা কাজ জুটিয়ে চালিয়ে নেব। ও বাড়িতে আর থাকব না। এখন একটু বুঝি যে সত্যি জীবনটা বড়ই কষ্টকর। এখানে কেউ কারোর না, বাবা – মা বাদে। লোকে এখন কথা বলতে চায় না, বন্ধুরা মাঝে মাঝে যোগাযোগ করে। এখন আর ওসব ভাবি না। ভাবলে বেশি কষ্ট হয়।
এখন একটু নিশ্চিন্ত। একটা ছোট খাটো কাজ করে জীবনটা চালিয়ে নেব। এবার ঘরটার বিবরণ দিই। পুরো ঘরে একটা ফ্যান, একটা ছোট্ট আলমারি, আর একটা চৌকি। আলমারির মধ্যে দুটো উদ্ভট জিনিস। একটা ছোট পকেট ডায়রি গোছের আর একটা পাশবালিশ। লাল মখমলের কভার দিয়ে মোড়া। আমার বেশ অদ্ভুত লাগল। কিছুই যখন দেয়নি তাহলে এই পাশ-বালিশ কেন থেকে গেল্তা জানি না।
সন্ধ্যায় সবে একটা গল্পের বই নিয়ে বসতে যাচ্ছিলাম। কাল আবার একটা কাজ খুঁজতে যেতে, দেখি হয় কিনা। একটা রান্নার চাকরি কিংবা বাসন ধোয়ার চাকরি পেলেও আপাদত চলবে। এখন মনে পড়ে সেই সব কথা, মধু স্যার বলত যে আমি অঙ্কতে ভালো, একটু মন দিতে হবে। এই সব ভাবছি হঠাৎ একটা শোরগোলের শব্দ আমার কানে আসে। ভাবনাটা ভেঙে যায়। কয়েকজন মিলে মনে হয় বচসা করছে। আমি সামনের অন্ধকার বারান্দার রেলিঙের ধারে গিয়ে দাঁড়ালাম। নিচের দিকে তাকিয়ে দেখি আমারই বাড়ির মালিকের সাথে ৪ জনের বেশ ঝগড়া শুরু হয়েছে। একজন বেশ ছোকরা গোছের লোক বলে উঠলো- “দেখুন দাদা, আপনি একজনকে জেনে শুনে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারেন না। আমরা কীভাবেকিন্তু পুলিশে কমপ্লেন করব। তিন তিনটে খুন হয়েছে। কেন কীভাবে এখনও জানা যায়নি। এরপর কি যুক্তি খাড়া করবে ?”
বাড়িওয়ালা অমূল্যবাবু বেশ একটু ধমকের সুরে বলে – “আরে যা তো তোরা। সন্ধেতে জ্বালাতে এসেছে। আরে কারো যদি মরার ইচ্ছা থাকে, সে একজন কেন চার-পাঁচজন মুরুকগে যাক। তাতে আমার দুর্নাম কেন? আমার এখন টাকার দরকার আমি ঘর ভাড়া রেখেছি। তাতে তোদের অত কী?”
হোমরা চোমরা লোকটা বলল- “না, এমনিতে ভালো না জায়গাটা। তার উপর এমন উপদ্রব চলবে তো পাড়ার একটা দুর্নম হয়ে যাবে। ওসব শুনতে আমরা রাজি নই।”
একটু অধৈর্য হয়ে অমূল্যবাবু ঘরে গিয়ে কি একটা নিয়ে এলেন। সেগুলো ওই লোকটার হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন – “যা, এবার যা দেখিনি।”
লোকটার সুর একটু নরম হল। দেখলাম তার হাতে কয়েকটা পঞ্চাশ টাকার নোট। লোকটা বলল- ” ঘুষ দিচ্ছেন। ভাবছেন টাকার গরমে আমরা চেপে থাকবো?”
বাড়িওয়ালা অমূল্যবাবু ও একটু নরম সুরে বললেন- “আরে না না। ঘুষ দেবো কেন? সামনে তোদের এত বড় একটা প্রোগ্রাম। কালী পূজার খিচুড়ি, ফাংশনের জন্য তো আগে থেকে টাকা লাগে। কিছু দিলাম, পরে আবার এসে নিয়ে যেও লাগে যদি।”
দেখলাম লোকগুলো আর কিছু না বলে চলে গেল। বুঝলাম পাশের ক্লাব থেকে এসেছে ওরা। কিন্তু কিসের কথা বলছে! এ বাড়িতে আমি ছাড়া আর অন্য ভাড়াটে থাকে কিনা আমি জানি না। কিসের খুন? এ বাড়িতে কোনও গন্ডগোল আছে নাকি? আমার একবার মনে হয়েছিল যে কম টাকায় একটা ঘর দিয়ে দিল। কিছু না কিছু ব্যাপার আছে। পারলে সকালে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে হবে। এখানে আবার পুলিশ হানার ব্যাপার তাহলে তো মুশকিল। ওসব ঝামেলায় কে জড়াবে। আমার বাড়িওয়ালাকেও বিশেষ সুবিধার মনে হয় না। কে জানে!
রাতে খাবার জন্যে কয়েকটা আলু, ডিম আর কয়েকটা পাউরুটি কিনেছিলাম। তাই রাতে খেলাম। বিছানাটা পাতলাম। আলমারিটাতে থাকা বালিশটা আমি নিলাম না। আমার এমনিতে পাশবালিশ এর প্রয়োজন পড়ে না। তার উপর আমার কেমন একটা অস্বস্তি হতে লাগল ওই লাল রঙের কভারটা দেখে। আলো বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম। সঙ্গে সঙ্গে ঘুম আসল না। কেমন একটা নির্জনতা চারিদিকে। পাখা ঘোরারও যেন শব্দ হচ্ছে না। আস্তে আস্তে আমার চোখের পাতা জুড়ে এল। আমি চললাম ঘুমের দেশে।
সকালে চোখে সকালের রোদ আসতেই উঠে বসলাম। একটা মোটা জিনিসের উপর হাত রেখে উঠে বসলাম। তন্দ্রা ভাবটা একটু কাটতেই আমি একটা ব্যাপার দেখে চমকে উঠলাম। আমি যার উপর হাত রেখে আছি, সেটা হল সেই লাল মখমলের কভারে ঢাকা পাশবালিশটা। আমি অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলাম। বুঝলাম না ঘটনা কী ঘটছে। রাতে আমার ঘুম চোখে হাঁটার অভ্যেস নেই। তাহলে কী করে আসে এটা আমার কাছে? আমার ঘরে কি কেউ ঢুকেছিলা? না, দরজা তো বন্ধ। উঠে দাঁড়ালাম। মুখ হাত ধুয়ে কয়েকটা বিস্কুট খেলাম। বালিশটা তখনও আমার বিছানার উপর..। কিছুই মাথায় ঢুকছে না। মুখ হাত ধুয়ে আমি চললাম মালিক অমূল্যবাবুর কাছে।
– “ও কিছু না। আমি ওদের কোনও বার ওদের সময় মতন চাঁদা দিই না। তাই ওদের আমার উপর রাগ। তা তুমি আবার তদারকি করতে এসেছ কেন? ওসব লোক ভালো না। ভুজুং ভাজুং বলবে। বিশ্বাস করবে না।”
– “তাহলে ওরা কিসের খুনের কথা বলছিল?” আমি একটু কৌতূহলী হয়ে বললাম।
অমূল্যবাবু বললেন – “আরে ধুর, অসব কথার পৃষ্টে কথা। ছাড়ো তো। আর নিজের কাজে যাও।”
আমি ওখান থেকে চলে আসলাম। কিন্তু স্পষ্ট বুঝলাম্কিছু একটা লোকাচ্ছেন উনি। কিন্তু অবাক হবার বোধ হয় আর বাকি ছিল আমার। নিজের ঘরের দরজা দিয়ে সবে ঘরে ঢুকেছি, আমার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা স্রোত বয়ে গেল। ব্যাপারটা আর কিছুই না। সেই পাশবালিশটা এখন আর আমার বিছানার উপর নেই। আমি স্পষ্ট দেখেছিলাম ওটা ওখানেই ছিল। তাহলে গেল কোথায়। আর একটা চিন্তা মাথায় আসতেই ভয়টা আরও পেলাম। আমি ঘরের দরজা খোলা রেখে গিয়েছিলাম। তখন যদি কেউ ঢোকে… আমি ছুটে গেলাম আমার দিকে। টাকাগুলো যেখানে আছে সেখানে দেখলাম। নাহ, টাকা সরায়নি। ব্যাপারটা কী? আলমারিটা খুললাম। খুলে দেখি বালিশটা ওই আলমারির মধ্যে। আবার খানিকক্ষণ দাড়িয়ে থাকলাম ওখানে। আমি কি পাগল হয়ে গেছি! নাকি আমার স্মৃতিশক্তি কমে গেছে! মাথা থেকে বার করে ফেলতে চাইলাম। জীবনে এমনিতে যন্ত্রণা, তার উপর এসব। আর সহ্য হয় না। কিছু না খেয়েই বেরিয়ে পড়লাম কাজ খোঁজার উদ্দেশ্যে।
সেদিনের মত কিছু আর হল না। কিন্তু এমন অনেক কিছুই আমার জীবনে হতে লাগল যা আমি কোনদিন আশা করিনি এবং যা আমার…
বাড়ি এলাম বিধ্বস্ত অবস্থায়। নাহ, ওরা ভালো রান্না জানা চাকর চায়। খুব ভুল হয়ে গেছে। আগে থেকে কয়েকটা রান্নার বই পড়ে যদি কিছু জেনে রাখতাম্ তাহলে কাজটা পেয়ে যেতে পারতাম। বাড়ি এসে কাঁধের ছেঁড়া ব্যাগটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে বাথরুমে গেলাম। ভাঙা কলটা খুলে চোখে মুখে জল দিয়ে ঘরে এসে বসি। সারাদিন পেটে কিছু পড়েনি। কয়েকটা পাউরুটি্ আর একটা ডিম ভেজে খেয়ে নেই। কিছুটা খিদে লাঘুব হয়। হঠাৎ একটা মিষ্টি গন্ধ নাকে আসে। খুব মিষ্টি। যেন হঠাৎ ঘরে কেউ সেন্ট মেখে এসেছে। ভালো করে গন্ধটা শুঁকি আমি। লেডিস পারফিউম। কিন্তু গন্ধ কোথা থেকে এল? ঠিক ৫ মিনিট পর গন্ধ আপনা আপনি উধাও হয়ে গেল। আমিও একটু প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে পারলাম। ওই গন্ধ তে মনে হচ্ছিল যেন আমার গলা টিপে ধরছিল। নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম না। এই ভাবে একটা দিন আমার কাছ থেকে চলে গেল।
এর পর থেকেই শুরু হয় প্রত্যেকদিনের এক অদ্ভুত ঘটনা। কাল অর্থাৎ ঘটনা অনুযায়ী আজ সকালে যখন উঠি তখনও আমি আমার পাশে ওই বালিশটাকে পাই। লাল মখমলে ঢাকা কভারে। আবার আমার চোখের বাইরে হলেই প্রতিদিন নিজের জায়গায় চলে যায়। প্রায় দিন দশেক পর প্রায় বাধ্য হয়ে আমি নিচে বাড়িওয়ালার দরজায় একটা জোরে ধাক্কা দিই। দেখি অমূল্যবাবু হেলতে দুলতে দরজা খুলছেন। ওঁকে দেখে আমি যথেষ্ট গম্ভীর গলায় বলি- “দেখুন। আপনার ঘরে যদি কোনও গণ্ডগোল থেকে থাকে, তো আমার ২ মাসের এ্যাডভান্স টাকাটা ফিরত দিন। আমি চলে যাচ্ছি। এ কী উপদ্রব শুরু হয়েছে?”
অমূল্যবাবু দেখলাম বেশ কঠোর ভাবে বললেন – “কোনও নেশা করো? কিসের উপদ্রব হ্যাঁ! তুমিও যদি ওই ক্লাবের ছেলেদের সাথে আমার বদনাম করো তো এমনিই বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেব। টাকা নিতে এসেছে। এত কমে কে বাড়িভাড়া দেবে?”
আমি কি পাগল হয়ে গেছি? নাকি সত্যি এমন ঘটছে। তাই বলে একটা..একটা পাশবালিশ? কি সম্পর্ক এর? রোজ আমার বিছানায় থাকে আর পরে নিজের জায়গায় চলে যায়? কীভাবে, কেন! কিছুই মাথায় ঢুকছিল না। উশকো চুল নিজের দুই হাত দিয়ে জাপটে ধরলাম। কী মনে হল, এক টানে খুলে ফেললাম আলমারিটা। একটা ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করে খুলে গেল। বার করলাম সেই লাল কোলবালিশটা। কেমন একটা বিদঘুটে ধরনের লাল। খানিকটা রক্তের আস্তরণ শুকিয়ে গেলে যেমন হয়, ঠিক সেই রকম। একটি কাছে। ইয়ে এলাম বালিশটা। কিসের একটা গন্ধ পেলাম। মিষ্টি গন্ধ। এই গন্ধ আমি চিনি। লেডিস পারফিউম এর গন্ধ। বুকটা অজান্তে ছ্যাঁৎ করে উঠল। এতে পারফিউমের গন্ধ কেন থাকবে? আমার মনে এক অজানা আশঙ্কার সৃষ্টি হল। আমি বুঝলাম, কোনও এক মহিলা আমার অজান্তে এই ঘরে ঢোকে। আর এই চোরের ছবি দেয় ওই বুড়ো মালিক। কিছু একটা বদ উদ্দেশ্য আছে ওই বুড়োর। দুটো মাস গেলে হয়। এখানে না থেকে রাস্তায় থাকব। তাও ভালো। এই গন্ধটা কেমন মায়াবী। নেশার মতন। ঘুম ঘুম পায়। এই সকালেও কেমন ঘুম পাচ্ছে আমার। আমি নিজের অচেতন অবস্থায় আবার ঢোলে পড়লাম ঘুমে, ওই পাশবালিশ এর সাথে।
চোখ যখন খুললাম তখন দেখি প্রায় সন্ধে। এতক্ষণ ঘুমালাম! আমার পাশে ওই পাশবালিশটা। ওটাতে কিছু একটা আছে, যা আমাকে টানছে। দেখাচ্ছে তার অদ্ভুত খেল। আমি উঠে বসলাম। আকাশে কয়েকটা ঘুড়ি উড়ছে। বালিশটা আমি আবার ওই পাল্লা খোলা আলমারিতে রেখে, পাল্লগুলো ভেজিয়ে দিলাম। সামনে থাকা ডায়েরীটা অজান্তেই থাক থেকে পড়ে গেল। সেটা কুড়িয়ে আমি আবার ঠিক জায়গায় রাখতে গিয়ে কয়েকবার পাতাগুলো নাড়াচাড়া করলাম। না সামনের দিকে কিছুই নেই। বোধহয় একেবারেই ফাঁকা। রেখে দিলাম ঠিক জায়গায়।
রাত হয়েছে। এবার শুয়ে পড়া দরকার। গল্পের বইটা বন্ধ করে এবার নিজের বিছানাটা করে ফেললাম। একবার চোখ পড়ল ওই আলমারীটার দিকে। মনে হল, পাশবালিশটা নিয়ে শুতে। কী জানি কেন, আলমারিটা খুলে পাশবালিশটার নিয়ে এলাম আমি। সেই সুন্দর গন্ধটা আবার আমার নাকে এল। দম বন্ধ করা সেই গন্ধ। কি জানি, কে বা কারা রেখে গেছে এটা। কেমন যেন অদ্ভুতুড়ে। আলো বন্ধ করে পাশবালিশটাকে নিয়ে শুলাম। মনে হল আমার পাশে একটা মানুষ ঘুমিয়ে আছে। সজীব নয়, জড় পদার্থের মানুষ। প্রথম দিকে একটু যেন অস্বস্তি হল, তারপর আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়লাম। নিজের অজান্তেই কখন পাশবালিশটাকে জড়িয়ে শুয়ে পড়েছি নিজেই জানি না।
সকাল দশটার সময় ঘুম ভাঙল আজ। তন্দ্রামোহ চোখে দেখলাম আমার পাশে পাশবালিশটা নেই। তরাক করে উঠে পড়লাম। কী হল, কাল রাতে তো আমি ওটাকে নিয়ে ঘুমিয়ে ছিলাম। উঠে গিয়ে আলমারির দরজাটা খুলতে দেখি যে সেটা আপনার আপনি যেন নিজের জায়গায় চলে গেছে। লাল রংয়ের কভারটা একটু বেশি লাল দেখাচ্ছে। ঝলমলে লাল। তাজা লাল। বন্ধ করে দিলাম আলমারিটা। এই ভৌতিক পরিবেশে দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার। কেমন দুর্বল দুর্বল লাগছে। মাথা টলছে। বোধ হয় কয়েকদিন ভাত না খাওয়ায় কারণে। চোখে মুখে জল দিলাম। নিজের মাথাকে বোঝালাম যে, এসব এখন সাধারণ ব্যাপার। যত তাড়াতাড়ি এখন থেকে বেরোতে হবে। প্রথম দিন ওই লোকটা বোধ হয় ঠিকই বলছিল। আর একটা ঘর ঠিক করে রাখা উচিত। যদিও ভৌতিক ভিত্তি এখনও মানছি না তবুও, কেমন ভয় ভয় করছে। এই ঘরে কোনও আয়না নেই তাই ব্যাগে থাকা পকেট আয়না দিয়ে নিজের মুখ দেখতে হয়, চুল আঁচড়াতে হয়। আয়নার সামনে নিজেকে কেমন একটু পরিবর্তিত লাগল। চোখ ভিজে গেছে, অবশ্য ভালই ঘুমাচ্ছি। চোখ মুখ ফ্যাকাশে। কে জানে কেন! আজ একটু চাল কিনে আনতে হবে। একটা হাঁড়ি এনেছি, ওতে ভাত রান্না হয়ে যাবে। এদিকে টাকাও ফুরিয়ে আসছে। উফফ, পাগল হয়ে যাচ্ছি এবার। তার উপর বিদঘুটে বিদঘুটে ব্যাপার।
ছয় দিন কেটে গেছে। আমার আগের দশা আর এখনকার দশার মধ্যে অনেক পার্থক্য। কেমন শীর্ণকায় হয়ে যাচ্ছি। চোখের তলায় হাঁড়ির কালি জমে গেছে। উঠে দাঁড়াতে পারছি না। এক মায়াবী শক্তি আমায়.. আমায় বোধ করেছে। আমি পারছি না। আমি পারছি না সেই বাঁধন কাটাতে। ওটা.. ওটা একটা বালিশ না, ওটা পিশাচ। না, ভুল বললাম। পিশাচিনী। প্রতি রাতে আমায় আকর্ষণ করে। তারপর কিছু জানি না। মাঝে মাঝে মনে হয় কে রাতে একটা মাংসল পিন্ড আমায় জড়িয়ে আছে। ছাড়াতে পারি না। তখন আমি অচৈতন্য এ ঘুমের দেশে। আমায় ওই পিশাচিনী জোর করে বাধ্য করে ওই বালিশকে জড়িয়ে শুয়ে থাকার জন্যে। আর দিনে দিনে, তার দেহের ওই লাল মখমলের আবরণ আরো লাল হয়ে উঠছে। যেনো মানুষের দেহ লাল হয়ে গেছে। প্রতিবার ওই সুগন্ধ আমায় গ্রাস করে। আমি প্রতি রাতে স্বপ্ন দেখি- অমাবস্যার অন্ধকার।একটা মহিলা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। তার মাথায় ওই লাল মখমল আবৃত পাশবালিশটা। নিজের মনের দুঃখটা সে চেপে রাখতে না পেরে সে ওই কোলবালিশের এর কভারটা খুলে নিজের মুখে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিল, আর তারপর যে দড়ি ওটাতে পড়ানো ছিল, সেটা নিজের গলায় বেঁধে নিল। কিছুক্ষণ ছটফট করল শরীরটা। আর তারপর নিথর হয়ে গেল। তৎক্ষণাৎ একটা প্যাঁচা ডেকে উঠল্ আর আমি.. আমার ঘুম ভেঙে গেল। এই একই জিনিস প্রতিবার দেখি আমি। আমার কি ডাক্তার দেখানো উচিত? তাই ভালো, না হলে আমি পাগল হয়ে যাব। চান খাওয়া এমনিতেই মাথায় উঠেছে, তার উপর আরো এমন চললে আমি নির্ঘাত পাগলা গারদে ভর্তি হব। আস্তে আসতে সব সয়ে যাচ্ছে। যেন লৌকিক – অলৌকিক, দুটো জগতের মাঝে আমি। নিজের অজান্তে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস বার হল আমার মুখ দিয়ে।
-“ডাক্তার বাবু, আমায় বাঁচান। আমি পাগল হয়ে যাবো এবার।”
– “আরে, আরে কি করছেন এটা! উঠুন, উঠুন। আপনার সমস্যা বলুন।”
আমি সব বললাম। উনি আমায় দেখে বললেন। আপনি বরং মনোবিজ্ঞানী দেখান। আপনার সেটাই প্রয়োজন। আমি মেডিসিনের ডাক্তার হয়ে এটুকু বলতে পারি যে, আপনার দেহে রক্তাল্পতা দেখা দিয়েছে। বেশি করে ঘুমান, ফল খান। আর একবার Psychriatrist দেখান।”
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে একটা রিক্সা করে বাড়ি পৌঁছলাম। মনোবিজ্ঞানী দেখানোর জন্য অত টাকা এখনই খরচ করা ঠিক হবে না। এই তো এখন দিব্যি মনে হচ্ছে নিজেকে। কিন্তু রক্তাল্পতা কেন?
আমি এখন জানি ওই ভয়ানক পাশবালিশ কী চায়। হাওয়া মাঝে মধ্যে আমার কানে কানে বলে যায় যে, আমার দিন ঘনিয়ে এসছে। এক অমূলক মায়ায় জড়িয়ে পড়েছি আমি। খাওয়া দাওয়া অনেকদিন করি না। তাতে আমার কিছু আসে যায় না। ওই মধুর গন্ধ আমার প্রাণ ভরিয়ে দেয়। ওই নরম স্পর্শ আমায় বলে যে, তুমি এবার আমার মতন করে আমার কাছে আসবে। সারাদিন বসে থাকি। কাজ খোঁজার কাজটাও বন্ধ করে দিয়েছি। এখন শুধুই এক তপস্যা চালাচ্ছি। মাঝে মধ্যে রাতে আমি স্পষ্ট বুঝতে পারি যে, ওই বালিশ থেকে কয়েকটা অদৃশ্য মাংসল হাত ও আমায় কোন শক্তিতে জড়িয়ে ধরতে চাইছে। কেন, তার উত্তর আমার কাছে আপাতত নেই। প্রতিদিন ওই হাতের মাধ্যমে আমার দেহের রক্ত চুষে নিচ্ছে ওই পিশাচিনী। আর নিজের উজ্বলতা বৃদ্ধি করছে।
আজ অমাবস্যা। রাত হয়েছে। এবার শুয়ে পড়ব। আলো বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম। চারিদিক নীরব, ঘুটঘুটে অন্ধকার। রাত কটা হবে তখন? ২টো হবে। হঠাৎ একটা লিকলিকে স্পর্শ অনুভব করলাম। সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। আমি চুপচাপ শুয়ে থাকলাম। এবার একসাথে তিনটে স্পর্শ অনুভব করলাম। মনে হল আমার গলার কাছে কিছু একটা আসছে। আমি নড়তে পারছি না। কিছু একটা আমার মুখ বেয়ে নিচে নামছে। তারপর একটা দড়ির মতন জিনিস দিয়ে আমার গলার কাছে বাঁধল। সেই সুগন্ধ আবার এল। দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তবু নড়ছি না। সব শেষে কানের কাছে একটাই মেয়েলি কণ্ঠ শুনলাম – “এবার তুমি আমার দেশে আসবে।” তারপর সব শেষ।
সকালে পুলিশ আসে । কীভাবে আসে তা জানি না, কারণ সকালে দুর্গন্ধ তখনও ছড়ায়নি। বোধ হয় এর আগের খুনগুলোর নির্ঘণ্ট অনুযায়ী এবারও ক্লাবের সবাই তৈরি ছিল। প্রথমে টোকা, তারপর ধাক্কা, আর তারপর দরজা ভেঙে ফেলে তারা। তারপর যে দৃশ্য দেখে তারা তাতে বিশেষ চমকায় না। এর আগেও ঠিক একই ভাবে ঘটেছে ঠিক একই ঘটনা। একটা ২৫ থেকে ৩০ বছরের ছোকরা চৌকির উপর পাশবালিশ এর কভার গলায় জড়িয়ে মারা যায়। পুলিশ এসে প্রতিবারের মতন এবারও অ্যাকসিডেন্ট কেস বলে চালান করে দেয়। পুলিশ জানে এই কেস নিয়ে ভাবলে বৃথা সময় নষ্ট। দেহে রক্তের পরিমাণ কম । মুখে কোনও আতঙ্কের ছাপ নেই। এরপর থেকে এই ব্যাপারটা আর চাপা থাকে না। সারা শহর জেনে যায়। অনেকে বিশ্বাস করে, অনেকে করে না। কিন্তু ওই ঘরে কেউ আর থাকে না।
মানুষের এই এক দোষ আছে। সমস্যা পেলে তা সমাধান না করে এড়িয়ে চলে। কিন্তু তার সমাধান জানা প্রয়োজন। সবাই ভাববে এটা একটা ভূতের গল্প। তার আড়ালে অনেক রহস্য আছে। যে কথা লেখা ওই লাল ডায়রিতে। শুরুতে নয়, শেষে। একটা মেয়ে কীভাবে একা হয়ে পড়ে ও নিজের জীবন বিসর্জন দেয়, সেই ঘটনা। কীভাবে সে একজন কে বিশ্বাস করেও লাঞ্ছিত হয়, সেই ঘটনা। পাপের শাস্তি তো পেতেই হবে। সে এটুকু এই পৃথিবী থেকে শিখে যায় যে আর কাউকে হোক, সব মানুষকে বিশ্বাস করতে নেই। যার জন্যে সে নিজের প্রাণ হারিয়েছে আর তার শাস্তি সকলকে দিচ্ছে। এর আগেও অনেকে ঠিক একই ভাবে, আমার মতন মরেছে। কারণ সে কাউকে বিশ্বাস করে না। সে সকলকে নিজের রাজ্যে নিজের দেশে নিয়ে যায়। যার প্রবেশ পথ ওই পাশবালিশ।
মৃতদেহ দেখার পর প্রথমদিনের সেই ভদ্রলোক তার ছেঁড়া স্যান্ডো গেঞ্জি ও তার সেই দন্ত বিকশিত করে বললেন – “আমি আগেই বলেছিলাম। এ ঘরে ১ মাসের বেশি থাকতে পারবেন, আর যদি থাকতেও পারেন তবে সেটা এ জগতে না।”
The End