প্রতিদিনের মত আজকেও পার্কের বাগানে হাঁটছিলাম। সেখানে সিমেন্টের এক বেঞ্চে বসে তিনি করম্যাক ম্যাকার্থির কবিতা পড়ছিলেন। তার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়, তিনি আমার হাত ধরে জানতে চাইলেন, “তুমি আকিফ রহমান না? আমি মাহবুব মাইসুর।”
সমস্যা হল, আমার নাম ‘আকিফ ইসলাম’, ‘আকিফ রহমান’ না।
আমি হেসে বললাম, “আপনি আর কারও সাথে আমাকে গুলিয়ে ফেলেছেন নিশ্চয়ই!”
এই কথা শুনে, গোল ফ্রেমের পিছনে থাকা তার গভীর কাল চোখ এমন ভাবে প্রসারিত হল যেন আমি তাকে অপমানজনক কোনও কথা বলেছি।
হঠাৎ করে বাগানের ফুলগুলো ঝরে পড়তে শুরু করল। বুনো হাওয়া উড়ে বেড়ানো সুন্দর নীল পাখিগুলোকে কুৎসিত কোনও বস্তুতে রূপান্তরিত করে মাটিতে আছড়ে ফেলে দিল। চোখের পলকেই পার্কের এই সুন্দর বাগানটি একটা মৃত্যুপুরীতে পরিণত হল।
ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে আমার ঘুম ভাঙল। উফ! সেই একই দুঃস্বপ্ন। বাথরুমে গিয়ে টুথব্রাশে টুথপেস্ট লাগাতে গিয়ে বুঝতে পারলাম, আমি এখনও কাঁপছি। এই দুঃস্বপ্নের কথা ভাবতেই মনে হচ্ছে, আমাকে কেউ কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে জড়িয়ে ফেলছে।
“আকিফ!” রান্নাঘরের ওদিকটা থেকে আমার স্ত্রীর কণ্ঠ শুনতে পেলাম।
“হ্যাঁ, রাইদা, বল।” আমি বাথরুম থেকেই হাঁক ছাড়লাম।
“তোমার নাস্তা রেডি হয়ে গেছে। খেতে এসো।”
তার কোনও ধারণাই নেই আমার এই দুঃস্বপ্নের ব্যাপারে। তাকে কী-ই বা বলব! কাউকেই এ ব্যাপারে কিছু বলিনি এখনও।
কোথা থেকে শুরু করব? কোথায় গিয়ে শেষ করব? পুরো স্বপ্নটাই এত এলমেলো!
একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে, আমি ব্রাশ করতে শুরু করলাম। মনের অজান্তেই হেসে উঠলাম, আমার দাঁত এখনও আছে, তা দেখে। ঐ মাহবুব মাইসুরের থেকে যখন আমি দৌড়ে পালাচ্ছিলাম, তখন আমার দাঁতগুলো খুলে পড়তে শুরু করেছিল। মুখের মধ্যে রক্তের নোনা স্বাদ পাচ্ছিলাম। হেহ! আর এদিকে বিজ্ঞানীরা বলেন, স্বপ্ন নাকি স্বাদ-বর্ণ-গন্ধহীন। তারা মনে হয় কোনওদিন স্বপ্নই দেখেননি! অন্তত দুঃস্বপ্ন দেখেননি, এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত।
“তুমি ঠিক আছো তো? তোমাকে কেমন দেখাচ্ছে যেন!” টেবিলে খাবার পরিবেশন করতে করতে, রাইদা জিজ্ঞেস করল।
“হুম।”
“সকালে উঠে আয়না দেখেছ? তোমাকে কত বিবর্ণ দেখাচ্ছে!” রাইদা চিন্তিত সুরে বলে।
আমার ছোট্ট ‘হুম’ তাকে আশ্বস্ত করতে না পারায়, এবার একটু লম্বা করে বললাম, “আমি ঠিক আছি। সবকিছু আবার ঠিক হয়ে যাবে।”
“তোমার ডাক্তার দেখানোটা জরুরি হয়ে পড়েছে।”
এই কথাটা সে ক’দিন থেকেই বলছে। আমিই গুরুত্ব দিচ্ছি না।
সে বলতে থাকে, “আর মা-ও চিন্তা করছিল। বলছিল, জামাইয়ের আবার এত কম বয়সে কোন রোগে ধরল! মায়েদের মন, বুঝোই তো।”
রাইদা ও আমি পালিয়ে বিয়ে করি। পাঁচ বছর হল। আমার শ্বশুর-শাশুড়ি এতদিনে আমাদের সম্পর্কটাকে মেনে নিলেও, আমার উপর তারা কখনোই খুশি হতে পারেন না। হাজার হোক তাদের মেয়েকে আমি ভাগিয়ে এনেছি। অবশ্য প্রেম করার সময় আমাদের মধ্যে যে ফ্যান্টাসি ছিল, এখন আর তা নাই। তবে আমাদের সম্পর্ক এখনও কার্যকরী ও নির্ভরযোগ্য আছে।
আমি কোনও উত্তর দিচ্ছি না দেখে, রাইদা তার কথা চালিয়ে যেতে থাকে, “ডাঃ সাঈদ চেম্বারে আজ একটু তাড়াতাড়ি ডেকেছেন।”
ডাঃ সাঈদ শহরের নামকরা ডেন্টিস্ট। রাইদা তাঁর পারসোনাল চেম্বারে এসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করে। সে তার কাজের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ বলা যায়।
এই মিষ্টি সকালের গাম্ভীর্য কাটাতে আমি মজা করে বললাম, “বাহ! ভালই তো! আজকের অতিরিক্ত টাকাটা আমরা তাহলে ডাক্তার দেখাতে খরচ করতে পারি।”
রাইদা কপট রাগের ভান করে বলল, “তুমি না… “
কিন্তু আমার মুখ ভেঙচান দেখে, কথা শেষ না করেই সে হেসে ফেলল।
অবশ্য সত্যটা হল ওর মাইনে আমার চেয়ে বেশ অনেকটা বেশি। তবে এ নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নাই। আমি এক মাল্টিন্যাশনাল ব্র্যান্ডেড কোম্পানির স্থানীয় ব্রাঞ্চের এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হিসেবে আছি। একনিষ্ঠ আনুগত্য ও বিশ্বাসযোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও, সাত বছর ধরে আমার বেতন এক পয়সাও বাড়েনি। আমাদের ব্রাঞ্চের ম্যানেজার রিটায়ার্ড করার পর, তার ছেলে ম্যানেজারের দায়িত্ব পায়। যদিও সে বয়সে আমার ছোট কিংবা সমান, তারপরও সে এমন ভাব করে যা আমার পক্ষে নেওয়া সম্ভব হয় না। আমাদের ব্রাঞ্চের বেশিরভাগ ক্রেতা কমতে শুরু করে, তার দূরদর্শিতার অভাবে। কিন্তু সে সব দোষ আমাদের, বিশেষত আমার উপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। রাইদা আমাকে চাকরিটা ছেড়ে দিতে বলে। কিন্তু আমি রাজি হই না। সংসারের বেশিরভাগ খরচ, রাইদার টাকা থেকেই হয়।
…………………………………………………………………………………………………….
সেই একই দুঃস্বপ্ন আসতেই আছে। সবকিছু ধীরে ধীরে আরো বেশি জীবন্ত হয়ে উঠছে। মাহবুব মাইসুরের চেহারা আগের চেয়ে আরো বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বুনো হাওয়ায় ফুলের শুকনো পাপড়ি বৃষ্টির মত ঝরে পড়ে।
একদিন এই একই দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম থেকে উঠে পানি খেতে গিয়ে দেখি, গ্লাসের পানি আমার চেহারার আকার ধারণ করছে। আমি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যায়।
ডাঃ লাবিবের কাছে গেলে তিনি তাঁর চিরাচরিত সাইকোলজিক্যাল বুলি আওড়ে যান। তাঁর মতে আমার কোনও পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার আছে, যা এখনও ডায়াগনোজ করা হয়নি।
সেদিন সবকিছু মিলিয়ে মেজাজ এমনিতেই চড়ে ছিল। তার উপর অফিসেও নতুন ম্যানেজার যা তা ব্যবহার করে। যতক্ষণে আমি অফিস থেকে বের হলাম, ততক্ষণে আমার মেজাজ রীতিমতো তেতে গেছে।
অনেক রাতে আমি যখন বাড়ি ফিরতাম প্রতিদিন, ওই সময়ে ওই রুটের বাসে সাধারণত বেশিরভাগ সময়ে আমি একাই থাকতাম। কিন্তু সেদিন আরো একজন ছিলেন।
হঠাৎ তিনি আমার সিটের কাছে এসে জানতে চাইলেন, “আমি কি তোমাকে চিনি?”
এমনিতেই মেজাজ খারাপ হয়েছিল, তার উপর আবার উটকো ঝামেলা। বিরক্ত হয়ে বললাম, “না, আমার মনে হয় না।”
“কিন্তু আমার মনে হয়, আমি তোনাকে চিনি, আকিফ রহমান।”
আমার রক্ত শুকিয়ে এল। আমি তোতলাতে তোতলাতে বললাম, “কে?”
“তোমাকে দেখে তার কথা মনে পড়ে গেল। কিছু মনে কোরো না।” মানুষটি এসে আমার পাশের সিটে বসে পড়ল। আমি ভাল করে তাকিয়ে দেখলাম, এ আর কেউ নয়, স্বয়ং মাহবুব মাইসুর।
আমি আগের মতই তোতলাতে তোতলাতে বললাম, “ব্যাপারটা কি?”
মাইসুর আমার হাতে একটা ছবি দিয়ে বললেন, “আমি একে খুঁজছি!”
আমি ছবিটা ভাল করে দেখলাম, ছবির লোকটি আসলেই আমার মত দেখতে। আমি জানতে চাইলাম, “কেন?”
মাইসুর ছবিটা ফিরিয়ে নিয়ে পকেটে রেখে বললেন, “এ একটা ক্রিমিনাল। আর তাকে অবশ্যই আইনের আওতায় আসতে হবে। তাকে কঠিন শাস্তি পেতে হবে।”
আমি মাথা নাড়িয়ে বলি, “কিন্তু এটা আমি না!”
মাইসুর নাক সিঁটকিয়ে বলেন, “আমার মনে হয়েছিল, এটা তুমিই।”
আমি বাসের কন্ডাকটরকে বলি, “আমার নামার জায়গা চলে এসেছে। নামিয়ে দেন।”
আমি বাস থেকে নামতেই, মাহবুব মাইসুর পিছন থেকে চিৎকার করে বলেন, “খুব শীঘ্রই সে শাস্তি পাবে।”
খুব শীঘ্রই সে শাস্তি পাবে – এটা আমাকে শোনানোর কী আছে? তার চেয়েও বড় কথা, মাহবুব মাইসুরের অস্তিত্ব বাস্তবে কোথা থেকে এল। সে তো কেবল আমার স্বপ্নের একটা অংশ।
রাতের খাবার খাওয়ার সময় রাইদা বলল, “তোমাকে বেশ চুপচাপ লাগছে আজকে!”
“উম… আজকে একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটেছে।”
সে জোর করতে থাকল জানার জন্য। আমি বললাম, “আজকে বাসে একজন আমার সাথে কথা বলল, কিন্তু সে আমার স্বপ্ন থেকে এসেছে।”
সে চিন্তিত হয়ে জানতে চাইল, ডাক্তারের কাছে আমার আজকে যে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল, তা মিস করেছি নাকি।
“তোমার কথা হয়েছে ডাক্তারের সাথে?”
“হ্যাঁ!”
“কী বললেন উনি?”
“তেমন কিছু না। শুধু বললেন, দুশ্চিন্তা বা চাপ থেকে এরকম হয়ে থাকে।”
রাইদা কণ্ঠে কাঠিন্য এনে বলে, “আমি বুঝছি না, তোমাকে কী বলা উচিত। তোমাকে চাকরিটা ছেড়ে দিতে বললাম, কিন্তু তুমি শুনলে না।”
রাইদা আর কিছু বলে না। সোফায় বসে টিভি দেখতে দেখতে আমার ঘুম চলে আসে। রাইদা আমার পাশেই বসে ছিল।
“আকিফ রহমান,” মাহবুব মাইসুর টিটকারি মেরে বললেন।
“আমি কি জেগে আছি?” আমি জিজ্ঞেস করি তাকে। কারণ, একটু আগে রাইদা যেখানে বসে ছিল, মাহবুব মাইসুর ঠিক সেই জায়গাটিতেই বসে আছেন।
মাইসুর মাথা নেড়ে বলেন, “কোনও পার্থক্য আছে কি?”
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, “আপনার এই খেলায় আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।”
“খেলা? কোনটাকে তোমার খেলা মনে হয়? আমি বহুদিন ধরে তোমাকে খুঁজে, শেষ পর্যন্ত পেয়েছি।” মাইসুর হো হো করে হাসতে থাকেন।
“আমি আপনাকে বলতেই আছি, আমি আকিফ রহমান নই।” উত্তেজিত হয়ে আমি উঠে দাঁড়াই।
মাইসুর পুরো ঘরে চোখ বুলাতে বুলাতে বলেন, “তুমি আকিফ রহমান ছিলে, তুমিই ছিলে।”
“ছিলাম মানে?”
“ছবিটা দেখলে না তখন? ছবির মানুষটা তুমিই ছিলে।”
“আমার মত দেখতে কেউ একজন। হতে পারে ডপলগ্যাংগার।”
“না, আমার তা মনে হয় না। ওটা তুমিই – তোমার পূর্বজন্মের।”
“মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন, আগের জন্মে আমি আকিফ রহমান ছিলাম?”
মাহবুব মাইসুর জোর দিয়ে বললেন, “হ্যাঁ, এটাই সত্যি।”
আমি চিৎকার করে বললাম, “মাহবুব মাইসুর, তুমি পাগল বৈ কিছু নও। না, না – আমিই পাগল হয়ে যাচ্ছি। তাই, তোমাকে দেখতে পাচ্ছি।”
তিনি সজোরে হাত তালি দিয়ে বললেন, “অনেক লম্বা সময়, অনেক লম্বা সময় ধরে আমি তোমাকে খুঁজছি এবং শেষ পর্যন্ত পেয়েও গেছি। তুমি এই পুরো দেশের শত্রু ছিলে। তোমার কঠোরতম শাস্তি হওয়া দরকার।”
“আমার বাসা থেকে এক্ষুনি বেরিয়ে যাও, পুলিশ ডাকার আগেই,” আমি তাকে হুমকি দিলাম।
মাইসুর এগিয়ে এসে আমার মোবাইল ফোনটি আমার হাতে তুলে দিয়ে বলেন, “নাও, নাও, কল দাও।”
আমি তড়িঘড়ি করে ফোনটা হাতে নিয়ে ডায়াল করতেই দেখি, ডায়াল টোন বাজে না। আমার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে থাকে। আমি ফোনটা নামিয়ে রাখতে রাখতে নিজেকে বলতে থাকি, ‘আমি স্বপ্ন দেখছি, এর বেশি কিছু নয়।’
মাহবুব মাইসুর অট্টহাসি দিয়ে বলেন, “শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্তে পৌঁছলে তাহলে?”
আমি তার কথায় গুরুত্ব না দিয়ে, নিজেকে প্রবোধ দিতে থাকি, ‘আমি এখনই জেগে উঠব। তারপর দেখব সব ঠিক হয়ে গেছে।’
মাইসুর আমার চিবুক ধরে বলেন, “অথবা তেমন না হয়ে এমন হবে মনে কর – তুমি পার্কের বাগানে এসেছিলে। তখন শীতের শুরু। তুমি আমাকে দেখতে পাওনি, কিন্তু আমি তোমাকে দেখতে পাই। কি সুন্দর বিকেল ছিল! আমি তোমাকে ফলো করি, যতক্ষণ না তুমি পার্ক থেকে বেরিয়ে যাও। আর তারপরই বোমাটা বিস্ফোরিত হল।”
আমি বিস্ফারিত চোখে বলি, “বোমা? কোন বোমা?”
“আশপাশে অনেক চেঁচামেচি হচ্ছিলো। কিন্তু আমি উঠে দাঁড়াতে পারছিলাম না। অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার আমাকে নড়াচড়া করতে নিষেধ করলেন। ঐ জন্মে ওটাই আমার শোনা শেষ কণ্ঠস্বর ছিল।” মাইসুর বিষণ্ণ কণ্ঠে কথাগুলো বললেন।
আমি চমকে উঠে বললাম, “এসব কিছুই আমার মনে নাই।”
“অবশ্যই তোমার মনে থাকবে না। ঐদিন যে মারা গিয়েছিল, সে তো আর তুমি নও। ৯ নভেম্বর, ১৯৩০,” মাইসুর হাসতে হাসতে বলতে থাকেন, “আমি মারা গিয়েছিলাম, খোদার কসম, ওটা আমি ছিলাম। সেদিনই আমি প্রতিজ্ঞা করি, তোমাকে খুঁজে বের করে, প্রতিশোধ আমি নেবই। তাই, আমরা এখানে। তুমি আর আমি। ঠিক সেদিনের মত, যেদিন পার্কে তুমি আমাকে হত্যা কর।”
আমার গায়ের লোম খাঁড়া হয়ে গেল। “কী বলছ তুমি এসব! আমি কাউকে খুন করিনি।”
তার হাড় জিরজিরে আঙ্গুল আমার দিকে তাক করে তিনি বললেন, “তুমিই আকিফ রহমান।”
হঠাৎ একটা ঝাঁকি খেলাম আমি।
“আকিফ, উঠে পড়।” এটা রাইদার কণ্ঠ।
আমি চমকে উঠে বসি। সে আতঙ্কিত হয়ে বলতে থাকে, “তুমি কোনও খারাপ স্বপ্ন দেখছিলে, মনে হয়।”
আমি কাঁপতে কাঁপতে বলি, “স্বপ্নটা অনেক বেশি জীবন্ত ছিল।”
রাইদা জানতে চাইল, “মাইসুর কে?”
“মাইসুর?”
“হ্যাঁ, তুমি বারবার এই নামটা বলছিলে।”
“সে বলছিল, সে প্রতিশোধের জন্য ফিরে এসেছে।”
রাইদা অবাক হয়ে বলল, “কীসের প্রতিশোধ?”
“তাকে হত্যা করার।”
“তুমি কি কাউকে হত্যা করেছ?” রাইদা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।
পুরো ঘরে তড়িৎ গতিতে চোখ বুলিয়ে আমি দেখে নিলাম, ঐ মাহবুব মাইসুর আবার হাওয়ার মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসছে নাকি। তারপর বললাম, “না, পুরোটাই স্বপ্নের অংশ ছিল।”
রাইদার চোখে মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। “ডাক্তারকে বলতে হবে, তোমাকে যেন ভাল করে দেখে কোন ওষুধ দেন।”
সেদিন কাজে যাওয়ার পথে, বাস থেকে নেমে, পরিত্যক্ত বিল্ডিংটা পার করার সময় খেয়াল করলাম, পরিবেশটা ধীরে ধীরে আমার স্বপ্নের মত জায়গায় রূপ নিচ্ছে। শুকনো ফুলের পাপড়ি আকাশ থেকে ঝরে পড়তে শুরু করে।
হঠাৎ করেই আমি আর শ্বাস নিতে পারছিলাম না। শেষ পর্যন্ত আমি মাথা ঘুরে পড়ে যায়।
যখন আমি চোখ মেললাম, তখন দেখি রাইদা আমার পাশে বসে আছে। কিন্তু আমি আমাদের বাসার বিছানায় শুয়ে নাই। অন্য কোনও জায়গায়- ঠিক চিনতে পারলাম না…
“আমি কোথায়?”
সে ম্যাগাজিনের পাতা উল্টাতে উল্টাতে বলল, “এমারজেন্সি রুমে।”
আমি আতঙ্কিত হয়ে জানতে চাইলাম, “আমি এখানে কীভাবে আসলাম?”
“তুমি রাস্তায় অচেতন হয়ে পড়েছিলে। তোমার সহকর্মীরা দেখতে পেয়ে, এখানে নিয়ে এসেছে।”
আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। সত্যি অনেক বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। তাই, আর কিছু না ভেবে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। কিন্তু চোখ বন্ধ করতেই, আবার সেই একই দৃশ্য। ভয়ে আমি চোখ খুলে ফেললাম।
ডাঃ লাবিব গুনগুন করতে করতে রুমে ঢুকলেন। মুচকি হেসে বললেন, “শুনলাম, ভয় পেয়েছ নাকি?”
রাইদা চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। ডাঃ লাবিব শূন্য চেয়ারটিতে এসে বসলেন। আমি বললাম, “আমি তাকে দেখেছি।”
ডাঃ লাবিব হেসে আমার কাঁধ চাপড়িয়ে বললেন, “হুম! তার মানে তুমি কিছু জিনিস দেখতে পাচ্ছ, যা আমরা দেখতে পাই না!”
আমি ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় বললাম, “না, আমি শুধু তাকে দেখতে পাই। মাহবুব মাইসুর।”
“কে এই ব্যক্তি?”
আমি তাকে বুঝানোর চেষ্টা করলাম, “তিনি আমার স্বপ্নেই আসেন শুধু। এখন বাস্তবেও আসেন মাঝে মাঝে।”
ডাঃ লাবিব শ্রাগ করে বললেন, “সে কী চায় তোমার কাছে?”
“আমাকে মারতে… খুন করতে!” আমি হাঁসফাঁস করতে করতে বললাম।
“হুম!”
“আমি বুঝতে পারছি, এরপর যখনই দেখা হবে, তখনই সে আমাকে মেরে ফেলবে।”
ডাঃ লাবিব আমার হাতে একটা ওষুধ দিয়ে বললেন, “এটা খেয়ে নাও। তাহলে সে আর আসবে না, আসতে পারবে না আর কি।”
তারপর তিনি আমাকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলেন। আমি একটু গাঁইগুঁই করে জানতে চাইলাম, “এটা কীসের ওষুধ?”
“তেমন কিছু না। মাইল্ড সিডেটিভ। তোমার নার্ভকে শান্ত করবে।” ডাঃ লাবিব আমাকে আশ্বাস দিলেন।
………………………………………………………………………………………………………
মানুষটি পার্কের বেঞ্চে বসে আছে। তার পায়ের কাছে অনেকগুলো কবুতর এসে জড়ো হয়েছে৷ মাথা নিচু করে সে তাদের খাবার দিচ্ছে। মাথা না উঠিয়েই, যা করছিল তা করতে করতেই, সে বলল, “আকিফ রহমান। এত তাড়াতাড়ি তোমাকে আবার দেখতে পাব, এটা আশা করিনি।”
হঠাৎ করেই একটা গুলির আওয়াজ পাওয়া গেল। আকিফ ইসলামের মনে হল, তার বুকে কেউ সজোরে ঘুষি মারল। বুকের দিকে তাকাতেই, সে দেখতে পেল, তার সাদা শার্ট লাল হয়ে যাচ্ছে।
………………………………………………………………………………………………………
ডিউটিতে থাকা কেউ বুঝতেই পারল না, আকিফ ইসলামের হৃদস্পন্দন হঠাৎ থেমে গেল কেন! কারণ, তারা কেউই ধূসর চুলের ঐ বৃদ্ধকে দেখতে পেল না, যে ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি নিয়ে ইমার্জেন্সি রুম থেকে নীরবে বেরিয়ে গেল।
(সমাপ্ত)