কলেজে গ্রীষ্মের ছুটি পড়ায় পরিমল ঠিক করল তাদের গ্রামের দেশ ঘরে গিয়ে কয়েকদিন ঘুরে আসবে। এই কথা শুনতে পেয়ে স্কুলের বন্ধু রবিন ও সাবির জেদ ধরে বসত। তাদের একটাই কথা ,পরিমল আমাদের ও তোদের দেশ বাড়িতে নিয়ে চল।
“না রে না সেরকম কিছু নেই,চারিদিকে সবুজ, ছোট্টো গ্রাম, গ্রামের পাশে কুটলেশ্বরী নদী বয়ে গেছে আর কিছু নেই।”
রবিন থামিয়ে বলল, “দেখ পরিমল নিয়ে যাবি না বললেই হয়, কী আছে না আছে তার বর্ণনা আমরা শুনতে চাই না।”
“আচ্ছা ঠিক আছে তোরা যদি যেতে চাস চল, আমি না করব না। তবে গ্রাম কিন্তু শহরের মত নয়।”
“তোকে আর বেশি কথা বলতে হবে না, আমরা গেলেই দেখে নেব,” সাবির কথাটি বলে হাসতে শুরু করল।
পরের দিন যাবে বলে ওরা দিন স্থির করে বাড়ির দিকে যাবে, এমন সময় পরিমল বলল, “ তাহলে তোরা কাল সকাল সাতটায় কুন্টিয়া বাস স্টপে এসে দাঁড়াবি। আমি সব ব্যবস্থা করে চলে আসব।”
কথামত পরেরদিন যথাসময়ে রবিন সাবির পৌঁছে গেল ঘড়ির কাঁটা তখন সকাল 7:30। দেখা গেল পরিমল একটা ব্যাগ বোঝাই করে হাঁপাতে হাঁপাতে পৌঁছলো।
“আরে পরিমল এই ব্যাগের ভেতর কি রয়েছে?,” সাবির কথাটি বলার শেষ করার পূর্বে পরিমল থামিয়ে বলল, “আরে কিছু না, দূরে যাচ্ছি কখন কী লাগবে বলা যায় না। তাই যা যা দরকার তা নিয়েছি। তোরা তো কিছু আনবি না তারপর তো বলবি, তোর গ্রামে এসেছি তুই এটা আনলি না কেন ওটা আনলি না কেন।”
রবিন বলে উঠল, “আরে চল কতটা রাস্তা জানি না আবার যেতে গিয়ে দেরি হয়ে যাবে তখন।”
ওরা সকলে বাসে উঠে পড়ল। বাসে যেতে ঘন্টা চারেকের পথ ঝিন্টুয়া পুটুলির বাস স্টপ। ওখান থেকে গ্রামের মেঠোপথে আবার রিকশা করে মিনিট চল্লিশ এর মত গেলে পরিমলের দেশ ঘর।
“হ্যাঁরে পরিমল তোদের দেশ ঘরে এখন কারা আছে?” বাসে যেতে যেতে সাবির প্রশ্ন করল।
“বাবা চাকরিসূত্রে এখানে আসার পর দাদু ঠাকুমা,জেঠু,জেঠিমা ও জেঠদাদা থাকত।”
মুখ বিকৃত করে রবিন বলল, “থাকত মানে! এখন কি নেই?”
“এখন দাদু,ঠাকুমা নেই। আর সবাই আছে
আমি দুই বছর আগে একবার একদিনের জন্য গিয়েছিলাম আর যাওয়া হয়নি। তবে কোনও চিন্তা নেই জেঠদাদা আছে। ও সব জায়গায় ঘুরিয়ে দেখিয়ে দেবে। তবে,”
ওকে থামিয়ে দিল সাবির বলল, “আগে তো পৌঁছই।”
ওরা কথা বলতে বলতে ঝিন্টুয়া পুটলির বাস স্টপে এসে পৌঁছে গেল। তখন প্রায় সূর্য মাথার উপর উজ্জ্বল আলো দিয়ে হালকা কাত হয়ে পশ্চিম দিকে মুখ ঘুরিয়েছে। তারপর ব্যাগ নামিয়ে রিক্সা চড়ে গ্রামের দিকে রওনা হল।
পর্ব,২
তখন প্রায় দেড়টা ওরা জেঠুর বাড়ি পৌঁছল। সারা দিনের ক্লান্তি কাটাতে স্নান সেরে খেয়ে একটা বড়ো ঘুম। যখন ঘুম ভাঙল তখন সন্ধ্যার সূর্যকে ডুব দিতে এখনও ঘন্টা দুয়েক অপেক্ষা করতে হবে।
রবিন বলল, ‘চল পরিমল,একটু ঘুরে আসি’
‘আরে কোথায় যাবি, কিছুক্ষণ পর তো সন্ধ্যা হয়ে যাবে’
“হোক না,তবু এই আশেপাশের পরিবেশটা ঘুরে দেখে আসি,” রবিন কথাটি বলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে লাগল। তাকে দেখে সকলে প্রস্তুত হচ্ছিল।
এরপর বেরোতে যাবে জেঠিমা বলল,“এখন কোথায় যাবি?”
“জেঠিমা এরা একটু ঘুরতে যাবে বলছে তাই।”
“না এখনই সন্ধ্যা হয়ে যাবে,গ্রামের রাস্তা তোরা জানিস না। তোর দাদা এখন বাড়িতে নেই।”
“জেঠিমা দাদাকে তো দেখতে পাচ্ছি না,দাদা কোথায় গেছে?”
“তোর দাদা কী আর ছোট আছে, সে এখন শহরে থাকে। মাসে দুই মাসে একবার করে আসে। তবে বেশিদূর যাস না। ওই নদীর দিকে একবারে যাবি না। সন্ধ্যার আগে ফিরে আসিস।”
“আমরা বেশিদূর যাব না জেঠিমা। সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসব,”এই বলে ঘরে ঢুকে টর্চটা নিয়ে এল, যদি ফেরার পথে অন্ধকার পথ দেখা না যায়।
সাবির বলল “চল পরিমল ওই নদীর দিকটা থেকে ঘুরে আসি”
“না জেঠিমা যেতে বারণ করেছে।”
“তুই কী ভয় পাচ্ছিস? গ্রামে এসেছি,নদীর তীরে না গেলে হয়।”
“জায়গাটা ভালো নয় আমি শুনেছি।”
“আরে চল। আমাদের আবার ভয়,” কথাটি বলে সাবির রবিন একসঙ্গে হেসে উঠল।
ওরা তিনজনে প্রায় দেড় মাইল বনের ভেতর, চড়াই উৎরাই মেঠো পথ পেরিয়ে নদীর তীরে এসে দাঁড়াল। নদী বয়ে চলেছে শান্ত কুলকুল স্বরে। নদীর প্রান্তর শুধুই ফাঁকা। জনবসতির কোন চিহ্ন নেই। চারিপাশে পরিবেশটা দারুণ। বহুদিন পর এমন নদীর কুল কুল স্বর, মাঝে মাঝে দু একটা নৌকো,মন কেড়ে নিয়ে যায়। ওরা নদীর পাড়ে কিছু সময় বসে সমস্ত রূপ নিঙড়ে নিচ্ছিল।
কিছুক্ষণ পর হঠাৎ চারিদিকে কালবৈশাখীর কালো মেঘ ঢেকে গেল,চারদিক থেকে ঝোড়ো হাওয়া বইতে শুরু করল। সাথে সাথে প্রচুর বৃষ্টি। তিনজনে তখন অনেকদূর এসে গেছে। কোথায় আশ্রয় নেবে বুঝে উঠতে পারছে না। কিছুটা দূরে একটা পোড়াবাড়ি লক্ষ করল। তারা দৌড় দিল বাড়িটির দিকে। কোনও রকম একটা আশ্রয় প্রয়োজন।
পোড়া বাড়ির ছাদ থেকে বুঝি ছাদ সমেত বৃষ্টি যেন মাথায় ভেঙে পড়ে। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলকানি পুরাতন জীর্ন বাড়িটিকে আরও অদ্ভুত করে তুলছিল।
এদিকটাতে পরিমল কোনদিন আসেনি। গ্রামের সমস্ত দিক ঘুরে দেখলেও, এদিকে সে কোনও দিন আসেনি। বন্য পথ ধরে নদীর তীরে সাধারণত কেউ মারা গেলে সৎকারের জন্য নদীর তীরটাকে বেশিরভাগ ব্যবহার করা হয়।
পরিমল ভাবছিল “এই পোড়া বাড়িটা কোথায় ছিল। কোনও দিন তো আমি আগে কখনো এই বাড়ির ব্যাপারে শুনিনি।”
রাত হতে চলল, তবুও বৃষ্টি থামার লেশমাত্র নেই। এরূপ ভয়ঙ্কর পরিবেশ দৃশ্য রবিনও সাবির দুজনেই উপভোগ করলেও কিন্তু পরিমল গ্রামের ছেলে হওয়ায় গ্রামীণ পরিবেশ ও অচেনা ফাঁকা নদী তীর ভালো ঠেকছিল না। সবকিছু তার কাছে এলমেলো লাগছিল। রাত হতে চলেছে। বাড়ি তাদের ফিরতে হবে। হঠাৎ তার চোখ পড়ল বাড়ির চারদিকের ফাটল ধরা দেওয়ালে গাছের শিকড় আরও ফাটিয়ে দিয়েছে। দেওয়ালের চারিদিকের ওই ফাটল কিছুক্ষণ পর তা কোথায় যেন মিলিয়ে গেল।
পর্ব,৩
ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টির অনুভূতি সাবির ও রবিনের চোখ তন্দ্রাচ্ছন্ন করে তুলেছে। যদিও তারা বিকেলে আসার পূর্বে ঘুমিয়ে ছিল। পরিমলের হঠাৎ লক্ষ্য পরলো যেখানে নদীর তীরে তারা বসে ছিল, এক মহিলা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। এত ঝড় বৃষ্টির মধ্যে ভিজে চলেছে।
পরিমল সাবিরকে ডাক দিল,“এই সাবির,দেখ কেউ দাঁড়িয়ে আছে না। যেখানে আমরা বসে ছিলাম,দেখ ওইখানে।”
পরিমলের ডাকে সাবির চোখ ভালো করে মোছে তাকিয়ে বলল,“কই রে? কোনখানে?”
“আরে ওই তো দাঁড়িয়ে আছে।”
“তুই কি ভেবেছিস ভয় দেখাবি? আমি হলাম শহরের ছেলে, এসব বলে লাভ নেই।”
“নারে ভয় দেখাচ্ছি না,আমরা বরং চলে যাই।”
“মানে! বাইরের দিকে দেখেছিস,এত ঝড় বৃষ্টি। যে বাজ পড়ছে,তা না আমাদের মাথায় পড়ে,” বলেই রবিনকে ডাকল।
এই রবিন,এই ছেলেটা যেখানে যায় শুধু ঘুমায়, ঘুম এর পিছন ছাড়ল না।”
বলেই সে বলল ,“হ্যাঁরে পরিমল, এখানে যে পোড়া বাড়ি আছে, তুই তো আগে বলিসনি।”
“না রে, আমিও জানতাম না।”
সাবির বলল,“তবে ভাল হয়েছে এখন তো আশ্রয় পাওয়া গেল।”
এমন সময় বাড়ির ভেতর থেকে নপুরের ঝনঝন শব্দ হতে লাগল। মনে হল কেউ একজন আসছে।
সাবির বলল,“বোধহয় কেউ এখানে বাস করে, ভেতরে কেউ বা কারা আছে। চল ভেতরে যাই।”
“না রে ভেতরে যাব না। এখানেই ভালো,বৃষ্টি থামলে আমরা চলে যাব।”
“তোর শুধু ভয়।”
দরজাটা খুলে গেল, পঁচিশ ছাব্বিশ বছর বয়সি মহিলা দরজা খুলল। মহিলাটি তিনজনকে বলল,“ আপনারা ভেতরে চলে আসুন।”
সাবির রবিনকে ডাক দিল ,“রবিন ওঠ।”
রবিন উঠে পড়লো। তারপর তিনজনে ঘরের ভিতরে ঢুকল।
বাইরে থেকে যেভাবে বাড়িটা দেখাচ্ছিল ভেতর সম্পূর্ণ অন্যরকম। পরিষ্কার,পরিচ্ছন্ন দেয়ালে সাজানো হয়ে আছে কারুকার্য। তিনজন একটা ঘরে বসে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল, কিন্তু মহিলাটিকে আর ফিরে আসতে দেখা গেল না। তিনজনে গল্প করতে থাকলেও পরিমলের বাড়িটা ভালো ঠেকছিল না। তাই সে সাবির ও রবিনক বলল, “দেখ আমাদের এখানে বেশি সময় থাকা ঠিক হবে না। চলে যাই চল।”
“আরে দাঁড়া, নদীর থেকে কিছুটা দূরে, ঝড় বৃষ্টির রাতে,অন্ধকারে বন্য পথে কিভাবে যাব?” বলে রবিন সাবিরের দিকে তাকাল আর বলল,“সাব্বির কি বলিস?”
“হ্যাঁ ঠিক বলেছিস। বৃষ্টিটা একটু থামুক, তারপর না হয় যাওয়া হবে”, কথাটা বলেই সাবিরের হঠাৎ পরিমলের হাতে বাঁধা বস্তুটির দিকে চোখ পড়ল। বলল, “ওটা কী বাঁধা রে তোর হাতে?”
“জানি না তবে, আমি জানি এটা দুই বছর ধরে আমার হাতে বাঁধা আছে।”
এমন সময় একটা ক্ষীন কণ্ঠ দরজার পাশে এসে ডাক দিল, “বৃষ্টি থামবে না আপনারা আজ এখানেই থেকে যান।”
পরিমল বলল, “না না আমরা চলে যাব,তবে বৃষ্টি থেমে গেলেই।”
বৃষ্টি থামার লক্ষণ নেই, বিদ্যুতের ঝলকানিতে পোড়া বাড়ির ভেতর পর্যন্ত আলো যেন ঠিকরে প্রবেশ করছে। হঠাৎ চোখ পড়ল তিনজনের নদীর দিকে, মূর্তির মত চেহারা যুক্ত অনেক পুরুষ মহিলা দাঁড়িয়ে। চেহারাগুলো কী ভয়ঙ্কর।
পর্ব,৪
পরিমলের কাছে সবকিছু এলোমেলো লাগছে। ও বলল, “ভাল লাগছে না চলে যাই চল। সে মহিলাটিকেও অনেক সময় হল দেখিনি।”
রবিন বলল, “কিন্তু বৃষ্টি?”
“সে বৃষ্টি হোক। চলে যাই চল। আমাদের এখানে থাকা ঠিক নয়।”
“বাইরের ওই ভয়ঙ্কর রূপ!”
“তা থাক যা হয় হোক। এখান থেকে আগে বেরোই।”
“চলে যাবি বলছিস,তাই ভালো। চলে যাই চল।”
সাবিরও বলে উঠল।।আমারও ভালো ঠেকছে না”
ওরা চলে যাবে, এমন সময় চারিদিকে অন্ধকার হয়ে গেল,ঘরের ভিতরে যে আলো জ্বলছিল সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে। পরিমলের কাছে রাখা টর্চের আলোটা জ্বেলে চারিদিকে একবার ভালো করে দেখে নিল। মনে হল বাড়িটি কোনও জমিদার বাড়ি। যা তারা এতক্ষন খেয়াল করেনি। হঠাৎ সে একটা ফটো দেখে শঙ্কিত হয়ে রবিন ও সাবিরকে ডেকে, ছবিটির উপর আলো ফেলে ধরল। ছবিটি আর কেউ নয়, এতক্ষন যে মহিলাটি ঘরে আশ্রয় দিয়েছে এটা তার ফটো। কিন্তু মহিলাটির ছবির নীচে লেখা আছে, জন্ম, ১৬৮০। ওদের হাত পা অসাড় এল।
এমন সময় উপরের একটা ঘর থেকে একটা কান্নার আওয়াজ থেকে থেকে আসতে শুরু করল। এত বৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়াতে ও ওদের শরীর ভিজে যেতে থাকল ঘামে। ওরা চলে যাবে বলে ধীরে ধীরে দরজার দিকে এগোতে থাকে। সেই সময় খোলা দরজাটা জোরে শব্দ হয়ে বন্ধ হয়ে গেল। ওরা অনেক চেষ্টা করেও দরজা খুলতে পারল না। কান্নার আওয়াজ আরও বাড়তে থাকল,ওরা অনেক চেষ্টা করেও দরজা খুলতে পারল না। বেরোনোর পথ খুঁজছিল। সব বন্ধ।
টর্চটাও তার কাজ বন্ধ করে ফেলেছে। থেকে থেকে জ্বলছে আর নিভছে। হঠাৎ একটা সুড়ঙ্গের পথ টর্চের আলোয় ভেসে উঠল। কোন কিছু না ভেবে তিনজনে সুরঙ্গ ধরে এগোতে থাকল। তবুও কান্নার আওয়াজ থামে না,যেন মনে হচ্ছিল কান্নার শব্দ দ্বিগুণ হয়ে উঠেছে। চারিদিকে দেওয়ালে তার প্রতিধ্বনি’ পাগল করে তুলছে। এমন সময় কান্না থেমে গেল। ছুটতে ছুটতে একটা ঘরের ভিতর এসে ওরা পড়ল, বুঝতেই পারেনি। ওরা ভেবেছিল সুরঙ্গ ধরে গেলে আলোর দিশার সন্ধান পাওয়া যাবে। কিন্তু না আরও ভয়ঙ্কর জায়গা। একটা পচা গন্ধের স্তুপ।
পরিমল টর্চের আলোটা ভালো করে জ্বাললে,আলোয় ভেসে উঠল কতগুলি কঙ্কালের দেহ। একটা দেহ দেখে রবিন আঁতকে উঠে। সে চিনতে পেরেছিল দেহটাকে। কিছুদিন আগে ওই লোকটির কাগজে বেরিয়েছে নিরুদ্দেশের খবর। তাহলে নিরুদ্দেশ হয়নি লোকটি। লোকটির পোশাক দেখে মনে হল শহরের কোনও ভদ্র পরিবারের। দেহটা একেবারে সাদা। কেউ তার সমস্ত রক্ত শুষে নিয়েছে।
পচা গন্ধ ছড়ানো তার দেহের পকেট থেকে একটা কার্ড পাওয়া গেল। নাম, সৌরিক ভট্টাচার্য্য, ভূত গবেষক। পাশে পড়ে থাকা একটা ব্যাগ খুলে দেখল ওরা। অনেক জিনিস, যা তারা আগে কখনো দেখেনি। ব্যাগের মধ্যে একটি ডায়রিও পাওয়া গেল। টর্চের আলোটা জ্বেলে ডাইরিটি ওরা পড়তে শুরু করল।
পর্ব, ৫
অনেকদিন হল রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠেনি। আমি ঠিক করেছি যাব ঝিন্টুয়া পুটলির বাস স্টপ থেকে কিছুটা দূরে গেলে,দেড় মাইলের মত ঘন বন। ওই বন এর পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে কুটিলেশ্বরী নদী। তবে আমি কয়েকদিন আগে ওই গ্রামে গিয়েছিলাম। ওখানকার কিছু মানুষের মুখে ভৌতিক লোক-কথা শুনে আমারও যাওয়ার প্রবণতা বেড়ে উঠেছে।
কিছু মানুষের মুখে শুনেছি ওখানে নাকি এখনও ভূত আছে। তবে অনেকেই এটা জানে না। কেউ কেউ বলল তারা হঠাৎ ওই জায়গায় একটা বাড়ি দেখতে পায়,সেখান থেকে শোনা যায় কান্নার আওয়াজ। তবে গ্রামের দুই একজনের কাছে শুনতে পেলাম,ওখানে এখনও রাতের কিংবা অমাবস্যার রাতে গেলে ভূতেদের দেখা যায়। রাতে ওখানে যাওয়ার সেরূপ গ্রামবাসীরা সাহস করেনি। সন্ধ্যা হলেই এ পথে তারা মাড়ায় না। কেউ মারা গেলে সকাল না হওয়া পর্যন্ত দেহ বাড়িতেই রাখা হয়। সকাল হলে নদীতীরে নিয়ে এসে তাকে পোড়ানো হয়।
গ্রামবাসীর কাছে শুনতে পেলাম কয়েক বছর পূর্বে,এক শহুরে যুবক বিশ্বাস না করে, ভূত কি তা জানার জন্য রাতের বেলা এই নদীতীরে এসেছিল। তার সঙ্গে ঠিক কী ঘটেছিল সেই রাতে, কেউ জানে না। সকালে তার মৃতদেহ নদীতীরে পড়ে থাকতে পাওয়া যায়। দেহের কোন অংশে ক্ষতি হয়,কেবল গলার কাছে থেকে কেউ যেন তার সমস্ত রক্ত শুষে সাদা দেহ ফেলে রেখে গেছে।
আমি ভূত গবেষণা করি, এটা কিছুটা হলেও বিশ্বাস করি। এই ঘটনার পেছনের আসল রহস্য খুঁজতে গিয়ে, গ্রামের সবচেয়ে বয়স্ক মানুষদের সঙ্গে দেখা করলাম, যারা আমায় এ ব্যাপারে বলতে পারেন। তাদের কাছ থেকে শোনা কথাগুলি থেকে বুঝতে পারি যে,কোনও এক কালে জমিদার রুদ্রদামন এর জমিদারি নদীর তীরে ছিল। তিনি নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করতেন। তার একমাত্র কন্যা নিস্তারিণী। নাচে, গানে ছিল অতুলনীয় প্রতিভা। জন্মের সময় মা মারা গেলে, জমিদার রুদ্রদামন আর বিবাহ করেনি।নিস্তারিণী ছিল তার আদরের সবকিছু। জমিদারের প্রজারা এই দেড় মাইলের জঙ্গলে বাস করত। তখন কোনও জঙ্গল ছিল না। জমিদার রুদ্রদামনের শাসনে প্রজারা সুখেই ছিল। নিস্তারিণীর বয়স যখন পঁচিশ বছর তখন জমিদার রুদ্রদামন মারা যায়।
নিস্তারিণী ২৫ বছর বয়সে জমিদারি দেখাশোনা করত। সেই সময় কয়েকজন বন্ধুদের নিয়ে কিছু যুবক গ্রামীণ পরিবেশে বেড়াতে আসে। তাদের মধ্যে একজন ছিল প্রনয়। যার সঙ্গে প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ে নিস্তারিণী। তার সৌন্দর্যের কাছে পরাজিত হয় প্রনয়। এরপর বাকি বন্ধুরা শহরে ফিরে গেলেও ওই যুবক আর ফিরে যায়নি। বেশ ভালই কাটছিল দিনগুলো। হঠাৎ একদিন ওই যুবক লক্ষ্য করে ঘরের ভেতরের সুড়ঙ্গ চলে গিয়েছে অনেক দূর পর্যন্ত। শেষ প্রান্তে কুঠুরি। সেদিন নিস্তারিণী বাড়িতে ছিল না গোপন কুঠুরি দেখবার জন্য এগিয়ে গেল সুরঙ্গ ধরে। যখন শেষ প্রান্তে পৌঁছাল তার সব বন্ধুদের মৃতদেহ পড়ে আছে। যাদের দেহ রক্তশূন্য। ঘাবড়ে গেল সে। ভয়ে তার শরীর একেবারে হিম হয়ে গেল। শেষে চুপচাপ ফিরে এল। এই রহস্য বোঝার জন্য যেমন সে এতদিন ছিল তেমনই থাকার চেষ্টা করতে থাকল। খোঁজ করতে থাকল এর প্রকৃত রহস্য। জানতে পারল নিস্তারিণীর বয়স যখন দশ বছর, তখন থেকে রক্ত খাওয়ার প্রবণতা। জমিদার না করেনি তার এই আদরের মেয়ের নেশাকে। তবে গ্রামের কোন মানুষের রক্ত খেলে জানাজানি হয়ে যাবে বলে,জমিদার কিছু পুরুষ মহিলা নিয়োগ রেখেছিল, তারা জমিদারের এলাকা ছেড়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে ছোট বড় বিশেষ করে ছোট ও যুবকদের লোভ দেখিয়ে ধরে এনে এখানে বন্দি করত। তাদের রক্ত পান করতে করতে অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল নিস্তারিণীর।
এর শেষ করতে হবে। কত না যুবকের প্রাণ গিয়েছে নিস্তারিণী রক্ত খাওয়ার প্রবণতা থেকে। আজ এত হত্যা। তাই সে এই কাজে যুক্ত থাকা কর্মীদের একে একে নিশ্চিত করল। বন্ধু বিয়োগ যন্ত্রণা ওই যুবকের মধ্যে তখন দাউদাউ করে জ্বলছে। নিস্তারিণীর অজান্তে, সমস্ত মানুষ যখন গভীর ঘুমে, প্রণয় এক এক করে সেইসব পুরুষ মহিলাকে হত্যা করে নদীর তীরে কবর দিতে শুরু করে।
একদিন যখন এক যুবক জমিদার বাড়িতে এল,প্রনয় বুঝতে পারে এর জীবনের বিপদ আসতে চলেছে। যুবকটি আসার পর থেকে কোন না কোন ভাবে নিস্তারিণীকে তার পাশে দেখতে পাওয়া গেল। সেদিন আর প্রণয় রাতে ঘুমালো না। রাত তখন বারোটা। প্রনয় এর শেষ বিহিত করবে বলে এগিয়ে গেল কুঠুরির দিকে। যখন পৌঁছাল,সব শেষ। তখন যুবকের দেহ পড়ে আছে, পাশে বসে নিস্তারিণী। রক্ত পান করছে, তাজা রক্ত সঙ্গে আছে আরও দুইজন পুরুষ যারা যুবকটিকে হত্যা করতে নিস্তারিণী কে সাহায্য করেছে।
প্রনয় আর নিজেকে স্থির রাখতে পারলো না। চিৎকার করে উঠল। ক্ষোভে যন্ত্রণায় এর শেষ বিহিত করার জন্য সঙ্গে নিয়ে আসা কেরোসিন সকলের গায়ে ছড়িয়ে দেয়। বাঁচার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে সকলে। ভেতরে ঢোকার পূর্বে দরজা বন্ধ করে ঢুকে ছিল সে। তাই চেষ্টা করেও তারা বেরোতে পারল না। শেষে তারা প্রনয়কে হত্যা করতে এগিয়ে আসে। তৎক্ষণাৎ হাতে থাকা মশাল দিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। সেদিন প্রনয় কুঠুরির ভিতরে জ্বলন্ত আগুনের হাত থেকে বাঁচতে পায়নি। সেদিন নিস্তারিণী আঁকড়ে ধরা হাত থেকে নিজেকে ছাড়াতে পারেনি। হয়তো বা ছাড়তে চায়নি। সে ও যে নিস্তারিণীকে ভালবেসে ছিল। তাই বোধহয় নিস্তারিণী সঙ্গে পুড়ে যেতে চেয়েছিল। নিস্তারিণী মারা গেলেও তার রক্তপিপাসু আত্মা এখনও ঘুরে বেড়ায়। সেদিন থেকে শহরে যুবকদের কেউ এলে বেঁচে প্রায় অসম্ভব। আজও নিস্তারিণী পুড়ে যাওয়া কান্নার আওয়াজ অনেকেই শুনতে পায়।
তবে আজ আমি যাবো। এই ঘটনা কতটা সত্য যাচাই করে,আমার গবেষণা পথ আরও সুগম করে এগিয়ে নিয়ে যাব।
আর কোন লেখা নেই। ওদের বুঝতে অসুবিধা হল না এরপরের ঘটনা ঠিক ওই লোকটির সঙ্গে কী ঘটেছিল।
ক্রমশ,,!,,
পর্ব,৬
বিকট কান্নার আওয়াজ এর সাথে একটা খটখটে হাসির শব্দ সারা ঘর জুড়ে কম্পিত হচ্ছিল। ওরা বুঝে নিয়েছি ওদের আজ বেঁচে ফেরা অসম্ভব। ব্যাগে কোনও বস্তু পাওয়া যায় কিনা সেটা ভালো করে দেখতে থাকল সাবির। কিছুই বোঝা যাচ্ছে না,এত বস্তুর কোনটা কেমন ভাবে কাজ করে। তবে একটা গীতা ও কোরান রয়েছে।
ওরা বুঝে উঠবার আগে,একটা ছায়ামূর্তির বিচরণে ওরা একেবারে ভয়ে সিঁটিয়ে গেল। বাড়ির চারিধারে অট্টহাসির রোল পড়েছে। পরিমল বলল“ আমাদের উচিত হয়নি এখানে আসা। তবে কে যে বেঁচে ফিরব তা জানি না”
“এরকম বলিস না। দেখা যাক কি হয়। আমরা যতটা পারি এর মোকাবিলা করব,” সাবির কথাটি বলে ব্যাগ থেকে বের করল ছোট দুটি কোরান ও গীতা। কথা বলতে বলতে কিন্তু এতক্ষণে দুইজন ব্যাগ নিয়ে ব্যস্ত। রবিনের প্রতি খেয়াল করেনি। রবিনের কোনও সাড়া নেই। ওরা ঘুরে তাকাল। পরিমল ডাক দিল, “রবিন! রবিন!”
অন্ধকার ঘরে রবিনের কোনও সাড়া নেই। পরিমল টর্চের আলো ঘুরিয়ে রবিনের দিকে ফেলল। কিন্তু রবিন নেই। যেখান থেকে ওরা ছুটে এসেছিল, সেখান থেকে কান্না ও হাসির বিকট শব্দ শোনা গেল।
ওদের বুঝতে বাকি নেই,ওদের বন্ধু বিপদে রয়েছে। ওরা দুইজন ছুটল সেই ঘরের দিকে। ঘরে গিয়ে দেখে রবিনের সাদা দেহ পরে আছে সেই বসবার ঘরে। ওরা রবিনের দেহে প্রাণ আছে কিনা দেখবার জন্য যখন এগোল দেহটার দিকে,তখনি দেহটাকে অদৃশ্য শক্তি টানতে শুরু করল সেই সুরঙ্গের পথে। ওরাও ছুটল তার পিছু পিছু। সেই কুঠুরি,মৃত দেহের স্তুপের মধ্যে নিয়ে গিয়ে ফেলেছে রবিনের দেহ।
পরিমলকে কেউ যেন টানার চেষ্টা করলো, কিন্তু পারল না। সেই ভয়ঙ্কর শক্তি বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। পরিমলের বুঝতে বাকি থাকল না কেন এই অদৃশ্য শক্তি তাকে এখনও টেনে নিয়ে যেতে পারেনি।
সেই ভয়ঙ্কর শক্তি সব বুঝতে পেরে এবার সাবির টানতে যাবে সঙ্গে সঙ্গে পরিমল সাবিরের হাত ধরে ফেলে। পরিমলের মন্ত্রপুত তাবিজ এর শক্তি অন্যদিকে অদৃশ্য শক্তি, মাঝে রয়েছে সাবির। পরিমল কতক্ষণ ধরে রাখতে পারবে বুঝতে পারছেনা। অদৃশ্য শক্তির টান আরও বাড়তে থাকল। সঙ্গে সঙ্গে তার মধ্যে এক বুদ্ধি খেলে গেল।
গীতার ছোট বইটা তুলে পড়তে শুরু করল। সেই ভয়ঙ্কর টান ধীর হতে শুরু করলো। দুজনের মাঝে পড়ে থাকা সাবির তখন অচৈতন্য। পরিমল তার হাত আর ছাড়েনি। সে পড়ে চলেছে গীতার বাণী। সে যখন বুঝতে পারল অদৃশ্য শক্তি কিছুটা পরাজিত হতে পেরেছে। অচৈতন সাবিরকে ডাক দিল, “সাবির সাবির।”
থেকে থেকে কান্নার শব্দের সাথে বিকট হাসির শব্দ ঘরময় প্রতিধ্বনি হচ্ছিল। আর সাবিরের হাত একবারের জন্য ছাড়েনি। দুজনে একসঙ্গে গীতা ও কোরান পড়া চালিয়ে গেল।
ওদিকে অদৃশ্যশক্তি বারবার চাইছিল ওদের পড়ার পথে ব্যাঘাত ঘটাতে। এরই মধ্যে পরিমলের হাত কখন যে সাবিরের কাছ থেকে আলাদা হয়ে গেছে খেয়াল করেনি। সঙ্গে সঙ্গে রক্তচোষা বাদুর এর মত লাফিয়ে পড়ল সাবির ওপর সেই অদৃশ্য শক্তি। তবে এবার সে রক্ত পান করল না। অবস্থান করল সাবিরের শরীরে।
পরিমল বুঝতে পারল কেন সাবিরের রক্ত পান করেনি। যদি সাবিরকে মেরে ফেলে তবে ওই শক্তি আর কোনভাবেই পরিমলকে মারতে পারবে না। তাই অদৃশ্য শক্তি চাই ছিল সাবিরের দেহে থেকে পরিমলের সঙ্গে যুদ্ধ করবে। এভাবে পরিমলকে হত্যা করে, পরে সাবিরকে মারবে।
পরিমলের বিষয় বুঝে নিতেএক মুহূর্ত দেরি হয় নি। সঙ্গে সঙ্গে মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত ছিল। কিন্তু তার এই গায়ের জোর কতক্ষন তার বন্ধুর বিপরীতে টিকবে সে ভাল করেই জানে। বন্ধুর মধ্যে থাকা অদৃশ্য শক্তির সেই ভয়ঙ্কর হাসি,শক্তির জোরের সাথে সে কোনভাবেই পেরে উঠতে পারছিল না। ক্ষতবিক্ষত পরিমল কোনওভাবেই তার প্রিয় বন্ধুকে আঘাত করতে চায়নি।
সেই অদৃশ্য শক্তির জয় প্রায় নিশ্চিত। এতক্ষণে পরিমলের মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল সে বলে উঠল, “নিস্তারিণী,নিস্তারিণী”
সমাপ্তি পর্ব
সাবির এর মধ্যে থাকা অদৃশ্য শক্তি থেমে গেল। পরিমল বলল, “আমি জানি আমি মুক্তি পেলেও তুমি মুক্তি পাওনি, তুমি কি আজও এইভাবে হত্যা করে যাবে? মুক্তি চাইবে না!”
অদৃশ্য শক্তি বলল ,“প্রনয়!”
“হ্যাঁ আমি প্রণয়। তোমারই প্রনয়। আমি তোমার সঙ্গে পুড়ে গিয়ে পরজন্মে তোমায় চেয়েছিলাম। তুমি আসোনি। তোমার এখনও অতৃপ্ত আত্মা মুক্তি চায়নি। তুমি আজো হত্যালীলা চালিয়ে যাচ্ছ।”
“তোমায় চাই প্রণয়। আর কিছু না।”
পরিমল এবার ভয় পেয়ে গেল। বলল ,“তুমি আমাকে চাইবে কেন। আমার তোমাকেই চাই। তুমি মুক্তি পেলে তোমার জন্য আমি অপেক্ষা করব।”
নিস্তারিণী চুপ, পরিমল আবার বলল ,“তোমার এই হত্যালীলা আমার বন্ধু রবিন মারা গেছে। তুমি এখনও সাবিরের দেহে আছ। তুমি কি এখনও হত্যা করবে?”
সঙ্গে সঙ্গে সাবিরের দেহ ছেড়ে নিস্তারিণী বেরিয়ে আসে। সেই অদৃশ্য শক্তির কী ভয়ঙ্কর রূপ। ধীরে ধীরে নিস্তারিণী দৃশ্যমান হয়। বলল, “প্রণয় আমি মুক্তি চাই,আমায় মুক্ত করে দাও।”
“তোমার অতৃপ্ত আত্মা এখনও দেখছি রয়ে গেছে। তোমার রক্ত পিপাসু আত্মা মুক্তি লাভ করতে চায়নি। মুক্তিলাভে দেখ জগৎ কতটা পাল্টে গেছে।”
সাবিরের দেহ তখন ক্লান্ত, ওকে পরিমল তুলে একটা বন্ধন দিয়ে নিজের সঙ্গে বেঁধে ফেলেছে। আর পরিমল ভুল করতে চায়নি। আবার বলল, “তুমি কি জানো কীভাবে তোমার মুক্তি?”
“এখনও এই ঘরের মাটি খুঁড়লে দেখবে আমার দেহের পুরোটা এখনও পোড়েনি।”
বলেই আবার বলল, “প্রণয় তোমার দেহের থেকে ওই মন্ত্রপূতঃ তাবিজ খুলে ফেলো। আমি তোমায় একবার ছুঁতে চাই।”
পরিমল পড়ল মহাবিপদে। ্কী করবে এখন বুঝতে পারছে না। সে ভালো করে জানে যদি সে একবার এই তাবিজ খুলে ফেলে নিস্তারিণী তাকে ধরে ফেলবে।
নিস্তারিণী বলল,“একবার খোলো,আমি মুক্তি চাই তবে, মুক্তির আগে তোমায় সেই আগের স্পর্শের অনুভূতিটুকু একবার নিতে চাই।”
কোনওভাবেই খুলতে রাজি নয় পরিমল। সে বলল, “হ্যাঁ খুলছি, তবে তোমায় দেহ আগে বের করি”
পরিমল চাইছিল দেহটা তাড়াতাড়ি বের করে পুড়িয়ে ফেলতে। ও খুঁড়তে শুরু করল। নিস্তারিণী তাবিজের জন্য কোনওভাবেই পরিমল ছুঁতে পাড়ছিল না। অপরদিকে সঙ্গে বাঁধা থাকায় সাবিরকেও ছুঁতে পারছিল না।
“প্রণয় তোমার মনে আছে মৃত্যুর আগে কি বলেছিলে?”
পরিমল ভাবল ডাইরিতে তো কিছু লেখা নেই। কী জবাব দেবো, ও বুদ্ধি দিয়ে জবাব দিল,
আমি সব ভুলে গেছি নিস্তারিণী। আমি জানি তুমি তখন ছিলে আমার। তুমি মুক্তি পাও। ফিরে এসো আমার জীবনে।”
“তবুও প্রনয়, কবে আবার আমাদের দেখা হবে জানি না, একবার আমায় স্পর্শ করতে দাও।”
কোনভাবেই তাবিজ খুলতে চায়নি,সে জানে সে ধরা পড়বে,তখন দুজনে আর বাঁচবার উপায় থাকবে না। চুপচাপ মাটি খুঁড়ছে। মাটি খোঁড়া প্রায় শেষ, মাটির ভেতরে দেখতে পাওয়া গেল কয়েক টুকরো কঙ্কালসার হাড়। পরিমল ন্যাকড়া জড়ানো মশালের অংশ দেখতে পায়। বোধহয় এটা সৌরিক ভট্টাচার্য সঙ্গে নিয়ে এসেছিল। সে আর বিলম্ব করতে চায়নি, ন্যাকড়াটিতে আগুন ধরিয়ে দিল ব্যাগে থাকা দেশলাই দিয়ে।
প্রনয় এবার তো তাবিজ খোলো। আমি একবার তোমায় ছুঁতে চাই।”
পরিমল চুপ
“প্রনয় তুমি কি খুলবে না? তুমি কি ভয় পাচ্ছ?”
পরিমল আবারও চুপ
“তুমি প্রনয় হতে পারো না। প্রনয় ভীতু ছিল না। প্রনয় কোনও ভাবে বারবার ইতঃস্তত বোধ করত না। তুমি তাহলে প্রণয় নও।”
“না আমি প্রনয় নই কিন্তু নিস্তারিণী আমি তোমায় মুক্তি দিতে চাই। এভাবে আর কতজনকে তুমি হত্যা করবে?”
নিস্তারিণী চুপ
তারপর বলল, “তাই ভালো মুক্ত করে দাও। আমি মুক্তি চাই!”
পরিমল আগুন ধরিয়ে দিল। নিস্তারিণীর আত্মা ধীরে ধীরে হাসতে হাসতে পুড়ে যেতে থাকল। কিছুক্ষণ পর তা অদৃশ্য হয়ে গেল ওদের চোখের সামনেই। ধীরে ধীরে জমিদার প্রাসাদ সবই হারিয়ে গেল।
তখন প্রায় রাত তিনটা। ওরা বসে আছে সেই ফাঁকা নদীর তীরে। প্রাসাদ নেই। বন্ধু রবিনের মৃতদেহটা তখন পাশে পড়ে সেই সঙ্গে পড়ে আছে সৌরিক ভট্টাচার্যের দেহটাও।
সমাপ্ত