আমি অ্যালেক্স গোমেজ। কৈশোরেই অনাথ আশ্রম থেকে পালিয়ে, বর্তমানে কার্ভালো-গাঁওয়ের ডন কার্ভালোর শিপিং উইং-এর একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। মাঝরাতে বিদেশি জাহাজ স্মাগলিং পণ্য ওঠানো আর নামানো আমাদের কাজ।
কাল আমার কুড়ি বছরের জন্মদিনে ডন কার্ভালোর সাথে শিভা স্যার এসেছিলেন। কেক কেটে আর এক পেগ আন্টিকোয়েরি গলায় ঢেলে বিদায় নেবার আগে, ডন কার্ভালো আমাকে এক কোনে নিয়ে গিয়ে বললেন, “ডিড ইউ লাইক দি গিফট সনি?” আমি মাথা নামিয়ে বলি, “থ্যাংক ইউ স্যার। খুব সুন্দর গিফট। অনেক দামি উপহার দিলেন আমাকে।” কার্ভালো ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বললেন, “নেভার মাইন্ড দ্যাট। আমার মনে হয় তুমি আর আণ্টানিও এবার ভ্যাকেশন পিরিয়ডে নতুন বোটে ভয়াজে বেরিয়ে পড়।”
ডনপুত্র আন্টানিও, কার্ভালো সাম্রাজ্যের একমাত্র উত্তরাধিকারী। ডন কার্ভালো আমার কুড়ি বছরের জন্মদিনে যে আমদানি করা অত্যাধুনিক নতুন মোটর বোট উপহার দিলেন, সেটা কিন্তু আসলে পুরস্কার। ডনের বিশ্বাস, আমি আন্টানিওর প্রকৃত বন্ধু যে তাকে ড্রাগের নেশা থেকে জীবনের মূল স্রোতে ফিরিয়ে এনেছে।
গভীর রাত অবধি জন্মদিনের পার্টি চলেছে। আন্টানিওকে সকালেই নতুন বোটে আসব বলেছিলাম, কিন্তু আমার সেখানে পৌঁছাতে বেশ দেরী হয়ে গেল। আন্টানিও তখন নতুন বোটের এঞ্জিন রুমে গিয়ে কম্প্রেসরগুলো চেক করছিল। আমাকে দেখেই বলে “গুড মর্নিং বাডি, হাং ওভার গেছে কি যায়নি? চলো আমরা জুয়ারি ব্যাকবে থেকে ঘুরে আসি। ওখানকার লাল কাঁকড়ার ঝাল আর কোকোনাট ফেনি পেটে পড়লে দিল চাঙ্গা। আর এই সাথে এই বোট কতটা সুন্দরী আর তপ্তযৌবনা তাও পরখ করা যাবে।”
ফ্লাই ব্রিজে গিয়ে, নোঙর তুলে আমরা এগিয়ে চললাম জুয়ারি নদীর মোহানার দিকে। স্টিয়ারিং হুইলে আন্টানিও, গিটার নিয়ে আমি। কিছুদিন আগে তোলা ডেজা-ডেজা-এভু-এভু ফোক ডান্সের টিউন আর আন্টানিওর লিরিকসে, ‘লাভ ইজ এভার ইয়ং/নেভার লেট ইট গোয়িং’ গানটা গাওয়া শুরু করলাম। আন্টানিও বুড়ো আঙুল তুলে ফুর্তির সাথে বলল, “আর একটু এগিয়ে অটো-ন্যাভিগেশন চালু করে, তোমার পাশে বসছি কঙ্গো নিয়ে।”
নতুন বোটে জুয়ারি মোহানা থেকে কোকোনাট ফেনি আর কাঁকড়া ঝাল পেট পুরে খেয়ে, ফেরার পথে কিছুটা এগিয়ে মনে হল একটা স্পিড বোট আমাদের পিছু নিয়েছে। পুলিশ, কাস্টমস আর নেভির লোক এই রকম স্পিড বোটে এসে চেক করে, কিন্তু তারা এভাবে ফলো করে না। বেশ আগে থেকে বোটের ইঞ্জিন বন্ধ করার সিগন্যাল দেয়, মেসেজ পাঠায়। কিন্তু এই স্পিডবোটটা সে রাস্তায় না গিয়ে, শুধু পিছু পিছু আসছে। এর মতলব ভালো নয়। কার্ভালোর এলাকাতে কোনও দুঃসাহসী ঢুকে পড়েছে। মুস্কিল হল আমাদের এই নতুন বোটটার রেডিও সেট, কার্ভালো-গাঁওয়ের রেডিও অফিসের সাথে টিউন করা নেই। আমার গ্যাং মেটের একজন রেডিও সেট নিয়ে খেলে। তার কাছে ‘কাপ্ররোজিনে জুনিয়র, নিউ বোট জুয়ারি ডেঞ্জার’—মানে নতুন বোট নিয়ে ডন পুত্র বিপদে পড়েছে জুয়ারি মোহনার কাছে—এই একটা সতর্ক বার্তা পাঠিয়ে দিলাম।
মারগাঁও থেকে বইছে একটা বড়ো ক্রিক। তার মোহনার কাছে আসতেই দেখি এই স্পিড বোট যেন খবর পাঠিয়েছিল তার গ্যাংকে। একটা বড় বোট তৈরিই ছিল। মোহনার মুখে আমাদের বোটের একটু আগে চলতে লাগল। এবারে পরিষ্কার হয়ে গেল এরা দুজন মিলে আমাদের সামনে পিছনে ঘিরে ফেলে কিছু বদ মতলবে আছে। এর মোকাবিলা করতে হবে ঠাণ্ডা মাথায়। আন্টানিও বলল, “লোয়ার-ডেকে, ইঞ্জিন রুমের কাছে দুটো লোডেড বেরেটো অটোমেটিক গান রাখা আছে। ব্যালাস্টের জন্য রাবারাইজড কয়ারের বোরা পেছনের ডেক চেম্বারে আছে। আমরা ওর আড়ালে বসে থাকব।” বেরেটো গানে সাড়ে তিনশো রাউন্ড লোড করা যায়, ব্যাক থ্রাস্ট কম আর ওপরের দিকে তুলে র্যাপিড ফায়ারও করা যায়। আর একটু এগিয়ে, ডান দিকে একটা ছোট জোয়ার-ভাটা খাল আছে। আন্টানিওকে ইঞ্জিন রুমে পাঠিয়ে আমি এই খালটা পার করার ভান করে ইঞ্জিনে ফুল-থ্রটল অন করে ব্যাক মোশনে খালে ঢুকে গেলাম। বোটটার ব্যালান্স এত ভালো যে সামান্য টাল খেয়েও সামলে নিল।
খালের মুখে বড় গাছের আড়াল থাকায় সামনের বোটটা যখন আমাদের মতলব বুঝল, তখন আমরা ক্রিকের মধ্যে বেশ অনেকটা এগিয়ে গেছি। পেছনের স্পিডবোটে লোকাল অপারেটর থাকলেও, ক্রিকের মুখে হঠাৎ করে ঢুকতে পারবে না। ঢুকলেও একটু থতমত খাবে। ঠিক এইসময় দূর থেকে অটোমেটিকের র্যাপিড ফায়ারিং শোনা গেল। এরপর বাজ পড়ার আওয়াজের মতো পরপর কয়েকটা বোম ফাটার আওয়াজ শুনতে পেয়ে আমি আন্টানিওকে আশ্বস্ত করলাম যে আমাদের মিলিশিয়া টিম পৌঁছে গেছে আর বড় বোটটাকে আক্রমণ করেছে। স্পিড বোটটা বুঝেছে যে সে আমাদের পেছনে পেছনে খালে ঢুকে ইঁদুরের জাঁতাকলে পড়েছে। চারজন কৃষ্ণাঙ্গ বিদেশিকে দেখা গেল স্পিড বোটের ফোর ডেকে। অটোমেটিক নিয়ে ফায়ারিং করবার জন্য তৈরি। ওরা কিছু করার আগে আন্টানিওর বেরেটো দুটোকে শুইয়ে দিল। ততক্ষণে কোথা থেকে বাকি দুই শয়তান সাঁতরে আমাদের বোটের খুব কাছে এসে পড়েছে। আমাদের বোটের ফোর ডেকে চড়ার আগেই আমার স্টীলেটো ওদের নাভির কাছে আমুল বিঁধে গেল আর ততোক্ষণে আন্তানিওর বেরেটো ওদেরকে খাঁড়িতে জল-সমাধি দিয়ে দিয়ে দিয়েছে।
মিলিশিয়ার লোকেরা যে চারজনকে বোটে জীবিত পেয়েছিল, সেই গ্যাংটা কার্ভালোগাঁওয়ে এসে শিভা স্যারের জেরায় স্বীকার করে যে তারা মাফিয়া ফেলিনির লোক। আন্টানিওকে অপহরণ করে, মুক্তিপণ হিসাবে কার্ভালোর এলাকার কিছুটার দখল অথবা ভাগিদারী পাওয়া—এইটাই মাফিয়া ফেলিনির উদ্দেশ্য ছিল।
মিলিশিয়া গ্যাং, কার্ভালোর নিজের হাতেই তৈরি। এরা সেরা বন্দুকবাজ এবং গেরিলা লড়াইয়ে নিপুণ। বন্দরের অদূরে নোঙর করা বিদেশি জাহাজে বেআইনি মাল ওঠানো-নামানো নিয়ে কার্ভালোর একাধিপত্যের পেছনে এরাই আছে।
কিন্তু ফেলিনি মাথাচাড়া দেওয়ার পর এখন কার্ভালোর সময়টা সুবিধের নয়। সময়ের সাথে সে পাল্টাতে পারেনি, কিন্তু ফেলিনি তা করেছে। ক্ষমতার অলিন্দে ঘোরাফেরা করা এই নিষ্ঠুর মানুষটি অসাধারণ চতুর এবং দূরদর্শী।
ফেলিনির এলাকা মারগাঁও ডক।গোয়ার কোরতালিম থেকে দোনাপাউলা অবধি, সমস্ত স্মাগলিংয়ের একছত্র কারবারি কার্ভালো।
ফেলিনি নিজের উত্থানের সাথে কার্ভালোর এই এলাকাটা পুরো দখল না করতে পারলেও, কিছুটা নিজের দখলে আনতে পেরেছে। সুযোগ পেলেই মাফিয়া ফেলিনি আর তার দলবল বাকি এলাকায় নিজেদের দখলদারির লড়াই লাগিয়ে দেয়।
ফেলিনির বাহিনি গেরিলা লড়াইয়ে খুব পটু। কিন্তু তারা কার্ভালোর মিলিশিয়ার সাথে পেরে ওঠে না। প্রতিবছরই দু’দলের ক্ষমতা দখলের লড়াই হয়ে থাকে। তবে এইবার আন্টানিওকে নিয়ে তারা একটু বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলল। কয়েকদিন এই নিয়ে মিলিশিয়া দলে ‘বদলা লেঙ্গে’র আবহাওয়া বেশ গরম ছিল।
যাইহোক, প্রতিবারের মতো এবারেও কিছুদিন পরে ফেলিনির উৎপাত ঠাণ্ডা হয়ে গেল। এর মধ্যেই কাছে চলে এল সপ্তাহব্যাপী বিদেশি জাহাজ না আসার বাৎসরিক ভ্যাকেশন মানে কার্ভালো-গাঁওতে অধিবাসীদের নিজের নিজের পছন্দমতো ফুর্তির আবহাওয়া।
আমি আর আন্টানিও সি-রুট ম্যাপ নিয়ে অনেক মাথা ঘামানোর পর অনেক আগেই ঠিক করেছিলাম যে এই ভ্যাকেশনে গোয়ার উত্তর-পশ্চিম দিকে উন্মুক্ত সমুদ্রের দিকে যাব। এই জায়গাতে অনেকগুলো ছোট-ছোট পরিত্যক্ত আর জঙ্গলে ঘেরা দ্বীপ ম্যাপে দেখা যাচ্ছে। আমরা এই দ্বীপগুলোতে গিয়ে থাকব আর এই জায়গাগুলোর সম্বন্ধে সন্ধান চালাব। মিলিশিয়ার একটা বোটও আমাদের সঙ্গে যাবে এই শর্তে কার্ভালো রাজি হলেন।
আন্টানিও ঠিক করেছে, ভ্যাকেশন শুরু হবার আগের রাতেই আমরা অ্যাডভেঞ্চারে বেরিয়ে পড়ব। মোহনা থেকে একটু এগিয়ে মিলিশিয়ার বোট আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে।
কিন্তু সেই সময়টায় আমাদের সবার অজান্তে এক মহাবিপদ ঘাপটি মেরে সুযোগের অপেক্ষা করছিল।
আন্টানিওর পথ চেয়ে আপার ডেকে বসে আছি। ওর মোবাইল সুইচড অফ। বোটের ওয়্যারলেস সেট থেকে ওর ঘরের সেটে কোড পাঠিয়েও কোনও জবাব নেই। এই সময় কানে এল কার্ভালো-গাঁওয়ের দিক থেকে একটা হল্লা। প্রথমে ধীরে, তারপরে সেটা জোর আর্তনাদে পরিণত হয়ে গেল। কয়েক মিনিট পরে শুরু হয়ে গেল অটোম্যাটিক আর ইনসাস থেকে ফায়ারিং, ‘টেরা, টেরা, টট, টট’ আর বোমার কানফাটা আওয়াজ। তবে কি মাফিয়া ফেলিনির লোকেরা এবার কার্ভালোগাঁওয়ে ঢুকে পড়েছে? আপার ডেক থেকে দ্রুত নেমে ইঞ্জিন রুম থেকে বেরেটোগান হাতে নিয়ে লোয়ার ডেকে এসে দেখি এক কোনে রাবারাইজড কয়ারের ব্যালাস্টগুলো সাজানো আছে। চটপট সেগুলো দিয়ে কভার তৈরি করে তার আড়ালে লোডেড বেরেটো হাতে পজিশন নিয়ে নিলাম।
এখন চারদিক থেকে হল্লা শোনা যাচ্ছে। লোকজনের ছুটে পালানোর আওয়াজ আর থেকে থেকে বাজ পড়ার মতো বোমের পিলে চমকানো শব্দ, জোয়ারের ঢেউয়ের মতো আছড়ে আছড়ে পড়ছে। হঠাৎ পিছনপানে চেয়ে দেখি কার্ভালো-গাঁওয়ের একটা দিকে আগুন জ্বলছে। ওইদিকেই তো কার্ভালোর দোতলা কাঠের বাড়ি, আর তার পাশেই শিভা স্যারের বাড়ি। মিলিশিয়া-বেষ্টিত কার্ভালোর গড়ে এসে এই ধরণের চমক দেওয়া দুঃসাহসী আক্রমণ মাফিয়া ফেলিনির গেরিলা বাহিনি ছাড়া আর কারও কি হতে পারে? মোহনার কাছে জঙ্গলের বড় বড় গাছগুলোর আড়ালে নোঙর করে রাখা এই বোটটাকে ওরা আক্রমণের হিসাবে রাখেনি। নাকি…
সেই সম্ভাবনার কথা মনে হতেই গা শিউরে উঠল। ওরা কি তাহলে মিলিশিয়াকে এড়িয়ে গিয়ে আন্টানিওর নাগাল পেয়ে গেছে? দৌড়ে আসা পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। আমাকে এই আওয়াজ একমনে শুনে বুঝে নিতে হবে এটা আমার পরিচিত না অপরিচিত লোকের পদধ্বনি। ব্যালাস্টের আড়ালে লোডেড বেরেটোটাকে একহাতে শক্ত করে ধরে অন্য হাতে বুটের স্ট্র্যাপে আটকানো স্টীলেটোগুলো একবার ছুঁয়ে নিলাম।
পায়ের শব্দটা চেনা মানুষের হতে পারে, তবে সে একা। তার পেছনে বা আগে আর কেউ নেই। ফ্ল্যাশ টর্চটা একবার জ্বেলে দেখা যেতে পারে, কিন্তু তাতে আমি ফেলিনি গ্যাঙের অটোমেটিকের চাঁদমারি হয়ে যেতে পারি। একটা ছায়ামূর্তি যেন এগিয়ে আসছে। পায়ের শব্দটা আর একটু এগিয়ে আসতেই একটা চাপা গলায় চেনা আওয়াজে শুনি, “হেল্প! হেল্প!” আরও একটু এগিয়ে এসে সেই ছায়ামূর্তি এবার জোরেই বলে উঠল, “দোস্ত অ্যালেক্স, আমি আন্টানিও।”
আন্টানিও জ্ঞান হারানোর আগে থেমে থেমে কোনওমতে বলল, “মিলিশিয়া ভ্যাকেশনের মুডে ছিল। সেই সুযোগে ফেলিনির গেরিলারা ঢুকে আক্রমণ করতেই মিলিশিয়ার সাথে স্ট্রিট ফাইট শুরু হয়ে যায়। ফেলিনির গেরিলারা খুব চটপট ছড়িয়ে ছড়িয়ে হামলা করছে। বাবা আর শিভা আঙ্কলের ঘরে দূর থেকে ডিজেল স্প্রে করে তীর-ধনুক থেকে আগুনের মশাল ছুঁড়ে দিয়েছে। চারদিকে ওরা…”
আমি বললাম, “চারদিকে কি?”
আন্টানিও বলল, “ওরা ঘিরে ধরে বাছা-বাছা লোকদের গুলি করছে। আমাকে ধরে বন্দি করার চেষ্টা করেছিল। পালানোর চেষ্টা করতেই একজন কাঁধে তরোয়ালের কোপ মারতে যায়। আমি কোনওরকমে সেটা এড়ালেও, চোট লেগেছে।”
লোয়ার ডেকের ফার্স্ট-এড বক্স খুলে আন্টানিওর চোটে ব্যান্ডেজ করে এটিএস আর ব্যাথা কমানোর ইনজেকশন পর পর দিয়ে দিলাম। হাতের কাছেই ব্রান্ডি তৈরি ছিল, ও চোখ খুলে বসতেই খাইয়ে দিলাম। একটু চাঙ্গা হয়ে ওকে ডেকচেয়ারে আধশোয়া করে বসিয়ে দিলাম। মোটামুটি বুঝে নিলাম
সে ধীরে ধীরে বলল, “বাবা আর শিভা আঙ্কেল দু’জনেই মনে হয় আমাদের বাড়ির পেছনের বাগানের গোপন চেম্বারের সিঁড়িঘর দিয়ে স্পিড বোটে পালিয়েছে খাঁড়ির মোহনাতে। ”
আমি বললাম, “তুমি আসার পর ইঞ্জিন লো-পাওয়ারে করে কোনওরকমে নোঙর তুলে নিয়েছি। এখন জোয়ারের সময়। গুগল থেকে অটোন্যাভিগেশন করে বোটের রাডার আমাদের নিয়ে যাবে বাঁদিকের শাখা খাঁড়িতে।”
ওর কাঁধের চোটের যন্ত্রণাটা ফিরে আসছে নাকি? সেটা লুকাতে লুকাতে আন্তানিও বললে, “তাহলে সাগরে পৌঁছেই আমরা এমন রুট ধরব যা এখানের কোনও লোকাল বোট ধরবে না।”
আমাদের বোট তখন সেই শাখা খাঁড়িতে, যা ডোনাপউলার একটু আগে এসে সমুদ্রে মিলেছে। দু’পাশের বন জঙ্গল কম। জোয়ারের ঢেউ এখানে বড় বড়। লোডেড ব্যারেটোটা ওকে এগিয়ে দিয়ে, আমি চললাম ওপরের ডেকে। ফ্লাই ব্রিজে (অপারেটিং কেবিন) গিয়ে স্টিয়ারিং সামলাতে হবে।
আন্টানিও এখন অনেকটা সুস্থ। আমার দিকে বুড়ো আঙুল তুলে বন্দুক হাতে সামান্য খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগিয়ে গেল ব্যালাস্টের কভারের দিকে।
ফ্লাই ব্রিজে আসতেই উঠল তুমুল ঝড়, আর সেই সাথে বিদ্যুৎ চমক দিয়ে মেঘগর্জনের সাথে বৃষ্টি। বড় বড় ঢেউ যেন হামলে পড়ছে বোটটার ওপর। হঠাৎ আসা দুর্যোগে একটা সুবিধে হল অবশ্য। ঢেউগুলোর দোলায় বোটটা অনেক কম ফুয়েল খরচায় ক্রিক দিয়ে চলে এল মান্ডবির মোহানাতে ডোনাপউলার কাছে।
কিন্তু এ কি! ফুয়েল মিটার খারাপ হয়ে গেল নাকি? এখনই দেখাচ্ছে আধা ট্যাঙ্ক ডিজেল খালি। আজই সন্ধ্যায় আমাদের সাথে মিলিশিয়ার যে বোটটা যাওয়ার কথা ছিল, এই বোটের ফুয়েল, খাদ্য সামগ্রী আর পানীয় জল তাদেরই নিয়ে আসার কথা। কিন্তু সন্ধের পরেই তারা তো লড়াইয়ে ব্যস্ত ছিল। আমাদের ফুয়েল আর রেশন তারা দেবে কি করে?
যাওয়ার কথা ছিল এখান থেকে জুয়ারি নদীর মোহনা ছাড়িয়ে আরও উত্তর-পশ্চিমে। কিন্তু তাতে আমরা ফেলিনির গেরিলাদের কবলে পড়তে পারি। এই কারণেই আমরা যাব প্রায় দক্ষিণের দিকে, কেরল অথবা চেন্নাই ঘেঁষে। নৌবাহিনীর নজরদারির জন্য সেখানে কারো ট্যাঁ-ফোঁ করার উপায় নেই।
ভাঁটা আসার আগেই মাঝসমুদ্রে পৌঁছে গেলাম। ভাবলাম অটোন্যাভিগেশন চালু করে এবার লোয়ার ডেকে গিয়ে আহত আন্টানিওকে এবার বিশ্রাম দিই। নিচে ম্যাপের প্রিন্ট রাখা আছে। সেইটা নিয়ে ওর সাথে একবার বসাও দরকার।
কিন্তু অটোন্যাভিগেশন চালু হল না কেন? নিচে নেমে দেখি ব্যালাস্টের কাছে ব্যারেটো গানটাকে আঁকড়ে ধরে কুঁকড়ে প্রায় গোল হয়ে শুয়ে আছে আন্টানিও। মুখ দিয়ে ফেনা উঠছে।
মিলিশিয়া গ্যাঙের একজনের কাছে শুনেছিলাম তরোয়াল বা ছুরির চোট লাগলে, বিষক্রিয়ার ফলে এই রকম হতে পারে। আমার কাছে সে জন্য একটা ওষুধ ব্যাগে রাখা আছে।
ইঞ্জিন রুমের আলমারি থেকে ব্যাগটা বার করতে গিয়ে সেখানে ঢুকতে দেখি বৃষ্টির জলে কম্পিউটার, রাডার সেন্সরের পুরো প্যানেল, জিপিএস প্যানেল, অচল হয়ে গেছে। ম্যাপের যে বড় প্রিন্টআউট জলে ভিজে এখন মণ্ড হয়েছে। সব মিলিয়ে বেশ বড় মাপের বিপদ ঘটে গেছে।
আন্তানিওকে দেখলাম ও এবার সোজা হওয়ার চেষ্টায় পা ছুঁড়ছে। কিচেনের এককোনে কাত হয়ে থাকা একটা বোতলের অবশিষ্ট জলে সেই ওষুধ মিশিয়ে খাওয়াতেই আন্তানিও একবার বমি করল কিন্তু একটু পরে উঠে বসল।
ফোরবোর্ড থেকে ওকে ধরে-ধরে নিয়ে এলাম ককপিটে। এখনও বেশ জ্বর আছে ওর শরীরে। ককপিট থেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে সন্ধের মুখে আবার ঝড়-তুফানের সাথে বেশ বড়-বড় ঢেউ আসছে। এখন থেকেই নৌকা একবার ডানে যায় তো একবার বাঁয়ে।
ড্যাশ বোর্ডের প্যানেল বলছে ফুয়েল রিজার্ভে। বড়জোর রাতটুকু চলতে পারে। এরপর সমুদ্রের ঢেউয়ের ঠেলায় তার মর্জিমাফিক খামখেয়ালি দিকে চলবে বোট। এমনটাও এখন হতে পারে যে সমুদ্রের ঢেউ আমাদের ঠেলে নিয়ে গেল ভারত মহাসমুদ্রে। সেখানে ঢেউয়ের ওঠানামাতে বোট জলে ভরে গিয়ে জলসমাধি হবে আমাদের।
একটা ভয় এসে আমাকে যেন গ্রাস করতে এগিয়ে এল। আর্ত চিৎকারটা গলাতে এসে আটকে গেল অসুস্থ আন্টানিওর কথা মনে পড়াতে। আর ঠিক এইসময় এই হু-হু করে বয়ে যাওয়া তুফান ঝড়ের আর সমুদ্রের প্রবল গর্জনের ভেতর শুনতে পেলাম সেই মেঘমন্দ্র আওয়াজ, ‘অ্যালেক্স’। বুঝলাম, এই আওয়াজ আমার চিরকালের ত্রাতা সেই মহা অশরীরীর। আমার জন্ম থেকেই তিনি আছেন এই অনাথের আশেপাশে কোথাও।
এই আওয়াজ যখন শুনতে পেয়েছি তখন বিপদ থেকে উদ্ধার নিশ্চয় পাব। হয়তো কাল কোনও বড় ট্রলার, কোনও জাহাজ, কিম্বা সদাজাগ্রত ইন্ডিয়ান নেভির কোনও সাহায্য পেয়ে যাব আমরা।
ককপিটে ফিরে আন্তানিওর কপালে হাত দিয়ে বুঝলাম ওর জ্বর কমে গেছে আর পরম স্বস্তিতে সে ঘুমাচ্ছে। ওষুধটা সত্যি কাজে দিল তাহলে। আমি হাতটা কপাল থেকে সরাতে গেলে ও ধরে ফেলল হাত দিয়ে।
এ এক আশ্চর্য ভয়েজ, যাতে ঘটনাচক্রে বোট-ন্যাভিগেশন, ওয়্যারলেস সেট—সব বিগড়ে আছে। ইঞ্জিনে ফুয়েল প্রায় নেই। আমাদের খাবার রেশন নেই। খাবার জল আছে মাত্র দেড় বোতল। একমাত্র সাথী, সেও সুস্থ নেই। এতসব নেই-এর মধ্যে আছে দু’জন অল্পবয়েসী ছেলে। নদীতে বড়জোর সমুদ্রের পাড়ের কাছাকাছি চলার যোগ্য বোটে, তারা ভেসে বেড়াচ্ছে মহাসমুদ্রে বা তার কাছাকাছি। সেটা যে সেই মহা অশরীরীর জোরে তা বুঝতে পারলাম।
চার দিন কেটে গেছে, সমুদ্রে তুফান শুধু কাল বন্ধ হয়েছে। চার দিন বলা গেল এইজন্য যে ঘন মেঘে আকাশ সূর্যকে ঢেকে রাখলেও বোঝা যায় দিন-রাতের ফারাকটা। বোঝা যায় না শুধু সূর্যোদয় বা সূর্যাস্তের দিকটা। ক’দিন কাটল অজানা সমুদ্রযাত্রায় সেটা জানা যাচ্ছে। কিন্তু কোনদিকে যাচ্ছি বা কতটা এলাম, তা জানার কোনও উপায় নেই। ফুয়েল রিজার্ভ লেভেলে যাওয়ার আগেই ইঞ্জিনকে বন্ধ করে দিয়েছি।
ঢেউয়ের জল বোটে লাফিয়ে ঢোকে। জল লোয়ার ডেক ছাপিয়ে গিয়ে বিপদ ঘটানোর আগেই পাম্প চালাতে হবে। আর যদি কখনও কোনও দ্বীপ দেখা যায়, তবে সেখানে যেতে হবে। এই দুটো কারণের জন্য ফুয়েলকে যতটা পারা যায় বাঁচিয়ে রাখা উচিত। দ্বীপ যদি কাছেপিঠে এসে পড়ে, সেখানে আশ্রয় পেতে হলে দিন ছাড়া গতি নেই। এই চারদিনে একটা জাহাজেরও যেমন দেখা নেই, তেমনি নেভির কোনও টহলদারি বোটকেও দেখা যায়নি। কাল বিকেলে নেভির একটা সি-প্লেনকে দেখা গিয়েছিল। আমার লাল শার্ট দিয়ে এসওএস সিগনাল পাঠানোর একটা ব্যর্থ প্রয়াসও করেছিলাম।
আন্টানিও সেরে উঠছে, কিন্তু এখন খুব দুর্বল। ওর অজান্তে তিনটে টিন ফুডের পুরোটাই ওকে খাইয়েছি এই ক’দিন। বাকি একটাতে আমি কোনওরকমে চালিয়েছি। কাল রাত্রে ঢেউয়ের জলের সাথে একটা মাছ লোয়ার ডেকে আটকে গিয়েছিল। ক্ষুধার্ত জঠরের করুণ আবেদনে সেই মাছ পুড়িয়ে তার কিছুটা সকালে দু’জনেই খেয়েছি।
আজ সন্ধেতে সেই মাছপোড়ার অবশিষ্টাংশ আর শেষ জলের বোতলের তলানিটুকু দুই বন্ধুতে শেষ করে আপার ডেকে বসে অন্ধকার সমুদ্রের দিকে চেয়ে রইলাম। দু’জনেরই মনে একই প্রশ্ন, “এরপর কী লেখা আছে কপালে?”
কয়েকবার এই কথা ভাবতে ভাবতে আমি বোধহয় ঘুমিয়েই পড়েছিলাম। হঠাৎ মনে হল কে যেন ঠেলা মারল আমাকে। সেইসময় আবার শুনলাম সেই স্পষ্ট মেঘমন্দ্র গলা, ‘অ্যালেক্স’। বিপদ থেকে কি উদ্ধার পেতে যাচ্ছি না নিতান্ত মনের ভুল?
চোখ খুলে দেখি অনেকদিন পর রোদ উঠেছে, বেশ চড়া রোদ। ডেকের রেলিং ঘেঁষে আন্টানিও দাঁড়িয়ে আছে আর দূরে একটা সিগ্যাল কাঁ-কাঁ করছে।
আন্টানিও বহুদিন বাদে উঠে দাঁড়িয়েছে। আমিও চট করে উঠে ডেকের রেলিঙের দিকে দৌড়ে গিয়ে দেখতে থাকি পাখিটা গেল কোনদিকে? আন্টানিওর , দূরবীন চোখে লাগাতেই দেখলাম দলে দলে উড়তে থাকা স্যান্ডপাইপার।উড়ন্ত পাখির দলের গতিপথের দিক খুব সামনেই দ্বীপের সম্ভাবনার ইঙ্গিত করছে। কিন্তু সেইদিকে যেতে গেলে এখন আমাদের বোটের মুখ দক্ষিণ দিক থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে ঘোরাতে হবে।
উপকুলের কাছে আসতে নজরে এল দ্বীপটায় পাহাড় আর জঙ্গল দুটোই আছে। আরও এগিয়ে গিয়ে প্রায় দক্ষিণ-পশ্চিম হতে চোখে এল দ্বীপের খাঁড়ির মোহনা।
সময়টা জোয়ারের। খাঁড়ির মোহনার কাছে সাগরতট থেকে প্রায় দেড়শ মিটার দূরে নোঙর করে দ্বীপে নামার আগে পুরো প্রস্তুতি দুই বন্ধুতে মিলে করে নিলাম।
কাঁধে দুটো বড় ব্যাকপ্যাক আর ব্যারেটো গান নিয়ে কোমর জল ভেঙে মোহনার কাছে আসতে বেশ সময় লাগল। প্রায় একসপ্তাহ পর জল থেকে ডাঙা ছোঁয়ামাত্র এই বিচের বালিতে নতজানু হয়ে দুই বাহু তুলে ওপর-নিচ, ডানে-বাঁয়ে মাথা নুইয়ে স্মরণ করলাম সেই মহা অশরীরীকে। বিপদ যখনই আমাকে পাক দিয়ে ঘিরে ধরে, তখনই তিনি আমাকে আমার নাম ধরে ডেকে সাহস জুগিয়ে গিয়েছেন। কাল রাতেও তাই-ই হয়েছিল।
সামনের বালিয়াড়ির চুড়া থেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে দূরে একটা উঁচু পাথুরে নেড়া পাহাড়। সেখান থেকে সবেগে ঝর্ণার জল গড়িয়ে পড়ছে। আমরা দু’জন যতটা সম্ভব জোরে চলেও সেই ঝরনার পাহাড়ের কাছে পৌঁছাতে দুপুর হয়ে গেল।
পাহাড়তলীতে ডিমের আকারের একটা বিরাট লেক তৈরি হয়েছে এই ঝরনার জলে। লেকের জল হালকা নীল কাঁচের মতো। জল এতটাই স্বচ্ছ যে তাতে বেশ গভীরেও দেখা যাচ্ছে বড় বড় মাছের ঝাঁক। চারিদিকে সুস্বাদু রসাল মিষ্টি ফল ধরা গাছের ছায়াঘেরা লেকের সুস্বাদু জল খেয়ে মনে হল আজকের দুপুরের আহার- বিশ্রামের জন্য এতো ভালো জায়গা আর পাব না আমরা।
“গেট আপ, অ্যাল গেট আপ, অ্যাল হেল্প…” আর্তচিৎকারটা আমার খুব সামনেই হচ্ছে। আমরা যে গাছের তলায় শুয়েছিলাম, তার একটা মোটা শাখা ছিল আন্টানিওর ঠিক মাথার ওপরেই। সেখান একটা লম্বা পাইথন তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ততক্ষনে আমার স্টীলেটো, পাইথনের মাথায় এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে বিঁধে গেছে। আন্টানিও বিদ্যুৎগতিতে গড়িয়ে আমার দিকে কোনাকুনি হয়ে এসে শুয়ে-শুয়েই ব্যারেটো থেকে নির্ভুল নিশানায় তিন-চার রাউন্ড ফায়ারিং পাইথনের মাথা থেকে মাঝ-শরীরে চালিয়ে দিয়েছে।
শিকারের আশা ছেড়ে নিজের প্রাণ বাঁচাতে পাইথন গড়িয়ে গিয়ে পড়ল লেকের জলে। আমরা দু’জন সভয়ে দেখলাম এক বিশাল কুমির তখন জল থেকে ভুস করে মাথা তুলে পাইথনের ঘাড় কামড়ে ধরেছে। নীল আকাশকে হার মানানো রঙের লেকের জল, তার রঙ বদলে, মৃত্যু-যাতনায় ছটফট করা পাইথনের রক্তে লাল হয়ে উঠেছে।
লেকের জলে কুমিরের তাণ্ডব দেখার পর আন্টানিও দেখাল লেকের বাঁ-দিকের ঢালের জমিতে পাঞ্জাওয়ালা বেশ বড় বড় পায়ের ছাপ। আন্টানিও বলল, “এই দ্বীপ কম বিপদের জায়গা নয়।”
সূর্য পশ্চিমের দিকে যেতে শুরু করেছে। সন্ধে নামার আগেই রাতের থাকার কিছু একটা উপায় বার করে ফেলতেই হবে। আন্টানিও আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “দোস্ত অ্যালেক্স, ওই দিকে তাকাও।” ওর দেখানো দিকে চোখ ফেলতে আমারও মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল।
সামনের ছোট টিলার চূড়াতে একটা প্রকান্ড বড় গাছ দেখা গেল। এখান থেকে যতদূর দেখা যাচ্ছে, তাতে মনে হয় ওই টিলাতে জঙ্গল কম। টিলার চূড়াতে পৌঁছে দেখলাম প্রায় বারো ফুটের বেশি উঁচু এই গাছটার তেলচুকচুকে মসৃণ কাণ্ড যেমন বিরাট মোটা, আর তার নিস্পত্র শাখা-প্রশাখাগুলোও তার কাছাকাছি মজবুত আর স্বাস্থ্যবান।
পাইথন বা অন্য কোনও সাপ, কিম্বা শিকারের লোভে অন্য কোনও জন্তু জানোয়ার এই পিছল গাছে ওঠার চেষ্টা করবে না। এই সব সাত-পাঁচ ভেবে দুই বন্ধু ঠিক করলাম যে ওই গাছটার একটা উঁচু মোটা ডালে হ্যামক টাঙিয়ে রাত্রে থাকা হবে।
হ্যামকে রাত কাটালেও গাছ থেকে একটু দূরে তাকে বেষ্টন করে গাছের চারদিকে চওড়া চওড়া নালা মতো খুঁড়ে শুকনো ডালপালা সেই নালি বা ট্রেঞ্চে ফেলে আগুন জ্বেলে দিতে হয়। দূর থেকে এই আগুন দেখেই হিংস্র বন্য প্রাণীরা আর আসে না।
চারদিকে ছড়িয়ে থাকা ডালপালাগুলো কুড়িয়ে জড়ো করতে গিয়ে আন্টানিও হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, “হেই অ্যালশ! এদিকে খামের সাইজের অনেকগুলো গর্ত।” ততক্ষণে আমার দিকেও একই রকম সাইজের আরও অনেক ট্রেঞ্চ। ঝড়ে ভেঙে পড়া অন্য গাছটা থেকে শুকনো ডালপালা আনতে গিয়ে আমাদের দু’জনের চোখে পড়ল এইরকম অনেক ট্রেঞ্চ। এই ট্রেঞ্চগুলো দেখতে গিয়ে চোখে পড়ে গেল গায়ের রক্ত হিম করে দেওয়া একটা দৃশ্য।
সবেমাত্র তার কিছু আগে একটা ট্রেঞ্চের গায়ে তিন-চারটে বড় গাঁইতি দেখে আমরা দু’জনে সেগুলো কীভাবে এল তাই নিয়ে বলাবলি করছিলাম যে তাহলে কি এই দ্বীপে মানুষ আছে? এরপরই আর একটা বড় ডালপালার স্তূপ টেনে আনতে গিয়েই দেখি তার তলায় একটা বেশ গভীর ট্রেঞ্চ। তাতে শোয়ানো অবস্থায় আছে একটা নরকঙ্কালের অংশ আর করোটির কাছে তখন চকচক করছে একটা পেনড্যান্ট সহ একটা সোনার হার।
নরকঙ্কালটি বেশ পুরনো কেন না তার জায়গায় জায়গায় হাড় ক্ষয়ে গিয়ে মাটি তৈরি হতে শুরু করেছে। মিনিটখানেক পরে আমাদের সম্বিত ফিরতেই, দুজনে একসাথে ‘ওহ মাই গড’ বলে এত জোরে চিৎকার করেছিলাম যে দূরে লেক থেকে মাছশিকারি পাখিগুলো, তাদের শিকার ছেড়ে দিয়ে একসাথে উড়ে এসে সেই ভেঙে পড়া গাছেই বসেছিল।
বিকেলের অস্তমিত আলোতে আমরা গাঁইতি দিয়ে অনেকটা মাটি কুপিয়ে এনে সেই কঙ্কালে মাটি দিয়েছিলাম। আর অস্তগামী সূর্যের দিকে পিছন ফিরে অজানা লোকটির প্রতি শান্তি কামনা করে প্রার্থনাও করেছিলাম। আমরা দু’জনে এক সাথে ‘আমেন’ বলার পরই পাখিগুলো ভেঙে পড়া গাছের ডালগুলো থেকে এক এক করে ধীরে ধীরে উড়ে গিয়েছিল। ঠিক সেইভাবে, যখন আমরা কোনও শোকসভায় অন্তিম প্রার্থনার শেষে কবরখানা থেকে ধীরে ধীরে এক এক করে চলে যাই।
নরকংকালে ভারী ওজনের সোনার পেনড্যান্ট একটা মানুষের করোটি মিনে করা ছিল। এইটা এখন মনে আসতে শিরদাঁড়াতে যেন একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল।
টিলার পুবদিকে ধু ধু করা মাঠ। তাতে কোথাও সবুজ ঘাস সবিনয়ে কিছুটা মাথা চাড়া দিয়েছে, কোথাও তাও নেই। অস্তগামী সূর্যের নরম আলোতে আমরা বিস্মিত হয়ে দেখলাম যে একটা পায়ে-চলা পথ টিলার গা বেয়ে নেমে এই মাঠের মাঝামাঝি দিয়ে চলে গেছে জঙ্গলের দিকে।
কিছুটা পরে আমরা দুই বন্ধুতে টাকলা গাছটাতে একটা মোটা দেখের শাখাতে দুটো হ্যামক টাঙিয়েছিলাম। গাছের চারপাশে আগুন জ্বালানোর জন্য মাটি একটু খুঁড়তেই চার-চারটে বিশাল মেটে আলু পেয়ে গেলাম। এই মেটে আলুগুলো আগুনে ঝলসে রাতের উপাদেয় খাবার খেয়ে যে যার হ্যামকে চড়ে দিনের শেষ আলো নিভে যাওয়া দেখলাম।
হ্যামকে চড়ে বাইনোকুলারে চোখ রেখে দেখি জঙ্গলের চারপাশের গাছগুলো থেকে পরের পর বাঁদর এসে সেই মাঠে এসে নামছে। এই জঙ্গলে এই প্রথম কোনও প্রাণী দেখতে পেলাম। কপি বাহিনী দিনের শেষে হয়তো কিছুক্ষন জিরিয়ে নিয়ে আবার অস্তগামী সূর্যের দিকে হারিয়ে গেল।
সেইদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একবার কেমন জানি মনে হল আয়নাতে রোদ পড়লে যেমন রশ্মি বের হয় থেকে থেকে, তেমনটা হচ্ছে। এই জঙ্গলে ওদিকে কেউ কি আয়না পেতে রেখেছে নাকি? আন্টানিওকে জিজ্ঞাসা করার জন্য ওর হ্যামকের দিকে চেয়ে দেখি সে গাছের মগডালে দূর সমুদ্রের হাওয়া পেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমারও চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসছে। কিন্তু দু’জনে পালা করে জেগে থাকব সে কথা আগেই হয়ে আছে। গাছের তলায় নজর দিতে দেখি একজোড়া কালো বনবিড়াল এসে হাজির হয়েছে। দমকা হাওয়া পেয়ে ট্রেঞ্চে যে ডালপালাগুলো ধুইয়ে ধুইয়ে জ্বলছিল, তারা এবার দাউদাউ করে জ্বলে উঠতে ভয়ে হাউ-মাউ করতে করতে তারা পালাল।
চোখ থেকে ঘুম তাড়ানোর জন্য মাথায় কিছু প্রশ্ন রাখি। অমাবস্যা সাত-আট দিন আগে পার হয়ে গেছে। চাঁদের আলোতে জোর না হলেও দেখা যাচ্ছে ধু ধু মাঠ চিরে যাওয়া সেই পায়ে-চলা রাস্তাটা। ওইদিকে যদি একটাও মানুষও থাকে, সে পুরো সন্ধেতে বাতি দূরে থাক, একটু আগুনও জ্বালাল না কেন? আলো বা আগুনের সামান্য ফুলকি বহু দূরে হলেও দেখা যেত।
তাহলে কি এখানে আদিম মানবেরা থাকে? কিন্তু আদিম মানবেরা কি মৃতদেহকে কবর দেয়? আমরা যে কঙ্কালটা দেখে শিউরে উঠেছিলাম, সেটা কি তাহলে গাছের তলায় চাপা পড়া কেউ ? দেখে তো তা মনে হয়নি। যদি এটা কবরস্থান না হয়, তবে কবরের মতো অতগুলো ট্রেঞ্চ কেন খোঁড়া হয়েছিল? তাও আবার এখনকার যুগের গাঁইতি-শাবল দিয়ে? সবচেয়ে বড়ো কথা হল কঙ্কালের করোটিতে মীনে করা সেই সোনার হার।
স্কুলে একটা কাহিনী পড়েছিলাম যে কোনও সূত্রে গুপ্তধনের হদিস পেয়ে একদল মানুষ এসে পৌঁছায় এক নির্জন দ্বীপে। সেখানে তারা এইরকম অনেক ট্রেঞ্চ খুঁড়েছিল। একটি ট্রেঞ্চে কিছু সোনাদানা পেয়ে যাবার পর তার ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে লড়াই লেগে যায় নিজেদের মধ্যে আর শেষটায় তাদের সর্দার এই লড়াইয়ে মারা গেলে তারা তাকে এইরকম ট্রেঞ্চে ফেলে পালিয়ে যায়। এখানে একটু আগে আমরা যে কঙ্কাল দেখেছিলাম হতে পারে সে ছিল এইরকম কোনও দলের সর্দার। গুপ্তধন সেরকম কিছু না পেয়ে দলের বাকিরা তাকে হত্যা করে একটা ট্রেঞ্চে ঠেলে দিয়ে তাদের দলের লোকেরা পালিয়ে যায়। যদি হত্যা করে থাকবে তাহলে ওই মোটা সোনার হার ছেড়ে যাবে কেন? এই জায়গাটা ঠিক মিলছে না।
চোখ ফেরাতে দেখি একটু আগে যেখানে কবরে মাটি দিয়ে এসেছি সেই দিকে কেউ যাচ্ছে। মনে হচ্ছে আলখাল্লা পরা একটা কালো ছায়া ক্রমশ বড় হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সেই পায়ে-চলা পথের দিকে। চাঁদের সাদা আলোতে কালো ছায়াটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। এমনকি তার বীভৎস হিংস্র মুখ আর হাত-পায়ের নখগুলো যেন এগিয়ে আসছে আমাদের দিকেই, যেন খুঁজছে আমাদেরকে? আমি এবার চিৎকার করে ডাকলাম, “আন্টা সাবধান, চোখ খুলে দেখো কালো অশরীরী। আসছে, ও আসছে আমাদের কাছে।”
আন্টানিও তার হ্যামকে জেগে ওঠার আগেই দেখি একটা বিকট দর্শন কুচকুচে কালো পাখি মুখ হাঁ করে তার বিশাল ডানাদুটো ঝাপটাতে ঝাপটাতে আমাদের কান ঘেঁষে উড়ে গিয়ে ঝড়ে ভেঙে পড়া গাছটায় বসল।
ঠিক সেই মুহূর্তে একটা বড় ধুমকেতু আকাশে আলোর ফুলঝুড়ি ছড়িয়ে অদৃশ্য হতে তার পিছু পিছু তিন তিনটে তারা আকাশ আলো করে এগিয়ে গেল সেই পুব দিকে। সাথে সাথে নির্মেঘ আকাশে যেন বাজের আওয়াজ শোনা গেল।
আন্টানিও উত্তেজিত স্বরে বলল, “অ্যালস ওরা এল, দেয়ার দে কাম, লুক দেয়ার।”
আমি উদ্বিগ্ন গলায় বললাম, “কারা আন্টানিও? দেবতারা?”
আন্টানিও চাপা উত্তেজনার সুরে বল, “ড্যাম ইট! বুঝতে পারছ না? এই তিনটে ইন্ডিয়ান নেভির সি–প্লেন। আগেরটা অন্য কিছু হবে। সেটাকে ধাওয়া করে এরা গেল।”
“তুমি সিওর! ওটা প্লেন না আকাশের…’’
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই আবার পুর্বদিকে ছুটে গেল সেই আলোর ফুলঝুরি। তারপরই তিনটে ছুটন্ত তারা আর সেই আওয়াজ। এবার অনেক নিচু দিয়ে উড়ে যাওয়াতে স্পষ্ট বোঝা গেল এগুলো সি-প্লেনই, কোনও মিলিটারি মহড়ার অংশ হবে।
এরপরই এল জোর তুফান আর বৃষ্টি। তুফান থেকে বাঁচতে আমরা টিলার নেড়া জায়গাতে পৌঁছে গেছিলাম। ভোরের আলোতে দেখলাম যে আমাদের প্রবল ঝড়ে হ্যামক কোথাও উড়ে গেছে। দৌড়াতে দৌড়াতে সমুদ্রের কাছে দূরবীন দিয়ে তন্ন তন্ন খুঁজেও আমাদের নিরুদ্দিষ্ট বোটের কোনও সন্ধান পেলাম না। এই দ্বীপে এখন আমরা কার্যত যাবজ্জীবন বন্দি।
একটু পরে সব সামলে নিয়ে ঠান্ডাবুদ্ধিতে আমরা দুজনে স্থির করলাম যে এই দ্বীপ থেকে উদ্ধার পেতে হলে একমাত্র উপায় আমাদের ওই পশ্চিমের দিকে পাথুরে পাহাড়গুলোর চূড়ায় চড়তেই হবে। সেখান থেকে, রাত্রে আগুন জ্বেলে এস ও এস সংকেত দেওয়া হবে। রাত্রে সি প্লেনগুলো মহড়া দেবার সময় আমাদের সংকেত খুব স্পষ্ট করে নিশ্চয় দেখতে পাবে।
কাল শেষ বিকেল আর চাঁদনী রাতে হ্যামক থেকে এই পশ্চিম দিকে একটা বড়ো মাঠ আর জঙ্গলে ঢাকা একটা পায়ে-চলা রাস্তা দেখা গেছিল। পাহাড়ের দিকে যেতে গেলে এই রাস্তাতেই যেতে হবে। পায়ে-চলা রাস্তায় জঙ্গল পেরোতে গিয়ে দেখি যে জঙ্গল তো নয় এ যেন এক নানারকম ফলের বাগান। পেয়ারা, নাসপাতি আর কলার একটা ছোট কাঁদি এইসবে আমাদের একটা বড় হ্যাভারস্যাক প্রায় ভরে উঠলো। জঙ্গলের সুঁড়িপথে ঘন্টা খানেক চলার পর সেটি আবার একটি মাঠে পৌঁছে শেষ হয়ে গেল। মাঠ আসবার একটু আগে থেকেই দেখা যাচ্ছিল সারি সারি পাহাড় যেন দেওয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
মাঠের মধ্যে অনেক উঁচু উঁচু ছায়াদার গাছ আছে। সবেমাত্র কাঁধ থেকে বোঝাগুলো দূরে সরিয়ে রেখে একটা গাছের ছায়ায় দুজনে হাত পা ছড়িয়ে একটুখানি জিরিয়ে নেওয়া শুরু করেছি আর তখনি আমাদেরকে হতচকিত করে ঘটনাটা ঘটে গেল। সামনের গাছেই ছিল এক হনুমান পরিবার। তারা বিদ্যুৎগতিতে নেমে বেছে বেছে ফলভর্তি ঝোলাদুটি নিয়ে পালিয়ে গেল। আমরা চ্যাঁচানো ছাড়া আর কিছুই করতে পারলাম না।
আমরা ভেবেছিলাম একটু জিরিয়ে নেবার পর পেট ভর্তি করে ফলাহার করে পুরো এনার্জি নিয়ে পাহাড়ে চড়ব। এখন সেটা বেশ মুশকিল লাগছে।
মনে পড়ল কাল পড়ন্ত বিকেলের আলোতে একপাল বাঁদর দেখেছিলাম। বাঁদরের দল কী বুঝল কে জানে, দেখি একটু পর আমাদের খিদে তেষ্টার কথা বিবেচনা করে একটা ব্যাগ ফিরিয়ে দিয়ে গেল আর তাদের দলপতি দূরে একটা দিকে যাবার জন্য ইশারা করল।
আমি বললাম, “মনে হচ্ছে, ও চাইছে আমরা ওর সাথে কোনও দূরের জায়গাতে যাই। সেখান থেকে হয়তো পাহাড় চড়তে সুবিধে হবে। আমরা যে পাহাড়ে চড়তে চাই তা আমাদের হাবে ভাবে, ওরা বুঝে নিয়েছে।”
প্রায় ঘণ্টাখানেকের ওপর আমরা চলেছি। গাছে গাছে আরামে দোল খেতে খেতে আমাদের বন্ধুরা সপরিবারে বিনা বাধায় আর আমরা আগাছার জঙ্গল সাফ করতে করতে তার তলায় তলায়। একটা পায়ে-চলা পথ দেখা যাচ্ছে একটু দূরে।
কিন্তু ওই রাস্তাটাতে যেতেই দাঁত খিঁচিয়ে পথ আগলে এসে দাঁড়াচ্ছে কখনও দলপতি, কখনও তার বউ। আমি চারপাশে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করছি ওরা কেন ওই রকম করছে? কিন্তু কিছু বোঝা যাচ্ছে না। ঘন জঙ্গল প্রায় শেষ হয়ে এল। একটা পাহাড় পথ আগলে এসে দাঁড়িয়েছে। পাহাড় থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে জল পড়ছিল। একটু এগোতে দেখি আরও একটি পাহাড়ি ঝরনা এবং সেটা আগের তার চাইতে অনেক বড়। দুপুর হয়ে এল প্রায়। আমাদের গাইডেরা ঝরনায় গা ভিজিয়ে, ঝরনা পার করে পাহাড়ে চড়ছে আর আবার নিচে নেমেও আসছে। হতে পারে ওরা আমাদের ইশারা করছে পাহাড়ে চড়ে ঝরনাটা পার করতে।
ওই দিকে যে সত্যি বিপদ আছে তা বুঝলাম যখন প্রাণঘাতী বিপদটা সত্যি সামনে এল এবং সেটা একটা না, অনেকগুলো। পাহাড়ি ঢালে আমরা নেমে এগিয়ে যাচ্ছিলাম পায়ে-চলা রাস্তার দিকেই। ওই দিকে সামনে প্রায় হাঁটু সমান আগাছা আর ঘাস জঙ্গল। এটা পার করলেই এখান থেকেই দেখা যাচ্ছে পাহাড়তলির পরিষ্কার পায়ে-চলা পথ। আমরা তখন ঘাসবনের কাছে প্রায় ঢুকে গেছি। দেখি অন্যদিক থেকে একটা জংলি শুয়োর তাড়া করে আসছে আমাদেরই দিকে।
আমি চটজলদি রিফ্লেক্সে আন্টানিওকে এক ঠেলা দিয়ে সরিয়ে নিজেও বিদ্যুৎ গতিতে ঘাসবনের দিকে না এগিয়ে ব্যাক-ভল্ট জাম্প করলাম। শুয়োরটা, আমাদের এই দ্রুত দিক পরিবর্তন সামলাতে না পেরে ঘাসবনে ঢুকে পায়ে-চলা পথের দিকে এগিয়ে যেতেই কোথা থেকে বেশ কয়েকটা তীর এসে ফুঁড়ে দিল শুয়োরটাকে। মরণ-চিৎকার করতে করতে শুয়োরটা পায়ে-চলা রাস্তায় আসতে অন্য দিক থেকে শুরু হল তীর ধেয়ে আসা। শুয়োর লুটিয়ে পড়ল পায়ে-চলা রাস্তাটায়। এর মধ্যে আমরা দু’জনে একটা বড় গাছে চড়ে পুরো ব্যাপারটা দেখছি। ততক্ষণে হনুমান দলপতি আমাদের পাশের গাছটায় এসে আমাদের পায়ে-চলা রাস্তার দু’পাশের গাছগুলোর দিকে ইশারা করছে। বাইনো নিয়ে সেদিকে তাকাতে দেখি কয়েকটা গাছে মানুষ-পুতুলের মতো কিছু ঝুলছে। তাদের হাতে গুণ টেনে রাখা তীর-ধনুক।
দলপতি এবার অস্থির হয়ে জোরে জোরে হুপ–হাপ করতে করতে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে যেন আমাদের বলছে, “এসব কায়দা বোঝা তোদের কম্মো নয়।” এই বলে সেই গাছটা থেকে কয়েকটা বড় ফল দূরের গাছগুলোর দিকে ছুঁড়ে দিতেই দেখি গাছগুলো থেকে বেশ কয়েকটা মানুষ পুতুল তীর–ধনুক হাতে বেরিয়ে এসে পায়ে-চলা রাস্তায় তাদের গুণ টেনে রাখা ধনুক থেকে তীর চালিয়ে দিল। আমরা সেই দেখাদেখি গাছ থেকে ঘাসঝোপে কাঁধে ঝোলানো ধনুকে তীর লাগিয়ে বেশ জোরে গুণ টেনে ঘাস ঝোপে ছুঁড়তে দূর থেকে একটা তীর এসে আমাদের সামনের গাছে বিঁধলো আর বাকি তীরগুলো সব পায়ে-চলা রাস্তায় এসে সেখানে বিঁধে গেল। এক–দুটো এসে লাগল নিস্পন্দ শুয়োরটার গায়ে। আন্টানিও নিজের ব্যাকপ্যাক থেকে ব্যারেটো বের করতে যাচ্ছিল, আমি ইশারায় নিষেধ করলাম। চাপা গলায় ওকে বললাম, “এটা কোনও মানুষের পাতা তীরফাঁদ যার অন্য প্রান্তগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ঝোপ, পায়ে-চলা রাস্তায়, বা দু’পাশে গাছে ডালে। শক্ত–সমর্থ কোনও কিছু এগুলোকে নাড়া দিলেই পুতুল মানুষগুলোর হাতে তীর লাগানো ধনুকগুলোর গুণ টানাই আছে। সেগুলো থেকে বর্ষার মতো তীর ছুটে আসবে।
আন্তানিও ফিসফিসিয়ে বলল, “তাহলে তো সেই ফাঁদ পাতা মানুষটা এল বলে।”
আমি বললাম, “সেই মানুষটা ধারে–কাছে নেই। থাকলে সে এখানে এসে তার শিকারের খোঁজ করত।”
তবু সাবধানের মার নেই। মরার সময় শুয়োরটা একটা পা উঁচু করে পড়েছিল। আমি ব্যাগ থেকে শক্ত মাছধরা নাইলন দড়ি বার করে ল্যাসোর মতো ফাঁস বানিয়ে দূর থেকে ছুঁড়ে সেই পায়ে লাগিয়ে দিতেই দুজনে মিলে টেনে নিয়ে এলাম। কাছে নিয়ে এসে দেখি গুণ টেনে রাখা ধনুক হাতে একটা মানুষ পুতুলও সেই সঙ্গে আছে। তবে তার ধনুকে তীর নেই। হতে পারে এরই ধনুক থেকে তীর ছুটে এসে শুয়োরের বুকে বিঁধেছে।
মরা শুয়োরটাকে একটা গাছে টাঙিয়ে রেখে এবার হনুমানদের দেখানো পথেই চলতে শুরু করলাম। আন্টানিওকে গাছে ঝোলানো শুয়োরটা দেখিয়ে বললাম, “যাওয়ার সময় নিয়ে যাব। আজ ঝলসানো শুয়োরের মাংসে মুনলাইট পিকনিক জমবে ভালোই।”
পাহাড় শেষ হতেই এসে পড়লাম একটা ধু–ধু করা প্রকাণ্ড ফাঁকা মাঠে, যেটা হঠাৎ শেষ হয়েছে আর একটা ন্যাড়া উঁচু পাহাড়ে। বাঁদর পরিবার সেই মাঠ বেশ দ্রুত গতিতে পার হতে হতে এক–একবার পেছনে আমাদের দিকেও চেয়ে দেখছিল। আমরা শেষটায় একটু বসে পড়ি হাঁফ নেওয়ার জন্য।
এখান থেকে দেখা যাচ্ছে, আমাদের হনুমান গাইডেরা পাহাড়ের কাছেই এক জায়গায় গোল হয়ে বসে আছে। বাইনো লাগিয়ে দেখি পাহাড়ের গা দিয়ে একটা মোটা জলধারা বয়ে যাচ্ছে। গাইডের দল আমাদের দেওয়া কলা, ফলমূল আর জল দিয়ে তোফা টিফিন করে মাঝে মাঝে আমাদেরকে হাত তুলে তুলে হুপ–হুপ করে ডাকছে।
জল দেখে আমরা আর বসে থাকতে পারলাম না। সঙ্গের বোতলের গরম জলে প্রাণের দায়ে একটু আগে সামান্য গলা ভিজিয়েছি মাত্র। এই বাঁদরের দল ওদের এই কন্ডাক্টেড ট্যুরে কতগুলো নেড়া পাহাড় আর এই ছুটকো জলধারাই দেখাতে নিয়ে এসেছে নাকি?
পাহাড়ি মিষ্টি জল খেতে এতটাই ব্যস্ত ছিলাম যে চোখের সামনের জিনিসগুলো দু–দুটো মানুষের নজরে আসেনি। এতক্ষণে দেখি যে পাহাড়ের কোল জুড়ে ছোট–বড় অনেকগুলো চৌকো চৌকো ট্রেঞ্চ কাটা আছে। পাহাড়ের একদম গোড়াতেই একটা খোলা গুহা। আমাদের গাইড দলপতি হনুমান বারবার সেখানে যেতে ইশারা করছে, কিন্তু নিজে যাচ্ছে না। গাইডের এই আচরণ আমার ভালো লাগল না। ওরা এখানকার স্থানীয়। যদি কোনও বিপদ নেই, তবুও নিজে না গিয়ে আমাদেরকে যেতে ইশারা করছে কেন?
এই রকম অজানা গুহাতে প্রবেশের আগে কী কী করা উচিত তা করার জিনিসপত্র খুব সামান্য পরিমানে সৌভাগ্যক্রমে আমাদের ব্যাকপ্যাকে আছে।
ব্যাকপ্যাক দুটো নামিয়ে, বাজিগুলো আর ডিজেলে ভেজা মশাল বার করলাম। এই বাজিগুলো জঙ্গল বিট করার সময় জংলি প্রাণীগুলোকে ভয় পাইয়ে তাড়ানোর জন্য ব্যবহার করা হয়। বাজি আর মশাল দেখেই দলপতি গাইড তার পরিবারকে সরে যাওয়ার ইশারা করে নিজেও সরে গেল।
হতে পারে, গুহাতে কিছু মূল্যবান জিনিস লুকিয়ে রাখা আছে। এর আগে এখানে যে অনেক মানুষের দল এসেছে, তারা পাহাড়ের কোলে এতগুলো ট্রেঞ্চ আর একটা বড়োসড়ো মানুষের হাতে পাথরকাটা গুহা, কি এমনি এমনি এইসব করেছে? আমাদের আগেও কেউ বা কোনও দল কি এই পরিত্যক্ত কিন্তু কোনও কারণে মুল্যবান এই গুহার খবরটা জানত? কি এমন বহুমূল্য জিনিস আছে এই গুহাতে যার জন্য দফায় দফায় লোক এসেছে এইখানে? একটা ঠাণ্ডা স্রোত মেরুদণ্ড বেয়ে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ল।
আন্টানিও উদ্বিগ্ন গলায় বললে, “এই বাঁদরের দল কিন্তু তাদের সব কার্যকলাপ মনে রেখেছে। তারা জানে যে এখানে যারা আসে তারা এখানে আসবে। গাইডের দল আমাদের বোধহয় এইজন্য দেখাতে চাইছে? না এতে আরো অন্য কথা আছে।” অনেক সময় খুব দরকারি কথা পশুপাখিরা আকার–ইঙ্গিতে বলতে চায় আমাদের, কিন্তু আমরা বুঝতে পারি না।
সবমিলিয়ে এই গুহাটা আমাদের দু’জনেরই মনে একটা কৌতূহল জাগিয়ে কেন জানি টানছে ভেতরে যাওয়ার জন্য। আমরা দু’জনেই ঠিক করলাম যাব, তবে হঠকারিতা বাদ দিয়ে। গুহার ভেতরে জঙ্গল বিট করার বিকট আওয়াজের এই বাজিগুলো ফাটলেই অনেক কিছু দেখা আর বোঝা যাবে।
বড় সলতের এই বাজিগুলোতে আগুন লাগিয়ে ছুঁড়ে ফেলতে হয় একটা বিশেষ কায়দায়। সেটা করতেই বাজির বিকট আওয়াজে দূর গাছে থাকা হনুমানের দলও সচকিত হয়ে একটু আরও দূরের গাছে পালিয়ে গেল। আমরাও গুহা থেকে দূরে একটা ঝোপের আড়ালে থাকলেও হাতের কাছে ব্যারেটো দুটো রেডি রেখেছিলাম।
কিছুক্ষণ পরে গুহা থেকে বেরোতে দেখলাম শুধু ধোঁয়া আর সালফারের কটু গন্ধ। বেশ কিছু বাদুড় ছাড়া আর কেউ বেরিয়ে এল না। গুহাতে বিষাক্ত গ্যাস থাকলে তা সালফারের ধোঁয়াতে কমে গেল আর বাদুড় বেরিয়ে আসাতে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল যে গুহাতে সাপ নেই। সাপের কাছে, নেউলের চাইতে বাদুড় আরও ভয়ানক।
আমরা আধঘণ্টা সময় গুহার বাইরে অপেক্ষা করছিলাম আর দুই বন্ধুতে ঠিক করে নিচ্ছিলাম গুহার ভেতরে কী কী জিনিস সামনে এলে আমরা কীভাবে নিজেদের বাঁচাব।
গুহার প্রবেশের পথ বেশ সরু। ঠিক গুহার মুখে এসে আন্টানিও থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। আমি অধৈর্য্য হয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম, “আবার কি হল দোস্ত? আমাদের ফিরতেও হবে।” ও আমাকে ইশারায় সামনে ডেকে আনল।
গুহার মুখে টর্চ ফেলতেই, আমি দেখলাম একটা বীভৎস আকৃতির করোটি যেন আমাদের দিকে চেয়ে আছে। কাল সেই ট্রেঞ্চে শোয়ানো নরকঙ্কালের করোটির কাছে যে হারটা তার পেনড্যান্টে হুবহু এই করোটি মীনে করা ছিল। “তাহলে এই করোটি কি কোনও দস্যুদলের চিহ্ন?” আমি বললাম “ এটা সম্ভব এবং ওই কঙ্কাল হয়তো সেই দলের সর্দার যার গলায় এই করোটি মীনেকরা পেনড্যান্টের মোটা সোনার হার ঝুলতো।” আন্টানিও বলে, “মনে হচ্ছে চুক্তির খেলাপ করার জন্য একে অতর্কিতে আক্রমণ করে ট্রেঞ্চে ঠেলে দিয়েই তারা পালিয়ে যায়। হারটা খোলবার হয় সময় পায় নি নয়তো এই সোনার হার নিয়ে নিজেদের মধ্যে আবার গন্ডগোল বেঁধে যেতে পারে এই আশঙ্কায় তারা তাদের সর্দারের গলা থেকে না খুলেই চলে গেছে। আমি বললাম, “তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়াল? তারা কোথাও থেকে সন্ধান পেয়ে এই দ্বীপে এসে, অনেক জায়গায় ট্রেঞ্চ করেছে এবং শেষটায় এই করোটি গুহা খুঁড়েছে।”
আমি বললাম, “আমার মনে হয় এইখানে তারা কিছু ধনরত্ন পায় এবং এরপরই সর্দারের সঙ্গে তাদের হাতাহাতি লেগে যায়।”
আন্টানিও মাথা নেড়ে বলে, “আমরা এখানে এসেছি এই করোটি গুহার মাথায় যে সবচাইতে উঁচু পাহাড়চুড়ো আছে সেখানে পৌঁছানোর রাস্তা খুঁজতে। শিখরে পৌঁছে সেখান থেকে আজ রাত্রে মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া ফাইটার প্লেনগুলোকে খোলা আগুন দিয়ে এস ও এস সিগন্যাল পাঠাতে পারি। এইসব ধনদৌলত যেখানে থাকার থাকুক। এইসব যে কি রকম বিবাদের জড় হতে পারে তা আমরা কাল নিজের চোখেই দেখেছি।”
আমি বললাম, “ঠিক সেইজন্যই আমাদের সুড়ঙ্গের ভেতরে যাওয়া উচিত।” আন্টানিও বিস্ময়ের সুরে বলে, “এর মানে? আমি তো কিছুই বুঝছি না।” আমি বলি, “আমি কিছু একটা আন্দাজ করছি। তুমি একটা জিনিস ভেবে দেখ। এই বহু পুরানো সুড়ঙ্গ থেকে কোনও ভ্যাপসা গন্ধ বা পচা হাওয়া আসছে না। আমাদের পটকাগুলোর কটু বারুদের গন্ধ কয়েক মিনিটের মধ্যে সাফ হয়ে সেখান থেকে এখন টাটকা হাওয়া আসছে।”
আন্টানিও মাথা নেড়ে বলে, “হ্যাঁ, সেটা একদম ঠিক। কিন্তু তা দিয়ে কি প্রমান হয়?” আমি বলি, “বন্ধু হতে পারে গুপ্তধনের অনুসন্ধানে সেই দস্যুদের একটা দল পাহাড়চুড়োতে পৌঁছে ট্রেঞ্চের বদলে দিনের পর দিন একটা গভীর হেলানো কুয়ো খুঁড়েছিল। তাদের অন্য একটা দল তখন এইখানে সুড়ঙ্গ খুঁড়ছিল। হেলানো কুঁয়ো আর অনুভূমিক সুড়ঙ্গ যেখানে মিলেছে সেইপথে পাহাড়চুড়ো থেকে হাওয়ার স্রোত এই সুড়ঙ্গে এখনো ঢুকছে ঠিক যেমন বাড়ির ঘুলঘুলিতে হয়।”
আন্টানিও লাফিয়ে ওঠে, “বন্ধু, তোমার বুদ্ধির প্রশংসা করি। আমি উত্তর গোয়ার এক খনিতে এইরকম কুঁয়ো দেখেছি যার গায়ে পাশাপাশি দু তিনটে সিঁড়ি লাগানো থাকে। আমি বলি, “বন্ধু আমি শুধু আন্দাজ করছি মাত্র। ভেতরে ঢুকলেই সব পরিস্কার হবে।”
গুহার ভেতরে গিয়ে টর্চ জ্বালতেই, আমরা দেখলাম এটা যেন আর একটা স্টোর। গুহার দুই দেওয়ালে সারি সারি তাক। তাতে বড়ো বড়ো বেলচা, চিজেল, হাতুড়ি, গাঁইতি, নানা সাইজের শাবল, স্প্যানার, চেন ব্লক, পুলি রয়েছে। মোটামুটি যেন একটা ছোটখাটো ওয়ার্কশপের স্টোর। ভেতর হু–হু করে টাটকা হাওয়া ঢুকছে। আলো ফেলে দেখা যাচ্ছে যে আর এগোনো যাবে না। গুহার ছাদ থেকে পাথর পড়েছে কিম্বা অন্য জায়গা থেকে পাথর এনে সেখানে স্তূপ করে রাখা হয়েছে।
পাথরের স্তুপ টপকে যতটা সম্ভব যাওয়া যায় আমরা এগিয়ে গেলাম কাছে আসতে চোখে পড়ল গুহার ডানদিকে একটা হেলানো সিঁড়ি রাস্তা ওপরের দিকে চলে গেছে। হু হু করে হাওয়া সেখান থেকেই আসছে। পুরোটা কালো রাবার পেন্ট করা আর দু’ধারে রেলিং দেওয়া সিঁড়িটার ধাপগুলো লোহার পাতের।
আমরা দু’জনে পরস্পরকে থাম্বস আপ করে সিঁড়ি ধরে উঠতে শুরু করলাম। কিন্তু কিছুটা গিয়ে দেখি সেখানে আবার একটা ঘরের মতো জায়গা আছে। সিঁড়ি সেইখানেই শেষ। তবে কি ঘরের ভেতর কিছুটা গেলে আবার সিঁড়ি আছে? কেন না সেখান থেকে আরো হাওয়া ঢুকছে।
এই পাথরগুলো সরিয়ে রাস্তা করতে গেলে নিচে গিয়ে সেই স্টোররুম মতো জায়গা থেকে শাবল আর বেলচা নিয়ে আসতেই হবে। নিচে গিয়ে সবেমাত্র আমরা বেলচা বার করা শুরু করেছি এমন সময় একটা জোর অঘটন ঘটলেও আমরা দুজন শেষটায় প্রাণে বেঁচে গেলাম।
আমাদের সামনেই একটা বড় র্যাকে অনেকগুলো বড় বড় প্যাকেটের পেছনে লম্বা কয়েকটা বেলচা দেখা যাচ্ছিল। পাশের র্যাক থেকে একটা বড় শাবল নিয়ে প্যাকেটগুলো আন্তানিও খোঁচা মেরে সরাবার চেষ্টা করছিল।
হঠাৎ একটা প্যাকেট পড়ল আমার গায়ে। আর তার পরেই আরও কিছু প্যাকেট। আমি হুমড়ি খেয়ে আন্টানিওকে নিয়ে মাটিতে গড়িয়ে পড়লাম। এই সময় গুহার মুখ দিয়ে হু–হু করে সমুদ্রের বুক থেকে ঝড়ের হাওয়া বইতে লাগল আর সেকেন্ডের কম ব্যবধানে পর পর তিনবার পুরো গুহাটা কে যেন কাঁপিয়ে দিল।
আমরা দু’জনে একসঙ্গে মাটিতে শুয়ে বলে উঠলাম, “ভুমিকম্প! ভুমিকম্প হচ্ছে।” গুহার বাইরে দৌড়ে পালানোর জন্য চেষ্টা করতে গিয়ে দেখি গুহার সামনের মুখ পাথর পড়ে বন্ধ হয়ে গেল।
সেইসময় সামনের তাকগুলো থেকে সব জিনিস গড়িয়ে গড়িয়ে নিচে পড়তে শুরু করল। আমরা দু’জনে যে যেমন পারি উঠে লাফ দিয়ে গুহার অন্য দেওয়ালের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। ওই দিকে পৌঁছাতে শুনি আন্টানিওর আর্ত চিৎকার, “ওহ! জেসাস! অ্যালেক্স লুক দেয়ার, লুক! দেয়ার! ইট হ্যাংগস দেয়ার।”
সেকেন্ডের ভগ্নাংশে ওর কাছে পৌঁছে দেখি আন্টানিও ভয়ে ঠক ঠক করে কাঁপছে আর ওর চোখের দিকে চেয়ে এবার আমি দেখতে পেলাম।
আমাদের উল্টোদিকের দেওয়ালের র্যাক এবং তার জিনিসগুলো নিচে পড়ে যাওয়াতে সেটা খালি হয়ে গেছে। সেখানে এবার দেখা যাচ্ছে একটা আস্ত নরকঙ্কাল দুলছে আর যেন থেকে থেকে আমাদের দিকে এগিয়ে এসে আবার যেন পিছিয়ে যাচ্ছে। আমরা দু’জনে এবার একসাথে ফ্ল্যাশ লাইটের আলো সেদিকে ঘোরাতে পাথর পড়ে আমাদের হাতের ফ্ল্যাশ লাইট দুটো ছিটকে কোথায় যেন চলে গেল।
গুহাতে এত অন্ধকার নেমে এল যে আমরা দু’জন পাশাপাশি থেকেও কেউ কাউকে দেখছি না। একি! আমি এত জোরে ডাকছি, “আন্টা! আন্টা! হেল্প! হেল্প!” কোনও সাড়া নেই। কোনও উপায় না দেখে আমি এগিয়ে যেতে কি যেন শীতল একটা আমাকে চেপে ধরল! আমি ছাড়াতে যাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে বুঝলাম যে ওই শীতল দুটো জিনিস আসলে শক্ত হাড়ের দুটো হাত এবং তা আমাকে চেপে ধরে আমার গলার দিকে এগোচ্ছে। আমি শরীরের সব জোর দিয়ে সেই হাত দুটো থেকে কোনও মতে ছাড়াবার চেষ্টা করলাম এবং তার পর আমার আর কিছু মনে নেই।
জ্ঞান ফিরে এলে দেখি আমি গুহার মাটিতে শুয়ে আছি, সামান্য দূরে আন্টানিও তখনও অজ্ঞান। একটু আগে ভুমিকম্পে গুহার মুখ যে পাথরগুলো বন্ধ করে দিয়েছিল কে তাদের সরালো? গুহাতে এখন আগের মতো আলো আছে। একটু খুঁজতেই আমাদের দুজনেরই টর্চ দুটো খুঁজে পেলাম।
আন্টানিওর মুখে চোখে ব্যাকপ্যাকে রাখা ফ্লাস্ক থেকে জল ছিটিয়ে দিতে, ও সুস্থ হয়ে উঠল। উল্টোদিকের দেওয়ালে টর্চের আলো ফেলতে দেখা গেল যে সেখানেই সব শেলফগুলো নিচে পড়ে আছে।
একটা জায়গায় আলমারি রাখার মতো জায়গা দেখা যাচ্ছে আর ওই তো! ওই তো সেই কঙ্কালটা ঝুলছে। ভালো করে আলো ফেলতে দু’জনেই দেখলাম কঙ্কালের করোটির তলায় একটা ম্যানিলা দড়ির ফাঁস লাগানো আছে আর ঠিক সেইখানটাতে কী যেন একটা চক–চক করে উঠছে। কঙ্কালের কাছে গিয়ে দেখলাম হুবহু কালকের দেখা সেইরকম সোনার হার শুধু তার পেনড্যান্টটা অনেক বড়ো। পেনড্যান্টের সামনে মীনে করা পেছনে একটা কিছু লেখা।
লেখাটা পড়ে আন্টানিও বললে, লেখা আছে “চন্দ্রণ”। নামটা আমি একটু জোরে চেঁচিয়ে বললাম, আর তার সাথে সাথে সিঁড়ি রাস্তা আর গুহামুখ থেকে আবার একটা তুফানি ধুলোর ঝড় উঠল আর কয়েক সেকেন্ডের জন্য আবার একবার ভুমিকম্পও হল। ধুলোতে আমাদের চোখ বন্ধ করেছিলাম এক মিনিটের মতো। চোখ খুলে দু’জনে এবার চিৎকার করে উঠলাম। এ আমরা কী দেখছি! এইটুকু সময়ের মধ্যে এটা কী করে সম্ভব? কঙ্কাল আর দেখা যাচ্ছে না। তবে কি আমরা যা দেখলাম তা অন্য কিছু?
আন্টানিও মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারে। ও বলল, “দোস্ত, হতে পারে যে দমকা হাওয়া আর ভুমিকম্পে দড়ি ছিঁড়ে কঙ্কালটা এখানেই কোথাও আছড়ে পড়েছে। চল খুঁজি।” আমি সাহস ফিরে পেয়ে বললাম, “চলো এই গুহার চারদিকে আলো ফেলি, থাকলে দেখা যাবে।”
এত বিপদেও ও হেসে ফেলল, “আরে দোস্ত, থাকলে মানে? আছেই তো সেটা।”
আর ওর কথাকেই সত্যি প্রমাণ করে আমার ফ্ল্যাশ লাইটের আলো গুহার সিঁড়ি রাস্তার দিকে ফেলতে কি একটা চমকে উঠল। দু’জনে সেদিকে কাছে গিয়ে দেখি ঠিক সিঁড়ির রাস্তার শুরুতেই সেই কঙ্কাল পড়ে আছে। তার ডান হাতটা সেই সিঁড়ির দিকে ঝুলে। দেখে মনে হবে যেন সিঁড়ির দিক করে কি যেন দেখাতে চাইছে কঙ্কালটা! তার সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে দেখি গলায় সেই সোনার অটুট লকেট, তাতে লেখা আছে ‘সুন্দরম’।
একটু আগে এইটাই তাহলে ফ্ল্যাশ লাইটের আলোতে চকচক করেছিল। তার গলায় কি ফাঁস লাগিয়ে হত্যা করে এই গুহার দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখা হয়েছিল? তবে কি সেটা আড়াল করতেই এই শেলফগুলো বানানো হয়েছিল? কিন্তু কেন? গুপ্তধনের সন্ধান সে শেষ পর্যন্ত দিতে পারেনি, এর জন্য?
আন্টানিওর আহ্বানে আমার চিন্তায় বাধা পড়ল, দেখি কঙ্কালের ডানহাতটা যে দিকে দেখাচ্ছিল সেইদিকে ও এগিয়ে গিয়ে একটা ঝুলন্ত সিঁড়ি চড়ে এগিয়ে গেছে। ঐখান থেকে ও চেঁচিয়ে বলছে, “দোস্ত, এই দিকে একটা ছোট গুহা আছে আর তুমি এলেই দারুন কিছু দেখতে পাবে।” ও গুহাতে ঢুকে গেলে আমি আর দেরি না করে চটপট পৌঁছে গিয়ে সব দেখে অবাক হয়ে গেলাম।
সিড়ির শেষ ধাপে এসে দেখি পাথর কেটে পর পর দুটো থামওয়ালা একটা বেশ বড়ো চত্বর বানানো হয়েছে। থামগুলো পার করেই দেখি এক নয়ন মনোহর দৃশ্য। চত্বরের মধ্যেই মন্দিরের মতো গর্ভগৃহ বানানো হয়েছে যার বাম প্রান্তে শিবের শ্বেত মূর্তি, তাঁর ডানদিকে রাজবেশে বুদ্ধ আর মাঝখানে এক বিশাল আকৃতির শিব লিঙ্গ যাতে দু’জনের হাত স্পর্শ করে আছে। এইখানে মাঝে মাঝে আলো চমকে চমকে আসছে। এই পাতালপুরীতে আলো কোথা থেকে আসছে। ব্যপারটা কি কৌতূহলী হয়ে গিয়ে দেখি এক কোণ থেকে সূর্যের আলো আর হু হু করে হাওয়া আসছে। আন্টানিও আমাকে দেখাল সেখানে কোনও স্ফটিক লাগানো আসছে যা লেন্সের মতো মাঝে মাঝে সূর্যের আলো ফেলছে আর সেইসময় সেই আলোর এক অংশ নিচে রাখা কাঠের গুঁড়ির ওপর পড়তেই সেখানে ধোঁয়া উঠছে। এই কাঠগুলো জুনিপার হতে পারে। পরিবেশ দেখে মনে হচ্ছে কেউ এইমাত্র পুজো সেরে ফিরে গেছেন।
ভালো করে লক্ষ্য করে দেখি আলো আসছে রাজবেশী বুদ্ধের মাথার মুকুট থেকে। আন্টানিও বললে, “হতে পারে এঁর মাথার মুকুটে বড়ো হীরে লাগানো আছে। গর্ভগৃহের বাইরের বারান্দায় দরজার পাল্লার মতো কিছু দেখা যাচ্ছে। আমারা দু জনে সেটা টানতেই দেখলাম সেটা আসলে একটা আলমারি আর সেখানে রয়েছে অনেকগুলো হীরে বসানো মুকুট আর সোনার অলংকার। হতে পারে এই সেই গুপ্তধন যা হয়তো কোনও রাজা বা সমুদ্রবানিজ্য করে ফেরবার পথে কোনও সদাগর এইগুলি মন্দিরের দেবতাদের দান করে গেছেন।”
এই জায়গার ঐশ্বরিক অনুভূতিতে আমরা দু’জনেই বারবার আনন্দে শিহরিত হচ্ছিলাম। স্বর্ণালংকারের প্রাচুর্য্যে আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দিলেও আমরা স্থির করলাম যে, ঈশ্বরের এই সম্পদ যে স্থানে থাকবার কথা সেইখানেই থাকুক।
গুপ্তধনের লোভে কেউ যেন আর এখানে পা না দেয় চোখ বন্ধ করে তাঁদের জিগ্যেস করলাম। মনে হল রাজবেশী বুদ্ধ আর দেবাদিদেব মহাদেব দু’জনেই যেন মৃদু হাসছেন। এইসময় আমি আবার শুনতে পেলাম সেই স্পষ্ট মেঘমন্দ্র গলা, ‘অ্যালেক্স’। মনে আর কোনও দ্বিধা না রেখে দু জন্যেই নেমে এলাম গুহাতে। সুন্দরমের দেহাবশেষ ঠিক সেইভাবেই শোয়ানো শোয়ানো ছিল।
আমরা স্থির করলাম সুন্দরমের এই দেহাবশেষকে এইখানকার জল–হাওয়া মাটির সাথে মিলিয়ে দিয়ে, যথাসম্ভব সৎকার করব তাকে। এই গুহার বাইরে যে উদ্দেশ্যেই হোক বেশ কিছু লম্বা চওড়া ট্রেঞ্চ কাটা আছে। সুন্দরমকে সেখানেই সমাহিত করবার উদ্দেশ্যে তার কঙ্কালদেহকে আমরা কাঁধে করে গুহার বাইরে এলাম।
করোটি গুহার বাইরে এসে বুঝলাম যে ভূমিকম্পে গুহার মুখ বন্ধ করে রাখা পাথরগুলো যারা সরিয়েছে তারা আমাদের গাইড ফ্যামিলি। গুহার মুখের অদূরেই তারা গোল হয়ে বসে ছিল।
আমাদেরকে একটা আস্ত কঙ্কাল নিয়ে বাইরে বেরোতে দেখে ভেবেছিলাম আমাদের গাইড পরিবার ভয়ে পালাবে। কিন্তু দেখি ওরা আমাদের পিছু পিছু আসছে। কঙ্কাল নামিয়ে রেখে আমরা দুই বন্ধু পাশের ট্রেঞ্চগুলোর চারপাশে জমে থাকা মাটি নিয়ে আসতে গিয়েছিলাম। আন্তানিও আমাকে কিছু একটা দেখার ইশারা করল।
দেখি এর মধ্যে পুরো গাইড পরিবার আশেপাশের গাছগুলো থেকে কিছু জংলি ফুল নিয়ে এসেছে আর সেই ফুল প্রথমে দিচ্ছে তাদের দলপতি। আমরা যেন কিছু দেখিনি এই ভান করে মাটি জোগাড় করতে লাগলাম।
কিছু পরে কঙ্কালকে কবরে নামিয়ে আবার দূরে সরে এলাম। দূরের মাটি–পাথরের আড়াল থেকে দেখলাম এক অবিশ্বাস্য দুর্লভ দৃশ্য।
আমাদের আনা মাটি ছাড়াও ওরা নিজেদের চেষ্টাতেও কিছু মাটি আনতে পেরেছে। কবরের চার পাশ ঘিরে ওরা এক এক করে কঙ্কালের উদ্দেশ্যে মাটি ফেলে সবাই সরে গেল ধীরে ধীরে। হয়ত আমাদের বুঝিয়ে দিয়ে গেল এই নির্জন দ্বীপে ওরাই ছিল প্রয়াত সুন্দরমের একমাত্র কাছের লোক। সুন্দরমের শেষ কাজ করার জন্য ওরা শুরু থেকে বুঝতে পেরেছিল আমরা ওদেরকে সাহায্যই করব। মানুষ ছাড়া বাকি প্রাণীদের অনুমান শক্তি প্রবল হয়। অস্ত যাওয়া সূর্যের আলোতে এই সত্যটা আমাদের সামনে উজ্জ্বল হয়েই রইল।
ধু ধু করা যে মাঠ পার হয়ে আমরা করোটি গুহাতে ঢুকেছিলাম সেটি আসলে এক ছোট মালভূমি। তার পশ্চিমদিকের সীমানায় যেতেই চোখে পড়ল সেখান থেকে নেমে গেলেই সামনেই বেলাভূমি আর নীল সাগর। অস্তগামী সূর্যকে বাইনোকুলারে ধরতে গিয়ে অদূরে একটা বড়ো জাহাজ ফোকাসে এল। আমি আনন্দে লাফিয়ে উঠে বাইনোকুলার আন্টানিওকে ধরিয়ে দিলাম।
সূর্য ডুবে যাবার আগে আমরা প্রচুর কাঠকুটো জোগাড় করে এই পশ্চিম প্রান্তের জায়গায় জায়গায় আমরা জমা করেছিলাম। সন্ধের অন্ধকার হতেই, আগুন দিয়ে অনেক এস ও এস সংকেত বানানো হয়েছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই জাহাজ থেকে সার্চলাইটের মোর্স কোডে তাঁরা আমাদেরকে উদ্ধার করবেন জানালেন তবে সেজন্য কাল ভোরের এল ফোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। সূর্যের আলো আকাশে আসতেই দুটি সেসনা স্কাই ওয়াগন আমাদেরকে দেখতে পেয়েই স্ট্যাটিক হয়ে সিঁড়ি নামিয়ে দিল।
এই অজানা দ্বীপ থেকে বিদায় নেবার আগে আমাকে সব বিপদ থেকে যিনি উদ্ধার করেন আর আমাকে গুরুগম্ভীর স্বরে “অ্যালেক্স” বলে ডাক দিয়ে জানিয়ে দেন যে তিনি আমার সঙ্গেই আছেন তাঁকে নতজানু হয়ে ধন্যবাদ জানালাম।
(লেখক পরিচিতি 50 শব্দে : লেখালিখির শুরু কিশোর বয়েসে যা স্কুল ম্যাগাজিন এবং বিভিন্ন স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। পরবর্তী জীবনে খনিজ অনুসন্ধানের পেশার কারনে অরন্যে ও পাহাড়-পর্বতে বেশিটা কাটিয়েছেন বলে, লেখাতে অভিযান এবং রোমাঞ্চকর বিষয়ের প্রাধান্য রয়েছে। লেখাগুলি প্রকাশিত ও পুরস্কৃত হয়েছে কিশোরভারতীতে, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ফেস বুকের একাধিক গ্রুপে। প্রকাশিত উপন্যাস এবং গল্পসঙ্কলন চারটি।)